Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প813 Mins Read0

    ১৭. তারপর আর কোন কথা না বলে

    তারপর আর কোন কথা না বলে, তাড়া লাগালো, কাকু এবার বসে যান, আমি ব্রেকফাষ্ট পরিবেশন করছি। তুমি করবে? কেন বেয়ারা তো করতে পারে? তা পারে কিন্তু ওকে আজ ছুটি দিয়ে দিন। তা হলে দুপুরে খাবে কি? কেন আমি রান্না করব, আজ আপনি ও আপনার সহকর্মীরাই হোন না আমার ও আমাদের অতিথি। প্রতীমবাবু মৃদু হেসে বললেন তাই হোক মা। তারপর নিজের গলার মূল্যবান সোনার চেনটি খুলে তার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, আজ তো আর কিছু নেই মা। সেলিনা কেঁদে ফেলল, প্রতীমবাবু বললেন ভয় নেই মা। যত ঝড়ঝঞ্জা আসুক জীবনে, আমি থাকবো তোমাদের পাশে, আর সেই সময় আমি নীচু হয়ে ওনাকে প্রণাম করলাম।

    সারাটা দিন কেটেছে এক গভীর আনন্দে। জীবনে কোন স্মৃতিতো মুছে ফেলার নয়। সন্ধ্যার আগে ফিরছি এক সঙ্গে। হিন্দু বধুর কি ভাবে চলা উচিত, কি তাদের করা উচিত এই সব নিয়ে জ্ঞান দিতে দিতে এলেন প্রতীমবাবু।

    রাতের ডিনারের পরে সেলিনা চলে গেছে ঘরে। প্রতীমবাবু বললেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি প্রান্তিক, যদি কিছু মনে না করো। বলুন? যা তোমরা করেছে আমি নিজেও চেয়েছিলাম তোমাদের জীবনে এটা ঘটুক, কিন্তু এ তোমাদের হঠাৎ খেয়াল নয়তো। একথা বলছেন যে। উনি বললেন না এমনিই জিজ্ঞাসা করছি। তবু যদি কিছু মনে না কর তাহলে বলবে কি কেন এ কাজ তোমাদের করতে হল হঠাৎ? আমি বললাম আপনি কি আমাদের জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছেন? না প্রান্তিক, আমি তোমাদের একজন শুভাকাঙ্খী। তবু তোমরা যা করলে, তার জন্য আমি তো আমার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না। কেন? প্রতীমবাবু বললেন, আমি তোমাদের এখানে আসতে বলেছিলাম। অবশ্য তার জন্য একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। সে যাই হোক। এখানে আসার পরে তোমরা যা করলে তার জন্য কারো কারো কাছে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন তো আমায় হতেই হবে। কেন তোমরা সকলকে এড়িয়ে এ কাজ করলে। যদি অসুবিধা না থাকে বলা যাবে কি? বললাম, আপনাকে বলতে চেয়েছি বারবার, কিন্তু সেই মুহূর্তটুকু তৈরি করা যায় নি। এবার মনে হয় বলা যেতে পারে। বলে যা যা ঘঠেছিল সব বললাম ওনাকে। উনি অবাক হয়ে শুনলেন। তারপর বললেন, কিন্তু তোমার মা যখন শুনবেন হয়তো আঘাতও পেতে পারেন, কি বলবে তাকে? শুধু মা নয়, আঘাত তো পেতে পারেন আমার পিসিও, তাইতো এ দায়িত্ব আমরা আপনাকে গ্রহণ করতে বলছি। আমাকে বলছ? হা কাকু, আপনাকেই বলছি, কারণ আমি জানি, যে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আপনার উপর আমার মা ও পিসির আছে, তাতে এক মাত্র আপনিই পারেন সবকিছুকে ঠিকঠাক মত পরিচালিত করতে। একটা কথা শুধু আপনাকে বলতে পারি, আবেগ ও রোমান্টিক স্বপ্ন ও কল্পনা আমাদের যেখানেই ভাসিয়ে নিয়ে যাকনা কেন, আমি ও সেলিনা আপনাকে কথা দিচ্ছি, তারা গ্রহণ না করা পর্যন্ত পরিশীলিত সংযম আমাদের রক্ষা করবে। উনি বললেন জানি। এ বিশ্বাস তোমাদের উপর আছে। কিন্তু যদি এমন হয় যে তোমাদের কোন ভাবেই এই অবস্থায় গ্রহণ করতে পারলেন না কেউই। কি হবে?

    খেয়াল করিনি কখন এসে দাঁড়িয়েছে সেলিনা পিছনে। প্রতীমবাবু ও খেয়াল করেন নি। সেলিনা বলল এমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হলে, জানি আপনি দুঃখ পাবেন, তবু আপনাকে কথা দিচ্ছি কাকু, আমি সরে যাবো। আমি আমার সত্যকে নিয়ে একা একা পথ চলবো। কিন্তু আজ আর জীবন থেকে এসব মুছে ফেলার উপায় নেই কাকু। জানি মা, জীবনে এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটে সারা জীবন দিয়ে তার দেনা শোধ করতে হয়। সেলিনা বলল তাই করব, তবু আজ আর প্রান্তিকের জীবন থেকে সরে যেতে বলবেন না, পিরবো না, বলে প্রতীমবাবুর পায়ের উপরে উপুড় হয়ে বসে পড়ল সেলিনা। আর তিনি তার মাথায় নীরবে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, সব বুঝি মা। কিন্তু আমিতো প্রান্তিকের কেউ নই। হয়তো ঠিক অথবা ঠিক নয়। কিন্তু যা ঘটেছে তাতে আমরা ইচ্ছে করে ঘটাইনি, আর যে ভাবেই হোক ঘটে যা গেছে তা অস্বীকার করব কি করে। তারপর বলল, সবার প্রতি গভীর বিশ্বাস নিয়ে প্রান্তিকের সঙ্গে নিশ্চয়ই ফিরব কাল, কিন্তু যদি সত্যিই আশ্রয়হীন হই, আপনি দেবেন না আমাদের আশ্রয়। বলুন কাকু দেবেন না?

    দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রতীমবাবু বললেন, আশ্রয়হীনতো হওনি। যদি হও, আমার দরজা তোমাদের জন্য চিরদিন ভোলা থাকবে মা। শুধু একটা কথা দাও, জীবনে যদি সেই দুঃসময় আসে কখনো, আমাকে না জানিয়ে কোথাও যাবেনা তোমরা। আমি ও সেলিনা প্রায় একসঙ্গে উচ্চারণ করলাম, তাই হবে কাকু।

    একটা দুঃস্বপ্ন নিয়ে কাটে রাত। কতবারই চেষ্টা করেছি স্বাভাবিক হতে, পারিনি, বলতে গেলে সারারাত চোখের জল ফেলেছি। সেলিনা কোনদিন ভাবেনি, তার ভিতর আছে এমনি একটি নরম মন, তার অন্তরেও বাস করে এমন এক ভীরু নারী, যে নিজে পথ চেনে না। আমার হাত ধরেই সে পথ চিনতে চায়।

    এক সময় শেষ হয় রাত। ও আমার বুকের উপর থেকে উঠে গিয়ে স্নান করে। তারপর অশ্রুকশার দামী শাড়ীতে সাজায় নিজেকে। তাড়া লাগায় আমাকেও স্নান করবার জন্য। আমি স্নান করে এলে, মোসলেউদ্দীন সাহেবের দেওয়া ধুতি ও পাঞ্জাবী তুলে দেয় আমার হাতে, বলে পরে এস। তাই করে এলে, সিঁদুরের কোঁটোটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলে, জানিনা প্রান্তিক জীবনে আর কোনদিন তোমাকে এমন করে পাব কিনা। তাই তোমার। দেওয়া সিঁদুরে আরেক বার রাঙিয়ে দাও আমার সিথ। নীরবে তাই করলাম প্রতিবাদ না, করে। তারপর আমাকে ও আবারও প্রণাম করে বলল, মা যদি গ্রহণ না করেন, কথা দাও প্রান্তিক, আমাকে গ্রহন করবার জন্য মাকে তুমি অনুরোধ করবে না। বললাম সেলিনা। এই শেষ বারের মতো তোমার অবাধ্য হচ্ছি প্রান্তিক, তোমাকে কথা দিতেই হবে। আমার জন্য তুমি কারো কাছে কোন অনুরোধ জানাবে না। দুঃখে বুক ভেঙে যাচ্ছে, তবু বললাম, তাই হবে সেলিনা।

    ফেরার পথে কত কথাই মনে হয়েছে। কত স্মৃতি ভেসে আসছে। কত মান-অভিমান, রাগ অনুরাগের খেয়া পেরিয়ে এই যেখানে এসেছি সেই কি তবে শেষ ঠিকানা? সন্দেহের দোলায় দোলে মন। আবেগে কঠ আসে রুদ্ধ হয়ে। আজ পর্যন্ত কেউ তো আমায় অস্বীকার করেনি। কেউতো বলেনি, না, সেলিনা তোমার জীবনে আসতে পারেনা। আমার পিসিতে চেয়েছিলেন এই যেন হয়। মিনতি সেন সন্দেহের দোলায় দুললেও কখনো এটা ঘটতে দেবেন না এটাতো মনে হয়নি। অশ্রুকণাতত সেলিনাকে গ্রহণ করার জন্য বারবার বলেছে, তপতীতে তার হৃদয় দিয়ে বুঝেছে সেলিনার গভীর প্রেমের অনুভূতি। কে জানে রেহানা হয়তো এমনি কিছু অনুমান করে গভীর অভিমানে সরে গেছে কি না।

    যখন হাওড়ায় এসে নেমেছি, সেলিনা বলল, বাড়ীতে এখনি ফিরবে? কেন? মিনতি পিসিকে একটা ফোন করলে হয় না? বুঝতে পারছি নারীর স্বাভাবিক দুর্বলতায় তার ভীরু মন বার বার কেঁপে উঠছে। যাদের ভালবাসা জীবনকে এই খানে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে, যারা কখনো বাঁধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়নি, কেমন করে এ ঔদ্ধত্য তাদের কাছে প্রকাশ করা যাবে। বললাম, ফোন করে কি বলব? ও বলল, ফোনটা ধরে আমাকে দাও। যা বলার আমি বলব। তুমি? হ্যাঁ আমি। কারণ, যা কিছু ঘটেছে তার সব দায়িত্ব আমার। বেশ, বলে স্টেশন থেকে মিনতি সেনকে ধরলাম হ্যালো? মিনতি সেন ইজ স্পিকিং। মা আমি প্রান্তিক বলছি। কোথা থেকে? হাওড়া থেকে। তাহলে বাড়ী না এসে ফোন করছিস। যে, কখন পৌঁছালি? সেলিনা তোমার সঙ্গে কথা বলবে না। দে হ্যালো? কে সেলিনা? হ্যাঁ, মা, বল আমায় তুমি ক্ষমা করতে পারবেতো মা। সে কি কথা সেলিনা। কি অন্যায় করেছিস যে ক্ষমা করার প্রশ্ন আসছে? আমার অন্যায়ের কোন সীমা নেই মা! বারে মেয়ে, কি যে করলি তাইতো বুঝতে পারছি না, অথচ ক্ষমা চেয়ে চলেছিস। অন্যায়, সে ছোট বা বড় যেমনই হোকনা কেন, তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারবে কি না তাই বল। যদি না পারি। তা হলে এমুখ আর তোমাদের দেখাবো না। এখান থেকে দুচোখ যে দিকে যায় চলে যাব। মিনতি সেন বললেন তুই যখন বলতে পারবিনা, তা হলে প্রান্তিককে দে, ওর কাছে জিজ্ঞাসা করি কি অন্যায় করেছিস। তার মানে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই তাই না মা। বেশ দিচ্ছি প্রান্তিককে, ধর, আর আমিও চলে যাচ্ছি। ব্যথায় কেঁদে ওঠে মিনতি সেনের বুক বললেন, সেলিনা। কোথায় সেলিনা? তার আগে ও আমার হাতে ফোন দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে। মিনতি সেন বললেন, কি এমন তোরা করেছিস যে আমার ক্ষমা না পেলে ওকে চলে যেতে হবে। আমি ধীরে ধীরে বললাম, মা, একদিনতো রেহানাকে তুমি হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিলে। আজ কি পারবেনা সেই জায়গায় সেলিনাকে জায়গা দিতে। মিনতি সেন বললেন, প্রান্তিক, আমি গর্ভে ধারণ না করেও তোদের মা। তোর মা, রেহানার, আর আজ থেকে সেলিনারও মা। মা কি পারে অনুতপ্ত সন্তানের অন্যায়কে ক্ষমা না করে? তোরা অনেক কথা বলেছিস। কিন্তু কি অন্যায় করেছিস সেটা শুধু বলিসনি। ঠিক আছে, আমি আসছি, তোরা অপেক্ষা কর ওয়েটিং রুমে। আমি আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো। ছেড়ে দিলেন ফোন মিনতি সেন।

    সেলিনা বলল, আমিতো তোমায় বলেছিলাম আমার জন্য তুমি কাউকে কিছু বলবেনা। কোন অনুরোধ করবে না। তুমি কথা দিয়েছিলে, কিন্তু রাখলে না সে কথা। ব্যথায় যেন ভারি হয়ে ওঠে বুক। বললাম হ্যাঁ কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু তোমার জন্য তো কিছু বলিনি সেলিনা তাছাড়া অবুঝ হয়ো না। মিনতি সেন তো জানে না কিছুই। কেন তার প্রতি এই ভুল ধারণা করছ। সেলিনা বলল না প্রান্তিক আমি চলে যাবো। আমি একটু রেগে গিয়ে বললাম তুমি কি ইচ্ছে করলে যেতে পার নাকি। না পারিনা তোমার অমতে আজ আমি কিছুই পারিনা। কিন্তু আমি জানি, তুমি আমায় বাধা দেবে না। কি ভাবে জানলে আমি বাধা দেবো না। এতদিন তো বাধা দাওনি। এতদিন আর আজকের মধ্যে কি কোন পার্থক্য নেই? জানিনা। যদি না জান তাহলে মিনতি সেনের কাছে ক্ষমা চাইতে গেলে কেন? দেখ সেলিনা, তোমার হাতের নোয়া তোমাব সিঁথির সিঁদুর, তোমার কপালের ওই রক্তিম টিপ সব কিছু জ্বল জ্বল করে জানিয়ে দিচ্ছে, আজ স্বেচ্ছায় তুমি কিছু করতে পার না। আজ তুমি আমার স্ত্রী সেলিনা। সাক্ষী মনোয়ারা বেগম, মোসলেউদ্দীন সাহেব, আকবর, আর সব থেকে বড় সাক্ষী প্রতীমবাবু নিজে। এই সব কিছুকে অস্বীকার করে পারবে তুমি চলে যেতে আমাকে ছেড়ে? না পিরবো না, কোন ভাবেই পিরবো না। আমাকে তুমি পথ বলে দাও আমি কি করব। বললাম, তুমিতো পথ হারাওনি, যদি সত্যি কোন দিন পথ হারিয়ে ফেল, আমি থাকব তোমাকে পথ দেখানোর জন্য। সত্যি প্রান্তিক! হ্যাঁ সেলিনা, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকব তোমার পাশে। আবেগকে গাঢ় করে সেলিনা বলল, বিশ্বাস কর প্রান্তিক, তোমাকে ছেড়ে যেতে হবে এই চিন্তা আমায় পাগল করে দিচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে বলত। আমি সবে বলতে আরম্ভ করেছি যুগ যুগ ধরে বহমান সংসার আর ঠিক সেই মুহূর্তে সামনে এসে দাঁড়ালেন মিনতি সেন। আমার কাঁধ থেকে ওর মাথাটা তুলে দিয়ে বললাম, দেখ সেলিনা, তোমাকে নিতে মা এসেছেন। সেলিনা উঠে গিয়ে মিনতি সেনকে প্রণাম করতেই, তাকে দু হাতে তুলে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ওরে পাগলি মেয়ে, কোন অভিমানে পালিয়ে যেতে চাইছিস? আমার ক্ষমা পাবিনা বলে? ওরে পাগলী তোদের সব কথা অশ্রুকণা জানিয়েছে আমাকে।

    ঢাকুরিয়ার বাড়ীতে আমরা যখন পোঁছালাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলে। জবার মা বলল কি সুন্দর মানিয়েছে বৌদিমনি তোমাকে? সেলিনা লজ্জা পেল এবং জবার মায়ের উত্তরে শুধু হাসল। মিনতি সেন নীলাঞ্জনার অফিসে ফোন করে বললেন নীলাঞ্জনা তুমি অফিস ফেরৎ আমাদের এখানে অবশ্য এস। নীলাঞ্জনা বলল, এত তাড়া কিসের? ছেলে এসেছে নাকি? মিনতি সেন বললেন শুধু ছেলে নয় ছেলের রৌও এসেছে। আসতে ভুল করোনা কিন্তু। অবাক হয়ে নীলাঞ্জনা বললেন, বৌ মানে কে? অশ্রু? এসেই দেখনা কে? কাকে বৌ হলে তোমার সুবিধা হয়। দেখ ছেলে তোমার, কাকে বৌ করবে সে তোমার ব্যাপার, আমার মেয়েটি এসেছে কি না তাই বল। এইতো মাত্র কদিন, তবু মনে হচ্ছে কতযুগ যেন দেখিনা ওকে? ওকি এসেছে? দাও না ওকে? মিনতি সেন বলল, দিচ্ছি ভাই দিচ্ছি, বলে হাক ছাড়লেন, সেলিনা তোর মা ডাকছে, যাই মা বলে এগিয়ে এসে ফোন ধরল সেলিনা। বলল, মা আমি সেলিনা বলছি। তবু ভালো, ফিরে এসেছিস আমিতো ভাবলাম, কোন বনে জঙ্গলে গেছিস বাঘের পেটে গেছিস কি না কে জানে? বাঘের পেটে কেন যাবো মা। ওখানেতো অশ্ৰুদি ছিল। নীলাঞ্জনা বললেন হ্যারে, শেষ পর্যন্ত প্রান্তিক অশ্রুকেই বিয়ে করল। একবার আমার কথা মনে করলনা। আমি কি বাধা দিতাম? সেলিনা বলল, অশ্ৰুদি তো থেমে গিয়ে আবার বলল, প্রান্তিক কাকে বিয়ে করে ঘরে আনবে সেতো তার ব্যাপার, তুমি আসছো তো! নীলাঞ্জনা বললেন প্রান্তিক তাহলে শেষ পর্যন্ত অশ্রুকেই বিয়ে করল। কণ্ঠে তার অভিমান। সেলিনা বলল, যাকে তার ভাল লেগেছে তাকেই সে বিয়ে করেছে। এতে তোমার আমার কি বলার আছে। তা ঠিক, তারপর বললেন, অশ্রুকে বধূর সাজে খুব সুন্দর মানিয়েছে তাইনা। তুমি এলেই দেখতে পাবে কেমন মানিয়েছে। নীলাঞ্জনা বললেন আমি না হয় পিসি আমাকে বলার দরকার মনে করেনি। তাই বলে মিনতি মানে ওর মাকেও বলল না। অশ্রুর বাবা-মা গিয়ে ছিলেন? মিটি মিটি হাসছে সেলিনা। বলল, তুমি কি সব সংবাদ ফোনেই নেবে নাকি? এসেই যা জানার, জেনে নাও না। নীলাঞ্জনা তবু আরো বললেন, তোর খুব মন খারাপ তাই না? আর তোকে না হয় ও নাই বা মেনে নিল, তাই বলে রেহানার কথা একবারও ভাবলনা। হয়তো ভেবেছিল, তারপর বলল, ওকে ডেকে দেবো? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, না দরকার নেই। তাহলে তুমি আসছো তো? তুই চলে আয় তারপর এক সঙ্গে না হয় যাবো। সেলিনা বলল, পুরানো হলেও নতুন বৌ তো। তুমি নতুন বৌকে কিছু দেবেনা? দিতে তো হবেই। তুই বলনা, কি দেওয়া যায়। আমার মনে হয় একগুচ্ছ ফুল দিলে সব থেকে ভালো হয়। তাই হয় নাকি? হাজার হোক, প্রান্তিকততা আমার ছেলের মতন। নারে তা হয় না। তবে কি দেবে? সেই জন্যই তো তোকে আসতে বলছি। তাহলে তোমার ভাইপোকেও নিয়ে আসি কি বল? তা কি করে হবে মা, নতুন বৌকে ছেড়ে ও একা আসবে কি করে? নারে ও পাগলামি করিসনে। তার থেকে আমিই আসছি। কখন আসবে? কতদিন তোমাকে দেখিনা, ভীষণ তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে মা। মনে হচ্ছে এখনই ছুটে যাই তোমার কাছে, ক্ষমা চাই আমার অন্যায়ের। আর তোর অন্যায়। তুই আবার কি অন্যায় করলি? অন্যায় যদি কেউ করে থাকে সে প্রান্তিক করেছে। এখনতো মিনতিই ওর সব। আমি কে? আমার দুঃখ ব্যথায় ওর কি যায় আসে? ও কিন্তু তা বলেনা মা। বলছিল তুমি যা করেছে ওর জন্য পৃথিবীতে কেউ নাকি তা করেনি। বানিয়ে বলছিসনা তো। ওর হয়ে বানিয়ে বলতে যাবো কেন? যা ও বলেছে তাই বললাম। তাই যদি হতো, তা হলে ও মিনতির ওখানে না উঠে আমার কাছেই আসতো। আমিতো মিনতির কাছে শোনামাত্র ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে আর কথাই বলব না। তা হারে তুই ভাল ছিলিতো। হ্যাঁ মা ভীষণ ভালো ছিলাম। অশ্ৰুদি ভীষণ যত্ন করেছে আমাদের। এতকথা ফোনে হয় না, তুমি এসো না? বেশ আমি আসবো। নতুন বৌকে যা হোক একটা কিছু দিতে তো হবে। দিয়েই চলে আসবো। তুইও কিন্তু চলে আসবি। তোকে আমি আর ওখানে থাকতে দেব না। বেশ তাই হবে, আগে তুমি এসোতো।

    সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এলে নীলাঞ্জনা এলেন। গাড়ী করেই এলেন। সেলিনাকে নিয়ে যাবেন, তাই গাড়ী নিয়ে আসা। ইদানীং বেশ কিছুদিন হলো অফিস থেকে গাড়ী পেয়েছেন নীলাঞ্জনা। তবে সাধারণত অফিসের কাজের বাইরে গাড়ী বাবহার করেন না উনি। সুন্দর ফুলের বাস্কেট, আর দামী সোনার হার নতুন বৌকে দেবেন বলে নিয়ে এসেছেন নীলাঞ্জনা। গাড়ীর হর্ণের শব্দে মিনতি সেন বেরিয়ে এসে দেখেন নীলাঞ্জনা। আরে তুমি? হ্যাঁ এলাম। তা বাড়ীতে একটা উৎসব উৎসব মনে হচ্ছে। আর কাউকে বলেছে নাকি? কয়েকজনকে বলেছি নীলাঞ্জনা। যারা আমার সুখ দুঃখের সঙ্গে সব সময় থাকে তাদের না বলে পারলাম না। তুমি তোমার ছেলের অন্যায়কে সমর্থন করলে? ছেলের অন্যায়? না নীলাঞ্জনা প্রান্তিক যে কোন অন্যায় করতে পারে না, সেতো তুমি ভাল করে জান। অন্যায় নয়? রেহানাকে ভালবেসে অন্যকে বিয়ে করা অন্যায় নয? তুমি কি ঝগড়া করবে? তারপর বললেন, রেহানাকে ও সত্যি ভালবাসতো, তাই বলে যাকে ও বিয়ে করেছে তাকে ও ভালবাসে না, একথা তোমাকে কে বলেছে? হয়তো বাসে, তবে একদিন কিন্তু ও বলেছিল, না ওকে ও ভালবাসে না, বলেছিল নাকি? কবে? তুমি আর ন্যাকামো করোনা মিনতি। যাক গে বৌমাকে ডাক। আমি আশীৰ্বাদ করেই চলে যাবো। আর সেই সঙ্গে সেলিনাকেও ডাকো, ওকে আমি নিয়ে যাবে। মিনতি সেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন নীলাঞ্জনার দিকে। বলে কি নীলাঞ্জনা। ওকি তবে সত্যি জানেনা প্রান্তিক কাকে বিয়ে করেছে? ব্যারিষ্টার ভট্টাচার্জ সাহেব এসে ঢুকলেন সেই সময়। নীলাঞ্জনাকে দেখে বললেন, এনাকে তো চিনতে পারলাম না মিস সেন। ইনি প্রান্তিকের পিসি। ও নমস্কার, আমি সুরেশ ভট্টাচার্য বটতলার উকিল। নীলাঞ্জনা বললেন বটতলার উকিল যে এ বাড়ীতে প্রবেশাধিকার পেতে পারেন না, সে আমি জানি উকিল সাহেবা, কিন্তু সঙ্গে এটি কে? মেয়ে? হ্যাঁ আমার মেয়ে শান্তা। শান্তা এগিয়ে এসে নীলাঞ্জনাকে প্রণাম করল। মিনতিকেও করল। দীর্ঘজীবি হও মা। তা উকিল সাহেব গিন্নী কই? আছে কোথাও চিন্তা করবেন না দেখা হয়ে যাবে। অধৈৰ্য্য হয়ে নীলাঞ্জনা বললেন কি হলো মিনতি ছেলে ছেলের বৌকে ডাক। মিনতি, ভট্টাচার্জ সাহেবকে বললেন, আপনি উপরে যান ভট্টাচার্জ সাহেব। আপনার কাকা আসবেন না? আসবেন তবে একটু দেরি হবে জানিয়েছেন। মিনতি সেন নীলাঞ্জনার হাত ধরে বললেন, অভিমান করো না ভাই, এতে ওরা দুঃখ পাবে? নীলাঞ্জনা বললেন, আমি না হয় পিসি মিনতি, কিন্তু এই আমি না থাকলে, ওকে কে চিনতো। সেই আমায় এতবড় আঘাত দিল? আমি জানিনা কি ভাবে ও তোমাকে আঘাত দিয়েছে। জান না? না না জানার ভান করছ মিনতি? ঠিক আছে, ও সেলিনাকে বিয়ে করবে না তাই বলে রেহানার জন্য অপেক্ষা না করে অশ্রুকে বিয়ে করতে হবে? এরপর আমি সেলিনার মুখের দিকে তাকাবো কি করে বলতো? এতক্ষণে মিনতি সেনের বোধ গম্য হয় নীলাঞ্জনার রাগের কারণ। কিন্তু রহস্য উন্মোচন না করে বলেন। অশ্রুওতো তোমার মেয়ের মতন, ওকেই মনে করো না তোমার সেলিনা। তাই মনে করতে হবে মিনতি, উপায় কি বল। দেখি প্রতীমবাবুকে বলব, অশ্রুরতো চাকরি প্রয়োজন নেই অশ্রুর চাকরিটা যদি সেলিনাকে দেন। প্রতীমবাবুর নাম শুনতেই চুপ হয়ে গেলেন মিনতি। বললেন তাই বলো। কিন্তু আমাকে এসব শুনিয়ে লাভ কি? আজকের দিনে ওনাকে নিমন্ত্রণ করোনি মিনতি? মিনতি সেন তাড়া লাগিয়ে বললেন তুমি কি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবে? এস ভিতরে এসো। প্রান্তিক ও তার বৌ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ঠিক সেই সময় বাইরে গাড়ী থামার শব্দ হল। আকবর হেঁটে এলেন হাতে একগাদা উপহার নিয়ে, এসে বললেন, গাড়ীতে সাহেব বসে আছেন। প্রান্তিক সাহেবকে, একবার ডেকে দেবেন? মিনতি বললেন, কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলামনা কে আপনি? আমাকে চিনতে পারবেন না, আমি আকবর। তারপর বললেন, প্রান্তিক সাহেব আসতে না পারলে, অন্তত একবার সেলিনা মেমসাহেবকে বলুন না আসতে। সাহেব একবার তাকে ডেকেছেন। সেলিনার নাম শুনে চমকে উঠলেন নীলাঞ্জনা। বললেন, তোমার সাহেব এদের চেনেন? কেন চিনবেন না এই কয়কদিন তো ওনারা চৌধুরী সাহেবের কাছেই ছিলেন। কে চৌধুরী সাহেব? উত্মা প্রকাশ করে বললেন মিনতি সেন। আকবর বলল, সেকি? আপনারা চৌধুরী সাহেবকে চেনেন না। সুর এ্যান্ড সুর কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার প্রতীম চৌধুরী? তিনি গাড়ীতে বসে আছেন কি অন্যায় কথা বলত। তার পর নীলাঞ্জনা আকবরকে বললেন যাও না ভাই প্রতীমবাবুকে উপরে ডেকে নিয়ে এসো। আকবর এগিয়ে গেলে নীলাঞ্জনা বললেন, মিনতি তোমার বাড়ীতে এসেছেন, তোমার কিন্তু একবার যাওয়া উচিত। মিনতি এব কোন প্রতিবাদ না করে বললেন, আমি প্রান্তিককে পাঠিয়ে দিচ্ছি। না তার দরকার নেই মিনতি, আমিই যাচ্ছি। কিন্তু তোমাকে ভাই অনুরোধ সেদিনের মত ব্যবহার করো না। চেষ্টা করবো, তুমি ওনাকে নিয়ে ওপরে এসো।

    প্রতীমবাবু বললেন নমস্কার নীলাঞ্জনা দেবী, কেমন আছেন? ভাল আছি। নমস্কার। তারপর বললেন আমি কিন্তু ভাবতেই পারিনি আমাকে আপনি চিনতে পারবেন। তা হয়তো ঠিক। তবে আমার স্মৃতি শক্তি খুব একটা প্রখর নয়তো। তাই চিনেও না চেনার ভান করতে পারি না। অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারেন নীলাঞ্জনা। বলেন, যারা চিনেও না চেনার ভান করেন হয়তো তার কোন গূঢ় অর্থ থাকতে পারে। আমাকে কিন্তু দয়া করে সেই দলে ফেলবেন না। না ফেলতে পারলে ভালো হয় কিন্তু কখন যে কোন দলে ভীড়ে যাবেন কে জানে? আর একটা কথা, আমার আসাতে যদি কোন অস্বস্তি হয়, তা হলে দয়া করে প্রান্তিক বা সেলিনাকে একটু ডেকে দিন না। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলেই চলে যাব। নীলাঞ্জনা বললেন অস্বস্তি হওয়া বা কারও তো কিছু মনে করার নেই প্রতীমবাবু। বরং অনেক লজ্জার হাত থেকে আপনি যেমন বাঁচিয়েছেন তেমনি অনেক অপ্রস্তুত হওয়ার হাত থেকেও রক্ষা করেছেন, আর সেই আপনি গাড়ীতে বসে থেকে এদের সঙ্গে কথা বলে চলে যাবেন তা হয় নাকি? না ঠিক তা নয়। আসলে সেলিনার করুণ মুখের কথা মনে করে আমি না এসে পারলাম না। তারপর বললেন দেখেছেন ওকে নববধুর বেশে? কি অপূর্ব মানিয়েছে ওকে? অবাক হয়ে নীলাঞ্জনা বলে মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি। সেলিনা নববধু এসব কি বলছেন আপনি? প্রতীমবাবু বললেন আপনি এখনো দেখেন নি ওদের? না এখনো দেখা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া প্রান্তিক বা অশ্রুকণা এদেরতো নতুন ভাবে দেখার কিছু নেই। নীলাঞ্জনা ও প্রতীমবাবু হাঁটতে হাঁটতে নীচের বসার ঘর পর্যন্ত এলেন। তারপর প্রতীমবাবু বললেন, দাঁড়ান নীলাঞ্জনা দেবী, মনে হচ্ছে আপনি কিছুই জানেন না। না জানার তো কিছু নেই। তাহলে অশ্রুকণার কথা উঠছে কেন? যতদুর জানি, অকশা এখানে আসেই নি। আসেনি মানে? তাহলে প্রান্তিক কাকে বিয়ে করেছে। সেই জন্যইতো বলেছিলাম নববধুর অপূর্ব সাজে দেখেছেন সেলিনাকে? মানে প্রান্তিক সেলিনাকে বিয়ে করেছে? প্রতীমাবু বললেন, ঘটনা চক্রে যা ঘটে গেছে তাকে ঠিক বিয়ে বলা যায় না, বলা যেতে পারে মুহূর্তের অভিনয়। কিন্তু অভিনয় ওতো কারো কারো জীবনে সত্য হয়। ওদের জীবনেও তাই হয়েছে। সেলিনাতো আপনার মেয়ে, একবার দেখবেন না নববধূর সাজ তার পূর্ণ হল কি না। নীলাঞ্জনার তখন নিজের কাছে নিজেকে এত অপমানিত লাগে যে, বললেন কোন দরকার নেই প্রতীমবাবু। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। হঠাৎ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা আসছে কেন? আসছে এই জন্য যে আমি ব্যাপারটা জানিনা। আর আপনি তা জানিয়েছেন বলে। তারপর অশ্রুর জন্য যে উপহার এনেছিলেন। তাই প্রতীমবাবুর হাতে দিয়ে বললেন। আমার একটা অনুরোধ রাখবেন প্রতীমবাবু? বলুন। ওটা ওর হাতে দিয়ে বলবেন ওর মা ওকে বুক ভরে আর্শীবাদ করেছেন, তবু আমি থাকতে পারছি না। কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলেন প্রতীমবাবু। বললেন নীলাঞ্জনা দেবী। নীলাঞ্জনা বললেন অনেক বিশ্বাস নিয়ে এটা আপনার হাতে দিয়ে যাচ্ছি। আর যদি সম্ভব হয় কাল একবার আসবেন, আপনাকে আমার একটা ইচ্ছের কথা জানিয়ে যাবো।

    নীলাঞ্জনা ও প্রতীমবাবুর দেরি দেখে মিনতি সেন এদিকেই আসছিলেন, হঠাৎ প্রতীমবাবুকে ওই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, এলেনই যদি তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে কেন? উপরে যাবেন না? হ্যাঁ যাবে। তা আপনি কেমন আছেন মিনতি দেবী। ভালো, আপনি ভালো আছেন তো? হা নিশ্চয়ই ভাল আছি, আর ভাল না থেকে কোন উপায়ও নেই মিনতি দেবী। এই দেখুননা কি কথা বলতেই, নীলাঞ্জনা দেবী তার সমস্ত উপহার আমার হাতে দিয়ে বললেন, এগুলো যেন আমি সেলিনাকে দিয়ে বলি তার মায়ের বুক ভরা আশীর্বাদ রইল এর সাথে। তারপর চলে গেলেন। অনেক করে বোঝাতে চাইলাম, কিন্তু চলেই গেলেন নীলাঞ্জনা দেবী। সুতরাং বলতেই হবে ভাল আছি। এবার চলুন একবার উপরে যাওয়া যাক। চলুন। মিনতি সেন ওনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন, যে ঘরে আছে, সেলিনা ও প্রান্তিক।

    দেখতে দেখতে দলবল নিয়ে হৈ হৈ করে এলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার সাহেব। সামনে প্রতীমবাবুকে দেখে বললেন আপনি? মিনতি সেন বললেন উনি প্রতীম চৌধুরী, প্রান্তিকের কাকা। আজকের দিনে আমাদের বিশেষ অতিথি, আপনি কথা বলুন কাকু, আমি আসছি। কমিশনার সাহেবের গলা পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ব্যরিষ্টার ভট্টচার্জ সাহেব। কমিশনার সাহেবের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পরে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি মি: চৌধুরী কখন এলেন? এই সবে মাত্র। কমিশনার সাহেব জানতে চাইলেন ভট্টাচার্জ সাহেব আপনি চেনেন নাকি একে। চিনি বৈকি, উকিল মানুষ। মক্কেলকে হাত ছাড়া করতে নেই। তারপর একটু হেসে বললেন, আপনিও চেনেন, তবে পুলিশি কর্ম ব্যস্ততায় ভুলে গেছেন এই যা। তবু। বললেন কমিশনার সাহেব। ব্যরিষ্টার ভট্টাচার্জ বললেন, উনি সুর এত সুর কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার প্রতীম চৌধুরী। কমিশনার সাহেবের যেন হঠাৎ সব মনে পড়ে গেছে, বললেন হ্যাঁ হ্যাঁ, কয়েক দিন ধরেতো কাগজে নামও দেখেছি। শিলোয়নের সঙ্গে সমাজেরও যাতে উন্নতি হয় তার জন্য ওর অক্লান্ত চেষ্টার কথা। কয়েকদিন ধরে কাগজে বেরিয়েছে কিন্তু আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সময় হয়ে ওঠে নি। একটু চিন্তা করে বললেন মনে হচ্ছে কোথায় যেন আপনাকে দেখেছি। অনেকটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। ভট্টাচার্জ সাহেব বললেন, তা অনেক সময় হয়। হঠাৎ হঠাৎ কিছুতেই মনে করা যায় না, তারপর আবার সব মনে পড়ে যায়। তাই বলছিলাম এখন আর ও সব ভেবে লাভ নেই। যখন মনে পড়বে, তখন দেখা যাবে। এখন চলুন ওপরে। আচ্ছা তাই চলুন বললেন কমিশনার সাহেব। আজ বিয়েও নয়, ফুলশয্যাও নয় তবু কেন মিনতি সেন আমাদের উপরের ঘরে প্রায় বন্দী করে রেখেছেন কে জানে?

    খুব দামী শাড়ী পরেছে সেলিনা। মিনতি সেন তার সমস্ত মূল্যবান গয়না দিয়ে সাজিয়েছেন ওকে। হাতে এয়োতির চিহ্ন নোয়া যেমন আছে তেমনি আছে আরো অসংখ্য অলংকার। সিঁথির সিঁদুর ভোরের সূর্যের মত উজ্জ্বল। বেনীতে জড়িয়েছে বেল ও যুইয়ের মালা। উজ্জ্বল তিনটি লাল গোলাপ একেবারে উৎস মূলে। আমি পরেছি মূল্যবান পাজামা পাঞ্জবি। মিনতি সেনের বিরাট হল ঘরে আরো অনেকের সঙ্গে আমরা গল্পে মেতে আছি। শান্তার সঙ্গে খুব অল্প সময়ে মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায় সেলিনার। এত লোককে যে বলেছেন মিনতি সেন ভাবতে পারিনি। শুধু অভাব বোধ করছিলাম, অশ্রুকণা ও তপতীর। পিসিতো আসবেই জানা কথা।

    আরেকটা ব্যাপারে মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠেছে তাহলে আমার বাবা-মা। জানিনা তারা কেমন ভাবে নেবেন আমাকে। ভাগ্যের চাকা এমন ভাবে ঘুরে গেছে যে, আমি যেন আর ওদেব ছেলে নই। ওদের চিন্তা ভাবনার সঙ্গে আমার আকাশ পাতাল তফাৎ হয়ে গেছে। তবু বিশ্বাস আছে–গ্রামের সমাজ আমাদের গ্রহণ করতে না পারার জন্য বাবা মাও হয়তো চোখের জল ফেলবেন সমাজকে অস্বীকার করতে না পারার জন্য। তবু তাদের আশীর্বাদ থেকে হয়তো বা বঞ্চিত হবে না।

    কমিশনার সাহেব এসে দাঁড়ালেন সামনে। আমি ও সেলিনা প্রণাম করলে, কমিশনার সাহেব তাকে আশীর্বাদ করে মিনতি সেনকে ডেকে বললেন, মিনু তোর বৌমাকে দেখে এত লোভ হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে এখনি হাইজ্যাক করে নিয়ে চলে যাই। সকলে হেসে উঠলেন। সেলিনা বলল, কোন দরকার নেই, যখনি দরকার হবে, আমি নিজেই চলে যাবো। হাইজ্যাকের ঝামেলা পোয়াবেন কেন? আবারও সবাই হেসে উঠলো। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, অবাক হয়ে কমিশনার সাহেব তাকিয়ে আছেন সেলিনার দিকে। তার ঠাট্টার যে এমন একটা জবরদস্ত উত্তর হতে পারে, বোধ হয় তিনি তা ভাবতেও পারেননি। কিন্তু উনিতো শুধু মিনতি সেনের কাকা নন, তিনি জবরদস্ত পুলিশ কমিশনার, জবাবেরও একটা জবাব দেওয়া দরকার। বললেন তা তুমি পারবে দিদি ভাই, কারণ হাইজ্যাক তোমার রক্তে মিশে আছে। ঠাট্টার সঙ্গে নিলে কথাটাকে ঠাট্টা হিসাবেই গ্রহণ করা যায়। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থ গ্রহণ করতে গেলে অপমান বাজতেই পারে বুকে, তাই সেলিনাও হেরে যেতে রাজী নয়, বলল, তা আপনি এক অর্থে ঠিকই বলেছেন, যে রক্তকে আপনি এত গৌরাবান্বিত করতে চেয়েছেনে, আমিতো সেই রক্তেরই উত্তরাধিকার। চুপ হয়ে গেলেন কমিশনার সাহেব। অন্যেরা জবাবের জন্য মনে মনে খুশী হলেও বাইরে কিছু প্রকাশ করলেন না। কমিশনার সাহেব বললেন তোমার চাতুর্যকে প্রশংসা না করে উপায় নেই, কিন্তু দিদি ভাই আমাকে যে যেতে হবে। যাবেন, আপনিতো আমার অতিথি নন, মায়ের অতিথি তিনিই বুঝবেন আপনি যাবেন কি থাকবেন। এ জবাবও আশা করেননি কমিশনার সাহেব। শুধু একটু হাসলেন তারপর মিনু মিনু করে চিৎকার করতে করতে বাইরে চলে এলেন।

    এতক্ষণে প্রতীমবাবু এগিয়ে এলেন, সেলিনা ওকে দেখতে পেয়ে একবোরে দৌড়ে ওর কাছে এসে বলল, কাকু তুমি কখন এলে? আজ কিন্তু থেকে যেতে হবে কোন অজুহাত কিন্তু শুনবো না। প্রতীমবাবু অবাক হয়ে যান মেয়েটির মুহূর্তের উত্তরণে। ঠিক আছে দেখব। তার আগে একবার ঠিক করে দাঁড়াও তো, তারপর প্রান্তিককে বললেন, প্রান্তিক তোমার মাকে ডাকো। প্রান্তিক বেরিয়ে গিয়ে মিনতি সেনকে ডেকে নিয়ে এল। তখনো পর্যন্ত কমিশনার সাহেব যাননি বলে, তাকেও জোর করে ভিতরে নিয়ে এলেন। মিনতি সেন কাছে এসে দাঁড়ালে এক গাদা উপহারের বাক্স তার পায়ের কাছে রেখে প্রতীমবাবু বললেন, সেলিনার জন্য এনেছিলাম, গ্রহণ করলে নিজেকে ধন্য মনে করব। মিনতি সেন বললেন, আপনি এনেছেন, ওকেই আপনি দিয়ে দিন। আমাকে বলছেন কেন? ওরা যদি আমার বাড়ীতে কখনো যায়, আমি নিশ্চয়ই আপনাদের অনুরোধ করবো না। আপনি প্রান্তিকের মা হতভাগ্য মেয়েটিকে আপনি যে মেনে নিয়েছেন এতে যে আমার কি আনন্দ হচ্ছে তা বলতে পারবো না। তাই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ওটা আমি আপনার মাধ্যমে তুলে দিতে চাই।

    দেখতে পাচ্ছি, মিনতি সেন কাঁপছে। কত বছরের স্মৃতি বুকে নিয়ে পথ চলা। আজ তারা মুখোমুখি। ভিতরটা কি ভেঙে যাচ্ছে না? অবশ্যই যাচ্ছে, তাই হয়তো মিনতি সেন পালিয়ে যেতে চাইছেন। কোন ভাবে উপহারের বাক্সগুলি একে একে সেলিনাকে দিয়ে প্রতীমবাবুকে বললেন, আপনি খুশীতো। শুধু খুশী নই ভীষণ আনন্দিত। আপনার জন্য আমার গভীর শ্রদ্ধা রইল। মিনতি সেন আমারও বলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে তাল সামলাতে না পেরে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন, এগিয়ে এস মিনতি সেনকে ধরে ফেললাম। বললাম, তোমার শরীর খারাপ মা। না, আমি ভাল আছি। তুই দেখতে প্রান্তিক জবার মা কোথায় গেল। যাদের আসতে বলেছিলাম তারা মনে হয় সবাই এসে গেছেন। এদের তো কিছু খাওয়ার বন্দোবস্তও করতে হবে। এই সময় আমি জানতে চাইলাম পিসি আসেননি? মিনতি সেন কোন উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। কি হয়েছে মার অমন করছেন কেন? আমি ঠিক জানিনা, তুমি দেখনা কি হয়েছে। তারপর জবার মাকে ডেকে আনতে বেরিয়ে গেলাম। এবার সেলিনা কমিশনার সাহেবে কে বললেন, এখন কিন্তু দাদু আপনি আমার অতিথি। মানে? বা মা অসুস্থ, অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্বতো আমার। তাই বলছি, একদম চলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না, তা হলে হয়তো উল্টো ভাবে হাইজ্যাক হয়ে যেতে হতে পারে। হাসছে সেলিনা, খারাপ হয় না দিদিভাই এই বৃদ্ধ বয়সে হাইজ্যাক হতে, বললেন কমিশনার সাহেব। তারপর অনুরোধ করে বললেন, কিন্তু দিদি ভাই সত্যি দেরি হয়ে যাবে। তোমার আপ্যায়নটা যদি একটু তাড়াতাড়ি কর ভাল হয়। এই করি দাদু।

    সেলিনার নির্দেশে মুহূর্তে হল ঘরটাকে ক্যাটারিং এর লোকেরা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে ফেলে। প্রত্যেককে হাত জোড় করে সেলিনা বলে, আপনারা যদি বসে যান তাহলে খুব ভাল হয়। প্রতীমবাবুকে বলল, তুমি বসবে না? না এখন না। তারপর বললেন তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে সেলিনা, আসবে এদিকে? সেলিনা এক পাশে এগিয়ে গেলে প্রতীমবাবু বললেন, তোমার মা এসেছিলেন, এই উপহারগুলো আমার হাতে তুলে দিয়ে বলে গেলেন, আমি যেন এগুলো তোমার হাতে তুলে দিয়ে বলি, তোর মা তোকে বুক ভরে আশীর্বাদ করেছেন। আমি অনেকবার বলেছি, তবু তিনি তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন না। আমি যাচ্ছি ওখানে, যে ভাবে তোক ধরে নিয়ে আসব। কোন দুশ্চিন্তায় আজকে অতিথি আপ্যায়নে যেন কোন ক্রটি না হয়। সেলিনা বলল প্রান্তিক জানে?না কেবল ওর মা জানেন। হয়তো এটা তার বুকে খুব বেজেছে। আমাকে যখন কাকু বলে ডেকেছে মা। আমি থাকবো। তোমার পাশে কোন ভয় নেই। কিন্তু আমাকে থেকে যেতে বলবে না। যে ভাবেই হোক আমাকে চলে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দিও। তাই দেব। কোন অস্বস্তিতে তুমি পড় তা আমি চাইবনা। কিন্তু কাকু মা না আসা পর্যন্ত মনটা কাটার খোঁচার মত ক্ষতবিক্ষত হতে থাকবে, তুমি যে ভাবে পার তাকে নিয়ে এস। হ্যাঁ তাই হবে। আমি চলে যাচ্ছি। উনি চলে গেলেন। একবার হল ঘরে এসে সেলিনা দেখলে সব ঠিক ঠাক মত আছে কিনা। তারপর এল মিনতি সেনের কাছে, সেলিনাকে দেখে জবার মা উঠে দাঁড়াল, বলল, বৌদিমনি, তুমি একটু বোস না দিদিমনির কাছে। দাদাবাবুকে বলুন না ডাক্তার ডাকতে। আমি দেখছি। তুমি যাও।

    সেলিনা মিনতি সেনের মাথার কাছে বসে ডাকলো মা, চোখ মেলে তাকালেন মিনতি সেন। তারপর বললেন তুমি এখানে, যাদের বলেছি তাদের কি হবে? কোন চিন্তা নেই মা, সব ব্যবস্থা আমি করেছি, তা ছাড়া দাদু ভাই আছেন, তোমার সম্মান রক্ষার্থে, তিনি যা করার করবেন। কে? কাকু যাননি? তুমিতো অবাক করলে মা। আজকের দিনে উনি যাবেন কি করে? তুমি ঠাট্টাও বোঝনা? তাই যেন হয়। ওটা যেন ঠাট্টাই হয়। সেলিনা বলল, মা এসে চলে গেছে? তোকে কে বলল? যেই বলুক, তুমিতো আমায় বললেনা উল্টে চিন্তা করে করে শরীরের এই অবস্থা বানালে। কি করব বল, কি করে বলি তোর মা এসেও তোকে না দেখে চলে গেছে। কেমন ভাবে নিবি? যে ভাবেই নিইনা কেন? কথাটাতো সত্যি। আর উনি যদি এত জেদী হতে পারেন তবে আমার জেদী হতে আপত্তি কোথায়? নারে ওভাবে কথা বলতে নেই। ওর মনে যে আঘাত লেগেছে তা কি তুই বুঝবি না। খুব ভাল কথা মা, কিন্তু উনি যে ভাবে চলে গেলেন তাতে তোমার মনে আঘাত লাগবেনা। তাছাড়া আমিতো জানি তোমার মনে এমনিতেই ঝড় চলছে। কিসের ঝড়। আজ থাক মা। আর একদিন বলব। বরং চল অতিথিদের ওখানে। ওদর সঙ্গে কথা বল, দেখবে আস্তে আস্তে সব কিছু শান্ত হয়ে গেছে। এরপর মিনতি সেন জানতে চাইলেন তোর কাকু চলে গেছেন? আমাকে বলে গেছেন, কি একটা জরুরী কাজ আছে, সেরেই আসবেন। কিন্তু মা, যত বড় অফিসারই হোক উনিতো আর বাব ভাবুনন, তবে ওনার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তোমাকে  এত আড়ষ্ট লাগে কেন? এর আগে মায়ের ওখানেও দেখেছি তুমি প্রায় এড়িয়েই চললে ওনাকে। আজও ওনার কাছ থেকে উপহার গুলো নিতে তুমি কেমন কেঁপে উঠলে। কেন এরকম কর? তোমার সঙ্গে কি আগে ওনার পরিচয় ছিল? মিনতি সেন কি উত্তর দেবেন এর? বললেন। প্রান্তিক তোকে কিছু বলেনি? কি ব্যাপারে। তোর কাকুর সম্পর্কে। না তো। তা হলে তোর আর জেনে লাভ নেই। না মা আমাকে জানতেই হবে। কেন এত জোর করছিস। কাকুকে আমার ভীষণ ভালো লাগে, তুমি এমন করলে তো উনি আসতে চাইবেন না। নাই বা এলেন, তোরা যাবি ওনার কাছে। আমারা যাব আর উনি আসবেন না, একি আমাদের ভাল লাগবে? থাক তোর কাকুর কথা এখন, বরং চল, দেখি ওদের খাওয়া কতদূর হল।

    নীলাঞ্জনা কিছুতেই আসবেন না। বললেন না প্রতীমবাবু, কত আশা ছিল ওকে আমি মনের মত সাজিয়ে বাসরে পাঠাবো। নিজের গর্ভে তো কেউ এলো না। তাই আমার মাতৃহৃদয় উজাড় করে দিয়েছিলাম ওকে। ওকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, প্রান্তিকের অসুখের সময়, মাত্র কয়েক মিনিটেই আপন করে নিল আমাকে। পরে রেহানাকেও দেখলাম। এমন মিষ্টি মেয়ে আর হয় না। দুই বোনের মধ্যে চিন্তা ভাবনায় আকাশ পাতাল তফাৎ। কিন্তু প্রথম দিন থেকে আমার মনে হয়েছে, রেহানা নয় সেলিনাই বেশী ভালবাসে প্রান্তিককে। কিন্তু বিশ্বাস করুন প্রতীমবাবু প্রান্তিকের কোন সাড়া না পেয়ে আমি এ ব্যাপারে চুপচাপ ছিলাম। তাছাড়া যেহেতু প্রান্তিক রেহানাকে ভালবাসে বলে, মনকে সেই ভাবে প্রস্তুত করি। এরপরে তো রেহানা চলে যায়। কোথায় যে গেছে আজ জানিনা। রেহানা থাকতে সেলিনা যা পারেনি, ওর অবর্তমানে কিন্তু ও ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ওর দিকে। আমার সমর্থন ছিল। মনে প্রানে চাইছিলাম, রেহানা যদি ফিরে না আসে, তাহলে যেন সেলিনাকেই গ্রহণ করে প্রান্তিক। যদিও প্রান্তিককে আমি এসব কথা কোন দিন বলিনি, সেলিনাকেও নয়। আজ যখন আমার স্বপ্নই বাস্তবায়িত হলো। অথচ আমি জানলাম না, কেমন করে মেনে নেবো বলুন। প্রতীমবাবু বলেন আপনার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু নীলাঞ্জনা দেবী পৃথিবীতে কাউকে না কাউকে হয়তো আঘাত সইতে হয়। তা না হলে জীবনের সুন্দর ও মধুর মুহূর্তগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, আপনি বোধ হয় জানেন না, আপনার ওই ভাবে চলে আসায় মিনতি দেবী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, একা ঐ বাচ্চা মেয়ে অতিথিদের সামলাবে কি করে। আর যদি কোন ভাবে সামলানোও যায় অসুস্থ মানুষকে নিয়ে কি করবে ও? তার থেকে চলুন। এ সময় আপনার ওনাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করি।

    এবার চলুন। নীলাঞ্জনা বললেন, আমার এখানে আপনাকে কে আসতে বলেছে। এসেছি আমি নিজে, তবে সেলিনাকে বলে এসেছি, ও বেচারা জানেই না যে আপনি গিয়েছিলেন।

    বেশ চলুন, কিন্তু আমাকে এই রাতেই ফিরে আসতে হবে। তাই হবে নীলাঞ্জনা দেবী। যদি সত্যি ফিরতে পারেন, আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।

    নীলাঞ্জনাকে নিয়ে প্রতীমবাবু যখন মিনতি সেনের বাড়ীতে পৌঁছালেন, তখন অতিথিরা সব চলে গেছে। শুধু প্রান্তিক, সেলিনা, জবার মা ও মিনতি সেন ছাড়া বাড়ীতে আর কেউ নেই। আর কেউ আসবে না বলে জবার মা মেইন গেটে তালা দিয়ে দিয়েছে এ সময় গাড়ীর হর্ন বার বার বেজে উঠলো। মিনতি সেন নামতে চাইলে আমি বললাম আমি দেখছি। গেট খুলে দিতেই গাড়ী থেকে নামলেন প্রথমে প্রতীমবাবু তারপর নীলাঞ্জনা পিসি। আমি অভিমান করে বললাম, পিসি তুমি এসেও আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে গেলে? তারপর প্রতীমবাবুকে বললাম, কাকু আসুন। আকবরকে বললাম, আকবর তুমিও গাড়ীটা লক করে এস।

    আকবরকে বাইরের ঘরে বসিয়ে আমি পিসি ও প্রতীমবাবুকে নিয়ে উপরে এলাম। সেলিনা ও মিনতি সেন কথা বলছেন। মিনতি সেন শুয়ে আছেন। আর তার শিয়রের কাছে বসে সেলিনা একথা সেকথা বলে চলেছে। আমি বললাম, মা, কাকু ও পিসি এসেছেন। সেলিনা দৌড়ে এসে নীলাঞ্জনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললে, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলবো না মা, কিছুতেই কথা বলবো না। কেন তুমি আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে গেলে। তুমি ছাড়া কে আছে আমার বল, বলতে বলতে চোখের জলে ভিজিয়ে দিল নীলাঞ্জনার শাড়ীর আঁচল। আর তাতেই সিঁথির সিঁদুর আর কপালোর টিপ এলো মেলো হয়ে গেল। নীলাঞ্জনা বললেন ছাড় আমাকে। কি পাগলামি করছিস। আজতো আমার আনন্দের দিন। আনন্দ না ছাই, তা হলে তুমি চলে গেলে কেন? এভাবে বলিস নে মা, তারপর বললেন কেন যে গেলাম আবার কেন এলাম তাও জানিনা। মিনতি সেন যেন মুহূর্তে সুস্থ হয়ে গেলেন, সেলিনাকে বললেন সেলিনা এবার ছেড়ে দে মাকে। প্রতীমবাবুকে বললেন বসুন মিঃ চৌধুরী। তারপর কাউকে না বলে যাওয়ার জন্য সত্যি রাগ হয়েছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, রাগ হওয়াটা আমার ঠিক হয়নি। কখন খেয়েছেন? খাবেন তো? নীলাঞ্জনা, তুমি দেখনা সেলিনা ওর কাকুকে কি খাওয়াবে? বাঃ আমি কেন দেখব? তুমি কি করবে? আমার কাকু এসেছেন তোমার বাড়ীতে আর তাকে খাওয়াবার দায়িত্ব নেব আমি তা হবে না। তুমি বরং দেখ কি খাওয়াবে, আমি ততক্ষণ আকবরকে দেখছি। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলেন মিনতি সেন। নারীর লজ্জা সে যেন সব বয়সে এক। নীলাঞ্জনা বললেন, সেলিনা ঠিকই বলেছে মিনতি, তুমি ওকে খেতে দাও। আমি বরং ততক্ষণ সেলিনার সঙ্গে নীচে কথা বলছি।

    ওরা আর অপেক্ষা না করে নীচের ঘরে চলে গেল। মিনতি সেন বললেন, আপনি কি এই ভাবেই খাবেন, না পোষাকটা বদলে নেবেন। প্রতীমবাবু বললেন, আপনার যদি অসুবিধা হয় তাহলে বদলাতে হবে, তা না হলে এতে আমার কোন অসুবিধা নেই। এ ভাবেই সবকিছু অভ্যেস হয়ে গেছে। মিনতি সেন বললেন, কিন্তু প্রয়োজনে তো অনেক অভ্যেস বদলাতে হয়। তা হয়, তবে জানেন কি, প্রয়োজনটা এত সামান্য যে বদলাবার দরকার হয় না। এর মধ্যে আমি ভিতরে গিয়ে পায়জামা পাঞ্জবি আর তোয়ালে এনে প্রতীমবাবুর হাতে দিয়ে বললাম, আপনি বরং একটু ফ্রেশ হয়ে নিন কাকু। বেশ তোমরা যখন বলছ তখন দাও। কিন্তু প্রান্তিক, আমার একটু তাড়া আছে। মিনতি সেন বললেন, মেয়ের বাড়ীতে এসে না থেকে চলে যাবেন। রাতটা থেকে গেলে খুব কি অসুবিধা হবে? প্রতীমবাবু তার কোন উত্তর না দিয়ে ওই সব নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন, এবং মিনিট ১৫ পরে যখন বেরিয়ে এলেন দেখে মনে হচ্ছে সত্যি যেন ক্লান্তি দূর হয়েছে। জবার মা এসে সংবাদ দিল, দাদাবাবু, বৌদিমনি নিচেই ডাকছেন আপনাকে। আসছি বলে, চলে এলাম আমি।

    জীবনে এই প্রথম মুখোমুখি মিনতি সেন ও প্রতীম চৌধুরী। মিনতি সেন বুললেন, কিছুই খাচ্ছেন না যে। বেশী খেতে পারি না মিস সেন, তা ছাড়া নীলাঞ্জনা দেবী জোর করে খাইয়ে দিলেন। তা হলে দরকার নেই, শরীর খারাপ করতে পারে। আমার শরীর খারাপ করে না। ঈশ্বর বোধহয় ওটা দিতে আমাকে ভুলে গেছেন। তা আপনি এখন সুস্থ তো। জানেন মিস সেন, আপনি যখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আমার খুব খারাপ লাগছিল। কেন? কেন আবার কি? সবাই দেখলেন সেলিনার জন্য আনা আমার উপহার গুলো যেন আপনি অনিচ্ছায় গ্রহণ করছেন। নিজের ছেলের বৌয়ের জন্য আনা উপহার কি কেউ অনিচ্ছায় গ্রহণ করতে পারে? আসলে যখন জানলাম, নীলাঞ্জনা সেলিনার জন্য আনা উপহার আপনার হাতে দিয়ে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে, তখন থেকেই ভীষণ হতাশ লাগছিল। ওটা ছিল তারই প্রভাব। এজন্য আপনি অন্য কিছু মনে করবেন না। না না মনে করার কিছু নেই, আমাকে যে আপনারা গ্রহণ করেছেন এটাই বড় কথা। তারপর মিনতি সেনকে বাধা দিয়ে বললেন না না আর দেবেন না। মিনতি সেন বললেন, কিন্তু এটা যে আপনার মেয়ের রান্না। ও যদি দুঃখ পায়। ওতো মেয়ে, দুঃখ পেলে পাবে। কিন্তু আপনি পাবেন না তো।

    একি হল মিনতি সেনর? ২৫ বছর আগের ঘটনা গুলো কেন এক এক করে ভেসে উঠছে। চোখের সামনে ঠিক ছবির পর্দার মতো। প্রতীমবাবু বললেন, কি হল মিস সেন, অমন কাঁপছেন কেন? শরীর খারাপ লাগছে? নিজেকে সংযত করে বললেন, না না। কোন অসুবিধা নেই। আপনি খান, আর যদি খেতে ইচ্ছে না করে তা হলে একদিকে সরিয়ে রাখুন। দুঃখ পেলেন? আজ কাল আর দুঃখ পাইনা মিঃ চৌধুরী। সেই ভাল, দুঃখ একটা বিলাসিতা মাত্র। বিলাসিতা যত বর্জন করা যায় ততই মঙ্গল। আপনি বোধ হয় সম্পূর্ণ ভাবে বর্জন করতে পেরেছেন? জানিনা, তবে চেষ্টার ত্রুটি করিনি। আমাকে শিখিয়ে দিতে পারেন কি ভাবে দুঃখকে বর্জন করতে হয়। প্রতীমবাবু বলেন, এতো অতি সোজা ব্যাপার মিস সেন, কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করুন। শুধু কাজ আর কাজ। দেখবেন দুঃখকে ভাববার সময়ই পাচ্ছেন না। মিনতি সেন বললেন চেষ্টা করব।

    তারপর চুপচাপ দুজন। যেন কারো কোন কথা নেই। মিঃ চৌধুরী নীরবে এটা ওটা নাড়া চাড়া করছেন, বলতে গেলে প্রায় খাচ্ছেন না কিছুই–মিনতি সেন মিষ্টি নিয়ে এলে প্রতীমবাবু বললেন, আমি মিষ্টি খাইনে। খাননা? তাতে কি হয়েছে, আজ না হয় খেলেন। মেয়ের বাড়ীতে এক টুকরো মিষ্টি না খেলে চলবে কেন? তা যা বলেছেন। আহা দিন। অসুবিধা হলে থাক। মুখে বললেও ২/৩টে মিষ্টি নামিয়ে দিলেন প্রতীমবাবুর খাওয়ার থালায়, প্রতীমবাবু কোন রকম প্রতিবাদ না করে খেয়ে নিলেন।

    খাওয়া শেষ হলে মিনতি সেন জল নিয়ে এগিয়ে এলেন। এতীমবাবু বললেন আমি বেসিনে হাত ধুয়ে নিচ্ছি। মিনতি সেন বললেন, বেসিনটা নোংরা আছে, আপনি হাত এগিয়ে দিন আমি জল দিচ্ছি। কিন্তু হাত মুছতে গিয়ে দেখেন পকেটে রুমাল নেই। ধারে কাছে কোন তোয়ালেও নেই সেই বাথরুমে, মিনতি সেন ঘর থেকে একটা নতুন তোয়ালে এনে দিলেন হাত মুছতে।

    প্রতীমবাবু বললেন, এবার আমাকে উঠতে হবে মিস্ সেন। আপনাদের মনে হয় খাওয়া হয় নি। তারপর বললেন দেখি আকবরের হোল কিনা। মিনতি সেন বললেন, আপনি যে এসেছেন এটাই কৃতজ্ঞ চিত্তে মনে রাখা উচিত, সেখানে আবার থাকতে বলি কোন অধিকারে।

    এমন যে সংযত মানুষ প্রতীমবাবু, তিনি যেন কেমন করে বলে ফেললেন, কোন অধিকার কি নেই? অবাক হয়ে তাকালেন মিনতি সেন। আর প্রতীমবাবু কথাটি বলে ফেলে বড় অসহায় বোধ করতে লাগলেন। তারপর নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বললেন, অন্য ভাবে নেবেন না মিস সেন, আসলে সেলিনার আমি কাকা, এইটুকু অধিকারতো দাবী করা যেতে পারে। মিনতি সেন যে কি একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, সেলিনা বলল, কাকু তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছেনা? তুমি যে বললে শিয়ালদার একজায়গায় না গেলেই নয়? তা হলে আর দেরি করছ কেন? হ্যাঁ মা, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমি না গেলে ওদের সব নষ্ট হয়ে যাবে। আজ তা হলে আসি মিস সেন, নমস্কার। নমস্কার, তারপর মিনতি সেন সেলিনাকে বললেন, যাতত মা, ওনাকে একটু গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আয়। নীলাঞ্জনা বলল তুমি যাও মিনতি। সেলিনা বরং এদিকটা একটু দেখুক। অগত্যা মিনতিকেই পায়ে পায়ে এগুতে হয় প্রতীমবাবুর সঙ্গে। গাড়ীতে ওঠেন প্রতীমবাবু। তাকান উভয়ে উভয়ের দিকে। কত কথাই যেন বলার ছিল। কিন্তু কোন কথাই বলা হয় না। প্রতীমবাবু শুধু বল্লেন শরীরের প্রতি যত্ন নেবেন। প্রেসারটা বাড়তে পারে। ওটা চেক করে নেবেন। মিনতি সেন বল্লেন, আবার করে আসবেন? যদি আমার আসাতে অস্বস্তি না হয় তা হলে যেদিন বলবেন সেদিন আসব। আপনার এত কাজ ফেলে পারবেন আসতে? আকবর গাড়ীতে স্টার্ট দিল। প্রতীমবাবুর উত্তরটা শোনা হল না। কিন্তু মিনতি সেন কিছুতেই বুঝতে পারছেনা, যে ঝড় থেমে গিয়েছিল ২৫ বছর আগে, তাই কেন এবং কেমন করে পথভ্রষ্ট হয়ে হঠাৎ মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে সব এলোমেলো করে দিল। ধীরে ধীরে মিনতি সেন উঠে এলেন উপরে।

    রাত প্রায় ১২টা। জবার মা আবার সবকিছু বন্ধ করে এলেন। আমি সেলিনা নীলাঞ্জনা পিসি ও মিনতি সেন এক সঙ্গে খেয়ে নিলাম। জানিনা কেন এবং কি ভাবে পিসির অভিমান জল হয়ে গেছে।

    খাওয়া দাওয়া শেষ হলে, মিনতি সেন বললেন, সেলিনা আজ সারাটা দিন কেমন ঝড়ের মত কেটে গেছে, একটুও বিশ্রাম পাসনি, এবার যা শুয়ে পড়। দেখতে পাচ্ছি সেলিনার দৃষ্টিতে অসহায়তা। কি করবে বুঝতে পারছেনা। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না ওর সঙ্গে এক ঘরে আমিও রাত কাটাবো কি না। সেলিনা এগিয়ে গেল। আমি তখনো দাঁড়িয়ে আছি। মিনতি সেন বললেন কিছু বলবি? না তাহলে বসে আছিস কে? ও তোর জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? অগত্যা আমাকেও সেলিনার পিছু পিছু যেতে হয়।

    অনেকগুলো ঘর নিয়ে মিনতি সেনের বাড়ী। এ ঘরে আগে কোন দিন ঢুকিনি। সুন্দর করে বিছানা পাতা। বিরাট বিছানায় পাশাপাশি বালিশ। খাটটা ফুল দিয়ে সাজানো। সমস্ত বিছানায় শুধু ফুল আর ফুল। বিরাট খাটের দুই পাশে বড় বড় আয়না। শুলে সমস্ত শরীরটা প্রতিবিম্বিত হয় আয়নার মধ্যে। খাট থেকে একটু দূরে দেওয়ালের সঙ্গে বড় ড্রেসিং আয়না। জামা কাপড় রাখার আলনা তার পাশে। তার থেকে কিছু দূরে আলমারী। মিনতি সেনের রুচি বোধের প্রশংসা না করে উপায় নেই। সেলিনা এগিয়ে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। আমি বললাম মেঝেতে বসলে যে, ঠান্ডা লাগবেনা। না লাগবেনা সারাটা দিন কি গরমটা গেল। তারতো কোন আঁচ পেলে না। কি করে পাব বল, আজকের দিনটা যেন তোমারই, কেউ যেন আমাকে চেনে না। সেলিনা হাসছে। হাসছো যে, না হেসে কি করি বল, ঘাড় থেকে নামাতে চেয়েছিলে পারলে না, তাই হাসি পাচ্ছে। ওঃ তাই বল, মানে সারা জীবন এই জীবন্ত বোঝা বয়ে চলতে হবে এইতো। তা একবার ঘাড়ে ওঠ, পরীক্ষা করে দেখা যাক ওজনটা কত। সেলিনা বলল ভয় নেই প্রান্তিক। আমার এত বড় বোঝা বইতে পারবে না, তার থেকে যতটা বইলে তোমার কষ্ট হবে না সেই অংকটা করেই ফেল না। করব, কিন্তু তুমি কি সারা দিনের এই ভাবি পোষাক পরে থাকবে নাকি? কেন এগুলো কি তুমি সহ্য করতে পারছনা? আমি বললাম, দেখ, কিছু কিছু জিনিষ আছে তা ক্ষণিকের জন্য সুন্দর। সর্বক্ষনের জন্য নয়। এই ভারি পোষাক আর গয়নার আড়ালে আসল তোমাকে খুঁজে পাওয়া সত্যিই কষ্টকর। তাই যদি মনে হয়। তা হলে এগুলোকে আস্তে আস্তে খুলে দিয়ে তোমার আসল সেলিনাকৈ খুঁজে নাও না। আমি হাসতে হাসতে এগিয়ে এলাম ওর কাছে তারপর ওর আঁচলে যেইনা হাত দিয়েছি সে যেন তেড়ে এসে বলছে এই করছ কি দাঁড়াও। আমি বললাম, আমি যাকে চাই তাকেই তো খজে দেখছি আবরণ ও আভরনের জঙ্গলে। ও বলল, না লক্ষ্মীটি, তুমি যাও, বোস গিয়ে ওখানে। তোমার পরিচিত সেলিনা হয়েই আমি আসছি? তা হলে হার স্বীকার করলে। ও বলল এ হারের স্বাদ যে আলাদা প্রান্তিক, এখানে যে জয়ী হতে চায় তার মত বোকা আর কেউ নেই। লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে যায় সেলিনা। আর আমি শুধু প্রতীক্ষার প্রহর গুনি।

    ও ঘরে মিনতি সেন ও নীলাঞ্জনা পিসি তখনো কথা বলে চলেছেন। নীলাঞ্জনা বলছেন, আজকের জন্য প্রতীমবাবুকে ধরে রাখতে পারলে না। আমার তো মনে হয় তুমি আরেকটু জোর করলে উনি রাজী হয়ে যেতেন। জানি না নীলাঞ্জনা, উনি যে থাকতে চাননি, যেকোন অজুহাতে চলে যেতে চেয়েছেন এটাই যেন স্বস্তি। এ তোমার স্বার্থ পরের মতো কথা মিনতি। ভাবতে পারছ উনি কখন পৌঁছাবেন বাড়িতে। হয়তো একটু রাত হবে, কিন্তু পোঁছবেন তো। আর পৌঁছালেই কষ্টের লাঘব হবে এক সময়। তার মানে বলতে চাইছে এখানে থাকলে তার কষ্ট হতো। হ্যাঁ নীলাঞ্জনা ভীষণ কষ্ট হতো, সে কষ্ট অসহ্য। তার থেকে আমি যে তাকে ছুটি দিতে পেরেছি, এটাই আনন্দের। নীলাঞ্জনা বললেন তুমি তার কষ্ট দেখছ, নিজের কষ্টটা দেখছনা? নিজেরটা দেখেছি বলেই তো তারটা এমন উপলব্ধি করতে পারছি। তারপর বললেন, যাকগে নীলাঞ্জনা, ছেড়ে দাও ওসব কথা। বরং বল, কি ভাবে প্রান্তিকের বাবা-মা সেলিনাকে মেনে নিতে পারে। ওবা যে মানবে না এমন কোন ইঙ্গিৎ তো নেই, তবে কেন আগে আগে ভাবতে যাবে। তার থেকে বরং সীতাংশুদাকে আসতে বলি। সেই ভাল, তা হলে তুমি তাই কর নীলাঞ্জনা।

    সারারাত নীলাঞ্জনার পাশে এ পাশ ও পাশ করেন মিনতি সেন। নীলাঞ্জনা বলল, মিনতি, কেন মিছেমিছি কষ্ট পাও। সে তোমাকে বুঝাতে পারব না কেন কষ্ট পাই। একটা দুটো বছর নয়। পচিশটা বছর কেটে গেছে। একটা ছোট্ট চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, যদি মনে করেন আমরা এক সাথে পথ চলতে পারব, আমি অপেক্ষা করব। এযে কি কষ্ট তোমাকে বুঝাতে পারবনা। দেখ যতদিন ওকে দেখিনি, এমন হয়নি। কাজের ভিতরে ডুবে থেকে নিজেকে ভুলতে চাই, ভুলতে চাই অতীত। কিন্তু ভোলা কি যায়! ওকে দেখে বুঝতে পারছি কি কষ্ট বয়ে চলেছেন। উনি বয়ে চলেছেন আর তুমি বয়ে চলছোনা? জানিনা নীলাঞ্জনা, কিছুই জানি না। তারপর বললেন জান নীলাঞ্জনা কথার পরে কথা বলতে গিয়ে ওকে যখন বললাম, আপনাকে থাকতে যে বলব সে অধিকার কোথায়? উনি বললেন কোন অধিকার কি নেই? কথাটা বলেই কেমন যেন লজ্জিত হয়ে পড়েন, পরে অবশ্য ব্যাখ্যা কবে যদিও বললেন, আসলে আমি সেলিনার কাকা সেটা কি একটা অধিকার নয়? কিন্তু উনি যা বলতে চেয়েছিলেন, এতো তা নয়, তার ভিতরের না বলা কথা, বলতে চেয়েও বলতে না পারার যন্ত্রণায়, চোখ ফেঁটে জল আসতে চাইছিল, বহু কষ্টে সংযত করলাম। সে সময় নিজে যে কি পরিমান দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম তোমাকে কি বলব। কিন্তু বাঁচাল সেলিনা, ও সেই সময় এসে বলল, কাকু তোমার যে দেরি হয়ে যাচ্ছে। নীলাঞ্জনা বললেন, আমি বুঝি মিনতি, তোমাকে একটা কথা বলব? বল তুমি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এস। তা হয়না নীলাঞ্জনা। কেন হয় না? কেন যে হয়না তা তোমাকে বলতে পারবো না, তবে এটা হয় না এটাই সত্যি। তারপরে বললেন ভুলে যাচ্ছ কেন আমি প্রান্তিকের মা। তুমি কি পারবে সেলিনাকে অস্বীকার করে পরিমলবাবুর কাছে ফিরে যেতে? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নীলাঞ্জনা বলল পরিমলবাবুর সঙ্গে তুমি প্রতীমবাবুর তুলনা করো না, মিনতি, অন্ধকার এবং আলো কখনো এক হতে পারে না। এ তোমার অভিমান। না অভিমান নয়। অভিমানের জন্য চাই বিশ্বাস, অধিকার বোধ, যা তোমাদের আছে, আমার তা নেই। পরিমলবাবু সারা জীবন আমার সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন। শুধু তাই নয়, মিথ্যে অজুহাতে আমাকে মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করেছেন। চিরকাল ছলনার অভিনয় করে আমাকে ঠকিয়েছেন, আমার জীবনের কোন জায়গায় আজ তার জন্য বিন্দু মাত্র করুণা নেই। হয়তো এ তোমার ভুল, ক্ষণিকের জন্য তিনি যেটা করেছেন, সেটাও তার এক চরম অভিমান। নীলাঞ্জনা বললেন, তোমার কথা যদি সত্যি হতো, আমি তোমারই মত কষ্ট পেতাম, আনন্দ আর গর্বে আমার বুক ফুলে উঠতো। কিন্তু তাতো নয় মিনতি। একদিন খুঁথিকে ঠকিয়ে সে আমার কাছে এসেছিল তার অতীতকে গোপন করে। ও যদি গোপন না করে সত্যি কথাটা বলতো, তার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারলেও তারজন্য একটা করে অনুভূতি আমার থাকতো। তবু ওর কাছে আমি কৃতজ্ঞ, যে কটা দিন ছিল ও আমার কাছে, ওর ভালবাসা পেয়েছি, ওর আদর পেয়েছি, ওর স্বপ্নে নিজেও স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু তুমি? আমিও যে ওর কাছ থেকে অনেক পেয়েছি,নীলাঞ্জনা, সে যে আমার সাত রাজার ধন। বলতে পার, কে অমন করে জীবনকে তিলেতিলে ক্ষয় করতে পারে একটা মেয়ের জন্যে? তুমিতো জান ওর সঙ্গে আমার কোন ভালবাসার সম্পর্ক ছিল না। আমাদের বিয়ে হতে যাচ্ছিল সম্বন্ধ করে। কিন্তু ভেঙে গেল একটা দুর্ঘটনায়। তারপর তো অনেক ঝড় চলে গেছে জীবনের উপর দিয়ে। একদিন যখন সেই ঝড় থামল, এসেছিলেন উনি। ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম এ আর হয় না। তার উত্তরে ঐ ছোট্ট চিঠি, ভাবিনি এমনি করে কেউ অপেক্ষা করতে পারেন। কোন ভালবাসার স্মৃতি অনুভূতি এসবের পরশ না পেয়েও যে কোন পুরুষ অপেক্ষা করতে পারেন, ওঁকে না দেখলে আমি জানতেই পারতাম না। ২৫ বছর পরে তোমাদের বাড়ীতে প্রথম দেখে চমকে উঠেছিলাম। বিশ্বাস কর ওকে অনেক কথা জিজ্ঞাসার থাকলেও পালিয়ে বেঁচেছিলাম সেদিন। আর আজতো পালাবারও উপায় ছিল না। আজতো একা পেয়েছিলে তবে জিজ্ঞাসা করলে না কেন? পারলাম না নীলাঞ্জনা, কিছুতেই পারলাম না। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, ও যেন নীলকণ্ঠ। সমস্ত বিষ একাই হজম করে পৃথিবীকে নির্বিষ করেছেন। তারপর বললেন কি অদ্ভুত এই নারীমন তাইনা? কেন? ও যখন হাত মুখ আঁচিয়ে একটা রুমাল খুঁজছিলেন হাত মুখ মোছর জন্য, ধারে কাছে কোন তোয়ালে না থাকায় ছেলে মানুষের মত মনে হয়েছিল হাতের কাছে যখন। কিছুই নেই আছেতো আমার শাড়ীর আঁচল, ওটা দিয়েতো কাজ সারতে পারেন। তা তুমিতো বলতে পারতে। চেয়েছিল মন, বার বার চেয়েছিল, কিন্তু পারলাম না নীলাঞ্জনা কিছুতেই পারলাম না। ২৫ বছর আগে মনকে যে ভাবে প্রস্তুত রাখা যেতো, আজ আর হাজার চেষ্ঠাতেও তা হয় না। তাইতো ঘরে গিয়ে নতুন ভোয়ালে এনে তার হাতে তুলে দিতে হল। শুধু একটা সান্ত্বনা, যে পাজামা পাঞ্জবি পরে ও গাড়ীতে উঠলো, ওটা কাল হঠাৎই কিনেছিলাম। কেনার পরে মনে হল কেন কিনলাম। আজ মনে হচ্ছে ওটা হয়তো ওঁর জন্যই কিনেছিলাম। আমার এই ক্ষুদ্র স্মৃতি থাকুকনা তার কাছে। কেঁদে ফেললেন মিনতি।

    নীলাঞ্জনা ওকে কাঁদতে দিলেন, কোন রকম সান্ত্বনা না দিয়ে শুধু একটা হাত ওর বুকের উপরে রেখে চুপ করে রইলেন। তারপর এক সময় ভোর হয়। ঘুম ভাঙে আমার। কিন্তু সেলিনা তো নেই কাছে। সারারাত তো পাশেই ছিল। যেন কত যুগ যুগান্তরের অতৃপ্ত আদর দিয়ে ওকে ভরিয়ে দিয়েছি, ও-ও দিয়েছে। দুটি যৌবন যা চায় তারই বিনিময় করেছি আমরা, তবু অতৃপ্ত মন ভোরের আকাঙ্খা নিয়ে আবার যখন ওকে কাছে পাওয়ার জন্য পাশ ফিরেছি, দেখি সে নেই। কুঞ্চিত চাদরটি পরিপাটি করে টানা। এতবড় হল ঘরের কোনদিকেই তো ও নেই। তাহলে গেল কোথায়? হয়তো বাথরুমে। অপেক্ষা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম আবার। সেলিনা এল, যেন ভোরের যুই। এই সকালেও স্নান করেছে ও। পরেছে নিভাজ নতুন শাড়ী। লাল পাড় ভিতরের খোল আকাশী নীল। সিঁথিতে দিয়েছে সিঁদুর। কপালে পরেছে টিপ। সারা বিছানায় ছড়ানো ফুল কখন যেন একটা একটা করে তুলে নিয়ে ভরেছে প্লাস্টিকের প্যাকেটে, তারপর তা একদিকে গুছিয়ে রেখেছে, যদিও চুল ভেজায়নি সম্পূর্ণ ভাবে, তবু যেটুকু ভিজিয়েছে তোয়ালে দিয়ে মোছা সত্ত্বেও শিশির ফোঁটার মত চিকচিক করছে দুই কপালে গড়িয়ে পড়ার জন্য। আমি অপলক তাকিয়ে আছি ওর দিকে। লজ্জায় রাঙা হয়ে বলল কি দেখছো। বললাম ভোরের যুঁই। ও কাছে এসে বলল উঠবেনা? ইচ্ছে করছেনা। তাহলে তুমি ঘুমাও, আমি দেখি মা কি করছেন। মন ভীষণ ভাবে চাইছিল আমার ভালবাসা ওর অধর স্পর্শে ধন্য হোক। কিন্তু ও পালিয়ে গেল। বলল না না ওটা রাতের অপেক্ষায় থাকুক। রক্তে যখন নেশা লাগে, রাতকে মনে হয় কতইনা ছোট।

    এরপর একদিন নেশালাগা সেই রাত এল যদিও, কিন্তু এমন তিক্ত ভাবে এল যে, আমর জীবনে যে ঝড় উঠলো। তা যেন আর শেষ হতে চায় না। কি হয়েছে সেলিনার জানিনে। সারাদিনে একবারও মনে হয়নি, ওর মনের মধ্যে অন্য কোন স্রোত বয়ে যেতে পারে। আমার চাওয়ার উত্তরে ও বলল, জানতো প্রান্তিক ভিখিরিকে করুণা করা যায়, দান। করা যায় না। দান গ্রহণ করতে হলে যোগ্যতা থাকতে হয়। সেলিনা এভাবে যে কথা বলতে পারে ভাবনারও অতীত। অপমানে ভিতরটা জ্বলতে লাগলো। প্রতি উত্তরে বললাম তা ঠিক, তবে গ্রহীতার যেমন যোগ্যতা থাকা দরকার, দাতারও তা থাকা দরকার। দাতার যে যোগ্যতা নেই জানলে কি করে? যে ভাবে জানতে পারলে গ্রহীতার যোগ্যতা নেই। ও বলল, যোগ্যতা যে তোমার নেই সে তো পরীক্ষিত সত্য। মানে? মানে তুমি বোঝনা? না বুঝিনা। তাহলে বুঝেও কাজ নেই। দেখ সেলিনা, এই সব কিছুর জন্য আমি দায়ী নই। দায়ী তুমি? আমি জানি, এবং তোমার থেকে ভালভাবেই জানি। যোগ্যতার নিয়ন্ত্রক কেবলমাত্র আমি। তার ভালোমন্দের দায়িত্বও আমার, আমি তোমাকে চেয়েছিলাম–নিজের যোগ্যতায়। সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তোমাকে ছিনিয়ে এনেছি, আজ কেবল তুমি আমারই। তোমার নিজস্ব কোন স্বতন্ত্রতা থাকতে নেই থাকতে পারে না। ভালো লাগা মন্দ লাগার অধিকারটুকুও শুধু আমারই থাক। বললাম এটাই তোমার শেষ কথা? শেষ কথা বলে কোন জিনিষ হয় না প্রান্তিক। আমি চাইনা আমার ভালবাসার নেশায় তুমি ভেসে যাও। তোমার ভবিষ্যৎকে আমি এভাবে নষ্ট করে দিতে পারি না। তার মানে তুমি বলতে চাও তোমার দাম্ভিক অহংকারের কাছে আমাকে মাথা নত করতে হবে? এতে নতুন কথা নয়। সে তো তুমি করেছছই। আর করোছো বলে তোমার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে। তাই সেলিনাকে আদর করতে গিয়ে রেহানার মুখ ভেসে ওঠে। সেলিনা নামে ডাকতে গিয়ে অসতর্কে উচ্চরিত হয় রেহানা। তবু তুমি বলতে চাও তুমি শুধু আমারই। তার থেকে তুমি একটা কাজ কর না প্রান্তিক, আমার নামটা বদলে নিয়ে রেহানা করে দাও। তাতে তোমারও কষ্ট হবে না, আমিও বাঁচব।

    এরপর আর কথা চলে না। পৌরুষে আঘাত লাগা সত্ত্বে বললাম, আমাকে তুমি জান সেলিনা, আমার দোষ গুণ সব মেনে নিয়েই আমাকে তুমি গ্রহণ করেছিলে, রক্তে মিশে আছে যে স্মৃতি তাকে ইচ্ছে করলে কি মুছে দেওয়া যায়? জানি যায় না, তা হলে দ্বিচারিতা না করে তাই বলতে পারতে। বললে কি করতে? তোমাকে মুক্তি দিতাম। পারতে না সেলিনা, আজ নিজেকে যতই শক্তিশালী মনে করোনা কেন, আমাকে হাজার অপবাদ দিলেও আমাকে মুক্তি দেবার শক্তি তোমার ছিল না, আজও নেই। কেন মিথ্যে দম্ভ কর। গোলাপের সৌন্দর্য তার কাটায় লোপ পায় না, কিছুটা দুর্বলতায় ভালবাসা উজ্জ্বলতা পায়। এটা যে তুমি বোঝনা তা নয়। তবু তুমি আঘাত দিতে চাও। দিয়ে যদি তুমি সুখী হও, বুক পেতে দেব তোমার আঘাত গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু মাত্র কদিনেই তোমার এই পরিবর্তন আমাকে যে কি কষ্ট দিচ্ছে তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। এরপরেও কি আমাদের ভালবাসা শুধু দেনা পাওনার হিসাব কববে না? তুমিতো নিজেই বলেছো রেহানা যদি কোনদিন ফিরে আসে তার হাতে আমাকে তুলে দিয়ে তুমি যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাবে। এখনো বলছি। তাই যদি মনে হয়, তাহলে আমার মনের অসতর্ক মুহূর্তে উচ্চারিত রেহানা নামটাকে এত ভয় পাও কেন? তারপর বললাম প্রতীমবাবু ও মিনতি সেন, কেউ কাউকে পায়নি কোন দিন, তাই বলে তাদের জীবন উপলব্ধিকে তুমি অস্বীকার করতে পারবে? তারপর বললাম বলত সেলিনা ওদের নিবেদিত ভালবাসার কোন তুল্য বিকল্প দেখেছো কোথাও? না দেখিনি। তাই বলে না পাওয়াব মধ্যে যে সত্য আছে তার গুরুত্বকে অস্বীকার না করেও বলব, যে জ্বালা শুধু কাদায় আনন্দে ভাসায় না, তা আমি চাইনে। ভুল বললে সেলিনা, ওদের ওই অবয়বহীন ভালবাসায় যদি আনন্দ না থাকতো পৃথিবীর কোন কর্তব্যই তাদের পক্ষে পালন করা সম্ভব হতো না। থাক এসব কথা, রাত হয়েছে অনেক এবার ঘুমিয়ে পড়। তুমি ঘুমিয়ে পড়। আমার যখন ঘুম আসবে তখন আমি নিজেই ঘুমাবো। আমি ঘুমাবো আর তুমি জেগে থাকবে, আমি ঘুমাতে পারব? যদি না পার। তাহলে তুমিও জেগে থাক। ঠিক আছে দেখি তোমার সঙ্গে জেগে থাকা যায় কি না। ইস্ কত যেন ভালবাস আমায়? আমি ওব একটা হাত নিজের বুকের পরে রেখে বললাম, সত্যি তোমায় ভালবাসি না? তুমি বলত, কেমন করে বললে একথা? বলতো আমি কে? আবর সেই ছলনা আবার সেই কথার মারপ্যাঁচ উত্তরে বললাম তুমি! তুমি! ও জেদ ধরে বলল তুমি তুমি কি, বলনা আমি কে? আমি পাশ ফিরে ওকে আমার একেবারে বুকের পরে টেনে নিয়ে বললাম, তুমি আমার সেলিনা, কেবল আমারই সেলিনা। না গো আমি শুধু সেলিনা নই। আমি সেলিনার মধ্যে রেহানা। তারপর বলল তোমার কষ্ট আমি বুঝি প্রান্তিক। শুধু দুঃখ হয় যখন অনুভব করি তুমি আমার কষ্টটা ঠিক মত বোঝ না। কে বলেছে বুঝিনা? সেলিনা বলল আমি বলছি আমার মন বলছে। তা না হলে এক বারও কি তুমি আমার কষ্টের কথা জানতে চাইতে না? জানতে চাইতে না আমার এত কষ্ট কি ভাবে লাঘব হতে পারে। তারপরে বলল তুমি ঘুমিয়ে গেলে আমি যে বাকি রাতটা না ঘুমিয়ে কাদি একবার কি জানতে চাইতেনা কেন আমার চোখে জল? ওর কথা শুনে নিজের পরে ধিক্কার হয়, আমি কি সত্যিই অন্ধ? উত্তরে বলি, সেলিনা প্রেমের দেবী দিয়েছেন আমার ভিক্ষা পাত্র পূর্ণ করে, আমি যে দীন ভিখারি। তাই হয় তো বুঝিনা তোমার আসল কাটা কোথায়? সেলিনা বলল তাই বলল। তোমাদের মহাদেবতো স্বয়ং ভিখিরি। হিন্দু কুমারীতো তবু তারই মত বর খুঁজে ফিরেছে যুগে যুগে। তারপর আমাকে নিবিড় ভাবে আকর্ষণ করে বলল আমার মাথা ঠিক ছিল না। আর আমি যখন তোমারই, পারলে না আমায় আঘাত করতে? আঘাত যে তোমাকে অনেক দিয়েছি তোমার কষ্টই তো তা বলে দিচ্ছে। আরো আঘাত চাও? হ্যাঁ চাই, যত পার আমায় আঘাত কর। আঘাতে আঘাতে আমায় তুমি তোমার করে নাও প্রান্তিক। সেলিনার মধ্যে বেঁচে থাকুক তোমার রেহানা, ও মারা গেলে যে হারিয়ে যাবে তোমার সেলিনাও। এখনো অভিমান। না গো, বিশ্বাস করো, যতক্ষণ তোমায় পাব, যেন সবটুকু তোমাকে পাই। আর তোমার পূর্ণতা তো রেহানা ও সেলিনার প্রেমে। তাহলে কেন কষ্ট পাও? আমার তো কোন কষ্ট নেই। তারপর বলল কিছু চাইবেনা? চাইবো? না তুমি দাতার মত দুহাত ভরে দেবে? আজ আমি শুধু গ্রহণ করব। ভিখিরি মহাদেবের ভিক্ষের দানে নিজেকে নেব পূর্ণ করে, দেবেনা? দাও প্রান্তিক দাও আমাকে পূর্ণ করে, তোমার প্রেমে, তোমার ভালবাসায়, তোমার অতৃপ্ত আকার সর্বগ্রাসী বন্যার মতো আমায় তুমি ভাসিয়ে নিয়ে যাও প্রান্তিক।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅগ্নিপরীক্ষা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }