Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল – অৎসুইশি

    লেখক এক পাতা গল্প252 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩. মানুষের বল তৈরি

    তৃতীয় খন্ড

    ১

    রূপকথার গল্পকার

    স্বপ্নে মিকি দেখছে যে মানুষের বল তৈরি করছে সে।

    স্বপ্নটা এরকমঃ ছোট একটা রুমে অন্য একজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মিকি। রুমটায় আসবাব বলতে একটা আলমারি আর টেবিলের ওপর রাখা টিভি।

    মিকির মুখোমুখি দাঁড়ানো ব্যক্তির হাতে বিশাল একটা ক্ষত।

    সেই হাতটা ধরে ম্যাসাজ করতে শুরু করলো মিকি। অবাক হয়ে খেয়াল করলো যে লোকটার ত্বক অনেকটা কাদার মতন। মিকি লেপে দেয়া। মাত্র ক্ষতটা দূর হয়ে গেল। নিজেকে অনেকটা মাটির কুমোরের মতন মনে হলো তার। তাই কুমোর যেরকম তার সৃষ্ট কাজে মসৃণতা আনার চেষ্টা করে, মিকিও লোকটার দেহ থেকে সব অমসৃণতা দূর করে ফেলবে বলে ঠিক করলো।

    প্রথমেই হাত দুটো একসাথে চেপে ধরলো। জোড়া লেগে গেলো ও’দুটো। এরপর রুটি বানানোর আগে আটা যেভাবে কাই করতে হয়, সেভাবে তার পুরো দেহটাই পিষতে শুরু করলো মিকি। পুরোটা সময় চোখ বড় বড় করে সবকিছু দেখলো লোকটা।

    কিছুক্ষণ পর দেখা গেল মিকির সামনে কোমর সমান উচ্চতার একটা গোলক। তবে এখান সেখান থেকে বেরিয়ে থাকা কিছু চুল দেখে বোঝা যাবে যে গোলকটা একজন মানুষের তৈরি। সমতল পৃষ্ঠে একটা চোখ অবশ্য দেখা যাচ্ছে। মিকি যেদিকে যাচ্ছে, চোখটা সেদিকে অনুসরণ করছে তাকে।

    বলে পরিণত হওয়ায় নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে লোকটা। মিকি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও সেটা দেখা ছাড়া আর কিছু করার রইলো na তার।

    “আবারো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন,” চমকে জেগে ওঠায় পর মিকির উদ্দেশ্যে বললো হিতোমি।

    সময় কাটানোর জন্যে এতক্ষণ পেটের পেশিগুলো প্রসারিত আর সংকচিত করছিল সে। কাউচের স্প্রিংগুলোর ফলে তার ছোট্ট শরীরটা লাফাচ্ছিল ওপরে। এই ব্যাপারটা উপভোগ করে সে।

    সামনে খোলা অসম্পূর্ণ খসড়ার পাতাগুলো সোজা করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় মিকি। আকাশ মেঘলা। তুষারপাত শুরু হবে শিঘ্রই। স্টোভে। আগুন জ্বালিয়ে এক কেতলি পানি চাপিয়ে দিল সে কফি বানানোর জন্যে।

    ‘কফিটা সুস্বাদু মনে হচ্ছে,” হিতোমি বললো। “স্টোভ জ্বালিয়ে রেখেছেন কেন? ঠান্ডা নেই তো।”

    মিকি তাকে বুঝিয়ে বললো যে যাদের শরীরের সে ক্ষতের সৃষ্টি করে তারা তাপমাত্রার তারতম্য অনুভব করতে পারে না।

    “আমার ক্ষতগুলো কি ঠিক হয়নি?”

    মিকি বললো যে তার ক্ষতগুলো এখনও তাজা দেখাচ্ছে, যেন কিছুক্ষণ আগেই কেটে ফেলা হয়েছে হাত পা।

    কফির কাপ হাতে নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো মিকি। কানেদাকে যেখানে পুঁতে ফেলেছে সেদিকে দৃষ্টি। একটা গাছেও পাতা নেই। যতদূর চোখ যায় কেবল সিডার আর দেবদারু গাছ।

    “কারো আসার শব্দ পেয়েছেন নাকি?” হিতোমি জিজ্ঞেস করলো।

    তাকাশি কানেদাকে উঠোনের পেছনে কবর দিয়েছে চার দিন হতে চললো। জানালার পাশ থেকে সরে এসে ডেস্কের ড্রয়ারটা খুললো মিকি। ভেতরে সেদিন ছাউনির পাশে পাওয়া জিনিসটা শোভা পাচ্ছে।

    “আপনার ওপর নজর রাখছে কেউ। জিনিসটা সেটারই প্রমাণ। হঠাৎ করে বাড়ির পেছনে নিশ্চয়ই উদয় হয়নি ওটা।”

    কিন্তু আমি তো কাউকে দেখলাম না। আসলেও কেউ আমাকে সন্দেহ করেছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে।

    ড্রয়ারের ভেতরে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো মিকি, কার হতে পারে এটা? চেনা কারো?

    “এখন কি করবেন আপনি? মা’র সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে আমার। বাড়ি যেতে চাই,” ঘাড় ঘুরিয়ে মিকির দিকে তাকিয়ে বললো হিতোমি। তার লম্বা চুলগুলো চেহারা ঢেকে রেখেছে। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিৎ আপনার। তারা নিশ্চয়ই মাফ করে দেবে আপনাকে।”

    মিকি হিতোমিকে বলল যে আত্মসমর্পণ করার কোন ইচ্ছে নেই তার।

    “তাহলে…” ভাঙা গলায় বললো হিতোমি। “আর কখনো বাড়িতে যেতে পারবো না আমি?”

    তাকে একটা গল্প শোনানোর প্রস্তাব দিল মিকি।

    “কিসের গল্প?”

    তাক থেকে কয়েকটা বই নিয়ে এলো সে। এরমধ্যে তার নিজের লেখা বইও আছে।

    “ওটা তো দ্য কালেক্টেড ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল, তাই না? আমাকে আগেই পড়ে শুনিয়েছেন গল্পগুলো। একটা গল্প পুরো শিনিচি আর ইউকির কাহিনির মত।”

    “মানব গিটু’-গল্পটার কথা বলছে হিতেমি। একটা বিশাল দানো হাত দিয়ে চেপে কয়েকটা মানুষকে একীভূত করে ফেলে ওখানে।একীভূত অবস্থায় মানুষগুলোর হাত পা একে অপরের সাথে পেঁচিয়ে যায়। কিম্ভুত দেখায় তাদের। বাকিটা সময় সেই পেঁচানো অবস্থা থেকে নিজেদের ছোটানোর চেষ্টা করে তারা।

    গল্পটা তলকুঠুরির শিনিচি হিসামোতো আর ইউকি মোচিনাগার ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয় হিতোমিকে।

    “ভিন্ন একটা গল্প বলুন এবারে। ওই পেপারব্যাকটা থেকে। না, আপনার ডান হাতেরটা।”

    যে বইটা দেখাচ্ছে হিতোমি, সেটা একটা পুরনো কল্পবিজ্ঞান কাহিনির সংকলন। নামগল্পটা তাকে পড়ে শোনালো মিকি। খুব বেশিক্ষণ সময় লাগলো না শেষ হতে।

    “শেষটা একটু কষ্টের,” ফ্যাকাসে হয়ে গেছে হিতোমির চেহারা। সত্যি কথা বলতে গল্পের শেষ পরিচ্ছেদটা পছন্দ হয়নি তার একদমই।

    “আপনি যদি গল্পটার নায়ক হতেন, তাহলে কি করতেন?” মিকিকে জিজ্ঞেস করলো সে।

    দৃশ্যকল্পটা অনেকটা এরকম:

    * একটা স্পেসশিপ চালাচ্ছে নায়ক।

    * অন্য এক গ্রহ থেকে কার্গো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। কার্গোর উপাদান হচ্ছে ব্লাড সিরাম। সেগুলো তাড়াতাড়ি জায়গামত পৌঁছে না দিলে অনেক লোক মারা যাবে।

    * বেশি পরিমাণ কার্গো পরিবহণের সুবিধার্থে জ্বালানির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে স্পেশ শিপটায়। শুধু ল্যান্ডিং আর গতি বাড়াতে যেটুকু জ্বালানি দরকার, সেটুকুই ভরা হয়েছে ট্যাঙ্কে।

    * স্পেসশিপে বাড়তি কেউ থাকলে তাকে মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলতে হবে, নতুবা স্পেসশিপের জ্বালানি দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। ল্যান্ড করার আগেই মুখ থুবড়ে পড়বে স্পেসশিপটা। বাড়তি লোকটার ওজনের সমান ব্লাড সিরাম নষ্ট করা যাবে না।

    এখানে প্রশ্ন হচ্ছে

    * বাড়তি ব্যক্তিটা যদি ফুটফুটে বাচ্চা একটা মেয়ে হয়, তাহলে নায়ক কি তাকে মহাশূন্যে ছুঁড়ে দেবে?

    * ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়, কারণ নায়কের জন্যে অনেকে অপেক্ষা করে আছে। মেয়েটাকে না ছুঁড়ে ফেললে ল্যান্ড করা সম্ভব নয়। গল্পটার মতনই, মেয়েটাকে বাঁচানোর কোন উপায় আছে?

    হিতোমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো।

    মিকিও সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামালো। এরপর বললো যে মেয়েটাকে বাঁচানোর একটা উপায় জানা আছে তার।

    হিতোমির চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “তাই নাকি? আসলেও তাকে বাঁচাতে পারবেন আপনি?”

    মিকি বুঝিয়ে বললো যে স্পেসশিপটার ওজন যদি ঠিকঠাক থাকে, তাহলে আসলেও বাঁচানো সম্ভব। প্রথমে তাকে এমন কিছু খুঁজে বের করতে হবে, যেটার সাহায্যে, মেয়েটার হাত পা কেটে ফেলতে পারবে। হাড়ি কাটতে পারে, এরকম শক্ত হতে হবে জিনিসটাকে।

    “স্পেসশিপে নিশ্চয়ই কুড়াল বা এ জাতীয় কিছু থাকবে না।”

    মেয়েটার হাত পা কেটে ফেলে তার ওজন যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। কাটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো মহাশূন্যে ছুঁড়ে দেয়া হবে এরপর। এক্ষেত্রে মেয়েটার বয়স কম হওয়াতে নায়কের সুবিধাই হবে।

    এরপর নিজের শরীর থেকে মেয়েটার ওজনের সমান অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলে সেগুলোও মহাশূন্যে ছুঁড়ে দিতে হবে। তখন সহজেই স্পেসশিপটা তার গন্তব্যে ল্যান্ড করতে পারবে, জ্বালানিও নষ্ট হবে না।

    “কিন্তু নিজের শরীরে কিভাবে কাটা ছেঁড়া করবেন আপনি?” হিতোমি বললো। “স্পেসশিপ চালাতে হলে তো হাত, পা সবই দরকার। তবে তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে মিকির প্রস্তাবটা পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আরেকটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন, স্পেস শিপটায় চেতনা নাশক জাতীয় কিছু নেই। জ্ঞান থাকা অবস্থায় এরকমটা করা নিশ্চয়ই সম্ভব হবে না? ব্যথার কারণে স্পেসশিপটা চালাতেই পারবেন না। সুতরাং ইচ্ছে হলো আর হাত পা কেটে ফেললাম-এই চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। হাত-পা ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না,” বলে নিজের দিকে একবার তাকালো হিতোমি। “আমার কথা অবশ্য আলাদা।”

    *

    ঘুমন্ত হিতোমিকে তুলে তলকুঠুরিতে নিয়ে এলো মিকি। ঘরটা বেশ অন্ধকার, আর্দ্রতাও ওপরের তুলনায় বেশি। ইটের দেয়ালগুলো কালচে হয়ে গেছে।

    তলকুঠুরির একপাশে অনেকগুলো বর্শি চোখে পড়বে। লাল মাংস লেগে আছে ওগুলোর সাথে। কানেদার স্মৃতিচিহ্ন। এগুলোও পচতে শুরু করবে কিছুদিনের মধ্যে।

    হিতোমিকে বিছানায় নামিয়ে রাখলো মিকি। “মা…” বিড়বিড় করে বলছে মেয়েটা।

    দরজার দিকে ঘুরতে যাবে এমন সময় শিনিচির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “ও কি আপনাকে নিজের পরিবারের ব্যাপারে কিছু বলেছে?”

    তলকুঠুরিতে বেশ কয়েকটা তাক সারি সারি দাঁড় করানো। নিজেদের সবসময় ওগুলোর পেছনে অন্ধকারে লুকিয়ে রাখে শিনিচি আর ইউকি।

    মিকি তাদের দিকে এগিয়ে গেল। শিনিচির মাথাটা দেখতে পাচ্ছে না ছায়ার কারণে, কিন্তু ইউকি ঘুমিয়ে আছে।

    “তাকের ঐপাশ থেকে আমাদের সাথে কথা বলে ও,” বললো শিনিচি। “অতীতের ব্যাপারে কথা বলে। পরিবারের সদস্যদের সাথে ক্যাম্পিংয়ে যেত হিতোমি প্রায়ই। স্কুলে দৌড় প্রতিযোগিতায় সবসময় প্রথম হতো।”

    হিতোমি প্রায়ই তলকুঠুরিতে শুয়ে শুয়ে অতীত রোমন্থন করে। নিজের প্রাত্যাহিক জীবনের স্মৃতিগুলো বড় পোড়ায় তাকে। হাত-পা গুলো একদম ঠিক ছিল তার, ছুটির দিনে ইচ্ছেমতন দেরি করে উঠতো, স্কুলের ডেস্কে বান্ধবীদের সাথে ফুটসি খেলতে।

    স্মৃতিগুলোর কথা ভাবার সময় নিজের কাল্পনিক হাত পাগুলো আগের মতনই নাড়ায় হিতোমি।

    একবার কাউচে বসে মিকির উদ্দেশ্যে সে বলেছিল, “বলুন দেখি আমি কি করছি?” কাঁধদু’টো ওপর নিচে নড়ছিল তার।

    “বুঝতে পারছেন না? ডিম ভাজছি!”

    কাল্পনিক হাতে একটা ফ্রাইং প্যান ধরে ছিল সে। মিকি বুঝতে পারল যে ফ্রাইং প্যানে ডিমটা ওল্টানোর চেষ্টা করছে হিমি।

    “সবার ভালোবাসায় বড় হয়েছে হিতোমি,” শিনিচি বললো। “আপনি কি কখনো কারো ভালবাসা পেয়েছেন?”

    মিকি বললো যে এই প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই।

    “আমার সাথে আগে নিয়মিত কথা বলতেন আপনি। তখন একবার বলেছিলেন যে ছোটবেলায় এক বান্ধবী ছিল আপনার। তাকে কি ভালোবাসতেন?”

