Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প789 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২.৫ পলায়নের সূত্রপাত

    ১০. পলায়নের সূত্রপাত

    হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার পর্যানে উপবিষ্ট অবস্থায় কোমড় মোচড়ায়। সে ছত্রিশ ঘন্টা আগে শেরশাহের হাতে লাহোর তুলে দিয়ে এসেছে। তার পেছনে তার বাহিনীর অবশিষ্ট লোকেরা, মাত্র হাজার পনের হবে তারা সংখ্যায়, ভাসতে ভাসতে চলেছে বেশীর ভাগই পালিয়েছে। তাঁদের পেছনে গরম ধূলোর ভিতরে প্রায় দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে বেপরোয়া মানুষের কয়েক মাইল দীর্ঘ একটা স্রোত বিশৃঙ্খল অবস্থায়, গাধা, খচ্চর আর মালবাহী শকটে তাঁদের সমুদয় সহায়সম্পদ হাল-বাণ্ডুল করে বোঝাই করে এগিয়ে আসছে।

    ভ্রমণ-ক্লান্ত বণিকদের একটা দল মাত্র চারদিন আগে ঘোড়ার মুখে ফেনা তুলে ছুটতে ছুটতে লাহোরে প্রবেশ করে তাঁরা এতোটাই আতঙ্কিত যে নিজেদের মালবোঝাই খচ্চরের বহর পথের ধারেই পরিত্যাগ করে এসেছে- সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে থাকে যে শেরশাহ শহরের অধিবাসীদের হত্যা করার হুমকি দিয়েছেন। কয়েক ঘন্টা পরে, শেরশাহের কাছ থেকে এক বার্তাবাহক এসে উপস্থিত হয়। তাঁর বহন করে আনা চিঠিটার ভাষা এবং বক্তব্য একেবারে সরল আর স্পষ্ট। শেরশাহ সত্যি সত্যি শহরটা ধ্বংস করে এখানকার অধিবাসীদের হত্যার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু সেটা কেবল হুমায়ুন যদি শহর ত্যাগ করতে অস্বীকার করে।

    লাহোর ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত ঠিক যেমন সে আগ্রা ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল চূড়ান্ত অপমানজনক। কিন্তু শেরশাহের অধীনে বিশাল একটা বাহিনী রয়েছে যা- হুমায়ুনের কাছে যেসব খবর এসেছে তা যদি সত্যি হয় এবং সেগুলোকে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই- তাঁর নিজের বাহিনীর চেয়ে প্রায় বিশগুন বড় সম্ভবত এরচেয়েও বেশী। দূর্গকরণের আর পরিখা খননের আদেশ দেয়া সত্ত্বেও, শহরে কোনো প্রতিরক্ষা দেয়াল থাকায় এতো বিশাল একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে লাহোরকে রক্ষা করার কোনো প্রচেষ্টা অনিবার্য ধ্বংস ডেকে আনবে, এমনকি যদি সে কাবুল থেকে যে বাহিনী আসতে বলেছে তারা সময়মতো এসে পৌঁছালেও।

    হুমায়ুন বিষয়টা কয়েক ঘন্টা বিবেচনা করেই, তাঁর সেনাপতিদের লাহোর পরিত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিতে আদেশ দেয়। শহর পরিত্যাগের খবরটা জানাজানি হতেই, শহরের বাসিন্দারা বিশ্বাস করতে চায় না যে হুমায়ুন চলে যাবার পরে শেরশাহ তাঁদের রেহাই দেবার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটা রক্ষা করবেন। পুরো শহরে দ্রুত একটা অনিয়ন্ত্রিত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নগরদূর্গের একটা পাথরের গম্বুজ থেকে, হুমায়ুন শহরের বাড়িঘর থেকে, বুকের কাছে কাপড়ের পুটলির ভেতরে নিজেদের মূল্যবান সামগ্রী বেধে নিয়ে, উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাদের হাত ধরে, মানুষজনকে পিলপিল করে বের হয়ে আসতে দেখে। কয়েকজনকে বৃদ্ধ বাবা-মাকে পিঠে বহন করতে দেখা যায়। শহরের সংকীর্ণ সড়কে অচিরেই হাতে টানা ঠেলাগাড়ি আর টলতে থাকা ভারবাহী পশুত্র শকটের একটা ভীড় জমে উঠে। শহরের সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে নিজেদের বিচারবুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে উন্মত্ত আর অপদার্থ জনস্রোতে পরিণত হয়েছে, পালিয়ে গিয়ে নিজেদের রক্ষা করার জন্য যারা বেপরোয়া। দোকানে লুটপাট শুরু হয় এবং দুর্বলদের ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং অনেকেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে মানুষের পায়ের নীচে পিষে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা প্রলয়কাণ্ডে পৃথিবীর ধ্বংস হওয়া প্রত্যক্ষ করার মতো মনে হয়।

    রাজপ্রাসাদের কাছে বিশাল কুচকাওয়াজের ময়দান থেকে যেখানে, বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এসে শহরের লোকদের কানে অনুরণিত হতে থাকলে আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে, হুমায়ুনের আদেশে তাঁর বাহিনীর সবচেয়ে বড় ব্রোঞ্জের কামানগুলো, যেগুলো সাথে করে নিয়ে যাওয়া পরিশ্রমসাধ্য আর যা অগ্রসর হবার গতি মন্থর করে দেবে, ধ্বংস করা হচ্ছে। কামানগুলো ষাড়ের দল প্রাণপন শক্তিতে কোনোমতে টেনে খোলা ময়দানে নিয়ে আসে যেখানে হুমায়ুনের গোলন্দাজ বাহিনীর লোকেরা, তাদের দেহের নগ্ন উপরিভাগ থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে, দ্রুত কামানের নল বারুদ দিয়ে পূর্ণ। করছে এবং তুলার লম্বা পলিতা যুক্ত করার পরে- সেটায় অগ্নি সংযোগ করতে, বিকট বিস্ফোরনে উত্তপ্ত, দোমড়ানো, ধাতব খণ্ড বাতাসে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।

    নিজের ভাবনাকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে, হুমায়ুন আড়চোখে তার বামপাশে একটা বিশাল সাদা স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট হিন্দালের শক্তিশালী অবয়বের দিকে তাকায়, সে নিজের ক্ষুদ্র বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে। শেরশাহের বার্তার বিষয়বস্তু শোনার সাথে সাথে হিন্দাল হুমায়ুনকে খুঁজে বের করে এবং তাদের পিতার নামে শপথ করে বলে যে কামরান আর আসকারির আনুগত্য পরিহারের বিষয়ে সে বিন্দুবিসর্গও জানতো না। হিন্দাল ছোট থেকে নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারে

    এবং নিজের এই খুদে সৎ-ভাইটির মুখাবয়বে ফুটে উঠা সংক্ষোভ আর কামরান এবং আসকারির এহেন অপকর্মের প্রতি অবিশ্বাস দেখতে পেয়ে হুমায়ুন তাঁর কথা বিশ্বাস করে। পরে, ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করে সে বুঝেছে তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি ভুল করেনি। অন্যথায়, হিন্দাল কেন লাহোরে থেকে গিয়ে শাস্তির ঝুঁকি নেবে? আর তাছাড়া, কামরান আর আসকারি আপন ভাই। হিন্দাল- হুমায়ুনের মতো তাঁদের কেবল সৎ-ভাই, আর সেজন্য রক্ত ও সম্মানের বন্ধনটাও অনেক দুর্বল। হুমায়ুন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে যেন হিন্দাল মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায় আর আলতো করে হাসে। হুমায়ুন ভাবে, হিন্দাল তার সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়ায় ভালোই হয়েছে। সম্ভবত তাঁদের রাজবংশের বর্তমান বিপদের সময়ে বাবরের সন্তানদের অন্তত দুজন নিজেদের ভিতরে স্থায়ী একটা বন্ধন সৃষ্টি করতে পেরেছে এবং সেটা থেকে শক্তি লাভ করেছে।

    হুমায়ুন তার দ্রুত এগিয়ে আসা শত্রুর সামনে লাহোর পরিত্যাগের আগে সেখানে তাঁদের অবস্থানের একেবারে শেষ মুহূর্তে, সে বাইসানগারকে আলিঙ্গন করে এবং তাকে বিদায় জানায়, সম্ভবত এই শেষবার। তার নানাজানের কাছ থেকে পৃথক হওয়াটা একটা কঠিন কাজ আর তারচেয়েও কঠিন বুড়ো মানুষটাকে রাজি করান যে তাঁর উচিত একদল সৈন্য নিয়ে উত্তর দিকে গিয়ে হুমায়ুনের জন্য কাবুলকে আগলে রাখা। হুমায়ুন তাকে বারবার যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে যে কামরান আর আসকারি তার ভাগ্য বিপর্যয়ের সুযোগ গ্রহণ করে সেখানের রাজত্ব দখল করার চেষ্টা করতে পারে, সেজন্য সেখানে তার মনোনীত শাসকের উপরে সে আর আস্থা রাখতে পারছে না যে বাড়তি সৈন্য পাঠাতে আগেই অনেক কালক্ষেপন করেছে এবং বাইসানগার মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন লোকের অন্যতম তার জন্য কাবুল আগলে রাখবে বলে তাঁর অবিচল আস্থা রয়েছে।

    কথাটা সত্যি কিন্তু এরসাথে আরো একটা কারণও রয়েছে যেজন্য হুমায়ুন চেয়েছে যে তার নানাজান উত্তর দিকে এগিয়ে যাক, যদিও বাইসানগারের কাছে সেটা সে স্বীকার করবে না। যোদ্ধার সত্ত্বা এখনও যদিও তাঁর মাঝে বিদ্যমান এবং তার মস্তিষ্ক এখনও পরিষ্কার, তারপরেও লোকটার বয়স হয়েছে- আশি বছর এমনকি কাশিমের চেয়েও তার বয়স বেশী আর দ্রুত তার শারীরিক সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। হুমায়ুনের সঙ্গী হিসাবে, সে যে দীর্ঘ আর বিপজ্জনক যাত্রায় রওয়ানা হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে: রাভি আর সিন্ধু নদের ভাটিতে ছয়শ মাইল দক্ষিণপশ্চিমে সিন্ধ অভিমুখে, তিনি তাঁর স্বল্প শারীরিক শক্তির নিঃশেষ না করে কাবুলে অনেকবেশী কার্যকর আর নিরাপদে থাকবেন। সিন্ধের সুলতান, মির্জা হুসেন, হুমায়ুনের রক্তসম্পকের আত্মীয়- তাঁর আম্মিজান ছিলেন বাবরের আত্মীয়সম্পর্কিত বোন হুমায়ুনকে আশ্রয় দেয়ার জন্য সে তাই নৈতিকভাবে দায়ী। কিন্তু তার সৎ-ভাইদের চেয়ে, যাদের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক অনেকবেশী গাঢ়, মির্জা হুসেনের কাছে এই নৈতিকতা ঠিক কতখানি মূল্য বহন করে?

    বাইসানগার, একটা পর্যায়ে, হুমায়ুনের যুক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে, তাঁর কথায় রাজি হন। অবশ্য খানজাদা আর গুলবদনকে এতো সহজে রাজি করান সম্ভব হয় না এবং এই যাত্রায় হুমায়ুনকে তাঁদের কাছে পরাভব মানতে হয়। তাঁর ফুপিজান আর সৎ-বোন সরাসরি বাইসানগারের সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। আমার নিজের নিয়তি নির্ধারণের অধিকার আমি অর্জন করেছি, মৃদু কিন্তু দৃঢ়ভাবে খানজাদা বলেন। সাইবানি খানের হারেমে আমি যতবছর নিগৃহিত হয়েছি, ততবছর আমি। নিজেকে কেবল একটা কথাই বলেছি, আমি যদি এই দুরাবস্থা সামলে নিতে পারি তাহলে আমি আর কখনও নিজের ভাগ্য, নিজের জীবনের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাব না যদি কেবল মৃত্যুই একমাত্র বিকল্প হয়। প্রিয় ভাস্তে, আমি তোমার সাথে যাবার নিয়তিই বেছে নিয়েছি। এই কথোপকথনের পুরোটা সময় গুলবদন চুপ করে থাকে কিন্তু হুমায়ুন ঠিকই খেয়াল করে পুরোটা সময় সে কি দৃঢ়ভাবে খানজাদার হাত আকড়ে রয়েছে এবং তাঁর অভিব্যক্তিতে কেমন দৃঢ় একটা সংকল্প ফুটে রয়েছে। খানজাদা যখন নিজের বক্তব্য শেষ করেন গুলবদনও হিন্দাল আর হুমায়ুনের সঙ্গী হবার জন্য নিজের অভিপ্রায়ের কথা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়।

    হুমায়ুন মনে মনে কৃতজ্ঞবোধ করে তাঁরা তাঁর সাথে রয়েছে বলে। তাঁরা শক্তসমর্থ টাটুঘোড়ায় সওয়াড় হয়ে তার পাশে পাশে অবস্থান করে, তাদের নিজস্ব পরিচারিকারদল এবং তার আর হিন্দালের সেনাপতিদের কয়েকজনের জায়া আর কন্যারাও তাদের অনুসরণ করে, যাদের ভিতরে জাহিদ বেগের স্ত্রীও রয়েছে, তিনিও টাটুঘোড়ায় সওয়ার। গতি খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং যাতায়াতের জাঁকজমকপূর্ণ মাধ্যমের, সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে পালকি কিংবা হাওদার পর্দার পেছনে অবস্থানের, সময় এটা না। এসব সত্ত্বেও, মহিলাদের এই ক্ষুদ্র দলটাকে হুমায়ুনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর দল পাহারা দেয় এবং ভারী পোষাকের আড়ালে, চুল বেধে মাথায় আঁটসাঁট টুপি পরিহিত অবস্থায় উৎসুক দৃষ্টির কবল থেকে তাঁদের ভালোমতোই লুকিয়ে রাখা হয়। বাতাস আর ধূলো কবল থেকে রক্ষা করার জন্য মুখের অবগুণ্ঠনের উপরে কেবল তাদের চোখজোড়াই দৃশ্যমান থাকে।

    আরও একজোড়া চোখ তাঁদের সাথে থাকবার কথা ছিল- ধুসর একজোড়া চোখ- হুমায়ুন ভাবে তাঁর আত্মাকে তুষ্ট করতে। লাহোর প্রাসাদ শেষবারের মতো ছেড়ে যাবার পূর্বে হুমায়ুন নতুন খোঁড়া কবরটা দ্রুত জিয়ারত করতে যায় যেখানে দুদিন আগে সালিমাকে দাফন করা হয়েছে। মেয়েটা নিশ্চিতভাবেই তার সাথেই আসতো- এ বিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু শহর ত্যাগ করতে শেরশাহের বেধে দেয়া চূড়ান্ত সময়ের খবরের সাথে সাথে চারপাশের দ্রুত বাড়তে থাকা গোলমালের ভিতরে মেয়েটা হঠাৎ একটা জ্বরের কবলে পড়ে যা সংক্রমনের মাত্র চব্বিশ ঘন্টার ভিতরে তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়। হুমায়ুন যখন নিজের বিশাল হাতের থাবায় তাঁর ছোট্ট হাতের মুঠি আকড়ে ধরে তার ক্ষুদ্র দেহ থেকে প্রাণের শেষ স্পন্দনটুকু মিলিয়ে যেতে দেখে তখন কালঘামে জবজবে অবস্থায় সে চিত্তবৈকল্যের শেষ সময়গুলোতে সে কেবল তাকিয়ে ছিল, ঘোলাটে চোখের দৃষ্টিতে কোনো স্মৃতি ছিল না বা সে তাঁর চোখের অশ্রুও চিনতে পারেনি। মেয়েটার কথা তার বড্ড মনে পড়বে। গুলরুখের আফিম মিশ্রিত সুরা পানের অভ্যাস সে ত্যাগ করার পড়ে এবং শেরশাহের হাতে তাঁর পরাজয়ের পর থেকে আরও বেশী করে সালিমা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, মানসিক দ্বন্দ্ব, প্রাত্যহিক কর্তব্য আর দায়িত্ব থেকে তার শারীরিক প্রশান্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ নিমিত্ত হয়ে উঠেছিল।

    মানুষের অস্তিত্বের নশ্বরতা নিয়ে ভাবনার কিংবা শোক প্রকাশের সময় এখন তার নেই। ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে যাবার সময় একটা প্রশ্নই বারবার হুমায়ুনকে জর্জরিত করেছে। লাহোর ত্যাগ করে কি সে ঠিক কাজটাই করেছে? উত্তরটা অবশ্য বারবার একই পেয়েছে। আসন্ন রক্তগঙ্গার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নির্বিচারে এতো হাজার হাজার নিরীহ নাগরিকদের হত্যা- শহরের উত্তরে রাভি মদীর উপরে স্থাপিত কাঠের সেতুর উপর দিয়ে তার বাহিনীকে পশ্চাদপসারণের আদেশ দেয়া তাঁর সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তাঁর শেষ লোকটা নিরাপদে সেতু অতিক্রমের সাথে সাথে তাকে অনুসরনরত শেরশাহের বাহিনীর গতি খানিকটা হলেও বিঘ্ন করার লক্ষ্যে সে সেতুটা ধ্বংস করে দেয়। সেনাবাহিনীকে অনুসরনকারীরা যে যেভাবে পেরেছে, মাছ ধরার কিংবা নদী পারাপারের নৌকার সাহায্যে, নদী অতিক্রম করেছে।

    কিন্তু হুমায়ুনকে ধাওয়া করার কোনো অভিপ্রায়ই শেরশাহ প্রকাশ করেনি, সে এক নাগাড়ে প্রায় দেড়দিন ঘোড়া দাবড়ে এখন লাহোর থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থান করছে। অতিক্রান্ত প্রতিটা মাইল আর ঘন্টার সাথে সাথে সে আরও বেশী মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে যে পুনরায় সংঘটিত হবার সময় সে পাবে। আরেকটা সুসংবাদ হল যে কামানগুলো সে সাথে করে নিয়ে আসতে পেরেছে- ষাড় দিয়ে টেনে রাভির তীরে নিয়ে এসে নিরাপদে সেগুলো ভেলায় তুলে দিয়ে হুমায়ুনের গোলন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি আর তার সৈন্যদের অধীনে ভাটির উদ্দেশ্যে সেগুলো ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। লাহোর থেকে আড়াইশ মাইল দক্ষিণপশ্চিমে মূলতানে, অবশিষ্ট বাহিনীর সাথে যোগ দেবার জন্য তাঁদের আদেশ দেয়া হয়েছে। সিন্ধের উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রার সময় সৈন্যদের রসদ আর তাদের বেতন দেবার জন্য মোহর আর রত্নপাথরে বেশ ভালো রকমের সম্পদের সাথে সাথে গাদাবন্দুক, বারুদ আর সীসার গুলিও পর্যাপ্ত পরিমাণে তার সাথে রয়েছে। পরিস্থিতি সম্ভবত যতটা খারাপ বলে প্রতিয়মান হচ্ছে ততটা খারাপ না।

    কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন ধুসর আকাশের দিকে তাকাতে হুমায়ুন কিছু মৃত অথবা মৃতপ্রায় জন্তুর উপরে নিঃশঙ্কচিত্তে বৃত্তাকারে দুটো শকুনকে উড়তে দেখে। পানিপথে মোগলদের মহান বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে সে ঈগলদের রণক্ষেত্রের উপরে চক্রাকারে উড়তে দেখেছিল। সম্ভ্রান্ত ঈগল থেকে নোংরা, অশুভ-বিবেচিত, গলিত শবদেহ গোগ্রাসে ভক্ষণকারী…তার সৌভাগ্য কিভাবে হ্রাস পেয়েছে এটা কি তারই একটা প্রতীক? হুমায়ুন তার পিঠে আড়াআড়ি ঝোলান চামড়ার গিল্টি করা তৃণ থেকে একটা তীর তুলে নিয়ে পর্যান থেকে তাঁর দুই বাঁকঅলা ধনুক খুলে নেয় এবং গরম বাতাসে মৃত্যু লেখা তীর ছুঁড়ে দেয়। নিক্ষিপ্ত তীর তার লক্ষ্যবস্তু খুঁজে পায়। সে দ্রুত আরেকটা তীর তুলে এনে ব্যগ্র দৃষ্টিতে আকাশে তাঁর দ্বিতীয় লক্ষ্যটা খুঁজতে গিয়ে দেখে তাঁর মাথার উপরের আকাশ শূন্য খাঁ খাঁ করছে।

    *

    সুলতান, আমার গুপ্তদূতেরা এখান থেকে তিন কি চার মাইল দূরে একটা ক্ষুদ্র অশ্বারোহী বাহিনীকে দ্রুত আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখেছে, আহমেদ খান তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে ধরতে কথাগুলো জানায়।

    আল্লাহ মেহেরবান, আমি যে বার্তাবাহককে মির্জা হুসেনের কাছে পাঠিয়েছিলাম এটা সে না হয়ে যায় না, একদল নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে এখন ফিরে আসছে। কিন্তু তারপরেও সাবধানের মার নেই, সেনাসারির অগ্রগতি মূলতবি রাখ এবং আমার লোকদের বলে দাও নিজেদের অবস্থানের চারপাশে একটা রক্ষণাত্মক ব্যুহ নির্মাণ করতে। কোষাগার আর জেনানাদের প্রহরায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন যেন করা হয়।

    জ্বি, সুলতান।

    ভাগ্য ভালো হলে, মূলতান থেকে দীর্ঘ ছয় সপ্তাহের দুর্গম যাত্রা, যেখানে সে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তার গোলন্দাজবাহিনী আর কামানের সাথে মিলিত হয়েছে এবং তারপরে সিন্ধু নদের তীর বরাবর এগিয়ে এসেছে শীঘই শেষ হতে চলেছে এবং শেরশাহের বিরুদ্ধে কিভাবে প্রত্যুপক্রম সূচনা করা যায় এবার সেটা সে পরিকল্পনা করতে পারবে। হুমায়ুন চোখ কুচকে পশ্চিমের দিগন্তের দিকে তাকায়, সেখানে অতিকায়, রক্তলাল সূর্যটা দ্রুত দিগন্তের ওপাশে বিলীন হচ্ছে। সে অচিরেই সামনের এলোমেলো পাথর আর খর্বকায় বৃক্ষরাজির মাঝে ধূলার একটা মেঘ সনাক্ত করতে পারে এবং তারপরে অশ্বারোহীদের সে দেখতে পায় তারা সংখ্যায় প্রায় ত্রিশজন হবে- একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছে, দিনের শেষ সূর্যের আলোয় তার মাথার ইস্পাতের শিরোস্ত্রাণ ঝিকিয়ে উঠছে। অশ্বারোহী যোদ্ধার দলটা তাদের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে, দলটার ভিতরে প্রায় দুই সপ্তাহ পূর্বে মির্জা হুসেনের কাছে চিঠি নিয়ে যে পত্রবাহকে হুমায়ুন পাঠিয়েছিল আসলেই তাকে দেখতে পায়। নেতৃত্বদানকারী অশ্বারোহী তাঁর মাথার শিরোস্ত্রাণ খুলে, ঘোড়া থেকে নেমে এসে তাঁকে অভিবাদন জানায়।

    মহামান্য সুলতান, আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন। সিন্ধের সুলতান, মির্জা হুসেন তার ভূখণ্ডে আপনাকে স্বাগত জানিয়েছে। তিনি আপনার জন্য এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা অস্থায়ী সেনাছাউনিতে অপেক্ষা করছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে স্বাগত জানাবার সম্মান থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছেন কারণ তিনি চেয়েছেন আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবার সব প্রস্তুতি তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে তদারকি করবেন। আমি তার দেহরক্ষীদলের সেনাপতি এবং আমার লোকেরা আপনার প্রতিরক্ষা সহচর হিসাবে এখান থেকে আপনাকে নিয়ে যাবে।

    হুমায়ুন গাছের গাঢ় ছায়ার মাঝে অস্থায়ী ছাউনির মশালের কমলা রঙের আলো যখন দেখে ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মির্জা হুসেনকে সে বহু বছর আগে একবার দেখেছিল যখন তিনি কাবুল এসেছিলেন বাবরকে সম্মান প্রদর্শন করতে এবং তিনি দেখতে কেমন সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই। অস্থায়ী ছাউনির ঠিক মধ্যখানে, দীর্ঘকায়, পিঠ টানটান করে দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে এবং চমৎকার লাল আলখাল্লার সাথে মাথায় শক্ত করে বাঁধা সোনালী পাগড়ি পরিহিত লোকটা তার এক অর্থে তার কাছে একজন আগন্তুক।

    স্বাগতম, সুলতান। আমার রাজ্যে আপনার আগমন আমাকে সম্মানিত করেছে।

    আমার ভাই, আপনার আতিথিয়তা আমাদের একান্ত কাম্য। আমি আর আমার ভাই আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

    সৌজন্যতা প্রকাশের কৃত্যানুষ্ঠান বজায় থাকার মাঝেই হুমায়ুন ভাবে মির্জা হুসেন লোকটা সুদর্শন যদিও খানিকটা নাদুসনুদুস দেখেতে। নিজের দেহে মেদ জমতে দেবার আগে লোক্টা নিশ্চয়ই একজন ভালো যোদ্ধা ছিল। মির্জা হুসেন কিভাবে নিজের রাজ্যের সীমানা বাড়িয়েছেন এবং সেটাকে স্থায়ী করেছেন সেই বিষয়ে সে বাবরের গল্পগুলো মনে করতে চেষ্টা করে, এমনকি দক্ষিণে তার প্রতিবেশী বাহাদুর শাহের কাছ থেকেই তিনি ভূখণ্ড দখল করেছেন। গুজরাতে হুমায়ুন যখন লড়াই করছিল তখন মির্জা হুসেন সাহায্যের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে বার্তা প্রেরণ করলেও কোনো সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেননি। হুমায়ুনও অবশ্য তাঁর এই আত্মীয় সম্পর্কিত ভাইয়ের কাছে সাহায্য চেয়ে কোনো অনুরোধ করেনি। বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকার কারণে সে গুজরাতের প্রাচুর্যময় ধনসম্পদ প্রয়োজনের চেয়ে বেশী অন্য কারো সাথে ভাগ করতে আগ্রহী ছিল না।

    সুলতান, আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবার সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। আপনার বাসস্থানের কাছেই মেয়েদের থাকবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে এবং আপনার সৈন্যদের জন্য সারিবদ্ধভাবে তাবু তৈরী করা হয়েছে। আজ রাতটা আপনি অবশ্যই বিশ্রাম নিবেন। আপনার জন্য আমি খাবার তৈরী করতে বলে দিয়েছি। আজ থেকে তিনদিন পরে, সারকারে আমার প্রাসাদে আপনারা পৌঁছাবার পরে পুরনো দিনের কথা আমরা আলোচনা করবো।

    হুমায়ুন নিজের মনে ভাবে, সেই সাথে ভবিষ্যতের কথাও। মির্জা হুসেনের সাহায্য তার দরকার অবশ্য যদি সে সাহায্য করতে রাজি হয়। কিন্তু তার পূর্বে অবশ্যই সৌজন্যতা প্রকাশ করতে হবে…

    সেদিন সন্ধ্যাবেলা, নিজের তাবুতে রেশমের কারুকাজ করা গদিতে শুয়ে লাহোর ত্যাগ করার পরে প্রথমবারের মতো হুমায়ুন নিজের ভিতরে প্রশান্তির একটা পরশ অনুভব করে। সে তার পরিবার আর অবশিষ্ট সেনাবাহিনীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে এসেছে। আল্লাহ্ সহায় থাকলে, সে শীঘ্রই পুনরায় যুদ্ধযাত্রা করবে।

    *

    ষাট ঘন্টা পরে গনগনে সূর্যের নীচে একপাশে হিন্দাল আর অন্যপাশে মির্জা হুসেনকে নিয়ে হুমায়ুন সরকারের দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশ করে, যেটা সাগর দেখা যায় এমন একটা উঁচু শৈলান্তরীপের উপরে চওড়া দেয়ালের অভ্যন্তরে অবস্থিত। মূল তোরণদ্বারের উপরে পরিষ্কার আকাশে দুটো নিশান পতপত করে উড়ছে- সিন্ধের টকটকে লাল আর তারপাশে মোগলদের উজ্জ্বল সবুজ। তোরণদ্বার থেকে একটা সংক্ষিপ্ত, কিন্তু খাড়া একটা ঢাল অতিক্রম করে তবে, তিনপাশে আঙ্গিনাযুক্ত সোনালী পাথরের তৈরী প্রাসাদে পৌঁছান যায়।

    প্রাসাদের পশ্চিম ভাগে মধ্যম তলার প্রায় পুরোটা জুড়ে বিলাসবহুল আবাসন কক্ষে নিজেকে থিতু করে, হুমায়ুন হিন্দাল আর কাশিমকে তার সাথে দেখা করতে বলে। নিজের পরিচারকদের, কেবল জওহর বাদে যাকে সে নিজের জীবন দিয়ে বিশ্বাস করে এবং এই মুহূর্তে যে দরজায় পাহারা দিচ্ছে, উৎসুক কানের উপস্থিতি ব্যতীত সে তাঁদের সাথে কিছু আলোচনা করতে ইচ্ছুক।

    হুমায়ুন ইশারায় কাশিম আর হিন্দালকে আসন গ্রহণ করতে বলে। বৃদ্ধ উজির অনেক কষ্টে মেঝেতে উপবিষ্ট হন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোর দুর্ভোগ তাদের মাশুল আদায় করে নিয়েছে। কাশিমকে আগের চেয়ে কৃশকায় দেখায় এবং আগের তুলনায় ঝুঁকে পড়েছেন। কথা শুরু করার আগে তাঁর বৃদ্ধ পরামর্শদাতা নিজেকে গুছিয়ে নেয়া পর্যন্ত হুমায়ুন অপেক্ষা করে। সৌজন্যতার খাতিরে আমি এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলিনি যদিও মির্জা হুসেন ভালো করেই জানেন আমি কেন এখানে এসেছি- যে শেরশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমি তাঁর সাহায্য চাই। অবশ্য শীঘ্রই আমি বিষয়টা উত্থাপন করবো এবং সেজন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই। কাশিম, তার আশেপাশে যারা রয়েছে তাদের কাছ থেকে আপনি কি তার অভিপ্রায় বা ভাবনা সম্বন্ধে কিছু কি জানতে পেরেছেন?

    তার মনে কি খেলা করছে আমি হয়তো সে সম্বন্ধে কিছু অবগত হতে পেরেছি… কাশিম সৌজন্য দেখিয়ে বলে। আপনি যদি একজন ভালো শ্রোতা হন তাহলে দেখবেন মানুষ নিজের অজান্তে অনেকবেশী কথা প্রকাশ করে থাকে…আমি শুনেছি যে আপনাকে স্বাগত জানাবার অনুরোধ জানিয়ে আপনি তাঁকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন মির্জা হুসেন যখন সেটা প্রথম পড়ে, প্রচণ্ড ক্ষোভে সে চিঠিটা প্রথমে ছুঁড়ে ফেলেছিল। তার রাজ্যের সমৃদ্ধ ব্যবসায়ী আর আরব থেকে আগত মাল বোঝাই ঢাউয়ে গিজগিজ করতে থাকা বন্দরকে কোনো ধরনের বিরোধের ভিতরে সে জড়াতে চায় না। তার মনে এমন ভয়ও রয়েছে যে আপনি হয়ত তার রাজ্যই কেড়ে নেবেন…

    তাহলে সে আমাকে স্বাগত জানিয়ে এখানে কেন নিয়ে এলো? সে কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যেতে পারতো, হিন্দাল প্রশ্ন করে।

    হুমায়ুন একটা দুর্বোধ্য আওয়াজ করে। তার কিছু করারও ছিল না। সে আমাদের রক্ত সম্পর্কের ভাই এবং আমার মনে হয় তার কাছে এ বিষয়টার একটা পৃথক আবেদন রয়েছে। তাছাড়া, আমার সাম্প্রতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও আমি নিজের ভূখণ্ড উদ্ধারে আগ্রহী একজন সম্রাট এবং আমি যখন সেটা করবো, তাকে পুরস্কৃত করতে আর তার উচ্চাকাঙ্খাকে আরও বাড়িয়ে তোলার মতো অবস্থানে আমি থাকবো। মির্জা হুসেন এটা ভালো করেই জানে। আর তাছাড়া প্রকাশ্যে বিরোধিতার অভিপ্রায়ব্যতীত সে আমার মুখের উপরে না বলতে পারে না। কিন্তু তাঁর মনে আর হৃদয়ে যাই থাকুক, আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ অবশ্যই আমাকে চিন্তা করতে হবে। গত তিনদিনে শেরশাহের বাহিনীর অগ্রগতির কোনো সংবাদ কি আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে?

    না, সুলতান, কাশিম উত্তর দেয়। পর্যটক আর অন্যান্যদের কাছ থেকে যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি, সে এখনও লাহোর ছেড়ে এগিয়ে আসেনি।

    আর কামরান এবং আসকারির কি খবর?

    সুলতান, বর্তমানে তারা কোথায় রয়েছে সেটা কেউ বলতে পারছে না। কিছু গুজব শোনা যাচ্ছে যে কাবুল নদীর উত্তরে বাদশানে তাঁরা চলে গিয়েছে। কিন্তু সুলতান আমি আগেই বলেছি এগুলো কেবলই গুজব…

    হুমায়ুন ভ্রূ কুচকে তাকিয়ে থাকে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কামরান আর তারসাথে শেরশাহ কি আমার ধারণার চেয়েও গভীর কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। কামরানের বিশ্বাসঘাতকতা করার প্রস্তাব আর শেরশাহের সেটা প্রত্যাখ্যান করা পুরোটাই যদি মানিকজোড়ের একটা চক্রান্ত হয়ে থাকে, লাহোর থেকে আমাকে বের করে আনার জন্য যাতে তারা তাদের বাহিনী নিয়ে আমার বাহিনীকে আক্রমণ করতে আর ধ্বংস করতে পারে, ব্যাপারটা যদি এমন হয়?

    সেটাও সম্ভব, সুলতান, কাশিম মৃদু কণ্ঠে বলে। আমরা সেটা উপেক্ষা করতে পারি না।

    কামরানের পরিকল্পনা সম্বন্ধে আসকারি কতটা জানে সে বিষয়টাও আমাকে ভাবিত করে। শেরশাহের পক্ষে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার ষড়যন্ত্র কি তাঁরা দুজনে একসাথে করেছিল নাকি আসকারি কামরানের সাথে পালিয়েছে কারণ সে ভেবেছে যে আমি কখনও বিশ্বাস করবে না সে ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত নয়?

    হিন্দাল এতক্ষণে কথা বলে। আমি নিশ্চিত আসকারি আগে থেকেই জানতো। কামরান যেখানেই যায় সে সবসময়ে তাঁকে অনুসরণ করে। আমি কোনো ধরনের বিদ্বেষপ্রসুত হয়ে কথাগুলো বলছি না কিন্তু আমার জানার কারণ আছে- আমিও একটা সময়ে তাই ছিলাম।

    আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলছে। কামরানের মতো না, আসকারি দুর্বল এবং বড় ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সে সবসময়ে আতঙ্কিত থাকে, হুমায়ুন মন্তব্য করে। সে কারণেই তার বিশ্বাসঘাতকতায় আমি কম আঘাত পেয়েছি। আমার ছেলেবেলায় কামরানের সাথে বয়সে সে প্রায় আমার সমান- আমি খেলেছি, শিকার করেছি আর তর্কাতর্কি করেছি। আমরা যদিও প্রায়ই ঝগড়া করতাম। মাঝেমাঝে মারামারি পর্যন্ত গড়িয়েছে ব্যাপারটা স্বল্পসময়ের জন্য হলেও আমাদের মাঝে একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল…অনেকটা আপন ভাইয়ের মতো। সে যে আমার মৃত্যু কামনা করতে পারে এই ধারণাটাই আমাকে একই সাথে ক্রুদ্ধ আর শশাকার্ত করে তুলছে…

    দরজায় একটা টোকার শব্দ তার কথার মাঝে বিঘ্ন ঘটায় এবং জওহর কে এসেছে দেখার জন্য ভালোমতো তেল দেয়া বিশাল গোলাপকাঠের দরজার পাল্লাটা খুলতে সে কথা থামিয়ে মৌন হয়ে যায়। হুমায়ুন বাইরে থেকে নীচু গলায় কথোপকথনের শব্দ ভেসে আসতে শুনে, তারপরে জওহর আবার হাজির হয়।

    সুলতান, মার্জনা করবেন, কিন্তু মির্জা হুসেন তার উজিরকে একটা বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন।

    তাকে আসতে দাও।

    হাল্কা-পাতলা কিন্তু নিখুঁত গড়নের অধিকারী চোখে মুখে বুদ্ধিদীপ্ত আর দ্ব্যর্থহীন চাহনির অধিকারী উজির সাড়ম্বরে অভিবাদন জানায়। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন সুলতান, কিন্তু মির্জা হুসেন অনুরোধ করেছেন, আজ রাতের ভোজসভায় আপনি আর আপনার ভাই উপস্থিত থাকলে তিনি সম্মানিতবোধ করবেন।

    অবশ্যই, হুমায়ুন উদারভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আমরা যোগ দিতে পারলে খুশীই হব এবং মির্জাকে তাঁর এই আতিথিয়তার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানাবেন।

    উজির আরো একবার মাথা নত করে এবং কক্ষ থেকে প্রস্থান করে।

    দরজার পাল্লা বন্ধ হওয়া মাত্র, হিন্দালের মুখে হাল্কা হাসির আভাস ফুটে উঠে। একটা ভালো লক্ষণ, আপনার কি তা মনে হয় না? মির্জা হুসেন আমাদের জন্য এর চেয়ে বেশী আর কি করতে…

    তুমি হয়তো ঠিকই বলছে কিন্তু সে হয়তো আমাদের ছোটখাট জিনিষ দিয়ে তুষ্ট করতে চাইছে, একই সাথে আমরা আসলেই যেটা চাই সেটা দিতে অস্বীকার করার সুযোগ খোঁজার অবসরে… আমরা অচিরেই সেটা বুঝতে পারবো…।

    সেদিন সন্ধ্যাবেলা চারপাশে ঘোলাটে গোলাপী রঙের একটা ভাব নেমে আসতে মৃদুভাবে ঢাকের বোল শোনা যেতে থাকে। মির্জা হুসেনের প্রেরিত পরিচারকদের সাথে হুমায়ুন আর হিন্দাল প্রাসাদের কেন্দ্রীয় অংশে উপস্থিত হয় এবং জেসমিন ফুলের পাপড়ি দিয়ে সাজান আর সুগন্ধি তেলের দিয়ার সলতে দ্বারা আলোকিত দীর্ঘ আর চেটালো একটা সিঁড়ি অতিক্রম করে উপরে উঠতে থাকে। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে হুমায়ুন আর হিন্দাল মার্বেলের কারুকাজ করা একটা চৌকাঠের নীচে দিয়ে অতিক্রম করে একটা অষ্টভূজাকৃতি কক্ষে প্রবেশ করে, কক্ষটা দেয়ালের গিল্টি করা মশালদানিতে রক্ষিত জ্বলন্ত মশাল আর রূপার অতিকায় ঝাড়বাতিদানের আলোয় ঝলমল করছে। সোনার জ্বলজ্বল করতে থাকা জরির কারুকাজ করা গালিচা মেঝেতে পাতা আর দেয়ালে মুক্তা আর কাঁচের পুতির ঝালর দেয়া রেশমের উজ্জ্বল রঙের ব্রোকেডের পর্দা ঝুলছে। তাদের ঠিক বিপরীতে রূপার জরির ঠাস বুনোটের কারুকাজ করা কাপড় দিয়ে মোড়া একটা মঞ্চে স্তূপাকারে তাকিয়া রাখা রয়েছে।

    হুমায়ুন আর হিন্দাল প্রবেশ করা মাত্র বাদ্যযন্ত্রীর দল সরব হয়ে উঠে। হাস্যোজ্জ্বল মির্জা হুসেন এগিয়ে আসেন তার ভাইদের স্বাগত জানাতে। হিন্দুস্তানী রীতিতে গলায় মালা দিয়ে তাঁদের বরণ করে নিয়ে মঞ্চের নির্ধারিত সম্মানিত স্থানের দিকে তাদের নিয়ে যায়। তারা আরাম করে বসবার পরে, সে হাততালি দিতে মঞ্চের পাশের একটা প্রবেশ পথ দিয়ে পিলপিল করে বেয়ারার দল প্রবেশ করতে শুরু করে সবার কাঁধে সোনালী গামলায় স্তূপ করা খাবার- কলা পাতা দিয়ে মোড়া সিদ্ধ ভেটকি মাছ কিংবা নারকেলের ঘন ঝোলে ভাসা রান্না করা মাছ, রোস্ট করা হরিণের মাংসের ফালি, মসলা দিয়ে রান্না করা ভেড়ার পাজরের মাংস, সিদ্ধ বেগুনের ঘাট, মটরশুটি দিয়ে রান্না করা পোলাও আর আখরোট এবং কিশমিশ দিয়ে প্রস্তুত নানরুটি।

    সুলতান, শুরু করেন আর যুবরাজ হিন্দাল আপনিও। আমার ভাইয়েরা, অনুগ্রহ করে আহার শুরু করেন আপনারা আজকে আমার সম্মানিত অতিথি। দেখেন, সব উপাদেয় খাদ্য…আমাকে কেবল বলেন কোনো খাবারটা আপনার কাছে। সবচেয়ে উপাদেয় মনে হচ্ছে, আমি নিজে আপনার খাদ্য পরীক্ষকের ভূমিকা পালন করবো। আমার ছাদের নীচে অবস্থানের সময় আপনার ভীত হবার কোনো কারণ নেই…

    আমার ভাই, আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। এবং আমি মোটেই ভীত নই। তার এই ভাইয়ের সাহায্য লাভ করতে হলে হুমায়ুন ভালো করেই জানে তাঁকে বিশ্বাসের প্রাঞ্জল প্রদর্শন করতে হবে। কোনো প্রকারের ইতস্তত ভাব না দেখিয়ে সে এক টুকরো গরম নান তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে রান্না করা মাছের একটা টুকরো মুড়ে নিয়ে মুখে দেয়। খাবার আসলেই উপাদেয় হয়েছে।

    হুমায়ুন পরে যখন তাঁর তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে রয়েছে, মির্জা হুসেন আবার হাততালি দেয় এবং পাশের সেই একই প্রবেশ পথ দিয়ে তিনটা মেয়ে কক্ষের ভিতরে এসে তাঁর সামনে নতজানু হয়, সবার চোখ মাটির দিকে নিবদ্ধ। কয়েক মিনিট পরে, সদ্য ঘুমভাঙা চোখে ভেড়ার চামড়ার জারকিন বাঁধতে বাঁধতে সে এসে হাজির হয়। এত ভোরে ডেকে পাঠানোর কারণে স্পষ্টতই বিভ্রান্ত বাবর তার মুখ থেকে উষ্ণ নিঃশ্বাসের সাদা কুণ্ডলী নির্গত হতে দেখে। এসো, অনেক ঘুমিয়েছো…আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। বাবর তাকে ডেকে বলে। কি?…

    আমার কথা তুমি ঠিকই শুনেছে- এবার চল অলস কোথাকার…

    দশ মিনিট পরে, সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে তাদের ঘোড়া ছুটিয়ে বের হতে দেখা যায়। সূর্যের আলোয় রাতের তুষার গলতে শুরু করায় তাদের ঘোড়ার খুরের কারণে গুটি বসন্তের মত দাগ পড়ে মাটির বুকে। যা কিছুই হোক, বেঁচে থাকা। আর তারুণ্যের চেয়ে মঙ্গলময় আর কিছুই হতে পারে না।

    *

    প্রথমে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। বছরের এই সময়ে, ধুসর প্রায় নিপ্রভ আলো মানুষের চোখকে অনায়াসে প্রতারিত করতে পারে। কোলবা পাহাড়ের দিকে বাবর চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকার মাঝেই সে ভাবে সে আরো লোক দেখতে পেয়েছে- হ্যাঁ: সে ঠিকই দেখেছে- দূরের কালো অবয়বগুলো ঘোড়সওয়ারের।

    ওয়াজির খানও স্থির চোখে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

    উজবেক…?

    আমারও তাই মনে হয়, সুলতান। সম্ভবত অগ্রগামী গুপ্তদূতের দল।

    বাবর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। গত তিন সপ্তাহ ধরে সমরকন্দে গুজব- প্রথম প্রথম অস্পষ্ট, ভিত্তিহীন তারপরে অনেক বিশদ বর্ণনা- ছড়াতে শুরু করেছে। সবাই দেখা যায় দুটো বিষয়ে একমত যে, সাইবানি খান সমরকন্দের পশ্চিমে বোখারায় অবস্থান করে ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তুলছে আর শীতকালটা নিজের লোকদের সাথে একত্রে অতিবাহিত করা সব উজবেক যোদ্ধাকে মোটা পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন।

    বাবরের আদেশে সমরকন্দের অস্ত্র নির্মাতারা, পুরো শীতকালটা যারা কঠোর পরিশ্রম করেছে, এখন তাদের প্রয়াস বৃদ্ধি করে দিন-রাত নাগাড়ে কাজ করছে। বাতাসে এখন কেবল ধাতুর সাথে ধাতুর আঘাত করার শব্দ ভাসছে। তারা চুল্লীতে তীক্ষ্ণ প্রান্ত বিশিষ্ট ফলা আর বর্শার আকৃতি তৈরি করে সেটা নেহাইয়ে রেখে সেটাতে পান দিচ্ছে। অস্ত্রের কোনো কমতি তার নেই এবং সাধ্যমত চেষ্টা করেছে শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে। কিন্তু মানুষ কোথায় পাবে?

    সে ভ্রূকুটি করে। শেষবার গণনা করার সময়ে সংখ্যাটা ছিল সাত হাজার। যার ভিতরে মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজ বাহিনীও রয়েছে যারা পুরোটা শীতকাল শহরেই অতিবাহিত করেছে। উজবেকরা আক্রমণের পাঁয়তারা করছে জানার পরেই সে এই অঞ্চলের অন্য সর্দারদের কাছে দূত পাঠিয়েছে- এমন কি তামবাল আর জাহাঙ্গীরের কাছেও সে লোক পাঠিয়েছে। সমরকন্দের পতনের পরে তাদের সেনাবাহিনী আকশি ফিরে গিয়েছে- সম্মিলিতভাবে সাধারণ শত্রুকে প্রতিহত করার আবেদন জানিয়ে। এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকে কোনো উত্তর আসেনি।

    ওয়াজির খান, আমি উজবেকদের ফিরে আসতে দেখে মোটেই অবাক হচ্ছি না। আমি জানতাম তাদের ফিরে আসাটা কেবল সময়ের ব্যাপার। আপনি যখন অসুস্থ ছিলেন তখন বাবুরী আর আমি প্রায়ই বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতাম… আর সেই বাজারের ছোকরা কি বলতো?

    ওয়াজির খানের কণ্ঠের অপ্রত্যাশিত রুক্ষতায় বাবর অবাক হয়। হতে পারে সে বাজারের ছেলে, কিন্তু তারপরেও তার কথায় যুক্তি আছে…এবং সে সমরকন্দ আর এর লোকদের ভালো করেই চেনে…

    সুলতান, তার ভুলে গেলে চলবে না সে কে, এবং আপনার ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য…আপনি হলেন আমাদের সরতাজ…তার মতো একজন উঁইফোড়ের সাথে আপনি পরামর্শ করছেন বয়োজ্যেষ্ঠ, বিজ্ঞ আর অভিজাত-বংশীয় কাউকে বিবেচনায় না এনে সেটা ভালো দেখায় না…আল্লাহতালা যদি আপনার পিতার হায়াত দরাজ করতেন তাহলে এসব কথা তিনিই আপনাকে বলতেন…

    বাবর পারলে ওয়াজির খানকে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেয়। সম্ভবত এসব তার জানের শত্রু সেই বুড়ির কাজ বাবুরীর প্রতি এসান দৌলত তার বিতৃষ্ণা বা বাবুরীর সাথে তার মেলামেশার ব্যাপারে নিজের আপত্তির কথা কখনও গোপন করার চেষ্টা করেননি। বাবরের তারপরেই মনে পড়ে ওয়াজির খানের কাছে সে নানাভাবে ঋণী আর সম্প্রতি বুড়ো লোকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। তৈমূরের রক্তের উত্তরাধিকারী আর একজন সুলতান এই দুটো বিষয় আমি কখনও ভুলবো না। বাবুরীর সঙ্গ আমার ভালো লাগে…কিন্তু তার পরামর্শ আমি গ্রহণ করি কারণ সেগুলো যুক্তিসঙ্গত। আপনার মতোই আমি যা শুনতে চাই বলে সে বিশ্বাস করে সেরকম মন রাখা কথা বলে না…বরং সে নিজে যা বিশ্বাস করে সেটাই কেবল বলে। তার মানে এই না যে সবসময়ে আমি তার সাথে একমত হই… আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেই…।

    আপনার বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রণাদাতা হিসাবে আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। হতে পারে বাবুরী বিচক্ষণ, কিন্তু একই সাথে সে বদরাগী আর একটা হামবড়া ভাব তার মধ্যে রয়েছে। আপনি যদি তার সাথে আপনার বন্ধুত্বের ব্যাপারে এখনই সতর্ক না হন, অন্যরা তাহলে নিজেদের অবহেলিত মনে করে ঈর্ষান্বিত আর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে…আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই মাঝে মাঝে আমিও এর উর্ধ্বে উঠতে পারি না…

    ওয়াজির খানের চোখমুখের বিব্রতভাব লক্ষ্য করে বাবর আলতো করে তার কাঁধ স্পর্শ করে। আপনি আমার সবচেয়ে বড় সহায় এবং অন্যসব ইচকিসের চেয়ে আমি আপনার পরামর্শ বেশি গুরুত্ব দেই। আমি সতর্ক থাকবো…এখন এসব নিয়ে আর শুধু শুধু বিব্রত হবেন না, মন্ত্রণা সভা আহ্বান করেন। তাদের জানা উচিত আমরা পাহাড়ের উপরে কি দেখেছি…

    [মনে হয় এখানে কিছু একটা মিসিং, কিন্তু বইতে এমনই আছে। পেজ ১৯৪-১৯৫]

    রয়েছে। কেন না? সে মনে মনে ভাবে। বাবর নিজের অবস্থান সুসংহত করতে একাধিক রাজবংশের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলেন। খানম যদিও তাকে খুব একটা আলোড়িত করেনি, তবে তার চাহনীর ভিতরে কেমন একটা মাদকতা রয়েছে। মেয়েটার ধমনীতে তারই বংশের রক্ত বইছে এবং শেরশাহের বিরুদ্ধে সগ্রামে তার বাবা একজন দরকারী বন্ধু হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। বিয়ের দিন ফুলশয্যায় পূর্ণাঙ্গতা পাবে এমন একটা মৈত্রীর সম্বন্ধ করতে বাধা কোথায়? কাশিমের তথ্য প্রথমবারের মতো যেন ভুল বলে প্রতিয়মান হতে চলেছে- মির্জা হুসেন তাঁকে আদতেই সাহায্য করতে ইচ্ছুক। কিন্তু একটা বিষয়ে হুমায়ুন নিশ্চিত। স্ত্রী হিসাবে কাউকে গ্রহণ করার পূর্বে তাকে অবশ্যই তার শত্রুদের পরাস্ত করতে এবং নিজের সিংহাসন সুরক্ষিত করতে হবে। খোলাখুলি কথা বলার এবার সময় হয়েছে।

    মির্জা হুসেন, খানমকে কোনোদিন স্ত্রী হিসাবে বিবেচনা করতে পারলে আমি খুশীই হব। সে আকর্ষণীয় দেখতে, বিষয়নিপূণা একজন রমণী। আমরা ভাবনার পুরোটা জুড়ে যদিও এখন কেবলই যুদ্ধ এবং আমার হারানো ভূখণ্ড উদ্ধারের কথা বিরাজ করছে, বিয়ে নয় এবং সেজন্য আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী। আপনি আপনার আতিথিয়তা আর উপঢৌকনের ব্যাপারে যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছেন কিন্তু আমি আপনার সেনাবাহিনীর সহায়তা চাইছি। আসুন সবার সামনে আমরা আমাদের মৈত্রীর কথা ঘোষণা করি।

    হুমায়ুন কথা শেষ করে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে মির্জা হুসেনকে কৃতজ্ঞ এমনকি উল্লসিত হতে দেখবে বলে প্রতিক্ষা করে। নিজের মেয়ের সাথে মোগল ম্রাটের বিয়ের সম্ভাবনা সুলতানের কাছে কল্পনাতীত একটা বিষয়। কিন্তু সে তাকিয়ে দেখে তাঁর নিমন্ত্রাতার মুখের হাসিতে কেমন যেন আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। তার ঠোঁটের কোণা যেন কঠিন হয়ে, চোখের দৃষ্টিতে এক ধরনের শীতলতা ফুটে উঠেছে। খানম অনেক বাজিয়েছে! এবার আমাদের একটু একলা থাকতে দাও। সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে বলে।

    খানম চমকে উঠে এবং সাথে সাথে বাজানো বন্ধ করে। উঠে দাঁড়িয়ে সে তার পরণের গাঢ় নীল রঙের লম্বা আলখাল্লায় একটা খসখস শব্দ তুলে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করে।

    আমার ভাই, পরস্পরকে আমরা আগে একটু বুঝতে চেষ্টা করি। মির্জা হুসেন আবেগহীন কণ্ঠে কথা শুরু করে। আমি তোমাকে এখানে আসবার জন্য নিমন্ত্রণ করিনি। তুমি নিজে এসেছে। নৈতিকতার খাতিরে আমি তোমায় স্বাগত জানিয়েছি। শেরশাহ, এখান থেকে মাত্র ছয়শ মাইল দূরে- সম্ভবত আমরা সবাই যা জানি তারচেয়েও নিকটে- লাহোরে অবস্থান করছে, তোমার আর আমার সম্মিলিত বাহিনীর চেয়েও বিশাল একটা বাহিনী তার সাথে রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি তার বিরুদ্ধাচারণ করতে চাই না। আমি তোমাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে পারি এবং তুমি যদি প্রতিশ্রুতি দাও যে আমার মেয়ের সম্মান আর সুরক্ষার দায়িত্ব নেবে তাহলে আমি আন্তরিকতার সাথেই তোমার সাথে তার বিয়ের বন্দোবস্ত করতে পারি কিন্তু এর বেশী কিছু প্রত্যাশা করতে যেও না। আমার আশীর্বাদের সাথে খানমকে গ্রহণ করো, তোমার বর্তমান সমস্যা তোমার প্রতি আমার আর কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা থাকবে না এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আমার উপঢৌকন হিসাবে, কিন্তু আমার প্রজাদের আর আমার উপরে তোমার কারণে কোনো বিপর্যয় নেমে আসবার আগেই আমার ভূখণ্ড ত্যাগ কর।

    মির্জা হুসেন ইচ্ছা করেই উচ্চকণ্ঠে কথাগুলো বলেন যাতে সকলে শুনতে পায় এবং হুমায়ুন দেখে হিন্দাল চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে সুলতানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ক্রোধের একটা স্রোত তাঁকে আপুত করে। কাশিমই দেখা যাচ্ছে ঠিক আন্দাজ করেছিল। মির্জা হুসেন, আমিরজাদা তৈমূরের রক্ত আপনার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে কিন্তু তারপরেও আপনার কণ্ঠে যোদ্ধার চেয়ে বেনিয়ার সুরই প্রকটিত…

    মির্জা হুসেনের চোখমুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। হুমায়ুন সন্তুষ্টির সাথে লক্ষ্য করে যে খোঁচাটা একেবারে জায়গামতো বিদ্ধ হয়েছে। কোনো মানুষই এমন কথা শুনতে পছন্দ করবে না। বিশেষ করে নিজের ঘরের নিরাপত্তার মাঝে বসে।

    তোমার পরিকল্পনা বিপজ্জনক, মির্জা হুসেন কোনোমতে বলেন। নিজের ভাগ্য বিপর্যয়ের বিষয়টা মেনে নাও। হিন্দুস্তান ত্যাগ কর। তোমার যেখানে জন্ম হয়েছে সেই কাবুলে ফিরে যাও। সেখানে একটা সমৃদ্ধ রাজত্ব রয়েছে। তুমি যেখানে আগম্ভক সেখানে কোনমতেই তুমি সমৃদ্ধি লাভ করতে পারবে না।

    আপনি নিজের অতীত বিস্মৃত হয়েছেন। আমার মরহুম আব্বাজান হিন্দুস্তান জয় করেছিলেন এবং একটা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা তিনি আমায় দান করে গেছেন। আমি এই স্থানের সাথেই নিজেকে একাত্মবোধ করি। নিজের কন্যা আর কিছু ধনসম্পদ দিয়ে আমায় কেনার কথা চিন্তাও করতে যাবেন না… আমাদের উচিত এসব না করে দুজনে মিলে পরিকল্পনা করা কিভাবে আমার ভূখণ্ড পুনরায় দখল করা যায়। আমরা আমাদের প্রথম বিজয় অর্জন করার সাথে সাথে, অন্যরা আরো একবার আমার নিশানের নীচে এসে সমবেত হবে। কিন্তু আপনি এটা স্বীকার করতে চাইছেন না। বাণিজ্য আপনাকে এতোটাই পৃথুল করে তুলেছে যে আপনি বোধহয় আমাদের যোদ্ধার রীতি ভুলে গিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে এর সাথে সম্পৃক্ত দায়বদ্ধতা আর আকাঙ্খিত লক্ষ্য…

    হুমায়ুন ক্রোধে এতোটাই উন্মত্ত হয়ে পড়ে যে ভুলে যায় তার ভাই ছাড়াও আরো অন্যান্যরা আশেপাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। মঞ্চের নীচে মির্জা হুসেনের কয়েকজন অমাত্য নীচু টেবিলের চারপাশে বৃত্তাকারে উপবিষ্ট রয়েছে এবং সে সহসা তখন চারপাশের নিস্তব্ধতা আর তাঁদের চোখে ফুটে উঠা বিস্ময় সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। এটা কাউকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করা কিংবা কারো সাথে প্রকাশ্য বিরোধিতায় জড়াবার সময় না। হুমায়ুন বহু কষ্টে নিজের মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তুলে যদিও তার খুব ইচ্ছে করছিল তার নাদুসনুদুস এই নিমন্ত্রাতার মাংসল গলাটা টিপে ধরতে। কিন্তু আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আপনার অতিথি। আমি আসলে আমার মনের কথা খোলাখুলি বলে ফেলেছি। মির্জা হুসেন, এসব আলোচনার উপযুক্ত সময় বা স্থান এটা না। আমাকে মার্জনা করবেন। আগামীকাল সকালে আমরা যখন একা থাকবো এবং আমরা যখন উভয়েই বিষয়টা নিয়ে বিবেচনা করার সুযোগ পাব তখন এবিষয়ে আবার আলোচনা হবে।

    কিন্তু মির্জা হুসেনের মুখের অভিব্যক্তি দেখে হুমায়ুন স্পষ্ট বুঝতে পারে যে সিন্ধের সুলতানের কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহায্যের প্রত্যাশা না করাই উত্তম।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড : এম্পায়ার অভ দা মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল : রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }