Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প789 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১.২ এক নিলাজ দুশমন

    ০২. এক নিলাজ দুশমন

    লাল বেলেপাথরে নির্মিত আগ্রা দূর্গের প্রাকার বেষ্টিত প্রাঙ্গনে অবস্থিত জলবুদ্বুদ নিঃসরণরত কৃত্রিম প্রস্রবনের পাশ দিয়ে উঁচু বলভিযুক্ত দরবার হলের দিকে যাবার পথে হুমায়ুনের আগে আগে হেঁটে যাওয়া লম্বা আর সাদা পাগড়ি পরিহিত দুই দেহরক্ষীর বুকের বর্মে সকালের সূর্যের আলো সোনার দ্যোতনা তুলে চিকচিক করে। স্তম্ভযুক্ত দরবার কক্ষের, শীতল বাতাসের অবারিত প্রবাহের জন্য যার তিন দিকই উন্মুক্ত, ভিতর দিয়ে আর সমবেত উপদেষ্টামণ্ডলীর কাতারের মাঝে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে, যারা তার অগ্রসর হবার সাথে সাথে প্রথাগত অভিবাদন জানাবার রীতিতে নিজেদের আনত করে, হুমায়ুন কক্ষের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মার্বেলের বেদীতে আরোহণ করে। সেখানে, পরণের সবুজ রেশমের আলখাল্লাটা সামলে নিয়ে সে তার সোনার পাত দিয়ে গিলটি করা, উঁচু পৃষ্ঠদেশযুক্ত সিংহাসনে নিজেকে উপবিষ্ট করে। তার সাথে আগত দুই দেহরক্ষী তরবারির বাটে হাত রেখে সিংহাসনের ঠিক পেছনে, দুই পাশে অবস্থান গ্রহণ করে।

    হুমায়ুন ইঙ্গিতে তার উপদেষ্টাদের এবার উঠে দাঁড়াতে বলে। তোমরা জান কেন আজ আমি তোমাদের একসাথে এখানে ডেকে এনেছি- সুলতান বাহাদুর শাহের প্রভৃষ্ট ঠাট-ঠমকের বিষয়ে আলোচনা করতে। আমাদের রাজ্যের দক্ষিণপশ্চিমে গুজরাটের সমৃদ্ধ অঞ্চল নিয়ে সে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না, দিল্লীর পরাভূত সুলতান, ইব্রাহিম লোদি যাকে আমি আর আমার মরহুম আব্বাজান তোমাদের চমকপ্রদ সহায়তার দ্বারা সিংহাসনচ্যুত করেছিলাম, তার সন্তানদের সে। শরণ দিয়েছে। তাঁদের সাথে নিজের পারিবারিক বন্ধনের কথা ঘোষণা করে, নিজের চারপাশে মিত্র সংগ্রহ শুরু করেছে সে। রাজপুত আর আফগান গোত্রগুলিকে তার দূতেরা সুকৌশলে বোঝাতে চাইছে যে আমাদের সাম্রাজ্যের ভিত্তি বাস্তবের চাইতে কল্পনার মানসপটে বেশী প্রোথিত। আমাদের সাম্রাজ্য মাত্র দুইশ মাইল প্রশস্ত হবার কারণে সে বিষয়টা নিয়ে ঠাট্টা উপহাস করছে যদিও খাইবার গিরিপথ থেকে এটা হাজার মাইলের বেশী প্রসারিত। বর্বর হানাদার তকমা দিয়ে তারা আমাদের একেবারে খারিজ করে দিতে চাইছে ভোরের শিশিরের মতো সহজেই যাদের শাসনক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যাবে।

    আমরা তাদের এই মনোভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং আমাদের ঘৃণারও অযোগ্য বলে বিবেচনা করি কিন্তু আজ সকালে এক বার্তাবাহক- সারারাত ঘোড়া দাবড়ে আসবার কারণে পরিশ্রান্ত- খবর নিয়ে এসেছে যে বাহাদুর শাহের একদল সৈন্য, যার নেতৃত্বে ছিল লোদি রাজ্যাভিযোগী তার্তার খান, আমাদের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে হামলা করেছে। আগ্রা থেকে মাত্র আশি মাইল পশ্চিমে, আমাদের অনুগত এক রাজপুত জায়গিরদারের প্রেরিত উপহারসামগ্রী বহনকারী কাফেলা তারা দখল করেছে। আমি নিশ্চিতভাবে এখন কেবল এটুকুই বলতে পারছি। আমরা কদাপি এমন অসম্মান সহ্য করবো না। আমাদের উচিত এবং অবশ্যই আমরা সুলতানকে এজন্য সমুচিত শিক্ষা দেব। আমাদের উচিত তাঁকে পরাস্ত করা কিনা সে বিষয়ে আলোচনার জন্য আমি আজ তোমাদের এখানে আসতে বলিনি, আমি তোমাদের ডেকেছি কিভাবে সেটা সবচেয়ে ভালোভাবে করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করতে। হুমায়ুন দম নেয়ার জন্য কথা বন্ধ করে এবং পুনরায় শুরু করার আগে চারপাশে নিজের উপদেষ্টাদের দিকে ভালো করে তাকায়।

    হুমায়ুনের আত্মীয়-সম্পর্কিত এক ভাই, এবং তার অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি, সুলেইমান মির্জা প্রথম নিজের মতামত প্রকাশ করে। বাহাদুর শাহকে মত দেয়াটা খুব একটা সহজ হবে না। সেটা করতে যাবার আগে নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের বিষয়টা একটু বিবেচনা করা উচিত। আপনার মরহুম আব্বাজান যখন দিল্লী জয় করেছিলেন তখনকার কথা আলাদা ছিল, এখন আমাদের শত্রুর চেয়ে আমাদের সৈন্য সংখ্যা, আর যুদ্ধোপযোগী রণহস্তি আর ঘোড়ার সংখ্যা অনেকবেশী। সবগুলো প্রাণীই বেশ ভালোভাবেই প্রশিক্ষিত আর সৈন্যরা বিশ্বস্ত। বাহাদুর শাহের উপচে পড়া রাজকোষ থেকে লুণ্ঠিত দ্রব্যের সম্ভাবনা যুদ্ধের জন্য তাদের আগ্রহকে জোরদার করবে। কিন্তু হিন্দুস্তানে মোগলদের প্রথমবার আগমন আর এখনকার বাস্তবতার মাঝে একটা পার্থক্য রয়েছে। এইবার, কেবল আমরাই না- উভয়পক্ষের কাছেই কামান আর ম্যাচলক গাদাবন্দুক রয়েছে। সুলতান মক্কায় হজ্জ পালন করতে যেসব হজ্জযাত্রী খোলা সমুদ্র অতিক্রম করে সেখানে যায় আর দূরদুরান্ত থেকে আগত বণিককের দল যারা ক্যাম্বে আর সুরাটে অবস্থিত তার সমুদ্রবন্দরে আশেপাশে ভীড় করে উপরে আরোপিত কর থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ অসংখ্য কামান আর বন্দুক কেনার জন্য ব্যয় করেছে এবং অভিজ্ঞ অটোমান অস্ত্রনির্মাতাদের রাজি করিয়েছে তার ঢালাইখানায় কাজ করতে। প্রতিটা যুদ্ধে আমাদের পক্ষে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর উপস্থিতিই যথেষ্ট এমন আত্মশ্লাঘা আমরা আর করতে পারি না। তাদের উপস্থিতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তার আগে আরো একবার আমাদের কৌশল পরিবর্তন করার সময় হয়েছে।

    হ্যাঁ, তোমার বক্তব্য বিষয় সহজেই বোধগম্য হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধের বাস্তবতায় এটা কিভাবে অর্থবহ হয়ে উঠবে? মাথার টিকি ধরে টানার অবসরে বাবা ইয়াসভালো জানতে চায়।

    মহামান্য সম্রাটের আব্বাজান সম্রাট বাবর তাঁর জীবনের শেষ লড়াইগুলোতে যে কৌশল ব্যবহার করেছিলেন এর সাথে তার যৌবনে অনুসৃত কৌশলের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে, সুলেইমান মির্জা উত্তর দেয়। অশ্বারোহী তীরন্দাজদের নিয়ে গঠিত হামলাকারী বাহিনীকে প্রথমে গুজরাটে পাঠান যেতে পারে বাহাদুর শাহের বাহিনীকে তাঁরা যেখানেই দেখতে পাবে সেখানেই তাঁদের আক্রমণ করবে এবং বাহাদুর শাহ তাঁদের বিরুদ্ধে নিজের সৈন্যদের সন্নিবেশিত করার অনেক আগেই তারা বাতাসে মিলিয়ে যাবে। আমাদের মূলবাহিনী কোথা থেকে আক্রমণ করবে সে বিষয়ে তাঁকে একটা বিভ্রান্তির ভিতরে ফেলে দিতে হবে এবং এই পুরোটা সময়ে আমরা রণহস্তি আর গোলন্দাজদের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের মূল বাহিনী নিয়ে তাঁর ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে নিশ্চিত নির্ভরতার সাথে এগিয়ে যাব।

    হুমায়ুনের অধিকাংশ উপদেষ্টাই যদিও মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে, কিন্তু বাবা ইয়াসভালো প্রশ্ন করেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের মূল বাহিনীর নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু কি হওয়া উচিত?

    গুজরাটের গহীন জঙ্গলে অবস্থিত চম্পনির দূর্গ লক্ষ্যবস্তু হলে কেমন হয়? হুমায়ুন প্রস্তাব করেন। বাহাদুরের রাজকোষের একটা বিপুল অংশ এখানে রক্ষিত আছে। আমরা যদি এটা কুক্ষিগত করতে পারি সে বিষয়টা মেনে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের অবরোধকারী বাহিনীর কাছ থেকে একে মুক্ত করতে সে। বাধ্য হবে আক্রমণ করতে।

    সেতো বুঝলাম, কিন্তু আমরা আমাদের অবরোধকারী বাহিনীর পেছনের হুমকি কিভাবে মোকাবেলা করবো? সুলেমান মির্জা জানতে চায়।

    বাবা ইয়াসভালো এবার তার প্রশ্নের উত্তর দেয়, আসন্ন যুদ্ধের ভাবনায় তাঁর চোখ চকচক করছে। সময়ের বরাভয় আমাদের পক্ষে থাকবে। আমরা আমাদের কামানগুলো মাটি খুড়ে এমনভাবে স্থাপণ করতে পারি যাতে তাঁরা দূর্গ আর পেছন থেকে আগুয়ান বাহিনীর উপর একই সাথে গুলিবর্ষণ করতে পারে, এবং আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে এমনভাবে বিন্যস্ত করবো যাতে তাঁরা দুপাশেই যুদ্ধ করতে পারে। বাহাদুর শাহ যদি অবরোধ ভাঙা চেষ্টা করে তাহলে সে বিপজ্জনক এক চমকের সম্মুখীন হবে।

    আপনার বক্তব্যের মাঝে কোনো খুঁত নেই, হুমায়ুন বলে। গুজরাতের সীমানা অতিক্রমকারী প্রথম হানাদার বাহিনীর নেতৃত্বে আমি নিজে থাকব। বাহাদুর শাহ যখন শুনবে- কথাটা নিশ্চয়ই তার কানে পৌঁছাবে- যে আমি নিজে লড়াইয়ের ময়দানে উপস্থিত আছি, আমাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে এটা তাকে আরও বেশী বিভ্রান্তির ভিতরে ফেলে দেবে। সুলেমান মির্জা, আমি বাবা ইয়াসভালো আর আপনার উপরে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সম্পূর্ণ নির্ভর করছি। আলোচনা আজ এই পর্যন্তই মূলতবী থাকল।

    কথাটা বলেই হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর দুই দেহরক্ষী আরও একবার তার সামনে অবস্থান নিয়ে আঙ্গিনার অপর প্রান্তে তার খাস কামরার দিকে ধীরে ধীরে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। সেখানে পৌঁছাবার পরে সে জওহরকে, তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরিচারক আর রাজ-অনুচর লম্বা, সুদর্শন চেহারার এক তরুণ যার বাবা বাবরের দেহরক্ষী বাহিনীর একজন অধিনায়ক ছিলেন পাঠায় তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষীকে একঘন্টার ভিতরে তাঁর সামনে উপস্থিত হবার আদেশ দিয়ে যাতে তাঁর এই অভিযান শুরু করার সবচেয়ে মাঙ্গলিক সময় গণনা করা যায়। তাঁর যুদ্ধ পরিকল্পনা খুব দ্রুতই নির্ধারিত হয়। তাঁর আক্রমণ শুরু করার সময়ের প্রতি জ্যোতিষীর রাশিফল আর গণনার বরাভয় রয়েছে এই দৃঢ় আশ্বাস সম্রাট হিসাবে সে যখন তাঁর প্রথম অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে তখন তাঁর নিজের আত্মবিশ্বাস আর সেই সাথে তার বাহিনীর মনোবলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

    ইত্যবসরে সে তার অভিযানের জন্য নির্বাচিত তার পছন্দের সেনাপতিদের বিষয়ে তাঁর ফুপু খানজাদার বিজ্ঞ পরামর্শের জন্য তাঁর সাথে ঘন ঘন সাক্ষাৎ করে এবং এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অন্য আরেকটা বিষয়ে সে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সাথে আলোচনা করতে চায়। সে অভিযান পরিচালনা করতে যখন দূরদেশে যাবে তখন তাঁর সৎ-ভাইদের তাদের আপন আপন প্রদেশে স্বাধীনভাবে রেখে যাওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে- কামরান রয়েছে উত্তরপশ্চিম দিকে পাঞ্জাবে, আসকারি পূর্বদিকে জুনাপুরে আর হিন্দাল রয়েছে পশ্চিম দিকে আলওয়ারে? তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার এই সুযোগের কি তাঁরা সদ্ব্যবহার করবে? তাঁর কি উচিত তাঁর সেনাবাহিনীতে তাদের সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া এবং সাথে করে গুজরাতে নিয়ে যাওয়া যাতে সে তাদের উপরে লক্ষ্য রাখতে পারে?

    তাদের নিজ নিজ প্রদেশ থেকে যে সংবাদ তার কাছে এসেছে তাতে এখনই উদ্বিগ্ন। হবার মতো কোনো কারণ নেই, বিশেষ করে হিন্দাল আর আসকারির ক্ষেত্রে তারা তাঁদের প্রশাসনিক বিষয়ের সবকিছু খুটিনাটি তাকে নিয়মিত লিখে পাঠায় এবং তাদের প্রদেয় কর পুরোপুরি প্রদান করে কখনও সময়ের আগেই। কামরানও তাঁর প্রদেশের রাজস্বের ন্যায্য হিস্যা ঠিকমতোই প্রদান করে যদিও তার প্রেরিত দাপ্তরিক বিবরণী অনিয়মিত আর সংক্ষিপ্ত। কখনও কখনও হুমায়ুনের দরবারের কোনো অসন্তুষ্ট কর্মকর্তা কামরানের প্রদেশে যায় সেখানে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে। আবার কখনও গুজব শোনা যায় যে কামরান তার প্রাদেশিক প্রয়োজনের তুলনায় বিশাল সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে, কিন্তু এসবই শেষ পর্যন্ত ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয় বা আঞ্চলিক বিদ্রোহ দমন বা অন্য কোনো কারণের দ্বারা সৈন্য সমাবেশের বিষয়টার ন্যায্যতা প্রতিপাদিত হয়।

    কিন্তু কামরান তার উচ্চাকাঙ্খ পরিত্যাগ করার বান্দা না আর সে কেবল কালক্ষেপন করছে আর প্রস্তুত হচ্ছে হুমায়ুনের কোনো দুর্ভাগ্যকে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহারের জন্য এই অনুভূতি থেকে হুমায়ুন কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। তবে তাই হোক। কামরান কোনো কারণে যেন এমন কোনো সুযোগ না পায় সেটা সে নিশ্চিত করবে। সে যাই হোক, এমনও হতে পারে কামরানের, আর সেই সাথে আসকারি আর হিন্দাল, তাঁদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে এবং তারা হুমায়ুনের মহানুভবতার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ যেমনটা তাঁদের কাছ থেকে কাম্য, তার এই বিচার ভুল হয়েছে। সে আশা করে তাঁর প্রথম ধারণাটাই সঠিক। যদি কোনো কারণে ব্যাপারটা এমন না হয়, তাঁর নানাজান আগ্রা থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত সে বাহাদুর শাহর বিপক্ষে কোনো ধরনের অভিযান শুরু করবে না। তিনি এবং হুমায়ুনের উজির কাশিম কাবুল থেকে ফিরে আসবার কয়েকদিন পরেই দিল্লীতে শাহী খাজানা পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে গিয়েছেন, আশা করা যায় কয়েক দিনের ভিতরেই তারা ফিরে আসবেন। হুমায়ুন তখন তার অনুপস্থিতিতে বাইসানগারকে রাজপ্রতিভূ নির্বাচিত করবে। সে তার নানাজানকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারে- সেই সাথে কাশিম আর খানজাদাকেও তারা তাঁর কলহপ্রিয় সৎ-ভাইদের উপরে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।

    তাঁরা তাঁর আম্মিজানকেও দেখে রাখবে। বাবরের অসময়োচিত মৃত্যুর পরে পার্থিব বিষয়ে মাহামের যে সামান্য আগ্রহ ছিল সেটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নিজের সন্তান সম্রাট হবার কারণে সে যদিও গর্বিত কিন্তু সে কখনও তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করে না বা খানজাদার মতো তাকে কোনো পরামর্শও দিতে আসে না। হুমায়ুন তাঁর সাথে যেটুকু সময় কাটায় সে তখন আকুল হয়ে কেবলই অতীতের কথা রোমন্থন করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে হয়তো বুঝতে পারবে যে ভবিষ্যতের ব্যাপারে ব্যাপৃত থাকাই এখন হুমায়ুনের জন্য বাঞ্ছনীয়।

    *

    একটা বেলেপাথরের পাহাড়ী ঢালের উপর থেকে হুমায়ুন বাহাদুর শাহের সৈন্যদের লম্বা সারির দিকে তাকিয়ে থাকে, যারা তাঁর উপস্থিতি সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন, চারশো ফিট নীচে নদীর তীর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগোবার সময়ে পায়ের আঘাতে ধূলোর মেঘ সৃষ্টি করছে। বছরের এই সময়ে- মার্চ মাসের গোড়ার দিকে, সে আগ্রা ছেড়ে আসবার পরে ইতিমধ্যে দুই মাস অতিক্রান্ত হয়েছে- নদীর বেশীর ভাগ অংশই শুকিয়ে গিয়েছে কেবল নদীগর্ভের গভীর অংশে কয়েকটা বিক্ষিপ্ত জলাশয় বিরাজ করছে। নদীর তীরে একটা বেমানান তালগাছ সবুজের স্পর্শ হয়ে বিরাজ করছে। হুমায়ুন সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত পদাতিক সেনাদলের সামনে পিছনে অশ্বারোহীবাহিনীর ছোট দল দেখতে পায় এবং এসব আয়োজনের ঠিক মধ্যে একটা মালবাহী গাড়ির একটা বিশাল সারি।

    সাফল্যের হাসি লুকিয়ে রাখতে অপারগ, হুমায়ুন তার পর্যাণের উপরে ঘুরে বসে জওহরের সাথে কথা বলার অভিপ্রায়ে, এই অভিযানে তাঁর অনুচর- কর্চি হিসাবে সে তার সাথে এসেছে। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমাদের প্রেরিত রেকিদল ভালোই কাজ দেখিয়েছে আর আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। আমাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে গুজরাতিদের কোনো ধারণাই নেই। এখন দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে পেছনে যার যেখানে আমরা আমাদের বাকি সঙ্গীসাথীদের রেখে এসেছি। তাদের বলবে আমার আদেশ পাহাড়ী ঢাল বরাবর তাঁরা এগিয়ে আসবে, কিনারা থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে যেন নীচে থেকে তাদের কেউ দেখতে না পায় যতক্ষণ না তারা মাইলখানেক বা আরো কিছুটা সামনে যেখানে ঢালটার নতি অনেকটা সহনীয় হয়ে এসেছে আমাদের শত্রুর উপরে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে। তাদের বলবে আমি আমার দেহরক্ষীবাহিনী নিয়ে সেখানে তাদের সাথে যোগ দিব।

    জওহর মাথা নাড়ে এবং ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে রওয়ানা দেয়। হুমায়ুন যখন তাঁর দেহরক্ষীদের নিয়ে পাহাড়ের ঢালের কিনারা থেকে সরে এসে পূর্ব নির্ধারিত মিলনস্থলের দিকে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়, সে নিজের ভিতরে আশঙ্কা আর উত্তেজনার একটা মিশ্র অনুভূতি নিজের ভিতরে অনুভব করে যুদ্ধের আগে সব সময়ে তার এমনই অনুভূত হয়, কিন্তু পূর্বের চেয়ে এবার দায়িত্ববোধের একটা বাড়তি বোঝা সে নিজের উপরে অনুভব করে। পূর্বে, তার মরহুম আব্বাজান, তিনি যদি সমূহ যুদ্ধক্ষেত্রে নিজে উপস্থিত নাও থাকতেন, পুরো অভিযানের সামগ্রিক পরিকল্পনা অনুমোদন করতেন আর সিংহাসন তাঁর আব্বাজানের এক্তিয়ারভুক্ত- তার নিজস্ব নয়- যা ছিল হুমকির মুখে। ভাবটা মাথায় আসতেই হুমায়ুনের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় এবং সে তার সাথের লোকদের কিছুক্ষণের জন্য যাত্রাবিরতি করতে আদেশ দেয়। সে কি নিশ্চিত- যতটা নিশ্চিত তার পক্ষে হওয়া সম্ভব- যে তার পরিকল্পনা কার্যকরী হবে- সে কি অভিযানের প্রতিটা অনুষঙ্গ যথেষ্ট সময় নিয়ে যাচাই করেছে যাতে ভাগ্যের উপরে যতটা কম সম্ভব নির্ভর করতে হয়? সে যখন এসব ভাবনায় বিপর্যস্ত তখন সে দুটো খয়েরী রঙের অতিকায় বাজপাখিকে পাহাড়ী ঢলের আড়াল থেকে অনায়াস স্পর্ধায় উপরের মেঘহীন নীল আকাশের দিকে উড়ে যেতে দেখে প্রসারিত ডানায় উষ্ণ বাতাসের বরাভয় তাদের ঊর্ধ্বমুখী উড়ান নিশ্চিত করেছে। সহসা তাঁর মনে পড়ে যায় পানিপথের যুদ্ধের সময় দেখা সেই ঈগলদের কথা যা একটা শুভ লক্ষণ বলে প্রমাণিত হয়েছিল। এই পাখিগুলোও নিশ্চিতভাবেই সেটাই আবারও প্রমাণিত করবে যখন সে তার গুজরাত অভিযানের প্রথম আঘাত হানতে চলেছে।

    নিজের সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, হুমায়ুন তার অবশিষ্ট বাহিনীর সাথে মিলিত হবার জন্য নির্ধারিত মিলনস্থলে পৌঁছে। পুরো বাহিনী রণসাজে বিন্যস্ত হওয়া মাত্র, হুমায়ুন দ্রুত আক্রমণের আদেশ দেয় যা দুটো উপর্যুপরি ঢেউয়ের মতো পরিচালিত হবে। খাড়া উত্রাই বেয়ে বল্পিতবেগে নীচের দিকে ঘোড়া নিয়ে ধেয়ে আসা আক্রমণের প্রথম স্রোত, শত্রুর সেনাসারির পেছনের দিকটা সম্পূর্ণভাবে মোকাবেলা করবে। আক্রমণের পরের স্রোতটা সেনাসারির সামনের যোদ্ধাদের পুরোপুরি ঘিরে ফেলবে যখন তারা থমকে থেমে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করবে তখন তাদের মাঝে সৃষ্ট বিভ্রান্তি কাজে লাগিয়ে আক্রান্ত পেছনের যোদ্ধাদের সহায়তা করতে সম্মুখের যযাদ্ধারা এহেন আচরণ করতে বাধ্য। হুমায়ুন ময়ান থেকে তার আব্বাজানের প্রিয় তরবারি আলমগীর বের করে এর রত্নখচিত বাটে চুমু খায় এবং তার লোকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, তোমাদের মনে নিয়ে এসো যোদ্ধার তেজস্বিতা আর কণ্ঠে বীরের দম। আমাদের সদ্য জয় করা ভূখণ্ড রক্ষার জন্য আমরা লড়াই করছি। এসব অহঙ্কারী ভূঁইফোড়দের কাছে আমরা প্রমাণ করবো যে সাহসিকতার জন্য আমাদের সনাতন খ্যাতি আমরা হারিয়ে ফেলিনি। তারপরে মাথার উপরে উত্তোলিত তরবারি আন্দোলিত করে হুমায়ুন আক্রমণের ইঙ্গিত করে এবং কাছাকাছি অবস্থানরত দেহরক্ষীদের সাথে নিয়ে তাঁর বিশাল কালো স্ট্যালিয়নের পাঁজরে খোঁচা দিয়ে ঢাল বেয়ে আক্রমণের জন্য ধেয়ে যায়।

    পাহাড়ের গা বেয়ে তারা যখন নীচের দিকে ধেয়ে আসে, পাথরকুচি আর লাল ধূলো তাদের চারপাশে উড়তে থাকে, এরই ভিতরে সে তার সামনে গুজরাতি সেনাদলকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে যখন লোকগুলো তাঁর দিকে ঘুরে তাকায় কিসের এতো শোরগোল সেটা দেখতে। পুরোপুরি অপ্রস্তুত গুজরাতিরা প্রথমে ইতস্তত করে এবং তারপরে তাদের জন্য সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে এমন শ্লথ ভঙ্গিতে তাঁরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে শুরু করে, তাদের যুদ্ধাস্ত্রের জন্য হাতড়াতে থাকে এবং চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে চারপাশে তাকাতে থাকে তাদের আধিকারিকদের খোঁজে দেখতে চায় তাদের কি আদেশ। কালো শুশ্রুমণ্ডিত এক লোক বাকিদের চেয়ে অনেক দ্রুত, লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নামে এবং তার পর্যাণের সাথে মোটা কাপড়ের ব্যাগের সাথে বাঁধা মাস্কেট টেনে বের করতে চেষ্টা করে।

    হুমায়ুন তার ঘোড়ার মুখ বন্দুকধারীর দিকে ঘুরিয়ে দেয় এবং ডানহাতে নিজের তরবারি আকড়ে ধরে সে যখন তার ঘোড়ার গলার কাছে নুয়ে এসে তার বাহনকে বিড়বিড় করে সামনে ধেয়ে যেতে বলে, নিয়তি আর নেতৃত্বের সব ভাবনা তার মন থেকে তিরোহিত হয়ে সেখানে ভর করে মারা, মরা, বেঁচে থাকার আন্ত্রিক প্রবৃত্তি। নিমেষের ভিতরে সে লোকটার কাছে পৌঁছে যায়, যে তখনও তার মাস্কেটে বারুদ ভরার জন্য কসরত করে চলেছে। হুমায়ুন তার শশ্রুমণ্ডিত মুখ বরাবর তরবারি চালায় এবং লোকটার ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসলে সে মাটিতে আক্রমণকারী অশ্বারোহী বাহিনীর খুরের নীচে পরে যায়। হুমায়ুন ততক্ষণে শত্ৰুসারির অনেক ভেতরে প্রবেশ করেছে, অশ্বারূঢ় হয়ে সামনে এগিয়ে যাবার সময়ে সে দুপাশে পাগলের মতো তরবারি চালাতে থাকে। অকস্মাৎ ভীড়ের মাঝ থেকে বের হয়ে আসতে সে তার হাঁপাতে থাকা, উত্তেজনায় নাক টানতে থাকা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে তার বাকি লোকেরা অচিরেই তার চারপাশে এসে জড়ো হয়।

    অবিলম্বে যথেষ্ট লোক তাঁর সাথে সমবেত হলে, হুমায়ুন দ্বিতীয়বারের মতো শত্রুর সেনাসারির দিকে ফিরতি আক্রমণ শানায়। এক ঢ্যাঙা গুজরাতি তার হাতের বাঁকান তরবারি দিয়ে তাঁকে আঘাত করলে সেটা বুকের বর্মে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং হুমায়ুনকে তাঁর পর্যাণে ছিটকে ফেলে। হুমায়ুন যখন তার পিছু হটতে থাকা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করতে প্রাণান্ত হচ্ছে, সেই সুযোগে গুজরাতি সেনাটা এবার তার দিকে ঘোড়া নিয়ে ধেয়ে আসে এবং নিজের প্রতিপক্ষকে খতম করার অতি-উৎসাহে, হুমায়ুনের মস্তক বরাবর সে তার আন্দোলিত তরবারির নিশানা স্থির করে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে হুমায়ুন তরবারির আগ্রাসী ফলার নীচে ঝুঁকে যায় যা তাঁর শিরস্ত্রাণের সামান্য উপর দিয়ে বাতাস কেটে বের হয়ে যায়। গুজরাতি নিজের ভারসাম্য ফিরে পাবার আগেই, হুমায়ুন দ্রুত আলমগীরের ফলা এক ধাক্কায় তাঁর উদরের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়। লোকটা তরবারি ফেলে নিজের ক্ষতস্থান চেপে ধরতে, হুমায়ুন ঠাণ্ডা মাথায় এবং ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিপক্ষের গলার পেছনে আঘাত করে, কাঁধ থেকে তাঁর মাথা প্রায় আলাদা করে ফেলে।

    নিজের চারপাশে তাকিয়ে, আন্দোলিত লাল ধূলোর ভিতর দিয়ে হুমায়ুন দেখে যে গুজরাতি সেনাসারি ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। অশ্বারোহী বাহিনীর কিছু সৈন্য আতঙ্কে ঘোড়া দাবড়ে পালাচ্ছে। সেনাসারির মাঝে অবস্থানরত অন্যেরা অবশ্য দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে, মালবাহী গাড়িগুলো রক্ষা করছে যেগুলোতে সম্ভবত কামান আর মালপত্র আছে। হুমায়ুন ভালো করেই জানে সে যদি তাদের বন্দি করতেও সক্ষম হয় তবুও সে কোনো কামান বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না কারণ সেগুলো তার বাহিনীর অগ্রসর হবার গতি মন্থর করে দেবে যাদের মূল লক্ষ্যই হল দ্রুত এগিয়ে যাওয়া। অবশ্য কামানগুলো সে অকেজো করে দিতে পারে। নিজের ধমনীতে টগবগ করতে থাকা যুদ্ধের উন্মাদনার সাথে এবং তাকে অনুসরণ করার আদেশ ঘোষিত করার জন্য তাঁর তূর্যবাদককে চিৎকার করে আদেশ দিয়ে, হুমায়ুন ঝড়ের বেগে কোনো সময় নষ্ট না করে মালবাহী গাড়িগুলোর দিকে ছুটে যায়।

    অকস্মাৎ একটা মাস্কেটের গুলিবর্ষণের শব্দ তার কানে ভেসে আসে- তারপরে আরেকটা মাস্কেটের। গুজরাতি বন্দুকবাজদের কয়েকজন অবশেষে নিজেদের মাস্কেট কার্যক্ষম করতে সক্ষম হয়েছে এবং মালবাহী গাড়িগুলোকে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করে তারা গুলিবর্ষণ করছে। হুমায়ুনের কাছ থেকে দশ গজ দূরে ছুটন্ত ঘোড়াগুলোর একটা আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং ধূলোর ভিতরে মুখ থুবড়ে পড়ে এবং পিঠের আরোহীকে মাটিতে ছিটকে ফেলে, তাকে অনুসরণরত সহযোদ্ধাদের ঘোড়াগুলো তাঁকে নিজেদের খুরের তলায় পিষে ফেলার আগে সে মাটিতে শুয়ে এক মুহূর্তের জন্য ছটফট করে, তার দেহে প্রাণের শেষ স্পন্দটুকুও শেষ হয়ে যায়।

    হুমায়ুন ভালো করেই জানে বন্দুকধারীরা তাদের বন্দুকে পুনরায় বারুদ ভরার আগেই তাকে মালবাহী গাড়িগুলোর কাছে পৌঁছাতে হবে। আরো একবার আলমগীর আন্দোলিত করে, সে নিজের ঘোড়ার পাজরে গুতো দেয় এবং প্রায় সাথে সাথে গাড়িগুলোর মাঝে গিয়ে উপস্থিত হয়। এক বন্দুকবাজকে লক্ষ্য করে সে তরবার চালনা করে যে কাঁপতে থাকা হাত দিয়ে তাঁর মাস্কেটের লম্বা নলে ধাতব বলটা একটা ইস্পাতের শলাকার সাহায্যে প্রবিষ্ট করার প্রচেষ্টায় রত। লোকটার মুখে তরবারির ফলা আঘাত হানতে, হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শত্রুপক্ষ মাল বোঝাই গাড়িগুলোকে টেনে এনে কোনো ধরনের রক্ষণাত্মক বিন্যাস তৈরী করার অবকাশ পায়নি আর তাই হুমায়ুনের লোকেরা, যারা তার পেছন পেছন এসে হাজির হয়, অনায়াসে তাঁদের ঘিরে ফেলে এবং প্রতিটা আলাদা আলাদা গাড়ীর রক্ষীদের পরাভূত করে। গুজরাতি অশ্বারোহী বাহিনীর আরও সেনাসদস্য ঘোড়া দাবড়ে পালায় এবং পদাতিক বাহিনীর সেনা আর সেনাবাহিনীর সাথে আগত অন্যান্য লোকেরা এরপরে কে কত দ্রুত পালাতে পারে যেন তারই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।

    প্রতিরোধ শেষ- নিদেনপক্ষে এখনকার মতো। হুমায়ুন অবশ্য ভালো করেই জানে যে তাঁর সাথে যে লোক রয়েছে তাদের সংখ্যা বাড়াবাড়ি ধরনের কম আর এই বিষয়টা যখন গুজরাতি বাহিনীর আধিকারিকেরা লক্ষ্য করবে তখন তারা চেষ্টা করবে দলবদ্ধ হয়ে তাঁকে আক্রমণ করতে। আর তাই নষ্ট করার মতো সময় তাঁদের হাতে নেই। হুমায়ুন তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর একটা ক্ষুদে দলকে আদেশ দেয় পলাতকদের পিছু ধাওয়া করতে আর তাঁদের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ করার নির্দেশ দেয় কিন্তু কয়েক মাইলের বেশী ধাওয়া করতে নিষেধ করে এরপরে ফিরে এসে একটা চলনসই রক্ষণাত্মক ব্যুহ তৈরীর আদেশ দেয়। সে অন্য লোকদের মালবাহী গাড়িতে কি রয়েছে সেটা দেখতে বলে। তারা সাগ্রহে আদেশ পালন করতে এগিয়ে যায় এবং চটের ভারী আচ্ছাদন সরিয়ে ফেলতে ভেতরে ছয়টা মাঝারি মাপের কামান, প্রয়োজনীয় বারুদ, কামানের গোলা আর সেই সাথে নতুন তৈরী করা বর্শার একটা গোছা আর পাঁচ বাক্স মাস্কেট দেখতে পায়।

    আমরা মাস্কেটগুলো সব নেব। বাক্সগুলো খালি কর। আমাদের সাথে বাড়তি ঘোড়ার পর্যাণে মাস্কেটগুলো গোছা করে বেঁধে দাও। কামানের নলে যতগুলো বারুদ ভর্তি কাপড়ের ব্যাগ প্রবেশ করান যায়, প্রবেশ করাও আর তারপরে মাটিতে বারুদের একটা রেখা তৈরী করে ওখানে ঐ পাথরের পেছনে নিয়ে যাও। পাথরের পেছন থেকে আমরা বারুদে অগ্নি সংযোগ করবো, হুমায়ুন বলে।

    সোয়া এক ঘন্টা পরে সব কাজ শেষ হয়। হুমায়ুন তাঁর বেশীর ভাগ লোককে নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দেয় কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ তদারকি করতে নিজে কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে পেছনে থেকে যায়। বারুদে অগ্নি সংযোগের সম্মান সে দীর্ঘদেহী এক তরুণ বাদশানীর উপরে অর্পণ করে বেচারা চকমকি পাথরের বাক্স নিয়ে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে স্ফুলিঙ্গ তৈরীর জন্য কসরত করতে থাকে। সে শেষপর্যন্ত যখন সফল হয়, বারুদের জ্বলন্ত শিখা মাটির উপর দিয়ে ক্রমান্বয়ে থুতু ফেলার মতো একটা শব্দের জন্ম দিয়ে এগিয়ে যায়। একটা ছোট পাথরের সাথে প্রান্ত ঘেঁষে যাবার সময় এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় শিখাটা বুঝি নিভে যাবে কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটা আবার সামনে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে। প্রায় সাথে সাথে এক বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে আরও পাঁচটা বিস্ফোরণের শব্দ এর পরপরই শোনা যায়। প্রতিটা কামানের নলের ভিতরে বারুদের বিস্ফোরণ ঘটেছে।

    ধূলো আর উৎক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষের টুকরো থিতিয়ে আসতে হুমায়ুন, বিস্ফোরণের বিকট শব্দে তখনও কানে তালা লেগে রয়েছে, দেখতে পায় যে চারটা নল লম্বালম্বিভাবে ফেটে গিয়ে পেছনের দিকে বেঁকে এসেছে ঠিক অনেকটা কলার খোসা ছাড়াবার মতো। আরেকটা আক্ষরিক অর্থেই টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। ষষ্ঠ কামানের নলে কেবল ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে- হুমায়ুন ভাবে, কামানটাকে অকেজো করতে এটাই যথেষ্ট। তাঁর লোকেরা এবার দ্রুত ফিরে আসে এবং অবশিষ্ট মালবাহী গাড়িগুলোতে মূল্যবান দ্রব্যের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কেউ একজন কিছু রেশমের কাপড় খুঁজে পায়, অন্য আরেকজন একটা সিন্দুকের তালার ভিতরে তাঁর খঞ্জরের অগ্রভাগ প্রবিষ্ট করিয়ে সিন্দুকটা জোরপূর্বক খুলতে চায় ভেতরে মূল্যবান কোনো পাথর আছে কিনা দেখতে।

    হুমায়ুন এর ভেতরেই তার অশ্বারোহী বাহিনীর একজন সদস্যকে যাদের উপরে সে রক্ষণাত্মক ব্যুহ তৈরীর আদেশ দিয়েছিল ঘোড়া দাবড়ে তাঁর দিকে ছুটে আসতে দেখে। সুলতান, গুজরাতিরা পুনরায় একত্রিত হয়েছে। আক্রমণের জন্য তাঁরা প্রস্তুত হচ্ছে, আমরা সংখ্যায় কত অল্প সেটা এখন তাদের চোখে পড়েছে।

    আমরা অবশ্যই ফিরে যাব। তূর্যবাদক পশ্চাদপসারণের-সঙ্কেত ধ্বনিত কর। আমরা পাহাড়ের ঢালের উপরে গিয়ে অবস্থান নেব। তারা আমাদের অনুসরণ করার মতো মূর্খতা দেখাবে না। তারা ভালো করেই জানে যে উপরে উঠার প্রয়াসরত অবস্থায় তারা যদি আমাদের আক্রমণের সুযোগ দেয় তবে তার মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু।

    বিশ মিনিট পরে, বেলেপাথরের সেই ঢালের উপর থেকে নীচের দিকে সেনাসারির ধ্বংসযজ্ঞের দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন গুজরাতিদের সেখানে জটলা করতে দেখে। কয়েকজন অতিলোভী নির্বোধ ছাড়া, যারা লুটের সম্ভাবনায় আবিষ্ট হয়ে মালবাহী গাড়ির দ্রব্যসামগ্রী তল্লাশি করতে অনর্থক দেরী করেছিল, তার বাকি লোকেরা নিরাপদেই ফিরে এসেছে। তাদের ভিতরে, হুমায়ুন বিষণ্ণ মনে ভাবে, সেই তরুণ বাদশানীও রয়েছে, পাহাড়ী ঢালের উদ্দেশ্যে অনেক দেরীতে ঘোড়া ছোটালে পিঠে তীরবিদ্ধ হয়ে বেচারা মাটিতে আছড়ে পড়েছে। তার পর্যাণের সাথে নকশি করা গোলাপি রেশমের চোঙের মতো গোল করে পাকানো রোলের পাক খুলে গিয়ে তার সওয়ারীবিহীন ঘোড়ার পেছনে অবাধে মাটিতে লুটাচ্ছে।

    *

    চোখের সামনে ওখানে রয়েছে- লম্বা তালগাছের সারি এবং কমলালেবুর ধুসর খোসার মতো বালির পরেই দীপ্তিময় সমুদ্রে মধ্যাহ্নের সূর্যের আলো এমন তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয় যে হুমায়ুন বাধ্য হয় হাত দিয়ে চোখের উপরে একটা আড়াল তৈরী করতে। শক্রর সৈন্যসারির উপরে সাফল্যের সাথে ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনা করার পরে হুমায়ুন তাঁর সাথের তিন হাজার সৈন্যের বহরের অর্ধেক সৈন্য তাঁর মূল বাহিনীর সাথে যোগ দেবার জন্য পাঠিয়ে দেয়, যা এই মুহূর্তে অবরোধের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ আর অনুষঙ্গ নিয়ে মোগল ভূখণ্ড থেকে চম্পনীর জঙ্গলবেষ্টিত দূর্গের অভিমুখে খুব ধীরে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।

    হুমায়ুন বাছাই করা দেড় হাজার অশ্বারোহীর একটা চৌকষ বাহিনী নিয়ে নিজে গুজরাতের আরও অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, যেখানেই শত্রুসেনার কোনো বাহিনীকে খুঁজে পায় সেখানেই তাঁদের পরাস্ত আর বিপর্যস্ত করে তুলে। সে নিশ্চিত, তার মূল বাহিনী কোথায় আসল আঘাত হানবে সে বিষয়ে গুজরাতিদের বিভ্রান্ত আর অনিশ্চিত করে তুলতে সে সফল হয়েছে; ঠিক যেমন সে পরিকল্পনা করে এসেছিল। ঝটিকা আক্রমণের সময়ে ধৃত গুজরাতিদের মুখে সামরিক উপকরণ আর বাণিজ্যিক পণ্য বহনকারী একটা কাফেলা কাম্বের সমুদ্র বন্দরের অভিমুখে রওয়ানা হয়েছে জানতে পেরে সেটার পশ্চাদ্ধাবন করে সে সমুদ্রের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। হুমায়ুন ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায় যে সে কাফেলাটাকে খুঁজতে চেষ্টা করেছিল। সে জওহরকে তার পাশে ডাকে। আমার আদেশ জানিয়ে দাও যে মধ্যাহ্নের খরতাপে আমরা তালগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেব আর নিজেদের সতেজ করে নেব আর সেই সময়ে আমাদের অনুসন্ধানী দূত কাফেলাটার খোঁজ করবে। সেটার এখন আর খুব একটা বেশী দূরে অবস্থান করার কথা না। বস্তুতপক্ষে, আমরা যা জানতে পেরেছি সেটা সত্যি হলে কাম্বে বন্দরের দূরত্ব এখান থেকে দশ মাইলের বেশী হবার কথা না, সমুদ্রের উপকূলের উত্তরপশ্চিমে কোথায় সেটা রয়েছে। প্রহরী আর প্রতিহারী মোতায়েনেরও আদেশ জানিয়ে দাও যাতে করে কেউ আমাদের যেন চমকে দিতে না পারে।

    সম্রাটের অভিপ্রায় জেনে নিয়ে জওহর যখন ঘুরে দাঁড়ায়, হুমায়ুন তার বিশাল কালো ঘোড়াটার পাঁজরে আলতো করে গুতো দিতে সেটা তাল গাছের নীচে দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, তালগাছের গাঢ় সবুজ রঙের লম্বা, তীক্ষাগ্র পাতাগুলো সমুদ্র থেকে আগত এবং নরম বালির উপর দিয়ে প্রবাহিত বাতাসে আন্দোলিত হয়ে মরমর শব্দ করছে। হুমায়ুন এখানে লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসে। দাঁড়িয়ে পায়ের জুতো জোড়া খুলে ফেলে সে সোজা সমুদ্রের দিকে হেঁটে যায়, সে খুব ভালো করেই জানে যে এমনটা করার ব্যাপারে তাদের পরিবারের ভিতরে সেই প্রথম। পায়ের ডিসের নীচের অংশে এসে আছড়ে পড়া পানি শ্রান্তিহর শীতল। পুনরায় নিজের চোখে উপরে হাত দিয়ে একটা আড়াল তৈরী করে সে সোনারমতো চকচক করতে থাকা, দীপ্তিময় দিগন্তের দিকে তাকায়। সে ভাবে সেখানে সে হয়তো একটা জাহাজের অবয়ব দেখতে পেয়েছে–সম্ভবত কাম্বের সাথে বানিজ্য করে তাদেরই কোনো একটা জাহাজ হবে। তাঁরা কি ধরনের মাল বহন করে? তারা কি ধরনের লোক? দিগন্তের ওপাশে কি আছে, এমনকি আরব এবং পবিত্র নগরীদ্বয়ের ওপাশে? সেখানে কি নতুন জ্ঞান আহরণে পর্ব চলছে? সেখানে নতুন শত্রুরা ওঁত পেতে রয়েছে নাকি কেবলই ধুধু বিরান প্রান্তর নাকি অনন্ত সমুদ্র?

    হুমায়ুনের নিঃসঙ্গ ভাবনার স্রোত জওহরের চিৎকারের ফলে বিঘ্নিত হয়। সুলতান, আপনার আধিকারিকেরা আপনার সাথে পরামর্শ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। আপনি কি অনুগ্রহ করে তাঁদের সাথে আহার করবেন? আপনি অনেকক্ষণ ধরেই নিবিষ্ট মনে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছেন এবং আপনার চারধারে পানি বাড়ছে। কথাটা সত্যি। সেই ছোট ঢেউগুলো এখন ফিরে যাবার আগে হুমায়ুনের হাঁটু ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। অনিচ্ছাসত্তেও সে বিমূর্ত ভাবনার জগৎ থেকে, যা সবসময়ে তাকে আনন্দ দান করে থাকে, বর্তমানের বাস্তবতায় নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং আধিকারিকেরা তালগাছের নীচে টকটকে লাল চাঁদোয়ার তলায় আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে যেখানে প্রতীক্ষা করেছে সেদিকের উদ্দেশ্যে হাঁটতে আরম্ভ করে।

    দশ মিনিট পরে, আহমেদ খান, তাঁর প্রধান অনুসন্ধানী দূত, কাবুলের দক্ষিণে, গজনীর পাহাড়ী এলাকা থেকে আগত পাগড়ি পরিহিত পাকান শরীরের ত্রিশ বছর বয়সী এক যুবককে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, তাঁর কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে গাল বেয়ে নেমে এসে তার পাতলা খয়েরী দাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে। উপকূলের প্রান্তে তালগাছের চওড়া সারির ঠাস বুনোটের অন্যপাশে সমুদ্র থেকে সোয়া মাইলের মতো ভিতরে অবস্থিত একটা রাস্তা দিয়ে কাফেলাটা এগিয়ে আসছে, এই মুহূর্তে সেটা পাঁচ মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থান করছে। কাম্বে শহর থেকে সেটা চার মাইল মতো দূরে রয়েছে, যা ওখানে অবস্থিত ঐ নীচু শৈলান্তরীপের কারণে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে।

    আমরা সমুদ্র সৈকতের উপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে তালগাছের সারির অন্যপাশে যাব এবং তারা কাম্বে পৌঁছান মাত্র অতর্কিতে তাঁদের আক্রমণ করবো। আল্লাহতালা আমাদের সহায় থাকলে, আমরা হয়ত এমনকি বলপ্রয়োগের দ্বারা বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য নিজেদের পথ করে নিতে পারবো যদি কেবল কাফেলাটাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়ার জন্য তোরণদ্বার খোলা থাকে।

    মাত্র পাঁচ মিনিট পরেই, হুমায়ুনের ঘোড়া বালুর প্রান্ত বরাবর আস্কন্দিত বেগে ছুটতে থাকে তার চারপাশে, তাঁর দেহরক্ষীর দল খুব কাছ থেকে তাঁকে ঘিরে রেখেছে। এক ঘন্টারও কম সময়ের ভিতরে তাঁরা পাথুরে শৈলান্তরীপ অতিক্রম করে এবং তালগাছের নিরবিচ্ছিন্ন আড়ালে অবস্থান করে। হুমায়ুন কাম্বে বন্দরে স্থির হয়ে ভেসে থাকা বা বন্দরের বাইরে নোঙ্গরবদ্ধ অবস্থায় থাকা সব জাহাজের মাস্তুল আর পাল দেখতে পায়। কাফেলাটা, যার ভিতরে রয়েছে মালের ভারে টলমল করতে থাকা উট, ভারবাহী হাতি আর তার সাথে খচ্চর আর গাধার পাল, অবসন্ন ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে বন্দরের ক্ষুদ্র বসতিকে ঘিরে থাকা মাটির দেয়ালে অবস্থিত এখন হাট করে খোলা অবস্থায় রয়েছে এগিয়ে যায়। দেয়ালটা দেখেও খুব একটা উঁচু মনে হয় না–সম্ভবত কেবল দুই মানুষ পরিমাণ উঁচু। কাফেলার রক্ষীদল, সব মিলিয়ে যাঁর জনবল প্রায় চারশোর কাছাকাছি, অশ্বারূঢ় হয়ে এর দুইপাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে কিন্তু তাদের দেখে ক্লান্ত মনে হয়, মধ্যাহ্নের খরতাপে মাথা নোয়ানো সেইসাথে তাদের প্রত্যেকের তরবারি কোষবদ্ধ আর ঢাল তাদের পিঠের সাথে আটকানো।

    ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তার লোকদের মূল দলের কাছে ফিরে এসে হুমায়ুন, চেঁচিয়ে বলে, এখনই আক্রমণ করতে হবে। আমরা তাদের ভড়কে দেব। উট আর হাতির দলটাকে আতঙ্কিত করতে চেষ্টা করবে। তাহলে তাঁরাই গুজরাতি রক্ষীবাহিনীর বারোটা বাজিয়ে দেবে। হুমায়ুন এসব কথা বলার মাঝেই নিজের বিশাল কালো ঘোড়াটার পাঁজরে গুতো দেয়, যার পুরো দেহটা ইতিমধ্যেই বিন্দু বিন্দু তেলতেলে ঘামে ভিজে গিয়েছে এবং অচিরেই তাল গাছের ভিতর দিয়ে নিজের লোকদের সাথে নিয়ে সে, বন্দরের তোরণদ্বার আর কাফেলা থেকে তাঁকে পৃথককারী, আধ মাইল বিস্তৃত পাথুরে, বালু ঢাকা পটভূমির উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে ঘোড়া হাকায়। তার আদেশ পাওয়া মাত্র, তার সবচেয়ে অভিজ্ঞ তীরন্দাজদের কয়েকজন দাঁত দিয়ে ঘোড়ার লাগাম কামড়ে ধরে রেকাবের উপর দাঁড়িয়ে পড়ে কাফেলার অবস্থান লক্ষ্য করে এক পশলা তীর ছুঁড়ে দেয় ঠিক যখন এর রক্ষীবাহিনী বুঝতে পেরেছে যে তাঁদের উপরে আক্রমণ করা হয়েছে। কয়েকটা তীর একটা হাতিকে আহত করলে বেচারা তাঁর দেহের মোটা চামড়া ভেদ করে প্রবিষ্ট শরযষ্টিসহ ঘুরে গিয়ে, ব্যাথায় আর্তনাদ করতে করতে তাঁকে অনুসরণরত কয়েকজনকে মাড়িয়ে ছুটে গেলে, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

    ব্যাথায় চাপা আর্তনাদ করে একটা উট ভূমিশয্যা নেয়, ব্যাথায় ছটফট করতে করতে বেচারা বালিতে আছড়ে পড়লে অবোধ জটার পিঠে বাঁধা মালপত্র চারদিখে ছড়িয়ে পড়ে, উটটার বিশাল, তুলতুলে মাংসল পা বাতাসে বৃথাই আন্দোলিত হয়। আরেকটা উট, কালো পালকযুক্ত একটা তীরে এফোড়-ওফোড় হয়ে যাওয়া লম্বা গলা নিয়ে, দুলকি চালে সাগরের দিকে ছুটে যায়। প্রায় সাথে সাথেই হুমায়ুন এবং তার লোকেরা রক্ষীবাহিনীর দুর্বল সারির ভিতরে ঘোড়া নিয়ে প্রবেশ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার সময়ে দুপাশে উন্মত্তের মতো তরবারি চালাতে থাকে। কিছু গুজরাতি আক্রমণের প্রথম ধাক্কা সামলাতে না পেরে আক্ষরিক অর্থেই ভূপাতিত হয়। সামান্য যে কয়েকজন নিজেদের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে, ঘুরে দাঁড়িয়ে অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখোমুখি হবার চেষ্টা করেছিল তাদের স্রেফ কচুকাটা করা হয়। বেশীরভাগই অবশ্য এতসব ঝামেলায় না গিয়ে নিজেদের ঘোড়ার গলা বরাবর ঝুঁকে নীচু হয়ে তখনও ভোলা থাকা কাম্বের প্রধান তোরণ-দ্বারের অভ্যন্তরে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছোটার জন্য জন্তুগুলোকে মিনতি করে।

    হুমায়ুন আর তার দেহরক্ষীর দল তাদের পিছু ধাওয়া করে। বেশভূষায় আধিকারিকের মতো দেখতে একজনকে তার অধীনস্ত দুজন লোকের সাথে পালিয়ে যেতে দেখে হুমায়ুন যত জোরে সম্ভব ঘোড়া দাবড়ায়। ঘাড়ের উপরে হুমায়ুনের উপস্থিতি টের পেয়ে, পলায়নপর আধিকারিক ঘুরে তাকিয়ে নিজের সমূহ বিপদ বুঝতে পেরে নিজেকে বাঁচাবার জন্য নিজের পিঠের সাথে বাঁধা ঢালটা আকড়ে ধরতে চেষ্টা করে। ঢালটা সে ঠিকমতো আকড়ে ধরার আগেই, হুমায়ুনের তরবারির ধারালো ফলা বেচারার ধাতব শৃঙ্খলে নির্মিত বর্মের ঠিক উপরে লোকটার মোটা আর পেষল গলায় একটা গভীর ক্ষতস্থানের জন্ম দিলে, সে ঘোড়া থেকে আছড়ে পড়ে গিয়ে বেশ কয়েকবার গড়াগড়ি করে এবং একটা সময়ে স্থির হয়ে যায়।

    চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে হুমায়ুন কাম্বের তোরণ-দ্বারের নীচে পৌঁছে যায়। উল্টে থাকা একটা টেবিল এড়াতে সে প্রাণপনে টেনে ঘোড়াটা ঘুরিয়ে নেয়, নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়া যায় যে শুল্ক বা কর আদায়ে নিয়োজিত আধিকারিকেরা কিছুক্ষণ আগেই এখান থেকে আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে গেছে, মূল ফটকের পাশে অবস্থিত বাড়িটার পেছনে একটা ছোট চত্বরে সে শীঘ্রই এসে পৌঁছে। সেখানে বোধহয় পূর্ণোদ্যমে একটা বাজার বসেছিল। সেখানের সামনের দিকে উন্মুক্ত ছোট ছোট দোকানগুলোয় যারা ছিল বোঝাই যায় তাঁরা ব্যস্ততার সাথে সেখান থেকে চলে গিয়েছে, আতঙ্কে উজ্জ্বল বর্ণের মশলা ভর্তি ব্যাগগুলো ধূলোয় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, মাটিতে শস্যকণা পড়ে রয়েছে সেখানে উল্টে যাওয়া একটা জালা থেকে গড়িয়ে আসা দুধ আর কমলা রঙের মসুর ডালের সাথে এখন দারুণ সখ্যতা তার। সৈন্যদের টিকিটাও কোথাও দেখা যায় না। কাফেলার রক্ষীবাহিনীর মতোই, কাম্বের প্রতিরক্ষায় যারা নিয়োজিত ছিল তাঁরা বোধহয় লড়াই করার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। গুটিকয়েক দোকানমালিক যারা পালিয়ে যেতে পারেনি। বেশীর ভাগই শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ বা প্রায় কালো পোষাকে সজ্জিত মহিলা- সবাই তাদের আক্রমণকারীদের সামনে বালিতে মুখ গুঁজে বশ্যতা প্রকাশের ভঙ্গিতে নিজেদের প্রণত করে। সৈন্যদের বসবাসের ব্যারাকটা কোথায় খুঁজে বের কর। সেখানে যদি কোনো সৈনিককে দেখতে পাও তাকে সাথে সাথে বন্দি করবে। বন্দরে অবস্থানরত জাহাজ আর গুদামঘর থেকে তোমাদের যা ইচ্ছে নিতে পার। বাকিটা পুড়িয়ে দেবে। কেবল লক্ষ্য রাখবে তোমাদের মালপত্রের ভার যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়। সূর্যাস্তের আগেই আমরা এখান থেকে চলে যাব। কাম্বে বন্দরে আমাদের হামলার খবর যখন গুজরাতিদের কানে যাবে, তারা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে এতটাই শঙ্কিত আর অনিশ্চিত হয়ে পড়বে যে যখন তাঁরা চম্পনীর হুমকির সম্মুখীন জানতে পারবে তখন তাঁদের মূলবাহিনী কোথায় মোতায়েন করবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। সেই দূর্গ আক্রমণকারী আমাদের মূলবাহিনীর সাথে পুনরায় মিলিত হবার জন্য আমাদের দ্রুত এখান থেকে ফিরে যেতে হবে। আমরা সেখানেই চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবো যার ফলে গুজরাত আমাদের করায়ত্ত হবে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড : এম্পায়ার অভ দা মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল : রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }