Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প813 Mins Read0

    ২০. তাই তোক তবে

    তাই তোক তবে। এখান থেকে বাঁকুড়া শহর বেশী পথ নয়। পৌঁছিয়ে গেলাম এক সময়। হাসপাতালে গিয়ে শুনলাম, ওর ডিউটি আজ ইভিনিংএ। কোয়ার্টারে গিয়ে যখন পৌঁছালাম, তখন বেলা প্রায় ১০টা। বেল দিতেই ও বেরিয়ে এসে আমাকে দেখেতো একেবারে অবাক। অশ্রুকণাকে গাড়ীতে বসিয়ে রেখে এসেছি। ও আমার হাত ধরে ভিতরে টেনে নিতে নিতে বলল, তোমাকে আজ সত্যি মনে প্রানে চাইছিলাম। আমি অবাক হয়ে বললাম, এত আনন্দ কেন তপতী। কেন এত আনন্দ জানিনা প্রান্তিক। শুধু মনে মনে ভাবছিলাম আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম, তুমি, সেলিনা বা অশ্ৰুদি যে কোন একজন যেন আজ আসো, আমি যেন কিছুই জানিনা এমন নিরীহ ভাবে বললাম, আজ কি তোমার নবজন্ম যে, আমাদের যে কোন একজনকে চাইছিলে। ও গম্ভীর হয়ে বলল, তা বলতে পার। কিন্তু রুকসানা নামের মেয়েটি এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে মনে হয়েছিল যদি তোমাদের যে কোন একজন আসতো। আমি তাচ্ছিল্য সহকারে বললাম কোথাকার কে রুকসানা, তার জন্য আমাদের আসার এত অধীর প্রতীক্ষা কেন? নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল জানিনা, শুধু মনে হয়েছিল, ও কিছুতেই রুকসানা হতে পারে না। ও তবে কে? আমার মনে হয় ও রেহানা। কিন্তু হাজার অনুরোধেও ও তা স্বীকার করেনি। আমি বললাম, তা হলে একটা চিঠি দিয়ে জানালেনা কেন? কাকে, তোমাকে? হ্যাঁ আমাকেই লিখতে পারতে। কোন অধিকারে প্রান্তিক? রেহানা তোমার কে? ছিঃ তপতী একথা তুমি বলতে পারলে রেহানা আমার কে? ও বলল, কোনদিন ভাবিনি, রেহানাকে নিয়ে এ ভাবে তোমার সঙ্গে কথা বলা যায়। আজ তা হলে ভাবলে কেন? তোমার আদর্শ, তোমার মহত্ত্ব তোমার সুগভীর প্রেম ও অনুভূতি গোলক ধাঁধায় হারিয়ে গেছে তাই। কি করে বুঝলে? যে দিন শুনলাম, রেহানা নয়, অদিও নয়, তোমার ঘরে তোমার স্ত্রী হয়ে এসেছে সেলিনা, সেদিন থেকে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম হায় কি বিচিত্র এই মন আর তার ভালবাসার উত্থান পতন। বললাম তুমি কিন্তু একদিন বলেছিলে, রেহানা নয়, সেলিনাই আমাকে বেশী ভালোবাসে। তাতে অস্বীকার করি না আজো। কিন্তু তুমি? তোমার সমস্ত মন জুড়ে কি সেলিনা ছিল, না রেহানা? হয়তো ওরা দুজনেই ছিল একে অপরের পরিপূরক হয়ে, কিন্তু সে কথা থাক তপতী। তোমার বিচারে রেহানার সংবাদ জানার আমার কোন অধিকার যদি নাও থাকে, জানাতে পারতে সেলিনাকে, জানাতে পারতে অশ্রুকণাকেও, ও বলল অশ্ৰুদিকে তো জানিয়েছিলাম, কিন্তু কি জানি, হয়তো তোমার প্রতি অভিমানে তোমার সমস্ত সংশ্রব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন। ততক্ষণে চুপি চুপি কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে অশ্রুকণা, এবার পর্দা ঠেলে এক রাশ অভিমান নিয়ে বলল, সত্যি তপতীদি, এরপর আর ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যায় না। অবাক হয়ে বলল, তুমি অশ্রুদি? আমার চিঠি পেয়েছিলে? আমি পাইনি, তবে ও পেয়েছিল, আর তাইতো সাত সকালে উঠে ও আমাকে এখানে ধরে নিয়ে এসেছে।

    সব তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল তপতীর। সিঁথি লাল, অথচ হাতে কোন এয়োতির চিহ্ন নেই। প্রান্তিকের সঙ্গে এসেছে একেবারে আটপৌরে একটা শাড়ী পরে। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল ওর সিঁথির দিকে, বলল, বিজয়িনী তোমাকে দেখছিলাম অশ্রুদি। ও সব কথা প্রকাশ না করে বলল, নীল রক্তে আমার জন্ম তপতীদি, মৃত্যুর আগে নীল রক্ত কখনো হারতে জানেনা। দুঃখের অনুভূতি ময় কণ্ঠে তপতী বলল, হবে হয়তো। সে যাকগে তোমাদের সঙ্গে আর কেউ এসেছে? হাসতে হাসতে অশ্রু বলল, আমার একা এই যাত্রা পথটাকেও কি তুমি কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে বলছ? তপতী বলল, সারা জীবনইতো একা পথ চলার অঙ্গীকার নিয়েছে, চললে না হয় এই সামান্য পথটুকু ভাগাভাগি করে? ও বলল সে আমার দ্বারা হবে না তপতীদি। তারপর ওর সাদা সিঁথির দিকে তাকিয়ে বলল, বরং তুমি যদি বল, আমি তোমার জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথে চলে যাবো, হাটবে নাকি ওর সঙ্গে একা দীর্ঘ পথ? তপতী বলল ঠাট্টা করছ? কেন ঠাট্টা করব। কোন কিছুকে গ্রহণ করার অপেক্ষা সহ্য হয়, কিন্তু ছাড়ার অপেক্ষা একদম সহ্য হয়না। তারপর বলল হাসিমুখে ওকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে চলে যাব, বুকে বিন্দুমাত্র ব্যথা বাজবেনা, কণ্ঠ কাঁপবেনা একটুকুও। মৃদু হেসে ও বলল ভেবে দেখব, আমার নৌকায় জায়গা আছে কি না। বরং একটুখানি বোস, সকালে নিশ্চয়ই খাওয়া হয় নি, আগে কফি নিয়ে আসি। অশ্রুকণা বলল, তার আগে চলনা ওই রুকসানা নামের মেয়েটিকে দেখে আসি।

    ও বলল, ভালই করেছ। আজ না হলে দেখা হতো না। আমার মনেও একটা ক্ষোভ থেকে যেত। উদ্বিগ্ন হয়ে অশ্রুকণা বলল, কেন? ওর আজ ছুটি হয়ে গেছে। ছুটির পরে ও কোথায় যাবে? এখানে থেকে প্রায় ৫০ কিমি দুরে এক আদিবাসী গ্রামে। ওদের মধ্যেই কাজ করেন উনি। ওদের কোন ঠিকানা আছে? নিশ্চয়ই আছে। দিতে পারবে আমায়? দেব। তার আগে আমি কফি আনছি খেয়ে চল রুকসানাকে দেখে আসবে। তাই তোক বলে চুপ করে গেল অশ্রুকণা।

    বাঁকুড়া আদিবাসী উন্নয়ন সমাজের পক্ষ থেকে, ওকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। কাল ওদের ওখান থেকে কেউ আসবে বলে জানিয়েছে। এই বেলা চল রুকসানা সত্যি রেহানা কিনা পরখ করে দেখা যাক।

    কফিটা খেয়ে বললাম চল তা হলে। তপতী, আমি ও অশ্রুকণা। কেবিনের দরজাটা বাইরে থেকে ভেজানো। তপতী জেনে নিয়েছে ভিতরে কেউ আছে কি না, যদিও এটা ভিজিটিং আওয়ার নয়। তপতী বলল, প্রান্তিক তুমি যাও। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। তাই হোক, বলে আমি ভেজানো দরজায় টোকা মারলাম। ভিতর থেকে মেয়েলী কণ্ঠস্বর ভেসে এল, খোলা আছে। দরজাটা একটু খানি ফাঁক করে দেখে নিলাম ভিতরের মানুষটাকে। দরজার দিকে পিছন ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওই গ্রীবা দেশ, কোমর থেকে নীচে নামা এক গোছা কালো চুল, তার শাড়ী পরার ভঙ্গিমা, হাত দুটো কেমন করে রাখে সেই স্মৃতি সব কিছু একাকার হয়ে মুহূর্তে আমায় জানিয়ে দিল রুকসানার আসল পরিচয়। তপতী ভুল করে নি, মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে রেহানা। সুর করে আবৃত্তি করলাম–

    একদিন এই ফাঁকা পথ দিয়ে
    এসেছিনু তব দ্বারে।
    মুগ্ধ নয়নে দেখেছি তোমা
    গোপন অন্ধকারে।

    ও তড়িতে ফিরে বলল কে আপনি? আমি হেসে ফেলে বললাম—

    চিনবে আমায় কেমন করে
    হারিয়ে গেছে মন
    সে মন আমি ফিরিয়ে দেব
    এই করেছি পণ।

