ব্লু ফ্লাওয়ার ৪ – ৩০
৩০
“জনাব।”
সামশের তার চেম্বারে ছিল। আকবর খান প্রবেশ করল নক না করেই। সামশের বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হল?”
আকবর বলল, “সরি জনাব। একটা কথা বলার ছিল।”
সামশের বলল, “কী কথা?”
আকবর বলল, “মৌলানা হজরতউল্লাহ খবর পাঠিয়েছেন। উনি মাসকট যাবেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
সামশের স্থির চোখে আকবরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কোন রিপ্লাই করেছো?”
আকবর বলল, “না জনাব। আপনার সঙ্গে কথা না বলে রিপ্লাই করি নি।”
সামশের বলল, “গুড। তুমি জানিয়ে দাও ওকে এখন মুজফফরাবাদ থেকে বের করা অসম্ভব। ওখানেই থাকতে হবে। দরকার হলে আমরা ফান্ড পাঠাতে পারি, কিন্তু বেরোয় না যেন। যত ঝামেলা। একটাও ঠিক ঠাক কাজ করতে পারে না, শুধু দেশের বাইরে যাবার ঝামেলা করে আমাদের মাথা খারাপ করে দেবে।”
আকবর বলল, “জনাব, ওকে কেন বাইরে যেতে হয়?”
সামশের বলল, “জানি না। এসবের ঝক্কি কে সামলাবে? সি আই এ খোঁজ পেলেই আমাদের চেপে ধরবে। এদিকে আবার ইলেকশনের ঝামেলা এসে পড়ল। কোন মানে হয় এত ঝামেলা করার? এমনিতেই কোন সরকারকে আর্মি বেশিদিন টিকিয়ে রাখবে না, মাঝখান থেকে আবার ইলেকশন।”
অফিসের ফোন বাজছিল। সামশের ধরল, “হ্যালো।”
“জনাব। একটা রিকুইজিশন পাঠিয়েছি সকালে। পেয়েছেন তো?”
ও পাশ থেকে মৌলানা হজরতউল্লাহর গলা ভেসে এল।
সামশের বলল, “জি জনাব। পেয়েছি। এই মুহূর্তে আপনার মুজফফরাবাদ থেকে বেরোনো কঠিন জনাব। আপনি এখন না বেরোলেই ভাল।”
ও প্রান্তে কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা। তারপর শোনা গেল, “আল্লাহর মর্জিতে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। এখন তো পিছনো যাবে না জনাব।”
সামশের বলল, “জনাব, আপনি বোঝার চেষ্টা করুন। প্রেসিডেন্ট সাহেব ইলেকশনের ঘোষণা করেছেন, গোটা পৃথিবীর নজর এখন পাকিস্তানের উপরে, এখন কোন রকম ঝুঁকি নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না।”
মৌলানা বলল, “কোন ফুল গাছ ওঠার আগে অনেক যত্ন করতে হয় জনাব। একদিনে সে ফুলগাছ ওঠে না। ফুল ফুটলেই হল না, তার যত্ন আত্তিও করতে হয়। আপনি নীল ফুলের কথা ভুলে গেছেন আশা করি?”
সামশের ফোনের স্পিকার হাত দিয়ে ঢেকে আকবরকে বলল, “তুমি এখন এসো। পরে ডাকব।”
আকবর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সামশের ফোন ধরে বলল, “না জনাব। তা ভুলব কেন? মকসদ কি কেউ এত সহজে ভুলে যায়?”
মৌলানা বলল, “আপনারা তো আমাকে ভুলেই গেলেন। মালি যদি ফুলের কুঁড়িদের ভুলে যায়, তাহলে কী করে হবে? একদিনের চেষ্টায় আপনি ওই পোস্টে গেছেন আলি সাহাব? আমাদের পরিশ্রমকে ভুলে যাচ্ছেন বুঝি? নাকি পূর্ব পুরুষের পরিশ্রমকেও মনে করতে চাইছেন না?”
সামশের সোজা হয়ে বসল, “জি জনাব, গুস্তাখি মাফ করবেন, তবে অনেকদিন হয়ে গেল, এই নিয়ে আমার কাছে কোন ইনফরমেশন আসে নি।”
মৌলানা বলল, “দায়টা শুধু আমাদের? আপনার না? পাকিস্তানের ভালর জন্য শুধু আমরাই ভেবে যাবো? আপনাদের ওখানে কী করতে রাখা হয়েছে?”
সামশের বলল, “জি জনাব, আপনার হুকুমই শিরোধার্য। আমি দেখছি কী করতে পারি।”
মৌলানা বলল, “দেখা বা না দেখার দিন চলে গেছে জনাব। আমি ইসলামাবাদ পৌঁছবো খুব শিগিগিরি। এই সময়ে আমার কোন আই ডি তৈরি করা হবে, আমায় কী কভার দেওয়া হবে, সেগুলো ঠিক করে রাখুন। মনে রাখবেন, নীল ফুলের ঠিক ঠাক যত্ন করতে হলে আমাদের যত্নও করতে হবে। বিন্দুমাত্র অযত্ন অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারে। ঠিক বলছি তো?”
সামশের বলল, “জি জনাব। আপনি যেভাবে বলবেন, তেমনই হবে। আমি ব্যবস্থা করছি।”
মৌলানা বলল, “রফিক সাহেবের খবরটা পেলাম। খুব দুঃখ পেলাম।”
সামশের বলল, “কোন রফিক সাহেব জনাব?”
মৌলানা ফোন কেটে দিল। সামশের কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল।
পরক্ষণেই “শিট”
বলে চেম্বার থেকে বেরোল। আকবর তার ডেস্কে বসে ছিল। সামশের বলল, “ঢাকার
এজেন্টকে ইমিডিয়েটলি বল আমাদের অফিশিয়াল মেইল করতে। রফিকের খবরটার অফিশিয়াল কনফার্মেশন পাঠতে বল।”
আকবর বিস্মিত হয়ে বলল, “আপনিই তো জনাব খবরটা আটকে রাখতে বলেছিলেন?”
সামশের বলল, “এখন আমিই বলছি। যা বলছি কর।”
আকবর বলল, “জি জনাব।”
সামশের অস্থির হয়ে পায়চারি শুরু করল। মৌলানার ফোন তার মাথা খারাপ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
৩১
রাত বারোটা। মুম্বই
দুজনে চুপ করে বসে আছে।
শাহিদ বিরক্ত গলায় বলল, “আমি জানতাম চাচাজান ফোন করবে না। এভাবে হয়? আমরা কি এখানে বাশারের আশ্রমে থাকতে এসেছি নাকি?”
রশিদের চোখ মুখ কঠিন হয়ে গেছে। সে বলল, “আমি তো তোকে বলেছিলাম। ঠিক আছে। আমরা আর ফোন করব না। এর পর কী করতে হবে, আমিই বলব।”
শাহিদ বলল, “কিছুই বলার নেই। চল হেঁটে আসি।”
রশিদ বলল, “এত রাতে?”
শাহিদ বলল, “রাতের কী আছে? আমাদের কাছে আর কী রাত কী দিন। চল।”
রশিদ বলল, “ঠিক আছে। চল।”
দুজনে বেরোল। আশ্রমের বাগানের মাঝ বরাবর সুদৃশ্য রাস্তা। দামী মারবেল দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। বাগানের মাঝে সুদৃশ্য ফোয়ারা।
রশিদ বলল, “আমার কেন জানি না, মনে হচ্ছে চাচাজান ইচ্ছে করে দেরী করছে।”
শাহিদ বলল, “কেন? দেরী করার কি কোন কারণ আছে? আর যদি সেটা করেও, আমাদের জানাচ্ছে না কেন?”
রশিদ বলল, “হতে পারে চাচাজান ভেবেছে বাশার আমাদের সামলে নেবে।”
শাহিদ রেগে গেল, “চাচাজান কি বাশারকে আমাদের থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে?”
রশিদ দাঁড়িয়ে গেল। বলল, “একজন পাকিস্তানি এই দেশে এসে এত বড় সাম্রাজ্য তৈরি করে ফেলল কয়েক বছরের মধ্যে, তোর কি মনে হয় না চাচাজান আমাদের থেকে ওকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভুল করেছে?”
শাহিদ বলল, “কেন? বাশারের জায়গায় আমরা এলে পারতাম না?”
রশিদ বলল, “আমি মনে করছি না তো। চাচাজান কী মনে করে সেটা বলছি”
ফোয়ারার সামনে একটা বছর সাতেকের ছেলে দৌড়ে এল। তার পেছন পেছন একজন আশ্রমিক। বাচ্চাটা রশিদের পেছনে গিয়ে লুকল। আশ্রমিক বলল, “বাবা বলরাম, এত রাতে দুষ্টুমি করে না, ঘরে চল বাবা।”
রশিদ আশ্রমিককে বলল, “এ এত রাতে জেগে আছে কেন?”
আশ্রমিক বলল, “বাবাজী নেই তো, তাই ঘুমাচ্ছে না। ও সেই সন্ধ্যে থেকে বায়না ধরেছে বাবাজীর কাছে যাবে বলে।”
রশিদ বলল, “বাবাজীর খুব প্রিয় এই ছেলে?”
আশ্রমিক বলল, “হ্যাঁ, বাবাজি ওকে বেনারস থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর থেকে আশ্রমেই থাকে।”
বাচ্চাটা আবার দৌড়ে পালাল। আশ্রমিক তার পেছন পেছন গেল। শাহিদ বলল, “এতিমখানাও খুলেছে বাশার।”
রশিদ বলরামকে দেখছিল চোখ ছোট ছোট করে। বলল, “এই বাচ্চাটা বাশারের খুবই প্রিয়।”
শাহিদ বলল, “হ্যাঁ। তাই তো বলল। ব্যাটা সত্যি সত্যিই নিজেকে পয়গম্বর ভেবে ফেলেছে। ডানা খুব বড় হয়ে গেছে।”
রশিদ বলল, “ডানা বাড়লে ছাটার দরকার তো থাকেই। যে কাজে পাঠানো হয়েছে, সে কাজ না করে যদি পয়গম্বর সেজে ঘুরে বেড়ায় আর চাচাজান এগুলো দেখেও না দেখার ভান করে থাকে, তাহলে কী করার আছে?”
বাচ্চাটা এতক্ষণে আশ্রমিকের হাতে ধরা পড়ল। রশিদ ডাকল। আশ্রমিক বাচ্চাটিকে নিয়ে এল। রশিদ বলল, “বলরাম, সকালে আমাদের কাছে এসো। তোমার জন্য স্পেশাল গিফট আছে।”
বলরাম বড় করে ঘাড় নেড়ে পালাল।
শাহিদ বলল, “তুইও বাশারের মত হয়ে গেলি নাকি? বাচ্চাটাকে আবার কী স্পেশাল গিফট দিবি?”
রশিদের পকেট থেকে ফোন বেজে উঠল। রশিদ চমকে শাহিদের দিকে তাকাল। এই ফোনটা বাশার দিয়ে গেছিল। ইন্ডিয়ান নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। রশিদ ধরল, “হ্যালো।”
“ভাইজান, হালাল বকরির বিরিয়ানি শেষ কবে খেয়েছিলে?”
রশিদ বলল, “জুম্মাবারে।”
“সকাল আটটায় আশ্রম ঘুরতে যাবো ভাইজান।”
ফোন কেটে গেল। শাহিদ বলল, “কে ফোন করেছে?”
রশিদ বলল, “জানি না। কোড বলল।”
শাহিদ বলল, “বিরিয়ানির কোড?”
রশিদ মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ।”
শাহিদ বলল, “তাহলে কী করবি? আবার অপেক্ষা? একেই হয়ত চাচাজান পাঠিয়েছে?”
রশিদ থমথমে গলায় বলল, “সেটাই মনে হচ্ছে। দেখি কী বলে। এখন তো বাশার নেই।”
শাহিদ বলল, “বাশারের জন্য আমাদের বসে থাকার কোন ইন্সট্রাকশান নেই তো। কাজ এলে চলে যেতে
হবে। সেটা কাল হবে নাকি, সেটা জানা নেই।”
রশিদ বলল, “আমার মনে হচ্ছে কালই হবে।”
শাহিদ বলল, “তবে তাই হোক। চল তাহলে শুয়ে পড়ি।”
রশিদ কিছু বলল না। সন্দিগ্ধ মুখে হাঁটতে লাগল।
৩২
ইমান শেখের দোকানের সামনে একটা বড় গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। এত বড় সচরাচর রাজা বাজারে আসে না। দোকানে ভিড় কম ছিল। বীরেন বাইরে গেল।
ইমানের ভাই রজ্জাক গাড়ির ভেতরে বসা কারো সঙ্গে কথা বলছে। বীরেন এগিয়ে গিয়ে শুনতে যাচ্ছিল এমন সময় সায়কের গলা শুনতে পেল “উঁহু, এই ভুল নয়। দূরে থাকো।”
বীরেন চমকে পিছনে ফিরে দেখল একজন বয়স্ক দাড়িওয়ালা পাঠান তাকে এ কথা বলল। এ লোকটাকে তো সে দেখেছে। এদিকে মাঝে মাঝেই আসে।
সে তড়িঘড়ি নিজের বিস্মিতভাবটা গিলে নিয়ে বলল, “ওহ, আর আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি আমাকে ভুলেই গেছেন।”
সায়ক বলল, “কাজটা ভালই করছো। কৌতূহল দমন করতে শেখো। শুধু লক্ষ্য রাখো কী ধরণের লোকজন আসছে। ইমান শেখ আমাদের লোক ছিল। এখন হাঁটতে থাকো। করাচী ভ্যারাইটির গলিতে চলো।”
বীরেন হাঁটতে থাকল। পিছন ফিরে দেখল বুড়ো পাঠানের ছদ্মবেশধারী সায়ক তার থেকে একটা দূরত্ব রেখে ধীরে ধীরে হাঁটছে। করাচী ভ্যারাইটির গলিটা কানা গলি। তেমন লোকজন নেই। গলিতে ঢুকে বীরেন দাঁড়াল। সায়ক এসে বলল, “রজ্জাকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?”
বীরেন মাথা নাড়ল, “না।”
সায়ক বলল, “ওরা নতুন লোক নেবে। গিয়ে কথা বল।”
বীরেন বলল, “সুলেমানের কী হবে? এখানে তো ভালই জমে গেছিলাম”
সায়ক বলল, “কমফোর্ট জোনে থেকে কোন মানুষ উন্নতি করতে পেরেছে? তোমাকে এই কারণেই বাজারে ঢোকানো হয়েছিল। ট্রেনিং কমপ্লিট, বাজার বুঝে গেছো। দেখবে ওদের দোকানের সামনে একটা পোস্টার ঝুলিয়েছে, লোক লাগবে। কথা বলতে যাও। যদি পেয়ে যাও, ঢুকে যাবে। যদি না পাও, পরিচিত হয়ে যাবে, মাঝে মাঝে গিয়ে দোকানে বসবে, আড্ডা মারবে।”
বীড়েন বলল, “সুলেমান রেগে যাবে না?”
সায়ক বলল, “চাকরি ছাড়লে রাগবে, না ছাড়লে কেন রাগতে যাবে? ব্যাল্যান্স করতে হবে। চেষ্টা কর। হয়ে যাবে। আমি আসি।”
সায়ক ভিড়ে মিশে গেল। বীরেন কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে সুলেমানের দোকানের গদিতে পৌঁছল। তাকে দেখে সুলেমান বলল, “আরে মিয়াঁ কোথায় গেছিলে?”
বীরেন বলল, “বাথরুমে গেছিলাম জনাব। যাওয়ার পথে কত বড় গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল, সেটাই দেখছিলাম।”
সুলেমান হেসে উঠল, “ইসলামাবাদ ঘুরে এসো একদিন, এরকম কত বড় বড় গাড়ি দেখতে পাবে। এই বাজারে কি আর বড় গাড়ি চাইলেই ঢুকতে পারে? ও হল ভি আই পি গাড়ি।”
বীরেন বলল, “কোন নেতা এসেছিলেন?”
সুলেমান বলল, “এই তো, ইলেকশনের খবর এসেছে। এখন কত নেতার আসা যাওয়া দেখবে। এরা পারেও। সেই তো মিলিটারিই দেশ চালাবে, কেন যে আবার এসব ঝামেলা করতে যায়। তুমি বড় গাড়ি দেখবে তো? সে যাবো তোমাকে নিয়ে একদিন। অনেক রকম গাড়ি দেখিয়ে নিয়ে আসব।”
বীরেন ঘাড় নেড়ে বসে পড়ল। দোকানের লোকেদের সঙ্গে সুলেমান রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করল। সুলেমানের ধারণা জেনারেল নিয়াজি নতুন দল করবেন। নতুন দল করা মানে নিন্দুকদের মুখ বন্ধ রাখার একটা নতুন কৌশল। সেনানায়কেরা ক্ষমতার লোভ সামলাতে পারেন না। নিয়াজিও সেটাই করবেন। সারাদিন রাজনীতির আলোচনা শুনে আর হিসেব কষে কাটিয়ে দিল বীরেন। রাত ন’টার পর ইমান শেখের দোকানে ঢুকল। রজ্জাক এখন দোকানের মালিক হয়েছে। মূল গদিতে বসছে। তাকে দেখে বলল, “কী লাগবে?”
বীরেন বলল, “জি জনাব আমি কাজের বিজ্ঞপ্তি দেখে এলাম। আপনাদের লোক লাগবে?”
রজ্জাক বলল, “হ্যাঁ সে তো লাগবেই। আগে আমি হিসেবের কাজ দেখতাম, এখন হিসেব দেখলেই তো শুধু হবে না, গোটা দোকান সামলাতে হচ্ছে। তুমি কি হিসেব জানো?”
বীরেন বলল, “আমি সুলেমান মিয়াঁর দোকানে হিসেবের কাজ করি।”
রজ্জাক বলল, “তাহলে? কাজ তো করছ, আবার কাজ চাইতে এসেছো যে?”
বীরেন বলল, “জি জনাব, যদি কিছু বেশি মাইনে পাওয়া যেত, গ্রামে টাকা পাঠাতে হয় তো।”
রজ্জাক বলল, “সে ঠিক আছে, সুলেমানের সঙ্গে তো আমাদের ভাল সম্পর্ক। ওর লোক নিলে আবার সেটা খারাপ হতে পারে। তুমি খবর রাখো, আমি লোক না পেলে তোমাকে নেব না হয়। কত দিচ্ছে সুলেমান?”
বীরেন বলল, “জি, পাঁচ হাজার রূপী, সঙ্গে খাওয়া দাওয়া।”
রজ্জাক বলল, “ঠিক আছে। তুমি খবর রাখো। কাউকে না পেলে তো রাখতেই হবে। আমি না হয় তোমায় সাত হাজার দেবো, পরে আরো বাড়িয়ে দেব। চলবে?”
বীরেন বলল, “জি জনাব।”
রজ্জাক বলল, “তোমার ফোন আছে?”
বীরেন মাথা নাড়ল, “না।”
রজ্জাক বলল, “তাহলে দিন তিনেক পরে দোকানে এসেই খবর নিয়ে যেও”
বীরেন বলল, “ঠিক আছে জনাব।”
বীরেন বেরিয়ে নিজের মনেই হাসল। সায়ক তাকে আচ্ছা ঝামেলায় ফেলে দিল!
৩৩
সকাল আটটা।
দয়াসাগর আশ্রমের গেটের বাইরে রশিদ আর শাহিদ দাঁড়িয়ে আছে। শাহিদ বলল, “ওই নাম্বারে একবার ফোন করলে হত না?”
রশিদ বলল, “না। কোন দরকার নেই। দেখা যাক।”
মিনিট খানেক পরে একটা বড় গাড়ি এসে দাঁড়াল। একই সঙ্গে রশিদের ফোন বেজে উঠল। রশিদ ফোন ধরতে গাড়ির দরজা খুলে গেল। রশিদ শাহিদকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই।
রশিদ ড্রাইভারকে বলল, “আর কেউ আসে নি?”
ড্রাইভার বলল, “না ভাইজান।”
এসির তাপমাত্রা হিমশীতল করে দেওয়া হয়েছে। দুজনে চুপ করে গাড়িতে বসে রইল।
ঘন্টাখানেক বাদে গাড়িটা একটা মাঝারি মাপের হোটেলে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার বলল, “রুম নাম্বার তিনশো সাত। রিসেপশনের দিকে যেতে হবে না। লিফটে উঠে যান।”
দুজন তাই করল। তিনশো সাত নম্বর রুমে ডোর বেল বাজাতে দরজা খুলে গেল। রশিদ ঘরের ভিতর ঢুকে দেখল একজন যুবক টিভি দেখছে। রশিদ বলল, “আপনি ফোন করেছিলেন?”
যুবকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মুম্বইতে স্বাগত। আমি উমর। বিলালের ছেলে। আমাকে মনে আছে আপনাদের?”
রশিদ এবং শাহিদের চোখ মুখ পাল্টে গেল। এতক্ষণ তারা সন্দিগ্ধ ছিল। এবার তারা স্বাভাবিক হল। শাহিদ বলল, “তোমার বাবা কোথায়? আমরা কত ভাল বন্ধু ছিলাম জানো?”
উমর বলল, “বাবা তিন বছর আগে চলে গেছেন। যাওয়ার আগে আপনাদের কথা বার বার করে বলেছিলেন।”
রশিদ বলল, “চাচাজানের কথাও বলেছ?”
উমর মাথা নাড়ল, “জি’।
তিনজন বসল। শাহিদ বলল, “তুমি কখনো বাশারের সঙ্গে দেখা করতে যাও নি?”
উমর বলল, “হ্যাঁ। মাঝে মাঝেই উনি আমাকে ডেকে নিতেন। ওর কথাতেই আমি জিনিসপত্র স্টোর করতে শুরু করেছিলাম। আপনার কি এখনই স্টোররুমে যাবেন?”
রশিদ বলল, “তার আগে জায়গা আর প্ল্যান জানতে হবে।”
উমর বলল, “প্ল্যান এখনও কিছু আসে নি, তবে একটু আগে আমার কাছে মেসেজ এল, আমাদের কালকের মধ্যে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।”
রশিদ বলল, “মুম্বইতেই?”
উমর মাথা নাড়ল, “জানি না।”
রশিদ বিরক্ত গলায় বলল, “এভাবে হয় নাকি? কী করতে হবে, কোথায় করতে হবে, না জানলে কী করে হবে?”
উমর বলল, “আজ রাতে আরেকজন আসার কথা। বাকিটা উনি জানেন হয়ত।”
রশিদ উমরের দিকে তাকিয়ে বলল, “উমর, চাচাজান কিন্তু এবার আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। অন্য সব মিশনে প্ল্যান আগে থেকে ঠিক করা থাকে। আমাদের অন্ধকারে রেখে লাভ কী হচ্ছে?”
উমর বলল, “ধরা পড়ার পর সবাই গড় গড় করে প্ল্যান বলে দেয়। চাচাজান সে ঝুঁকি নিতে চান নি হয়তো।”
রশিদ রেগে গেল, “অন্য সবাই আর আমরা এক? উনি জানেন না আমাদের?”
উমর বলল, “আমি একটা সম্ভাবনার কথা বললাম শুধু। এই কারণেই কিছু চাই নি। আপনারা রেগে যাবেন না। আমার আব্বুর বন্ধু আপনারা। আপনারা আমার উপর রেগে গেল কষ্ট পাবো।”
উমরের কথায় রশিদের রাগ খানিকটা কমল। সে সোফায় বসে পড়ে বলল, “যেভাবে সব চলছে, তার দুটো মানে দাঁড়ায়। হয় সব কিছু নিখুঁত প্ল্যান হয়ে আছে, নয়ত কিছুই হয় নি। চাচাজান কাঁচা কাজ করার লোক না। তাহলে…”
শাহিদ বলল, “সব কিছু প্ল্যান করা আছে। আমাদের শুধু কাজটা জানতে হবে ইনশাল্লাহ।”
উমর উঠল। একটা প্যারাস্যুট কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে এসে টেবিলের উপর রেখে ব্যাগ থেকে একটা ছোট জ্যাকেট বের করে টেবিলের উপর রাখল। বলল, “এই জ্যাকেটটা আপনাদের কার হবে?”
শাহিদ বলল, “এতো ছোটদের জ্যাকেট। আমাদের কারো হবে না।”
উমর বলল, “এটা লাস্ট এপ্রিলে বাশারচাচা আমাকে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করলে বলেছিল সময়ে কাজে দেবে।”
রশিদ জ্যাকেটটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “বাচ্চাদের জ্যাকেট। আচ্ছা?”
জোরে হেসে উঠল রশিদ। শাহিদকে কানে কানে কিছু একটা বলল, তারপর দুজনেই হেসে উঠল। শাহিদ বলল, “শাবাশ চাচাজান।”
৩৪
শুভকে তুষার ফোন করে কয়েকটা নির্দেশ দিয়েছিলেন। শুভ বেরিয়ে গেল বিকেল নাগাদ। রাতে শুভ তারেক হাসানকে নিয়ে এল।
আশরফ তারেককে দেখে বললেন, “কাশ্মীর ২০০৩? হাসান না?”
হাসান আশরফকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “যাক। মনে আছে তাহলে। আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে? প্রথমে তুষার স্যার, তারপরে তোমরা। যাক, আমাকে মনে আছে এখনও।”
মাথুর তারেককে দেখে চোখ পিট পিট করে বললেন, “কী খাবার এনেছ আগে বলো তো। শুভ কোথায় একটা নিয়ে এল, সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে।”
তারেক বললেন, “এ দেশে এসেছ যখন, খাবারের চিন্তা তোমাদের করতে হবে না। বাংলাদেশ পুলিশ এখন হাই অ্যালার্টে চলে গেছে। বাংলাদেশে সব সময় দুটো সত্ত্বা কাজ করে। ওদের নিজেদের লোকেদেরই দেখাতে হয় যে ওরা ইন্ডিয়ার হয়ে কাজ করছে না।”
আশরফ বললেন, “আর রফিক যে এখানে ফ্রিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তার বেলা?”
তারেক বললেন, “রফিকের অনেক চামচা আছে। ক’টাকে ধরবে? কাশ্মীরে যেমন তুমি বুঝতে পারবে না কোনটা পাকিস্তানী আর কোনটা স্বাধীনপন্থী, এখানেও অনেকটা এক। সরকারের উপর অনেক চাপ থাকে। ইন্ডিয়ান জাসুস এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে খবর পেলে সরকারের মাথা খারাপ করে দেবে বিরোধীরা। পাকিস্তানও ছাড়বে না।”
মাথুর বললেন, “ঠিক আছে। তুমি এবার বল তো আমরা কী করব? মানে এরকম পরিস্থিতিতে অনেকদিন পড়ি নি। কী করব সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না। তুষার স্যারও সরাসরি কোন সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না।”
তারেক বললেন, “সেটা তো সাহেব যা অর্ডার দেবেন তাই হবে। আমি আপাতত তোমাদের আমার বউয়ের রান্না খাওয়াতে পারি।”
আশরফ বললেন, “আমাদের ফলো করে হচ্ছে। অতো ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। আমরা এখানেই থাকি।”
তারেক চিন্তিত গলায় বললেন, “সেটা ঠিক। আমি কয়েকটা জায়গায় সোর্সদের অ্যাক্টিভ করেছি, দেখা যাক কী হয়। শুভর কাছ থেকে রুকসার নামের মেয়েটির ব্যাপারে শুনলাম। ডেসক্রিপশন শুনে মনে হল রিভেঞ্জ বাহিনীর মেয়ে।”
আশরফ ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “রিভেঞ্জ বাহিনী মানে?”
তারেক বললেন, “১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক পরিবার সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেসব ক্ষতিগ্রস্থরা এখন দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় নতুন করে জোট বাঁধছে।”
আশরফ বললেন, “একাত্তরের যুদ্ধে যারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, মানে তখনও যদি জন্ম নেয়, তাদের এখন পঞ্চাশের উপর বয়স হবে। রুকসার তো সরাসরি তাদের কেউ হবে না।”
তারেক বললেন, “তাহলে তাদের ছেলে মেয়ে কেউ হবে। বা আরো অন্য কোন রিলেশন। কিংবা হতে পারে রফিকই টার্গেট ছিল। ইন্ডিয়া বাংলাদেশে রফিকের কম কেচ্ছা আছে নাকি?”
আশরফ বললেন, “উফ। মাথা খারাপ হয়ে গেল। অঙ্কের বাইরে কোন কিছু এলে অবশ্য এটাই হওয়া স্বাভাবিক। রুকসার আমাদের অংকে ছিলই না। কোত্থেকে এসে সব এলোমেলো করে দিল।”
তারেক বললেন, “সেফ হাউজের ঘটনা নিয়ে একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। ঠিক কী কারণে সেফ হাউজে হামলা হল। কে করল? শুভ, এই শুভ।”
শুভ সোহানদের সঙ্গে মিলে রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল। তারেকের কথা শুনে ঘরে ঢুকল। তারেক বললেন, “রুকসার তোমার হদিশ পেল কী করে? ওই বা কী করে জানল তুমি কী করছ, কাদের সঙ্গে যুক্ত?”
শুভ বলল, “আমাদের নাটকের ক্লাবে ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। মাস ছয়েক আগে ও আমাদের জয়েন করেছিল। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে বলত পুরান ঢাকায়। প্রচণ্ড অ্যাম্বিসাস মনে হত। খুব ভাল অভিনয় করত। আমাকে বলেছিল ও সিনেমা করতে চায় এবং তার বিনিময়ে ও সব কিছু করতে পারে।”
তারেক রেগে গেলেন, “আর সেটা জেনে তুমি ওকে রফিকের কাছে পাঠিয়ে দিলে? তুমিই তো আসল ব্লান্ডারটা করেছো।”
শুভ বলল, “বন্ধুত্ব হয়েছিল। দেখে মনে হত মিথ্যা বলার মেয়ে না। আমি তো এখনও বুঝতে পারছি না রুকসার কী করে আমাকে ইউজ করে নিল। ও যে এত দূর যাবে, বুঝতেই পারি নি। স্যারেরা হানিট্র্যাপের কথা বলায় আমার ওর নামই মাথায় এসেছিল।”
তারেক বললেন, “কত বড় ব্লান্ডার করেছো তুমি বুঝতে পারছো? মিথ্যে কথা বলার লোক না বলে তোমার মনে হয়েছে? মনে হবার উপরে আমাদের কাজ চলে? তুমি জানো না কী কী দেখে নিতে হয়? জানতে না?”
শুভ বলল, “তখন অতোটা গভীরে গিয়ে ভাবি নি। ভেবেছিলাম ও রফিকের থেকে রফিক কোথায় যাবে বের করে ফেললে ওকে টাকা দিয়ে চুপ করিয়ে দেব।”
তারেক বললেন, “আর টাকা। আমার তো এখন চিন্তা হচ্ছে ও তোমার সম্পর্কে কতটুকু জানে।”
শুভ বলল, “জানার তো কথা না। ওর সঙ্গে আমি কোন ব্যক্তিগত কথা কখনই বলি নি।”
তারেক বললেন, “ওরম মনে হয়। মেয়ে দেখলে সবাই দুর্বল হয়ে যায়। তুমি আর তার ব্যতিক্রম হবে কেন?”
শুভ জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “এটা আপনার একদম ভুল ধারণা। এসব ভাবা ঠিক না।”
তারেক বললেন, “শুভ। তুমি এবার অফ যাও। এখান থেকে মিশন আমি টেক ওভার করব। আমি তুষার স্যারকে বলে দিচ্ছি।”
শুভ ম্লানমুখে মাথা নাড়ল।
৩৫
রাত এগারোটা। তুষার কফি নিয়ে স্টাডি রুমে বসেছেন।
ইরাবতী বললেন, “এখন কফি? রাতে ঘুমনোর ইচ্ছে নেই নাকি?”
তুষার বললেন, “কিছু একটা ওয়ে আউট বের করতে হবে। ঢাকায় একটা জট পাকিয়ে গেছে।”
ইরাবতী বললেন, “কী রকম জট?”
তুষার বললেন, “ছোট জট। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি এই জটটা খুলতে পারি, তত ভালো।”
ইরাবতী বললেন, “ঢাকায় খান আর মাথুর দুজনেই তো আছে। ওরা কিছু একটা উপায় বের করবে।”
তুষার বললেন, “আমি দেখেছি, যে ব্যাপারটা নিয়ে আমরা বেশি উত্তেজিত হয়ে যাই, সেখানেই সব ভুলগুলো করি।”
ইরাবতী বললেন, “ড্যামেজ হয়েছে? সেটা কি খুব বেশি? কন্ট্রোল করা যাবে না?”
তুষার বললেন, “যাবে। সেটাই চেষ্টা করতে হবে এখন।”
ইরাবতী বললেন, “ঠিক হয়ে যাবে। বেশি ভেবো না। আজ সাউথ ব্লকে গেছিলে কেন?”
তুষার বললেন, “স্পেশাল মিটিং ছিল। এজেন্সির ষোলটা ভাগ হচ্ছে। তার মাথায় আমাকে রাখা হবে। আমি বার বার করে বললাম, এবার আমার রিটায়ারমেন্টের সময় এসে গেছে। ছেড়ে দিন। কিছুতেই শুনল না। বলছে আমাকে দেশের এখন দরকার।”
ইরাবতী বললেন, “সমস্যা কোথায়? বরং তুমি অলস হয়ে বসে থাকলে আরো বেশি সমস্যায় পড়ে যাবে। যতদিন সক্ষম আছো, লড়ে যাও।”
তুষার বললেন, “এক একজন প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসেট এখন দেশের বাইরে। সায়ক কী করছে, বীরেন কী করছে, খান, মাথুর কী করছে, সারাক্ষণ মাথায় ঘুরতে থাকে। দেশের ভিতর কিছু হলে আমরা সেই লড়াইটা করতে পারি, বাইরে থাকলে কী করব? পাকিস্তানে তো কোন প্রশ্নই নেই, বাংলাদেশ নিয়েও অনেকগুলো দ্বিধা আছে।”
ইরাবতী বললেন, “বাংলাদেশ তো বন্ধু দেশ। ওরা ১৯৭১ নিয়ে আমাদের উপর যথেষ্ট কৃতজ্ঞ”
তুষার ম্লান হাসলেন, “ব্যাপারটা অতো সোজা না। ওদের মধ্যে পাকিস্তানের সমর্থক প্রচুর। বিষয়টা পাকিস্তান বা আফগানিস্তান না, বিষয়টা হল ঠিক ভুলের। সবাই সেটা বুঝতে পারে না। পাকিস্তান কেন বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার করে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাসী সংগঠন চালিয়ে যাবে? বাংলাদেশই বা সেটা হতে দেবে কেন? অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও ওরা পারে না। কিন্তু কূটনীতিতে সবাইকে ওভাবে বন্ধু ভাবা যায় না। বন্ধু থাকলেও আমাদের লাভ ক্ষতির হিসেব আমাদেরই করে রাখতে হয়।”
তুষারের ফোন বেজে উঠল। তুষার দেখলেন আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ইরাবতী উঠে বললেন, “আমি বেডরুমে গেলাম। তুমি দেরী কোর না। রাত জাগলে আবার শরীর খারাপ হবার চান্স থাকে।”
তুষার ফোন ধরলেন। ও প্রান্ত থেকে গান ভেসে এল, “অ্যায় মেরে প্যারে ওয়াতান। ভাল আছেন তো স্যার?”
সায়ক। তুষার বললেন, “আমি ভাল আছি। তোমাদের নিয়ে চিন্তাতে আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড় হয়েছে। কী খবর তোমাদের?”
সায়ক বলল, “বিশেষ কোন খবর নেই স্যার। আমি জানি আপনি বীরেনকে নিয়ে চিন্তায় আছেন, আপনাকে জানিয়ে দিই, বীরেন ঠিকই আছে। নিরাপদে আছে।”
তুষার বললেন, “আর নিরাপদ। পদে পদে যে দেশে বিপদ, সে দেশে তুমি নিরাপদের কথা বলছ।”
সায়ক বলল, “তাহলে কথাটা রিভাইস করে বলি, আপাতত নিরাপদে আছে।”
তুষার বললেন, “হ্যাঁ। সেটা বলতে পারো।”
সায়ক বলল, “ইমানের দোকানে অনেকদিন পরে কবুতরের লোক এসেছিল। রজ্জাকের সঙ্গে কথা বলেছে। রজ্জাককে ওরা বিশ্বাস করতে পারছে না।”
তুষার বললেন, “তাতে আমাদের কোন ক্ষতি নেই। রজ্জাক কিছু জানেও না।”
সায়ক বলল, “কাশ্মীরে ওরা একটা লোকাল নিউজ চ্যানেল খুলেছে। ক্রমাগত ভারত বিরোধী প্রচার হচ্ছে। ওদের ফান্ডিং করছে কবুতর।”
তুষার বললেন, “কাশ্মীরে আবার ওরা ঢুকছে। আজকেও দুজনকে খুঁজে মারা হয়েছে। ওরা গ্রামে গ্রামে ঢুকে গেছে, মানুষের ঘরে ঢুকে গেছে। সাধারণ কাশ্মীরিরা ওদের আশ্রয়ও দিচ্ছে। এইসব নিউজ চ্যানেল আরও বেশি করে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। কত আর বন্ধ করা যায়? একটা বন্ধ করলে আরেকটা চলে আসছে।”
সায়ক বলল, “বাইরে থেকে ফান্ডিং আসছে। ফান্ডিং এর সোর্স বের করুন স্যার। ফান্ড বন্ধ হলে ওদের পাখনা কেটে দেওয়া যাবে। গুড নাইট স্যার। আজ আর কথা বলা যাবে না।”
ফোন কেটে গেল। তুষার চিন্তিত মুখে বললেন, “অ্যাবসোলিউটলি রাইট বড়াল। ফান্ডিং সোর্স। দেখা যাক কী করা যায়।”
৩৬
“আজ সন্ধ্যেবেলা নামাজ পড়ে এসে আমার বাড়ি নিয়ে যাবো তোমায়। আমার ছোট ছেলের জন্মদিন আছে।”
সুলেমান কাজ করতে করতে বলল। বীরেন অপ্রস্তুত হল। আজকেই সে সুলেমানকে ইমান শেখের দোকানে কাজ করার কথা বলবে ঠিক করেছিল। রজ্জাক বলেছে সে জয়েন করতে পারে। ওর হিসেবের লোকের দরকার, এদিকে সেরকম বিশ্বস্ত কাউকে পাচ্ছে না। রজ্জাকও নিশ্চয়ই খোঁজ নিয়েছে তার ব্যাপারে। বুঝেছে সে কাজের ছেলে এবং বিশ্বস্ত।
বীরেনের একটু মন খারাপ হচ্ছিল। সুলেমান লোক ভাল। মন পরিষ্কার। বাজারের অনেক দোকানদারই কর্মচারীদের মানুষ বলে ভাবে না। সুলেমানের সে দোষ নেই। তাকে পছন্দ করে।
বীরেন বুঝতে পারে সুলেমানকে ঠিক করে কথাটা বলতে হবে, নাহলে সুলেমান দুঃখ পাবে। নিজের দেশ ছেড়ে এসে, তথাকথিত শত্রু দেশের একজন মানুষের প্রতি হয়ত এরকম অনুভূতি আসা উচিত না, কিন্তু মানুষের সঙ্গে না মিশলে বোঝা যায় না দেশ বিভেদেও তারা মানুষই থাকে। তাদের ভালোবাসা, রাগ, দুঃখ সব আছে। মানবিক অনুভূতি, বন্ধুত্ব সব কিছু ভুলেই হয়। তার জন্য আলাদা কোন শর্ত থাকে না।
ভাল মানুষদের জন্য শত্রুতা মুলতুবি রাখাই ভাল।
সারাদিন ব্যস্ততায় কেটে গেল। মাগরেবের নামাজের সময় সুলেমান বলল, “চল চল শোয়েব, আর দেরি করা ঠিক হবে না। মসজিদ থেকে বাড়ি চলে যাবো। চল বেরোনো যাক।”
দুজনে বেরোল। বাজারের মাঝখান দিয়ে যাবার সময় প্রতি মুহূর্তে বীরেনের মনে হচ্ছিল এবার বলে দেওয়াই ভাল। মসজিদের সামনে গিয়ে ঠিক করল ওর বাড়িতে গিয়েই বলবে। সুলেমানের ছেলের জন্য কোন উপহার কেনাও দরকার। মসজিদে ঢোকার ঠিক আগে বীরেন দেখল একটু দূরে সায়ক দাঁড়িয়ে আছে আগের ছদ্মবেশে। তাকে ইশারায় ডাকছে।
বীরেন বলল, “মিয়াঁ আপনি যান, আমি একটু পরে আসছি।”
সুলেমান অবাক হয়ে বলল, “কী হল আবার?”
বীরেন বলল, “একটা কাজ মনে পড়ে গেল। আপনি যান।”
সুলেমান বলল, “কী যে কর না। ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি এসো।”
সুলেমান মসজিদে প্রবেশ করল। বীরেন সায়কের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সায়ক ফিসফিস করে বলল, “ফুলের দোকানের পাশে এসো।”
বীরেন বলল, “মাগরেবের নামাজটা পড়ে এলে হত না?”
সায়ক বলল, “না। কথা আছে। এসো।”
সায়ক হাঁটতে শুরু করল। বীরেন তার পিছনে গেল। ফুলের দোকানের পাশের দাঁড়িয়ে সায়ক বলল, “রজ্জাক কী বলছে?”
বীরেন বলল, “কাজ হয়ে গেছে। জয়েন করতে বলছে।”
সায়ক বলল, “বলেছে যখন জয়েন কর নি কেন?”
বীরেন বলল, “সুলেমানকে বলতে হবে তো।”
সায়ক বলল, “বলে ফেলো। দেরী করছো কেন? মায়া পড়ে গেছে? এখানে মায়ার কোন জায়গা নেই। শক্ত হও এবং পারলে কালকেই জয়েন কর।”
বীরেন মাথা নাড়ল।
সায়ক বলল, “এবার যাও।”
বীরেন মাথা নেড়ে মসজিদের দিকে হাঁটতে শুরু করতেই সায়ক তার হাত চেপে ধরল। বীরেন অবাক হয়ে সায়কের দিকে তাকানোর সময়টুকু পেল না। তীব্র শব্দে চতুর্দিকে কেঁপে উঠল। সায়ক চেঁচিয়ে উঠল, “শুয়ে পড়। শিগগিরি।”
বীরেনের মাথা ঘুরে উঠল। সে রাস্তায় শুয়ে পড়ল। আর্ত চিৎকার, হাহাকারে চারদিক ভরে উঠছে। সায়ক বলল, “ব্লাস্ট হয়েছে। মসজিদে। শুয়ে থাকো। ক’টা বোম আছে কে জানে।”
মানুষের ছোটাছুটির মধ্যে দেওয়ালের পাশে চোখ বন্ধ করে মিনিট পাঁচেক বসে থাকল বীরেন। মাথা কাজ করছে না। সুলেমান মসজিদের ভেতরে গেছিল ভাবতেই বমি চলে এল। রাস্তার উপর হড় হড় করে বমি করে দিল সে। সায়ক বলল, “কপালজোরে বেঁচে গেলে। আমি না ডাকলে মসজিদের ভেতর তুমিও থাকতে। উফ, এই দেশ!”
বীরেন মসজিদের দিকে তাকাল। ভয়াবহ দৃশ্য। একটু আগেও যেটা কল্পনাতেও ছিল না, সেটাই হল। হাঁটুর নিচে ব্যথা হচ্ছিল। এতক্ষণ পর খেয়াল হল। প্যান্ট তুলে দেখল পা থেকে রক্ত পড়ছে। সায়কেরও চোখে পড়েছে সেটা। বলল, “কাঁচ লেগেছে মনে হচ্ছে। চিন্তা নেই। ক্লিনিকে যাও। সেরে যাবে।”
বীরেন অসহায় গলায় বলল, “সুলেমান বাঁচবে না?”
সায়ক তার পিঠে হাত রেখে বলল, “আগে নিজে বাঁচো। মায়া পরে কোর। চল, পা দেখিয়ে নাও। রেস্ট করতে হবে আজকে। সুলেমানের দোকানেই যাও। এখনই উবে গেলে সন্দেহ হবে ওদের।”
বীরেন শূন্য চোখে মানুষজনের হাহাকার দেখছিল। কী অদ্ভুত এই ভূখণ্ড! মানুষের প্রাণের কোন মূল্যই নেই?
৩৭
প্রেসিডেন্ট নিয়াজী তার অফিসে কাজ করছিলেন। তার সেক্রেটারি আক্রম এসে বলল, “জনাব।”
নিয়াজী আক্রমের দিকে তাকালেন, “বল।”
আক্রম বলল, “রাওয়ালপিন্ডি রাজা মার্কেটের মসজিদে ব্লাস্ট হয়েছে কিছুক্ষণ হল।”
নিয়াজী বললেন, “শিয়া মসজিদ?”
আক্রম মাথা নাড়ল, “না জনাব। সুন্নি মসজিদেই হয়েছে।”
নিয়াজি বললেন, “এখানে আবার কে ব্লাস্ট করতে যাবে? বালোচদের কেউ? সামশেরকে ফোন কর। তুমি বস।”
আক্রম বসে সামশেরকে ফোন করল। সামশের ধরে সালাম করল।
আক্রম সামসেরের সালামের উত্তর দিয়ে বলল, “জনাব, আপনার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সাহেব কথা বলবেন।”
আক্রম ফোনটা নিয়াজির দিকে এগিয়ে দিলেন। নিয়াজি ফোন ধরে বললেন, “রাজা মার্কেটে ব্লাস্ট হয়েছে?”
সামশের বলল, “জি জনাব। আমি এখন ওখানেই যাচ্ছি।”
নিয়াজি অবাক হয়ে বললেন, “আপনি যাচ্ছেন? আপনাকে কেন যেতে হচ্ছে?”
সামশের বলল, “আমি রাওয়ালপিণ্ডিতেই আছি এখন জনাব। নিজে গিয়ে দেখাই তো ভাল।”
নিয়াজি বললেন, “হ্যাঁ, সেটা হলে খুবই ভাল হয়। রাজা মার্কেটের মত এত জনবহুল এলাকায় এই ব্লাস্টটা যথেষ্ট চিন্তার ব্যাপার। এটা তো ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওরের মধ্যে পড়ছে, তাই না?”
সামশের চুপ করে গেল। বোঝার চেষ্টা করল নিয়াজী তাকে দোষ দিচ্ছেন কি না। একটু থেমে বলল, “জনাব, আমাকে একটা দিন সময় দিন। যারা এই কাজ করবে, তাদের আমরা ছাড়ব না। এর শেষ দেখে ছাড়ব।”
নিয়াজী বললেন, “গুড। টেক কেয়ার”
সামশেরের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ফোন কেটে দিলেন নিয়াজি। আক্রমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আক্রম, সামশেরের কাজকর্ম তোমার কেমন লাগে?”
আক্রম বলল, “জনাব, আমি ওঁর সম্পর্কে কী বলব?”
নিয়াজি বললেন, “নির্দ্বিধায় বল। আমি জানতে চাইছি।”
আক্রম বলল, “মুজফফরাবাদে থাকাকালীন উনি বেশ কয়েকবার উপরতলার কথা না শুনে লস্করের ছেলেদের এল ও সি পার করাতে গিয়ে শো কজ খেয়েছিলেন। ওর ট্র্যাক রেকর্ড খুব একটা ভাল নয়। তবু ওর আগের লোকেদের কারো দুর্ঘটনায় মৃত্যু, কারো বা খুন, ওকে খুব তাড়াতাড়ি চিফের পজিশন দিয়েছে। আজাদ কাশ্মীরে যে ক’টা অর্গানাইজেশন অপারেট করছে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ওর খুব ভাল সম্পর্ক।”
নিয়াজি বললেন, “এন্ড ইভেন হি ক্যান ডিজওবে মি, ইফ হি থিঙ্কস, রাইট?”
আক্রম মাথা নাড়ল, “জি জনাব। সামশেরের আলাদা নেটওয়ার্ক আছে।”
নিয়াজি বললেন, “নিজের নেটওয়ার্ক থাকা ভাল, ধরে নিলাম সব কিছুর পরেও সেটা পাকিস্তানের ভালর জন্যই করা হয়েছে, তবু এভাবে মসজিদে ব্লাস্ট হলে ও নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। সম্ভবত এই জন্যই ও ঘটনাস্থলে যাচ্ছে। নজর রাখতে হবে। সামশের ইজ এ ভেরি কানিং পারসন। ওর অফিসে তোমার লোক অ্যাড কর। সামশেরের প্রতিটা কাজ কর্মের হদিশ যেন আমার কাছে আসে।”
আক্রম বলল, “জনাব, এরকম ব্লাস্ট কি ভোটে এফেক্ট ফেলবে?”
নিয়াজি মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বললেন, “না। ওসবে কিছু হয় না। সমস্যা হল, এই নিউজটা পশ্চিমি আর ইন্ডিয়ান মিডিয়া ফলাও করে দেখাবে। এইভাবে দেশের নাম খারাপ হয়। আমরা সেটা হতে দিতে পারি না। রাওয়ালপিন্ডি পুলিশকে ইন্সট্রাকশান পাঠাও, অকুস্থলে কোন রকম মিডিয়াকে যেন প্রবেশ করতে দেওয়া না হয়। এলাকাটা আইসোলেট করে দিতে হবে মিডিয়ার থেকে। অবশ্য ওখানে আইসোলেট করবেই বা কী করে?”
নিয়াজি চিন্তিত হলেন।
আক্রম বলল, “জনাব আমি পুলিশকে জানাই আইসোলেট করার জন্য আপনি ইন্সট্রাকশন দিয়েছেন। দেখা যাক, ওরা কী করে আপনার ইন্সট্রাকশন এক্সজিকিউট করে।”
নিয়াজি বললেন, “এখানে র- এর হাত থাকার চান্স কতটা?”
আক্রম বলল, “ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ায় আমরা এই ঘটনার দায় র-কেই যদি দিই, তাহলেও এখানে র এর কোন ভূমিকা না থাকারই কথা। আপনি ভোটের ঘোষণা করেছেন, এটা তার জন্য হতে পারে। বালোচরা রাওয়ালপিন্ডিতে আসবেই বা কেন? তাও মসজিদে? তার চান্সও খুব কম।”
নিয়াজি মাথা নাড়লেন, “সামশের থাকলে আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি আক্রম। ও কোন কাজের নয়।”
আক্রম বলল, “কিন্তু ও আপনার সময়েই আই এস আই চিফ হয়েছে।”
নিয়াজি অস্থিরভাবে মাথা নাড়লেন, “জানি। খুব ভাল করে জানি। ওই সময়টা আমি ইউ এস এতে ব্যস্ত ছিলাম। তখনই ও চিফ হল। বলতে পারছি না, হয়ত এখানেও ওই কিছু করাচ্ছে। আই নিড টু রিড হিম, নাও।”
প্রেসিডেন্ট নিয়াজির চোয়াল শক্ত হল।
৩৮
রাত এগারোটা। সেফ হাউজের সামনে একটা বাস এসে দাঁড়াল।
শুভকে কিছুক্ষণ আগেই তারেক রিলিজ দিয়ে দিয়েছেন।
ডিনার হয়ে গেছিল।
সবাই বাসে উঠলেন। তারেক ড্রাইভারকে দিক নির্দেশ দিয়ে আশরফের পাশে এসে বসলেন, “হয়ত এই সেফ হাউজটা ছাড়া ভাল সিদ্ধান্ত হল না। কিন্তু আমার কোন কিছুই ঠিক লাগছে না খান। আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছি, সে জায়গায় পাকিস্তানি কুকুর থাকবে না, সেটা তোমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি”
খান হাসলেন, “তুমি যদি জাহান্নামেও যেতে বল মিয়াঁ, আমি সেখানে যেতেও রাজি আছি। এখানে তুমিই লিডার। তুমি যা বলবে তাই হবে।”
তারেক বললেন, “এখন এসব বলে লাভ আছে বস? তোমরা তো ভুলেই গেছিলে আমাকে। নেহাত এখানে শুভ বাজে ভাবে ছড়ালো বলে তুষার স্যার আমাকে ফোন করলেন। নইলে আমি তো ভেবেছিলাম সংসারী লোক হয়েই এ দেশে আমৃত্যু কাটিয়ে দিতে হবে।”
খান বললেন, “আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বল। এই রিভেঞ্জ বাহিনী অ্যান্টি রাজাকার তো ঠিক আছে। এদের ইন্ডিয়া সম্পর্কে কী মনোভাব? এরা আমাদের শত্রু না বন্ধু?”
তারেক বললেন, “এদের মধ্যে দুটো দল আছে। একদল মুক্তিযুদ্ধে ইন্ডিয়ার কন্ট্রিবিউশন স্বীকার করে, আরেক দল করে না।”
মাথুর রেগে গেলেন, “কেন করবে না?”
তারেক বললেন, “সেটা তুমি জোর করতে পারো নাকি? ওদের আলাদা দেশ, আলাদা সব কিছু। ওদেরও অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা জিনিসটা জোর করে আদায় করা যায় না। ওরা যখন ফিল করবে, এমনিই আমাদের সঙ্গে থাকবে। তবে কিছুতেই বাংলাদেশকে শত্রু করার কথা ভাবলে চলবে না। পাকিস্তান এখনও এ দেশে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে রেখেছে। একবার সুযোগ পেলেই এখান থেকে এরা নতুন উদ্যোগে অনুপ্রবেশ শুরু করাবে।”
রাতের রাস্তা চিরে বাস যাচ্ছে। এক জায়গায় বাস দাঁড় করানো হল। তারেক নেমে গিয়ে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাস ছেড়ে দেওয়া হল। আশরফ বললেন, “পরিচিত নাকি?”
তারেক বললেন, “হ্যাঁ। পুলিশে বেশ কয়েকজন পরিচিত আছে। তবে এখানে অন্য সমস্যা। এ রাস্তায় ডাকাতির ভয় আছে বলে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।”
খান বললেন, “ভাল তো। দু চারটে ডাকাত থাকা ভাল। সোহান বলছিল এখানে খেয়ে আর ঘুমিয়ে ওর লাইফ স্টাইল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নেট প্র্যাকটিস হয়ে যাবে।”
তারেক বললেন, “এ দেশে আসার পর থেকে যে হারে তোমাদের বাসস্থান পাল্টাচ্ছে, তাতে লাইফ স্টাইলের থেকেও মানসিক সমস্যা বেশি হবার কথা।”
খান বললেন, “এ তো তাও দেশের বাইরে। কাশ্মীরে আমাকে এক সময় সপ্তাহে সাত দিনই আলাদা আলাদা ঠেকে কাটাতে হয়েছিল। অভ্যাস আছে। শুধু এভাবে অলস বসে থাকলে বিরক্ত লাগে।”
তারেক ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসলেন। বড় রাস্তা থেকে কিছুক্ষণ পর বাসটা একটা ছোট রাস্তায় নামল। রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। খানা খন্দে পড়তে পড়তে বাসটা একটা পুরনো অথচ খুব বড় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।
তারেক বললেন, “চল।”
খান বললেন, “এটা আবার কার বাড়ি? কত বড় বাড়ি এটা বাপরে!”
তারেক বললেন, “এই বাড়ি এক কালে এক হিন্দু জমিদারের ছিল। পরে এ বাড়ি আমার কলিগের বাবা কেনেন। ওর থেকে আমি কিনেছি।”
খান হাঁ করে তারেকের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “করেছো কী তুমি মিয়াঁ? ভাবতেই পারছি না।”
তারেক হাসলেন, “ভাবা না ভাবার কিছু নেই। এ বাড়ির ধারে কাছে কেউ আসে না। হন্টেড বলে কুখ্যাতি আছে। আমরা এখানে বসেই তুষার স্যারের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করব। যদি নির্দেশ আসে তোমাদের ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়ার, সেটাও এখান থেকেই তোমরা চলে যেতে পারবে। চল।”
সবাই জমিদার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলেন। বড় বড় ঘর।
তারেক বললেন, “এত বড় বাড়ি মেইন্টেইন করা খুব কঠিন ব্যাপার। চারটে ঘর মত ঠিক করা গেছে।”
সোহানরা ঘর দোর দেখে খুশি হয়েছে। পুকুর দেখে বলল, “এখানে কাল স্নান করা যাবে।”
তারেক বললেন, “বাইরে না যাওয়াই ভাল। যা করবে বাড়ির প্রাচীরের ভেতর থেকে করবে। এই বাড়ির কাছের গ্রাম তাও পাঁচ কিলোমিটার দূরে আছে। তবু সাবধানের মার নেই।”
তারেক বেরিয়ে গেলেন।
মাথুর বললেন, “শুধু লুকোচুরি খেলে যাচ্ছি এ দেশে আসার পর থেকে। তুষার স্যার কী চাইছেন বল তো খান?”
খান হাসলেন, “লেটস সি। দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট।”
মাথুর ঠোঁট ওলটালেন।
৩৯
দয়াসাগর বাবা ফিরেছে। ভক্তরা সব ভিড় করে বাবার পা ছুঁতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দয়াসাগর ভক্তদের সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকল না। আশ্রমে ফিরে রশিদের ঘরে এসে দরজা ধাক্কাল।
রশিদ দরজা খুলল।
দয়াসাগর ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে বলল, “এত অধৈর্য হবার কী আছে? চাচাজান কি এত তাড়াহুড়ো করতে বলেছিল? আমি বার বার বলেছিলাম যা হবে আমি ফিরে আসার পরে।”
রশিদ বলল, “ঠিক আছে। চিন্তা করছিস কেন? আমরা কাজ এগিয়ে রেখেছি তো। তুই এবার শুধু জায়গা বলবি, এ ছাড়া তোর তো কোন কাজ নেই আর।”
বাশার খাটে বসে পড়ল। বলল, “চাচাজানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। লোকেশন ফাইনাল হয়েছে। মুম্বইতেই।”
শাহিদ বলল, “মুম্বই তোর খুব ভাল লেগে গেছে না? রোজ রোজ নতুন নতুন মেয়ের সঙ্গে শুয়ে পড়ছিস এখন বাশার? তুই তো এখানেই জন্নত পেয়ে গেছিস রে।”
বাশার শাহিদের দিকে রাগী চোখে তাকাল।
শাহিদ বলল, “চোখ কাকে দেখাচ্ছিস তুই? খুব সাহস হয়ে গেছে তোর।”
বাশার বলল, “সাহসটা তোমাদের হয়েছে। আমি এখানে না থাকা অবস্থায় যদি তোমরা ধরা পড়তে, তাহলে এত দিনের প্ল্যান সব নষ্ট হয়ে যেতো।”
রশিদ বলল, “কেন? ধরা পড়তে যাবো কেন?”
বাশার বলল, “তোমরা কী ভেবেছো ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্সকে? ওরা অনেক এগিয়ে গেছে। সব কিছু আর আগের মত নেই”
রশিদ বলল, “তুই চুপ করে বস। আর আমাকে বল জ্যাকেটটার জন্য কাকে ইউজ করবি?”
বাশার বলল, “কাউকে পাই নি। ধারাভিতে একটা বাচ্চাকে পাওয়া গেছিল। কিন্তু ওই বাচ্চাটা বাস চাপা পড়ে মারা গেছে। আমি নতুন জ্যাকেট তৈরি করতে দিয়েছি।”
রশিদ কয়েক সেকেন্ড বাশারের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি তো ভেবেছিলাম জ্যাকেটের বাচ্চাকে তুইই ঠিক করে রেখেছিস।”
বাশার অবাক হয়ে বলল, “কে?”
রশিদ বলল, “বলরাম। তুই যাকে বেনারস থেকে নিয়ে এসেছিলিস।”
বাশার চমকে উঠে বলল, “না না। তা কী করে হয়? এটা অসম্ভব। বলরামকে দিয়ে এটা করা যাবে না।”
রশিদ বলল, “কেন করা যাবে না? তোর কি এই কাফের বাচ্চাটার উপর মায়া পড়ে গেছে?”
শাহিদ হেসে বলল, “এখানে তুই কি সত্যিকারের বাবা-ই হয়ে গেছিস নাকি বে?”
বাশার বলল, “বলরামের মা আমার কাছে ওকে দিয়ে গেছে। আমি কী করে ওকে দিয়ে এ কাজটা করাবো? তাছাড়া ওর তো জন্নতও নসীব হবে না। ও হিন্দু। আমাদের কাজে ওকে জড়ানোর কোন মানেই হয় না।”
রশিদ ঠাণ্ডা গলায় বলল, “উপরওয়ালা ঠিক করে দিলে সব কিছুর মানে হয়। সব কিছুর। তুই আমি ঠিক করে দেবো নাকি কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক? এই কাজের জন্য স্বয়ং উপরওয়ালা বলরামকে নির্বাচন করেছেন। আমরা এখানে কিচ্ছু করতে পারব না। শোন বাশার, ও বাচ্চা তোর কথা শোনে। তুই ওকেই জ্যাকেটটা পরানোর ব্যবস্থা করবি। বাকি কাজের দায়িত্ব আমার।”
বাশার অস্থির হয়ে বলল, “চাচাজান বারণ করবেন।”
রশিদ বলল, “চাচাজানকে নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। চাচাজানের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে।”
বাশার বলল, “বাচ্চাটা উধাও হয়ে গেলে, আমার উপরেও সন্দেহ আসতে পারে। কিছুদিন আগেই এখানে একজন ভণ্ড সাধুকে আশ্রমের মধ্যে ধরেছিল এদের ইন্টেলিজেন্স। চাচাজান যদি চান এখানে আর আমাকে দরকার নেই, শুধু তাহলেই এই বাচ্চাটাকে দিয়ে কাজ করাও। নইলে করিও না।”
রশিদ বলল, “চাচাজানের কথা বাদ দে। তোকে তো আমি বলেছি। এই মিশনে আমি আর শাহিদ তখনই ঢুকব, যখন তোর বলরাম ওই জ্যাকেটটা পরবে।”
বাশার রশিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার সঙ্গে তোমাদের কীসের শত্রুতা? আমি কী করেছি? নাকি আমাকে এত লোক সম্মান করছে বলে তোমরা আমাকে হিংসা করছ?”
রশিদ জোরে হেসে উঠে বলল, “শুধু একটা মেইল যাবে মিডিয়াতে। সবাই তোর আসল পরিচয় জেনে যাবে। সম্মান? মানে কোন সম্মান? তুই এখানে সম্মান পাওয়ার জন্য আছিস?”
বাশার পাংশু মুখ করে বলল, “আমি ব্যবস্থা করছি। কালকের মধ্যে বস্তির কোন বাচ্চাকে নিয়ে আসা হবে।”
রশিদ জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “উঁহু। বলরামই যাবে। নয়ত এই মিশন হবে না।”
বাশার চুপ করে বসে রইল। তার মাথা কাজ করছে না।