Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প813 Mins Read0

    ১৮. পরীক্ষার মাস খানেক বাকি

    পরীক্ষার মাস খানেক বাকি আছে। মিনতি সেন একদিন সেলিনাকে ডেকে বললেন, তোর মা কাল ফোন করেছিল একবার ওখানে যেতে। যাবি আজ? নিশ্চয়ই যাব। তা হলে প্রান্তিককে বল। তুমিও চল না। দূর পাগলি, তোরা যাবি মায়ের ওখানে আমি কেন যাবো? মিনতি সেন আর কোন কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মন দিলেন।

    আমাকে যখন বলল, আমি সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম। কয়েকদিন নীলাঞ্জনা পিসির জন্য ভীষণ মন খারপ করছিল। সেলিনা বলল, একটা কথা বলব? বল। তোমার পরীক্ষার আর কদিন বাকি আছে? ঠিক মত ধরলে ২৫ দিন। শেষ হতে আরো ১০ দিন। সেলিনা বলল তার মানে মোট ৩৫ দিন। এই ৩৫টা দিন তুমি আমাকে রেখে আসবে মায়ের কাছে? আমাকে বুঝি ভাল লাগছে না। তারপরে হেসেবললাম, বেশ রেখে আসব, কিন্তু ওখানে এতদিন থাকতে চাইছো কেন? দেখ মায়েরও একটা মন আছে। তোমার পরে তারও একটা দাবী আছে। কিন্তু সত্যি করে বলতো, মায়ের সেই দাবী কি তুমি পূরণ করেছে আরো বলল, তুমি হয়তো ভাবছো তোমার মায়ের শূণ্যতা যতবেশি পূরণ করতে পারবে ততটাই তোমার লাভ? বুঝলাম না। তুমি ভালো করে জান, তুমি না চাইলেও তোমার দাদুর এই বিশাল সম্পত্তির মালিকানা একদিন তুমি পাবেই। তোমার মা, এর কোন কিছুতেই কোন দিন হাত দেবেন না। আর সেই কৃতজ্ঞতায় তুমি এখান থেকে যেতে পারছ না। কিন্তু আমার মাতো তোমার পিসি, আজকের তোমাকে গড়ে তোলার কারিগরতো আমার মাই, তুমি অস্বীকার করতে পার? যা সত্য, তাকে অস্বীকার করা যায়? তা হলে এতদিনেও কয়েকটা রাত সেখানে থাকলেনা কেন? হয়তো তুমি ঠিক বলেছো সেলিনা আমি যে তা বুঝিনা তাও নয়, কিন্তু পিসিও তো একবারও বললেন না, তোরা কদিন থেকে যা প্রান্তিক। তিনি হয়তো অভিমানে বলেননি, তাই বলে তুমি থাকবেনা কেন? তাছাড়া মায়েরতো আজ কোথাও কেউ নেই। একটুও বুঝবেনা তার কথা?

    ও যা বলছে কোন ভাবে তা অস্বীকার করতে পারিনা। বললাম, তাহলে পরীক্ষার এ কয়দিন আমরা ওখানেই থাকি। আমি কিন্তু সে কথা বলিনি প্রান্তিক। তারপর বলল দেখ, একটা কথা বলছি, তুমি অন্য ভাবে নিওনা। বল। আমি তোমার কাছে থাকলে তোমার পড়াশুনার ক্ষতি হবে। আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমি যদি বলি তার উল্টোটা হবে। ও মৃদু হেসে বলল উল্টো টা যে হওয়ার নয় তার প্রমাণ গত একমাস। সুতরাং আমার পরে রাগ করোনা লক্ষ্মীটি, মায়ের ওখানে গিয়ে আমি যে কোন অজুহাতে থেকে যেতে চাইব। তুমি এতে না করোনা। কিন্তু পিসি যদি কিছু বলেন বা কারণটা জানতে চান? দোষটা নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিও। বলবে তোমাব পড়াশুনার অসুবিধা হবে। আচ্ছা তাই হবে।

    সিদ্ধান্তটাকে বাস্তবায়িত করতে খুব একটা অসুবিধা হয় নি। ওনারাও হয়তো মনে মনে চাই ছিলেন এমন কিছু। কিন্তু পিসির কাছে দুই দিন থাকতে হয়েছিল।

    এই দুইদিনের মধ্যে প্রতীমবাবু একদিন ফোন করেন মিনতি সেনের বাড়ীতে। হ্যালো! মিনতি সেন ইজ স্পিকিং। ও নমস্কার, আমি প্রতীম চৌধুরি বলছি। নামটা শোনামাত্র অকারণ হাতটা কেঁপে গেল মিনতি সেনেব। কোন ভাবে নমস্কার করে বললেন কেমন আছেন? উত্তর এড়িয়ে গিয়ে প্রতীমবাবু বললেন, প্রান্তিক বা সেলিনা কেউ কি কাছে আছে? খুব দরকার? হ্যাঁ দরকার একটু ছিল। আমাকে বলা যায় না? যায়, তবে কিভাবে নেবেন। তা হলে থাক, আমি ওদের সংবাদ পাঠিযে দেবো। না দরকার নেই আপনাকেই বলছি, মিনতি সেন শোনার অপেক্ষায় চুপ করে থাকেন। প্রতীম চৌধুরী বলেন, প্রান্তিক কি আজ একবার আসতে পারবে? আজই? কেন অসুবিধা হবে? না, তা নয়, আসলে ওরা নীলাঞ্জনার ওখানে। ওদের বাড়ীতে তো কোন ফোন নেই। নীলাঞ্জনা অফিসে গেলে সংবাদটা দেওয়া যাবে। তা হলে থাক দরকার নেই। বরং ওরা আসলেই সংবাদটা দেবেন। তা না হয় দেব, কিন্তু আপনার প্রয়োজনটা কিন্তু বলেননি, তাছাড়া আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার শরীরটাও ভাল নেই। না না শরীর ঠিক আছে। তবে যা মনে হচ্ছে সেটা ২/৩ দিন অফিসে যাচ্ছিনা বলেই হয়তো মনে হচ্ছে। কেন অফিসে যাচ্ছেন না কেন? ভাবলাম ২/১ দিন বিশ্রাম নেওয়া যাক তাই আর কি? আপনার কোযর্টার কি অফিস লাগোয়া? হ্যাঁ অফিস কমপাউন্ডের মধ্যে তবে আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই, প্রান্তিক চেনে। আজো অফিসে যাবেন না। না ভাবছি আরো কয়েকটি দিন বিশ্রাম নিয়ে দেখি। কাজের মধ্যে আনন্দ পাওয়া যায় না বিশ্রামের মধ্যে। সেলিনাকে পাঠিয়ে দেব? কয়েকদিন থেকে আসবে আপনার কাছে। না না দরকার নেই মিস সেন। বড্ড বেশী লোভ হয়ে যাবে তাছাড়া প্রান্তিকের তো পরীক্ষা এসে গেলো মনে হয়। তারপর বেশ জোরের সঙ্গে বললেন কোন দরকার নেই মিস সেন বরং আজ বা কাল যদি কিছুক্ষণের জন্য প্রান্তিক আসতে পারে ভাল হয়। আচ্ছা দেখছি, ধন্যবাদ। ফোন ছেড়ে দিলেন প্রতীমবাবু। মিনতি সেন ভাবছেন কি করবেন, অফিসে যাচ্ছেন না ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন, অথচ বলছেন শরীর ঠিক আছে। এখন যদি প্রান্তিককে বলি, তাহলে হয়তো তার পড়াশুনা বন্ধ করে ওখানে কয়েকদিন যাতায়াত করবে অথবা থাকবে। অসম্ভব নয় তাতে ওর পড়াশুনার ক্ষতি হবে। এমনিতেই তো যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। এক নিজে গিয়ে দেখে আসা যায়। মনে মনে ভাবলেন যদি কিছু ভাবেন? একটা মন যুক্তি খাড়া করে ভাবে ভাববেন, তাই বলে এত আশা করে যিনি ফোন করলেন, তার প্রয়োজনটাও তো জানা দরকার। অবশেষে অফিসে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে পড়লেন মিনতি সেন, আর এই প্রথম কোন এক জনের কাছে যাচ্ছেন মিনতি সেন, যিনি তার প্রেমিক নন, তার স্বামী নন, অথচ তার মনের অবচেতনায় আজো যিনি বেঁচে আছেন স্বপ হয়ে, যে স্বপ্ন কোন দিনই হয়তো পূর্ণ হবে না। পূর্ণ হওয়ারও নয়। পা কাঁপছে, বুকের মধ্যে দুরুদুরু একটা আশঙ্খ। কি জানি যদি কিছু মনে করেন উনি। আবার ভাবেন যদি কিছু মনে করেন, করবেন। কিন্তু যে মানুষটা তারই একটা ছোট্ট উত্তরের জন্য আজ দীর্ঘ ২৫টি বছর জীবনের স্বাদ আহ্লাদ ত্যাগ করেছেন, বিপদের সময় তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো কি তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? প্রতীম বাবুর অফিস চত্তরে ঢুকে, কেমন যেন পা দুটি আর চলতে চাইছেনা। একটা ভীতি ময় অনুভূতি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একজন বেয়ারাকে ডেকে জিজ্ঞাস করলেন, বড় সাহেবের বাংলো কোনটি? বেয়ারা কোন রকম প্রশ্ন না করে তাকে নিয়ে এলেন বড় সাহেবের বাংলোতে। কাঁপা কাঁপা হাতে বেল টিপলেন মিনতি সেন। একজন নার্স বেরিয়ে এলেন। কাকে চাই? সাহেব ঘরে আছেন? হ্যাঁ। আছেন একটু ডেকে দেবেন? উনিতো অসুস্থ? অসুস্থ? কতদিন। তা বেশ কিছুদিন হল। আপনি? আমি এখানকার একজন সিস্টার। ওনাকে দেখাশুনা করি। আপনি একাই দেখাশুনা করেন? হ্যাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আমি দেখাশুনা করি। আর রাতে, ওর অফিসের একজন বেয়ারা থাকেন। মিনতি সেন জানতে চাইলেন ভিতরে আসতে পারি? হ্যাঁ হ্যাঁ আসুননা।