    ও রেগে বলল, আপনি বেরিয়ে যান। এ ভাবে আপনাকে কে প্রবেশাধিকার দিয়েছে? একথা বলেই সিস্টার সিস্টাব করে ডেকে উঠলো। একটা কেলেংকারী হয়ে যেতে পারে ভেবে তপতী এগিয়ে এল। বলল, কি হয়েছে বলুন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, একে কে এখানে পাঠিয়েছে, তাছাড়া এটাতো ভিজিটিং আওয়ারও নয়। আমি হতবাক হয়ে ভাবছি, তবে কি আমার ভুল? অশ্রুকণা কিন্তু নিশ্চিত হয়ে এগিয়ে এসে বলল, রেহানা চিনতে পারছিসনা আমায়? তাকিয়ে দেখ আমি অশ্রুকণা, আর কাকে তুই বেরিয়ে যেতে বলছিস? প্রান্তিককে? যে তোর স্বপ্নকে পূরণ করেছে, তোর ত্যাগকে মহিমান্বিত করেছে, সেলিনাকে গ্রহণ করেছে ও জীবন সঙ্গিনী হিসাবে। একদিনতো এই জন্যই কাউকে না জানিয়ে বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলি। চেয়েছিলি ডালিম যেন তোর একান্ত আদরের সেলিনার কোন ক্ষতি না করে, আর সেই আদরের ধনকে চেয়েছিলি, তোর একান্ত আপন ও গোপন প্রান্তিকের হাতে তুলে দিতে। তুই কেন বিশ্বাস করতে পারলিনা, যে তোর ভালবাসার আবদারকে ও ফিরিয়ে দিতে পারে না। একদিনতো তোরই জন্য আমিও ওর জীবন থেকে সরে যেতে চেয়েছিলাম, পেরেছি কি? তুইও চেয়েছিলি সেলিনার জন্য ওর জীবন থেকে সরে যেতে। কিন্তু পারিসনি তাইতো এই মিথ্যে পরিচয়। আসলে তুই, আমি, আমরা পরাজিত। কিন্তু সব পরাজয় পরাজয় নয়। বাবা মা তার শিশু সন্তানের কাছে বার বার হারার অভিনয় করেন, কখনো বা সত্যি হেরে যান, সে হারার মধ্যে কোনও অগৌরব নেই। হয়তো ডালিমকে পথ দেখাতে চেয়ে তুই তার মঙ্গলই করেছি, কিন্তু নিজেকে এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে কিসের সন্ধান পাবি তুই? তুই মিনতি পিসিকে বলেছি তাকে একবার মা বলে ডাকতে তোর ভীষণ ইচ্ছে। জানিস কি, তোর সেই ঋণের বোঝা নিজের কাঁধে নিয়ে প্রান্তিক মিনতি সেনের ছেলে হয়ে তোরই ঋণ শোধ করে চলেছে। কি করে ভুলে গেলি তাকে, কি করে ভুলে গেলি, প্রান্তিকের গ্রামে গিয়ে তার বাবাকে বাবা বলে ডেকে তোর সেই আবদার। মেয়ে বলে মেনেছেন ভবিষ্যতে অস্বীকার করবেন না তো? কিন্তু তোর জীবনে এসবের কোন মূল্য নেই। তোর কাছে তোর নিজের অভিমানটাই বড়। বারবার চিঠিতে লিখে গেছিস তোকে যেন না খোঁজা হয়, নিজেই আবার তুই আসবি। এত করেও তোর পরীক্ষা নেওয়া শেষ হলনা রেহানা? জানিস্ তুই সেলিনার কি ক্ষতি করেছিস? ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রেহানা অশ্রুকণার চোখের দিকে। অশ্রুকণা বলে চলেছে, বুঝতে পারবিনা রেহানা নিজের অজান্তে কতবড় ক্ষতি করেছিস ওর, তোর এই পালিয়ে বেড়ানোতে, তুই না ভাল করেছিস প্রান্তিকের না ভাল করলি সেলিনার। ছিঃ এই কি তোর ভালবাসা? ডালিমকে বলেছিস প্রান্তিক তোর গুরু, আর এই তোর গুরুদক্ষিণা?

    ও নীরবে সব শুনলো, তারপর শান্তভাবে বলল, এত কথা জেনে আমার কি লাভ? তাছাড়া আপনারা কে? কেন আমাকে এত কথা শোনাচ্ছেন! কেন আমাকে রেহানা বলে ভুল করছেন। আমিতো বলেছি আমি রেহানা নই, আমি রুকসানা। অশ্রুকণা আর থাকতে পারল না বলল তুই রেহানা নোস? না–না–না! অশ্রুর চোখের ইঙ্গিতে আমি ও তপতী বেরিয়ে এলাম, অশ্রুকণা বলল, তুই যে রেহানা নোস তার কোন প্রমান আছে তোর কাছে? ও বলল, আমি যে রেহানা তার কি কোন প্রমান আছে? অশ্রুকণা চকিতে তার শাড়ীর আঁচলটা সরিয়ে দিয়ে উন্মুক্ত পিঠে হাত দিয়ে বলল, এই সেই জরুল, এই যে তার নীচে যে আঘাতের দাগ, যা শয়তানদের অত্যাচারে এখনো জাজ্বল্যমান, এসব কি রেহানার প্রমান নয়? আরো প্রমান চাস? না–না চাইনে বলে দু হাতে চোখ ঢেকে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। অশ্রুকণা তাকে কোন রকমের সান্ত্বনা না দিয়ে নীরবে বেরিয়ে এসে আমাকে বলল, তুমি যাও প্রান্তিক। ওকে রাজী করাও, ওকে আমার ওখানে নিয়ে যাব।

    তপতী ও অশ্রুকশা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল, আমি ভিতরে গিয়ে ওর পাশে বসে, পরম মমতায় ওর চুল গুলোকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে ওর উন্মুক্ত পিঠে হাত রাখলাম। ও আরো জোরে শব্দহীন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ওর শরীরের ওঠানামায় ওর কান্নার গভীরতা অনুভব করতে পারছি। বুঝতে পারছি কান্না ওর ভীষণ দরকার। আর ওর কামার স্পর্শ যেন, ছোঁয়াচে রোগের মত আমাকে বার বার ছুঁয়ে যাচ্ছে? খানিক পরে ডাকলাম, রেহানা? ও আস্তে আস্তে উঠে বসল। নিজের শাড়ির আঁচলে মুছে নিল চোখের জল। তারপর বলল, ওই নামে আমায় ডেকোনা প্রান্তিক। রেহানার মৃত্যু হয়ে গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেছে রেহানার জন্মান্তর। আমি রুকসানা। বললাম, মিনতি সেনকে দেখতে ইচ্ছে : করে না? না। নীলাঞ্জনা পিসিকে? না। তোমার মা আফরোজ বেগমকে। বলেছিতো না-না-না। কাউকে দেখতে ইচ্ছে করে না। তবে মিথ্যে বলবনা প্রান্তিক, ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে একজনকে। কে? ও বলল, তোমার বাবা, গ্রামের সেই শান্তসৌম্য মানুষটিকে, যিনি আমাকে মেয়ে হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাকে কথা দিয়েছিলাম, মেয়ে বলে ডেকেছেন, পরে অস্বীকার করবেন নাতো! একবার শুধু একবার তাকে দেখতে ইচ্ছে করে। তারপর আবার চলে যাব আমার নিজের কর্মক্ষেত্র আদিবাসীদের মধ্যে। খুব ভাল কথা। জীবনের কর্ম যজ্ঞ সবার জন্যেতো এক নয়। তুমি যে এই ক্ষুদ্র সংসারের জন্যে নও, তা সেদিনই জানতে পেরেছিলাম, যেদিন তুমি তোমার ভালবাসাকে রূপান্তরিত করে প্রেমিককে বানিয়েছিলে গুরু। কেন আমাকে এমন করে মাটি থেকে ছিন্ন করে ছুঁড়ে দিলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে? হয়তো বৃহতের আহ্বান শুনেছো তুমি, তাই ক্ষুদ্রকে বিসর্জন দিতে তোমার বুকটা কাপল না একবারও। এত নির্মম আর নিষ্ঠুর যে, অতীতের যা কিছু সব ভুলে যেতে চাইছো, ভুলে যেতে চাইছে প্রান্তিকের ভালবাসা পর্যন্ত।

    ও বলল, তুমি চুপকর প্রান্তিক! আমি বললাম কেন চুপ করব? অসহায় আদিবাসীদের কল্যাণে নিয়োজিত প্রাণের যদি অধিকার থাকে, তার অতীতকে কাঁদাবার তবে আমার কেন অধিকার থাকবেনা, আঘাতে আঘাতে তোমাকে সেই অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তা আর হয়না প্রান্তিক। আমি যে নিবেদিত আদিবাসীদের মঙ্গল কামনায়। সেখান থেকে আমাকে আর ফিরে আসতে বলো না। বললাম, বেশ ডাকব না, কিন্তু যে সেলিনার জন্য তুমি এত করলে একবার দেখবেনা, বধূরূপে তাকে কেমন লাগছে। উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার দুটি চোখ। বলল এসেছে তোমার সাথে? এসেছে, তবে এই হাসপাতালে নয়। কোথায়? অশ্রুর ওখানে। তারপর বললাম, চলনা রেহানা, আর একবার আমরা সবাই সবাইকে চিনে নিই। ও বলল তা আর হয় না প্রান্তিক। জীবনে যা পেয়েছি তা আর নতুন করে পেতে চাইনে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, তুমি সেলিনাকে গ্রহণ করেছে এ যে আমার কি আনন্দ তা তোমাকে বোঝাবার নয়। আমি বললাম, তোমার আনন্দটাই সব নয় রেহানা। তোমার স্মৃতি তাকে কি করম বিকারগ্রস্থ করে দিয়েছে, কি চেয়েছিলে আর কি হয়েছে সেই অভিশাপকে দেখবেনা? ও আতঙ্কিত হয়ে বলল, কি বলছ প্রান্তিক! আমি যা বলছি তাইতো তোমাকে নিজের চোখে দেখে আসতে বলছি। তুমি ভাবতে পারবেনা, রেহানা হওয়ার জন্য। সেলিনার সেই অক্লান্ত প্রয়াস। সে নিজের জীবন থেকে সেলিনা নামাটাই মুছে দিতে চায়। তার আবদার তাকে রেহানা নামে ডাকতে হবে। সেই দুরন্ত ছটফটে মেয়েটির কি করুন মৃত্যু তা না দেখলে তোমার পথ চলা যে শেষ হবে না। কি যেন ভাবতে লাগল ও, তারপর। বলল, সেলিনাকে তোমার বাবা মেনে নিয়েছেন? হ্যাঁ, মেনে নিয়েছেন। তোমার পিসি এবং মিনতি সেন মানে আমার মা? হ্যাঁ নিয়েছেন। আর আমার জন্মদায়িনী মা আফরোজ বেগম। আমার চোখ ছল ছল করে উঠলো। বললাম তুমি বোধ হয় তোমার মায়ের সর্বশেষ সংবাদ এ জান না। কেন কি হয়েছে? অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো ওর বুক। আমি ধীরে ধীরে বললাম, চোখ বোজার আগে, উনি আমার হাতে সেলিনাকে দিয়ে বললেন, ও যদি স্বেচ্ছায় তোমাকে ও তোমার পিসিকে ছেড়ে না যায়, তাহলে ওর সব দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম প্রান্তিক। আমাকে ফিরিয়ে দিও না। সেলিনা এবং আমি আতঙ্কিত হয়ে বলতে চাইলাম, এ হয় না। মৃদু হেসে আফরোজ বেগম বললেন অনেক ভুল করেছি। আর করতে চাই না। না প্রান্তিক তোমার জীবনে রেহানার যে স্থান, সেখানে ওকে দিয়ে যাচ্ছিনা, ওর ভাল মন্দের দায়িত্ব শুধু তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। মা নেই? বলে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল রেহানা। আমি ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললাম। নিয়তিকে অস্বীকার করবার শক্তি আমাদের কারো নেই। কিন্তু রেহানা, সেলিনাকে সবাই মেনে নিয়েছে কিনা জানতে চেয়েছো, কিন্তু আমি মেনে নিলাম কি না সেতো জানতে চাইলে না। মৃদু হাসল রেহানা, এ সেই হাসি, যে হাসি আমায় একদিন মুগ্ধ করে রাখতো ঘন্টার পর ঘন্টা। তারপর বলল, আমার কোন ইচ্ছেকে তো তুমি কোন দিন অস্বীকার করনি, আজই বা করবে কেন? আমিতো মনে প্রানে চেয়েছিলাম, ওকে তুমি আপন করে নাও। যত কষ্টই হোক তোমার, আমি জানি আমার এ ইচ্ছেকে তুমি অমৰ্য্যাদা করতে পার না। বললাম ভালো কথা। তোমাদের কারো কাছে আমি কোন রক্তমাংসের মানুষ নই। আমার কোন ইচ্ছে অনিচ্ছা থাকতে নেই। আমি একটা জড় পদার্থ মাত্র। আর সেই জড় পদার্থের অধিকার নিয়ে তোমাদের কাড়াকাড়ি। একবার ভাবলেও না রক্তমাংসের মানুষটির নিজস্ব কোন চাওয়া পাওয়া আছে কি না। মনে হল ভীষণ আঘাত পেয়েছে ও। বলল দেখ প্রান্তিক, তোমাকে আমি আমার গুরু হিসাবে মেনে নিয়েছি। একদিন বলেছিলাম ডালিমকে তোমার কথা উঠতে। সবকিছুকে মেনে নেওয়ার শিক্ষা মানুষকে ভালবাসার শিক্ষা, আমি পেয়েছি আমার গুরুর কাছ থেকে। সেই তুমি আজ যদি নতুন নির্দেশ দাও তাও মেনে নেবো অক্ষরে অক্ষরে। অশ্রুকণা আমাকে গুরু দক্ষিণার কথা স্মরণ করিয়ে আমার বিবেককে জাগাতে চেয়েছে। আজ তুমিও বলছো, তোমার কথা নাকি আমি একদমও ভাবিনি। সত্যি কি তাই প্রান্তিক? তুমি কি চেয়েছিলে তোমাকে নিয়ে একটা সঙ্কট তৈরি হোক, আর সেই সঙ্কটের ভিতর দিয়ে আমাদের চরম স্বার্থন্বেষী চেহারাটা কংকালের মতো বেরিয়ে আসুক। আর সেটাই যদি হয় তোমার গুরুদক্ষিণার দাবী, তাহলে বল কি করতে হবে আমায়। প্রচন্ড অভিমানে যেন কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। বললাম, না রেহানা, তোমাকে আর আমার দেনা পাওনার সাথে মেলাতে চাইনে। তোমার আপন পথে চলার অধিকার দিলাম তোমাকে। যে মহৎ প্রেম তোমাকে আজ জনারণ্যের মাঝে নিয়ে এসেছে তার থেকে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল আমার করে পেতে চাইনে। শুধু অনুরোধ, তোমার ছায়াটুকু সরিয়ে নাও সেলিনার জীবন থেকে, শুধু ওকে সেলিনা হয়ে বাঁচতে দাও। ও বলল তাই হবে। যাব আমি অশ্রুর ওখানে। দু চোখ ভরে দেখবো তোমাদের। তারপর চলে যাবো। আমিও তো রক্ত মাংসের মানুষ প্রান্তিক। তাইতো নিরাকার আল্লাহ বা প্রানহীন পাষাণ মুর্তির কাছে, আমার মুক্তির আবেদন না জানিয়ে রক্ত মাংসের মানুষের মধ্যেই, নিজের মুক্তি খুঁজে ফিরছি। তাদের ভালবাসার মধ্যে যে আমি তোমার ভালবাসার স্পর্শ পেতে চাই প্রান্তিক। আর স্বপ্ন দেখতে চাই, পথ প্রান্তে ক্লান্ত তোমাদের হয়তো বা কোন দিন বরণ করে নেওয়ার জন্য রেহানা অপেক্ষা করছে। আমি বললাম, তাই যেন হয়। তোমার স্বপ্ন যেন সত্য ও সুন্দরের স্পর্শে চির অমলিন হয়। এবার চল আমাদের সাথে।

    তপতী ও অশ্রুকণা ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে বলল, তা হলে মিথ্যে মেখলা খুলে ফেলেছিস বল। তারপর বলল, তোর চলার পথে বাধা সৃষ্টি করতে চাইনে। কিন্তু রেহানা একবার আমার দিকে তাকা। আমাকে তোর কিছুই বলার নেই? আছে অঞ। অনেক কথাই বলার আছে। কিন্তু যে কথা বলব, সে তো ওর কথা। বরং আমার হয়ে ওই তোকে বলবে। তবু তার মুখ দিয়ে যে কিছু শুনতে চাই। ও বলল, সেদিন যখন সকলের অগোচরে পথে নেমেছিলাম, মনে একটাই ইচ্ছে ছিল ডালিমদের ষড়যন্ত্রে যেন শেষ না হয়ে যায় ফুলের মত দুটো জীবন। একজনের মধ্যে তীব্র আগুন, আরেকজনের দ্যোদূল্যমানতা, আমায় সংকল্পে অটল করে। মনে মনে ভাবি, তুলনাহীন এই ভালবাসাকে আমি ব্যর্থ করে দিতে পারি না। যারা ব্যর্থ করে দিতে চায় একবার তাদের মানবিকতার কাছে আবেদন জানাবো। যদি শোনে ভাল, না হলে নিজেই শাস্তি দেব। তবু কিছুতেই সেলিনার প্রেমকে ব্যর্থ হতে দেব না। আর তাই নিজের পরিচয়কে গোপন করে গিয়েছিলাম ডালিমের কাছে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে পড়ে গেল প্রান্তিকের মুখ। তার কথা। হৃদয় জয় করতে হয় ভালবাসা দিয়ে। মুহূর্তে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ডালিমকে বললাম, তোমাকে আমিই পথ দেখাবো ডালিম। ও সাতদিন সময় নিয়েছিল। কিন্তু বুঝতে পারিনি, জীবনের অঙ্ক সহজ ভাবে মেলে না। একদিকে প্রান্তিক তার আচরণের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছে নতুন পথ, আর ডালিমের মৃত্যু আমাকে দিয়েছে সত্যের সন্ধান। যে সত্যের সন্ধান আমি পেয়েছি প্রান্তিকের কাছ থেকে। আমি জানি সে সত্যের সন্ধান, এতদিনে তুইও পেয়ে গেছিস তাই নতুন করে তোকে কিছু বলার নেই অশ্রু। নিশ্চয়ই তোদের গাড়ী প্রস্তুত। অশ্রু বলল, হ্যাঁ, প্রস্তুত। তা হলে ওঠা যাক। তপতী এতক্ষণ কোন কথা না বলে এক পাশে দাঁড়িয়েছিল। রেহানা আস্তে আস্তে তার কাছে এসে তার দুটো হাত ধরে বলল, তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই তপতীদি। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তোমায় ছোট করতে চাইনে। শুধু একবার অনুমতি দাও আমার শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে। রেহানা। চোখ দুটো ওর ছল ছল করছে। রেহানা বলল, নতুন করে আর কোন কিছু বলার নেই তপতীদি। আমি আবার আসব তোমার কাছে, বার বার আসব। তোমার চোখ দিয়ে দেখব আমি নীল আকাশ সবুজ প্রান্তর আর জ্যোছনার প্লাবন। এতদিনের মিথ্যাচারকে অভিমানের আড়ালে চাপা দিয়ে আমায় তুমি দূরে সরিয়ে দিওনা তপতীদি। অশ্রু বা সেলিনাকে যা দিতে পারব না, সেই কষ্টের বোঝা তোমার পায়ে নামিয়ে রেখে আমি আমার শ্রদ্ধা জানালাম। কোনো অজুহাতে তা ফিরিয়ে দিওনা। বলে সত্যি সত্যি রেহানা তপতীর পায়ে হাত রাখতে যেতেই তপতী তাকে দুহাতে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, তোমার দেওয়া কষ্ট আমার বুকের মধ্যে নিয়ে তোমায় আমি ঋণমুক্ত করলাম রেহানা। আমার দরজা চিরদিন তোমার জন্য ভোলা রইল। আমার চোখ দিয়ে এই বিরাট পৃথিবীকে তুমি আর কতটুকু দেখতে পাবে। বরং আমিই দেখব তোমার চোখ দিয়ে এই পৃথিবীকে, এইটুকু দাবীর অধিকার তুমি আমায় দাও ভাই। তাই দিলাম তপতীদি। এবার অশ্রুকে তাড়া দিয়ে বলল, চল তা হলে, ওরা এসে গেলে হয়তো আবার পথরোধ করে দাঁড়াবে। এবারও যাওয়া হবে না।

    আমাদের গাড়ীটা ছেড়ে দিল। তপতী তাকিয়ে আছে যতক্ষণ দেখা যায়। যখন আমরা অশ্রুদের ওখানে পৌঁছালাম তখন দুপুরের সূর্য বেশ খানিকটা হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। আমরা না যাওয়াতে সেলিনা ও প্রতীমবাবু ফিরে এসেছেন বেশ খানিকটা আগে। কিন্তু সব কিছু বন্ধ থাকাতে সীতা শুধু ফাঁকা বারান্দায় বসে পাহারা দিচ্ছে শূন্য খাঁ খাঁ বাড়ীটা। সেলিনা জিজ্ঞাসা করল অশ্ৰুদি কোথায়? তাতো জানিনা বৌদিমনি। আপনারা বসুন, আমি সতভূষণ বাবুকে ডেকে আনছি। প্রতীম বাবু বললেন, দরকার নেই, তুমি এখানেই থাক, আমরা ওর ওখানে যাচ্ছি। অশ্রু এলে আমাদের সংবাদ দিও। তাই হবে বলে ও ঘাড় নাড়ল। আমরা এসে যখন শুনলাম, তখন অশ্রুকে বললাম তুমি রেহনাকে নিয়ে ঘরে যাও, আমি দেখছি।

    সবে কফির কাপে ঠোঁট দুইয়েছেন আমি দ্রুত ঘরে প্রবেশ করতেই কনক বলল, দাদা তুমি? এত তাড়াতাড়ি চলে এলে? আমি ওর কোন কথার উত্তর না দিয়ে সেলিনাকে বললাম, সেলিনা, রেহানা এসেছে। যুগপত বিস্মিত হয়ে প্রতীমবাবু বললেন কে রেহানা? হ্যাঁ, কাকু। তাহলে চল আর দেরি নয়। সংবাদটা শুনে সেলিনা যেন নীরব হয়ে গেল। কফির কাপটাকে ও আর ঠোঁটের কাছে আনতেই পারলনা। থরথর করে কাঁপছে ও। কনক এসে ওকে ধরে বলল, বৌদি তোমার কি শরীর খারাপ কবছে? প্রতীমবাবু বললেন, কি হলো মা! তারপর ওকে দুহাতে তুলে বললেন, এস তোমাকে শুইয়ে দিই। ও বলল, না কাকু, দরকার নেই চল।

    কনক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে, কত যেন প্রশ্ন আছে ওর। প্রতীমবাবু সেলিনাকে নিয়ে এগুতেই কনক বলল দাদা, রেহানা কে? বললাম ওর দিদি, কিন্তু বোন, এখন আর কিছু জানতে চাসনে পরে আসব।

    চলে এলাম, কতদিন পরে মুখোমুখি রেহানা ও সেলিনা। দুজনেই দুজনার দিকে তাকিয়ে আছে ভাষাহীন অপলক চোখে। তারপর এক সময় বেহানা বলল, কি রে আমাকে চিনতে পারছিস না। ও কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে দেখে বলল, কি অপূর্ব লাগছে তোকে। আয়না আমার কাছে। তবুও স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছে দেখে বলল, এত অভিমান! সেলিনা এবার তাকালো অশ্রুকণার দিকে! তার রক্তিম সিঁথি তাকে কি কোন নতুন সংকেত দিতে চাইছে। কিন্তু নিজেকে যথা সম্ভব সংযত রেখে বলল, কাকু, এই রেহানা, যার ভালবাসার স্রোতে আমি ভেসে ভেসে এসেছি প্রান্তিকের কাছে। এবার যার জিনিষ তার হাতে তুলে দিয়ে আমিও ছুটি চাই কাকু! প্রতীমবাবু অবাক হয়ে দেখছেন রেহানার স্নিগ্ধ রূপ, যা জোছনার মিগ্ধতাকেও হার মানায়। রেহানা কাছে এসে প্রণাম করে বলল, ওকে বুঝিয়ে বলুন কাকু ওর কাছ থেকে আমি কিছু নিতে আসিনি, দিতে এসেছি সর্বস্ব উজাড় করে নিজেকে রিক্ত করে ঋণমুক্ত হতে। প্রতীমবাবু বললেন, আমি জানি মা। তুমি ওকে ভুল বুঝোনা। তুমি ভাবতেও পারবেনা, কি প্রাণান্তকর প্রয়াসে, ও প্রান্তিকের কাছে শুধু রেহানা হতে চেয়েছে। যাতে প্রান্তিকের জীবনে তোমার জন্য কোন শূন্যতা না থাকে। তোমরা কথা বল। আমরা পাশের ঘরে আছি।

    অশ্রু, আমি এবং প্রতীম কাকু পাশের ঘরে চলে এলাম। রেহানা বলল, একি পাগলামি করছিস সেলিনা। রেহানার শান্ত সরোবরে প্রান্তিক হয়তো স্নান করতে পারে, ভাসতে পারে না। তুই কি বুঝিসনা যে উদ্দাম ঝড় নিয়ে ওকে তুই উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাস, সেখানেই। ওর মুক্তি, তোরও মুক্তি। কেন মিথ্যে নিজেকে রেহানা বানাতে চাইছিস। প্রান্তিক কেবল মুক্তি পেতে পারে তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সাগরের ঊর্মিমালায়। ওর সেই মনটাকে বুঝতে না চেয়ে নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস ওকেও কষ্ট দিচ্ছিস। সেলিনা এবার বলল আমার কষ্টটাই কি সব? তুই কি বলতে চাস তোর কষ্ট আমি বুঝি না। তুই জানিসনা, আমার মাঝে ও শুধু তোকে খোঁজে। কেমন করে আমি তাকে বোঝাবো, এভাবে সেলিনার মধ্যে রেহানাকে পাওয়া যায় না। তাই উদাস চোখে অতীত স্মৃতিচারণায় ওর মন যখন ভারি হয়ে ওঠে, সেলিনার উদ্দামতা সে মূহর্তে ও চায় না রেহানা। ও শুধু তোকে খোঁজে। আমি স্ত্রী হয়ে কি ভাবে ওর কষ্ট লাঘব করব তুই আমায় বলে দে। ওকে কাছে টেনে নিয়ে পাশে বসিয়ে বলল। ও তোর ভুল সেলিনা। সে সময় ও তোকেই চায়। সেলিনার উদ্দাম ঝড়ে সে নিজেকে সঁপে দিতে চায়, আর তুই ভুল বুঝে অন্য কিছু হতে চাস বলে ওর কষ্টটা শুধু বাড়িয়ে দিস। রেহানা! হারে সেলিনা ঠিক তাই। আর ভুল করিসনি লক্ষ্মীটি। প্রান্তিকের রক্তের উত্তরাধিকার তোর মধ্যে বড় হচ্ছে। সেই উত্তরাধিকারের একমাত্র দাবীদার হয়ে ওর জীবনটাকে মরুভূমি করে দিসনে। জানি আমার জন্য তোর কষ্ট হয়, তাইতো তুই নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে একটু একটু করে প্রান্তিকের দিকে এগিয়ে দিয়েছিস আমাকে। আমি কি বুঝি না বলতে চাস? তারপর বলল যেখানে তোর জন্ম, তাদের কাছে তোর ওই সিঁথির সিঁদুর হয়তো খেলার অলংকার মাত্র, কিন্তু এদের কাছে এর যে কি অসীম মূল্য তা হয়তো এতদিনে জেনে গেছিস, তাই কথা দে, কোনদিন ওকে তুই আঘাত দিবিনা। সেলিনা বলল, এত কষ্ট তুই কেমন করে সইবি রেহানা। ভয় নেই সেলিনা, একদিন গুরু হিসাবে যাকে মেনে নিয়েছিলাম, আজো মানি, আমার চলার পথে ওর আর্শীবাদ আমি পেয়ে গেছি, সেলিনা এবার এসেছি তোর কাছ থেকে মুক্তি নিতে। দিবিনা আমায় মুক্তি? সেলিনা কায়ায় ভেঙে পড়ে বলল পারবো না রেহানা, কিছুতেই পারবো না তোর কাছ থেকে ওকে কেড়ে নিতে। তা হলে কি চাস তুই, তোর কাছ থেকে ওকে আমায় কেড়ে নিতে বলছিস? নারে রেহানা, একদিন যেমন বুঝতেও দিইনি, আমার কষ্ট কোথায়, আজও তেমনি করে ওকে তোর জন্য রেখে দিয়ে আমি ফিরে যেতে চাই। পাগল। এইজন্য বুঝি বরমাল্য দিয়ে ওকে গ্রহণ করেছিলি? ওর দেওয়া সিঁদুরে তোর সিঁথি লাল, আজ আর পালাবি কোথায়? তবু আমি পারব না রেহানা। রেহানা বলল, দেখ সেলিনা আর এই ভাবে এতগুলো জীবন নষ্ট করে দিসনা। তারপর বলল, কেন পারবিনা। ভয়টা কোথায়? আমি তোকে অভয় দিচ্ছি রেহানার অশরীরী ছায়া তোকে কোনদিন আর স্পর্শ করবেনা। দুর থেকে আমি তোদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবো। তোর অশ্ৰুদি থাকবে পাশে সদা জাগ্রত প্রহরীর মতো। জীবনে যাতে কোন ভুল না করিস। থাকবেন নীলাঞ্জনা পিসি এবং আমার মা মিনতি সেন। অভিভাবকের মতো আছেন প্রতীম কাকু, আর সবার ওপরে রয়েছে প্রান্তিক, যে তোর যাবতীয় ভয় ও আশঙ্কা কাটিয়ে তোকে আপন করে নেওয়ার জন্য। আর একটা কথা সেলিনা, তুই সেলিন, যে সেলিনার উদ্দাম প্রেমের কাছে ধরা দিয়েছে প্রান্তিক, রেহানার প্রেম সেখানে কোনদিনও পোঁছাবেনা। তাই মিথ্যে আশঙ্কা ত্যাগ করে, তোর দুরন্ত ঝড়ো প্রেমে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যা, এই আমার শেষ অনুরোধ। ভুলে যাসনে তোর রক্তমাংসে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে প্রান্তিকের উত্তরাধিকার। তার কাছে তুই কি কৈফিয়ৎ দিবি?

    সেলিনা বলল, কিন্তু সে আসবে কী না তারতো কোন নিশ্চয়তা নেই। বিস্মিত হয়ে, রেহানা বলল কেন? সেলিনা সেদিনের সব ঘটনা খুলে বললে, রেহানা বলল, প্রান্তিক হয়ে, রেহানা বলল কেন? সেলিনা সেদিনের সব ঘটনা খুলে বললে, রেহানা বলল, প্রান্তিক আমায় সব কথা বললেও ও প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে। হয়তো আমায় আঘাত দিতে চায়নি। কিন্তু সেলিনা সেদিন যাইই ঘটুক না কেন, সে সব ঘটেছে রেহানার অশরিরী উপস্থিতিতে। ও আঘাত হোর ও তোর সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। সে আসবেই, তাই তাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য নিজেদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত কর। সব শেষে আশীর্বাদ চেয়ে নে প্রান্তিকের বাবা ও মায়ের কাছ থেকে, কারণ ওর রক্তধারাতো তাদেরই থেকে বয়ে আসছে। সেলিনা শুধু দেখছে অবাক হয়ে তার দিদি রেহানাকে। এর পর রেহানা ডাকল, অশ্রু তোরা একবার এ ঘরে আসবি? আমরা সবাই এঘরে এলে, আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, প্রান্তিক, মনের সম বিধা কাটিয়ে সেলিনাকে তুমি একান্ত করে নাও। ওর অভিমানকে গভীর মমতায় মুছিয়ে দিয়ে রেহানাকে নিষ্কলুষ কর। তোমার জীবনে রেহানাব ছায়াও যাতে না পড়ে সেই আর্শীবাদ তুমি আমায় কর প্রান্তিক। ও এই প্রথম তার মাথা নামিয়ে দিলো আমার পায়ের কাছে। বললাম তাই হবে রেহানা। এবার রেহানা এগিয়ে এসে প্রতীমবাবুকে বললেন, যে আদর্শ ও ভালবাসার অতুল ঐশ্বর্য নিয়ে আপনি এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন আমাকে তার শরিক করে নেবেন কাকু? বুঝতে পারছি প্রতীম বাবুর বুকের মধ্যে যেন কি হচ্ছে। বললেন, রেহানা মা, তোমাকে পথ দেখাবার সাধ্য কোথায় আমার? শুধু তোমার চলার পথকে আরো সুগম করার অঙ্গীকার করতে পারি মাত্র। তা হলে তাই করুন। কি করতে হবে মা। শুধু আপনার ড্রাইভার আকবরকে বলুন আমাকে যেন আমার কর্মক্ষেত্রে একটু পৌঁছিয়ে দেয়। ওরা আমার পথ চেয়ে আছে। সেলিনা, আমি ও অকণা একসঙ্গে বলে উঠলাম রেহানা! প্রতীমবাবু বললেন, কেন বাধা দিচ্ছো! ওকে যেতে দাও। অশ্রুকণা বলল, আমাকে কিছু বলবিনা রেহানা? হ্যাঁ বলব। আমার মা মিনতি সেনকে আমার কথা বলিস, কাজ যখন শেষ হবে, যাবো তার কাছে ফিরে, ততদিন যেন আমার জন্য অপেক্ষা করেন।

    আকবর গাড়ী নিয়ে এল। আস্তে আস্তে রেহানা গাড়ীতে গিয়ে উঠলে! অশ্রু এগিয়ে এসে বলল আর কিছু বলবিনা। সেলিনাকে দেখিস, আর! হাসল একটু, তারপর বলল, যে সত্য রক্তের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে, মঙ্গলদীপ জ্বেলে তাকে বাঁচিয়ে রাখিস ভাই। গাড়ী ছেড়ে দিল। সেলিনা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, দিদি, যাসনে। অনেকক্ষণ পরে আমি ওকে বললাম ঘরে চল সেলিনা। চোখের জল মুছে ও শুধু বলল হ্যাঁ, তাই চল।

    -: সমাপ্ত :-

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅগ্নিপরীক্ষা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }