ব্লু ফ্লাওয়ার ৪ – ১
১
বেনারস।
ভিড় গিজগিজ করছে দয়াসাগরবাবার নতুন আশ্রমে। ঝাঁ চকচকে আশ্ৰম।
দয়াসাগরবাবা এসেছেন শোনামাত্র তাঁকে ঘিরে উত্তেজনা চরমে পৌঁছল। বাবার প্রসন্ন মুখ। যে ভক্তরা বাবার কাছে পৌঁছতে পারছে, পা ধরে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। বাবা কাউকে ফুল ছুঁড়ছেন, কারো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ভিড় ক্রমশ বাড়ছে।
হঠাৎ এক হতদরিদ্র মহিলা একটা ছোট ছেলেকে বাবার কোলে দিয়ে কেঁদে পড়ল, “বাবা। বাঁচান”
দয়াসাগর ভরাট গলায় বললেন, “কী সমস্যা তোমার কন্যা?”
মহিলা বলল, “আমার বর মাতাল। বাচ্চার খাবারের জন্য টাকা না দিয়ে সব টাকা দিয়ে মদ খেয়ে ফেরে। আমার ছেলে আমার কাছে থাকলে বেঁচে থাকবে না। ওকে আপনি নিয়ে যান বাবা। আপনার আশ্রমে থাকলে ও মানুষ হবে।”
দয়াসাগর স্মিত হাসলেন। বললেন, “তথাস্তু। আজ থেকে ওর নাম বলরাম। ও আমার কাছে থাকবে।”
মহিলাটি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাবার নামে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করল।
দয়াসাগর তার এক শিষ্যাকে ডেকে তার হাতে শিশুটিকে অর্পণ করে বললেন, “আজ থেকে বলরাম আমাদের সঙ্গে থাকবে।”
সবাই জয়ধ্বনি দিতে লাগল। দয়াসাগর সবাইকে আশীর্বাদ দিতে শুরু করলেন।
২
মেয়েটা হাঁটছে ঢাকার শাঁখারিবাজার এলাকা দিয়ে। গলি, বাজারের মধ্যে দিয়ে মেয়েটা হেঁটে চলেছে। ছোট একটা গুমটি পানের দোকানের সামনে এসে মেয়েটা দাঁড়াল। বোরখা সরিয়ে বলল, “রমজান চাচা আছে?”
দোকানদার পান সাজাতে সাজাতে বলল, “চার নম্বর ঘর।”
মেয়েটা আবার হাঁটতে শুরু করল। মন্দিরের পাশের গলি দিয়ে ঢুকে পড়ল। দোতলা একটা বাড়ির নাম “শকুন্তলা।”
মেয়েটা দরজায় গিয়ে কলিং বেল টিপল। এক হিন্দু মহিলা দরজা খুলল। মেয়েটা বলল, “চার নাম্বার ঘর।”
দরজা ছেড়ে দাঁড়াল মহিলা। মেয়েটা ঘরের ভিতরে ঢুকতে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েটা বলল, “চার নম্বর ঘর কোথায়?”
মহিলা খাটের উপর বসে পড়ে বলল, “ভিতরে যাও। রান্নাঘরের বাঁ দিকের ঘরটা।”
মেয়েটা পর্দা সরিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। রান্না ঘরে প্রেশার কুকারে একটা সিটি দিয়ে উঠল। মেয়েটা দেখল রান্নাঘরের পাশের একটা ঘরে দরজা খোলা। সে ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, “এটাই চার নাম্বার ঘর?”
ঘরের ভেতর থেকে পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “এসো। চিনে এসেছো তাহলে? ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে বসো।”
মেয়েটা দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতর ভাল করে তাকাল। একটা ছোট ঘর। একপাশে চেয়ার টেবিল। টেবিলের ওপর একটা কম্পিউটর। চেয়ার টেবিল লাগোয়া একটা সিঙ্গল খাট। মেয়েটা খাটের উপর বসল। পুরুষ কণ্ঠস্বরের অধিকারী যুবক চশমা পরিহিত। রিভলভিং চেয়ারে বসে কম্পিউটারের মনিটরে মন দিয়ে কিছু দেখছে। মিনিট পাঁচেক পর বলল, “আমি আতর। তুমি আমার নাম শুনেছো?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল। আতর বলল, “তোমার নাম সুমাইমা। তুমি টাঙ্গাইলে থাকো। তাই তো?”
মেয়েটা বলল, “জি।”
আতর বলল, “সুমাইমা, তুমি কি জানো আমরা এখন কী রকম সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি?”
সুমাইমা অস্বস্তির সঙ্গে মাথা নাড়ল, “জি জানি।”
আতর বলল, “আশা করি তুমি এটাও জানো, এখন যদি আমরা সর্বস্ব দিয়ে এদের আটকাতে না পারি, তবে আমাদের দেশটাকে খুব শিগগিরি ইন্ডিয়া গ্রাস করে নেবে?”
সুমাইমা বলল, “আমি এসব জানি। এসব আমাকে বলার কোন দরকার নেই। আমাকে কাজ দিন। কী করতে হবে বলুন।”
আতর চেয়ার ঘুরিয়ে সুমাইমার মুখোমুখি হল, বলল, “কাজ আসবে। তোমার কাজের মত কাজ আসবে। আপাতত তোমার একটাই কাজ। ওদের বিশ্বাসভাজন হওয়া। ওদের লোকেদের সঙ্গে মিশে যাওয়া। পারবে না?”
সুমাইমা মাথা নাড়ল, “জি পারব।”
আতর বলল, “ফ্রেশ হয়ে নাও।”
সুমাইমা বাথরুমে ঢুকে গেল। আতর ফোন বের করে কিছু একটা ভেবে একটা নাম্বারে ফোন করল। ও প্রান্ত ফোন রিসিভ করতেই আতর বলল, “ঘর ফাঁকা না থাকলে ফোন করে লাভ নেই।”
ও প্রান্ত থেকে ভারি কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “শুনছি।”
আতর বলল, “সুমাইমা এসেছে। ওকে টায়ার্ড লাগছে। কী করব?”
“নাটকের দলটায় জুড়ে দে। ওই ছেলেটা… শুভ… ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বল। প্রেম পিরিত না। বন্ধুত্ব।”
“জি ভাই।”
সুমাইমা কিছুক্ষণ পরে ঘরে ঢুকে বলল, “খেয়ে নিয়েছি।”
আতর বলল, “ঠিক আছে। এবার এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে দেখবে বাইরে একটা রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে। ওটায় উঠে যাবে। ও তোমাকে একটা হোস্টেলে নিয়ে যাবে। লেডিস হোস্টেল। আজ রাতটা ওখানেই থাকবে। কাল তোমাকে ওদের জায়গাটা দেখিয়ে দেবো।”
সুমাইমা বলল, “রেস্ট করতে হবে? কেন? আমায় কাজ দিন।”
আতর বলল, “তাড়া নেই তো। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।”
সুমাইমা বলল, “আমি তৈরি। যে কোন কাজের জন্য। যে কোন রকম মানে সব রকম।”
আতর একটু বিস্মিত হয়ে বলল, “তুমি পারবে?”
সুমাইমার চোখ দুটো জ্বলে উঠল, “কাজ দিয়ে দেখুন।”
আতর বলল, “তুমি হোস্টেলে যাও। ভেবো না। তোমার জন্য উপযুক্ত কাজই থাকবে।”
সুমাইমা বেরিয়ে যেতেই আতর আবার আগের নাম্বারে ফোন করল। অপর প্রান্ত বিরক্ত গলায় বলল, “আবার কী হল?”
আতর বলল, “ও যে কোন রকমের কাজ করতে পারবে বলছে। মানে সব।”
অপরপ্রান্ত বলল, “ঠিক আছে। এখনই এত আনন্দ করার কিছু নেই। এখন আপাতত গাছ পোঁতার কাজ চলছে। সেটা চলতে দে। পরে দেখা যাবে।”
আতর বলল, “ঠিক আছে।”
ফোন কেটে গেল।
৩
রাজা মার্কেট।
রাওয়ালপিণ্ডি, পাকিস্তান। রাত এগারোটা।
এখনো ভিড় আছে। তবে কমের দিকে। বড় বড় স্টকিস্টরা এখানে জিনিস কিনতে আসে।
ইমান শেখের দোকান। দোকান বন্ধ করা যাচ্ছে না এত ভিড়। ইমান শেখ ঠিক করেছে সাড়ে এগারোটায় সবাইকে বের করে দোকান বন্ধ করে দেবে। মাঝে মাঝেই হুমকি দিচ্ছে।
চাহিদা হবে নাই বা কেন? বিরাট কাপড়ের দোকান ইমান শেখের। রাতে পাঁচ ছ ঘণ্টা ঘুমোতে পারে। ভোর থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ভিড় করতে শুরু করে। এমনিতেই ভিড় থাকে, তার উপর সামনে ঈদ। দেশের সব থেকে বড় উৎসব। ব্যবসায়ীরা কমদামে জিনিস কিনতে আর যাবেই বা কোথায়? ইমান শেখ ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ী।
হিসেব মেলাতে বসেছে ইমানের ভাই রজ্জাক। জাবদা খাতায় তার হিসেবের পালা চলছে। ইমান দোকানের ভিড় দেখে চিৎকার করল, “আমি আর বেশিক্ষণ দোকান খোলা রাখব না। এক কাজ কর, কাল ভোরে চলে এসো। এখন আর কিছু বিক্রি করা যাবে না।”
কারো কোন হেলদোল নেই। ইমান ঠিক করল যারা দোকানে আছে তারা থাকুক, আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। সে বাইরের কোলাপসিবল গেট বন্ধ করতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। একজন সাড়ে ছ’ফুট লম্বা লোক ঠিক গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। ইমানের মুখ হাঁ হয়ে গেল। সে বিস্মিত গলায় বলল, “জামিল ভাইজান?”
জামিল অত্যন্ত সুপুরুষ। ইমানকে জড়িয়ে ধরে বলল, “চিনতে পেরেছোঁ তাহলে?”
ইমান বলল, “চিনতে পারব না মানে? আপনাকে কে চিনতে পারবে না? আপনি এত দিন কোথায় ছিলেন ভাইজান?”
জামিল বলল, “এখানে কথা বলা যাবে না। তোমার খাস কামরায় চল।”
ইমান বলল, “আসুন আসুন।”
দোকানের পাশের একটা ছোট গলি দিয়ে ইমান জামিলকে দোকানের পিছনের একটা ছোট ঘরে নিয়ে এল। এসি চালিয়ে দিয়ে বলল, “বসুন ভাইজান।”
জামিল বসল। বলল, “আমি সৌদি থেকে ফিরলাম।”
ইমান বলল, “মাশাল্লাহ ভাইজান। আজকেই ফিরলেন?”
জামিল বলল, “হ্যাঁ।”
ইমান বলল, “আমি কী করতে পারি আপনার জন্য?”
জামিল বলল, “অনন্তনাগে আমাদের এক যোদ্ধা নিউজ চ্যানেল শুরু করেছে। ওর জন্য সামান পৌঁছে দিতে হবে বর্ডার পেরিয়ে অনন্তনাগে। সম্ভব?”
ইমান বলল, “বেশক। কবে পৌঁছতে হবে?”
জামিল বলল, “কাল দুপুরের মধ্যে।”
ইমান বলল, “পরশু রাত হলে অসুবিধে হবে ভাইজান? ইন্ডিয়ান আর্মির নজর এড়িয়ে পৌঁছতে হবে। বুঝতেই পারছেন কী সমস্যা হতে পারে।”
জামিল বলল, “মৌলানা সাহেব বলেছেন আমাকে কালকের মধ্যে পৌঁছতে হবে। এবার তুমি বুঝতেই পারছো ওর কাছে পৌঁছনো কতটা কঠিন। উনি অনেক আশা করে আমাকে কাজটা দিয়েছেন। তুমি ছাড়া আর কারো নাম তো মনে পড়ে নি আমার।”
ইমান খুশি হল, “কোন অসুবিধে নেই ভাইজান। আমি ব্যবস্থা করছি। সামান কোথায় আছে?”
জামিল বলল, “আমার গাড়িতে আছে।”
ইমান বলল, “ঠিক আছে। আমি আজকেই ব্যবস্থা করছি।”
জামিল বলল, “আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি না তুমি কাজটা কীভাবে করবে। তবে একটা কথা মনে রেখো, এই সামান যেন কোন ইন্ডিয়ান আর্মির হাতে না পড়ে। বাকিটা তুমি কীভাবে করবে, নিজে ঠিক কর।”
ইমান বলল, “ধরা পড়বে না জনাব। আমাকে সামান দিন।”
জামিল বলল, “এসো।”
জামিল ঘরটা উঠল। ইমান জামিলের পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল। গলি থেকে বড় রাস্তায় এসে জামিল তার গাড়ির কাছে এসে বলল, “গাড়িতে ওঠো।”
ইমান অবাক হয়ে বলল, “জি? গাড়িতে উঠতে হবে?”
জামিল বলল, “হ্যাঁ। ওঠো।”
ইমান গাড়িতে উঠল। জামিল ড্রাইভারের সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল।
ইমান বলল, “সামান গাড়িতে নেই জনাব?”
জামিল বলল, “এখানে দেওয়া যাবে না।”
ইমান শ্বাস ছাড়ল। কিছু বলল না।
মিনিট পনেরো গাড়ি চালিয়ে ইসলামাবাদ হাইওয়েতে গাড়ি দাঁড় করাল জামিল। পকেট থেকে রিভলভার বের করে ইমানের দিকে তাক করে বলল, “মৌলানা সাহেবের খাস নির্দেশ আছে তোকে যেন আমি নিজের হাতে মারি। গদ্দার! লজ্জা লাগে না তুই নিজের মানুষদের সঙ্গে গদ্দারি করিস?”
ইমান গাড়ির দরজা খুলতে গেল। পারল না। জামিল ইমানের মাথায় গুলি করল। রক্ত ছিটকে এসে জামিলের মুখে এসে লাগল। তাতে জামিল ভ্রুক্ষেপ করল না। গাড়ির দরজা খুলে রাস্তার পাশের মাঠে ইমানের বডিটা টান মেরে ফেলে দিয়ে গাড়িতে বসে ফোন বের করল।
ইমানের লাশের ছবি তুলে গাড়ি স্টার্ট করল জামিল।
৪
তুষার বাড়ি ফিরেছেন রাত বারোটা নাগাদ। ইরাবতী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তুষারের কাছে চাবি থাকে। বাড়ির ভেতর ঢুকে তাঁর ব্ল্যাক কফি খেতে ইচ্ছে হল। তুষার ইলেকট্রিক কেটলে গরম জল বসিয়ে টিভির সামনে বসলেন। মাথা ধরে যাচ্ছে। সব জায়গা উপদ্রুত হয়ে যাচ্ছে যেন। এত কিছু মাথায় নেওয়া যাচ্ছে না। তাঁর ফোন বেজে উঠল, স্ক্রিণে “প্রাইভেট নাম্বার”
লেখা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করে বললেন, “হ্যাঁ। বলছি।”
“স্যার, বাজে খবর আছে”, সায়কের গলা ভেসে এল।
তুষার বললেন, “কী হল আবার?”
সায়ক বলল, “ইমান শেখ খুন হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।”
তুষার চিন্তিত গলায় বললেন, “জেনে গেল কী করে?”
সায়ক বলল, “জানি না স্যার। খোঁজ নিচ্ছি।”
তুষার বললেন, “এবার কী হবে?”
সায়ক বলল, “নো আইডিয়া স্যার। ইমান শেখ না থাকা মানে একটা বড় লিঙ্ক চলে যাওয়া।”
তুষার বললেন, “তুমি ইসলামাবাদেই আছো এখন?”
সায়ক বলল, “হ্যাঁ।”
তুষার বললেন, “ওরা তারমানে তোমাকেও খুঁজতে শুরু করবে। ইমানের সঙ্গে তোমার লিংক হয় ওরা বের করে ফেলেছে, নয়ত বের করে ফেলবে। প্ল্যান বল।”
সায়ক বলল, “আস্তানা ছেড়ে দিয়েছি। আজ রাতে বাসস্ট্যান্ডে শোবো।”
তুষার বললেন, “সকালে কোথায় যাবে?”
সায়ক বলল, “হাতে দুটো অপশন আছে স্যার। মুজফফরাবাদ আর কোয়েটা।”
তুষার বললেন, “মুজফফরাবাদে তোমার প্রবল ঝুঁকি আছে। ওরা তোমাকে চিনে নেবে। কোন দরকার নেই। ওখানে যেও না। কোয়েটা চলে যাও।”
সায়ক বলল, “যেখানে ঝুঁকি আছে, সেখানে গেলেই সুবিধা স্যার। আরেকটা ভাল আইডিয়া আছে স্যার। আমি এখানেই থাকবো।”
তুষার বললেন, “কেন থাকতে চাইছো ওখানে?”
সায়ক বলল, “বেশ কিছু লিড আছে স্যার। এখন আমি এখান থেকে দূরে গেলে সেগুলো মিস হয়ে যাবে। পাকিস্তান আর্মির বেশ কয়েকজন উচ্চস্তরের অফিসার আবার নড়চড় শুরু করেছে। নেতারাও ব্যস্ত।”
তুষার চিন্তিত গলায় বললেন, “বুঝেছি।”
সায়ক বলল, “জানি স্যার। চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কী করা যায়।”
তুষার বললেন, “চিন্তাটা অন্য কারণে বড়াল। তুমি ওখানে একবারে একা হয়ে যাচ্ছো। বীরেনকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”
সায়ক বলল, “ওর ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রেনিং হয়ে গেছে?”
তুষার বললেন, “চলছে। শেষের দিকে।”
সায়ক বলল, “পাঠিয়ে দিন তাহলে।”
তুষার বললেন, “ঠিক আছে। তুমি আছো, মনে হয় না বীরেনের কোন অসুবিধে হবে।”
সায়ক বলল, “হবে না। পাঠিয়ে দিন। আমি দেখে নেব।”
ফোন রেখে তুষার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ফোনে একটা মেসেজ লিখে রাখলেন, “বি। কলকাতা- ঢাকা- ইসলামাবাদ।”
#
উত্তরা, ঢাকা।
সকাল ৯টা।
“বীরেন।”
বীরেন চুপ করে বসেছিল। তার সামনে বসে আছেন তারেক হুসেন। বীরেন যেদিন ঢাকায় এসেছিল সেদিন তারেক হুসেন তার উত্তরার ফ্ল্যাটে লুঙ্গি পরে বসে বিড়ি খাচ্ছিলেন। দরজা খুলেছিলেন তার স্ত্রী সাদিয়া। বীরেন এখানে প্রায় পনেরো দিন ধরে আছে। নির্দেশ ছিল যতদিন কোন ফোন না আসবে তাকে এখানেই থাকতে হবে।
এই ফ্ল্যাটে তাকে একটা ঘর দেওয়া হয়েছে। সারাদিন টিভি চলে। তারেকের দুই ছেলে রুবায়েত আর শুভ একজনের বয়স নয়, আরেকজন পাঁচ। দুজনেই চরম বিচ্ছু। কিন্তু তাকে ভারি পছন্দ করে। সারাক্ষণ চাচু চাচু করে কানের পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছে। সাদিয়াভাবির রান্নার হাত চমৎকার। কিন্তু তাও বীরেনের ভাল লাগে না গৃহবন্ধী হয়ে থাকতে।
ব্যাপারটা সামান্য পাল্টাল আজকে। ঘুম থেকে উঠতে দেখল তারেক তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তাকে ডাকছেন।
তারেকের ডাকে সাড়া দিল সে। বলল “হ্যাঁ, বলুন।”
তারেক বললেন “তোমাকে কাল বাদ দিয়ে পরশু সৌদি পাঠানো হচ্ছে। পাসপোর্টের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সৌদিতে কামাল থাকবে। ও তোমাকে ইসলামাবাদ নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবে। বুঝেছো?”
তারেক এতদিন তার সঙ্গে ঢাকাইয়া বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। এই কথাগুলো একেবারে সুন্দর শান্তিপুরী বাংলায় বললেন। বীরেন ঘাবড়াল খানিকটা। বলল “আপনি তো এরকম করে কথা বলতেন না তারেক ভাই।”
তারেক হেসে বললেন “আমি অনেক ভাষাতে সব রকম ভাবেই কথা বলতে পারি। তুমি কি আমাকে বাংলাদেশী ভেবেছিলে? তোমার বাবা যেমন দিনের পর দিন ভারতে ছিলেন একজন পাকিস্তানী হয়েও, আমিও তেমনি একজন ভারতীয় হয়ে শুরু থেকে বাংলাদেশে আছি। ভেবেছিলাম তুষার স্যার আমার
সম্পর্কে তোমায় সামান্য হলেও ইন্ট্রো দেবেন। দেন নি জেনে খারাপ লাগল। উনি আমাকে আর ভালবাসেন না বুঝলে? সব ভালোবাসা ওই ব্যাটা সায়ককে বাসেন।”
দুঃখিত মুখে মাথা নাড়লেন তারেক।
বীরেন মজা পেল। বলল “সায়ককে বাসেন, আপনাকে বাসেন না কী করে বুঝলেন?”
তারেক বললেন “ও আমি বুঝি। খবরই নেন না সাহেব। তবে কী জানো তো, পাকিস্তানে কাজ করাও কঠিন। বাংলাদেশ তো বন্ধুরাষ্ট্র। কেস খেলে আমরা এখান থেকেও ম্যানেজ করে নিতে পারি। ও দেশে খেলে তো আর দেখতে হবে না। সাহেবকে বলেছি সায়কের কাছে তুমি পৌঁছে গেলে অন্তত আমায় যেন খবর দেওয়া হয়। নইলে ভারি চিন্তায় থাকব।”
বীরেন ইতস্তত করে বলল “আচ্ছা ভাবি কি ইন্ডিয়ার?”
তারেক বললেন “না, মীরপুরের। এখানকার। উনি কিছুই জানেন না। জানবেনও না। তোমার মায়ের মতই। অবশ্য আমি তো আর ওকে ঠকাবো না। পুরোদস্তুর সংসার করে যাবো। ছেলে দুটো দেখেছো না? বিচ্ছুর একশেষ। বাংলাদেশ এমনিতে খুবই ভাল দেশ, বন্ধু রাষ্ট্র, যতদিন এই সরকার আছে আমাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। সমস্যা হল কিছু প্রান্তিক জায়গা আছে, যেখানে একশ্রেণীর মৌলবাদী সংগঠন মাথাচাড়া দিচ্ছে। এরা শুধু ভারত বিরোধী কাজ করছে বললে ভুল বলা হবে, বাংলাদেশের মধ্যে সমস্যা তৈরীতেও এদের হাত আছে। এই দেশটা আবেগী মানুষের দেশ। সিংহ হৃদয় মানুষের দেশ। ভুলে গেলে চলবে না, একটা গোটা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছিল ধর্ম নয়, ভাষার ভিত্তিতে। সেই জায়গাটা থেকে দেশটা এগোচ্ছে না পিছোচ্ছে সেটা দেখা আমাদের কর্তব্য। বাংলাদেশকে আমি পরের দেশ মনে করি না বীরেন। এখানে দারিদ্র আছে, কিন্তু এ দেশের মত আন্তরিকতা কোথাও পাওয়া যাবে না।”
বীরেন বলল “আচ্ছা আমি একটু বেরোতে পারি না? সারাদিন ঘরে বসে বসে অস্বস্তি লাগে খুব।”
তারেক জোরে জোরে মাথা নাড়লেন “না। এ দেশে পাকিস্তানি এজেন্ট গিজগিজ করছে। কোন ভাবেই তোমাকে বেরনোর কথা আমি বলতে পারব না। সরি।”
বীরেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল।
৫
মাঝরাত।
একজন মানুষ হেঁটে চলেছেন কলকাতার প্রিন্স আনোয়ার শা রোড ধরে।
বয়স সত্তর পয়ষট্টি থেকে সত্তরের মধ্যে। পরনে কালো স্যুট। সাদা কালো চুল ব্যাকব্রাশ করা। একটু ব্যাকডেটেড ফ্যাশন ভদ্রলোকের।
তবে হাঁটার ভঙ্গি অভিজাত।
হাঁটার গতি খুব বেশি নয়। ধীরই বলা চলে।
ভদ্রলোক রাস্তার ধার দিয়ে হাঁটছেন। কোন দিকে দৃষ্টি নেই তার। মাথা নিচু, পকেটে হাত।
মানুষটি হেঁটে চলেছেন।
রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। রাত বলে ট্রাফিক সিগনাল মানার ঝামেলা নেই। গাড়িগুলোর গতিও তাই কখনো কখনো লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগই বড়লোকের বখাটে ছেলে, কোন নাইট ক্লাব থেকে বেরিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে।
এ ভদ্রলোকের কিন্তু সেদিকে নজর নেই। তিনি চুপচাপ হেঁটে চলেছেন।
সাউথ সিটির সামনের রাস্তাটায় একটা পুলিশের গাড়ির নজরে পড়লেন তিনি।
টহলদারিতে বেরিয়েছিল গাড়িটি।
ভদ্রলোকের সামনে গাড়িটি দাঁড়াল। একজন কনস্টেবল জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন “ট্যাক্সি পাচ্ছেন না?”
ভদ্রলোক কনস্টেবলের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন “নেহী চাহিয়ে। এমনিই ওয়াক করছি।”
কনস্টেবলটি গাড়ির ভেতরে তাকিয়ে বাকিদের বললেন “বোঝো কান্ড। উনি নাকি ওয়াক করছেন। রাত দেড়টার সময় উনি ওয়াক করছেন নাকি!”
গাড়ির ভিতরে একজন উচ্চপদস্থ অফিসার বসে ছিলেন। তার নির্দেশ এল আই কার্ড দেখার। কনস্টেবলটি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন “আই কার্ড দিন।”
ভদ্রলোক শান্ত গলায় বললেন “নেহী হ্যায়।”
কন্সটেবল গাড়ির ভিতর তাকিয়ে বললেন “নেই বলছে স্যার”
গাড়ির ভেতরের অফিসার বললেন “ছেড়ে দাও, কোন উচ্চমানের পাগল হবে।”
কনস্টেবলটি ভদ্রলোককে বললেন “ঠিক আছে, যান। সাবধানে চলাফেরা করুন। রাতের বেলা অনেক ক্রিমিনাল ঘুরে বেড়ায়।”
ভদ্রলোক কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন “শুক্রিয়া।”
ভদ্রলোক আবার হাঁটতে শুরু করলেন।
একইভাবে। তার চোখ কোন দিকে যাচ্ছে না।
মিনিট পনেরো হাঁটার পর ভদ্রলোক দেখলেন রাস্তার বা দিকে একটা অডি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
তাকে দেখামাত্র গাড়িটার দরজা খুলে গেল।
একজন সুন্দরী মহিলা গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দাঁড়ালেন।
ভদ্রলোক গাড়িতে উঠে বসতে ভদ্রমহিলা গাড়ির দরজা বন্ধ করে তার পাশে বসলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল।
ভদ্রলোক বললেন “পাপা কেমন আছে তবসসুম?”
তবসসুম ক্লান্ত গলায় বললেন “ভাল না রফিক চাচা। শরীর খুব খারাপ যাচ্ছে ক’দিন ধরে”
রফিক চোখ বন্ধ করলেন। বললেন “তুমি আমাকে চাচা বলবে না। অনেকবার বলেছি তোমায়। রাতের কলকাতা শহরে হাঁটার মজাই আলাদা। তোমার পাপা আর আমি কত হাঁটতাম জানো?”
তবসসুম হাসলেন “সেসব গল্প অনেক শুনেছি। তবে আপনার এভাবে হাঁটা রিস্কি হতে পারে।”
রফিক বললেন “কত রিস্ক কাটিয়েছি জীবনে। দেশের জন্য সার্ভ করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কী হবে আর?”
তবসসুম বললেন “তবু। আপনার কিমত ক’জন জানে বলুন?”
রফিক হেসে গম্ভীর হয়ে গেলেন।
গাড়ি বেশ ভাল গতিতেই চলছিল। কিছুক্ষণ পর নিউ আলিপুরের এক অ্যাপার্টমেন্টের তলায় গাড়ি দাঁড়াল। তবসসুম গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে বললেন “আসুন… রফিক।”
রফিক নামলেন। তবসুম বললেন “আসুন।”
তবসসুমকে দেখে বিল্ডিং এর সিকিউরিটি স্যালুট করল।
তবসসুম এগিয়ে গিয়ে লিফটের বোতাম টিপলেন। লিফট খুলে যেতে তবসসুম রফিকের দিকে তাকিয়ে সসম্ভ্রমে বললেন “আসুন।”
লিফট দাঁড়াল বিল্ডিং এর আট তলায়। তবসসুম ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপতেই একজন বোরখা পরা মহিলা দরজা খুলল। তবসসুম বললেন “পাপা শুয়ে পড়েছে?”
মহিলা মাথা নেড়ে না বলল।
রফিক কোন দিকে না তাকিয়ে জুতো খুলে ফ্ল্যাটের একটা ঘরে প্রবেশ করলেন।
সাদা ধবধবে খাটে একজন বয়স্ক মানুষ শুয়ে আছেন চোখ খুলে। ষাট পেরিয়েছে মানুষটির। গায়ের রং অত্যধিক ফর্সা। অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন এককালে দেখে বোঝা যায়।
রফিককে দেখামাত্র তার চোখ উজ্জ্বল হল “এত কিছু করে এলে?”
রফিক ভদ্রলোকের খাটের পাশের চেয়ারে বসে ভদ্রলোকের হাত ধরে বললেন “তোমার এই অবস্থা আর আমি না এসে পারি? আসতে আমাকে হতই। রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটাও হল। তাড়াতাড়ি সুস্থ হও আনোয়ার।”
আনোয়ার মাথা নেড়ে বললেন “আমি মনে হয় আর সুস্থ হব না। আমি বুঝতে পারি আমার দিন ফুরিয়েছে। তুমি যে লাহোর থেকে এত দূর আসতে পারবে আমি ভাবতেও পারি নি রফিক।”
রফিক কয়েক সেকেন্ড আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললেন “পাসপোর্টটা দাও। আমার বেশি সময় নেই। আজ রাতেই বাংলাদেশ বর্ডার পেরোতে হবে আমাকে।”
আনোয়ার রফিকের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন “আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে! তুমি আসবে আমি ভাবতেই পারি নি। এখনই দিচ্ছি।”
৬
নতুন দিল্লি। দুপুর বারোটা।
অফিসে কাজ করছিলেন আশরফ। তুষার তার চেম্বারে ঢুকে বললেন, “কী করছো আশরফ, আসল খবরই মিস করে গেলে?”
আশরফ অবাক হয়ে বললেন, “কোন খবর স্যার?”
তুষার তার মোবাইলটা আশরফের দিকে এগিয়ে দিলেন, “চিনতে পারছো?”
আশরফ বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, “মাই গড! এতো রফিক!”
তুষার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললেন, “হু। আর পাশে মেয়েটা?”
আশরফ বললেন, “ওকে তো চিনি না।”
তুষার বললেন, “বেশ। সো, দ্য ব্রেকিং নিউজ ইজ আশরফ, রফিক ইন্ডিয়ায় এসেছিল।”
আশরফ চিন্তিত গলায় বললেন, “আবার কোন মিশন অ্যাক্টিভেট করতে চাইছে নাকি?”
তুষার মাথা নাড়লেন, “নো আইডিয়া। নিয়াজির এগেইন্সটে এরা এখন এক হচ্ছে। নিজেদের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে হয়ত খুব শিগগিরি এ দেশে কিছু করে বসবে। দিস ইজ ভেরি অ্যালার্মিং। কলকাতা থেকে ঢাকা গেছে। শেরাটনে আছে আপাতত। চেক ইনে মেয়েটির নাম আছে তবসসুম নূর। ইন্ডিয়াতে মেয়েটির কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই এখনও। কথা হল মেয়েটি কে?”
আশরফ বললেন, “কলকাতা অফিসে ফোন করে দিচ্ছি স্যার। ভোটার লিস্ট সার্চ করা হোক আগে। রফিক কোন নামে ঢুকেছিল, এত সহজে বেরিয়েই বা গেল কী করে? আমরা কিছুই করতে পারলাম না!”
আশরফের গলা হতাশ শোনাল।
তুষার বললেন, “এসেছিল, বেরিয়ে গেছে, বেরিয়ে যাক। আমি সেসব দিয়ে চিন্তিত নই আশরফ। আমি চিন্তিত এখন কোথায় ওরা কী প্ল্যান করছে, তা নিয়ে। প্ল্যানটা লং টার্ম, না শর্ট টার্ম সেটাও ভাবতে হবে।”
আশরফ বললেন, “লং টার্ম বলতে?”
তুষার বললেন, “রফিক বাংলাদেশে আছে মানে ও এখন বাংলাদেশ বর্ডারে নতুন কোন ঘাঁটি তৈরী করার জন্য গেছে। সেখানে কী কাজ করবে সেটাই তো জানতে হবে। বি এস এফকে আমি বলে দিয়েছি। ঢাকায় আমাদের উইংকেও বলেছি।”
আশরফ বললেন, “স্যার রফিককে ঢাকায় আটকে দেওয়া যাবে না?”
তুষার বললেন, “না। বরং ও ঢাকায় কেন গেছে, কী করছে সেটা জানা বেশি দরকারি।”
আশরফ বললেন, “আমি শেরাটনে চলে যাই স্যার। অসহ্য লাগছে আমার। আমাদের নাকের সামনে দিয়ে জানোয়ারটা এই দেশে এসে চলে গেল, আমি মানতে পারছি না।”
তুষার বললেন, “তুমি যাবে? গিয়ে মাথা গরম করে কিছু করে বসবে না তো?”
আশরফ হাসলেন, “কী যে বলেন স্যার, আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি? আমি শেরাটনে আজ রাতেই চেক ইন করে যাই।”
তুষার বললেন, “বেশ তো, আর সঙ্গে কাকে নেবে?”
আশরফ বললেন, “ঢাকায় সোহরাব আছে তো। আমি ওকে ফোন করে নিচ্ছি।”
তুষার জোর জোরে মাথা নাড়লেন, “না, তোমাদের দুজনেরই মাথা গরম। আমি এই কাজে সোহরাবকে দেবো না। তুমি মাথুরকে নিয়ে যাও।”
আশরফ বললেন, “মাথুর সবে শ্রীনগর থেকে এল স্যার। রেস্ট করছে। ওকে বিরক্ত করা ঠিক হবে?”
তুষার ফোন বের করলেন, “বিরক্তর কী আছে? তোমরা দুজন হলে এই কাজে অটোমেটিক চয়েস। এই তো ফোন পেয়েছি, হ্যালো, মাথুর? হ্যাঁ, ঢাকা যেতে হবে। বাক্সপ্যাটরা বেঁধে এয়ারপোর্ট চলে যাও। আশরফ যাবে। ও তোমাকে ব্রিফ করে দেবে। হ্যাঁ। ওকে।”
ফোন রেখে তুষার হাসলেন, “দেখলে? অ্যাস সিম্পল অ্যাস দ্যাট। কিন্তু মনে রেখো, তোমরা কিন্তু রফিককে ধরতে যাচ্ছো না। ওর গতিবিধি নজর রাখতে যাচ্ছো। আর গোটা ব্যাপারটা আমি মিনিস্ট্রিতে এখন কাউকে জানাবো না। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?”
আশরফ ঘাড় নাড়লেন, “লাউড এন্ড ক্লিয়ার স্যার।”
তুষার বললেন, “আর্মস ঢাকায় পাবে শুভর কাছে। কিন্তু ইউজ করবে না কোনভাবেই। কোনরকম কোন ঝামেলায় জড়াবে না। রফিককে দেখবে, কাচ্চি বিরিয়ানি খাবে, ইলিশ মাছ খাবে, ঢাকার আতিথেয়তা ভোগ করবে, ভাল ছেলের মত দেশে ফিরে আসবে। ক্লিয়ার?”
আশরফ এবার হেসে ফেললেন, “লাউড এন্ড ক্লিয়ার স্যার।”
৭
সকাল দশটা দশ।
ঢাকা শেরাটন হোটেল।
একটা কনভয় এসে দাঁড়াল হোটেলের সামনে। নিরাপত্তা রক্ষীরা সচকিত হয়ে উঠল। গাড়ি থেকে নামলেন দেশের এক পরিচিত নেতা। সোজা হোটেলে ঢুকে লিফটে উঠলেন। তার সঙ্গে চারজন নিরাপত্তারক্ষী আছে। লিফট থেকে নেমে একটা ঘরের সামনে এসে ভদ্রলোক নিরাপত্তারক্ষীদের বাইরে থাকতে বললেন। কলিং বেল টিপতে তবসসুম দরজা খুলল।
বলল, “জাহির সাব?”
জাহির মাথা নাড়ালেন, “জি”
তবসসুম বলল, “আসুন।”
জাহির ভিতরে ঢুকলেন। রফিক ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। জাহির সালাম দিলেন।
রফিক বললেন, “বসুন।”
জাহির বসলেন। তবসুম ভেতরের ঘরে চলে গেল।
জাহির বললেন, “জনাব ইনি কি নতুন ভাবিজী?”
রফিক স্ক্রিণে চোখ রেখে বললেন, “না। তবে হবে হয়ত। আমার পছন্দ হয়েছে একে। বন্ধুর মেয়ে। বলুন, ইস্ট পাকিস্তানের খবর কী?”
জাহির হাত কচলালেন, “জনাব বোধ হয় ভুলে গেছেন, ইস্ট পাকিস্তান বলে এখন আর কিছু নেই।”
রফিকের চোয়াল শক্ত হয়েই মুহূর্তে স্বাভাবিক হল, “আমার কাছে এই জায়গাটা পাকিস্তান ছিল, আছে, থাকবে। বাই দ্য ওয়ে, আপনাদের ভারত প্রীতি বেড়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। বিধর্মীদের বাঙালিরা এত পছন্দ করে কেন? আলাদা কিছু পান নাকি ওদের কাছে যেটা আমরা দিতে পারি না?”
জাহির বললেন, “জনাব সেটা বাংলাদেশ আওয়ামী পার্টি বলতে পারবে। আমরা তো বরাবর ইন্ডিয়া বিরোধী কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা পাকিস্তানের প্রতি সব ধরণের বশ্যতা স্বীকার করেই রয়েছি।”
রফিক গলায় বিদ্রূপ এনে বললেন,”তাই নাকি?”
জাহির বললেন, “জি অবশ্যই জনাব।”
রফিক বললেন, “তিস্তার পানি দেয় না ভারত, তা নিয়ে যে ঝামেলাটা করার কত ছিল সংসদে, করলেন না কেন?”
জাহির ঘাম মুছে বললেন, “জি জনাব, আমাদের ক্রিকেট টিম কাপ জিতল, আমরা সেটা সেলিব্রেশনে ব্যস্ত ছিলাম।”
রফিক বললেন, “ও। মানে সরকারি দল যেভাবে আপনাদের চালাবে, আপনারা সেভাবেই চলবেন। তাই তো?”
জাহির বললেন, “তা না জনাব। উই আর ট্রায়িং আওয়ার বেস্ট।”
রফিক বললেন, “নাহ। ইউ আর নট ট্রাইং জাহির সাব। আমাদের কাছে সব খবরই আছে। ইভেন আই এস আই এ দেশে একবারেই ফ্রি স্পেস পাচ্ছে না। দিস ইজ ভেরি ডিজাপয়েন্টিং।”
জাহির বললেন, “জি জনাব আমাদের সরকার এলে এত সমস্যা হবে না।”
রফিক জোরে হেসে উঠলেন, “এত এত টাকা গর্যান্ট নিয়ে কী করছেন তা আমরা জানি না ভাববেন না জাহির। আমরা আপনাদের নিয়ে একবারেই স্যাটিসফায়েড না। এভাবে চললে সমস্যা বাড়বে। যাই হোক, সিলেটে আমাদের একটা মাদ্রাসা চাই। কবে ব্যবস্থা করতে পারবেন?”
জাহির বললেন, “সিলেটে হবে না জনাব।”
রফিক বিরক্ত মুখে বললেন, “কেন হবে না? তাহলে কোথায় হবে?”
জাহির বললেন, “কিছু সমস্যা আছে। আপনার বর্ডার এরিয়া চাই তো? যশোরে দিয়ে দিচ্ছি?”
জাহির ল্যাপটপে বাংলাদেশের ম্যাপ খুলে বললেন, “না, যশোর উইল নট সার্ভ আওয়ার পারপাস। আমার সিলেট চাই। ট্রাই ইওর বেস্ট। আদারওয়াইজ রোশান সাবের সাথে কথা বলতে হবে।”
জাহিরের মুখে টেনশনের ছাপ এল। ফোন বের করে কাউকে ফোন করে কয়েক মিনিট কথা বলে বললেন, “হয়ে যাবে জনাব। আপনি কীভাবে অপারেট করবেন আমাদের জানান।”
রফিক বললেন, “আপনি কি আমাদের সঙ্গে খেলছেন নাকি বলুন তো? আপনাকে রোশান সাবের নাম নিতে হবে তারপরে আপনি কথা বলবেন, নয়ত বলবেন না, মানে টা কী?”
জাহির বললেন, “না জনাব। ব্যাপারটা সেরকম না। সিলেট নিয়ে আমাদের মধ্যে সত্যি সত্যিই একটু সমস্যা আছে।”
রফিক বললেন, “ইস্ট পাকিস্তান আমাদের মদত দেবে না, ইন্ডিয়ার কথায় উঠবোস করবে, ইন্ডিয়া যা বলবে তাই করে চলবে, তা যদি হয়, তাহলে কিন্তু আই এস আইকেও তার মত করে স্টেপ নিতে হবে।”
জাহির মাথা নিচু করে বললেন, “সে ক্ষেত্রে আপনাকে আমি বলব আপনি সরকার পক্ষের সাথে কথা বলুন।”
রফিক বললেন, “আপনার সরকার সরাসরি ইন্ডয়ার মদতপুষ্ট। আমরা ভেবেছিলাম আপনারা অন্তত আপনার ধর্মের মানুষদের জন্য কিছু করতে আমাদের সাহায্য করবেন। দুঃখের সঙ্গে দেখলাম আপনারা জঘন্যভাবে ব্যর্থ। যাই হোক, আপনার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগল। পরের বার এলে অবশ্যই চা খেয়ে যাবেন। বাই।”
জাহির উঠলেন না। রফিক বললেন, “হোয়াট?”
জাহির বললেন, “জি জনাব, সিলেটের জন্য কিছু ডলার…”
রফিক বললেন, “আপনি দেবেন।”
জাহির চমকে বললেন, “জি?”
রফিক বললেন, “অনেক ডলার নিয়েছেন। কোন কাজ করেন নি। এবার করুন। তারপর ভেবে দেখব। নাও লিভ।”
জাহির কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে অপমানটা হজম করলেন। তারপর বেরোলেন।
দরজাটা বন্ধ হতে রফিক চাপা গলায় বললেন, “ব্লাডি কোরাপ্টেড বাস্টার্ডস!”
৮
লক্ষ্ণৌ এয়ারপোর্টে জনা একশো মানুষ ভিড় করেছে।
বাবা দয়াসাগর এসছেন। বাবার পায়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রণাম করছে।
বাবার জন্য দামী গাড়ি এসেছে। বাবা তাতে চড়ে বসলেন।
সঙ্গে চলল বাবার সঙ্গী সাথীরা।
ইন্সপেক্টর তরুণ শর্মার উপরে দায়িত্ব পড়েছে বাবাকে তার আশ্রমে পৌঁছে দিতে হবে।
তরুণ তার গাড়িতে বসে ট্রাফিকের খোঁজ নিচ্ছিলেন।
তার অধঃস্তন বিজয় বলল, “স্যার, এই সব বাবারা বিশ্বস্ত হয়?”
তরুণ বিরক্ত মুখে বললেন, “আমি তুমি বিশ্বাস না করলে কী হবে,আমাদের সাহেবরা করে। এ নাকি ভি আই পি। কীসের ভি আই পি কে জানে! ভন্ড বাবা কোথাকার!”
বিজয় চানা খেতে খেতে বলল, “আমারও তাই মনে হয়। এই যে বাবার সঙ্গে বাবার ভক্ত মেয়েগুলো থাকে, এদের আমার কেমন যেন লাগছে।”
তরুণ হাসলেন।
দয়াসাগরের গাড়ি কিছুক্ষণ পর তার বাড়িতে ঢুকল।
তরুণদের জিপও ঢুকে গেল বাড়ির চত্বরে। শহরের মধ্যে অনেক জায়গা নিয়ে বাড়ি।
দয়াসাগর গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ভক্তবৃন্দ ছুটে এল। বাবার পা মাটিতে পড়ল না। তার আগেই ভক্তেরা হাত পেতে দিল।
তরুণ অবাক হয়ে দেখলেন বাবার বাড়ির উঠোন অবধি ভক্তরা বাবাকে মাটিতে পা রাখতেই দিল না।
তিনি হেড অফিসে ফোন করলেন, “স্যার, বাবাজী বাড়িতে পৌঁছে গেছেন। আমরা এবার বেরোচ্ছি।”
উত্তর এল, “ঠিক আছে। টহলদারি গাড়ি যেন বাবাজীর বাড়ির উপর নজর রাখে। বাবার উপর থ্রেট আছে।”
তরুণ ফোন রেখে থুতু ফেললেন।
বিজয় বলল, “কী হল স্যার?”
তরুণ বললেন, “এই লোককে কে থ্রেট দেবে বল তো?”
বিজর বলল, “সবই গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য করা হচ্ছে বুঝতে পারছেন না? চলুন স্যার।”
তরুণ গাড়িতে উঠলেন। বিজয় গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে, দেখল বাবা যে গাড়িতে করে এসেছিলেন, সে গাড়ির
ডিকি খোলা হচ্ছে। তরুণ বিজয়ের হাত ধরে বললেন, “এক মিনিট”
গাড়ির ডিকি থেকে একটা বড় ট্রাঙ্ক নামল।
তরুণ বললেন, “গাড়ি থামাও।”
বিজয় গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করল।
তরুণ নেমে গিয়ে ভক্তদের বললেন, “ট্রাঙ্ক খোলো।”
ভক্তদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল।
তরুণ বললেন, “বাবাজীর জানের খতরা আছে। আমি বাবাজীর নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি। এই ট্রাঙ্ক বাড়িতে ঢোকার আগে আমি দেখব ভিতরে কী আছে। তারপরে এটা বাড়ির ভিতরে ঢুকবে।”
খবর বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
বাবা দয়াসাগর বাইরে বেরিয়ে এলেন।
বাবা বললেন, “ওহে বৎস, এই ট্রাঙ্কের ভিতরে আমার বস্ত্র ইত্যাদি আছে। ভয়ের কিছু নেই। নিরাপত্তা ক্ষেত্র পেরিয়ে এই ট্রাঙ্ক নিয়ে আসা হয়েছে। তুমি নিরাপদে প্রস্থান কর।”
তরুণ জেদ ধরে দাঁড়ালেন।
বাবা একজনকে ইশারা করলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তরুণের কাছে উপরওয়ালার ফোন এল, “কী করছো ওখানে?”
তরুণ শান্ত গলায় বললেন, “ডিউটি করছি স্যার। ট্রাঙ্কের মধ্যে বোম থাকতে পারে। দেখতে চাই কী আছে”
“দেখতে হবে না। বেরিয়ে যাও।”
“না স্যার। এটা না দেখে বেরোতে পারব না।”
“শো কজ করা হবে তোমায়। সাসপেন্ডও হতে পারো।”
“হোক স্যার। না দেখে যাবো না। এত বড় ট্রাঙ্কে কী আছে না দেখে আমি নড়ব না।”
ফোন কেটে গেল।
তরুণ ভক্তদের উদ্দেশ্যে বললেন, “তালা খুলুন। নইলে আমি এই ট্রাঙ্ক নিয়ে চলে যাব। আমার উপর বাবাজীর সিকিউরিটির দায়িত্ব আছে মানে আমাকে দেখতে হবে এর ভিতরে কী আছে। বাবাজীর জানের খতরা আছে। বোম থাকলে কে দেখবে?”
একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হল। ধর্মের উপর অনাবশ্যক আঘাত বলে ভক্তরা স্লোগান দিতে শুরু করল। বাবাজী থমথমে মুখে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ট্রাঙ্ক খোলার অনুমতি দিলেন।
এক ভক্ত লনের উপর ট্রাঙ্ক খুলে দিল।
ট্রাঙ্ক ভর্তি পুজোর সামগ্রী।
বাবাজী হাসিমুখে বললেন, “এবার শান্তি?”
তরুণ একবার বাবাজীর দিকে তাকিয়ে সব সামগ্রী সরাতে শুরু করলেন।
মিনিট খানেক পরে ট্রাঙ্কের নিচ থেকে বেশ কয়েকটা রাইফেল উদ্ধার হল।
তরুণ বিস্মিত চোখে কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকালেন।
তবে বেশি সময় পেলেন না।
ভক্তরা তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তরুণ কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ছুরি তার পিঠে গেঁথে গেল।
বিজয়ও পালাতে পারলেন না।
৯
ইসলামাবাদ আই এস আই কন্ট্রোল রুম। আই এস আই চিফ সামশের আলি চেম্বারে বসে সিগারেট টানছে আকবর খান চেম্বারের দরজা নক করল। সামশের ইশারায় আকবরকে প্রবেশ করতে বলল। আকবর চেম্বারে ঢুকে বলল, “জনাব, মুজফফরাবাদ থেকে ফোন এসেছিল।”
সামশের বলল, “আবার কিছু চাই?”
আকবর বসে বলল, “না। জানাবে।”
সামশের বলল, “তোমার কী মনে হয় আকবর? কাশ্মীরে এই বারে কতজনকে পাঠানো যাবে?”
আকবর বলল, “জনাব, যত বেশি লোক সম্ভব।”
সামশের বলল, “রাইট। কাশ্মীর নিয়ে ভাইজানেরা বড্ড বেশি সক্রিয় হয়ে উঠছে। ইন্ডিয়া ইজ এ প্রেটি বিগ কান্ট্রি। এত বড় দেশের আর্মি, ইন্টেলিজেন্স, সবাই শুধু কাশ্মীর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে কী করে হবে? হবে না। হওয়া উচিত না। আমি তো ইন্ডিয়াকে ভালোই বাসি। আমরা চাই, ওরা শুধু কাশ্মীর নিয়ে না ভেবে, গোটা দেশের সিকিউরিটি নিয়েই ভাবুক।”
আকবর হাসল, “জি জনাব।”
সামশের তার ল্যাপটপটা আকবরের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, “স্পটগুলো সম্পর্কে খোঁজ নাও। নেতাদের বড় র্যালি হবার খবর আছে। এই প্রতিটা জায়গা সম্পর্কে আমাকে ডিটেইলড রিপোর্ট পাঠাও।”
আকবর বলল, “জি জনাব, আমাকে মেইল করে দেবেন এই ম্যাপটা?”
সামশের বলল, “শিওর। আরেকটা কথা।”
আকবর বলল, “জি জনাব।”
সামশের বলল, “চাইনিজ ডেলিগেটস আসছে প্রেসিডেন্টস হাউজে। আমাকে যেতে হবে। তোমাকে কবুতর সামলাতে হবে। সেক্টর সিক্স, সেভেন্থ পয়েন্ট পেট্রোল পাম্প। ওকে?”
আকবর ইতস্তত করে বলল, “আমি যাব জনাব? উনি আপনাকে না দেখলে রেগে যেতে পারেন।”
সামশের বলল, “কেন তুমি যাবে না? তুমি রিকোয়ারমেন্টসগুলো জেনে নেবে।”
আকবর বলল, “কেউ জেনে গেলে?”
সামশের বলল, “তাহলে তুমি এই কাজ করছো কেন? অন্য কোন চাকরি কর। এত বছর ধরে এই অর্গানাইজেশনে আছো, এখনো যদি এসব কথা বল, তাহলে তো কিছু বলার নেই।”
আকবর কিছু বলল না। চুপ করে গেল।
সামশের অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠল।
প্রেসিডেন্ট হাউজের বাইরে সাংবাদিকরা দাঁড়িয়ে আছে। সামশের কাউকে পাত্তা না দিয়ে হাউজে প্রবেশ করল।
প্রেসিডেন্টের খাস খানসামা তাকে বিশেষ কক্ষে বসাল। টিভি চলছে। সামশের টিভির রিমোট নিয়ে চ্যানেল
চেঞ্জ করতে শুরু করল।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজি ঘরে প্রবেশ করে বললেন, “সব ঠিক আছে?”
সামশের উঠে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্টকে অভিবাদন করে বলল, “জি জনাব।”
নিয়াজি সোফায় বসে সামশেরকে বসতে বলে বললেন, “মিটিঙটা আজকে হচ্ছে না মিস্টার আলি।”
সামশের বিস্মিত হয়ে বলল, “আমাকে তো কেউ জানায় নি!”
নিয়াজী বললেন, “আমিই বারণ করেছি। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। ফোনে তো সে কথা বলা
সম্ভব না, আপনিও আজকাল এই রাস্তাটা ভুলেই গেছেন, অগত্যা আপনার সঙ্গে কথা বলার এই সুযোগটা আমি ছাড়তে চাই নি।”
সামশের বলল, “শুনে খারাপ লাগল জনাব, এভাবে কি আমি এখানে আসতে পারি?”
নিয়াজী বললেন, “আপনাকে কিছুদিন আগেও এখানে আসার জন্য ফোন করা হয়েছিল, আপনি বলেছিলেন করাচী যাবেন, ফিরে এখানে আসবেন, আপনি আসেন নি। মনে আছে?”
সামশের বলল, “জি জনাব, বালোচরা ওখানে একটা ঝামেলা করছিল, আমি ওখানে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, আর সময় পাই নি।”
নিয়াজী কয়েক সেকেন্ড সামসেরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, আশা করব এর পরে আপনার এখানে আসার জন্য সময় থাকবে।”
সামশের মাথা নাড়ল, “নিশ্চয়ই জনাব। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
নিয়াজী বললেন, “সেটা হওয়াই ভাল। যাই হোক, আপনাকে ডাকার মূল কারণ হল, দেশে এখন একটা নির্বাচন হবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সেনাবাহিনী আর কতদিন দেশ চালাবে? আমি আপনার থেকে একটা ডিটেইলড রিপোর্ট চাই ফ্রম ইওর অরগানাইজেশনাল পারসপেকটিভ, উইদিন সেভেন ডেজ। ইজ ইট পসিবল?”
সামশের বলল, “নিশ্চয় জনাব।”
ঘরে একটা রোবো ভ্যাকুয়াম ক্লিনার সক্রিয় হল। নিয়াজী বললেন, “ওহ, আপনি এ জিনিস দেখেছেন? চিনা আবিষ্কার, এটা নিজে থেকেই ঘর মুছে দেয়। আমি নিজেই অপারেট করি। ভেরি ইন্টারেস্টিং থিং।”
সামশের বলল, “জি জনাব, এটা এখন খুব চলছে।”
নিয়াজী বললেন, “এই জিনিসের মধ্যে ওরা স্পাই ক্যাম বসিয়ে দেশের বাজারে ছাড়ছে নাকি সে ব্যাপারেও আমাকে একটা রিপোর্ট দেবেন। ক্লিয়ার?”
সামশের কয়েক সেকেন্ড নিয়াজীর দিকে তাকিয়ে বলল, “জি জনাব।”