    মিনতি সেন কয়েকটা ঘর পরে গিয়ে দেখেন একা নিঃসঙ্গ ভাবে শুয়ে আছেন প্রতীমবাবু। ঘুমাচ্ছেন। মিনতি সেন বললেন, যখন জাগবেন তখনি কথা বলা যাবে। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না। আমাকে চেনার কি খুব দরকার? না এমনিতে কিছু নেই, তবে যদি দেরি না করতে পারেন, তা হলে সাহেবকে বলতে হবে তো? না, তার কোন দরকার নেই, আমি ওর সঙ্গে দেখা করেই যাবো। তবুও যদি কিছু মনে না করেন। বলুন। আমি সাহেবকে বলেছিলাম, আমাকে যদি আজ ছুটি দিতে পারেন আমার বাবা খুব অসুস্থ। উনি বলেছিলেন দেবেন। ওঁর কে এক আত্মীয় ভাইপো বোধ হয় এসে থাকবেন। আমি সেই ভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। কিন্তু পরে উনি লোক পাঠিয়ে জানালেন যদি অন্তত ঘণ্টা দুয়েক থেকে যাই। দেখুন প্রায় ৪ ঘন্টা হয়ে গেছে, কিন্তু সাহেব এখনো কিছু বললেন না। মিনতি সেন বললেন তবে চলে গেলেন না কেন? কি করে যাই এই অসুস্থ মানুষটাকে ফেলে বলুন? এখন যদি আপনি কিছুক্ষণ থাকেন, তা হলে আমি কথা দিচ্ছি, ঘণ্টা চারেক পরে আমি ফিরে আসবো। তারপরে আকুল ভাবে বললেন, আমি না যেতে পারলে ভীষণ অসুবিধা হবে। মিনতি সেন বললেন, আচ্ছা আপনি যান আমি থাকবো আর যাওয়ার আগে শুধু বলে যান কখন কি খাওয়াতে হবে। মেয়েটি যেন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। বলল, আপনি আমাকে বাঁচালেন। তারপর ও সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। মিনতি সেন ততক্ষণে, ঘরের এলোমলো জিনিষগুলো গুছিয়ে রাখলেন। যেখানে যেগুলি রাখলে সুন্দর হয় সেখানে সেগুলো রেখে বদ্ধ ঘরের জানালা গুলো খুলে দিলেন। বাইরের ঠান্ডা হাওয়া এসে ঢুকলো ঘরে। জানালা দিয়ে ক্যামপাশের বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ দেখা যাচ্ছে। মিনতি সেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন প্রতীমবাবুর মাথার কাছে মুখোমুখি। কি কাহিল হয়ে গেছেন, কদিনে। ভীষণ মায়া হতে লাগল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি হয়েছে। জুলপির কাছে চুলে পাক ধরেছে সঙ্গে গাম্ভীর্য মিশে তাকে যেন আলাদা সৌন্দর্যের অধিকারী বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ পাশ ফিরে শুতে গিয়ে চোখ মেলে তাকাতে গিয়ে মিনতি সেনের চোখে চোখ পড়ল। অবাক হয়ে বললেন আপনি? উঠে বসতে চেষ্টা করলেন প্রতীম চৌধুরী। মিনতি সেন তাকে বাধা দিয়ে বললেন উঠবেন না। কতক্ষণ এসেছেন? তা প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হবে। অথচ আমাকে ডাকেন নি? না ডাকিনি কারণ আপনার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি। এরপর স্মিত হেসে বললেন, তাহলে ঈশ্বরের প্রতি আপনার বিশ্বাস ভেঙে গেছে কি বলেন? বুঝতে পারলাম না। কেন মাত্র কয়দিন আগে তো বলেছেন, ঈশ্বর অপনাকে অসুস্থ করতে ভুলে গেছেন। একটু লজ্জা পেয়ে প্রতীমবাবু বললেন, আপনি কেন কষ্ট করে আসতে গেলেন? মেয়েটি আবার কোথায় গেল কে জানে? কে আপনার নার্সতে? হ্যাঁ? ওকে তো আপনি আজ ছুটি দেবেন বলেছিলেন। বলেছিলাম, কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম প্রান্তিক আসতে পারবেনা, তখন বাধ্য হয়ে ওকে আবার ডেকে পাঠাতে হলো। খুব ভাল। এই মন নিয়ে আপনি নাকি মানুষের উপকার করেন। তারপর বললেন যে মেয়ে তার অসুস্থ বাবাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি পায় না, সেই মন নিয়ে মানুষের কষ্ট বুঝবেন কি করে? তারপর বললেন তা ও যে চার্ট দিয়ে গেছে, তাতে তো আপনার লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। কি খাবেন? যদি ও কিছু করে গিয়ে থাকে ভাল, না হলে খাওয়া আজ আর হবে না। বাঃ চমৎকার। এরপর মিনতি সেন বললেন এতবড় কোম্পানীর সর্বেসর্বা আপনি। অজস্র প্রতিষ্ঠান চালান, তারা পালা করে কেউ থাকতে পারল না আপনার দেখাশুনার জন্য? প্রতীমবাবু চুপ করে আছেন, কি উত্তর দেবেন এর? ম্যানেজমেন্ট তাকে নাসিং হোমে থাকতে বলেছিলেন, তিনি রাজী হননি। তারা যে পালা করে থাকবেন, সে উপস্থিতির আর্জিও মঞ্জুর হয়নি। একথা কি করে বলা যায়। মিনতি সেন ভিতরে গিয়ে কফি এবং বিস্কুট নিয়ে এলেন। নিন খেয়ে নিন। কোথায় পেলেন? বা অদ্ভুত প্রশ্ন তো? আপনার ঘরে সবই আছে, আর আমি একটি মেয়ে, কোথায় পেয়েছি এটাও আপনাকে বলতে হবে? প্রতীমবাবু বললেন, আপনার কফি? আনি বলে মিনতি সেন, আরেক কাপ কফি নিয়ে এলেন। তারপর বললেন, দাড়ি কামাননি কেন? পাজামা পাঞ্জাবিও তো বেশ কয়েকদিন পরে আছেন মনে হচ্ছে? কফিটা খেয়ে ও গুলো ছেড়ে দিন। কি করবেন? ভয় নেই কিছুই করবনা, বাথরুমে রেখে যাবো। তারপর বললেন, কি অদ্ভুত মানুষ আপনি, সত্যি কথাটিও বলতে পারেন না। প্রতীমবাবু বললেন সত্যি কথা না বললে আপনি এলেন কেন মিস সেন? মৃদু হাসলেন মিনতি সেন এবং বললেন আপনার এই অবোধ্য ভাষা কজনে বোঝেন বলুন তো। জানিনা, কিন্তু আপনি যে বুঝেছেন, আপনি কি তা অস্বীকার করতে পারবেন? তারপর বললেন এই মন নিয়েই তো আপনি সেদিন বলেছিলেন কোন অধিকারে আমাকে থাকতে বলবেন ম্লান হেসে এরপর বললেন আজ কি প্রশ্ন করা অসঙ্গত হবে, যে কোন অধিকারে আপনি এলেন?

    মিনতি সেনের মনের মধ্যে চলছে সাগরের উন্মতা। ঢেউয়ের পরে ঢেউ এসে ভেঙে দিচ্ছে তার চিন্তার সাবলীলতা। বললেন, আমার না হয় আপনাকে থাকতে বলার অধিকার ছিল না। কিন্তু আপনার তো ছিল, সেই অধিকারটা কেন প্রয়োগ করলেন না। কেন অতরাতে মিথ্যে অজুহাতে ফিরে এলেন? সারাটা জীবনতে আঘাত পেয়ে চলেছেন, আর কত আঘাত পেতে চান? অবাক হয়ে প্রতীমবাবু বললেন, আঘাত? না মিস সেন, আঘাত আমার বুকে বাজেনা। নিজের বুকে বাজেনা বলে বুঝি অন্যের বুকে তা ফিরিয়ে দিয়ে আনন্দ পান?

    মিনতি সেন উঠে চলে গেলেন। তারপর কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বললেন, গায়ে কি এখনো জ্বর আছে? না, তা হলে, চলুন বাথরুমে। ভাল করে মাথায় জল দেবেন। গা টাও ভাল করে মুছে নিতে পারবেন। কিন্তু। আবারও সেই মৃদু হাসি মিনতির ওষ্ঠে। বললেন আমাকে স্পর্শ করতে যদি সঙ্কোচ বাধা না হয়ে দাঁড়ায় তাহলে আমার কাঁধে ভর দিন। তারপর চলুন। প্রতীমবাবু বললেন, না থাক, মিস সেন। কি দরকার, একটা দিনের আনন্দ যজ্ঞে ভাগ বসিয়ে। তার থেকে যেমন আছি তেমনিই থাকি না। আমার তো অসুবিধা হচ্ছে না। মিনতি সেন বললেন, জীবনে একটা দিনের স্মৃতি কি কম? তুচ্ছ ঘটনায় কত জীবন উৎসগীত হয়ে যায় জানেন? জানি। তাহলে? প্রতীমবাবু বললেন আপনি বোধ হয় জানেন না তুচ্ছ ঘটনায় উৎসগীত সেই জীবন, কি ভাবে তার দেনার ঋণ শোধ করে চলে। জানি। জানেন? না জানলে, এলাম কি করে? তারপর বললেন আর কথা বাড়াবেন না, এমনিতেই লাঞ্চের দেরি হয়ে গেছে।

    মিনতি সেন কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন, তবু সঙ্কোচে আড়ষ্ট প্রতীমবাবু বললেন, আপনি আগে আগে চলুন, যদি অসুবিধা হয় আপনার সাহায্য নেবো। মিনতি সেন বললেন আপনি কারো কষ্ট বোঝেন না তাই না? হয়তো হবে মিস সেন। আসলে, আমরা কেউ কারো কষ্ট বুঝিনা, অথচ নীরবে বয়ে চলি তা। তাহলে খানিকটা বোঝা নামিয়ে হালকা হতে চেষ্টা করুন না। বেশ। প্রতীমবাবু খাট থেকে নেমে হাত রাখলেন মিনতি সেনের কাঁধে। আর তাতেই ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠলো তার সমস্ত শরীর। প্রতীম বাবু বললেন, একি হল মিস্ সেন? শরীর খারাপ লাগছে? না, চলুন।

    রেজার এগিয়ে দিয়ে মিনতি সেন বললেন, দাড়িটা কেটে ফেলুন আমি আছি। আর মনকে বোঝাবার চেষ্টা করুন আপনার কোন কষ্ট নেই। আপনার কিছুই হয়নি, আপনার কোন কিছুরই অভাব নেই। সবই তো আছে আপনার। দেখবেন শরীরের কষ্ট এমনিতেই চলে গেছে। আশ্চর্য দুটো চোখ মেলে তাকালেন প্রতীমবাবু। মিনতি সেনও এই প্রথম বার সরাসরি তাকালেন তার দিকে। প্রতীমবাবুর দাড়ি কামানো হয়ে গেলে, মিনতি সেন এগিয়ে এসে, তার মাথাটা ভাল করে ধুয়ে দিলেন, জামাটা খুলে ফেলে, গীজারে করা গরম জলে গামছা ভিজিয়ে ভাল করে মুছিয়ে দিলেন সমস্ত শরীর। তারপর বললেন, এই নিন, পাজামা পাঞ্জাবি, ওটাকে খুলে রেখে, এটা পরে নিন। আর হয়ে গেলে আমাকে ডাকবেন, আমি বাইরে আছি। প্রতীমবাবু কোন রকম অবাধ্য না হয়ে তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দরজার বাইরে পা দিলে মিনতি সেন এগিয়ে এসে তার হাতটা নিজের কাঁধের পরে নিয়ে বললেন চলুন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতীমবাবু মাথার চুলটা ঠিক করে নিয়ে বিছানায় বসতে গেলে মিনতি সেন বললেন, খাবেন না কিছু? অসহায় শিশুর মত প্রতীম বাবু বললেন খাওয়াতো দরকার কিন্তু আছে কি কিছু? আবার সেই মধুর হাসি মিনতি সেনের ওষ্টাধরে মিলিয়ে গেল। বললেন, ডাইনিং টেবিলে আসুন। মিনতি সেন খাবার সাজিয়ে দিলে অবাক হয়ে প্রতীমবাবু বললেন, এসব আপনি কোথায় পেলেন মিস সেন। হাসি আড়াল করে বললেন আপনার বান্না ঘরে। আপনি খাবেন না? খাবো, আপনি আগে খেয়ে নিন। তা হয় না, আপনিও বসুন। আপনি বড় বেয়াড়া তর্ক করেন, আগে খেয়ে নিন, তাছাড়া এসময় আমি খাইনা। প্রতীমবাবু এর পরে আর তাকে জোর করলেন না। এমনতেই, কেন যেন মনে হচ্ছে অনেক বেশী দাবী করা হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু শেষ হতে প্রায় ৪টা বেজে গেল। মিনতি সেন বললেন এবার আমাকে যেতে হবে। আশা করব কাল না হলেও পরশু আপনি অফিসে জয়েন করতে পারবেন।

    কে যেন বেল দিল। মিনতি সেন এগিয়ে এসে দেখেন সকালের সিস্টার। উনি খেয়েছেন তো? সে আপনি দেখবেন, আপনার পেসেন্ট ঠিক মত শুশ্রূষা করা গেছে কি না। কিন্তু সিষ্টার ঘরটাকে এমন নোংরা করে রেখেছিলেন কেন? পেশেন্টের জামা-প্যান্ট তো মনে হয় কয়েকদিন ধরে পাল্টাননি, জানলাগুলো বন্ধ রাখেন কেন? শুধু ওষুধ খাওয়ালে কি রোগী চিকিৎসা হবে? ভয়ে ভয়ে সিষ্টার বললেন উনিতো কথা শুনতে চাননা। কথা না। শুনলে জোর করে শোনাবেন। তারপর প্রতীমবাবুকে বললেন দেখুন মিঃ চৌধুরী সিষ্টারের কথার অবাধ্য হবেন না। তারপর বেরিয়ে এলেন মিনতি সেন একবারও পিছন ফিরে তাকালেন না।

    গতকাল আমার পবীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম সেলিনা–পিসিকে নিয়ে আসবে। কিন্তু আসেনি। মিনতি সেন বললেন আজ কি তুই যাবি তোর পিসির ওখানে? কেন? বা রে? মেয়েটা ওখানে কতদিন থাকবে? ওকে নিয়ে আসবি না? আজ আমার কাজ আছে মা। অফিস থেকে ফেরার পথে তুমি যেওনা। কেন তোর কি নিয়ে আসূতে লজ্জা করছে? না। তবে? আমিতো বলেছি আমার কাজ আছে। তুমি যেতে পারবেনা? দেখি বলে অফিসে বেরিয়ে গেলেন মিনতি সেন।

    আধ ঘন্টা পরে ফোনটা বেঝে উঠলো। হ্যালো। বলতো কে বলছি? সেলিনা। তা হলে চিনতে পারছ? কবে আসছ? মা যাচ্ছেন বিকেলে। তুমি আসবে না? কেন? ভীষণ ভাবে একটা সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছে। পিসি কোথায়? অফিসে। তুমি কোথা থেকে ফোন করছ? রাস্তার একটা বুথ থেকে। তা হলে নুন শশাতে চলে এস। বললাম মা আবার কখন যাবে কে জানে। যদি গিয়ে আবার তোমাকে না পান, কষ্ট পাবেন। ও জোর করে বলল কিছু কষ্ট পাবেননা। তুমি এস তো। কতদিন তোমাকে দেখিনা। এরপর সিনেমা দেখে আমরা যখন এলিট থেকে বেরোলাম, একেবারে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল অনুতপার সাথে। আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে পাশে সরে গিয়ে দাঁড়ালো সেলিনা। হাসতে হাসতে অনুতপা বলল নতুন বৌকে নিয়ে সিনেমায় এসেছিলে? সিনেমায় এসেছিলাম ঠিকই, তবে নতুন নয় বেশ কিছুদিনের পুরানো বৌকে নিয়ে। হেসে উঠলাম আমরা সবাই। তারপর অনুতপা বলল, তুমি কিন্তু ডাবল লাভ করেছে প্রান্তিক। মানে? পরিচিত যে কেউ হঠাৎ ওকে দেখে বলবে রেহানা। অথচ আমরা তো জানি ও সেলিনা। আমি হাসতে হাসতে বললাম তুমি যা বলেছে, তাইতো আমিও ওকে প্রায়ই ভুল করে রেহানা বলে ডেকে ফেলি। তাতে ও রাগ করে না? ওকেই জিজ্ঞাসা করে দেখোনা। সেলিনা হাসছে। অনুতপা বলল, তার আর দরকার নেই, ওর হাসি দেখে বুঝতে পারছি ও তোমার মন থেকে রেহানার দুঃখ ভুলিয়ে দিতে চায়। আমি বললাম, তুমিও কি সিনেমা দেখতে এসেছিলে? ভেবেছিলাম, কিন্তু হলো না। কেন? একটা জরুরী কাজ পড়ে গেল। তারপর বলল, চলি তা হলে প্রান্তিক। একদিন বৌকে নিয়ে এসো না। পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে আজকাল আর দেখাই হয় না। তা তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে? ভালো। তুমি কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করবে? চলনা কোথাও গিয়ে চা বা কফি খাওয়া যাক। ও হাসতে হাসতে বলল, তোমাদের রস ভঙ্গ করে? আমি বললাম, তুমি কিন্তু আগের মত আছো অনুতপা। তোমার কি খুব পরিবর্তন হয়েছে? তা একটু হয়েছে যেমন? এই বাঁধা গরু আর ছাড়া গরুর মধ্যে যে পরিবর্তন তেমনি আর কি? ও বলল আমার কিন্তু তা মনে হয় না। তবে কি মনে হয়? তুমি আগের মতোই আছে। আমি হেসে বললাম, তা এই কথাটা তুমি একটু বুঝিয়ে বলো না কেন? ও তোমার কথা শুনছে না? ঠিক তা নয়। তা হলে? তোমার তো বর আসেনি এখনো আসলে দেখতে পেতে সেলিনার সাথে তোমার চিন্তার বেশী কিছু পার্থক্য নেই। কি রকম? এই সব সময় বরকে সন্দেহ করা। অনুতপা বলল তোমার বিচার বড়ই এক পেশে হয়ে যাচ্ছে, বৌরা সন্দেহ করে, বররা করে না? করে হয়তো, কিন্তু আমার মুসকিল হচ্ছে, সেলিনাকে সন্দেহ করার মত সামনে যে কাউকে পাচ্ছিনা। জিভ কেটে অনুতপা বলল, খুবই পরিতাপের কথা প্রান্তিক, কিন্তু অেমার সন্দেহকে সত্য করতে ও বেচারা যায় কোথায় বলত। বরং তুমি নিজেই কাউকে জোগাড় করে দাও। দাম্পত্য জীবনে একটু কলহ না হলে মধুরতার স্বাদ পাবে না। তুমি জানলে কি করে? তোমার তো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। সব কিছু ব্যক্তি জীবনে ঘটলে অভিজ্ঞতা হবে, অন্যথায় হবে না এমনতো কোন কথা নেই। তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু মুসকিল হচ্ছে, সেলিনা তা মানতে চায় না, নিজের অভিজ্ঞতায় যাচাই না করে ও কিছু বিশ্বাস করতে চায় না। তা হলেতো আর সমস্যাই রইলনা। কি করে? ওই সমস্যা সৃষ্টি করবে, আবার তা মিটিয়েও নেবে, কি ভাই সেলিনা তাইতো। ও কোন উত্তর না দিয়ে শুধু হাসলো, তারপর অনুতপাকে বলল অনুদি আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগেছে। আগেতো আপনার সঙ্গে পরিচয় ছিল না, আসুন না একদিন। সেদিনই ভাল করে জেনে নেবেন ও যা বলছে, তা ও নিজেই বিশ্বাস করে কি না। তারপর বলল ওতো অবলীলায় এখন যা বলছে একটু পরেই তো অস্বীকার করবে। আমি বললাম দেখলে তো অনুতপা কি ভাবে আমার পিছনে লাগছে। তা দেখলাম বৈকি, তোমার ভাগ্যকে সত্যি হিংসা করতে ইচ্ছে করে। আমি বললাম ইচ্ছে করে, কিন্তু সত্যিকারের হিংসা করোনা হতো। নিশ্চয়ই করি। তবু ভালো, তুমি সেলিনার ভাগ্যকে হিংসা করনি, তা হলে যে কত রাত আমাকে জ্বলতে হতো কে জানে? হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এই রে বড্ড দেরি হয়ে গেছে আসি প্রান্তিক, আসি ভাই সেলিনা। সেলিনা বলল, তাহলে আপনি আসছেন তো আমাদের বাড়ীতে? আচ্ছা যাবো।

    একটু রাতের দিকে মিনতি সেন সেলিনাকে নিয়ে ফিরলেন। বললেন, ওকে নিয়ে এলাম ঠিকই কিন্তু কাল বা পরশু তোর বাবা আসবেন। তোর পিসিকে তোর বাবা যে ভাবে চিঠি লিখেছেন, তাতে খুব ভয় হচ্ছে। বাবার চিঠিতে ভয়ের কথা আছে? অন্তত চিঠিটা পড়ে আমার তাই মনে হয়েছে। বাবা চিঠিতে কি লিখেছেন? মিনতি সেন বললেন, আমি নিয়ে এসেছি। তুই পড়ে দেখ। পড়তে লাগলাম, বাবা লিখেছেন–

    কল্যাণীয়া নীলাঞ্জনা, তোমর চিঠি পেয়েছি, চিঠিতে জানিয়েছে, তোমার মেয়ে সেলিনাকে প্রান্তিক বিয়ে করেছে। সেলিনা মানে যাকে নিয়ে তুমি এখানে এসেছিলে সেই তো? দেখ নীলাঞ্জনা ও যখন বিয়ে করেছে, নিশ্চয়ই জেনে শুনে করেছে। নিজের পরে গভীর বিশ্বাস আছে বলেই আমার বা ওর মায়ের অভিমত নেওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি। তেমনি তোমরাও কোন প্রয়োজন মনে করোনি। আমরা কিন্তু শুনেছিলাম রেহানা নামে একটা মেয়েকে ও ভালবাসে। আর ওর ভালবাসা যাতে ব্যর্থ না হয়ে যায়, তাই তারই মঙ্গলার্থে মেয়েটি পথে নেমেছে। একদিন মেয়েটি আমাদের গ্রামেও এসেছিল। চিনতাম নাতো, তবে মেযেটির মিষ্টি মুখ তার নম্রতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, মনে হয়েছিল এমন মেয়েকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়াতে চেয়ে প্রান্তিক কোন অন্যায় করেনি। অথচ আজ দেখতে পাচ্ছি তাকে ভুলে যেতে বেশী সময়ও লাগেনি। তোমার মেয়েকেও হয়তো ভুলে যেতে ওর বেশী সময় লাগবেনা।

    রেহানা এবং সেলিনা নাম দুটো শুনে মনে হচ্ছে তারা আমাদের স্বজাতি বা স্বধর্মীয় কেউ নয়। ধর্মীয় ছুৎ মার্গ আমার নেই। তাই সেলিনাকে আমি আমার পুত্রবধু হিসাবে গ্রহণ করলাম। তোমার মেয়ে এর থেকে বেশী দাবী না করলেই খুশী হবো। আর একটা কথা সমাজকে তোমরা না মানতে পার, আমার তো না মেনে উপায় নেই।

    ইতি সীতাংশুদা।

    ইচ্ছে ছিল না তুব সেলিনা যেহেতু দাঁড়িয়ে আছে আমার কাছে, তাই পড়া হয়ে গেলে চিঠিটা তাকে দিয়ে দিলাম। ও পড়ে আমাকে ফেরৎ দিয়ে বলল, তুমি খুব ভাবছ? একটুতো ভাবছি। না ভেবোনা, আমার পরে বিশ্বাস রাখ, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই যেন হয়।

    রাতে বলল, বাবা যখন আসবেন, তোমার পিসির ওখানে তোমার যাওয়ার দরকার নেই। সেকি কথা, উনি কি ভাববেন? ওনার তো ভাবার কিছু নেই, তুমি তোমার মায়ের কাছে আছ আমি আছি আমার মায়ের কাছে। এতে ভাবতে যাবেন কেন? তাছাড়া আমাকে তো উনি মেনে নিয়েছেন। তা হয়তো নিয়েছেন, তবু যে কথা বলেছেন, যে তোমাকেও একদিন ভুলে যাবো। সেটাই তো চ্যালেঞ্জ প্রান্তিক, জীবনে চ্যালেঞ্জ না থাকলে সব কিছু কেমন জলে মনে হবে। কিন্তু তার আশঙ্কা যদি সত্যি হয় কোন দিন। সেলিনা বলল, পৃথিবীর সব আশঙ্কা কি সত্যি হয়, তা হলে তো ঈশ্বরের কোন দরকার ছিল না, মানুষই তার শেষ নিয়া হতে পারতো। তুমি আমার উপর এত বিশ্বাস রাখছ কেন? কারণ আমি তোমাকে জানি। বুঝি। রেহানাকে তো তুমি ভুলে যাওনি, তুমিতো তাকে প্রতিমুহূর্তে পেতে চেয়েছো আমার মধ্যে। আমিও প্রতিমুহূর্তে রেহানা হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। তুমি কি বুঝতে পার না আমাকে? পারি সেলিনা, আর এজন্য খুব কষ্ট হয় জান? কেন? আমি বুঝতে পারি না রেহানার শান্ত স্বভাব না তোমার উচ্ছলতা কোনটা আমাকে বেশী টানে। তাছাড়া এই যে একজনের মনকে বুঝে নিজেকে পরিবর্তন করা এই যে ত্যাগ। আমার কষ্ট কমায় না সেলিনা, বাড়িয়ে দেয় মাত্র। আমি তোমাকেও বুঝিনা প্রান্তিক, কখন কি চাও তুমি। আমার উচ্ছলতায় তোমার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে রেহানার মুখ, তাই তোমার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় রেহানা, আবার আমি যখন শান্ত হয়ে ঠিক রেহানা হতে চাই তখন তোমার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সেলিনার ছবি, তোমার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় সেলিনা। আমি যে কি ভাবে তোমাকে পাব বুঝিনা। মাঝে মাঝে কি মনে হয় জান? কি? আমি বোধ হয় তোমার জীবনে না এলে ভাল হতো। আমি কিন্তু তা ভাবিনা। আমি সব সময় চাই, তুমি শুধু তোমার মত হয়ে আমার কাছে এস। না গো তাতে তোমার কষ্ট আরো বাড়বে। তুমি শুধু আমার কষ্টটা দেখলে নিজের কষ্টটা দেখছনা? তোমাকে সুখী করার জন্য, তোমার মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য কোন কষ্টটাকেই আমার কষ্ট বলে মনে হয় না। জানতো মেয়েরা কোন সুরে বাজবে তা নির্ভর করে পুরুষের ইচ্ছের পরে। নারী দেহতো একটা যন্ত্র মাত্র। তাতে সুর দেওয়ার দায়িত্ব পুরুষের। তুমি যে সুর বাজাতে চাইবে, যদি সে সুরে বাজতে না পারি তা হলে বুঝবে, যন্ত্রটাই বিকল হয়ে গেছে। তারপর একটু থেমে বলল, আমার জন্য ভেবোনা প্রান্তিক, তোমাকে সুখী দেখার জন্য আমার কোন কষ্টটাকে কষ্ট বলে মনে হয় না। দেখো, তোমার বাবা, আমাকে সেলিনা হিসাবে ভাবতেই পারবেন না, তার চিন্তায় তাল গোল পাকিয়ে যাবে। আমি বললাম, তাতে যদি তিনি ভুল বোঝেন। যদি মনে করেন, তুমি একজন নিখুঁত অভিনেত্রী, তুমি যদি ছোট হয়ে যাও তার কাছে আমার কষ্ট কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে বুঝতে পারছ? বাবার কাছে সন্তান তো সব সময় ছোট। তুমি ভেবো না। কতদিন পরে তোমাকে কাছে পেয়েছি, মিথ্যে মন খারাপ করে রাতটাকে নষ্ট করা না প্রান্তিক। কাছে এস। ওর আকর্ষণে মুহূর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম ওর মধ্যে

    সকালে মিনতি সেন বললেন, তুই নাকি যাবি না, পিসির কাছে। হ্যাঁ মা, ভট্টাচার্য সাহেবেরে ওখানে একবার যেতে হবে। উনি বলেছিলেন, পরীক্ষার পরেই যেন জয়েন করি। কিন্তু তুই যে বললি, তুই তোর কাকুর ফার্মে জয়েন করবি। বলেছিলাম। কিন্তু কাকু নিজেই বললেন, আমি যেন ভট্টাচার্য সাহেবের দেওয়া অফারটা গ্রহণ করি। যা ভাল বুঝিস কর। ভবিষ্যতে আমাকে দোষারোপ করবিনা। আমি বললাম মা, কাকু বা ভট্টাচার্য সাহেব যাই বলুন না কেন কিন্তু তুমি যা বলবে, তাই হবে। দেখ এতবড় দায়িত্ব আমাকে দিস না। তোরা এযুগের ছেলে মেয়ে। ভবিষ্যত আমাদের থেকে অনেক ভালভাবে বুঝতে পারিস। তাই সিদ্ধান্তটা তোদরই নেওয়া উচিৎ। তুমি রাগ করছ। রাগ করব কেন? শোন মা, আমাকে প্রথমে কাকুই জানান যখন উনি মেদিনীপুরে ছিলেন। আমি ওদের ওখানে কাজ করব না ভট্টাচার্য সাহেবের অফার গ্রহণ করব, আমার এ প্রশ্নের উত্তরে উনি বলেছিলেন, আমি কি ভাবে ওর কাছে এই উপদেশ চাইছি। বলেছিলাম আমার একজন শুভাকাঙ্খী হিসাবে। তখনি উনি বলেন, তা হলে তোমার ভট্টাচার্য সাহেবের অফার গ্রহণ করা উচিৎ।

    ঠিক সেই সময়ে ফোনটা বেজে উঠলো। মিনতি সেন বললেন হ্যালো। সুরেশ ভট্টাচার্য স্পিকিং। ও বলুন। প্রান্তিক আছে? হ্যাঁ আছে? ওকে দেবৈন? ধরুণ। আমি বললাম হ্যালো? হ্যালো ইয়ং ম্যান, মিঃ চৌধুরী তো বললেন, তুমি পরীক্ষার পরে জয়েন করবে? কি হল, তুমি কি তোমার মত বদল করেছে নাকি। না না, মত বদলাব কেন? তাহলে কবে জয়েন করছ? ওরা আমার কথায় ২ মাস চেয়ার ফাঁকা রেখেছেন। আর তো রাখা সম্ভব নয়। আমি আজিই আপনার সঙ্গে দেখা করছি। এতক্ষণ মাযেব সঙ্গে এই ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছিলাম। থ্যাঙ্ক য়ু। ফোনটা ছেড়ে দিলেন।

    মিনতি সেন বললেন, তোর কাকু যখন বলেছেন, তখন ভট্টাচার্য সাহেবের অফারটাই গ্রহণ কব। আমি বললাম তুমি মন থেকে বলছ তো মা। উনি তা এড়িয়ে গিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে, তোরা তোদের কাকুকে খুব ভালবাসিস তাই না? সেতো তোমার জন্য মা। আমার জন্য? অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন মিনতি সেন। তারপর অবশ্য বলেন তা হলে কি বলতে চাস তোব কাকুর মধ্যে ভালবাসার মত কিছু নেই, শুধু আমার মুখ চেয়ে তাকে ভালবাসিস?বললাম, এই ভাবে নিচ্ছ কেন? বড় কথা হচ্ছে কাকুকে ভাল না বেসে উপায় নেই, আর তিনিও এত ভালাবাসেন যে, কোন ভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তাই আমরা শুধু সেতু রচনা করে চলেছি। সেলিনা কাছে ছিল না, তাই বললাম, আমি ছেলে, হয়তো একথা আমার বলা উচিৎ নয়, তবু বলছি মা, কাকুকে একটু বোঝার চেষ্টা করে। তাকে বুঝে আমার কি লাভ? কিছুই লাভ নেই মা? তাহলে তুমি গিয়েছিলে কেন? চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো মিনতি সেনের। অপমান আর লজ্জায় যেন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। নিজেকে খানিকটা সংযত করে বলল, সব কৈফিয়ত কি তোক দিতে হবে? কেন দেবে না? তুমিতো মা, তোমার ভালমন্দ দেখার কোন দায়িত্ব আমার নেই? আর তা যদি না থাকে, তবে আমিও বলে দিচ্ছি, তোমার লোক দেখানো ছেলে আমি হতে পারব না। যেন কান্নায় কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল, বললেন প্রান্তিক। বললাম মা, তোমাকে আঘাত দেওয়ার জন্য এসব বলিনি, শুধু বলতে চেয়েছি মন কোন বয়সেই মরে না, ভালবাসা মরে না কখনো। যদি কারো তা হয়, তার বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই। কাকু তোমাকে তারপর তিনবার ফোন করেছেন, তিন বারই তার কণ্ঠ শুনে তুমি কোন কথা না বলে ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু কেন? তোকে কে বলল? যেই বলুক কথাটা সত্যি কিনা, তাই বল। উনি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, কি হল বল? দেখতে পাচ্ছি মিনতি সেনের চোখ বেয়ে টপটপ করে জল নেমে আসছে। আমি কাছে এগিয়ে এসে তার আঁচল দিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললাম, এত কষ্ট নিজের ভিতরে চেপে রাখ কেন মা? তুমি ভয় পাচ্ছ তোমার কোন আচরণে, আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারি। না মা, পারবনা তোমাকে ছেড়ে যেতে, তুমি তাড়িয়ে দিলেও আমি বারবার তোমার কাছে আসব। কতবার তাড়াবে তুমি আমাকে? তুমিতো শুধু আমার মা নও তুমিতো রেহানারও মা, ভুলব কি করে বল। উনি শুধু বললেন, প্রান্তিক সত্যি তুই আমাকে ছেড়ে কোন দিন যাবিনা। কোথায় যাব বল। তখনো মিনতি সেনের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে। বললাম মা, এবার কষ্টটাকে একটু ভাগ করে নাও না। মিনতি সেন সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললেন ভট্টাচাজ সাহেবের ওখানে কখন যাবি? আমিতো ওর অফিসে যাব, খেয়ে দেয়েই যাব। তারপর বিকেলে সেলিনাকে ও বাড়িতে রেখে আসব। সেই ভাল বললেন মিনতি সেন।

    ভট্টাচার্য সাহেব বললেন, তা হলে কাল জয়েন করতে পারবে তো। আপনি যদি বলেন, তা হলে আজও জয়েন করতে পারি। না তার আর দরকার নেই। তুমি কালই জয়েন কর। ওরা তোমাকে আলাদা কোয়ার্টার দেবে বলেছে। দিন সাতেকের মত দেরি হবে। ততদিন সব প্রস্তুত করে নাও। কোয়ার্টার নিতেই হবে? না নিয়ে কি করবে, ভাড়া বাড়ীতে থাকবে? মানে আমাকে কোথায় যেতে হবে? সেকি? তুমি তোমার এপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখনি। না দেখা হয় নি। বা অপূর্ব। আমি প্রয়োজন বোধ মনে করিনি কাকু, কারণ আমি জানি, আপনি যা করেছেন, তা বুঝে শুনেই করেছেন। উনি বললেন, তোমার কাছে এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা আছে? হ্যাঁ আছে তা হলে বের করো।

    আমি বের করে দেখি, ওতে স্পষ্ট করে লেখা আছে, শিলিগুড়িতে কোম্পানীর একটি ব্রাঞ্চে আমাকে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার করে পাঠানো হচ্ছে। ২ বছর থাকতে হবে ওখানে। তারপর আমার কাজে ম্যানেজমেন্ট সন্তুষ্ট হলে, কলকাতার হেড কোয়ার্টারে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে।

    বললাম, তার মানে কালই আমাকে শিলিগুড়ি যেতে হবে? না, সাতদিন তোমাকে হেড কোয়ার্টারে থাকতে হবে। তারপরই শিলিগুড়ি। আমি অকারণে একটা প্রণাম করে উঠে পড়লাম, কিন্তু উনি কোন বাধা দিলেন না।

    কাজে জয়েন করেছি কাল, ফোন নং দিয়ে দেওয়া হয়েছে পিসি ও মাকে। আজ অফিসে ঢাকার মিনিট পাঁচেক পরে পিসি ফোন করে জানালেন, আজ ভোরে বাবা এসেছেন। তুমি যদি পার বিকেলে এস। বললাম তুমি অফিস থেকে বলছ? হ্যাঁ, সঙ্কোচে জানতে চাইলাম সেলিনা কি বাবাকে সামলাতে পারবে। ওই তো আমাকে জোর করে পাঠিয়ে দিল। সীতাংশুদাও বললেন, তুমি যাও নীলাঞ্জনা। বৌমা তো আছে। বাবার মুড কেমন দেখলে? গ্রামের মানুষ ভাল বা মন্দ কোনটারই প্রকাশ সোচ্চার নয়। বিকালে আসলে সব জানতে পারবে। এখন ছাড়ছি। মিনতিকে জানিয়ে দিও। তুমি জানিয়ে দাও পিসি সেইটেই ভালো হবে। আচ্ছা।

    নীলাঞ্জনা পিসিই সেলিনাকে নিয়ে বাবার কাছে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন সীতাংশুদা, তোমার বৌমা। সেলিনা প্রণাম করতেই বাবার চমক আর ভাঙেনা, বললেন আশীর্বাদ করি সুখী হও মা।কিন্তু তোমাকে যেন এর আগে কোথায় দেখেছি বলত।নীলাঞ্জন পিসি বললেন সে কি সীতাংশুদা, এইতো যখন দেশের বাড়ীতে গিয়েছিলাম তখন তো ও ও গিয়েছিল। না নীলাঞ্জনা, ওকে যেন আলাদা ভাবে কোথায় দেখেছি। সেলিনা, বললেন, ঠিক বলেছেন বাবা, মেয়েকে চিনতে কি বাবার কোন অসুবিধা হয় না কি। বাবার মনে হল এতো সেই কণ্ঠ যে একদিন বলেছিল, আপনি কিন্তু কথা দিয়েছেন আমাকে মেয়ে হিসাবে মেনে নেওয়ার, আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না তো। বাবা বললেন, তোমায় কোথায় দেখেছি মা বলতো। সেলিনা বলল, বাবা তার মেয়েকে কোথায় দেখেছেন এ আমি কেমন করে বলব? যে ছবি মনের মধ্যে রয়েছে তাকে আর নতুন করে কোথায় দেখবেন। সে সব যাক বাবা, পরে না হয় ভেবে দেখবেন আপনার মন থেকে হারিয়ে যাওয়া মেয়ে আবার ফিরে এসেছে কি না। আপনি এখন ক্লান্ত বিশ্রাম নিন, আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি। দেখি আপাতত কিছু খাওয়ার জোগাড় করা যায় কিনা। আপনি তো চা বা কফি কিছু খেতেন না, এখানে দেব কি? বাবা অবাক হয়ে, তাকালেন ওর দিকে, তারপর বললেন তুমি এত কথা জানলে কি করে মা। বা আপনি তো আমায় অবাক করলেন বাবার পছন্দ অপছন্দ মেয়েকে অন্যের কাছে জানতে হবে? যত দেখছেন ততই অবাক হচ্ছেন বাবা, বললেন, দাও মা, তোমার যা ভাল লাগে তাই দাও। তা না হয় দিলাম, কিন্তু আমি যা রান্না করব তাই খাবেন তো, আবার বলবেন না তো, বহু বছর কাছে না থাকার জন্য মেয়েটা আমার সব ভুলে গেছে, আমার পছন্দ অপছন্দ সব। তারপর বলল কিন্তু বাবা আপনি একা এলেন কেন? মাকে কেন নিয়ে এলেন না? প্রশ্নটা করেই তার কোন উত্তর শোনার অপেক্ষায় না থেকে সেলিনা চলে গেল! নীলাঞ্জনা বললেন, ও যে আমার কতখানি হৃদয় জুড়ে আছে, সে তোমাকে কি বলব সীতাংশুদা। সে আমি কয়েক মিনিটে বুঝতে পারছি নীলু। ওর পরকে আপন করে নেওয়ার শক্তি আমায় অবাক করেছে। তোমাকে বলা হয়নি নীলু। তোমরা দেশের বাড়ীতে যাওয়ার আগে মাষ্টারমশায়ের সঙ্গে একটি মেয়ে এসেছিলেন। একে দেখে তাই আমি চমকে উঠেছিলাম। এতো সেই মেয়ে, সেই অধিকার বোধ, সেই মিষ্টি কথা। ও কি বলেছিল জান, আমাকে মেয়ে বলে ডেকেছেন, ভুলে যাবেন নাতো। আমার ভিতরটা যে কি হচ্ছিল তা তোমাকে বুঝাতে পারবনা। পরে শুনলাম ওর নাম রেহানা। প্রান্তিক ওকে ভালবাসে। সত্যি ভাল লেগেছিল প্রান্তিক ওর মত মেয়েকে ভালবেসেছে বলে।

    ঠিক সেই সময়ে, কফি, পকৌড়া, আরো কিছু খাবার নিয়ে ঢুকলো সেলিনা, বলল, বাবা, সেই মেয়েটাকে তো আপনি পাগলের মত খুঁজেছেন তাই না? আজ যদি বলি, আমি সেই মেয়ে, পারবেন আমাকে অস্বীকার করতে? না মা পারব না। সত্যি তোমাকেই খুঁজছিলাম, আজ পেয়েছি তোমাকে। আর তো খোঁজার দরকার নেই। না, নেই কিন্তু তোমার মত মেয়েকে আমি যে কি বলে আশীর্বাদ করব বুঝতে পারছি না। মেয়েকে তো বাবা সব সময় আশীর্বাদ করছেনই আবার নতুন করে কি করবেন? তারপর নীলাঞ্জনাকে বলল, মা, তুমি অফিসে যাবেনা? আজ আর যাব না, কতদিন পরে সীতাংশুদার সাথে দেখা, তাছাড়া তুই একা একা পারবি কেন? আমি পারবো না? কি যে বল না মা। বাবা এসেছেন মেয়ের কাছে, আর মেয়ে বাবাকে সামলাতে পারবেনা এ আবার হয় নাকি। তুমি অফিসে যাও, বাবা বললেন, হা নীলু তুমি অফিসেই যাও। কিন্তু প্রান্তিককে যে দেখছিনা ও কোথায়? সেলিনা বলল, সে হবে না বাবা, আগে মেয়ের সঙ্গে সব কথা ফুরোক তবে ছেলে। তাই হবে মা, কিন্তু ও কোথায়? ও তো ওর মায়ের কাছে, তা ছাড়া সবে কালই নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে। মা অফিসে গিয়ে ফোন করবেন, বিকেলে আসবে। বাবা আর কিছু বললেন না।

    বিকেলে এলাম আমি। বাবা বললেন, নীলুকে চিঠিতে আমার আশঙ্কার কথা আমি ফিরিয়ে নিলাম প্রান্তিক। আমি বললাম, ওকে আপনার পছন্দ হয়েছে তো? সেলিনা বলল এই তোমার এক দোষ, মেয়েকে বাবার পছন্দ হয়েছে কি না এটা একটা প্রশ্ন হলো? আজ পর্যন্ত শুনেছো কোন মেয়েকে বাবার পছন্দ নয়? তার চেয়ে তুমি বলতো আমাকে তোমার পছন্দ কি না। বাবা শুধু হাসছেন। নীলাঞ্জনা বললেন, দেখেছো সীতাংশুদা ওরা কেমন ঝগড়া করে। বাবা বললেন দেখছি নীল, আর ভাবছি এদেরকে যারা এ যুগের ছেলে মেয়ে বলে তাচ্ছিল্য করে তাদের জন্য করুণা হয়। বাবার কথার প্রতি উত্তরে সেলিনা বলে, বাবা আপনার আমাদের যুগে জন্মাতে ইচ্ছে করে না? আগে করত না, কিন্তু তোমাদের যত দেখছি, ততই মনে হচ্ছে, আমি যেন বার বার তোমাদের মাঝে আসি। তোমাদের এই জীবনটা যদি ফিরে পেতাম? এতো সোজা ব্যাপার বাবা, শুধু গ্রহণ করার ক্ষমতা আছে কি না সেটাই যাচাই করে দেখতে হবে। কেমন করে? নিজের মনটাকে দিয়ে, আসলে মনটাই তো সব। মনটাকে শুধু আমাদের মত কবে নিন, দেখবেন কোন অসুবিধা নেই। বাবা হাসলেন, বললেন, শিখিয়ে দেবে মা, কেমন করে এই বুড়োমনটাকে তোমাদের মত তরতাজা করে নেওয়া যায়। তাহলে কাল চলুন না আমার সাথে। কোথায়? যেখানে ইচ্ছে। শুধু মনকে একটু স্বাধীনতা দিতে হবে। তা হলে দেখবেন আর কোন অসুবিধা নেই। সত্যি মা কোন অসুবিধা নেই। তাইতো আজন্ম সংস্কারকে তুমি হেলায় তুচ্ছ করতে পার। এই পারাটাই বড় কথা তাই বলছতো। হ্যাঁ, ঠিক তাই বলছি। থাকুননা আমাদের সাথে দেখবেন কেমন সুন্দর ভাবে সব পেরে গেছেন?

    রাতে খেতে বসে বলল, বাবা আপনি বলেছিলেন না, মা সমাজকে অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু আপনার পারার উপায় নেই। হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু সেই সমাজকে তো আপনি অস্বীকার করতে পেরেছেন। কেমন করে? সমাজ মানে তো কিছু আচরণ, এই এর হাতে খাব না, ওর ছোঁয়া স্পর্শ করবনা, সমাজকে যদি মানতেন, তা হলে তো মেয়ের হাতে খেতেই পারতেন না। অথচ তা পেরেছেন, কেন বলুন তো। তুমিই বলনা কেন? আসলে স্নেহ আর ভালবাসা, দুটি মন যেখানে একে অপরকে ভালবাসে সেখানে সব তুচ্ছ হয়ে যায়। এতদিন সমাজকে গভীর ভাবে ভালবেসে এসেছেন, তাই ভাবতেন একে বুঝি অস্বীকার করা যায় না, আজ যখন তার থেকেও আরো গভীর ভালবাসায় জড়িয়ে পড়েছেন সমাজকে ভালবাসা তুচ্ছ হয়ে গেছে তাই না? বাবার মুখে কোন কথা নেই। সেলিনা বলল, বলুন ঠিক বলেছি কি না। তুমি ঠিক বলেছ মা। আমি শুধু ভাবছি তুমি এমন করে ভাবতে শিখলে কি করে? এটা কিন্তু আমি আপনার ছেলের কাছে শিখেছি। প্রান্তিকের কাছে? হ্যাঁ বাবা ওর কাছে। ওর কাছে শিখেছি, মানুষকে ভালবাসাই তার আসল ধর্ম। ধর্ম ব্যবসায়ীর ধর্ম নয়। ও কিন্তু হাতে কলমে একথা শেখায়নি, তার আচরণের মাধ্যমে শিখিয়েছে। আর ওতো আপনার রক্তের উত্তরাধিকার। তাই আপনার চিঠি পেয়ে ও যখন খুব চিন্তিত, আমি আপনার চিঠিটা পড়ি। জানি অন্যের চিঠি পড়া অন্যায়, তবু আপনার চিঠি পড়ে ওদের যা যা মনে হল, আমার কিন্তু তা হল না। বাবা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন মে? বাঃ যে আপনি আমাকে মেনে নিচ্ছেন, তাকে আপনি অন্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন এতো দ্বিচারিতা। বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন বৌমা। সেলিনা বলল, না বাবা, আমি শুধু বৌমা নই, আমি আপনার মা, আপনার মেয়ে। আপনার বুকে যে শূণ্যতা, সেই খানেতো আমার জায়গা। কেন বৌমা বলে আমাকে দূর করে রাখবেন। এবার বাবা বললেন মা সেলিনা। সেলিনা বলল আমি শুধু সেলিনা নই বাবা, আমিতো সেই মেয়ে যাকে আপনি পাগলের মত খুঁজে ফিরেছেন, আমিতো আপনার সেই রেহানা, একবার ডাকুন না আমায় ওই নামে।

    অদ্ভুত এই সেলিনা, আমি ও নীলাঞ্জনা পিসি অবাক হয়ে ভাবছি বাবার চিন্তা ধারাকে এলোমলো করে দিতে এমন করে বুঝি কেউ পারত না। অবাক হয়ে অপলক বাবা তাকিয়ে থাকেন সেলিনার দিকে। পিসি বলেন, কি হল সীতাংশুদা, মেয়ের কাছে হেরে গেলেন? বাবা বললেন, সত্যি নীলু এ যে কি আনন্দের হার তা তোমাকে বুঝাতে পারবো না। সেলিনা সত্যি তুমি আমার মা। মনে থাকে যেন বাবা। বাজে অজুহাতে এই বিশ্বাস থেকে সরে আসবেন না কিন্তু।

    মাত্র ২ দিন থাকবেন বলেছিলেন বাবা। মিনতি সেন এলেন বাবা যেদিন এসেছিলেন তার পরের দিন দুপুর বেলায়। বাবা ঘুমাচ্ছেন আর সেলিনা তার মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে ঘুমাতে সাহায্য করছে। হঠাৎ বেলটা বেজে উঠলো। বাবা বললেন কে এল মা? আপনি ঘুমান আমি দেখছি। দরজা খুলে মিনতি সেনকে দেখে একেবারে জড়িয়ে ধরে বললেন মা তুমি। হ্যারে আমি, এবার ছাড়। মিনতি সেন এলেন বাবার কাছে। বাবা উঠে বসলেন। মিনতি সেন প্রণাম করে বললেন, কেমন আছেন দাদা। প্রান্তিকের কাছে শুনলাম, আপনি নাকি কালই চলে যাবেন। এবার নাকি আমার ওখানে যাওয়ার সময় হবে না, তাই আসতে হলো। সেলিনা বলল তোমার ছেলে বলেছে এই কথা? কেন ওকি ঠিক কথা বলেনি? তা জানিনা মা, তবে বাবা তোমার ওখানে যাবে না, আমি জানিনা তোমার ছেলে জানলে কি করে? এই তো ঘুমাবার আগে বাবা বললেন, মিনতির ওখানে একবার যাওয়া ভীষণ দরকার মা। আর তোমার ছেলে বলে দিল তোমার ওখানে যাবে না। আর তুমি সেই কথা বিশ্বাস করলে? বাবার অবাক হওয়ার পালা পারদের ওঠা নামার মত বাড়তে থাকে। মিনতি সেন বললেন, তুই দেখছি রেগে আছিস প্রান্তিকের পরে। ও কিন্তু ওই ভাবে বলেনি। তবে কি ভাবে বলেছে। বাবার ফিরে যাওয়ার তাড়া আছে, আসতে পারবে কি না কি জানি? সেলিনার মুখে হাসি ফুটে উঠে, বলে তাই বল। তা তুমি আজ অফিসে যাও নি? না তাহলে তো ভালই হল। চল না এক সঙ্গে যাওয়া যাবে। তারপর বাবাকে বললেন, বাবা আপনি ঘুমান, আমি মায়ের সঙ্গে ও ঘরে গিয়ে গল্প করছি। না মা, ঘুম আসবেনা, বরং আমিও তোমাদের সাথে গল্পে ভাগ বসাই, কি বল মিনতি। সেই ভাল, বললেন মিনতি সেন।

    কাল বাবা চলে গেছেন। আগামী দিন আমাকে চলে যেতে হবে শিলিগুড়ি। বাবা যদিও দুদিন থাকবেন বলেছিলেন, কিন্তু সেলিনার বিভিন্ন অবদার মেটাতে পাঁচ দিন থাকতে হল। আমি বিশ্বাস করি এই পাঁচটা দিন বাবার জীবনে অক্ষয় সম্পদ হয়ে থাকবে।

    রাতে সেলিনাকে বললাম, কোন যাদুতে বাবাকে তুমি এমন আপন করে নিলে? কেন মশাই দরকার নাকি সে যাদু শেখার? ভীষণ দরকার সেলিনা। কেন? তা হলে তাকেও আমি সেই যাদুতে বস করতাম। থাক মশাই আর বস করতে হবে না কাউকে, এমনিতে যাদের বস করেছে, তাদেরই জায়গা দিতে পারছনা, আবার নতুনকে এনে কাকে তাড়াতে চাও? আমি স্মিত হেসে বললাম আমার ভয়কে। মানে? সেই যাদুতে আমি তোমায় বস করতে চাই সেলিনা। প্রান্তিক! না সেলিনা সত্যিই ভয় হয়, এই বুঝি তোমায় হারাই। দুহু ক্রোরে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া বলে আমাকে তার বুকের কাছে টেনে নিল।

    শিলিগুড়িতে ও আমার সঙ্গে আসতে চায়নি। কিন্তু পিসি ও মিনতি সেনের অনুরোধে অবিশ্য সে এল। আমি বললাম, তুমি আসতে চাইছিলেনা কেন? দেখ, তোমাকে পেয়েছি সকলের মধ্যে দিয়ে, তাই আমার মনে হয়েছে সকলের মধ্যে দিয়েই তোমায় আমি ধরে রাখতে পারব। তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে আমাদের কারো পালাবার পথ নেই। কিন্তু এখানকার এই বিশাল কোয়ার্টারে, আমি কারো মা নই, কারো মেয়ে নই, শুধু তোমার স্ত্রী, আর তোমার স্টাফদের কাছে মেম সাহেব, এই শুন্য ঘরে শুধু তুমি আর আমি। তোমার কথা যখন শেষ হবে, অথবা আমার কথা বলার ইচ্ছে হবে কারো সাথে, কে আমাকে সঙ্গ দেবে বল? পেতেও যেমন সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে না। হারাতেও তাই। আমি বললাম সেলিনা, সব সময় এই ফ্রাশট্রাসানে ভোগ কেন বলত? জানিনা, যা মনে হয়েছে তাই বললাম।

    দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যায়। কখনো দার্জিলিংয়ের তুষার ধবল পাহাড়, কখনো সিকিমের ঘন অরণ্য, পাহাড়ী নদী, এদের সঙ্গ দিয়ে কেটে যায় অবকাশ। একদিন বলল, আমাকে মায়ের কাছে রেখে আসবে প্রান্তিক? আমি অবাক হয়ে বললাম কেন? ও বলল আজকাল তুমি আর আমার দিকে তাকাওনা তাই। আমি তোমার দিকে তাকাই না? আমি তোমাকে ভালবাসি না? ভালবাস, আদরও কর। কিন্তু তাকাওনা। বুঝলাম না। সেই জন্যই তো বলেছিলাম, আমাকে মায়ের কাছে রেখে এস। কারণটা বলবে তো। ও আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, তোমার রক্তের উত্তরাধিকার কুঁড়ি হয়ে ফুটেছে গো, তুমি বাবা হতে চলেছে প্রান্তিক। আমি আনন্দে পাগলের মত ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আদরে আদরে ভাসিয়ে দিয়ে বললাম সত্যি?হা গো সত্যি, সত্যি, সত্যি। এবার আমায় ছুটি দেবে তো? আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে? থাকতে তো হবে, যে আসছে, তার দাবীতে কম নয়। ওদের কাউকে যদি আসতে বলি। ও বলল নতুনকে বরণ করে নিতে, পারবে না কয়েকটা দিন আমাকে ছেড়ে থাকতে। কি করে থাকব বল, অফিস থেকে কতবার শুধু তোমাকে দেখব বলে ছুটে আসি। কাজ করতে করতে তোমাকে আদর করার জন্য মন পাগল হয়ে ওঠে। যেখানে ৩/৪ ঘন্টা তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারি না, সেখানে এতদিন কি করে থাকবো। অভ্যেস কর, না হলে পস্তাবে, কেমন করে? হাসতে হাসতে বলল, পরে যখন কচি দুটি হাত তোমাকে বাধা দেবে, কি করবে? বললাম ওকে আদর করে সরিয়ে রেখে তোমাকে আদর করবো। আবদার?

    সেলিনার যাওয়া হল না। নীলাঞ্জনা পিসি এবং মিনতি সেন ভাগাভাগি করে এ একটা মাস এখানে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। সেলিনার মনে হয়, বন্দোবস্তাটা মনঃপূত হয়নি। বলল, ওরা কি ভাববেন বলত। কি ভাববেন? তোমাকে হয়তো কিছুই বলবেন না, কিন্তু তারা কিন্তু মনে মনে ভাববেনই আমি যেতে চাইনি, তাই তুমি ওদের আসতে বলেছে। তা ঠিক নয় সেলিনা, আমি তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই বলেছিলাম। কেন বলতে গেলে? তুমিতো আমাকে রেখে আসতে পারতে। তুমি রেখে এলে ওরা কি বাধা দিতো? আমি বললাম ঠিক আছে সেলিনা। আমি তোমাকে রেখেই আসব। না গো, আর তা হয় না। কেন? আমিও যে পারবনা তোমাকে ছেড়ে থাকতে। এই সেই চিরন্তন সেলিনা।

    লেটার বক্সে চিঠি ফেলে গেল পোষ্ট ম্যান। অশ্রুকণার চিঠি। লিখেছে সেলিনাকে। সেলিনা, ভুলে গেছো অদিকে তাই না? ভুলে যাওয়ার মধ্যে কোন অন্যায় নেই ভাই। যাকে তুমি সারা জীবন ধরে চেয়েছিলে নিজের আঁচলের মধ্যে পেয়েও এত ভয় কেন? কেউ চুরি করে নিতে আসবে না, তোমার সাত রাজার ধনকে। কাল মিনতি পিসির চিঠিতে জানলাম, তুমি নতুন আগন্তুকের অপেক্ষায় আছে। কি ভাল যে লাগছে তোমাকে তা বলে বোঝাতে পারব না। বোন, তোমাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। এই ইচ্ছের মধ্যে তুমি আবার অন্য কিছু খুঁজতে যেও না। তোমাদের দুজনকেই দেখতে ইচ্ছে করছে। আসবে একবার? সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে নোয়া, লাল শাড়ীতে কেমন লাগছে তোমাকে, দেখার ভীষণ লোভ নিয়ে তোমাকে ডাকছি–অশ্রুদি।

    চিঠিটা অনেকবার পড়ে সেলিনা, তারপর রাতে তা তুলে দেয় আমার হাতে। আমি বলি যাবে নাকি একবার। তোমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে তাই না? অদিকে তোমারও খুব দেখতে ইচ্ছে করছে শুধু মুখে বলতে পারছনা এইতো! হয়তো ঠাট্টা, হয়তো মনের সন্দেহ, হয়তো অমূলক ভয়, তবু সেলিনার একথা আমার ভাল লাগলো না। সত্যি কথা বলতে কি, প্রাণপনে চেষ্টা করে চলেছি অশ্রুকণা বা রেহানাকে ভুলে থাকতে। কখনো কখনো বা সেলিনার মধ্যে তাদের খুঁজে পেতে চেয়েছি। যখনি আমার নিঃসঙ্গতায় তাদের ছায়া পড়েছে পালিয়ে এসে আদরে আদরে ভরে দিয়েছি সেলিনাকে। আদূরের প্রকাশ ঘটে আবেগের ভিতর দিয়ে, সব সময় যে আবেগ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তা কিন্তু নয়, কিন্তু নিজের কাছ থেকে পালাতে, এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ভেবেছিলাম একটা কড়াউত্তর দেব সেলিনাকে। কিন্তু কিছুই না বলে চুপ করে রইলাম। ও বলল, কি হল তোমার কল্পনায় আঘাত দিলাম? বললাম কি বলতে চাও? চলনা অশ্ৰুদির ওখান থেকে ঘুরে আসি। আমার পরে তার দাবী না থাকলেও তোমার ওপর তো আছে। আর আমি তোমার স্ত্রী, সেই সূত্রে খানিকটা দাবীতো আমারও আছে। কি যে ও বলতে চায়, সব সময় বুঝিনা। তবু বললাম, আমার উপর কারো কোন দাবী নেই একমাত্র তুমি ছাড়া। ইস অভিমান দেখ। তারপর বলল কার উপর কার দাবী আছে ওই ভাবে মুখে জোর করে কিছু বলা যায় নাকি? তারপর, বলল, তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে আজ যদি তোমার মা প্রতীম কাকুকে কিছু বলেন কাকুর কোন ক্ষমতা আছে তাকে অস্বীকার করার? বললাম, ঠিক জানিনা, তবে মনে হয় প্রতীম কাকু তা পালন করবার চেষ্টা করবেন। শুধু আমার মা কেন, তুমিও যদি কিছু চাও তার কাছে, সাধ্যমত তোমার চাওয়াটাকেও তিনি পূরণ করবার চেষ্টা করবেন। আমার চাওয়া আর মায়ের চাওয়া কি এক? অথচ দেখ, জাগতিক কোন সম্পর্ক তাদের ভিতর নেই। আমি জানি প্রান্তিক, অশ্ৰুদির সঙ্গে তোমার কোন জাগতিক সম্পর্ক নেই, তবু তার যে কোন চাওয়াকে তুমি কোন ভাবে অস্বীকার করতে পারবে না। আমি তা মেনেও নিয়েছি। কেন নিয়েছি জান? আমি অবাক হয়ে বললাম কেন? ও ধীরে ধীরে বলল, তোমার বাবা বলেছিলেন, দেহ তো মন্দির, মন নামক দেবতার আধিপত্য সেখানে। দেবতার কাছে তো আসবে লক্ষ লক্ষ ভক্ত। যার যেমন কামনা তাই নিয়ে। তা নিয়ে ভাবলে চলবে কেন? দেবতার কাছে, আমি যা চাইছি, তাই তিনি আমায় দিচ্ছেন কি না এখানেই আমার সন্তুষ্টি এখানেই আমার সীমাবদ্ধতা। বলেছিলাম, একই কামনা নিয়ে যদি অনেকেই আসে সেই দেবতার কাছে, তাহলে দেবতা কি সবার মনস্কামনা পূর্ণ করবেন? না করবেন না, কারণ, তুমি যে সমাজকে অস্বীকার করছ, দেহ বেদীতে সেই সমাজেরই অঙ্গ। তাই সমাজিক বিচারে দেবতার ইচ্ছে পূরণের ক্ষমতা সীমিত। তাই বলে মা ইচ্ছেটা তো মরে যেতে পারে না। ঘুরে ফিরে আসে, বার বার আসে। তা ভাবায় যেমন আনন্দে তেমনি আবার কাদায়ও। বুঝেছিলাম আমাকে তিনি সন্দেহ মুক্ত করতে চেয়েছেন। আজ আমার কোন সন্দেহ নেই। তুমি কেন ভুল বুঝে নিজে কষ্ট পাচ্ছ। একথা তুমি অস্বীকার করতে পার না, অশ্ৰুদিকে আমার কালে ভদ্রে দেখতে ইচ্ছে করলেও প্রতিমুহূর্তেতাকে তুমি দেখতে চাও। আর তোমার সেই ইচ্ছেটাকে দমন করে তুমি আমায় আদরে আদরে ভরে দাও। তোমার আদরের তারতম্যই তার প্রমাণ। আজ যদি তুমি একা একা তার কাছে যাও, থাকও দিনের পর দিন তাতেও তোমাকে আমি সন্দেহ করব না। এত বিশ্বাস আমার ওপর? না প্রান্তিক তোমার ওপর নয়। তোমার সীমাবদ্ধতার ওপর। মন, চাইলেও তুমি পারবেনা। তোমার সেলিনা, তোমার পাশে না থেকেও বার বার তোমাকে প্রতিহত করবে, আর তাকে অপমান করার কোন স্পন্ধাই তুমি দেখাতে পারবেনা। তাই বলছিলাম, মিথ্যে মনকে ধোকা দিয়ে কি লাভ প্রান্তিক, আমারও ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করেছ অদিকে, চলনা। আমি বললাম, তার থেকে এক কাজ কর না, ওকেই একবার আসতে বলনা। তবু তুমি যাবে না? তুমি তো জান সেলিনা যে কোন মুহূর্তে মা বা পিসি আসতে পারেন। যদি এসে আমাদের না পান। তা অবশ্য ঠিক। বেশ আমিই অদিকে চিঠি লিখে দিচ্ছি। কি লিখবে? হাসি হাসি মুখে বলল, লিখব, ভীষণ ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে তোমাকে অশ্রুদি, আরেক জনের ইচ্ছে কিন্তু আমার থেকেও বেশী। আসছে তো? কবে আসছ জানিয়ো। না আসলে কিন্তু আড়ি। আমি রাগ করে বললাম, তোমার যা ইচ্ছে লেখ। যদি যেতে চাও তাতেও আমি রাজী। ও বলল, তাই বল। যেতে চাও অথচ জট পাকিয়ে তা ভণ্ডুল করে দেওয়ার ইচ্ছে।

    শেষ পর্যন্ত যাওয়া আর হল না। পরের দিনই মিনতি সেন এলেন। আমি তখন অফিসে। সেলিনা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল মা, তুমি? তুমি যে বললে আগামী মাসের প্রথম দিকে আসবে? বলেছিলাম কিন্তু ভেবে দেখলাম, তোকে নিয়েই যাবো। আনন্দে চিক চিক করে উঠলো সেলিনার দুটি চোখ। বলল সত্যি মা। হারে পাগলি সত্যি সত্যি সত্যি। তারপর বললেন তোর প্রথম সন্তান আসবে, আর পাশে থাকবো না, আমি অথবা, তোর মা, না রে সেলিনা, তা হয় না। কিন্তু তুই যাবি তো। তোকে প্রান্তিক ছাড়বে তো। লজ্জায় কুণ্ঠিত হয়ে বলল, মা।

    আমি সংবাদ পেয়েও, একটা জরুরী মিটিংএ ব্যস্ত থাকার জন্য এলাম দুপুরের দিকে। মিনতি সেন বললেন, না রে প্রান্তিক তুই ঠিকই বলেছিস, এখানে কাউকে ভাল করে চিনিনা। আর ওখানে ডাক্তার নাসিং হোম হাসপাতাল সবই চেনা। তাই ভাবলাম, ওকে নিয়ে যাই কি বলিস? বললাম, আমিতো তাই বলেছিলাম, ওখানে তোমারা সবাই আছে। তাহলে এক সপ্তাহ ছুটি নে, চল ওকে রেখে আসবি। তাই হবে মা। বলে, দুপুরের লাঞ্চ খেয়ে আমি আবারও অপিসে গেলাম।

    একা পেয়ে মিনতি সেন সেলিনার কাছে জানতে চাইলেন কিরে মেয়ে ক মাস হল? ঠিক হিসাব করে দেখিনি, তবে ৬/৭ মাস হবে মনে হয়। বলিস কি? এতদিনেও জানাস নি কেন? কি করে জানাবো, তোমার ছেলের তো খেয়ালই নেই আমার দিকে? ও কি খেয়াল করবে। নিজের রক্ত মাংসে যার অস্তিত্ব তা ও জানবে কি করে? আমার দিকে তাকালেই জানতে পারতো। এখানে এসেতো দেখছি শুধু কাজ আর কাজ। ঠিক কাকুর মত। প্রতীম বাবুর প্রসঙ্গ উঠতেই মিনতি সেন আর কথা বাড়ালেন না। পুরুষ ছেলে, কাজের মধ্যেই আনন্দ পায় বেশী। কোন ডাক্তার দেখানো হয়েছে? না। বাঃ অপুর্ব, তোরা কি বলতো! ৬/৭ মাস হয়ে গেছে, এখনো ডাক্তারের কাছে যাসনি। না আজ বিকালেই কলকাতায় ফিরে চল, কালই ডাক্তার দেখাতে হবে। কিন্তু তোমার ছেলেতো আজ বিকালে যেতে পারবেনা। না পারে একদিন পরে যাবে।

    সবশুনে বললাম একদিন পরেই যাও না। অফিসের কিছু কাজ আছে কাল তা শেষ করে পরশুদিন যাবো। ট্র্যাঙ্কলে ম্যানেজমেন্টএর সঙ্গে কথা বলেছি, ওরা এখন ১০ দিন এবং পরে যখন প্রয়োজন হবে তখন একমাস ছুটি মঞ্জুর করেছেন।

    কলকাতার এক বড় নাসিং হোমের ডাক্তারকে দেখানো হলো। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার বললেন, আগে ডাক্তার দেখানো উচিৎ ছিল। আপনারা শিক্ষিত মানুষ অথচ একবারও ডাক্তার দেখালেন না। নীলাঞ্জনা পিসি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন কোন অসুবিধা নেই তো ডাক্তার মুখার্জী? বললেন না তেমন কিছু নয়। তবে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। বলছেন ৬/৭ মাস, কিন্তু বেবিতো ম্যাচিউর হয়ে এসেছে, সুতরাং নির্দিষ্ট টাইম বলতে না পারলে আমারও বলা সম্ভব নয়, নিদিষ্ট দিন। বরং পেইন উঠলে নাসিং হোমে নিয়ে আসবেন।

    আমাদের শোনা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। রাতে সেলিনা বলল, প্রান্তিক আমার ভীষণ ভয় করছে। কেন? জানিনা, তুমি থাকতে পার না? ঠিক আছে আমি দেখছি, কিন্তু আমাকে তো একবার শিলিগুড়ি যেতেই হবে। তুমি ভট্টাচাজ কাকুকে বলনা, যাতে কিছুদিন পর্যন্ত তুমি থাকতে পার। আচ্ছা তাই হবে। এসময় অযথা আজে বাজে চিন্তা করোনা। যে আসছে শুধু তার মঙ্গলের কথা ভাব। জান প্রান্তিক ভীষণ ভাবে ঈশ্বরকে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে, কোন দিনতো ডাকিনি, কি ভাবে ডাকবো বলত। বললাম, ঈশ্বরকে ডাকারতো বিশেষ কোন নিয়ম নেই। ডাকার মনটাই আসল। মনটাকে প্রস্তুত করতে পারলে যেমন খুশী তাকে ডাকতে পার। মন চাইলে, নমাজ বা সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে তাকে ডাকা যেতে পারে। তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে কি ভাবে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায়? কি বলতে হয় ঈশ্বরের কাছে। আশঙ্কর স্পর্শ আমি অনুভব করি। মানুষ যখন সত্যি হতাশ হয়ে যায়, ঈশ্বরই বোধ হয় তার শেষ সান্ত্বনা হয়। ডাক্তার যদিও হতাশ জনক কিছু বলেন নি, কিন্তু ভালও কিছু বলেননি। তোমার আকাঙ্খই তোমাকে শিখিয়ে দেবে কি ভাবে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালে অথবা কি ভাবে নমাজ করতে হয়। প্রার্থনাটাই আসল সেলিনা। কিন্তু প্রান্তিক তুমি ছাড়া আমার কাছে ঈশ্বরের তো আর কোন প্রতিরূপ নেই। বরং তুমি বস, আমি প্রদীপ জ্বালিয়ে তোমার কাছে আমি আমার ভাবী সন্তানের মঙ্গল কামনা করি। ভীষণ হাসি পেল ওর কথায়, কিন্তু তা দমন করে বললাম সেলিনা এমন ভেঙে পড়ছ কেন? জানিনা তো, কেন আমার এমন হচ্ছে, বার বার মনে হচ্ছে তোমাকে বুঝি আর আমি কোন দিন দেখতে পাব না। তাই কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে দিতে মন চাইছেনা। বললাম সেলিনা একদিনতো তুমি বক্সিংএর চ্যালেঞ্জার ছিলে, এভাবে ভেঙে পড়া তোমার শোভা পায় না। জানি, কিন্তু তুমি বুঝতে পারছনা প্রান্তিক, আমি আমার শেষ দেখতে পাচ্ছি যেন।

    আমি ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম, সব ভয় অমূলক সেলিনা। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন কোথায় পৌঁছিয়েছে তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা। সব উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেল। ও বলল, তুমি যাবে না বল। আচ্ছা যাবে না, আর দুশ্চিন্তা করো না কিন্তু। একবার বাবাকে আসতে বলবে। কেন? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, আমার পৃথিবী চির অন্ধকার। বললাম, তাই হবে, কালই বাবাকে চিঠি দেবো, মাকে নিয়ে যেন চলে আসেন। আরেকটা কথা, যেখান থেকে পার রেহানাকে খুঁজে বের করবে? কি সব পাগলামি করছ? কোথায় খুঁজে পাব তাকে বল। ও বলল, তোমাকে তো কতবার বলেছি, আমার মধ্যে তাকে তুমি খুঁজে নাও। নিলে না। আমি রেহানা হতে চেয়ে ছিলাম, তুমি হতে দিলে না, আমার শেষ বেলাকার অনুরোধ, একটা দিন তুমি অন্তত আমাকে রেহানা বলে ডেকো। বললাম তাতে যদি তোমার মনে শান্তি আসে তাই হবে রেহানা। বাঃ কি তৃপ্তি। কি সুন্দর ভাবে ঐ নামটা তোমার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় প্রান্তিক। আমি জানি সে একদিন আসবেই আসবে। আসতে তাকে হবেই প্রান্তিক। তাকে যে আমার বোঝাতেই হবে সেলিনা তাকে ঠকাতে চায়নি। শুধু তার প্রান্তিকের হৃদয় ক্ষতকে শুকিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে তার কাছে আসতে হয়েছিল। তুমি কথা দাও কোন অজুহাতে তাকে তুমি ফিরিয়ে দেবেনা। আমি রেগে বললাম, তুমি এবার থামবে? যা সব আজে বাজে কথা চিন্তা করছে তাতে তোমার সন্তানের মঙ্গল হবে? ও আমার বুকে মুখ লুকিয়ে নীরবে কাঁদতে লাগল আর আমি তাকে কাঁদতেই দিলাম। কোন বাধা দিলাম না।

    হেড কোয়ার্টারে গিয়ে ছুটির এ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে। শিলিগুড়িতে আর ফিরে যাইনি। শুধু এর মাঝে একদিন প্রতীমকাকুর ওখানে গিয়েছিলাম, কাকুই পিসিকে ফোন করে জানিয়েছিলেন আমি যেন একবার দেখা করি। উনি বললেন, সেলিনা কেমন আছে? আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি, এসময় তোমাকে শক্ত থাকতে হবে, আর একটা সত্যি কথা বলছি যা তোমার মা ও পিসিকে বলতে পারিনি। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, কি কাকু! উনি বললেন দেখ প্রান্তিক, যে ভাবে কেসটা জটিল হয়ে গেছে, তাতে নর্মাল কিছু হবে না। মেজর অপারেশান করতে হতে পারে। তাতে কিন্তু, সেলিনার জীবন সংশয় আছে। আমি চোখের জলে চিৎকার করে বললাম না কাকু না। একি প্রান্তিক তুমি কাঁদছো। ধীরে ধীরে বললাম, আমার মনে হচ্ছে আমার চারিদিক শুধু শূন্য আর শূন্য। যে ভয় আপনি করছেন, সেলিনা তা জানে? হা জানে। আমি গভীব বেদনায় বলে উঠি তাই তার আচরণ স্বাভাবিক নয়। ও চায় না, আমি ওকে সেলিনা বলে ডাকি। তবে কি বলে ডাকবে? ও চায় আমি যেন ওকে বেহানা বলে ডাকি। রেহানাব প্রতি গভীর অভিমান নিয়ে ও বলে, আমি ঠকাতে চাইনি রেহানা। শুধু তোর প্রান্তিকের ক্ষত স্থানকে শুকিয়ে দেওয়ার জন্যে তার আসা। সে যেন বুঝতে পারছে তার শেষ দিন ঘনিয়ে এসেছে, তাই একটা দিনও অন্তত আমি যেন ওকে রেহানা বলে ডাকি। আসলে জানেন কাকু, ও আমাকে যেমনই ভালবাসুক না কেন, আমার জন্য ওর যত কষ্টই হোকনা কেন, রেহানাকে ভালবাসে ও হৃদয় দিয়ে। রেহানার মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্য ও যা করেছে সে তো বলার নয়। রেহানার প্রতি তার তীব্র অভিমান, সে কেন এমন করে পালিয়ে গেল। এমনকি আমার বাবাকে পর্যন্ত বলেছে, তিনি যেন ওকে রেহানা বলেই ডাকেন। অদ্ভুত তো প্রান্তিক। হা অদ্ভুত। ঠিক আছে তুমি নিজে শক্ত হও। এই আমার অনুরোধ। আমি কাল যাবো। সেলিনা এখন কোথায়? তোমার পিসির কাছে, না তোমার মায়ের কাছে? মায়ের কাছে। ঠিক আছে আমি কাল যাবো, তবে কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। কখন যাবেন? সন্ধ্যায়।

    এসেছিলেন প্রতীমকাকু। নিজেই গাড়ী ড্রাইভ করে। তারপর গাড়ীটা লক করে চির গম্ভীর্যের বেড়ি টপকে তিনি রাস্তা থেকে ডাকতে ডাকতে উঠলেন রেহানা, রেহানা? সেলিনা চমকে উঠে বললেন, কে ডাকছে, কাকু না, ও বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। আর প্রতীমকাকু খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়ে দ্রুত সিঁড়ি টপকে রেহানা। রেহানা বলে উপরে উঠতে লাগলেন। আমি সেলিনাকে বাধা দেওয়ার জন্য নীচে নামতে চাইলে মিনতি সেন বললেন ওকে বাধা দিস নে প্রান্তিক। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম আর আশ্চর্য হয়ে মিনতি সেন দেখছেন এই দৃশ্য। কত বছর আগের প্রতীম চৌধুরী যেন তার বাচ্চা মেয়ের সঙ্গ পাওয়ার জন্য দ্রুত এগিয়ে আসছে, আর তার মেয়ে সেও যেন ছোট্ট শিশুটি হয়ে তার বাবার কাছে যেতে চাইছে। হৃদ স্পন্দন বেড়ে চলেছে মিনতি সেনের। জীবনে এ দৃশ্যতো তার কোনদিন দেখা হতো না। কিন্তু একি হল, একটা সিঁড়িতে পা ফেলতে ভুলে গিয়ে সেলিনা তার নিজের শাড়ীতে জড়িয়ে গিয়ে পড়ে গেল। প্রতীম দ্রুত এসে তাকে ধরার আগে, বেশ কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ গড়িয়ে গেল সেলিনা। আর রক্তে লাল হয়ে গেল তার শাড়ী এবং মুহূর্তে জ্ঞান হারালো। আর প্রতীম কাকু তাকে নিজের বুকের পরে তুলে নিয়ে বললেন, রেহানা এ তুই কি করলি মা। কেন এ ভাবে নামতে গেলি। আমি তো আসছিই। আমি তো তোকে নিতে এসেছি। এরা তোকে ভুল বুঝতে পারে। আমিতো তোকে ভুল বুঝিনি মা। কেন আমাকে এমন আঘাত দিলি?

    প্রতীমের চির গাম্ভীর্যের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এল তার চোখে জল। উপরে নিয়ে গিয়ে শুয়ে দিয়ে মিনতি সেনকে বললেন, মিস সেন, ফোনটা কোথায়? মিনতি সেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সেলিনার বুকের উপর। আমি স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইলাম। একি হল সব যেন স্বপ্নের মত। প্রতীম চৌধুরী ফোন করছেন, হ্যালো পুলিশ স্টেশান। ইয়েস! এখনি চলে আসুন এত নং বাড়ীতে একটা খুন হয়েছে, খুনী নিজেই ধরা দিতে চায়। এখনি আসছি, ফোন কেটে গেল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅগ্নিপরীক্ষা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }