Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প813 Mins Read0

    ০৪. দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে

    দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। শিয়ালদা স্টেশানে এসে শুনলাম ডায়মন্ডহারবার লাইনে তার কাটা গেছে। বিকালের আগে লাইন ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পিসি বললেন না, আজকের দিনটা একেবারে খারাপ। শুধু ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি করবে? তুমি যা বলবে। আমি আর কি বলব। আজকে আমি তোমার উপরে নিজেকে ছেড়ে দিলাম। যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই যাবো। বললাম আমার সাধ্য কোথায় পিসি। তবু কোথাও চল। এভাবে স্টেশানে বসে থাকা যায় না কি? তোমার কোন বন্ধুদের বাড়ী নেই কাছাকাছি? আছে কিন্তু আমার হঠাৎ হঠাৎ যাওয়া আর তোমাকে নিয়ে যাওয়া কি এক। বরং চল দক্ষিণেশ্বর যাই। ওখান থেকে নৌকোয় বেলুড় তারপর ফিরে আসা। সন্ধ্যার দিকে না হয় একবার মন্দিরে ঢুকে আরতি দেখা। হা সেই ভালো।

    দুপুরের দিকে একটা ডানকুনি লোকালে উঠে দক্ষিণেশ্বর এলাম আমরা। পঞ্চবটী বনে অনেকক্ষণ বসে থেকে গঙ্গাকে দেখলাম। পিসি বললেন, এখানে এলে আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের বাড়ীর পাশে যে নদী, প্রায়ই সেখানে এসে নদীর পাড়ে বসতাম। নদী যে কেন আমাকে এত টানে কে জানে? বাবা মায়ের কাছে এই নিয়ে কত বকুনি খেয়েছি, তবু আসতাম। তুমি একা? প্রায়ই একা আসতাম। মাঝে মাঝে বন্ধুদের কেউ কেউ থাকতত। কিন্তু আমার মতো তারা কেউ নদীপাগল ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হতো আমি বুঝি নদীর প্রেমে পড়ে গেছি। এত যে তোমার নদী ভাললাগে, তাহলে, বাসার কাছেও তো গঙ্গা আছে, যেতে পারোতো। পিসি বললেন না ঐ বাবুঘাট, আউটট্রাম ঘাট, এ গঙ্গা আমার একদম ভালো লাগেনা। আর এই দক্ষিণেশ্বর? না, এটা খুব একটা খারাপ লাগেনা। কিন্তু আমার ভীষণ ভাল লাগে, গঙ্গার নির্জন ঘাট। হয় শুধু আমি একা, অথবা আমাকে যে বুঝতে পারে এমন কেউ সঙ্গে থাকবে।

    জানি, পিসির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করা ধৃষ্টতা। তবু এমন কতকগুলো মুহূর্ত আসে জীবনে, তখন একাকার হয়ে যায় এই সব আপাত ব্যবধানের সম্পর্ক। তাই হয়তো কবিগুরুরও অসুবিধা হয় না সুরের তান তুলতে হৃদয় তন্ত্রীতে। তবু চুপ করে আছি দেখে পিসি বললেন, কিভাবছে প্রান্তিক। তোমার কথা। আমার কথা? হ্যাঁ তোমার কথা পিসি। তুমি যখন গ্রামে ছিলে আমি তখন কত ছোট। দূর থেকে দেখতাম তোমাকে। মাঝে মাঝে গাল টিপে দিতে। তারপর হাসতে হাসতে চলে যেতে। আমার খুব অভিমান হতো তোমার পরে। কেন? আমার কেন যেন মনে হতো আমি ছোট বলেই তুমি আমার সাথে কথা বলনা। মনে মনে শুধু ভাবতাম আমি কবে বড় হবো। বড় হলেতো তুমি আর কথা বলে পারবেনা।

    পিসি একটু হাসলেন শুধু। আমি বললাম হাসছো যে। না হাসিনি, আসলে জানকি প্রান্তিক, সব শিশুরাই তাই ভাবে। তারা কবে বড় হবে? বড় হলে তার সাধগুলো, স্বপ্নগুলো তারা নিজেরাই পূর্ণ করতে পারবে। কিন্তু তা আর পারেনা। বড় হওয়ার সাথে সাথে ছোট বেলার সেই স্বপ্নগুলো মরে গিয়ে অথবা দূরে সরে গিয়ে আরো নতুন নতুন স্বপ্ন নতুন নতুন ইচ্ছে মনের উপর আছড়ে পড়ে। অবহেলায় পড়ে থাকে ছোট বেলার সাধ ও আকাঙ্খ। এটাই জগতের নিয়ম। আসলে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় প্রান্তিক। আমি বললাম, মানিনা তোমার কথা। কি মানো? এই যে তুমি বললে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শৈশবের স্বপ্নগুলো মরে যায়। মরেনা বুঝি? এক চিলতে রহস্যময়ী হাসি মিলিয়ে যায় পিসির ওষ্ঠ প্রান্তে।

    আমাদের থেকে একটু খানি দূরে, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে এসে বসল। হয়তো তারা কলেজেই পড়ে। ছেলেটি বলল কেন যে তোমার সাধ হলো এখানে আসার? মেয়েটি বলল কেন জায়গাটা কি খারাপ? জান এখানে একদিন স্বয়ং রামকৃষ্ণ সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আমার জেনে কাজ নেই। ঠিক আছে কিন্তু তোমার এই গঙ্গা ভালো লাগেনা। আমার এত ভীড় ভালো লাগেনা। তাহলে চল, নৌকায় আমরা বেলুড় মঠে যাই। আবার সেই বেলুড় মঠ। তাহলে কোথায় যাবে? যেখানে শুধু তুমি আর আমি, পাশে কেউ থাকবে না। মাথার উপরে নীল আকাশ, আমি তাকিয়ে থাকবো তোমার দিকে। একটুখানি স্মিত হেসে মেয়েটি বলল শুধু তাকিয়ে থাকবে? হ্যাঁ শুধু তাকিয়ে থাকবো। তোমার চোখের তারায় খুঁজে পেতে চেষ্টা করব নিজেকে। তেপান্তর থেকে ছুটে আসবে এলোমেলো দুরন্ত বাতাস, যা তোমার শক্ত করে বাঁধা বেণী থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে চাইবে। ২/১ টি কুঞ্চিত কেশ আর ঐ দুরন্ত বাতাসের দুরন্তপনায় তোমার আঁচল উড়বে দূর আকাশে বলাকাব পাখার মত। সোনাঝরা সন্ধ্যার সেই মূহুর্তে তুমি শুধু আমার হয়ে থাকবে। হাসতে হাসতে মেয়েটি বলল, তোমার ক্ষেপামী যাবে না দেখছি। কতদিন ধরেই তো দেখছ, তবু আশ মিটলনা। মিটল কই? আর সত্যি সত্যি যেদিন মিটবে সেদিন তুমি আর রহস্যময়ী থাকবেনা। মনও কাদবেনা তোমার জন্য। তারপর বলল, চল ওঠা যাক। ওরা উঠে চলে গেল।

    এতক্ষণে পিসি একটিও কথা বলেনি। আমিও বলি নি। আমি নিশ্চয়ই জানি আমারই মতো পিসিও ওদের কথা শুনেছেন নিবিষ্ট মনে। সত্যি ছেলেটির মনের জোর আছে বলতে হবে। নিজের কথা স্পষ্ট করে বলার অধিকার আছে তার। আর তাই মেয়েটিও তাকে অস্বীকার করতে পারে না। পিসি হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বলল, ওরা কিন্তু একটা কথা ঠিক বলেছে প্রান্তিক, আমি চকিতে পিসির দিকে তাকিয়ে বললাম কি? ঐ যে ছেলেটি বলল, যেদিন আশ মিটবে সেদিন তুমি আর রহস্যময়ী থাকবেনা। মনও কাঁদবেনা তোমার জন্য।

    কথাটা গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যঞ্জনাময়। বললাম, ওরাতো আরো অনেক কথা বলেছে, তার একটাও তোমার ভাল লাগলনা। ভাল লাগেনি বলছিনা। ছেলেটি তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন। ফালতু অজুহাতে জীবনের অমূল্য মুহূর্ত সে হারাতে চায়না। সে ভীরু নয়। তার মনের কথা স্পষ্ট করে বলতে পারার জন্য এক প্রকারের শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পারে। কিন্তু খুব যে একটা দাগ কেটেছে আমার মনে তা নয় কিন্তু। কিন্তু আশ মিটলে তুমি আর রহস্যময়ী থাকবেনা, এযেন আমার জীবন দর্শনের নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। অতি সাধারণ কথা, কিন্তু কি অসাধারণ ব্যঞ্জনাময়।

    একটা হাত তার কাঁধে রেখে আস্তে বললাম, পিসি তোমার মনে যে এত দুঃখ লুকিয়ে আছে আগে কোন দিন বুঝতে পারিনি। বললেন আজও কি বুঝতে পারছ? বোঝ যায় না প্রান্তিক, জীবনের রহস্যময়তাই তার বেঁচে থাকার রসদ। একদিন যা মনে হতো শুধু সত্য নয় একমাত্র সত্য আর একদিন তাই কেমন এক নিমেষেই মিথ্যে হয়ে যায়। আমি বললাম, জীবনের সব সত্যই কি মিথ্যে হয পিসি? ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কি বলছ? জীবনের সত্য বলে কিছু আছে কীনা আমি জানিনা। তবে আজ বুঝতে পারছি, দামিনী কেন বেঁচে আছে? আমি বোকার মত প্রশ্ন করলাম কোন দামিনী? পিসি বলল, দামিনীকে চেননা? আমার তো মনে হয় না, রবীন্দ্রনাথ দামিনীর থেকে বড় করে আর কোন নারী চরিত্র এঁকেছেন কীনা। চতুরঙ্গ পড়েছে। দামিনীর মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি, সাধ মিটিল না। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ ছেলেটি কি বলেছে? আশ যে দিন মিটবে সেদিন আর তুমি রহস্যময়ী থাকবেনা। মনও কাদবেনা। দামিনীরও মন কাঁদতোনা যদি তার সাধমিটে যেতো। তারপর একটু খানি চুপ করে থেকে, একেবারে অতর্কিত ভাবে আমার একটা হাত তুলে নিলেন নিজের হাতের মধ্যে। কিন্তু একটি কথা বললেন না। বললাম তোমার শরীর খারাপ করছে? না। তাহলে চুপ করে আছো কেন?

    হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে তিনি জানতে চাইলেন কে তোমাকে বেশী করে টানে প্রান্তিক অশ্রুকণা না রেহানা? আমি অবাক হয়ে পিসির এই প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গেনিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি। বললাম, না পিসি কেউ নয়। ঐ ছেলেটি যেমন করে তার অধিকারের দৃপ্ত ঘোষণা জানিয়েছে আমার জীবনে তেমনি করে কেউ আসেনি আজো। আসেনি, না আসতে দাওনি? আমি বললাম তোমার কি হয়েছে বলতো আজ? এমন এমন প্রশ্ন করছ যা কোন দিন করনি? বললেন থাক ও কথা। একটু আগে তুমি বলেছনা, যখন তুমি ছোট ছিলে, তোমার সঙ্গে কথা না বলে শুধু গাল টিপে দিতাম বলে তোমার ভীষণ অভিমান হতো, আর ভাবতে কবে তুমি বড় হবে। বড় হলে আমার সঙ্গে তুমি কথা বলতে পারবে। আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে রইলাম। পিসি বলে চলেছেন। এখনতো তুমি বড় হয়েছে। অন্তত গালটিপে দেওয়ার বয়স তোমার নেই। অনেকদিন ধরে আছো আমার সাথে। কই তোমার কোন কথাই তো বলনা আমাকে। তার মানে শৈশরের সেই স্বপ্নগুলো তোমার মরে গেছে অথবা হারিয়ে গেছে নতুন স্বপ্নের ভিড়ে তাই না? আমি চমকে উঠে বললাম, না পিসি কিছুই মরেনি। আজো তোমার সাথে আমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে ভালো লাগে। কিন্তু তোমার সময় কোথায়? আর তাই বলে কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও আমার নেই। কেন? অভিযোগ নেই কেন? বললাম স্বপ্ন হয়তো মরেনা পিসি কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবের বালুতটে অনেক কিছুই চাপা পড়ে যায়। যেমন এইখানে না আসলে, আমার জানা হতোনা তোমার নিঃসঙ্গ অতীত। তোমার একাকিত্ব, হতাশা, ব্যথা ও বেদনা। উনি বললেন, এটা জেনেই তোমার কি লাভ হবে? না পিসি, লাভ লোকসান দিয়ে সব অঙ্ক মিলানো যায় না। এই যে কতক্ষণ আমরা বসে আছি এখানে। সূর্য হেলতে হেলতে গঙ্গার বুকে লাল আবির ছড়িয়েছে অথচ সময়কে আমরা জয় করেছি, কেন? এই অঙ্কের কি হিসাব মিলাতে পারবে? পারবেনা। তার থেকে চল সন্ধ্যা হয়ে এলো। মন্দিরের আরতি দেখবে বলেছিলে না? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পিসি বললেন, হ্যাঁ চলো।

    প্রায় আধ ঘন্টা পরে আমরা মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম। মন্দিরে যাওয়ার আগে যতটা বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল, এখন আর অতটা নেই। পিসি বললেন, সেই দুপুরে খেয়েছে, খিদে পায়নি? হা পেয়েছে। তাহলে চল, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।

    দুজনার জন্য যা যা অর্ডার দিয়েছিলাম তা থেকে পিসি তার ভাগের অর্ধেক আমাকে তুলে দিলেন। আমি বাঁধা দিলামনা। আসলে আমি পিসিকে শুধু দেখেই চলেছি। কত কাছে আছি আমি এই মানুষটির। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, কিছুই জানিনা তাকে। তিনিও কি জানেন আমাকে? না, হয়তো জানেন না, কাউকে পরিপূর্ণভাবে জানা হয়তো সম্ভবও নয়।

    পরিমলবাবুকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন পিসি। অনেক স্মৃতি হয়তো জড়িয়ে আছে তার সাথে। কিন্তু কি আশ্চর্যের বিষয় কোনদিন ভুলেও সেই স্মৃতির পাতা ওল্টননি একমুহূর্তের জন্যও। অনেক বার মুখে এলেও ঐ স্মৃতির কথা উচ্চারণ করতে পারিনি আমিও। যদি অন্য রকম কিছু ভাবেন। পিসি বললেন, আর কিছু খাবে? আমি অন্যমনস্কের মত বললাম, তুমি যদি দাও তাহলে খাব। কি খাবে? তোমার যা ইচ্ছে? পিসি আবার কিছু অর্ডার দিলেন তার ইচ্ছে মত। খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

    বাড়ীতে যখন ফিরলাম, তখন রাত ৮ টা। গোটা বাড়ীটা অন্ধকার। গেটে এসে দেখলাম, বাইরে থেকে তালা বন্ধ। তার মানে পরিমলবাবু এখনো ফেরেননি। পিসিকে জিজ্ঞাস করলাম, ওনার দেরি হবে এমন কথা উনি কিছু বলেছেন? পিসি বললেন উনি জানেন আমরা সন্ধ্যার ট্রেনে বেরিয়ে যাবো। তাই হয়তো দেরি করে ফিরবেন। ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। গেট খুলে চলো ভিতরে।

    গ্রামের বাড়ীতে যাওয়া হবে বলে, গোছাতে গোছাতে সেগুলো আবার তেমনি এলোমেলো রেখে বেরিয়ে পড়া হয়েছিল। পিসি সেগুলো আবার ঠিক ঠাক করে গুছিয়ে রাখলেন। তারপর ক্রমে ক্রমে রাত বাড়তে লাগলো। কিন্তু পরিমলবাবু তখনো এলেন না। কি করা যায় বলতে প্রান্তিক। তারপর নিজেই বললেন, তুমি কি একবার দীপঙ্করবাবুর ওখানে যাবে? ওখান থেকে যদি ফোন করা যায়? বললাম কোথায় ফোন করতে হবে?

    পিসি কয়েকটা ফোন নাম্বার দিলেন। একটা পরিমলবাবুর সিনিয়র বসের। আর দুটোর একটা তার স্টেনোর এবং অন্যটি পরিমলবাবুর অধিনস্ত সহকারী ম্যানেজারের। দীপঙ্করবাবুকে বলবে, একটু খোঁজ নিয়ে যেন তোমাকে সত্যি সংবাদটি জানান।

    আমি বেরিয়ে পড়লাম। অত রাতে দীপঙ্করবাবু তখন শুয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমার যাওয়াতে উনি উঠে পড়লেন। পিসি যা বলেছেন আমি ওনাকে বললাম। উনি বললেন, তুমি নিজেই ফোন কর। এস আমার সঙ্গে। সিনিয়র বস এবং সহকারী ম্যানেজারের ফোন এনেছো? ফোন করাতে মেয়েলি কণ্ঠে কে যেন বললেন স্পিকিং কাকলী মিত্র। আমি নমস্কার জানিয়ে বললাম আমি পরিমলবাবুর বাড়ী থেকে বলছি। উনিতো এখনো ফেরেননি। আজ কি উনি অফিসে গিয়েছিলেন? আপনার পরিচয়? ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সেই মেয়েলি কণ্ঠ। আমি ওনার আত্মীয়, আই মীন উনি আমার পিসেমশাই হন। প্লীজ ওয়েট বলে উনি ফোন রেখে দিলেন। এবং খানিক পরে বললেন, হ্যাঁ এসেছিলেন, কিন্তু আপনার পিসি কি জানেন না, উনি ট্যুরে ৭ দিনের জন্য বাইরে গেছেন। আমি বললাম, আসলে আমাদের আজ গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টিকিট না পাওয়ার জন্য যাওয়া হয়নি। হয়তো পিসিকে বলেছিলেন, কিন্তু ব্যস্ততার জন্য তিনি তা ভুলে গেছেন। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। উনি গুডনাইট জানিয়ে ফোন ছেড়ে দিতে চাইলে আমি বললাম, আচ্ছা ম্যাডাম আপনি ওনার ট্যুরের জায়গার ফোন নাম্বার দিতে পারবেন? নো সরি। আরেকটা কথা ওনার সঙ্গে আর কে গেছেন? ইট ইজ এ ভেরি ভেরি কনফিডেনসিয়াল, নো মোর প্লিজ। ওকে। গুডনাইট! গুড নাইট। ফোনটা ছেড়ে দিলেন কালী মিত্র।

    দীপঙ্করবাবু বললেন খোঁজ পাওয়া গেল? হ্যাঁ, উনি ট্যুরে গেছেন। তোমাদের বলে যায়নি? হয়তো বলেছেন। আসলে আমার আর পিসির গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যাওয়া হয়নি। পিসিকে যদি বলেও থাকেন উনি তা মনে করতে পারছেন না। ও আই সি? ঠিক আছে। সাবধানে যেও।

    পিসিকে সব বলতে, তিনি থ মেরে গেলেন। আমি বললাম কি হল পিসি? তুমি চুপ করে আছো কেন? না চুপ করে আর থাকব না। আমি আর পারছি না প্রান্তিক। ওর যদি আমাকে আর ভালো না লাগে বলে দিলেই পারে। এই ছল চাতুরীর দরকার কি? সকালে ওকে কত করে বললাম, তুমিও চল না। কতদিনতো যাওয়া হয় না। না আমার সময় নেই। কেন এত কি কাজ? দিল্লী থেকে চেয়ারম্যান আসবেন। অফিসের ফাঁইল পত্রগুলো প্রস্তুত করতে হবে। বললাম তুমি একা একা থাকবে? মাত্র কটাদিনতত, তারপর বললাম বেশ তুমি আমাদের সঙ্গে না যাও একটা দিন টুর নিয়ে ঘুরে এসো। বললেন কোন উপায় নেই। অফিস থেকে এখন বেরোবার কোন উপায় নেই। আর তার ষ্টেনো বলল তিনি ৭ দিনের ট্যুরে চলে গেছেন। এ অসহ্য।

    মিথ্যে কথা আমারও অসহ্য। প্রয়োজনে অনেক সময় মিথ্যে কথা বলতে হয় তা অস্বীকার করিনা। কিন্তু পরিমলবাবুর ব্যাপারটা এখন বুঝতে পারছি না। পিসির দুঃখ যন্ত্রণা যেমন বুঝি তেমনি পরিমলবাবুর পক্ষেও যে কিছু বলার আছে, সেটাকে অস্বীকার করতে পারিনা। কিন্তু কাকলী মিত্রর শেষের কথাটি আমাকে পিসির সঙ্গে সহমত হতে সাহায্য করছে। তিনি একটা অফিস থেকে অফিসিয়াল ট্যুরে গেছেন, তিনি তো আর ভারত সরকারের কেন গোপন শাখায় কাজ করেন না, যে তার ট্যুর ভেরি ভেরি কনফিডেনসিয়াল হবে। যাই হোক পিসিকে বললাম, তোমার হয়তো পিসেমশাইয়কে বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে পিসি। আর তা ছাড়া তুমি নিজেইতো বলেছে, এ কয়দিন না হয় যেন কোন ট্যুর থেকে ঘুরে আসে। তোমার সঙ্গে যখন কথা বলেছিলেন, তখন হয়তো উনি যা বলেছিলেন সেটা সত্যি ছিল। পরে হয়তো অফিসে গিয়ে জানলেন, তার থেকে, জরুরী তার ট্যুরে যাওয়ার তাই। তিনি চলেও গেছেন, এতে তোমার অসহ্যের কি আছে? পিসির রাগ পড়েনি। ভিতরে ভিতরে তিনি যে গজরাচ্ছেন বুঝতে পারছি। বললেন, দেখ প্রান্তিক এই ভাবে কারো দোষ ঢাকতে যেওনা। তাতে একূল ওকূল দুকূলই যাওয়ার সম্ভবনা।

    বললাম তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে পিসি? যদি সত্যি সত্যি তোমার বিশ্বাস হয়ে থাকে, তিনি তোমার মন থেকে দূরে সরে গেছেন। সন্দেহকে বাড়িয়ে দিয়ে কি তাকে কাছে টানা যায়? তুমি যদি তাকে আগের মত পেতে চাও, তোমাকেও ভালবাসতে হবে আগের মত। তার মন থেকে মুছে দিতে হবে অন্য কোন ছায়াপাত।

    পিসি বললেন আজ আর তা সম্ভব নয় প্রান্তিক। কেন? জানিনা কেন? তবু পরিমলকে আমার আর আগের মত ভালবাসা সম্ভব নয়। প্রথম কথা ছল-চাতুরী আমি একদম সহ্য করতে পারিনা। বললাম পিসি, শুধু নিজের ভাবনা থেকে ও ভাবে বিচার করছ কেন? উনিওতো কিছু ভাবতে পারেন তোমার সম্পর্কে, যা তার মনকে তোমার কাছ থেকে আগে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। রেগে গিয়ে পিসি বললেন কি বলতে চাও তুমি? আমাকে উনি বিনা কারণে সন্দেহ করবে কেন? কি প্রমাণ আছে আমাকে সন্দেহ করার? বললাম তোমরা হাতেও কি কোন প্রমাণ আছে তাকে সন্দেহ করার? এবার উল্টো পাল্টা ভাবে পিসি বললেন প্রমাণটাই কি সব। নিত্যদিনের আচার আচরণ আমার অনুভূতি এর কি কোন মূল্য নেই? বুঝতে পারছি পিসির এসব যুক্তিহীনের যুক্তি। আসলে পরিমলবাবুকে উনি এত ভালবাসেন যে একটুখানি বিচ্যুতিই তার কাছে বিরাট হয়ে দেখা দেয়। বললাম, তোমার অনুভূতির নিশ্চয়ই মূল্য আছে পিসি। তবু সব কিছুর জন্য অপেক্ষার মূল্যও কম নয়। উনি আসুক। দেখবে সময় একদিন তোমার মনের এই গ্লানি মুছে দেবে। উনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন তাই যেন হয়।

    পরের দিন সকাল যেন এক নতুন বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ভোরের আকাশ সুৰ্য্যের অপেক্ষায় মৌন। ছাদের টবে ফুটেছে অজস্র গোলাপ ও চন্দ্রমল্লিকা। কি তার রংএর বাহার। একটি চন্দ্রমল্লিকা ফুটেছে অজস্র রঙের সমহারে। দেখতে অপূর্ব। ভীষণ লোভ হচ্ছে ওই ফুলটি তুলে কোন প্রিয়জনের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু কে আমার প্রিয়জন, কার হাতে তুলে দেবো আমার আকাঙ্খার চন্দ্রমল্লিকা। পিসিকে শ্রদ্ধার অঞ্জলি দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু যে আকাঙ্খায় মন উন্মুক্ত, সেখানেতো নীলাঞ্জনা পিসি নেই।

    ভোরের আকাশকে সাক্ষী রেখে কোন দিন এই ছাদে উঠিনি আমি। আকাশের পূর্ব প্রান্ত লাল, কিন্তু অন্ধকারের মায়াবী আলো যেন এখনো মুছে যায় নি।

    হঠাৎ ছাদের দরজা খুলে যায়। একি পিসি তুমি? হ্যাঁ, কিন্তু তুমি এত ভোরে ছাদে কি করছ? দেখ কি অপরূপ অজস্র গোলাপ আর চন্দ্রমল্লিকার সমাহারে রাতের আকাশ যেন নতুন প্রভাতকে বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষায়। রাতে তুমি ঘুমাওনি? না পিসী একদম ঘুম হয়নি। তাইতো সকাল না হতেই উঠে এসেছি ছাদে। কেন? যদি আজকের আকাশ কোন নতুন বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। পিসি বললেন, সাররাত না ঘুমিয়েও তুমি এই সতেজ মনটা কোথা থেকে পাও প্রান্তিক? বললাম, জীবনের সব কিছুকে হাসিমুখে গ্রহণ করার একটা জেদ আমাকে চির সতেজ করে তোলে। ভুল প্রান্তিক ভুল। তাই যদি হতো, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতে। কিন্তু তাতো পারনি, অথচ নিজেকে মিথ্যে মায়ায় আচ্ছন্ন করে–যা সত্য নয় তাকেই সত্য বলে প্রকাশ করতে চাইছো। তারপর চোখের পর চোখ রেখে বললেন এখনো কুয়াশা কাটে নি দেখেছ? হ্যাঁ, কিন্তু আমি যখন এসেছিলাম তখন কিন্তু কুয়াশা ছিল না। পূর্ব প্রান্ত লাল হয়ে উঠেছিল সূর্য ওঠার অপেক্ষায়। যদিও অন্ধকার ছিল, তবু আলোর নিশানা আমি টের পেয়েছিলাম। ঐ দেখ সেদিন যে বিচিত্র বর্ণের চন্দ্রমল্লিকার টবটা কিনেছিলাম আজ তা পূর্ণতায় বিকশিত একটি ফুটন্ত চন্দ্রমল্লিকা। ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি ভাবছিলাম জান? কি? কোন এক প্রিয়জনকে উপহার দেব তা। তাই বুঝি? কে তোমাকে না করছে? না কেউ না করেনি। আসলে বুঝতে পারছি না, কোথায় ওর সত্যিকারের জায়গা। মানে? এই ভোরের বাতাস তোমার কাছে নতুন মনে হচ্ছে না পিসি? মনে হচ্ছে না আঃ কি আরাম! তুমিকি সারারাত জেগে জেগে স্বপ্ন দেখেছো? হয়তো দেখেছি, হয়তো দেখিনি, তুমি কিন্তু তাই বলে কথার অক্টোপাশে এই মুগ্ধ আর মোহময়ী সকালকে ভুল বুঝনা। ঠিক আছে তাই হবে। তোমার চিন্তার সঙ্গে চেতনাকে মিশিয়ে দেখি সকালটা তোমার মতো আমার জীবনেও কোন নতুন সুরের তান তোলে কীনা। হ্যাঁ সেই ভাল। কিন্তু পিসি আমার কথার তো উত্তর দিলে না। কি? ঐ অপূর্ব রঙের চন্দ্রমল্লিকার আসল জায়গাটা কোথায়? এ উত্তর দাতাব ইচ্ছের উপর নির্ভর করে না প্রান্তিক। তুমি যখন তোমার কোন প্রিয়জনকে দেবে বলে ঠিক করেছো, তখন তোমার মনকেই জিজ্ঞাস করো, কোথায় ওর সত্যিকারের জায়গা।

    হঠাৎ চমকে উঠলাম পিসির দিকে তাকিয়ে। একি পিসি? নতুন শাড়ী পরেছো, চুল বেঁধেছে নতুন করে, কোথাও যাবে নাকি? যাবো বলেইতো তোমার ঘরে গিয়েছিলাম প্রান্তিক। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, তুমি ঘরে নেই। অথচ বাইরে যাওয়ার গেট বন্ধ। তাইতো ছাদে এলাম। খুব ভাল করেছে পিসি। একটু দাঁড়াও, নড়বেনা কিন্তু। কেন? যা বলছি তাই করনা।

    নীলাঞ্জনা দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে রইলেন। আমি চন্দ্রমল্লিকাটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে এলাম। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, পিসি যেখানে গুরুজন সেখানে তার চরণতলে অর্পণ করব এই ফুলটি। হঠাৎ মনে হল দূর ওতো ভক্তের নৈবেদ্য। না আমি তা পারবনা। তাহলে কর কমলে? দূর। তাই হয় নাকি কখনো। প্রথম প্রেমের লাজ নম্রতায় প্রেমিকের হয়তো তা মানিয়ে যায়। কিন্তু আমার জীবনে পিসির অবস্থান কোথায়। তিনি কি আমার পূজার বেদী না বন্ধু না আর কিছু। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলাম, পিসির কাছে। একেবারে বুকের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পিসিকে বললাম, চোখ বন্ধ কর পিসি। কেন? আরে করইনা। পিসি কোন রকম দ্বিরুক্তি না করে চোখ বন্ধ করলেন। আর আমি, চন্দ্রমল্লিকাটি গুঁজে দিলাম পিসির শিথিল বেণীতে। তারপর মন যা চাইল, হেরে গেলাম যুক্তির কাছে। পিসি কিন্তু বিজয়িনী যেন। আমার দ্বিধান্বিতাকে দূরে সরিয়ে রেখে তার রক্ত গোলাপ ঠোঁট দুটি নিমেষে নামিয়ে নিয়ে এলেন আমার ভীরু ওষ্ঠা ধরে। তারপর দ্রুত পালিয়ে গেলেন যেন। না বললেন আমার সঙ্গে কোন কথা, না চাইলেন প্রতিদান হিসাবে কিছু।

    আর এই নিয়ে পিসি দুই বার তার ব্যগ্রতাকে নিয়ে এসেছেন আমার স্পর্শতার মধ্যে। তবু যেন কত ব্যবধান। সেদিন কিন্তু দেহের তন্ত্রীতে এ শিহরণ ছিল না। তবে আজ কোথা থেকে এলো, ভীরু বুকে এই কম্পিত শিহরণ! সেদিন পিসিকে চোখের পর চোখ রেখে বলতে পেরেছিলাম, আমি তোমায় ভালবাসি পিসি। আজ ভালবাসা কথাটি উচ্চারণ করতে আড়ষ্টতা কেন? কেন পারলাম না বলতে এ আমার ভালবাসার প্রথম উপহার। ধীরে ধীরে নেমে এলাম ছাদ থেকে। ঘরের অন্ধকার এখনো যায়নি। ভেজানো দরজার ঘরে আলো জ্বেলে পিসি হয়তো দেখছেন নিজেকে। আমি টোকা দিতে বললেন, ভিতরে এস। এতক্ষণ যে শাড়ীটা পরে ছিলেন, বদলে ফেলেছেন তা। অঙ্গে জড়িয়েছেন বাসন্তী রঙের বালুচরী। সিঁথিতে সিঁদুর, দুই ভুর মাঝখানে সোনা ঝরা টিপ, আঁচলটা সবে বুকের পরে তুলে নেবেন, আমি ঢুকতে গিয়েই বেরিয়ে এলাম। উনি আর আমাকে পিছু ডাকলেন না। আমি নিজের ঘরে এসে নিজে কেন এমন ব্যবহার করলাম তাই নিয়ে ভাবছি। উনি আমার ঘরে এসে বললেন, এখনো জামা প্যান্ট পরনি? আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে? বললেন, তাড়াতাড়ি কর প্রান্তিক। এযেন সকাল বেলাকার ছাদের সেই দ্বিধান্বিতা নীলাঞ্জনা নন। এ যেন এক দীপ্তিময়ী নতুন নীলাঞ্জনা। স্পষ্টতা আর অধিকার যেন তাকে এক নতুন মহিমা দান করেছে।

    অপূর্ব লাগছে নীলাঞ্জনা পিসিকে। অঙ্গের পোষাকের সঙ্গে বেণীতে গোঁজা ঐ সাত রঙা চন্দ্রমল্লিকা যেন আপন গরবে গরবিনী। আর সৌন্দর্যের কাছে মাথা নত করে না এমন কে আছে? বয়স কি সব সময় সৌন্দর্যের প্রতিবন্ধক? আমার মনে হয় না তা নয়। পিসির বয়স যেন তার সৌন্দর্যকে এক অপূর্ব লাবণ্যময় মর্যাদা দিয়েছে। বললাম কোথায় যাবে? পিসি বললেন কোথাও না। তবু …। ভোরের রাজপথ আমাদের চলমানতার সাক্ষী হয়ে থাকুক। ঠিক পাঁচ মিনিট। আর একটুও দেরি করোনা কিন্তু প্রান্তিক। যদিও অনুরোধ, কিন্তু তাকে উপেক্ষা করতে পারি এমন সাধ্য নেই।

    কেটে গেছে বেশ কয়েকটি দিন। পরিমলবাবু ফিরে এসেছেন ট্যুর থেকে। পিসি এব্যাপারে একটিও কথা বলেননি তার সাথে। পরিমলবাবু শুধু বলেছেন, তোমাদের তা হলে যাওয়া হলো না? তার কোন প্রতি উত্তর পিসি দেননি। পরিমলবাবুও এনিয়ে কোন জোর জবরদস্তি করেননি।

    অনেকদিন ধরে দেখা হয়না অশ্রুকণা, অনুতপা, রেহানা বা অন্যান্য কলেজ বন্ধুদে সাথে। আজ সবেবরাত। সৌভাগ্য রজনী। ভাবছি একবার যাব রেহানাদের ওখানে। হয়তে আর আগের মতো ওরা আমাকে গ্রহণ করতে পারবেনা, তবু অন্তত নিজের কাছে নিজে কৈফিয়ৎ দিতে পারব, আমি তোমাদের ভুল বুঝিনি, তোমারাই আমাকে ভুল বুঝে দূর সরিয়ে দিয়েছে।

    সন্ধ্যের পর, ওদের বাড়ীতে যখন গেছি, এক নিঃশব্দ পুরীর মতো মনে হচ্ছে ওদে বাড়ী। আজ কি তবে সৌভাগ্যরজনী নয়? তাইবা কি করে হবে। অনেক বাড়ীতে আলো মালায় সেজেছে। আমি মনের মধ্যে অনেক দ্বিধা নিয়ে বেল দিলাম। বেল দিতেই সতে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। রেহানা। কিন্তু একি চেহারা। মাথার চুল উস্কোখুস্কো পরনের শাড় অবিন্যস্ত। উদাস চোখ। ওকে দেখে ভীষণ ভয় হল। বললাম, কি হয়েছে তোমার রেহানা তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? বলল, এস ভিতরে এস কি যেন ছিল সে কণ্ঠে। হতাশা ন বিষাদ, বুঝতে পারছি না। আস্তে আস্তে ওর পিছনে পিছনে এসে বসলাম ওদের বসার ঘরে বলল, এত দিন পরে এলে? গিয়েছিলে গ্রামের বাড়ীতে? মনে হল যেন কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বললাম, না যাওয়া আর হল কই? কেন? গেলে না কেন? সে অনেক কথা থাক। কিন্তু তোমার এই অবস্থা কেন? সেলিনা কোথায়? হাসপাতালে। হাসপাতালে। চমকে উঠলাম আমি জানতে চাইলাম কি হয়েছে ওর? বলব! আজ সবেবরাত। সৌভাগ রজনী। আমাদের সৌভাগ্যতো দেখতে পারছ। আমার এই অবস্থা। সেলিনা হাসপাতালে মা জুরে বেহুশ। নিজেদের রান্না পৰ্য্যন্ত ঠিক মতো হয় না। তা তুমি কেমন আছো? ভালো না এতো ভালো থাকার কথা নয় প্রান্তিক? আমি বাঁধা দিয়ে বললাম আমার কথা পরে শুনো। জেনে রাখো আমি ভাল আছি। তা তোমাদের এই অবস্থা। আমাকে সংবাদ দাওনি কেন? রেহানা তার উত্তর না দিয়ে বলল তুমি চা খাবে? একটু বসো। আমি চা নিয়ে আসছি পাশের ঘর থেকে আফরোজ বেগম বললেন, কে কথা বলছেরে রেহানা? উত্তরে রেহান বলল প্রান্তিক। ওকে একবার আমার কাছে আসতে বলতো। রেহানা বলল, তোমার কাছে গেলেই তো তুমি কান্নাকাটি করবে। কি দরকার আমাদের দুঃখের বোঝ ওকে জানিয়ে বুঝতে পারছি কি যেন অভিমান জমে আছে রেহানার বুকে। আমি বললাম, আমি ও ঘরে আছি তুমি চা নিয়ে ও ঘরেই এসো। আমি আফরোজ বেগমের ঘরে গিয়ে বসলাম। উনি শুয়ে আছেন। হাতে এবং পায়ে ব্যান্ডেজ। কপালে হাত দিলাম, জ্বর খুব। বললাম, মাসিমা, আমাকে শুধু মিথ্যেই আপন আপন করেন। কি হয়েছে আপনাদের জানতে চাইনে, কিন্তু আমাকে একবার জানাবারও প্রয়োজন মনে করলেন না।

    আফরোজ বেগমের দুই চোখ বেয়ে জল নেমে এলো। আমি রুমাল বের করে মুছিয়ে দিয়ে বললাম, ভেঙে পড়বেন না মাসিমা। মন শক্ত করুন। দেখবেন একদিন সব ঠিক হয়ে গেছে।

    রেহানা চা নিয়ে এলো। সঙ্গে ২টো নিমকি, আর দুটো সন্দেশ। আমি বললাম মাসিমা আর তোমার চা। মা এই সময় চা খাননা, আর আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।

    বেশ গরম। তবু রেহানা শাড়ীর আঁচল আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিচ্ছে নিজের শরীরের সঙ্গে, বললাম অমন করছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে? ও বলল না, এমনি। তুমি খাও আমি আসছি। একটু পরেই ফিরে এল আবার। একটা ভিজিটিং কার্ড আমার হাতে দিয়ে বলল আজ দুদিন হাসপাতালে যেতে পারছি না। কি জানি কেমন আছে সেলিনা। কোনদিন কোন কথাই তোমাকে বলিনি। আজ অনুরোধ করছি, যদি এর মধ্যে গ্রামের বাড়ীতে না যাও রোজ অন্তত একবার যেও হাসপাতালে? কি জানি কেমন আছে ও? বললাম, কি হয়েছে। সে তুমি গেলেই দেখতে পাবে। তারপর আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরে বলল, আমার অনুরোধটুকু রাখছতো প্রান্তিক? কিন্তু একি? আফরোজ বেগমেব মতো ওরও যে প্রচণ্ড জ্বর। বললাম, কদিন এই জ্বর চলছে? বেশ কয়েকদিন হল। ডাক্তার দেখিয়েছো? হ্যাঁ। কি বলছেন? কমে যাবে বলেছেন। আমি আর থাকতে পারলাম না। বললাম রেহানা তুমি এত নিষ্ঠুর? থাক ওসব কথা। তুমি কাল যাচ্ছতো হাসপাতালে? বললাম, আমি এখনি যাচ্ছি। কিন্তু এখনতো তোমায় ঢুকতে দেবে না। না তা হয়তো দেবেনা, কিন্তু সংবাদটাতে পাব। কিছু প্রয়োজন হলে অন্তত দিয়ে আসতে পারব। কাল সকালে ওর সাথে দেখা করব। দুপুরে তোমাদের সংবাদ দেবো। তারপর ওর দিকে চোখ রেখে বললাম, নিশ্চয়ই সকাল থেকে খাওয়া হয় নি, দোকান থেকে খাবার এনে দিয়ে যাবো? দরকার নেই প্রান্তিক। সকালে একটু সুস্থ ছিলাম, রান্না করেছিলাম, বিকালটাও চলে যাবে। তুমি আজ যাবে বললেনা? যদি কোন সংবাদ পাও একটু দিয়ে যাবে? দুদিন সংবাদ না পেয়ে মায়েব মনের অবস্থা আরো খাবাপ হয়ে গেছে। আমি আর কি বলব। শুধু বললাম, আমার উপর তোমার কোন দাবী নেই তাইনা? ও কিছু বললনা। শুধু মাথা নিচু কবে রইল। আমি বেরিয়ে এলাম।

    হাসপাতালে এসে দেখি যে ওয়ার্ডে সেলিনা ভৰ্ত্তি আছে সেখানে আমার পরিচিত একটি মেয়ে কাজ করে। ওর নাম তপতী। আমাকে দেখে ও বলল, আরে প্রান্তিক না? এখানে তোমার কে আছে? আমার এক বন্ধুর বোন তোমাদের এখানে ভর্তি আছে, ওর নাম্বার বললাম। তপতী বলল, ও সেলিনা রহমান, এবারের ক্লাব বক্সিং এ প্রথম পুরস্কার বিজয়িনী। কিন্তু ওর কোন দাদা আছে বলেতো জানিনা। ওর এক দিদি না বোন সেই আসতো, কি যেন নাম–হ্যাঁ মনে পড়ছে রেহানা রহমান। ভীষণ মিষ্টি মেয়েটি। তা ওতো দুদিন আসছে না। আমি বললাম, রেহানা আমার সহপাঠী। ওর কথাই বলছিলাম, ও এবং ওর মা দুজনই খুব অসুস্থ। আজ হঠাৎ গিয়েছিলাম ওদের বাড়ীতে। তপতী ইঙ্গিতপূর্ণ চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে তারপর বলল–ও তাই বল।

    তপতী আমার স্কুল জীবনের বন্ধু সম্পর্কটি এক সময় ছিল অম্ল মধুর। কিন্তু সে সব পুরনো কথা। দেখা না হলে হয়তো কোন কথাই মনে পড়তনা। স্কুল ফাঁইনাল পাশ করে ও নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে চলে এসেছে। ওর সঙ্গে যে হঠাৎ এখানে দেখা হবে ভাবিনি। তপতী বলল, আমার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছ। না কিছু ভাবছিনা। তারপর বললাম, জগৎটা কি বিচিত্র তাই না? এই দেখনা, কতদিন হয়ে গেছে, সেই যে তুমি নার্সিং ট্রেনিংএ চলে গেলে, তোমার সঙ্গে যে আবার আমার দেখা হতে পারে তাই কি কখনো ভেবেছি? তা ঠিক। আমিও ভাবিনি। তারপর কণ্ঠটা একটু নীচু করে বলল, আমাকে বোধ হয় তুমি চিনতে পারনি। না সত্যি পারিনি, আর তা ছাড়া তুমি এখানে আছে জানলে হয়তো চিনবার চেষ্টা করতাম। আরো অসুবিধা, নাসিং ড্রেসে আসল চেহারা অনেকটা চাপা পড়ে যায়। ও বলল, চা খাবে? আতঁকে উঠে বললাম এত রাতে? ও বলল, তুমিতো নীলাঞ্জনা পিসিদের ওখানে আছো তাই না? হ্যাঁ। উনি কেমন আছেন? ভাল। আমাকে কি চিনতে পারবেন? হয়তো হঠাৎ দেখলে নাও চিনতে পারেন, তবে পরিচয় দিলে নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন বলেই মনে হয়। দেখেছি তো গ্রামের কথা প্রায়ই ভাবেন। তপতী বলল, আমাদের গ্রামের সব চেয়ে প্রতিভাময়ী মেয়ে। দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করে। বললাম একবার এসোনা পিসীর বাড়ীতে। যাব একদিন। তুমি ওর ঠিকানাটা দাও। তুমি থাক কোথায়? এখানে হোষ্টেলেই থাকি। তারপর বলল, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক। তুমি কি সেলিনার সঙ্গে দেখা করতে চাও? এখনকি তোমরা দেখা করতে দেবে? দুষ্টু হাসি ঠোঁটের কোনে মিলিয়ে দিয়ে তপতী বলল, না অসময়ে দেখা করার নিয়ম নেই। তবে তোমার যখন ভীষণ ইচ্ছে এস আমার সঙ্গে। আমি অন্যান্য পেসেন্টের সঙ্গে কথা বলার মাঝে তোমার কথা, দেখা এবং অন্যান্য প্রয়োজন শেষ করে নেবে। হাতে সময় দশ মিনিট। ডাক্তার বাবু রাউন্ডে আসবেন, বললাম আচ্ছা চল।

    অবাক হয়ে দেখলাম, সেলিনাব পায়ে এবং মাথায় ব্যান্ডেজ। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আমাকে দেখে ও অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে আছে। তপতী বলল, সেলিনা, তোমাব দিদি ও মা অসুস্থ, তাই আসতে পারেননি। ওকে তোমার খোঁজ নিতে পাঠিয়েছেন। তোমাদের প্রয়োজন দশ মিনিটের মধ্যে শেষ করে নাও। ডাক্তার বাবু এসে গেলে কিন্তু আমার অসুবিধা হবে। ধন্যবাদ বলে সেলিনা আমাকে পাশের টুলে বসতে বলল। তারপর দেখতে পাচ্ছি ওর চোখ দুটো ছল ছল করছে। এখনি বোধ হয় কান্না ঝরে পড়বে। আমি বললাম, কাল দুবেলায়ই আসব আমি, তখন সব কথা শুনবো। এখন বলত, তোমার কিছুর প্রয়োজন আছে কীনা? ও সকলেব সামনে আমার একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, প্রান্তিক ভাই আমার সেদিনের ব্যবহার কি ক্ষমা করতে পেরেছেন? ওকে বাঁধা দিয়ে বললাম, থাক ওসবকথা। তুমি এখন আগের থেকে ভালোতো? হ্যাঁ অনেকটা ভালো। ঘাও প্রায় শুকিয়ে এসেছে। শুধু সে দিনের কথা চিন্তা করলে মাথার মধ্যে ভো ভো করে। তারপর বলল, রেহানার জ্বর কমেনি? না এখনো কমেনি। তবে তার জন্য তুমি চিন্তা করোনা। তোমার কিছু দরকার কি না সেটা আগে বল। দুদিন জামা কাপড় চেঞ্জ করতে পারছি না। আমি বললাম এখানে খেতে পারছতো। চলে যাচ্ছে প্রান্তিক ভাই, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। জানি কষ্ট হবে তবু মা ও রেহানাকে একটু দেখবেন। তাবপর অন্য দিকে পাশ ফিরে শুলো সেলিনা। আমি উঠে পড়ে বললাম, আজ তাহলে আসি, কাল আসব। তুমি বাড়ীর জন্য চিন্তা করোনা।

    বেরিয়ে আসার সময় তপতী এলো কাছে। বললাম আমি তা হলে আসি তপতী। ও বলল, ঠিক আছে এসো। চিন্তার কিছু নেই, খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে। আমি বললাম তাই যেন হয়। ও আমার আরো কাছে এসে বলল, ওর জন্য আলাদা করে কিছু করতে চাইলে তোমার আপত্তি হবে না প্রান্তিক? মানে? ও বলল রেহানা এলেও দেখেছি তো ও যেন কাকে খুঁজতো। তারপর ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেলে, ওর বুকে যেন কিসের হতাশা নেমে আসতো। পেশেন্টের পরিচর্যা করতে করতে আমি তোমাদের লক্ষ করছিলাম। তুমি জেনো প্রান্তিক ও আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাবে। চিন্তা করো না। আমিতো এই হোস্টেলেই থাকি, ওর কোন অসুবিধা হবে না। শাড়ি ব্লাউজ যা যা প্রয়োজন আমিই কাল সকালে দিয়ে যাবো। তপতীর ভুল ভাঙাতে ইচ্ছে করল না। শুধু বললাম সে তুমি যা ভালো বোঝ করবে। আমি বেরিয়ে এলাম। রাত প্রায় দশটা আবার রেহানাদের বাড়ী। রেহানা জানালা খুলে দেখল যে আমি। বললাম দরজা খুলবার দরকার নেই। সেলিনা ভালো আছে। ওর যা প্রয়োজন মোটমুটি একটা এরেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে। অসুবিধা হবে না। হয়তো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে। কাল সকালে ওর সঙ্গে দেখা করে দুপুরে আসব। চিন্তা করোনা।

    আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ীতে যখন ফিরেছি তখন দশটা তিরিশ বেজে গেছে। পরিমলবাবু আজও হঠাৎ না বলে বাড়ী ফেরেননি। পিসি শুধু ঘর আর বার করছেন। আমাকে দেখে খুশী হয়েছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু বাইরে তা কিছুতেই প্রকাশ না করে গেটের তালা খুলে দিলেন। বললাম, আমি খুব দুঃখিত পিসি। তোমাকে সংবাদ দিতে পারিনি। পিসি কোন কথাই বললেন না। আমি বললাম কোথায় গিয়েছিলাম কেন দেরি হল কিছুই জিজ্ঞাসা করবে না? কি প্রয়োজন। দরকার মনে করোনি সংবাদ দাওনি। রাত হয়েছে খাওয়ার প্রয়োজন হলে খেতে এসো। আমি বললাম, পিসেমশাইয়ের সংবাদ নেবো না। কোন প্রয়োজন নেই। আমার জন্য যখন কেউ ভাবেনা, তখন আমিই বা ভাবতে যাব কেন?

    আমি আর কথা বাড়ালাম না। খাওয়ার টেবিলে এসে খেতে বসলাম। পিসি বললেন, তোমার কলেজ খুলতে আর কদিন বাকী আছে? দিন দশেক। তাহলে কি ঠিক করলে গ্রামের বাড়ীতে যাবেনা বলে মনস্থির করেছো? না ঠিক কিছুই করিনি। আর তাছাড়া তুমিও আর কিছুই বলনি। এবার তাহলে বল কবে যেতে চাও? পিসি বললেন, কালই চল। কাল? কেন তোমার অসুবিধা আছে নাকি। হ্যাঁ তা একটু আছে পিসি। তবে পরশু চল। আমি বললাম, আর কয়েকটি দিন দেরি করলে হয় না। কেন? তোমার এখানে এত কি কাজ যে কয়েকদিন দেরি করতে চাইছো? কণ্ঠে অসম্ভব উম্মা। আমি ধীরে ধীরে বললাম। তুমি জানতে না চাইলেও আমি বলতাম পিসি। আসলে তোমাকে না বলে আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। কি এমন কথা যে আমাকে না বলে তুমি শান্তি পাচ্ছ না। বললাম, শোনার আগে তোমার একটু শান্ত হওয়া দরকার পিসি। আমি কি অশান্ত? তুমি আমার থেকে নিজেই ভালো জানো তুমি শান্ত না অশান্ত। আমার কণ্ঠে যেন কি ছিল হয়তো উদ্বিগ্নতা আর দুশ্চিন্তার ছাপ। পিসি বললেন, একি প্রান্তিক তোমার চোখে জল, ছি এতবড় ছেলের চোখে জল আসতে নেই। তোমার এমন কি হয়েছে যে এত দুশ্চিন্তা করছ? আমি তো আছি। হ্যাঁ আমি জানি তুমি আছো, তাইতো নিজেকে এখনো ঠিক রাখতে পেরেছি। তারপর ধীরে ধীরে সব কথা খুলে বললাম। সেই ডালিমের কথা, সেলিনার কথা, রেহানার কথা, আফরোজ বেগমের কথা, এক এক করে সব বললাম পিসিকে। যে দিন গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল, সে দিন কেন যাওয়া হলো না, কেন মিথ্যে কথা বলতে হলো। আবার আজ সবেবরাতের রাতে ওদের ওখানে গিয়ে যা যা ঘটেছে, এবং হাসপাতালে তপতী, সেলিনা আবার সেখান থেকে রেহানাদের বাড়ী, কোনটাই বাদ না দিয়ে সব কিছু পিসিকে বলে, জিজ্ঞাসা করলাম এবার বল আমার কি করণীয়।

    খাওয়া বন্ধ করে পিসি সব শুনলেন। তারপর বললেন অনুমান কিছু করেছিলাম প্রান্তিক। কিন্তু বাস্তব আর অনুমানতো সব সময় এক হয় না। যাই হোক, সেলিনা হয়তো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে, কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে রেহানা ভোগাবে। ওকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে? জানিনা। সেকি কথা, ওর ঐ অবস্থা ওকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কী না এটাই জান না? তারপর বললেন ঠিক আছে সকালে ডাঃ মিত্রকে নিয়ে ওদের বাড়ী যাবে। যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা অবশ্যই উনি যা যা বলেন সবই করবে। যা ওষুধ বলেন সব কিনে দেবে। আর হোটেলে এরেঞ্জমেন্ট করবে যেন দুবেলা ওদের বাড়ীতে তারা খাবার পাঠায়। আমি বললাম কিন্তু। আবার কিন্তু কি। আমি আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু এতসব করার জন্যেতো অর্থের দরকার। হ্যাঁ দরকারই তো, এ সবলতা আর বিনা পয়সায় হবে না। কিন্তু ওরা যদি অত অর্থের সংস্থান করতে না পারে। তুমি দেবে। আমি? কি বলছ তুমি পিসি? আমি নিজের শরীরে যতক্ষন কুলাবে, পরিশ্রম করতে পারব, কিন্তু অর্থ কোথায় পাব? পেতে হবে প্রান্তিক। না পেলে চলবে কেন? কিন্তু কোথায় পাব? পিসি বললেন প্রিয়জনের জন্য প্রয়োজনে চুরি, রাহাজানি, ডাকাতি যা হয় কিছু একটা করবে। আমি আঁতকে উঠে বললাম কি বলছ তুমি পিসি, চুরি রাহাজানি, ডাকাতি করব? না করলে তুমি এতটাকা পাবে কোথায়? দরকার নেই আমার কোন প্রিয়জনের ভালো হওয়ার। রাহাজানির টাকায় তাদের ভালো হওয়ার থেকে ধীরে ধীরে তাদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াই উচিত। তাই বুঝি। তা তোমার চোখের সামনে সামান্য চিকিৎসার অভাবে তারা যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে, পারবে সেই দৃশ্য দেখতে? বললাম জানিনে পারব কিনা। তবে এসব আমি পারবনা। না যদি পারবে তা হলে ভালবাসতে গেলে কেন? ভালবাসা কি ছেলে খেলা? তারপর একটু থেমে বললেন, ঠিক আছে সারারাত না হয় ভেবে দেখ, এসব করা সম্ভব কীনা। আপাতত খেয়ে নাও। না আর খেতে ইচ্ছে করছে না। বেশ, তা হলে উঠে পড়।

    সকাল বেলা, আমায় ধাক্কা দিয়ে তুলে দিলেন পিসি, বললেন বাবাঃ কি ঘুম ঘুমাতে পারো। ডাঃ মিত্রের ওখানে যাবে না? বললাম না থাক পিসি। ডাঃ নিয়ে গিয়ে ওদের অপ্রস্তুত করতে চাইনা। আমি জানি, তা তুমি পারবেনা। আসলে তুমি একটা ভীরু কাপুরুষ মাত্র। তারপর নিজের মানি ব্যাগ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে বললেন, আশা করি আপাতত মিটে যাবে। পরে লাগলে আমাকে বলতে পারবে, না তাও পারবে না। কিন্তু পিসি? ও তুমি ভাবছো আমার কাছ থেকে এটাকা নেওয়া কি তোমার ঠিক হবে? ওটা না হয় পরেই ভেবো প্রান্তিক। আপতত, এ টাকাটা দরকার। আর দেরি করোনা, এর পরতো আবার সেলিনাকে দেখতে যাবে। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকালাম পিসির দিকে। সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশেছে যেন অপরূপ দেবীমাধুর্য। হাত পেতে নিলাম পিসির দেওয়া ভালোবাসার দান, প্রিয়জনের কাছ থেকে দান হিসাবে টাকা নেওয়া যায় কি না জানিনা। কিন্তু পিসির এ দানের সঙ্গে ঝরে পড়ছে অজস্র ভালোবাসা। আমি জামা কাপড় পরে বেরিয়ে পড়লাম। একটা টিফিন ক্যারিয়ারের কৌটা এগিয়ে দিয়ে বললেন এটা নিয়ে যাও। কি ওটা? সকালে কিছু খেতে হবে তো।

    অবাধ্য চোখর জল কিছুতেই বাধা মানতে চাইছেনা। বহু কষ্টে সামলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ডাঃ মিত্রকে নিয়ে যখন রেহানাদের ওখানে পৌঁছালাম, তখন নটা বাজে। উনি অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলেন রেহানাকে। ওষুধ লিখলেন ও কয়েকটা জটিল পরীক্ষা করতে বললেন, তারপর বললেন ভয়ের কিছু নেই। কয়েকদিন ভোগাবে, তবে সুস্থ হয়ে যাবে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, পরীক্ষাগুলো আজকেই করে ফেলতে পারলে ভালো হয়। যত দেরি হবে সঠিক চিকিৎসা তত বিলম্বিত হবে। আরেকটা কথা, এখন পরিপূর্ণ বেডরেষ্ট। টেনশন আর অমানবিক পরিশ্রম, তারপর দিনের পর দিন পরিমাণ মত খাদ্যের অভাব ওকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। মনে রাখবে প্রান্তিক বিশ্রামের যেন কোন ব্যাঘাত না হয়।

    ডাঃ বাবুকে বিদায় দিয়ে আবার ফিরে এলাম। রেহানা বলল এসব তুমি করতে যাচ্ছ কেন? কি লাভ তোমার? জীবনের সবকিছু কি লাভ লোকসান দিয়ে বিচার হয়? শুনেছতো ডাঃ বাবুর কথা। শুধু বিশ্রাম আর বিশ্রাম। কিন্তু কিভাবে বিশ্রাম নেবো প্রান্তিক। মায়ের ঐ অবস্থা, সেলিনা হাসপাতালে, আমার কি বিশ্রাম সাজে? তাহলে মর, আমার কি? রাগ করছ কেন? না রাগ করব না, কিন্তু আমার কথা না শুনলে আর কোন দিন আসব না। আর শোন, সেলিনাকে দেখে আমি বারোটা নাগাদ আসবো, এই টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার আছে খেয়ে নিও। তারপর দেখি কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্টের সঙ্গে এরেঞ্জমেন্ট করা যায় কি না। পাগলামি করোনা প্রান্তিক। তোমাকে কিছু করতে হবে না। দেখবে আস্তে আস্তে এবার আমি ভাল হয়ে গেছি। কোন পরীক্ষা না করে, কোন ওষুধ না খেয়ে? রেহানা অর্থপূর্ণ হেসে বলল, কাল থেকেতো ওষুধ খাচ্ছি প্রান্তিক। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। কাল যদি আমাকে অনেকটা সুস্থ না দেখ তোমার কথা শুনবো, কিন্তু আজ আর আমাকে নিয়ে টানাটানি করোনা। বেশ এই খাবারটা খেয়ে নিও। কি আছে ওতে? আমি জানি না। বা তুমি হাতে করে বয়ে নিয়ে এলে আর তুমি জানো ওতে কি আছে? বললাম তুমি বড্ড তর্ক করো রেহানা। আমার সময় নেই চললাম।

    সকালে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট থাকতে দেওয়া হয় রোগীর কাছে। তাও পনেরো মিনিট লেট। তপতী দাঁড়িয়ে আছে তখনো। ওর ডিউটি ইভিনিং এ। আমাকে দেখে বললো এতে দেরি করলে প্রান্তিক? হ্যাঁ, একটু দেরি হয়ে গেছে। সেলিনা কেমন আছে? ভালো আছে। তোমাকে খুঁজছে। আচ্ছা চল। তুমিই যাওনা। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। কেন মিথ্যে অজুহাত খুঁজছে। চল। আমাকে যেতেই হবে? বা তুমিতো আচ্ছা মেয়ে তপতী। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে অথচ আমার সঙ্গে যাবে না। একটু হেসে তপতী বলল, অনেক দিন পরে ওর সঙ্গে কথা বলবে। এমন কথা তো কিছু থাকতে পারে যা আমার উপস্থিতিতে বলা যাবে না। যদি না যায়, এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে বলবো। ওকেও তো মনে রাখতে হবে ও পেশেন্ট। ও হাসপাতালে আছে। তপতী কি যেন ভাবল তারপর বলল চল।

    তপতী নিশ্চয়ই সকালে এসে ওর পোষাক বদলিয়ে দিয়ে গেছে। একটা আনকোরা নতুন ছাপার শাড়ী পরেছে সেলিনা। মাথার চুল বিন্যস্ত। কে যেন সুন্দর করে আঁচড়িয়ে দিয়ে গেছে। কাল যেমন লেগেছিল আজ আর তেমন লাগছে না। তপতী বলল, তুমি এগোতে থাক, আমি একটু এখনকার ডিউটি দিদির সঙ্গে কথা বলে আসি। আমি এগিয়ে যেতে সেলিনা বলল, কুড়ি মিনিট দেরিতে এলেন প্রান্তিক ভাই। হ্যাঁ একটু দেরি হয়ে গেছে। আমি তো ঝগড়া করার জন্য অপেক্ষা করছি। কেন ঝগড়া করবে কেন? বা ঝগড়া কররোনা। তপতীদিকে দিয়ে আমাকে এত অপমান করলেন কেন? আমি বললাম, তপতী তোমাকে স্নেহ করে সেলিনা। মনে করোনা ও রেহানার মত তোমার আর একটা দিদি। আচ্ছা না হয় তাই ভাববো। ওকে আপনি চিনলেন কি করে? সে পরে হবে। এখন কেমন আছো? ভাল। আপনি তপতী দিকে জিজ্ঞাসা করুননা আমাকে কবে ছেড়ে দেবেন। বললাম এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? এটাতো হাসপাতাল, তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হলে আর একদিনও এরা তোমাকে রাখবেন না। হসতে হাসতে কাছে এসে দাঁড়ালো তপতী। বলল, ভাই সেলিনা, প্রান্তিককে যে তুমি চেন তা আগে বলনি কেন? সেলিনা বলল আপনি যে ওকে চেনেন তা জানব কি করে? তাছাড়া আপনার বিরুদ্ধেও আমার একটা অভিযোগ আছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ? দেখ প্রান্তিক ও বলেকি? তোমার কথায় ওর জন্য আমি যা নয় তাই করলাম, তারপরও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ? তা ভাই অভিযোগটা কিসের? হঠাৎ হাসতে হাসতে সেলিনা বলল, থাক বলবনা।

    কেটে যায় আরো কয়েকটা দিন। সেলিনাকে এখনো ছেড়ে দেয়নি হাসপাতাল কতৃপক্ষ। একটি গুলি কানের পাশ দিয়ে মাথার একটি অংশ দিয়ে গেছে। আরেকটা পায়ে। পায়ের ক্ষত শুকিয়ে গেছে প্রায় কিন্তু মাথার ক্ষত শুকাতে আরো কয়েকটা দিন লাগবে। কিন্তু সেলিনা কিছুতেই আর হাসপাতালে থাকতে চাইছেনা। অনেকদিন তো হয়ে গেছে হাসপাতালে আছে। হাসপাতালের অনেকের সঙ্গে এই দীর্ঘদিনের সহাবস্থানের ফলে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে। তপতী হোস্টেলে থাকে। হোস্টেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে, সেলিনার দুই বেলার খাবার ওই নিয়ে আসে। এ নিয়ে সেলিনা একদিন বলে যে, আপনি আমার জন্য এত কষ্ট করেন কেন তপতীদি। তপতী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, প্রান্তিক বলেনি রেহানার মত আমিও তোমার একজন দিদি। রেহানা যদি আমার পরিবর্তে এই হোস্টেলে থাকতো, তাহলে কি তোমাকে সে হাসপাতালের খাবার খেতে দিতো। কিন্তু আপনি কেন ভুলে যান। আমি আপনাদের ভালোবাসা বা স্নেহের যোগ্য নই। কে বলেছে? আমি বলছি। তোমার বলা বা জানাটাইকি সব? হা হা সব। তারপর বলল আমার জন্য হ্যাঁ, কেবল আমার জন্যই, আমার গোঁয়ারতুমির জন্য, শুধু আমার নিজের জীবনে নয়, আমার গোটা পরিবার তথা, প্রান্তিক ভাই এবং আপনাকেও এই কষ্ট ভুগতে হচ্ছে। তপতী ওকে বাধা দিয়ে বলে এত কথা বলোনা সেলিনা। ভুলে যেওনা তুমি এখনো সুস্থ হওনি। ও তাকালো তপতীর দিকে। তারপর ফঁকা হাসপাতালের দেওয়ালের দিকে মুখ করে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তপতী বলল, আমার উপর তোমার খুব রাগ হচ্ছে তাই না সেলিনা? সেলিনা আবার ফিরলো তপতীর দিকে। তারপর বলল, আপনারা আমাকে কেন এত ভালবাসেন বলুনতো? তপতী শুধু একটু হাসলো। তারপর বলল, তুমি ভালবাসার মতো যে, তাই তোমাকে ভালো না বেসে থাকতে পারি না। সেলিনার এই সব সহানুভূতির কথা শুনলে চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠে, তারপর ঝাঁপসা হতে হতে এক সময় জলে ভরে যায়। নিজেকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না। অতিকষ্টে চোখের জলকে সংবরণ করে ও বলল, আচ্ছা তপতীদি আপনার বাড়ীতে আর কে কে আছেন? কেন যাবে নাকি আমাদের বাড়ীতে? যেতেতো ইচ্ছে করে দিদি। কিন্তু ভয় হয়। কেন ভয় হয়? সেলিনা বলল, একবার যাব বলে ঠিক করার পরিণতি তো এই, আবার যদি যেতে চাই, জানিনা, এই পৃথিবীর আলো আর দেখতে পারব কি না। গম্ভীর হতাশা করে পড়ে তার কণ্ঠে। তপতী সেলিনার এই অবস্থার অতীত ইতিহাস জানে না, তবে ভেবে নেয়, নিশ্চয়ই কোন গোপন ইতিহাস আছে এর পিছনে। খুঁচিয়ে তা বের করে সেলিনাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না। বলে, থাক ও সব কথা। বরং পরে একদিন তোমার কাছ থেকে ভাল করে জেনে নেবো। এবার তাহলে আসি। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে ডাক্তারবাবুরা আসবেন রাউন্ডে। আমার কাজ আছে। সেলিনা বলল, আজ আর কেউ এলোনা তাই না? বুঝতে পারে তপতী। এই কেউ বলতে সেলিনা কার কথা বলছে। চারটে বাজার আগে থেকে তার মন কার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে তাতো অজানা নয় তপতীর। রেহানাও আসেনা বহুদিন। প্রান্তিক সেদিন বলেছিল সেলিনাকে রেহানা এখনো পরিপূর্ণ সুস্থ নয়। আর মা। না তিনি অনেকটা ভাল আছেন। ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েছেন? হ্যাঁ দিয়েছেন। রেহানার জ্বর কি এখনো কমেনি? কমেছে কিন্তু খুব দুর্বল। রোজই বায়না ধরে তোমার কাছে আসবে বলে। কিন্তু নর্থ থেকে সাউথে আসার ধল্ল সইতে পারবে কি না সেই ভয়ে আমি বলেছি, আরেকটু সুস্থ হও, তারপর নিয়ে যাবে। তাছাড়া আমিতো রোজই যাচ্ছি। রোজই তোমাদের সংবাদ দিয়ে যাচ্ছি। তপতী আছে ওখানে। ও ওর যথাসাধ্য করছে। সেলিনা জানতে চায় রেহানার চেহারা কি খুব খারাপ হয়ে গেছে? তুমি এই সব ভাব বুঝি। তোমাকে না বলেছি সেলিনা, এখন আর কারও কথা ভাববে না।

    সেলিনার স্বগতোক্তির উত্তরে তপতী জানায় তোমাকে বলে যেতে ভুলে গেছে প্রান্তিক, তাই যাওয়ার পরে মাঝ রাস্তা থেকে ফিরে এসে আমাকে বলে গেছে কাল ওর আসা হবে না। খুব জরুরি একটা কাজ আছে। তাই আমাকে বিশেষ ভাবে বলে গেছে, ভিজিটিং আওয়ারের সময়টুকু যেন আমি তোমার কাছে থাকি। তোমার কোন প্রয়োজন থাকলে যেন জেনে নিই। তা তুমিতো কিছুই বলছে না। প্রান্তিক জানতে চাইলে কি বলব। ও জানতো না যে আমি যাবো না, জানা থাকলে হয়তো এতটা উতলা হতোনা। বলল, আমার তো সব প্রয়োজনই আপনি মিটাচ্ছেন নতুন করে আর কি প্রয়োজন হবে?

    এতদিনে তপতীও জেনে গেছে, প্রান্তিকের সমস্ত মন জুড়ে আছে সেলিনা এবং তাদের পরিবারের সকলে, কিন্তু সম্পর্কটা কোন স্তরের তার কোন হদিস পায়নি। না সেলিনা না প্রান্তিক কেউ তাদের আচরণে এমন কোন কিছুর প্রকাশ হতে দেয় নি যে, তাদের সম্পর্ক নিয়ে অন্য কিছু ভাবা যায়। এই সম্পর্ক ভাই-বোনের স্নেহ ছাড়া অন্য কিছু নয়। তপতী প্রথম প্রথম একটু আধটু ঠাট্টা করতে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু এমন কিছু দৃষ্টিকটু ব্যবহার তাদের মধ্যে নেই যে সেই ঠাট্টাকে দীর্ঘস্থায়ী করা যেতে পারে। জানতে চাইলো প্রান্তিকের কাছে.আমি কি সেলিনাকে জানিয়ে দেব যে তুমি কাল আসতে পারবে না। কি দরকার আগে আগে জানিয়ে। ববং তাতে ওর মনটা অকারণ খারাপ হয়ে যেতে পারে। অন্তত পুরোটা সময় তো সে ভাবতে থাকবে, আমি আসতেও পারি। কিন্তু সত্যি করে যখন সময় শেষ হয়ে যাবে, তখন জানিয়ে দিও। আচ্ছা তাই হবে। কিন্তু তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব প্রান্তিক? বল। ওদের জন্য তুমি এত করছ কেন? আমি একটু হাসলাম, তারপর চুপ করে থেকে বললাম, ভগবান না করুন, এরকম অবস্থায় পড়লে, আমাকে তোমার পাশে পাবে ঠিক এখনকারই মতন। তবু যেন তপতীর কোথায় অতৃপ্তি থেকে যায়। ঠিক উত্তর যেন পাওয়া হল না। বলল, তুমি যে এদের জন্য এত করছ নীলাঞ্জনা পিসি জানেন?

    আমি বুঝতে পারছি। আমার ভিতর থেকে উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করে আসল সত্যটা বের করে নিতে চাইছে তপতী। বললাম হয়তো জানেন। তোমার একথার মানে? কি করে এর মানে তোমাকে বলি, বলততপতী। পিসিতো কোনদিন জিজ্ঞাসা করেন নি, আমি কোথায় যাই, কি করি। তার মানে তোমার বাঁধন বলতে কোথাও কিছু নেই। তোমার নিজের ইচ্ছেয় যা কিছু করতে পারো। বললাম, এ তোমার রাগের কথা তপতী। কোন বাঁধন নেই এটাই তুমি বুঝলে? তারপর বললাম যদি কোন বাঁধন না থাকবে, তাহলে আমি রোজ আসি কেন এখানে, আর তুমিই বা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এত করছ কেন? আমার কথা ছাড়, আমি তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছি। আমি তপতীর কৌতূহলকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, রাত অনেক হয়েছে। আর নয় তপতী। তারপর প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, তুমি পিসির ঠিকানা নিয়েছিলে একবার যাবেও বলেছিলে। যাবে না কি? কবে? যে কোনদিন। আচ্ছা ভেবে দেখব। আমি যখন উঠে পড়ছি, আবার পিছু ডাকলো তপতী। বললাম বল। রেহানা ওর বোন না দিদি? দিদি। ও কি এখানে আসার মত সুস্থ হয় নি? কেন বলত। না ও বলছিল, কতদিন রেহানাকে দেখেনা। আমার মনে হয়েছে রেহানাকেও ভীষণ ভালবাসে। যদি সম্ভব হয় কালকে পারবেনা বলছ, পরও ওকে নিয়ে এসোনা। আচ্ছা দেখি।

    পিসিকে যে মিনতি সেন ফোন করতে পারেন তা ছিল আমার ধারণার বাইরে। এটা ঠিক, মিনতি সেনদের ওখানে যাওয়া হয় না অনেক দিন। যাব যাব করেও যাওয়া হয় নি। আসলে সময় করে উঠতে পারিনি। কিন্তু মিনতি সেনের বাবা যে অসুস্থ। একবার আমি যাব কথা দিয়েও যাওয়া হয়নি। এটা খুব অন্যায় হয়েছে জানি। তাই বলে পিসিকে ফোন করে আমার কথা জানতে চাইবেন, না একথা কখনো ভাবিনি। তাই পিসি যখন বললেন, আজ মিনতি সেন ফোন করেছিলেন। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, মিনতি সেন তোমাকে ফোন করেছিলেন? হ্যাঁ করেছিলেন তো, কিন্তু তুমি যে ভীষণ অবাক হচ্ছো। উনি কি কোন কারণে আমাকে ফোন করতে পারেন না। পারেন না সে কথা আমি বলিনি, কিন্তু কেন ফোন করলেন সেটাই আমার জানার বিষয়। আমি ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে আছি কি জানি কি কথা না বলেছেন মিনতি সেন। পিসি বললেন তুমি বলেছিলে, ওর বাবা খুব অসুস্থ। তুমি যাবে একবার। হ্যাঁ বলেছিলাম, তবে যাওনি কেন? নানা ঝামেলায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এত কি ঝামেলা যে একজন ভদ্রমহিলাকে কথা দিয়েও তা রাখা গেলনা। আমি বললাম, না পিসি ঠিক তা নয়, আমি কথা দিলে তা রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করি। পিসি উম্মা নিয়ে বললেন এইতো তার নমুনা। যাকগে সে কথা তুমি কি পরশুদিন যেতে পারবে? কেন তুমি যাবে আমার সাথে? আমি যাব কেন? আমাকে কি যেতে বলেছেন নাকি? আমি বললাম জানি না উনি কি বলেছেন, তবে শুধু আমার যাওয়ার কথা বললে তো পিসেমশাইকে বলে দিতে পারতেন। তোমাকে নিশ্চয়ই ফোন করতেন না। তারপব কাতর অনুরোধ করে বললাম চল না পিসি আমার সাথে। পিসি যে আমার এই অনুবোধে রেগে যেতে পারেন, ভাবতে পাবিনি। বললেন, দেখ প্রান্তিক ছেলেমানুষীর একটা সীমা আছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। প্রায় রাত ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। আলোটা নিভানো হয়নি বলে পিসি এলেন আমার ঘরে। বললেন, আলোটাতো নিভিয়ে শুতে পারতে তা হলে আমার আর কষ্ট করে আসতে হতোনা৷ কি যে কর। তারপর যেমন ভাবে এসেছিলেন, আলোটা বন্ধ করে তেমনি ভাবে চলে যেতে উদ্যত হতেই আমি বললাম, শোন পিসি। কি বল? তোমার ঘুম পাচ্ছে? পিসি আববা রেগে গিয়ে বললেন, এই সব বাজে কথা শোনবার আমার সময় নেই। বুঝতে পারি কোথাও কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু ধরতে পারছি না। তবু কোন রকম রাগ বা উত্মা প্রকাশ না করে বললাম, যে কোন কারণে তোমার আজ মন ভালো নেই পিসি। তোমার বুঝি তাই মনে হচ্ছে? কিন্তু সেসব ভুল। আমি ভীষণ ভালো আছি। আজ আমি ভীষণ আনন্দে আছি। কি। সব প্রলাপ বকছ পিসি? পিসি আরো রেগে গিয়ে বললেন। আমি প্রলাপ বকছি? মানে আমি পাগল? পাগল তোমার পিসেমশাই। পাগল তোমার মিনতি সেন। পাগল তুমি তোমরা সবাই।

    আমি যে কি করব বুঝতে পারছি না। আলো নিভাতে সমস্ত ঘরটা ঘুরঘুঁটে অন্ধকার। আমি বিছানায় বসে নাইট বাটা জ্বেলে দিলাম। দেখলাম পিসি দুই হাতের পর মাথা রেখে চেয়ারে বসে আছেন। হঠাৎ খুব দুশ্চিন্তা হল আমার, তবে কি পিসেমশাইয়ের না আসা, এবং মিনতি সেনের আমাকে ফোন করে খোঁজ নেওয়ার মধ্যে কোন গভীর যোগসূত্র আছে?

    বললাম পিসি ওভাবে বসে আছে যে। যাও ঘুমিয়ে পড়ো গে। আবারো সেই রাগী জবাব তুমি ঘুমাও। আমার জন্য ভাবতে হবে না। আমার সময় হলে আমি ঘুমাতে যাব। আমি উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। আস্তে আস্তে দাঁড়ালাম পিসির পাশে এসে। পিঠে হাত রেখে ডাকলাম পিসি। আমার গায়ে হাত দেবে না। তোমরা সব শত্রু। কেউ তোমরা আমাকে চাও না। আমার ভালমন্দ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই তোমাদের। আমি শুধু অবাক আর অবাক হয়ে চলেছি। বললাম কি যা তা বলছ পিসি? কে তোমার শত্রু? এ তোমার মনের ভুল। মনকে ঠিক কর, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। এবার পিসি আর কোন কথা বললেন না। আমি আবারও ডাকলাম পিসি। কিন্তু কোন সাড়া নেই। এবার জোর করে মুখটা তুলে ধরতেই দেখলাম, দুচোখের জলে তার বুকের আঁচল ভিজে একাকার। বললাম ছিঃ পিসি ছিঃ! কি হয়েছে না বলে নিজের মধ্যে চেপে রেখে দিলে কি সমাধান হবে? এবার উনি আমাকে আস্তে আস্তে ওর বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন, আমি খুব খারাপ তাই না প্রান্তিক? এসব তুমি কি বলছ পিসি, কে বলেছে তুমি খারাপ। তাহলে তুমি এখান থেকে চলে যেতে চাইছো কেন? আমি পিসির বাহুপাশ থেকে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, সামনের চেয়ারটায় পিসিকে বসিয়ে দিয়ে, বিছানার এক পাশে মুখোমুখি বসে মৃদু কণ্ঠে বললাম, কে তোমাকে এই বাজে কথা বলেছে জানিনা। যেই বলুক সে মিথ্যে কথা বলেছে? আমি কোথায় যাব পিসি? কে আছে আমার এখানে? আর কেনই বা যাবো? তুমিতো আমার সঙ্গে এমন কোন ব্যবহার করনি যাতে রাগ করে চলে যাব। পিসি বলনে, তার মানে, আমি খারাপ ব্যবহার করলে তুমি চলে যেতে পার। আর এখন না গেলেও ভবিষ্যতে যেতে পারো নিশ্চিত, তাই না? আমি কি তাই বলেছি? না স্পষ্ট করে বলোনি, তবে তুমি যা বলেছে, তার তো মানে একটাই। কিন্তু প্রান্তিক তুমিতো নিজেই বলেছো আমাকে তুমি ভালবাসি। আমার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে তোমার ভাল লাগে। তাইনা? পিসিব প্রশ্নের উত্তরে বললাম সত্যি কথাইতো বলেছি পিসি। সত্যি আমি তোমাকে ভালবাসি। নীলাঞ্জনা বললেন, ভালবাসা বুঝি খুব পলকা জিনিষ, যে সামান্য আঘাতে তা ভেঙে যাবে। বললাম বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছে পিসি। নীলাঞ্জনা বলেলেন, কথা দাও প্রান্তিক আমি যদি খারাপ ব্যবহারও করি কোন দিন, তাহলেও তুমি কোনদিন চলে যাবেনা। তাহলে তো বুঝবো তুমি আমাকে ভালবাস।

    পিসির এই এলো মেলো ব্যবহারে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। তবু বললাম জানিনে আমার মুখ দিয়ে তুমি কি শুনতে চাও। বল তুমি আমি কি বললে তুমি খুশী হবে? আমার খুশী হওয়াটা কি তোমরা চাও? তোমরা বলতে কি বলতে চাইছো জানিনা, কিন্তু আমার কথা বলতে পারি, তুমি চাওনা, তুমি খুশী হতে পার না এমন কিছু আমি করবনা, কোন দিনই আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না পিসি। নীলাঞ্জনা চোখ তুলে তাকালে আমার দিকে। বললেন, একথার মানে কি জান? জানি কি জান? বললাম আমি আমার কথা বলেছি পিসি, আর তুমিও বধির নও যে শোননি। তাই নতুন করে এককথা বার বার বলতে পারবনা। পিসি মৃদু হেসে বললেন, কিন্তু আমাকে সুখী দেখতে বা করতে গিয়ে যদি তোমাকে কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়? তাই নেবো পিসি। সহজ কণ্ঠে নীলাঞ্জনা বললেন, এখনো সময় আছে প্রান্তিক এমন কঠিন সিদ্ধান্ত তুমি নিওনা। আমি ধীরে ধীরে বললাম, এ কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নয় পিসি। আমার জীবনে তোমার অবদানকে আমি অস্বীকার করব কি করে? নীলাঞ্জনা বললেন যদি আমার হঠকারিতার জন্য জেদের জন্য একে একে সবাই আমাকে ছেড়ে যায়? আমি যাব না। কেন? আমি তোমাকে ভালবাসি বলে। আর একথা তো তোমাকে বহুবার বলেছি। আমার কথা শুনে পিসি আবারও রেগে উঠলেন। বললেন, ভালবাসার মানে জান? না জানিনা, কিন্তু তোমাকে বাদ দিয়ে আমি কোন সুখ কিনতে চাইনে। কিন্তু ভেবে দেখোছো কি এসব করতে গিয়ে যদি তোমার জীবন জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে যায়? কোন দিনই তুমি জ্বালাতে পারবে না পিসি কারণ আমার জীবনে আগুন জ্বালিয়ে তোমার সুখ কেনা হবে না। সুতরাং ওতে আমি ভয় পাইনা পিসি, মিছিমিছি ভয় দেখিওনা আমাকে। আমিও খানিকটা একরোখা হয়ে কথাগুলো বললাম পিসিকে। কি যেন ভাবলেন পিসি। তারপর একবার পিছনের দবজার দিকে তাকালেন অকারণে। এগিয়ে এলেন আমার দিকে আস্তে আস্তে। আমি তখন মাথা নীচু করে আছি। দু হাতে আমার মুখটা তুলে নিলেন। ভয় যে পেলাম না তা নয়। আগেও দুই দুইবার তার দুর্বলতার আঁচ পেয়েছি আমি। আমার চোখ দিয়ে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে। নিজের আঁচলে তা মুছে দিয়ে বললেন, চোখের জল যে মাঝে মাঝে জীবনের কত কঠিনতাকে উর্বর করে তুলতে পাবে নিজের জীবন অভিজ্ঞতায় তা আমি বুঝেছি। মুছে ফেল চোখের জল প্রান্তিক। তারপর বললেন যাতে তোমাকে সুখী দেখতে পারবনা, তেমন সুখ আমি কি চাইতে পারি। আমার ভিতরের কান্না গলা পৰ্য্যন্ত উঠে এলো, বললাম পিসি! পিসি আমাকে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিলেন। তারপর মশারি খাঁটিয়ে, ঘরের সব গুলো আলো নিভিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।

    রাত কাটলো এক গভীর প্রত্যাশা নিয়ে। কি যে হল আর কি যে হল না, কোনটাই যেন ঠিক মনে করতে পারছি না। পিসি কি চাইলেন আর আমি কি দিলাম তার চেয়েও বড় হয়ে উঠলো পিসি কি দিলেন, আর আমি কি পেলাম। পিসি কি নিজেকে সরিয়ে নিলেন আমার কাছ থেকে? না তিনি আমার মনের মধ্যে জাগাতে চেয়েছেন সেই অপূর্ণতা, যার জন্য পিসি নয়, আমাকেই যেতে হবে তার কাছে। জানিনে কিছুই জানিনে। সকালের বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছেনা। ভাবছিলাম পরিমলবাবুর কথা। কে দায়ী পিসি না পরিমলবাবু? আপাত দৃষ্টিতে পরিমলবাবুর বিশেষ কোন দোষ আমি দেখতে পাচ্ছিনা। কিন্তু কিছু একটা আছে যা পিসি এবং পরিমলবাবুকে সন্দেহের দোলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। সকালের চা নিয়ে এসে পিসি বললেন, রাতে নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি। না হয়নি। আমি জানতাম তুমিতো সবই জান। হা জানিতো। কালকের সেই বিষণ্ণতা একে বারে অনুপস্থিত। সকালে স্নান করেছেন পিসি। পরেছেন গরদের লাল পেড়ে শাড়ী। একটু আগের প্রভাত পূজার শঙ্খধ্বনি এসেছে কানে। আগে করতেন না। কিন্তু ইদানিং সকাল সন্ধ্যা দু বেলাই মঙ্গলদীপ জ্বালান তিনি তার দেবতার মন্দিরে। নটরাজের পূজারি নীলাঞ্জনা পিসি। বললাম এত সকালে তোমার পূজা শেষ? তারপর জানতে চাইলাম আজ কি প্রার্থনা করলে তোমার দেবতার কাছে। পিসি বললেন আমার দেবতা নটরাজ। তিনি সব কিছুর উর্ধে। তার কাছে তো চাইবার কিছু নেই আমার, তবু মৃদু হেসে পিসি বললেন বলেছি আমার অপূর্ণতাকে পূর্ণ করে দাও হে নটরাজ তোমার আপন খেয়ালে। ব্যস তোমার প্রার্থনা শেষ? কেন তুমি কি অন্য কিছু চাইতে নাকি? না পিসি কোন দেবতার কাছে প্রার্থনা করা আমার পোষাবে না, আমি বরং তোমার কাছে প্রার্থনা করতে পারি। আমার কাছে বল কি চাও তুমি। হেসে বললাম কিছুই চাইনা। শুধু তোমাকে চাই পিসি শুধু তোমাকে। পিসি চায়ের পেয়ালা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই ধর চা। অফিসের সময় হয়ে গেছে। আর বলছিলাম কি বেশী মন খারাপ না করে একবার মিনতি সেনের কাছে যাও।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅগ্নিপরীক্ষা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }