Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প813 Mins Read0

    ০৯. মেয়েলি কণ্ঠস্বর

    মেয়েলি কণ্ঠস্বর আরো কাছে এগিয়ে এল। তাকিয়ে দেখি তপতী। সঙ্গের ছেলেটি নিশ্চয়ই সৌমেন্দ্র। বললাম তুমি? আবে তুমি প্রান্তিক একদম ভাবতে পারিনি। বাদাম খাবে? বলে অপেক্ষা না করে নিজেব বাদামেব ঠোঙাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি ওটা নিয়ে বললাম, তোমার ওখানেই যাব ভাবছিলাম। তাই বুঝি। হাসল ও। হাসলে যে। না এমনি। তারপর রেহানার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বুঝি বেহানা? রেহানা এর কি উত্তব দেবে বুঝতে না পেরে চুপ করে বইল। তপতী বলল, জিজ্ঞাসা করলে না তো ছেলেটি কে? আমি নমস্কার করে বললাম নিশ্চয়ই সৌমেন্দ্র। সৌমেন্দ্র হাসল। তা হলে তুমি চিনতে পেরেছে? বললাম, আমি আমার ভুল স্বীকার করে নিয়েছি তাহলে আবার লজ্জা দেওয়া কেন? সৌমেন্দ্র বলল। চল না গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসা যাক। আমি বললাম তোমরা যাও, একবাব নিউসেক্রেটারিয়েট যেতে হবে। সেখানে কেন? একজনের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট আছে, সে অপেক্ষা করবে। তপতী বলল তার থেকে বল না এই মুহূৰ্ত্তটুকুকে তুমি হারাতে চাও না। তারপর রেহানাকেই উদ্দেশ্য করে বলল তোমার কথা অনেক শুনেছি। সেলিমাব ওখানে প্রথম প্রথম দুএক দিন দেখেছিও। কিন্তু তখনতো চিনতাম না। যাবে গঙ্গার ঘাটে? তোমার গল্প শোনা যাবে। ও আস্তে বলল, আমার তো কোন গল্প নেই তপতীদি। ও ঠাট্টা করে বলল সব বুঝি একজনকে সঁপে দিযেছো। ভাবছিলাম কি উত্তর দেবে একথার। যা চাপা মেয়ে, বলল, সঁপে দিতে আর পারলাম কই? আজও বুঝতেই পারলাম না, ওর মনের মধ্যে আমার কোন জায়গা আছে কি না। আমি অবাক হয়ে তাকালাম রেহানার দিকে। বলে কি? তপতী হাসল। সত্যিইতো, যে ছেলের মন জুড়ে শুধু একজন, তারতো এ সন্দেহ হবেই। না তপতীদি তুমি ঠিক বলনি। ও নিজেও জানেনা ওর মনের মধ্যে সত্যিকারের কাবো জায়গা আছে কি না। তপতী ভীষণ অবাক হয়ে বলল, কোন কিছু নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে? তবুতো সময় কাটতে, ভুল বোঝাবুঝিটা সত্যি কি না যাচাই করে দেখা যেত। কিন্তু ওতো পাষাণ। ওর মন বা হৃদয় বলে কিছু আছে নাকি? কঠিন ভীষণ কঠিন এ আঘাত।

    রেহান যে এমন কথা কারোর সঙ্গে বলতে পারে তা কল্পনারও অতীত। তাও স্বল্প পরিচিত কারো সঙ্গে। এবার তপতী সিরিয়াস হয়ে বলল কি হয়েছে প্রান্তিক, ব্যাপার কি? ঝগড়া করেছ নাকি। অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ একটা দ্রুতগামী মটর সাইকেল ইচ্ছে করে রেহানাকে চাপা দিয়ে বেরিয়ে গেল। মাগো বলে পড়ে গেল রেহানা। তপতী ও সৌমেন্দ্র এগিয়ে এসে ধরা ধরি করে দেখে এমন ভাবে ধাক্কা দিয়েছে যে ডান হাতটায় প্রচণ্ড লেগেছে। পড়ে যাওয়াতে থেতলে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে। মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে গেছে রেহানা।

    সৌমেন্দ্র বলল, একটু অপেক্ষা কর। দেখি কোন ট্যাক্সি পাই কীনা। অপেক্ষা করতে হলোনা, একটা দ্রুতগামী ফাঁকা ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল সৌমেন্দ্র। তারপর হাত ধরাধরি করে তুলে নিয়ে সোজা হাসপাতাল।

    পরীক্ষা করে দেখা গেল আঘাত যতটা কম ভাবা হয়েছিল আসলে তা নয়। পড়ে গিয়ে মাথায় ভাল চোট লেগেছে। আর তাতেই জ্ঞান হারিয়েছে। এখন জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত কোন কিছুই বলা যাবে না।

    আমি চিন্তান্বিত হয়ে একটা চেয়ারে বসে আছি। তপতী বলল এত ভাবছ কেন? দেখ কিছুই হয় নি। আমার কিছু বলার নেই শুধু ভাবছি মিনতি সেনকে একটা ফোন করতে হবে। সেলিনা নয়, আফরোজ নয়, প্রথমেই যার কথা মনে পড়লে, তার নাম মিনতি সেন। ফোন পেয়ে ছুটে এলেন উনি। এসেই যে কাজটি করলেন, তা হল হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে দক্ষিণ কলকাতার এক বিখ্যাত নাসিংহোমে ভৰ্ত্তি করে দেওয়া হল। আর অর্থপেডিকের সব থেকে বড় ডাক্তাব ডাঃ পালকে কল দিলেন। তিনি এলেন দেখলেন, তারপর বললেন, মিস সেন এখনিতো কিছু বলতে পারব না। অন্তত ৭২ ঘন্টাতো অপেক্ষা করতে হবে। যাই হোক মিনতি সেন বললেন তুমি এক কাজ কর প্রান্তিক। ওর মা বা বোনকে সংবাদ দাও। ওদের আসা দরকার।

    আফরোজ বেগম এলেন না, কিন্তু সেলিনা এল। বলল, কি হয়েছিল প্রান্তিক ভাই। আমি আনুপূর্বক সব ঘটনা খুলে বলতে, বলল বুঝলাম ডালিমরা ওকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। আমি অবাক হয়ে বললাম ডালিমরা তো জেলে। কি বোকা আপনি প্রান্তিক ভাই। জেলে তাতে কি হয়েছে? ওদের লোকেরাতো বাইরে আছে? তুমি চেনো নাকি তাদের? না চিনি না, তবে ডালিমদের জেল হওয়ার কয়দিন পরে ওর নামে একটা চিঠি আসে। রেহানাকে জিজ্ঞেস করাতে ও চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। আমি ধমক দিয়ে বললাম তোর এই প্যান প্যানানি ভাল লাগেনা রেহানা। এ তোর ভারি খারাপ স্বভাব। সব কিছুতেই হতাশা আর কান্না। কিন্তু প্রান্তিক ভাই চিঠিটা পড়তেই আমার ভিতরে জেগে উঠলো এক তীব্র প্রতিশোধ স্পৃহা। আমি ওকে বললাম তোকে যেতে হবে আমিই যাব। বললাম সেতো বুঝলাম। কিন্তু কে লিখেছে চিঠি, কি লিখেছে তাতে।

    সেলিনা বলল, চিঠিটা ডালিমের লেখা ও প্রেসিডেন্সি জেল থেকে মেদিনীপুরের একটা জেলে বদলি হয়ে যাচ্ছে, সেই সময়কার লেখা। সেলিনা বলল নিজের জিনিষ রক্ষা করতে পারেন না অথচ অধিকারের এ অহংকার কেন? আজ যদি ওর কিছু হয়ে যায় কি করবেন? কেউতো আসবে না আপনার জীবনে। মনের অবস্থা খুবই খারাপ, তবু বললাম বাংলাদেশে কি মেয়ের অভাব আছে? না নেই কিন্তু যারা আছে, তারাতো কেউ রেহানা নয়। বললাম, নাইবা হল রেহানা, সেলিনা হতে তো তাদের আপত্তি নেই।

    এত বড় শ্লেষ। অথচ কোন প্রতিবাদ না করে চুপ করে রইল, সেলিনা। বললাম চল, রোগিদের জন্য সাক্ষাৎ প্রার্থীদের বসার ঘরে গিয়ে বসা যাক। সংবাদ পেয়ে এক সময় নীলাঞ্জনা পিসি এলেন। ভাবিনি, সংবাদও দিইনি। মনে হয় সেলিনার কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে এসেছেন। উনি আমাকে কিছুই জিজ্ঞাস করেননি। শুধু বললেন মিথ্যে চিন্তা করো প্রান্তিক। আমরা তো আছি। পিসির এই একটি মাত্র কথা কত যোজন দূরত্ব যেন কমিয়ে দিল আমার আর পিসির মধ্যে। আমি ঐ জনসমক্ষে পিসিকে জড়িয়ে ধরে বললাম পিসি। আমাকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কোন রকম চেষ্টা না করে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন ও তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবে, কোন চিন্তা করো না।

    মিনতি সেন ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেবিয়ে এলেন, এই প্রথম মুখোমুখি দেখা মিনতি সেন এবং নীলাঞ্জনা পিসির। নীলাঞ্জনাই বললেন আপনি মিস সেন? নমস্কার। আমি নীলাঞ্জনা, প্রান্তিকের পিসি। চিনি আপনাকে অবশ্য নামে। একদিন গিয়েছিলাম। বললেন থাক ওসব কথা। ডাক্তার কি বললেন? উনি কিছু বলেননি, তারপর সেলিনাব দিকে তাকিয়ে বললেন তুমিতো সেলিনা? হ্যাঁ একবার এস আমার সঙ্গে। সেলিনা নীরবে তাকে অনুসরণ করলো। ডাক্তারের চেম্বারে লোকাল থানার অফিসার ইনচার্জ আছেন তিনিই কথা বললেন। উনি আই মীন পেশেন্ট আপনার দিদি? হ্যাঁ, কিন্তু আমাকে আপনি তুমি করেই বলবেন। মিনতি সেন সায় দিয়ে বললেন, ঠিকই তো। মিঃ চোধুরী, ওতো আপনার মেয়ের বয়সী আপনার মেয়ের মতন, ওকে আপনি তুমিই বলুন। ঠিক আছে বললেন থানার বড়বাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা তোমার কি কোন সন্দেহ হয় এই এক্সিডেন্ট উদ্দেশ্য প্রণোদিত কীনা। আমিতো ঘটনা স্থলে উপস্থিত ছিলাম না, তবে যারা ছিলেন, তারা বলেছেন ইচ্ছে করেই মটর সাইকেল ওকে ধাক্কা দিয়েছে। বড় বাবু বললেন যদি তাই হয়, তা হলে তুমি কাকেও সন্দেহ করো? হা করি? কর? কাকে?

    সেলিনা তার ব্লাউজের নীচ থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করে বড়বাবুকে দিতে গেলে মিনতি সেন নিজে নিলেন। মিনতি সেন চিঠিটা পড়ে চমকে ওঠে থানার বড়বাবুকে বলেন মিঃ চৌধুরী এই চিঠিটা এখনি আপনাকে দেওয়া যাবে না। এভিডেন্স হিসাবে পরে কাজে লাগতে পারে। আপনাকে বরং একটা জেরক্স কপি দেব। তারপর সেলিনার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই চিঠি তুমি কবে পেয়েছে। বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে। আমাকে জানাওনি কেন? যদিও রেহানা তাকে এই চিঠির কথা কাউকে বারবার না করেছেন বলতে, কিন্তু সে সব চেপে গিয়ে সেলিনা বলল, চিঠিটাকে আমি কোন গুরুত্ব দিতে চাইনি তাই আরকি। মিনতি সেন বললেন, ঠিক আছে। বড়বাবু আবার জানতে চাইলেন সেলিনার কাছে তাহলে কাকে তুমি সন্দেহ কর। মিনতি সেন বললেন ও ছেলেমানুষ। উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করে তালগোল পাকিয়ে দেবেন না। আরো বললেন, আমার মনে হয়, এর পিছনে একটা গভীর ষড়যন্ত্র আছে। আমি আপনাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করব মিঃ চৌধুরী। আপনার যদি ওকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার থাকে তাহলে করতে পারেন। না না আর কিছুর দরকার নেই মিস সেন। আপনি বরং কমিশনার সাহেবকে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে রাখুন। ওনার কাছ থেকে মূল্যবান ইনস্ট্রাকসান এলে আমাদের কাজ করতে সুবিধা হয়। কিন্তু তার থেকেও আগে দরকার, ওর সুস্থ হয়ে ওঠা। ডাঃ পালকে তাই বললেন, আপনি একটু দেখুন ডাঃ পাল যাতে মেয়েটি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে। ডাঃ পাল বললেন আমি ডাক্তার, আমার কর্তব্য মানুষের জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য নয়। কিন্তু ৭২ ঘন্টা না গেলে আমি কোন কথাই বলতে পারবো না। এটা এমন এক সিদ্ধান্ত যার বিরুদ্ধে সরব হওয়া যায় না।

    হ্যাঁ ৭২ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরেছে রেহানার কিন্তু স্মৃতিশক্তি ফেরেনি। রেহানা কাউকে চিনতেই পারছেনা। শুধু আমি কাছে গেলে আমার হাতটা ধরে চুপ করে থাকে আর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মিনতি সেন যখনই সময় পান আসেন। কিছুক্ষণ থাকেন। আমাকে ও সেলিনাকে সাহস দিয়ে চলে যান। একদিন এসেছিল অশ্রুকণা। তখন আমি আর সেলিনা পাশাপাশি বসে আছি। সেলিনা বলল সব সময় আপনি এমন চুপ করে থাকেন কেন প্রান্তিক ভাই। এত চিন্তা করেন কেন? বললাম, খুব খারাপ লাগছে। সব সময় শুধু নিজেকেই এই সমস্ত ব্যাপারের জন্য দোষী মনে হচ্ছে। তাই নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছি না। ও বলল এ ভাবে সব সময় ভাবলে যে, আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। গম্ভীর হতাশায় বলে উঠি আত্মহত্যা পাপ, তা না হলে যে কোন মুহূর্তে আমি আমার নিজের জীবন শেষ করে দিতাম। ছিঃ প্রান্তিক ভাই এ ভাবে কথা বলতে নেই। আমি বললাম আচ্ছা সেলিনা, কেন এমন হয় বলত। কি? এই যে অভাব বোধ, এই যে শূন্যতা, জীবনের সবকিছু যেন মরুভূমি। মনে হয় এ জীবন নিয়ে কী করব আমি?

    সেলিনা বুঝতে পারে সব, বলল ভিজিটিং আওয়ার তো দেরি আছে, চলুননা কোথাও থেকে ঘুরে আসি। কোথায়? যে কোন জায়গায়। আচ্ছা চল। তারপর আমরা যখন বেরিয়ে পড়ব বলে উঠে পড়েছি তখন এল অশ্রুকণা, বলল, তোমরা কোথাও যাচ্ছ? সেলিনা বলল না অশ্রুদি। ভিজিটিং আওয়ারতে দেরি আছে তাই প্রান্তিক ভাইকে বললাম, একটু ঘুরে আসা যাক। বেশ তোমরা ঘুরে আসো। আমি আছি এখানে যদি প্রয়োজন হয়। আমি বললাম, কণা তুমি বরং সেলিনাকে নিয়ে একটু ঘুরে এসো, আমি থাকছি? সেলিনা বলল, ভিজিটিং আওয়ারের আগেতো কোন প্রয়োজন নেই, বরং আমরা তিনজনেই যাই চল অশ্রুদি, ও বলল তোমরা যাও সেলিনা। আমি কিছু ভাবব না। তারপর বলল, একদিন আমার অসুস্থ শিয়রে ঘন্টার পর ঘন্টা কাঠিয়েছে রেহানা, তার কিছু ঋণ অন্তত শোধ করতে দাও। আমি বললাম, বেশ, তুমি তাহলে থাক এখানে। তবে আমরা না ফেরা পর্যন্ত চলে যেও না। ও বলল আচ্ছা থাকব। অশ্রুকণা কে একা রেখে আমরা বেরিয়ে আসি।

    এ রাস্তা সে রাস্তা দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় আমরা ভিক্টোরিয়ার কাছে চলে এলাম। সেলিনা বলল, যাবেন ভিতরে? না থাক। তাহলে কোথাও বসা যাক। বেশ চল ওই গাছার নীচে বসবে। চুপ চাপ বসে আছি। কোন কিছুই ভাল লাগছেনা। শুনেছি আফরোজ বেগম রেহানার এই অবস্থার জন্য পুরো পুরি আমাকেই দায়ী করছেন। আমি নিজেও তাই মনে করি। সুতরাং আফরোজ বেগমের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। সেলিনা বলল প্রান্তিক ভাই, আমি হয়তো রেহানা নই, তবু কি আপনার দুঃখ আমি ভাগ করে নিতে পারি না? নিশ্চয়ই পার। উজ্জ্বল চোখে তাকালো সেলিনা আমার দিকে। বলল, তবে কেন আপনার দুঃখের বোঝা আমার উপর নামিয়ে দিতে আপনার এত আপত্তি। কোন আপত্তি নেই সেলিনা। কিন্তু যদি বুঝতাম এ দুঃখ বয়ে বেড়াবার শক্তি আমার নেই। তারপর বললাম আচ্ছা বলত সেলিনা, সে দিন মিনতি পিসি কি একটা চিঠির কথা বলছিলেন। কি ব্যাপার? আপনি জানেন না? গভীর বেদনায় বললাম আজ কালতো আমি অনেক কিছুই জানিনা সেলিনা। আমাকে জানানো হয় না। কেন জানানো হয় না জানেন না। তাহ, আপনার দুঃখের বোঝা বাড়তে পারে। হঠাৎ করে জানতে চাইলাম আচ্ছা রেহানা এই অবস্থার জন্য তোমার দুঃখ হয় না? কি করে বোঝাব প্রান্তিক ভাই, হয়তো আপনিও কোনদিন বুঝবেন না। হয়তো রেহানার এই অবস্থা না হলে আমার পক্ষে যা সম্ভব ছিল, আজ আর তা সম্ভব নয়? বললাম কিছুই বুঝতে পারছি না ব্যাপারটি কি? ও বলল থাক আপনার বুঝতে হবে প্রান্তিক ভাই। তারপর বলল মিনতি সেনের বাড়ীতে কাল একবার যেতে বলেছেন। কিন্তু আমিতো চিনিনা। যাবেন আপনি আমার সঙ্গে? আমি অবাক হয়ে তাকাই ওর দিকে।

    এসব কোন কথাই আমি জানিনা। কেন যে মিনতি পিসিও আমার ওপর বিশ্বাস বাখতে পারছেন না কে জানে, তবু বললাম নিশ্চই যাব সেলিনা কখন যাবে তুমি? দুপুরে যেতে বলেছেন, উত্তরে জানায় সেলিনা।

    আমরা যখন মিনতি সেনের বাড়ীতে এসে পৌঁছিয়েছি তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। মিনতি সেন সবে মাত্র ঘরে বিশ্রাম নিতে গেছেন, জবার মা আমাদের রসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন, বললাম পিসী কখন উঠবেন? ডেকে দেবো? না থাক কখন উঠবেন তাই বল না। উনি শুয়েছেন কিন্তু ঘুমাননি, আপনারা বরং উপরে আসুন।

    আমরা উপরে গেলাম। মিনতি সেন শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। তারপর সেলিনাকে বললেন, তোমার চিঠিটা ভাল করে পড়েছি। পড়ে তোমার যেমন সন্দেহ হয়েছে আমারও খানিকটা সেই রকম সন্দেহ হয়েছে।

    আমি অবাক হয়ে ওদের কথা শুনছিলাম, তারপর বললাম, পিসি চিঠিটা কি আমি পড়তে পারি? মিনতি সেন চিঠি আমার হাতে এনে দিলেন, বললেন পড়া হয়ে গেলে আমাকে ফেরত দিও। চিঠিতে কোন সম্বোধন নেই। তবে তা যে রেহানাকে লেখা হয়েছে বুঝতে অসুবিধা হয় না। লিখেছে সেদিন তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু যে ভাবে তুমি একটি বিধর্মী ছেলের পিছনে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে বসে আছে, তাতে ক্ষমা তোমাকে করা হবে না। আমার জেল হয়েছে বলে মনে করোনা আমি শেষ হয়ে গেছি। এখনতো দেখছি তোমরা দুজনেই ছুটেছে এক জনের পিছনে। ছিঃ তোমাদের রুচিবোধের। ঘৃণা করি তোমাদের এই বেলেল্লাপনার। কি আছে ওর মধ্যে। ও ছাড়াকি আর কোন ছেলে নেই। ভাল ভাবে বলছি এখনো সময় আছে। পিছিয়ে এসো না হলে সুযোগর অপেক্ষায় রইলাম। না ইতি বা সম্বোধন কোনটাই নেই। চিঠিটা পড়া হলে মিনতি পিসির হাতে দিয়ে বললাম, এ চিঠি দিয়ে আপনি কি করবেন? আবো বললাম, এক কাগুঁজে বাঘের প্রতিশোধ স্পৃহা ওর কি কোন মূল্য আছে? তার থেকে একটা কাজ কর না পিসি? কি? ডালিমদের ১০ বছরের জেলটা দেখুন না আরো কমিয়ে এনে দু-একবছরে করে দেওয়া যায় কীনা। অবাক হয়ে মিনতি সেন বললেন কি বলছ তুমি? বেশ ভীত হয়ে বললেন এতটা পৌরুষের অহংকার ভাল না প্রান্তিক।

    আমি বললাম, ওরা আমাকে দুর্বল ভাবে। আপনারাও হয়তো তাইই ভাবেন। সেলিনাতো মাঝে মাঝে প্রায়ই ঠাট্টা করে বলে যে, ওর বক্সিং রিং-এ গিয়ে ওকে নক আউট করতে। এরা প্রত্যেকেই আমার বাইরের দুর্বলতাটুকু দেখে এসব কথা বলতে সাহস পায়। তাদের আমি এই কথাটা বলতে চাই যে পিসি, ওরা কেউই আমার ভিতরটাকে চেনে না। আমি সন্ধ্যা প্রদীপ যেমন জ্বালতে জানি, তেমনি জানি সে আগুনে কী ভাবে মশাল জ্বালিয়ে সব কিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া যায়। তারপর একটু থেমে বললাম কেউ কেউ বোধ হয় ভাবছে, এবার আমার হারার সময়। কিন্তু পিসি জীবনে কোন ব্যাপারে হারিনি, হারতে আমি জানি না। রেহানা আজ না হয় কাল সুস্থ হয়ে যাবে। ওর স্মৃতিশক্তিও ফিরে আসবে। ওর স্মৃতিশক্তি ফিরে আসুক ও ফিরে পাক ওর স্বাভাবিক জীবন। আপনাকে তো সব বলেছি ওর কথা। জীবনের বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে গেছে যে মেয়েটি, যে কিছুই দাবী না করেও আমার সমস্ত দেওয়াটাকে উজাড় করে নিয়ে গেছে, যে মিশে আছে আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে, তাকে কি করে অস্বীকার করব? না তা আমি পারবো না। তাছাড়া তাকে বোঝাবার অবকাশ থাকলেও, আজ আর তা সম্ভব নয়। তারপর প্রসঙ্গ বদলে মিনতি সেনকে বললাম, পিসি ব্যারিষ্টার ভট্টাচার্য সাহেবকে বলবেন আমি তার অবসরটা গ্রহণ করছি?

    অবাক হয়ে তাকান মিনতি সেন ও সেলিনা। এ আমি কি বলছি। মিনতি সেন বললেন তুমি কি বলছ তুমি কি তা জান? জানি পিসি, একদিন বুকে তুলে নিয়ে ছিলেন আমাকে এবং রেহানাকে। আজ যদি নামিয়ে দিতে চান, নীরবে সরে যাব কোন প্রতিবাদ করব না, শুধু অনুরোধ পিসি আমার ভালবাসাকে অপমান করবেন না। তারপর সেলিনার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমাকে উঠতে হবে, সেলিনা। চলুন প্রান্তিক ভাই, আমিও আসছি, তুমি যাবে আমার সাথে? সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাই ওর দিকে। বা একথা বলছেন কেন? আমিতো আপনার সাথেই এসেছি। হ্যাঁ এসেছে তাই বলে আমার সাথে যে যেতে হবে এমনতো কোন কথা নেই। মিনতি সেন বললেন আমি বুঝতে পারছি না প্রান্তিক তুমি কি বলতে চাইছো। তোমাকে আমি অপমান করব কেন? তুমি কি বোঝনা, আমার হৃদয়ের কোন জায়গায় তোমার স্থান। তাছাড়া বাবার নির্দেশে তার যাবতীয় সম্পত্তির অধিকারী আমি। কিন্তু আমি যদি তা না নিই তা হলে এ সম্পত্তির যাবতীয় অধিকার তোমার ও রেহানার এ তো বাবার আদেশ। তাহলে কিসের জন্য তোমার এই হতাশা। কিসের অভাব তোমার? হা বুঝতে পারছি, তুমি কোন কোন জায়গা থেকে হয়তো এমন ব্যবহার পেয়েছে যা তোমার সমস্ত চিন্তাকে তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে, একদিনতো তোমরা ছোট হয়েও আমাকে তোমাদের মায়ের স্থানে বসিয়ে সন্তানের মত উপদেশ দিয়েছে, আজ কি তবে মনে করব, সে শুধু তোমাদের অভিনয়। আমি তোমাদের কেউ নই?কায়া বুঝি বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল ভিতর থেকে তা দমন করে কোন ভাবে বললেন, ঠিক আছে চলে যাও তুমি আমার কাছ থেকে। আর কোন দিন এসোনা আমার কাছে। বাবার আদেশ অনুসারে খুব তাড়াতাড়ি তার যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানার ছাড়পত্র তোমার কাছে পৌঁছে দেব। আবেগ আর অবুঝ যন্ত্রণায় তার গলা বুজে আসতে চাইছে, কোন ভাবে টলতে টলতে পাশের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি তাকে বাধা দিতেও পারলাম না। সেলিনাও কি জানি কোন কিছু না বুঝেই হয়তো চুপ করে ছিল।

    হতাশায় ভেঙে পড়ে উঠে পড়েও আবার বসে পড়লাম চেয়ারে। বেচারা সেলিনা। কি যে করবে বুঝতে পারছেনা। বার বার মন চাইছে আমাকে সান্ত্বনা দিতে। কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু কোনটাই করতে পারছে না এ কোন সেলিনা। আমি আস্তে আস্তে উঠে–দরজায় আঘাত করে ডাকি মিনতি সেনকে। পিসি দরজা খুলুন। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না কত গভীর অভিমানে আপনাকে একথা বলেছি আমি? কেন বুঝতে পাবছেন না, আমার অভিমান করার আর কোন জায়গা নেই। একে একে এক ছিন্নমূল উদ্বাস্তুর মত আমার সব শিকড়গুলো যে ছিন্ন হয়ে গেছে পিসি। যদি বলেন, না অভিমানেও আপনাকে কিছু বলবার অধিকার আমার নেই, আমি চলে যাচ্ছি পিসি আর কোনদিনই আসব না। তাই বলে স্বার্থপরের মতো আপনার উপেক্ষার দান আমি গ্রহণ করব, এ আপনি ভাবলেন কেমন করে? সত্যি করে বলুনতো আমাদের জন্য কি কোন মমতা নেই আপনার হৃদয়ে?

    কেন যে অবুঝ কান্না এমন করে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল কে জানে। আমি টলতে টলতে বেরিয়ে যেতে চাইলে, সমস্ত দ্বিধা এক পাশে সরিয়ে রেখে সেলিনা আমাকে ধরে ফেলে বলল, এভাবে কোথায় যাচ্ছেন প্রান্তিক ভাই। আমি জানিনা কে আপনাকে অপমান করেছেন। যদি কেউ করেও থাকেন, তাই বলে তার অভিযোগ গুলোকে সত্য বলে মেনে নিতে হবে। আমার মা হয়তো আপনাকে অনেক ব্যাপারে আঘাত দিয়েছেন, তার দেওয়া আঘাতটাই কেবল মাত্র সত্যি, আর তার দীর্ঘদিনের ভালবাসার কোন মূল্য নেই? কেন আপনাকে তিনি আঘাত দিয়েছেন আপনি বোঝেন? তারপর নিজেই বলে চলল, না ববাঝেন না প্রান্তিক ভাই। একটু খানি থেমে আবারও বলে চলে, যদি কোন মা, আবার তিনি যদি কিছু পুরোনো মূল্যবোধে বিশ্বাস করে থাকেন আর দেখেন যে, আপনার সঙ্গে সম্পর্কের জন্য তার মেয়েরা নানা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে যাচ্ছে, মায়ের কাছে তার সন্তানের থেকে তো বড় কেউ নেই। তাই তাদের মঙ্গলার্থে আপনার সরে যাওয়াটা যদি চেয়েও থাকেন, সেটাই বড়? আর সন্তান স্নেহে, নিজের না থাকা ছেলের অধিকারে যখন তার হৃদয়ে আপনাকে স্থান দিয়েছেন, তার কোন মূল্য নেই, একবার তার মনের অবস্থা বুঝতে চাইলেন না কেন? কেন আপনি বুঝতে চাইছেন না তাকে এড়িয়ে যাওয়াটা তার কাছ থেকে আরো দূরে সরে যাওয়া। রেহানা যেমন আপনার কোথায় ব্যথা বোঝে। তেমনি অন্যরাও অনেকেই বোঝে। কিন্তু ফারাকটা কোথায় জানেন? যে সমাজে আমরা বাস করছি। সেই সমাজটাতো এখনো আপনাদের মানসিকতার উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। শুধু ডালিমদের চিঠিটাকে বড় করে দেখছেন কেন? আপনি কি জানেন, কেন প্রিন্সিপাল সাহেব রেহানাকে ডেকে আপনার সঙ্গে তার সব সম্পর্ক ত্যাগ করতে বলেছেন। আমি জানি তা আপনি জানেন না। জানবেন কি করে, রেহানাতো তা আপনাকে বলবেনা কোন দিন। যদি আপনি আঘাত পান। যদি আপনি ভুল বোঝেন?

    আমি চমকে উঠে বললাম, কি বলছ কি তুমি? কি এমন ঘটনা যা রেহানা আমাকে জানাতে চাইলনা। সেলিনা বলল আপনিতো তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারতেন, আপনিতো জানেন, তাকে জিজ্ঞাসা করলে, যত অসুবিধাই হোক সে আপনাকে সত্যি কথাই বলবে। কিন্তু কেন আপনি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না? আমি ভেবেছিলাম ওই আমাকে বলবে। অনাবশ্যক কৌতূহল আমার নেই। বাঃ পূর্ব। শ্লেষ ঝরে পড়ে ওর কণ্ঠে। যেদিন ও সত্যি সত্যি আপনার জীবনে আসবে, সেদিনও কি কোন কৌতূহল থাকবে না? না সেদিনও বলবেন ও যদি না বলে, আমার জানার কি দরকার? আর এই মানসিকতা নিয়ে আপনি পথ চলবেন এক সাথে? পৃথিবীতে কেউ কি কোনদিন তা পেরেছে? না প্রান্তিক ভাই। আমি কিন্তু আপনাকে এ ভাবে ভাবিনি। যে ব্যাথা একা বয়ে চলেছে রেহানা কেন আপনি তার ভাগ নিতে চাইলেন না? তা ছাড়া একটা রূঢ় কথা প্রান্তিক ভাই, শুনতে খারাপ লাগবে, তবু বলবো, রেহনাকে কি আপনি বোঝেন? আমার তো মনে হয় শুধু রেহানা কেন, আপনি কাউকে বোঝেন না। তারপর বলল, সব মেয়েরাই চায় তার ভালবাসার পুরুষটি তাকে বুঝতে শিখুক, তাকে আগলে থাকুক, তার ভুলগুলো শুধরে দিক যেমন একদিকে, তেমনি আর একদিক তার ভালবাসার মানুষটি তাকে তার প্রিয় উপহারে সাজিয়ে দিক। হোকনা তা অতি তুচ্ছ, তবু তার ছবিটাতে নন্দিত হোক তার প্রেমিকা, এতো সব মেয়েরই স্বপ্ন প্রান্তিক ভাই। রেহানা সুন্দর, ভীষণ সুন্দর তার অন্তর ও বাহির। কিন্তু কোন দিনই কেন, আপনার প্রশংসায় তা ধন্য হতে পারল না। কেন আপনি ভালবেসে সামান্য কাঁচের চুড়িটাও পড়িয়ে দিলেন না তার হাতে? শুধু লজ্জা? না জীবনের খাতে বয়ে চলেছে অন্য কিছু, যে দ্বিধা কাঠিয়ে উঠতে পারেন নি আজো আপনি। মনে রাখবেন ভাঙতে চাইলেই কিন্তু ভাঙা যায় না। তার জন্য জোরের দরকার। রেহানার জন্য সে জোরতো আজও আমার চোখে ধরা পড়ল না প্রান্তিক ভাই। একটা কথাতো মানবেন, আমার মতো সে তার দাবী প্রকাশ করতে পারে না কোনদিন। অন্য দিকে নিজের সৌন্দর্যে আমি প্রভাবিত করবার চেষ্টা করি অন্যকে। চাই আমাকে কেউ তারমত করে সাজিয়ে দিক। যদি না পাই দাবী করার জোরটুকু দেখাতে পারি। কিন্তু ও তা পারে না। এই না পারাটা আপনি কেন পুষিয়ে দিলেন না।

    আমি আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, তুমি থামবে? সেলিনা বলল, থামব কেন? আপনার মন যে কখনো কারো প্রতি দুর্বল হয় নি একি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? তারপর বলল শুনুন, ধর্মীয় নেতারা প্রিন্সিপালকে জানিয়ে ছিলেন, আমাদের সঙ্গে শুধু আপনি নন আপনার প্রিয়জনদের মেলামেশা তারা ভালভাবে নিচ্ছেন না। আপনাকে যেন এই পথ থেকে বিরত করা হয়। আর রেহানার ক্ষেত্রে তাদের আর্জি ছিল, যদি সে আপনার সঙ্গে মেলা মেশা বন্ধ না করে সামাজিক ভাবে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা জারী করবেন আমাদের পরিবারের উপর। না হলে প্রিন্সিপালকে বাধ্য হতে হবে রেহানাকে কলেজ থেকে নাম কেটে দিতে অথবা ট্রান্সফার সার্টিফিকেট ইস্যু করতে। তারপর বলল, যদি আমাদের পরিবার কোন উচ্চবিত্ত পরিবার হতো, হয়তো সবকিছুকে অবজ্ঞা করা যেতো, আমাদের দেশে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বাস করেও এমন যে ২/১টি ঘটনা কোথাও ঘটেনি তাতো নয়, কিন্তু প্রান্তিক ভাই তারাতত কেউ সমাজের উপর নির্ভরশীল নন। তাই সমাজ কিংবা ধর্মীয় ফতেয়া তাদের কাছে মূল্যহীন। কিন্তু আমরা, আমাদের মত পরিবার, পাশে এসে দাঁড়াবার মতো যাদের কেউ নেই, তাদের তো ধর্মীয় নিয়ামকদের ফতোয়া অস্বীকার করার খুব একটা উপায় থাকেনা। তাছাড়া আমাদের সমাজ তো দেড় হাজার বছরের ধ্যান ধারণা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সেখানে আপনার বা রেহানার দাবীতে অনেক বেশী তাই।

    পাশাপাশি ডালিমের চিঠি। কি ভয়ংকর হুংকার। আর কি কুরচিকর ইঙ্গিত। হ্যাঁ প্রান্তিক ভাই আমিও আপনাকে ভালবাসি। সেই যেদিন প্রাচীর পাশের একটি রেষ্টুরেন্টে পর্দা ঘেরা কেবিনে টিফিন খাচ্ছিলাম, সেদিন থেকে ভাল লেগেছিল আপনাকে। মনে মনে চেয়েছিলাম, আপনার সম্মোহনী দৃষ্টি খুঁজে ফিরুক আমার অন্তরের অন্তঃস্থল। বাইরের রূপ দিয়ে বিচার করলে ডালিম অনেক সুন্দর। তবু ও আমাকে কোন দিন আকর্ষণ করতে পারেনি। কিন্তু প্রথম দিন থেকে আপনি আমাকে চুম্বকের মত টেনেছেন আপনার কাছে। জানি এ সম্ভব নয়, কিন্তু মনতো মানে নি। তাই যে কোন ভাবে আপনার দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছি আমার দিকে। কখনো নিজের দেওয়া ফুলে বলেছি আমার বেনী সাজিয়ে দিতে, কখনো আপনার দেওয়া ফুলে সাজিয়েছি নিজের করবী। একি শুধুই খেয়াল? কখনো কি চাইনি এসবের মধ্যে আপনার নাগালের মধ্যে আসতে? বুকে হাত দিয়ে বলুনতো কখনো কি আপনার মনে হয়নি এরূপকে ভালবাসা যায়? মনের নাগালতো পাওয়া যায় না প্রান্তিক ভাই? কাছ থেকে তপতীদির সুগভীর ভালোবাসা দেখেছি আমি। পরে অবশ্য জেনেছি আপনাকে না পেয়ে তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন, আশ্রয় খুঁজতে চেয়েছেন, অন্যত্র নিজের সাধনায় নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে। কেন অস্বীকার করবো, নীলাঞ্জনা পিসির জন্য যে শাড়ীর রং আপনি পছন্দ করেছিলেন, পিসি সেই শাড়ীতে আমায় শুধু সাজালেন, আমার পছন্দ করা গয়না দিয়ে সাজালেন আমাকে বলতে চান সেখানে, আমার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পিসির কোন গোপন ইচ্ছে ছিল না? যদি না থাকতো তা হলে কিছুতেই বলতেন না যে ভাবে মডার্ন হয় সেভাবে তো সাজিয়ে দিতে পার। আপনি হয়তো ভেবেছিলেন সন্ধ্যার ফুল দুটো ফেলে দিয়ে আপনি আমায় ভুলে থাকতে পারবেন? তা হয়না প্রান্তিক ভাই। কেন ফেলে দিয়েছিলেন জানেন আসলে ভীষণ ভীষণ দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন আপনি, তা না হলে অন্তত বলতেন, সত্যি সেলিনা খুব ভালো লাগছে তোমাকে। যেদিন মিনতি পিসির দেওয়া উপহারে নিজেকে সাজিয়ে এসে ছিলাম আপনার কাছে, বলে ছিলাম কেমন লাগছে বলুনতো। এড়িয়ে গেলেন এই বলে যে, যার দেওয়া উপহারে তুমি সেজেছে, বলার কথা তো তার? হায় অবোধ পুরুষ মন, এমন দুর্বল আপনি ভাবিনি কখনো।

    তাও যাক, রেহানার আপনার কাছে আসাতে কেন আপনি চমকে উঠলেন, সেলিনা আসতে পারে বলে? আপনি কি চাননি মনে মনে আমাকে? হয়তো অস্বীকার করবেন, কিন্তু তার দ্বারা কি মনকে ফাঁকি দেওয়া যাবে প্রান্তিক ভাই? যাবে না আর এই দোদুল্যমান মন নিয়েই আমাদের চলতে হবে। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বকে মেনে নিতে হবে স্বাভাবিকতায়। ব্যাথায় ভরে থাকবে হৃদয়ের একটা দিক, তবু হাসতে হবে, আনন্দের ফুলকি ঝরাতে হবে যার সঙ্গে পথ চলছি তাকে নিয়ে। এইতো জীবন। আর এদের হাসি কান্নার ইতিহাসই আজকের পৃথিবী।

    প্রথম প্রথম মনে হতো আমার এই গোপন অভিসার কেউ বুঝি জানে না, কিন্তু নীলাঞ্জনা, পিসি আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কাউকে কাউকে ফাঁকি দিতে পারলেও সবাইকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। আর সেটা আরো স্পষ্ট হল, অশ্ৰুদি যখন বললেন, সেলিনা তোমার হাসি ঠাট্টার মধ্যে চোখ দুটি অমন করুন কেন? কেন এমন করে প্রান্তিককে টানছে তোমার দিকে। বেচারা নিজেই হয়তো হারিয়ে যাবে একদিন।

    পুরুষের দাম্ভিকতা আর অহংকারকে যদিও বা এড়ানো যায় মেয়ে মানুষের দৃষ্টিকে কি এড়ানো যায়? যায় না-প্রান্তিক ভাই। কিন্তু থাক ওসব কথা। এতক্ষণ ক্ষোভ আর আবেগ মিশিয়ে যা বললাম তা আমার নিজের কথা। এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার দরকার নেই প্রান্তিক ভাই। আবারও বলছি, আমি রেহানা নই, আমি সেলিনা আমার অধিকার আমি বুঝে নিতে জানি। এবার বলুন, কোথায় যাবেন। আর কেনইবা যাবেন। আমি আপনাদের কথায় যেটুকু বুঝেছি, পারবেন কি মিনতি পিসিকে ছেড়ে চলে যেতে? কেন মিথ্যে অহংকারে ভ্রান্ত পথে পা বাড়াচ্ছেন। কেন বুঝতে চাইবেন না মিনতি পিসির জীবনে আপনাদের মূল্য কতটুকু। যদি না বুঝবেন, তবে কোথায় আপনি আলাদা? আপনার যে আলাদ অস্তিত্বকে আমি এতদিন শ্রদ্ধার অর্থ দিয়ে এসেছি তার কি কোন মূল্য নেই প্রান্তিক ভাই। ফিরে আসুন। যান পিসির কাছে, বুঝুন তাকে। ভয় নেই, আমার যত কষ্টই হোক, রেহানার কাছ থেকে আপনাকে কোনদিনই কেড়ে নেব না। আমিতো জানি, নিজেকে দিয়েই বুঝি, তাহলে কষ্টটা কত তীব্র হতে পাবে।

    ও দাঁড়িয়ে আছে আমার ঠিক পিছনে। তার উষ্ণ নিশ্বাসে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছি আমি। একবার মনে হল, ওর দিকে ফিরে ওকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে বলি তোমাকে বুঝি সেলিনা, তোমার দুর্বলতা তোমার ভাললাগা তোমার হাসি কান্না তোমার রাগ-অনুরাগ মান-অভিমান, কিছুই আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। তোমাকে ভালবাসি তোমার থেকেও বেশি করে। তবু রেহানা আছে আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। পৃথিবীর কোন কিছুর বিনিময়ে তাকে আমি হারাতে পারবো না।

    মন চাইলেও পারলাম না বলতে। পিছনে ফিরে দেখি কখন যেন নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়িয়েছেন মিনতি সেন। কোন ভাবেই চোখ মেলে তাকাতে পারলাম না তার দিকে।

    এগিয়ে এলেন উনি, সেলিনাকে নিজেই তার বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন তোকে বুঝতে ভীষণ ভুল করেছিলাম, মা। আমায় ক্ষমা করে দিস। সেলিনা বলল, পিসি আমি যদি কোন অন্যায় করি ক্ষমা করো, তোমাকে চিনতাম না দেখিওনি কখনো, কিন্তু শুনেছি তোমার কথা বিভিন্ন ভাবে। যাবে না হাসপাতালে। যাব। কিন্তু মা, পারবি তো নিজেকে সব কিছুর উর্দ্ধে নিয়ে যেতে। পারবি তো প্রান্তিকের ভালবাসাকে সুগভীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে। ভয় নেই। আমার সর্বস্ব বিলিয়ে দেবো, রেহানা যাতে সুস্থ হয়। কিন্তু কোন ঈর্ষা তোকে বিপথে চালিত করবে না তো মা। সেলিনা কোন উত্তর না দিয়ে চোখের জলে ভিজিয়ে দিল মিনতি সেনের বুকের কাপড়

    আমরা যখন হাসপাতালে এলাম, তার অনেক আগে থেকে ভিজিটিং আওয়ার আরম্ভ হয়ে গেছে। আজ আগে থেকেই এসেছেন নীলাঞ্জনা পিসি। আমাদের কাউকে না দেখে তিনি একা একা রেহানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। অন্য দিকে ফিরে শুয়ে আছে রেহানা। ডাকলেন, রেহানা। ডাক শুনে এ পাশে ফিরে দেখে নীলাঞ্জনা দাঁড়িয়ে আছেন। তাকিয়ে আছে রেহানা কি যেন বিষণ্ণ দৃষ্টি নিয়ে। নীলাঞ্জনা জানেন, স্মৃতি ফেরেনি ওর, কাউকে চিনতে পারে না। তাই কোন কথা না বলে পাশের টুলটা টেনে নিয়ে ওর বিছানার কাছ বসে ওর একটা হাত টেনে নিয়ে কোন কথা না বলে ছল ছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। রেহানা বলে, তুমি কাঁদছ পিসি। চমকে ওঠে নীলাঞ্জনা। বলে তুই চিনতে পারছিস আমায়? বলতো আমি কে? নীলাঞ্জনাকে দুহাতে তার বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে, তোমায় চিনতে পারবো না কেন? কি হয়েছে আমার। না রে পাগলি কিছু হয়নি। এখন কেমন আছিস বলতো। কিছু হয়নি তো এমন করছ কেন তুমি। তোমার সঙ্গে আর কেউ আসেনি? কার কথা বলছিস? ও চুপ করে থাকে। নীলাঞ্জনা বলে, প্রান্তিক এসেছে ডাকবো ওকে? ও কোথায়? ও একটা জিনিস আনতে বাইরে গেছে। এখনি এসে যাবে, পাঠিয়ে দেব? না থাক। আর কেউ আসেনি? এসেছে অনেকে। তুই কাকে চাইছিস বল তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেলিনা আসেনি? সে তো এই নাসিং হোমকেই তার বাড়ী বানিয়ে ফেলেছে। ও, বলে চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ভীষণ খিদে পেয়েছে পিসি। কিছু টিফিন আননি? বল কি খাবি? যা এনেছো তাই দাও।

    আজ কি মনে হতে, ফল কিনে ছিলেন নীলাঞ্জনা। বেদানা, আঙুর, আপেল বের করে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে দিতে লাগলেন। রেহানা বলল, তোমাদের খুব ভোগাচ্ছি তাই না? মেয়ের কথা দেখ। মেয়ের কাছে আসতে কোন মায়ের কি কষ্ট হয়? হয় না বুঝি? তাই কি কখনো হতে পারে মা। তাই যদি হয়, তবে আমার মা কোথায়? আমার মা আফরোজ বেগম। কথাটা বোঝেন, নীলাঞ্জনা। বলেন, আমি কি তোর মা নই? তুই একটা একটা করে খা, আমি দেখি ওরা ফিরল কি না। না তুমি বোস। অগত্যা বসতে হয় নীলাঞ্জনাকে। নীলাঞ্জনা পালিয়ে যায় কি না সেই ভয়েই বুঝি, নীলাঞ্জনার আঁচলটা চেপে ধরে আছে রেহানা।

    কাছে এসে দাঁড়াই আমি সেলিনা ও মিনতি সেন। নীলাঞ্জনা বললেন, এই যে প্রান্তিক তুমি এসেছো কি না জিজ্ঞাসা করছিল। তুমি বোস ওর কাছে, আমি এক পাশে বসতেই নীলাঞ্জনা সেলিনাকে বলল, সেলিনা জিনিষটা বোধ হয় পাসনি, চলতো দেখি কোথায় পাওয়া যায় নিয়ে আসি। তারপর মিনতি সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনিও চলুন মিস সেন। বলে নীলাঞ্জনা উঠে দাঁড়াতেই, রেহানা বলল না তুমি যাবে না পিসি। নীলাঞ্জনা বললেন, পাগলামি করে না রেহানা, আমি আসছি, ওরাতো পায়নি, আমি না গেলে হয়? তুমি প্রান্তিকের সঙ্গে কথা বল। আমরা আসছি। প্রায় জোর করে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নীলাঞ্জনা। আর এই প্রথম, কি যে এক গভীর আনন্দে ওকে বুকের পর টেনে নিতে ইচ্ছে করছিল, তা বোঝাতে পারবো না। বহু কষ্টে তা দমন করে বললাম, এখন কেমন আছ রেহানা। আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলল, আমার উপর তুমি রাগ করেছো? কেন? তা হলে এত দেরি করে এলে কেন? কি যে হয়েছে প্রান্তিক, প্রতি মুহূর্তেই শুধু তোমাকে চেয়েছি। আর তোমাকে না পেয়ে আমি যেন কেমন যোবা হয়ে যাচ্ছিলাম। বললাম একটা ভীষণ কাজ ছিল। আর কোন দিন এ ভুল হবে না। দেখ এবার থেকে আমি সব সময় তোমার পাশে থাকব। সত্যি? সত্যি। তা হলে আমাকে ধরে তুলে বসিয়ে দাও। বললাম, বসতে পারবে তো? হা গো পারবো।

    আমি ওকে আস্তে তুলে বসিয়ে দিলাম। বুঝতে পারছি কষ্ট হচ্ছে, তবু মনের জোরে বসল। বলল, তুমি কখন খেয়েছো? এইতো দুপুরের পরে। কোথায়? মিনতি পিসির ওখানে। উনি এসেছেন? আমি হা বলতেও বলল, তা হলে একবার ডেকে দাওনা। বললাম ওরা একটু বেরিয়েছে এখনই আসবেন।

    ও বলল জান প্রান্তিক, আমার কেবলি মনে হয় আমি বোধ হয় তোমাকে আর আগের মত ভালবাসিনা। কি করে বুঝলে? বা আমি তোমাকে ভালবাসি কি না আমি তা বুঝবনা? তুমি কি করে বুঝবে? তবে কে বুঝবে? আমি বুঝব। আমি জানি, আমাকে তুমি খুব-খুব ভালবাস।

    ও একটু ম্লান হাসল। তারপর বলল, আচ্ছা আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই তুমি আমাকে খুঁজে পাবে? তোমাকে হারাতেই দেবো না। বা তাই হয় নাকি? আমি কি টাকা কড়ি, যে লুকিয়ে রাখবে যাতে কিছুতে না হারিয়ে যাই। তুমি আমার অহঙ্কার রেহানা, তোমাকে সব সময় নিজের কাছে রাখা যে আমার আরো বড় অহঙ্কার। ও আবার হাসল, তারপর বলল, তোমার সবটাতেই বেশী বেশী। সেতো তোমার জন্যই রেহানা। তা হলে আমার এরকম মনে হয় কেন? সে তোমার মনের ভুল, বাস্তব সত্যি নয়।

    ও হঠাৎ করে বলল, তুমি সেলিনাকেও খুব ভালবাস তাই না? সেলিনার মত মেয়েকে ভাল না বেসে পারা যায়? তুমিই বলো না? সে তো আমার বোন বলে। তোমার বোন কি আমার বোন নয়? তবে ওরা যে বলল! ওরা কারা! তাতো জানিনা, কবে যেন দেখেছি ওদের, কিন্তু তবু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। কি বলল ওরা! ওরা বলল, সেলিনাকে তুমি ভীষণ ভালবাস। শুধু আমার জন্য, সে কথা তুমি বলতে পারছনা। ওর মত মেয়েকে ভালবাসবে, তাতে আমার কি বলার আছে? ও তারপর হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে বলল, সেলিনা খুব ভাল মেয়ে, জান ও আমার থেকেও তোমায় বেশী ভালবাসে, ওকে তুমি গ্রহণ করবে তো।

    এবার আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, ধমক দিয়ে বললাম তুমি চুপ করবে? ও বলল, খুব মায়া হয় ওর জন্য না? আচ্ছা কেন ওর খোঁপায় ভালবেসে যে ফুল গুঁজে দিয়েছিলে তা ফেলে দিলে? বললাম আমার ইচ্ছেয় তাকে সাজিয়ে ছিলাম, ভাল লাগেনি তাই ফেলে দিয়েছি। তা হলে তো আমাকে সাজিয়েও যদি কখনো ভাল না লাগে তা হলে নিশ্চয়ই ফেলে দেবে? আমি অভিমানে বললাম জানিনা। তুমি এমন কথা বললে আমি আর থাকব না তোমার কাছে? কোথায় যাবে? সেলিনার কাছে? আমি রাগ করে বললাম হ্যাঁ ৩ই যাবো। তোমার চোখের ওপর ওকে আমি ভালবাসব, ওকে আদর করব, ওকে নিয়ে বেড়াতে যাবো, ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব, দেখবে তখন মজাটা? ও হেসে বলল, ঈশ পারবে না তুমি। কেন পারবো না, কেন? কি করে পারবে? ওকে আদর করতে গিয়ে যদি আমার মুখ দেখে শিউরে ওঠো পারবে ওকে আদর করতে? আমি বললাম আচ্ছা রেহানা কে তোমার মাথায় এই সমস্ত দুবুৰ্দ্ধিগুলো ঢুকিয়েছে বলতো। ও নির্বিকার ভাবে বলল তুমি। আমি? হাঁ তুমি। কখন? এইতো বললে, ওকে তুমি ভালবাসবে। ওকে তুমি আদব করবে, বল নি?

    আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না ওকি সুস্থ? এর সঙ্গে আর বেশী কথা বলা ঠিক হবে না। ও বলল, কি হল আর কথা বলবে না? তুমি বল আমি শুনি। আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে? কোথায়? তোমাদের গ্রামে। সেই অনেকদিন আগে একবার বলেছিলে, যাবে তো? নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো? সেখানে কি কি আছে? বললাম, মাথার উপর খোলা আকাশ পায়ের নীচে দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেত। আকাশে অনেক তারা। নদী পারে হলুদ সর্ষে ক্ষেত। আর পুকুর ভরা মাছ। কোন ফুলের বাগান নেই তোমাদের গ্রামে? তাও আছে। তবে গ্রামের প্রত্যেকের বাড়ীতেই তো আছে ফুলের বাগান। তাই আলাদা করে শুধু ফুলের জন্য ফুলের বাগান কোথাও নেই। ও বলল তোমাদের বাড়ীতে ফুলের বাগান আছে? হ্যাঁ আছে। কি কি ফুল ফোটে। অনেক জানা না জানা অসংখ্য নামের ফুল ফোটে সেই বাগানে। চন্দ্রমল্লিকা ফোটে না? জান আমার চন্দ্রমল্লিকা ভীষণ ভাল লাগে। লাল নীল হলুদ সাদা অসংখ্য বকমের চন্দ্রমল্লিকার মধ্যে যেন আমি নিজেকে খুঁজে পাই। একটু হেসে বললাম তাই বুঝি। তারপর বললাম, তুমি যখন আমাদের গ্রামে আমাদের বাড়ীতে যাবে, অসংখ্য পাখ-পাখালীর ডাকে তোমার যখন ঘুম ভাঙবে, তোমাকে নিয়ে যাবে, সেই চন্দ্রমল্লিকার বাগানে।

    মনে মনে ভাবি কি আকুল তৃষ্ণা। এমনি অভিযোগের আঙুল তুলে এইতো একটু আগে মিনতি পিসির বাড়ীতে আমার কাছে কৈফিয়ৎ চেয়েছিল সেলিনা। অবিকল সেই কথা গুলো এক অসতর্ক মুহূর্তে বেরিয়ে এল রেহানারও মুখ দিয়ে। আমি আবেগে ভাসতে ভাসতে বললাম, সত্যি তোমাকে বুঝিনি রেহানা। বোঝনি? না। তা হলে এই নাও চিরুনি সুন্দর করে দাও আমার খোঁপা। আর যে শাড়ীটা পরে তোমার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম, আছে নিশ্চয়ই এখানে কোথাও পরিয়ে দাওনা সুন্দর করে আমাকে। আমি অবাক হয়ে বললাম আমি পরিয়ে দেব-তোমাকে শাড়ি? কেন পারবে না? তারপর করুণ ভাবে বলল, আমিতো নিজে পিরবো না পরতে, তবে কে আমাকে পরিয়ে দেবে? সেলিনা আসুক আমি ওকেই বলব। তবু তুমি পারবে না এটাতো কেবিন, কেউ তো নেই এখানে, তবে অসুবিধা কোথায়? আমি বললাম, অসুবিধাটা যে কোথায় তা আমি তোমাকে কেমন করে বোঝাই? ও হতাশ ভাবে বলল জানি পারবে না তুমি, তবে কেন মিথ্যে স্বপ্ন দেখাও প্রান্তিক? আমিতো হেরে গেছি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, হৃদয় এবং মনে আমি শক্তিহীন। তুমি চলে যাও প্রান্তিক ওরা বাইরে অপেক্ষা করছে, তুমি না গেলে ওরা কেউ আসবে না। ওদের আসতে দাও। বললাম থাক না ওরা বাইরে। আজ শুধু আমি থাকি তোমাব কাছে? কেন মিথ্যে দুঃখের রেশ বাড়বে? কি দেখবে তুমি আমার মধ্যে রূপ? হারিয়ে ফেলেছি। মন? বাসী হয়ে গেছে। হৃদয়? প্রাণহীন পাথর মাত্র। আর যে দুটি উজ্জ্বল চোখের মায়ায় পড়েছিলে একদিন, ধূসর হয়ে গেছে তাহলে কি দেখবে তুমি আমার মধ্যে?

    বললাম রেহানা, যত পার আঘাত দাও, কিন্তু ভুলে যেও না আমার শিরায় শিরায় কেবল তোমার উপস্থিতি। দাঁড়াও দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি। কেন? তোমাকে সাজাবো বলে? কি ভাবে সাজাবে। বললাম আমার ভালবাসার রঙে।

    চিকনি চালিয়ে ওর অবিন্যস্ত চুলকে বিন্যস্ত কবলাম। তারপর দু হাতে ওকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলাম। আমার অদক্ষ হাতে পরিয়ে দিলাম ওর আকাঙ্খিত শাড়ী। তারপর বললাম, তুমি পারবে দাঁড়াতে? কেন গো? আমার সাজানো যে পূর্ণ হয়নি রেহানা, আমি যাব আব আসব। পারবে না দাঁড়াতে? পারবো।

    আমি দ্রুত বেরিয়ে গেলাম। বাইরে তখনো অপেক্ষা করছে ওরা। আমি সেলিনাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বললাম, আজ আর ঠাট্টা করোনা সেলিনা। একবার শুধু একবার আমাকে জিততে দাও। সেলিনা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। বললাম আমি দাঁড়িয়ে আছি। গেটের বাইরে ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে আছে ফুলওয়ালী। আসার সময় দেখে এসেছি বিভিন্ন রং এর মিশ্র চন্দ্রমল্লিকা, নিয়ে আসবে একটা? ও বলল, এখনি আনছি। আর একটা কথা? বলুন। সবুজ টিপ আছে তোমার কাছে আর চওড়া লাল গার্ডার। হ্যাঁ আছে? দেবে আমাকে? দেব। ও দ্রুত গেটের বাইরে গিয়ে চন্দ্রমল্লিকা কিনে এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, আমি কৃতজ্ঞ প্রান্তিক ভাই আপনার কাছে। জয় হোক আপনার।

    দ্রুত ওর কাছে এসে দেখি সত্যি তেমনি ভাবে দাঁড়িয়ে আছে রেহানা। বললাম কষ্ট হচ্ছে না? না। আমি পরম মমতায় চওড়া লাল গার্ডার পরিয়ে দিলাম ওর হাতের রিষ্টে। কপালে সবুজ টিপ পরালাম। তারপর বললাম, আস্তে আস্তে হেঁটে যেতে পারবে আয়নার কাছে।

    ও এগিয়ে এল। দেখত আয়নায় চিনতে পার কিনা। চকিতে আমার দিকে ফিরে বলল, তুমি ভীষণ দুষ্টু। আমি ওকে মুহূর্তে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললাম সত্যিই তাই। ও আমাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলল তুমি শুধু আমার প্রান্তিক, শুধু আমার। আমি এই অবসরে চন্দ্রমল্লিকাটা ওর খোঁপায় গুঁজে দিয়ে চোখের পর চোখ রেখে তাকালাম ওর দিকে। বলল কি দেখছ অমন করে? বললাম, হেলায় হারিয়েছি যে অতীত, হিসেব মিলিয়ে দেখছিলাম তাকে ফিরে পেলাম কি না। পেলে? বললাম জীবন নিয়েতো অনেক বড়াই করো, বলতে পারো উত্তর মিলল কি না। কাল বলব। কেন আজ নয় কেন? এখনো যে নিজের অংক মেলাতে পারিনি। এটুকু সময় আমাকে দেবে না। আবার ওকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললাম, আমি অনন্ত কাল তোমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করব রেহানা। এবারে ছাড়। ভিজিটিং আওয়ার উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, ওরা সই অপেক্ষা করছেন। ওরা আসবেন না?

    রেহানা অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ভিক্ষে চাইবো না। যদি মনে হয় সুন্দর, প্রতিদান দেবে না? আবেগে থর থর করে কাঁপছে হৃদয় মন শরীর সব কিছু। বললাম দেব। এস তোমাকে শুইয়ে দিই।

    মনে হয় সত্যিই ক্লান্তি লাগছিল। বাধা দিল না। যেভাবে নিজের হাতে সাজিয়েছি ওকে সেই ভাবে আস্তে ওকে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলে ও আমার হাতটা মুহূর্তে ধরে ফেলে বলল তুমি মিথ্যেবাদী। আমি হাসলাম ওর চোখে চোখ রেখে বললাম প্রতিদান তো? চোখের ভাষায় ও বলল হ্যাঁ। কি যে হল কে জানে সমস্ত সংযমকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়ে নিজের মুখটাকে নামিয়ে নিয়ে এলাম ওর মুখের ওপর এবং আলতো চুম্বন দিয়েই পালিয়ে এলাম। দ্রুত দরজা খুলে একবার ওর দিকে তাকাতেই ও হাসি হাসি মুখে বলল, কাল আসছো তো?

    আজ ওকে ছেড়ে দেবে। সেলিনাকে বললাম চল, ওকে নিয়ে আসি। বলল, আপনি যান প্রান্তিক ভাই, কেন তুমি যাবে না? ও শুধু হাসল। মিনতি পিসি বলেছেন, আমি গাড়ী পাঠিয়ে দেব গেটে গাড়ী থাকবে। গাড়ীর নাম্বারটা আমায় দিয়েছিলেন। আফরোজ বেগমকে বললাম, আপনিতো একদিনও গেলেন না মাসিমা, আজ চলুন। আপনাকে দেখলে ওর ভাল লাগবে। উনি অকারণে চোখের জল ফেলে বললেন, না বাবা তুমি যাও। কতদিন পরে মেয়েটা আসবে বাড়ীতে। ওর জন্য বহু দিন পরে ও যা ভালবাসে দেখি তার কোন বন্দোবস্ত করতে পারি কি না।

    গতকাল রিলিজ অর্ডার এবং নার্সিং হোমের সমস্ত পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দিয়েছেন মিনতি সেন। বললাম, আপনি আসবেন না, উনি বললেন, দেখি যদি সময় করতে পারি। বুঝতে পারছি কেউ আসবে না। একদিন যেমন সেলিনাকে একাকী আমাকে নিয়ে যেতে হয়েছিল, আজও রেহানাকে হয়তো একাকীই নিয়ে যেতে হবে। ভীষণ আনন্দের মাঝেও কি যেন বিষণ্ণতার সুর বাজছে আমার একতারাতে। এমন নিবিড় করে ওকে তো আর কখন কাছে পাবো না।

    আজ ১০ দিন হলো ওর স্মৃতি ফিরে এসেছে। এই দশদিন ও যেমন নিঃস্ব করে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে আমার কাছে এত দীর্ঘদিনে তা কোনদিন করেনি। কত স্বপ্ন। কত কল্পনা কত অতীত স্মৃতির গভীর সাগরে নিজেদের ডুবিয়ে দিয়ে অস্তিত্ব খুঁজে ফিরেছি। এই দশদিনে মাত্র একদিন এসেছিল সেলিনা। বলেছিলাম ওকে, তুমি কি প্রতিশোধ নিচ্ছ? অবাক হয়ে বলেছিল প্রতিশোধ? কার উপর প্রান্তিক ভাই? আমার উপর? কেন কিসের প্রতিশোধ? বলেছিলাম তাহলে যাওনা কেন ওখানে? ও বলল, গানের ছন্দপতন ভাল লাগবে? আবার তো সেই অন্ধকার দিন, সেই একঘেয়েমি তীব্র বাস্তবের মুখোমুখি। মধুর বাঁশীর সুর বিলীন হতে তো সময় লাগবে না। এই সময়টুকু শুধু আপনাদেরই থাকুক। বলেছিলাম, সত্যি তোমাকে আজো বুঝতে পারলাম না আমি। তারপর বললাম তুমি কেন বোঝনা সেলিনা তোমারা না গেলে আমার ভাল লাগতে পারে না। ও বলল, ওটা অন্তরের কথা নয়। আপনাদের কোন এক কবি বলেছেন না নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকীর খাতা শূন্য থাক। হা ওমর খৈয়াম। সেলিনা বলল ওই কবিই বোধ হয় আরেক জায়গায় বলেছেন, প্রিয়ার ডাগরচোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে কিন্তু বই অনন্ত যৌবনা। আমি বললাম, তুলনাটা ঠিক হল না সেলিনা। আসলে এই বৈপরীত্যের জন্য দায়ী তোমার অন্তর। না গিয়ে কি তবে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে চাও। না, তাহলে? ভাবছি। কি ভাবছো? ভাবছি আপনার কথা? আমার কথা? হ্যাঁ প্রান্তিক ভাই আপনার কথা? কি? যদি আপনাকে রেহানার কাছ থেকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাই, কেমন লাগবে ওর। আমি হাসতে হাসতে বললাম, এরকম অবস্থায় ঠিক তোমার যেমন লাগবে। আপনি আমাকে এমন দুর্বল ভাবেন কেন বলুনতো? ওকে বাধা দিয়ে বললাম ওসব কথা থাক। কেন তুমি যেতে চাওনা ওখানে? কারণ আমার উপস্থিতি আপনাদের অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। তার থেকে এই ভাল। আপনি আর দেরি করবেন না যান।

    কথা বাড়ায়নি আর। আসতে আসতে ভাবছিলাম, সেই প্রথম যেদিন ওর কাছে নিজেকে ধরা দিয়েছিলাম সেদিন বলেছিলাম হিসেব মিলল কি না? বলেছিল সে, উত্তর কাল দেব। পরের দিন বলেছিল, না প্রান্তিক, আজো মেলেনি উত্তর। তবে মেলাতে আমাকে হবেই। তারপর দুষ্টুমি মাখা হাসি ফুটিয়ে বলেছিল, কি পাগল তুমি, উত্তর মেলানোর হিসাব চাইছ তুমি আমার কাছে, নিজেই তো মিলিয়ে নিতে পার। পার না?

    রহস্য ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ও আমার দিকে। রেহানা সুস্থ হয়ে উঠছে দ্রুত। ডাঃ পালও ভীষণ অবাক হয়ে গেছেন। এত দ্রুত এই আঘাত থেকে সেরে ওঠার কথা নয়। আমি বললাম, রোজ রোজ আর এখানে আসতে ভাল লাগেনা। তাড়াতাড়ি সুস্থ হও। সুস্থতা কি আমার হাতের মধ্যে। তোমারই মধ্যে। তোমার মনের জোর, তোমাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে সাহায্য করবে রেহানা। আবার সেই চতুর হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললে আমার সুস্থতায় তোমার লাভ হতে পারে, কিন্তু আমার তাতে যে ভীষণ ক্ষতি? সে আবার কি রকম?

    ও তাকালো ঘরের চারদিকে তারপর বলল, এখানে যে তুমি আমার, একান্ত আমার, এমন করেতো তোমাকে এর বাইরে গিয়ে পাবোনা। গভীর আবেগে বললাম, নিভৃত মনের কোন সে গোপনে এত ভালবাসাকে তুমি নির্বাসিত করেছিলে রেহানা। ও বলেছিল ভালবাসাতো মনের গহনে লুকিয়ে থাকে। সমুদ্রের মত অতলান্ত আবার উত্তাল তরঙ্গ মালার মধ্যেও সত্যি কারের ডুবুরি কেবল তাকেই খুঁজে পেতে পারে যা সে খুঁজতে চায়। আমি তো মেকি ডুবুরি। তাই বুঝি? তা হলে কেমন করে খুঁজে পেলে তুমি সেই অমূল্য মুক্ত? পেয়েছি কি? পাওনি বুঝি। আমি হাসলাম। ও খুব আস্তে বলল কাছে এসো। কেন? যদি না পেয়ে থাক নিজের হাতে তুলে দেব তোমাকে। কোন দুঃখ থাকবে না। পায়ে পায়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছি ওর দিকে। ঝড়ের মত ঢুকলে সেলিনা। আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে হৃদস্পন্দন বেড়েচলেছে দ্রুত। বললাম, তুমিতো আসবে না বললে? বলেছিলাম। তবে কি খুব প্রয়োজন? কেন আমার আসায় আপনাদের কি কোন ক্ষতি হয়েছে? রেহানা বলল এভাবে কথা বলছিস কেন? তুই থাম রেহানা। তারপর আমাকে বলল, একবার বাইরে আসতে পারবেন প্রান্তিক ভাই। রেহানা বলল, এখানে বলা যায় না। কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। না যায় না। বললাম চল। তারপর রেহানার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি আসছি।

    বাইরে এলে সেলিনা বলল, আজ আপনি বিকালে এখানে আসবেন না প্রান্তিক ভাই। কেন? আমায় বিশ্বাস করতে পারছেন না? আমি যে না বলছি এটাই কি যথেষ্ট নয়? একদিন সে কথা মেনে নিতে কোন অসুবিধা ছিল না, কিন্তু সে বিশ্বাস তুমি নিজেই নষ্ট করেছে। মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি প্রান্তিক ভাই? কি বলতে চাইছি তাতে তুমি আমার থেকেও বেশি জান। ও কোন কথা না বাড়িয়ে বলল, আপনার দুটি পায়ে পড়ি প্রান্তিক ভাই, আপনি আজ আসবেন না। পরে তার জন্য যে শাস্তি দেবেন তাই মাথা পেতে নেবো। কিন্তু আপনি এলে আমার ভীষণ বিপদ হবে। তা হলে কি করব।শুধু একটু অভিনয়। অভিনয়? হ্যাঁ প্রান্তিক ভাই অভিনয়? কার সাথে? আমার সাথে?

    হঠাৎ রাগ হয়ে গেল ভীষণ। বললাম, তোমার সব অভিযোগতো মাথা পেতে নিয়েছি। আবার কোন খেলা খেলবে আমাকে নিয়ে। তারপর বললাম বেশ অভিনয় করতে কোথায় যেতে হবে? কোথাও না। এই ওয়েটিং রুমে আমরা শুধু পাশাপাশি বসে থাকবো। ব্যাস। অভিনয় শেষ? কোন ভালবাসার কথা নেই, নেই কোন মান অভিমান, এমন নিরামিষ অভিনয় আমি করতে পারবো না সেলিনা। চোখে তীর্যক দৃষ্টি এনে বলল নিরামিষকে আমিষ করার দায়ীত্ব আমার তখন বাধা দেবেন না তো? বেশ তাই হবে।

    কি হয়েছিল জানিনা। ওযে কি খেলা খেলতে চেয়েছিল তাও জানিনা। ওয়েটিং রুমে বসে আছি আমরা। বুঝতে পারছি কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি আমি, নিজের মনে আগে যে জোর ছিল তাও যেন কেমন কমে আসছে। কোন কিছুই স্বাভাবিক ভাবে ভাবতে পারছি না। হঠাৎ ও আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলল, তুমি কেন বুঝতে চাওনা, কি চাই আমি তোমার কাছে। আমি অবাক হয়ে বললাম ছিঃ সেলিনা! এসব কি হচ্ছে? ও বলল কি নেই আমার প্রান্তিক, যার জন্য এমনি ভাবে এড়িয়ে চল। ও আমার কাঁধের পরে একটা হাত রেখে আরো কাছে এগিয়ে এল। বললাম, আমি রক্ত মাংসের মানুষ, কেন চাইছো রেহানার কাছ থেকে আমাকে এভাবে সরিয়ে নিয়ে আসতে। আমি তোমাকে ভালবাসি, ওর থেকেও আমি তোমাকে বেশী সুখী করতে পারব তাই। আরো কয়েকজন লোক এলেন ওয়েটিং রুমে বসবার জন্য। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে, বললাম চল এখান থেকে ওঠা যাক। কেন লজ্জা করছে তোমার? এটা শুধু লজ্জার নয়, এটা অশ্লীলতার প্রশ্ন। জীবনটাতো শুধু শ্লীলতা দিয়ে বিচার হয় না প্রান্তিক, কখনো কখনো তা অশ্লীল, আর তাই বলে অশ্লীলতাকে একেবারে অস্বীকার করো না। সময় ও পরিস্থিতি অনুসারে অশ্লীলতাকেও সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা যায়। আমার দৃষ্টি দিয়ে দেখ প্রান্তিক, আমি যা চাইহি, তুমিও তাই চাইছে, শুধু পরিস্থিতির মাপকাঠিতে তোমার তা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

    ও আমার কানের কাছে মুখ এনে আরো নীচুস্বরে ফিস ফিস করে কি যেন বলল, কোন কথাই বুঝতে পারলাম না। আমি কোন কথা না বলে চুপ করে আছি দেখে বলল, তা হলে আমার অপমান তুমি দেখতে চাও? দেখতে পাচ্ছি দুটি ছেলে, বয়স আমারই মত হবে, কয়েকবার এই ঘরে উঁকি মেরে যাচ্ছে। এবার তারা একটু নিরাপদ দূরত্বে এসে বসল। যেহেতু ভিজিটিং টাইম, তাই এ ঘরে লোকজনের আনা গোনা বেশী নেই। যারা এসে বসেছিলেন তারাও মিনিট পাঁচেক আগে চলে গেছেন। সেলিনার ওই গায়ে পড়া ভাব, আর ছেলে দুটির ওই ভাবে মাঝে মাঝে তাকিয়ে জরিপ করা, সব কিছু নিয়ে আমার প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল সেলিনার উপর। মনে হতে লাগল, হাতের পাঁচটা আঙুল বসিয়ে দিই ওর হাসি হাসি মুখে। ও কিন্তু নির্বিকার। চোখের ভঙ্গিমায় অনুরাগের দ্যোতনায় অধিকারের জবরদস্তিতে অকারণ বুক থেকে মাঝে মাঝে ইচ্ছাকৃত আঁচল খসে পড়া, সব কিছু নিয়ে আমাকে যখন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রেরিত করছে তখনি বলল, জানি আমার ডাকে তোমাকে সাড়া দিতেই হবে। কতদিন আর এড়িয়ে চলবে। তাই বলছি চল না প্রান্তিক, আমার সব ব্যবস্থা করা আছে। পার্ক হোটেল, ১৪ নং ঘর, সারা রাতের জন্য বুক করা হয়েছে। এবার খুশীতো আনন্দে উজ্জ্বল দুটি চোখ থেকে যেন সীমাহীন তৃষ্ণার লেলিহান শিখা বেরিয়ে আসছে।

    ছেলে দুটি তীব্ৰদৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, কি হ্যাংলামো দেখেছিস? আরেক জন বলল আরে ছেড়ে দে, এসব কেসের পরিণতি তো জানা। চল আমরা একটু ঘুরে আসি।

    ওরা বেরিয়ে গেল। সেলিনা তখন আমার হাত ছাড়েনি। তবে কাঁধের হাতটা নামিয়ে সামান্য দূরে সরে বসেছে। আমি একটু জোর করেই হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। বললাম, তুমি কি লাজু লজ্জার মাথা খেয়েছো? খিল খিল করে হেসে উঠলো সেলিনা। চোখ দুটির তীর্যক দৃষ্টিকে বাইরের রাস্তার দিকে ফিরিয়ে, বললাম তোমার হাসতে লজ্জা করছেনা? ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। যারা রোগী দেখতে এসেছিলেন তারা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছেন সব। রেহানাকে আজ কেউ দেখতে আসেনি। আমি যে সত্যি সত্যি আসব না তাও তো ওকে বলে আসা হয়নি। বুঝতে পারছি, কি তীব্র অভিমান নিয়ে কাল পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে।

    সেলিনা বলল, না লজ্জা করছেনা প্রান্তিক ভাই। প্রান্তিক ভাই! আবারও চমকে উঠলাম আমি। এ কোন কুহকিনী। ও বলল, বিশ্বাস করুন, এ অভিনয়টুকু না করে আমার কোন উপায় ছিল না। যে সমস্ত কথা বলেছি, তার জন্য আপনি আমায় ক্ষমা করে দেবেন। জীবনের পাতা থেকে আজকের এই মুহূর্তটুকু কালো কালি দিয়ে কেটে দেবেন। চলুন এবার। আমি কিছুই বুঝতে না পেরে বললাম, একবার যাবে না রেহানার সঙ্গে দেখা করতে? বলল, জানি খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার, ওর ও যে কি হচ্ছে সেতো আমি ভুত ভোগী হিসাবে জানি তবু শুধু একটা দিন এটাকে মেনে নিন প্রান্তিক ভাই। আমি বললাম, তুমি বক্সিংএর মেয়ে, রিংএ কাকে কিভাবে নক আউট করবে, সেটা তুমিই জান। তবু একটা কথা বলবে, এমন চরম অভিনয় তুমি করলে কেন? তুমি কেন বুঝতে চাইলেনা, আমিও রক্তমাংসের মানুষ, হঠাৎ পতন হলে কি উত্তর দেব তোমাদের কাছে? আবারও সেই উপছে পড়া হাসি। হাসতে হাসতেই বলে আমাদের কাছে? তার থেকে বলুননা, আমার কাছে। ধর তাই। কোন উত্তর দিতে হবে না প্রান্তিক ভাই। যদি না বুঝতাম আপনাকে, এই নৃশংস অভিনয় করতে যেতাম না। আজ কোন উত্তর চাইবেন না। যে জন্য এ অভিনয় দরকার হয়েছিল, তা যদি কৃতকাৰ্য্য হয় জানাব আপনাকে, অন্তরের কৃতজ্ঞতাও উজাড় করে দেব সেদিন। আজ থাক প্রান্তিক ভাই। আজ শুধু মিথ্যে এ অভিনয়টুকুর জন্য ক্ষমা ভিক্ষে চাইছি।

    অদ্ভুত, কি অদ্ভুত মেয়ে এই সেলিনা। বিপদের আঁচ আমি পাইনি। হয়তো ও পেয়েছে, বা স্থির জেনেছে। বিশ্বাস, নিজের জন্য এ অভিনয় সে করেনি। যে কোন চরম দুর্ঘটনা থেকে সে বাঁচাতে চেয়েছে আমাকে ও রেহানাকে। কিন্তু কিসের সন্দেহে সে একাজ করল জানিনা। হাজার অনুরোধে ও বলেনি।

    এতদিনের মেলা মেশায় বুঝি অশ্রুকণাকে, তপতীকেও বুঝি, বুঝি নীলাঞ্জনা পিসি, মিনতি সেনকেও। কিন্তু বুঝতে পারিনা এই অদ্ভুত মেয়ে সেলিনাকে। যে কোন কিছু চাইবার ক্ষেত্র যেমন স্পষ্ট, পিছিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তেমনি স্পষ্ট। কোন মায়াবী অবগুণ্ঠন নেই, নেই কোন ভনিতা। জানিনা এমন মেয়েকে ভালবাসা যায় কি না।

    আজ সেই রিলিজের দিন। আমি একাই এসেছি। অফিস ঘরে ঢুকেই দেখলাম কেউ নেই। কি ব্যাপার? ওরা তো সবাই এক সঙ্গে বেরিয়ে যায় না। কাগজগুলো যে আমার দরকার। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমি এলাম রেহানার কেবিনে, সেখানে ডাক্তার পাল, সিস্টার আরো অনেকে আছেন। একি? ছোট খাট ভিড় দেখে মনে খটকা লাগল কিছু কি হয়েছে রেহানার? কিন্তু না জেনেও মন এত কু-গাইছে কেন? ভিতরে ঢুকলাম। ওরা আমাকে পথ করে দিলেন। আমি বললাম রেহানা কোথায়? ওরা চুপ করে আছেন দেখে অবারও বলালম, ওর কি কিছু হয়েছে, কথা বলছেন না কেন? ডাক্তার পাল একটা চিঠি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন এতে সব লেখা আছে। মিসেস সেনকে আসতে ফোন করে দিয়েছি এখনি আসবেন।

    জানিনা কি আছে চিঠিতে। ভয়ে আমার বুক দুরদুর করে কাঁপছে। বারবার ভেবেও চিঠিটা পড়তেও পারছি না। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা তো পড়েছেন, কি আছে ওতে। ওরা বললেন, ওতে দুটো চিঠি আছে। একটা খাম বন্ধ করা, ওপরে আপনার নাম লেখা। আরেকটা এখানকার ম্যানেজমেন্টকে লেখা। ম্যানেজমেন্টকে লিখেছেন, এই নাসিং হোম তাকে যে যত্নের সঙ্গে এবং দক্ষতার সঙ্গে সুস্থ হতে সাহায্য করেছেন, তার জন্য যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন কৃতজ্ঞ থাকবেন। তাকে আলাদা কেবিন এবং স্বাভাবিক স্বাধীনতা দিয়ে তার শূন্য হৃদয়টাকে যে ভাবে ভরে দিয়েছেন, শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাদের কাউকে উনি ছোট করতে চান না। জীবনে যা কিছু চেয়েছেন, তার পূর্ণতা দিয়েছে এই ছোট্ট কেবিনের নির্জনতাটুকু। কোন অবস্থাতেই জীবন থেকে তিনি তা মুছে ফেলতে পারবেন না। কিন্তু সঙ্গে তিনি ভয়ও পেয়েছেন, হয়তো এই সুখ তার জীবনে স্থায়ী হতে দেওয়া হবে না। তাই তিনি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই পরিচিত গন্ডী থেকে তিনি দূরে চলে যাবেন, যাতে তার জীবনের একাকী নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোতে এই স্মৃতিটুকু বেঁচে থাকে। আর একটা অনুরোধ জানিয়ে গেছেন, মিস সেনকে তিনি যেন কোন অবস্থাতেই তাকে খোঁজার চেষ্টা না করেন, আর এই ম্যানেজমেন্টকে তারা যেন কোন ভাবে কাউকে দায়ী করে কাঠগড়ায় দাঁড় না করান। এই সঙ্গে লিখে গেছেন, আলাদা করে একটা চিঠি খাম বন্ধ করে দিয়ে গেলাম। ম্যানেজমেন্টের এই বিশ্বাস রেখে যে, এটা শুধু প্রান্তিককেই দেওয়া হবে আর কাউকে নয়।

    আমি অবাক হয়ে ওদের কথা শুনছিলাম। মনে মনে বললাম রেহানা এ তুমি কি করলে। কেন করলে এমন কাজ? কেন তোমার মনে এই ভয় জন্মাল যে, তোমার জীবনে এই সুখটা স্থায়ী হতে দেওয়া হবে না। তুমি একটু বিশ্বাস রাখতে পারলেনা আমার উপর? এত অবিশ্বাস আমাকে? আমার সমস্ত শরীরটা শিহরিত হয়ে উঠলো, আমি থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লাম।

    মিনতি সেন এসে দাঁড়ালেন পাশে। তিনি শুনে নিয়েছেন সব কথা। চরম বিস্ময়ে তারও কথা যেন বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। একি করল মেয়েটা কাকে ও ভয় পাচ্ছে? তবে কি সেলিনার প্রতি চরম অভিমানে সে এই পথ বেছে নিল।

    আমার কাছে আসতেই আমি হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। যেন আমার একমাত্র আশ্রয় স্থল মিনতি সেন ছাড়া আর কেউ নেই। উনি আমাকে কাঁদতে দিলেন। তারপর আমার হাত থেকে মুখ বন্ধ করা খামটা নিজের হাতে খুলে নীরবে পড়তে লাগলেন, প্রান্তিক, কতবার হিসাবের অংক মেলাতে বলেছে আমাকে। বলতে দ্বিধা নেই। মেলেনি আমার অংক। হয়তো অংকে বরাবর কাঁচা ছিলাম বলে মেলাবার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ তোমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম একদিন, কি পাবে এই অংক মেলানোয়। জীবনের অংক মেলেনা কোনদিন। তোমাকে আঘাত দিতে চাইনি বলে বার বার বলেছি ঠিক মিলিয়ে দেব একদিন। কিন্তু জানতাম না, আমার অংকের উত্তর তোমার উত্তরের সঙ্গেও মিলবে না।

    এই কেবিন আমাকে কি দিয়েছে, এখানকার ম্যানেজমেন্টকে তা বলে গেছি আলাদা ভাবে, তোমাকে তা আর নতুন করে কি বলব। আমি চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না। আমার এই যাওয়াটাকে জানি তোমরা হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে ভাববে। তা ভাবতে পার। কিন্তু যে পূর্ণতায় আমি পরিপূর্ণ, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মতো তাকে ক্ষয় হতে দিতে পারি না।

    আমার কাছে তুমি কতটুকু তা নিজের মুখে বলে নিজেকে যেমন ছোট করতে পারব না, তেমনি পারবো না তোমাকেও ছোট করতে। তুমি অনেক বার বলেছে, রেহানা তোমার ভালবাসার কাছে আমি তুচ্ছ। আমি যা নই তেমনি এক বিরাটত্বের মাঝে আমাকে উত্তীর্ণ করে, তুমি নিজে সান্ত্বনা খুঁজতে চেয়েছে। পারলাম না মেনে নিতে বলে আমায় তুমি ক্ষমা করো। জানিনা, মিনতি পিসি, তোমার পিসি, সেলিনা এমনকি আমার মা পর্যন্ত আমাকে ক্ষমা করতে পারবেন কিনা কিন্তু এও জানি প্রান্তিক তুমি পারবে। তোমার ভাষায় তুমি অতি ক্ষুদ্র। হ্যাঁ, সত্যিই তাই। তাই আমার এই তুচ্ছ সিদ্ধান্ত তোমার মতো ক্ষুদ্রের পক্ষেই ক্ষমা করা সম্ভব।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅগ্নিপরীক্ষা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }