Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভ্যাঙ্কুভারের ভ্যাম্পায়ার – ডিউক জন

    ডিউক জন এক পাতা গল্প253 Mins Read0

    হাইওয়ে

    হাইওয়ে

    সরি, হানি। আসতে পারছি না পার্টিতে…

    কীহ! পারছ না মানে? সারা বছরে একটা মাত্র দিন এই পার্টিটা হয়, আর সেটাই তুমি মিস করতে চাও! মেজাজ খারাপ করে দিয়ো না, বলে দিচ্ছি!

    সিণ্ডি… সিণ্ডি, বোঝার চেষ্টা করো… খুবই জরুরি একটা সেমিনার আছে কালকে। বড় বড় ক্লায়েন্টরা থাকবে। ভালো একটা ঘুম দরকার আমার। সারা রাত জেগে পার্টি করলে কাল সকালেই নট হয়ে যাবে চাকরি।

    কিছুই শুনতে চাই না আমি। তুমি থাকছ, ব্যস! এটাই শেষ কথা।

    থাকতে তো চাই-ই, বেবি। কিন্তু বোঝোই তো, প্রাইভেট চাকরির মা-বাপ নেই কোনও। সমঝে না চললে…

    চার্লি অ্যালান, তুমি কি চাও, আমাদের সম্পর্কটা এখানেই চুকেবুকে যাক?

    এসব কী বলছ, সোনা! রিলেশনের সঙ্গে কী? কালকের মিটিংটা যদি ইমপর্টেন্ট না হতো, তা হলে কি পার্টি মিস করি?

    আর এদিকে যে বান্ধবীদের কাছে প্রেসটিজ পাংচার হতে চলল আমার, সেটা বুঝি কিছু না?

    দূরো! কই আগরতলা, আর কই চৌকির তলা!

    কী বললে! আমি চৌকির তলা! ঠিক আছে, থাকো তুমি তোমার কনফারেন্স নিয়ে। আজ, এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমার জীবনে পাস্ট টেন্স।

    সিণ্ডি… সিণ্ডি… সিণ্ডারেলা…

    নাহ। আদরের ডাকেও কাজ হলো না। ফোন কেটে দিয়েছে চার্লির প্রেমিকা।

    বিচ! ক্ষোভের সঙ্গে বেরিয়ে এল জঘন্য গালিটা। এই মেয়েগুলোকে নিয়ে আর পারা গেল না। শো-অফ ছাড়া কিছু বোঝে না। কার বয়ফ্রেণ্ড দেখতে কেমন, কার কত পয়সা আছে, বার্থডে-ভ্যালেন্টাইনে দামি-দামি গিফট দেয়, কোন রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে নিয়ে যায়, কোন মডেলের গাড়ি চালায় সারাক্ষণ এসব নিয়ে অলিখিত প্রতিযোগিতা। পার্টিতে অ্যাটেণ্ড করতে হবে- কেন? সং সেজে পিছে পিছে ঘুরবার। জন্য।

    ফাজলামোর একটা সীমা থাকা দরকার।

    ব্রেক-আপ নিয়ে ভাবছে না সে। গেছে, যাক। ফেরানোর চেষ্টা করবে না। এমন কিছু আহামরি– মেয়ে নয় সিণ্ডি ক্রফোর্ড। হাজারটা মেলে অমন গার্লফ্রেণ্ড।

    গত আটটি মাসে বারংবার যে সত্যটা উপলব্ধি করেছে চার্লি- শি ইজ নট মাই টাইপ।

    ভালোবাসা কী? পারস্পরিক সমঝোতা। চমৎকার বোঝাপড়া। আমিই অল টাইম কেয়ার নেব তোমার, আর আমার বেলায় লবডঙ্কা- দিস ইজ নট ফেয়ার। মানুষের অসুবিধা থাকতে পারে না? জরুরি কাজের চেয়ে মৌজ-মাস্তি বড় হলো? ক্যারিয়ার তো আমার; চাকরি গেলে পুঁছবি তুই? তখন তো ঠিকই ঝুলে পড়বি অন্য নাগরের গলা ধরে।

    রাগের চোটে স্টিয়ারিং-এ থাবড়া দিল স্কটিশ যুবক। চাপ লেগে বেজে উঠল হর্ন। কর্কশ আওয়াজটা চিরে দিল নীলচে রাত।

    জেরিকোর রাস্তায় চলেছে নিঃসঙ্গ সিডান। কাজ থেকে ফিরছে স্কট।

    ক্যালিফোরনিকান হাইওয়েতে এমন কী কোনও জনমানবও নেই। হবেই। সবাই এখন বিচরণ করছে অলিতে-গলিতে, না হয় পার্টি জমাচ্ছে।

    ফুস করে একটা শ্বাস ফেলল যুবক। কালকের প্রোগ্রামটা না থাকলেও সে-ও যেত। সারা রাত আনন্দ করার সুযোগ হাতছাড়া করত না কিছুতেই। কিন্তু মেয়েটা এসব বুঝলে

    তো! …দূর! আবার কেন ভাবছে ওর কথা!

    নিজের উপরেই বিরক্ত হলো চার্লি। মুখ বাঁকাল।

    সাইপ্রেসের জঙ্গল ভেদ করে সিঁথির মতো চলে গেছে। পথটা। পিচঢালা রাস্তা। দুই ধারে কালো কালো ছায়া। বিশাল, প্রাচীন সব বৃক্ষের ভুতুড়ে কাঠামো। থোকা থোকা অন্ধকার সেখানে।

    উইণ্ডশিল্ড দিয়ে আলগোছে ডানে চাইল স্কটম্যান। ঝনঝন করে উঠল ওর সমস্ত স্নায়ু; ধাতব কোনও কিছু মাটিতে পড়ে গিয়ে আওয়াজ তুললে যেরকম অনুভূতি হয়।

    কী যেন দেখল!

    হেডলাইটের আলোর সীমানার বাইরে। দৃষ্টিসীমার দূর প্রান্তে।

    রাস্তার পাশের ঘাসময় জমিনে সাদা এক ছায়ামূর্তি।

    ক্রমশ নিকটবর্তী হচ্ছে কালো, সিডান। সেই সঙ্গে চার্লির চোখে স্পষ্ট হচ্ছে মূর্তিটা।

    একটি মেয়ে। একা। দুহাত দিয়ে টেনে গাউনের ঝুল তুলে রেখেছে গোড়ালির উপরে। ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে পাক খেয়ে ঘুরছে ধীরে ধীরে।

    পাকস্থলিতে বিজাতীয় খামচি অনুভব করল চার্লি। এই রাতের বেলায় একাকী রাস্তায় নাচছে কেন মেয়েটা? পাগল নাকি?

    তরুণীর পাশে গাড়ি দাঁড় করাল চার্লি। শটগান-সিটের উপর দিয়ে ঝুঁকে ডান দিকের আধখোলা জানালার কাঁচ নামাল পুরোটা। হেই।

    নাচ থামিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে মেয়েটা। ছড়াগান গাওয়ার সময় বাচ্চারা যেভাবে ঘাড় দোলায় ডাইনে-বাঁয়ে, তেমনি দোলাচ্ছে। তখনও তুলে ধরা জামাটা।

    সান্ধ্য পোশাকটার জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া, খেয়াল করল চার্লি। পা দুটো খালি।

    বিপদে পড়েছে?

    রেপ-কেস- চকিতে মনে হলো চার্লির। জোর-জবরদস্তি করায় ছিঁড়ে গেছে কাপড়। কিন্তু ধর্ষিতা একটা মেয়ে নাচবে। কেন বনের ধারের নির্জন রাস্তায়?– নাহ, ধর্ষণ না। অন্য কোনও ব্যাপার।

    একটা সম্ভাবনা বাতিল হতেই আরেকটা এসে ঠাই গাড়ল মনে। হুম… মনে হচ্ছে, এটাই। হ্যালোউইন-কসটিউম। হয় পার্টিতে যাচ্ছিল মেয়েটা, না হয় পার্টি থেকে ফিরছে। গাড়ি টাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে বোধ হয়।

    তা হলে নাচানাচির ব্যাখ্যা?

    খুব সহজ। ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে ওকে। হ্যালোউইনে সবাই যা করে। নিশ্চয়ই গাড়ির আলো দেখেছে দূর থেকে। শয়তানি বুদ্ধি চাড়া দিয়েছে মগজে। একলা রাস্তায় সাদা কাপড় পরা পেতনি… বাপ, রে!

    হাসল চার্লি মনে মনে।

    লিফট চাও?

    নড়াচড়া থামিয়ে দিল মেয়েটা। অনেক সময় নিল উত্তর দিতে।

    বাড়ি নিয়ে চলো আমাকে।

    শিয়োর। প্যাসেঞ্জার-ডোর খুলে দিল স্কটিশ। ওঠো। গাড়িতে উঠল যুবতী। দরজা লাগাল।

    ততা, মিস… সিটে মাথা ঠেকিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। মদালসা ভঙ্গি। আচরণটা অস্বাভাবিক ঠেকছে চার্লির কাছে। কোথায় থাকো তুমি?

    ওর দিকে তাকাল না অচেনা নারী। ব্র্যাকেনরিজ রোডের শেষ মাথায়।

    নড় করল চার্লি। চোখ আটকে গেল ওর তরুণীর বুকে। লো-কাট ড্রেস। অর্ধনগ্ন স্তন জোড়া সুডৌল। ওঠানামা করছে। শ্বাসের সঙ্গে। কফি-রং চুলগুলো এসে পড়েছে বুকের উপরে। উঁচু দুই পাহাড়ের মাঝে অন্ধকার, গভীর খাদ।

    ওর দিকে তাকাল মেয়েটা।

    চোখে চোখ পড়তে নার্ভাস হাসল স্কটিশ তরুণ। সরিয়ে নিল দৃষ্টি। আড়চোখে তাকাল আবার। রাতের বেলা একা বেরোনো উচিত হয়নি তোমার।

    তোমার মতন ভদ্রলোক যখন আছে, তখন আর চিন্তা কী? মদির গলায় বলল যুবতী। পায়ের উপরে পোশাক খামচে ধরা হাত দুটো টানছে ভিতরের দিকে। ধীরে ধীরে হাঁটুর উপরে উঠে এল কাপড়ের ঝল।

    যুবতীর অনাবৃত ঊরুতে আঠার মতো সেঁটে গেছে চার্লির চোখ দুটো। লম্বা থাই দুটো বেশ ভরাট আর ভারি।

    পা ফাঁক করল যুবতী। আমন্ত্রণ।

    চট করে ওর চোখে চোখ রাখল চার্লি। উদগ্র কামনায় জ্বলছে মেয়েটার চোখ দুটো।

    চার্লির থুতনির নিচে একটা হাত রাখল মেয়েটা। আজ রাতে গেস্ট হবে আমার? নিমন্ত্রণ করল।– এক মুহূর্তে সব কিছু বিস্মৃত হলো চার্লি। ত্বরিত উপর নিচ করল মাথা। চুলোয় যাক মিটিং!

    জলদি চলো তা হলে।

    আর কী দেরি করে! ছুটল সিডান। কিছুক্ষণ বাদে থামল এসে এক বাড়ির সামনে।

    বাড়িটা পুরানো। কাঠের। একতলা একটা দালান। অন্ধকারে মোড়া। টানা বারান্দা সামনে। রেলিং আছে। টিনের ছাত দেয়া হয়েছে বারান্দাতে। জং ধরে গেছে টিনে।

    এখানেই থাকো তুমি? উইণ্ডস্ক্রিন দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে চার্লি। এটাকে তো হানাবাড়ি লাগছে আমার কাছে। ঘুরল ও মেয়েটার উদ্দেশে।

    নেই! উধাও হয়ে গেছে মেয়েটা! ব্যাক-সিটে দেখল। থাকার কথা নয়, তবুও। গেল কই!

    গাড়ি থেকে নামল চার্লি। ভয় পাচ্ছে। ওর অজান্তে কীভাবে নেমে গেল মেয়েটা? নাকি সত্যি সত্যি প্রেতের কবলে পড়েছে? হ্যালোউইনের নির্মম একটা রসিকতা!

    ঝিঁঝির কোরাস ভরে রেখেছে রাত। চারদিকে তাকাল চার্লি। কেউ নেই কোথাও।

    বিশাল এক গাছ যখের মতো পাহারা দিচ্ছে যেন বাড়িটাকে। একটা পাতাও নেই গাছে। কালচে ডালপালাগুলোকে মনে হচ্ছে প্রেতের আঙুল।

    ভাঙাচোরা পিকেট ফেন্স থাকা-না-থাকা সমান কথা। কবে লাগানো হয়েছিল, কে জানে!

    কি বড় বড় কয়েকটা গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা হয়েছে আঙিনার এক ধারে।

    গায়ে ডেনিম জ্যাকেট। তার পরও শীত লেগে উঠল চার্লির।

    বাড়িটার দিকে এগোল ও কয়েক কদম। হাঁক ছাড়ল, হ্যালোহ! যতটা না কারও সাড়া পাওয়ার প্রত্যাশায়, তার চেয়ে বেশি নিজের ভয় কাটাতে। হাল্লো!

    হুটোপুটির শব্দ শোনা গেল বাড়ির ভিতরে। ইঁদুর-টিদুর হবে। ধুলোর গন্ধ ঢুকল নাকে।

    বারান্দায় পা রাখল চার্লি। বহু দিনের পুরানো কাঠ মড়মড় করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে পায়ের তলায়। আওয়াজটা পীড়াদায়ক।

    মশা-মাছি ঠেকানোর জন্য নেট লাগানো হয়েছিল জানালাগুলোতে। একটার মধ্যে মস্ত এক ফুটো। সেখান দিয়ে উঁকি দিল ভিতরে।

    অন্ধকার। সঙ্গে আলো থাকলে… আছে তো!

    প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করল চার্লি। বাটন টিপে জ্বালল টর্চ। কমজোরি আলো। সমস্যা নেই তাতে। কোনও রকমে দেখা গেলেই হলো।

    কিন্তু দেখা আর হলো না চার্লির। আলো ফেলতেই সাদা কী জানি ভিতর থেকে উড়ে এসে আছড়ে পড়ল জালের উপর। ঝট-পট-ঝট-পট শব্দ হলো। কবুতর বোধ হয়।

    কিন্তু চার্লির তা শিয়োর হওয়ার সময় কোথায়? ভীষণ চমকে চিতিয়ে পড়েছে পিছন দিকে। গলা দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে এসেছে চিৎকার।

    লাফ দিয়ে বোর্ডওঅক থেকে উঠে দাঁড়াল চার্লি। এক লাফে নামল উঠনে। তারপর পড়িমরি করে গিয়ে উঠল গাড়িতে। সিলভানিয়া ব্রিজে ওঠার আগে ছাড়ল না চেপে রাখা দম।– সহজাত প্রবৃত্তি দেখতে বলছে পিছন ফিরে। কিন্তু সাহস হলো না চার্লির। মনে হচ্ছে; পিছনে চাইলে ভয়ঙ্কর কিছু দেখতে পাবে ভুতুড়ে বাড়ির কোর্ট-ইয়ার্ডে। তার পরও দমিয়ে রাখা গেল না চোখ জোড়াকে।

    রিয়ার-ভিউ মিররে তাকাতেই দুটো হার্টবিট নেই হয়ে গেল চার্লির। গলা ফুড়ে বেরিয়ে এল চিৎকার।

    সেই মেয়েটা! পিছনে বসে চেয়ে রয়েছে ওর দিকেই!

    ঝট করে ঘাড় ঘোরাল চার্লি। হাত কেঁপে গিয়ে ডানে ঘুরে গেল স্টিয়ারিং।

    সেতুর রেলিং-এ গিয়ে গোঁত্তা মারল সিডান। শব্দ হলো বিকট। আরও একটা আওয়াজ- চার্লির জান্তব চিৎকার। ধাতব আওয়াজটাকে ছাপিয়ে গেল সেটা। অশুভ অক্টোবর রাতের শীতল হাওয়ায় তুলল প্রতিধ্বনি।

    দুই

    বাঙালি দুই ভাই। আয়ান, আয়মান। উনিশ শ নব্বইয়ের দশকে গ্রিন কার্ড নামক সোনার হরিণের দেখা পান ওদের বাবা আমান ইকরামুল্লাহ। সপরিবার থিতু হন আমেরিকায়। আয়ান-আয়মান তখনও বিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা রাখেনি।

    এরপর ক্যানসাসের উপর দিয়ে অনেক মেঘই এল, গেল। সেদিনের দুই পিচ্চি এখন তেইশ বছরের দুই টগবগে, সুদর্শন তরুণ।

    যমজ ওরা। মেডিকেল সায়েন্সের পরিভাষায়- মিরর ইমেজ টুইনস। একজন আরেক জনের আয়না-প্রতিবিম্ব ঠিক উলটো দেখতে। স্বভাব-চরিত্রেও মিল নেই তেমন। একটা বিষয় ছাড়া। দুই ভাই-ই অ্যাডভেঞ্চার-পাগল। বেপরোয়া। রহস্যের গন্ধ পেলে চনমন করে ওঠে ওদের মন। উদঘাটনের চেষ্টা চালায়।

    এই মুহূর্তে ওরা রয়েছে এক ফিলিং স্টেশনে। তেল খাওয়াচ্ছে ইমপালাটাকে। স্টেশনটার নাম মার্টিনস সার্ভিস সেন্টার। এই মুহূর্তে সুনসান। অন্য কোনও গাড়ি নেই স্টেশনে। কমলা ওভারঅল পরা এক মেকানিক শুধু কী জানি করছে এক ধারে দাঁড়িয়ে। আরেক ধারে বাতিল এক গাড়ির বড়ি ফেলে রাখা হয়েছে।

    সবগুলো পাম্পের গায়ে শোভা পাচ্ছে লাল নো স্মোকিং সাইন। কাঁচঘেরা অফিসটা নানান সাইনবোর্ড আর স্টিকারে জর্জরিত। টায়ারস। অয়েল। লুব্রিকেশন। ব্যাটারি। গ্যাস কথাটা বড় করে। আইস। কোল্ড বিয়ার।

    হুশ করে পাশ কাটাল একটা গাড়ি। নভেম্বরের শুরু আজকে।

    পেট্রলপাম্পের লাগোয়া, কনভেনিয়েন্স মার্ট থেকে বেরিয়ে এল আয়ান ইকরামুল্লাহ। হাতে জাঙ্ক ফুডের প্যাকেট। অন্য সময় হলে বিষবৎ পরিহার করত এসব ছাইপাঁশ। এখন উপায় নেই। এই দিয়েই পেট ভরাতে হবে। কাল রাতের পার্টির পর থেকে দানাপানি কিছু পড়েনি পাকস্থলিতে।

    তেল নেয়া শেষ। নজলটা আবার পাম্পে রেখে দিচ্ছে আয়মান। তাকাল ভাইকে ফিরে আসতে দেখে।

    প্যাকেট উঁচাল আয়ান। খাবি?

    ন্‌নাহ! ভেংচে উঠল আয়মান ইকরামুল্লাহ। রোজা রেখেছি কি না! বেলা বাজে বারোটা, আর উনি জিজ্ঞেস করছেন… দে! ছোঁ মারল একটা প্যাকেটে। খিদেয় জান যায়! এ গাড়িতে বসেই খাওয়া সারল দুই ভাই। বোতলের পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করল।

    এই পর্যন্ত চালিয়ে এসেছে আয়ান, এখন আয়মান বসেছে ড্রাইভিং সিটে।

    থুতনিতে সস লেগে আছে তোর,  বলল আয়ান। রিয়ার-ভিউ আয়না অ্যাডজাস্ট করে দেখল আয়মান। হাতের পোঁছায় চিবুক মুছল। ব্ল্যাক স্যাবাথ, না ডিপ পারপল? ইঞ্জিন চালু করার আগে অপশন দিল মেটাল-ভক্ত।

    মুখ বিকৃত করল আয়ান। এই ভরদুপুরে! রবীন্দ্র সঙ্গীত দে।

    উফ! এবার মুখ বাঁকাল আয়মান। কী যে মজা পাস এই প্যানপ্যানানি-মার্কা গানে! তা-ও আবার দুপুর বেলা।

    গাড়ির প্লেলিস্ট চেক করে গান দিল আয়মান। জাগরণে যায় বিভাবরী- আঁখি হতে ঘুম নিল হরি। অসময়ের গান। তা-ও ভালো, এটা রিমিক্স। সোমলতার গাওয়া।

    তিন

    জেরিকো ৭ লেখা রোডসাইন পেরোল ধূসর ইমপালা।

    রাস্তার এক পাশে পাহাড়। আরেক পাশে জঙ্গল।

    মোবাইল টেলিফোনে কথা বলছে আয়ান। ওদের মায়ের সঙ্গে।

    …চিন্তা কোরো না, আম্মি। সময়মতোই চলে আসব আমরা। …(হাসি) ওকে, আম্মি। রাখি?

    অক্সফোর্ড শার্টের পকেটে রেখে দিল সে ফোনটা।

    কী বলল? ভাইকে জিজ্ঞেস করল আয়মান।

    টার্কির স্পেশাল আইটেম থাকছে আজকে। লাঞ্চের আগে ফিরতে না পারলে জীবনেও আর ঢুকতে দেবে না বাসায়।

    টার্কির মাংস! উলস! জিভে পানি আসার ভঙ্গি করল আয়মান। খোদ শয়তানও ঠেকাতে পারবে না আমাকে।

    হেসে রাস্তার দিকে তাকাল আয়ান। একটা ব্রিজ দেখা যাচ্ছে সামনে। ব্রিজের গোড়ায় গাড়ি আর পুলিসের জটলা।

    স্লো কর, আদেশ করল।

    কেন?

    জবাব দিল না আয়ান। এক তাড়া আইডি কার্ড বের করল গ্লাভ-কম্পার্টমেন্ট খুলে। দ্রুত দেখতে লাগল একের পর এক। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা পেয়ে যেতেই হাসল দাঁত কেলিয়ে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানেই রাখ।

    রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করল আয়মান। তাকাল ভাইয়ের দিকে। চোখে জিজ্ঞাসা।

    একটা কার্ড ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল আয়ান। এটা তোর।

    নিল আয়মান। এফবিআই-এর পরিচয়পত্র। কার্ডের ছবি আর সিগনেচারটা ওর। পাশে লেখা: স্পেশাল এজেন্ট।

    ওদিকে আরেকটা আইডি পকেটে পুরেছে আয়ান।

    কখন তৈরি করলি এগুলো? বোকা হয়ে গেছে আয়মান।

    জবাব না দিয়ে দাঁত বের করল আয়ান। লেটস গো।

    কাজটা কিন্তু বেআইনি।

    আরে, দেশসেবার স্বার্থে সবই জায়েজ। মাসুদ রানা ভাব নিজেকে। তা হলেই দেখবি, খারাপ লাগছে না আর।

    জেমস বণ্ডকেই প্রেফার করব আমি। ব্রিটিশ স্পাই-এর অনুকরণে বলে উঠল আয়মান; দ্য নেম ইজ বণ্ড, জেমস বণ্ড।

    কপট হতাশায় মাথা নাড়ল আয়ান। এজন্যই কবি বলেছেন, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি।

    কোন্ কবি?

    কবিগুরু…

    উফ! আবার সেই বুঢ়ঢ়া! হেসে গাড়ি থেকে নামল আয়ান।

    মাথায় হ্যাট। খাকি শার্ট আর প্যান্ট মানায়নি ডেপুটি ব্র্যাণ্ডের কালো চামড়ার সঙ্গে। কিন্তু উপায় কী! ইউনিফর্ম বলে কথা। চকোলেট-রঙা জ্যাকেট। বুকে ব্যাজ। বাহুতে আমেরিকান ফ্ল্যাগ। গলায় ঝুলছে টাই। টাইপিন, ব্যাজ আর জ্যাকেটের বোতামগুলো সোনালি। ঝুঁকল নিচে। দুই হাত কাঠের রেলিং-এ। হাঁক ছাড়ল: কিছু পাওয়া গেল?

    দূরে, ওয়েটসুট পরা দু জন লোক পানি থেকে উঠে এসেছে নদীর নুড়ির চরায়। জবাব দিল একজন। নো! নাথিং!

    সিডানটার দিকে ঘুরল পুলিস অফিসার। এগিয়ে গেল। ওটার নিখোঁজ আরোহীর জন্যই এত সব তৎপরতা। ব্রিজের মাঝামাঝি পড়ে আছে গাড়িটা।

    এনি প্রোগ্রেস?

    মাথা নেড়ে নিরাশ করল আরেক ডেপুটি। গাড়ির ভিতর থেকে জবাব দিল, ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই কোনও। ননা ফিঙ্গারপ্রিন্টস। নো ফুটপ্রিন্টস। পুরোপুরি স্পটলেস। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।

    তুমি বলছিলে, এই চার্লি অ্যালান ছেলেটা প্রেম করত তোমার মেয়ের সঙ্গে।

    হ্যাঁ, তা-ই।

    সিণ্ডি কী বলে? জানিয়েছ ওকে?

    ওদের তো বলে ঝগড়া হয়েছে।

    কী নিয়ে?

    জিজ্ঞেস করিনি।

    করা উচিত ছিল। কবে হলো ঝগড়া, বলেছে কিছু?

    কালকে, কাল রাতে।

    ড্যাম। আর কাল রাত থেকেই নিখোঁজ চার্লি।

    তুমি কি কিছু মিন করছ? সন্দিগ্ধ স্বর ডেপুটি ব্রায়ানের।

    কিছু মিন করছি না।

    ইন্টারেস্টিং কেস।

    কথাটা কে বলেছে, দেখার জন্য ঘুরে দাঁড়াল ম্যাক্স ব্র্যাণ্ড দেখল দুই তরুণকে নিরীখ করল আপাদমস্তক। চেহারায় অদ্ভুত মিল দুজনের।

    হু আর ইউ?

    পেশাদারি কায়দায় ব্যাজ বের করে দেখাল আয়ান।

    ফেডারেল মার্শাল।

    ভুরু কুঁচকে গেছে ডেপুটির। ওয়াও। মার্শাল হওয়ার জন্য বয়সটা একটু কমই তোমাদের।

    মাপা হাসি হাসল আয়ান। থ্যাঙ্কস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল গাড়ির চারপাশে।

    আয়মানও ভান করছে দেখার। হঠাৎ খেয়াল হলো, ওরও কিছু বলা দরকার। মাতব্বরির ঢঙে জিজ্ঞেস করল, কোনও থিয়োরি?

    কিডন্যাপিং মে বি। শ্রাগ করল ব্র্যাণ্ড।

    ক্যান আই হেল্প ইউ, বয়েজ? জলদগম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল একটা।

    তাকাল তিনজনে।

    যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। শেরিফ। কোমরের বেল্টে আটকানো হোলস্টারে ঝুলছে পিস্তল। গালে একটা গোটা।

    দু জন এফবিআই এজেন্ট শেরিফের সঙ্গে। আসল এজেন্ট। একজন লম্বা, একজন একটু খাটো। একজনের কালো চুল, আরেক জনের সাদা। চিকনা। মোটকা। আজব। জুড়ি। একই রকম পোশাক-পরিচ্ছদ পরনে। ফর্মাল। তিনজনের চোখেই কালো সানগ্লাস। মুখের চেহারায় পেশাদারিত্ব।

    গলা খাঁকারি দিল আয়ান। নো, স্যর। থ্যাঙ্কস,  বলল তাড়াতাড়ি। কাজ শেষ আমাদের। পা চালাল নিজেদের গাড়ির দিকে।

    ওকে অনুসরণ করল আয়মান। চিন্তিত চেহারায় দুই ভাইয়ের চলে যাওয়া দেখতে লাগল শেরিফ ইস্টউড।

    লোকটার চোখের আড়াল হতেই আয়ানের মাথার পিছনে চাটি মারল আয়মান।

    আঁউ! শুধু শুধু মারছিস কেন?

    আরেকটু হলেই তো গেছিলাম চোদ্দ শিকের ওপারে!

    তাতে কী! নো রিস্ক, নো গেইন।

    চার

    কিছুক্ষণ পর টাউনের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল ওদেরকে। উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি নয়, খুঁজছে লাইব্রেরি কিংবা সাইবার ক্যাফে।

    মুভি থিয়েটারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল আয়ান। সাউথ-ওয়েস্ট মিউজিয়মের উলটো পাশে সিনেমাহলটা।

    কী হলো? শুধাল আয়মান।

    চার্লির বান্ধবীর নামটা মনে আছে?

    মিণ্ডি?

    ব্যাড শট। সিণ্ডি।

    সিণ্ডি-মিণ্ডি- যেটাই হোক, হু কেয়ারস?

    ওই দেখ।

    ভাইয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল আয়মান। একটা দৃশ্যই দেখতে পেল দেখার মতো। দেয়ালে পোস্টার সাঁটাচ্ছে। এক তরুণী।

    ওই মেয়েটাই, বাজি ধরে বলতে পারি, নিঃসন্দেহ আয়ান।

    শিয়োর হচ্ছিস কী করে?

    কানা! পোস্টার দেখ। কী লেখা?

    একটা শব্দই পড়া যাচ্ছে দূর থেকে। মিসিং।

    ওদের না ঝগড়া হয়েছে?

    সো হোয়াট? ঝগড়াঝাঁটি ছাড়া প্রেম হয় নাকি?

    হুম।…কথা বলতে চাস?

    আবার জিগায়!

    এগিয়ে গেল ওরা।

    সাদাকালো পোস্টার। বোঝাই যায়, কমপিউটারে বানিয়ে প্রিন্ট নেয়া হয়েছে। এক তরুণের ক্লোজ-আপ ছবি। উপরে লেখা: নিখোঁজ, নিচে লেখা: চার্লি অ্যালান। ঠিকই ধরেছে। আয়ান।

    এক পলক চাইল মেয়েটা ওদের দিকে। আরও অনেকগুলো পোস্টার ওর হাতে। চলে যেতে নিচ্ছিল, ডেকে থামাল আয়ান।

    ইয়াহ? কটা রঙের চোখ প্রসারিত করে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। ওষ্ঠের চেয়ে অধর পুরুষ্টু ওর। লিপস্টিক ছাড়াই লোভনীয়। তিল আছে উপরের ঠোঁটের উপরে। বাম ভুরুতে পিয়ার্সিং করিয়েছে। গায়ে ছেলেদের শার্ট আর লেগিংস।

    তোমার কথা অনেক শুনেছি চার্লির কাছে, চাপা মারতে আরম্ভ করল আয়ান।

    তোমরা চেনো ওকে?

    বা, রে! চিনব না? কত বাস্কেটবল খেলেছি একসঙ্গে!

    প্রমাদ গুনল আয়মান।

    আমার নাম আয়ান। আর ও হচ্ছে—

    আয়মান।

    চার্লি কখনও বলেনি তোমাদের কথা। হাঁটা ধরল সিণ্ডি।

    পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল আয়ান, অবাক হচ্ছি না। অনেক দিন দেখাসাক্ষাৎ নেই তো!

    পা চলল কয়েক কদম।

    ওকে সারপ্রাইজ দিতেই আসলে এখানে আসা আজকে, আবার বলল আয়ান। কিন্তু নিজেরাই বেকুব হয়ে গেলাম। ব্রিজের উপরে গাড়ি দেখেছি ওর। সেই থেকে মাথা ঘামা সমস্যাটা নিয়ে… খোঁজখবর করছি।

    কোনও ক্লু পেলে? আশান্বিত হতে চাইল মেয়েটা।

    নট ইয়েট। কিন্তু তুমি বোধ হয় সাহায্য করতে পারো কিছু। ক টা প্রশ্ন করলে মাইণ্ড করবে?

    করো।

    চলো, কোথাও গিয়ে বসি।

    একটা ফাস্ট ফুডশপে ঢুকল ওরা। বসল নিরিবিলি একটা টেবিল বেছে নিয়ে।

    সরাসরি রোদ আসে বলে পরদা টেনে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছায়া। অন্ধকার, তার পরও উজ্জ্বল হয়ে আছে ভিতরটা। আলো ছাড়াই।

    ওরা বসতে-না-বসতেই অর্ডার নিতে হাজির হলো। ওয়েইট্রেস। ছোট এক হ্যাণ্ডবুক আর পেনসিল ওর হাতে।

    ব্ল্যাক কফি নিল সিণ্ডি। আয়মান আর আয়ান নিল কোক।

    ছোট এক চুমুক দিল সিণ্ডি কফিতে। আমিই বলি প্রথমে। কাল রাতে ফোনে ঝগড়া হয়েছিল আমাদের। বোকার মতন সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিলাম ওর সঙ্গে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। কে জানে, এই কারণেই কি না…

    তার মানে বলতে চাও, রাগ করে কোথাও চলে গেছে। চার্লি?

    হতে পারে না? পালটা প্রশ্ন করল সিণ্ডি।

    পারে। আচ্ছা, ওর কোনও কথায় কি খটকা লেগেছে। তোমার কাছে?

    তেমন কিছু তো মনে হয়নি, মাথা নেড়ে বলল সিণ্ডি। বলছিল, একটা জরুরি মিটিং আছে ওর আজকে।

    কীসের মিটিং?

    অফিশিয়াল।

    তা হলে নিজে থেকে উধাও হওয়ার সম্ভাবনা কম।

    তোমার লকেটটা সুন্দর, অপ্রাসঙ্গিক একটা মন্তব্য করল আয়মান।

    লকেটটা স্পর্শ করল সিণ্ডি। গোল একটা বৃত্তের মধ্যে পঞ্চভুজ। থ্যাঙ্কস। চার্লি দিয়েছে।

    মানে জানো এটার?

    লকেটটা? উম… যদূর জানি, ভূতপ্রেত-সংক্রান্ত কিছু। শয়তানের চিহ্ন।

    উঁহু। বরং উলটো। পেন্টাগ্রাম এক ধরনের রক্ষাকবচ। শয়তানের হাত থেকে বাঁচাবে তোমাকে। খুবই পাওয়ারফুল। জিনিস। মানে, এসবে যদি বিশ্বাস করো আর কী।

    আয়ান লক্ষ করল, হঠাৎ করে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে সিণ্ডি।

    একটা কথা বলব, ভাবছিলাম, দোনোমনো করছে। মেয়েটা।

    কী?

    এই ঘটনাটার মতো আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল তিন বছর আগে। এখন মনে পড়ল। সেবারও হ্যালোউইনে। এক লোক গায়েব হয়ে গিয়েছিল রাস্তা থেকে। আর পাওয়া যায়নি তাকে। ঘটনাটায় বেশ তোলপাড় হয়েছিল এখানে। লোকে বলাবলি করত, আগেও নাকি ঘটেছে এমন ঘটনা।

    মুখ চাওয়াচাওয়ি করল আয়ান-আয়মান।

    সেনটেনিয়াল হাইওয়েতে? জিজ্ঞেস করল আয়ান।

    ঠিক মনে নেই। আমরা এই এলাকায় আছি পাঁচ বছর। তার আগের ঘটনা সম্বন্ধে জানতাম না কিছুই। কয়েক জনের মুখে শুনেছি, কোন্ এক মেয়ে নাকি বছর পাঁচেক আগে খুন হয় ওই রাস্তায়। লোকের ধারণা, মেয়েটার প্রেত এখনও ঘুরে বেড়ায় ওখানে, আর যে-ই ওকে লিফট দেয়, সে-ই গায়েব হয়ে যায়।

    টিপিক্যাল হরর গল্প, বিড়বিড় করল আয়মান।

    পাঁচ

    সাইবার ক্যাফে।

    স্থানীয় পত্রিকা দেখছে দুই ভাই। জেরিকো হেরাল্ড।

    অনলাইন সংস্করণ। এক বছর করে পিছিয়ে পিছিয়ে দেখছে পহেলা নভেম্বরের সংখ্যাগুলো। ৩১ অক্টোবরে যদি কিছু ঘটে থাকে, সেটার খবর পাওয়া যাবে পরের দিনের কাগজে।

    সমৃদ্ধ আর্কাইভ। এমন কী যখন শুধু মুদ্রিত কপি বেরোত, তখনকার ইস্যুগুলোও রাখা হয়েছে স্ক্যান করে।

    এক সময় পেয়ে গেল কাক্ষিত আর্টিকেলটা। শুভ্রবসনার আত্মহত্যা। ছবিও রয়েছে কিছু।

    দৃষ্টি বিনিময় করল ভ্রাতৃদ্বয়। দুজনেই একই কথা ভাবছে। তা হলে মার্ডার নয়, সুইসাইড! অপঘাতের মৃত্যু আলোচিত হলে যা হয়- এখানেও তা-ই হয়েছে- তিল থেকে তাল। ভুল আছে সিণ্ডির জানায়।

    শব্দ করে পড়তে আরম্ভ করল আয়মান:

    সেনটেনিয়াল হাইওয়ে থেকে ৩৩ মাইল দূরে এক মর্মান্তিক ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাশা ডিলন (২৫) নাম্নী এক নারী। কাউন্টি শেরিফ স ডিপার্টমেন্ট সূত্রে জানা গেছে, গত কাল রাত সাড়ে ১২টার দিকে সিলভানিয়া ব্রিজ থেকে পতনের ফলে সলিল-সমাধি হয়ে মহিলার মৃত্যু হয়। পুলিস আত্মহত্যা বলে রায় দিয়েছে এটিকে। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে।

    ৪৬৩৭ ব্র্যাকেনরিজ রোড নিবাসী মিস ডিলন ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী ও অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন। ডেপুটি রন ট্রাভেলটা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগে মহিলার স্বামী বেন ডিলন ৯১১-এ ফোন করে স্ত্রীর নিখোঁজ সংবাদ জানান। পরে মহিলার মৃত দেহ আবিষ্কৃত হলে অসুস্থতার কারণটি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, মাস তিনেক আগে দুর্ঘটনাবশত বাথটাবের পানিতে ডুবে তাঁদের দেড় বছর বয়সী এক মাত্র পুত্রসন্তানের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে মহিলা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। শিশুটির মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে করতেন তিনি।

    মৃত্যুর সময় সাশার পরনে ছিল সাদা গাউন। ময়নাতদন্ত শেষে স্থানীয় গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে লাশ।

    আমার দেখা সবচেয়ে শান্তশিষ্ট, মিষ্টি মেয়েটি ছিল সাশা, বলেছেন ডিলনদের প্রতিবেশী, ডায়ানা কুপার, সে ছিল একজন আদর্শ মা।

    আর পড়ার প্রয়োজন বোধ করল না আয়মান। আরেক বার দেখল মেয়েটার ছবি, মিস্টার ডিলনের ছবি, ব্রিজের ছবি।

    ব্রিজটা পরিচিত লাগছে না? বলে তাকাল ভাইয়ের দিকে।

    ছয়

    মিহি কুয়াশার চাদরে মোড়া রাতটা। বিষণ্ণ গম্ভীর, ঘোলাটে চেহারা দিয়েছে সিলভানিয়া ব্রিজের বাতির আলোকে। বইছে। উথাল-পাথাল জোলো হাওয়া।

    সূত্রের আশায় ব্রিজের এমাথা-ওমাথা চষে বেড়াচ্ছে দুই সহোদর। এখান থেকেই অন্তর্হিত হয়েছে চার্লি।

    খোঁজাই সার। পাওয়া গেল না কিছু। অবশ্য পুলিস আর পেশাদার গোয়েন্দাদের হাত পড়েছে যেখানে, সেখানে নিজেদের জন্য তেমন কিছু আশাও করেনি।

    খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে ব্রিজের কিনারে দাঁড়িয়ে নিচে ঝুঁকল এবার। সমতল রেলিং-এর উপরে কনুই রেখে দাঁড়িয়েছে কুঁজো হয়ে।

    প্রবল স্রোত নদীতে। জলের অবিরাম কোলাহল।

    এবার? বলল আয়মান কিছুটা গলা চড়িয়ে।

    একটুক্ষণ নীরবতা। ভাবছি।

    এসব বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলে হয় না?

    পারলে তো ভালোই হতো, রে। কিন্তু কৌতূহল একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। …চল, ফিরি। আর কিছু করার নেই আজ রাতে।

    যাওয়ার জন্য ঘুরল, এবং ভয়ানক চমকে উঠল দুজনে।

    ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক নারীমূর্তি! বিপরীত দিকের রেলিং-এর উপরে! গায়ে সফেদ বসন!

    সাশা! সাশা ছাড়া কেউ না!

    পিছন ফিরে রয়েছে মেয়েটা। ঘাড়ের উপর দিয়ে তাকাল ওদের দিকে। চন্দ্রাহত মানুষের বিজাতীয় হাসি মুখে।

    সড়সড় করে ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেল দু জনের। সামনে তাকিয়ে ছেড়ে দিল মেয়েটা নিজেকে। খসে পড়ল ১ রেলিং থেকে।

    দুদ্দাড় দৌড়ে গেল দুই ভাই। নিচে তাকিয়ে দেখতে পেল কিছুই। খলবল করছে ঘোলা পানি।

    চিৎকার দিল আয়মান, দেখা যায় কিছু?

    কিচ্ছু না!

    আচমকা উজ্জ্বল এক আলো জ্বলে উঠল দপ করে। সঙ্গে একটা আওয়াজ। ঝটিতি আলো আর শব্দের উৎসের দিকে ঘুরে গেল দুই জোড়া চোখ।

    সাঁকোর গোড়ায় রেখেছে ওরা গাড়িটা। সেখান থেকেই আসছে আলো। জলছে হেডলাইট। আর গোঁ-গোঁ আওয়াজটা। ইঞ্জিনের।

    গাড়িতে কে? আয়মানের প্রশ্ন করার কারণটা সঙ্গত। তীব্র আলো ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে চোখে। বোঝার উপায় নেই, কে বসা গাড়ির ভিতরে।

    খোদার কসম, আমি না, এরকম সময়েও কৌতুক করতে ছাড়ল না আয়ান, যদিও কপালে ওর চিন্তার ভাঁজ। ঝাঁকি খেয়ে সচল হলো গাড়ি। সোজা ছুটে আসছে ওদের দিকে। বাড়ছে গতি। প্রতি মুহূর্তেই।

    ক্ষণিকের জন্য স্ট্যাচ হয়ে গেল দুই তরুণ। রিগর মরটিসের মতো অবস্থা। কিন্তু বাঁচার তাগিদেই সচল হলো আবার হাত-পা। দৌড় দিল উলটো ঘুরে। নাহ। সম্ভব না। গাড়ির গতি ওদের চাইতে বেশি। প্রায় ধরে ফেলল বলে! তারপর? পিষে মারারই মতলব মনে হচ্ছে।

    ধাক্কা লাগে লাগে, এরকম অবস্থায় লাফ দে! বলে চিৎকার দিয়ে নিজেকেও রেলিং-এর ওপারে ছুঁড়ে দিল আয়ান।

    থেমে, স্কিড করে স্থির হলো ব্যর্থ ইমপালা।

    সাত

    ভাই লাফ দেয়ার মুহূর্ত পরেই ডাইভ দিয়েছিল আয়মান। ব্রিজের কিনারা ধরে ঝুলছে ও।

    মিনিট খানেকের কসরতে নিজেকে টেনে তুলল উপরে। প্রথমেই তাকাল গাড়িটার দিকে।

    স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পিছন থেকে, কেউ নেই ভিতরে! তা হলে…

    পরেও ভাবা যাবে ওসব। আগের কাজ আগে।

    আয়ান! কালো জলের মধ্যে আয়মানের ব্যাকুল চোখ : খুঁজছে ভাইকে। শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে।

    আয়ান!

    জিন্দা! বাতাসে ভর করে ভেসে এল অস্পষ্ট উত্তরটা।

    এবারে খুঁজে পেল আয়মান।

    অল্প দূরেই চড়া। সদ্য পানি ছেড়ে তীরে উঠেছে ওর ভাই। কাদা মেখে ভূত। হাঁপাচ্ছে চার হাত-পায়ে মাটিতে ভর দিয়ে। স্বস্তির হাসি হাসল আয়মান।

    ভ্রাতোহ! সব কটা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে ওর। স্বাদ কেমন ময়লা পানির?

    আট

    কুঁতকুঁতে চোখে তাকিয়ে আছে লোকটা। দৃষ্টিতে রাজ্যের সন্দেহ। তার পরও উঠে দাঁড়াতে হলো তাকে প্রফেশনালিজমের খাতিরে। আগন্তুকদ্বয় কাছে আসতে জিজ্ঞেস করতে হলো, গুড ইভনিং, স্যরস। কোনও সাহায্যে আসতে পারি আপনাদের?

    একটা রুম, প্লিজ।

    চাহিদা শুনে ভাবান্তর হলো না কোনও মাঝবয়সী ক্লার্কের চেহারায়। খুলল না চেক-ইন ডেস্কে রাখা লেজারটা। বক্তার পাশের লোকটার দিকে মনোযোগ। কুঁচকে রেখেছে নাকটা। তেমনি সন্দেহপ্রবণ চাউনি। পা দেখা যাচ্ছে না ডেস্কের ওপাশে দাঁড়ানো যুবকের; সেজন্য নিরীখ করছে আপেটমস্তক।

    গুয়ের গন্ধ ছুটছে গা থেকে। অপ্রীতিকর দৃষ্টির সামনে মরমে মরে যাওয়ার অবস্থা হলো কর্মচর্চিত আয়ানের। কিন্তু এমন ভাব ঝুলিয়ে রাখল চেহারায়, কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া লেটেস্ট ট্রেণ্ড যেন। দুষ্টি উপর-নিচ করে সে-ও দেখছে ম্যানেজারকে।

    মোটুরাম। পুরো মাথা জুড়ে গোল টাক, কেবল কান আর ঘাড়ের উপরে অল্প কিছু পাতলা ফুরফুরে চুল বাদে। নিখুঁত ইস্তিরি করা সাদা শার্ট আর টাই-এ ধুরন্ধর মাল্টিলেভেল মার্কেটিং এজেন্টের মতো লাগছে লোকটাকে।

    সরি, রুম নেই। কথাটা বলে পৈশাচিক আনন্দ পেল ক্লার্ক। তবে সেটা ভিতরে ভিতরে। বাইরে প্রকাশ পাচ্ছে। পেশাদারিত্ব- মেকি, মাপা দুঃখবোধ।

    নিরাশ হলো না ওরা। এমনটাই আশা করেছিল।

    কটেজগুলোতে? বাতলে দিল আয়ান।

    তাচ্ছিল্যের চাউনি উপহার দিল ওকে মোটা ম্যানেজার। না, দুঃখিত। খালি নেই ওগুলোও।

    কথা না বাড়িয়ে অ্যাবাউট-টার্ন করল ওরা।

    মিছে বলছে ব্যাটা! মোটেল-লবি থেকে বেরিয়ে সখেদ মন্তব্য আয়ানের।

    কী করে বুঝলি?

    ব্যাটার চেহারা দেখে।

    বাহ। ফেস-রিডিংও পারিস, দেখছি।

    ঠাট্টা করছিলাম।

    আমিও।

    তবে ব্যাটা কিন্তু মিছে কথাই বলছে।

    জানি তো।

    কীভাবে?

    ফেস-রিডিং শব্দটা মুখে এসে গিয়েছিল প্রায়, সামলে নিয়ে বলল আয়মান, বোঝা তো যায়!

    প্রমাণ দেখাচ্ছি। ওই দেখ।

    কী?

    পাতার ছাউনি দেয়া মোটেল-অফিসটার বাঁয়ে লম্বা এক নিচু একতলা বাড়ি। প্রতিটা ঘরের সামনে একটা করে পাম গাছ লাগানো। ডানে রয়েছে এক সারি কটেজ। মোট এগারোটা, সব একই রকম দেখতে। অফিস-বাড়িটার মতো ওগুলোরও পাতার ছাউনি।

    কী দেখাতে চাইছে, বুঝতে পারল না আয়মান। কটেজ সারির দিকে চোখ আয়ানের। কী দেখছে ও?

    কী? আবারও বলল আয়মান।

    ওই ঘরগুলো… একই রকম, না? একটা কিন্তু আলাদা। বল তো, কোনটা?

    কোনটা? কুইজ খেলার ঝামেলায় গেল না আয়মান।

    ডান দিক থেকে আট নম্বরটা। বলতে পারবি, কেন?

    গুনে গুনে আট নম্বর কটেজটা দেখল আয়মান। ধরতে পারল না। বাকিগুলোতেও চোখ বোলাল একবার করে। তা-ও বুঝতে পারল না কিছু।

    আই কুইট, হাল ছেড়ে দিল।

    গাধা! তিরস্কার করল আয়ান। একটা অন্ধকার।

    বুঝল এবারে। আট নাম্বারটা বাদে অন্যগুলোতে আলো কিংবা আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। নিশ্চিত ভাবেই তোক রয়েছে ওগুলোতে, যদি না কোনও কারণে জ্বালানো থাকে বাতি।

    তুই গাধা! পালটা বলল আয়মান। ঘুমিয়েও তো পড়তে পারে লোকটা।

    ঘুমিয়েছে কি না, সেটাই দেখি, আয়। বলে আর দাঁড়াল আয়ান। পা চালাল কটেজুটার উদ্দেশে।

    অগত্যা পিছু নিতে হলো আয়মানকে।

    ঘুরছে না নব। ঘুরবে যে, আশাও করেনি আয়ান। হিপ পকেট থেকে বের করল ওঅলেটটা। মানিব্যাগের কোনা থেকে বেরোল একটা জেমস ক্লিপ।

    করছিস কী! চাপা গলায় বলল আয়মান। মাথা খারাপ হয়েছে তোর? চুরি করে ঢুকছিস! জেগে গেলে লোকটা?

    ঘাবড়াও মাত। নেই কেউ।

    শিয়োর হচ্ছিস কী করে?

    ইন্সটিঙ্কট।

    টেনে লম্বা করল আয়ান ক্লিপটা। বিশেষ একটা ডিজাইনে বাঁকাল সেটা আবার। তারপর চাবির ফুটোয় ঢুকিয়ে ব্যস্ত হলো কেরামতি দেখাতে।

    অস্থির ভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আয়মান। কেউ দেখে ফেললে কী যে হবে, সেটা নিয়েই শঙ্কিত।

    এক মিনিটও লাগল না তালা খুলতে। দরজার কান মুচড়ে ধরে কবাট ঠেলল আয়ান। সিধে হলো নিচু অবস্থা থেকে। ভাইয়ের দিকে চেয়ে হাসছে সবজান্তা শমসেরের হাসি। আয়।

    মাথা খারাপ!

    এক দিকের কাঁধ ঝাঁকাল আয়ান। ক্লিপটা পকেটে পুরে ঢুকে পড়ল ভিতরে।

    অতএব, ঢুকতে হলো আয়মানকেও। ঢুকে, তড়িঘড়ি করে লাগিয়ে দিল দরজা।

    জ্বালানো হলো না আলো। সাবধানের মার নেই। একটা পেনসিল-টর্চ বের করেছে আয়ান পকেট থেকে। অন্ধকারের বুক চিরছে সেটা দিয়ে। তবে আরেকটা কাজ করেছে তার আগে। পরদাগুলো টেনে দিয়েছে ভালো মতো।

    খালি নয় কটেজটা। তবে এই মুহূর্তে কামরাতে নেই ভাড়াটে। বাইরে কোথাও গেছে হয়তো।

    আয়মানও একটা টর্চ হাতে নিয়েছে। এগিয়ে গেল এক দিকের দেয়ালের দিকে। ছোট-বড় কাগজ সাঁটা সারা ঘরের দেয়ালে। ম্যাপ। পেপার-কাটিং। ছবি। এ ছাড়া রয়েছে হাতে লেখা নোট। টেপ দিয়ে লাগানো একটা ক্লিপিং দেখল। ডাইনি নিধনের উপরে। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে দুই মহিলাকে। মরটিস ডান্স বা মরণনৃত্যের উপরে আরেকটা কাটিং। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ভীত লোকজনের দিকে শিং বাগিয়ে তেড়ে যাচ্ছে মনুষ্যকঙ্কাল-সদৃশ এক প্রাণী। আরও আছে শয়তান আর দানবের উপরে একটা কলাম। ডাকিনীর উপরে। একসোরসিজম নিয়ে। এ ছাড়া রয়েছে বই, পত্রপত্রিকা। প্রচুর। টেবিলে। অগোছাল বিছানায়। ফ্লোরে উঁই করা। কয়েকটা নাম পড়ল দুই ভাই। ইনফিনিটি স্টপস হিয়ার। দে আর কামিং। তৃতীয় নয়ন। মিথ। আরও নানা হাবিজাবি। অতিপ্রাকৃত ব্যাপারস্যাপারে আগ্রহ রয়েছে। লোকটার। সিম্বলজির উপরেও বই দেখল কয়েকটা। ( মৃদু শিস দিয়ে উঠল আয়ান। বান্দা দেখা যাচ্ছে ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার। কিউরিয়াস মাইণ্ড ওঅণ্টস টু নোউঃ হু ইজ হি?

    টেবিলের দেরাজ খুলল ও টান দিয়ে। আলো ফেলল ভিতরে। একটা ডায়েরি দেখা যাচ্ছে। একটা জপমালা। বের

    করেই ওলটাল দিনলিপির মলাটটা। লেখকের নামটা দেখে শিস দিল আবার। এবার একটু জোরে।

    কী পেলি? বলতে বলতে কাছে এল আয়মান।

    কাকতালীয় ব্যাপার।

    দেখি-দেখি।

    দেখাল, ওকে আয়ান। ডায়েরির প্রথম পাতায় নীল কালিতে লেখা: বেনজামিন ডিলন।

    বেন ডিলন! অফুটে বলল আয়মান। এখানে কী করছে। লোকটা?

    সেটাই তো কথা! আয়, উত্তরটা বের করে ফেলি।

    খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল অদ্ভুত এক ব্যাপার। জুতোর। নিচে কিচকিচ করে উঠতে আবিষ্কার করল ওরা, লবণ দিয়ে চক্র তৈরি করা হয়েছে মেঝেতে।

    অনেকখানি বোঝা হয়ে গেল আয়ানের।

    দেখ-দেখ, আয়ান! কামরার এক প্রান্ত থেকে ডাকল আয়মান।

    এগিয়ে দেখল আয়ান। কাগজ সাঁটা বড় একটা বোর্ড।

    উপরের দিকে গোটা গোটা হরফে লেখা: সেনটেনিয়াল হাইওয়ে ভিকটিমস। ডাবল-আণ্ডারলাইন করা লেখাটার। নিচে। তার নিচে মানুষের ছবি কয়েকটা। বোর্ড-পিন দিয়ে আটকানো। কোনওটা ফোটোগ্রাফ, কোনওটা বই থেকে কাটা। প্রতিটা ছবির সঙ্গে রয়েছে ক্যাপশন। ১. পড়ল ও লেখাগুলো। জিম ক্যারি, ২১, ১৮৬৬। পিটার পারকার, ২৭, ১৮৭১। জেমস ক্যামেরন, ১৯, ১৮৭৯। জোহান জেরেমি, ২১, ১৮৮২। টম ক্রুজ, ৩০, ১৮৯০। স্যাম মিলফোর্ড, ২২, ১৮৯৮। ম্যাট জেরাল্ড, ৩০, ১৯০৫। ডিক … লরেন্স, ২৯, ১৯১৬। শন মারফি, ২৫, ১৯২৮। কেভিন বেকন, ৩১, ১৯৪১। মেলভিন ক্লার্ক, ১৭, ১৯৫০। কলিন ফার্থ, ২৮, ১৯৫১। ডিন কেইন, ২২, ১৯৬৩। রিচার্ড হোয়াইটসাইড, ২৪, ১৯৭১। টমি জেন, ২৬, ১৯৮২। বিল প্যাক্সটন, ২৬, ১৯৯৭। বার্নার্ড হিল, ৩২, ২০০৭। সব শেষেরটা- চার্লি অ্যালান, ২৮, ২০১৪। যারা-যারা মারা গেছে, সবার নাম সিরিয়ালি সাজানো। মৃত্যুর সময় এবং বয়স সহ। সব ক জন পুরুষ।

    আয়ান যখন ছবিগুলো দেখছে, আরেক দিকে সরে গেছে তখন আয়মান। একখানা পেণ্টাকল দৃষ্টি আকর্ষণ করছে ওর। কাঠের তৈরি। দেয়ালের একটা হুক থেকে ঝুলছে জিনিসটা।

    একটা আর্টিকেল রয়েছে কবচটার তলায়। ইন্টারনেট থেকে প্রিন্ট-আউট নেয়া। কাছে গিয়ে পড়ল হেডিংটা। হাইওয়েতে আতঙ্ক।

    আয়ান! দেখে যা! ডাকল আয়মান। ভাই কাছে আসতে বলল, আমাদের সাবজেক্ট!

    চট করে লেখাটা পড়ল আয়ান। হাতে আঁকা একটা ছবিও রয়েছে। নির্জন রাস্তায় শিকারের অপেক্ষায় রয়েছে এক নারী।

    ঘাপলা নাম্বার এক,  ঘোষণা করল ও গম্ভীর গলায়। এটা আমাদের সাবজেক্ট না!

    না?

    না। তবে ইনডাইরেক্টলি সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে।

    কীভাবে বুঝলি, সম্পর্ক নেই?

    তার আগে বল, সাবজেক্ট কী আমাদের।

    ওই মেয়েটা… সাশা।

    কবে মারা গেছে?

    পাঁচ বছর আগে।

    এবার এটা দেখ। ফিচারটার নিচের দিকে আঙুল ঠেকাল আয়ান। কলামটার বাইরে ট্রেস রেখে দিয়েছে কমপিউটার- কবে, কোন পত্রিকা থেকে প্রিন্ট নেয়া হয়েছে। এখানে বলছে, লেখাটা সতেরো বছর আগের।

    ভালো রকম একটা ধাক্কা খেল আয়মান। চার্লির মত্যর জন্য যদি সাশার প্রেতই দায়ী হয়, তা হলে এটা কে? সতেরো বছর আগে তো মেয়েটা জিন্দাই ছিল!

    বিহ্বল দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকাল আয়মান।

    আর, তোর কথাই যদি ঠিক ধরি, তা হলে সাশা আমাদের সাবজেক্ট না, সাবজেক্ট এটা!

    বলতে চাস, লোকে সাশা আর এই মেয়েটাকে গুলিয়ে ফেলেছে?

    তা-ই তো মনে হচ্ছে। মরার সময় সাশার পরনে ছিল সাদা গাউন। আর এই মেয়েটাও… লোকের ধারণা, সাদা পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। আর আমার ধারণা, এজন্যই ঘর ছেড়েছে বেন ডিলন… পাড়া-পড়শির কথা থেকে বাঁচতে। লোকে তার বউকে দুষ্ট প্রেত ভাবে, সেটা নিশ্চয়ই অজানা নয়। তার।

    মানলাম। তা হলে এসব কী ঘর ভর্তি? এগুলোর ব্যাখ্যা?

    অনুমান করাটা কঠিন নয়। সম্ভবত বেন ডিলনও অবগত সাদা পোশাকের ভূতটা সম্বন্ধে। হয়তো বউয়ের মৃত্যুটা আত্মহত্যা ভাবছে না ও। কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভূতটাকে দায়ী করে বসে আছে কি না, তা-ই বা কে জানে! আর নয় তো সত্যিই ইন্টারেস্ট আছে ওর অকাল্টে।

    কিন্তু গেল কোথায় লোকটা?

    ভূত শিকারে, ঠাট্টা করল আয়ান। যেখানেই হোক, গেছে। তবে যাওয়ার আগে বাড়ি বন্ধ করে দিয়ে গেছে কিন্তু!

    মানে?

    মেঝেতে আলো ফেলল আয়ান। এটা দেখেছিস? লবণের চক্রটার কথা বলছে।

    পবিত্র সার্কেল! লবণ নাকি?

    জানিস তা হলে! …আরও আছে। বিড়ালের চোখ।

    ওয়াক! ছিহ!

    সত্যি সত্যি ভাবছিস নাকি? ক্যাটস আই পাথরের কথা বলছি। ঘরের কোনায় কোনায় রেখেছে… ভূতপ্রেত যাতে কাছে ঘেঁষতে না পারে!

    হুম। তো, আমাদের এখন করণীয় কী?

    আমরাও বেরোব।

    ভূত শিকারে?

    ধরতে পারলে বিখ্যাত হয়ে যাব কিন্তু। টিকেট কেটে দেখতে আসবে লোকে। এক ধাক্কায় বড়লোক।

    ঠাট্টা না, সিরিয়াসলি বল।

    সিরিয়াসলিই। এখানে যে-মেয়েটার কথা লিখেছে, সে নাকি সিলভানিয়া ব্রিজের উত্তর মাথার দিকে থাকত। আঠারো শ পঞ্চাশ সালের দিকে মারা গেছে। কারণ- অজ্ঞাত। এখনও আছে বাড়িটা… পরিত্যক্ত।

    ওখানেই যেতে চাস?

    যেতে হবে। যদি কিছু পাওয়া যায়, মিলবে ওখানেই।

    শিয়োর তুই?

    সাশা যে আমাদের কালপ্রিট না, অনেক আগেই শিয়োর হয়েছি সেটা। ওই ছবিগুলো দেখে। ডিলনের রিসার্চ যদি সঠিক হয়, ভূতটার প্রথম শিকার তা হলে আঠারো শ ছেষট্টিতে। তারপর থেকে একের পর এক খুন হয়ে আসছে সাশা মারা যাওয়ার পর হাইওয়েতে প্রথম টার্গেট হলো চার্লি। কিন্তু তার আগে যে সতেরো জন মারা গেছে, ওদেরকে কে মারল?

    আর কেনই বা?

    জানতে পারলে ভালো, না জানলেও ক্ষতি নেই। মেয়েটার জীবনে কী ঘটেছে, জানা নেই আমাদের। হতে পারে, কোনও পুরুষমানুষ মৃত্যুর কারণ হয়েছিল ওর। হাইওয়েতে সম্ভ্রম হারিয়েছিল মেয়েটা। ইজ্জত লুটে খুন করেছে ওকে লোকটা, অথবা আত্মহত্যা করেছে মেয়েটা। বদলা নিচ্ছে। তারপর থেকে। পুরুষদের প্রতি রাগ। বছরের। বিশেষ একটা সময়ে শিকার খোঁজে সে। হয়তো ওই দিনই মারা গিয়েছিল। সবই অনুমান।

    তোর অনুমান ঠিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি,  বলল বিমূঢ় হয়ে যাওয়া আয়মান। এখন আমারও মনে হচ্ছে, সাশা না মেয়েটা। খেয়াল আছে, ব্রিজের উপরে এক পলকের জন্য চেহারা দেখেছিলাম ওর? জেরিকো, হেরাল্ডে সাশার যে ছবি ছেপেছে, মেলে তার সঙ্গে?

    আরে, তাই তো!

    তা ছাড়া… পোশাকটাও তো মিলছে না! ভূতটার পরনে কী ছিল? মনে হয় না, সোয়া শ বছর আগের পোশাক?

    আরিব্বাস! ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে দিল আয়ান। তুই তো কামাল করে দিয়েছিস!

    শুরু হয়ে যাক তা হলে… অপারেশন: সাদা ভূত!

    অ্যাহ! মুখ বিকৃত করল আয়ান। নাম পেলি না আর!

    বাংলায় এর থেকে ভালো নাম বের কর দিকি!

    এর থেকে হাজারটা ভালো নাম পাওয়া যাবে, বৎস! বাংলা এমন এক ভাষা…

    কথা বাড়াচ্ছিস কেন খামোকা? তুই একটা নাম দিয়ে দে না!

    একটুখানি চিন্তা করল আয়ান। হাসি ফুটেছে ওর মুখে।

    অপারেশন: শ্বেতবসনা।

    ক্যয়া বাত! ক্যয়া বাত! ক্যয়া বাত! বাদশাহী ভঙ্গিতে তারিফ করল আয়মান, সুরটা কৌতুকের। এখনই রওনা হবি?

    একটু পরে। গোসলটা সেরে নিই আগে।

    ভুলেই গেছিলাম। নাক টিপে ধরল আয়মান। ডলা দিয়ে নিস ভালো মতো। যে গন্ধ, ভূত পালাবে!

    নয়

    ভুতুড়ে বাড়ির জংলা কোর্ট-ইয়ার্ডে এসে ঢুকল ইমপালা। থেমে দাঁড়াল। ইঞ্জিন বন্ধ করল আয়ান। আলোগুলোও নিভিয়ে দিল। সেই পুরানো প্রবাদ: আলো থাকলে ভূত দেখা দেয় না। ওরা তো মোলাকাত করতেই চায়।

    গাড়ি থেকে বেরোল দুই ভাই।

    এটাকে তো আমার ওয়েস্টার্ন আমলের র‍্যাঞ্চহাউসের মতো লাগছে!

    লাগাটাই স্বাভাবিক। সোয়া শ বছর আগে ওয়েস্টার্ন যুগই ছিল।

    অয়, চিটাগাঙের আঞ্চলিক ভাষায় বলল আয়মান। কথা বলার সময় প্রায়ই শব্দটা ব্যবহার করেন ওদের বাবা। এখন কী তা হলে?

    ঢুকব।

    ভিতরে?

    তো, আর কোথায়?

    না, মানে…

    ভয় পেলে থাক। বাইরেই থাক তুই।

    পরিষ্কার ব্ল্যাকমেইল। মুখ গোঁজ করল আয়মান। না, যাব।

    নিশুতি রাত।

    ভাঙা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল দু জনে। টর্চ রয়েছে সঙ্গে, তার পরও যথারীতি আলো জ্বালছে না। লাগছেও না। জ্যোৎস্না আছে। চাঁদের আলো ঢুকছে বাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে।

    প্রথমেই বাধা। মাকড়সার জাল। সারা বাড়িতেই জাল বিছিয়ে রেখেছে আটপেয়েগুলো। জড়িয়ে যাচ্ছে হাতে-মুখে। ভীষণ অস্বস্তিকর অবস্থা।

    ওদের পায়ের চাপে মড়মড় করছে কাঠের মেঝে। আওয়াজে চমকে লুকাচ্ছে টিকটিকি-হঁদুরের দল।

    ফটাস করে শব্দ হলো একটা। আয়মানের পায়ের তলায়। পড়ে অক্কা পেয়েছে একটা তেলাপোকা।

    ঝট-পট আওয়াজ হচ্ছে। বাদুড় নাকি?

    বিষ্ঠা আর পেচ্ছাপের গন্ধে টেকা দায়।

    আচমকা হাঁচি মারল আয়মান। স্তব্ধ রাত্রি ভেঙে পড়ল। যেন খান-খান হয়ে।

    আয়ানের মনে হলো, পৃথিবীর সমস্ত মুর্দার ঘুম বুঝি ভেঙে গেছে ওই আওয়াজে।

    প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আয়মানকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল পেতনিটা। মাকড়সার মতো ঝুলছিল এতক্ষণ কড়িকাঠ থেকে। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে লক্ষ করছিল ওদের কার্যকলাপ।

    কিন্তু ছেলেটার কাছে পৌঁছোবার আগেই ঘটে গেল আরেক ঘটনা। কোত্থেকে ছুটে এল আরেকটা প্রেত! ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রথমটার উপরে!

    রক্ত হিম করা চিৎকারে চমকে চাইল দুই ভাই। আবছা আবছা কী দেখল, বুঝল না কিছুই। হুটোপুটির শব্দ হচ্ছে ভীষণ!, আর কর্কশ চিৎকারটা তো রয়েছেই।

    সারা ঘর জুড়ে শুরু হলো তাণ্ডব। ঝড় উঠল ধুলোর। ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো ছাত। দমকা হাওয়ার ঝাঁপটা লাগছে, ওদের গায়ে। ভয় পেয়ে বাড়ি ছাড়ল কয়েকটা কবুতর।

    পকেট হাতড়ে টর্চ বের করল আয়ান। ভাইয়ের দেখাদেখি আয়মানও। আলো জ্বালতেই দেখা গেল বিচিত্র দৃশ্য। সাদা কাপড় পরা দুই প্রেত-নারী হামলে পড়েছে একে অন্যের উপরে! কামড়াচ্ছে… খামচাচ্ছে… অন্ধ রাগে চুল ছিঁড়ছে! একবার নিচে নামছে! একবার উপরে! এ-কোণ থেকে ধেয়ে যাচ্ছে ও-কোনায়! তারপর আচমকা জানালাপথে অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরে। দু জনেই। শোনা গেল বুক-চেরা এক চিৎকার। তারপর সব চুপ।– শিকড় গজিয়ে গেছে যেন পায়ে। আতঙ্কে জমে গিয়ে দৃশ্যটা দেখছিল দুই ভাই। ভুলে গিয়েছিল নড়তে। অনেকক্ষণ লাগল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে।

    .

    যতক্ষণ না ব্রিজ পেরোল ওদের গাড়ি, একটা কথাও বলল না দু জনের কেউ।

    কী দেখলাম, বল তো? হতচকিত ভাবটা এখনও কাটেনি আয়মানের।

    ক্যাট-ফাইট,  আয়ানও ঘোরগ্রস্ত, তার পরও কৌতুক করল।

    মেয়েটা কে?

    একটা নিঃসন্দেহে আসল মেয়েটা… যার কবলে পড়ে প্রাণ দিয়েছে এতগুলো মানুষ।

    আমি অন্যজনের কথা বলছি।

    সাশা ছাড়া তো আর কাউকে ভাবতে পারছি না!

    কিন্তু কেন?

    প্রশ্নটা আমারও। কেন?

    ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করল আয়মান পকেট থেকে। ভাঁজ খুলে বাড়িয়ে ধরল ভাইয়ের দিকে। এটা পড়।

    কী এটা?

    বেনের ডায়েরির একটা পৃষ্ঠা। পড়।

    কার্টসি লাইটটা জ্বেলে দিল আয়ান। আলোয় ধরল। পাতাটা।

    আগের পৃষ্ঠায় শেষ হয়নি বাক্য। শেষাংশ রয়েছে এটাতে।

    …ও যে আর স্বাভাবিক নেই, বুঝতে পারিনি আমরা কেউই। বুঝলাম, যেদিন নিজের হাতে। বাথটাবে চুবিয়ে মারল বাচ্চাটাকে। স্বীকারও করল নিজে এসে।

    এই প্রথম ভয় পেলাম, আমি নিজের বউকে। কিন্তু তখনও বড় ভালোবাসি ওকে, যেমনটা বাসি এখনও।

    মিথ্যা বললাম পুলিসকে। কিন্তু এতে করেও রক্ষা করতে পারলাম না–ওকে। হয়তো কোনও এক মুহূর্তে চেতনা ফিরেছিল ওর; অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় কী করে বসেছে, উপলব্ধি করতে পেরে সইতে পারেনি। শেষ করে দিয়েছে নিজেকে। আমাকে করে দিয়েছে একা… একদম একা…

    কখন জোগাড় করলি এটা?

    তুই যখন বাথরুমে ছিলি,  উত্তর আয়মানের।

    দেখাই যাচ্ছে, ধোয়া তুলসি পাতা না সাশা।

    বিষয়টা জানা দরকার না মানুষের?

    বাদ দে। মেয়েটা যদি জীবিত থাকত, তা হলে একটা কথা ছিল। পাপ সে করেছে, জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্তও করেছে- ব্যস, কাটাকাটি। তা ছাড়া অসুস্থ ছিল মেয়েটা। অসুস্থ অবস্থায় কী করেছে, না করেছে, সেসব ধরলে অন্যায়ই করা হবে ওর প্রতি।

    কিন্তু ও পাগল হলো কেন?

    তার আমি কী জানি? এক হাজার একটা সম্ভাবনার কথা বলা যায়। ধরা যাক, ডিলন লোকটা আগে থেকেই প্রেত পিশাচের পাগল। সারাক্ষণ পড়ে থাকে এই নিয়ে। এদিকে তার বউয়ের হয়তো পছন্দ না এসব বিষয়। কিন্তু চোখের সামনে অদ্ভুত-অদ্ভুত জিনিস দেখছে প্রতিনিয়ত… বিচিত্র সব বিষয়ের উপরে বইপত্র… ছবি-টবি… সুস্থ মানুষকে পাগল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

    এবার তা হলে,…

    এখানেই যতি দিই। কী বলিস?

    রহস্যের পুরোটা না জেনে ফিরে যাবি?

    কেন জানি মনে হচ্ছে, এরপর আর এগোনোটা ঠিক হবে না। মনে কর, মস্ত এক ফাড়া কাটল আজকে। প্রাচীন ওই ভূতটা মনে হয় হামলে পড়তে যাচ্ছিল আমাদের উপরে…

    তা-ই যদি হয়, তা হলে তো বলতে হবে, সাশা আমাদের বাঁচিয়েছে।

    হ্যাঁ, তা-ই।

    আবারও প্রশ্ন: কেন?

    কোনও উত্তর নেই… অনুমান আছে।

    বল, শুনি।

    নিজের অগোচরে হোক, যে পাপ ও করেছে, সেটার প্রায়শ্চিত্ত মরার পরেও শেষ হয়নি। মর-জগতে গিয়ে তাই উপকার করার চেষ্টা করছে জীবিত মানুষের। শুনতে কি হাস্যকর লাগছে?

    না, লাগছে না। শেকসপিয়র তো বলেই দিয়েছে: স্বর্গ মর্তে এমন অনেক কিছুই রয়েছে, যা আমাদের জানার বাইরে। …তবে অশরীরী দুটোর কী হলো, জানতে পারলে ভালো হতো, রে! তোর কী মনে হয়? কী হতে পারে?

    আপাতত চোখ রাখব পত্রিকার পাতায়। দেখব, এই এলাকায় আর কোনও রহস্যময় খুন হয় কি না। যদি না হয়, বুঝব, ভূতটার দফারফা করে দিয়েছে সাশা।

    আর যদি হয়?

    কিছু করার নেই।

    তা হলে চলতেই থাকবে একের পর এক খুন?

    কিছু করার নেই।

    ভূতটা সাশার কোনও ক্ষতি না করলেই হয়!

    টেনশন হচ্ছে? প্রেমে পড়েছিস নাকি?

    প্রেম না। মমতা। দীর্ঘশ্বাস পড়ল একটা। …তা হলে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন?।

    সোজা।

    ভয় লাগছে না তোর?

    কীসের?

    আম্মিকে ফেস করবি কেমন করে? দুপুরে জরুরি কাজে আটকা পড়েছি বলে সেই যে ফোন অফ করলাম, এখন তো খুলতেও ভয় করছে!

    খুলিস না! আমিও খুলছি না! একেবারে সরাসরি সামনে গিয়ে পড়ব।

    তুই আগে যাবি! তোর পিছে থাকব আমি! এহ! চড়-থাপ্পড়গুলো একাই খাব নাকি আমি?

    তোর জন্য টার্কির মাংস মিস করলাম। মাশুল তো দিতেই হবে।

    দুম করে কিল মারল আয়ান আয়মানের বাহুতে। শালা ঘরের শত্রু বিভীষণ!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅদেখা ভুবন – ডিউক জন
    Next Article অশুভ সংকেত – কাজী মাহবুব হোসেন

    Related Articles

    ডিউক জন

    অদেখা ভুবন – ডিউক জন

    August 19, 2025
    ডিউক জন

    আর্সেন লুপাঁ ভার্সেস হার্লক শোমস

    August 19, 2025
    ডিউক জন

    সুবৰ্ণ সমাধি – ডিউক জন

    August 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.