Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প813 Mins Read0

    ১১. নীলাঞ্জনা বসলেন

    নীলাঞ্জনা বসলেন সামনের একটা চেয়ারে। বললেন, আপনার মতো একজন স্বনামখ্যাত ম্যানেজার আমার এখানে এসেছেন, কি যে ভাল লাগছে? আমারও ভাল লাগছে আপনাদের মধ্যে আসতে পেরে। তা হলে তো মাঝে মাঝে আসতে পারেন। দেখি। কফির পেয়ালা শেষ করে, প্রতীম বাবু বললেন, আমাকে যে এবার উঠতে হবে? এত তাড়াতাড়ি তো ওঠার কথা ছিল না। তাছাড়া আপনার জন্য আমার মেয়ে যে এত রান্না করল সে গুলো কি হবে? আমি খাবো সে কথাতো ছিল না। তা হয়তো ছিল না, কিন্তু প্রান্তিক আপনাকে না খাইয়ে ছেড়ে দেবে তা আপনি ভাবলেন কি করে? তারপর জানতে চাইলেন এখানে কি কোন অসুবিধা হচ্ছে আপনার। না না অসুবিধা কিছু নয়। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। আপনাকে? বলুন। যতদূর জানি প্রান্তিকের মা এই কলকাতাতেই থাকেন, তা হলে ও আপনার কাছে থাকে কেন? একটু হাসলেন নীলাঞ্জনা, বললেন, মিনতিকে জিজ্ঞাসা করেননি? না জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কেন? আর তাছাড়া বললেন যে যতদূর জানি। ওর মা এই কলকাতাতেই থাকে, আগে চিনতেন নাকি ওকে। প্রতীম চৌধুরী বললেন বলা কি ঠিক হবে? অতীততো অতীতই তাইনা নীলাঞ্জনা দেবী। সব অতীত, অতীত নয় মিঃ চৌধুরী বললেন নীলাঞ্জনা আরো বললেন, কোন কোন অতীতকে মনে হয় সব সময় তা বর্তমান। আমি বরং ওকেই পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি ওকেই জিজ্ঞেসা করুন। ওর ছেলে কেন আমার কাছে থাকে। না থাক। থাকবে কেন? মনে হচ্ছে কী যেন লুকাচ্ছেন? কিছুই লুকাচ্ছিনা। আমি শুধু ভাবছি? কি ভাবছেন? আর একদিন বলব। কেন আজকে বলা যায় না? হয় তো যায় তবুও থাক। সেলিনা এসে বলল, মা, ওনাকে নিয়ে ও ঘরে এস। তুই যা, আমরা আসছি। নীলাঞ্জনা দেবী বললেন চলুন ওরা আপনার জন্য বসে আছেন। সত্যি খেতে হবে? নীলাঞ্জনা স্মিত হেসে বললেন, জোর দবরদস্তি করা হয়তো ঠিক হবে না, কিন্তু আপনি কিছু না খেলে, মনে হবে, আপনার আমাদের পছন্দ হয়নি। এই দেখুন, এই আপনাদের এক দোষ। আমাদের দোষ? আপনি আমাদের মতন কাউকে চেনেন নাকি। আর কথা না বাড়িয়ে প্রতীম বাবু বললেন, না চলুন।

    সেলিনা বলল, তোমরা বোস মা, আমি পরিবেশন করছি। তুই বোস মা, আমি পরিবেশন করি। প্রতীম চৌধুরী বললেন, আমার মনে হয়, আমরা সবাই এক সঙ্গে বসতে পারি, তাতে তো কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমি বললাম সেই ভাল। মা, তুমি বসবে না কেন? পিসি বলনা মাকে বসতে, মিনতি সেন বললেন, তোর সব কিছুতেই জবরদস্তি। প্রতীম চৌধুবী বলেন, মিনতি দেবী, ওতো ঠিকই বলেছে। আপনারা আমাকে আপনার না ভাবলেও ও কিন্তু আমাকে আপন ভেবেই একথা বলেছে। যদি আমার সঙ্গে এক সাথে বসতে আপত্তি থাকে, তাহলে অবশ্য থাক। তারপর সেলিনাকে বললেন, সেলিনা, তুমি যা দেওয়ার দিয়ে দাও। আমাকে তো আবার যেতে হবে অনেকটা পথ।

    এরপর মিনতি সেনের আর প্রতিবাদ করা চলে না। বললেন ঠিক আছে, তা হলে সেলিনা একসাথে সবাইকে দিয়ে দে। নীলাঞ্জনা পিসি এবং সেলিনা বাজার করেছে রান্না করেছে, যা কিছু আয়োজন সব তাদের ইচ্ছেয়। আমি শুধু নীলাঞ্জনা পিসিকে বলেছিলাম, মিনতি সেনের একটা অতীত আছে, যাকে নিয়ে সেই অতীত, তিনিই প্রতীম চৌধুরী। দীর্ঘদিন ওদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। দেখনা, যোগাযযাগটা তুমি ঘটিয়ে দিতে পার কিনা। মানে ঘটকালিটা আমাকে করতে হবে, বলেছিলেন নীলাঞ্জনা পিসি। না পিসি, সে এক বেদনাময় অতীত। তারপর তাদের সম্পর্কে যা জানি সব বললাম পিসিকে, এমনকি মিনতি সেনের বাবার চিঠিটা পর্যন্ত। নীলাঞ্জনা সব শুনলেন, কিন্তু কোন মন্তব্য না করে বললেন, উনি কবে আসবেন? রবিবার।

    প্রতীম চৌধুরী বললেন, সেলিনা এত আয়োজন করেছে কিন্তু এত কিছু খাওয়ার অভ্যেস তো নেই। বোঝতো, নিজের হাতে না হলে হোটেলের খাবারে পেট ভরাতে হয়। এত কি খাওয়া যায়? নীলাঞ্জনা বললেন, এ আপনার ভারি অন্যায়। বাংলাদেশে কি মেয়ের অভাব, কাউকে কি আপনার পছন্দ নয়? আমার পছন্দ নয় কথাটা ঠিক ওরকম নয়। বরং উল্টো আমাকেই কারো পছন্দ নয়। এ আপনার মিথ্যে অভিযোগ, যদি রাজী থাকেন, আমি কিন্তু ঘটকালি করতে পারি। দেখতে পাচ্ছি মিনতি সেন মুখ নীচু করে খেয়ে যাচ্ছেন, কারো কোন কথার বিশেষ কোন উত্তর দিচ্ছেন না। প্রতীম চৌধুরী বললেন ধন্যবাদ নীলাঞ্জনা দেবী। আর এই বয়সের ঘটকালি করার দরকার নেই। এতদিনেও যখন জীবনে কেউ আসেনি। বাকি দিনগুলো নাইবা কেউ এলো। তারপর হঠাই মিনতি সেনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি যে কোন কথাই বলছেন না মিনতি দেবী। মিনতি সেন বললেন, আপনারা বলছেন, আমি শুনছি। সবাই যদি বলি তা হলে শুনবে কে? তা অবশ্য ঠিক।

    একসময় খাওয়া শেষ হয়। মিনতি সেন আর ও ঘরের দিকে পা মাড়াননি। নীলাঞ্জনাই এলেন এ ঘরে। প্রতীম চৌধুরী বললেন, আপনাদের আতিতেয়তা আমার মনে থাকবে। আজ তবে উঠি। আচ্ছা, আবার কবে আসবেন? দেখি সময় সুযোগ হলে আসব একদিন। নীলাঞ্জনা বললেন প্রান্তিক, প্রতীমবাবুকে একটু এগিয়ে দিয়ে এসো। আমি কাছে এসে দাঁড়ালে প্রতীমবাবু বললেন, আশা করি তোমার গবেষণা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, একদিন এস তোমরা সবাই, ভীষণ ভালো লাগবে। বললাম যাব একদিন, হঠাৎ প্রণাম করলাম ওকে। এই প্রথম। উনি আশীর্বাদ করে বললেন, তোমার মত ছেলে যেন বাংলার ঘরে ঘরে জন্মায়। এরপর উনি আস্তে আস্তে গাড়ীতে গিয়ে উঠলেন। আমি সেলিনাকে নিয়ে আমার ঘরে এলাম।শুনতে পাচ্ছি নীলাঞ্জনা বলছেন, তুমি এমন ব্যবহার করলে কেন মিনতি। আমার কান সজাগ হয়ে আছে ওদের কথা শোনবার জন্য। মিনতি সেন বললেন কি করলাম। ভদ্রলোকের সঙ্গে এত যে দূরত্ব রচনা করলে, বুকে হাত দিয়ে বলত এ দূরত্ব কি তুমি চাইছিলে? মিনতি সেন বললেন আমি কি চাইছিলাম তার থেকেও বড় কথা, আমার কি করা উচিত? কেন? ভুলে যাচ্ছ কেন নীলাঞ্জনা, আমি শুধু মিনতি সেন নই, আমি প্রান্তিক ও রেহানার। মেয়েটা কি যে অভিমানে কোথায় চলে গেল জানিনা, ছেলেটাকেও তবে কি হারাতে বল? বুকের মধ্যে যতই কষ্ট হোক তা আমার পক্ষে সম্ভব নয় নীলাঞ্জনা। তারপর বললেন, আমি তো মেয়ে, মেয়ে মানুষের সব দূর্বলতা দিয়েই তো আমি তৈরি। এ দূরত্ব তাই আমার নিজের সৃষ্টি, এটা না করে আমার উপায়ও ছিল না। তুমি এতে অন্য কিছু মনে করো না। কিন্তু মিনতি, মেয়েদের কাছে কেবল মাত্র মাইতো তার একমাত্র পরিচয় নয়। সে তো কারো স্ত্রী, কারো বোন, কারো প্রেমিকা, তাকে অস্বীকার করবে কি করে? মিনতি সেন বললেন, হয়তো দুঃখ পাবে কিন্তু তবু বলব, সেলিনার মা হয়ে আজ তোমার যে মর্যাদা, তুমি কি তা অন্য কোন ভাবে পেতে পারতে, না পেয়েছে কোনদিন?

    নীলাঞ্জনা ভাবলেন কিছুক্ষণ তারপর বললেন, তোমার কথা হয়তো ঠিক। তবু হোক না তা মিথ্যা, একদিন তো স্বপ্ন দেখেছিলাম, ডুবেছিলাম আকণ্ঠ ভালবাসায়। সেদিনের সেই প্রাপ্তিটুকু কি জীবন থেকে একেবারে মুছে যাবার? হয়তো মুছে যাওয়ার নয়, কিন্তু আজ যেমন তুমি আর সেই অতীতে ফিরে যেতে পারবে না, আমার পক্ষেও সম্ভব নয় নীলাঞ্জনা। এই মাতৃত্বের অহঙ্কার থেকে নিজেকে নির্বাসিত করা। এটাই তোমার শেষ কথা? শেষ কথা বলে কারো জীবনে কিছু নেই। হয়তো নতুন যুগে নতুন কথা আসতে পারে পুরনো হয়ে যেতে পারে আজকের সত্যি, নতুন সত্যের আলোকে আবার যদি নতুন পথের ঠিকানা খুঁজে পাই। আজকের ইতি এখানেই টানা যাক, কি বল। বেশ তুমি যখন চাইছে না, আমি আর তোমায় কি বলব।

    যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি। ব্যারিষ্টার ভট্টাচার্জ সাহেব একদিন এলেন মিনতি সেনের বাড়ী। আমাকে দেখে বললেন হ্যালো ইয়ংম্যান, কেমন আছো? ভাল। আপনি? ফাঁইন, তোমাদের মত ছেলেদের দেখলে আরো ভালো লাগে। তারপর বললেন, আজকের কাগজ দেখেছো? না, বিশেষ কোন সংবাদ আছে? মিনতি সেন বললেন ভট্টাচার্য সাহেব আপনি যখন কথা বলেন, তখন সব কিছু কেমন রহস্যে ঢাকা থাকে। কি সংবাদ আছে আজকের কাগজে যাকে আপনি এত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভট্টাচার্য সাহেব বললেন কি জানি, আপনাদের কাছে কোন সংবাদ বিশেষ আর কোনটা নয়। আমি আইনের লোক। বহু সময় পয়সার বিনিময়ে মিথ্যেকে সত্য বলে চালাতে চাই যুক্তির জাল। বুনে। কিন্তু বিশ্বাস করুন মনে মনে কিন্তু চাই অপরাধী যেন শাস্তি পায়। মিনতি সেন বললেন, তবুও খোলসা হল না। জানতাম তা হবে না। তবু বলছি, আপনাদের ডালিমের কথা মনে আছে? আমি উৎসুক হয়ে তাকালাম ভট্টচার্জ সাহেবের দিকে। মিনতি সেন বললেন, তার কথা মনে থাকবে না? আমাদের জীবনে সে তো অভিশাপ। তার কোন কঠিন শাস্তি হোক আপনারা চান না। কি বলছেন ভট্টাচার্য সাহেব। চাইনে মানে? ওরই জন্য মেয়েটি আমার কোথায় হারিয়ে গেল। কিন্তু কঠিন শাস্তিতে তার হয়েছে। না হয়নি। সেকি কথা, তার ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, এবং তারপরে আরো ১০ বছর পুলিশের শ্যেনদৃষ্টির ভিতরে থাকাকে কি আপনি কম শাস্তি মনে করেন? তবে কি সে ছাড়া পেয়েছে? হ্যাঁ, মিস সেন ও মুক্তি পেয়েছে? বলেন কি? আঁতকে ওঠেন মিনতি সেন। আমি অবাক হয়ে বলি, তাহলে কি হবে ভট্টাচার্য কাকু। ও তো এখন রেহানাকে পাবে কি না জানিনা, কিন্তু সেলিনার উপর যে প্রতিশোধ নিতে চাইবে। মিনতি সেন বললেন আপনি যা হয় একটা কিছু করুন ভট্টাচার্য সাহেব, কণ্ঠে আকুল আৰ্ত্তি। ভট্টাচার্য সাহেব হাসতে হাসতে বলেন, তাইতো বলছিলাম, আপনাদের কাছে কোনটা বিশেষ কোনটা অবিশেষ তাইতো বুঝতে পারিনা। আপনি ঠাট্টা করছেন, কণ্ঠে তার আসন্ন বিপদের উদ্বেগ।

    ভট্টাচার্য সাহেব বললেন, আমার মত নগন্য ব্যারিষ্টার তার আর কি করবে। মুক্তি পেয়ে সেতো এখন সব বাঁধনের উর্দ্ধে। মিনতি সেন বলেন, এখনো আপনি রহস্যময়। সত্য কথাটা বলুনতো কি হয়েছে? মুক্তি পেয়ে সে কি আরো সাংঘাতিক কিছু করেছে? না মিস সেন আসলে বিচাবক তাকে সঠিক শাস্তি দেননি। মানবিক বুদ্ধিতে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিচারকেরও বিচারক যিনি, তিনি তা সইবেন কেন? সেই যে কথায় আছে না, তিনি কাউকে ক্ষমা করেন না করেন নি, ডালিমের ক্ষেত্রেও করেন নি। তাই তার বিচার নেমে এসেছে একান্ত গোপনে চরম আত্মশোচায়। আমি ও মিনতি সেন বললাম বুঝতে পারছি না। আমিও বুঝতে পারিনি প্রান্তিক, তারপর ধীরে ধীরে সেই বহু প্রতীক্ষিত সংবাদকে উন্মোচন করে বলেন, ডালিম আত্মহত্যা করেছে। আমরা বললাম আত্মহত্যা। হ্যাঁ আত্মহত্যা, এবং তার জন্য ও সুইসাইড নোটও লিখে রেখে গেছে। এই একটি কাজ সে সত্যিকারের ভাল কাজ করেছে। আর সেই ভালো কাজের জন্য, সেই সর্বশ্রেষ্ট বিচারকের কাছে তার মুক্তির সুপারিশ করা যেতেই পারে। সুইসাইড নোটে ও লিখে রেখে গেছে, জীবনে জিৎতে চেয়েছিলাম। ছলে বলে কলে কৌশলে যেকোন ভাবে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছি। সবশেষে বাজিতেও হেরে গেছি আমি। বুঝতে পারছি না এই পৃথিবীর আলোবাতাস কোন শয়তানদের জন্য নয়। আমি আমার দোষ মহামান্য আদালতের কাছে স্বীকার করে আবার পৃথিবীর আলো বাতাসে ফিরে আসার ছাড়পত্র চাই। শাস্তির ১০ বছর মেয়াদ শেষে মনে হয় বিচারক বোধ হয় আমাকে প্রতিশোধের সুযোগ দেওয়ার জন্য এই স্বল্প শাস্তি দিয়েছেন। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ভিতরের যে শয়তানটি ক্ষণিকের জন্য মানবিক হয়ে নিজের দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল, সেই আবার সহস্রগুন ভয়ংকর হয়ে প্রতিশোধ নিতে মেতে ওঠে, কিন্তু প্রতিটি বাজিই আমি হেরে যাই। ভয়ংকর হতাশা নেমে আসে জীবনে। বাঁচার ইচ্ছেটুকু যায় নষ্ট হয়ে। নিজেকে বলি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হই। এবার শাস্তির মেয়াদ যাতে বাড়ে তার জন্য যা যা বেআইনি কাজ তাই করতে আরম্ভ করি। সবশেষে তাই ভাবি, না এভাবে হবে না। আমাকে স্থির সংকল্প হতে হবে। অবশেষে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কারারক্ষী ও সাক্ষাৎ প্রার্থীদের বশীভূত করে ঘুমের ওষুধ আনিয়ে নিই বাইরে থেকে। আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী দিন আর পৃথিবীর আলো দেখতে চাইনা আমি। তাই যতগুলো ঘুমের ওষুধ আনিয়েছিলাম সব এক সঙ্গে খেয়ে রোজ কেয়ামতের বিচারের অপেক্ষায় রইলাম। হায় আল্লাহ, তুমি আমার ক্ষমা করো। আমার নিষ্ঠুরতায় যারা জীবনের পথ হারিয়ে ফেলেছে, তাদের নতুন পথের সন্ধান দিও। আমার মৃত্যুর জন্য কেবল মাত্র আমিই দায়ী। আমার জন্য যেন কাউকে কোন হয়রানি হতে না হয় সেই অনুরোধ রেখে গেলাম। হায় খোদা! ডালিম।

    মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলাম ডালিমের লেখা সুইসাইড নোট। হায় হতভাগ্য ডালিম মৃত্যুতেই তোমার সত্যিকারের জয় হল। মিনতি সেন কোন কথা বললেন না। ভট্টাচার্য সাহেব বললেন, আমি জানি ওই হতভাগ্যের জন্য আপনারাও সমব্যথী হয়ে উঠবেন। কি আশ্চর্য তাই না? এরই কিন্তু মৃত্যু কামনা করেছিলাম আমরা সবাই। আর আজ মনে মনে বলছি, দূর্ভাগ্য ওর ভিতরের মানুষটাকে ঠিক সময়ে ঠিক পথে চালিত করতে পারেনি। একথা আপনি নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না, তার নিষ্ঠুরতায় যাদের জীবন ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, অন্তর দিয়ে তাদেব সে ভালবেসে ছিল, তা না হলে সুইসাইড নোটে ও বলতে পারতো না আমার নিষ্ঠুরতায় যারা জীবনের পথ হারিয়ে ফেলেছে তাদের নতুন পথের সন্ধান দিও। জীবনের এই মানবিক দিক তাকে মৃত্যুতেও মহান করে তুলেছে। তাই তার সমাধি সাধারণ কয়েদির মত না হয়ে সাধারণ মানুষের মত হয়েছে। পুলিশের একাজ আমি সমর্থন করি। আর প্রার্থনা করি ঈশ্বরের কাছে জীবনের ভুল পথে চলতে গিয়ে যারা ডালিম হয়ে গেছে। তুমি তাদের ওরই চেতনায় উদ্বোধিত করো। হয়তো সেটাই হবে ন্যায়নিষ্ট বিচারকের সর্বশ্রেষ্ট বিচার।

    একটা থমথমে অবস্থা নেমে এল সমস্ত ঘরটয়। হতবাক মিনতি সেন, বিস্ময়ে অভিভূত আমি। মনে মনে বললাম, ঈশ্বর একি সত্যিই তোমার বিচার? যে মানবিকতার বরমাল্য তুমি তাকে দিলে, কয়েকদিন আগে দিলে না কেন? তা হলে তো এমনি একটা অমূল্য জীবন পৃথিবী থেকে ঝরে পড়তো না। আবার ভাবলাম, কার কাছে আবেদন? নিষ্ঠুর ঈশ্বরের কাছে? ওর নিষ্ঠুরতায় তো হারিয়ে গেছে আমার রেহানা। সে তো কোন অপরাধ করেনি, তবে কোন পাপের শাস্তি দিতে তুমি তাকে পথে নামিয়ে এনেছো? এই যদি তোমার বিচার, তবে কিসের ন্যায় বিচারক তুমি।

    কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা, যেন উঁচ পড়লেও টের পাওয়া যায়। সেই গভীর নিঃশব্দতাকে প্রভাত আলোর পদধ্বনির মতো স্পষ্ট করে ভট্টাচার্য সাহেব বললেন, মিস সেন জবার মাকে অন্তত বলুন এক কাপ কফি। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মিনতি সেন বললেন, সরি ভট্টাচার্য সাহেব, এই আনি। কেন জবার মা? আজকে ওকে ছুটি দেওয়া হয়েছে।

    যাকে মা হিসাবে মেনে নিয়েছি, স্থান দিয়েছি মনের নিভৃত অন্দরে, সন্তান হয়ে তাকে প্রেমিকা রূপে দেখার ঔচিত্য অনৌচিত্যের প্রশ্নে মন দোলা খায় যখন, তখন একদিন প্রতীমবাবুর ওখানে এসে উপস্থিত হই। উনি আমাকে বললেন, অনেক দিন পরে এলে কিন্তু। কেমন আছো? তোমার মা ভালো আছেন তো। বললাম হ্যাঁ, কিন্তু একটা কথা আমি আপনার কাছে জানতে এসেছি। বলুন আমার মাকে আপনি চেনেন একথা আগে বলেননি কেন? বুঝতে পারছি গভীর প্রচেষ্টায় একটা দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাইছেন প্রতীমবাবু। বললেন, তুমিতো কখনো তোমার আসল পরিচয় দাওনি। তাছাড়া আমি ঠিক বুঝতে পারিনি তুমি মিনতি দেবীর ছেলে? বললাম সে কথা থাক। আমি তো বড় হয়েছি। অবাক হয়ে আমি যখন দেখলাম, আমার মাকে দেখে আপনি চমকে উঠেছেন, আমার মাও ভীষা ভীষণ অবাক হয়ে অন্য ঘরে চলে গেলেন। যতক্ষণ ছিলেন স্বাভাবিক হতে পারেন নি। হয়তো আপনিও স্বাভাবিক হতে পারেন নি। এই দোদুল্যমানতায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? বল। সত্যি উত্তর দেবেন? উনি বললেন দেখ তুমি আমার ছেলের মতন। যে সত্য যতটুকু তোমার কাছে প্রকাশ করা যায় তার বেশী জানতে চেওনা। উত্তর দিতে পারবো না। বললাম, এমন তো হতে পারে আপনি যা জানেন, তা সত্য নয়। মানুষের জীবনে প্রেম ভালবাসা স্নেহ মমতা এতো কোন সামাজিক বন্ধনে বাধা যায় না। যায় কি? বুঝতে পারছি না তুমি কি বলতে চাইছে। বললাম, জীবন অভিজ্ঞতা আপনার আমার থেকে অনেক গুন বেশী। যা আপনি বিশ্বাস করেন, মনের মধ্যে যে স্বপ্নকে আপনি এই দীর্ঘ বছব গুলোতে লালন করে এসেছেন, আজ যদি হঠাৎ দেখেন, কোন এক উত্তাল ঝটিকায় তা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। আপনি কি পারবেন, আপনার সেই বিশ্বাসকে সরিয়ে নিতে? উনি বললেন, জানিনা তুমি কি বলতে চাইছে। এইটুকু বুঝতে পারছি, খুব সাধারণ ভাবে তুমি এসব কথা বলছনা। তোমার বক্তব্যের মধ্যে আছে এমন এক অসাধারণত্ব যা শ্রোতাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে। এটা আপনার আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার কথা। উত্তর নয়। তোমার উত্তর তো আমার জানা নেই প্রান্তিক। তা হলে কি বিশ্বাস করতে হবে এত দীর্ঘদিন ধরে যে বিশ্বাসকে আপনি, গভীর মমতায় বাঁচিয়ে রেখে এসেছেন, তাকে মেরে ফেলতেও আপনার কোন দ্বিধা নেই। প্রতীম বাবু বললেন, স্বপ্ন বা বিশ্বাসকে এ ভাবে মারা যায় না প্রান্তিক। তারা বেঁচে থাকে। আমি বললাম তাই বলুন, তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়। কি? যে নিঃসঙ্গ একাকীত্ব আমার মা এখনো বয়ে চলেছেন, আপনি কি পারেন না সেই নিঃসঙ্গতাকে গভীর মমতায় মুছিয়ে দিতে? আমি? কি বলছ প্রান্তিক? কে আমি? কি অধিকার আমার? যদি কোন অধিকার নেই তা হলে অমন চমকে উঠলেন কেন?

    খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে প্রতীম বাবু বললেন, সে তুমি বুঝবেনা। বললাম, আপনি আমাকে যত ছোটই মনে করুন আমি আমার ছোট্ট অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারি, যে নিঃসঙ্গ জীবন আপনি বয়ে চলেছেন, সে আমার মার জন্য, বলুন অস্বীকার করতে পারবেন?প্রতীমবাবুর চল্লিশ উদ্ধা জীবনে এমন তীব্রভাবে ভেতরটাকে বুঝি কেউ আঘাত করেনি। তাই খানিকক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন। পরে বললেন, জানিনা, কেন তুমি এভাবে বলছ। যা ছিল স্মৃতি তাকে স্মৃতিতেই থাকতে দাও প্রান্তিক। জীবনের অনেক সাধ, আকাঙ্খা, স্বপ্নই তো পূরণ হয় না, তার জন্য দুঃখ করলে বাকী জাবীনটাই তো নষ্ট হয়ে যাবে। তারপর বললেন হ্যাঁ, তোমার মায়ের একটা স্মৃতি আজো আমার মনের মণিকোঠায় বেঁচে আছে বলেই। দীর্ঘ ২৪ বছর পরেও তোমার মাকে আমার চিনতে ভুল হয়নি। তোমার মারও হয়তো ভুল হয়নি। না হলে অমন পালিয়ে যেতেন না। কিন্তু প্রান্তিক, এসব কথা থাক, তুমি বরং অন্য কথা বল। বললাম, আমি কিন্তু অন্য কথা বলতে আসিনি। আমি আমার নিঃসঙ্গতা দিয়ে আমার মার নিঃসঙ্গতা বুঝি। হয়তো আপনারটাও কিছু বুঝি। প্রতীমবাবু জীবনের এই গোপনতাকে যেন এড়িয়ে যেতে চাইছেন বুঝতে পারছি। বললেন, আমার ভীষণ ভাবে মনে থাকবে তোমার কথা। অনুরোধ প্রান্তিক এ প্রসঙ্গ বন্ধকর। জীবনের দূর্বল দ্বার খুলে কি লাভ। বরং খুলতে গেলে তা ভেঙে যেতে পারে। বললাম বুঝতে পারছি এক তীব্র অভিমানে আপনি অতীতকে ভুলে যেতে চাইছেন। উনি খানিকক্ষণ আবার চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, যে অতীতকে তুমি এত গুরুত্ব দিচ্ছ, সে রকম কোন অতীত কিন্তু আমার জীবনে নেই। তোমার মায়ের সঙ্গে আমার কোন পূর্ব পরিচিতি ছিল না, যে পরিচিতির সোপান বেয়ে অমূল্য স্মৃতি তৈরি হতে পাবে। ছিলনা কোন আবেগও। কারণ ভাল লাগার কোন মুহূর্ত তৈরি হয়নি ভালবাসাতো দূরের কথা। শুধু একটা গভীর ট্রাজেডির ঘটনা ঘটে গিয়েছিল আর তার জন্য আমার নিজেকে দায়ী মনে হয়েছিল। আর সেই জন্যই দায়ীত্বটুকু গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম। সুতরাং তুমি যে অভিমান জাত স্মৃতির কথা বলছ তা কিন্তু ছিল না। হাসলাম আমি, বললাম, তবু আপনি প্রতীক্ষা করেছেন, প্রতীক্ষা হয়তো আমার মাও করেছেন। অস্বস্তি বোধ করছেন প্রতীম বাবু। বারবার বলছেন থাক তোমার মায়ের কথা, তোমার কথা বল। বললাম, আমার মাকে না চিনলে আমাকে চিনবেন কি করে? কি করে চিনবো তোমার মাকে। আজ তো চেনার সমস্ত রাস্তাগুলোই বন্ধ। আমি একটু জোর দিয়ে বললাম, এ আপনার ভুল। ভুল? হ্যাঁ ভুল।

    তারপর আমার পকেট থেকে আমাকে লেখা দাদুর চিঠিটা তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, আমার দাদুর মৃত্যুশয্যার চিঠি। চিঠি যদিও আমাকে লিখেছেন, কিন্তু এর প্রতিটি লাইন জুড়ে আছেন আমার মা। পড়ুন। উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, বুঝি জানতে চাইছেন পড়ব? বললাম, ওচিঠির সত্ত্বাধিকারী তো আমি। আমি তো বলছি পড়ুন। জানতে পারবেন, আমার মায়ের আসল পরিচয়। কিন্তু। কোন কিন্তু নয়, আপনি পড়ুননা। আমাকে বুঝতে হলে আমার মাকে বুঝতেহলে আমার দাদুর এ চিঠিটা পড়া আপনার একান্ত দরকার। তারপর চিঠিটা আমি টেবিলে পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে উঠে পড়লাম। বললাম, আমি আধ ঘন্টা পরে আসছি। আশা করি আমার মায়ের আসল যন্ত্রণা ও পরিচয় ততক্ষণে পেয়ে যাবেন। কিন্তু তোমার লাঞ্চ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, এখনো সময় হয়নি। এসে লাঞ্চ করব।

    রাস্তা দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে ভাবছি, আমি কি ঠিক করলাম? মিনতি সেনের সত্যিকারের যন্ত্রণা কি আমি জানি? এমনও তো হতে পারে শুধু মাত্র মায়ের মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে চরম অভিমানে বাবার সব কিছুকে অস্বীকার করেছেন। এখনও তো বাবার বলতে যা কিছু তার কিছুতেই হাত দেননা। যদি ক্ষমা করতে পারতেন তাহলে কি এমন হতো? প্রতীম বাবুর জন্য সামান্য দরদ নাও থাকতে পারে। শুধু ভরসা, প্রশ্নের মুখোমুখি হলে অন্তত বলতে পারব, তা হলে কিসের আশায় তুমি আজো প্রতীম বাবুর ঐ ছোট্ট চিঠিটা বয়ে নিয়ে চলেছে?

    আধঘন্টা পরে ফিরে এলাম। ততক্ষণে লাঞ্চ এসেছে। আমাকে চিঠিটা ফেরৎ দিয়ে বললেন, আমাদের অহংকার কত ভঙ্গুর তাইনা প্রান্তিক। আমার মাকে চিনতে পারলেন? পেরেছি। পেরেছেন? আনন্দে আমার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললাম, তা হলে মাকে কি বলব। কিছুই বলতে হবে না প্রান্তিক। যদি প্রেক্ষাপট কিছু বলার অবস্থা তৈরি করে, বলল, তার মাতৃত্বের অহংকারকে আমি শ্রদ্ধা করি। কোন ভাবেই তাকে ছোট করতে পারব না। জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত দুর্বলতাই সব নয় প্রান্তিক। দুর্বলতা তৈরি হয় সকলকে নিয়ে পূর্ণতার জন্য। আমি শুভার্থী হিসাবে থাকবো তোমাদের পাশে, তোমাদের প্রয়োজনে আমাকে পাবে সবসময়। তোমার মাকে বলল, আমার শ্রদ্ধা রইল তার জন্য। একান্ত সমব্যথী হিসাবে সব অতীতকে মুছে দিয়ে যদি তোমাদের পাশে প্রয়োজন হয় আমাকে পারে সব সময়। তবু। না কোন তবু নয়। হয়তো আমি ক্ষুদ্র অতি তুচ্ছ। তবু আর যাতে ছোট না হতে হয়। সে দায়িত্ব তোমার? লাঞ্চ হয়ে গেলে, বললাম এবার আমাকে যেতে হবে। আচ্ছা এস। আর একটা কথা, যে কোন প্রয়োজনে, যতবড় কঠিন প্রয়োজন হোক, তোমার দাবী নিয়ে আমার কাছে এস। দাবী? হ্যাঁ দাবী, ভালবাসার দাবী, স্নেহের দাবী, অধিকারের দাবী। আমি বললাম, তাই হবে। আমি তবু দাঁড়িয়ে আছি, দেখে বললেন কিছু বলবে? না। আমি চলে এলাম, পিছন ফিরে দেখলাম, পাহাড়ের সহিষ্ণুতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন প্রতীমবাবু। তখনো স্থির অপলক। কি যে খারাপ লাগছিল ভাবার নয়।

    না কোন প্রেক্ষাপট তৈরি হয় নি, ভাবাও হয়নি। ওদিকে ধীরে ধীরে অশ্রুকণাকে নিয়ে বাড়ীতে এক সমস্যা তৈরি হয়েছে। সজলবাবুর মত ছেলেকে প্রত্যাখান করার পরও বাবা-মা ওর জন্য আলাদা পাত্রের সন্ধানে আছেন। কিন্তু অশ্রুকণার একই কথা সে তার সিদ্ধান্তে অনড়।

    একদিন ও এসেছে মিনতি সেনের বাড়ীতে। মিনতি সেনকে বলছে আমার একটা উপকার করবেন পিসি? বল। আগে করবেন কি না বলুন, তারপর বলব। আমি সামনে ছিলাম। বললাম, মা না জানলে বলবেন কি করে যে তিনি পারবেন কি না, তার ক্ষমতা আছে কি না? তুমি চুপ কর প্রান্তিক, আমিতো তোমাকে কিছু বলিনি। মিনতি সেন বললেন, তুই এখান থেকে যা প্রান্তিক, দেখি ও কি বলে? ও কি বলে জানতে ইচ্ছে হলেও, আমি চলে এলাম। মিনতি সেন বললেন বল কি বলতে চাইছো? আপনারতো বহুলোকের সঙ্গে জানা শোনা আছে, আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন? যত ছোটই হোক, শুধু বেঁচে থাকার মতো হলেই হবে। কি ব্যাপার অশ্রু, বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছো বুঝি। ও চুপ করে থাকে। আবার বললেন, কি হল, উত্তর দাও। পিসি বাবা-মা এখন আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছেন। আঁতকে উঠে মিনতি সেন বললেন, ছিঃ অশ্রু ওকথা বলতে নেই। তুমি কেন বাবা-মায়ের কষ্ট বোঝনা? ওনারা কি আমার কষ্ট বোঝেন? সন্তানের কষ্ট বাবা-মা বোঝেন না একি হয়? আসলে তোমার কি কষ্ট তাকি বলেছে বাবা মাকে? ওনাদের সে সময় নেই। আসলে ওনারা চান তার মেয়েকে রাজরানী করতে। মিনতি সেন বললেন সব বাবা-মাই তাই চান। কিন্তু আমি তো তা চাই না। তাহলে কি চাও তুমি? একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে বাঁচতে। তুমি সে কথা বলতে পারতে। বললে শুনছে কে? তাদের এক কথা আমরা যা বলব তাই তোমাকে মেনে নিতে হবে। অনেক সহ্য করেছি আর সহ্য করব না। সে না হয় মেনে নেওয়া গেল কিন্তু প্রান্তিকের সম্পর্কে এমন সব কথা বলল, আমার মাথা গরম হয়ে গেল, বললাম, তোমরা তোমাদের স্বপ্ন নিয়ে থাকো, আমাকে তোমাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য পাবেনা কোন দিন। এ কথা বলে বেরিয়ে এসেছি এক বস্ত্রে, বলে এসেছি। এখন থেকে আমাকে ফিরাতে বৃথা চেষ্টা করোনা। তোমাদের অহংকারের কাছে মাথা নত করতে পারবো না। মিনতি সেন শিউরে উঠে বললেন, একি করেছিস অশ্রু, এ পাগলামি কেন করতে গেলি। জানিনা পিসি। কিন্তু আমি আর ফিরে যাবো না। আপনি বললেও না। আচ্ছা ঠিক আছে তাই হবে। আমাকে একটু ভাবতে দে।

    কিছুক্ষণ চুপ চাপ মিনতি সেন ও অশ্রুকণা। খানিক পরে অশ্রুকণা মিনতি সেনের বুকের পরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, আমাকে তাড়িয়ে দেবে নাতো পিসি। আমার যে যাওয়ার কোন জায়গা নেই। মিনতি সেন ওকে কাঁদতে দিলেন। তারপর বললেন, যা চোখে মুখে জল দিয়ে আয়। তারপর খেয়েছিস কখন? কাল রাতে। সেকি! তোর বাবা-মা তোকে খাওয়ার জন্য বলেনি। সে কথা থাক পিসি, ওদের কাছে আমার তো কোন মূল্য নেই, যা কিছু মূল্য তা ওদের দম্ভ, অহঙ্কার আর ঐশ্বর্য্যের জন্য।

    মিনতি সেন আমাকে বললেন, যাতে দোকানে দেখ ভালো ডিনার কিছু পাওয়া যায় কি না। আজকেও জবার মা আসেনি, আমাকেই যেতে হবে বান্না ঘরে। আমি টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। এর মাঝে মিনতি সেন কফি করে নিয়ে খেতে খেতে বললেন। একটা কথা বলবি? বলুন প্রান্তিককে খুব ভালবাসিস তাইনা? জানিনা। বল না। আমি তো প্রান্তিকের মা। জানি। তা হলে আমাকে বলতে লজ্জা কেন? না পিসি, আমি জানিনা, কিছু জানিনা, বলে পালিয়ে গিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।

    আমি ডিনার নিয়ে এসে দেখি মিনতি সেন একাই বসে আছেন। বললেন ওটা রান্না ঘরে রেখে এসে আমার কাছে একবার আয় তো। আমি তার কাছে এসে বসলাম, উনি আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বললেন, আমার একটা কথা রাখবি প্রান্তিক? বল। রেহানা ফিরে আসবে কি না কে জানে? তার ভালবাসার স্মৃতি বয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিবি? এর দ্বারা কি সত্যিকারের শ্রদ্ধা করা হবে তাকে? আমি অবাক হয়ে বললাম এ তুমি কি বলছ মা? কি করে আমি রেহানাকে ভুলে যাবো। আমি তাকে ভুলে যেতে বলিনি, কিন্তু কবে সে ফিরবে তার জন্য সারাটা জীবন অপেক্ষা করবি? আদৌ ফিরবে কি না তারও তো ঠিক নেই। আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললাম তোমার কাছ থেকে এসব কথা আশা করিনি মা। একদিন আমি ও রেহানা তোমার মাঝে খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম মাতৃত্বের পূর্ণ আস্বাদ। আজ এমন কি হল যে একজনকে তুমি সরিয়ে দিতে চাইছে। নারে পাগল ছেলে সরিয়ে দিতে চাইবো কেন? কোন মা পারে যে সন্তান হারিয়ে গেছে তাকে ভুলে থাকতে? তুমিতো তাই চাইছে। আমি যে মা। মায়ের শূন্যতা তুই কি করে বুঝবি। আমার বোঝার দরকার নেই। বুঝতে পারছি একদিন তুমি আমাকেও ভুলে যেতে চাইবে।

    কখন যেন পাশে এসে দাঁড়ায় অশ্রুকণা। চোখ ফোলা ফোলা, বোঝা যায়, এতক্ষণ কাদছিল। মিনতি সেন উঠে পড়ে বললেন, তোরা আয় আমি ডিনারটা টেবিলে সাজিয়ে দিচ্ছি।

    টেবিলে একটা কথাও বলেনি অশ্রুকণা আমার সাথে। আমি কিছু বলতে গেলে তাও উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেছে।

    রাত হয়, আমাকে এখন যেতে হবে? আবার কবে আসবি। তুমিতো এক মেয়ের অভাবে আর এক মেয়েকে পেয়েছে, আবার আমার অভাবেও নিশ্চয়ই কাউকে খুঁজে পাবে, আমাকে হয়তো আর কোন দিন দরকার হবে না। প্রচণ্ড অভিমানে কথাগুলো বলে হন হন করে বেরিয়ে এলাম। মিনতি সেন পিছন থেকে বারাবার ডেকে বললেন, শোন প্রান্তিক, শুনে যা আমার কথা।

    অশ্রুকণা বলল, আমিও যাই তা হলে, ও যখন চায় না যে আমি এখানে থাকি, বলে ও বেরিয়ে আসতে চাইলে মিনতি সেন বললেন তোরা সবাই এভাবে পাগলামি করলে আমি সামলাই কি করে বলতো।

    বেশ কিছুদিন যাইনি মিনতি সেনের বাড়ী। হয়তো অশ্রুকণা এখনো ও বাড়ীতেই আছে। এর মাঝে একদিন এসেছিলেন প্রমথবাবু। অশ্রুকণার খোঁজে। আমি যেটুকু শুনেছি তার ভিত্তিতে বললাম, আপনার মেয়ে কোথায় গেছেন সেকি আমার জানার কথা? এইটুকু বলতে পারি আমাদের এখানে আসেনি। নীলাঞ্জনা পিসি বললেন, এভাবে কথা বলছ কেন প্রান্তিক। ও বাড়ী থেকে না বলে বেরিয়ে গেছে। ও তো তোমার বন্ধু, জানতে ইচ্ছে করে, ও কোথায় গেছে? না করে না। তারপরে বললাম আমি কারোর কেউ নই পিসি। আমি শুধু আমারই। আমি নাকি ওনার মেয়েকে বদ মতলব দিয়েছি, ভুল পথে চালিত করেছি, কি ভাবেন ওনারা? ঐশ্বর্যের দাম্ভিকতায় যা মনে হয় বলা যায়? অবাক হয়ে শোনেন আমার কথা, নীলাঞ্জনা পিসি ও সেলিনা। প্রমথবাবুর বোধ হয় কিছু বলার ছিল না। এরপরে আর কিছু জানতে চাওয়াও সম্ভব নয়। মাথা নীচু করে যখন চলে যাচ্ছেন, নীলাঞ্জনা পিসি বললেন, শুনুন। উনি দাঁড়িয়ে গেলে পিসি বলতে থাকেন, অশ্রুকণা আমার মেয়ের মত, অনেকবার এসেছে আমাদের এখানে। খুব খারাপ লাগছে শুনে যে ও বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসে আর ফিরে যায়নি। প্রান্তিক ছেলেমানুষ, ওরতো বাবা-মায়ের যন্ত্রনার কথা বোঝা সম্ভব নয়। তাই হয়তো মুখে যা এসেছে বলে ফেলেছে। ওর ব্যবহারের জন্য ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। উনি বললেন না না, সে কি কথা। ও হয়তো আমাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়েছে তার জন্য আমিই দুঃখ প্রকাশ করছি। পিসি বললেন, সে যাই হোক, অশ্রুকণা আমাদের এখানে আসেনি। আমরাও দেখছি ও কোথায় গেছে, কেন গেছে? আর সংবাদ পেলেই জানাব আপনাদের। ধন্যবাদ জানিয়ে উনি বেরিয়ে গেলেন।

    পিসি দীর্ঘ সময় কিছু না বলে রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে জানতে চাইলেন তুমি কি জানো প্রান্তিক ও কোথায় গেছে? ওর সঙ্গে কি তোমার ঝগড়া হয়েছে? বললাম কেন ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হবে? তা হলে ওর বাবাকে তুমি ও ভাষায় কথা বললে কেন? তুমি তো এরকম ব্যবহার করতে না কখনো। কাল গিয়ে ওর বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে আসবে। একটা কথা মনে রেখো ধীরে ধীরে যে উচ্চতায় পৌঁছেছে এক ঝটকায় তা থেকে মাথা মুড়ে পড়ে যেওনা। আমি চুপ করে রইলাম, কিছুই ভাল লাগছেনা। নাইট বাল্ব জ্বালিয়ে শুয়ে আছি, ঘুম আসছেনা। শুধু এ পাশ ও পাশ করছি। হঠাৎ উজ্জ্বল আলোতে ঘর ভরে গেল। ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে এল সেলিনা। আমি অবাক হয়ে বললাম তুমি? হ্যাঁ আমি, মা পাঠালে। তোমাকে পাঠিয়েছেন পিসি? কৈন? বলছি। বল। তুমি কি শুয়ে শুয়ে শুনবে প্রান্তিক ভাই। এতে যদি অসুবিধা হয় বসতে পারি। না দরকার নেই তুমি শুয়ে শুয়ে শোন। বল? অদি কোথায় গেছে তুমি জান না? আমি কি করে জানব? আমি কি করে জানব নয়, জান কিনা তাই বল। হ্যাঁ বা না? আমি রেগে গিয়ে বললাম, আমি কি আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে বলতে হবে হ্যাঁ বা না। হ্যাঁ দিচ্ছ। মায়ের আদালতে তুমি সাক্ষ দিচ্ছ আর আমি উকিল হয়ে তোমাকে জেরা করছি। বল অশ্ৰুদি কোথায় গেছে তুমি জান কি না? না জানিনা। মিথ্যে কথা। কি মিথ্যে কথা? তুমি জান যে সে কোথায় গেছে। জানলেও বলতে হবে? এবার হেসে ফেলল সেলিনা, বলল এবার পথে এসেছ প্রান্তিক ভাই। তবে জানলেই যে বলতে হবে এমন কোন দিব্যি নেই, আমার জানার দরকার ছিল তুমি জান কিনা। বললাম জানতাম না, তবে ঘটনা চক্রে জেনে ফেলেছি। মানে? হঠাৎ দেখি উনি মিনতি সেনের ওখানে উপস্থিত। আমার সঙ্গে কথা হয় নি, মিনতি সেনকে ও কি বলেছে আমি জানিনা। কিন্তু মিনতি সেন আমায় জিজ্ঞেসা করে জানতে চেয়েছেন, অশ্রুকণাকে আমি ভালবাসি কীন রেহানার শূন্য জায়গায় তাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় কীনা ইত্যাদি। রাগে আমার সমস্ত শরীর জ্বলতে থাকে তাই চলে এসেছি। এর বেশী আমার কিছু জানা নেই। আমি বলতেও পিরবোৰা কেন সে গেছে ওখানে? এখনো আছে কি না? কিছুই জানিনা। সেলিনা বলল, এই সহজ সত্যটা তুমি বললে না কেন? জানিনা বলে কেন গোপন করলে? আমি জানিনা। তুমি না জানলেও আমি জানি প্রান্তিক ভাই। আমি জানিনা আর তুমি জান? হ্যাঁ জানি। তাহলে বলতোকেন? অদি তোমায় ভালবাসে, রেহানার থেকেও হয়তো বেশী ভালবাসে। তুমি বাস কিনা সেটা বড় কথা নয় তবে অশ্ৰুদি বাসে। আর তাইতো সে অস্বীকার করতে পারে তার বাবার যে কোন প্রচেষ্টাকে। তুমি যে তা জানো। তা নয়। হয়তো আমার থেকে বেশী জান। কিন্তু প্রান্তিক ভাই, এ ভাবে পালিয়ে গেলে চলবে কেন? শুধু রেহানার ব্যথা বেদনা বুঝবে। অদির কষ্টটা বুঝবেনা? শুধু রেহানাই থাকবে তোমার স্মৃতিকে আচ্ছন্ন করে, আর অশ্ৰুদির জন্য সাজিয়ে রাখবে দুঃখের পশরা? এ হতে পারে না প্রান্তিক ভাই। তারপর বলল তুমি কেন বোঝ না, কি গভীর ভাবে ভালবাসলে এমনি করে সব কিছুকে উপেক্ষা করে সে পথে নামতে পারে। না প্রান্তিক ভাই, এতটা নিষ্ঠুর তুমি হয়ো না। তোমার মধ্যকার এই নিষ্ঠুর মানুষটাকে আমি দেখতে চাইনা প্রান্তিক ভাই। অদিকে বুঝতে চেষ্টা করো। রেহানার জায়গায় তাকে বসাতে পারবে কিনা সেটা অন্য কথা। তাই বলে তার ব্যাথার জায়গাটা তার অসহায়তাকে কেন গুরুত্ব দেবেনা। এটাই কি তুমি চাও? আর যদি সত্যি সত্যি তাই চাও, তাহলে আমাদের কথাও শুনে রাখ, আমরা কিন্তু তা চাই না।

    আমার যেন কিছুই বলার নেই। এরা নিজেরা যেমন রেহানাকে ভুলে যেতে চাইছে তেমনি আমার জীবন থেকেও মুছে দিতে চাইছে তার সমস্ত স্মৃতিটুকু। তোমরা তোমাদের নিজেদের মত করে কথা বলছ, আমাকে বুঝতে চাইছে না, দুঃখ এখানেই সেলিনা। কেন তোমারা বুঝতে পারছো না আমার জীবনে অন্য কোন মেয়ের জায়গা নেই। হয়তো বুঝি প্রান্তিক ভাই। কিন্তু তুমিতো শুধু একা রেহানার নও, তুমি তো আমাদেরও। রেহানা তোমার জীবনের যতটাই অধিকার করে থাকুক না কেন, আমাদের সম্মিলিত অধিকারকে দাঁড়িপালায় ওজন করলে কি, রেহানার একার ওজনের থেকে ভারি হবে না? এও এক অবুঝ অভিমান সেলিনা। সত্যি বলছি আমি তোমাদের বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছনা, না বুঝতে চাইছো না? তোমার যা ভাললাগে তাই তুমি মানে করতে পারো। আমি শুধু বিশ্বাস করি ও কথা দিয়েছে ও আসবে আমার কাছে। আমাকে সেই অপেক্ষাটুকু করতে দাও সেলিনা। এইটেই তোমার শেষ কথা? হা এটাই আমার শেষ কথা। সেলিনা বলল তুমি কেন বুঝছো না প্রান্তিক ভাই, রেহানা যদি সত্যিই আসত তা হলে ডালিমের মৃত্যুর পরেই আসতে পারতো। ও তো তোমাকে ডালিমের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিল। সমস্ত ঝুঁকি নিয়েও সে চেয়েছিল, ডালিম যেন তার নিষ্ঠুর আক্রমণে তোমাকে ক্ষতবিক্ষত না করে। আমি বললাম, এমনও তো হতে পারে ডালিমের মৃত্যু সংবাদ সে জানেই না। সেলিনা ধীরে ধীরে বলল এ তোমার বিশ্বাসের কথা। বাস্তব নয়? বাস্তব নয়? না। তবে কোনটা বাস্তব? সেলিনা বলল বাস্তব সব সময় সুন্দর হয় না প্রান্তিক ভাই। ডালিমের সুইসাইড নোট পড়েছো? হ্যাঁ পাড়ছি। কিছুই কি বুঝতে পারনি? না বোঝার কী আছে। হয়তো আমার মতো করে আমি বুঝেছি? সেলিনা হেসে বলল তোমার মত করে বোঝা হলেই তো তা বাস্তব হয় না? বাস্তব থাকে আরো গভীরে। ডালিম নিষ্ঠুর, ডালিম হিংস্র শুধু নয়, সে শয়তান, কিন্তু তার মানবিক গুন শুলো যে একেবারে শেষ হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ তো তার সুইসাইড নোট। তারপর বলল ভুল ক্ষণিকের, উত্তেজনার আগুন তাকে দাউ দাউ করে জ্বালায় মাত্র, কিন্তু সেই ভুলে কেউ যদি মমতার পরশ বুলিয়ে দিতে, সত্যি কারের ভালবাসা নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াতো হয়তো ডালিম এতবড় ভুল করতো না। লুণ্ঠনে তৃপ্তি নেই, তাকে যদি একথাটা কেউ প্রথমেই পরম মমতায় বুঝিয়ে দিতো, তাহলে হয়তো ওর পথ অন্য রকম হতো। একটু থেমে বলল তোমাকে বললাম না প্রান্তিক ভাই, ডালিমের সুইসাইড নোট প্রমাণ করে প্রতিশোধের স্পৃহায় তাকে পাগল করেছিল, তাই সে একের পর এক প্রতিশোধ গুলো নিতে চেয়েছে, যদি সার্থকতা আসত, তাহলে হয়তো আরো নতুন নতুন নেশায় মেতে উঠতো, হারিয়ে যেতে যা কিছু পুরোনো। কিন্তু ব্যর্থতা তাকে একটা জায়গায় আটকে রেখেছিল। আর এই হতাশার মধ্যেই মৃত্যুর স্বপ্ন দেখলো সে।

    সেলিনা বলল, কি ভাবছে প্রান্তিক ভাই। না কিছু না। কিছুনা যদি তাহলে এমন চুপ করে আছো কেন? কি বলব বল। কিছু তো একটা বলতে হবে? তুমিই বল আমি কি করব, আমার কি করা উচিৎ? আমি বলব? অবাক করলে প্রান্তিক ভাই। তোমার ভাগ্যকে পরিচালিত করবে তুচ্ছ সেলিনা? এ তুমি ভাবলে কি করে? আমি একটু জোরের সঙ্গে বললাম কেন পারবে না। নিজের মনের আগুনকে ছাই চাপা দিয়ে রেহানার জায়গায় তুমি কেন অশ্রুকণাকে এগিয়ে দিতে চাইছো? তারপর বললাম দেখ সেলিনা আমিও মানুষ। রক্তমাংসেরই মানুষ। ব্যথা বেদনা কামনা বাসনা মান অভিমান রাগ অনুরাগ সবই আমার আছে। আমিও চাই, কেউ আমার পাশে থেকে আমাকে উৎসাহ দিক, আমাকে পথ দেখাক, ভুল করলে ভুল ভেঙে দিক। যে শুধু মাত্র দূরের নক্ষত্র হয়ে থাকবে না। সে আমার বাগানে ফুল হয়ে ফুটবে। কখনো বা তাকে সাজাবো আমার আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে যে বুঝবে আমার হৃদয়কে, সে আমার ভালবাসাকে দেবে মৰ্য্যাদা, কর্ম ক্লান্ত প্রান্তিকের পাশে এসে বসবে সে, প্রয়োজনে তার আঁচলের হাওয়ায় মুছিয়ে দেবে ক্লান্তি, সে আমার ঘুমহীন চোখে গুন গুন সুরে সূচনা করবে ঘুমের আগমন আবার ভোরের সূর্য ওঠার আগে সেইই জানাবে আমায় নতুন দিনের বার্তা। আবেগে কাঁপতে থাকে আমার কণ্ঠ তাতে আরো আবেগ ঢেলে আমি জানতে চাই পারবেনা সেলিনা, আমার হৃদয় ক্ষতকে তোমার মরমী স্পর্শে শুকিয়ে দিতে পারবে না, শ্রান্ত আর ক্লান্ত প্রান্তিককে তোমার গানের সুরে ঘুম পাড়াতে পারবেনা আমার জীবনের সমস্ত আগুনকে নিভিয়ে দিয়ে, কেবল তোমার ভালবাসার প্রদীপ জ্বালাতে? গভীর আবেগে ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে বললাম, একদিন রেহানাও চেয়েছিল, তোমার ভালবাসার মধ্যে আশ্রয় খুঁজে নিতে। আজ আমি সত্যি ক্লান্ত, সত্যি একটু খানি আশ্রয়ের যে আমার ভীষণ প্রয়োজন। আরো বললাম চার দিক থেকে যে ঝঞ্জা আসছে, হয়তো সে ঝঞ্জায় কোনদিন হারিয়ে যাব, তার আগে দেবে আমায় একটু আশ্রয়? তোমার ভালবাসায়, তোমার মমতায় তোমার কল্যাণ কামনায়, জন্ম হোক নতুন প্রান্তিকের, যে শুধু তোমার আর কারো নয়। রেহানা ছবি হয়ে জায়গা নিক দেওয়ালে। অশ্রুকণা খুঁজে নিক নতুন ঠিকানা। আমি শুধু তোমার মধ্যেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে ধন্য হতে চাই। বল সেলিনা বল, পারবেনা আমার বোঝা বইতে। গভীর আগ্রহ নিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাই ওর দিকে, তারপর এক সময় সজোরে ওকে বুকের পরে টেনে নিই এক নিমেষে।

    না কোন বাধা দিল না সেলিনা, শুধু চোখের জলে আমার বুকের জামা ভাসিয়ে দিল। আমি ওকে বুক থেকে তুলে নিয়ে বললাম, ছিঃ সেলিনা তুমি কাঁদছো? ও বলল আমাকে ছাড়, মা জেগে আছেন, আমি ওকে ছেড়ে দিলাম। ও ধীরে ধীরে পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসল, নিশ্চল নিঃশব্দ এক প্রতিমুৰ্ত্তি যেন।

    নিজের কাছে নিজেরই খুব অস্বস্তি হচ্ছে। আমি এত দুর্বল তাতো আগে জানা ছিল। কি করে ভুলে গেলাম রেহানার উজাড় করা ভালবাসাকে। কি করে ভুলে গেলাম আফরোজ বেগমের সেই শেষ কথা গুলো, তোমার জীবনে রেহানার যে স্থান সে স্থানে, সেলিনাকে জায়গা দিতে বলছিনা বাবা। অথচ আমি? তাহলে কোথায় আমি আলাদা ডালিম থেকে? ও ওতো ভালবেসে ছিল রেহানাকে, কিন্তু চেয়েছিল সেলিনা তার হোক। আমিও তো তাই, সে লুণ্ঠনে যা পেতে চেয়েছিল আমি আত্ম নিবেদনের মাধ্যমে তাই পেতে চেয়েছি। মাধ্যম যাই হোক উদ্দেশ্য তো এক। সেলিনা কিছু না বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো বললাম চললে? হ্যাঁ। কিছু বলবেনা? আজ কিছু বলার নেই প্রান্তিক ভাই, তুমি এই মুহূর্তে ভীষণ ভীষণ দুর্বল। তুমি এখন ঘুমাও। আমি মাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। বললাম, আমি তো তা চাইনি, আমি চেয়েছি তোমাকে, জানি। তাহলে? তা হয় মা প্রান্তিক ভাই। এই মধ্য রাতের মুহূর্তের আবেগ প্রভাতের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যাবে দূর সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে। তখন তুমি না পারবে আমার চোখে চোখ মেলে তাকাতে, না পারবো আমি তোমার সামনে দাঁড়াতে। তার থেকে নিঃশব্দ আধারের ভেতর দিয়ে যে সত্যের আলোকে আমি তোমাকে দেখলাম, তোমার যে রূপ আমার মনে তার চিরস্থায়ী আসন গেড়েছে, বিলীন হয়ে যাক তা এই অন্ধকারের বেলাভূমে। এটাও স্মৃতি হয়ে যাক প্রান্তিক ভাই। এর বেশি কিছু আমি চাইনা। সেলিনা। এগিয়ে এসে আবারও ওর একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিলাম। ও এবারও কোন বাধা দিল না শুধু বলল বল। তুমি কি আমায় বুঝতে চাইছো না? ও বলল আমার থেকে তোমাকে কেউ বেশী বোঝেনা প্রান্তিক ভাই। কিন্তু আমার জীবন নিয়ে যা কিছু করার বা বলার অধিকারতো শুধু তোমার আর মায়ের। তোমরা যা বলবে, অবাধ্য না হলে, আমি তাই করতে বাধ্য? বল কি করতে হবে? আমি চমকে উঠে দূরে সরে গিয়ে বললাম, তুমি এতদূর থেকে কথা বলছ কেন সেলিনা। মনে হয় সহস্র যোজন দূর থেকে তোমার কণ্ঠ ভেসে আসছে। ও বলল, এ তোমার ভুল ধারণা প্রান্তিক ভাই। আমিতো তোমার পাশেই আছি। তুমি শুধু চিনতে ভুল করছ? তাই হয়তো হবে। নিজের অহঙ্কারে আমি প্রতি মুহূর্তে ভেবেছি, আমি যেমন নিজেকে বুঝতে পারি এমন বুঝি কেউ পারে না। সেলিনা এবারও চুপ করে রইল। আমি বললম, তুমি কি কোন কথাই বলবেনা? ও বলল বল কি জানতে চাইছো? একদিন যে জোর বা অধিকার এবং দাবী ছিল তোমার আজ কি তা নেই। না নেই। কেন? সেদিনের যেকোন জোরের পিছনে আমি জানতাম, আমার কোন দুর্বলতাই তোমাকে স্পর্শ করবেনা, আমার আত্ম নিবেদন এবং ভালবাসা দিয়েও আমি তোমার নাগাল পাব না। তাই অবলীলায় বলতে পারতাম, বলুনতো এই পোষাকে কেমন লাগছে আমাকে। অথবা নিজে ফুল তুলে এনে আপনার হাতে দিয়ে বলতে পারতাম, দিনতো আমার বেনীতে গুঁজে, অথবা ফুলের বাগানে আপনাকে দেখে বলতে পারতাম সব থেকে সুন্দর ফুলে আমাকে সাজাতে ইচ্ছে করে না? আমার চোখের তীব্র আহ্বানকেও আপনি সেদিন অবহেলায় ফিরিয়ে দিতে পারতেন, তাই সেদিন যা সম্ভব ছিল আজ আর তা নেই। আজ আমি জানি, আমার সেদিনের ছেলেখেলা তোমার মনে আরেক ভাবে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। আজ তুমি এক অন্য মানুষ দুর্বলতাই যার একমাত্র সত্য। না প্রান্তিক ভাই এ ভাবে তুমি আমাকে চেওনা, তাতে তুমি নিজে না পাবে মৰ্য্যাদা না পারবে আমাকে মৰ্য্যাদা দিতে তার চেয়ে অন্য কোন আশ্রয় খুঁজে নাও প্রান্তিক ভাই। আর আমাকে ফিরিয়ে দাও আমার অতীত।

    দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম, হয়তো তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু কেন এত দূর্বল হয়ে যাচ্ছি বলত সেলিনা? কেন মনে হচ্ছে আমার পাশে কেউ নেই, কেন এই মুহূর্তে বেশী করে মনে হচ্ছে আমাকে যদি সব থেকে কেউ বেশী আঘাত দিয়ে থাকে তবে সে রেহানা। কেন মনে হচ্ছে সে আর কোন দিনই আসবেনা আমার জীবনে। সেলিনা আস্তে আস্তে বলল, যে কারণটা তোমাকে আঘাত দিতে পারে আমি জানি। জান? হ্যাঁ জানি। বল না কারণটা কি? বললে হয়তো আমার অহংকারের কথা হয়ে যাবে তবু প্রান্তিক ভাই, যে কথা একটু আগে বলেছি, আমার থেকে বেশী করে তোমাকে কেউ বোঝেনা। তুমি কতটা বিশ্বাস করবে জানিনা, তবু একথা সত্যি যে আমি তোমাকে পেতে চেয়েছি আমার চঞ্চলতায় আমার চটুলতায় আমার চপলতায়, আবার কখনো বা আমার বক্সিং এর রিং এ। আবার একান্ত ভাললাগার অনুভূতির ভেতর দিয়েও তোমাকে যেমন করে কাছে পেতে চেয়েছি এক তপতীদি ছাড়া তেমন করে কেউ তোমাকে কাছে পেতে চায় নি এবং বুঝবারও চেষ্টা করেনি। তাই বলছি, যে দেবত্বের আবরণে নিজেকে তুমি আচ্ছাদিত করতে চেয়েছো, ওরা চেয়েছে সেই দেবতার পায়ে শ্রদ্ধা জানাতে, ভালবাসাকে তারা অর্ঘ্য হিসাবে অঞ্জলি দিতে চেয়েছে। চেয়েছে তোমার দেবত্বই বড় হোক মনুষ্যত্ব নয়। আমি চেয়েছি প্রতি মুহূর্তে তোমার মানবিক রূপ। কামনা বাসনাময় জীবন্ত মানুষ। ওরা চেয়েছে মনুষত্ব থেকে দেবত্বে তোমার উত্তরণ ঘটুক। কিন্তু আমি চাইনি। আমি সব সময় চেয়েছি তোমার মধ্যেকার সেই রক্তমাংসের মানুষটাকে যার দুঃখ আছে, বেদনা আছে, আছে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার। তাই তোমার আজকের এই আচরণে কোন লজ্জা নেই। তুমি মানুষ এটাই তোমার আসল পরিচয়। তাই চেয়েছিলাম, রেহানা থাক তার ভক্তির অঞ্জলি নিয়ে, সে তোমার এই মনুষ্যত্ব রূপে দেখে হয়তো আঘাত পাবে, মনে হবে তার দেবতার এ পরিণতি অসহ্য। তোমার ভিতরের দুর্বলতাকে যে সে বোঝেনা তা নয়, তবু অবুঝমন, যে ভাবে স্বপ্ন দেখে, সে ভাবেই দেখতে চায় বাস্তবকে। রেহানার কাছে তুমি দেবতা হয়েই থাক, কিন্তু অশ্ৰুদির জন্য তোমার, মানবিকতাই জয়ী হোক, তুমি ওকে ফিরিয়ে দিওনা, মা বা পিসি অন্তত তাইই চায়।

    আমি বললাম আর তুমি? আমার কথা থাক প্রান্তিক ভাই। রেহানার জায়গায় তুমি। আমাকে স্থান দিতে চেওনা, তাতে শুধু আমাকে অপমান করা হবে না, অপমান করবে তুমি আমার মা আফরোজ বেগমকে। আর সব থেকে অপমান করবে রেহানাকে। এ ভাবনা থেকে তুমি সরে এস প্রান্তিক ভাই। আমি বললাম তোমাকে আমি বুঝিনি কোন দিন, আজো বুঝতে পারলামনা। কিন্তু একটা কথা আমাকে দেবে সেলিনা? বল। যতদিন না রেহানা ফিরে আসে ততদিন তুমি থাকবে আমার পাশে। যদি তোমাদের দাবী মেটাতে অশ্রুকণাকেও জায়গা দিতে হয়, তবুও তুমি থাকবে আমার পাশে, বল থাকবে? কথা দাও সেলিনা।

    শুনতে পাচ্ছি, অস্পষ্ট উচ্চারণে সেলিনা বলছে, হায় ঈশ্বর একি পরীক্ষা তুমি আমাকে দিয়ে করতে চাইছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, এ কঠিন পরীক্ষায় তুমি আমায় ফেলতে চাইছো কেন? যে দুর্বলতায় তুমি আজ ভাস্বর আমাকে পাশে রেখে, তুমি কি তা থেকে মুক্তি পাবে? না পাব না জানি আর সত্যি কথা বলতে কি মুক্তি তো আমি পেতে চাই না। অবাক হয়ে সেলিনা বলল, তা হলে? আমি চাই জ্বলতে। জ্বলতে জ্বলতে ভিতরটা আমার ছাই হয়ে যাক, আর আমার সেই জ্বালা তোমাকে জ্বালায় কি না তাই শুধু দেখতে চাই। তারপর বললাম, নিজেকে তুমিও অনেক বড় মনে কর সেলিনা। ভাব জ্বলতে যদি হয়ই, তবে তুমি একাই জ্বলবে। আমি তাই দেখতে চাই জ্বলার ক্ষমতা তোমার কতটা। তুমি যদি ভেবে থাক বক্সিংএর রিং এ আমাকে তুমি হারিয়ে দেব, হয়তো তা তুমি পারবে সেলিনা, কিন্তু জীবনের রিং এ তোমাকে আমি কিছুতেই জয়ী হতে দেবনা। দেখতে চাই। তোমার দৌড় কতটা। আমার কথা শুনে সেলিনা একেবারে নির্বাক হয়ে গেল। বলে কি প্রান্তিক? তবু, সেলিনা, রেহানা, অশ্রুকণা বা তপতী নয়, সে সেলিনা, তাই সে বলে, বেশ তাই হবে। তাতেই যদি তোমার ভিতরে আগুন নেভে, আমি রাজী। কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে প্রান্তিক ভাই, কি? আমার বুকে যত আগুনই জ্বলুক, কোন অবস্থাতেই তুমি তা নেভাতে চেষ্টা করবেনা, যদি তা কর, সেদিন থেকে কিন্তু আর আমাকে পাবেনা তোমার পাশে, সেদিন জানবে রেহানার মতো সেলিনাও হারিয়ে গেছে।

    কি কঠোর এবং কঠিন শাস্তি! দেখতে পাচ্ছি বেরিয়ে যাচ্ছে সেলিনা, ভেজানো দরজা খুলে বাইরে পা দেবে, আমি আবার ডাকলাম সেলিনা! ও ঘুরে তাকালো আমার দিকে! বলল, বল! রাত কি সত্যি শেষ হয়ে গেছে? হ্যাঁ, ভোরের আযান ভেসে আসছে মজিদ থেকে। বললাম, একটু বোস। কেন? বোসনা। ও আমার সামনে এসে বসল। আমি পূর্ব দিকের জানালা খুলে দিলাম। ভোরের নরম বাতাস আবছা আঁধারে ধুসর হয়ে আছড়িয়ে পড়লো ঘরেব মধ্যে। আমি ওকে বসিয়ে রেখে বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল দিলাম, তারপর রাতের পোষাক বদলে এসে বললাম, যাবে আমার সাথে? কোথায়? একবার ভোরের রাজপথে তোমাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে চাই? ও চমকে উঠে বলল, স্বপ্ন! না বাস্তর! বললাম দেখতে পাবে ল, ও বলল, দাঁড়াও প্রান্তিক ভাই, মাকে বলে আসি। পিসিতো ঘুমাচ্ছেন। জানিনা, তবু ঘুম থেকে উঠে যদি না দেখতে পান, চিন্তা করতে পারেন। আচ্ছা।

    সেলিনা গিয়ে দেখ নীলাঞ্জনা তখনো না ঘুমিয়ে বসে আছেন। বলল তুমি ঘুমাওনি? ঘুম আসেনি। তুমি আমাকে ডেকে পাঠাওনি কেন? ইচ্ছে করেই। না ঘুমিয়ে তোমার যদি শরীর খারাপ করে? করলই বা, তোরাতত আছিস! সেলিনা যেন কি বলতে চেয়েও বলতে পারল না। ও ওর নিজের ঘরে ঢুকে গেল। তারপর সারারাতের বাসি পোক ছেড়ে অন্য পোষাকে নীলাঞ্জনার সামনে এসে দাঁড়ালো। কোথাও যাবি? প্রান্তিক ভাই ভোরে বেড়াতে নিয়ে যাবে বলছে, তুমিও চল না মা। নারে তোরা যা। অফিস আছে, কাজ আছে। সেলিনা বলল, তা হলে আসি। নীলাঞ্জনা বললেন, হ্যারে সেলিনা, এত কঠিন শাস্তি মাথা পেতে নিচ্ছিস কেন? লজ্জায় মুখে ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল মুখে দিয়ে চুপ কর রইল সেলিনা। কি উত্তর দেবে। প্রতি রাতে একটি কথাই তাকে বলে নীলাঞ্জনা, তুই আবার হারিয়ে যাবিনা তো আমার জীবন থেকে? কোথায় যাব মা। তোমাদের ছেড়ে আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তা হলে তুই আমার স্বপ্নকে এভাবে ব্যর্থ করে দিচ্ছিস কেন? তা হয়না মা। কেন হয় না। তুই কি ভাবছিস আমি তোর মনের কথা জানি না? আমার মনের কথা সব নয় মা। আরেক জনকে তো আমাকে গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে। আর তাছাড়া, রেহানার শূন্যস্থানে? না মা তা হয় না।

    কিন্তু এখন কি বলবে, প্রান্তিকতো এগিয়ে এসেছে। এখন যদি নীলাঞ্জনাও আরো দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসেন কি উত্তর দেব? কিরে চুপ করে আছিস কেন? তারপর বললেন, তোরা বোধহয় আমার কথা ভাবসিনে, তাই না। মা এ তুমি কি বলছ? দেখ তোদের সব কথা আমি শুনেছি, হ্যাঁ শ্রুতিকণার কথা আমিও বলেছিলাম। তার কারণ, আমার বিশ্বাস ছিল রেহানাকে বাদ দিয়ে ও কোন দিনও অন্য কারো কথা ভাবতে পারবেনা। কিন্তু ও আমার মনের কথা নয়। কত ছোট কালে ওকে আদর করতাম। তারপর তো এলো একদিন আমার কাছে। যৌবনের দ্বার প্রান্তে এসে থাক সেদিনের সে সব কথা। দেখতে দেখতে আমার জীবনটাও কেমন যেন মরুভূমি হয়ে গেল একদিন, এর মাঝে তুই এলি মরুতৃষ্ণাকে কানায় কানায় ভরে দিয়ে। আমার জীবনে অতীত শুধু অতীত। আজ তোকেই নিয়ে আমার বাস্তব, তোকেই নিয়ে আমার স্বপ্ন। তোকে যে আমি কোন ভাবেই চোখের আড়াল করতে পারবো না মা। কেন আমাকে চোখের আড়াল করবে? তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। তাই কি হয় পাগলি মেয়ে। তারপর বললেন, এক যদি প্রান্তিকের কথায় রাজি হতিস তা হলে না হয় কথা ছিল, কিন্তু তার দেওয়া শাস্তিই শুধু মাথা পেতে নিলি, তাকে নিলি না। মা হয়ে আমার এসব ভাল লাগে? সেলিনা তখনো স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে আছে কি বলবে সে। নিজের জীবনের শূন্যতা? মায়ের স্বপ্ন! প্রান্তিকের আকষর্ণ সবইতো তাকে টানে তবু সে পারছে না কেন? যে হয়তো কোনদিনই আসবেনা, তারই জন্য জীবনের সব সাধ আহ্লাদকে বিসর্জন দিতে হবে? কিন্তু কেন?

    প্রান্তিক এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে, বলল, চলনা পিসি তুমিও। নীলাঞ্জনা বললেন, নারে প্রান্তিক, তোমরাই যাও। আমার কাজ আছে। সেলিনাকে বললাম, আকাশ লাল হয়ে গেছে, আযানের সুর শেষ, এখনি হয়তো কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠবে মন্দিরে মন্দিরে, তাড়াতাড়ি চল। সেলিনা বলল চল। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।

    এতদিন প্রমথ বাবু জানতে পারেনি, অশ্রুকণা মিনতি সেনের বাড়ীতে আছে। অনুতপাই সংবাদটি দিয়েছিল। এসেছিলেন একদিন স্নেহময়ী দেবী ও প্রমথবাবু। মিনতি সেন, তাদের আপ্যায়ন করে ঘরে নিয়ে এলেন। এ কয় দিনে চেহারা অনেকটা ভেঙে গেছে ওঁদের। মিনতি সেনের কাছে কাতর আবেদন জানালেন, আমাদের একমাত্র মেয়ে, ওকে আমাদের সঙ্গে ফিরে যেতে বলুন।

    ওরা এসেছেন জেনেও অশ্রুকণা আসেনি ওঁদের কাছে। মিনতি সেন বললেন, কেন পাগলামি করছিস অশ্রু, বাব-মায়ের কষ্টটা একটু বোঝবার চেষ্টা কর। ফিরে যা ওদের সঙ্গে, ওর সেই এক কথা, না পিসি, আপনার যদি অসুবিধা হয় আমিই চলে যাব, তবু যে বাড়ী ছেড়ে এসেছি, আর সেখানে ফিরে যাব না। আপনি ওদের চলে যেতে বলুন। কথাগুলো মোটই আস্তে বলেনি অশ্রুকণা। সবই শুনতে পেয়েছেন ওর বাবা ও মা। ব্যর্থ হয়ে যখন মিনতি সেন ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রমথবাবু বললেন, না আপনাকে কিছু বলতে হবে না মিনতি দেবী। যা শোনার আমরা শুনে নিয়েছি। বাবা মা হওয়া যে কি কষ্টের আপনাকে বোঝাতে পারবো না, তবু আপনার কাছে আমার একমাত্র অনুরোধ, ওকে আপনি দেখবেন। উঠে পড়েন প্রমথবাবু এবং স্নেহময়ী দেবী। স্নেহময়ী দেবী শুধু একবার বললেন, একবার শুধু চোখের দেখা দেখব কোন কথা বলব না, কিছু জানতেও চাইবো না। চোখ ফেটে জল আসতে চাইলেও কাঁদব না, শুধু একবার আমাদের সামনে এসে দাঁড়াক ও, তারপর চলে যাব, আর কোনদিন আসব না বিরক্ত করতে।

    না মিনতি সেনকে এ অনুরোধ করতে হয় নি। অশ্রুকণা নিজেই এসে দাঁড়িয়েছে ওদের সামনে। তারপর বলেছে, দেখাতে হয়েছে, আর কোন দিন আসবে না আমার কাছে, আমার খোঁজও নেবে না। তোমাদের কোন কিছুর পরে আমার কোন লোভ নেই। ইচ্ছে করলে তোমাদের অতুল ঐশ্বৰ্য যাকে খুশী দিয়ে যেতে পারো। কথাগুলো বলে, যেমন এসেছিল তেমনি ঢুকে গেল ভিতরে, যেন একটা দমকা বাতাস এল এবং মিলিয়ে গেল।

    জীবন নাট্যের যবনিকাপাত যে কিভাবে হয় কেউ তা জানে না। আসলে আমরা যে খেলার পুতুল মাত্র সে কথাই ভুলে যাই। আমাদের নিজেদের পরে অধিকার যে কত ভঙ্গুর তা যদি জানতাম, অনেক অহংবোধ থেকে মুক্ত হতে পারতাম। মিনতি সেন বললেন, এ তুই কি করলি অশ্রু, এভাবে কেউ বাবা-মাকে আঘাত দেয়? অশ্রুকণা উত্তরে বলে, আঘাত যে ওদের পেতেই হবে পিসি। কেন? বিনা কারণে কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইলে, সেই কাঠগড়ায় আগে নিজেদের দাঁড়াতেই হয় এটা তাদের জানা দরকার। কেন তুই বিনা কারণে এ সব কথা বলছিস? তোর কি কোন দোষ নেই? আমি তো আমার দোষকে অস্বীকার করছি না পিসি। আমাকে যে কোন কথা বলার, আমাকে বিনা কারণে শাস্তি দেওয়ারও হয়তো ওদের অধিকার আছে, কিন্তু তাই বলে যার কোন দোষ নেই, যে কেবল তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে যথাসাধ্য করেছে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কোন ভাবেই মেনে নিতে পারব না পিসি। বুঝতে পারছি তোর মনের অবস্থা। কিন্তু তোকেও ভো বুঝতে হবে ওদের মন, ওরা কি চান? ওদের কোথায় ব্যথা। ওদের ব্যথাকে, আপনি যতটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন, আমার ব্যথাকে কি সেই ভাবে ভাবছেন? কেমন করে বুঝলি যে তোর কথা আমি ভাবছি না। যদি ভাবতেন তাহলে একটা কিছু করতেন এতদিন। কি করতাম বল! অশ্রুকণা বলল আমিতো প্রথম দিনই বলেছিলাম পিসি, যত ছোট হোক আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিন। হাসলেন মিনতি সেন, বললেন, একটি চাকরি পেলে তোর সব কষ্ট যন্ত্রণা মিটে যাবে? যা তুই চাস সব পেয়ে যাবি? পারবি ভুলে যেতে প্রান্তিককে? এভাবে বলছেন কেন পিসি। প্রান্তিককে ভোলা না ভোলা সে তো সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার। আমি ভুলে গেলাম কি গেলাম না তাতে তো কারো কিছু যায় আসে না।

    তাই বুঝি বেরিয়ে এসেছিস ঘর থেকে? তারপরে বললেন, সত্যি করে বলতো, পারবি হাসিমুখে প্রান্তিককে অন্য কারো হাতে তুলে দিতে? এসব কথা থাক পিসি। কেন থাকবে কেন? তোর চাওয়ার ওপর তোর কোন অধিকার নেই? অধিকারতো এভাবে পাওয়া যায় না। আমাকে তো বুঝতে হবে যে অধিকারের বড়াই আমি করছি, তার ওজন আছে কি না। মানে? আপনিও যদি মানে না বোঝেন তাহলে আমার কিছু বলার নেই পিসি। তোরা সবাই বড্ড হেয়ালী কথা বলিস। আসলে তোরা সোজাসুজি কথা বলতে পারিস না তার কারণ, তোরা জানিসই না তোরা কি চাস? অশ্রুকণা বলল, আমি চাইলে পাব? পাওয়ার মত চাইলে, না পাওয়ার তো কোন কারণ নেই। মনে থাকবে পিসি। দেখব সত্যিকারের মনের জোর আমার আছে কি না?

    অশ্রুকশার মনের জোর ছিল কি না জানি না, কিন্তু একদিন সে সত্যি সত্যি বলল, আমার ভিতরের সত্যটা তুমি কবে দেখতে পাবে প্রান্তিক? আমি চমকে উঠেও বললাম, আমার ভিতরের সত্য যেদিন আমি দিনের আলোর মত পরিস্কার দেখতে পাব। তার মানে? আসলে কি জান কণা, এত মানুষের সংস্পর্শে এসে তোমাদের এত ভালবাসা পেয়ে আমি নিজেই বুঝতে পারি না, সত্যি করে আমার ভিতরে কোন ভালবাসা আছে কি না। এ তোমার হেয়ালী, আসল কথাটা বল। আসল কথা তুমি জান না? কি? তারপরে অবশ্য বলল রেহানা ফিরে আসবে তোমার কাছে এই তো? ধর প্রান্তিক সে কোনদিন এলনা, এমন এক মুহূর্তে তুমি যদি নিজেকে বুঝতে পার, পিরবো কি সেদিন তোমাকে কিছু দিতে? দিতেই হবে, এমনকি কোন কথা আছে।

    অভিমানে ঠোঁট ফোলায় অশ্রুকণা বলে, আমি যে সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছি তোমার জন্য প্রান্তিক! এ তুমি ভুল করেছে কণা। যদি ভুলও করে থাকি, আমার যে ফেরার কোন পথ নেই। নীরবে একটা হাত তুলে নিয়ে বলে, বিশ্বাস কর, আজ যদি রেহানা থাকতো, আমি তোমার জীবন থেকে সরে যেতাম, কোন ভাবেই তোমাকে আমি বিব্রত করতাম না। আমি জানি, রেহানার জন্য তোমার কষ্টটা কত। আর সব চেয়ে বড় কষ্ট, এই ভাবে তার চলে যাওয়া। সামনে গঙ্গা বয়ে চলেছে, চটি খুলে পা দুটো জোয়ারের জলে ভিজিয়ে দিয়ে বললাম জানিনা, আজ রেহানার জন্য কোন কষ্ট হয় কি না। রেহানা যদি আমাকে বলে যেতো, অথবা রেহানা যদি বলতো, আমি যা বলেছি সব ভুল, তোমার জন্য রেহানার কোন দরদ নেই, হয়তো প্রথম প্রথম কষ্ট হতো কিন্তু তারপর এক সময় ঠিক হয়ে যেতো। মনকে সান্ত্বনা দিতম, রেহানা অন্তত দ্বিচারিতা করেনি।

    রেহানা যদি অন্য কাউকে ভালবেসে চলে যেতো মনকে বোঝাতে পারতাম, নিজের জীবনের সুখ কিনে নেওয়ার অধিকার তার আছে, কিন্তু একি সে করল, আজ কতদিন হয়ে গেল না এলো সে, না এলো তার কোন সংবাদ।

    অশ্রুকণা চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। একদিন তো তার হাতে তোমাকে তুলে দিয়ে আমি সরে গিয়েছিলাম। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ কণা! কৃতজ্ঞ মানে? মানে কিছু নেই, কিন্তু সে কথা থাক। তোমাকে একটা কথা বলব কণা? বল। জীবনের মানে তুমি এই ভাবে খুঁজতে চেয়েছে কেন? কেমন ভাবে! এই যে ভাবে, নিজের জীবনকে তুমি তিল তিল করে ক্ষয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছ, ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছ, কি পাবে এর দ্বারা? যদি বুঝতাম কি পাব যদি লাভ লোকসানের হিসাব কষতাম, তাহলে হয়তো উত্তর দিতে পারতাম। আমিতো লাভলোকসানের হিসাব নিয়ে তোমার কাছে আসতে চাইনি, আমি শুধু চেয়েছি, তোমার শূন্যতাকে বুঝতে! যে ভাবে বুঝতে চাইছে সে ভাবে কি পারবে বুঝতে? জানিনা পাব কিনা, তবু তোমাকে বুঝতে চাইবো, রেহানার না ফেরা পর্যন্ত। তারপর বলল, তোমাকে কথা দিচ্ছি প্রান্তিক, রেহানা যদি ফিরে আসে, বা তার খোঁজ পাই, তার হাতেই তোমাকে সঁপে দিয়ে আমি ফিরে যাবো। কোথায়? তাতো জানিনা, তবে তোমায় বিড়ম্বনায় ফেলব না, এ প্রতিশ্রুতি তোমায় আমি দিচ্ছি। জীবনকে কি তুমি খেলার পুতুল মনে কর কণা? জীবনতো খেলারই পুতুল। না এ তোমার ভুল, ইচ্ছে হলেই খেলার পুতুল ভেঙে দেওয়া যায়, কিন্তু ইচ্ছে হলেই কি জীবনকে ভেঙে দেওয়া যায়? যায় না। তাই তোমাকে বার বার বলছি, এই ভাবে জীবনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেল না কণা।

    গভীর অভিমামে হৃদয়টা ওর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে, আর তারই ফলে বুকের ওঠানামাটা সাগরের তরঙ্গমালার মত এই ভাসছে এই ডুবছে। হয়তো আমি হারিয়ে যাব ঐ তরঙ্গ মালায়। ভয় হচ্ছে এখনি বুঝি ডুবে যাব আমি। বললাম, দেখ সূর্য ডুবে গেছে, এখনি গভীর আঁধার নেমে আসবে এই গঙ্গার বুকে, সেই অন্ধকারে হয়তো পথ খুঁজে পাবো না, চল ওঠা যাক। ও বলল, হারিয়ে যেতে তোমার খুব ভয় তাই না? তোমার ভয় নেই? না। কেন ভয় থাকবে, আমিতো হারাতে চাই। একবার শুধু একবারের জন্য আমাকে হারাতে সাহায্য করে। কণা। বল। এ ভাবে আমায় দুর্বল করে দিওনা! আমাকে সাহস দাও, বাঁচতে দাও নিঃশ্বাস নিয়ে।

    আমাকে ছেড়ে দিয়ে হেসে উঠল ও, না। তোমার মনের জঙ্গলে এমন কোন গহন অন্ধকার নেই, যেখানে হারিয়ে গেলে আর পথ খুঁজে পাবনা, তার থেকে চল ওঠা যাক। চল। আমরা উঠে এলাম গঙ্গার ঘাট থেকে।

    হাঁটতে লাগলাম গড়ের মাঠের ভেতর দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় ভিক্টোরিয়ার সামনে এসে যখন থামলাম, সামনে এসে দাঁড়ালো এক ফুলওয়ালী। ফুল নেবেন না বাবু? অশ্রুকণা তাকালে আমার দিকে, তারপর ফুলওয়ালীকে বলল, কি হবে ফুল দিয়ে? আমি ওকে বাধা দিয়ে ফুলওয়ালীকে বললাম, মালা নেই, যুঁই ফুলের মালা! না বাবু শেষ হয়ে গেছে। তাহলে কি আছে? ভালো গোলাপ আছে নেবেন বাবু? অশ্রুকণা বলল, তুমি চল প্রান্তিক, রাত হয়ে যাচ্ছে। বললাম দাঁড়াওনা। ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে বললাম, তোমার গোলাপ কত করে? বলল, এক টাকা ডজন। বেশ এক ডজন দাও। আমি গোলাপ নিয়ে ফিরে এলাম অশ্রুকণার কাছে। বললাম, আমার কাছে এসোতো। কেন? কেন আবার কি, যেখানে যা শোভা পায় তাকেতো সেখানে রাখতে হবে। ও বাধা দিয়ে বলল, না প্রান্তিক, এ ভাবে সাজতে আমার ভাল লাগেনা। ভাল লাগেনা? না, একদম ভালো লাগেনা। আমারও ভাল লাগেনা, বলে, সমস্ত ফুলগুলো কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ছড়িয়ে দিলাম রাস্তার চারিদিকে। আমার ঐ কাণ্ড দেখে ও অবাক হয়ে বলল, এ তুমি কি করলে প্রান্তিক! যা করা উচিত তাই করেছি, তারপর একটা চলতি ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে উঠে পড়লাম, সোজা মিনতি সেনের বাড়ী। পথে একটিও কথা বলিনি ওর সাথে। ও-ও বলেনি। মিনতি সেনকে বললাম, মা, তোমার মেয়েকে দিয়ে গেলাম। অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছিল অনেক কষ্টে খুঁজে এনে তোমার কাছে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেলাম। দেখ, আবার যেন পথ হারিয়ে না ফেলে, বলে আর কোন অপেক্ষায় না থেকে বেরিয়ে পড়লাম। মিনতি সেন ডাকলেন প্রান্তিক শোন! বল? অনেক দিন আসিস না, একটু বোস না, কতদিন তোকে দেখিনা! আজ না মা, ভীষণ তাড়া আছে, কাল আসব।

    পরের দিন অশ্রুকণা বলল, আপনার ছেলে আসবে, আমি থাকলে ওর অস্বস্তি হবে, আমি বরং ঘুরে আসি। কোথায় যাবি? দেখি অনুতপা বাড়ী আছে কি না যদি না থাকে, তাহলে ন্যাশানাল লাইব্রেরী থেতে ঘুরে আসব। অনেকদিন লাইব্রেরীতে যাওয়া হয় না। মিনতি সেন বললেন তুই চাস না, ও আসুক আমার কাছে? পিসি! কণ্ঠে ওর অনুতাপের ছোঁয়া। আমি কি তাই বলেছি? না তা বলিসনি, কিন্তু বলতো অশ্রু, সেই কবে কি এক তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে চলে গেল, আর এলো না, এর মাঝে কি ভাবে তোর সাথে দেখা হয়েছে, আর কোথায় হারিয়ে গিয়ে ছিলি কিছুই জানিনা। কতদিন পরে এলোও যেমন বেরিয়েও গেল তেমনি ঝড়ের মত। যদি বা বলল আজ আসবে, তুই পালাতে চাইছিস। তার মানে আর কোনদিন হয়তো আসবে না। তুই কি চাস ও যেন না আসে?

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅগ্নিপরীক্ষা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }