Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভৌতিক পালঙ্ক

    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভৌতিক গল্প এক পাতা গল্প10 Mins Read0

    ভৌতিক পালঙ্ক

    অনেকদিন পর সতীশের সঙ্গে দেখা। বেচারা হন্তদন্ত হয়ে ভিড় ঠেলে বিকাল বেলা বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের বাঁ-দিকের ফুটপাথ দিয়ে উত্তর মুখে চলেছিল। সমস্ত আপিসের সবেমাত্র ছুটি হয়েছে। শীতকাল। আধো-অন্ধকার আধো-আলোয় পথ ছেয়ে ছিল। ক্লান্ত দেহে ছ্যাকরা গাড়ির মতো ধীরে ধীরে পথ ভেদ করে চলেছিলাম। সহসা সতীশকে দেখে ওর জামাটা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলাম— আরে সতীশ যে!

    সতীশ সবিস্ময়ে আমার পানে চেয়ে বলে উঠল— খগেন! মাই গড! আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম!

    বললাম— তার প্রমাণ আমাকে ধাক্কা দিয়েই তুমি চলে গেছিলে আর একটু হলে! ভাগ্যিস ডাকলাম!

    —সরি! আমি একটু বিশেষ ব্যস্ত।

    —তা সে বুঝতেই পারছি। তা, কোথায় চলেছ শুনি?

    —তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে। বেশিদূর নয়। যাবার পথে সব বলব।

    —আশ্চর্য!

    —’না’ বললে শুনব না। জোর করে নিয়ে যাবো।

    ছেলেবেলা থেকেই সতীশকে চিনি। কথা অনুযায়ী সে কাজ করে। আর শরীরে কিছু বল থাকায় প্রায় ক্ষেত্রে সে বলপ্রয়োগ করে স্বার্থসিদ্ধি করতে ভোলে না। অগত্যা তার সঙ্গে যেতে হল।

    তার গন্তব্য স্থান খুব নিকটেই ছিল এবং সে তার উদ্দেশ্য খুব সংক্ষেপেই ব্যক্ত করল। সেদিন সকালে খবরের কাগজে বেচা-কেনার কলমে একটি বিজ্ঞাপন ছিল

    একটি অতি আধুনিক এবং রহস্যজনক চীনদেশীয় খাট অধিক মূল্যদাতাকে বিক্রয় করা হইবে। জগতে ইহা অদ্বিতীয়। সুযোগ হারাইলে অনুশোচনা করিতে হইবে।

    ২/৩… স্ট্রিট।

    সতীশ তার পকেট থেকে বিজ্ঞাপনটি বার করে বলল— পড়ো।

    —বুঝলাম। তা ‘রহস্যজনক’ শব্দটার মানে কী?

    —ওইটেই তো আমায় ভাবিয়ে তুলেছে। কোনো হদিশ করে উঠতে পারছি না।

    সতীশ চলছিল রাস্তার নাম দেখতে দেখতে। হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠল— পেয়েছি! এই গলি!

    সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে সেই গলির পানে তাকিয়ে আমার সারাশরীরে কেন জানি না একপ্রকার শিহরণ জাগল। চীনাপল্লির চীনা আবহাওয়ায় রহস্যজনক খাট! সতীশের হাতটা ধরে বললাম— খাটে কাজ নেই সতীশ, চলো ফিরে যাই। আমার বাঙালি-খাট বেঁচে থাকুক।

    সতীশ প্রবল বেগে এক ঝাঁকানি দিয়ে উঠল— ভীতু কোথাকার! এতটা এগিয়ে এসে কখনো ফেরা যাবে না!

    গলির মোড়ের ডানপাশে একটা নিমগাছ ভূতের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। ওদিকের ডাস্টবিনের মধ্যে থেকে যতসব অখাদ্য-কুখাদ্যের উৎকট গন্ধ ভেসে আসছিল। অন্নপ্রাশনের ভাত যেন ঠিকরে বার হয়ে আসতে চাইল অসহ্য যন্ত্রণায়। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে কোনোগতিকে পথ চলতে লাগলাম।

    একটা দমকা বাতাস বিভ্রান্ত হয়ে আচমকা দক্ষিণ দিক থেকে ভেসে এসে আমাদের শরীরে যেন আছাড় খেয়ে পড়ল। মাথার ওপর দিকে কয়েকটা বাদুড় ডানার শব্দ করতে করতে উড়ে গেল। দুটো অভিভাবকহীন কুকুর এই অনধিকার প্রবেশকারীদের পানে চেয়ে বিশ্রী সুরে অভিযোগ করতে লাগল।

    পথে আর জন-মানবের চিহ্ন পর্যন্ত রইল না। পাশে একটি চীনা ডাক্তারের বহু পুরাতন সাইনবোর্ড। তার উপরকার নর-কঙ্কালের ছবিটি জীর্ণপ্রায়। কোথা থেকে একটি পিয়ানোর অস্পষ্ট সুর ভেসে আসছিল।

    শীঘ্রই আমরা আমাদের নির্দিষ্ট গৃহে এসে পৌঁছলাম। অমন বাড়ি আমি আর জীবনে দেখিনি। ইট বার করা, পঙ্গুপ্রায়; বহু প্রাচীনকালের সাক্ষ্য নিয়ে দাঁত বার করে দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো নবাব আলিবর্দি খাঁর আমলে এই বাড়ির ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল।

    ভাঙা ফটক দিয়ে অতি সন্তর্পণে ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাড়ির ভেতরে গিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এত লোক এখানে কোথা থেকে এল? যে-নির্জন নিস্তব্ধ গলি আমরা পিছু ফেলে আসলাম, সেখানে তো কারুর ছায়া পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। ভৌতিক কাণ্ড নাকি? সকলের মুখে কৌতূহলের ছাপ বর্তমান ছিল। নানা জাতীয় লোক সেখানে সমবেত হয়েছিল। এতগুলি লোক, কিন্তু কারুর মুখে একটি কথা নেই। সুচ পড়লে পর্যন্ত তার শব্দ শোনা যায়।

    ঘণ্টা খানেক পর একটি বৃদ্ধ মোটা চীনা আমাদের পথ প্রদর্শন করে নিয়ে গেল। তার মাথায় একটি চুলও কাঁচা ছিল না। তার সামনে ওপরের দু-টি দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো, আর বাঁ-হাতের উল্কিতে একটি ভোজালির ছবি। সে আমাদের ইশারা করে অনেকগুলি ঘর পার করে সেই খাটের ঘরে নিয়ে গেল। বাড়িটি ছিল একটি দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো— চারিদিকে গোলকধাঁধা।

    হ্যাঁ খাট বটে! অমন খাট আমি জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি! খাট আমি অনেক দেখেছি; কিন্তু ঠিক ওইরকম আশ্চর্য চীনা-খাট সেই প্রথম এবং শেষ দেখলাম। তার অপূর্ব ভাস্কর্য, অপূর্ব কারুকার্য! একপাশে ভগবান বুদ্ধের ধ্যানগম্ভীর প্রশান্ত মূর্তি। আয়তনে খাটটি বিশেষ বড়ো নয়। দু-টি মানুষ বেশ আরামে শুতে পারে। আবার আশ্চর্য, সেই খাট বাড়িয়ে দশজনের জায়গা করা যায়। দেখে চমকে গেলাম। সকলের সঙ্গে দরকষাকষি হতে লাগল। ওই সামান্য এক কাঠের খাটের প্রতি সকলের মন আকৃষ্ট হয়েছিল। কেনবার জন্য সকলের কী যে ব্যাকুলতা! দাম হু-হু করে বাড়তে লাগল। শেষে সতীশের ভাগেই ওই খাটটি জুটল— পনেরো-শো টাকায়।

    সেই খাট নিয়ে বাড়ি ফিরতে সতীশের প্রায় দশটা বাজল। যে দেখল সেই বলল— চমৎকার!

    সেখান থেকে খাওয়া-দাওয়া করে আমি বাড়ি গেলাম। সতীশ বলল— আবার এসো, নেমন্তন্ন রইল।

    —তথাস্তু। বলে চলে এলাম।

    আমি যাবার আগেই পরের দিন সকালে সতীশ এসে হাজির। উশকোখুশকো চুল, মুখ শুকনো, চোখ দু-টি জবাফুলের মতো লাল; দুর্ভাবনায় ও দুশ্চিন্তায় হয়তো সারারাত্রি ঘুম হয়নি।

    আমি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলাম— আরে ব্যাপার কী?

    —বিপদ, বিষম বিপদ! সতীশের গলা দিয়ে স্বর বার হচ্ছিল না।

    —কীসের বিপদ?

    —সেই খাট!

    একটা যে কিছু হবে, তা আমি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। কেউ কখনো খাল কেটে কুমির নিয়ে আসে? হাজার হোক, এটা একটা রহস্যজনক খাট!

    পূর্ব রাত্রের ঘটনা সে সবিস্তারে বর্ণনা করে গেল। সারারাত্রি সে ঘুমোতে পারেনি। ওই খাটের উপর সে শুয়ে ছিল। হঠাৎ মধ্যরাত্রে তার মনে হল কে যেন খাটটা নাড়াচ্ছে। উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দেখল, না, খাট ঠিকই আছে। আবার শুয়ে পড়ল, আর খানিক পরেই ঘুম ভেঙে গেল। কীসের এক ভীষণ শব্দে সারা ঘরখানা যেন থমথম করছে! দেওয়ালের সঙ্গে যেন খাটখানার ভীষণ ঠোকাঠুকি হচ্ছে!

    ধড়মড় করে উঠে সে আলো জ্বালল। না, সব কিছু নিঃশব্দ নিথর— কোথাও এতটুকু শব্দ নাই। সে আবার শুয়ে পড়ল। এবার আলো আর সে নেবাল না। ভোর রাত্রে কার দুর্বোধ্য আর্তকণ্ঠের বিলাপধ্বনিতে তার চেতনা ফিরে এল। কে যেন খাটের পাশে বসে বিনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে মরছিল।

    আমি বললাম— বলেছিলাম তো তোমার প্রথমেই, ও-খাট কিনে কাজ নেই! যেমন তোমার রোখ! এইবার বোঝো!

    সতীশ বলল— দেখো খগেন, তোমার হয়তো বুঝিয়ে বলতে পারব না। ওই হতভাগা খাটখানার ওপর এমন মায়া লেগে গেছে যে কী বলব। আমি ওকে ছাড়তে পারব না কোনোমতেই।

    —তবে মরো ওই খাট নিয়ে!

    —আমি তোমার সাহায্য চাই।

    —আমার সাহায্য!

    —হ্যাঁ! আজ তুমি আমাদের ওখানে রাতে খাওয়া-দাওয়া করবে। সারারাত না-ঘুমিয়ে ওই খাট পাহারা দেবো। দেখি ওর গলদ কোথায়!

    —আর আমার আপিস?

    —পাগল, কাল যে রবিবার।

    অগত্যা বন্ধুকে সাহায্য করবার জন্যে সন্ধ্যা বেলা তাদের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। সতীশ আমার অপেক্ষায় পথপানে চেয়ে ছিল। সে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল— সুস্বাগতম! সুস্বাগতম!

    —তারপর? আর কোনো গণ্ডগোল হয়নি তো?

    —না, দিনের বেলা গণ্ডগোল হবার তো কোনো কারণ নেই।

    সতীশের মা বললেন— দেখো দেখি বাবা খগেন, এত বলছি— যা, খাট বিক্রি করে দে, তা আমার কথা যদি ও শুনেছে!

    সতীশ বলল— বলছ কী মা, ভয় পেয়ে পনেরো-শো টাকার খাটটা বিক্রি করে দেবো?

    খাওয়া-দাওয়া সেরে রাত্রি জাগবার সাজসরঞ্জাম নিয়ে আমরা দু-টি বন্ধুতে খাটের ঘরে গিয়ে বসলাম। আমার হাতে দীনেন রায়ের ডিটেকটিভ উপন্যাস আর সতীশের হাতে হেলথ অ্যান্ড হাইজিন।

    রাত্রি ক্রমে ক্রমে বাড়তে লাগল। ঠিক হল আগে সতীশ ঘুমুবে আর আমি জাগবো। তারপর সতীশ জাগবে আর আমি ঘুমুবো।

    বইখানা খুলে আমি বসে রইলাম। পড়তে পারলাম না একটি অক্ষরও; এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম; চারদিকে কান খাড়া করে বসে রইলাম ভয়ে-ভয়ে। এতটুকু শব্দে থেকে থেকে চমকে-চমকে উঠছিলাম— ওই বুঝি সেই অপদেবতা আমার গলাটি দিলে টিপে।

    কাদের বাড়ির ঘড়িতে সুর করে দুটো বেজে গেল। হঠাৎ মনে হল কে যেন বাইরে বারান্দায় চলে বেড়াচ্ছে। তার পদশব্দ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমার সারাশরীর দোল দিয়ে উঠল, লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল।

    হঠাৎ সশব্দে খোলা জানলাটা বন্ধ হয়ে গেল। মুহূর্তে বোধ হল আমি যেন শূন্যে উঠে গেছি, আমার জ্ঞান লোক পেয়ে গেছে! আমি মৃত না জীবিত— তাও ঘোর সন্দেহের বিষয় হয়ে উঠল। আমি সভয়ে ডেকে উঠলাম— সতীশ, সতীশ!

    সতীশ ধড়মড় করে উঠে বসল— ব্যাপার কী?

    ভয়ে ও বিস্ময়ে আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুল না। সতীশ আমার দু-কাঁধে হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে ডাকল— খগেন, খগেন!

    আমি আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললাম— ওঃ, যা ভয় পেয়েছিলাম!

    —তা তো বুঝতেই পারছি। যাক, আর তোমায় জাগতে হবে না। তুমি ঘুমোও, আমি জেগে বসে আছি।

    —না, আমারও ঘুমিয়ে কাজ নেই। আর তা ছাড়া ঘুমও আমার হবে না আদৌ।

    —ভীতু কোথাকার!

    তারপর ভীতু আমি ও সতীশ দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে রইলাম। আমরা দু-জনেই নিঃশব্দে জেগে রইলাম; কেউ-ই একটিও কথা কইলাম না। আমি খোলা জানলা দিয়ে বাইরের টুকরো আকাশের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। অসংখ্য তারকা মিটমিট করে জ্বলছিল। বোধ হল, তারা যেন আমাদের বিপদে ফিক-ফিক করে হাসছিল। আমরা চুপটি করে বসে আছি, এমন সময়ে হঠাৎ ইলেকট্রিকের আলো দপ করে নিবে গেল। আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম— কে?

    বোধ হল, কে যেন মেন সুইচ বন্ধ করে দিয়েছে।

    হঠাৎ এক উৎকট হাসিতে সারাঘর রী-রী করে উঠল। অমন হাসি আমি জীবনে কাউকে হাসতে দেখিনি। হাসি যেন আর শেষ হতে চায় না! সে কী বিকট শব্দ!— হা-হা-হা হি-হি-হি হো-হো-হো হে-হে-হে…

    বোধ হল, কে যেন ঠিক দরজার কাছে হেসে খুন হচ্ছে। আমি শিউরে উঠলাম।

    সতীশ চট করে টর্চটা দরজার ওপরে ফেলল। তাতে হিতে বিপরীত হল। বোধ হল, কে যেন দরজার ঠিক বিপরীত দিকে জানলাটার ধারে বসে আর্তকণ্ঠে বিনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে মরছে। তার কান্নার কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না। কেবল একটা করুণ সুর সারাঘরময় ঘুরে ঘুরে মরতে লাগল। তারপর সেই খাটের ওপর দিয়ে সেই বিলাপধ্বনি আর নড়ল না। তার কান্নায় যেন খাটটা ভিজে গেল। সেই অবোধ্য ভাষায় সকরুণ বিলাপধ্বনি চিত্তে এমন এক অজ্ঞাত বেদনার সঞ্চার করল, যার ফলে আমাদের সমস্ত শক্তি যেন ক্রমে-ক্রমে লোপ পেতে লাগল। মনে হল, কে যেন ক্লোরোফর্ম দিয়ে আমাদের অজ্ঞান করে দিচ্ছে। আমরা যেন ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পড়ছি।

    সতীশের সাহসটা ছিল কিছু বেশি, তাই সে খাটের ওপর টর্চ ফেলে গর্জে উঠল— কে, কে ওখানে?

    কিছুই দেখা গেল না, কেউ সাড়া দিল না। সহসা সেই খাটখানা ঘরময় দাপাদাপি শুরু করে দিল। মনে হল, অগণিত নরকঙ্কাল যেন তার চারদিকে নৃত্য করে মরছে। তাদের হাড়ের খট-খট শব্দে কানের পর্দা ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হল। আমার বুকের ভেতরটা টন-টন করতে লাগল কীসের যেন বেদনায়। বোধ হল, হয়তো বুকখানা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

    একটু একটু করে আমার জ্ঞান হারিয়ে গেল।

    তারপর কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেল, তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। বোধ হল, আমি যেন অনেক দূরে এক চীনাবাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছি। একটি ছোটো ঘরে তখন সেই গভীর রাত্রে টিম-টিম করে একটি দীপ জ্বলছিল। ঘরের মেঝের ওপর একটি লোক মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে রয়েছে। একটি ছেঁড়া মাদুরের ওপর তার সেই রোগ-পাণ্ডুর মুখখানা দেখে আমার বড়ো দয়া হল। রোগে ভুগে-ভুগে বেচারা কঙ্কালসার হয়ে গেছে। তার পাশে বসে ছিল তার স্ত্রী হবে বলেই বোধ হল— চেহারা কিন্তু তার স্বামীর চারগুণ। একটা মস্ত টুলের ওপর বসে সে ঢুলছিল।

    তার পাশেই আমাদের এই খাটটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে এটাকে কে এখানে নিয়ে এল!

    হঠাৎ স্ত্রীলোকটি বিকট এক হাঁ করে হাই তুলল, তারপর দুটো সশব্দ তুড়ি দিয়ে একবার ঘরের চারদিকে চেয়ে দেখল। দেখলাম— তার স্বামী ইতিমধ্যে উঠে সেই খাটের দিকে এগিয়ে গেছে চুপি-চুপি। চকিতে ক্রুদ্ধা বাঘিনীর মতো তার স্ত্রী তাকে জোর করে খাট থেকে নামিয়ে বিছানায় ফেলে দিলে।— সে ভীষণভাবে গর্জন করতে লাগল, আর আর স্বামী ব্যাকুলভাবে অনুনয় করতে লাগল ওই খাটের পানে অঙ্গুলি-সংকেত করে। বোধ হয় সে চায় খাটে উঠতে; কিন্তু তার স্ত্রী তাকে কিছুতেই উঠতে দেবে না।

    উত্তেজনায় কাশতে-কাশতে তার মুখ দিয়ে এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে গেল। আমি শিউরে উঠলাম। তারপর লোকটার মাথাটা বিছানায় লুটিয়ে এল, আর সে উঠল না। তার স্ত্রী তার পাশে বসে বিনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদতে লাগল।

    যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম— ভোরের আলোয় চারদিক ভরে গেছে। দেখলাম, সতীশের মা আমার চোখে মুখে জলের ছিটে দিচ্ছেন।

    তিনি আমার জ্ঞান ফিরে আসতে দেখে বললেন— খগেন, বাবা খগেন।

    আমি বললাম— আমি কোথায়?

    —নীচের ঘরে।

    —সতীশ কোথায়?

    —সতীশের এখনও জ্ঞান হয়নি।

    তারপর শুনলাম রাত্রি চারটে নাগাদ আমরা নাকি দু-জনে সদর দরজায় এসে মাটিতে পড়ে গোঁ-গোঁ করতে থাকি। সতীশের মা বাইরে এসে এই অবস্থা দেখে চিৎকার করে কাঁদতে আরম্ভ করে দেন। পাকা তিন ঘণ্টা তদারক করার পর আমাদের জ্ঞান হয়। ডাক্তার এসে বলে গেছিল— ভয়ের কোনো কারণ নেই। একটা সাডন শক (sudden shock) আর কী! জ্ঞান হলে একটু ব্রোমাইড দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

    সতীশের জ্ঞান হতে, সেও সেই আমারই মতো অবিকল উদ্ভট স্বরে কথা বলে গেল। আমি বিস্ময়ে সকলের পানে তাকিয়ে রইলাম।

    সতীশের মা বললেন— আগে ওই সর্বনেশে খাট বিদায় করো বাবা!

    .

    খাট বিক্রির একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। পরের দিন বিকালে অসংখ্য লোকে বাড়ি ছেয়ে গেল। খাটটা বিক্রি হল— শেষপর্যন্ত দু-হাজার টাকায়! এক ইহুদি সেটা কিনে নিয়ে গেল।

    যাক, মাঝ থেকে কিছু লাভ হল। বিক্রি না-হলে শেষপর্যন্ত হয়তো ওটা বিলিয়ে দিতে হত!

    এখনও মাঝে মাঝে সেই রহস্যজনক খাটের কথা ভাবি। এক-একবার মনে হয়— সেটা এখন কার কাছে খোঁজ করি। এই অতৃপ্ত আত্মা, যাকে তার দুর্দান্ত স্ত্রী কোনোক্রমেই ব্যাধির ভয়ে খাটের ওপর জীবিত অবস্থায় শুতে দেয়নি, সে কি আজ তৃপ্ত হয়েছে? না এখনও সে ওই খাটের পেছনে প্রতি রাত্রে ঘুরে ঘুরে মরে— কাউকে ওর ওপর শুতে দেবে না বলে?

    জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৬, রূপহলুদ

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleভূত
    Next Article মশলা-ভূত

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    ধীরেন্দ্রলাল ধর ভৌতিক গল্প

    তান্ত্রিক

    March 13, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }