ব্লু ফ্লাওয়ার ৪ – ২০
২০
সোহান, ড্যানি, গুরদীপ এবং ভেঙ্কট।
চারজন পৌঁছে রিপোর্ট করেছে তাদের। আশরফ ওদের খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছেন। ওরা দোতলার ঘরে ঘুমিয়েছে। ভোর রাত অবধি আশরফ জেগে রইলেন।
শেরাটন থেকে আসা প্রতিটা শব্দ শোনার চেষ্টা করলেন।
মাথুর ভোরে উঠে আশরফকে বললেন, “না ঘুমোলে এনার্জি আসবে কী করে?”
আশরফ বললেন, “মেয়েটা ফিরুক। তারপর ঘুম হবে। চিন্তা হচ্ছে।”
মাথুর বললেন, “কেন ফিরবে না? কী নিয়ে ডাউট হচ্ছে তোমার?”
আশরফ বললেন, “ডাউটের কিছু নেই। আমি জানি, মেয়েটা বাহাদুর আছে। ঠিক ফিরে আসবে। তবু রফিক একটা নরকের কীট। এসব লোকের কাছে আমাদের মেয়েদের পাঠালে গিল্ট ফিলিংস কাজ করে। আমরা খুব একটা ভাল কাজ করি না, বল মাথুর?”
মাথুর কাঁধ ঝাঁকালেন, “আমাদের সেই কাজ করতে হবে, যেটা আমাদের দেশের জন্য ভাল। পিছনে তাকানোর জায়গা নেই।”
ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিলেন আশরফ। মাথুর আশরফের পিঠে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে আবার ঘরে ফিরলেন।
আশরফের প্রার্থনা সম্পন্ন হলে মাথুর বললেন, “আজ হঠাৎ রিলিজিয়াস হলে?”
আশরফ বললেন, “নিজের গিল্ট ফিলিংসটা উপরওয়ালার সঙ্গে শেয়ার করলাম। তুমিও ফিরে গঙ্গা স্নান কোর। পাপ কম হবে।”
মাথুর বললেন, “রফিকের রক্তে স্নান করতে পারলে ভাল গঙ্গা স্নান হত। কী বল?”
আশরফ হাসলেন, “তুষার স্যার একবার শুধু নির্দেশ দিক। তারপর রফিকের বারোটা বাজাবো।”
আশরফ কানে হেডফোন লাগালেন। কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
কয়েক মিনিট পরে শুভকে ফোন করলেন। শুভ ঘুমোচ্ছিল। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর ধরল, “হ্যাঁ স্যার।”
আশরফ বললেন, “রুকসার বেরিয়েছে?”
শুভ একটু থমকে গিয়ে বলল, “না তো। বেরোয় নি। কেন স্যার?”
আশরফ বললেন, “ও বেরোলে আমাকে জানিও। আমি মাঝরাতের পর থেকে সেরকম কোন সাউন্ড পাই নি আর।”
শুভ হেসে উঠে বলল, “ওই বুড়োর কী ক্ষমতা আছে স্যার? ঘুমিয়ে পড়েছে দেখুন।”
আশরফ বললেন, “তবু। সতর্ক থাকবে। কোন রকম আপডেট পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ইনফর্ম করবে।”
শুভ বলল, “ঠিক আছে স্যার।”
কম্যান্ডোরা উঠে পড়েছে সাড়ে চারটেতেই। বাড়ির সামনের ছোট বাগানে দৌড় শুরু করেছে। আশরফ মাথুরকে বললেন, “ওদের দেখো। শেখো। সারাক্ষণ ঘুমাচ্ছো আর খাচ্ছো। যাও, দৌড়াও।”
মাথুর বললেন, “কেন দৌড়বো না। আমি কত ফিট দেখবে?”
কয়েক মিনিটের মধ্যে মাথুর বাগানে দৌড় শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষণ ব্যায়াম করে এসে ঘেমে নেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, “কী সর্বনাশ! প্র্যাকটিস একবারে কমে গেছে। হাল ভাল না।”
আশরফ বললেন, “সে তো জানি। ভাল হয়েছে। রোজ সোহানদের সঙ্গে উঠে দৌড় শুরু করবে।”
মাথুর পরনের জামা খুলে ফেললেন। বললেন, “এই চারজনই পুঞ্চে ছিল। সেখান থেকে এখানে জয়েন করল। চার জন চারশো জনের সমান। কে বলবে ওই টেম্পারেচর থেকে এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে?”
আশরফ বললেন, “ওদের থেকে ইন্সপিরেশন নিয়ে ফিট হয়ে যাও। তুমি কিন্তু অনেক হালকা দিয়ে দিয়েছো এখন।”
মাথুর বললেন, “ঠিকই। হালকা দিলে চলবে না। দেখা গেল তোমরা সব বেঁচে গেলে, আর আমি ফেঁসে গেলাম।”
আশরফ বললেন, “না দোস্ত, আমি বেঁচে থাকলে তোমার গায়ে হাত দেওয়ার সাধ্য কারো নেই। যাই হোক, রফিক সিলেট যাওয়ার প্ল্যান করছে।”
মাথুর বললেন, “সিলেটে কী ভাল ডিশ পাওয়া যায়?”
আশরফ বললেন, “জানি না। শুভকে জিজ্ঞেস করতে হবে।”
মাথুর বললেন, “অনেক এক্সারসাইজ হয়ে গেল। আজকেই সিলেট যাব নাকি?”
আশরফ মাথা নাড়লেন, “জানি না। রফিকের উপর ডিপেন্ড করছে। ও আজ গেলে আমরাও আজই যাব।”
মাথুর বললেন, “ঠিক আছে। এরা তো ছোলা টোলা খাবে মনে হয়। তুমি কী খাবে ব্রেকফাস্টে?”
আশরফ বললেন, “আরে ইয়ার এখনো ঠিক করে ভোরের আলো ফোটে নি। তুমি খাওয়ার চিন্তা শুরু করে দিলে?”
মাথুর বললেন, “দৌড় করালে যে? আচ্ছা আমি দেখি ফ্রিজে কী আছে।”
মাথুর ফ্রিজের দিকে দৌড়লেন।
আশরফ কানে হেডফোন দিলেন।
২১
সকাল সাতটা।
আশরফ পায়চারি করছেন।
রফিকের ঘরের সাউন্ড রিসিভার থেকে কোন রকম শব্দ আসছে না।
মাথুর বললেন, “চিন্তা কোর না। বুড়ো ঘুমোচ্ছে আর কী।”
আশরফ বললেন, “আরে কিছু তো সাউন্ড আসবে। নাক ডাকার সাউন্ড এলেও তো বুঝব ঠিক আছে সব।”
ফোন বাজতে শুরু করল আশরফের।
আশরফ দেখলেন শুভ ফোন করছে। তাড়াতাড়ি ধরলেন, “বল শুভ।”
শুভ বলল, “স্যার, একটা ব্যাড নিউজ আছে।”
আশরফ বললেন, “কী ব্যাড নিউজ? রফিকের ঘরের রিসিভারটা নষ্ট হয়ে গেছে না রুকসার ধরা পড়েছে?”
শুভ বলল, “না স্যার। রফিক ইজ ডেড স্যার।”
আশরফ চোখ কপালে তুলে বললেন, “হোয়াট?”
মাথুর নড়ে চড়ে বসলেন, “কী হল?”
শুভ বলল, “রুকসারকে পাচ্ছি না। পালিয়েছে সম্ভবত।”
আশরফ বললেন, “ঠিক আছে। রুকসারকে পাচ্ছো না মানে কী বলতে চাইছো? আর একটা কথা, উই নিড টু লিভ দিস প্লেস।”
শুভ বলল, “বেরিয়ে যান স্যার। পেছনে একটা ছোট দরজা আছে। আমি এখনই গাড়ি নিয়ে আসছি। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকবেন।”
আশরফ বললেন, “ওকে। এসো।”
ফোন কেটে আশরফ মাথুরকে বললেন, “এখনই বেরিয়ে যেতে হবে। সোহানদের বলে দাও। চল চল।”
মিনিট তিনেকের মধ্যে বাড়িটার পেছনের দরজা দিয়ে বেরোলেন তারা। মাথুর বললেন, “রুকসারের কোন বিপদ হয়েছে? কী হয়েছে বলবে তো?”
আশরফ তুষারের ফোনে চেষ্টা করছিলেন। লাইন বিজি বলছে। মাথুরকে বললেন, “রফিক মরে গেছে। রুকসারই মেরেছে মনে হচ্ছে। তারপর রুকসারকে শুভ খুঁজে পাচ্ছে না।”
মাথুর বললেন, “গুড গড। রুকসারই নাম তো মেয়েটার? ডাবল এজেন্ট না তো?”
সোহানসহ বাকি তিনজন কম্যান্ডো চুপ চাপ তাদের সঙ্গে হাঁটছিল।
ফুটপাথে একটা গাছের তলায় দাঁড়ালেন আশরফ। সবাইকে দাঁড়াতে বললেন।
বললেন, “এখানেই অপেক্ষা করা যাক। রুকসার ডাবল এজেন্ট কি না জিজ্ঞেস করছো কেন?”
আশরফ এবার তুষারকে ফোনে পেলেন। খবরটা শুনে তুষার কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “সামথিং ইজ ভেরি ফিশি।”
আশরফ বললেন, “আমরা কী করব স্যার? ঢাকায় থাকবো না বেরিয়ে যাবো?”
তুষার বললেন, “থাকবে। শুভকে বল কোন একটা সেফ হাউজে নিয়ে যেতে। উই নিড টু ওয়েট ফর দেয়ার রিয়্যাকশান। রুকসারের ব্যাপারে যা যা জানার জানতে শুরু কর। আর রফিকের সঙ্গে আরেকটা মেয়ে
এসেছিল। হ্যাঁ, তবসসুম ওর নাম, ওর কী খবর আছে?”
আশরফ বললেন, “না স্যার। জেনে জানাচ্ছি।”
শুভর গাড়ি এসে গিয়েছিল।
তারা গাড়িতে উঠে বসলেন।
আশরফ বললেন, “তুষার স্যার বললেন কোন সেফ হাউজে নিয়ে যেতে। তবসসুমের ব্যাপারেও জানতে চাইছেন।”
শুভ বলল, “ওকেও মেরে দিয়েছে রুকসার। দুজনকেই।”
আশরফ বললেন, “তুমি কী করে খবর পেলে? কে জানাচ্ছে তোমায়?”
শুভ বলল, “স্যার শেরাটনে লন্ড্রিতে আমাদের লোক আছে। ওকে তো নজর রাখতেই বলেছিলাম। সাড়ে ছ’টা নাগাদ ও গিয়ে দেখছে রফিকের ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ঘরে ঢুকে দেখছে দুজন দুটো ঘরের খাটে পড়ে আছে। দুজনেরই গলার কাছে কাটা দাগ। ওদের ঘুমন্ত অবস্থায় রুকসার ওদের মেরে বেরিয়ে গেছে।”
আশরফ শুভকে বললেন, “আমাকে ঠিক করে বল শুভ। রুকসারের সম্পর্কে তুমি কতটা জানো?”
শুভ বলল, “আপনি ভাল করেই জানেন স্যার, আমাদের এজেন্টদের লাইফে কতগুলো শেড থাকে। রুকসার কালকে অবধি আমার কথা শুনে কাজ করেছে। এখন কেন আমাদের কোন রকম ইন্সট্রাকশান ছাড়াই এ কাজ করল, সেটা কী করে বলব?”
আশরফ বললেন, “তুমি সিসিটিভি চেক্ করতে বল। ঠিক কখন রুকসার হোটেল থেকে বেরিয়েছে, বেরিয়ে কোন ট্যাক্সি ধরেছে কি না, জানার চেষ্টা কর।”
মাথুর বললেন, “রফিক মরেছে, সেলিব্রেট করা উচিত তো। আজকে কাচ্চি হবে তো শুভ?”
আশরফ কড়া চোখে মাথুরের দিকে তাকালেন।
মাথুর হাসলেন, “ক্যা ইয়ার। হোয়াই সো সিরিয়াস?”
২২
রশিদ আর শাহিদের জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসি চালিয়ে দুজনে শুয়ে টিভিতে হিন্দি সিনেমা দেখছিল।
রশিদ বলল, “কত বড় দেশ, কতগুলো শহর। চাচাজান ঠিকই বলেন। আমরা ইন্ডিয়ার উপকারই করছি। এত লোকের বেঁচে থাকার দরকার কী?”
শাহিদ জোরে হেসে উঠল।
রশিদ বলল, “কম শব্দ করে হাস ভাই। আমাদের বাবার ভক্তরা ভয় পেয়ে যাবে। এই ধর্মও কী জিনিস ভাই, একটা মুসলমান এসে হিন্দুগুরু সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই তার পায়ে পড়ে যাচ্ছে। হা হা হা।”
শাহিদ বলল, “আমাদের কাজটা ওর জন্য সোজা হয়ে গেছে। এখন আর নৌকোয় করে এদেশে আসার দরকার পড়বে না। চাচাজান জিন্দাবাদ।”
রশিদ বলল, “চাচাজান টেস্ট প্লেয়ার। ওই আছে না, ইন্ডিয়ার, রাহুল দ্রাবিড় টাইপ। লম্বা ভাবে।”
শাহিদ বলল, “ভাই, রাহুল দ্রাবিড় ব্যাঙ্গালোরের লোক না?”
রশিদ বলল, “হবে হয়ত।”
শাহিদ বলল, “যদি আমাদের হাতে দ্রাবিড় মরে যায়, তো?”
রশিদ বলল, “পার্টি হবে।”
শাহিদ বলল, “আর মুম্বইতে হলে শচীন।”
রশিদ বলল, “বলিউড আছে। মৌজা হি মৌজা।”
দরজায় নক হল।
রশিদ উঠে দরজা খুলল।
দয়াসাগর বাবা ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করল।
খাটে বসল।
শাহিদ আর রশিদ বাবার দিকে তাকিয়ে খিক খিক করে হাসতে লাগল। শাহিদ বলল, “শালা, পুরো কাফের লাগছে তোকে বাশার।”
বাশার বলল, “হাসির সময় নেই। কাজের কথা বলি। আমাকে সব ঠিক করতে হয়েছে এ ক’দিন ধরে।”
শাহিদ বলল, “আমরা তো এখন হাসব। তুই কাঁদবি। দিব্যি ছিলি বল? বউ বাচ্চা সব ভুলে… আহাহা কত সেবিকা।”
বাশার এবার রেগে গেল, “আর ভাল লাগছে না। আমি আমার কাজ ঠিক করেই করেছি। নইলে তোমরা এখানে কিছুতেই পৌঁছতে পারতে না। এবার ঠিক করে কথা বল।”
শাহিদ বলল, “শুনতে হবে। আমরা এখানে মরতে পারি যে কোন সময়। আর তুই থাকবি আনন্দে। কেন কথা শুনবি না?”
বাশার বলল, “চাচাজান যা বলবেন, আমাদের তাই শুনতে হবে। কোনটাই আমার ইচ্ছেমত হচ্ছে না। প্রথমে তো তোমারই এ দেশের আসার কথা ছিল। তুমি আসবে না বলেই আমাকে পাঠানো হয়েছিল।”
রশিদ বলল, “ঠিক আছে। তোকে আর রাগাবো না। তোর কাজে আমরা খুশি। আমাদের জন্য কী ব্যবস্থা করা হয়েছে, বল এবার।”
বাশার বলল, “আমাদের কাল ব্যাঙ্গালোরে সভা আছে। পরের দিন চেন্নাই। নেক্সট হায়দ্রাবাদ। আমি ফিরে এলে তোমরা মুভ করবে। যদি মুম্বইয়ের বাইরে যেতে হয়, যাবে।”
রশিদ বলল, “আমাকে আগে বলিস নি কেন? এতদিন কী করব?”
বাশার বলল, “গাড়ি ঠিক করা আছে। মুম্বই ঘুরবে। ভাল ভাল জায়গা আছে, আমি ব্যবস্থা করে রেখেছি। সেখানে যাও, ফূর্তি কর।।”
শাহিদ বলল, “আমরা এখানে ফূর্তি করতে আসি নি। তুই ঘুরে বেড়াবি, আমরা এখানে কেন পড়ে থাকব?”
বাশার বলল, “উপায় নেই বলে। আমাকে আলাদা থাকতে হবে বলে চাচাজান হুকুম দিয়েছেন বলে। আমি ফিরব, তারপরে তোমরা চাচাজানের কথা মত যেখানে যাবার যাবে। আগে বলেছি, আবারও বলছি।”
শাহিদ রশিদের দিকে তাকাল। দুজনের মুখই থমথমে হয়ে গেল।
বাশার সেটা দেখে পাত্তা না দিয়ে হালকা গলায় বলল, “মুম্বই আর করাচীর মধ্যে আমার খুব বেশি পার্থক্য মনে হয় না। তোমাদের মনে হচ্ছে?”
শাহিদ বলল, “আমি জানি না তুই চাচাজানকে কী বুঝিয়েছিস, কিন্তু এভাবে কোন অপারেশন কমপ্লিট হয় না। আমি কিছুতেই এর মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।”
বাশার বলল, “তোমরা আমার থেকে বয়সে বড়। তোমরা যদি প্ল্যানের কিছু বুঝতে না পারো, তাহলে সেটা আমাকে না জিজ্ঞেস করে চাচাজানকে জিজ্ঞেস করে নাও।”
শাহিদ বলল, “চাচাজান তো আমাদের কথা শুনবে না। তোর কথা শুনবে। ঠিক আছে। আমি এখন কিছু বলব না। যদি বেঁচে থাকি, তোর কপালে দুঃখ আছে।”
বাশার বলল, “সেই আশাই করব, তোমরা ঠিক থাকো, ইনশাল্লাহ। আমি যাই, সান্ধ্য প্রার্থনার সময় হয়ে এল।”
শাহিদ আর রশিদ একে অপরের দিকে তাকাল।
২৩
শহরের বাইরে বেশ খানিকটা পথ যাবার পর একটা বাড়িতে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল শুভ। বলল, “এটা আমাদের সেফ হাউজ। যতক্ষণ না জানতে পারব রুকসার কেন এই কাজটা করেছে, ততক্ষণ ঢাকা নিরাপদ নয়।”
আশরফ বলল, “তা তো ঠিকই। ফোনের ব্যাবস্থা আছে তো?”
শুভ বলল, “হ্যাঁ, আপনারা আসুন, আমি ব্যবস্থা করেছি।”
আশরফ সোহানকে বললেন, “তোমরা দেখে নাও।”
সোহান সবাইকে নিয়ে বাড়ির ভিতরটা দেখতে গেল।
মাথুর বিরক্ত গলায় বললেন, “এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই ঢাকার মত ভাল হবে না শুভ।”
আশরফ বললেন, “তোমার কি খাওয়া ছাড়া আর কিছু মাথায় আসে না?”
মাথুর কাঁধ ঝাঁকালেন, “আরে খাওয়াটা তো শুভদের দায়িত্ব, আমরা ওদের গেস্ট না?”
শুভ হেসে বলল, “খাওয়ার ব্যাপারে চিন্তা নেই, আমি ব্যবস্থা করছি। চলুন।”
তারা বাড়ির ভিতরে ঢুকে বসলেন। সোহানরা একটা ঘরের দখল নিল আশরফের নির্দেশ মত। শুভ মাদুর পেতে দিল, “এখানে খাটের ব্যবস্থা নেই। আপনার সমস্যা হতে পারে।”
মাথুর বললেন, “খাওয়া ছাড়া আমার সমস্যার কিছু নেই। এবার বল শুভ, তুমি রুকসারকে নিয়ে কী ভাবছো? আমরা কি রুকসারের খোঁজে যাব? তোমার সাজেশন বল।”
শুভ বলল, “আমি ক্ষুদ্র মানুষ। আমি এই ব্যাপারে কী বলব বলুন তো?”
আশরফ বললেন, “আমাদের কাছে কেউ ক্ষুদ্র না শুভ। মাথুর ঠিকই বলেছে। তোমার কী মনে হচ্ছে?”
শুভ একটু ভেবে বলল, “রুকসারের ব্যাকগ্রাউন্ড সার্চ শুরু করেছি। ওর বাড়িতে আমাদের লোক যাবে। আমরা খুব শিগগিরি ওকে ট্র্যাক করতে পারব আশা করছি।”
আশরফ বললেন, “শুধু আশা করলে হবে না শুভ। ব্যাপারটার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। উই নিড টু নো এভ্রিথিং এবাউট হার, অ্যাট এনি কস্ট। আমাদের সব প্ল্যানই তো ভেস্তে দিল মেয়েটা। যদি ধরেও নি রফিক এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যে ওকে আত্মরক্ষার্থে ওদের মারতে হয়েছে, তাহলেও সে স্টোরি দাঁড়াচ্ছে না।”
শুভ বলল, “যদি রাগের মাথায় মেরে থাকে? আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মানুষের পাকিস্তানীদের উপর প্রবল রাগ আছে। হতে পারে রাগের মাথায় রুকসার কাজটা করেছে, পরে ভয় পেয়েছে আপনারা বকাবকি করবেন, তাই গা ঢাকা দিয়েছে।”
আশরফ গম্ভীর মুখে মাথুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই পয়েন্টটা হলেই ভাল হয়, তাই না?”
মাথুর বললেন, “দেখো শুভ, বাংলাদেশে পাকিস্তানের সিমপ্যাথাইজারও প্রচুর আছে। তুমি যা বললে তা যেমন ঠিক, তার উল্টোটা হলে যথেষ্ট সমস্যা তৈরি হতে পারে। এটা হতে পারে আই এস আই এমন কোন প্ল্যান করেছে যেটা থেকে রফিককে সরিয়ে দিয়েছে। ওদের নিজেদের লোকের উপর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই, রুকসারকে ব্যাবহার করেছে হয়ত।”
শুভ বলল, “হতে পারে। তবে তার জন্য আমার কাছে আসার আগে রুকসারকে অনেক বেশি ব্যাকগ্রাউন্ড সেট আপ করতে হত। যদি তাই হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমরা ওর ট্র্যাপে পড়েছিলাম।”
আশরফের ফোন বাজছিল। আশরফ দেখলেন প্রাইভেট নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ধরলেন, “হ্যালো।”
“কী আপডেট?”
তুষারের কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
আশরফ বললেন, “এটা সিকিওর লাইন স্যার?”
তুষার বললেন, “হ্যাঁ। তোমরা সেফ হাউজে শিফট করে গেছো?”
আশরফ বললেন, “হ্যাঁ স্যার।”
তুষার বললেন, “গুড। চোখ কান খোলা রাখো। আর শোন, রুকসার বলে যে মেয়েটিকে তোমরা পাঠিয়েছিলে, ওর সমস্ত ডকুমেন্টস জাল।”
আশরফ চমকে উঠলেন, “আপনি কী করে জানলেন?”
তুষার বললেন, “জেনেছি, বাংলাদেশে আমার পুরনো সেট আপ আছে। ওসব নিয়ে বেশি ভাবতে হবে না এখন। রুকসারের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। ওটা আলাদা টিম দেখছে, কালকের মধ্যে সব জেনে যাবে।”
আশরফ বললেন, “তাহলে এখন আমরা কী করব স্যার?”
তুষার বললেন, “ঢাকা নড়ে চড়ে বসেছে। রফিকের ব্যাপারে আমরা ওদের ব্রিফ করে দিয়েছি। এখন দেখার আই এস আই ঢাকাকে কোন চাপ দেয় নাকি। আপাতত আমার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকো।”
আশরফ হতাশ গলায় বললেন, “কিছুই করব না স্যার? ঘরে বসে থাকবো?”
তুষার বললেন, “হ্যাঁ। সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ তো। চিন্তা কোর না। কাজ আসবে, শিগগিরি আসবে। তোমাদের মুভমেন্ট এখন থেকে রেস্ট্রিকটেড। আমাকে সাউথ ব্লককে ইনফর্ম করতে হয়েছে। তোমরা কোন রকম মুভমেন্টে থাকবে না।”
আশরফ ফোন রাখলেন।
মাথুর জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল? কী করতে বলছেন স্যার?”
আশরফ বললেন, “আপাতত বিরিয়ানি খেতে বলছেন আর কী।”
মাথুর বললেন, “মানে কিছু করব না?”
আশরফ শুভকে বললেন, “ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের কিছু নেই শুভ। রুকসারের কোন ডকুমেন্ট ঠিক নেই। সব জাল। তুমি স্যারকে রুকসারের ডকুমেন্ট পাঠিয়েছিলে?”
শুভ অবাক হয়ে বলল, “আমি তো কিছু পাঠাইনি।”
আশরফ বললেন, “ঢাকা অফিস থেকে পেয়েছেন তবে। চিন্তা কোর না। আমাদের এখন কোন কাজ নেই আপাতত। তুমি মাথুরকে বিরিয়ানিই খাওয়াও।”
শুভ বলল, “উনি দিল্লিতে বসে এত কিছু পেয়ে যাচ্ছেন?”
আশরফ হাসলেন, “ঐ জন্যই তো উনি আমাদের বস।”
২৪
বাশারকে ঘিরে ভক্ত সমাগম হয়েছে। প্রচুর ভক্ত এসেছে। বাশারের পায়ে আছড়ে পড়ছে।
ব্যাঙ্গালোর যাবে বাশার। তার আগে ভক্তদের সঙ্গে মিলন সভার আয়োজন করা হয়েছে। জানলা থেকে বাশারের জনপ্রিয়তা দেখে শাহিদ বলল, “আমি যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। এত কম সময়ে বাশার এগুলো করল কী করে?”
রশিদ টিভি দেখছিল। বলল, “তোর কি হিংসা হচ্ছে। এসব করতে ইচ্ছা করছে?”
শাহিদ বলল, “না মানে এখানকার মানুষ এরকম কেন? পাগলের মত করছে। ওই দেখ, মায়েরা বাচ্চা কোলে নিয়ে এসেছে। নাম দেবে নাকি বাশার।”
রশিদ বলল, “পাকিস্তানেও এরকমই হয়। আমাদের মত দেশে এরকমই হবে। বাশার এখানে কী করে এত বড় বাবা হয়ে গেল, কেউ ভাবলোই না। তুই এসব ছাড়। এদিকে আয়।”
শাহিদ এসে রশিদের সামনে বসল।
রশিদ বলল, “তুই ফল খা। বেশি ভাবিস না।”
শাহিদ আঙুর খেতে খেতে তার ব্যাগ বের করল। একটা মাঝারি মাপের ফোন ব্যাগ থেকে বের করে বলল, “আমি চাচাজানকে ফোন করি।”
রশিদ রেগে গিয়ে বলল, “ফোন রাখ। বার বার ফোন ইউজ করতে বারণ করে গেছে বাশার।”
শাহিদ বলল, “বাশার বারণ করলেই শুনতে হবে?”
রশিদ বলল, “হ্যাঁ, কারণ আমাদের সেভাবেই চলতে বলা হয়েছে। আরেকটা কথাও ভুলে গেলে চলবে না, বাশার আমাদের অনেক আগে থেকে এখানে ঘাঁটি গেড়ে আছে। ও যদি মনে করে এখানে স্যাটেলাইট ফোন ইউজ করায় কোন সমস্যা আছে, তাহলে আছে। আমাদের ওর কথা শুনতে হবে।”
শাহিদ বলল, “সবার এত কথা শুনে চলতে ভাল লাগে তোর?”
রশিদ বলল, “আমরা অন্য দেশে আছি এখন। সাবধান থাকতেই হবে। বাশার গাড়ি ঠিক করে দিয়েছে বেশি না বকে চল আমরা মুম্বই ঘুরে আসি। আশ্রমের গাড়ি করে ঘুরবি, ফিরবি, খাওয়া দাওয়া করবি, এই নিয়ে খুশি থাক। যখন আমাদের দরকার পড়বে, আমরা তখন কাজ শুরু করব।”
শাহিদ স্যাটেলাইট ফোন সশব্দে তার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “তুই যা, একা একা ঘুরে আয়। আমি যাব না।”
রশিদ বলল, “তাও হবে না। চাচাজান বলে দিয়েছে সব সময় আমাদের এক সঙ্গে থাকতে হবে। আমি একা একা ঘুরতে পারি না। চল, তৈরি হ।”
শাহিদ বিরক্ত মুখে উঠে বাশারের দেওয়া জামা কাপড় পড়ল। আশ্রমের পোশাক, এটা পরলে তাদের আশ্রমিক বলে মনে হবে।
রশিদ জানলার কাছে গিয়ে দেখল একটা বিরাট বড় গাড়িতে বাশার বেরিয়ে গেল। সবার দিকে হাত নাড়ল। তাদের জানলার দিকে একবার দৃষ্টি হেনে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে তারা দুজন বেরোল। আশ্রমের গাড়ি করে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার কাছে পৌঁছল।
তাজ হোটেলের দিকে তাকিয়ে রশিদ চোখ বন্ধ করে শ্রদ্ধা জানাল শহিদদের প্রতি। শাহিদ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখান থেকে কোথায় যেন ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়? আমরা যাব?”
রশিদ বলল, “হ্যাঁ, এলিফ্যান্টা কেভ। আর এদিকেই ট্রম্বে আছে। সমুদ্র থেকে তেল তোলা হয়।”
শাহিদ রশিদের দিকে তাকাল। রশিদ বলল, “তুই যেটা ভাবছিস আমি বুঝতে পারছি। কঠিনতম মিশনের একটা হবে সেটা। মনে হয় না চাচাজান রাজি হবে।”
শাহিদ বলল, “আচ্ছা।”
কথাটা বলে সে ফিক ফিক করে হাসতে লাগল।
২৫
একটা ক্যারামের ব্যবস্থা করা গেছে। চারজন জওয়ান ক্যারাম খেলছে। আশরফ শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছেন। মাথুর ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বললেন, “তুমি কি কিছু আঁচ করতে পারছ?”
আশরফ বললেন, “কী আঁচ করতে হবে?”
মাথুর বললেন, “স্যার আমাদের সঙ্গে চারজন কম্যান্ডো পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে বলছেন আমাদের কিছু করতে হবে না। এর কী মানে দাঁড়ায়?”
আশরফ উঠে বসে বললেন, “রফিক মরেছে এটায় তুমি খুশি তো?”
মাথুর বললেন, “খুশি হয়ে কী হবে? যদি ওরা আরো বড় কোন প্ল্যান করে থাকে, তাহলে রফিকের থাকা না থাকায় কী যায় আসে?”
আশরফ বললেন, “একজ্যাক্টলি। স্যারের কাছে এমন কোন খবর আছে, যাতে বাংলাদেশ জড়িত। সোহানদের এই জন্যই স্যার পাঠিয়ে দিয়েছেন। তুমি আর আমি হলাম স্যারের দুটো ঘোড়া। আমাদের দুটোকে একসঙ্গে পাঠানোর ঝুঁকি কেন নিচ্ছেন সেটা অনুমান করাই যায়।”
মাথুর হেসে বললেন, “আর মন্ত্রী কে? সায়ক?”
আশরফ বললেন, “বড়াল অনেক দূর চলে গেছে ভাই। ওকে আর বোর্ডে বসানোর জায়গায় নেই আমরা।”
মাথুর বললেন, “অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? কবে যে আবার সবাই মিলে পার্টি করব, আদৌ আর করতে পারবো কি না, তাই জানি না।”
শুভ দরজা ঠেলে ঢুকল।
মাথুর বললেন, “কী খবর তোমার?”
শুভ বলল, “একটা খবর পেলাম। মায়ানমার সীমান্ত থেকে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী ঢুকেছে এ দেশে। এখন ওরা চট্টগ্রামে আছে।”
আশরফ বললেন, “পাকিস্তানী তো বুঝলাম, কোন গ্রুপ?”
শুভ বলল, “বছর পনেরো থেকে সতেরো বয়স এদের। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ঢুকেছে খবর পেলাম।”
আশরফ বললেন, “ব্যস। ওই বয়স মানেই হল মগজ ধোলাই করে এদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। নজর রাখা হচ্ছে তো?”
শুভ বলল, “স্যার শুধু খবর এসেছে। নজর রাখার কাজ পুরোপুরি চলছে নাকি সেটা বলতে পারব না।”
আশরফ ফোন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তুষারকে ফোন করলেন। তুষার ধরে বললেন, “বল।”
আশরফ বললেন, “স্যার চট্টগ্রামে একটা দল ঢুকেছে। টিনেজারদের দল। মায়ানমার থেকে ইনফিল্ট্রেট করেছে। পারমিশন চাই স্যার।”
তুষার অবাক গলায় বললেন, “কীসের পারমিশন?”
আশরফ বললেন, “ওদের ধরার।”
তুষার বললেন, “ধরে কী করবে? আমি ঢাকা ইন্টেলিজেন্সকে জানিয়ে দিচ্ছি। ওরা ব্যবস্থা করবে।”
আশরফ বললেন, “স্যার ঢাকা সম্পর্কে তো আপনিও ভাল করে জানেন। এদের হাফ আমাদের সাপোর্ট করে, হাফ পাকিস্তানকে করে। ইন ফ্যাক্ট এখন পাকিস্তানীদের সমর্থনের পাল্লা বেশি যাচ্ছে। কেন অকারণ রিস্ক নেবেন?”
তুষার বললেন, “সে যাই হোক, আমরা কূটনৈতিক চাপ দিতে পারি খুব বেশি হলে। তোমাদের এই অপারেশনে নামাতে পারি না। একটা কথা মনে রাখো, চট্টগ্রামে জামাতের বেস মারাত্মক স্ট্রং। ওখানে কিছু করতে পারা কঠিন ব্যাপার। আর কয়েকটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে কী করতে চাইছ? হতে পারে ওরা এখানে কোন মাদ্রাসায় ট্রেনিং ক্যাম্প চালাতে এসেছে।”
আশরফ বললেন, “এটাও হতে পারে ওরা চট্টগ্রাম থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে কোন এক সীমান্ত দিয়ে আমাদের দেশে ঢুকে গিয়ে কোন ব্লাস্ট করল।”
তুষার বললেন, “তার জন্য আমরা তো আছি। কেন খামোখা টেনশন দিচ্ছ তুমি? এখন অলরেডি একটা ঝামেলায় ফেঁসে আছো, বাংলাদেশে কী হচ্ছে তার আপডেট আমার কাছে আছে। ভেবো না। যেখানে আছো সেখানেই থাকো।”
আশরফ বললেন, “স্যার আপনি আমাদের চট্টগ্রাম যেতে দিন অ্যাটলিস্ট।”
তুষার বললেন, “কেন জেদ করছ খান? কী হয়েছে তোমার? এত অধৈর্য তো তুমি ছিলে না। ওখানে অসুবিধা হচ্ছে কোন?”
আশরফ বললেন, “না স্যার। ঠিক আছে। গুড নাইট স্যার।”
তুষার বললেন, “টেক কেয়ার। গুড নাইট।”
ফোন কাটলেন তুষার। আশরফ ঘরে ঢুকতে মাথুর বললেন, “বস কী বললেন?”
আশরফ বললেন, “কিছু না। হাত পা বেঁধে বসে থাকতে হবে আমাদের। শুভ, খাওয়াও কিছু। খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কোন কাজ নেই এখন মনে হচ্ছে।”
২৬
আগের দিন সৌদি থেকে ইসলামাবাদ যেতে যতটা না সময় লেগেছিল, তার থেকে অনেক বেশি মানসিক চাপ ছিল।
তার ওপর সায়ক যখন বলল তারা এক পাকিস্তানি সেনার বাড়িতে অনুপ্রবেশ করে থাকছে, বীরেন খানিকটা ঘাবড়েই ছিল।
বিছানায় এপাশ ওপাশ করে ঘুম এল রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ। ভোর চারটের সময় সায়ক তার কাঁধে চাপড় মেরে তুলে দিল, “উঠে পড় বীরেন।”
বীরেন উঠে বসল। সায়ক বলল, “পেট ক্লিয়ার করে নাও। একটা গাড়ি জোগাড় করেছি।”
বীরেন তাড়াতাড়ি উঠে বাথরুমে গিয়ে যতটা পারে পেট খালি করার চেষ্টা করল। প্রবল চেষ্টাতেও পুরোপুরি পেট খালি হল না। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে বাথরুম থেকে বেরোতে সায়ক তাকে পাঠান কুর্তা পায়জামা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “এটা পরে নাও। আর ফেজ টুপিটা টেবিলের ওপর আছে। পরে নাও।”
বীরেন তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নিল।
একটা জিপ দাঁড়িয়ে ছিল বাড়িটার সামনে
সায়ক বলল, “বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। আমি একবার জাস্ট দেখে নি কিছু ফেলে গেলাম কি না।”
বীরেন বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশ অন্ধকার। রাস্তাঘাট ভারি সুন্দর। স্ট্রীট লাইটগুলো জ্বলছে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সায়ক বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বলল, “চলে এসো।”
বীরেন গাড়িতে গিয়ে বসল।
সায়ক গাড়ি স্টার্ট করে বলল, “উর্দুতে তুমি সড়গড়?”
বীরেন বলল, “হ্যাঁ।”
সায়ক বলল, “প্র্যাকটিস কর। আমাদের ওখানে যেমন বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন বলার ধরণ, এখানেও তাই। যেখানে যাবে, বলবে কম, শুনবে বেশি। বোকা সেজে থাকলে সব থেকে ভাল। তবে বোবা হয়ে টিকে থাকা বিপদ। যতটা প্রয়োজন, তার বাইরে কোন কথা বলবে না। তোমাকে আমি প্ল্যান্ট করছি রাওয়ালপিণ্ডি রাজা মার্কেটে। সব থেকে বেশি ভিড় হয় এখানে। তুমি এখানে একা থাকবে। কাউকে কোন ফোন করবে না। কারো সঙ্গে কোন যোগাযোগ করার দরকার নেই। তুমি অনাথ বা এতিম। এখানে কাউকে চেনো না। কাজ খুঁজছিলে বলে তোমাকে আমি দিয়ে যাচ্ছি।”
বীরেন বলল, “কী কাজ করতে হবে?”
সায়ক বলল, “দোকানে যা যা কাজ থাকে। এরা হোলসেলার। কাপড় বওয়া, হিসেব করা, সব করতে হবে। মানুষের ভিড় হল লুকিয়ে থাকার সেরা জায়গা। এই ভিড়েই লুকিয়ে থাকবে অমূল্যরতন। চোখ কান খোলা রাখবে। কোথাও কিছু লিখে রাখবে না। যা লেখা থাকবে, সব মগজে। মগজাস্ত্র ছাড়া এখানে তোমার আর কোন অস্ত্র নেই।”
বীরেন বলল, “বুঝেছি।”
সায়ক বলল, “শোয়েব আলি। এটাই তোমার নাম এখন, মনে রেখো”
বীরেন বলল, “ঠিক আছে।”
ইসলামাবাদ পেরিয়ে রাওয়ালপিণ্ডির দিকে গাড়ি চলল। রাজা মার্কেটে এই ভোরেও ভিড় শুরু হয়ে গেছে। বাজারের বাইরে গাড়ি ছেড়ে সায়ক বলল, “আমার সঙ্গে চল।”
দুজনে হাঁটতে থাকল। সকাল সকাল কর্মব্যস্ত লোকের ভিড়ে জমজমাট বাজার। একটা দোকানে ঢুকে সায়ক দোকানের মালিকের কাছে গিয়ে সেলাম জানিয়ে বলল, “সুলেমানভাই, খবর কী?”
সুলেমান রুপি গুনছিল। সায়ককে দেখে বলল, “আরে সোবাহান মিয়াঁ। কতদিন পরে দেখা। সব ঠিক আছে তো?”
সায়ক হাসল, “হ্যাঁ মিয়াঁ। আপনি দোকানের জন্য এক বিশ্বস্ত লোক খুঁজছিলেন না? আমি আমার এক পরিচিতকে নিয়ে এসেছি। গ্রামের ছেলে। বাপ মা মরা এতিম। কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আমার তো আপনার কথাই মনে পড়ল। ও শোয়েব আলি। শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন। আপনি যা কাজ দেবেন, আশা করি পারবে। অসুবিধে হবে না।”
সুলেমান বীরেনের আগাপাস্তালা দেখে বলল, “কী মিয়াঁ, হিসেবের কাজ জানো তো?”
বীরেন বলল, “জি জনাব। যেটা জানি না শিখিয়ে দেবেন।”
সুলেমান বলল, “দোকানের পিছনের ঘরে শোয়া। সারাদিন কাজ। এখন কাজ শেখো। বেশি দিতে পারবো না, তবে যদি বিশ্বাসী লোক হও, খাওয়া পরার অভাব রাখবো না এটা মনে রেখো। ঠিক আছে?”
বীরেন মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে জনাব।”
সায়ক বলল, “তাহলে মিয়াঁ, আমি আজ চলি? শোয়েবকে আপনার জিম্মায় দিয়ে দেলাম।”
সুলেমান বলল, “নাস্তা করে যান মিয়াঁ। নাস্তা না করে তো আপনাকে ছাড়ব না।”
সুলেমান বীরেনের দিকে তাকাল, “বাইরে দেখো পরোটার দোকান আছে। সোবাহান মিয়াঁর জন্য পরোটা নিয়ে এসো।”
সুলেমান বীরেনের হাতে রূপি দিল। বীরেন দোকান থেকে বেরোল। আগে হলে কান্না পেত, এখন সেসব পাচ্ছে না তার। মজা লাগছে। অচেনা জায়গায় কাজ। সে কি পারবে? ওসব ভাবলে চলবে না। তাকে পারতেই হবে।
২৭
আতর জাহিরের সামনে কাচু মাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
জাহির বলল, “কী হল? এরকম মুখ করে তাকিয়ে থাকার কী হল?”
আতর বলল, “কী করব জনাব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এত বড় একটা কাজে পাঠালাম, কাজ তো পুরো উল্টো করে চলে এল!”
জাহিরের ফোন বাজছিল। জাহির ধরল, “জি জনাব।”
ও প্রান্ত থেকে সামসেরের কন্ঠ ভেসে এল, “খবর চেপে যেতে হবে। এখন হাইলাইট করা যাবে না।”
জাহির ধরলো, “জি জনাব।”
সামশের বলল, “মেয়েটাকে নিয়ে কোন আপডেট পাওয়া গেছে?”
জাহির বলল, “না জনাব।”
সামশের বলল, “তুমি শিওর, মেয়েটা তোমাদের লোক ছিল?”
জাহির বলল, “জি একশো ভাগ জনাব। সব দিক থেকে কনফার্ম করেছিলাম।”
সামশের বলল, “কাকে মেরেছে বুঝতে পারছো? কোন ধারণা আছে?”
জাহির চুপ করে গেল।
সামশের ও প্রান্ত থেকে ফোন কেটে দিল।
জাহির আতরের দিকে তাকালো, “ও মাগীরে যেখান দিয়ে পাবি, যেখানে পাবি, যে অবস্থায় পাবি ধরতে হইবো। যদি না পারোস, নিজে নিজেরে মারবি, ঠিক আছে?”
আতর আতঙ্কিত মুখে মাথা নাড়ল।
#
দয়াসাগর আশ্রম। দুজনে নামাজ পড়ে উঠল। শাহিদ খাটে বসে বলল, “বাশার না থাকলে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। থাকলে ওর পেছনে লেগে মজা পাওয়া যেত।”
রশিদ বলল, “মজাতেই আছে। যে কোন সময় আমাদের ঘাড় থেকে নামিয়ে এখানকার ধর্মগুরু হয়ে যাবে। আর কী চাই? বিরাট ক্ষমতা হয়ে গেছে।”
শাহিদ গম্ভীর হয়ে গেল, “অতো সোজা না। একবার বেগড়বাই করলে ওর হিসেব ঠিক বুঝে নেওয়া হবে। সেটা বাশার খুব ভালভাবে জানে।”
রশিদ হেসে উঠল, “বেচারা বাশার। একবার র ওর খোঁজ পেলে খালি হাতে জবাই করবে ওকে।”
শাহিদ বলল, “বাশারের কিছু না হওয়াই ভাল এখন। হলে সমস্যা বাড়বে। এখানকার পুলিশদের সঙ্গে ওর
দহরম মহরম দেখেছিস? ওর জন্য আমাদের দিকে কেউ চোখ তুলেও তাকাবে না।”
রশিদ বলল, “চাচাজান ছিল বলেই তো এত কিছু হল? কার প্ল্যান এগুলো? চাচাজানেরই তো!”
শাহিদ বলল, “জানি না চাচাজান কী ভেবে রেখেছে আমাদের জন্য।”
রশিদ বলল, “ফোন কর। আমি বলছি। জিজ্ঞেস কর আমাদের এখন করণীয় কী।”
শাহিদ উঠল। ব্যাগ থেকে ফোন বের ফোন করল। ও প্রান্তে একবার রিং হতেই ফোন রিসিভ হল, “কেমন আছিস আমার বাঘেরা?”
শাহিদ সালাম জানিয়ে বলল, “এখানে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। সারাদিন বদ্ধ ঘরে থাকা যায় নাকি? চাচাজান যেন আমাদের খুব তাড়াতাড়ি কোন কাজের ব্যবস্থা করে।”
ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল, “আজ রাতে কাজ দিচ্ছি। আপাতত ঘরে থাকাই ভাল। যত কম বেরোনো যায়, তত ভাল। বাশার ফিরলে কাজে নেমে পড়তে হবে। উপরমহল থেকে অর্ডার এলে মিশন শুরু হবে। চিন্তার কোন বিষয় নেই, বাশার যখন আছে, কোন ভয় নেই।”
শাহিদ বলল, “ভয়ের কোন ব্যাপার নেই। শুধু কাজ চাই। জন্নত নসীব হওয়ার থাকলেও যেন যা হবে তাড়াতাড়ি হয়। আমরা ভয় পাই না। আমরা আমাদের মানুষদের কথা সর্বত্র পৌঁছনোর জন্য যা যা করতে হয়, তাই করব। চাচাজান আমাদের শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা নেবেন।”
ফোন কেটে গেল। শাহিদ উত্তেজিত মুখে রশিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “রাতে কাজ আসছে। বলছে বাশার ফিরলে কাজ শুরু করতে হবে।”
রশিদ শান্ত মুখে বলল, “বাশার খুব গুরুত্ব পেয়ে গেছে দেখছি। আমাদের থেকে বাশার এত বেশি গুরুত্ব পেয়ে গেল? অথচ বাশারের জায়গায় আমার আসার কথা ছিল আগে। চাচাজান বাশারকেই পাঠাল। ঠিক আছে। কোন অসুবিধা নেই। বাশারই যদি এখন ভি আই পি হয়, তবে তাই হোক। দেখা যাক ও কী বলে।”
শাহিদ বলল, “আমিও তো সেটাই বলছি। বাশারের উপর যেন একটু বেশিই টান হয়ে গেছে সবার। কী এমন কঠিন কাজ? বুরবক লোকেদের আরো বুরবক বানাচ্ছে! যেন আমরা এখানে থাকলে এ কাজটা করতে পারতাম না! কী এমন হাতিঘোড়া কাজ ছিল।”
রশিদ বলল, “চাচাজান যদি আজকে কোন কাজ না পাঠায়, তাহলে আমি চাচাজানের অপেক্ষায় থাকব না। তার আগেই বড় ঘটনা ঘটাবো। আমরা কী কাজ করব, তার জন্য আমাদের বাশারের জন্য বসে থাকতে হবে, চাচাজানের এই ফয়সলা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।”
শাহিদ বলল, “কালকে? কোথায় করব?”
রশিদ বলল, “এখানেই করব। লোক গিজগিজ করছে সবখানে। যেখানেই বিয়ে হবে, সেখানেই বারাত আসবে। চিন্তার কিছু নেই।”
শাহিদ বলল, “স্লিপারদের কাজে লাগাবো না?”
রশিদ বলল, “দুশমন মুলুকে দুশমনদের মেরে মরব, আর কাউকে দরকার হয়? কাউকে না। চাচাজান আজকাল খুব সামশের সাবের সঙ্গে মিটিং করছে। এত মিটিং করার কী আছে? এসব সিদ্ধান্ত নিতে এত সময় নিলে হয়?”
শাহিদ উত্তেজনায় রশিদের হাত চেপে ধরে বলল, “তুই যা ঠিক করবি তাই হবে। আমাদের দুজনের জান্নাত নসীব হোক, তার আগে যতজন ভারতীয়কে জাহান্নামে পাঠাতে পারি, তত লাভ। দরকার নেই কারো নির্দেশের অপেক্ষায় থাকার।”
রশিদ বলল, “আজকে রাতটা শুধু দেখব। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, আমরা দুজনেই নেব।”
শাহিদের দু চোখ জ্বলে উঠল, “বেশক।”
২৮
“মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশে যে আগুন জ্বলেছিল, তা যখনই শুনি, আমরা একদিকে যেমন উত্তেজিত হই, ভয়ও পাই। অনেকেই জানে না, পূর্ব পাকিস্তানে গ্রামের পর গ্রাম পাক সেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। হিন্দুদের দেখা মাত্র খুন করা হত, হিন্দু মেয়েদের রেপ করা হত। প্রচুর, অসংখ্য, কোন হিসেব পাওয়া যাবে না স্যার।”
শুভ ভোর বেলাতেই চলে এসেছিল। খাবার টেবিলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। শুভর কথা শুনে আশরফ বললেন, “সে হিসেবে পাকিস্তানের উপর বাংলাদেশের প্রচুর রাগ থাকার কথা।”
শুভ ম্লান হেসে মাথা নাড়ল, “দুঃখের কথা অনেকের মধ্যেই সে রাগ নেই। ধর্মের কালো কাপড়ে তাদের চোখ বাঁধা। এখনও পাকিস্তানের সিমপ্যাথাইজার প্রচুর আছে। রাজাকারদের সেভাবে শাস্তি দেওয়া হয় নি তখন। রাজাকার প্রচুর আছে এ দেশের আনাচে কানাচে। খুঁজলে অনেক রাজাকার পাওয়া যাবে। কুখ্যাতদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। বাকিদের কিছুই হচ্ছে না।”
মাথুর মন দিয়ে পরোটা খেতে খেতে বললেন, “পাকিস্তান বেশ কয়েকটা দেশকে ইন্ডিয়ায় ইনফিল্ট্রেট করতে ইউজ করে। বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় মাদ্রাসাগুলোকে আই এস আই ট্রেনিং ইন্সটিটিউট হিসেবে ব্যবহার করছে। আমার মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে, রফিকের প্ল্যান আরো বড় হতে পারে। জানি না এরপর কী হতে পারে।”
শুভর ফোন বেজে উঠল। শুভ ফোন ধরে উত্তেজিত হয়ে বাইরে চলে গেল। আশরফ মাথুরের দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বললেন, “কী হল?”
মাথুর বললেন, “দেখো, আবার কিছু হল নাকি।”
মিনিট দুয়েক পরে শুভ চিন্তিত মুখে ফিরল। আশরফ বলল, “কী হয়েছে?”
শুভ বলল, “ভাগ্যিস আগের সেফ হাউসটা ছেড়ে এসেছি। ওখানে ব্লাস্ট হয়েছে এখন।”
মাথুর আশরফ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। মাথুর বললেন, “কারা করেছে জনা গেছে?”
শুভ মাথা নাড়ল, “না। তবে আপনাদের খবর গেছে ওদের কাছে।”
মাথুর বললেন, “কাদের কাছে? আই এস আই?”
শুভ বলল, “ডিরেক্ট আই এস আই নাও হতে পারে। হতে পারে আই এস আই ফান্ডেড এখানের কোন অর্গানাইজেশন। ওই বাড়িটার খবর ওদের কাছে যাওয়া মোটেও ভাল খবর না।”
আশরফ ফোন বের করে তুষারকে ফোন করে সবটা বললেন। তুষার শুনে বললেন, “ফোনটা স্পিকারে দাও।”
আশরফ স্পিকারে দিলেন। তুষার বললেন, “শুভ শুনতে পাচ্ছো?”
শুভ বলল, “জি স্যার।”
তুষার বললেন, “সেফ হাউজের কথা ঢাকা সি আই ডি জানত?”
শুভ বলল, “না স্যার। শুধু দুজন জানতেন। মিজান সাহেব আর ডি আই জি সাহেব। ওরা কাউকে বলার লোক নন।”
তুষার একটু ভেবে বললেন, “এই সেফ হাউজের কথা কে জানে?”
শুভ বলল, “কেউ জানে না স্যার। আমি কাউকে বলি নি। এই সেফ হাউজ আমিই বের করেছিলাম। আমার নানার বন্ধুর বাড়ি এটা। এখন কেউ থাকে না।”
তুষার বললেন, “ঠিক আছে। তুমি এখন থেকে কোথাও যেও না। ওদের সঙ্গে থাকো।”
শুভ অবাক হয়ে বলল, “তাহলে স্যার বাজারহাট করব কী করে?”
তুষার বললেন, “সেগুলো কর। কিন্তু ওরা যদি তোমাকে ট্রেস করে ফেলে, তাহলে এই সেফ হাউজও ট্রেস হয়ে যাবে। আমি এখনই ঢাকা সরকারকে এখানে ইনভলভ করতে চাইছি না। সেক্ষেত্রে তোমাকে অনেক রেস্ট্রিক্টেড ওয়েতে চলতে হবে। অ্যাম আই ক্লিয়ার?”
শুভ বলল, “জি স্যার।”
তুষার বললেন, “তোমাদের সবাইকেই বলছি, ঢাকা ইজ স্টিল সেফ। চিন্তার কোন কারণ নেই। তোমরা অ্যালার্ট থেকো শুধু। আমায় শুধু রুকসারের ব্যাকগ্রাউন্ডটা পুরো পুরি বের করা অবধি অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে অন্য কোন অর্গানাইজেশন অ্যাক্টিভ হলে সেটা কারা, তারা বন্ধু না শত্রু, সেটা বের করতে সময় লাগবে।”
আশরফ বললেন, “স্যার, যারা ওই বাড়িটায় বোম ফেলেছে, তারা বন্ধু হবে ভাবার কি কোন কারণ আছে?”
তুষার থমকে গিয়ে বললেন, “সেটা ঠিক। আচ্ছা শুভ, রুকসার ওই বাড়িটা সম্পর্কে জানত?”
শুভ বলল, “জি স্যার।”
তুষার বললেন, “গুড গড। তাহলে রুকসার আমাদের শত্রু?”
শুভ বলল, “আমি ওর ব্যাপারে কী করে বলি বলুন তো? এখন তো কিছুই মিলছে না দেখছি।”
তুষার বললেন, “আমি এই মুহূর্তে ঢাকা মিশন অ্যাবর্ট করতে বলতে পারি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ঢাকা ছাড়াটা আমাদের জন্য কোন মিস্টেক হতে পারে।”
আশরফ বললেন, “স্যার, শুভ বলছিল মায়ানমার থেকে বেশ কিছু পাকিস্তানি ঢুকেছে। এটা ওদের কাজ হতে পারে?”
তুষার বললেন, “হতে পারে, নাও পারে। আই এস আই বাংলাদেশে অনেক ছেলেই ঢুকিয়ে যাচ্ছে। একেকজনের একেক রকম লক্ষ্য।”
মাথুর বললেন, “স্যার, লস্কর বা অন্য কোন অর্গানাইজেশন হলে?”
তুষার বললেন, “ভীষণ অ্যালারমিং। ঠিক আছে। আমি কয়েকটা উইং অ্যাক্টিভ করছি বাংলাদেশে। আপডেট দিচ্ছি তোমাদের। বাই।”
তুষার ফোন কেটে দিলেন। আশরফ চিন্তিত মুখে বললেন, “আবার কী উইং?”
মাথুর কাঁধ ঝাঁকালেন, “কে জানে!”
২৯
সারাদিন ধরে দোকানের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রথম দুদিন বস্তা ধরতে হয়েছিল, পরে সুলেমান তাকে হিসেবের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। বীরেনের হিসেবের মাথা পরিষ্কার। জায়গা করতে বেশি সময় লাগে নি। পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা আসে। দুপুরে কোন এক সময়ে টিফিন করতে হয়। দোকানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেলে বীরেন বাইরেটা দেখে। কোথায় ছিল, কোথায় চলে এসেছে। এত বড় পৃথিবী, ধর্ম, ভাষা, হিংসার ভিত্তিতে ভাগ হয়ে গেছে। এক কালে তো এ সবই ভারতবর্ষ ছিল, এখন পাকিস্তান হয়ে গেছে। ঠিক কী করতে হবে তাকে, সে নিজেও জানে না। সায়ক যোগাযোগ রাখবে বললেও এখানে যেদিন তাকে দিয়ে গেল, তারপর থেকে আর যোগাযোগ করে নি। এভাবেই শুরু হয় তার মত বাকিদেরও। হয়ত বাকি জীবনটা এখানে কাজ করেই চলে যাবে। হয়ত কালকেই ডাক পড়বে কোন মিশনে। বেশি ভাবা ছেড়ে দিয়েছে সে। দোকানের ভিতরে একটা কুঠুরি পেয়েছে সে। সেখানেই থাকে। বাড়িতে যোগাযোগ করা যাবে না।
এখানে থেকে তেমন কিছু দেখাও যায় না। তবে একদিন শুনেছে তাদের সামনের দোকানের ইমান শেখকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করেছিল। তার সঙ্গে কি সায়কের তাকে এখানে আনার কোন যোগসূত্র আছে? তুষার স্যারের কথা মাথার মধ্যে রাখে বীরেন। তুষার স্যার বলেছিলেন, এই কাজগুলোতে একটার পর একটা পরিস্থিতি আসবে। একজন ভাল স্পাইকে ভাল অঙ্কও জানতে হয়। ঠিক সময়ে তাকে বুদ্ধি খাটিয়ে এই পরিস্থিতিগুলোকে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করে মিলিয়ে দিতে হবে।
বীরেন ইমান শেখের দোকানটা সুযোগ পেলে রোজই খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে। আর পাঁচটা দোকানের থেকে আলাদা কিছু না। ভিড় হয় সকাল থেকে রাত অবধি। সাধারণ দোকানদারেরা আসে। মাল নিয়ে চলে যায়। জুম্মার দিন অর্থাৎ শুক্রবারে বাজার শুধু রাতে খোলা থাকে। সেদিন বীরেন একটু সময় পায় হাত পা খেলিয়ে নেওয়ার। সারাদিন গদিতে বসে কাজ করে করে ঘাড় ধরে যায়।
সুলেমান তাকে নিয়ে মসজিদে যায়। বীরেন নামাজ পড়ার সব পদ্ধতি শিখে নিয়েছিল। মন দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকে। তার মন বলে, মসজিদে ডাকুক কিংবা মন্দিরে, ঈশ্বর ঠিকই তার কথা শুনবেন একদিন। জুম্মার নামাজ সেরে সে সুলেমানের সঙ্গে ফিরছিল, এই সময় সুলেমানের মন হালকা থাকে। বীরেন হালকা গলায় বলল, “ইমান শেখের দোকানটা খুব বড়। অনেক দিনের ব্যবসা ওদের, তাই না জনাব?”
সুলেমান বলল, “হ্যাঁ, আমার আব্বা রাওয়ালপিণ্ডি আসার অনেক আগে থেকে ওদের ব্যবসা। বেচারাকে খুন হতে হল। কে জানে, কী হয়েছিল। সেদিন সকালেও আমাদের কথা হয়েছিল, জানো।”
বীরেন বলল, “কেউ জানে না কেন খুন হতে হয়েছিল?”
সুলেমান বলল, “না। কারো সঙ্গেই তো কোন ঝামেলা ছিল না। এই আমাকেই দেখো মিয়াঁ, সারাদিন দোকানেই ব্যস্ত থাকি। কার সঙ্গে কী শত্রুতা আছে আমি কিছুই জানি না। সবই নিজের নিজের নসীব। কী লিখে দিয়েছেন আল্লাই জানেন। এখন রজ্জাক দোকান চালাচ্ছে। ইমানের মত কি আর পারবে? ইমানের অনেক ক্ষমতা ছিল। শ্রীনগরের লোক ওরা। কবে চলে এসেছিল।”
বীরেন অবাক হয়ে বলল, “ইন্ডিয়ার শ্রীনগর?”
সুলেমান বিরক্ত হল, “কী যে উলটোপালটা কথা বল তুমি শোয়েব, শ্রীনগর ইন্ডিয়ার কেন হবে? ওটা ওরা দখল করে রেখেছে।”
বীরেন মাথা নাড়ল, “ঠিক জনাব। ইমান শেখ কাশ্মীরি ছিল?”
সুলেমান বলল, “হ্যাঁ। ওরা সবাই কাশ্মীরি। ওদের কাপড় দেখলেই সেটা বুঝতে পারবে। আমাদের আর ওদের ঘরানা আলাদা। তা তোমার মাথায় হঠাৎ ইমান শেখ ঢুকল কেন বল তো?”
বীরেন লজ্জিত মুখে বলল, “জি জনাব, সেরকম কোন কারণ নেই। একই বাজারের ব্যবসায়ী ছিলেন উনি, শুনে খারাপ লাগল যে খুন হতে হয়েছে।”
সুলেমান দুঃখিত মুখে বলল, “ঠিকই বলেছ, মানুষের জীবনের কি কোন ঠিক আছে? আল্লাহ যেমন রেখেছেন, তেমন থাকতে হবে আমাদের। আচ্ছা শোন, তুমি আজ ছুটি নিয়ে সিনেমা দেখে আসতে চাইলে যেতে পারো, তুমি তো ছুটিও নাও না। গেলে যাও। আমি দোকান সামলে নেবো।”
বীরেন বলল, “জি বহুত শুক্রিয়া জনাব। ছুটি নিয়ে কী হবে? আপনি একা পড়ে যাবেন, ও পরে দেখা যাবে।”
সুলেমান খুশি হল, “তুমি উন্নতি করবে মিয়াঁ আমি বুঝতে পারছি।”
রাতে দোকানে বসে বসে বীরেনের চোখ মাঝে মাঝেই ইমান শেখের দোকানের দিকে চলে যাচ্ছিল। সবকিছুই স্বাভাবিক। তাও কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল তার।