Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প813 Mins Read0

    ০৭. রেহানা এসে দাঁড়ালো

    রেহানা এসে দাঁড়ালো মিনতি সেনের পাশে। বলল, আপনি ভাল আছেন তো? হারে মেয়ে হ্যাঁ। কবে আসছিস? আপনি কবে আসবেন? আমাকে ডেকে মিনতি সেন বললেন, তুমি কাল একবার আসতে পারবে? যাব। তারপর পুলিশ কমিশনারকে বললেন, এই মেয়েটিই রেহানা। আপনাকে এর কথাও বেশ কয়েকবার বলেছি। কোন ব্যাপারে যেন? আপনি সব ভুলে যান। কমিশনার সাহেব প্রান খুলে হেসে বললেন তোর এই বকুনিটুকু আমার এত ভাল লাগে যে, বার বার তোর বকুনি খেতে ইচ্ছে করে। তারপর নিজেই বললেন, ঐ ডালিমের কেসটা নিয়েতো। তারপর রেহানার চিবুকটা একটুখানি নাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তুমি ভেব না মামনি। মিনতি যখন তোমাদের সহায় ভগবানেরও সাধ্য নেই তোমাদের হারায়। তারপর মিনতি সেনকে তাড়া লাগিয়ে বললেন চল চল দেরি হয়ে যাবে। আর একটা কথা, বলে আমাকে ডেকে নিলেন কাছে, বললেন হয়তো কোন অযত্ন হবে না, তবু তুমি আমাকে নিয়মিত সংবাদ জানাবে। আমার ফোন নাম্বার জানতো। বললাম জানি। ওরা বেরিয়ে গেলেন।

    না অশ্রুকণার চিকিৎসার কোন অসুবিধা হয় নি। আলাদা কেবিন। বিশেষ খাতির করে দুবেলা দেখা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যা যা করণীয় সবই করছেন ঘড়ির কাটার সঙ্গে সময় মিলিয়ে। আমি বোজ আসতে পারিনি, কিন্তু রেহানা এসেছে রোজ। ওর কাছ থেকে সংবাদ নিয়েছি। যেদিন ওকে ছেড়ে দেবে রেহানা বললো আজো তুমি যাবে না? না রেহানা তুমি যাও। এ তোমার ঠিক হচ্ছে না প্রান্তিক। আর এসবের মানে আমি যদি ভুল করি তা হলে তুমি এই রকমই করবে তাইতো। তুমি জানো রেহানা অশ্রুকণা যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। জানি আমি। না জানো? রেজিষ্ট্রি করে আমায় বিয়ে করেছে এইতো। হাসতে হাসতে বলল রেহানা। আমি রেগে গিয়ে বললাম এটাকে তুমি সামান্য অপরাধ বলে মনে কর? না করিনা। এটাকে আমি অসামান্য অপরাধ বলেই মনে করি, যদি বলে থেমে গেল রেহানা। থামলে কেন? বল না যদি কি? ও বলল থাক না, যা মিথ্যা, তাতো সত্যি হবে না কোন দিন, কি দরকার ও নিয়ে মাথা ঘামাবার। তাছাড়া অশ্রুকণা এজন্য খুব অনুতপ্ত। এই এ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে ওরও একটা নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাছাড়া সত্যি কথা কি জান? কি? আমি তাকালাম ওর দিকে। ও বলল, ও তোমাকে ভালবাসে প্রান্তিক ভীষণ ভালবাসে। আসলে ঘটনা চক্রে যাই ঘটুকনা কেন, এবং যে ভাবেই তার প্রচার হোক না কেন, আমি যে তোমার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম, এবং অনেক রাতে ফিরেছিলাম, এটাকে ও কোন ভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই রাগের মাথায় ও সব কথা ও বলে ফেলেছে। আমি বললাম কাকে বলেছে জান? জানি। কাকে? তোমার পিসিকে তো। তুমি কি করে জানলে? বা, হাসতে হাসতে রেহানা বলল, রেজিস্ট্রি করে বিয়ের কথা যখন বললাম তখনতো জিজ্ঞাসা করলেনা কার কাছে শুনেছি। আর অনেক রাতে ফেরার কথা শুনে জানতে চাইছ কার কাছে শুনেছি?

    আমি বললাম ঐ ভাবে ব্যাখা করছ কেন রেহানা। আসলে পিসির কাছে যে দিন শুনলাম অশ্রুকণা এইসব কথা বলেছে, রাগে আমি জ্বলতে লাগলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম ওর সঙ্গে জীবনেও আর কথা বলবনা। হাসতে হাসতে রেহানা বলল, অথচ দেখ, ওকে নিয়ে সবাই যখন জটলা করছে, তখন কেবল তুমিই বুঝতে পারলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। তারপর সেই হাসপাতাল কাণ্ড, এতো আমাদের জীবনের অক্ষয় সম্পদ। নাতি নাতনিদের সঙ্গে গল্প করার বিষয় কি বল? আমি ভীষণ চেষ্টায় হাসি দমন করতে গিয়েও পারলাম না। বললো হাসলে যে বাঃ হাসবনা, তোমার স্বপ্ন কত দিগন্ত বিস্তৃত। আগেতো ছেলে মেয়ে তার পরতো নাতি নাতনি। কিন্তু তার আগে দরকার বিয়ে। সে সামাজিক হোক বা রেজিস্ট্রি তাই না? যা অসভ্য কোথাকার। বলে দ্রুত পালিয়ে গেল।

    অশ্রুকণার বাবা, বাইরে আছেন, ওর মা বলেছেন, বাবা প্রান্তিক, ভর্তিতে তুমিই করে ছিলে, ওকে রিলিজ করেও তুমিই বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দিও। এই দায়িত্ব তোমাকেই দিয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা মাসিমা ঠিক আছে।

    ভেবেছিলাম রেহানাকে পাঠাবো। আমি যাব না। কিন্তু রেহানার এতগুলো কথার পর যদি না যাই, রেহানা বলবে অশ্রুকণার প্রতি তোমার ভালবাসা এত গভীর যে, অভিমানের উর্ধে উঠতে পারলে না। কিন্তু একি। ওযে আসছেই না। কে জানে কখন আসবে?

    হঠাৎ দেখি সেলিনা আসছে। আবদার করে বলল চলুন না প্রান্তিক ভাই এটুকুতো মাত্র পথ হেঁটেই যাইনা। মন্দ হয় না বললাম আমি। আরো বললাম তোমার শরীর কিন্তু এখনো ঠিক হয়নি সেলিনা, কষ্ট হবে। তুমি নিশ্চয়ই জান অশ্রুকণাকে নিয়ে আসতে হবে। ওরা হয়তো অপেক্ষা করে থাকবে আমার জন্য। হঠাৎ সেলিনা বলল, আচ্ছা প্রান্তিক ভাই, অশ্রুকণাদি যদি জিজ্ঞাসা কবেন, এ কে? আপনি কি পরিচয় দেবেন? তোমার যা পরিচয়? কি আমার পরিচয়? মৃদু হেসে বললাম সে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করবে উত্তরটা তাকে দেব। অশ্রুকণাকি চেনেনা তোমাকে? না জানেনা তুমি কে? হঠাৎ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, আমার সঙ্গে কথা বলতে আপনার খুব কষ্ট হয় তাইনা? ভাবতে পারছি না ওকি বলতে চায়। কেন যে ও এল আমার সাথে, আর এলই যদি তবে ওর যা সাধারণ পোষাক তাই পরে এলোনা কেন? কি দরকার ছিল মিনতি সেনের দেওয়া এই রাজকীয় পোষাক পরার। এটাকি ছেলে মানুষী না শুধুই খেয়াল, অথবা অন্য কিছু। হল না বাসে বা ট্রামে ওঠা বাধ্য হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসতে হল এ পথটুকু ওর সাথে। যে কারণেই হোক ওর ইচ্ছে যে পূর্ণ হয়েছে এতে যে ও আনন্দিত তা ওর শারীরিক ভাষায় বোঝা গেলেও মুখে কিছু বললনা। তারপর হাসপাতালের যাবতীয় দেনা পাওনা মিটিয়ে দিয়ে আমি যখন অশ্রুকণার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি ও আমার দিকে তাকিয়ে ঝবঝর করে কেঁদে ফেলল। এতটা বোধ হয় সেলিনাও ভাবেনি। ও তাই অশ্রুকণার কাছে গিয়ে বলল, একি অশ্রুদি, এখনকি ভেঙে পড়ার সময়? মনকে দৃঢ় করুন। আঘাতকে গ্রহণ করুন সহজ ভাবে। আমি অবাক হয়ে তাকাই সেলিনার দিকে। এত দিনে বুঝেছি যে সেলিনাব ভিতর আছে এক কৌতুক প্রিয় আর সংবেদনশীল মন। তাই তো ওর পক্ষেই বলা সম্ভব ছিঃ অশ্ৰুদি এটাকি কান্নার সময়? জীবনে কত পথ পাড়ি দিতে হবে দুর্গম না সহজ আমরা কি জানি? তাই আর কান্না নয়। দাঁড়ান সোজা হয়ে। এবং তারপর, নিজের দামী শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিল ওর চোখের জল। আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জানতে চাইল ওর পরিচয়। বললাম একেতো তোমার না চেনার কথা নয়, এ সেলিনা রেহানার বোন। সেলিনা। নামটাকে ও মনে করতে পারছে কীনা বোঝ গেলনা। সেলিনা হেসে বলল চিনতে পারছেন নাতো একটু মনে করার চেষ্টা করুন ঠিক চিনতে পারবেন। অশ্রুকণা তবুও মনে হয় চিনতে পারলনা। তারপর বললাম ওকে যে চিনতেই হবে তার কি কোন মানে আছে? সবাই কে কি আমরা চিনি? অশ্রুকণা মনে মনে ভাবে, প্রান্তিক যাই ভাবুক। যে ভাবেই আমার না চেনাটাকে ব্যাখ্যা করুক একথাটা মানতে হবে যে, সেলিনা নামের এই মেয়েটিকে যদি আমি না চিনতাম, তাহলে কিছুতেই ও নিয়ে আসতোনা। তাছাড়া ও যে রেহানার বোন সে পরিচয়ও তো দিয়েছে প্রাভিক। এরপরে তার অবশ্যই চেনা উচিৎ ছিল। কিন্তু কেন যে কিছুতেই মনে করতে পারছেনা। নিজের স্মৃতি শক্তির উপর খুব রাগ হয় অশ্রুকণার। সেলিনা বলল, বেশ গরম আইসক্রিম খাবেন? আমি হেসে বললাম গরম কোথায়? এখনতো ঠান্ডা পড়ে গেছে বলা যায়। তুমি খেতে পার আমি খাব না। আর আপনি অদি। অনেক আশা করে তাকালো ওর দিকে। অশ্রুকণা বলল, প্রান্তিক তিনটে আইসক্রিম নিয়ে এসো না। তিনটে কেন? বা আমরা তো তিনজন না? আমিতো খাব না বলছি। সেলিনা বলল এ আপনার ভীষণ বাড়াবাড়ি প্রান্তিক ভাই। আপনি খাবেন না। বেশ তো। কিন্তু খাবেন না একথাটার পরে এত জোর দিচ্ছেন যে, আমাদের খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তা বন্ধ করে রাখার আপ্রাণ প্রয়াস। মেয়েটির চতুরতাকে প্রশংসা না করে উপায় নেই। বললাম, ঠিক আছে তোমরা একটু অপেক্ষা কর, আমি যাব আর আসব। আমি যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছি হঠাৎ দেখি অশ্রুকণা সেলিনাকে তার নিজের বুকের পরে টেনে নিয়ে বলছে। আমাকে ক্ষমা করো সেলিনা তোমাকে চিনতে না পাবার জন্য। এবার কি তবে চিনতে পেবেছেন? হাসি মুখে বলল সেলিনা। অকশা বলল, তোমাকে চেনা যে অতি কঠিন কাজ একথা বহুবার শুনেছি প্রান্তিকের কাছে, মন তোমার চির সবুজ, হৃদয় যেন এক স্রোতস্বিনী নদী। হেলায় জয় করতে চাও দুনিয়াকে, নিজেকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দেওয়াতেই তোমার আনন্দ। আরো যেন কি সব বলতে যাচ্ছিল অশ্রুকণা–। তাকে বাঁধা দিয়ে সেলিনা বলল, দাঁড়ান অশ্ৰুদি, এভাবে প্রশংসা বা নিন্দা যাইই করুন না কেন, তা দিয়ে আমাকে চিনবেন কি করে? তারপর বলল প্রান্তিক ভাই কি জানি কি বলেছেন তার ব্যাখা উনি দিতে পারবেনা। কিন্তু আমি যে, এতদিন পথ চললাম ওর সাথে, আজো চিনতে পারিনি ওকে একটুও, তা সে সত্য বা মিথ্যে যাই হোকনা কেন। তারপর হেসে বলল, এই দেখুন না, এই গোলাপটি আজইতো তার নিজের হাতে পরিয়ে দিয়েছেন আমার বেনীতে, হয়তো আপন খেয়ালে, অথবা অনুরোধ এড়াতে পারেননি তাই, কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বিধর্মী হয়েও ওর পায়ে যে মাথা নোয়ালাম অথচ একবারও বললেন না, সেলিনা তোমাকে আমি ভালবাসি, তাই তো এই সুন্দর গোলাপটিকে তার যোগ্য স্থানে রাখতে পেরে নিজেকে ধন্যমনে করছি। কি নিষ্ঠুবতা। কি অপমান! এবার আপনিই বলুননা অশ্রুদি, একি অপমান নয়? সুন্দরকে যদি যোগ্য মর্যাদাই না দিতে পারবেন তবে আর তার আরাধনা কেন?

    অবাক হয়ে শোনে অশ্রুকণা আর নিবিষ্ট মনে ভাবে সেলিনার কথা, কি অকপটতা। যেন কোন গ্লানি নেই। যেন কোন মন্দ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। ওর কথায় একটু খানি হেসে অশ্রু আমাকে বলল, যাও প্রান্তিক তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। তারপর সেলিনাকে বললো, এসো ভাই একবার আমার কাছে, আমি রেহানা নই, আমি তোমার মত অসামান্যও কেউ নই। অকুশার চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। এই দুই নারীর নিজস্ব আদান প্রদানে আমি আর কেন স্বাক্ষী হয়ে থাকি। বেরোতে হবে। ট্যাক্সির মিটার উঠছে। যদিও মাসীমা, মানে অশ্রুকণার মা, টাকা দিয়ে দিয়েছেন। আমি ওদের আবেগ ধারায় কোন ছন্দ পতন না ঘটিয়ে আইসক্রিমের জন্য বেরিয়ে পড়লাম।

    সেলিনা বলল, দিদি আমি পৃথিবীকে সোজাসুজি দেখতে ভালবাসি। কারো করুণার প্রত্যাশা আমি কোন দিনই করিনা। তবু আমার জীবনে আলোড়ন তুলে এলেন এই প্রান্তিক ভাই। তারপর অশ্রুকণার দিকে তাকিয়ে বলল, না না ভুল বুঝবেন না, আমি আপনাদের মত করে কোন দিনই চাইনি ওকে। এরপর বলল আপনিতো স্পষ্ট করে বলছেন আপনার কথা, আর রেহানা? নিজের কথা কোন দিনই সে বলতে পারবেনা কাউকে। আপনি ওকে ঠিক বুঝেছেন, অন্যের জন্য ও সরে দাঁড়াবে, তবু নিজের দাবি পেশ করবেনা কোন দিন। কান্নতেই বোধ হয় ওর আনন্দ। আর দেখুননা প্রান্তিক ভাইয়ের ব্যাপার, ও কি বোঝেনা রেহানা ওর কাছে কি চায়? কে পারে নিজেকে এমন নিঃস্ব করে তুলে ধরতে। তবু কি কঠিন হৃদয়? একবারও বলতে পারলেন না। না হয় মিথ্যে করেই বলতেন, রেহানা আমি তোমায় ভালবাসি। একটু থেমে বলল, রেহানার বুকে ঈর্ষার আগুন জ্বালতে আমিও কম চেষ্টা করিনি, যাতে অন্তত ও যা চায় তার উপর অধিকার দাবি করতে পারে। কিন্তু সবই নিষ্ফল অশ্ৰুদি, আজ তাই আর একবার চেষ্টা করছি, দেখি যদি ওর মনের দরজা খোলে তাতে। তারপর কি ভাবতেই সেলিনা বলল, আমার পরে রাগ করলেন অদি? কেন বলত। আমার স্বার্থপরতায়। তোমার স্বার্থপরতায? হ্যাঁ, আমার স্বার্থপরতায়, কারণ আমি জানি রেহানার থেকে আপনিও কম ভালবাসেন না প্রান্তিক ভাইকে। অথচ সেই আমি রেহানার হয়ে ওকালতি করে যাচ্ছি, একি আমার স্বার্থপরতা নয়? অশ্রুকণা আবারও ওকে তার বুকের পরে টেনে নিয়ে বলল, তোমার মতন স্বার্থপর একটা বোন যদি আমার থাকতো। সেলিনা বলল আমাকে কি আপনি তাই ভাবতে পারেন না, না পারিনা। কেন? কোন বোনকি তার দিদিকে আপনি বলে? সেলিনা বলল, আমার অন্যায় হয়েছে, এই কান ধরছি, আব হবে না। তারপর দুজনেই খিল খিল করে হেসে উঠলো। দু জনের চোখেই জল দেখতে পেলাম।

    আমরা যখন অশ্রুদের বাড়ী পৌঁছালাম তখন প্রায় ৯টা বেজে গেছে। সেলিনাকে নিয়ে আবার এতটা পথ পাড়ি দিতে হবে। স্নেহময়ী দেবী সেলিনাকে বললেন, তুমি মা আসবে একটু আমার ঘরে? সেলিনা ওই ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলে, অশ্রুকণা বলল, আমায় কি তুমি ক্ষমা করতে পারবেনা প্রান্তিক? কেন বলত। বা আমি যা করেছি তাতে তোমার অজানা নয়, এবার তুমিই বল সেটা অন্যায় নয়? কিসের অন্যায়? আর তাছাড়া তুমিতো অন্যায় জেনে কিছু করনি? কিন্তু আমি যে মিথ্যে কথা বলেছি। জেনে তো মিথ্যে কথা বলনি আর না জেনে যদি কিছু করে থাক, তাতে অন্যায়টা কোথায়? প্রান্তিক তুমি মানুষ না দেবতা? এভাবে কথা বলছ কেন? দেখ আমি এক অতি তুচ্ছ মানুষ মাত্র। আমার রাগ আছে, অভিমান আছে আছে হিংসা দ্বেষ বিদ্বেষ ঈর্ষা। আছে চাওয়া পাওয়া রক্ত মাংসের কামনা বাসনা সবই, শুধু পার্থক্য কি জান? কি? বলে তাকালো আমার দিকে আমি বললাম, আমার কথা আমি প্রকাশ করতে পারি না। কেন পারনা? কেন তুমি তোমার দাবিকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে পারনা? কেন পারনা বলতে তোমার একান্ত প্রিয়জনকে যে আমি তোমায় ভালবাসি। তোমাকে আমি চাই। তোমার জন্যই আমার বেঁচে থাকা, তোমার জন্যই আমার স্বপ্ন দেখা। বললাম, দেখ কণা, যত সহজে তুমি একথা বলতে পারছ, আমি তা পারিনা। কেন পার না? কেন এত ভীরু তুমি? সে তুমি বুঝবেনা কণা। তারপর বললাম আচ্ছা আজ যদি আমি তোমায় বলি, কলা চল আমরা হারিয়ে যাই, পারবে হারিয়ে যেতে? ও আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে বলল, না আজ আর তা পারবো না। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে বলল, কিন্তু একদিন এই আমিই তোমার সাথে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম যেখানে খুশী। সেদিন যদি তুমি বলতে, চল নরকে যাই, আমার হাসিমুখে তোমার সাথে নরকে যেতেও কোন আপত্তি হতো না। ওর কথা মনোযোগ সহকারে শুনে বললাম, তবে আজ অসুবিধা কোথায়? অসুবিধা যে কোথায় সেকি তুমি জানো? না আমাকে তুমি পরীক্ষা করতে চাইছো? পরীক্ষা? আমি কি তত বড় মানুষ যে তোমাকে পরীক্ষা করার অধিকার আমার আছে? যাক ও সব কথা। একটা কথা জিজ্ঞাস করব? সত্যি কথা বলবে? মৃদু হেসে বললাম, নিশ্চয়ই বলব, বল কি জানতে চাও। কে তোমার মন জুড়ে। বসে আছে রেহানা না সেলিনা? আমি রেগে গিয়ে বললাম, কণা? ও বলল, রাগ করছ কেন প্রান্তিক। আমি জানি, আমিতো মেয়ে, একজন মেয়ে হিসাবে পুরুষের চোখের ভাষা যেটুকু বুঝি, তাতে রেহানা আছে তোমার সমস্ত অন্তর জুড়ে, আর, আর কি? আর সেলিনা আছে তোমার স্বপ্ন হয়ে–এক পলকে যে আমার মত মেয়েকে জয় করে নিতে পারে, তোমার পৌষ তাকে অস্বীকার করবে কি করে প্রান্তিক? জানি, তোমার জীবন আজ এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তুমি যেন পথ খুঁজে পাও, তুমি যেন জয়ী হও।

    কি যে হল আমার কে জানে? সেলিনাকে তো কখনো এ ভাবে ভাবিনি আমি। অনেক দুর্বল মুহূর্ত যে আসেনি জীবনে তা নয়। তবু এমন করে কেউতো আমাকে এই পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় নি, যেমন করে দিয়েছে অশ্রুকণা। তবু মনেব দ্বিধাকে অস্বীকার করার জন্য বললাম, জানিনা কণা, কে আমাকে বেশী টানে, তুমি না রেহানা? সেলিনা না নীলাঞ্জনা, জানিনা আমি কিছু জানিনা। আমি এক দিকভ্রান্ত পথিক। কোথায় যে যাব তাইতো জানিনা, আমি যে কেমন করে কখন আমার ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি তাইতো জানি না। আর এও জানিনা কে আমাকে পৌঁছে দেবে সেই হারানো ঠিকানায়। অবাক আর বিস্ময় ভরা দুটি চোখ তুলে তাকালো অশ্রুকণা আমার দৃষ্টি কে অনুসরণ করে। পারলাম না। ওর মত অপলক তাকিয়ে থাকতে। তখন আমার হাতখানা নিশিন্ত আশ্রয় নিয়ে আছে তার হাতের মধ্যে। ঠিক সেই সময় খাবার, আর কফির পেয়ালা নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো সেলিনা আর তার পিছনে ওর মা। হাতখানা ছিনিয়ে নিলাম ওর হাত থেকে। সেলিনার দিকে তাকিয়ে বললাম রাত হয়েছে অনেক, এবার যেতে হবে সেলিনা। হাসি হাসি মুখে সেলিনা বলল, কফিটা না খেয়েই যাবেন প্রান্তিক ভাই। চোখ তুলে তাকালাম ওর দিকে, সোজাসুজি রাখলাম আমার দুটি চোখ ওর চোখের পরে। কি অপূর্ব আর সুন্দর লাগছে সেলিনাকে।

    সেলিনা নারী। পুরুষের চোখের ভাষা তার অজানা নয়। এতো মেয়েদের সহজাত ধর্ম। চোখ দুটি সেলিনা নামিয়ে নিল। নিজেকে সহজ আর স্বাভাবিক করতে রাখল কফির পেয়ালা আর খাবারের প্লেট সামনের টেবিলে। তারপর দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার আগে বলল, আপনি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন প্রান্তিক ভাই, আমার দেরী হবে না। কারো কোন কিছু বলার সময় না দিয়ে নিজেকে অদৃশ্য করে নিয়ে গেল পর্দার আড়ালে।

    স্নেহময়ী দেবী বললেন, হ্যাঁ বাবা তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। অনেক রাত হয়েছে। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন আবার কবে আসবে? বললাম আসব মাসিমা, চিন্তা করবেন না। খাওয়া শেষে উঠে পড়লাম। স্নেহময়ী দেবী বললেন, তুমি আমার অশ্রুকে নতুন জন্ম দিয়েছে বাবা। তোমার কথা ভুলতে পারবো না কোনদিন। ওব বাবা নেই এখানে, তুমি না থাকলে কি যে হতো। বললাম, এ আপনার ভুল ধারণা মাসিমা। কারো জন্য কোন কাজ পড়ে থাকে না এ বিশ্বাস আমার আছে। তারপর স্বাভাবিকের থেকে একটু জোরে সেলিনাকে ডেকে বললাম, সেলিনা তাড়াতাড়ি এসো।

    অশ্রুকণা আমার সঙ্গে আর কোন কথা না বলে সেলিনাকে বলল, রেহানাকে বলল আমি ভালো আছি। কিন্তু আবার কবে আসবে তুমি? নিজের স্বাভাবিকতায় ফিরে যেতে যেতে সেলিনা বলল, যত তাড়াতাড়ি তুমি আমাদের বাড়ীতে যাবে। তারপর আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, চলুন না, প্রান্তিক ভাই। এর পরতো দেখছি বাস ট্রাম কিছুই পাওয়া যাবে না।

    রেহানাদের বাড়ীর রাস্তায় ঢুকতে ঢুকতে দেখি, জানালা খুলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেহানা। সেলিনা বেল দিতেই রেহানা দরজা খুলে দিলো। আমি বললাম অনেক বাত হয়ে গেছে আর ভিতরে যাব না। ও বলল আচ্ছা। সেলিনাও ভিতরে যাওযার জন্য কোন অনুরোধ জানায় না। ফিরেই এলাম, পিছনে তাকিয়ে দেখি জানালায় তখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেহানা। ওর মনে কি কোন ঝড় উঠেছে। কে জানে। ওঠাটা যে অস্বাভাবিক নয়, এতদিনে তা বুঝতে পারছি।

    সেদিন তপতীকে কথা দিয়েছিলাম, আসব একদিন। নিশ্চয়ই শুনবো তোমার কথা। ও বলেছিল সেদিন একা আসবে তো। বলেছিলাম তাই হবে। সত্যি সত্যি একদিন তাই রেহানাদের কেসের সংবাদ নিতে এসে ভট্টাচাৰ্য্য সাহেবের বাড়ী থেকে ওকে ফোন করে জানালাম, ফ্রি আছো তো? আধ ঘন্টার মধ্যে আসছি আমি। উত্তরে বলেছিল, গেটের বাইবে ঝাউবনের পাশে অপেক্ষা করব।

    এসে দেখি সত্যি সত্যি অপেক্ষা করছে ও। এতদিন হাসপাতালে ওকে সেবিকার পোষাকেই দেখেছি। মনের মধ্যে সেই ছবিটি গেঁথে আছে। তাই নীল শাড়ী আর লাল ব্লাউজে একটু বুঝি চিনতে অসুবিধা হয়েছিল। কিন্তু তা কোন অস্বস্তিতে ফেলতে পারে নি, কারণ, ওই-ই দুর থেকে বলল, ১০ মিনিট লেট প্রান্তিক। বললাম হবে বা। ও বলল চল আমরা হাঁটতে হাঁটতে ভিক্টোরিয়া যাই। মনে মনে ভাবলাম হয়তো যা ও বলতে চায় তা হাঁটতে হাঁটতেই বলাটা সহজ হবে। আমার তাতে আপত্তি নেই। এক অজ গ্রাম থেকে শহরে এসে এ কয় বছরেতো কম অভিজ্ঞতা হয়নি। কার মনে যে কোথায় কোন ছবি লুকিয়ে আছে কে জানে। স্যোৎসাহে বললাম, খুব সুন্দর প্রস্তাব, সহজ মনে তোমার কথা শোনা যাবে।

    ভিতরে ঢুকে দেখি কোন জায়গাই প্রায় ফাঁকা নেই। খানিকটা হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গা ফাঁকা পাওয়া গেল। আমরা বসলাম। তপতী জিজ্ঞাসা করল তুমি কি এর আগে কখনো এসেছে এখানে? না। তাহলে এত কথা জানলে কি করে? আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম তার আগে তুমি বলত এত জায়গা থাকতে তুমি এখানে এলে কেন? তাহলে কোথায় যেতাম। তারপর বলল তুমিতো জান, আমি হোস্টেলে থাকি, সেখানে তোমাকে নিয়ে যাই কি করে? আমি বললাম যাকগে সে কথা, তুমি আমাকে কি জন্যে আসতে বলেছিলে? তুমি কি রাগ করেছ তোমাকে আসতে বলার জন্য, না সেলিনার সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছো? আমি বললাম, তপতী তোমার একটা কথা জানা ভীষণ দরকার যে তুমি সেলিনাকে জড়িয়ে যে সব ইঙ্গিত করছে এসব ভুল। ভুল? সেলিনাকে তুমি ভালবাস না? সেলিনা তোমাকে ভালবাসেনা? হ্যাঁ বাসে। তা হলে? তাহলে কি? এরপরও বলছ আমার ভুল?হা ভুল তপতী, ভীষণ ভুল। আমি ভাবছিলাম, তোমার এ ভুল ভাঙিয়ে দেওয়া দরকার। ও বলল, আমি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের মনের ভাষা বুঝিনা এইকি তুমি বলতে চাও? আমি কিছুই বলতে চাইনে, শুধু বলতে চাই এ তোমার ভুল। তপতী বলল, আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না প্রান্তিক তুমি কি বলতে চাইছো? আর এই যদি তোমার মনের কথা হয় তাহলে বলব, সেলিনা বড় দুঃখিনী। আমি একটু হাসলাম বললাম, সেলিনাকে তুমি আজো চিনতে পারনি। তপতী প্রতিবাদ করে বলল, আমি বলব প্রান্তিক তুমি সেলিনাকে বুঝতে পারনি। হাসপাতালে ওকে আমি কাছ থেকে দেখেছি, ওর মনকে বুঝেছি। তুমি একদিন না এলে ওব অভিমান যে কত তীব্র হতে পারে, আমিতো তার সাক্ষী। তবু তুমি বলবে ওকে আমি বুঝতে পারিনি? না পারনি তপতী, থাক সে কথা, আর কেন বুঝতে পারনি তা তোমাকে আরেকদিন বুঝিয়ে বলব। এবার তোমার কথা বল। আমার কথা! তারপর বলল আমার কথা কি তোমার শুনতে ভাল লাগবে? কেন লাগবেনা। তোমার যদি কিছু বলার থাকে তা আমর শুনতে খারাপ লাগবে কেন? ও বলল, তোমার সৌমেন্দ্রর কথা মনে আছে? আমি একটু চিন্তা করে বললাম, কোন সৌমেন্দ্র। ও বলল আমাদের বাড়ীর কারো কথা কি মনে আছে তোমার? কেন থাকবেনা। তোমার বাবা মা তারপর তোমার এক ভাই প্রতুল। ও এখন কি করছে? এবার স্কুল ফাঁইনাল পরীক্ষা দেবে? আমাদের বাড়ীর আর কারো কথা তোমার মনে পড়ে না? তোমাদের বিরাট পরিবার। মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, আগে ছিল এখন আর নেই। যাই হোক সবাইকে মনে রাখাতো আমার পক্ষে সম্ভব নয় তপতী। হ্যাঁ, এবার বল সৌমেন্দ্রর কথা। তার মানে সৌমেন্দ্রকে তুমি মনে করতে পারছনা। তারপরে বলল, আমাদের বাড়ীতে এক ভদ্রমহিলা ছিলেন আমরা সবাই তাকে পিসিমা বলে ডাকতাম, মনে আছে? আমি মনে করতে পেরে বললাম হ্যাঁ মনে পড়ছে। কি একটা ব্যাপারে যেন তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। হ্যাঁ ওনারই ছেলে সৌমেন্দ্র। আমাদের থেকে এক ক্লাশ উপরে পড়তো। তা হয়তো হবে, তখন তো অনেক ছোট ছিলাম। ও এখন ফাঁইনাল ইয়ার ডাক্তারী পড়ে। আমি আনন্দ প্রকাশ করে বললাম খুব ভাল কথা। তোমাকে ডেকেছি, সেই কারনে। একটা উপকার করে দেবে প্রান্তিক? আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম কি ব্যাপার বলত। তপতী বলল, কাল চিঠি এসেছে ওর মা অসুস্থ, কিন্তু ওর পরীক্ষা চলছে, এখন বাড়ীতে গেলে এ বছরটা নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে? আমি বোঝাব? আমার কথা উনি শুনবেন কেন? তপতী বলল আমার বিশ্বাস, ও শুনবে তোমার কথা। তুমি আমাকে ফোন না করলে আমিই যেতাম নীলাঞ্জনা পিসির বাড়ীতে, এবং আজই। বললাম, সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুমি যখন আমায় আসতে বলেছিলে, তখনতো এই ঘটনা ছিল না, তা হলে কেন আসতে বলেছিলে? ওর জন্যই আসতে বলেছিলাম। ওর জন্য? আমি অবাক হয়ে বললাম হাসপাতালে অনেক বার তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে একবারও তো ওর কথা বলনি? না বলিনি। কারণ বুঝতে পারিনি, তার সঙ্গে কথা বলেও তাকে তুমি চিনতে পারবে না। অদ্ভুত! হ্যাঁ অদ্ভুত। তারপর বললো একদিন কৈশোরের চপলতা বশত তোমাকে একটা চিঠি লিখে শুধু মাস্টার মশাইয়ের কাছে নয় বাড়ীতেও পর্যন্ত মার খেয়েছিলাম। মনে আছে? হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু তুমি ওই রকম একটা চিঠি লিখতে গিয়েছিলে কেন? কেন লিখতে গিয়েছিলাম সে উত্তর তো দিতে পারবো না প্রান্তিক, কিন্তু লিখেছিলাম। ওতে কি লিখেছিলাম তোমার কি মনে আছে? আমি খানিকক্ষন চিন্তা করে বললাম, কিছু কিছু মনে পড়ছে। তুমি যা লিখেছিলে, তার কয়েকটা লাইন এই রকমই ছিল, তুমি আকাশ, আমি চাঁদ, কখনো তোমার ভালবাসায় বিকশিত হই শুক্লপক্ষের পূর্ণ চন্দ্রে। আরো বোধহয় লিখেছিলে, তোমার নিষ্ঠুরতায় পাষাণকেও হার মানাতে হয়, তবু আমি নিজেকে সঁপে দিতে চাই সেই পাষণের বেদীতলে। হেসে উঠলাম আমি। কি ছেলেমানুষী ছিল সেদিন তোমার। তপতীর কণ্ঠ বুঝি আবেগে বুজে আসতে চাইলো। হ্যাঁ ছেলেমানুষি। কিন্তু তোমার উত্তরটা সেটা মনে আছে তোমাব? আমি বললাম, আজ আর সেই অতীতকে নিয়ে এত ঘাটাঘাটি করছ কেন? তাপর বললাম, হয়তো তোমাকে অনেক আঘাত দিয়ে যা লিখেছিলাম, তা আমার লেখা উচিত হয় নি, কিন্তু আমার ঐ চিঠির জন্য যে তোমাকে এত মার খেতে হবে, তা কিন্তু ভাবিনি। আসলে তোমার চিঠিটাকে মনে করেছিলাম একটা খেলা, তাই খেলাচ্ছলে আমিও খেলা করেছিলাম। হ্যাঁ, সত্যি খেলা করেছিলে। তাইতো লিখতে পেরেছিলে, কিসের এত দম্ভ তোমার আমার আকাশে চাঁদ হয়ে ফুটতে চাও, চাও আমার ভালোবাসার অধিকার দাবী করতে? ভিখিরিকে করুণা করা যায় ভালবাসা যায়না। আজো আমি কেঁপে উঠি তোমার সেই হুল ফোঁটানো লেখা গুলো মনে পড়লে। আজো অনেক রাতে ঝরে আমার চোখের জল। দুঃখের ভারি বোঝায় একাকী ভাবি, একবার কি আসতে পারতেনা, শুধু একবার। পারতেনা বলতে, তপতী চিঠিতে যা লিখেছি সেটা আমার মনের কথা নয়। কিন্তু আসনি। কেন আসনি জানিনা, কিন্তু আমার মনের পর্দায় যে ছবি এঁকে গেলে তাকে তো মুছে ফেলতে পারলামনা আজো। সেদিনের সে সব কথা অনেক বার ভেবেছি হাসপাতালের সেই মুহূর্তগুলোতে, একবার মনেও হয়েছিল তোমাকে জিজ্ঞাস করবো, সত্যি কি আমাকে আঘাত দেওয়ার জন্য ঐ হুল ফুটিয়েছিলে না নিজেকে গোপন করতে চেয়েছিলে কঠিন পাষাণে।

    দেখলাম ওর চোখদুটি ছল ছল করে উঠছে। আমি তার একটা হাত আমার হাতের মধ্য নিয়ে বললাম, তপতী অতীত অতীতই, কেন হৃদয় খুঁড়ে সেই বেদনা জাগাতে চাইছো। আজ তোমার আমার পথ এক নয়। এ কথাতো মানবে আমাদের দুটি পথ দুটি দিকে গেছে চলে। তবে আর পিছন ফিরে তাকানো কেন? তপতী বলল, তাকাতাম না প্রান্তিক, সৌমেন্দ্রর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে চেয়েছি। ওর মাকে যদিও পিসি বলেই জানতাম, বড় হয়ে জানতে পেরেছি উনি ছিলেন আমাদের বাড়ীর কাজের মেয়ে। দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে তিনি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন। যেদিন জানতে পারলাম অকারণে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে, সেদিন থেকে তোমার প্রত্যাঘাতকে ভালবাসায় রূপান্তর করে ভরে দিতে চাইলাম তাকে। আর তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে সেদিন দেখলাম তোমাকে, অনেক অনেক বছর পরে। দেখলাম সেলিনার প্রতি তোমার গভীর ভালবাসা, ঈর্ষার আগুনে জ্বলতে লাগলাম আমি। মুহূর্তে ভুলে গেলাম সৌমেন্দ্রকে দেওয়া আমার আশ্বাস আমার প্রতিশ্রুতি। তোমাকে বলতে লজ্জা নেই প্রান্তিক, কয়েকটা দিন পাগলের মত শুধু তোমার কথাই ভেবেছি। কিন্তু তার মধ্যেই দেখলাম, তোমার প্রতি সেলিনার আকর্ষণ। তার গভীর ভালবাসা। তার জেদ, তার অভিমান, আর অন্যদিকে, তোমার স্নেহের পরশে ও যেন এক নতুন মানুষ। ধীরে ধীরে ভালবেসে ফেললাম ওকে। যা আমি পাইনি তাই পাওয়ার সাধ জাগলো ওর মাধ্যমে। নিজেকে গুটিয়ে নিলাম, যে হিংসার অনলে একদিন তোমার ধ্বংস কামনা করেছিলাম, সেলিনা সেখানে নিয়ে এল এক নতুন জীবন। তারপর বলল, শুনেছি তোমার সমস্ত জীবন ব্যাপী আছে রেহানা, সেলিনার সেখানে কোন অধিকার নেই, জানিনা এটাও সেলিনার অভিমান কি না। তোমাকে বলতে চেয়ে ছিলাম নিজের কথা, জানাতে চেয়েছিলাম, সেই তপতীর মৃত্যু হয়েছে প্রান্তিক। যাকে তুমি আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করেছিলে।

    তারপর কিছুক্ষণের জন্যে থামল তপতী। তাকালে আমার দিকে। বলল আমার বদলির আদেশ হয়েছে, সৌমেন্দ্রর পরীক্ষা শেষ হলে নতুন জায়গায় চলে যাবো। ওর মাকে নিয়ে আসব কাছে এই স্বপ্ন যখন দেখে চলেছি, তখনি এলো এই দুঃসংবাদ। জানিনা আজো তুমি আঘাত দেবে কি না, সেদিন যাকে ভিখারিনি বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলে তোমার অহংকারে ঘা লেগেছিল বলে আজ কিন্তু সে সত্যিই ভিখিরিনির মত তোমার কাছে এসেছে, ফিরিয়ে দেবেনা তো? ওর চোখে জল।

    তপতী তার নিজের কথা বলতে গিয়ে বার বার অতীতকে কেন মনে করিয়ে দিচ্ছে জানিনা। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিনের সেই ঘটনাগুলোকে কৈশোরের চপলতা ছাড়া আমার অন্য কিছু মনে হয়নি। তা যে এতদিন কোন মেয়ে তার মনের নিভৃত কোনে এতগুলো বছর অভিমানে বাঁচিয়ে রাখতে পারে আমার ধারণারও অতীত। মাঝে মাঝে মনে হয় কতটুকু জানি আমরা মানুষকে। এই হাসপাতালে ওকে না দেখলে হয়তো মনেই পড়তোনা তপতী নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আমার একটি অতীত স্মৃতি আছে, আর সৌমেন্দ্র, ও আমাদের থেকে সিনিয়র ছিল। ওর বাবা মারা গেছেন ও যখন একেবারে হোট। ভাল করে মনে নেই। তপতীর ভালবাসা তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। মনে হয়, তাকে ডাক্তার করার পিছনেও আছে তপতীর পরিশ্রম আর স্বপ্ন। মুহূর্তে ভাল লেগে গেল তপতীকে। ভীষণ ভালো। জীবনতো এই রকমই, তার বাঁকে বাঁকে কত যে মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে কে তার খোঁজ রাখে? মনে মনে ভাবি কি ভুলই না আমরা করি। একটা ছোট্ট ঘটনা, কৈশোরের চপলতা, হয়তো বা মনের নিভৃতে ভালবাসার রঙে রঙ্গীন হয়ে পাখা মেলতে চেয়েছিল। ঐ চিঠিটা, সে প্রান্তিক কে না লিখে যে কোন কিশোরকেই লিখতে পারতো। যদি আমি কোন উত্তর না দিতাম, তা হলে হয়তো হারিয়ে যেতো তার চপলতা। কিন্তু আমার ঘৃণা আর আঘাত, ওর মনের চপলতাকে দিল এক দৃঢ় প্রত্যয়। মার খেয়েও কোন প্রতিবাদ করে সে খুঁজে নিতে চাইল তার ভালবাসার একনিষ্ঠতা অন্যত্র, অন্যখানে। সবই ঠিক।

    আমার অতীত জীবনকে ছিন্ন ভিন্ন করে তপতী বলল, কি ভাবছ প্রান্তিক। কিছু না। তাকালাম দূর আকাশ পানে, কখন যেন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে এসেছে। আকাশে মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলক আর ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে বললাম, দেখেছো এখনি মনে হচ্ছে প্রবল বর্ষা নামবে। ভিক্টোরিয়ার রক্ষীরা গাছের গুঁড়িতে এখনো কেউ বসে আছে কীনা তাই খুঁজতে বেরিয়েছেন। বলতে এসেছেন, তারা যেন আর দেরি না করে চলে যান, ঝড় ও জল এক সঙ্গে নামতে পারে। বললাম চল তপতী, আর দেরি করা ঠিক হবে না। কি এক গভীর আকুলতা নিয়ে ও তখনো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি যেন দেখেও দেখতে চাইলামনা এই আকুল ব্যগ্রতা।

    দুই একটা জলের ফোঁটা গায়ে এসে লাগে। মুহূর্তে সারা আকাশ কালো হয়ে চারিদিক গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেল। ঝড় উঠলো, প্রথমে ধুলিঝড়, তারপর প্রবল বৃষ্টি। গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পেলাম, রাস্তার উপর দিয়ে জল বয়ে চলেছে, সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। ভিজে একাকার হয়ে গেছি আমরা। কোন দিকে যাব বুঝতে পর্যন্ত পারছি না।

    সর্বাঙ্গ ভেজা তপতীকে আমি কি ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব? কিভাবে পৌঁছিয়ে দেব তাকে তার বাসায়। রাস্তায় কোথাও হাটু জল কোথাও বা তার থেকেও বেশী। বৃষ্টির অন্ধকারেও যেটুকু আবছা আলো আছে তাতেই তাকাতে পারছি না ওর দিকে। হঠাৎ চলতে চলতে পা পিছলে পড়ে গেল তপতী। ওকে কোন ভাবে তুলে নিলাম দুহাতে। বললাম মনে হচ্ছে আর হাটা যাবে না। এবার কোথাও দাঁড়ানো যাক। ও বলল তা হয় না প্রান্তিক বেশী রাত হলে হোস্টেলে ফেরাই কষ্ট হবে। তার চেয়ে আমার হাতটা ধর তারপর এগিয়ে চল। যে কোন ভাবেই হোক রাত ৮টার আগে হোস্টেলে আমাকে ফিরতেই হবে। আমি আর দ্বিরুক্তি না করে ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আগে আগে পথ চলছি। ও কি ভাবছে জানিনা। আমি কিন্তু মনে মনে ভাবছি, ও একটু আগে ভিখারিনির মত কিছু চেয়েছিল, কি দিতে পারতাম জানিনা, কিন্তু দুর্বার প্রকৃতি বুঝি, সব চাহিদা মিটিয়ে দিয়েছে ওর। জানি এই মুহূর্তটুকু ও ভুলতে পারবেনা কোনদিন। তাই জীবনে যা দিতে পারিনি, স্মৃতি হয়ে তাই অন্তত বেঁচে থাকুক, ওর মনের মণিকোঠায়।

    সাড়ে সাতটা নাগাদ অনেক দুর্যোগ আর জল পেরিয়ে ওর হোস্টেলের কাছে সম্পূর্ণ স্নান করে এসে দাঁড়ালাম। ও তাকাল আমার দিকে। বললাম, একেবারে স্নান করে উঠেছে তপতী। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। ও বলল, তুমি কিভাবে যাবে? আমার জন্য ভেবোনা। ঠিক পৌঁছে যাব। আবার কি দেখা হবে? কেন হবে না? অবশ্যই হবে। এই পৃথিবী যতবড়ই হোকনা কেন তাকে ছোট করে নিতে কোন অসুবিধা হবে না। তোমাকে খুব কষ্ট দিলাম তাইনা? বললাম কোন কোন কষ্ট আনন্দের দ্যোতনা হয়ে বেঁচে থাকে জীবনে। আজকের কষ্টটাও না হয় সেই ভাবে বেঁচে থাক। কি জানি, বলল তপতী। আমি বললাম, কি যেন চেয়েছিলে আমার কাছে, বললে না তো। ও বলল, পেয়ে গেছি প্রান্তিক। যে ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছিলাম এই দুর্যোগের দুরন্তপণা তা যেন নতুন করে ফিরিয়ে দিয়ে গেল আমাকে। তারপরে বলল সাবধানে যেও। আচ্ছা। আর একটা কথা। বল। যাওয়ার আগে একবার রেহানাকে দেখার ভীষণ ইচ্ছে, দেখাবে? ওকে কি তোমার প্রয়োজন? প্রয়োজন? হ্যাঁ, ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন। আচ্ছা মনে রাখব তোমার কথা। আর সৌমেন্দ্রকে বল, পরীক্ষা যেন ড্রপ না করে। ওকে চিনতে না পারার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। তাকে বলো যতটা অমানবিক আমাকে তিনি মনে করেছেন। আমি কিন্তু তা নই। বেশ বলব। তুমি কিন্তু আর দেরি করো প্রান্তিক। তারপর বলল সারাটা রাস্তা তোমাকে হয়তো হেঁটেই যেতে হবে।

    বাড়ীতে গিয়ে দেখি পিসি ফেরেনি তখনো। রাত হয়েছে অনেক। সারা রাস্তায় কোন বাসট্রাম নেই। সারা কলকাতা যেন এক সীমাহীন সমুদ্র। শুধু জল আর জল। কোথায় খুঁজবো তাকে। অগত্যা দীনেন্দ্রস্ট্রীটে গিয়ে ওর অফিসে ফোন করলাম। এক চান্সে ফোনটা পেয়েও গেলাম। নীলাঞ্জনার কথা জিজ্ঞেস করতেই একজন ডেকে দিলেন। হ্যালো। আমি প্রান্তিক বলছি। পিসি বললেন তুমি বাড়ীতে পৌঁছে গেছ? হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কিভাবে আসবে? আমার জন্য চিন্তা করোনা। অফিসে প্রায় সবাই আটকা পড়ে গেছি। এরা একটা গাড়ীর ব্যবস্থা করছে, চলে আসব, ফোন ছেড়ে দিলেন।

    গভীর রাতে ফিরলেন পিসি। সমস্ত শরীর ভিজে একাকার। বললেন, এত জল যে গাড়ী আসতে পারছেনা, তাই হাঁটতে হল। আঁতকে উঠে বললাম ইস্ একেবারে স্নান করে ফেলেছে। আমি গীজারে জল গরম করে দিচ্ছি, স্নানটা করে নাও। না থাক। এত রাতে আর স্নান করবনা। বললাম সেটা ঠিক হবে না। স্নান না করলে শরীর আরো খারাপ লাগবে। যাই হোক আমার কথা শুনে পুরো স্নান না করলেও অর্ধেক চান করলেন তিনি। কিন্তু অতরাতে আর কিছু খেতে রাজী হলেন না। বললাম, এক গ্লাস গরম দুধ অন্তত মুড়ি দিয়ে খেয়ে নাও। তিনি আর কথা বাড়ালেন না।

    পরের দিন সকালে, অনেক রাস্তা থেকে জল সরে গেছে, তবে অনেক নীচু রাস্তা এখনো জলের নীচে। একবার রেহানাদের ওখানে যাওয়া দরকার। কাল যা জল হয়েছে, তাতে তাদের একতলা বাড়ীতে কোমর জল হওয়ার কথা। কলেজে যাওয়ার আগে ওদের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখনো ঘরের মেঝে থেকে জল সরেনি। বেল দিতেই দরজা খুলে দিল সেলিনা। বলল, কাল জলের সময় কোথায় ছিলেন প্রান্তিক ভাই? কোথায় আর থাকব। একবার উকিলের কাছে গিয়েছিলাম। ও! বলে থেমে গেল সেলিনা। বলল চা খাবেন? না, তা কাল কি তোমরা এখানেই ছিলে? কোথায় আর যাব বলুন। দেখতে পারছি বিছানাপত্র সব ভেজা। অন্য কোথাও চলে যেতে পারতেন? কোথায় আর যাব। সর্বত্রই তো জল, সবারই তো একই অবস্থা। আপনি বরং বসুন, আমি চা নিয়ে আসছি। ভিজে কাপড়ে রেহানা এসে দাঁড়ালো। বললাম, ভিজে কাপড়ে আছ, ঠান্ডা লাগবে যে। কি আর করব। কাল রাতে সব ভিজে গেছে। জল আলমারিতে পর্যন্ত ঢুকে সব ভিজিয়ে দিয়েছে। একটু সরিয়ে নিতে পারলেনা? হয়তো পারতাম, কিন্তু যখন সরাতে গেছি তার অগেই সব কিছু ভিজে একাকার। তারপর বলল, তুমি কাল ভেজোনি তো। যা সামান্য ভিজেছি তাতে অসুবিধা হয়নি। ও বলল একবার মনে হয়েছিল তুমি আসতে পার, কিন্তু না আসতে ভাবলাম হয়তো কোথাও আটকে পড়েছে। কি হয়েছিল। কাল পিসি প্রায় রাত ২টোয় ফিরেছে। আঁতকে উঠে বলল কেন? প্রায় ১২টা পর্যন্ত অফিসে আটকে ছিল, তারপর যদিওবা অফিস থেকে গাড়ীর এ্যবেঞ্জমেন্ট করেছিলো কিন্তু এতজলে গাড়ী কোথা দিয়েও আসতেই পারলনা। অগত্যা হাঁটা, এবং তারপর সাঁতরিয়ে এবং স্নান করে যখন বাড়ীতে পৌঁছালেন, তখন ২টো বাজে। কালকের ধকলে শরীরটা সকাল থেকেই খারাপ। রেহানাকে খুব চিন্তাম্বিত মনে হল।

    সেলিনা চা নিয়ে এল। ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম মাসিমা কোথায়? রান্নাঘরে। ও চাটা দিয়ে চলে গেল। রেহানা বলল, তোমার শরীরটা যে একদম ভাল লাগছে না, কি হয়েছে? কৈ কিছু নাতো। কিছুনা কি? তুমি লুকোচ্ছ। দেখতে পাচ্ছি চোখ দুটো তোমার লাল সারা মুখে চিন্তার ছাপ, আবার জ্বর আসবেনা তো? বলেই আমার কপালে হাত রেখে পরীক্ষা করে রেহানা। তার পরে বলে তুমি কিগো? গায়ে তো জ্বর। কেন মিথ্যে কথা বল? তারপর আমার হাত ধরে বলল, ওঠো এবার? কোথায়? সেলিনার ঘরের বিছানা জলে ভেজেনি। চল শুয়ে পড়বে। আমি বললাম, এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন রেহানা। আমি ঠিক আছি, তোমায় এত ব্যস্ত হতে হবে না। ও আস্তে আস্তে বলল, কেন এত কষ্ট দাও বলত? তোমার শরীর খারাপ, আমার ভাল লাগবে? ওঠ লক্ষ্মীটি। চল ও ঘরে। লজ্জা ভীষণ লজ্জা আমাকে আড়ষ্ট করে দেয়। বললাম, চিন্তা করোনা রেহানা। আমার কিছু হবে না দেখো, জানি তোমার কিছু হবে না আর কিছু হলে যে তোমার মহত্ত্ব ব্যর্থ হয়ে যাবে। তুমি অনেক বড় প্রান্তিক, তাই হয়তো আমার মত সাধারণ মেয়ের উদ্বিগ্নতা তোমাকে ভাবায় না। তারপর বলে বেশ, তোমাকে ও ঘরে যেতে হবে না, কিন্তু কলেজেও তুমি যেতে পারবেনা। কেন? কেন আবার কি? তুমি কি বাড়াবাড়ি রকমের একটা কিছু বাধাতে চাও না কি?

    এ এক নতুন রেহানা। এমন করেতো কোনদিন ও আমার সাথে কথা বলেনি। চিরদিনই নিজেকে নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছে, মেপে মেপে কথা বলেছে দুশ্চিন্তা বা উদ্বিগ্নতা যদি কিছু থাকেও তাকে কখনো বাইরে প্রকাশ হতে দেয়নি, বুঝতেও দেয়নি তার ভাবনা চিন্তা গুলোকে।

    আর আজ? আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে। সেলিনা চায়ের কাপ নিতে এসে দেখে, রেহানা ঠিক আমার মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার আঙুল বিলি কেটে চলেছে আমার মাথার চুলে। ওর বোধ হয় খেয়ালই নেই, বাড়ীতে আর কেউ আছে কি না। ওর বুকের সিক্ত কবোষ্ণতা আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। এমন করে ওতো কাছে আসেনি কোনদিন। মন হয়তো কখনো বা চেয়েছিল, ওর আবেগ ছুঁয়ে যাক আমার হৃদয়কে। এই যে উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা, এরতো একটা মূল্য আছে। তাকে উপেক্ষা করি কি ভাবে?

    সেলিনাও বুঝি কম অবাক হয়না। এমন করে ও যে আমার কাছে আসতে পারে সে বুঝি সেলিনারও স্বপ্নের অতীত। কিন্তু ও এমন এক জাতের মেযে, সব কিছুকে নিতে পারে অতি সহজ ভাবে। অন্য কেউ হলে হয়তো একটি হাঁচি দিয়ে তার উপস্থিতি জানাতে, অথবা নীরবে সরে যেতো। কিন্তু সেলিনা অন্য ধাতুতে গড়া। রেহানাকে এ অবস্থায় দেখে সেলিনা বলল, যে ভাবে ভিজে কাপড়ে দুই প্রান্তিক ভাইয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিস তাতে তোর সংক্রামক ব্যধি ওকে না সংক্রামিত করে। যা, শাড়ীটা শুকিয়ে গেছে। সারারাত যে ভাবে ভিজে ছিস্ তাতে প্রান্তিক ভাইকে না আবার তোকে নার্সিং করতে হয়। ত্বরিতে সরে দাঁড়ায় রেহানা। মাথার চুলে বিলি কাটুনি বন্ধ করে হাতটাও সরিয়ে নেয় দ্রুত রেহানা। আমিও লজ্জা কম পেলাম না। মন বুঝি প্রস্তুত ছিল রেহানার ভালবাসার আঙুলের স্পর্শ পাওয়ার জন্য। সেলিনা বলল এতে এত লজ্জাবতী হয়ে গেলি কেনরে রেহানা। নিজের জিনিষের প্রতি মমতা কার না হয়। যেন লজ্জায় মরে যেতে যেতে অস্পষ্ট ভাবে বলতে বলতে গেল, শুধু বাঁদরামি। সেলিনা বলল, কি হয়েছে প্রান্তিক ভাই, শরীর খারাপ? না না ঠিক আছে। তা হলে অমন বিপরীত মুখী সেবা নিচ্ছিলেন কেন? এতো আপনাদেব ক্ষেত্রে একেবারে বেমানান? রেহানাকে বলল ওভাবে আঁতকে উঠলি কেন, যা স্নান করে শাড়ীটা বদলিয়ে আয়, ততক্ষণে দেখছি প্রান্তিক ভাইয়ের কি হয়েছে। রেহানা আস্তে আস্তে চলে গেলে সেলিনা আমার কপালে হাত দিয়ে আঁতকে উঠে বলল, একি প্রান্তিক ভাই এযে অনেক জ্বর। চলুন। কোথায়? এ বাড়ীতে তো আর কোন শুকনো বিছানা নেই, তাই বাধ্য হয়ে মন না চাইলেও আমার বিছানায় যেতে হবে। ভয় নেই। রেহানা স্নান করে এলেই, তাকে পাঠিয়ে দেবো। মুখ টিপে হাসতে লাগল সেলিনা। আমি বললাম, সেলিনা এই রকম ভয়ংকর ঠাট্টা করে কি আনন্দ পাও তুমি? অন্তত দুঃখ যে পাইনে এটাতো ঠিক। আর তা ছাড়া আপনি একে ঠাট্টা বলছেন কেন? আপনি জ্বরে ভুগবেন, আর ও দূরে দূরে থাকবে, এ হয় নাকি? কেন তুমিতো আছ? আমি? হাসল সেলিনা। হাসলে যে। না, প্রান্তিক ভাই হাসছিনা, শুধু জানিয়ে যাচ্ছি, কোন রকম উচ্ছলতা, চপলতা বা প্রগলভতা প্রকাশ না করেও ও যেখানে আপনার অন্তর ছুঁয়ে যাবে হাজার সেলিনার সাধ্য নেই সেখানে পৌঁছাবার। যদি এই ঠাট্টাটুকু আপনার ভাল না লাগে করব না প্রান্তিক ভাই। তাই বলে মনে করবেন না, ঠাট্টা করছি বলে আপনাদের আমি বুঝিনা। একটু চুপ করে থেকে বলল, চলুন এবার। একটু বিশ্রাম নিন প্রান্তিক ভাই তারপর ভাল না লাগলে চলে যাবেন। কথা দিচ্ছি রেহানা আপনাকে আটকাবেনা।

    উঠতেই হল। আসলে বুঝতে পারছি, ভিতরে ভিতরে কি যেন চাইছে মন। জ্বরটাও বেশ চাগিয়ে আসছে, বললাম চল। সুন্দর করে বিছানা করা হয়েছে। নতুন একটা চাদর পাতা হয়েছে সদ্য ভাঁজ খুলে। বালিসে দেওয়া হয়েছে নতুন ওয়াড়। আর কোনায় সুন্দর সেলাইয়ের কাজ। সেই কবে মাকে দেখেছি, নতুন কেউ এলে এমনি করে সাজিয়ে দিতেন বিছানা। দ্বিরুক্তি না করে শুয়ে পড়লাম। শরীর যে পারছেনা, তা অস্বীকার করি কি করে। আফরোজ বেগম আমার মাথায় জল পট্টি দিয়ে চলেছেন। কতক্ষণ জানিনা চোখ বুঝে দেখছি, যেন তপতী পাশে এসে বলছে, এ আমারই দোষ। তোমাকে যদি সেদিন ভিক্টোরিয়ায় নিয়ে না যেতাম, যদি এ ভাবে তুমি জলে না ভিজতে, কিছুতেই তুমি জুরে পড়তেনা। চল

    প্রান্তিক আমাদের হাসপাতালে। যে ওয়ার্ডে তুমি ভৰ্ত্তি হবে মেট্রনকে বলে সেই ওয়ার্ডেই আমি ডিউটি নেব। অন্তত ঐ কটাদিন আমার সেবার মাধ্যমে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। যাবে প্রান্তিক? বললাম না। কেন বার বার না করছ? আমার থেকে কি এরা তোমার বেশী সেবা করবে? বললাম তবুও না। আবারও সেই না। তুমি কি একটুও আমাকে বুঝতে চাইছনা? একবার তাকাও আমার দিকে। দেখ সেদিনের মত আজো জড়িয়েছি বেনীতে যুঁই ফুলের মালা। তোমার প্রিয় আকাশী রংএর শাড়ী পরেছি, কপালে লাগিয়েছি সবুজ টীপ একদিন বলেছিলে, এ পোষাকে তোমাকে ভীষণ মানায় তপতী। একবার পরীক্ষা করে দেখনা,রেহানার থেকে আমি তোমাকে বেশী ভালবাসি কী না। বলছি তো না-না-না। তুমি যাও এখন? কিসের এত অহংকার তোমার? আমাকে এই ভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছ? তারপর যেন অভিসম্পাত দিয়ে বলছে, যাকে তুমি চাইছ সে কোনদিন আসবেনা তোমার জীবনে। দুটো জীবন তোমাদের ব্যর্থ হয়ে যাবে প্রান্তিক। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিওনা। চল আমার সাথে। চিৎকার করে উঠলাম তুমি যাবে কি না।

    চোখ মেলে দেখি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলছে রেহানা। বলল, আমায় তুমি চলে যেতে বলছ? এত নিষ্ঠুর তুমি? আমি কি এতই অস্পৃশ্য তোমার কাছে। ও উঠে যেতে চাইলে, ওর শাড়ীর আঁচলটা ধরে টান দিতেই তা বুক থেকে খসে পড়ে গেল। আমি লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম অন্য দিকে। এতক্ষণ কি তবে স্বপ্ন দেখছিলাম। চকিতে শাড়ীর আচলটা বুকে তুলে নিয়ে ও পালিয়ে গেল।

    এ আমি কি করলাম। গায়ে অসহ্য যন্ত্রনা। মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। চোখ দুটো দপ দপ করছে। এত নিঃসঙ্গ লাগছে যে, সে এক অসহনীয় অবস্থা। আমার চিৎকারে ছুটে এলো সেলিনা। আমার বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কি হয়েছে প্রান্তিক ভাই, এমন করছেন কেন? বললাম, একটা ট্যাক্সি ডাকতে পারবে সেলিনা, আমি বাড়ী যাব। ও ওমনি তার করাঙ্গুলি স্পর্শে আমার বুকের যন্ত্রণা লাঘব করতে করতে বলল যাবেন, কিন্তু জ্বর নিয়ে তো আপনি যেতে পারবেন না। আমাকে যে যেতেই হবে। কেন? কার প্রতি এ অভিমান আনার? রেহানা এসে বলল, একটা ট্যাক্সি ডাক সেলিনা। আমরাতো ওর কেউ নই। কেন থাকবে এখানে? কারো শুশ্রূষা নিতে ওর বিবেকে বাঁধে। তাতে বুঝি ওর মহত্বে আঘাত লাগবে। সেলিনা রেহানার কথার কোন প্রতিবাদ না করে বলল, তুই এখানে একটু বোস আমি আসছি। কোথায় যাবি? যা যা বলছি তাই কর। বলিহারি তোর অহংকার? কেন ওকে বুঝতে চাইছিস না বলতো। এই অবস্থায় ওকে ফিরিয়ে দিলে একলা ঘরে কে তোকে সান্ত্বনা দেবে? তার থেকে বোসনা ওর কাছে। শুধু তোর ব্যথা দেখবি। ওরটা বুঝবিনা? ছিঃ রেহানা ছিঃ। কেন যে ভালবাসতে গিয়েছিলি? শুধু কাঁদতেই শিখেছিস। একটু হাসতে শেখ রেহানা।

    রেহানা বসল আমার পাশে। সেলিনা চলে গেলে ওর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিতে গেলে ও জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। আমি আবারও তা জোর করে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, কি চাও তুমি রেহানা? আমি কষ্ট পাই তাইতো? ও বলল চুপ করো প্রান্তিক। বেশী কথা বলোনা। আমি চুপ করে গেলাম। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে এক সময় বললাম আমার জন্য তোমার খুব কষ্ট হয় তাইনা? না হয় না। হয় না? কেন হবে? কে তুমি আমার নিজের মন থেকে বলছ তো আমি তোমার কে? তুমি চুপ করবে? হা করব। তবে আগে বল, আমার সাহচার্য কি তোমার কাছে অসহ্য? তুমি কি আঘাত দিয়ে ছাড়া কথা বলতে পার না প্রান্তিক? আমি আঘাত দিয়েছি না তুমি আমায় আঘাত দিয়েছ? বেশ আমিই তোমায় আঘাত দিয়েছি। এক দিনতো বলেছিলে, কোন আঘাতই নাকি তোমার বুকে বাজেনা। তা হলে? তাই বলে তোমার দেওয়া আঘাতও আমার বুকে বাজবেনা আমি কি এতই নিষ্ঠুর? তুমি তো পাষাণ। প্রাণহীন একখন্ড পাথর মাত্র। মমতা কি আছে তোমার?

    মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বললাম মাথাটা একটু টিপে দেবে? বড্ড যন্ত্রণা। ছল ছল চোখে বলল কোথায়? আমার সমস্ত শরীরে। কেন এমন হল প্রান্তিক, কেউ কি তোমায় কঠিন আঘাত দিয়েছে? তুমি ছাড়া কারো সাধ্য নেই আমাকে কঠিন আঘাতে ঘায়েল করতে পারে। ও বলল, হাত ছাড়, মাথা টিপে দিচ্ছি।

    নীরবে আমার মাথা টিপে দিতে লাগল রেহানা। এক সময় বলল, যন্ত্রণা একটু কম লাগছে? আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। ডাক্তার সরকারকে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো সেলিনা। রেহানা উঠে দাঁড়ালো। ডাক্তার সরকার বললেন কি হয়েছে মা? খুব জ্বর, হাত পা কামড়াচ্ছে শরীরে ভীষণ ব্যথা আর মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

    ডাক্তার সরকার দেখলেন। তারপর বললেন, ভোগাবে কয়েকদিন, তবে ভয়ের কিছু নেই। বিশ্রাম দরকার। আফরোজ বেগম বললেন, ডাক্তার বাবু ছেলেটি ওর পিসির কাছে থাকে। বাবা মা কেউ কাছে নেই। কি যে হবে। ডাক্তার সরকার খুব উদার প্রকৃতির মানুষ। বললেন বাবা মা কাছে নেই, তাতে কি আপনারা তো আছেন? আপনি দেখবেন? আফরোজ বেগম বললেন আপনি বোধ হয় কিছু জানেন না ডাক্তার বাবু। কি? ওকে আমি আমার কাছে রাখব কি করে? কেন ও হিন্দুর ছেলে বলে? আমি কিন্তু একথা আপনাদের কাছে আশা করিনি। ও যা করেছে আপনাদের জন্য এবং এখনো যা করে, আপনার স্বজাতি, এমন কি আপনার ছেলেও তা করতনা। জানি ডাক্তারবাবু, কিন্তু ওর পিসি তা মানবে কেন? ও আই সি। তাহতে পারে। তবে যদি সত্যি সত্যি দায়ীত্ব পালন করতে চান, তাতে কোন অসুবিধা হবে না। তারপর রেহানাকে বললেন, ওর কিন্তু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠা দরকার মা। বিখ্যাত ব্যরিস্টার মিঃ ভট্টাচার্য বিনা পয়সায় যে তোমাদের কেসটি গ্রহন করেছেন, সে কিন্তু ওর জন্য, ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন আফরোজ বেগম এবং সেলিনা।

    রেহানা আমার কপালে হাত রেখে বললো, ডাক্তারবাবু কি বলে গেছেন শুনেছ? আমি চুপ করে রইলাম। এর আমি কি উত্তর দেব। রেহানা আবার বলল, কি কথা বলছেনা যে। কি বলি বলত। কি করবে? তুমি বল কি করবো? আমার কথা তোমার ভাল লাগবে? বলেই দেখনা। পিসির কাছে ফিরে যাও। তুমি যাবে তো আমার সাথে? যাব, থাকবে আমার কাছে? হাসল রেহানা, ভীষণ মিষ্টি সে হাসি। বলল, থাকব। সত্যি? তুমি বোঝ না? আমি তো সব সময় তোমার কাছে আছি। তবে আমি তোমায় দেখতে পাইনা কেন? কেন হৃদয় আমার এত খালি মনে হয় বলতে পার? পারি। তবে বল। তুমি আমায় একটুও ভালবাসনা তাই। তাই বুঝি? তবে আমি কাকে ভালবাসি? আমাকে ছাড়া সব্বাইকে? ওর একটা হাত টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুলাম।

    সেলিনা বলল, যা রেহানা খেয়ে আয়, আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা। ইচ্ছে না। করলেও খেতে যে হবে। যা তাড়াতাড়ি খেয়ে আয়। ওষুধটা খাইয়েছিস? ডাঃ কাকু বলেছেন ওষুধটা খেলে জ্বরটা কমে যাবে। খাইয়েছি। যা তবে। বিকাল হয়ে এল। প্রান্তিক ভাইকে তো ওর পিসির কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে গেল রেহানা। ঘাম দিয়ে জ্বরটা নেমে যেতে শরীরটা একটু হালকা লাগল। সেলিনাকে বললাম ভীষণ খিদে পেয়েছে। কি খাবেন? যা হোক।

    গরম পরটা, আলুভাজা, মিষ্টি আর কফি নিয়ে এল রেহানা, বলল খেয়ে নাও। তারপর যেতে হবেতো। কোথায়? বা তোমার পিসি চিন্তা করবেন না।

    আমি আর কোন কথা না বলে খেয়ে নিলাম। সেলিনা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে এল। মনে মনে ভেবেছিলাম রেহানা হয়তো যাবে আমার সাথে। কিন্তু শেষ বেলায় ও বলল, তুই যা সেলিনা। আমারও বোধহয় জ্বর আসবে। সেলিনা শুধু একটু হাসল। তারপর ট্যাক্সিতে আমার পাশে এসে বসল। কয়েক মিনিটের পথ। পৌঁছে গেলাম। সেলিনা বেল দিতে গেলে বললাম, দরকার নেই সেলিনা, আমার কাছে চাবি আছে। ওকে চাবিটা দিতে, গেটটা খুলে আমাকে নিয়ে ভিতরে এল। পিসি শুয়ে আছেন। আমার সঙ্গে ওকে দেখে উঠে এলেন। সেলিনা বলল, আপনি পিসিতো। বলে মাথা নীচু করে প্রনাম করতেই নীলাঞ্জনা বললেন তুমি মানে …। তার কথা শেষ না হতেই সেলিনা বলল। না না আমি রেহানা নই, আমি সেলিনা। কিন্তু আপনাকে ওরকম লাগছে কেন? বলে আমাকে ছেড়েই পিসির কপালে হাত দিতেই চমকে উঠে বলল একি আপনারও জ্বর? নীলাঞ্জনা বললেন, ওরও কি জ্বর হয়েছে? হ্যাঁ ভীষণ জ্বর। কলেজে যাওয়ার পথে আমাদের ওখানে গিয়েছিলেন। আসলে, কালকের ঝড়জলের পরে সংবাদ নিতে আর কি। কিন্তু তখনও ওর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মা তাই ওকে আটকে দিলেন। বললেন আজ আর কলেজে গিয়ে কাজ নেই বাবা। এখন একটু বিশ্রাম নাও। তারপর বিকেলে একটু সুস্থ হলে না হয় চলে যেও। কিন্তু জ্বর আর কমে না। বাধ্যহয়ে ডাঃ কাকু মানে ডাক্তার সরকারকে ডাকা হলে উনি দেখেশুনে বললেন, ভোগাবে তবে ভয় নেই, ওর বিশ্রাম আর নার্সিং-এর দরকার। সেটাতো তোমাদের ওখানেও হতে পারতো বললেন নীলাঞ্জনা। এই দেখুন আপনি এখনো রেগে আছেন। আপনি মা, আপনার নাসিং আর আমার মায়ের নাসিং কি এক হবে? কেন তোমরাতো আছে, তোমরা পারতেনা নাসিং করতে? পারতাম পিসি কিন্তু তাতে যা বাড়তে ছাড়া কমোনা। একি আপনার শরীর যে কাঁপছে, চলুন চলুন আপনাকে শুইয়ে দিই। নীলাঞ্জনা বাধা দিয়ে বললেন দরকার হবে না, তুমি ওকে দেখ।

    সেলিনা নীলাঞ্জনাকে ধরে নিয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে বলল, মায়েদের এই জেদটা আমার ভীষণ ভাল লাগে জানেন পিসি। কেমন একটা অহংকারী ভাব। সন্তানের সব ভালো-মন্দের মা-ই যেন একমাত্র জিম্মাদার। আমার মাকেও দেখেছি তো, ওঁর ধারণা উনি ছাড়া, ওর সন্তানের আর কেউ যেন কোন নাসিং-ই জানেনা। একমাত্র ওঁর নাসিং হলে ওর ছেলে মেয়েরা সব সুস্থ হয়ে যাবে। মাথার দু পাশের দুটো রগ চেপে ধরে শুয়ে পড়লেন নীলাঞ্জনা। সেলিনা তার হাতটাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, আমি টিপে দিচ্ছি, নিজে কি নিজের সেবা করা যায় নাকি? সেলিনা খুব যত্ন সহকারে, তার মাথা টিপে দিতে লাগলো। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল। লজ্জা করবেন না প্রান্তিক ভাই দরকার হলে আমাকে ডাকবেন। তারপর নীলাঞ্জনাকে বললেন, চা খাবেন পিসি? চা কে করবে? কেন আমি? তুমি? কেন আমাকে আপনার রান্না ঘরে ঢুকতে দেবেন না? যদি না দিই। আমি জোর করে ঢুকবো, দেখি মা হয়ে কেমন করে আপনি আটকান। নীলাঞ্জনা বললেন, তুমি বার বার আমাকে মা বলছ কেন? আমিতো ওর মা নই। জানি, কিন্তু আমিতো আপনাকে প্রান্তিক ভাইয়ের মা বলিনি। তবে কার কথা বলছ? আমার মায়ের কথা বলছি। আমার মা হতেও আপত্তি আপনার?

    নীলাঞ্জনা ভাবেন, এ মেয়ে বলে কি? সেলিনা তার চিন্তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়ে বলে, তা হলে চা করে নিয়ে আসি, গরম গরম খেয়ে দেখুন ভাল লাগবে। নীলাঞ্জনা নীরবে সম্মতি জানালে সেলিনা বলে প্রান্তিক ভাই আপনি খাবেন তো। কিন্তু আমার মতামতের অপেক্ষা না করে ও তিন কাপ চা করে নিয়ে এলো। এক কাপ আমাকে আমার ঘরে দিয়ে বাকী দুকাপ নিয়ে নীলাঞ্জনার ঘরে ঢুকলো সেলিনা। নীলাঞ্জনা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, বা বেশ সুন্দর চা বানিয়েছে তো তুমি? তাহলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন তো? তারপর বলল নিশ্চয়ই খাওয়া হয় নি। আপনি চাটা খান। আমি আপনার জন্য গরম গরম কিছু খাবার আর কফি করে নিয়ে আসছি।

    কি জানি নীলাঞ্জনা সেলিনাকে এবারেও কেন বাধা দিলেন না। সেলিনা অতি অল্প সময়ের মধ্যে গরম লুচি ও ঝাল ঝাল তরকারী করে নিয়ে এলো। আগে এটা খেয়ে নিন। কফি পরে আনছি? থাক পরে খাব। কেন পরে খাবেন কেন? এখনি খান। তারপর বলল আমি খাইয়ে দেব? কিন্তু প্রশ্নটা করে ও তারজন্য কোন অপেক্ষা না করে সত্যি সত্যি সেলিনা লুচিতে তরকারী দিয়ে নীলাঞ্জনাকে বলল হা করুন। নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। সেলিনা বলল, আমার দিকে তাকালে কি খাওয়া হবে পিসি, আর কোন কথা নয় এবার হা করুন। নীলাঞ্জনাকে বাধ্য হয়ে হা করতে হয়। আর সেলিনার দেওয়া লুচিটাও খেয়ে নেন নীলাঞ্জনা। তারপর বলেন, আমি নিজেই খাচ্ছি। সেলিনা বলে, কেন আমার হাতে খাওয়া যাবে না, না আমি খাওয়াতে পারব না?

    হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন নীলাঞ্জনা, এমন অদ্ভুত মেয়ের পাল্লায়, এর আগে পড়েনি কখনো। নিজেকে পরিচয় দিয়েছে রেহানার বোন হিসাবে। প্রান্তিকের কাছে ওদের সবার কথা শুনেছেন নীলাঞ্জনা। কিন্তু কোন দিনই মুসলিম সমাজের রক্ষণশীলতার বাইরে এদের কথা ভাবতে পারেননি। তাই তার অবাক হওয়াটা অনেক বেশী। লুচি তরকারী খাওয়া হয়ে গেলে, সেলিনা কফি করে নিয়ে এল। এবারে আমাকেও এক কাপ দিয়ে নীলাঞ্জনার ঘরে ঢুকে গেল সেলিনা। বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন পিসি, সন্ধ্যা হয়ে এলো, আমাকে তো যেতে হবে। যেতে হবে? কথাটা শুনে এমন ভাবে তাকালেন নীলাঞ্জনা পিসি, যেন একথাটা ভীষণ নতুন তার কাছে? বললেন, না গেলে মা রাগ করবেন, না? তাতো করতেই পারেন। যেমন প্রান্তিক ভাই যদি আপনার কাছে ফিরে না আসতেন আপনি রাগ করতেন না? না করতাম না। তাই হয় না কি? আপনি আমাকে ছেলে ভুলাতে চাইছেন? নীলাঞ্জনা বললেন, আচ্ছা তোমাকে যদি আমি ধরে রাখি তা হলেও যাবে? ধরে রাখবেন? কেমন করে ধরে রাখবেন? আমার স্নেহ দিয়ে, আমার ভালবাসা দিয়ে। ও সব বাজে সেন্টিমেন্ট পিসি, ও সব দিয়ে কাউকে ধরে রাখা যায় না। তবে কেমন করে ধরে রাখা যায়। তার উত্তরতো আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে পিসি, কারণ আপনি তো মা।

    সেলিনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজেকে খুব হালকা লাগছিল নীলাঞ্জনার। সত্যি শরীরটা তার ভীষণ খারাপ লাগছিল। একলা ঘরে তা আরো দ্বিগুন হয়ে উঠেছিল। তারপরে যখন প্রান্তিক এই মেয়েটিকে নিয়ে ঢুকল, মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গ্রীষ্মের দাবদাহে এ যেন এক পশলা মিষ্টি বৃষ্টি। সেলিনা বলল, মনের জোর দিয়ে ধরতে হয়। এই দেখুন না, মা, রেহানা, চাইছিল প্রান্তিক ভাই থাকুক। তবে থাকল না কেন? জানতে চাইলেন নীলাঞ্জনা। সেলিনা পুরনো আলোচনা জের টেনে বলল ঐ যে বললাম, তাদের চাওয়ার মধ্যে সেই জোরটাই যে ছিলনা। নীলাঞ্জনা বললো ওদের না হয় জোর ছিল না, কিন্তু তোমার তো ছিল, তুমি চাইলেনা কেন? সেলিনা হাসতে হাসতে বলল এইতো আপনি ভুল করলেন পিসি, জোর যদি কারো থাকে সে ওই রেহানার আছে, কিন্তু বেচারা চাইতেই পারল না।

    নীলাঞ্জনা বললেন, তা হলে আমি বলছি তুমি থাক। সেলিনা উত্তরে বলল ওটাকি জোরের কথা পিসি? ওটাতো কথার কথা। যে দিন সত্যি জোর দিয়ে বলবেন, দেখবেন হাজার প্রতিকূলতায়ও আমাকে নড়াতে পারবেন না।

    কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। জ্বরে ভুগতে হল পিসি ও আমাকে সেলিনা আসতো মাঝে মাঝে। এবং এই আসার মধ্য দিয়ে পিসির মন ও হৃদয় ছুঁয়ে গেল সেলিনার চপল সাহচর্য। সেলিনাকে অনেক বার বলতে চেয়েছি, একবার যেন রেহানা আসে, কিন্তু পারিনি, কেন পারিনি জানিনে। সেলিনাও তার উপস্থিতির মধ্যে একবারও রেহানার নাম পৰ্য্যন্ত উচ্চারণ করে নি। একদিন শুধু বলেছিল না প্রান্তিক ভাই, ও যা ভয় করেছিল, তা হয়নি জুরে পড়তে হয় নি ওকে। ভালো আছে। ব্যাস্ আর কোন কথা নয়। আফরোজ বেগম একদিন এসে পিসিকে দেখে গেছেন। সেলিনা ও আফরোজ বেগমের মধ্য দিয়ে পিসির অনেক ভুলের অবসান হয়েছে মুসলিম রক্ষণশীলতা সম্পর্কে। একদিন নীলাঞ্জনা সেলিমাকে রেহানার কথা জিজ্ঞাস করেছিলেন, তাতে সেলিনা বলেছিল, আমাকে বুঝি আপনার আর ভাল লাগছে না ঠিক আছে ওকেই পাঠিয়ে দেব। আমি আর আসব না। অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়েছিল সেলিনা। নীলাঞ্জনা বললেন, পাগলি মেয়ের কাণ্ড দেখ। আমি কি তাই বলেছি।

    রেহানার আসা হয়নি। সেলিনাই এসেছে। বেশীর ভাগ সময় সে পিসির সঙ্গে কাটিয়ে গেছে। আমার কাছেও এসেছে, তবে খুব কম।

    শরীরটা যথেষ্ট দুর্বল তবে সুস্থ হয়ে উঠছি তাড়াতাড়ি। পিসি, গতদিন কাজে জয়েন করেছেন। অনেকদিন পরে ঘর থেকে বেরিয়ে তার মনটাও অনেকটা ভাল। অবশ্য সেলিনার সাহচার্যে তার চপলতা ও চঞ্চলতার মধ্য দিয়ে অতীতকে যেন খুঁজে পেয়েছেন নীলাঞ্জনা। আজ অফিস থেকে ফিরে বললেন, সেলিনা আসেনি? আমি বললাম তোমাকে তো বলে গেল ও আজ আসবে না। বলেছিল বুঝি, তা তুমি আজ কেমন আছ? ভাল ও আচ্ছা শোন, মিনতি সেন আজ আমার অফিসে ফোন করেছিলেন তোমাকে। কেন? এর আগেও নাকি ২/১ বার করেছেন। খুব দরকার বুঝি? হ্যাঁ উনি বললেন, তোমাকে ওঁর ভীষণ দরকার। কবে নাগাদ তুমি যেতে পারবে। তুমি জিজ্ঞাসা করনি কি দরকার? করেছি, তবে বলেননি। কিন্তু মনে হল, সত্যি তোমাকে তার প্রয়োজন। পারবে নাকি একবার যেতে? আমি বললাম, প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে, তবে কিসের প্রয়োজন সেটাইতো বুঝতে পারছি না। পিসি বললেন, উনি কাল আবার ফোন করবেন। আমি বললাম, তুমি একটা কাজ করবে পিসি? কি? ফোন করলে বল না যে উনি যদি পারেন তবে যেন একবার আসেন। বলেছিলাম। উনি কি বললেন? বললেন যে একদম সময় করতে পারছেন না। তাই তুমি যেতে পারলে ভাল হয়। তুমি বলেছ কি, আমি কয়দিন ধরে অসুস্থ তাই যেতে পারিনি। না আমি কিছু বলিনি। কাল ফোন করলে কি বলব, তাই বল। যা ভাল বোঝ তাই বলল। আমার একা একা অতদূর যাওয়ার ক্ষমতা নেই, এইটুকু তোমাকে বলতে পারি। আচ্ছা তাই হবে।

    প্রায় ২ মাস হয়ে এল, রেহানার সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ নেই। এত দীর্ঘদিন ওকে না দেখে থাকিনি কখনো। কত কথা যেন জমা হয়ে আছে মনের মধ্যে। এমন করে ওর অভাবতো জীবনে কখনো অনুভব করিনি। কোন দিনই বেশী কথা বলেনা রেহানা। ওর উৎকণ্ঠা এবং নৈকট্য তাও চিরদিন দূরে দূরে থেকেছে। এক সঙ্গে পথ চলতেও দেখেছি সামান্য ২/১টা কথা চাপা ভাবে বলেছে ও। আমিও যে ওর সঙ্গে খুব বেশী কথা বলি তা নয়। তবে আকাশ ভরা জোছনা রাতে তার সঙ্গে পথ চলতে চেয়েছি কতবার, কিন্তু বলতে পারিনি। ভোরের শিশির বিন্দুতে রাজপথের পিছল পথে হাটার বাসনাও দুর্নিবার প্রচেষ্টায় দমন করেছি। জীবনের শুন্যতা কেমন ভাবে তার সাহচার্যে পূর্ণতা পেতে পারে ভাবার চেষ্টা করেছি এই দীর্ঘ মাস। ও আমাকে নিষ্ঠুর বলে, প্রাণহীন প্রস্তর খণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে, কিন্তু ওকি। ওতো জানে, আমি শুয়ে আছি, এখন আমি কোথাও যেতে পারবো না। পারত না একবার আসতে?

    কি হতে এলে? নীলাঞ্জনা পিসি কিছু মনে করতেন? নিশ্চয়ই না। সেলিনার নৈকট্য তার জীবনেও এনেছে এক গভীর পরিবর্তন, কিন্তু সেই নীলাঞ্জনা এক বার, মাত্র একবারই সেলিনাকে বলেছিলেন, রেহানা কি আসতে পারে না একবার? আফরোজ বেগম এলেন অথচ সে এলো না। ও কি বোঝে না, আমার কান উৎকীর্ণ হয়ে কার পদধ্বনি শুনতে চায়। চোখ দুটি দেখতে চায় কার চকিত আবির্ভাব। মন চায় কার নীরবতার বিষণ্ণতায় মগ্ন হতে। আর সেলিনা? তারও যেন কত পরিবর্তন হয়ে গেছে। একি তার অভিনয়? না এমনি ভাবে পরিবর্তনের মাধ্যমে সে কোন নতুন বারতা বয়ে আনতে চায়।

    একটু আগে পিসি অফিসে চলে গেছেন। বলে গেছেন, সেলিনা এলে বল ও যেন তোমার খাবার গরম করে দেয়। আর আমার সঙ্গে যেন দেখা করে যায়। আমি অপেক্ষা করে আছি ওর আসার আশায়। আর ভাবছি ও যদি আসে, তবে অনেক দিন পরে, একলা আমাকে পেয়ে সেকি ফিরে যেতে পারবে তার অতীতে? পারবে কি তেমনি হাসিঠাট্টা আর চকিত চঞ্চলতায় আমার মনকে ছুঁয়ে যেতে যেখানে আমি একটি পরশ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু কোথায় সেলিনা? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসন্ন, সেলিনার দেখা নেই।

    ঝপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো এক সময়। পায়ে পায়ে এগিয়ে এলাম ঘরে। সুইচ টিপে জ্বালালাম বিদ্যুতের আলো। এলিয়ে দিলাম ক্লান্ত দেহকে নিজের বিছানায়। সেলিনা বলল, এখন শশাবেন না, প্রান্তিক ভাই, আমি কফি নিয়ে আসছি।

    খানিক পরে এলো পিসি। সেলিনাকে যেন কতদিন পরে দেখছেন, এমনি এক আনন্দের সুরে ভরে উঠলো মন। বললেন, ভীষণ ক্লান্তি লাগছে, আমার জন্য এক কাপ কফি হবে সেলিনা? সেলিনা বলল, আপনি, হাতে মুখে জল দিয়ে আসুন, আমি এক্ষুনি কফি দিচ্ছি। আপনার জন্যতো কফি করাই আছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅগ্নিপরীক্ষা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }