Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভূমিকা – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প133 Mins Read0

    ৪. বাড়ির আবহাওয়া থমথমে

    ০৯.

    বিয়ের ব্যাপারে অদিতি সিতাংশুকে নাকচ করে দেবার পর থেকেই বাড়ির আবহাওয়া থমথমে হয়ে গিয়েছিল। নগেন মৃগাঙ্ককে ছুরি মারলে সেটা একেবারে বিস্ফোরণের পর্যায়ে চলে আসে। এই ঘটনার জন্য মৃণালিনীকে বাদ দিলে বাড়ির প্রতিটি মানুষ, বিশেষ করে মীরা আঙুল তুলে অদিতিকেই দায়ী করছে। শুধু তাই না, মা বাবা বড়দা এবং বউদিরা দিনরাত সমস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, চাঁপাকে বের করে দিতে হবে। সে এখানে থাকলে বাড়ির লোকেদের যে আরও মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে, এতে কারও এতটুকু সংশয় নেই। উটকো ঝামেলা ঘরে পুষে রেখে নিজেদের অকারণে বিপন্ন করতে কে-ই বা চায়?

    প্রচণ্ড জেদে গোটা বাড়ির বিরুদ্ধে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যায় অদিতি। যত চাপই আসুক, চাঁপাকে কিছুতেই তাড়িয়ে দিতে পারবে না। সে এ বাড়িতেই থাকবে।

    অদিতি বোঝাতে চেষ্টা করে, কেন তোমরা এত ভয় পাচ্ছ? লালবাজারে আমি কথা বলেছি, খুব শিগগিরই নগেনকে অ্যারেস্ট করা হবে। তাছাড়া দরকার হলে আমাদের বাড়িতে আমর্ড গার্ডের ব্যবস্থা করা যাবে।

    রমাপ্রসাদ বলেন, তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। আমাদের আত্মীয় না, স্বজন না, চেনা-জানাও না, এমন একটা মেয়ের জন্য ফ্যামিলি পিস ডিসটার্বড় হোক, এটা আমি একেবারেই চাই না। তুই ওকে যেখান থেকে এনেছিস সেখানে দিয়ে আয়।

    অদিতি বলে, না, কিছুতেই না। তার কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ফুটে বেরোয়।

    হেমলতা বলেন, খুব বাড়াবাড়ি করছিস বুবু।

    যে মায়ের গলা কোনোদিন কোনো কারণেই একটা বিশেষ সীমারেখার ওপর ওঠে না, হঠাৎ তাকে এভাবে বলতে দেখে হকচকিয়ে যায় অদিতি। সে বলে, মা, আমি একটা মেয়েকে বাঁচাতে চেষ্টা করছি। তুমি একে বাড়াবাড়ি বলছ।

    হেমলতা বলেন, ওকে বাঁচাতে গিয়ে যদি আমাদের কারও সর্বনাশ হয়ে যায়, সেটা কিছুতেই মানব না। ছুরিটা বাবলুর কাঁধে না লেগে বুকে লাগলে কী হত, আগে তার জবাব দে।

    অদিতি বুঝতে পারছিল, মৃগাঙ্ককে ছুরি মারার ঘটনায় হেমলতা ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন। এটা মায়ের আশঙ্কা এবং আবেগের ব্যাপার! যুক্তি-তর্ক বা সামাজিক দায়িত্ববোধের ব্যাপারগুলো তাঁর মাথায় কিছুতেই ঢোকানো যাবে না। ছেলেমেয়ে বা স্বামীর নিরাপত্তা তাঁর কাছে সবার ওপরে। সেখানে অন্য সমস্ত কিছুই তুচ্ছ।

    অদিতি জানে সে বাড়ি থেকে বেরুলেই চাঁপাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। তাই একটি মুহূর্তের জন্যও সে বাইরে যাচ্ছে না। সারাক্ষণই চাঁপাকে আগলে আগলে রাখছে।

    কিন্তু সে একটা চাকরি করে। ইচ্ছেমতো কলেজে ছুটি নিলে চলে না। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা এসে যাচ্ছে। অনার্সের কোর্স অর্ধেকটাই পড়ানো হয়নি। হাতে আর আছে মাত্র ছটি মাস। এর ভেতরে পুরো কোর্স শেষ করে দিতে হবে। রেগুলার ক্লাস ছাড়াও টিউটোরিয়াল ক্লাসগুলো রয়েছে। এখন একটা দিনও কলেজে না গেলে ছেলেমেয়েদের দারুণ ক্ষতি হয়ে যাবে।

    তবু দুটো দিন চাঁপাকে নিয়েই রইল অদিতি। কিন্তু আজ সকালে প্রিন্সিপ্যাল পাশের বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছেন, অদিতি যেন অবশ্যই কলেজে আসে। দু-দিন ক্লাস না হওয়ায় ছেলেমেয়েরা ভীষণ ক্ষুব্ধ। তারা প্রিন্সিপ্যালের ঘরে এসে খুব হইচই করেছে।

    অগত্যা, চাঁপাকে ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকতে বলে দশটা নাগাদ যখন অদিতি বেরুতে যাবে, চাঁপা ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করে, দিদি, আপনি কখন ফিরবেন?

    অদিতি বলে, পাঁচটার ভেতর। ক্লাস হয়ে গেলে এক মিনিটও দেরি করব না। সাবধানে থাকবে।

    আচ্ছা। কিন্তু

    বলো।

    আমার খুব ভয় করছে।

    চাঁপা আসায় বাড়িতে যে দমবন্ধ-করা যুদ্ধকালীন অবস্থা চলছে, সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি তার আছে। অদিতি ভরসা দিয়ে বলে, কীসের ভয়? আমি দুর্গাকে বলে যাচ্ছি তোমার ভাত দিয়ে যাবে।

    চাঁপা বলে, এভাবে কদিন আমাকে আগলে রাখবেন?

    এই প্রশ্নটার উত্তর জানা নেই অদিতির। সে বলে, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা যাচ্ছি।

    .

    কলেজে এসে পর পর দুটো অনার্স ক্লাস নিয়ে আগের দুদিনের যেসব ক্লাস নেওয়া হয়নি তার থেকে দুটো ক্লাস নিল। সে ঠিকই করে রেখেছে, রোজ একটা-দুটো করে একস্ট্রা ক্লাস নিয়ে মেক-আপ করে ফেলবে।

    একটানা চারটে ক্লাস নেবার পর স্টাফরুমে আসতেই অরুণা বলে, অদিতিদি, বিকাশবাবু তিনবার ফোন করেছেন। উনি অফিসে চারটে পর্যন্ত থাকবেন। তোমাকে রিং করতে বলেছেন। অরুণা এই কলেজে হিস্ট্রি পড়ায়, বিকাশকে চেনে।

    দুদিন বিকাশের সঙ্গে দেখা হয়নি। শুধু বিকাশ কেন, বাইরের সবার সঙ্গেই অদিতির যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই দুটো দিন সারাক্ষণ চাঁপাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে সে।

    স্টাফরুমের এক কোণে উঁচু একটা টুলের ওপর টেলিফোনটা রয়েছে। অদিতি উঠে সেখানে চলে যায়। বার তিনেক ডায়াল করার পর বিকাশকে ধরতে পারে সে।

    বিকাশ বলে, কী ব্যাপার, দুদিন তোমার দেখা নেই। কলেজে কাল-পরশু ফোন করেছিলাম। নারী-জাগরণ-এর অফিসে রোজ যাচ্ছি। কেউ কোনো খবর দিতে পারছে না। আজ অফিসে আসার পর রমেনের ফোন পেলাম। ও বলছিল তোমাদের বাড়িতে নাকি কারা রেইড করেছিল। কী হয়েছিল? তার কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠার ছাপ।

    মৃগাঙ্ককে ছুরি মারার ঘটনা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যা যা হয়েছে সংক্ষেপে সমস্ত জানিয়ে অদিতি বলে, বুঝতেই পারছ, কেন আমাকে বাড়িতে আটকে থাকতে হয়েছিল?

    হ্যাঁ। কিন্তু-

    কী?

    এভাবে কতদিন চলবে?

    যতদিন না সমস্যাটার কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

    কিন্তু ব্যাপারটা খুব কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল যে।

    অদিতি হাসে, সহজ সরল হলে সেটা আবার সমস্যা থাকে নাকি?

    অনিশ্চিতভাবে বিকাশ বলে, তা অবশ্য। একটু থেমে আবার বলে, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া খুব দরকার। জানো, হাউসিং বোর্ড থেকে কাল আমার, মানে আমাদের ফ্ল্যাটটার পজেশান দিয়েছে।

    হঠাৎ মৃদু উত্তেজনা অনুভব করে অদিতি। চাঁপার মুখটা বিদ্যুৎচমকের মতো এক পলক তার চোখের সামনে ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। বলে, এত তাড়াতাড়ি দিয়ে দিল?

    বিকাশ বলে, তুমি সেদিন বলার পর হাউসিং-বোর্ডে গিয়ে খুব ধরাধরি করেছি। বলেছি, ফ্ল্যাট না পেলে বিয়েটা আটকে যাচ্ছে বলতে বলতে তার গলা তরল এবং হালকা শোনায়।

    বিকাশের তারল্য বা লঘুতা অদিতির ওপর কোনো দাগ কাটে না। সে অন্যমনস্কর মতো বলে, একটা ভালো খবর দিলে।

    এখন ফ্ল্যাটটা তো সাজাতে হবে। কাল একজন ইন্টেরিওর ডেকরটরের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা মান্থলি ইনস্টলমেন্টে সবকিছু করে দিতে চাইছে। এই চান্সটা আমাদের নেওয়া উচিত। তবে–

    কী?

    কীভাবে ঘর সাজানো হবে, ওয়ার্ডরোব খাট ডাইনিং টেবিল–এ-সব কীরকম ডিজাইনের হবে, কোন ঘরে কী রাখা হবে, তুমি বলে না দিলে ডেকরেটর কিছু করতে পারবে না। তোমার সঙ্গে ডেকরেটরের কথা হওয়া দরকার। বেস্ট হত, তুমি যদি এরমধ্যে সময় করে একদিন ফ্ল্যাটে আসতে, ডেকরেটরকেও তখন আসতে বলতাম। কবে আসতে পারবে?

    ঠিক বলতে পারছি না। যাবার আগে তোমাকে ফোন করব।

    ফোনটা একটু তাড়াতাড়িই কোরো।

    আচ্ছা

    আরেকটা কথা, অমিতাদি তোমার জন্যে ওরিড। তাঁকে একটা রিং কোরো। আজ তোমার ফোন না পেলে কাল উনি তোমাদের বাড়ি যাবেন।

    অমিতাদি বাড়িতে এলে খুব ভালো লাগবে। অবশ্য আমি এক্ষুনি ওঁকে ফোন করছি।

    রাখলাম—

    ঠিক আছে।

    এবার ইউনিভার্সিটিতে ফোন করে একবারই অমিতাদিকে পেয়ে যায় অদিতি।

    সব শোনার পর অমিতাদি বলে, খুব বিপদ হল তো।

    কণ্ঠস্বরে মনে হয় অমিতাদি খুবই উদ্বিগ্ন। অদিতি বলে, তা একটু তো হবেই। যা চলছে তার বিরুদ্ধে গেলে কেউ কি তা মেনে নিতে চায়? প্রবলেম যখন এসেছে তখন ফেস করব।

    একটা কথা বলব অদিতি?

    বলুন না—

    তুমি চাঁপাকে ওদের বস্তিতে পাঠিয়ে দাও।

    অদিতির মনে হয়েছিল, ঠিক এমনই কিছু একটা বলবেন অমিতাদি। আগেও তিনি এবং নারী-জাগরণ-এর আরও অনেকেই এ-জাতীয় পরামর্শ দিয়েছে। বাড়ির লোকেরা তো চাঁপাকে বের করে দেবার জন্য প্রথমদিন থেকেই তার ওপর প্রচণ্ড চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

    অমিতাদির কথায় উত্তেজিত হয় না অদিতি। খুব শান্ত গলায় বলে, এখন আর তা সম্ভব না। আমি যখন ওকে বস্তি থেকে নিয়েই এসেছি, শেষপর্যন্ত দেখতে চাই।

    ফাইট টু ফিনিশ?

    রাইট।

    একটা মেয়ের জন্যে নাহয় তুমি লড়াই করলে, কিন্তু আমাদের সোসাইটিতে চাঁপার মতো হাজার হাজার মেয়ে রয়েছে। তাদের সবার জন্যে তো এই মুহূর্তে কিছু করতে পারছ না।

    এই কথাগুলোও নতুন না। আগেও কয়েকজনের মুখে শুনেছে অদিতি। সে বলে, একজনকে দিয়েই শুরু করা যাক না। যদি তেমন কিছু করে উঠতে পারি, অনেকেই এগিয়ে আসবে।

    একটু চুপ করে থাকার পর অমিতাদি বলেন, তুমি নারী-জাগরণ-এর অফিসে আসতে পারবে?

    অদিতি বলে, যত তাড়াতাড়ি পারি। বস্তির সেই সাভের কাজটা সবে আরম্ভ করেছিলাম। চাঁপার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলে ওটা আবার নতুন করে স্টার্ট করতে হবে।

    কিন্তু এখানে নগেন থাকে-অমিতাদির গলা শুনে মনে হয় তিনি বেশ চিন্তান্বিত।

    থাক না। ক্রিমিনালরা বেসিক্যালি কাওয়ার্ড হয়। ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলে পৃথিবীতে কোনো কাজই করা সম্ভব না।

    ঠিক আছে, তুমি এলে এ নিয়ে কথা হবে। আমাদের মেম্বাররা তোমার জন্যে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে।

    ফোন নামিয়ে আর দেরি করে না অদিতি। ব্যাগ এবং ছেলেমেয়েদের অ্যানসার পেপারের একটা বান্ডিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

    .

    ১০.

    বাড়ির কাছে এসে গেটের পাশে চাঁপাকে বসে থাকতে দেখে থমকে যায়। ভয়ে এবং আশঙ্কায় সিঁটিয়ে আছে মেয়েটা।

    কী হতে পারে চাঁপার? কেন সে রাস্তায় বসে আছে? তবে কি তাকে নিয়ে বাড়িতে নতুন করে কোনো ব্যাট হয়েছে? ঝাঁক বেঁধে এইসব প্রশ্ন অদিতিকে বিচলিত এবং উদ্বিগ্ন করে তোলে।

    প্রায়ই দৌড়েই সে চাঁপার কাছে চলে আসে। বলে, তুমি এখানে।

    চাপা উত্তর দেয় না। তার ঠোঁটদুটো শুধু কাঁপতে থাকে এবং চোখ জল ভরে যায়।

    চাঁপাকে হাত ধরে টেনে তোলে অদিতি। প্রবল উৎকণ্ঠায় জিগ্যেস করে, কী হয়েছে?

    চাঁপা এবারও কিছু বলে না, মুখ নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

    অদিতি আবার বলে, কী হল, কথা বলছ না কেন?

    ভাঙা ভাঙা ঝাপসা গলায় এবার চাঁপা বলে, বড়দা, বাবা আর বউদিরা আমাকে বার করে দিয়েছে।

    অদিতি চমকে ওঠে, কখন?

    আপনি কলেজে যাবার পর।

    তারপর থেকে এখানে বসে আছ?

    হ্যাঁ।

    অদিতি দ্রুত বাঁ-হাতের কবজি উলটে ঘড়িটা দেখে নেয়। তিনটে বেজে কুড়ি। সে বেরিয়েছে দশটায়। তার মানে পাঁচ ঘণ্টা কুড়ি মিনিট মেয়েটা রাস্তায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

    অদিতি জিগ্যেস করে, আমি বেরুবার পর কোনো গোলমাল হয়েছিল কি?

    না।

    তা হলে তোমাকে বের করে দিল যে?

    জানি না। হঠাৎ ওনারা এসে দরজা খুলতে বলল। আমি ভয়ে ভয়ে খুলে দিলাম। ওনারা বলল, এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাও। নইলে পুলিশ ডাকব। পুলিশের নামে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তবু বললাম, ছোটদি আমাকে এখানে থাকতে বলেছে। শুনে ওনারা রেগে গিয়ে এত গালাগাল দিতে শুরু করলে যে থাকতে সাহস হল না। অবশ্যি

    কী?

    পাশের ঘর থেকে পিসিমা সমানে বলে যাচ্ছিল আমাকে যেন তাড়িয়ে না দেয়। কিন্তু তেনার বিছানা ছেড়ে নামার ক্ষ্যামতা নেই। এদিকে বস্তিতে যে ফিরে যাব, সে রাস্তাও বন্ধ।

    শুনতে-শুনতে মুখ শক্ত ওঠে অদিতির। পঙ্গু শয্যাশয়ী পিসিমা ছাড়া বাড়ির প্রতিটি মানুষ চাঁপার বিরুদ্ধে। তার জন্য বিন্দুমাত্র সহানুভূতি কারও নেই। এদিকে সারাক্ষণ তাকে পাহারা দিয়ে বাড়িতে বসে থাকার মতো পর্যাপ্ত সময় অদিতির নেই। তার কলেজ আছে, নারী-জাগরণ আছে, বাইরে হাজার রকম কাজ আছে। তাকে বেরুতেই হবে। যদি জোর করে চাঁপাকে আবার বাড়িতে নিয়েও যায়, সে যখন বাইরে বেরুবে, বাবা দাদা এবং বউদিরা নিশ্চয়ই ফের তাড়িয়ে দেবে। তাতে তিক্ততা আর অশান্তিই শুধু বাড়বে।

    রাস্তায় দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ ভেবে ভবিষ্যৎ কার্যসূচি ঠিক করে নেয় অদিতি। কেন না সে জানে, বিকেল চারটে পর্যন্ত আজ অফিসে থাকবে বিকাশ। তার আগেই তাকে ফোন করা অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া বাড়ির লোকেদের সঙ্গে তার বোঝাঁপড়া আছে। যাকে বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছে তাকে সবাই মিলে তাড়িয়ে দেবে, এটা সে কিছুতেই মেনে নেবে না। অন্তত একটা জোরালো প্রতিবাদ করতেই হবে।

    অদিতি বলে, তুমি এখানেই দাঁড়াও। আমি আসছি।

    চাঁপা ভীরু গলায় বলে, দিদি একটা কথা বলব?

    বলো

    আমার জন্যে বাড়িতে গিয়ে রাগারাগি করবেন না।

    চাঁপার মনোভাব বুঝতে অসুবিধে হয় না। ইদানীং এ বাড়িতে যেসব অশান্তি এবং দুর্ঘটনা ঘটেছে তার কারণ সে। এজন্য মেয়েটা লজ্জায় সঙ্কোচে একেবারে কুকড়ে আছে।

    অদিতি বলে, ঠিক আছে, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। বলে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। তারপর পেছন দিক দিয়ে পাশের বাড়ি চলে যায়। প্রথমে বিকাশকে ফোন করা দরকার।

    এক ঘন্টা আগে যার সঙ্গে কথা হয়েছে, এত অল্প সময়ের মধ্যে আবার তার ফোন পেয়ে বেশ অবাকই হয়ে যায় বিকাশ। বলে, কী ব্যাপার!

    অদিতি বলে, চারটের সময় তুমি তো বেরিয়ে যাবে?

    হ্যাঁ। আমাদের বাড়িতে আমার যে অংশটা রয়েছে সেটা দাদাকে বিক্রি করে দিচ্ছি। ওই ব্যাপারে আমাদের ল-ইয়ার এগ্রিমেন্ট ড্রাফট করে রেখেছেন। সেটা দেখতে যাব।

    মুশকিল হল। আজ ল-ইয়ারের কাছে না গিয়ে যদি কাল যাও, খুব অসুবিধে হবে?

    কেন?

    তোমার সঙ্গে আজ আমার দেখা হওয়াটা ভীষণ জরুরি।

    হঠাৎ কী হল? কিছুক্ষণ আগে যখন কথা বললাম তখন তো এত আর্জেন্সির কথা জানাওনি।

    অদিতি বলে, হঠাৎ নতুন একটা ডেভলাপমেন্ট হয়েছে।

    কী ডেভলাপমেন্ট? বিকাশের কণ্ঠস্বরে একই সঙ্গে উৎকণ্ঠা এবং আগ্রহ।

    ফোনে বলা যাবে না। দেখা হলে শুনো।

    ঠিক আছে, ল-ইয়ারকে ফোন করে দিচ্ছি, কালই যাব। এখন বলল, আমাকে কী করতে হবে?

    তুমি অফিস থেকে সোজা গলফ গ্রিনের নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাও। আমি ঘণ্টাখানেকের ভেতর ওখানে পৌঁছে যাব।

    আচ্ছা।

    ফোন নামিয়ে অদিতি নিজেদের বাড়িতে আসে। বাবা মা বড়দা এবং দুই বউদি দোতলাতেই ছিল।

    অদিতি তীব্র গলায় বলে, এ-বাড়িতে আমার কি সামান্য অধিকারও নেই?

    বরুণের চোখ কুঁচকে যায়। সে বলে, তার মানে?

    আমি একটা অসহায় মেয়েকে আমার ঘরে এনে রাখলাম, আর তোমরা তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলে?

    আমাদের ফ্যামিলির সিকিউরিটি নষ্ট হয়, এ হতে দেওয়া যায় না।

    অদিতির মাথার ভেতর কোথায় যেন বারুদের স্তূপে আগুন ধরে যায়। সে বলে, আর তোমরা ফ্যামিলির জন্যে কী করতে যাচ্ছ? একটা বজ্জাত ডিবচের কাছে আমাকে বেচতে যাচ্ছিলে? আমার ধারণা টাকার জন্যে ওই লোকটা এ বাড়ির সবাইকে পথে বসাবে। আর তার জন্যে তোমরা দায়ী।

    রমাপ্রসাদ গলা চড়িয়ে বলেন, এভাবে তুমি কথা বলবে না বুবু। বড়দের সম্মান দিতে শেখো–

    বড়দের উচিত এমন দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাতে ছোটরা সম্মান করতে বাধ্য হয়। সে যাক, একটা পরিষ্কার কথা জানতে চাই, তোমরা চাঁপাকে এখানে থাকতে দেবে কিনা–

    না, কিছুতেই না। আমাদের নিজেদেরই যথেষ্ট প্রবলেম আছে। চাঁপা থাকা মানেই নিত্যনতুন ঝামেলা।

    ঠিক আছে, তাহলে আমাকেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়।

    হেমলতা ওধার থেকে চেঁচিয়ে ওঠেন, কী বলছিস বুবু? তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল?

    রমাপ্রসাদ বলেন, একটা উটকো মেয়ের জন্যে কেন এত জেদ ধরে আছিস?

    অদিতি বলে, বাবা, শুধু চাঁপার জন্যেই না, আমার নিজের জন্যেই আমাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। আমার অজান্তে যেদিন তোমরা আমাকে একটা বদমাসের হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিলে সেদিনই ভেবেছিলাম এই পরিবেশে থাকা ঠিক না। চাঁপা আসার পর তোমরা যা করলে তাতে ডিসিশানটা নিতেই হল।

    হেমলতা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে অদিতির দুই হাত ধরে বলেন, কোথাকার কে একটা মেয়ে, তার জন্যে বাপ-মা, বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যাবি বুবু? বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন।

    মায়ের কষ্টটা খুবই আন্তরিক। নরম গলায় অদিতি বলে, চাঁপার জন্যে না, আমার নিজের জন্যে বাড়ি ছাড়ছি মা।

    অদিতিকে হেমলতার মতো কে আর বেশি চেনে। যেমন জেদি তেমনি একগুঁয়ে। সিদ্ধান্ত যা সে নিয়েছে সেখান থেকে তাকে ফেরানো যাবে না।

    হেমলতা ব্যাকুল হয়ে বলেন, কোথায় যাবি তুই?

    এই মুহূর্তে বাড়ির আবহাওয়া যেরকম তাতে বিকাশের নাম বললে মারাত্মক কিছু ঘটে যাবে। অদিতি বলে, পরে জানাব।

    এরপর রমাপ্রসাদ, বন্দনা, এমনকী মীরা আর বরুণও অদিতিকে আটকাবার চেষ্টা করে। তারা বলে, এভাবে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ভালো দেখায় না, লোকের কাছে মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না, ইত্যাদি। কিন্তু অদিতি অনড় থাকে। সে বলে, কাল-পরশু এসে আমার জিনিসপত্র নিয়ে যাব।

    হেমলতা বলেন, তুই কি এ-বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করে দিলি বুবু?

    কে বললে শেষ করে দিলাম? দু-চারদিন পর পর এসে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে যাব। বলে আর দাঁড়ায় না অদিতি। সোজা তেতলায় গিয়ে একটা সুটকেসে কিছু জামা-কাপড়, ব্রাশ পেস্ট, এমনি টুকিটাকি দরকারি জিনিস পুরে মৃণালিনীর সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে পড়ে।

    গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটে আগে আর আসেনি অদিতি। তবে বিকাশের কাছ থেকে ঠিকানাটা জেনে নিয়েছিল। চাঁপাকে সঙ্গে করে খুঁজে খুঁজে ফ্ল্যাটটা যখন সে বের করল, কলকাতা মেট্রোপলিসের ওপর সন্ধে নামতে তখন আর বেশি দেরি নেই।

    এখনও কলিংবেল লাগানো হয়নি। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে মুখোমুখি দাঁড়ায় বিকাশ। অদিতিরা পৌঁছুবার আগেই সে এখানে এসে বসে আছে। দারুণ খুশিতে তার চোখমুখ ঝকমক করছে। অদিতির জন্য অসীম ধৈর্য নিয়ে চার-পাঁচটা বছর সে অপেক্ষা করেছে। এত দিনে কাম্য নারীটি নিজের থেকেই তার কাছে ধরা দিল।

    হেসে হেসে বিকাশ বলে, এসো এসো। বলতে বলতেই অদিতির পেছনে চাঁপাকে দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে এক ফুয়ে আলো নিভিয়ে দেবার মতো তার মুখ কালো হয়ে যায়। নিরুচ্ছাস গলায় এবার বলে, এ কি, চাঁপাকেও নিয়ে এসেছ!

    চাঁপা সে এখানে কতটা অবাঞ্ছিত, মুহূর্তে টের পেয়ে যায় আদিতি। সে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়েই বলে, ওর জন্যেই আজ বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম। এখন বলো ভেতরে ঢুকব কি ঢুকব না?

    বিকাশ লজ্জা পেয়ে যায়। শশব্যস্তে অদিতির হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে বলে, কী আশ্চর্য, এসো। প্লিজ

    ভেতরে যেতেই অদিতি দেখতে পায় বসবার ঘরে খানতিনেক চেয়ার পাতা রয়েছে। এগুলোও সে আশা করেনি। চেয়ার দেখিয়ে জিগ্যেস করে, পেলে কোথায়?

    তুমি আসবে বলে পাশের ফ্ল্যাট থেকে চেয়ে এনেছি। কিন্তু

    বলো–

    তুমি তো বললে বাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছ। এখানে খাট, বিছানা রান্নাবান্নার ব্যবস্থা কিছুই নেই।

    ওসব কোনো প্রবলেম না।

    একটু ভেবে বিকাশ বলে, হঠাৎ এভাবে চলে এলে। আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।

    উত্তর না দিয়ে অদিতি চাঁপাকে অন্য একটা ঘরে রেখে ফিরে আসে। বলে, এত হেস্টি ডিসিশান নিতে অবাক হয়ে গেছ-না?

    তা তো হয়েছিই।

    এবার সব ঘটনা জানিয়ে অদিতি জিগ্যেস করে, এ ছাড়া আমি আর কী করতে পারতাম বলো?

    খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে বিকাশ। অদিতির একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে গাঢ় গলায় বলে, তুমি তো জানো এই দিনটার জন্যে কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি। কিন্তু ওই চাঁপাও আমাদের লাইফে অনেক সমস্যা নিয়ে আসবে। অকারণে অশান্তি, টেনশান, থানা-পুলিশ! ওর হাজব্যান্ড লোকটা একটা জঘন্য ক্রিমিনাল

    আমার জন্যে ওকে মেনে নাও। প্লিজ বিকাশ–অদিতি বিকাশের মুখের দিকে স্থির চোখে তাকায়।

    দ্বিধান্বিতভাবে বিকাশ বলে, ঠিক আছে।

    বিকাশ রাজি হয়েছে বটে, তবু অদিতির মনে হয় সবটাই বোধহয় ঠিক নেই। কোথায় যেন অদৃশ্য একটা কাঁটা থেকেই যাচ্ছে। অবশ্য বিকাশের দিকটাও ভেবে দেখা দরকার! নারী সচেতনতা, নারীর মর্যাদা রক্ষা–এইসব জরুরি ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু যে নতুন বিয়ে করবে সে কখনোই চাইবে না স্ত্রীর সঙ্গে একটি বিপজ্জনক এবং স্থায়ী সমস্যা এসে হাজির হোক।

    বিকাশ এবার বলে, চলো, ফ্ল্যাটটা তোমাকে দেখাই। তারপর খাওয়া এবং ঘুমের ব্যবস্থা করা যাবে।

    মোট তিনটে বেড রুম, একটা বড় হল, দুটো বাথরুম, কিচেন, ব্যালকনি, দেওয়ালে এবং সিলিংয়ে টাটকা পেইন্টের গন্ধ, মোজেক-করা ঝকঝকে ফ্লোর-সব মিলিয়ে ফ্ল্যাটটা চমৎকার।

    দেখা হয়ে গেলে বিকাশ জিগ্যেস করল, কি, পছন্দ হয়েছে?

    অদিতি ঘাড় হেলিয়ে দেয়, হ্যাঁ।

    এবার বাজারে যাওয়া যাক। একটা কথা ভাবছি—

    বলো

    যতদিন না খাট-টাট কেনা হচ্ছে ডেকরেটরদের কাছ থেকে বালিশ তোষক মশারি-টশারি ভাড়া করে আনলে কেমন হয়?

    আমিও ঠিক সেই কথাই ভেবেছি।

    চাঁপাকে ফ্ল্যাটে রেখে অদিতি এবং বিকাশ বাজারে চলে যায়। ডেকরেটরকে বিছানা-টিছানা পাঠাতে বলে কিছু স্টেনলেস স্টিলের বাসন এবং কাপ-প্লেট কেনে। তাছাড়া কেরোসিন স্টোভ, দশ লিটার কেরোসিন, চাল, ডাল, চিনি, জেলি, মাখন, চা, দুধের টিন, কিছু আনাজ, মশলা, বাদাম তেল ইত্যাদি কিনে ফিরে আসে।

    আপাতত জোড়াতালি দেওয়া অস্থায়ী সংসার পাতা যাক। পরে ধীরেসুস্থে সব গুছিয়ে নেওয়া যাবে।

    ফিরেই স্টোভ ধরিয়ে চা করতে বসে যায় অদিতি। সেই কখন নাকেমুখে গুঁজে কলেজে ছুটেছিল। বাড়ি ফেরার পর ক্রমাগত এমন সব নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেছে নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যায়নি।

    এতক্ষণে দম বন্ধ করা নাটকের পর টান-টান স্নায়ুগুলো এখন আলগা হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে এক কাপ চা না পেলে মাথা ছিঁড়ে পড়ছে। তা ছাড়া খিদেও পেয়েছে প্রচণ্ড।

    ক্ষিপ্র হাতে তিনজনের মতো চা এবং টোস্ট করে নেয় অদিতি। তার আর বিকাশের চায়ের কাপ-টাপ নিয়ে সে চলে আসে বাইরের ঘরে। চাঁপা কিচেনে বসেই খাবে।

    চায়ে একটা চুমুক দিয়ে হেসে ফেলে বিকাশ। বলে, এমন ড্রামাটিকালি কেউ সংসার শুরু করেছে কিনা, আমার অন্তত জানা নেই।

    হালকা শব্দ করে অদিতিও হাসে, না।

    এলোমেলো কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বিকাশ বলে, তুমি এসেছ, মোস্ট ওয়েলকাম। কিন্তু একসঙ্গে জীবন শুরু করার আগে একটা খুব ইম্পর্টান্ট ফরমাল ব্যাপার রয়েছে। সেটা সেরে নেওয়া দরকার।

    বিয়ের কথা বলছ?

    হ্যাঁ। মানে সামাজিক রেকগনিশনের কথাটাও তো ভাবতে হয়।

    অদিতি হাসে, লোকনিন্দার ভয় তোমার তাহলে আছে।

    বিকাশ বিব্রতভাবে বলে, মানুষের মধ্যে থাকতে হলে কিছু কিছু প্রথা তো মানতেই হয়, যখন বিয়ের সাবস্টিটিউট আমরা ভেবে উঠতে পারিনি এখনও। তোমার সিঁথিতে সিঁদুর-চিঁদুর না দেখলে চারপাশের লোক আজেবাজে কমেন্ট করবে

    তোমার কি ধারণা, বিয়ের পর আমি সিঁদুর পরব? ওটা বুঝি সাধু স্ত্রীর সার্টিফিকেট?

    তা বলছি না। ওটা বহুকালের সিস্টেম। তাহলে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে নোটিশ দিই?

    ওসব পরে ভাবা যাবে। সিঁদুর, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ, এ নিয়ে এখন মাথা খারাপ করার দরকার নেই। সারাদিন চাঁপা আর আমার ওপর দিয়ে যা গেছে তাতে আমাদের রেস্ট দরকার।

    বিকাশ সংকোচ বোধ করে। বলে, সরি! একটু থেমে আবার শুরু করে, একটা কথা ভেবে দেখলাম।

    বলো।

    যতদিন না আমাদের বিয়েটা হচ্ছে, আমি ভবানীপুরের বাড়িতে থেকে যাব। তোমরা এখানে থাকবে।

    তুমিও এখানে থাকলে, আমার আপত্তি নেই। অবশ্য যদি বাড়িতে থাকাটা খুব জরুরি হয় তাহলে আলাদা কথা।

    খানিকটা চুপচাপ।

    তারপর অদিতি ফের বলে, তুমি নিশ্চয়ই আমার বদনামের কথা ভাবছ—

    বিকাশ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বলে, হ্যাঁ, মানে

    ওসব আমি গ্রাহ্য করি না। তোমার আর আমার মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা বড় ব্যাপার। বিয়েটা তো হাতেই রইল। এক সময় ওটা করে ফেললেই হবে। তার চেয়ে এখন বড় ব্যাপার হল, চাঁপার জন্যে এমন কিছু করে দেওয়া যাতে অন্যের ওপর নির্ভর না করে, নিজের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।

    হুঁ। অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ে বিকাশ।

    .

    ১১.

    দেখতে দেখতে দশটা দিন কেটে যায়।

    গলফ গ্রিনে আসার পরদিন সকালেই অদিতি লালবাজারে সৈকতকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, সে এখন থেকে এখানেই থাকবে। যদি জরুরি কোনো খবর থাকে তার কলেজে যেন ফোন করে সৈকত। নইলে গলফ গ্রিনে লোক পাঠিয়ে যোগাযোগ করতে হবে।

    সৈকত সেদিন একটা দরকারি খবর দেয়। নগেনকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তবে তাকে বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না। কেন না লোকটার পেছনে একজন পাওয়ারফুল রাজনৈতিক দাদা রয়েছেন। নগেন তাঁর জন্যে জান দিয়ে ইলেকশানের সময় খাটে। কাজেই দাদাটি তার প্রভাব খাঁটিয়ে যেন-তেন প্রকারে নগেনকে পুলিশের কবজা থেকে বের করে আনবেনই। তবে অদিতি বা চাঁপার ভয় নেই। সে যাতে বড় রকমের গোলমাল বাধাতে না পারে, ব্যক্তিগতভাবে সেদিকে নজর রাখবে সৈকত।

    তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অদিতি ভেবেছে, লালবাজারে তার জানাশোনা না থাকলে নগেন যে তাকে অতিষ্ঠ করে তুলত, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।

    এই দশ দিনে নানা ঘটনা ঘটে গেছে।

    এর মধ্যে একদিন বালিগঞ্জে নিজস্ব জিনিসপত্র আনতে গিয়েছিল অদিতি। হেমলতা সেদিন তার দুই হাত নিজের বুকের ভেতর টেনে নিয়ে ব্যাকুলভাবে বলেছিলেন, তুই কোথায় আছিস বুবু-আমাকে বলতেই হবে।

    মায়ের কষ্ট, দুর্ভাবনা এবং ব্যাকুলতা যে কতটা আন্তরিক তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি অদিতির। সে বলেছে, তোমাকেই তো বলব মা, কিন্তু পরে। গাঢ় গভীর আবেগে তার গলা বুজে এসেছিল।

    পরে না, এখনই বল।

    একটু ভেবে অদিতি মুখ নামিয়ে বলেছে, গলফ গ্রিনে, বিকাশের ফ্লাটে।

    হেমতলা স্থির চোখে অদিতিকে লক্ষ করতে করতে বলেছেন, তোদের বিয়ে হয়ে গেছে?

    না মা।

    বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি পারো, করে ফেলো।

    যে কথাগুলো বিকাশকে অসংকোচে বলতে পেরেছিল অদিতি, মা-কে তা বলা যায়নি। সে বলেছে, এত তাড়া কী মা?

    হেমলতা বলেছেন, লোকসমাজে বাস করতে হলে ওটা দরকার বুবু। মানুষকে বাদ দিয়ে তো কেউ বাঁচতে পারে না। তাদের পছন্দ-অপছন্দ আর মতামতকে উপেক্ষা করলে কি চলে? বিয়েটা কিন্তু করে ফেলবে?

    চিরকালের দুর্বল শঙ্কিত মায়ের ভেতর থেকে অন্য এক মা বেরিয়ে এসেছিল যেন। তাঁর আচরণে কথাবার্তায় এতটুকু ভীরুতা নেই। যা রয়েছে তা হলে কর্তৃত্ব এবং দৃঢ়তা। অদিতি বলে, ঠিক আছে। তোমাকে একদিন গলফ গ্রিনে নিয়ে যাবে।

    আগে তোদের বিয়ে হোক, তার আগে নয়।

    রমাপ্রসাদ বরুণ মীরা এবং বন্দনার সঙ্গে দেখাও হয়েছিল। তারা কেউ অদিতির সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। শুধু প্রবল আক্রোশে তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছে।

    হাসপাতাল থেকে মৃগাঙ্ককে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছিল। অদিতি তার ঘরে গিয়ে জিগ্যেস করেছিল, এখন কেমন আছ ছোটদা?

    মৃগাঙ্ক খাটে শুয়ে ছিল। উত্তর না দিয়ে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরেছে। আর মীরা কর্কশ গলায় বলেছে, যথেষ্ট হয়েছে আর আহ্লাদের দরকার নেই।

    হেমলতাকে বাদ দিলে আর যিনি সেদিন সস্নেহ এবং স্বাভাবিক ব্যবহার করেছেনে তিনি মৃণালিনী।

    মৃণালিনী কাছে বসিয়ে পিঠে এবং মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে অদিতি কোথায় আছে, সেখানে আর কে কে থাকে ইত্যাদি নানা খবর খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছিলেন। তারপর জিগ্যেস করেছিলেন, হা-রে, বিকাশ ছেলেটা কেমন?

    অদিতি বলেছে, এখন পর্যন্ত ভালোই মনে হচ্ছে।

    বিয়ে হয়ে গেছে তোদের?

    না।

    সব দিক বুঝে বিয়ে করবি। পরে যেন আপসোস না করতে হয়।

    মৃণালিনীর জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি অন্য মেয়েদের থেকে একেবারে আলাদা। বিয়ের পর প্রচণ্ড ধাক্কায় তিনি আমূল বদলে গেছেন। যে সমাজে পুরুষের অবাধ প্রভুত্ব সেটা তিনি ঘৃণার চোখে দেখে থাকেন। পৃথিবীর কোনো পুরুষকেই তিনি শতকরা একশো ভাগ বিশ্বাস করেন না।

    অদিতি হেসে বলেছে, মা তো এক্ষুনি বিয়েটা সেরে ফেলার জন্যে চাপ দিচ্ছে। নইলে নাকি ভীষণ দুর্নাম রটে যাবে।

    মৃণালিনীকে এবার অসহিষ্ণু দেখিয়েছে। তিনি বলেছেন, না না, বউদির কথা মোটেও শুনবি না। আমাদের সময় মেয়েদের সুনাম আর সতীত্বের দাম ছিল। ও দুটোর জোরেই তাদের বিয়ের বাজারে বিকোতে হত। কিন্তু তুই একালের মেয়ে, সুন্দরী, সবচেয়ে বড় কথা চাকরি-বাকরি করিস। তোকে বিয়ে করার জন্যে কত ছেলে হাঁ করে আছে। কিছুদিন মেলামেশা করে দ্যাখ, বিকাশ ছেলেটা কেমন। যদি মনে হয় খাঁটি, বিয়ে করবি। নইলে কোনোমতেই না।

    তুমি একজন রিবেল পিসি।

    তাতে আমার কোনো সংকোচের কারণ নেই। জানবি ওটাই আমার আসল পরিচয়। যাক-গে, বাড়ির অন্যসব খবর বলো। সেই লোকটা মানে সিতাংশু ভৌমিক এখনও আসে?

    রোজ। তবে আগের মতো হই-চই আর হয় না। মনে হয়, কিছু একটা মতলব ওরা করছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। দুর্গাকে অবশ্য লাগিয়ে রেখেছি, ঠিক জেনে যাব।

    একটু চিন্তা করে অদিতি এবার বলে, আমি চলে যাবার পর সবাই তোমার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করছে?

    মৃণালিনী হাসেন, আগের চেয়ে খারাপ কিছু না। তোর মাকে বাদ দিলে সকলেই আমার মৃত্যু চায় কিন্তু অত সহজে আমি মরছি না।

    অদিতি বলে, আমি ঠিকানা লিখে কটা পোস্টকার্ড নিয়ে এসেছি। তেমন দরকার হলে চিঠি লিখে দুর্গাকে দিয়ে পোস্ট করিয়ে দিও।

    আচ্ছা। একদিন তোদের ফ্ল্যাটে আমাকে নিয়ে যাস।

    নিশ্চয়ই।

    এরমধ্যে নিয়মিত কলেজে গেছে অদিতি। রোজ চারটে কি পাঁচটা করে ক্লাস নিয়েছে। কলেজ থেকে গেছে নারী-জাগরণ-এর অফিসে। সেখান থেকে বিকাশ কৃষ্ণা হৈমন্তী বা রমেনকে সঙ্গে করে ঢাকুরিয়ার বস্তিতে গেছে।

    প্রথমদিকে অমিতাদিরা বাধা দিতে চেয়েছিলেন। তাঁদের ভয়, বস্তিতে অদিতি ফের গেলে গোলমাল হবে কিন্তু তাকে আটকানো যায়নি। যে কাজের দায়িত্ব সে নিয়েছে একটা ক্রিমিনালের ভয়ে তা মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার মানে হয় না।

    এদিকে সৈকত যা বলেছিল তা-ই ঘটেছে। অ্যারেস্ট করার পর নগেনকে ধরে রাখা যায়নি। রাজনৈতিক দাদাটি তাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। তবে আগের মতো অতটা মারমুখী উগ্র নেই নগেন। দূর থেকে অদিতির উদ্দেশে রোজই কিছু খিস্তিখেউড় দিয়ে এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে সে অদৃশ্য হয়ে যায়।

    নারী-জাগরণ-এর কাজের সঙ্গে সঙ্গে চাঁপার জন্য একটা কাজের চেষ্টা চলছে। অমিতাদি থেকে শুরু করে প্রতিটি মেম্বারই এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে।

    এর মধ্যে চমকপ্রদ যে ব্যাপারটা ঘটেছে তা এইরকম। প্রথম যেদিন অদিতি গলফ গ্রিনে আসে, সেই রাতটা ফ্ল্যাটে থাকেনি বিকাশ। ভবানীপুরে তাদের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু পরের দিন অফিস থেকে সোজা নারী-জাগরণ হয়ে গলফ গ্রিনে চলে আসে। তারপর থেকে এখানেই আছে।

    অদিতি বিকাশ এবং চাঁপা আপাতত তিনজন রাতে তিনটে বেডরুমে থাকে।

    এখানে আসার দিন পাঁচেক বাদে হঠাৎ একদিন দরজায় খুট খুট আওয়াজে দরজা খুলে সে অবাক। বিকাশ দাঁড়িয়ে আছে।

    অদিতি বলেছে, তুমি!

    বিকাশ বলেছে, আমার ঘরে চলো।

    বিকাশের আচ্ছন্ন চোখ, চাপা অথচ তীব্র কণ্ঠস্বর বুঝিয়ে দিয়েছে সে কী চায়। অদিতি শান্ত মুখে বলেছে, না।

    তুমি তো কোনোরকম বাজে সংস্কার মানো না। বিকাশ আরেকটু এগিয়ে এসেছিল।

    তা হয়তো মানি না, কিন্তু তুমি যা চাইছ মানসিক দিক থেকে আমি তার জন্যে এখনও প্রস্তুত হতে পারিনি।

    আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল বিকাশ। তারপর ঝুঁকে দুহাতে অদিতির মুখ তুলে ধরে গভীর আবেগে চুমু খায়। অদিতি বাধা দেয় না।

    .

    ১২.

    আরও কয়েক মাস কেটে যায়।

    এর মধ্যে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিকাশকে বিয়ে করেছে অদিতি। বলা যায় করতে হয়েছে। এই বিয়েটার জন্য প্রথম থেকেই মা প্রবল চাপ দিয়ে গেছেন। যখনই অদিতি বালিগঞ্জের বাড়িতে সবার খোঁজখবর নিতে গেছে হেমতলার এক কথা, এবার বিয়েটা করে ফ্যাল বুবু, আর দেরি করিস না। লোকে আজেবাজে কথা বলছে।

    বিয়ে বিয়ে করে মা প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন, রাগারাগি করেছেন, জেদ ধরেছেন। তিনি পুরোনো ধ্যানধারণার মানুষ, সংস্কার এবং চিরাচরিত প্রথা ভাঙার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। একটি পুরুষ এবং একটি নারী বিয়ে না-করে সমাজে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করবে, তাঁর কাছে এটা অভাবনীয়। তিনি মনে করেন এ ধরনের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অপবিত্র। তাঁর স্থির বিশ্বাস, বিয়ে না করে, একসঙ্গে থেকে অদিতিরা পাপ করেছে।

    হেমতলা যে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছিলেন, অদিতির বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। বিয়েটা সে নিশ্চয়ই করত, তবে আরও কিছুদিন পরে। মায়ের তাড়াতেই তাকে সব কাজ ফেলে একদিন ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে ছুটতে হয়েছিল।

    কিন্তু বিয়ের পর দ্রুত পালটে যেতে থাকে বিকাশ। তার ভেতর থেকে এমন একটা পুরুষ বেরিয়ে আসতে থাকে যে প্রচণ্ড রক্ষণশীল, অধিকারবোধে সচেতন, স্ত্রী যার কাছে ব্যক্তিগত প্রপার্টির মতো। যে মনে করে তার পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী স্ত্রী উঠবে বসবে চলবে ফিরবে। বৈধ আইনসিদ্ধ বিয়েটা যেন স্ত্রীর ওপর অবাধ প্রশ্নাতীত মালিকানা তার হাতে তুলে দিয়েছে।

    এ জাতীয় পুরুষ চারদিকে আকছার দেখা যায় এবং তাদের মেনেও নেওয়া হয়। সামাজিক প্যাটার্নটাই তো এইরকম। কিন্তু বিকাশের ভেতর পুরুষশাসিত সমাজের এমন একজন মারাত্মক প্রতিনিধি যে আত্মগোপন করেছিল, আগে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি অদিতি। সে একেবারে হকচকিয়ে যায়।

    বিয়ের পর থেকেই নারী-জাগরণ-এ যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে বিকাশ। সে চায় না অদিতিও ওখানকার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখুক। দেশে গভর্নমেন্ট আছে। রাজনৈতিক দল, সোশাল অর্গানাইজেশন, চ্যারিটেবল সোসাইটি–এসবের অভাব নেই। তারাই লাঞ্ছিত অপমানিত মেয়েদের কথা ভাবুক, তাদের দায়দায়িত্ব নিক। বিকাশ বা অদিতির মতো দু-একজন এ ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও চলে যাবে।

    বিকাশের জীবনদর্শন খুবই পরিষ্কার, সেখানে কোনোরকম গোঁজামিল নেই। সে চায় প্রচুর টাকা, অফিসে প্রোমোশন। গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটের তিন গুণ একটা ফ্ল্যাট বা সল্টলেকে বাংলো ধরনের বাড়ি, ঝকঝকে গাড়ি, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে হই-হুল্লোড়, দু-তিন বছর পর পর বিদেশ ভ্রমণ, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং আরামের বাইরে আর কোনো কিছু নিয়ে সে ভাবতে চায় না। তবে কটা বছর অসীম ধৈর্যে নারী-জাগরণ-এ সে যে ঘোরাঘুরি করেছে তার একমাত্র কারণ অদিতি।

    যাই হোক, অদিতি তার কথা শুনেছে ঠিকই কিন্তু নিজে যা করেছিল তা-ই করে গেছে। কলেজ, নারী-জাগরণ, বস্তিতে সার্ভে বা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্ট্রিট কর্নার মিটিং, এইসব কর্মসূচি থেকে তাকে এতটুকু সরানো যায়নি। এই নিয়ে বাড়িতে অশান্তি এবং টেনশান শুরু হয়েছে।

    চাঁপা এখনও তাদের ফ্ল্যাটে আছে। তাকে নিয়ে পুরোনো গোলমালটা থেকেই গেছে। তার উপযুক্ত কাজ আজ পর্যন্ত জোটানো যায়নি। তবে এ নিয়ে খুব একটা হই-চই করছে না বিকাশ। কেননা রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাড়ির যাবতীয় কাজই করে। তারা দুজন যখন বেরিয়ে যায়, সে ফ্ল্যাটে পাহারা দেয়। অবশ্য অদিতি যতক্ষণ থাকে, চাঁপাকে সাহায্য করে।

    আশ্রয় এবং চারবেলা খাওয়ার বদলে যার কাছ থেকে এত কাজ পাওয়া যায়, নিজেদের স্বার্থেই তাকে তাড়ানোর কথা তেমন করে আর বলে না বিকাশ। নগেন যদি আর হামলা-টামলা না করে হয়তো চাঁপা এখানে স্থায়ীভাবেই থেকে যাবে। তবে অদিতির একেবারেই তা ইচ্ছে নয়। চাঁপাকে ঝি খাটাবার জন্য সে বস্তি থেকে নিয়ে আসেনি। সসম্মানে স্বাধীনভাবে মাথা তুলে এই সমাজে বাস করার সুযোগ সে পাক, এটা সে চায়। সেজন্য চেষ্টার ত্রুটি নেই তার।

    এর মধ্যে হঠাৎ একদিন ফোন করে সৈকত জানিয়ে দিল, ট্রান্সফার হয়ে সে নর্থ-বেঙ্গল যাচ্ছে।

    সৈকত চলে যাবার দিন সাতেক পর একদিন সকালে দলবলসুদ্ধ নগেন হানা দিল। অকথ্য খিস্তি এবং চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে তারা। উদ্দেশ্য চাঁপাকে নিয়ে যাবে। বোঝ যায়, এতদিন সৈকত তাকে কন্ট্রোলে রেখেছিল। এখন সে আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

    কিন্তু এখনকার প্রতিবেশীরা মানুষ ভালো। তারা নগেনদের তাড়িয়ে দেয়।

    নগেনরা নতুন করে ঝামেলা করায় পুরোনো অশান্তিটা আবার চাড়া দিয়ে ওঠে। বিকাশ বিরক্ত মুখে বলে, ওকে তাড়াও

    অদিতি বলে, তাড়াবার জন্যে ওকে নিয়ে আসিনি।

    কিন্তু ওই অ্যান্টিসোশালটা ফের ঝঞ্জাট বাঁধালে কে সামলাবে? আমাকে দিয়ে ওসব হবে না।

    তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি করব।

    .

    এইভাবেই চলছিল।

    হঠাৎ একদিন রাত্তিরে খেতে খেতে বিকাশ বলে, একটা খবর শুনেছ?

    অদিতি মুখ তুলে তাকায়। বিকাশকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলে, কী খবর?

    তোমার দাদারা আর বাবা তোমাদের বাড়িটা বেচে দিতে যাচ্ছেন।

    অদিতি চমকে ওঠে, কে বললে?

    বিকাশ জানায়, একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিকের সঙ্গে তার জানাশোনা আছে। তার কাছেই শুনেছে, রমাপ্রসাদরা নাকি তাদের কোম্পানিকে বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে।

    অদিতি নিজের অজান্তেই জিগ্যেস করে, রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক কে? সিতাংশু ভৌমিক?

    না। অরুণোদয় ভট্টাচার্য। সিতাংশু ভৌমিক আবার কে?

    একজন কন্ট্রাক্টর। সে-ও বাড়ি-টাড়ি কেনে।

    ও।

    অদিতি বুঝতে পারে কাউকে না-জানিয়ে বাড়ি বেচে সিতাংশুর ধার শোধ করতে চাইছেন রমাপ্রসাদরা। সিতাংশুর কাছে বিক্রি করতে গেলে কিছুতেই এত টাকা পাওয়া যাবে না। যে টাকাটা সে জুয়া এবং ফাটকার জন্য ঋণ দিয়েছিল তার ওপর সামান্য কিছু দিয়ে বাড়িটা নির্ঘাত লিখিয়ে নেবে।

    বিকাশ আবার বলে, ও বাড়িতে তোমারও তো অংশ রয়েছে।

    অদিতি লক্ষ করে, বিকাশের চোখ চকচক করছে। তার স্নায়ুগুলো মুহূর্তে টান টান হয়ে যায়। সে বলে, হয়তো আছে। কেন?

    তোমার ভাগের টাকাটা পেলে সল্ট লেকে জমিটমির চেষ্টা করা যাবে। তারপর ছোটখাটো বাংলো টাইপের সুন্দর একটা বাড়ি

    বিকাশের কথাবার্তা, আচরণ অনেকদিন থেকেই পছন্দ হচ্ছে না অদিতির। এই মুহূর্তে ঘৃণায় তার ভেতরটা কুঁকড়ে যায়। লোকটা এত লোভী, আগে টের পাওয়া যায়নি।

    অদিতি উত্তর দেয় না। তবে বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা তার মাথায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। দু-এক দিনের ভেতর বালিগঞ্জে গিয়ে খোঁজখবর নিতে হবে।

    .

    যেদিন বিকাশ বাড়ি বিক্রির খবর দিল তার পরদিন দুপুরে অদিতি যখন কলেজে বেরুচ্ছে সেই সময় মৃণালিনীর চিঠি এল। লিখেছেন, চিঠি পেয়েই যেন অদিতি বালিগঞ্জে চলে যায়, তিনি খুবই বিপন্ন।

    আজ কলেজের পর ঢাকুরিয়া বস্তিতে যাবার কথা আছে। কিছুদিন হল, কাজটা খুব ঢিলেঢালা চলেছে। এভাবে চললে একটা বস্তির সার্ভে শেষ করতে পাঁচ বছর লেগে যাবে। এ ব্যাপারে স্পিড় আনতেই হবে। অদিতি ঠিক করে রেখেছিল, আজ কম করে পঁচিশ-তিরিশটি মেয়ের ইন্টারভিউ নেবে। কিন্তু এই চিঠির পর কিছুই করা সম্ভব না।

    কোনোরকমে কলেজে জরুরি ক্লাসগুলো নিয়ে বিকেলের দিকে বালিগঞ্জ চলে আসে। মৃণালিনী তাকে জানান, বাড়ি বিক্রির চক্রান্ত চলছে। যদি তা না করা যায়, মোটা টাকায় মর্টগেজ দেওয়া হবে। বাড়ির একটা অংশ মৃণালিনীর নামে দিয়ে গেছেন তাঁর বাবা–অদিতির ঠাকুরদা। তাঁর ওপর রীতিমতো জুলুম করা হচ্ছে যেন তিনি বিক্রি বা মর্টগেজে রাজি হন। নিরুপায় হয়েই শেষ পর্যন্ত অদিতিকে চিঠি লিখতে হয়েছে।

    সব শোনার পর অদিতি ট্যাক্সি ডেকে আনে। মৃণালিনীকে সে নিজের কাছে নিয়ে যাবে।

    রমাপ্রসাদরা আটকাতে চেষ্টা করেছিল, একরকম জোর করেই মৃণালিনীকে ট্যাক্সিতে নিয়ে তোলে অদিতি।

    .

    রাত্তিরে অফিস থেকে ফিরে মৃণালিনীকে দেখে কপাল কুঁচকে যায় বিকাশের।

    কী কারণে মৃণালিনীকে নিয়ে আসতে হয়েছে জানিয়ে অদিতি বলে, বলো তো, কী অন্যায় জোর করা হচ্ছে পিসির ওপর!

    বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে বিকাশ বলে, তা হলে টাকা আসবে কী করে? বাড়ি বেচলে তবে তো টাকা!

    অদিতি নিশ্চুপ। স্থিরচোখে তাকিয়ে থাকে।

    হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটায় বিকাশ। চিৎকার করে বলে, ভেবেছ কি–এটা ধর্মশালা, না রিফিউজি ক্যাম্প। যাকে খুশি এনে তুলছ! এসব এখানে চলবে না।

    অদিতি বিন্দুমাত্র বিচলিত বা অস্থির হয় না। গম্ভীর গলায় শুধু বলে, ঠিকই বলেছ। ভেবে দেখলাম আমারও এভাবে চলবে না। দু-চারদিনের ভেতরে চাঁপা, পিসিকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব।

    বিকাশ বলে, তোমাকে যাবার কথা তো বলিনি।

    অদিতি উত্তর দেয় না।

    .

    দিন সাতেক পর একটা বাড়ি ভাড়া করে চাঁপা মৃণালিনীকে নিয়ে যাদবপুরে চলে যায় অদিতি। সে বুঝতে পারছে, চারপাশে তার জন্য অসংখ্য রণক্ষেত্র সাজানো হয়েছে। যুদ্ধ ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই অদিতির।

    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসিন্ধুপারের পাখি – প্রফুল্ল রায়
    Next Article পূর্বপার্বতী – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }