Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প789 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪.৩ পিশাচের মঙ্গলসাধন

    হুমায়ুন লাল আর সোনালী জরির কারুকাজ করা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে এবং সোনার পানি দিয়ে গিল্টি করা নীচু টেবিলের উপরে স্তূপীকৃত রূপার বাসনপত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, যেখানে সজ্জিত খাবার দিয়ে সে আর হামিদা কিছুক্ষণ আগেই মধ্যাহ্নভোজন সমাপ্ত করেছে। হুমায়ুনের পছন্দ দই আর মসলা দিয়ে তন্দুরে- মাটির উনুন যা মোগল রসুইখানার আবশ্যিক অনুষঙ্গ এবং তাঁরা যেকোনো অভিযানে রওয়ানা হবার সময় এটা সঙ্গে নিতে ভুলে না- অল্প আঁচে ঝলসানো মুরগীর মাংস। হামিদা কমলা দিয়ে তৈরী আঠাল মিষ্টান্ন এক কামড় খেয়ে খুঁতখুঁতে ভঙ্গিতে তামার তৈরী একটা ছোট কারুকাজ করা পাত্রে রক্ষিত গোলাপজলে নিজের আঙ্গুল পরিষ্কার করছে দেখে সে হামিদার দিকে তাকিয়ে হাসে। হামিদাও তাঁর দিকে হেসে তাকায়। হুমায়ুন হামিদার পেছনে বুদ্বুদ উঠতে থাকা মার্বেলের তৈরী একটা ছোট প্রসবণের উপরে জানালা দিয়ে আপতিত সূর্যরশ্মির দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে তার নিজেকে সন্তুষ্ট মনে হয়।

    সে হামিদার দিকে তাকিয়ে আবার হাসে এবং তার ঠোঁটের বিভঙ্গ আর চোখের দ্যুতি দেখে বুঝতে পারে যে মেয়েটা জানে সে আহার পরবর্তী ভালোবাসার-পর্ব নিয়ে চিন্তা করছে এবং বিষয়টাকে সে স্বাগতই জানাবে। হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে হামিদাকে নিজের কাছে টেনে আনবে এমন সময় হামিদার ব্যক্তিগত পরিচারিকা জয়নব বেরসিকের মতো ভেতরে প্রবেশ করে। জয়নব কিছু বলার আগেই, হুমায়ুন তার উদ্বিগ্ন মুখাবয়ব দেখে বুঝে নেয় যে অলস দুপুরবেলা সে যে উষ্ণ আর অলস রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করছিল সেটা আপাতত স্থগিত করতে হবে।

    সুলতান, আহমেদ খান আপনার জরুরী উপস্থিতি কামনা করেছেন তারা আপনার সৎ-ভাই কামরানকে বন্দি করেছে। হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে জয়নবের কথার মাঝেই হামিদার মুখাবয়ব থেকে রমণ ইচ্ছুক প্রেয়সীর অভিব্যক্তি মুছে গিয়ে সেখানে বিজয়োন্মত্ত, প্রতিশোধ পরায়ন এক মায়ের ক্রুদ্ধ রূপ ফুটে উঠেছে। হামিদা তার একমাত্র ছেলের সাথে কামরানের আচরণের কারণে তাঁকে কখনও ক্ষমা করেনি- ভুলে যাবার প্রশ্নই উঠে না। আর কামরানকে হুমায়ুন এতোবার জীবন বখশ দিয়েছে বলে সে বহুবার তাকে তিরস্কার করেছে। সে প্রায়ই তার প্রিয় ফার্সী কবির কয়েকটা পংক্তি উদ্ধৃতি করে তাঁকে শোনায়: বন্ধ্যা মাটিতে কখনও মিষ্টগন্ধ ফুল ফোটে না তাই বৃথা আশায় বীজ নষ্ট করো না। পিশাচের সাথে ভালো আচরণ ভালো লোকের সাথে পৈশাচিক আচরণের ন্যায় গর্হিত।

    হুমায়ুন কোনো মন্তব্য করার পূর্বেই, হামিদা চিৎকার করে উঠে, তাকে বন্দি করার জন্য আল্লাহতালাকে শুকরিয়া জানাই। আমি আশা করি এবার আর ক্ষমা করার মতো বাতুলতা আপনি প্রদর্শন করবেন না। তাঁকে তাঁর প্রাপ্যের চেয়েও বেশী সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং প্রতিবারই সে তাঁকে দেয়া সংশোধনের সুযোগ অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখান করেছে। আপনার প্রতি তাঁর ক্ষোভের শেকড় এতো গভীরে প্রোথিত যে সে কখনও তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসবে না। দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেন না। আমার খাতিরে না হোক, আমাদের সন্তানের খাতিরে যার জীবন নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলেছিল তাকে এই মুহূর্তে মৃত্যুদণ্ড দিন।

    হুমায়ুন কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর আব্বাজানের তরবারি আলমগীর নেয়ার জন্য ক্ষণিকের তরে হাঁটবার গতি মন্থর করে, তারপরে কক্ষ ত্যাগ করে। হামিদার কথায় স্পষ্টভাবে প্রকাশিত ক্ষোভের খানিকটা হলেও সে নিজের ভিতরে পূঞ্জীভূত হচ্ছে টের পায়। পরমানন্দদায়ক স্বস্তির একটা অনুভূতি এই ক্ষোভের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়- যে অবশেষে হিন্দুস্তানের উপরে ইসলাম শাহের নিয়ন্ত্রণের প্রাবল্য পরীক্ষা করার জন্য সিন্ধু নদের অপর তীরে সে যে অনুসন্ধানী অভিযানের পরিকল্পনা করেছে, সেটা কার্যে পরিণত করার সময় পশ্চাদে কামরানের হুমকি নিয়ে তাঁকে আট দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

    জেনানাদের আবাসন কক্ষে প্রবেশ পথে অবস্থিত রূপার আস্তরণযুক্ত পাল্লার ভিতর দিয়ে হুমায়ুন যখন বাইরের সূর্যালোকিত প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয় আহমেদ খান ইতিমধ্যে সেখানে তার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে।

    আহমেদ খান, আপনি তাকে কোথা থেকে বন্দি করেছেন এবং কিভাবে?

    দুইদিন পূর্বে কামরানকে তাঁর শেষ বিদ্রোহের সময় সমর্থন করেছিল এমন একজন পাতি গোত্রপতিকে আমরা বন্দি করতে সক্ষম হই। আমরা তাঁকে বন্দি অবস্থায় দূর্গপ্রাসাদে নিয়ে এসে ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে আটকে রাখি। আজ খুব সকালে সে আমার সাথে দেখা করতে চায় এবং নিজের কৃতকর্মের শাস্তি লাঘব করার অভিপ্রায়ে সে আকার ইঙ্গিতে বলে, যে সে জানে কামরানকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে। আমি তাঁকে জানাই যে সুলতানের সাথে আলোচনা না করে তার সাথে কোনো ধরনের চুক্তি করতে পারবো না, কিন্তু নিজের ভালো চাইলে তার উচিত হবে। অনর্থক কালক্ষেপন না করে- সে যা জানে সবকিছু আমাকে খুলে বলা। সে একটা বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারে যে কামরানকে যদি খুঁজে পাওয়া যায় তবে আপনিও অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করবেন না। সে তখন বলে, তার বিশ্বাস যে কামরান কাবুল শহরের যেখানে দরিদ্র লোকেরা বাস করে- ট্যানারীর আশেপাশের এলাকা। সেখানে লুকিয়ে রয়েছে। আমি যখন তাঁকে চাপ দেই সে স্বীকার করে যে তার তথ্যটা কমপক্ষে এক সপ্তাহের পুরান এবং তাঁর তথ্যদাতা, কামরানের সামরিক শিবির অনুসরণকারী একটা ছিঁচকে চোর, স্বভাবতই তাঁর কথার উপরে খুব একটা ভরসা রাখা যায় না। আমি অবশ্য সাথে সাথে চিন্তা করে দেখি আমাদের শক্তিশালী একটা বাহিনীকে সেখানে পাঠিয়ে পুরো ট্যানারী এলাকা ঘিরে ফেলে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

    সুলতান, আমি সেটা করেছিলাম বলে আমি দারুণ গর্বিত। আমাদের সৈন্যরা যখন এক চামারের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যাঁর পরিবার দক্ষিণ থেকে এসেছে, সেই চামারকে কেন যেন আতঙ্কিত মনে হয় এবং সে সৈন্যদের বাসায় প্রবেশ করতে বাধা দেয়, দাবী করে যে তার শ্বাশুড়ি ভীষণ অসুস্থ গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়েছে। আমার সৈন্যরা তাকে ধাক্কা দিয়ে পথ থেকে সরিয়ে দেয় এবং স্তূপ করে রাখা চামড়া একপাশে ছুঁড়ে দিয়ে, পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে তল্লাশি করে এবং তারা বর্শার ফলা এমনকি চামড়া পাকা করার জন্য তামার পাত্রে রাখা রং আর প্রশাবের ভিতরেও প্রবিষ্ট করায়। তারা কিছুই খুঁজে পায় না, কিন্তু তারা তারপরেও নিশ্চিত যে চামার লোকটা কিছু একটা বা কোনো লোককে গোপন করার চেষ্টা করছে, তারা শেষপর্যন্ত বাড়ির উপরের তলায় পর্দা দিয়ে ঘিরে রাখা অংশে প্রবেশ করে, যেখানে চামার লোকটা দাবী করেছে যে তার অসুস্থ শ্বাশুড়ি অবস্থান করছে। তারা সেখানে কয়েকটা নোংরা কম্বলের নীচে একটা দেহ চাপা দেয়া রয়েছে দেখতে পায়। তাঁরা কম্বল সরিয়ে নীচে বিশাল হাত আর পায়ের বিরাটাকৃতি একটা অবয়ব দেখতে পায় তাঁদের মনে হয়, অবয়বটা কোনো মেয়েমানুষের তুলনা বিশাল শিশুর মতো কুকড়ে শুয়ে রয়েছে। আমাদের তথাকথিত শ্বাশুড়ির পরণে মেয়েদের অপরিচ্ছন্ন পোষাক আর তার মুখটা আরব মেয়েদের মতো মোটা কালো হেজাব দিয়ে ঢাকা। তাঁকে শান্তিতে মরতে দেয়ার জন্য সে উচ্চকণ্ঠে সকরুণ আর্তি জানায়। তল্লাশি পরিচালনাকারী আধিকারিক অবশ্য এসব আর্তিতে কান না দিয়ে হেজাব তুলে দেখার জন্য এগিয়ে যায়। সে হেজাব তুলতে গেলে, অবয়বটা তাঁর পরণের মেয়েলী আলখাল্লার পুরু ভঁজের ভেতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং তার বাহুতে আঘাত করে। আধিকারিকের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন সৈন্য দ্রুত মহিলার পোষাক পরিহিত লোকটাকে নিরস্ত্র করে এবং তার হেজাব না তুলেই তারা নিশ্চিত হয়ে যায় সে কোনো মহিলা না বরং কয়েকদিনের না কামান খোঁচা খোঁচা দাড়িযুক্ত আপনার সৎ-ভাই।

    সে প্রথমে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে এবং চিৎকার করে বলে যে আপনি একজন অপদার্থ শাসক এবং সেই ন্যায়সঙ্গত সম্রাট; আরও বলে যে আমার লোকেরা একজন অকালকুষ্মণ্ডের মোসাহেব এবং তাদের উচিত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া এবং তাকে ছেড়ে দেয়া। অবশ্য, কিছুক্ষণ পরেই সে নিরব হয়ে যায়, মনে হয় ভাগ্যের উপরে সে নিজেকে সোপর্দ করেছে।

    আমার সৎ-ভাই এখন কোথায় আছে?

    সুলতান, দূর্গপ্রাসাদের নীচে ভূগর্ভস্থ কারাকক্ষে।

    হুমায়ুন মানসপটে, কাবুলের দূর্গপ্রাকারের উপরে তিনবছরের আকবরকে যেন দেখতে পায় এবং পুনরায় নিজের সৎ-ভাইয়ের প্রতি একটা অদম্য ক্রোধ তাকে অন্ধ করে তুলে। আকবর কত সহজে মারা যেতে পারতো। কামরানের বিদ্রোহের ফলে কত লোক মারা গিয়েছে? সে রত্নখচিত ময়ান থেকে তার আলমগীর বের করে আনে।

    আহমেদ খান, আমাকে কামরানের কাছে নিয়ে চলেন।

    আহমেদ খান প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে দ্রুত পথ দেখিয়ে এগিয়ে যায়, একটা নীচু দরজার নীচে দিয়ে, যার উভয়পার্শ্বে প্রহরী মোতায়েন করা রয়েছে, প্রবেশ করে এবং খাড়া একপ্রস্থ সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে যা দূর্গপ্রাসাদের তলদেশে নেমে গিয়েছে। হুমায়ুন চোখ পিটপিট করে অভ্যন্তরের গলিপথের অন্ধকারে দৃষ্টি সইয়ে নিতে চেষ্টা করে, যেখানে কেবল একটা তেলের প্রদীপ একটা চোরকুঠরির ভিতরে জ্বলছে। তার দৃষ্টি কিছুটা পরিষ্কার হতে তাঁর মনে হয় একটা বিশাল উঁদুরকে সে দেয়াল বরাবর দৌড়ে যেতে দেখেছে। সে মনে মনে ভাবে, নিজের বিশ্বাসঘাতক ভাইকে বিদ্রোহের মহামারী দ্বারা অন্যদের আক্রান্ত করা থেকে সে অন্তত থামাতে পেরেছে এবং সে তার তরবারির হাতল আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। তারা অবশ্য ইতিমধ্যে কামরানের কারাকক্ষের দরজার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে, আহমেদ খানের চারজন সৈন্য যেখানে পাহারা দিচ্ছে।

    আমি একা ভিতরে প্রবেশ করতে চাই, হুমায়ুন গম্ভীর কণ্ঠে বলে। আমি একা অনুশোচনাহীন বিশ্বাসঘাতকের সাথে বোঝাঁপড়া করতে চাই। আমার হাতেই কেবল আমার পরিবারের রক্ত ঝরবে।

    পুরু কাঠের দরজার উপরের আর নীচের ভারী লোহার ছিটকিনি একজন প্রহরী খুলে দেয়। হুমায়ুন মাথা নীচু করে কারাকুঠরির ভেতরে প্রবেশ করে এবং কামরান, ভেতরের খড় দেয়া মেঝের উপরে, স্যাঁতসেঁতে পাথরের দেয়ালে পিঠ দিয়ে বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে, পাঁচ বছরের বেশী সময় যাকে সে চোখে দেখেনি। ধরা পড়ার সময় তাঁর পরণে যা ছিল সেই খয়েরী মেয়েলি আলখাল্লা এখনও তার গায়ে রয়েছে। তাঁর পরণের কাপড়চোপড় শতছিন্ন এবং তার মাথার ভারী কালো হেজাবটা এখন পেছনে তুলে রাখায় তাকে বিদ্রোহী নয় বরং কেমন যেন হাস্যকর দেখায়।

    কিছুক্ষণ পরে, কামরান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সে হুমায়ুনের চোখের দিকে তাকান থেকে নিজেকে বিরত রাখে এবং সেই প্রথম নিরবতা ভঙ্গ করে কথা শুরু করে। আমি আমার প্রাণ বখশ দিতে তোমায় বলবো না। তাই মোটেই ভেবো না যে আমি তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়ে তোমার করুণা ভিক্ষা করবো। তোমার হাতে আমি আমাদের আব্বাজানের তরবারি দেখেছি। ওটা ব্যবহার কর। আমায় হত্যা কর। আমি যদি তোমার অবস্থানে থাকতাম তাহলে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতাম না… আমি কেবল একটা জিনিষ তোমার কাছে চাই… এবং কথা শেষ না করে এই প্রথমবার সে তাঁর সবুজ চোখের দৃষ্টি উঁচু করে আর প্রাসরি হুমায়ুনের চোখের দিকে তাকায়। আমাদের আব্বাজানের পাশে আমাকে সমাধিস্থ করো।

    হুমায়ুন পলকহীন চোখে পাল্টা তাকিয়ে থাকে। তুমি তাঁর স্মৃতিকে অসম্মান দেখাবার পরেও আমি কেন সেটা করবো? আমার কাছে তুমি যত প্রতিশ্রুতি করেছো সবগুলো ভাঙার পরেও, শান্তি আর মীমাংসার জন্য আমার সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরেও, এবং সবচেয়ে যেটা মারাত্মক আমার সন্তানের জীবন বিপদের মুখে ফেলার পরেও আমি কেন সেটা করতে যাব?

    নিজেকে আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন তুমি যা করতে পছন্দ করতে। কিন্তু আমার মৃতদেহ কোথায় শায়িত রয়েছে আমি কেবল সেটা নিয়ে চিন্তিত। ঝামেলাটা শেষ কর। আমার মতো, সবাই তোমায় যেমন দূর্বল ভাবে, প্রমাণ করো, তুমি মোটেই সেরকম নও। হুমায়ুনের মুখের কাছে কামরান নিজের মুখ নিয়ে আসে এবং তার চোখে পচা চর্বির মতো দুর্গন্ধযুক্ত একদলা কফ নিক্ষেপ করে।

    কিন্তু হুমায়ুন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। মৃত্যুশয্যায় বাবরের শেষ কথাগুলোর পেছনে নিহিত সত্যিকারের প্রাজ্ঞতা, নিজের ভাইদের কখনও কোনো ক্ষতি করবে না, তোমার যতই মনে হোক সেটা তাঁদের প্রাপ্য, এক নতুন মাত্রায় তাঁর সামনে প্রতিভাত হয়। হুমায়ুনের সাথে সাথে তার ভাইদেরও বাবর রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজের ভাইকে যদি সে হত্যা করে তাহলে কি সে শান্তিতে বাঁচতে পারবে? এই নোংরা প্রকোষ্ঠে তাঁকে হত্যা করার জন্য প্ররোচিত করে, কামরান- যে তাকে খুব ভালো করেই চেনে তার জন্য তার শেষ ফাঁদটা পেতেছে, নৈতিকতা বর্জন করে হুমায়ুন যেন নিজেকে তার স্তরে নামিয়ে আনার ধৃষ্টতা দেখায়, আর রাগের মাথায় প্রমাণ করে যে করুণা নয়, দূর্বলতাই তাঁর পূর্ববর্তী সব মীমাংসা প্রয়াসের পেছনে কাজ করেছে।

    হুমায়ুন উদ্ধত তরবারিটা নামিয়ে নেয় এবং চোখের উপর থেকে কফের দলাটা মুছে ফেলে। মৃত্যুই তোমার প্রাপ্য তুমি সেটা নিজেই বুঝতে পেরেছে দেখে আমি খুশি হয়েছি কিন্তু আমি আমার পরামর্শদাতাদের সাথে আলোচনা করেই তোমার ভাগ্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। তোমায় যদি মৃত্যুদণ্ড দিতেই হয় হঠকারী প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে না সেটা ঠাণ্ডা মাথায় বিচার বিবেচনার পরেই দেয়া হবে। হুমায়ুন কক্ষ ত্যাগ করার জন্য ঘুরে দাঁড়াবার সময়, তাঁর মনে হয় কামরানের ঠোঁটের কোণে সে যেন হাল্কা হাসির একটা ছটা দেখতে পেয়েছে। সে যা দেখেছে তাঁকে তাঁর দূর্বলতা ভেবে নিয়ে কি সে হাসছে, নাকি ভেবেছে যে এইবারের মতো সে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে?

    সে কক্ষ থেকে বের হয়ে যাবার আগে শেষবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে কামরানের দিকে যখন তাকায়, তাঁর সৎ-ভাইয়ের দৃষ্টি তখন আবারও মাটির দিকে নিবদ্ধ, মুখাবয়ব ভাবলেশহীন।

    *

    হুমায়ুন তার সূর্যালোকিত দরবার কক্ষে সমবেত, তার পরামর্শদাতাদের মগ্ন দৃষ্টিতে অবেক্ষণ করে। তাঁর নিজের মেজাজ তিক্ত হয়ে রয়েছে। কামরানের ভাগ্য নিয়ে তাকে একটা সিদ্ধান্তে উপণীত হতে হবে। কালক্ষেপণ করাটা দূর্বলতা বলে প্রতিয়মান হবে। সে আলোচনা শুরু করতে তাঁর পরামর্শদাতাদেরও গম্ভীর দেখায়।

    আমার সৎ-ভাইয়ের জীবন বখশ দেয়া হবে কি না সেটা আমার এক্তিয়ার কিন্তু তার আগে আমি আপনাদের মতামত জানতে আগ্রহী। আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত করে নিঃসন্দেহে বহু লোকের প্রাণহানির জন্য সে দায়ী। তার বিরুদ্ধচারিতা আমার শক্তি খর্ব করেছে, হিন্দুস্তান পুনরায় দখলের নিমিত্তে আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটিয়েছে, সেই সাথে আমার একমাত্র সন্তান আকবরকে বিপদের সম্মুখীন করেছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও সে আমার সৎ-ভাই, আমার আব্বাজানের সন্তান এবং তৈমূরের রক্তের উত্তরাধিকারী। আমি এই রক্তে আমার হাত তখনই রঞ্জিত করবো যখন আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হব যে আমার সামনে এটা ছাড়া আর কোনো পথ নেই এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে, আর আমার রাজত্ব ও এর জনগণের মঙ্গলার্থে তার মৃত্যু প্রয়োজন। আপনাদের মতামত আমি শুনতে আগ্রহী।

    সুলতান, বৈরাম খান সামনে এগিয়ে আসে, তাঁর কণ্ঠস্বর পরিষ্কার এবং স্পষ্ট, আমার মনে হয় এখানে উপস্থিত সবার পক্ষে আমি মতামত ব্যক্ত করতে পারি। এটা নিয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই আপনার স্বার্থে, আপনার সন্তান, আপনার সাম্রাজ্য আর আমাদের সবার স্বার্থে আপনার সৎ-ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত। কামরান আপনার ভাই নয়, সে আপনার শত্রু। তার প্রতি আপনার ভ্রাতৃসুলভ অনুভূতি থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। একজন শাসকের সিদ্ধান্তের ভিতরে এসব অনুভূতির কোনো স্থান নেই। আপনি যদি সম্রাট হিসাবে অধিষ্ঠিত থাকতে চান এবং আপনার আর আপনার সন্তানের জন্য হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধারে আমাদের সবার সমবেত অভিলাষ হাসিল করতে চান, তাহলে কেবল একটাই করণীয় রয়েছে। তার প্রাণদণ্ড কার্যকর করেন। সাথীরা আমার, আমি কি ঠিক বলিনি?

    দরবারে উপস্থিত সবাই সম্মিলিত কণ্ঠে এবং কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই উত্তর দেয়, হ্যাঁ!

    অন্যকোন সমাধানের পক্ষে আপনাদের কারো কি কোনো সাফাই দেবার নেই, হুমায়ুন জানতে চায়।

    না, সুলতান।

    ধন্যবাদ। আপনাদের পরামর্শ আমি ভেবে দেখবো। হুমায়ুন আর একটা কথা না বলে দরবারকক্ষ ত্যাগ করে, তার ভ্রু কুচকে রয়েছে। তার পরামর্শদাতাদের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব সহজ কাজ না। তাদের কেউই তার মতো কামরানের রক্ত ধারণ করে না। সে কি করছে সেবিষয়ে সচেতনভাবে কোনো চিন্তা না করেই হুমায়ুন জেনানাদের কক্ষের দিকে হাঁটতে শুরু করে এবং সেখানে পৌঁছে সে সরাসরি গুলবদনের কামরায় যায়। তার সৎ-বোন বেগুনী রঙের একটা ঢোলা রেশমের আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে নীচু একটা গিল্টি করা কেদারায় বসে রয়েছে আর তাঁর পরিচারিকা হাতির দাঁতের তৈরী একটা চিরুণী দিয়ে তাঁর কালো চুল আচড়ে দিচ্ছে। গুলবদন হুমায়ুনের মুখের অভিব্যক্তি দেখা মাত্র পরিচারিকাকে বিদায় দেয়। কি ব্যাপার ভাইজান?

    তুমি কি জানো তারা আবারও কামরানকে বন্দি করেছে এবং এই মুহূর্তে সে ভূগর্ভস্থ কারাকুঠরিতে বন্দি রয়েছে?

    অবশ্যই জানি।

    তার নিয়তির ব্যাপারে আমি আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাই। আমি বুঝতে পারছি যে তার অসংখ্য অপকর্মের জন্য সাধারণ রীতিনীতি অনুযায়ী তার মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য এবং আমার পরামর্শদাতারা একবাক্যে রায় দিয়েছে যে এইবার তাকে মরতেই হবে। তাকে পুনরায় আমার কজার ভিতরে পাবার ক্ষণটা আমি প্রায়শই যখন কল্পনা করতাম আকবরের প্রতি তাঁর দুর্ব্যবহারের কারণেই কেবল আমার মনে হত নিজ হাতে তাঁকে হত্যা করি, এবং হামিদা- আকবরের মা হিসাবে- এটা করতে আমাকে মিনতি করতো। অবশ্য, আমার ক্রোধ প্রশমিত হলে আমি বুঝতে পারি রাগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমার ঠিক হবে না, আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য কোনটা উত্তম হবে সিদ্ধান্ত নেবার সময় সেটাও মাথায় রাখতে হবে। ভাইদের কোনো ক্ষতি না করার জন্য আব্বাজানের নিষেধের কথা আমার স্মরণ আছে আর তাই সিদ্ধান্ত নিতে আমি ইতস্তত করছি।

    আপনার বিড়ম্বনা আমি বুঝতে পারছি, হুমায়ুনের হাত ধরে কোমল কণ্ঠে গুলবদন বলে। আপনি কখনও কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করেননি। মনে আছে আপনার অমার্তদের বিরক্তি সত্ত্বেও ভিস্তিঅলা নিজামকে দেয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি, যে আপনার সিংহাসনে সে এক কি দুই ঘন্টার জন্য অধিষ্ঠিত হবে, আপনি কিভাবে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। আপনি সবসময়ে নিজের কথা রাখেন, তাই আপনি মাঝে মাঝে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন যে অন্যরা যেমন শেরশাহ, যে চওসার যুদ্ধের আগে আপনার সাথে ছলনার আশ্রয় নিয়েছিল বা আপনার নিজের সৎ-ভাইয়েরা তেমন কিছু করবে না। আপনি কামরানকে এত সুযোগ দিয়েছেন এবং সে অবলীলায় যেভাবে আপনার করুণার সুযোগ নিয়েছে যে আমার নিজেরই মনে হয় যে আমাদের আব্বাজানকে আপনি যদি কোনো প্রতিশ্রুতি কখনও দিয়েও থাকেন সেটা তাঁর ক্রমাগত শঠতার কারণে নাকচ হয়ে গিয়েছে… সে চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবে। আমাকে যদি অকপটে বলতে বলেন আমি বলবো তার মরাই উচিত। আমাদের আব্বাজান যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য এতো কঠোর সংগ্রাম করেছিলেন সেই সাম্রাজ্যের জন্য এটা মঙ্গলজনক হবে। কামরানের সমস্যা দূর হলেই কেবল আপনি হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের জন্য একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করতে পারবেন।

    হুমায়ুন অনেকক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে থাকে। সে অবশেষে সতর্কতার সাথে বলতে শুরু করে। আমি জানি তোমার যুক্তি ঠিক আছে। আমি এটাও জানি আমাদের আব্বাজান সবসময়ে বলতেন আমি বড় বেশী নিঃসঙ্গতা পছন্দ করি…কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে আমি কোথাও গিয়ে কিছুক্ষণ একাকী বিষয়টা নিতে ভাবতে চাই।

    আমাদের আব্বাজানের স্মৃতিকথা আপনি সাথে করে নিয়ে যেয়ে দেখতে পারেন যদি সেখান থেকে কোনো নির্দেশনা বা সান্ত্বনা পান? আর তাছাড়া, তিনি যেমনটা বলেছেন তেমনি করে সেসব আপনারই লেখা, জীবনযাপন আর শাসন কার্যের জন্য নির্দেশনা প্রদান।

    হুমায়ুন, কিছুক্ষণ পরে, কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের প্রাচীরে অবস্থিত সর্বোচ্চ পর্যবেক্ষণ চৌকির পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। তাঁর হাতে হাতির দাঁত দিয়ে বাধান তাঁর আব্বাজানের স্মৃতিকথা যা সে তার উত্থানপতনের মাঝেও সযত্নে সংরক্ষণ করেছে। সে জওহরকে কঠোর আদেশ দিয়ে পর্যবেক্ষণ চৌকির প্রবেশদ্বারে বসিয়ে রেখে এসেছে, যে কেউ যেন ভেতরে প্রবেশের অনুমতি না পায়। হুমায়ুন যখন সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে, একটা সমতল ছাদে এসে উপস্থিত হয়, সে টের পায় যে দিনের উষ্ণতা হ্রাস পাচ্ছে। ঘন্টাখানেকের ভিতরেই সন্ধ্যা নামবে। তারকারাজি তাকে কি দিক নির্দেশনা দেয় সেটা পর্যবেক্ষণের জন্য তার হয়ত তারা ফোঁটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত কিন্তু সে তারপরে কি মনে করে ভাবনাটা নাকচ করে দেয়। সে জীবনে যত পরীক্ষা আর আশাহতের বেদনার সম্মুখীন হয়েছে সেখান থেকে সে একটা শিক্ষাই লাভ করেছে যে সে তার স্ত্রী বা রক্তসম্পর্কের আত্মীয়, তার পরামর্শদাতাদের মতো তারকারাজির উপরে নিজের সিদ্ধান্তের দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারে না।

    বাবর তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি বাল্যকালেই বুঝতে পেরেছিলেন যে একজন শাসককে শাসনকার্য পরিচালনা করতেই হবে। এটা শাসককে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে অতুলনীয় সুযোগ আর স্বাধীনতা দান করে, কিন্তু সেই সাথে এটা তার ভূমিকাকে ভীষণ একাকিত্বে ভরিয়ে দেয়। তাকে কেবল সিদ্ধান্ত নিলেই হবে না বাকি জীবনটা তাঁকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে হাশরের ময়দানে তাঁকে এজন্য জবাবদিহি করতে হবে।

    অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে শুরু করলে, হুমায়ুন তাঁর আব্বাজানের স্মৃতিকথা খুলে আনমনে পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। তার চোখ প্রথমেই একটা অনুচ্ছেদের দিকে আকৃষ্ট হয় যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে, কিভাবে তৈমূর তার এক অভিযানের সময় স্তেপের অধিবাসীদের ভিতরে প্রচলিত সনাতন রীতি অনুযায়ী করুণার বিরল দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেছিলেন এবং তাঁর নিজের পরিবারের একজন শক্তিশালী সদস্য যে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করেছিল তাঁকে হত্যা না করে কেবল অন্ধ করে দিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সৃষ্টির সম্ভাবনা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। বিদ্রোহ দমনের একটা পন্থা হিসাবে বাবর এটা সমর্থন করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন যে আজও অনেক গোত্রের ভিতরে এমন শাস্তির বিধান প্রচলিত রয়েছে এবং এটাকে তারা ন্যায্য আর যথার্থ বলে বিবেচনা করে।

    হুমায়ুন সাথে সাথে বুঝতে পারে যে কামরানের এটাই নিয়তি হওয়া উচিত। দৃষ্টিহীন হবার সাথে সাথে তাঁর হুমকিও দূর হবে। কোনো বিদ্রোহী গোত্রপতি আর কখনও কামরানকে হুমায়ুনের প্রতিপক্ষ হিসাবে বিবেচনা করবে না। তার সৎ-ভাইও হয়তো নিজের কৃতকর্ম বিবেচনার সময় পাবে এবং শেষ বিচারের ডাক আসবার আগে হয়তো সে অনুতপ্তও হতে পারে। শাস্তিটা খুবই নিষ্ঠুর হবে, কিন্তু হুমায়ুন জানে যে এটা বলবৎ করে কিছুটা করুণা প্রদর্শনের জন্য নিজের সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি সে সম্মান প্রদর্শন করবে এবং সেই সাথে নিজের সৎ-ভাইদের প্রতি অচিন্তনীয় হিংস্রতা থেকে বিরত থাকতে তাঁর আব্বাজানের নিষেধাজ্ঞা কিছুটা হলেও মান্য করা হবে।

    বাবরের স্মৃতিকথার হাতির দাঁতের মলাট বন্ধ করে, হুমায়ুন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসে। আমার পরামর্শদাতাদের এই মুহূর্তে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো, সে জওহরকে বলে। পাঁচ মিনিটের ভিতরে তাদের সবাইকে তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমার সৎ-ভাইকে অন্ধ করে দেয়া হবে, তার ক্রমাগত অপকর্মের শাস্তি হিসাবে আর সেই সাথে এখানে আমার রাজত্ব আর হিন্দুস্তানে আমাদের অধিকার পুনরুদ্ধারে সে যেন কোনো হুমকি সৃষ্টি করতে না পারে। আজ রাতে সূর্য অস্ত যাবার একঘন্টা পরে শাস্তি কার্যকর করা হবে। জাহিদ বেগ, এই দায়িত্বটা আমি আপনাকে দিচ্ছি। আমার ইচ্ছা হেকিমের বিবেচনায় সবচেয়ে দ্রুততম পদ্ধতি যেন অবলম্বন করা হয় এবং আমার সৎ-ভাইকে যেন কোনো রকম হুশিয়ারি দেয়া না হয় যাতে করে কি ঘটতে চলেছে সেজন্য সে ভীত হবার সময় না পায়। আমি তার যন্ত্রণা আর কষ্ট দেখতে চাই না। জওহর, আমার পক্ষে তুমি বিষয়টা প্রত্যক্ষ করবে। অবশ্য, কামরানকে যেন জানান হয় যে আমার প্রত্যক্ষ নির্দেশে শাস্তিটা বলবৎ করা হয়েছে এবং এর পুরো দায়দায়িত্ব আমার একার। আগামীকাল মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ পূর্বে তুমি আমার সৎ-ভাইকে এজন্য আমার সামনে হাজির করবে।

    *

    সুলতান, জওহর দেড়ঘন্টা পরে এসে জানায়, আপনার আদেশ পালিত হয়েছে। জাহিদ বেগের বাছাই করা ছয়জন লোক কারাকুঠরিতে প্রবেশের পাঁচ মিনিট কি তারও কম সময়ে পুরো ব্যাপারটা শেষ হয়েছে। তাদের ভিতরে চারজন আপনার সৎ-ভাইকে মাটিতে চেপে ধরে একেকজন তার একেক হাত পা চেপে ধরে থাকে। সে যখন ধ্বস্তাধ্বস্তি আর লাথি চেষ্টা করছে তখন পঞ্চমজন- মানুষ না বলে তাকে ভালোক বলাই উচিতোর বিশাল হাতের পাঞ্জায় কামরানের মাথাটা চেপে ধরে এবং মাথাটা স্থির রাখে। ষষ্ঠব্যক্তি আগুনের শিখায় আগেই গনগনে লাল করে রাখা সুইয়ের গোছা নিয়ে দ্রুত আপনার সৎ-ভাইয়ের দুই চোখের মণিতে পর্যায়ক্রমে বিদ্ধ করে। কামরান যন্ত্রণায় যখন বুনো পশুর মতো চিৎকার করছিল, লোকটা তখন তার দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি নষ্ট করার জন্য চোখের মণিতে লবণ আর লেবুর রস ঘষে দেয়। সে তারপরে আপনার সৎ-ভাইয়ের চোখে সুতির পরিষ্কার, নরম কাপড় বেঁধে দেয় এবং জানায় যে তাঁকে আর কোনো কষ্ট দেয়া হবে না। তারপরে তাঁরা তাঁকে তাঁর শাস্তি এবং সে প্রাণে বেঁচে থাকবে- যদিও সেটা হবে একটা বিকলাঙ্গ জীবন- এসব বিবেচনা করার জন্য কারাপ্রকোষ্ঠে একাকী রেখে বের হয়ে আসে…

    *

    পরেরদিন সন্ধ্যাবেলা, মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ আগে, কামরানকে হুমায়ুনের সামনে এনে হাজির করা হয়। তাঁর চোখে এখন আর পট্টি বাধা নেই এবং হুমায়ুনের আদেশে তাকে গোসল করিয়ে মোগল যুবরাজের উপযুক্ত পোষাক পরিহিত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। হুমায়ুন প্রহরীদের বিদায় করে দেয় এবং কোমল কণ্ঠে কামরানের সাথে কথা বলতে শুরু করে।

    আমি হুমায়ুন, তোমার সৎ-ভাই। আমি তোমায় নিশ্চিত করে বলছি কক্ষে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। কামরান যখন দৃষ্টিহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে সে বলতে থাকে, আমি তোমাকে জানাতে চাই যে আমার কেবলমাত্র আমারই আদেশে তোমায় অন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যারা কাজটা সম্পন্ন করেছে তাদের কোনো দোষ নেই। আমি এটা করতে বাধ্য হয়েছি কারণ আমার মনে হয়েছে যে আমি তোমার প্রতি যতই ক্ষমাসুলভ আচরণ করি, তুমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত হবে না আর আমাকে আমার সিংহাসন আর আকবরের ভবিষ্যত এবং আমাদের সাম্রাজ্য রক্ষা করতে হবে। হুমায়ুন চুপ করে থাকে এবং অপেক্ষা করে, খানিকটা হলেও আশা করে কামরান কিছু বলবে বা নিদেনপক্ষে, অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও, তাঁকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করবে।

    কিন্তু কিছুক্ষণ নিরব থাকার পরে কামরান পরাজয় মেনে নেয়া সুরে কথা বলে। আপনি আমার জীবন বখশ দিয়েছেন কিন্তু একই সাথে আমার কাছ থেকে আমার প্রিয় সবকিছু কেড়েও নিয়েছেন- আমার পরিকল্পনা, আমার উচ্চাশা। আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আপনি মহান আর করুণাময় পাদিশাহ হিসাবে এখন আবির্ভূত হতে পারেন যখন আপনি জানেন আমাকে কবন্ধ করে ফেলার চেয়েও নিখুঁতভাবে আপনি আমাকে ধ্বংস করেছেন…

    হুমায়ুন কোনো কথা বলে না এবং কামরান কিছুক্ষণ পরে আবার বলতে থাকে। আমি আপনাকে দোষ দেই না। আমি সবসময়ে আপনার ক্ষমাশীলতাকে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেছি এবং জানি আমার শাস্তিই প্রাপ্য। গতকাল রাতে আমি যখন জেগে শুয়েছিলাম আর দৃষ্টিহীন এই চোখের ব্যাথা কমার জন্য প্রার্থনা করছিলাম এবং ভাবছিলাম যে আমি এতদিন যেভাবে জীবনযাপন করেছি সেটার সমাপ্তি ঘটেছে, আমার মনে তখন আরেকটা ভাবনার জন্ম হয়। পুরো ব্যাপারটাই একটু অদ্ভুত কিন্তু আমি যেন কেমন একটা স্বস্তিবোধ করতে থাকি… একটা অনুভূতি, যে অবশেষে, এতোবছর পরে আমি পার্থিব আকাঙ্খার বোঝা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারি। আমি আপনার কাছে। কেবল একটাই জিনিস কামনা করি এবং এটা আমি আন্তরিকতার সাথে চাইছি।

    কি সেটা?

    আমি এখানে আপনার করুণা বা ঘৃণার পাত্র হিসাবে বা আপনি আমাকে যেমন উদারতা প্রদর্শন করতে চান তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চাই না। আসকারির ন্যায়, আমাকেও মক্কায় তীর্থ করতে- হজ্জ্বে যাবার অনুমতি দিন। আমাকে এটা কিছুটা হলেও হয়তো আত্মিক প্রশান্তি দান করবে।

    অনুমিত দিলাম, হুমায়ুন বলে, আমি তোমার জন্য দোয়া করবো। সে কথা বলার সময় অনুভব করে কান্নায় তার গাল ভিজে যাচ্ছে। সে অনুধাবন করে, সে কাঁদছে খানিকটা, সে আর তাঁর সৎভাই সামান্য সময়ের জন্য যে নিষ্পাপ সময় অতিবাহিত করেছিল সেটা হারাবার বিষণ্ণতাবোধ থেকে আর খানিকটা নিজেদের ভিতরে যুদ্ধ করে নষ্ট করা সময়ের কথা চিন্তা করে যখন তারা একসাথে তাদের আব্বাজানের সাম্রাজ্য উদ্ধারে উদ্যোগ নিতে পারতো, আর খানিকটা গতরাতে তার ইঙ্গিতে কামরানকে যে কষ্ট দেয়া হয়েছে সেটা ভেবে। তার অশ্রুধারা, অবশ্য একইসাথে, একটা প্রগাঢ় আর সর্বব্যাপী স্বস্তি প্রতিফলিত করে। সে আরো একবার হিন্দুস্তানের পাদিশাহ হতে, এমনকি নিজের সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করতে আর বাবর যে মহান সাম্রাজ্য স্থাপণের স্বপ্ন দেখেছিল সেটা অর্জনে স্বাধীনভাবে মনোনিবেশ করতে পারবে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড : এম্পায়ার অভ দা মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল : রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }