ব্লু ফ্লাওয়ার ৪ – ৭০
৭০
সুনয়না দাভে ইন্টারোগেশন চেম্বারে বসে ছিলেন। তুষার তার সামনে বসে বললেন, “কেমন আছেন?”
সুনয়না বললেন, “আমাকে এভাবে আটকে রেখে দেওয়ার কারণটা জানতে পারি?”
তুষার হালকা গলায় বললেন, “রশিদকে বাশারই মেরে দিয়েছে। শাহিদ ধরা পড়েছে।”
সুনয়না অবাক হবার ভান করে বললেন, “মানে? এরা কারা?”
তুষার বললেন, “আপনি এদের চিনতে পারছেন না দেখে খুব ভাল লাগছে। আপনি অবশ্য বেশ ভাল চেষ্টা করেছেন। অনেক ভাল ভাল আসামীর থেকে আপনার রেজিস্টেন্স লেভেল ভাল মিসেস দাভে। ইউ আর গুড। ভেরি গুড। আপনি যাদের চিনতে পারছেন না, তারা হল আপনার ব্যাগের প্রাপকরা।”
সুনয়না বললেন, “আমাকে আমার উকিলের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হোক। এভাবে আটক করা অনৈতিক।”
তুষার বললেন, “কোথাকার উকিল? এদেশের না পাকিস্তানের? ইসলামাবাদে আপনার জন্য উকিলের ব্যবস্থা করতে বলে দেবো?”
সুনয়না রাগী গলায় বললেন, “হোয়াট ননসেন্স! আমাকে এভাবে আটকে রেখে আজেবাজে কথা বলছেন কেন? আপনি আমার মত একজন সম্মাননীয় নাগরিককে এভাবে আটকে রেখে দিতে পারেন না। একবার আমাকে বাইরে বেরোতে দিন, বাকিটা আমি বুঝে নেবো।”
তুষার সুনয়নার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, “একটা লোকের গল্প শুনবেন ম্যাডাম? লোকটার নাম অচিন্ত্য রানে। টাকার বিনিময়ে লোকটা উপকূলে ভিন দেশের নৌকোগুলোর আসার খবর চাপা দিয়ে দিয়েছিল। কত টাকা পেয়েছিল জানা নেই, তবে দেশের ইতিহাসে এই লেভেলের বিশ্বাসঘাতক খুব কম এসেছিল। লোকটাকে ধরার আগেই তার স্ত্রীকে নিয়ে লোকটা বেপাত্তা হয়ে গেছিল। আমাদের ইন্টেলিজেন্সের থেকে অবশ্য পালিয়ে যাওয়া এত সহজ হয় নি। তার স্ত্রীর ফোনে যখন ইসলামাবাদ থেকে মেসেজ আসে, তা দুর্ভাগ্যবশত আমাদের র্যাডারে ধরা পড়ে যায়। দেখুন তো ম্যাডাম, এই মেসেজটা চিনতে পারছেন কিনা। কী যেন ভাষাটা… গরমে বিয়ার খাবার না কী যেন… ফোন থেকে ডিলিট করে দিলেও আমাদের আইটির ছেলেদের ওই মেসেজটা বের করতে খুব বেশি হলে দশ মিনিট লাগবে। একবার চেষ্টা করবো নাকি?”
সুনয়না দাভে তুষারের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন, “একটা রশিদ বা শাহিদ ধরে আনন্দ করছিস তোরা? লাভ নেই। তোদের সব ক’টাকে শেষ করবে ওরা।”
তুষার শিস দিয়ে উঠলেন, “দ্যাটস ইট। বাকিটাও বলে ফেলুন।”
সুনয়না দাভে বললেন, “আমি কিচ্ছু বলব না। আমি কিছু জানি না।”
তুষার বললেন, “ওই যে লোকটা, অচিন্ত্য রানে… ধরা পড়েছে। উলটো করে বেঁধে রেখে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট চলছে। আপনি চাইলে আপনাকে ওর সেলে নিয়ে যেতে পারি। দেখতে চান হাজব্যান্ডকে?”
সুনয়না আর্তনাদ করে উঠে বললেন, “আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। উনি অনেক দিন আগে সুইসাইড করেছেন।”
তুষার হাসলেন, “স্বামীর ভুল কাজটাকে বয়ে চলেছেন ম্যাডাম? কোন দরকার ছিল? আপনি নিজেও জানেন আপনার স্বামী ভুল কাজ করেছিল দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আপনি চেষ্টা করুন, আপনি পারবেন। ভুল পথে থেকে কারো কোন লাভ হচ্ছে না।”
সুনয়না ভেঙে পড়লেন। কাঁদতে শুরু করলেন।
তুষার কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে ইন্টারোগেশন রুম থেকে বেরিয়ে শ্রীবাস্তবকে বললেন, “দিনরাত বসিয়ে রেখে জেরা করে যাও। বলবে মনে হচ্ছে। প্রয়োজনে রাজসাক্ষী হবার লোভ দেখাও। বাশার কেমন আছে?”
শ্রীবাস্তব বললেন, “বেটার।”
তুষার বললেন, “সবক’টা আশ্রম সিজ করার কাজ কত দূর হল?”
শ্রীবাস্তব বললেন, “আজকের মধ্যে হয়ে যাবে। বাশারকে দিয়ে ইউপির ইন্সপেক্টর খুনের কনফেশনটাও করিয়ে নেওয়া হয়েছে। মিডিয়াতে দয়াসাগরবাবার সম্পর্কে ডিটেলস দিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
তুষার বললেন, “বলরামের মায়ের হাতে ছেলেটাকে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। এটা দরকারি। ঠিক আছে। আমি আরেকবার ইন্টারোগেশন রুমে যাবো।”
শ্রীবাস্তব বললেন, “শিওর স্যার।”
তুষার ইন্টারোগেশন রুমে প্রবেশ করেন। পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বার ডায়েল করলেন। ও প্রান্ত থেকে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে ফোন ধরল সামশের, “হ্যালো।”
তুষার ফোন স্পিকারে রেখে বললেন, “কেমন আছেন আপনি? চিনতে পারছেন? আপনার খবরটা এই মাত্র পেলাম মিস্টার আলি, খুব খারাপ লাগল। আমি নিশ্চিত, আপনার থেকে যোগ্য অফিসার পাকিস্তান কোনদিন পায় নি।”
সামশের বলল, “কে বলছেন?”
তুষার বললেন, “তুষার রঙ্গনাথন। ভিয়েনায় দেখা হয়েছিল। একসঙ্গে কফি খেয়েছিলাম। আপনি তো বলেছিলেন যে কোন সময় ফোন করতে পারি। এখন দেখছি ভুলেই গেছেন।”
সামশের কৃত্রিমভাবে হাসল, “ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ। অনেক দিন আগের কথা। কেমন আছেন আপনি?”
তুষার বললেন, “ভালোই আছি। শুনুন না, সুনয়না দাভে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। বলবেন?”
সামশের আকাশ থেকে পড়ল, “কে ইনি?”
তুষার বললেন, “তেমন কেউ না। তবে ওর বিয়ারটা নষ্ট হয়ে গেছে বুঝলেন?”
সামশের বলল, “কী বলছেন আপনি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না জনাব।
তুষার সশব্দে হেসে উঠে ফোন কেটে দিলেন।
সুনয়না কান্না বন্ধ করে তুষারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তুষার বললেন, “টিচারদের আমাদের দেশে সর্বোচ্চ
সম্মান দেওয়া হয় ম্যাডাম। আপনি এ দেশের ছাত্রদের শিক্ষা দেন। যে ছাত্রদের পড়ান, তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি আসে নি কোন দিন? আজ যদি ব্লাস্টটা হত, আপনার কোন ছাত্র মারা যেত, আপনি খুশি হতেন? ব্যক্তিগত স্কোর সেটল করার জন্য মানুষ হয়ে মানুষকে এভাবে মেরে ফেলা উচিত?”
সুনয়না মাথা নিচু করে বসে রইলেন।
তুষারের ফোন বাজছিল। তুষার দেখলেন আশরফ ফোন করছেন। ধরলেন, “হ্যাঁ, বল।”
আশরফ বললেন, “এসে গেছি স্যার। বাইরে অপেক্ষা করছি।”
তুষার দেখলেন কাঁচের ও প্রান্তে আশরফ আর মাথুর অপেক্ষা করছেন। অনেকদিন পর পরিচিত মুখ দুটো দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তুষার…
#
ইসলামাবাদ
সেক্টর ওয়ানের পার্কে একজন ভিখারি চুপ করে বসে আছে। একটা বাড়ির সামনে একটা বড় গাড়ি এসে দাঁড়াল। বাড়িটা থেকে চারজন লোক গাড়িতে উঠল। তাদের হাতে দুটো ব্যাগ।
একজন পাঠান ভিখারির বাটিতে কিছু রূপী দিয়ে বলল, “আস্তানায় ফিরে যাও। রাতেই মুজফফরাবাদ রওনা হতে হবে। এ বরযাত্রী সেদিকেই যাচ্ছে।”
ভিখারি মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে।”
পাঠানবেশী সায়ক বেঞ্চে বসল। হাতে রাখা কাগজটা খুলল। কাগজে বড় বড় করে হেডলাইন হয়েছে, “আই এস আই চিফ সামশের আলি প্রেসিডেন্ট নিয়াজির খুনে যুক্ত? আমেরিকান মিডিয়ার নিউজে উত্তাল বিশ্ব।”
ভিখারি সেজে থাকা বীরেন হাঁটতে হাঁটতে পার্কের বাথরুমের দিকে রওনা দিল।
এবার সাজ পাল্টে রাওয়ালপিণ্ডি যেতে হবে তাকে।
তাদের কাজ শেষ হয় না। তাদের কাজের শুধু শুরু হয়…
#
অনেক দিন পরে কলেজ গেল মিনি।
নিয়মিত একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হয় তাকে। কাউন্সেলিং হয়। নার্ভের ওষুধ খেতে হয়। বাড়িতে মাঝে মাঝে জ্যেঠুর ঘরে গিয়ে বসে সে।
চুপ করে বসে থাকে। জ্যেঠুর কথা মনে পড়লে চোখে জল চলে আসে।
একটা লোক শুধু একটা ভুল আদর্শের জন্য তার এত বড় ক্ষতি করে দিতে পারল?
এতটাই ঠুনকো হয় রক্তের সম্পর্ক?
কলেজে মেহজাবিন তার পাশে বসে ছিল। দুটো ক্লাস করার পর মেহজাবিন বলল, “মাঠে গিয়ে বসবি? তোর সঙ্গে কত কথা বলার আছে!”
মিনি বলল, “চল।”
তারও ক্লাস করতে ভাল লাগছিল না।
মাঠে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ছেলে মেয়েরাই গল্প করে। তারা একটা কোণ দেখে বসল। মেহজাবিন বলল, “তোকে কোন প্রশ্ন করতেও ভয় লাগে। আমার মাথাতেও ইনজুরি করেছিল ওরা। বাবা খুব ভয় পেয়ে গেছিল।”
মিনি বলল, “তারপরে?”
মেহজাবিন বলল, “তারপরে বেশ কয়েকদিন বাবাই আমাকে কলেজে নিয়ে আসতো। একটুর জন্য বড় কোন ইনজুরি হয় নি। তুই ঠিক আছিস তো?”
মিনির কান্না চলে আসছিল। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ রে, ঠিক আছি।”
মেহজাবিন চারদিকে তাকিয়ে বলল, “সব জায়গায় সব কথা বলা যায় না। আবার কিছু কিছু কথা আছে, যেগুলো না বলাই হয়ত ভাল। আমরা যত কম জানি, তত ভাল।”
মিনি বুঝতে পারল না। বলল, “মানে?”
মেহজাবিন হাসল, “থাক। তোকে নজর রাখার জন্য কেউ আছে তো? ওরা কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার লোক না। এখনও হয়ত টার্গেট করে রেখেছে।”
মিনি বলল, “কী আর করা যাবে বল? আমাদের ভবিষ্যৎ তো আর আমরা ঠিক করতে পারব না।”
মেহজাবিন বলল, “সেদিনের পর থেকে আমারও আর কোন কিছু ঠিক লাগছে না। কতবার তোর বাড়িতে খোঁজ নেব ভেবেছি, নিতে পারি নি। তারপর যখন সব জানলাম…”
মেহজাবিন চুপ করে গেল।
মিনি বলল, “হয়েছে। ঠিক আছে। যা হয়েছে তার জন্য আর সব সময় ভয়ে সিঁটিয়ে থাকব না। তুইও থাকিস না। ওরা তো এটাই চায়, আমরা যেন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি। তাই না?”
মেহজাবিন বলল, “ওরা খুব ভয়ংকর রে। খুব।”
মিনি বলল, “তা আর আমার থেকে ভাল কে জানবে বল? ওদের লক্ষ্য পূরণের জন্য ওরা যে কোন সীমা পার করতে পারে। এটা ওদের কাছে কোন ব্যাপারই না। মাথা নিচু করে তাকানোর দিন শেষ হয়েছে। এবার এগোতে হবে।”
মেহজাবিন বলল, “তোর ফুচকা প্রিয় ছিল। এখন খেতে ইচ্ছা করে না?”
মিনি বলল, “বাবা এনে দেয়। আগের মত আর যাওয়া হয় না। তবে এখন আবার যাব। ভয়ে ঘরে বসে থাকার কোন মানে হয় না, এটা আমি বুঝেছি।”
দুজনে মিলে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর মিনি বলল, “চল একটা সিনেমা দেখে আসি। কতদিন দেখা হয় না।”
মেহজাবিন ইতস্তত করে বলল, “যাবি?”
মিনি বলল, “চল।”
দুজনে কলেজ থেকে বেরোল। বাসে উঠল।
বাসে বসার জায়গা পাওয়া গেল। সিনেমাহলের স্টপ এলে দুজনে বাস থেকে নামল। মিনি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বলল, “আমি টিকিট কাটছি।”
মেহজাবিন হাসল, “ঠিক আছে। পরের দিন আমি কেটে দেব।”
মিনি বলল, “বেশ।”
তারা এগোচ্ছিল, এমন সময় চারটে ছেলে প্রায় তাদের গায়ে এসে পড়ল। গায়ে পড়েই পরক্ষণে “সরি, সরি, কিছু মনে করবেন না”, বলে বাজে ভাবে হাসল।
মিনি কয়েক সেকেন্ড দেখল। চারটে ছেলে।
মিনিট দুয়েক লাগল, চারটে ছেলেই মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওড়নাটা ঠিক করতে করতে মিনি বলল, “চল, টিকিট কাটা যাক।”
মেহজাবিন হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা কী করে করলি?”
মিনি হাসল, “সেলফ ডিফেন্সের ক্লাস করছি দু মাস হল। এখন আর অত সহজে ওরা তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। বললাম তো তোকে, মাথা নিচু করে তাকানোর দিন শেষ হয়েছে। এবার এগোতে হবে। এই তুই তোর এত বড় হাঁ-টা বন্ধ কর প্লিজ। কী ভয়ঙ্কর লাগছে।”
মেহজাবিনের মুখের হাঁ তবু বন্ধ হল না। মিনি হাসতে হাসতে টিকেট কাউন্টারের দিকে এগোল…
***