    ঘাড় কাত করলো মিকি। শিনিচির চেহারায় নিঃসঙ্গতা ভর করেছে। “ওর কথা ভাবলে বড় কষ্ট হয় আমার। কি করবো বুঝে উঠতে পারি না। মাঝে মাঝে এত বেশি অসহায় লাগে যে মরে যেতে ইচ্ছে করে।

    ইউকির প্রেমে পড়েছে সে। কিন্তু এ কথাটা ইছে করে গোপন করে রেখেছে এতদিন। মিকির সামনে ফিসফিসিয়ে সত্যটা কেন বললো, এর উত্তর তার জানা নেই। তবে ইউকি ঘুমিয়ে আছে বলেই কাজটা করেছে।

    নিজের বিশাল দেহটা নাড়ালো শিনিচি। স্বাভাবিক ব্যক্তির তুলনায় অনেক বেশি লম্বা সে। তবে ইউকি সে তুলনায় খাটো। একই দেহের দু’পাশে দুটো মাথা। মিকির হাতের কাজ। তাদের জোড়া দিয়ে দিয়েছে সে। আগে সম্পূর্ণ আলাদা দু’জন মানুষ ছিল তারা।

    “নিজের অদ্ভুত ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে আমাদের এই দশা করেছেন আপনি। সেজন্যে আপনাকে সাধুবাদ জানাবো নাকি অভিশাপ দেব বুঝতে পারছি না।”

    জোরে গুঙিয়ে উঠলো শিনিচি।

    দুটো আলাদা মানুষকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করলে কি হবে?–এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে কাজটা করেছিল মিকি। প্রথমে শিনিচির ডান হাতটা কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলেছে। ইউকির বাম হাতেরও একই অবস্থা করেছিল। এরপর তাদের পেশী আর রক্তনালীগুলো জুড়ে দিয়েছে সিন্থেটিক সুতোর সাহায্যে। সার্জারি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু অবশ্য জানতো na মিকি, তার বাবার বইগুলো এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিল তাকে। তার ক্ষমতাবলেই হয়তো, শিনিচি আর ইউকির শরীর জোড়া লেগে গেছে। তাদের রক্তের গ্রুপ এক কিনা, সেটা নিয়েও কখনো ভাবেনি মিকি। রক্তের গ্রুপ আলাদা হলেও এক্সপেরিমেন্টটার ফলাফল বদলাতো বলে মনে হয় না।

    ধীরে ধীরে শিনিচি আর ইউকির পেশী আর স্নায়ু একীভূত হতে শুরু করে। তাদের শরীরের মধ্যকার সীমারেখা মিলিয়ে যাচ্ছে। দু’জনেরই আলাদা চেতনা আছে অবশ্য এখনও। একে অপরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত তারা। জানে যে তাদের শরীরে কি হচ্ছে। তলকুঠুরিতেই প্রথমবার দেখা হয়েছিল দু’জনের। একজনকে এই বাড়িটার কাছে খুঁজে পেয়েছিল মিকি; অপরজন তার বই পড়ে একটা চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠিতে আত্মহত্যার ইঙ্গিত থাকায় তাকে আমন্ত্রণ জানায় সে।

    তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কয়েকবার করে কেটে জোড়া দিয়েছে মিকি। বাড়তি জিনিসগুলো অবশ্য ফেলে দিতে হয়েছে। মিকি যাদের দেহে ক্ষত সৃষ্টি করে, তাদের শরীরে পচন ধরে না। কিন্তু কেটে ফেলা অঙ্গগুলোর কথায় সে কথা প্রযোজ্য না, কারণ হৃদয় এবং মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ওগুলোর। পচতে শুরু করে স্বাভাবিকভাবেই।

    কেটে জোড়া দেয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো প্রথমে নড়াচড়া করতে পারতো না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে হাড়ির মতন প্রবৃদ্ধি তৈরি হয়েছে ওগুলোর ভেতরে। এক সময় মিকি আবিষ্কার করে যে সেগুলোও নাড়াতে পারছে শিনিচি বা ইউকি। প্রথমদিকে নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হলেও, এক সময় পুরোপুরি অঙ্গগুলো নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয় তারা। তবে এখন শিনিচি-ইউকির শরীরে যে হাত-পা গুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো হিতোমির। কোন এক অজ্ঞাত কারণবশত হিতোমির কাটা হাত পায়ে পচন ধরেনি। তাই সেগুলো শিনিচি ইউকির শরীরে জুড়ে দিয়েছে সে।

    মিকি জিজ্ঞেস করেছিল যে হিতোমির হাত-পা নিয়ন্ত্রণ করে কে।  “জানি না,” ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে ইউকি। “আমি করতে পারি বা শিনিচিও করতে পারে। এখন আর এসব আলাদাভাবে বুঝতে পারি না।”

    শরীরের (আদৌ যদি মাংসের দলাটাকে শরীর বলা যায়) ওপর একক নিয়ন্ত্রণ নেই তাদের কারোরই। আর এটা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথাও নেই।

    “নিজেদের মধ্যে গল্প করি আমরা সারাক্ষণ,” শিনিচি বলে। “আগের নিঃসঙ্গতা আর একাকীতু নিয়ে।”

    ছোটবেলায় বাবা-মা’কে হারায় শিনিচি। পরিবার পরিজন বলতে কেউ ছিল না। তাই ইউকির সার্বক্ষণিক উপস্থিতি উপভোগ করে সে। ইউকি একবার বেঁচে থাকার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিজেকে শেষ করে দেয়ার। কিন্তু এখন শিনিচির কারণে বেঁচে থাকার উৎসাহ ফিরে পেয়েছে সে।

    “কিন্তু আপনি বড় নিষ্ঠুর,” অনুযোগের কণ্ঠে বলে মিকি। “আপনি যদি আমাদের ঘাড়দুটো আরেকটু কাছাকাছি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতেন…”

    দু’জনের মাথা দেহের দু’প্রান্তে। এসময় নড়ে উঠলো বিশাল দেহটা। “জেগে আছো নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম ঘুমাচ্ছো।”

    “এখনও বুঝতেই পারলাম না,” ছায়া থেকে উত্তর এলো।

    “আমাদের শরীরের যা অবস্থা, কখনো বুঝতে পারবে বলে মনে হয় না।”

    জোড়া শরীর নিয়ে কিভাবে আরামে ঘুমানো যায়, সেটা বোঝার চেষ্টা করছে দু’জনে।

    শিনিচি মাথা উঁচু করলে, ইউকির গাল প্রায় মেঝের সাথে লেগে যায়। আর ইউকি নিজেকে সুবিধাজনক অবস্থানে আনলে শিনিচির দুর্বল হাতটাকে ভারী শরীরটা ভার বহন করতে হয়। দু’জনেই যাতে আরামে থাকতে পারে, সেই অবস্থানটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে তারা অনেকদিন ধরে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। একজনকে অস্বস্তিদায়ক অবস্থান মেনে নিতেই হবে। এজন্যেই খুব সম্ভবত ‘মানব গিট্ট’ গল্পটার সাথে তাদের মিল খুঁজে পেয়েছে হিতোমি।

    “আপনার ক্ষমতাটা যে কি,” মিকি কথা বলে ওঠে আবারো। “আমাদের অনেক আগেই মরে যাবার কথা ছিল। আপনি কারো শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করা মাত্র, মৃত্যু দূরে পালিয়ে যায় তার থেকে। আমার ক্ষতস্থানগুলোতেও জীবনের অস্তিত্ব স্পষ্ট টের পাচ্ছি। জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে আমাদের রেহাই দিয়েছেন আপনি…”

    ঘুরে দাঁড়ালো মিকি।

    তলকুঠুরি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় পেছনের কাঠ আর ইটগুলোর দিকে একবার তাকালো সে।

    তলকুঠুরির দরজাটা বুজে দিতে হতে পারে। প্রয়োজনীয় মাল-মশলা আছে এখানে। যদি আগন্তুকের হদিস না পাই, এটাই করতেই হবে।

    এর কিছুদিন পর কেউ একজন কড়া নাড়লো তার দরজায়।

    .

    ২

    শিওজাকিই অপরাধী, এটা একরকম নিশ্চিত আমি। কিন্তু সেটার কোন প্রমাণ নেই। পুলিশ ফোন দিতে গিয়ে থেমে গেছি বহুবার। প্রতিবারই রিসিভারটা উঠিয়ে একটু পরেই নামিয়ে রেখেছি। যদি আমাকে বলা হয় যে কিসের ভিত্তিতে তাকে দোষ দিচ্ছি, তখন কি বলবো? আমার দেয়া ব্যাখ্যাগুলো নিশ্চয়ই মনঃপুত হবে না তাদের।

    এক সপ্তাহ যাবৎ শিওজাকির ব্যাপারে তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করছি। কিন্তু কাউকে যে তার ব্যাপারে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করবো, সেটা সম্ভব না। তার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়, এরকম কিছু করা যাবে না। একবার যদি বুঝে যায় যে তাকে সন্দেহ করি আমি, হিতোমির ক্ষতি হতে পারে।

    একদিন মেলানকলি গ্রোভে সুমিদাকে বলতে শুনলাম, “শিওজাকির বিয়ে হয়েছিল আগে।” বরাবরের মতনই কাউন্টারের উল্টোদিকের সিটটায় বসে একদৃষ্টিতে সাওরিকে কাপে কফি ঢালতে দেখছে সে।

    “সুমিদা, তোমার তো এই সময়ে ক্লাসে থাকার কথা, যেন কোন বাচ্চার সাথে কথা বলছে, এমন ভঙ্গিতে বললো সাওরি।

    “আপনার কি মনে হয়? কোনটা বেশি জরুরি আমার জন্যে? ক্লাসে যাওয়া, নাকি এখানে আসা?।”

    সুমিদা এরকম কিছু বললে কিমুরা সবসময় কাউন্টারে রাখা গোল ট্রেটা দিয়ে বাড়ি বসায় তার পিঠে। মজাচ্ছলেই কাজটা করে সে।

    “শিওজাকি বিবাহিত?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

    জবাবে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটা দেখালো সুমিদা। “ভালো করে খেয়াল করো। হ্রদটার তীরে একটা লাল বিন্দু দেখতে পাবে।”

    ছবিটার কাছে চোখ নিয়ে গেলাম আমি। আসলেও একটা লাল রঙের বিন্দু দেখতে পাচ্ছি, আগে চোখে পড়েনি কোন রহস্যময় কারণে।

    “আমার কাছে মনে হয়েছিল, বিন্দুটা কোন মহিলার আদলে আঁকা। শিওজাকিকে জিজ্ঞেস করায় সে বলে তার স্ত্রীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে বিন্দুটা দিয়েছে সেখানে।

    পুরো চিত্রকর্মটার তুলনায় বিন্দুটা একদমই ছোট। কাছে চোখ না নিলে দেখতে পেতাম না। আমার কাছেও একটা মহিলার অবয়বের মত ঠেকছে বিন্দুটা। লাল রঙের পোশাক তার পরনে।

    ঠিক সেই মুহূর্তে ছবিতে আঁকা হ্রদটা আর গাছগুলো উধাও হয়ে গেল। একদৃষ্টিতে লাল বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে আছি আমি। এখন মনে হচ্ছে, ছবিটার বাকি অংশটুকু আঁকাই হয়ে মহিলাকে ঘিরে।

    কাঁধ ঝাঁকালো সুমিদা। “সে আসলেও বিবাহিত কিনা জানি না। আমাকে যা বলেছিল সেটাই বললাম।”

    শিওজাকির ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য নেই আমার কাছে। তার অতীত বা পরিবার-পরিজন সম্পর্কে কিছু জানি না। এই বাড়িটা হঠাৎ ভাড়া নিয়েছে কেন সে? কায়েদিতে তার পরিচিত কেউ আছে?

    তদন্তের সময়টুকুতে মিঃ ইশিনোর বাসাতেই থাকলাম আমি। সাওরি আর তার সাথেই খাওয়া দাওয়া সারি। মাঝে মাঝে একইসাথে লিভিং রুমে বসে টিভি দেখি।

    কখনো কখনো মনে হয় যে তাদের অনর্থক বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি, আবার কখনো মনে হয় ইশিনোদের বাড়িতে কাজুয়ার জায়গা দখল করেছি আমি।

    প্রতিদিন বাসায় একবার ফোন দেই। তাদের কাছে বেশ কয়েকবার ক্ষমা চেয়েছি এভাবে হুট করে চলে আসায়। যতই নিজেকে প্রবোধ দেই না কেন, কাজটা ঠিক করছি না।

    “পুরনো নামি কখনো এভাবে বাড়ি থেকে চলে যেত না,” বলে তারা।

    বাবা প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলে কথা বলার সময়। আর মার সাথে সম্পর্ক এখনও ঠিক হয়নি। দু’জনেই রিসিভার কানে চেপে চুপ করে থাকি। কিছুক্ষণ অবিচ্ছিন্ন নীরবতার পর বাবার দিকে ফোন এগিয়ে দেয় সে।

    “তাড়াতাড়ি ফিরে এসো,” বাবা বলে। “একবার চেকআপের জন্যে হাসপাতালে যেতে হবে।”

    শিওজাকির ব্যাপারে মাথা না ঘামালে সেই সময়টুকু সাওরিকে কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করি। ক্যাফেতেও, বাসাতেও। অ্যাপ্রন পরে পাশাপাশি বসে অপেক্ষা করি কাস্টমারের জন্যে। বাসন ধুতে ধুতে এটাসেটা নিয়ে গল্পে মেতে উঠি।

    একবার দু’হাত ভর্তি অপোয়া বাসন নিয়ে সাওরি বলে, “নাক দিয়ে পানি পড়ছে আমার!”

    কিন্তু হাত খালি করে যে নাক মুছবে সেই উপায় নেই।

    “এবার ঠিক আছে?” একটা টিস্যু নিয়ে তার নাক থেকে সর্দি মুছে ফেলে বলি। ছোট বাচ্চাদের মতন নাকি কণ্ঠে আমাকে ধন্যবাদ দিল সারি।

    এক ঝড়ের রাতে দু’জন কার্ড খেলে কাটালাম। স্টোভ জ্বালিয়ে আর কোতসুর নিচে পা দিয়েও যখন শরীর গরম হলো না, মোটা কাপড় গায়ে চাপিয়ে জড়াজড়ি করে বসে রইলাম। বাইরে থেকে শোঁ শোঁ বাতাসের আওয়াজ ভেসে আসছিল। মনে হচ্ছিল আমি আর সাওরি বাদে আর কেউ নেই পৃথিবীতে।

    উনো খেলার সময় কাজুয়ার ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করলো সাওরি। আমার মুখ থেকে নিজের ভাই সম্পর্কে অজানা তথ্যগুলো জানতে চায় সে। কিন্তু কাজুয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই, ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি আমি।

    তখন হেসে ওঠে সাওরি। সত্যটা কি, সে ব্যাপারে ধারণাও নেই তার।

    “জানো একবার খেলার সময় কার্ড খেতে শুরু করে কাজুয়া। একদম ছোট্ট ছিল তখন। সেবার প্রথমবারের মতন নিজেকে বড় বোন মনে হয়েছিল, কার্ড বেটে দেয়ার সময় বললো সে।

    গল্পটা শুনে হেসে ওঠার সময় খেয়াল করলাম যে কাজুয়া আর সাওরির জন্যে এক ধরনের মমতা অনুভব করছি ভেতরে ভেতরে। মমতাটুকু এতই প্রগাঢ় যে রীতিমত কান্না পাচ্ছে। কি অদ্ভুত? হাসছি, সেই সাথে কাঁদতেও চাইছি।

    “সাওরি, তোমাদের বাবা-মা’র শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের কথা মনে আছে?” কয়েকদিন আগে সাওরি জোর দিয়ে আমাকে বলেছে তাকে তুমি করে বলতে। “কাজুয়ার কাছে সেদিনের কথা শুনে একটু অবাকই হয়েছিলাম…”

    স্মৃতিটা কিছুদিন আগে বাঁ চোখে দেখেছি আমি। কালো পোশাক পরে সবাই দাঁড়িয়ে ছিল সাওরি আর কাজুয়ার উল্টোদিকে। তবে ভিড়ের মধ্যে এক তরুণকে আলাদাভাবে চোখে পড়ে আমার। সাওরি আর কাজুয়ার দিকে এগিয়ে এসে মাথা নিচু করে কিছু কথা বলে সে। কথাগুলো শুনে চোখে পানি চলে আসে সাওরির। তরুণের চোখেও সেদিন ভর করে ছিল রাজ্যের বিষণ্ণতা।

    তরুণ ছেলেটা কি বলেছিল ওদের উদ্দেশ্যে, সেটাই জানতে চাইলাম। সাওরি তাকে একবার জড়িয়ে ধরে কান্নার মাঝেই।

    “এরকমটা করেছিলাম নাকি? আসলে ঠিক মনে নেই,” গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে সে। “ঐ ছেলেটার গাফিলতির কারণেই বাবা-মা মারা যায়। দড়িতে ঠিকমতো গিট দিতে পারেনি…।”

    সাওরি বউ কষ্ট লেগেছিল ছেলেটার জন্যে। বারবার নাকি কাজুয়া আর সাওরির কাছে ক্ষমা চাইছিলো। অন্য এক শহর থেকে কাজ করার জন্যে কায়েদিতে আসে সে। নিজের ব্যাপারে সব খুলে বলে ওদের।

    “এগুলো তোমাদের কেন বলে সে?”

    “হয়তো কারো সাথে কথা বলে মন হালকা করতে চাচ্ছিলো।”

    এর দুই সপ্তাহ পরে গলায় ফাঁস নেয় ছেলেটা। সুইসাইড নোট লিখে রেখে যায় যে তার কারণে দু’জন ছেলেমেয়ে অনাথ হয়ে গেছে, এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না।

    বিষণ্ণ কণ্ঠে আমার কাছে ছেলেটার গল্প করলো সাওরি।

    *

    হাতে সময় থাকলে বাঁ চোখের স্মৃতি ভর্তি বাইন্ডারটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়ি শহর ভ্রমণে। ভারি জিনিসটা পিঠে নিয়ে হেঁটে বেড়ানোর সময় নিজেকে ভিক্ষু মনে হয়।

    যে করেই হোক, খুব তাড়াতাড়ি শিওজাকির বিরুদ্ধে প্রমাণ যোগাড় করতে হবে আমাকে। কিন্তু সেটার জন্যে কাজুয়ার পদচিহ্ন অনুসরণ করা দরকার।

    শহরময় হেঁটে বেড়ানোর সময় তার দেখা জিনিসগুলোই নিজের চোখে দেখি। তার অভিজ্ঞতাগুলোকে আরো আপন করে নেয়ার চেষ্টা করি। সেদিন কাজুয়ার প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার পর স্মৃতির স্রোতে বাঁধ ভেঙে যায়। একটার পর একটা ভেসে উঠতে থাকে বাঁ চোখে।

    শহরের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ের পাশেই একটা সুপারমার্কেট। আর সেটার পেছনে পরিত্যক্ত কিছু জমি। ছোটবেলায় নিভৃতে সময় কাটানোর জন্যে এখানে প্রায়ই আসততা কাজুয়া। আমিও তার মতন ঘাপটি মেরে বসে থাকি জায়গাটায়। নিজেকে কাজুয়া মনে হয় তখন।

    সারি সারি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভর্তি একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎই থমকে দাঁড়াই। পাশেই খালি একটা পার্ক। কায়েদি শহরের অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হচ্ছে কাঠ। একটা লোক পুরু পোশাক পরে গাছের গায়ে করাত চালাচ্ছিল। কাছে এগিয়ে যাই ভালো করে দেখার জন্যে। কিন্তু হাত নেড়ে আমাকে সেখান থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় সে। যে কোন সময় বিপদ হতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যে গাছটা ভেঙে পড়ে নিচে।

    বাইন্ডারটা বের করে সেটা পড়তে পড়তে রাস্তা দিয়ে হাঁটি। দেখে মনে হবে গাইডবুক হাতে কোন পর্যটক হেঁটে বেড়াচ্ছে।

    এক হাত দিয়ে বইটা ধরে অন্য হাত দিয়ে স্মৃতিগুলোর পাতা ওল্টাতে থাকি। হাতে গ্লোভস থাকায় পাতা উল্টাতে একটু কষ্ট হচ্ছে অবশ্য। তবে এক হাতে ভারি বাইন্ডারটা ধরে থাকা আরো কষ্টসাধ্য।

    ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে হাঁটছি তো হাঁটছিই। শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা পরিত্যক্ত রেললাইন খুঁজে পেলাম। সেটার পাশ দিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে একটা নুড়ি বিছানো পথ। রেললাইনগুলোয় মরিচা পড়ে লালচে রঙ ধারণ করেছে।

    বাইন্ডারটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে রেললাইনের ওপরে উঠে পড়লাম। আগের নামি হলে হয়তো খুব সহজেই ভারসাম্য রক্ষা করে সামনে এগোতে পারতো। কিন্তু আমি বারবার হোঁচট খাচ্ছি।

    পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের ছোট্ট শহরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাজুয়ার দেখা শহরের দৃশ্যের সাথে এখনকার দৃশ্যে অবশ্য কিছু পার্থক্য আছে। নতুন কিছু বাড়ি বানানো হয়েছে, তৈরি হয়েছে নতুন রাস্তা। এ কারণেই জার্নালের বিবরণীর বাইরে কিছু বিল্ডিং চোখে পড়লো।

    বাম চোখে এখনও পুরনো দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি। এই চোখটা আসলে অতীতের একটা জলজ্যান্ত অংশ। শক্ত ক্যান্ডি যেরকম ধীরে ধীরে গলে যায়, ঠিক সেভাবে আমার অপটিক নার্ভে ধীরে ধীরে অতীতের দৃশ্য সরবরাহ করে চোখটা।

    বনের ধারে গিয়ে শেষ হয়ে গেল রেললাইন। সামনে একটা প্লাটফর্ম। স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন এই প্লাটফর্মটাই দেখি স্বপ্নে। সেখানে অবশ্য পুরো সবুজ ছিল গাছগুলো, এখনকার মত পাতাবিহীন না। তবে বগিটা এখনও আগের মতনই আছে।

    দৌড়ে গেলাম ওটার দিকে। ভেতরে ঢুকে পড়লাম কিছু না ভেবেই। এখন আর ঠান্ডা বাতাস আঘাত হানতে পারছে না আমার চোখেমুখে। বাইরের তুলনায় ভেতরে বেশ গরম। কিন্তু স্মৃতিতে যেরকম দেখেছিলাম তার চেয়ে খালি ঠেকলো বগিটা। সবকিছু সরিয়ে ফেলা হয়েছে, সিটগুলোও। এখন শুধু একটা ফাঁপা বাক্স বগিটা।

    মনে আছে আমার, কাজুয়াকে এখানে খেলায় নিতে চাইনি অন্য বাচ্চাগুলো। একজন তো পাথর ছুঁড়ে মারে।

    আমার বাঁ চোখের অনেক স্বপ্নেই একাকী সময় কাটাতে দেখি কাজুয়াকে। কিছু স্বপ্নে বন্ধুদের সাথে খেলা করতেও দেখেছি তাকে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই একা হাঁটতো।

    হয়তো এটাই বাস্তবতা, জীবনের বেশিরভাগ সময়ই নির্জনেই কাটাই আমরা।

    কাঠের মিলটাতে গেলাম এরপর। কাজুয়া আর সাওরির বাবা-মা যেখানটায় মারা গেছে, সেখানে ঢুকবো কিনা ভাবতে লাগলাম। একটা খাটো বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে জায়গাটুকু। সদ্য কাটা কাঠের গন্ধ নাকে এসে লাগলো। সাওরির কাছ থেকে নেয়া একটা স্কার্ফ দিয়ে নাক ঢেকে ভেতরে পা রাখলাম।

    কিছুক্ষণ ঘোরাফেরার পর মিলের অফিসের দরজার দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। পরিচিত একজন হাত নাড়ছে আমার উদ্দেশ্যে। সাওরি। দুজনেই দু’জনকে দেখে অবাক হয়েছি।

    “এখানে খুব বেশি আসি না আমি,” বললো সে। “কিন্তু আজকে মা বাবার ব্যাপারে কিছু জিনিস জানতে ইচ্ছে করছিলো।” সাওরির বাবার কিছু সহকর্মী এখনও কাজ করে এখানে।

    মেলানকলি গ্রোভের উদ্দেশ্যে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করি আমরা। চুপ করে আছে সাওরি। হয়তো বাবা-মা বা কাজুয়াকে নিয়ে ভাবছে। কিংবা সেই বিষণ্ণ চেহারার তরুণকে নিয়েও ভাবতে পারে।

    ক্যাফের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কিমুরা বাদেও অপরিচিত কয়েকজন কাস্টমার বসে আছে টেবিলে। খুব বেশি একটা লোক হয়না ক্যাফেটায়, কিন্তু মাঝে মাঝে অনেকেই একসাথে চলে আসে সময় কাটানোর জন্যে।

    কাউন্টারে বসেই জমে গেলাম। মনে হচ্ছে হিটারটা হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দূরে অন্ধকার টেবিলটায় বসে আছে শিওজাকি। আশেপাশের কারো দিকে কোন খেয়াল নেই তার-অন্তত দেখে সেটাই মনে হচ্ছে।

    বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল বরাবরের মতন। ঐ টেবিলটায় গিয়ে বসতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ক্যাফেতে ঢুকেছি খুব বেশিক্ষণ হয়নি, এত তাড়াতাড়ি গেলে সন্দেহ করতে পারে। তাই চুপচাপ কাউন্টারের পাশেই বসে রইলাম।

    “নামি?”

    সাওরি যে আমার নাম ধরে ডাকছিল, সেটা এতক্ষণে খেয়াল করলাম। কোমরে অ্যাপনের ফিতেটা বেঁধে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “লাঞ্চ করেছো? কিছু লাগবে?”

    বললাম যে খাইনি।

    না চাইতেও বারবার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে শিওজাকির দিকে। আমার লাঞ্চ শেষ হয়েছে কেবল, এসময় উঠে দাঁড়ালো সে। কাঠের মেঝেতে তার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কাউন্টারে বিল মেটানোর জন্যে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো হারামিটা।

    চোখাচোখি হওয়াতে একবার ঝড়ের বেগে মাথা নাড়লাম কেবল। অপহৃত হিতোমি আর মৃত কাজুয়ার ছবি ভেসে উঠলো মনে। রাগে ফেটে পড়ছি, এটা ঠিক। কিন্তু সেই সাথে প্রচণ্ড ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে আমাকে। নিজেকে ছোট্ট একটা অবলা প্রাণীর মত মনে হচ্ছে। সামনে থেকে দানোটার চলে যাওয়ার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

    শিওজাকি বের হয়ে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পরক্ষণেই নিজের এহেন কাপুরুষতায় বিষিয়ে উঠলো মন।

    কিয়োকো ক্যাফেতে এলো এসময়। হাতে একটা হার্ডকভার বই। আমাকে দেখে হাসলো সে আন্তরিক ভঙ্গিতে। নিজের প্রিয় সিটটায় বসে কফির অর্ডার দিল। “হাউজ ব্লেন্ড, প্লিজ।”

    “নিশ্চয়ই…” সাওরিকে দেখে মনে হচ্ছে অনিচ্ছাস্বত্তে কথাটা বললো।

    ততক্ষণে হাতের বইটা পড়া শুরু করেছে কিয়োকো।

    *

    একা একা বসে থাকলে সবসময় মৃত মানুষদের নিয়ে ভাবে সাওরি। কখনো নিজ থেকে একথা আমাকে বলেনি সে, কিন্তু সেটাই ধারণা আমার।

    ব্যাখ্যা করছি, দাঁড়ান। ধরুন, লিভিং রুমের জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে সাওরি। বাড়িটা একটা পাহাড়ি ঢালে তৈরি তাই নিচের রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। এই মুহূর্তে সেখানে কেউ না থাকলেও সাওরি নিশ্চয়ই দেখছে কাজুয়া স্কুল থেকে ফিরে আসছে বা তার বাবা কাজে যাচ্ছে।

    ওয়াশিং মেশিনের দিকেও একই দৃষ্টিতে তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি আমি। নিশ্চয়ই মা’র কথা ভাবছিলো সে তখন। অবশ্য ছোটবেলা থেকে মামার বাসায় বড় হয়নি সে। তবুও, আমার ধারণা মা’র কথাই ভাবছিল সাওরি।

    এরকম সময়ে চাইলেও তার সাথে কথা বলতে পারি না। পেছন থেকে দেখলে ভীষণ দুঃখী মনে হয় তাকে। যে কারো মনে করুণার উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য দৃশ্যটা।

    বাম চোখে খণ্ড খণ্ড অতীতের চিত্র দেখি আমি। আর সাওরির জন্যে সবকিছুই হচ্ছে অতীতের বোমন্থন। হয়তো কথাটা ঠিকমতো বোঝাতে পারছি না। আমি যে রকম কাজুয়ার স্মৃতিগুলোর জন্যে অপেক্ষা করি, সাওরিও সে রকমভাবে মৃত মানুষদের নিয়ে ভাবে।

    “দুই মাস হয়ে গেল,” রাতের খাবার শেষে বললো সাওরি। “তবুও আমার মনেই হচ্ছে না কাজুয়া চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেছে। এটার কারণ কি? হয়তো আমি কষ্টই পাইনি ওর মৃত্যুতে।”

    সাওরির মামার বাসায় ফিরতে দেরি হয় ইদানীং। তাই আমরা দুজন খেয়ে নেই। টেলিভিশন বন্ধ থাকায় তার প্রতিটা শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

    কোতসুর ওপরে রাখা একটা কাপের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। কাজুয়া নিয়মিত ব্যবহার করতে কাপটা।

    “হয়তো উল্টোটা ভাবছো তুমি। আসলে কাজুয়া যে চলে গেছে এটা মেনে নিতে পারোনি, তাই কষ্ট অনুভব করছো না ভেতরে ভেতরে।”

    “তুমি খুবই অদ্ভুত, নামি।”

    একবার ঘাড় কাত করলাম।

    “তোমাকে দেখলে মনে হয় আমার ছোটভাইটা এখনও এখানে আছে আমার সাথে।

    “তাই?”

    “হ্যাঁ। যাইহোক, তুমি কি জানো যে কাজুয়ার বাম চোখটা অন্য একজনের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে?”

    এই বিষয়ে আরো আগে থেকেই কথা বলার ইচ্ছা আমার।

    “মৃত্যুর পর ওর একটা চোখ সংরক্ষণ করা হয়। এমনটাই চেয়েছিল কাজুয়া।”

    “কেন?”

    “দেড় বছর আগে চোখে একটা ফোঁড়া হয় ওর। সেটা কেটে ফেলার পর কিছুদিনের জন্যে চোখটা ব্যান্ডেজ করে দেয় ডাক্তার। তিনদিনের জন্যে এক চোখ অন্ধ হয়ে যায় কাজুয়ার।”

    সাওরি বললো যে চক্ষু হাসপাতালে মরণোত্তর চক্ষুদানের একটা লিফলেট দেখে কাজুয়া। তখনই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেয় সে।

    “চোখ দুটো খুবই সুন্দর ছিল আমার ভাইয়ের,” স্মৃতি রোমন্থনের ভঙ্গিতে বললো সাওরি। মাঝে মাঝে ভাবি, এখনও কত কিছু দেখা বাদ ছিল ওর।”

    যেরকমটা বললাম একটু আগে, সুযোগ পেলেই মৃতদের নিয়ে ভাবতে শুরু করে সাওরি।

    সুমিদা যখনই আন্তরিক ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা জানায় সাওরিকে, হেসে উত্তর দেয় সে। প্রথমে এটাই দেখেছিলাম কেবল। কিন্তু পরে ভালোমতো খেয়াল করায় বুঝতে পারি, কথার মাঝে কাজুয়া যে চেয়ারটায় বসততা, সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে সাওরি।

    সময় বয়ে চলে। মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় মানুষ। পরিত্যক্ত রাস্তা বা রেললাইন যেরকম অদৃশ্য হয়ে যায় শহর থেকে, মানুষের অস্তিত্বও মিলিয়ে যায়। চেনা পৃথিবীটাকে একটু অন্যরকম মনে হয় তখন। কিন্তু সাওরি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষদের নিয়ে এমনভাবে চিন্তা করে, যেন সময় থেমে গেছে।

    সাওরির থমকে যাওয়া জীবন এখন কাজুয়ার রেখে যাওয়া ভাঙা সোনালি ঘড়িটার মতন। কাটাগুলো আর ঘুরছে না।

    তার মামার ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।

    আমি যে ঘরটায় ঘুমাই, তার উল্টোদিকে একটা বৌদ্ধ বেদি আছে। সেই বেদিতে কাজুয়া, সাওরির বাবা-মা আর মিসেস ইশিনোর ছবি রাখা।

    একদিন সকালে গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছি এসময় বাইরে থেকে শব্দ শুনতে পাই। দরজা খুলে দেখি সাওরির মামা বেদিটা ঠিকঠাক করছেন। এরপর হাত জোড় করে আমার দিকে তাকালেন তিনি, “তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি?”

    মাথা ঝাঁকিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। পা ভাঁজ করে বসলাম বেদির সামনে।

    “একবার আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছিলাম কোন কারণ ছাড়াই, দুর্বল কণ্ঠে বললেন মিঃ ইশিনো। “কেন যে একটুতেই রেগে যেতাম।”

    তার স্ত্রীর ছবিটার দিকে তাকালাম। নিউমোনিয়ায় মারা গেছে সে।

    এরপরেও বেশ কয়েকবার তাকে বেদিটার সামনে দেখেছি আমি। বেদনার্ত মানুষকে সান্ত্বনা দিয়ে আসলে খুব বেশি কিছু বলা যায় না, তাই মুখ বন্ধ রেখেছি প্রতিবারই।

    মিঃ ইশিনোকে দেখে মনে হয় যেন অনুতাপ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে।

    একদিন ক্যাফের কাজে কিমুরাকে সাহায্য করি আমি। সাওরি কোথায় যেন গিয়েছে, তাই তার জায়গায় আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে ক্যাফে মালিক। অবশ্য খুব বেশি কিছু যে করেছি তা-ও না। একদমই অল্প কাস্টমার এসেছিল সেদিন। আমার একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে বসে বসে কিমুরার অভিযোগ শোনা।

    কিছুক্ষণ পরে কিমুরা উধাও হয়ে গেল।

    “সুমিদা, একটু এখানে বসুন,” বলে তার হাতে অ্যাপ্রনটা ধরিয়ে দেই আমি।

    অবাক হয়ে যায় সে। “দাঁড়াও… মানে কি? এখানে কি করবো আমি?”

    তার কথা আমলে না নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ক্যাফের পেছনে ছিল কিমুরা। সে কি করছে তা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো আমার।

    একসারিতে জুতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্রায় ত্রিশটার মতন হবে। প্রত্যেকটাই ব্যবহৃত। সব ধরনের জুতো আছে সেখানে। বাচ্চাদের থেকে শুরু করে পূর্ণবয়স্ক মানুষ, সবার।

    “এগুলো কি?”

    “আমার বন্ধুর রেখে যাওয়া জুতো। ওর অদ্ভুত একটা স্বভাব ছিল। কখনো কোন জুতো বাইরে ফেলে দিত না। মারা গেছে কিছুদিন আগে। কিন্তু এই জুতোগুলো রয়ে গেছে।”

    হাতে সময় পেলেই জুতোগুলো বাইরে নিয়ে এসে রোদে শুকোতে দেয় কিমুরা। শুধু গায়ে গতরেই না, মনটাও বড় মানুষটার।

    “ব্যবহারের ক্রমানুযায়ী জুতোগুলো সাজাচ্ছি। বাম দিকেরগুলো ছোট বেলায় পড়তো। আর ডান দিকেরগুলো মৃত্যুর কয়েকদিন আগে পড়েছে। এই চামড়ার জোড়াটা দেখতে পাচ্ছো?” মাঝের দিকের একটা জুতো দেখিয়ে বললো সে। “আমাদের যখন প্রথম দেখা হয়, তখন পায়ে এটাই ছিল তার।

    ডান পাশের আরেকটা জোড়ার দিকে কিছুক্ষণ পর নির্দেশ করে সে। “ক্যাফের উদ্বোধনের দিন এটা ছিল পরনে। তখন অবশ্য ক্যাফের : মালিকানা আমার ছিল না। আমার এক চাচা চালাতে।”

    একটা মানুষের জীবন ইতিহাসের স্বাক্ষী এই জুতোগুলো।

    একদম ডান দিকের জুতোটার দিকে বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিমুরা। “এই জুতোটা খুলে রেখে রেলওয়ে ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ে। ওর বাসার দরজার বাইরে পাই এগুলো। রাতের অন্ধকারে খালি পায়ে ব্রিজ পর্যন্ত গিয়েছিল সে।

    কিমুরার কথা বলা শেষ হলে ভেতরে গিয়ে ব্যাকপ্যাক থেকে বাইন্ডারটা বের করি। কিমুরার গল্পটা শুনে একটা অদ্ভুত স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেছে।

    “কি করছো?” কোমরে অ্যাপ্রন জড়ানো সুমিদা জিজ্ঞেস করে। কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে। যা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে ভালো মানিয়েছে তাকে ক্যাফের কর্মি হিসেবে।

    “আমার গোপন ডাইরি এটা, কাউকে দেখাই না।”

    ওর কাছ থেকে লুকিয়ে ভেতরের পাতায় উঁকি দেই।

    প্রথমে ভাবলাম ভুল দেখছি। কিন্তু না, কিমুরা যে রাতের কথা বললো, সেদিনকার দৃশ্যটা দেখেছিল সে।

    অন্ধকারে মিডল স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল সে। সাইকেলটা পাহাড়ি ঢাল বেয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসছিল। তখন মিডল স্কুলে পড়তো সে, এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারলাম সাইকেলটার কারণে।

    ল্যাম্পপোস্টের আলোয় একটা লোককে বিপরীত দিকে হেঁটে যেতে দেখে সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলো লোকটা। আশপাশের কোন কিছুর প্রতি মনোযোগ ছিল না।

    তবে দৃশ্যটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে কারণ লোকটা খালি পায়ে হাঁটছিল।

    *

    কাজুয়ার অনুসন্ধানের শুরুটা যে কারণে হয়েছিল, সেই স্মৃতিটা দেখলাম একদিন!

    সেদিন বাইরে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না শিওজাকির বাড়িতে যাবো কিনা। ঢাল বেয়ে বাড়িটার দিকে এগোচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু বারবার থেমে যাচ্ছিলাম। এসময় কাজুয়ার দুর্ঘটনাটা যেখানে হয় সেই জায়গাটা চোখে পড়ে আমার পাশ দিয়েই কিয়োকোর বাড়িতে যাবার রাস্তা। এই রাস্তাটার দু’পাশেও সিডার গাছ ভর্তি। আশপাশের সব শব্দ শুষে নেয় গাছগুলো।

    এসময় একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পেলাম পেছন থেকে। শিওজাকি আসছে, এই ভয়ে জমে গেলাম রাস্তায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম যে অন্য মডেলের একটা গাড়ি, চালকও ভিন্ন।

    আমার সামনে গাড়ি থামিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক।

    “এক্সকিউজ মি, আমি মনে হয় হারিয়ে গেছি। একটু সাহায্য করতে পারবে?”

    তার গাড়িটার দিকে হেঁটে যাচ্ছি, এই সময়ে বাঁ চোখটা গরম হয়ে উঠলো। সিডার গাছের পাশে দাঁড়ানো গাড়িটা দেখে আমার মাথায় একটা স্মৃতির ছিপি খুলে গেছে। তবে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি স্মৃতিগুলোর এরকম হঠাত আগমনে।

    “আমি আসলে এদিকটা ঠিকমতো চিনি না,” লোকটার উদ্দেশ্যে বললাম। “দুঃখিত।”

    বাম চোখে দেখছি সিডার গাছের পাশ দিয়ে একটা গাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে কাজুয়া। হয়তো আমি যে রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে আছি, সেই রাস্ত টা ধরেই হাঁটছিল সে। গাড়িটা তার সামনে পার্ক করা। তবে আমার মত গাড়িটার কাছে না থেমে পাশ দিয়ে হেঁটে যায় সে।

    যখনই ডান চোখে এমন কিছু দেখি যেটার সাথে আমার বাম চোখে দেখা দৃশ্যটা মিলছে না, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। তাই এই অবস্থায় চোখ বন্ধ করে নেই। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার সামনে অন্য একজন লোক থাকায় সেটা করা সম্ভব না।

    “এই রাস্তাটা ধরে গেলে…পরের প্রিফেকচারটায় পৌঁছুতে পারবো তো?”

    তার উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ার সময় এমন একটা অনুভূতি হলো যে আর একটু হলেই হার্ট অ্যাটাক করতাম।

    গাড়িটার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আয়নায় চোখ পড়ে কাজুয়ার। সেখানে সে দেখতে পায় যে পেছনের সিটে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটার চেহারা এতবার দেখেছি আমি যে একদম মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। হিতোমি আইজাওয়া।

    তবে দৃশ্যটা দেখে কাজুয়ার মনে কোন সন্দেহ জাগেনি। চুপচাপ পাশ কাটিয়ে হেঁটে যায় সে। ড্রাইভিং সিটে কে বসে আছে সেদিকে তাকায় না, লাইসেন্স প্লেটটাও দেখে না।

    এখানেই শেষ হয়ে গেল স্মৃতিটা।

    সামনের লোকটা কি বলছে সেটা শোনা অনেক আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছি আমি। আসলে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি বললেও অত্যুক্তি হবে না। হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন বয়স্ক ভদ্রলোক।

    ভাগ্যক্রমে হিতোমিকে গাড়িতে দেখে ফেলেছিল কাজুয়া। তখন অবশ্য জানতো না যে অপহরণ করা হয়েছে তাকে। স্মৃতিতে হিতোমির হাত পা’গুলো তো ঠিকই ছিল, তাই না? নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবো না।

    পরে খবরে হিতোমিকে দেখালে সত্যটা বুঝতে পারে সে। সেটা কি অপহরণের পরপরই, নাকি দুই মাস আগে, জানার উপায় নেই। কিন্তু যখনই হোক, হিতোমিকে গাড়িটার পেছনের সিটে দেখার কথা মনে ছিল তার।

    কাজুয়া কি জানতো যে গাড়িটা শিওজাকির? অবশ্য স্মৃতিতে যে গাড়িটা দেখেছি, সেটার সাথে শিওজাকির এখনকার গাড়ির মডেলের কোন মিল নেই। হয় নতুন গাড়ি কিনেছে, নতুবা দুইটা গাড়ি আছে তার।

    এমনটাও হতে পারে যে শিওজাকির বাড়িতে যাবার রাস্তাটায় গাড়িটা দেখে কাজুয়া। এভাবেই হয়তো সে বুঝতে পারে যে নীল রঙের বাসাটায় থাকে অপহরণকারী।

    শিওজাকির বাসায় যাওয়ার রাস্তাটা ভালোমতো খুঁটিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক কোথায় দৃশ্যটা দেখেছিল সে, এটা হয়তো জানতে পারবো। কিন্তু এই এলাকার সবগুলো জায়গা একইরকম দেখতে। সবখানে একই চেহারার গাছ। শেষ পর্যন্ত হতাশ মনোরথে রওনা দিলাম মেলানকলি গ্রোভের উদ্দেশ্যে।

    ফেরার পথে সাওরিকে দেখলাম কিয়োকোর বাসায় যাওয়ার রাস্তাটা থেকে বেরুতে। তাকে ডাক দিলাম আমি। “আজকে ডেলিভারি দেয়ার দিন,” আমাকে দেখে বিস্মিত স্বরে বললো সে।

    *

    একদিন ক্যাফের ভেতরেই ভুল করে কোট রেখে আসে শিওজাকি। ওটা পেছনের দিকের টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে ঝুলন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করে কিমুরা।

    কিছুক্ষণ মনে মনে নিজের সাথে যুদ্ধের পর বললাম, “আমাকে দিন। ফেরত দিয়ে আসি।”

    “তোমার কষ্ট করতে হবে না,” কিমুরা বললো। “কালকে তো সে আসবেই।”

    কিন্তু এরকম একটা সুযোগ হাতছাড়া হতে দেয়া যাবে না। তার ফেলে যাওয়া জিনিস ফেরত দেয়ার ছুতোয় বাড়ির ভেতরটা দেখতে পারবো। কিছু সন্দেহও করবে না শিওজাকি।

    আরো কিছুক্ষণ জোরাজুরির পর আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিল কিমুরা। সুমিদা এতক্ষণ ধরে আমাদের কথা শুনছিলো। আমাকে নীল বাড়িটা পর্যন্ত পৌঁছে প্রস্তাব দিল সে। রাজি হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলাম নেই।

    শিওজাকির বাড়ির ভেতরে গাড়ি চালিয়ে ঢুকে পড়লো সে। শিওজাকির কানে গাড়ির শব্দ যাচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে মাথাব্যথার কোন দরকার নেই এবারে, তবুও বাড়িটার যতই কাছে গেলাম, ভয়ভয় করতে লাগলো ভেতরে।

    শিওজাকির গাড়িটা সামনেই পার্ক করা। ওটার পাশে গাড়ি থামালো সুমিদা।

    প্যাসেঞ্জার সিট থেকে বের হয়ে বাড়িটার দিকে তাকালাম। খুব একটা লম্বা না, এরকম নকশার বাড়ি আমাদের শহরে বেশ কয়েকটা দেখেছি আগে। তবে বাড়িটাকে ঘিরে রাখা পাতাবিহীন গাছগুলো অবশ্য নেই সেখানে।

    বাড়িটার অবস্থান এমন জায়গায় যে সামনের দিকটায় বেশিরভাগ সময়েই ছায়ায় ঢাকা থাকে। নীল দেয়ালগুলো অনেকটাই কালো মনে হয় তাই দূর থেকে। বাইরেই যদি এরকম অন্ধকার হয়, না জানি ভেতরে কি অপেক্ষা করছে।

    হিতোমি আইজাওয়া এই বাড়ির তলকুঠুরিতে বন্দী, সেখানে নিশ্চয়ই আরো বেশি অন্ধকার। কথাটা ভাবার সাথে সাথে কেঁপে উঠলো আমার শরীর।

    “খুব বেশি সময় তো লাগবে না তোমার?” গাড়ি থেকে বের না হয়েই বললল সুমিদা। গাড়ির ভেতরকার আরামদায়ক উষ্ণতা ছেড়ে বের হবার ইচ্ছে নেই তার, বোঝাই যাচ্ছে।

    কিন্তু সে আমার সাথে থাকলে আরো সাহস পাবো। তাই বললাম, “আমার সাথে আসুন।”

    অন্য দিকে তাকিয়ে কথা না শোনার ভান করলো সুমিদা।

    অগত্যা কোটটা দুহাতে চেপে ধরে একাই গেলাম আমি। গাড়িতে আসার পথে কোটটার পকেটগুলো হাতড়ে দেখেছি, কিছু নেই ভেতরে।

    দুরুদুরু বুকে দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কালো কাঠের দরজায় সোনালি রঙের নব শোভা পাচ্ছে।

    কড়া নাড়ার কিছুক্ষণ পর শিওজাকির পদশব্দ শোনা গেল ভেতর থেকে। দরজা খুলে পাতলা ফ্রেমের চশমার ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সে।

    কথা জড়িয়ে গেল আমার। তবুও কোনমতে বুঝিয়ে বললাম যে কেন এসেছি।

    “ধন্যবাদ,” বলে পেছনে দাঁড়ানো গাড়িটার দিকে তাকালো সে। “ওটা সুমিদার গাড়ি না? সেও এসেছে তাহলে।”

    কেউ সাথে থাকার জন্যে এর আগে কখনো এতটা স্বস্তিবোধ করিনি। হারামিটা এখন আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

    “এতদূর যখন এসেছোই, কফি খেয়ে যাও?”

    মাথা নেড়ে সায় জানালাম তার প্রস্তাবে। গাড়ির কাছে ফিরে সুমিদাকে বললাম শিওজাকির কফি খাওয়ানোর কথা। ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সে।

    ভেতরে গেলাম আমরা। পশ্চিমা নকশা অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। বাড়িটা, আমাদের জুতোও খুলতে বললো না শিওজাকি।

    দেয়াল এবং মেঝেতে খুব বেশি কারুকাজ নেই। সিলিং থেকে কোন ঝারবাতিও ঝুলতে দেখলাম না। বরং ভেতরটা একটা উপাসনালয় বা পুরনো আমলের স্কুলের মতনই সাদামাটা।

    আমাকে আর সুমিদাকে লিভিংরুমে নিয়ে গেল শিওজাকি। ঘরের মাঝখানে একটা সোফা আর কফি টেবিল। পাশেই ছোট একটা বুক শেলফ। দেশি বিদেশি দামী দামী সব বই সাজিয়ে রাখা সেখানে।

    পেছনের দেয়ালে কালো ফ্রেমে একটা ছবি ঝোলানো। সেটার ব্যাপারে শিওজাকিকে জিজ্ঞেস করায় বললো যে সে নিজেই এঁকেছে ছবিটা। এক বৃদ্ধ মহিলাকে আপেল ভর্তি ঝুড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে সেখানে।

    আমাদের জন্যে কফি নিয়ে এলো শিওজাকি।

    রুমের আশপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কাজুয়া কখনো এসেছে কিনা। তবে কোন দৃশ্যই আমার বাঁ চোখে কোন প্রকার উত্তাপের উদ্রেক ঘটালো না।

    “এগুলো সবই অ্যান্টিক,” সোফায় হাত বুলিয়ে বললো সুমিদা। বসলে শরীর একদম দেবে যায় সোফাটায়। “আমি যে রুমটায় থাকি, সেখানে এরকম একটা কাউচ বোধহয় ঢোকানোও যাবে না।”

    “এখানকার আসবাবের বেশিরভাগই আগের ভাড়াটিয়ার ফেলে যাওয়া।”

    “সে কি এগুলো আগের ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে পেয়েছিল?” জিজ্ঞেস করলাম।

    “বলতে পারবো না, তার সাথে দেখা হয়নি আমার,” মাথা কাত করে বললো শিওজাকি।

    ছয় মাস আগে বাড়িটায় উঠেছে শিওজাকি। হিতোমি উধাও হয়েছে এক বছর আগে। তাকে কি এখানেই নিয়ে এসেছিল সে? হিসেব তো মিলছে না।

    সুমিদা আর শিওজাকি কথা বলছে কি যেন একটা বিষয়ে। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম যে বাথরুমে যাব আমি। শিওজাকি বলে দিল কোথায় সেটা।

    এরকম একটা বাড়িতে নির্দেশনা ভুলে যাওয়াটা নিশ্চয়ই সন্দেহের চোখে দেখবে না কেউ। ভুল করে অন্য একটা ঘরের দরজা খুলে ফেলতেই পারি।

    হলওয়ে ধরে সামনে এগিয়ে অন্য ঘরগুলোর দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দেয়া শুরু করলাম। লিভিং রুম থেকে আমাকে দেখতে পাচ্ছে না সুমিদা বা শিওজাকি। ঘরগুলো ভালোমতো খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ধরা পড়ে যাবার ভয়ে সেটা করতে পারছি না। একবার উঁকি দিয়েই দরজা ভিড়িয়ে দিচ্ছি। কয়েকটা ঘরে কোন আসবাব নেই। দেখে মনে হলো ছবি আকার স্টুডিও।

    হিতামি এই বাড়িতেই কোথাও আছে, এই কথাটা মাথায় আসার সাথে সাথে হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। ঠিকমতন নিঃশ্বাসও নিতে পারছি না। তার এত কাছে এসেও বাঁচাতে পারছি না! এটা কোন কথা!

    বাড়ির মাঝ বরাবর একটা সিঁড়ি। দোতলার হলওয়ের রেলিংটা দেখা যাচ্ছে নিচ থেকে। ওখানে কি আছে? উপরে গিয়ে যে দেখবো, সেই সাহস নেই। ধরা পড়ে গেলে নিশ্চিত সন্দেহ করবে শিওজাকি।

    অন্য একটা ঘরের দরজা খুললাম আমি। খুব বেশি সময় নেই হাতে। আমাকে ফিরে যেতে হবে দ্রুত।

    পেয়ে গেছি! মেয়েদের কাপড় ঝুলছে ভেতরে। একটা সবুজ ব্লাউজ আর কালো রঙের স্কার্ট। কার জিনিস এগুলো?

    নিজেকেই প্রশ্নটা করেছি, এমন সময় পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। ঘুরে দাঁড়ালাম ভয়ে ভয়ে। শিওজাকি।

    “আমার স্ত্রীর কাপড়গুলো এই ঘরটায় রেখে দিয়েছি।”

    তার স্ত্রী মারা গেলেও কাপড়গুলো কাউকে দিয়ে দেয়ার কথা নাকি মাথায় আসেনি শিওজাকির।

    “দুঃখিত… পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম। তার চোখের দিকেও তাকাতে পারছি না।

    “নামি,” সুমিদা ডাক দিল। “চলো, যাওয়া যাক।

    আমাদের পার্কিং লট অবধি এগিয়ে দিল শিওজাকি। নীল বাড়িটা থেকে বের হয়ে ঢালু রাস্তা ধরে নিচে নামতে শুরু করলো গাড়িটা।

    “ওহ, ফিসফিসিয়ে বললাম আমি। “সে তো বলেছিল একটা ভাঙা দেয়াল ঠিক করবে। সেজন্যে জিনিসপত্রও কিনেছিল, কিন্তু…”

    আমাকে তো এটাই বলেছিল শিওজাকি।

    “ঠিক করবে? কি?” সামনের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো সুমিদা।

    তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে কিছুদিন আগে ভূমিকম্প হয়েছিল কিনা।

    “হ্যাঁ, ছোটখাটো ভূমিকম্প।”

    তাহলে আমাকে মিথ্যে বলেছে শিওজাকি, জিনিসগুলো কেনার অন্য উদ্দেশ্যে ছিল তার।

    .

    ৩

    রূপকথার গল্পকার

    গাড়িটা চলে যেতে দেখলো মিকি। সামনের দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে দোতলার স্টাডিরুমে চলে এলো দ্রুত।

    “কথার আওয়াজ পেলাম,” কাউচ থেকে হিতোমি বললো। “বাসার আশেপাশে কয়েকদিন ধরে যে ঘুরঘুর করছে, সে-ই এসেছিল নাকি?”

    কাঁধ ঝাঁকালো মিকি।

    “কি হয়েছে বলুন না।”

    বলতে গিয়েও থেমে গেল মিকি, অনর্থক ঝামেলা বাড়িয়ে কাজ নেই।

    “আমি কিন্তু চাইলে চিৎকার করতে পারতাম। তবুও চুপ ছিলাম, আপনাকে বাঁচানোর জন্যে করেছি এটা ভাববেন না। আমি যদি কিছু বলতাম তাহলে আরো একজন লোককে মেরে ফেলতেন আপনি, তাই না?”

    কিছু বললো না মিকি।

    “ওহ না, আপনি তো কাউকে একেবারে মেরে ফেলতে পারেন না,” বক্তব্য শুধরে নিল হিতেমি।

    মিকি তাকে বললো ইচ্ছে করলে যে কাউকে হত্যা করতে পারে সে। কেবল মাথাটা কেটে ফেলতে হবে।

    “কিন্তু কেউ যদি এরকম একটা লাশ খুঁজে পায়, তাহলে তো বিপদ হবে।”

    সেক্ষেত্রে ঘটনা এমন ভাবে সাজাবে মিকি, যাতে গোটা ব্যাপারটাই দুর্ঘটনা মনে হয়।

    ধরুন কাউকে মেরে ফেলতে হবে মিকির। তাকে পাহাড়ের ওপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে কিংবা টুকরো টুকরো করে কাটলেও মরবে না। মিকির ভিক্টিমরা তার হাতের স্পর্শ আছে এরকম কোন উপায়ে কখনোই মারা যায় না। শরীরের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলেও লাভ হয় না।

    কিন্তু মিকি চাইলে সেই লোকটাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে ফেলতে পারে বা বেশি মদ খাইয়ে মাতাল করে তুলতে পারে। এরপর একটা চলন্ত গাড়ির সামনে ধাক্কা দিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। তখন মিকি না, গাড়ি চালকের কারণে মারা যাবে নোকটা। অনেকে আত্মহত্যাও ভাবতে পারে গোটা ব্যাপারটাকে।

    “আপনি কি এই ব্যাপারে নিশ্চিত? আগে কখনো চেষ্টা করে দেখেছেন?”

    মিকি জবাব দিল না। মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ বলে ধরে নিল হিতেমি।

    নিচতলার কথোপকথনের কথা ভাবলো মিকি। যে আগন্তুকের অপেক্ষায় ছিল, আজকে বাসায় কি সে-ই এসেছিল? একদমই সাধারণ কথা বার্তা হয়েছে আমাদের… কিছু কি সন্দেহ করেছে।

    যদি পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়ায়, তাহলে এই বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে আমাকে।

    [তবে তার আগে আগন্তুকের মুখটা চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারে। ঠিকভাবে কাজটা করলে জায়গা বদলানোর প্রয়োজন হবে না।]

    .

    ৪

    বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে। বাবা বারবার বলছে ডাক্তারের কাছে যাবার কথা। আর দেরি করাটা উচিৎ হবে না।

    সত্যি বলতে, আমার ঐখানে যাওয়ার তেমন একটা ইচ্ছে নেই। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর থেকে নিজের বাসায় কাটানো সময়ের খুব বেশি স্মৃতি নেই আমার মাথায়। যেগুলো আছে, সেগুলোও খুব সুখকর নয়। বরং কাজুয়ার স্মৃতিগুলো ভাবতেই বেশি ভালো লাগে। কায়েদি, সাওরি, মেলানকলি গ্রোভ।

    সাওরিকে যখন বললাম যে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, মাথা নাড়লো সে। চেহারায় মন খারাপের ভাব স্পষ্ট।

    “ঠিক কাজটাই করছে। তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে আছেন।”

    “আমি কি ফিরে আসতে পারি?”

    “কবে আসবে?”

    “চারদিন পর।

    একটু অবাক হলো সে আমার উত্তরে। “পরিবারের সাথে সময় কাটাতে একদমই ভালো লাগে না তোমার?”

    যত দ্রুত সম্ভব কায়েদিতে ফিরে আসতে চাই আমি। এখনও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা তো করাই হয়নি। হিতোমিকে উদ্ধার করতে হবে। শিওজাকির বিরুদ্ধে প্রমাণ জড়ো করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এখনও।

    ‘নামি… সাওরি বললো গম্ভীর কণ্ঠে। “তোমার পরিবারের ব্যাপারে কখনো কিছু বলোনি আমাকে। জানি আমার নাক গলানোটা ঠিক না এই ব্যাপারে, তবে তাদের সাথে তোমার সম্পর্কটা আসলে ঠিক কি কারণে এমন, সেটা নিয়ে ভেবেছি গত কয়েকদিনে। এভাবে হুট করে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা মোটেও ভালো কোন কাজ নয়।”

    “তুমি কি চাও না যে আমি ফিরে আসি?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

    “অবশ্যই চাই। কিন্তু এটাও চাই যে তুমি তোমার বাবা-মা’র সাথে বসে ভালো করে একবার কথা বলো। এরপর যখন ইচ্ছে এসে পড়ো।”

    সুমিদা ট্রেন স্টেশন অবধি পৌঁছে দিচ্ছে আমাকে। কায়েদিতে আসার প্রথম দিনের মতনই, জানালা দিয়ে ছোট্ট পাহাড়ি শহরটা দেখতে লাগলাম। সিডার গাছের সারি, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ছোট ছোটব্রিজ, দূর পাহাড়ের উপত্যকা-সব পেছনে ফেলে এগোচ্ছি। কিছুক্ষণ পর স্টেশনের কাছাকাছি চলে এলাম। কাছেই একটা ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল আর কয়েকটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।

    “নামি, তুমি তো ফিরে আসবে?” স্টেশনের সামনে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো সুমিদা। “আমাকে একটা ফোন দিয়ো। গাড়ি নিয়ে চলে আসবো স্টেশনে। তুমি চলে যাওয়াতে সাওরি আবার একা হয়ে পড়বে। ক্যাফেতে তোমার উপস্থিতি সবকিছু স্বাভাবিক করে দিয়েছিল। কাজুয়া থাকার সময় এরকম লাগতো, জানো?।”

    “সবকিছু স্বাভাবিক করে দিয়েছিল? এভাবে কেউ কথা বলে? আপনি যে মাঝে মাঝে কিসব বলেন…।”

    “মানে ঐ তো আর কি… কাজুয়ার অভাব অনেকটাই পূরণ করে দিয়েছিলে তুমি।”

    তাকে সাওরির ভাইয়ের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে বললো, মারা যাবার এক বছর আগে বন্ধুত্ব হয়েছিল দু’জনের।

    দুর্ঘটনার ঠিক এক বছর আগে, মাতাল কাজুয়াকে ক্যাফেতে নিয়ে এসেছিলাম আমি। হুশ একদমই ছিল না বেচারার।”

    “শুনেছি গল্পটা। সেদিনই তো সাওরির সাথে প্রথম দেখা হয় আপনার।”

    “হ্যাঁ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্বাভাবিক হবার পরে আমাকে আর চিনতে পারে না কাজুয়া,” হেসে বলে সুমিদা। এরপর বেশ কয়েকবার একসাথে ড্রিঙ্ক করেছি, সিনেমা দেখতে গেছি-এসব আর কি।

    একদিন নাকি দুজন মিলে হাঁটতে হাঁটতে দূরের একটা সবুজ পাহাড়ি অঞ্চলে চলে গিয়েছিল। সেদিন ক্লাস ফাঁকি দেয় সুমিদা আর কাজুয়া ততদিনে ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে গিয়ে সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে ছিল তারা।

    “দুই আহাম্মক আমরা,” সুমিদা বললো। “আসল কাজ না করে সারাদিন টোটো করতাম।”

    “আমার তো মনে হচ্ছে দু’জনে ভালোই সময় কাটাতেন।”

    কাজুয়ার সাথে সুমিদার সময় কাটানোর গল্পটা ভালো লাগলো আমার। গ্রীষ্মের দিনগুলোতে এভাবে উদ্দেশ্যহীনের মত সময় কাটাতে ভালই লাগবে।

    “ওকে আপন করে নেয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,” বললাম।

    গাড়ি থেকে নেমে সুমিদাকে বিদায় জানিয়ে স্টেশনে ঢুকে পড়লাম।

    কালো রঙের চাবির রিংটা এখনও ঝুলছে গাড়ির ভেতরে। ওটার সাথে লাগানো কালো পাখিটা ক্যাফের সেই বইটার কথা মনে করিয়ে দিল আমাকে। একটা কাক মানুষের চোখ উপড়ে নিচ্ছে! ছবিগুলো ভীষণ অস্বস্তি দায়ক। ঠিক করলাম পরেরবার ফিরে এসে বইটা পড়বো।

    *

    বুলেট ট্রেনে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগলো।

    বাসার কাছের স্টেশনটায় যখন পৌঁছালাম, সন্ধ্যা নেমে গেছে। লোকজনের ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। পশ্চিমের আকাশে এখনও লালচে আভা। গোধূলির আলোয় স্টেশনের পাশের দোকানগুলো দেখে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে রংধনু নেমে এসেছে।

    অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছি। সাওরি তো তখন বললো কথাটা, কিন্তু আসলেও বাবা-মা’র সামনে কিছু বলতে পারবো কিনা কে জানে। কয়েকবার মনে হলো ঘুরে স্টেশনের দিকে রওনা দেই।

    কিন্তু বাবাকে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছি ফেরার কথা।

    শিরাকি-নামফলকের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। পরিচিত দৃশ্যটাও অপরিচিত ঠেকছে এখন। কলিংবেলে চাপ দিতে মা দরজা খুলে দিল। আমাকে দেখে মুখ থেকে হাসিটা মুছে গেল তার। কি বলবে বুঝতে পারছে না যেন।

    “এসেছি আমি,” কিছুক্ষণ পর বললাম।

    অন্য দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো মা।

    কি করবো জানি না। কি বলবো জানি না। কান্না চেপে মা’র পেছন পেছন গেলাম

    মাকে আমি ঘৃণা করি না, কিন্তু সে আমাকে ঘৃণা করে। কিছু একটা বলা উচিৎ আমার। তবুও ভয় ভয় লাগছে। কি এমন বলবো? পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে ভাবতে লাগলাম-আমি যদি কথা বলি, সে কি না শোনার ভান করবে?

    “এসেছো তাহলে,” বাবা লিভিং রুম থেকে বললো।

    “ওভাবে হুট করে চলে গিয়েছিলাম দেখে দুঃখিত।

    মিশ্র একটা অনুভূতি খেলা করছে বাবার চেহারায়, কিন্তু পুরনো কথা ভুলে যেতে বললো সে।

    তিনজন মিলে রাতের খাবার সারতে বসলাম। প্রথম দিকে আমি আর মা দুজনই চুপ থাকলাম।

    পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করার জন্যে বাবা মাঝে মাঝে এটা সেটা বলছে। হা-হুঁ করে জবাব দিচ্ছি আমি। বেচারার জন্যে খারাপই লাগছে আমার।

    “কোথায় ছিলে এতদিন?” জিজ্ঞেস করলো বাবা। কায়েদির কথা– ফোনে জানাইনি তাকে। শুধু বলেছি অন্য একটা শহরে আছি।

    “এক বন্ধুর বাড়িতে। পাহাড়ি এলাকায়।”

    সাওরি, মেলানকলি গ্রোভ, কিমুরা আর সুমিদার ব্যাপারে সবকিছু খুলে বললাম তাদের। বললাম যে কিভাবে সাওরির সাথে কার্ড খেলেছি, সুমিদা একটু উল্টোপাল্টা কিছু বললেই কিমুরা গাট্টি বসায় তার মাথায়। কথাগুলো বলার সময় মুখে আপনা থেকেই একটা হাসি ভর করলো। এই মানুষগুলোকে নিয়ে চাইলে সারাদিন কথা বলতে পারবো।

    কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম হাতে গাল দিয়ে একমনে আমার কথা শুনে যাচ্ছে বাবা।

    “অনেকদিন পর এভাবে কথা বলতে শুনছি তোমাকে। পুরনো হাসিটা আবার ফিরে এসেছে।”

    কিন্তু মা যে এসব কথা শুনে বিরক্ত সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে এঁটো বাসনগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করলো সে।

    সেদিন রাতে নিচ থেকে বাবা-মা’র কথা কাটাকাটির আওয়াজ শুনতে পেয়ে নেমে এলাম চুপিচুপি। আমাকে নিয়ে ঝগড়া করছে দু’জন। নামি আর ঐ মেয়েটা এই দুটো শব্দ শুনলাম বেশ কয়েকবার।

    সিঁড়িতে বসে তাদের কথা শুনলাম অনেকক্ষণ। তবে ঝগড়ার বিষয়বস্তু কি সেটা বোঝার আগেই তর্ক থামিয়ে দিল তারা। বাতি নিভিয়ে দেয়ায় গোটা নিচতলায় এখন ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের সঙ্গী হয়েছে নৈঃশব্দ্য।

    সিঁড়িটা ঠান্ডা, তবুও বসে রইলাম। একটা কথা মাথায় ঘুরছে-বাবা মা আছে আমার।

    এর আগ পর্যন্ত আমি ভাবতাম এই বাড়িতে যারা থাকে তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। হয়তো স্মৃতি হারিয়ে ফেলায় এমনটা মনে হয়েছিল। সাওরি যখন বললো বাবা-মার সাথে ভালো করে কথা বলতে, তখন মনে হয়েছিল বাবা-মা থাকাটা আসলেও জরুরি কিনা।

    কিন্তু তারা দুজন আমাকে নিয়ে ঝগড়া করছে। আমার ব্যাপারে দু’জনেরই আলাদা আলাদা মতামত আছে। সেটা ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক তা বুঝতে পারিনি। তারা যে আমাকে নিয়ে চিন্তিত, সেটা আগেও বুঝতে পারতাম। কিন্তু সেই উপলব্ধিটা আমার মধ্যে কোন ভাবনার উদ্রেক করেনি। সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি, তবুও আমিই তারই সন্তান। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

    *

    ডাক্তার সাহেব বললেন যে স্মৃতি একটা রহস্যময় ব্যাপার।

    সেই হাসপাতালটায় এসেছি আবার ফলোআপের জন্যে। নস্টালজিক ভঙ্গিতে মাঝবয়সী ডাক্তারের সামনে বসে আছি এখন।

    বুড়ো আঙুল দিয়ে আমার চোখের নিচে টেনে ধরে পরীক্ষা করছেন তিনি। ওপরে নিচে, ডানে বামে তাকাতে বলছেন। আপাতত সব ঠিকই আছে মনে হচ্ছে।

    আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন তিনি, যেমন-”চোখে ব্যথা আছে নাকি?”

    মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম।

    “আগের কিছু মনে পড়েছে?”

    “এখনও না।”

    “আচ্ছা। যে কোন সময়ে একেবারে ফিরে আসতে পার, কিংবা ধীরে ধীরে মনে পড়বে সবকিছু।”

    তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে স্মৃতি ফিরে আসার ব্যাপারে চিন্তা করা বন্ধ করে দিয়েছি আগেই।

    “আমাদের মস্তিষ্ক খুবই জটিল একটা যন্ত্র,” বললেন তিনি। তার দেখা অন্য এক রোগীর ব্যাপারে গল্প করলেন আমার সাথে।

    মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিল লোকটা। বিগত দশ বছরের সবকিছু মুছে যায় মস্তিষ্ক থেকে। সম্পূর্ণ নতুনভাবে জীবনযাপন শুরু করেছিল সে। দু’বছর পর একদিন হঠাৎ আস্তে আস্তে ফিরে আসতে শুরু করে স্মৃতিগুলো।

    “মাঝে মাঝে একসাথে ফিরে আসে সব স্মৃতি। আবার কখনো নির্দিষ্ট বিরতিতে এক এক করে ফেরে। কেউ কেউ অবশ্য স্মৃতি একদমই ফিরে পায় না। এরকম নজিরও আছে। কিন্তু তোমার বয়স কম। অতীতের কথাগুলো মনে পড়তেও পারে।”

    স্মৃতি ফিরে পাবার ব্যাপারে ভাবলাম। আবারো আগের নামি হয়ে যাবো আমি। কিন্তু সেটা তো চাই না?

    পুরনো আমিকে ভিডিওটেইপে দেখেছি। আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে পিয়ানো বাজাচ্ছিল সে। কিবোর্ডের ওপর দিয়ে আঙুলগুলো উড়ে চলছিল যেন। নতুন আমি কি কখনো ওরকম কিছু করতে পারবে?

    যদি স্মৃতি ফিরে পাই, তাহলে এখনকার আমির কি হবে? ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম কথাটা।

    “সেটা বলা মুশকিল।”

    চেহারায় অস্বস্তি নিয়ে একবার গোঁফে হাত বুলালেন তিনি। স্মৃতি ফিরে পেলে আবারো আগের মতন হয় যাবো ঠিকই, কিন্তু এখনকার সবকিছু মনে থাকবে। এটা শোনার পর কিছুটা স্বস্তি পেলাম। আমি চাই না কাজুয়ার স্মৃতিগুলো মুছে যাক।

    “আচ্ছা এমন কি হতে পারে যে, আমার দু’টো সত্তার দৃষ্টিভঙ্গি দু’রকম। মানে স্মৃতি ফিরে পাবার আগে পরের কথা বলছি।”

    “এরকমটা হতে শুনেছি।”

    অন্য একজন রোগীর ব্যাপারে আমাকে খুলে বললেন তিনি। স্মৃতি হারাবার আগে সবকিছু ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে লোকটা, কিন্তু স্মৃতি হারাবার পর একদম নেতিবাচক হয়ে যায় তার আচার-আচরণ। একসময় যখন স্মৃতি ফিরে আসে, আবারো আগের মত ব্যবহার করা শুরু করে সে।

    “অ্যামনেশিয়ার রোগীরা স্মৃতিবিহীন অবস্থায় যে সময়টুকু কাটায়, তাদের পুরো জীবনের সময়কাল তুলনায় সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব অল্প। স্মৃতি ফিরে এলে মধ্যবর্তী সময়টুকু মনে হয়ে একটা লম্বা স্বপ্ন।”

    হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার গোটা পথে এই কথাটা নিয়েই ভাবলাম কেবল।

    স্মৃতি ফিরে এলে আমার কি হবে? সবাই আগের মতন পছন্দ করতে শুরু করবে আমাকে, আগের মতন পড়াশোনা আর খেলাধুলায় ভালো করবো। কিন্তু এই আপদগ্রস্ত আমার কি হবে তখন?

    আগের নামি কি কখনো রাস্তা দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যাবার সময় একাকীত্ব অনুভব করতো? কখনো কি বীতস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকাতো আয়নায় নিজের দিকে? যাদের সবাই ভালোবাসে, তাদের প্রতি কি ঈর্ষা কাজ করতো তার মনে?”

    ঐ নামির আছে সতেরো বছরের ইতিহাস। কিন্তু আমার স্মৃতিগুলোর বয়স মাত্র দুই মাস। স্মৃতি ফিরে এলে, এই কথাগুলো যে ভাবছে, তাকে কি বড় ঠুনকো চরিত্রের কেউ মনে হবে? গোটা সময়টাই একটা স্বপ্ন

    অপারেশনের পরে অনেকটা সময় কোন স্বপ্ন দেখিনি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে ঘুমিয়ে পড়লে সাওরি আর কায়েদি শহরের অন্যদের দেখি স্বপ্নে। একটা স্বপ্নে নীল রঙের একটা গাড়ির সাথে জোরে ধাক্কা লাগে আমার চোখ খোলার পরেও মনে হয় পাহাড়ি ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছি। অভিজ্ঞতাটা একদম বাস্তব। পরের কয়েকটা দিন রাস্তা দিয়ে চলার সময় কেবলই মনে হয় যে এই বুঝি নীল গাড়িটা এসে ধাক্কা দিবে আমাকে।

    কিন্তু বেশিরভাগ স্বপ্নই ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার পর আর মনে থাকে না। স্মৃতি ফিরে পেলে কি এখনকার আমিকে একেবারে ভুলে যাবো?

    আগের নামিকে অচেনা এক সত্তা মনে হয় এখন। তবে এটা যে ভ্রান্ত একটা ধারণা, তা-ও জানি।

    *

    ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে কাটাতে লাগলাম পরের কয়েকটা দিন। বাজে অভিজ্ঞতাগুলোই ঘুরে ফিরে আসছে মনে। চাইলেও মাথা থেকে বিদায় করতে পারছি না ওগুলো।

    মার সাথে আমার সম্পর্কের আরো অবনতি হয়েছে। কেউই কারো সাথে কথা বলার চেষ্টা করি না। আসলে কি বলবো সেটা জানি না। আমি নিশ্চিত, মা’র ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য।

    এ মুহূর্তে মা রাতের খাবার বানাচ্ছে। পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আমি। এই দৃশ্য আগেও অনেকবার দেখেছি নিশ্চয়ই, তবুও একদম নতুন মনে হচ্ছে।

    মা খুব বেশি লম্বা না। ছিপছিপে, দোহারা গড়ন। চুল ধূসর হতে শুরু করেছে। ছুরি দিয়ে একমনে গাজর কেটে চলেছে সে। ছুরির নড়াচড়ার তালে কাঁধও নড়ছে।

    তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইচ্ছে করে চোখ ঘুরিয়ে নিল মা!

    “মা, তুমি তো আমাকে অনেক ভালোবাসতে। আর সেই কারণেই এখন এত ঘৃণা করো। সেটাই স্বাভাবিক, এখন তো আর আগের মত কিছু করতে পারি না আমি, স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি…”

    জবাব দিল না সে। সমস্যা নেই, ভাবলাম।

    “ডাক্তার সাহেব বলেছেন আমার স্মৃতি ফিরে পাবার ভালো সম্ভাবনা আছে। তিনি অবশ্য চোখের ডাক্তার, কিন্তু এমন অনেককেই চেনেন যাদের অ্যামনেশিয়া সেরে উঠেছে কয়েক বছর পর। আবারো আগের মতন হয়ে যাবো তখন।”

    কিন্তু আমি চাই এখনকার নামিকে ভালোবাসো তুমি। এটা ঠিক যে আগের মত সবকিছুতে আর দক্ষ নই আমি। তবুও, এখনকার এই চিন্তাভঙ্গিটা কি এতই ফেলনা? স্মৃতি ফিরে পেলে হয়তো এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা ভেবে হাসবো। কিন্তু এখনকার আমিকে নিয়ে আমি যথেষ্ট গর্বিত। প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগতো, এখন আর লাগে না। আমি চাই তুমি বর্তমান নামিকেও মেনে নাও।

    “কালকে আবারো বন্ধুর বাসায় যাবো আমি কয়েকদিনের জন্যে।”

    বলে দৌড়ে ওপরতলায় আমার ঘরে চলে আসলাম।

    পরদিন খুব ভোরে কাউকে কিছু বলে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে।

    *

    স্টেশন থেকে ফোন দিলাম সুমিদাকে।

    “তাড়াতাড়িই ফিরলে দেখছি,” আমি গাড়িতে ওঠার পর বললো সে।

    “এখানে কিছু কাজ এখনও বাকি আছে। সাওরির কি খবর?”

    “ইদানিং বড় চুপচাপ হয়ে গেছে ও,” বললো সুমিদা। গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে কাজুয়ার ব্যাপারে আমার সাথে গল্প করলো সে। কাজুয়া সম্পর্কে নতুন যে কোন তথ্য লুফে নেই আমি। সুমিদা এখন যে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটায় থাকে, সেটার সামনে থামলাম আমরা। ডিভিআরের রেকর্ডিং চালু করে আসতে ভুলে গেছে সে। বিল্ডিংটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় সে বললো গত এক বছর ধরে এখানে থাকছে। আগে অনেক দূরে থাকত বিধায় ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে অসুবিধে হতো। তাই চলে এসেছে এই নতুন অ্যাপার্টমেন্টে।

    গাড়িতে বসেই সুমিদার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ইঞ্জিন চালু করে রিয়ারভিউ মিররে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখে সে বললো, “কাজুয়া প্রায়ই আসততা এখানে।”

    “তাই নাকি? রাতে থাকতো?”

    “সাওরি যখন বাসা থেকে বের দিয়েছিল ওকে, তখন কয়েকদিন ছিল,” হেসে বললো সুমিদা।

    “কি কারণে বের করে দিয়েছিল সেটা শুনতে ভালোই লাগবে আমার, খুব বেশি আগ্রহ না দেখিয়ে বললাম। ভেতরে ভেতরে কৌতূহলে ফেটে পড়ছি।

    একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সুমিদা। ইঞ্জিন চালু না করে কাজুয়ার ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করলো সে।

    মিডল স্কুলে থাকার সময় খুব একটা খারাপ ছাত্র ছিল না কাজুয়া। কিন্তু হাইস্কুলে ওঠার পর রেজাল্ট খারাপ হতে থাকে। সেসময় অবশ্য সুমিদা চিনতো না তাকে; এসবই কাজুয়ার কাছে শুনেছে।

    কোনমতে হাইস্কুল থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় কাজুয়া। সুমিদা যেখানে পড়ে সেখানে না, অন্য একটা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি মন উঠে যায় তার।

    “ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সারাদিন বাসায় বসে থাকতো।”

    জীবনের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা অনুভব করতে না কাজুয়া। ক্লাস বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে সময় যেন একদম থেমে যায় তার। বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাতও বন্ধ করে দেয়। সুমিদার সাথে যখন পরিচয় হয় তার, সবাই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। একা একা কায়েদিতে ঘুরে বেড়াতো কাজুয়া। কখনো পাহাড়ে চড়তো, কখনো পার্কে গিয়ে বসে থাকতো, কখনো পুরনো স্কুলে গিয়ে টিচারদের সাথে কথা বলতো।

    “সন্ন্যাসী বনে গেছিল রীতিমত,” সুমিদার কণ্ঠের আবেগটুকু বুঝতে অসুবিধে হলো না আমার।

    সাওরি কাজুয়ার এরকম ছন্নছাড়া জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠলে সুমিদার অ্যাপার্টমেন্টে এসে পড়েসে।

    গাড়িতে করে কায়েদি ফিরে যাবার পথে কেবল কাজুয়াকে নিয়েই ভাবলাম। সুমিদা অবশ্য কথা বলার চেষ্টা করলো কয়েকবার, কিন্তু আমার প্রাণহীন উত্তরে দমে গেল কিছুক্ষণ পর। আমাকে আর বিরক্ত করলো না।

    কায়েদির এক অলস গ্রীষ্মের দিনে একা একা হেঁটে বেড়াচ্ছে কাজুয়া-এই দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। লম্বা ঘাসের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হাত বাড়িয়ে সবুজটুকু মুঠোবন্দি করার চেষ্টা করছে। একটা পাখি কাজুরার পায়ের শব্দ পেয়ে উড়ে গেলে সেটার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকলো সে কিছুক্ষণ। হাঁটার সময় শুকনো বাতাস মুখে এসে লাগলে সেই অনুভূতিটাও উপভোগ করছে। নিজে নিজেই কথা বলছে হয়তো।

    সাইড ভিউ মিররে আমার বাম চোখটা দেখতে পাচ্ছি।

    কাজুয়াকে ভালোবাসি আমি। এতদিন চেষ্টা করছিলাম তার প্রতি আমার অনুভূতিটা ঠিক কি ধরনের সেটা নিয়ে না ভাবার। খুব কাছের কারো প্রতি সাধারণত এরকম স্নেহ কাজ করে মানুষের। এর থেকে বেশি কিছু হলে আমি নিজেই কষ্ট পাবো। মারা গেছে কাজুয়।

    তার প্রতি শুধু এই অনুভূতিটুকুই যে কাজ করে, তা নয়। বরং নিজেকে মাঝে মাঝে কাজুয়া ভাবি আমি। মনে হয় যেন তার আত্মা ভর করেছে আমার শরীরে। এরকমটা মনে হওয়ার কারণ যে তার স্মৃতিগুলো, এটা জানি। কিন্তু আমার আসল পরিচয় কি, এটা যখন নিজেকে জিজ্ঞেস করি, কোন যুক্তিযুক্ত উত্তর খুঁজে পাই না।

    কে আমি? নামির কোন স্মৃতি নেই আমার মধ্যে। কিন্তু কাজুয়ার স্মৃতিগুলোর কারণে নিজেকে তো আর কাজুয়া দাবি করতে পারি না। এই যে তার হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে কায়েদিতে ফিরে এসেছি, এটা কি আসলেও ঠিক হচ্ছে? নাকি প্রকৃতি ইচ্ছেকৃতভাবে এরকম একটা পরিস্থিতিতে ফেলেছে আমাকে, ভিন্ন কোন উদ্দেশ্যে?

    কিছুক্ষণের মধ্যেই কায়েদিতে ঢুকে পড়লাম আমরা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পুরোটা দিন রাস্তাতেই কাটলো আজকে।

    মেলানকলি গ্রোভ দেখতে পেলাম আবারো। ভেতরে নিশ্চয়ই বিশালদেহী কিমুরা আর বিমর্ষ সাওরি পথ চেয়ে আছে কাস্টমারের অপেক্ষায়।

    “এসে পড়েছে!” আমাকে দেখে হেসে বললো সাওরি।

    মনে হল যেন কেঁদেই ফেলবো। আমার স্মৃতি ফিরে এলেও এই মুহূর্তটা কখনো ভুলতে চাই না।

    “নামি, বাবা-মা’র সাথে কথা বলেছে তো?” সাওরি জিজ্ঞেস করলো। “হ্যাঁ, বলেছি খানিকটা,” অস্পষ্টভাবে বললাম।

    “স্কুল শুরু হয়ে যাবে না? এখন এখানে থাকলে অসুবিধে হবে না তো কোন?”

    “একটু অসুবিধে হতে পারে। তবে সেটা নিয়ে আপাতত ভাবছি না।”

    “আসলে স্কুলে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই তোমার, কাউন্টারের ওপর গালে হাত রেখে বললো সে।

    কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

    “আমার কাছ থেকে কিছু লুকোতে পারো না তুমি!” এবারে হেসে উঠলো সাওরি। সাথে সাথে মন খারাপ ভাবটা দূর হয়ে গেল আমার।

    তার সাথে কথা বলার প্রতিটা মুহূর্তে কেবল মনে হতে লাগলো যে এই স্মৃতিগুলো একসময় ভুলে যাবো। পুরনো নামি কি এই কথাগুলো চিন্তা করে মনে মনে খুশি হয়ে উঠবে কখনোর।

    না, স্মৃতিগুলো কখনো ভুলবো না আমি। আগের স্মৃতি আদৌ ফিরে আসবে কিনা জানি না, কিন্তু সাওরি বা কায়েদির কাউকে কখনো ভুলবো না। তবে তাদের প্রতি আমার অনুভূতিগুলো বদলে যেতে পারে। সেটাই আমার সবচেয়ে বড় ভয়।

    মিঃ ইশিনোর বাড়িতে ফিরে রাতের খাবার শেষ করে সাওরিকে বললাম যে অনেকদিন ধরেই স্কুলে যাই না আমি। মার সাথেও সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। তবে এসবের কারণটা কি, তা চেপে গেলাম।

    “সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু,” আমাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললো সাওরি। “সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়, কথাটা শোনোনি?”

    “হয়তো আমার কথাই ভুলে গেছে সময়।”

    আমি যে অ্যামনেশিয়ায় ভুগছি, এটা সাওরিকে বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। তখন সে বুঝতে পারবে যে কাজুয়ার সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে আমি যা বলেছি, তার পুরোটাই মিথ্যে।

    একদিন সবকিছু খুলে বলবো তাকে। এখানে আসার সত্যিকার কারণটাও বলবো।

    *

    সেই রাতে দাঁত ব্রাশ করার সময় সামনের দরজা খোলার শব্দ কানে এলো আমার। কুলি করে মুখ মুছে দ্রুত নেমে এলাম নিচে। মিঃ ইশিনোর পুরনো জুতোটা নেই দরজার পাশে। ঝাপসা কাঁচের দরজার অন্যপাশে তার অবয়বটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অবশ্য।

    কোনকিছু না ভেবেই শুভরাত্রি বলার জন্যে দরজা খুললাম।

    সিঁড়ির ওপরে বসে আছেন তিনি। কাঁধ দুটো ঝুঁকে আছে। কাজুয়ার বাম চোখে তাকে যেরকম দেখেছিলাম, তার চাইতে একদমই ভিন্নরকম লাগছে এখন। মনে হচ্ছে যেন বাঁচার ইচ্ছেটা হারিয়ে ফেলেছেন।

    দরজা খোলার শব্দে পেছনে তাকিয়ে আমাকে দেখে একটা দুর্বল হাসি ফুটলো তার মুখে। “হ্যালো,” আলতো মাথা নেড়ে বললেন।

    “ঘুমোতে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনি কি করছেন দেখে যাই,” বললাম।

    জবাবে কি বলবেন সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন মিঃ ইশিনো। “আমার স্ত্রীর কথা ভাবছিলাম, কিছুক্ষণ পর বললেন ক্ষীণ কণ্ঠে।

    গেটের সামনের দিকটায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। ওখানটাতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন মিসেস ইশিনো।

    “সরি, আপনাকে বিরক্ত করাটা উচিৎ হয়নি আমার…”

    মনে হচ্ছে যেন কেঁদে ফেলবো।

    “সমস্যা নেই। ওর কথা সবসময়ই ভাবি আমি।”

    বাইরে বেশ ঠান্ডা। রাতের অন্ধকার দিনের উত্তাপটুকু শুষে নিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে এখনো আরো বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার ইচ্ছে তার। হয়তো অবচেতন মনে নিজেকে এভাবেই শাস্তি দিচ্ছে সে। স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার কারণে এখনও অনুতাপ কাজ করে তার ভেতরে।

    এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার নাক গলানোর কোন অধিকার নেই।

    তবুও সরে যেতে পারলাম না দরজা থেকে। তার পিঠের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনার স্ত্রীর সম্পর্কে আমাকে অনেক কিছু বলেছে কাজুয়া।”

    আসলে তাকে বাম চোখে দেখেছি আমি।

    এক রাতে মিঃ ইশিনো মাতাল হয়ে লিভিং রুমেই ঘুমিয়ে পড়েন। তার স্ত্রী পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন চেহারায় উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে। কিছুক্ষণ পর একটা কম্বল নিয়ে এসে তার গায়ে চাপিয়ে দেন।

    একদমই সাধারণ একটা দৃশ্য।

    কিন্তু তার চেহারায় স্বামীর জন্যে যে অনুভূতিটা খেলা করছিল, তা মোটেও সাধারণ কিছু ছিল না।

    মিঃ ইশিনোকে সেটাই বললাম।

    “আমি নিশ্চিত আপনার ওপর কোন ক্ষোভ ছিল না তার, কাজুয়া এমনটাই বলেছিল।”

    চুপ রইলেন মিঃ ইশিনো।

    ভেতরে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালাম।

    “ধন্যবাদ,” আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন।

    ঘরে এসে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লাম। তিনি আসলে জানতেন। জানতেন যে তার মৃত্যুর পর এরকম দশা হবে মিঃ ইশিনোর। তাই কখনো পাল্টা রাগ দেখাননি। এটাই হয়তো ভালোবাসা।

    এটা কি কাকতালীয় যে মামীর সাথে এতটা সময় কাটানোর পরও এই স্মৃতিটাই মনে রেখেছে কাজুয়া। মনে হয় না। ওটা যে সাধারণ কোন মুহূর্ত ছিল না এটা কাজুয়া বুঝতে পেরেছিল।

    *

    আমি জানি হিতোমি ঐ নীল বাড়িটাতেই আছে। কিন্তু শিওজাকির বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ যোগাড় করতে না পারা অবধি কিছু করা সম্ভব নয়।

    ক্যাফেতে তার সাথে কথা হয়েছে আমার। “কয়েকদিন আপনাকে দেখিনি এখানে। শুনেছিলাম বাড়ি ফিরে গেছেন।”

    “হ্যাঁ,” জবাব দেই শান্ত কণ্ঠে। কিন্তু ভেতরে ভতরে তার মুন্ডুপাত করছিলাম।

    তার কারণেই মারা গেছে কাজুয়া। প্রচণ্ড রাগ লাগে আমার। তা সত্ত্বেও নিজেকে সামলাই, যাতে উল্টোপাল্টা কিছু না করে ফেলি।

    কথা না বাড়িয়ে নিজের পছন্দের টেবিলটার দিকে চলে যায় শিওজাকি। সে বসার পর কিছুটা শান্ত হই, আসলে তার প্রতি এখনও একটা ভয় কাজ করে আমার মনে।

    মাঝে মাঝে সন্ধ্যা অবধি মেলানকলি গ্রোভেই থাকি। ক্যাফে বন্ধ হওয়া অবধি অপেক্ষা করি। এরপর সাওরির সাথে একসাথে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরি। তার মামার বাড়িতে যাওয়ার পথে একটা বনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় আমাকে। সাওরি বলে যে ছোট থেকেই এই পথে যাতায়ত আছে তার, কোন ভয় নেই। তবুও কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করে ভূতুড়ে গাছগুলর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়।

    আজকেও সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ক্যাফে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত থাকবে। তাই হাতে কিছুটা সময় আছে। বইয়ের শেলফে ‘চোখের স্মৃতি’ নামের রূপকথার বইটা চোখে পড়লো এসময়। ভেতরের ছবিগুলো খুবই অস্বস্তিকর। ওটাই তুলে নিলাম পড়ার জন্যে।

    কাউন্টারে বসে পড়তে শুরু করলাম। রূপকথার বই হলেও ভেতরে এমন কিছু ছবি আছে যেগুলো বাচ্চাদের উপযোগী নয়। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল বইটা। লেখকের লেখার হাত বেশ ভালো। বইটা বন্ধ করার পরেও একটা কাককে ঠোঁটে রক্তাক্ত চোখ নিয়ে ঘুরতে দেখলাম মনের পর্দায়।

    কাকটা চায়নি যে মেয়েটা তার খারাপ কাজগুলো সম্পর্কে জানুক। সে যে মানুষ নয় এটাও জানাতে চায়নি। ব্যাপারটা পীড়া দিয়েছে তাকে। আর শেষটা…

    “আমি জানতাম যে গল্পের শেষটা ভালো হবে না,” সাওরির উদ্দেশ্যে বললাম। কিন্তু মেয়েটার বাবা-মা’র কি দশা হয়েছিল চিন্তা করো।”’

    কাউন্টারের পেছনে বসে বইটা সম্পর্কে আমার কি ধারণা সেটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছিল সে। “আমিও এটাই ভেবেছিলাম।”

    “বইটা কি কিমুরার খুব পছন্দ? সেজন্যেই রেখে দিয়েছে শেলফে?”

    “মনে হয় না এটা তার বই। একদিন হঠাৎই শেলফটায় পায়।”

    আরেকবার পাতাগুলো ওল্টালাম। একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম এবারের ছবিতে প্রথম যে ছেলেটার চোখ তুলে নেয় কারাসু, সেই ছেলেটা রাগত ভঙ্গিতে হাত নাড়তে থাকে তার উদ্দেশ্যে। কিন্তু চোখ হারাবার পর তো ব্যথায় কাতরানোর কথা তার। মনে হয় যেন শারীরিক কষ্টের ব্যাপারটা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

    প্রচ্ছদে লেখকের নাম লেখা-শান মিকি।

    *

    সাওরি আর আমি হেঁটে বাড়ি ফিরছি। ঠান্ডায় কাঁপছি দু’জনই। সাধারণত এ সময় কথা বলি আমরা, কিন্তু আজকে একদম চুপচাপ সে। মনে পড়লো যে সুমিদা বলেছিল ইদানীং সবসময় মুখ গোমড়া করে রাখে সাওরি।

    “কি ভাবছো?”

    “ইয়ে মানে…” সাওরি বললো। “কিয়োকোর কথা।”

    “কিয়োকো?” কণ্ঠের বিস্ময় গোপন করতে পারলাম না। মনে আছে একবার তোমার সাথে কিয়োকোর বাসা থেকে ফেরার পথে দেখা হয়েছিলা আমার?”

    “আসলে সেদিন তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম আমি,” সাওরি বললো। কি নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিল জিজ্ঞেস করায় চুপ করে থাকলো সে, শুধু একবার হাসলো দুর্বল ভঙ্গিতে।

    আবারো চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম দুজনে।

    “কাজুয়া যখন চোখ দান করে দেয়ার কথা বলেছিল, তুমি কি আপত্তি করেছিলে?”

    “খুব বেশি না। আসলে ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দেইনি তখন।”

    “কেন?”

    “কারণ ওর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার কোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার নেই। তাছাড়া ওর চোখটা এখনও অন্য কারো শরীরে বেঁচে আছে, এটা ভালো না?”

    মরণোত্তর চক্ষুদানের জন্যে একটা ফর্ম পূরণ করতে হয়। সেখানে অভিভাবকের সই দরকার। কাজুয়ার ফর্মটায় সাওরি সই করে। ব্যাপারটা নিয়ে সাওরিকে কথা বলতে শুনে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলাম।

    ওরা দু’জন যদি কাজটা না করতো, তাহলে আমার কি হতো? অন্তত কায়েদিতে আসতাম না। এই সুন্দর মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে পারতাম না। একসময় হয়তো স্মৃতি ফিরে পেতাম। কিন্তু নিজেকে ভুলতে না চাওয়ার যে অনুভূতিটা, সেটার স্বরূপও কখনো জানতাম না।

    দুর্ভাগ্যজনকভাবে কাজুয়ার ফর্মটা পূরণ করার স্মৃতি দেখিনি আমি বাম চোখে। এসময় হঠাৎই বুঝতে পারলাম যে কেন দেখিনি।

    “যখন কাজুয়া ফর্মটা পূরণ করছিল, তার চোখে কি ব্যান্ডেজ ছিল?”

    “এটা জানতে চাইছো কেন?” কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো সাওরি। “তিন দিন ব্যান্ডেজ ছিল ওর চোখে, হ্যাঁ।”

    “ডান চোখে না বাম চোখে?”

    “বাম চোখে, আগেও বলেছিলাম না?”

    আমার চেহারায় যে চোখটা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে সেটা ব্যান্ডেজে ঢাকা ছিল তখন। অনন্তকাল অপেক্ষা করলেও তাই সেই স্মৃতিগুলো দেখতে পাবো না কখনো। কারণ বাম চোখটা সেই মুহূর্তটুকু প্রত্যক্ষই করেনি কখনো।

    এসময় একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় এলো। বাম চোখে দৃশ্যটা দেখতে পারেনি তখন ব্যান্ডেজের কারণে। হয়তো হিতোমিকে তলকুঠুরিতে দেখার পর পালানোর সময়েও এই ধরনের কিছু হয়েছিল। বাম চোখে ব্যথা পেয়েছিল। তাই আমি ঐ পাথুরে দেয়ালটা দেখতে পাইনি স্মৃতিতে।

    ব্যথা পেয়ে বাম চোখটা যদি বন্ধ হয়ে যেত, গোটা দৃশ্যটাই তো অন্ধকার হবার কথা। কিন্তু লাইব্রেরিতে সেদিন হঠাৎ এরকম একটা স্মৃতির প্রদর্শনীতে চমকে গিয়েছিলাম ভীষণ। হয়তো এই অল্প সময়ের বিরতিটা খেয়ালই করিনি।

    এখন একদম শতভাগ নিশ্চিত আমি।

    হিতোমি শিওজাকির বাড়িতেই আছে। আমার ধারণাই ঠিক।

    কিছুক্ষণ দ্বিধাবোধের পর মিঃ ইশিনোর ফোনটা চেয়ে নিলাম পুলিশকে ফোন দেয়ার জন্যে। কর্ডলেস ফোন হওয়াতে দূরে গিয়ে কথা বললেও সমস্যা নেই। সাওরি বা তার মামা যদি শুনতে পারে আমি কি বলছি, তাহলে পরিস্থিতি অনর্থক ঘোলাটে হবে। তারা ভেবেছে বাবা-মা’র সাথে কথা বলবো আমি।

    যা করছি ঠিক করছি, নিজেকে অভয় দিয়ে তিন ডিজিটের নম্বরটায় ফোন দিলাম। ১-১-০। এতদিন ভেবে এসেছি পুলিশে ফোন দিয়ে কোন লাভ নেই। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?

    এক মাঝবয়সী লোকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো অন্য পাশ থেকে। পুলিশের কাজের সুবিধার্থে আমার কথা রেকর্ড করা হবে বলে জানালো

    প্রথমে হিতোমি আইজাওয়াকে চেনে কিনা সে এটা জিজ্ঞেস করলাম। “আপনি কি… জানেন কার কথা বলছি?”

    জানে না সে।

    “এক বছর আগে হারিয়ে যায় সে।”

    এরপর বললাম যে অপহরণ করা হয়েছে তাকে।

    জবাবে কেবল প্রাণহীন কণ্ঠে “ওহ” বললো অফিসার। এর জবাবে আমি চুপ থাকলে কিছুক্ষণ পর যোগ করলো, আমরা তদন্ত করে দেখবো ব্যাপারটা। আপনাকে ফোন করে জানাবো। এটাই তো আপনার নম্বর?”

    কিছু বললাম না তৎক্ষণাৎ। এটা মিঃ ইশিনোর নম্বর। যদি পুলিশ ফোন করার পর সাওরি ধরে, আমার সম্পর্কে কি ভাববে? সত্যটা তখন স্বীকার করতে হবে আমাকে। সবকিছু খুলে বলতে হতে পারে। সবাই ধরে নেবে যে আমি মিথ্যুক।

    “আমাকে কি বলতেই হবে?”

    সাথে সাথে কথা বলার ধরণ পাল্টে গেল অফিসারের।

    নিজের পরিচয় না দেয়াতে সে ভাবছে আমি বোধহয় ফাজলামো করার জন্যে ফোন দিয়েছি। বারবার বললাম যে সেরকম কোন উদ্দেশ্য নেই আমার, কিন্তু লাইন কেটে দিল সে।

    পরদিন নতুন সংকল্প নিয়ে মেলানকলি গ্রোভে পা রাখলাম আমি।

    শিওজাকি প্রতিদিন দুপুর একটার সময় আসে ক্যাফেতে। ততক্ষণ অবধি কিয়োকোর সাথে কথা বললাম।

    আমাদের কথোপকথনের মাঝামাঝি এক পর্যায়ে সে বললো, “সাওরি যে কাজুয়াকে নিয়ে কি ভাবে সেটাই চিন্তা করি মাঝে মাঝে।

    এখনও ভাইয়ের মৃত্যু মন থেকে মেনে নিতে পারেনি সাওরি। মনে মনে এই কথাটা ভাবলেও মুখে বলতে পারলাম না।

    “আমার ধারণা সবসময় তাকে নিয়েই চিন্তা করে মেয়েটা,” কিয়োকো বললো।

    তাকে কাজুয়ার সোনালি হাতঘড়িটার কথা বললাম। সাওরি যে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছে সেটা, তাও জানালাম।

    “ঘড়ি?”

    “দুর্ঘটনায় ভেঙে যায় ঘড়িটা। ঠিক দুর্ঘটনার সময়টাতেই থেমে গেছে কাটাগুলো।”

    এর আগের দিন বাসায় ফেরার সময় সাওরির বলা কথাটা মনে পড়লো। কিয়োকোর সাথে কি বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছিল সে? জানতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এভাবে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।

    একটা বেজে গেল দেখতে দেখতে। ঠিক তখনই দরজার ঘণ্টার শব্দটা শুনতে পেলাম। একজন কাস্টমার এসেছে।

    প্রতিদিনের মত আজকেও কালো কোটটা পরনে শিওজাকির। ধীরে সুস্থে হেঁটে নিজের টেবিলটায় গিয়ে বসলো।

    মাথা নিচু করে সাহস জোগালাম মনে মনে। ভয় লাগছে ভীষণ। কিন্তু পুলিশের লোকেরা যেহেতু ধরে নিয়েছে আমি ফাজলামো করছি, এখন আর অন্য কোন উপায় নেই।

    “কোন সমস্যা?” জিজ্ঞেস করলো কিয়োকো।

    “নাহ, কিছু না,” মৃদু হেসে বলে উঠে পড়লাম।

    শিওজাকির সামনে এসে দাঁড়ালাম একটু পর। পকেট থেকে একটা পুরনো খবর কাগজ বের করে তার চোখের সামনে ধরলাম। হিতোমি আইজাওয়ার স্কুলের ছবিটা আছে সেখানে।

    “শিওজাকি,” ডাক দিলাম।

    মুখ উঠিয়ে আমার দিকে তাকালো সে। “হ্যালো।”

    আমার হাত কাঁপছে। এখন আর ফিরে যাবার সময় নেই। “একটা প্রশ্ন ছিল আপনার কাছে। এই মেয়েটাকে খুঁজছি আমি। তাকে চেনেন?”

    গলার কাঁপুনিটা চেষ্টা করেও লুকোতে পারলাম না। আমার কাছ থেকে কাটা খবরের কাগজটা নিল শিওজাকি। সেসময় আমার হাত স্পর্শ করলো তার হাত। ভীষণ ঠান্ডা। কেঁপে উঠলো আমার গোটা শরীর; সেটা ভয়ে নাকি ঠান্ডায় তা বলতে পারবো না।

    কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। এরপর আমার দিকে চোখ ফেরালো।

    “নাহ, আগে কখনো দেখিনি,” ছবিটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো শিওজাকি।

    এরপর আমাদের মধ্যে আর কোন কথা হয়নি। তার কাছ থেকে এরকম প্রতিক্রিয়াই অবশ্য আশা করেছিলাম। কিন্তু ছবিটা দেখার পর ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই ঝড় বইতে শুরু করেছে তার।

    নিশ্চয়ই ভাবছে আমি কেন হিতোমির খোঁজ করছি। তাকেই বা কেন জিজ্ঞেস করলাম। আমার মুখ বন্ধ করার জন্যে এখন কিছু একটা নিশ্চয়ই করবে সে। সেটা আজ হোক বা কাল।

    আমি চাইছি যে করুক।

    একমাত্র তখনই গোটা পৃথিবীর কাছে তার মুখোশটা খুলে দিতে পারবো।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজু – অৎসুইশি
    Next Article আজাজেল্‌ – আইজাক আসিমভ

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }