Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভুলবে সে গান যদি – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত এক পাতা গল্প110 Mins Read0

    ভুলবে সে গান যদি – ৩০

    ।। অনিল সাগরে।।

    মনে করুন সেই ষাট দশক। ঋত্বিক ঘটক-এর হাত ধরে ভেসে উঠছে ‘পার্টিশান ট্রিলজি’র কালজয়ী প্রথম অধ্যায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’। ‘কোমল গান্ধার’ বা ‘সুবর্ণরেখা’ আসতে তখনও এক-দু’বছর দেরি।

    কথা-সাহিত্যিক শক্তিপদ রাজগুরুর রচনা, সুপ্রিয়া দেবী-অনিল চ্যাটার্জি-বিজন ভট্টাচার্য-এর সেই অভিনয় আর অনিল সেনগুপ্ত-এর সংগীতে পণ্ডিত এ টি কানন-এর কন্ঠের সেই অপার্থিব মাদকতা। অনিল বাবুর উচ্ছ্বসিত ‘লিপে’ হংসধ্বনি রাগে কানন সাহেবের ‘লগি লগন পতি সখী সন’…

    জলজ্যান্ত ইতিহাস রচনা হল বাংলা সিনেমা ও সিনে সংগীতের জগতে।

    এরপর কেটেছে ২৫টি বছর।

    আট দশকের মাঝামাঝি। নবীন মারাঠি চলচ্চিত্র পরিচালক অমল পলেকর-এর ‘অনকহী’র মুক্তি। মারাঠি নাট্যকার সি টি খানলকর-এর লেখা ‘কলই তস্মৈ নমহঃ’ অবলম্বনে হিন্দি ছায়াছবি। সঙ্গে যুক্ত হল পলেকর, শ্রীরাম লাগু, দীপ্তি নভল, বিনোদ মেহর-র অভিনয়ে সমৃদ্ধ সোশ্যাল থ্রিলার। এদের পাশাপাশি এক গানপাগল মানুষের চরিত্রে প্রৌঢ় অনিল চ্যাটার্জী-র নজরকাড়া অভিনয় রীতিমত ব্যাতিক্রমী। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ছিল প্রচলিত দোঁহা ও ভজনে সুরকার জয়দেব-এর অভূতপূর্ব কম্পোজিশন। ‘বসন্ত বাহার’ (১৯৫৬)-র দীর্ঘ বিরতির পর আবারও প্লে-ব্যাক করলেন পণ্ডিত ভীমসেন যোশী। মিশ্র খামাজে তুলসিদাসের রাম-ভজন—’রঘুবর তুম কো মেরী লাজ’ (মতান্তরে তুম হো এবং তুম তো)। অনেকের মতে, প্রায় একই রকম বন্দিশ পাওয়া যায় কৃষ্ণপ্রেমী সুফিসাধক গরীব নওয়াজের রচনাতেও। কিন্তু আগে সেই গান।

    কালের অদৃশ্য নিয়মে এই গানেও লিপ দিলেন অনিলই। এ টি কানন-এর সুরের হাত ধরে যে পথচলা শুরু হয়েছিল, সেই বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হল ভীমসেন যোশীতে।

    দুটি পৃথক কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে কানন-ভীমসেন। মধ্যে সূত্রধর সেই অনিল চ্যাটার্জী।

    সে বছর সেরা সংগীত ও সেরা প্লে-ব্যাকের জন্য ৩২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল অমল পলকের ‘অনকহী’।

    সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি এ টি কানন-কে মনে রাখলেও কোথাও না কোথাও ভুলেছে ভীমসেনজিকে। তাঁর সেই অসাধারণ, স্বর্গীয় ভজনটিকে। যা প্রারম্ভিক আলাপেই একটা নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।

    আর তার সঙ্গে অনিলবাবুর তরঙ্গায়িত অভিনয়, অমল পলকের বিমুগ্ধ দৃষ্টি, শ্রীরাম লাগু-র মুগ্ধতা…সব মিলিয়ে এক অসামান্য জাদু-বাস্তবতা।

    সিনেমাটিতে ব্যবহৃত অনিলবাবুর নিজের ভাষায়, এই গান ”মরুভূমিতে যেন বৃষ্টির ফোঁটা”…তার ছিটেফোঁটা আমাদেরও গায়ে এসে লাগুক…ভেজাক…

    সুরের বৃষ্টিধারায় আমরাও ভিজতে থাকি…

    ।। কেদার ও ‘শাখা-প্রশাখা’।।

    সাল ১৯৯২। সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখা-প্রশাখা’। বিখ্যাত সেই শেষ দৃশ্য।

    সুস্থ হয়ে উঠছেন আনন্দ মজুমদার। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের আঘাতকে পিছনে ফেলে। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো আঘাত খানিকক্ষণ আগেই পেয়েছেন তিনি। ছোট্ট নাতি ডিঙ্গো দাদুর সঙ্গে দেখা করতে এসে অকপট সারল্য ও সততায় জানিয়ে গেছে তার বাবা ও কাকার ‘এক নম্বরি’, ‘দু নম্বরি’ রোজগারের কথা। প্রশ্ন করেছে তার দাদুকে, সে কত নম্বরি? তিন নম্বরি? চার নম্বরি?

    সৎ, আদর্শবান আনন্দের কাছে তার দুর্নীতিগ্রস্ত সন্তানদের আসল পরিচয় এভাবে উঠে আসায় তিনি বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, বজ্রাহত। যেন সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়েছে তাঁর। এর চেয়ে যেন মৃত্যুও শ্রেয় তার কাছে। বাবার সঙ্গে দেখা করে একে একে ফিরে যাচ্ছে ছেলেরা, প্রবোধ-প্রবীর-প্রতাপ। তারা নিজেদের জগতে ব্যস্ত মানুষ। মিলিয়ে যাচ্ছে গাড়ির কর্কশ আওয়াজ।

    ধীরে ধীরে বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় প্রশান্ত। তার কোথাও যাওয়ার নেই। সে মানসিক ভারসাম্যহীন। অথচ তার আদর্শ বিবেক, সততা চির অটুট। ছেলেকে দেখতে পেয়ে ঝকঝক করে ওঠে আনন্দ মজুমদারের চোখ। তাকে কাছে ডাকেন। বলে ওঠেন—”তুই-ই আমার সব রে প্রশান্ত, তুই আমার সব”! বাড়িয়ে দেন হাত। সন্তানের দিকে। পিতার হাত ধরে পুত্র। সেই হাত বুকে টেনে নেন পিতা। অস্ফুট কন্ঠে বলে ওঠেন, ”শান্তি শান্তি শান্তি!”

    সত্যজিতের ‘শাখা-প্রশাখা’ সেই অর্থে কোনদিনই আমার পছন্দের তালিকায় ঠাঁই পায়নি। কিন্তু ছবিটা যতবার দেখতে বসেছি, এই শেষ দৃশ্যটি আমায় নাড়িয়ে দিয়ে যায়। শুধু গল্প বলার ধরন বা অভিনয় নয়, তার নেপথ্যে সংগীতের জন্য বারবার এই ছবিটির কাছে ঘুরে ফিরে আসা।

    সিনেমাটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র প্রশান্ত (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও সে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকের অনুরক্ত। রাতে তার ঘর থেকে গ্রেগরিয়ান চ্যান্টস, বাখ বা বেঠোফেন ভেসে আসে। অসামান্য মুনশিয়ানায় প্রাশ্চাত্য সংগীতের ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ তার এই ছবিটিতে। ছিল শ্রমণা গুহঠাকুরতা-র কন্ঠে একটি রবীন্দ্রসংগীতও। সম্পূর্ণ নয়, খণ্ডাংশ—’মরি লো মরি, আমায় বাঁশীতে ডেকেছে কে’। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে শেষ দৃশ্যে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী-র কন্ঠে কেদারের আলাপ, অতুলনীয়, অপার্থিব, অদ্ভুত, অনন্যসাধারণ।

    একে অন্যের হাত ধরে থাকা অসহায় পিতা-পুত্র, শান্তিধ্বনি ও এন্ড ক্রেডিটস-এ অজয়বাবুর কেদার রাগের সেই আলাপ আজও কোথাও আমাদের নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। অতনু চক্রবর্তী তার ‘সিনেমা সংগীত ও সত্যজিৎ’ বইতে রাগটির ব্যবহার, চলন ও গায়কি নিয়ে সত্যজিৎ-অজয়বাবুর অসামান্য কেমিস্ট্রির কথা তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তীকালে টলিউড-বলিউড বিভিন্ন সিনেমায় অজয়বাবু কন্ঠ মাধুর্য রাখলেও ‘শাখা-প্রশাখা’য় তাঁর সেই ছোট্ট আলাপ পর্যায়টি আজও অবিস্মরণীয়।

    ।। আজ জানে কী জিদ না করো।।

    তুম হী সোচো জারা কিউ না রোকে তুমহে…

    আশি দশকের গোড়া। করাচি, পাকিস্তান। বহু ইতিহাসের সাক্ষী ব্রিস্টল হোটেলের ১১৩ নম্বর রুমে মুখোমুখি দুই অসমবয়সী বন্ধু। ‘ললিউড’ অর্থাৎ পাক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দুই কিংবদন্তি। হাতে রঙিন পানিয়ের গ্লাস। নেপথ্যে লং-প্লেয়িং রেকর্ডে ফরিদা খানুম। ইমন কল্যাণে বিখ্যাত সেই গজল। যার সুর ছুঁয়ে সন্ধে নামছে করাচির জইনাব বাজারে। ঘরের ভিতর খেলা করছে পড়ন্ত বিকেলের কনে দেখা আলো।

    —”শুভান আল্লাহ! আপনার কলমে জাদু আছে, হাশমী সাহেব! পাকিস্তান-হিন্দুস্তান সেই জাদুতে মশগুল, শুভান আল্লাহ!” —গান শেষ হতে বললেন এক বন্ধু। নাম আহমেদ রুশদী, কিংবদন্তি গায়ক, লোকে যাকে ‘সুরের জাদুকর’ নামে চেনে। ইদানিং খুব অসুস্থ। শরীর ভালো যাচ্ছে না তার।

    —”না, রুশদী ভাই। লিখতে আর পারলাম কই! আল্লাহতালহ যতটা লেখালেন তাই দিয়ে সামান্য কিছু আঁচড় কাটলাম।”—আলতো হেসে বললেন কালো চশমা পরা, চাপ দাড়ির লোকটি। ইনি ফয়াজ হাশমী। বিখ্যাত শায়ের ও গীতিকার।

    —”কী বলছেন আপনি! আপনি তো পাকিস্তানের ‘সরতাজ’। আল্লাহ মেহরবান, পাকিস্তানের মাটিতে আপনি এমন ফসল ফলিয়েছেন।”

    —”হা হা হা!” হেসে উঠলেন ফয়াজ, ”পাকিস্তান আর আমাকে চিনল কই। আমিও তো এখানে শুধু ‘মুহাজির’ হয়েই রইলাম।” গম্ভীর গলায় গ্লাসে চুমুক দিয়ে—”তবে শুধু পাকিস্তান নয়, হিন্দুস্তানেরও ভাগ আছে এই ‘নজম’-এ। বিশেষ করে আমার ফেলে আসা ছোটোবেলার শহর কলকাতার”—বললেন হাশমী।

    —”বলেন কী? কলকাত্তা? ইয়া আল্লাহ! এটা তো জানা ছিল না।”—বিস্ময়ে হতবাক রুশদী। আর মিটিমিটি হাসছেন ফয়াজ।

    —”কলকাত্তা এক আজীব শহর, রুশদী ভাই। খোদ গালিব যে শহরে এসে আর ফিরে যেতে চাননি। যে শহরে রবীন্দ্রনাথ, ডি এল রায়, কাননদেবী, কে এল সহগল, পঙ্কজ মল্লিক আর গহরজান-এর মতো কত শত ফনকাররা সাধনা করেছেন, আমার মতো সামান্য মানুষের ‘ইবাদতে’ মিশে আছে সেই শহর। সেই শহরের মিট্টিতেই মিশে আছে এই নজম। সেই আমার প্রথম আশিকি”…

    হেসে উঠলেন ফয়াজ হাশমী। উলটো দিকের চেয়ারে বসা আহমেদ রুশদী কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। আর সেই মওকায় করাচির শীত একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে ঘরে। ঘন হচ্ছে কুয়াশা। স্মৃতির আঁকেবাঁকে দখল নিচ্ছে সেই অদ্ভুত নীল ধোঁয়া। ঘরের ভেতর ফায়ার প্লেসের আগুনটা উসকে দেওয়ার কথাও যেন মনে পড়ল না কারও। শুধু একটা সুর, দু’এক টুকরো কথা সেতারের মীড়খণ্ডের মতো মোচড় দিয়ে উঠছে দিকবিদিক জুড়ে—

    ওয়াক্ত কে কয়েদ মে জিন্দেগী হ্যায় মগর
    চন্দ লামহা ইয়ে হী হ্যায় জো আজাদ হ্যায়।

    ২

    ১৯২০ সাল। মধ্য কলকাতার শিয়ালদা অঞ্চলে হায়াত খান লেন (এখন যা বৈঠকখানা রোডের পাশে মনীন্দ্রনাথ মিত্র রোড)-এ জন্মেছিলেন ফয়াজ হাশমী। তার ওয়ালিদ মহম্মদ হুসেইন হাশমী নিজেও ছিলেন নামজাদা ‘শায়ের’ ও নাট্যকার। ‘দিলগীর’ ছদ্মনামে শায়েরী লেখার পাশাপাশি ‘ম্যাডান থিয়েটার’-এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই রক্তে সাহিত্যের টান নিয়েই জন্মেছিলেন ফয়াজ।

    নয়-দশ বছর বয়স থেকে লেখালেখিতে হাতেখড়ি তার। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় লেখেন প্রথম নজম। তার সেই লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন সেই সময়কার কলকাতার উর্দু ও ইংরাজি সাহিত্যের মহাপণ্ডিত জনাব আগা হসর কাশ্মীরি। কাশ্মীরি ভবিষ্যদবানি করেছিলেন, বহুদূর যাবে ছোট্ট ফয়াজ। বাংলার পাশাপাশি ইংরাজি, উর্দু সাহিত্যের অনুরাগী ফয়াজ হাশমী এরপর কলেজের (খুব সম্ভবত বঙ্গবাসী কলেজ, ইংরাজি সাহিত্য) পাঠ চুকিয়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে যশোর রোডে গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়ায় ‘রেসিডেন্ট লিরিসিস্ট’ হিসেবে কাজে যোগ দেন। এরমধ্যেই প্রায় ৩০০-এরও বেশি শায়েরী লেখেন ফয়াজ। অনেকের মতে, এই সময়ই লেখা হয়েছিল—’আজ জানে কী জিদ না করো’। পুরোটা নয়, শুধু প্রথম স্তবক।

    সত্যি-মিথ্যে জানা নেই, ফয়াজ হাশমী-র ঘনিষ্টজনদের মতে, এর নেপথ্যেও রয়েছে একটি চমকে দেওয়া ঘটনা। কলেজে পড়াকালীন এক বঙ্গললনার প্রেমে পড়েছিলেন ফয়াজ। কিন্তু কোনওদিন তাকে প্রেমনিবেদনের সাহস দেখিয়ে উঠতে পারেননি। মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সিনে-গবেষক খালিদ হাসান জানিয়েছেন, সেই হারানো প্রেমের উদ্দেশেই লেখা হয়—’আজ জানে কী…’। যদিও তখন তা শেষ করতে পারেননি হাশমী। শোনা যায়, কোনওদিনই তিনি ভুলতে পারেননি তার সেই প্রথম প্রেমকে। প্রথম হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণাকে তিনি সাজিয়ে ছিলেন কবিতার পাতায় পাতায়।

    গ্রামোফোন কোম্পানির কাজের ফাঁকে ফাঁকে টলিপাড়ায় যাতায়াত ও পুরোদমে লেখালেখি চালিয়ে গেছেন তিনি। অভিন্নহৃদয় বন্ধু কমল দাশগুপ্ত-এর সুরে, তালাত মাহমুদ-এর কন্ঠে ও তার লেখায়—’তসবির তেরে দিল মেরা ব্যহলা না সকেগি’ তাকে রাতারাতি জনপ্রিয়তা এনে দেয়। অনিল বিশ্বাস-এর সুরে পঙ্কজ মল্লিক-এর কন্ঠে সেই বিখ্যাত গান ‘ইয়ে রাতে ইয়ে মৌসম’ জাত চিনিয়ে দেয় ফয়াজ হাশমীর। কিন্তু বেশিদিন কলকাতায় কাজ করতে পারেননি তিনি। ১৯৫১ সালে কোম্পানির নির্দেশে লাহোরে বদলি হয়ে যান হাশমী। কিন্তু লেখালেখি থামাননি। শিল্পসাহিত্য, সংগীত বা কবিতা কবে কোন কাঁটাতারের নিষেধ মেনেছে। তাই নতুন উদ্যমে শুরু হয় সিনেমার জন্য গান লেখা। ১৯৫৬ সালে প্রথম ব্রেক অসে ‘কুওয়ারি বেওয়া’ সিনেমায়। তার লেখনির জাদুতে মুগ্ধ হয় গোটা পাকিস্তান। এরপর একে একে ‘সবেরা’ (১৯৫৯) ও ‘দিয়া ওউর তুফান’ (১৯৬৯)-এর মতো একাধিক ব্লকবাস্টারের হিট গান বেরিয়েছে তার কলমেই। ২০০০-এরও বেশি গান, নজম এই সময়ে লিখেছেন ফয়াজ হাশমী। পেয়েছেন বহু প্রতিষ্ঠিত ‘নিগার সম্মান’ও।

    অবশেষে ১৯৭৩। রিলিজ হল ‘বাদল ওউর বিজলি’। সিনেমাটি মাঝারি মানের চললেও হাশমীর গান জিতে নিল পাকিস্তানের ‘দিল-ও-দিমাগ’। পার্টিশানের সময় আগ্রা থেকে ছিন্নমূল হয়ে পাকিস্তানে উঠে আসা এক তরুণ সুরকার সোহেল রানা আবাদী-র সুরে বিহ্বল হল পেশোয়ার থেকে ইসলামাবাদ। হাবিব ওয়ালি মহম্মদ-এর কন্ঠে আর গীতিকার ফয়াজ হাশমী-র লেখার জাদুতে নতুন করে অমৃতের স্বাদ খুঁজে পেল পাকিস্তান। কালক্রমে সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে এদেশেও ঢুকে পড়ল রাগ ইমন কল্যাণের সুরে সেই কালজয়ী রচনা। আট দশকে সেই গানকেই নতুনভাবে গাইলেন ফরিদা খানুম। আবারও নতুন করে রচনা হল ইতিহাস। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে তামাম দুনিয়ার লোকের মুখে তখন একটাই গান—’আজ জানে কী জিদ না করো…’

    এই গানের সুর ধরে অমর হয়ে রইলেন খানুম। কিন্তু কখন অজান্তে, ইতিহাসের পাতা থেকে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন সোহেল রানা, ফয়াজ হাশমীরা। আগ্রা মনে রাখেনি সোহেল রানা-কে। একসময় যে গানের জন্ম এই শহর কলকাতায়, তার কাছেই বা কতটা সমাদর পেয়েছেন গানের গীতিকার, ‘কলকাতার ছেলে’ ফয়াজ হাশমী! ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর করাচিতে যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন হাশমী, তখনও শুধুই বঞ্চনা আর অভিমানের পাহাড় নিঃশব্দে জমা রয়ে গেল কোথাও। শুধু পিছনে পড়ে রইলো একটি কালজয়ী গান ও তাকে ঘিরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কিংবদন্তির ক্যারাভান।

    দিল্লিতে এসে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের কনফারেন্সে এক বৃদ্ধ গবেষকের কাছে এই দাস্তান শুনেছিলাম বহু বছর আগে। নাম না জানা সেই মানুষটি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, পাকিস্তান তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি বা সিনেমার জগতের বহু গুণীজনদের প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। যেমন কদর পাননি ‘ঠান্ডা গোশত’-এর লেখক সাদাত হাসান মান্টো, ‘প্রিন্স অফ মিনার্ভা মুভিটোন’-এর সাদিক আলি, মুমতাজ শান্তি, রেহানা মীনা সুরি বা ফয়াজ হাশমীর মতো ব্যক্তিত্বরা। কিন্তু এ দেশই বা তাদের কতটা মনে রেখেছে? কতটাই বা দিয়েছে প্রাপ্য সম্মানটুকু?

    কলকাতার সেই অজ্ঞাত কবি ফয়াজ হাশমী দুই প্রাচীন শহর, কলকাতা ও করাচিকে বেঁধে দিয়ে গেছেন একটি নজমের সূত্রে। রাগ ইমন কল্যাণ তাকে দিয়েছে অক্ষয় চেতনার নিঃশব্দ উদ্ভাস। দুই দেশ, দুই কালখণ্ডের ঊর্ধ্বে উঠে শত সহস্র হৃদয়ে আজও ধ্বনিত হয়ে চলেছে প্রিয় মানুষকে কাছে পাওয়ার সেই চিরকালীন আকুল আর্তি। যার সামনে থমকে যায় সময়ের কাঁটা। ভালোবাসার স্তব্ধ জাগরণ মথিত হয় বিশ্বচরাচরে।

    আজ জানে কী জিদ না করো
    ইয়ু হী পহলু মে বৈঠে রহো
    হায়, মর জায়েঙ্গে হম তো লুট জায়েঙ্গে
    অ্যায়সি বাতে কিয়া না করো

    তুম হী সোচো জরা কিঁউ না রোকে তুমহে
    জান জাতী হ্যায় জব উঠকে জাতে হো তুম
    তুমকো অপনী কসম, জান-এ-জাঁ
    বাত ইতনী মেরী মান লো

    ওয়ক্ত কী কয়েদ মে জিন্দেগী হ্যায় মগর
    চন্দ ঘড়িয়াঁ হ্যায় ইয়েহী জো আওয়াজ হ্যায়
    ইনকো খোকর মেরী জান-এ-জাঁ
    উম্রভর না তরসতে রহো

    কিতনা মাসুম রঙ্গীন হ্যায় সমা
    হস্ন অউর ইশক কী আজ মেরাজ হ্যায়
    কাল কী কিসকো খবর জানে-এ-জাঁ
    রোক লোক আজকী রাত কো


    যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ,
    থাকলে না হয় এভাবেই পাশে বসে

    যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ…

    ছেড়ে চলে যাবে বলো না ও’কথা তুমি
    মৃত্যুর চেয়েও নিঃস্ব হয়েছি আমি,

    যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ…

    ভেবে দেখো তুমি কেন আটকাই পথ
    চলে যাও যদি, নিঃশ্বাস থেমে আসে
    তোমাকে প্রেমের দিব্যি, হে প্রিয়তমা
    এটুকু কথাই রাখো সেই আশ্বাসে

    যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ…

    জীবন বন্দি সময়ের কারাগারে
    কিছু মুহূর্ত এখনো পড়েনি ধরা
    অনুতাপ জেনো থেকে যাবে চিরকাল
    যদি নাই পারো সে সময়ে বাস করা

    রঙিন বাতাসে সারল্য মাখামাখি
    শিখর ছুঁয়েছে মাধুর্য, ভালোবাসা
    কে দেখেছে বলো আগামীর ইতিহাস
    ধরে রাখো এই রাত্রিনিবিড় ভাষা

    যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ
    থাকলে না হয় এভাবেই পাশে বসে

    যাওয়ার কথা নাই বা বললে আজ…

    ভাবানুবাদ : লেখক

    ।। খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা।।

    মেয়েটি উন্মাদের মতো ভালোবেসেছিল আরেক উন্মাদকে। উন্মাদ নয়, দিব্যোন্মাদ! সে রাখাল বালকের মতো সহজ, সরল, সুন্দর একটি ছেলে যে ভেড়া চড়ানো আর ‘ওয়াঞ্জলি’ (বাঁশি) বাজানো ছাড়া আর কিচ্ছুটি জানত না।

    বহুদূর, সুন্দরী চিনাবের পাশে পাঞ্জাবের ছোটো জনপদ ‘খাজিয়ান ওয়ালা’ (বর্তমান তখত হাজারা, জিলা সরগোদা, পাকিস্তান) থেকে সে তশরিফ নিয়ে আসে এই জং প্রদেশে। ভারি দুঃখী সেই ছেলেটি। সম্পত্তির লোভে তার ভাইরা, ভাবীরা তাকে তাড়িয়ে দেয়। বাড়ি ছেড়ে এই দেশ, ওই দেশ ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছে ছিল ‘জং’-এ। সেই জং প্রদেশ, এক সময় যেখানে নিরলস সাধনা করেছেন সুলতান বাহুর মতো বিখ্যাত সুফিসাধক।

    সেখানেই দেখা হয় দুজনের। সুন্দরী সেই মেয়েটির বাবা চুচাক মিঁয়া জং অঞ্চলের প্রভাবশালী, ধনী জমিদার। ঘরছাড়া ছেলেটির দুর্দশা দেখে (অনেকের মতে মেয়েটির অনুরোধে) চুচাক মিঁয়া তাকে আস্তাবল সামলানোর কাজ দেয়। তাই ভালোবেসে করে সেই ছেলেটি। ঘোড়া, বকরি আর ভ্যের চরানো ছাড়া অবসরে ‘ওয়াঞ্জলি’ বাজাতে ভারি ভালোবাসত সে।

    মেয়েটি ভালোবেসে নাম দিয়েছিল ‘মুরলীওয়ালে’। কী অদ্ভুত জাদু সেই ছেলেটির বাঁশিতে। আহা, যেন শতসহস্র ঝরনার জল নেমে আসতো জং প্রদেশের উপত্যকায়। তার সেই বাঁশির প্রেমে পড়েছিল মেয়েটি। প্রেমে পড়েছিল চালচুলোহীন সেই ভাসা ভাসা চোখের ছেলেটির। সময় পেলেই চিনাবের পাশে দেখা যায় তাদের। ছেলেটি মনপ্রাণ উজাড় করে বাঁশি বাজাত আর সেই বাঁশির সুরে সাড়া দিয়ে সব কাজ ফেলে ছুটে আসত মেয়েটি। সে বুঝতেও পারেনি, কখন সেই সুরের পথ বেয়ে তারা স্পর্শ করেছিল একে অন্যের হৃদয়।

    কিন্তু সুখ বেশিদিন কারুর কপালে সয়না। একদিন ধরা পড়ে যায় তারা। মেয়েটির কুচুটে, লোভি চাচা কৈয়দো দেখে ফেলে তাদের। ভীষণ মারধোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় গরিব ছেলেটিকে। গ্রামের এক মৌলবির সঙ্গে শলাপরামর্শ করে মেয়েটির জোর করে বিয়ে ঠিক করে দেওয়া হয় সৈয়দা খ্যেরেয়া নামের অন্য একজনের সঙ্গে। এই খবর পেয়ে রাগে, দুঃখে, হতাশায় পাগল হয়ে যায় ছেলেটি। ভগ্নহৃদয় নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে অজানা পথে। অন্যদিকে মেয়েটিরও করুণ অবস্থা। সে তার ‘মুরলীওয়ালে’-কে ছাড়া আর কাউকে নিকাহ করতে চায় না। প্রেমিকের সঙ্গে বিচ্ছেদে মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে তার মাকে সে বলে—

    খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
    দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা…

    ‘হীর-রাঞ্জা’-র এরপরের গল্প সকলেরই জানা। কীভাবে বঙ্গের ‘কানফাটা’ সম্প্রদায়ের শৈব সন্ন্যাসী গোরক্ষনাথের সংস্পর্শে এসে যোগীতে পরিণত হয় রাঞ্জা, কীভাবে বাড়ির অমতে রুখে দাঁড়ায়ে হীর, বহুদিন বাদে আবারও মিলিত হবে তারা ও বিয়ের রাতে পারিবারিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিষ মাখানো লাড্ডু খেয়ে একসঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে প্রেমিক যুগল। পাকিস্তানের জং প্রদেশে পাশাপাশি মাটির গভীরে আজও শান্তিতে শুয়ে রয়েছে তারা।

    অবিভক্ত পাঞ্জাবের লোকসংস্কৃতিতে মিশে রয়েছে ‘হীর-রাঞ্জা’-র সেই অমর বিষাদ-প্রেমাখ্যান (Romantic Tragedy) যা আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছরেরও আগে ১৭৬৬ সালে রচনা করেছিলেন মহান কবি ও সুফিসাধক ওয়ারিশ শাহ (১৭২২-১৭৯৮)। পাঞ্জাবের লোককথায় যে তিনটি অমর আখ্যানের কথা পাওয়া যায় ‘হীর-রাঞ্জা’ তার অন্যতম। বাকি দুটি হল ‘সোহনী-মহিওয়াল’ ও ‘মির্জা-সাহিবা’। এই অমর আখ্যান তিনটির সূত্র ধরে কাঁটাতারের দুই-পাশের মানুষের সুখ-দুঃখ ভালোবাসা-বিচ্ছেদের ‘দাস্তান’ শুধু পাঞ্জাব প্রদেশেই নয়, সারাদেশ জুড়ে আজও মথিত।

    ‘হীর-রাঞ্জা’-র অমর প্রেমকথার সাক্ষী হয়ে আজও এই আখ্যান ও বিশেষ করে এই প্রচলিত গানটি (অনেকের মতে ওয়ারিশ শাহ-ই এর রচয়িতা) দুই দেশের ভালোবাসার মানুষদের মোহাচ্ছন্ন করে। পপুলার কালচারেও এই পাঞ্জাবি লোকগীতি তার প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। ১৯২০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত দুই দেশেই ‘হীর-রাঞ্জা’-র কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্র। প্রতিটি সিনেমাতেই ঠাঁই পেয়েছে এই লোকগীতিটি। চল্লিশ দশকে পাকিস্তানি লোকশিল্পী তুফৈল নিয়াজী-র কন্ঠে এই গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর একে একে নূরজাহান শামসাদ বেগম নিয়াজি ব্রাদার্স মেহদী হাসান তালাত মেহমুদ, নুসরত ফতেহ আলী খান থেকে শুরু করে হালের শাফাকাত আমানত আলী ও রেখা ভরদ্বাজ-এর মতো শিল্পীরা এই গানটিকে অভাবনীয় উৎকর্ষতার উচ্চতায় নিয়ে যান।

    মজার ব্যাপার, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বহুল পরিবর্তনও আসে গানটির কথা ও ভাষাতেও। প্রাচীন পাঞ্জাবি, গুরুমুখী বা শাহমুখী কখনও বিবর্তিত হয়েছে সিন্ধি, উর্দু আবার কখনও মিশেছে হিন্দী এমনকি খড়িবোলিতেও। কিন্তু তার ভাব বা সুরমাধুর্যে কোথাও ফাঁক পড়েনি। কী ভারত, কী পাকিস্তান আজও পাঞ্জাব প্রদেশের বহু পরিবারে বিয়ে-শাদির সময়ে এই গানটি গাওয়া হয়। গানের মাধ্যমে স্মরণ করা হয়, শ্রদ্ধা জানানো হয় সেইসব মানুষগুলিকে যাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও ত্যাগের কাহিনি যুগ যুগ ধরে মানুষকে ভালোবাসার আলোকিত পথে হাঁটতে শিখিয়েছে, দৃপ্তভাবে।

    না মাঈ না ভেজ মুঝে,
    ম্যায় নেহী জানা পরদেশ
    জিস রাঞ্জে সঙ্গ শ্বাস জুড়ি,
    উহ রাঞ্জা হ্যায় ইস দেশ রে…

    খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
    দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা।
    লোগ কহে উসে রাঞ্জা যোগী,
    মুঝ কো তো রব কা জামাল
    জানে না জানে লোগ না জানে
    উও জানে মেরা হাল, না মাঈ না ভেজ মুঝে…

    খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
    দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা।

    বনধ আঁখো সে রাহ দিখে না
    জো উহ জ্যোত জাগায়ী
    রাঞ্জা মেরা দিন ধরম হ্যায়
    রাঞ্জা হ্যায় কুল খুদাই, না মাঈ না ভেজ মুঝে…

    খ্যেরেয়াদে নাল ম্যায় নহী জানা
    দিল ভিচ রাঞ্জে দা খায়াল, নহী জানা।

    (আধুনিক পাঠ)

    ।। যব ছোড় চলে…।।

    ‘যব ছোড় চলে লখনৌ নগরী/তব হাল-এ-আদাম পর কেয়া হ্যায় গুজরি’। —মাঝেমাঝেই গানটা খুব মনে পড়ে।

    ওয়াজিদ আলি-র লেখা। লখনৌয়ের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তুখোড় ষড়যন্ত্রে ওউধ থেকে সুদূর কলকাতার মেটিয়াব্রুজে তাকে হাউস এরেস্ট করে ব্রিটিশরাজ। এরপর কোনদিন আর তাঁর প্রিয় লক্ষণাবতীর মুখদর্শন করতে পারেননি তিনি। যার বিয়েতে সে সময় সত্তর লক্ষ দিনার খরচ হয়েছিল, আজও পার্ক সার্কার্সে কাছিয়াবাগান কবরখানায় সবার অজান্তেই মাত্র সাত টাকার কাফান-এ ঘুমোচ্ছেন তিনি। কোথায়, তা কেউ জানে না। সাধের লখনৌ ছেড়ে চলে আসার সময় এই গজলটি লিখেছিলেন ‘মেটিয়াবুরুজের নবাব’।

    প্রিয় শহর, জন্মভূমি ছেড়ে আসার দুঃখ কষ্ট বেদনা এই অনবদ্য গজলটির পরতে পরতে গেঁথে রাখা। আজকাল কেন জানিনা এই গানটাই ঘুরে ফিরে আসছে মাথার মধ্যে। কাজে মন বসছে না। কেমন যেন প্রকাণ্ড, নিবিড় শূন্যতা মস্তিষ্কের অলিতে গলিতে। তবে কি কোথাও, আমাদের সবার মধ্যেই ওয়াজিদ আলি শাহ’-র প্রেতাত্মা কম বেশি লুকিয়ে? বিশেষ করে যারা আজও বিভিন্ন জীবিকার সূত্রে, অথবা গ্রাসাচ্ছাদনের লড়াইয়ে বহু বছর ঘরছাড়া।

    মা দুর্গার পিছুপিছু যারা অল্পদিনের জন্য হলেও ফিরে আসতে চায় নিজের ঘরে, নিবিড় সংসারে। বাড়ি ছেড়ে, প্রিয় মানুষকে ছেড়ে, স্বজন-পরিজনকে দূরে ছেড়ে থাকার কষ্ট তারা ভালোই জানে। তবু এ কটা দিন দূরত্বের কথা নাই বা হল বলা। নাই বা হল বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা একাকিত্বের দিবারাত্রির কাব্যচর্চা। একটা দিন শুধু উল্লাস, আনন্দ-মুখর মুর্হূত আর আপোষহীন ভালোবাসার কাছে সবটুকু জমা রাখা থাক। জানি, এই ‘মাহ ভাদর’ কাটবে একদিন। যথাসময়ে, অমোঘ অনিবার্যতায়। রুক্ষ প্রবাসী জীবন, বেঁচে থাকার লড়াই, কর্মব্যস্ততায় ‘ডুব দে রে মন কালী বলে’। আস্তে আস্তে আবার সঠিক অর্থতত্ত্বে নিমজ্জিত হবে এই প্রাণ। একেই তো বেঁচে থাকা বলে। এক পলকে মিলন, অন্য পলকে বিচ্ছেদ। আবারও কোনও নতুন শুরুর অপেক্ষায় এই শেষের কড়িকাঠ বেয়ে ঝুলতে থাকা। অনবরত, অবিচ্ছিন্নভাবে।

    এবার তবে ফেরার পালা। নতুন করে ‘ফেরার’ জন্য এই ফেরা। লাইন দিয়ে কারাগৃহের দিকে এগিয়ে চলেছে ওয়াজিদ আলি-র প্রেতেরা। এই মন্দ্র স্বেচ্ছা নির্বাসনের পথে আমিও। ঘন্টা বাজছে দূরে। ঘুমের মধ্যে আমি তা শুনতে পাই। অন্ধ অনুসরণ করে এগোতেই থাকি। একের পর এক মিলিয়ে আসতে থাকে মুখ। পরিচিতের, স্বজনের, শত্রু-মিত্রভেদে মানুষের দল। সবার আগে দাঁড়িয়ে আছেন ‘তিনি’। ওয়াজিদ নন, সেপাই মিউটিনির পাক্কা চার বছর পর তাঁর জন্ম। মেটিয়াবুরুজ নয়, কলকাতার জোড়াসাঁকোয়।

    এত রাতে কী করছেন কবি?

    ”বসন্ত কি এসে গেল?” তিনি শুধোন। ”কী কাণ্ড, শরৎকালই যে শেষ হল না এখনও! আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?” জিজ্ঞেস করি। ‘বহু যুগের ওপার হতে’ ভেসে আসে তার স্বর—”এ পরবাসে রবে কে…”

    আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকি সে ঘর ও বাহিরের মধ্যবর্তী শূন্যতায়। ফেরা, না ফেরার অনাদি মাঝখানে। ‘ওয়াজিদি গজল’ একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে রবি ঘরানায়। আমি তা তন্ময় হয়ে শুনি। দূরে কেউ গাইছে। ”যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে/এই নিরালায় রব আপন কোণে/যাব না এই মাতাল সমীরণে…”

    দূরে কোথাও বুক মোচড়ানো সুরে বেজে উঠছে এস্রাজ। আমি নয়, আমারই ছায়া ফিরে চলেছে ‘পরবাসে’।

    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমহাসিন্ধুর ওপার থেকে – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
    Next Article দ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো

    Related Articles

    প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    মহাসিন্ধুর ওপার থেকে – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    September 22, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.