Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ব্লু-জন গহ্বরের বিভীষিকা

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প27 Mins Read0

    ব্লু-জন গহ্বরের বিভীষিকা

    আর্থার কনান ডয়েল

    ১৯০৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাউথ কেনসিংটনের ৩৬ নং আপার কভেন্ট্রি ফ্ল্যাটে যক্ষ্মা রোগে ডাঃ জেস হার্ডকাসূলের মৃত্যুর পর, তাঁর কাগজপত্রের মধ্যে নিম্নলিখিত কাহিনীটি পাওয়া যায়। যাঁরা হার্ডকাকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন, তাঁরা একাহিনী সম্পর্কে কোনও মন্তব্য না করলেও, অন্তত এটুকু একবাক্যে স্বীকার করেন যে, হার্ডকাল একজন সুস্থমস্তিষ্ক বৈজ্ঞানিক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক ছিলেন; তাঁর পক্ষে নিছক মনগড়া কতগুলো আজগুবি ঘটনাকে বাস্তব বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা খুবই অস্বাভাবিক ছিল।

    লেখাটা পাওয়া যায় একটা খামের মধ্যে। তার শিরোনামায় বলা হয়েছে–গত চৈত্র মাসে উত্তর-পশ্চিম ডার্বিশায়ারে অ্যালারটনদের ফার্মের নিকটবর্তী স্থানের একটি ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। বন্ধ খামের পিছনে ছিল পেনসিলে লেখা এই চিঠি–

    প্রিয় সিটন,

    শুনে আঘাত পাবে কিনা জানি না আমার কাহিনী তুমি অবিশ্বাস করার ফলে আমি সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত আর কারুর কাছে কোনও উল্লেখ করিনি। হয়তো বা আমার মৃত্যুর পর শেষ পর্যন্ত কোনও অপরিচিত ব্যক্তি এই কাহিনীর উপযুক্ত মর্যাদা দেবে, যে মর্যাদা থেকে আমার বন্ধু আমায় বঞ্চিত করেছিল।

    এই সিটন ব্যক্তিটি যে কে, সেটা অনুসন্ধান করেও জানা যায়নি। ইতিমধ্যে, মৃত ব্যক্তি যে অ্যালারটনদের ফার্মে সত্যিই গিয়েছিলেন, এবং তাঁর থাকাকালীন যে ভয়াবহ ঘটনা সেখানে ঘটেছিল, এবং সেই ঘটনার যে আনুমানিক কারণ তিনি তাঁর লেখায় ব্যক্ত করেছেন, সে সবই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই সামান্য ভূমিকাটুকু দিয়ে, ডায়েরির আকারে বর্ণিত হার্ভকালের বিচিত্র কাহিনীটি অবিক ভাবে নীচে উদ্ধৃত করা হল :

    ১৭ এপ্রিল

    এই জায়গাটির জলবায়ুর গুণ এর মধ্যেই বেশ অনুভব করছি। অ্যালারটনদের ফার্মের উচ্চতা ১৪২০ ফুট, সুতরাং এখানকার আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর হওয়াই স্বাভাবিক। সকালে সেই কাশির ভাবটা ছাড়া অন্য কোনও অসোয়াস্তি নেই, আর টাটকা দুধ ও মাংস খাওয়ার ফলে ওজন বৃদ্ধির সম্ভাবনাও সুস্পষ্ট। স্যান্ডারসন আমার অবস্থা শুনলে খুশিই হবে।

    অ্যালারটন ভগিনীদ্বয় দুজনেই বেশ মজার ও অমায়িক প্রকৃতির মহিলা। দুজনেই অবিবাহিতা। ফলে, স্বামী ও সন্তানের অভাবে দুজনেরই স্নেহের শেষ কণাটুকু বর্ষিত হচ্ছে এই রুগণ ব্যক্তিটির উপর। অবিবাহিতা মহিলারা সংসারে অপ্রয়োজনীয়, এ ধরনের একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে বলে জানি; কিন্তু আমি ভাবি, এদের অভাবে আমাদের মতো অকৃতদার অপ্রয়োজনীয় পুরুষদের দশা কী। হত। স্যান্ডারসন যে কেন আমায় এখানে আসতে বলেছিল, তার কারণটা দুই বোনের কথাবাতায় প্রকাশ পেয়ে গেছে। আসলে, আজ অধ্যাপকের আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেও, স্যান্ডারসনের জীবনের শুরু হয়েছিল এই গ্রাম্য পরিবেশেই। হয়তো ছেলেবেলায় সে এই খামারের আশেপাশে কাক-চড়ই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।

    অসমতল উপত্যকার মাঝখানে অবস্থিত এই গ্রামটি ভারী নির্জন, নিস্তব্ধ। এর পথঘাটগুলি ছবির মতো সুন্দর। দুপাশে খাড়াই উঠে গেছে লাইমস্টোনের পাহাড়। এই পাহাড়ের পাথর এতই নরম যে, হাতের চাপে আলগা হয়ে খসে আসে। এখানকার জমির ভিতরটা মনে হল ফাঁপা। একটা অতিকায় হাতুড়ি নিয়ে যদি এই জমির উপর ঘা দেওয়া হয়, তা হলে বোধহয় তা থেকে গুরুগম্ভীর জয়টাকের মতো শব্দ বেরোবে। তেমন জোরে ঘা দিলে হয়তো বা জমি ধসে গিয়ে ভূগর্ভস্থিত কোনও বিশাল সমুদ্রের সন্ধান মিলবে। এসব পাহাড়ের ভিতর জলাশয়ের অস্তিত্ব মোটেই অসম্ভব নয় কারণ বাইরে থেকে পরিষ্কার দেখা যায়, অজস্র জলধারা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে নানান। ফাটলের মধ্য দিয়ে আবার পাহাড়েরই ভিতরে গিয়ে ঢুকেছে। এমন বড় বড় ফাটলও কিছু রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে কিছুদূর অগ্রসর হলে মনে হয় যেন আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গপথ দিয়ে তারা সোজা একেবারে পৃথিবীর অন্তস্তলে গিয়ে পৌঁছেছে। আমার সাইকলের ল্যাম্পটা হাতে নিয়ে এসব গহ্বরের আনাচে-কানাচে ঘোরাফেরা করে আমি গভীর আনন্দ পাই। গহ্বরের ছাতে আলো ফেললে দেখা যায় স্ট্যাল্যাক্টাইটের কালোর ফাঁকে ফাঁকে রুপালির ঝলমলানি। আলো নেভালে দুর্ভেদ্য অন্ধকার, জ্বালালে আরব্যোপন্যাসের মায়াপুরীর বর্ণচ্ছটা।

    এইসব ফাটলের মধ্যে একটির বিশেষত্ব হল এই যে, সেটা মানুষের কীর্তি, প্রকৃতির নয়। বু-জনের কথা আমি এখানে আসার আগে শুনিনি। এক জাতীয় নীল রঙের খনিজ পদার্থের নাম। হল ব্লু-জন। এই ধাতু এতই দুষ্প্রাপ্য যে, এর তৈরি একটা ফুলদানিই বিক্রি হয় আগুনের দামে। আশ্চর্য অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন রোমানরাই প্রথম এই অঞ্চলে ব্লু-জনের অস্তিত্ব অনুমান করে পাহাড়ের গায়ে একটা গভীর সুড়ঙ্গ খনন করে। আগাছার জঙ্গলে আবৃত এই সুড়ঙ্গের মুখটাকেই বলা হয় রু-জন গ্যাপ। রোমানদের এই কীর্তির তারিফ না করে উপায় নেই। নোনা-ধরা অনেক গহ্বর ভেদ করে চলে গেছে এই সুড়ঙ্গ। অতি সন্তর্পণে, অনেক মোমবাতি হাতে মজুত রেখে এই সুড়ঙ্গে প্রবেশ না করলে, এর অন্ধকার জগৎ থেকে আবার বাইরের আলোয় বেরিয়ে আসা একেবারে অসম্ভব। আমি এখন পর্যন্ত বেশিদূর এগোইনি, তবে আজই সকালে এর মুখটায় দাঁড়িয়ে গহ্বরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, আমার স্বাস্থ্য ফিরে পেলে কোনও এক ছুটির দিনে এসে, রোম্যানরা ডার্বিশায়ারের পাহাড় ভেদ করে কতদূর ঢুকতে পেরেছিল, সেটা যাচাই করে দেখব।

    এখানকার লোকেরা যে কী পরিমাণ কুসংস্কারে বিশ্বাসী তা ভাবলে অবাক লাগে। এমনকী আর্মিটেজ ছোক্রাটিও দেখলাম বাদ যায় না। অথচ সে তো বেশ সুস্থ সবল শিক্ষিত লোক, আর মানুষ হিসেবেও চমৎকার। আমি গহুরটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় দেখি সে সামনের মাঠ পেরিয়ে আমারই দিকে আসছে। এসে বলল, ডাক্তারবাবুর দেখছি এ ব্যাপারে তেমন ভয়ডর নেই।

    আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, ভয়? কীসের ভয়?

    আর্মিটেজ গহ্বরের অন্ধকারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই যিনি থাকেন ওর ভিতরে–তাঁর!

    এইসব পাণ্ডববর্জিত গ্রামদেশে উদ্ভট সব কিংবদন্তি গড়ে ওঠা বোধহয় খুব সহজ, আমি আর্মিটেজকে জেরা করে তার এই অদ্ভুত ধারণার কারণ জানলাম। সে বলল প্রায়ই নাকি গ্রামের এখান-সেখান থেকে একটি-আধটি করে ভেড়া উধাও হয়ে যায়। আর্মিটেজের মতে নাকি সেগুলোকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা যে আপনা থেকেই ভুল পথে চলে গিয়ে পাহাড়ের খাদে-খন্দে হারিয়ে যেতে পারে, সে কথা বলতে আর্মিটেজ বলল, একবার নাকি এক চাপ রক্ত ও একগোছা ভেড়ার নোম পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। এই ঘটনারও যে একটা অত্যন্ত সাধারণ কারণ থাকতে পারে, সেটা বলতে আর্মিটেজ পালটা জবাব দিল যে, ভেড়াগুলো উধাও হয় নাকি কেবলমাত্র অমাবস্যার রাত্রে। তাতে আমি বললাম যে, এসব অঞ্চলে যদি ভেড়া-চোর থেকে থাকে, তা হলে তারা তাদের কাজের জন্য যে অমাবস্যার রাতটাই বেছে নেবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? জবাবে আর্মিটেজ বলল, একবার নাকি দেখা গিয়েছিল গ্রামের একটা পাঁচিলের গা থেকে কে যেন বড় বড় পাথরের ইট সরিয়ে সেগুলোকে বহুদূরে ছড়িয়ে ফেলে রেখে এসেছে। আমার মতে এ কাজও অবিশ্যি মানুষের অসাধ্য নয়। কিন্তু সবশেষে আর্মিটেজ এক তুরুপ মেরে বসল। সে বলল সে নাকি এই অদৃশ্য প্রাণীটির গর্জন শুনতে পেয়েছে। গহ্বরের মুখে একটানা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই নাকি সে-শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। আর বহুদুর থেকে এলেও সে-শব্দের জোর নাকি সহজেই অনুমান করা যায়। কথাটা শুনে আমি না হেসে পারলাম না। আমি জানতাম যে পাহাড়ের ভিতর যদি জল চলাচল করে, তা হলে লাইমস্টোনের ফাঁকে ফাঁকে সেই জলপ্রবাহের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে বাইরে থেকে গর্জনের মতো শোনানো কিছুই আশ্চর্য নয়। এভাবে বারবার তার কথার প্রতিবাদ করায় আর্মিটেজ শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমায় ছেড়ে চলে গেল।

    আর তার পরমুহূর্তে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। আমি গহ্বরের মুখটায় দাঁড়িয়ে, আর্মিটেজের কথাগুলো কত সহজে হেসে উড়িয়ে দেওয়া গেল তাই ভাবছি, এমন সময় সত্যিই গহ্বরের ভিতর থেকে এল এক অদ্ভুত শব্দ। সেশব্দের সঠিক বর্ণনা দেব কী করে? প্রথমত, শুনে মনে হল সেটা আসছে বহুদূর থেকে–যেন পৃথিবীর একেবারে গভীরে অবস্থিত কোনও জায়গা থেকে। কিন্তু দূর থেকে এলেও শব্দটা রীতিমতো জোরে। জলধারা বা পাথর গড়িয়ে পড়া থেকে যে শব্দ হয়, এটা সে জাতের নয়। এ-যেন এক তীব্র, তীক্ষ্ণ হ্রেষাধ্বনির মতো। এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার ফলে কিছুক্ষণের জন্য আর্মিটেজের কথাগুলো আমাকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলল। আমি আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক গহ্বরের মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম, কিন্তু দ্বিতীয়বার আর সে-শব্দ শোনা গেল না। বাড়ি ফিরলাম মনে গভীর বিস্ময়ের ভাব নিয়ে। আর্মিটেজের কথায় আমল দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু এটা অস্বীকার করা চলে না যে, যে-শব্দটা আমি নিজের কানে শুনেছি, সেটা ভারী অদ্ভুত। এখনও লিখতে লিখতে যেন কানে সেশব্দটা শুনতে পাচ্ছি।

    এপ্রিল ২০

    গত তিন দিনে আমি বার কয়েক ব্লু-জন গ্যাপের দিকে গিয়েছি। এমনকী, সুড়ঙ্গের ভিতরেও কিছুদূর অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু আমার ল্যাম্পের আলো যথেষ্ট জোরালো না হওয়ায় বেশিদূর যেতে সাহস পাইনি। এবারে আরও আঁটঘাট বেঁধে যেতে হবে। শব্দটা আর দ্বিতীয়বার শোনার সৌভাগ্য হয়নি। এক-একবার মনে হয়েছে যে, প্রথমবারে শোনাটা হয়তো আমার আর্মিটেজের সঙ্গে কথাবার্তার ফলে আমার কল্পনাপ্রসূত। সমস্ত ব্যাপারটাই যে আজগুবি সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যদিও এটা না বলে পারছি না যে, গ্যাপের মুখে ঝোঁপঝাড়ের অবস্থা দেখে এক-এক সময় মনে হয়েছে যে, কোনও অতিকায় জীব হয়তো তার মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে যাতায়াত করছে। মোট কথা, আমার মনে একটা তীব্র কৌতূহল জেগে উঠেছে। অ্যালারটনদের আমি এখনও কিছু বলিনি, কারণ এঁরাও কুসংস্কার থেকে মুক্ত নন। কিন্তু আমি নিজে আরও অনুসন্ধান করব, আর তার। জন্য কিছু মোমবাতিও কিনে রেখেছি।

    আজ সকালে গ্যাপের কাছাকাছি ঝোঁপের আশেপাশে কিছু ভেড়ার লোম পড়ে থাকতে দেখলাম। একটা লোমের গোছায় দেখি রক্ত লেগে রয়েছে। বেশ বুঝতে পারি যে, পাথুরে জায়গায় চরে বেড়ালে ভেড়াগুলো আপনা থেকেই জখম হতে পারে, কিন্তু তাও হঠাৎ ওই লালের ছোপ চোখে পড়াতে কেমন যেন চমকে উঠলাম। রোমানদের কারুকার্যে শোভিত গহ্বরের ওই প্রবেশদ্বার মনের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্কের সঞ্চার করল। গহ্বরের অন্ধকারের ভিতর থেকে যেন আদ্যিকালের একটা ভ্যাপসা গন্ধ আসছে। সত্যিই কি কোনও নাম-না-জানা প্রাণী ওই অন্ধকারের মধ্যে বাস করে? সুস্থ অবস্থায় হয়তো এসব চিন্তা মাথায় আসত না। অসুখে মানুষের স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, আর তাই তার মনে নানান অসম্ভব কল্পনা দানা বাঁধতে পারে।

    এইসব ভীতিজনক চিন্তা আমার সঙ্কল্পকে শিথিল করে দিয়েছিল। ভেবেছিলাম, গহ্বরের রহস্য রহস্যই থাক, এ নিয়ে আর মাথা ঘামাব না। কিন্তু আজ রাত্রে আবার নতুন করে উৎসাহ জেগে উঠেছে, আর মনেও অনেকটা জোর পাচ্ছি। আশা করি, কাল এব্যাপারে আরও কিছুদুর অগ্রসর হতে পারব।

    এপ্রিল ২২

    আমি যথাসাধ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে কালকের অদ্ভুত অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করার চেষ্টা করছি। কাল যখন আমি ব্লু-জন গ্যাপের উদ্দেশে রওনা দিই, তখন বিকেল। বলতে দ্বিধা নেই, সেখানে পৌঁছে। গহ্বরের দুর্ভেদ্য অন্ধকারের দিকে চাইতেই আবার যেন সেই আশঙ্কার ভাবটা আমার মনে জেগে উঠল। মনে হল, একা না এসে একজন সঙ্গী আনা বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হত। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মনে সাহস ফিরিয়ে এনে মোমবাতি জ্বেলে কাঁটা-ঝোঁপের জঙ্গল ভেদ করে গহ্বরের ভিতর ঢুকলাম।

    আলগা পাথরের ঢাকা জমির উপর দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ ফুট নামার পর একটা রাস্তা পেলাম, যেটা একেবারে পাহাড় ভেদ করে সোজা সামনের দিকে চলে গেছে। যদিও আমি জিওলজিস্ট নই, তবু এটুকু বুঝতে পারলাম যে, এ পাথর লাইমস্টোনের চেয়ে অনেক বেশি শক্ত জাতের কোনও পাথর, কারণ এর গায়ে প্রাচীন শাবলের দাগ রয়েছে। দেখলে মনে হয় যেন এই সবেমাত্র খোঁড়া হয়েছে। আমি কোনওমতে হোঁচট খেতে খেতে এই প্রাচীন পাথরের সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললাম। আমার হাতের মোমবাতি আমাকে ঘিরে একটা ক্ষুদ্র আলোর গণ্ডি রচনা করেছে। তার ফলে সামনের সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় পৌঁছে দেখি সেটা গিয়ে পড়েছে একটা বিশাল নোনা-ধরা পাথরের গহ্বরে, যার ছাত থেকে ঝুলে আছে চুনে-ঢাকা অসংখ্য লম্বা-লম্বা আইসি। আবছা আলোয় আরও লক্ষ করলাম যে, গহ্বরের দেওয়াল ভেদ করে চারদিক দিয়ে আরও অনেকগুলো জলে-ক্ষয়ে-যাওয়া রাস্তা এঁকেবেঁকে কোথায় যেন গিয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরও এগোব না ফিরে যাব তাই ভাবছি, এমন সময় আমার পায়ের কাছে একটা জিনিস প্রবলভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

    গহ্বরের মেঝেয় অধিকাংশটাই হয় পাথর না হয় চুনের আবরণে ঢাকা; কিন্তু একটা জায়গায় বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে ছাত থেকে জল ছুঁইয়ে পড়ে কাদা হয়ে আছে। সেই কাদার ঠিক মাঝখানে দেখলাম একটা প্রকাণ্ড ছাপ, অস্পষ্ট অথচ গভীর। উপর থেকে পাথরের চাঁই পড়লে যেরকম হয় অনেকটা সেইরকম। কিন্তু কাছাকাছির মধ্যে কোনও আগা পাথর বা এমন কিছু লক্ষ করলাম না, যাকে ওই ছাপের জন্য দায়ী করা চলে। অথচ কোনও পরিচিত জন্তুর এতবড় পায়ের ছাপ পড়া সম্ভব নয়। আর জন্তুই যদি হয়, তা হলে মাত্র একটা পায়ের ছাপ কেন? যতখানি জায়গা জুড়ে কাদা হয়েছে, কোনও চেনা জন্তু অন্তত আর-একটা ছাপ না ফেলে অতখানি জায়গা পেরোতে পারে না। যাই হোক, আমি ওই আশ্চর্য ছাপটা পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়িয়ে, চারদিকে অন্ধকারের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলাম আমার বুকের ভিতরে একটা দুরু দুরু কাঁপুনি শুরু হয়েছে, আর তার সঙ্গে আমার হাতের মোমবাতিটাও কিছুতে স্থির রাখতে পারছি না।

    অবশেষে নিজের মনকে বোঝালাম যে, অতবড় ছাপ যখন কোনও পরিচিত জানোয়ারের হতে পারে না–এমনকী হাতিরও নয়, তখন এ ধরনের অমূলক কল্পনাকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটানো ছাড়া আর কিছুই নয়। আরও এগোনোর আগে আমি একবার যে সুড়ঙ্গটা দিয়ে গহ্বরে এসে পৌঁছেছি, তার মুখের চেহারাটা ভাল করে দেখে চিনে রাখলাম। এ কাজটা খুবই দরকারি, কারণ এটা ছাড়া আরও অনেকগুলো রাস্তা গহ্বর থেকে বেরিয়েছে। কোথায় ফিরতে হবে সেটা জেনে নিয়ে, অবশিষ্ট মোমবাতি ও দেশলাই-এর কাঠিগুলো একবার পরীক্ষা করে, আমি অসমতল পাথরের উপর দিয়ে গহ্বরের ভিতর এগিয়ে চললাম।

    রওনা হওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আচমকা এক চরম বিপদের সামনে পড়তে হল। আমার সামনে দিয়েই বয়ে চলেছিল প্রায় বিশ ফুট চওড়া একটা নালা। সেটাতে পা না ভিজিয়ে টপকে পার হওয়া যায় কোনখান দিয়ে, সেটা দেখবার জন্য আমি জলের ধার দিয়ে হেঁটে চলেছি, এমন সময় নালার উপর একটা পাথরের ঢিপি চোখে পড়ল। আন্দাজে মনে হল এক লাফে সেই টিপিটার উপর পৌঁছনো যায়। কিন্তু পাথরের তলার দিকটা জলে ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে সেটার উপর লাফ দিয়ে। পড়তেই পাথরটা কাত হয়ে আমায় ফেলে দিল একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা নালার জলে। মোমবাতিটা নিভে গেল সঙ্গে সঙ্গেই, আর আমি ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে জলের মধ্যে পড়ে অসহায়ভাবে এদিক ওদিক হাতড়াতে লাগলাম।

    শেষটায় কোনওরকমে দাঁড়িয়ে উঠে নিজের গোঁয়ার্তুমির কথা ভেবে ভয়ের চেয়ে হাসিই পেল বেশি। জ্বলন্ত মোমবাতিটা অবশ্যই জলে পড়ে খোয়া গেছে, কিন্তু আমার পকেটে রয়েছে আরও। দুটো, কাজেই চিন্তা নেই। একটা মোমবাতি বার করে সেটা জ্বালাতে গিয়ে বুঝতে পারলাম বিপদটা কোথায়; জলে পড়ার ফলে আমার দেশলাইয়ের বাক্সটা ভিজে একেবারে সপে হয়ে গিয়েছে, ফলে সেটাতে আর কোনও কাজই হবে না।

    এবার সত্যি করেই আমার রক্ত হিম হয়ে এল। অন্ধকারের নমুনাটাও এবার বেশ বুঝতে পারলাম। চারদিক থেকে সে অন্ধকার যেন আমায় ঘিরে চেপে ধরেছে; হাত দিয়ে যেন সে অন্ধকারের ঘনত্ব অনুভব করা যায়। আমি কোনওরকমে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। গহ্বরের কোনদিকে কী আছে সেটা প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে চেষ্টাও বৃথা কারণ চিনে রাখার মতো যা কিছু দেখে রেখেছিলাম, তা সবই দেওয়ালের উপর দিকে–সুতরাং মেঝে হাতড়ে কোনও ফলই হবে না। তাও, হয়তো দেওয়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে সাবধানে এগোলে আবার রোমান সুড়ঙ্গর মুখটায় পৌঁছনো যেতে পারে, এই মনে করে আমি এক পা দু পা করে দেওয়ালের দিক আন্দাজ করে এগোতে লাগলাম। অচিরেই বুঝতে পারলাম, এ চেষ্টায় কোনও ফল হবে না। ওই বেয়াড়া অন্ধকারে দশ বারো পা হাঁটার পরেই বুঝলাম যে, এ অবস্থায় দিক্‌বিদিজ্ঞান বজায় রাখা অসম্ভব। নালার কুলকুল শব্দ থেকে অবশ্য বুঝতে পারছিলাম সেটা কোনখান দিয়ে বইছে–কিন্তু সেটা থেকে সামান্য দূরে গেলেই নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় মনে হচ্ছিল। বুঝলাম এ অবস্থায় গহ্বর থেকে বেরোনোর কোনও উপায় নেই।

    আমি আবার সেই পাথরটার উপর বসে আমার শোচনীয় অবস্থা সম্বন্ধে ভাবতে আরম্ভ করলাম। আমি যে ব্লু-জন গহুরে অভিযানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলাম, সে কথা আমি কাউকে বলিনি। সুতরাং আমি হারিয়ে গেলেও আমাকে খুঁজতে কোনও সার্চ-পার্টি যে এদিকে আসবে এমন কোনও আশা নেই। একমাত্র নিজের উপস্থিত বুদ্ধি ছাড়া আমার আর কোনও অবলম্বন নেই। মুক্তির উপায় যেটা রয়েছে, সেটা হল কোনও একটা পন্থা বার করে দেশলাইগুলোকে শুকিয়ে নেওয়া। আমি যখন জলে পড়েছিলাম, তখন আমার শরীরের একটা দিকই ভিজেছিল। বাঁ দিকের কাঁধটা জলের উপরে ছিল। আমি দেশলাইয়ের বাক্সটা বার করে সেটাকে আমার বাঁ বগলের তলায় চেপে বসে রইলাম। শরীরের উত্তাপ সেটাকে শুকোনোর কাজে নিশ্চয়ই কিছুটা সাহায্য করবে। তবে কমপক্ষে ঘণ্টাখানেকের আগে মোমবাতি জ্বালানোর কোনও সম্ভাবনা নেই এবং এই ঘন্টাখানেক চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কোনও গতি নেই।

    আসবার সময় কিছু বিস্কুট পকেটে পুরে এনেছিলাম, তারই একটা মুখে পুরে চিবোতে লাগলাম। বিস্কুটের শুকনো ভাবটা কাটানোর জন্য যে নালায় আমার পতন হয়েছিল, তারই খানিকটা জল আঁজলা করে তুলে মুখে ঢেলে দিলাম।

    খাওয়া শেষ হলে পর নিজের শরীরটাকে ঢিপির উপর একটু এদিক-ওদিক নেড়ে ঠেস দেওয়ার একটা জায়গা বার করে, পা ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। গহ্বরের স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডাটা বেশ তীব্রভাবেই অনুভব করছিলাম, কিন্তু মনকে বোঝালাম যে, আধুনিক চিকিৎসকদের মতে আমার যে রোগ, তাতে জানলা খুলে শোয়া, এবং শীত-গ্রীষ্ম নির্বিশেষে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণ–এ দুটোর কোনওটাই নিষিদ্ধ নয়। ক্রমে গহ্বরের দুর্ভেদ্য অন্ধকার ও নালার একঘেঁয়ে কুলকুলুনি আমায় তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলল।

    কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম জানি না। ঘণ্টাখানেক কিংবা তারও হয়তো কিছু বেশি হবে। এমন সময় হঠাৎ আমাকে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে ঢিপির উপর সোজা হয়ে উঠে বসতে হল। আমার কানে একটা শব্দ এসেছে, যেটা নালার শব্দের চেয়ে একেবারে আলাদা। শব্দটা এখন আর নেই, কিন্তু তার প্রতিধ্বনি এখনও আমার কানে বাজছে। এটা কি মানুষের পায়ের শব্দ? আমাকে খুঁজতে এসেছে। কি কোনও দল? কিন্তু তাই যদি হয় তা হলে তো তারা আমার নাম ধরে ডাকবে। যা শুনেছি তা তো মানুষের গলার শব্দ নয়! আমি দুরু দুরু বক্ষে দম প্রায় বন্ধ করে বসে রইলাম। ওই যে–আবার সেই শব্দ! ওই–আবার! এবার আর থামা নেই। একটানা শব্দ আসছে–কোনও জানোয়ারের পদক্ষেপের শব্দ–দুম দুম দুম দুম্! কী বিশাল এই পদধ্বনি! জানোয়ারটি যে আয়তনে বিরাট, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু মনে হয় পায়ের তেলোগুলো নরম হওয়ার ফলে শব্দটা খানিকটা চাপা। এই অন্ধকারেও সেই পদক্ষেপে বিন্দুমাত্র ইতস্তত ভাব নেই। আর এতেও কোনও সন্দেহ নেই যে, সেটা আমার দিকেই আসছে।

    পায়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে এল। কোনও অজ্ঞাত প্রাণী অন্ধকারের বাধা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে আসছে। আমি পাথরের উপর সটান শুয়ে পড়ে নিজেকে যথাসম্ভব অদৃশ্য করে ফেলার চেষ্টা করলাম। শব্দটা এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ থেমে গেল। তারপর শুরু হল একটা সপাৎ সপাৎ আওয়াজ। জন্তুটা নালার জল খাচ্ছে। তারপর একটুক্ষণ চুপচাপ, কেবল মধ্যে মধ্যে প্রচণ্ড নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ, আর নাক টেনে গন্ধ শোঁকার শব্দ। জন্তুটা কি আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে গেল নাকি? আমার নিজের নাক তখন একটা বিশ্রী বুনো গন্ধে ভরে আছে। তারপর আবার শুরু হল পায়ের শব্দ, আর সেটা যেন নালার এদিকে আমার কাছেই। আমার হাতকয়েকের মধ্যে কিছু আলগা পাথর খড়বড় করে উঠল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে পাথরের উপর ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। তারপর শুনলাম পায়ের শব্দ পিছিয়ে যাচ্ছে। জলের ছপছপানি শুনে বুঝলাম, জন্তুটা নালা পেরিয়ে উলটো দিকে চলে যাচ্ছে। ক্রমে যেদিক দিয়ে শব্দটা এসেছিল সেইদিকেই আবার সেটা মিলিয়ে গেল।

    আমি বেশ কিছুক্ষণ পাথরের উপর পড়ে রইলাম। ভয়ে নড়বার শক্তি ছিল না। শব্দটার কথা বারবার মনে পড়তে লাগল, আর আর্মিটেজের আতঙ্কের কথা, আর নরম কাদার উপর সেই বিরাট পায়ের ছাপের কথা।

    এখন আর কোনও সন্দেহ নেই যে, পাহাড়ের এই গহ্বরে কোনও এক নাম-না-জানা, ভয়াবহ, অতিকায় প্রাণী বাস করছে। সেটা যে কেমন দেখতে, তা এখনও অনুমান করতে পারিনি, তবে এটুকু জানি যে, সেটা আয়তনে বিরাট এবং আশ্চর্য দ্রুতগতি। সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, এমন জানোয়ার অসম্ভব, কিন্তু আমার আজকের অভিজ্ঞতা এর বিপরীত সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব আমার মনকে অস্থির করে তুলল। অবশেষে মনকে বোঝালাম যে, আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছি। আমার রুগণ অবস্থাই আমার মনে এক কাল্পনিক বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু, এবার যে ঘটনাটা ঘটল, তাতে আমার মনে আর সন্দেহের কোনও কারণই রইল না।

    আমার দেশলাই এতক্ষণে শুকিয়েছে মনে করে আমি বগল থেকে সেটা বার করে একটা কাঠি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। গহ্বরের ফাটলে হাত ঢুকিয়ে বাক্সের গায়ে কাঠি ঘষতেই সেটা ফস্ করে জ্বলে ইঠল। মোমবাতি জ্বালিয়ে, যেদিকে জানোয়ার গেছে সেদিকে একবার ভয়ে ভয়ে দেখে নিয়ে রোমান সুড়ঙ্গের দিকে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে জমির নরম অংশটাতে চোখ পড়তেই দেখলাম, আগের ছাপের মতো আরও তিনটে টাটকা ছাপ সেখানে পড়েছে, সেইরকমই গভীর আর সেইরকমই বিরাট। এ-দৃশ্যে আবার নতুন করে যেন ভয়ে আমার হৃৎকম্প শুরু হল। আমি মোমবাতির শিখাটাকে হাত দিয়ে আড়াল করে প্রাণপণে সুড়ঙ্গপথ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে, এক নিশ্বাসে দরজার মুখ দিয়ে বেরিয়ে কাঁটাঝোঁপ ভেদ করে হাঁপাতে হাঁপাতে বাইরের ঘাসের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। মাথার উপর আকাশে তখন অজস্র তারা ঝলমল করছে।

    বাড়ি পৌঁছলাম রাত তিনটায়। আজ এখন পর্যন্ত আমার স্নায়ুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে আতঙ্ক ও উত্তেজনার শিহরন রয়েছে। কিন্তু এখনও আমি কাউকে কিছু বলিনি। এব্যাপারে খুব সাবধানে এগোতে হবে। এখানকার সরল গ্রাম্য অধিবাসীরা, বা নিরীহ অ্যালারটন ভগিনীদ্বয়, আমার এ ঘটনা শুনলে কী মনে করবে জানি না। আমার এখন এমন কারুর কাছে যাওয়া উচিত, যাকে ঘটনাটা বললে সে একটা উপায় বাতলাতে পারবে।

    এপ্রিল ২৫

    গহ্বরের অভিজ্ঞতার পর দুদিন আমি শয্যাশায়ী ছিলাম। গত ক দিনের মধ্যে আমার এমন আর একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে, যাতে অন্যটার চেয়ে কিছু কম ধাক্কা খাইনি। আগেই বলেছি, আমি এমন। একজনের অনুসন্ধান করছিলাম, যে আমাকে কিছুটা পরামর্শ দিতে পারবে। এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে মার্ক জনসন বলে এক ডাক্তার থাকেন। প্রফেসর স্যান্ডারসন এই ডাক্তারটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে একটা চিঠি আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। আমি একটু সুস্থ হয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ঘটনাটা খুলে বললাম। তিনি মনোযোগ সহকারে সবকিছু শোনার পর আমার স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া ও আমার চোখের মণি খুব ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলেন। দেখা শেষ হলে পর তিনি কোনও আলোচনার দিকে না গিয়ে সোজাসুজি বললেন যে, আমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তাঁর আওতার। বাইরে। তবে কাসলটনে মিঃ পিটন বলে এক ভদ্রলোক থাকেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমার ঘটনাটা তাঁকে আদ্যোপান্ত জানানো দরকার। তিনিই নাকি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন।

    অগত্যা, স্টেশন থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট্ট শহরে গিয়ে হাজির হতে হল। শহরের এক প্রান্তে একটা সম্রান্ত অট্টালিকার সামনে গেটের গায়ে পিতলের ফলকে পিল্টনের নাম দেখে বুঝলাম তিনি এখানকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। দরজায় বেল-টা টেপার সময় মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগল। কাছাকাছি একটা দোকানে গিয়ে মালিককে পিটন সাহেব সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করায়। তিনি একগাল হেসে বললেন, সে কী, জানেন না? উনি যে এ-তল্লাটে সবচেয়ে নামকরা মাথার ব্যানোর ডাক্তার! ওই তো ওর পাগলা গারদ। বলা বাহুল্য, আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে

    থেকে সোজা আমার গ্রামে ফিরে এলাম। চুলোয় যাক এইসব পণ্ডিত লোক। এঁরা যেন এঁদের জ্ঞানের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে কোনও কিছুই স্বীকার করতে চান না। অবশ্য, এখন ঠাণ্ডা মাথায় বুঝতে পারছি যে, আমি আর্মিটেজের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি, জনসনও আমার সঙ্গে ঠিক সেই একই ব্যবহার করেছেন।

    এপ্রিল ২৭

    ছাত্রাবস্থায় সাহস ও উদ্যমের জন্য আমার বেশ খ্যাতি ছিল। একবার কোল্টব্রিজের এক হানাবাড়িতে রাত কাটাবার কথা উঠলে আমিই প্রথম এগিয়ে গিয়েছিলাম। এখন আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। তা হলে কি বয়স বাড়ার ফলেই আমার সাহস কমেছে, না কি আমার রোগই এর কারণ? গহুর আর তার অধিবাসীর কথা ভাবলে এখনও আমার মনে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। এ অবস্থায় কী করা যায়, এ প্রশ্ন প্রতি মুহূর্তেই আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। কাউকে কিছু না বলে যদি চুপচাপ বসে থাকি, তা হলে হয়তো গহ্বরের রহস্য চিরকাল রহস্যই থেকে যাবে। আবার যদি সকলের কাছে সব কিছু প্রকাশ করে ফেলি, তা হলে হয়তো সারা গ্রাম জুড়ে একেবারে আতঙ্কের বন্যা বয়ে যাবে। আর না হয় তো এরা আমাকে পাগল ভেবে সেই গারদেই চালান দেবে। সবচেয়ে ভাল পন্থা বোধহয়। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করে আরও ভালভাবে আঁটঘাট বেঁধে আর একবার গহ্বরে অভিযান। আমি এর মধ্যেই কালটনে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে এনেছি। তার মধ্যে প্রধান হল একটা অ্যাসিটিলিন ল্যাম্প ও একটা দোনলা বন্দুক। দ্বিতীয়টা অবশ্য ধার করতে হয়েছে, কিন্তু এক ডজন ভাল কার্তুজ আমি নিজে পয়সা খরচ করে কিনেছি। যা আছে, তাতে একটা আস্ত গণ্ডার অনায়াসে ধরাশায়ী করা চলে। মোট কথা, আমার গুহাবাসী বন্ধুটির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমি। প্রস্তুত। কিছুটা স্বাস্থ্যোন্নতি ও আরও খানিকটা মনের জোর পেলেই আমি যুদ্ধং দেহি বলে বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু আপাতত, এই জানোয়ারটি ঠিক কোন জাতের সে প্রশ্নে আমার ঘুম নষ্ট হতে চলেছে। একের পর এক নানান জবাব আমি নিজেই বাতিল করে দিয়েছি। ভেবে ভেবে কোনও কূল-কিনারা পাচ্ছি না। এটা যে একটা রক্তমাংসের জ্যান্ত জানোয়ার, সেটা তো তার চিৎকার আর তার পায়ের ছাপ থেকেই প্রমাণ হয়। তা হলে কি হিংস্র ড্রাগন জাতীয় যেসব প্রাণীর কথা আমরা রূপকথায় পড়েছি, সেগুলো আসলে কাল্পনিক নয়? তাদের খানিকটা অংশ কি আসলে সত্যি, এবং সেই সত্যটুকু প্রমাণ করার ভার কি শেষটায় আমার উপর পড়ল?

    ৩ মে

    কদিন যাবৎ এখানকার বসন্তকালের খামখেয়ালি আবহাওয়াটা আমাকে বেশ কাবু করেছে। আর এই কদিনের ভিতরই এমন কিছু উদ্ভট ঘটনা ঘটেছে, যার তাৎপর্য কেবল আমিই বুঝি। রাতগুলো মেঘলা হওয়ায় তিনদিন চাঁদের আলো ছিল না। এর আগে ঠিক এমন রাত্রেই একটি ভেড়া উধাও হয়েছে। গত কয়েক রাত্রেও ভেড়া লোপ পেয়েছে–অ্যালারটনদের দুটি, ক্যাটওয়াকের বুড়ো পিয়ার্সনের একটি ও মিসেস মুলটনের একটি। তিন রাত্রে চারটি ভেড়া উধাও। কোনও চিহ্নই পাওয়া যায়নি সেগুলোর, ফলে চতুর্দিকে নানারকম গুজব রটছে। কেউ বলে এটা ভেড়া-চোরের কাজ, কেউ বলে আশেপাশে নাকি বেদেরা আস্তানা গেড়েছে–এ হল তাদেরই কীর্তি।

    কিন্তু এর চেয়েও গুরুতর একটা ঘটনা ঘটেছে গত কদিনের মধ্যে; আর্মিটেজ নিখোঁজ। গত বুধবার রাত্রে সে নাকি তার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল; তারপর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর্মিটেজের আত্মীয়স্বজন নেই, তাই তার অন্তর্ধান তেমন একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেনি। লোকে বলছে সে নাকি অনেক টাকা ধারত, তাই অন্য কোনও জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে গেছে–সেখান থেকে কদিনের মধ্যেই হয়তো তার জিনিসপত্র চেয়ে পাঠাবে। আমার নিজের কিন্তু অন্যরকম আশঙ্কা হচ্ছে। আমার বিশ্বাস ভেড়া-চুরির ব্যাপারটার কোনও একটা বিহিত করতে গিয়েই সে প্রাণ হারিয়েছে। হয়তো সে ওই অজ্ঞাত জীবটির অপেক্ষায় ওত পেতে বসে ছিল, আর সেটা উলটে তাকেই আক্রমণ করে তার গহ্বরের ডেরায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। বিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের মতো সভ্য দেশে এ ধরনের ঘটনা ভাবতেও অবাক লাগে, যদিও আমার মতে এটা মোটেই অসম্ভব নয়। আর সত্যিই যদি তাই হয়, তা হলে কি আমার এ ব্যাপারে একটা দায়িত্ব নেই? আমি যখন এতদূরই জেনেছি, তখন আমার কর্তব্য এটার একটা প্রতিকারের চেষ্টা করা–সম্ভব হলে নিজেই। আজকের একটা ঘটনার পর আমি স্থির করেছি, নিজেই এব্যাপারে একটা কিছু করব। সকালে স্থানীয় পুলিশ-স্টেশনে গিয়েছিলাম। ইনস্পেক্টর সাহেব গম্ভীর ভাবে আমার বক্তব্য একটা মোটা খাতায় তুলে নিয়ে আমাকে নমস্কার করে বিদায় দিলেন। বাইরে বেরোতে না বেরোতে শুনতে পেলাম তাঁর অট্টহাসি। বুঝতে পারলাম, তিনি তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের কাছে আমার কাহিনীটা বেশ রসিয়ে পুনরাবৃত্তি করছেন।

    ঠিক দেড় মাস পর আমার খাটে বালিশের ওপর পিঠ দিয়ে বসে আমি আবার ডায়রি লিখছি। শরীর ও মন বিপর্যস্ত বিহুল হয়ে আছে। যে সংকটের সামনে পড়তে হয়েছিল, আর কোনও মানুষের ভাগ্যে তেমন হয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ব্লু-জন গ্যাপের বিভীষিকা চিরকালের মতো বিদায় হয়েছে, জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য আমার মতো রুগণ ব্যক্তির পক্ষেও কিছু করা সম্ভব হয়েছে। এইবারে যথাসম্ভব পরিষ্কার ভাবে যা ঘটেছিল, তার বিবরণ দিই।

    .

    ৩ মের রাতটা ছিল অন্ধকার ও মেঘাচ্ছন্ন–ঠিক যেমন রাত্রে নাম-না-জানা জানোয়ারটা হানা দিতে বেরোয়। রাত এগারোটায় হাতে লণ্ঠন ও বন্দুক নিয়ে আমি বাড়ি থেকে রওয়ানা দিলাম। যাওয়ার আগে টেবিলের উপর একটা কাগজে লিখে গেলাম যে, আমি যদি না ফিরি, তা হলে যেন ব্লু-জন গ্যাপের আশেপাশে আমার অনুসন্ধান করা হয়। রোমান সুড়ঙ্গের মুখটাতে পোঁছে, কাছাকাছি একটা পাথরের ঢিপি বেছে নিয়ে লণ্ঠনের ঢাকনাটা বন্ধ করে হাতে বন্দুক নিয়ে ঢিপিটার উপর ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।

    এই বসে থাকার যেন আর শেষ নেই। উপত্যকাটার চারদিকে টিপটিপ করছে কৃষকদের বাড়ির বাতিগুলো। দূর থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভেসে আসছে চ্যাপল-লি-ডেল গিজার ঘড়ির ঢং ঢং শব্দ। আশেপাশে অন্য লোকজন যে রয়েছে, তার চিহ্নগুলো যেন আমার একাকিত্বকে আরও করুণ ও দুর্বিষহ করে তুলছিল। এক-এক সময় মনে হচ্ছিল, আমার অভিযানে জলাঞ্জলি দিয়ে সব ছেড়ে-ছুড়ে বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু মানুষের মনে আত্মসম্মান বোধটা এত গভীর ও বদ্ধমূল যে, একটা কোনও সংকল্প নিয়ে একবার অগ্রসর হলে মাঝপথে ফিরে আসা ভারী মুশকিল।

    সেই কারণেই সেদিন আমি গহ্বরের মুখ থেকে ফিরে আসতে পারিনি। আর যাই হোক, আমি কাপুরুষ, এ অপবাদ আমাকে কেউ দিতে পারবে না।

    দূরের গিজার ঘড়িতে বারোটা বাজল। তারপর একটা, তারপর দুটো। এই সময়টা অন্ধকার সবচেয়ে গভীর। তারাহীন আকাশের নীচ দিয়ে মেঘ ভেসে চলেছে। পাহাড়ের ফাটলে কোথায়। যেন একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। এ ছাড়া শুধু এক ঝিরঝিরে হাওয়ার শব্দ। আর সব চুপ। এমন সময় হঠাৎ কানে এল এক পরিচিত আওয়াজ–দুম দুম দুম দুম দুম্ দুম–আর তার সঙ্গে পায়ের। ধাক্কায় পাথর গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ। ক্রমে এদিকে আসছে শব্দটা। কাছে–আরও কাছে। এবার। সুড়ঙ্গের মুখের ঝোঁপঝাড় খচমচ করে উঠল। পরমুহূর্তেই আবছা অন্ধকারের ভিতর দিয়ে সৃষ্টিছাড়া নাম না জানা অতিকায় কী যেন একটা প্রায় নিঃশব্দ দ্রুতপদে গুহা থেকে বেরিয়ে আমার ঠিক পাশ দিয়ে গিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ভয়ে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। বুঝতে পারলাম, এতক্ষণ অপেক্ষা করা সত্ত্বেও, আমার মনটা এই অপ্রত্যাশিত ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

    এবার আমার সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে জানোয়ারটার ফেরার অপেক্ষায় বসে রইলাম। গহ্বরের বাইরের শান্তিময় নিরুদ্বেগ পরিবেশ থেকে বোঝবার কোনও উপায় নেই যে, এক বিপুল বিঘুঁটে প্রাণী এই সবেমাত্র সেখানে হানা দিতে বেরিয়েছে। সেটা কতদূর যাবে, কী মতলবে গেছে, কখন ফিরবে, সেসব জানার কোনও উপায় নেই। পাথরের উপর বন্দুকের নলটাকে বসিয়ে মনে মনে। প্রতিজ্ঞা করলাম যে, দ্বিতীয়বার আর সংকট-মুহূর্তে সাহস হারাব না। যত বড় দুশমনই হোক না কেন, এবার তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।

    সজাগ থাকা সত্ত্বেও জানোয়ারটা যে কখন ফিরে এল, সেটা টেরই পাইনি। হঠাৎ সামনে চেয়ে দেখি–আবার সেই অতিকায় জানোয়ার–ঘাসের উপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে ব্লু-জন সুড়ঙ্গের দিকে আসছে। আবার অনুভব করলাম বন্দুকের ঘোড়র উপর রাখা আমার ডান হাতের তর্জনীটা অবশ হয়ে আসছে। প্রাণপণ চেষ্টা করে কোনওরকমে আমার জড় ভাবটাকে কাটিয়ে উঠলাম। ঝোঁপঝাড় ভেদ করে জানোয়ারটা গুহার ভিতর ঢুকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে এসেছে, এমন সময় আমি বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিলাম। বারুদের ঝলসানিতে মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম এক প্রকাণ্ড, লোমশ ছাই রঙের

    জানোয়ার, নীচের দিকে রঙটা ফিকে হয়ে এসেছে–বেঁটে বেঁটে বাঁকানো পায়ের উপর তার আলিসান শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এক ঝলকের দেখা–আর তারপরেই শুনলাম খড়বড় শব্দ। আগা পাথরের উপর দিয়ে নেমে জানোয়ারটা চলেছে তার গর্তের দিকে। আমার মাথায় হঠাৎ যেন খুন চাপল। ভয়ডর সব দূর করে দিয়ে এক লাফে পাথরের উপর থেকে নেমে বন্দুক ও লণ্ঠন হাতে সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে ছুটে চললাম জানোয়ারটার উদ্দেশে।

    আমার লণ্ঠনের উজ্জ্বল রশ্মি সামনের অন্ধকার ভেদ করে চলেছে। এ সেই দু সপ্তাহ আগের টিমটিমে মোমবাতির আলো নয়। কিছুটা পথ দৌড়নোর পরই জানোয়ারটাকে দেখতে পেলাম–সুড়ঙ্গের এপাশ ওপাশ জুড়ে থপথপিয়ে এগিয়ে চলেছে, তার পায়ের লম্বা ও রুক্ষ নোম চলার সঙ্গে সঙ্গে দুলছে। লোম দেখে যদিও ভেড়ার কথা মনে হয়, আয়তনে জানোয়ারটা সবচেয়ে বড় হাতির চেয়েও বেশ খানিকটা বড়–আর যত লম্বা, ততই যেন চওড়া। পাহাড়ের সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে এই বিরাট বীভৎস জানোয়ারের পিছনে ধাওয়া করার সাহস আমি কোথা থেকে পেলাম জানি না। আদিম শিকারের নেশা যখন মানুষকে পেয়ে বসে, আর সেই শিকার যদি চোখের সামনে পালায়, তা হলে মানুষ যেন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তার পিছনে ছোটে। দোনলা বন্দুক হাতে তাই আমি ছুটে চলেছি এই দানবের পিছনে।

    জানোয়ারটা যে রীতিমতো দ্রুতগতি, সেটা আমি আগে লক্ষ করেছিলাম। এবারে বুঝলাম যে তার আর একটি মারাত্মক গুণ আছে, সেটা হল শয়তানি বুদ্ধি। হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল, সে বুঝি প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে। সে যে আবার উলটোমুখে ঘুরে রুখে দাঁড়াতে পারে, সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আগেই বলেছি, সুড়ঙ্গটা গিয়ে পড়েছে একটা বিরাট গহ্বরে। কিছুক্ষণ দৌড়নোর পর সেই গহুরটাতে পৌঁছতে হঠাৎ জানোয়ারটা থমকে থেমে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।

    লণ্ঠনের সাদা আলোতে তার যা চেহারা দেখলাম, তা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। ভাল্লুকের মতো হিংস্র ভঙ্গিতে সামনের দু পা শূন্যে তুলে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতপ্রমাণ জানোয়ারটা, আয়তনে ভাল্লুকের দশগুণ, উঁচানো দুই পায়ের থাবায় লম্বা তীক্ষ্ণ বাঁকানো নখ, বীভৎস বিকৃত হাঁ করা লাল মুখে ধারালো দাঁতের সারি। ভাল্লুকের সঙ্গে পার্থক্য কেবল একটা ব্যাপারে–যে ব্যাপারে এটার সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনও জানোয়ারের কোনও মিল নেই–সেটা হল জানোয়ারটার ঠিকরে বেরিয়ে আসা, দৃষ্টিহীন, মণিহীন, জ্বলন্ত বলের মতো দুটো চোখ। কী দেখলাম সেটা ভাল করে বোঝার আগেই জানোয়ারটা থাবা উচিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এর পরে আমার হাত থেকে লণ্ঠনটা ছিটকে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কিছু মনে নেই।

    যখন জ্ঞান হল, তখন দেখি আমি অ্যালারটনদের বাড়িতে আমার খাটের উপর শুয়ে আছি। রু-জন গ্যাপের ঘটনাটার পর দুদিন কেটে গেছে। মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে, বাঁ পায়ের হাড় ও পাঁজরের দুটো হাড় ভাঙা অবস্থায় আমি সারারাত ওই গুহার মধ্যে পড়ে ছিলাম। পরদিন সকালে আমার লেখা চিঠি খুঁজে পেয়ে জনাদশেক চাষা দল বেঁধে গিয়ে আমায় খুঁজে বার করে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। সেই থেকে সমানে নাকি আমি প্রলাপ বকেছি। জানোয়ার জাতীয় কিছুই নাকি এদের চোখে পড়েনি। আমার বন্দুকের গুলি যে কোনও প্রাণীকে জখম করেছে, তার প্রমাণ হিসাবে কোনও রক্তের চিহ্নও নাকি এরা দেখতে পায়নি। আমার নিজের অবস্থা, এবং জমিতে কিছু অস্পষ্ট দাগ ছাড়া আমার কাহিনীর সত্যতা প্রমাণ করার মতো কিছুই নাকি পাওয়া যায়নি।

    এই ঘটনার পর দেড় মাস কেটে গেছে। আমি এখন বাইরের বারান্দায় বসে রোদ পোয়াচ্ছি। আমার ঠিক সামনেই খাড়া পাহাড়–তার পাংশুটে পাথরের গায়ে ওই যে দেখা যাচ্ছে র-জন সুড়ঙ্গের। মুখ। কিন্তু ওটা আর আমার মনে ভীতিসঞ্চার করে না। আর কোনওদিনও ওই সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে কোনও ভয়ঙ্কর প্রাণী মনুষ্যজগতে হানা দিতে বেরোবে না। বিজ্ঞানবি অথবা বিদ্যাদিগগজ অনেক সম্ভ্রান্ত বাবুরা হয়তো আমার কাহিনীকে হেসে উড়িয়ে দেবেন–কিন্তু এখানকার দরিদ্র সরল গ্রামবাসীরা আমার কথা এক মুহূর্তের জন্যও অবিশ্বাস করেনি। এ সম্পর্কে কালটন কুরিয়ার পত্রিকার মন্তব্য তুলে দিলাম :

    আমাদের পত্রিকার, অথবা ম্যাটলক, বাক্সটন ইত্যাদি অঞ্চলের যেসব পত্রিকার সংবাদদাতা উক্ত ঘটনার তদন্ত করিতে আসিয়াছেন, তাহাদের কাহারও পক্ষে গহ্বরে প্রবেশ করিয়া ডাঃ জেস হার্ডকাসলের বিচিত্র কাহিনীর সত্যমিথ্যা বিচার করিবার কোনও উপায় ছিল না। উক্ত ঘটনা সম্পর্কে কী করণীয় তাহা স্থানীয় অধিবাসীগণ নিজেরাই স্থির করিয়া প্রত্যেকেই গুহার প্রবেশদ্বারটি প্রস্তর দ্বারা বন্ধ করিতে তৎপর হইয়াছিল। গহ্বরের সম্মুখস্থ ঢালু রাস্তা দিয়া বৃহৎ বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড গড়াইয়া লইয়া সুড়ঙ্গ-দ্বারটি তাহারা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছে। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনাটির পরিসমাপ্তি ঘটে এইভাবেই। স্থানীয় বাসিন্দাগণ ঘটনাটি সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করেন। কেহ কেহ বলেন, রুণ অবস্থাই ডাঃ হার্ডকাসূলের মস্তিষ্কবিকৃতি ও তজ্জনিত উদ্ভট কল্পনাদির কারণ। ইহাদের মতে, কোনও ভ্রান্ত অথচ দৃঢ় বিশ্বাস তাঁহাকে গহ্বরে প্রবেশ করিতে বাধ্য করিয়াছিল, এবং গহ্বরের প্রস্তর ভূমিতে পদস্খলন হেতু তিনি আহত হইয়াছিলেন। গহ্বরের ভিতর যে এক অদ্ভুত জীব বাস করে, এরূপ একটা জনপ্রবাদ বহুঁকাল হইতে এই অঞ্চলে প্রচলিত আছে। স্থানীয় কৃষকদিগের বিশ্বাস যে, ডাঃ হার্ডকালের বিবরণ ও তাঁহার দেহের ক্ষত এই প্রবাদকে বাস্তবে পরিণত করিয়াছে। উক্ত ঘটনা। সম্পর্কে ইহার অধিক কিছু মন্তব্য করা সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ইহার সমর্থন আদৌ সম্ভবপর বলিয়া আমরা মনে করি না।

    কুরিয়ার পত্রিকা এই মন্তব্যটি প্রকাশ করার আগে একবার আমার সঙ্গে আলাপ করলে বুদ্ধিমানের কাজ করত। আমি অনেক ভেবে ঘটনাটার একটা বৈজ্ঞানিক কারণ অনুমান করে এর অবিশ্বাস্যতা খানিকটা দূর করেছি। অন্তত আমার নিজের অভিজ্ঞতার একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসাবে আমি এখানে সেটা পেশ করছি।

    আমার মতে (যে মত আমি ঘটনাটা ঘটবার আগেই ডায়েরিতে ইঙ্গিত করেছি) ইংল্যান্ডের এই সব অঞ্চলে ভূগর্ভে বিস্তীর্ণ জলাশয় রয়েছে। পাহাড়ের ফাটল দিয়ে বাইরের জলস্রোত ভিতরে ঢুকেই এইসব জলাশয়ের সৃষ্টি করেছে। জলাশয় থাকলেই বাষ্পের উদ্ভব হয়, এবং বাষ্প থেকে বৃষ্টি ও বৃষ্টি থেকে উদ্ভিদের জন্ম সম্ভব। পৃথিবীর আদি যুগে হয়তো বা এই ভূগর্ভ জগতের সঙ্গে বাইরের জগতের একটা যোগাযোগ ছিল, এবং সেই অবস্থায় হয়তো বাইরের জগতের গাছপালার কিছু বীজ ও তার সঙ্গে কোনও কোনও প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী এই ভূগর্ভজগতে এসে পড়েছিল। এইসব প্রাণীদেরই একটির বংশধর হয়তো এই জানোয়ারকে দেখে মনে হয় আদিম ভাল্লুকের এক বর্ধিত সংস্করণ। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে হয়তো এই ভূগর্ভজগৎ আমাদের পরিচিত জগতের পাশাপাশি একই সঙ্গে অবস্থান করেছে। রোমান সুড়ঙ্গটি খোঁড়ার সময় হয়তো এই ভূগর্ভজগতের কোনও প্রাণী বাইরের জগতের সন্ধান পায়। অন্ধকারবাসী অন্য সব প্রাণীর মতোই এও দৃষ্টিশক্তিহীন জীব। অথচ অন্য সব ইন্দ্রিয় এতই সজাগ যে, চোখের অভাব পূরণ হয়ে যায়। না হলে সে ভেড়ার সন্ধান পাবে কী করে? এরা যে কেবল অন্ধকার রাত্রে চলাফেরা করে, তার কারণ বোধহয়, মণির অভাবে আলো সহ্য হয় না। আমার লণ্ঠনই হয়তো চরম সংকটের মুহূর্তে আমার প্রাণরক্ষা করেছিল। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। এসব তথ্য আমি লিখে গেলাম আপনাদের বিবেচনার জন্য। একে সমর্থন করা সম্ভব কিনা তা আপনারা বিচার করে দেখবেন। যদি মনে হয় সবটাই অবিশ্বাস্য, তা হলেও আমার কিছু বলার নেই। মূল ঘটনা আপনাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের অনেক উর্ধ্বে। আর আমার ব্যক্তিগত মতামতের প্রশ্ন যদি তোলেন, তা হলে বলব যে, তারও আর বিশেষ কোনও মূল্য নেই, কারণ আমার কাজ ফুরিয়ে এল।

    ডাক্তার জে হার্ডকালের ডায়রির শেষ এখানেই।

    দি টেরর অফ ব্লু জন গ্যাপ
    সন্দেশ, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৪

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅভিরাম
    Next Article মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }