Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025

    সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভ্রমণ সমগ্র ২ – নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেন এক পাতা গল্প110 Mins Read0

    দ্বীপায়নিকা

    অনন্ত সময়ে থিরথিরিয়ে কাঁপছে বড়তালাওয়ের অথৈজলে। উড়ে যাচ্ছে স্মৃতির মতো নাম ভুলে যাওয়া পাখির ঝাঁক—কানে আসছে তাদের কাকলি। নীল পাহাড়ের ঢেউ আবছা হতে হতে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে ফিরোজা আকাশে, কত সহজেই এসব ঘটে যাচ্ছে।

    স্বচ্ছ সবুজেনীল জলের তলায় ফুলন্ত জলজ উদ্ভিদের উজ্জ্বল বেগুনিলাল আভা, স্রোতে দুলছে, রং বদলাচ্ছে। বাবার টেবিলের সেই আশ্চর্য কাচের পেপারওয়েটের মতো। কেমন করে ঢুকলো ঐসব রঙিন ফুলগুলো অমন কঠিন কাচের গোলকটার মধ্যে? কে ঢোকাল? ঠিক যেন ম্যাজিক।

    ছোট্ট ছোট্ট সবুজ ঢেউয়ের মাথায় ছোট্ট ছোট্ট বেলফুলের মালা। ডুবছে ভাসছে মিলিয়ে যাচ্ছে ফুটে উঠছে ফেনার ফুল। যেন হাঁসের সারি। আমার এই টিলার ওপরের একফালি বারান্দাটাও ম্যাজিক জানে। মন ভাল করার ম্যাজিক।

    দুটো ক্ষুদে ক্ষুদে কালো পাখি, ভ্রমরের চেয়ে একটুখানি বড় মাপের হবে, দাম্পত্যকলহ করতে করতে আপনমনে উড়ে গেল আমার নাকের ডগায় প্রায় ডানার ঝাপ্টা মেরে—চকে সরে এসে ওপরদিকে নজর পড়ল, চক্রাকারে পাক দিচ্ছে চিলটা, ঠিক ওদের মাথার ওপরে। চকচকে রূপোর থালায়।

    বিদেশে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছি—তাই সময় মিলেছে, বারান্দায় একা। উঁচু টিলার ওপরে—আমার এই বারান্দাটাই যেন একটা দ্বীপ। অনেক অনেক নিচে যতদূর দৃষ্টি যায় সর্বস্ব ঝেঁপে আছে পরম রূপসী বড়তালাও। তীরে বাঁধা ছোট্ট ছোট্ট জেলে নৌকোগুলো যেন হেলেদুলে বলছে, “একা কেন? এই তো আমরাও রয়েছি।” মস্ত মস্ত মাছ ধরার জাল পাতা রয়েছে, আশ্চর্য সব জ্যামিতিক নকশায় গড়া বাস্তব ছবির আবহাওয়া তৈরি করেছে তারা জলে, মাটিতে, আকাশে বিস্তীর্ণ জাল জড়িয়ে। জড়িয়ে যায় দৃষ্টিতেও।

    জলের ধারটি ঘেঁষে একটি ফিতের মতো রাস্তা— যতদূর চোখ যায়। আরও একটা ফিতে-রাস্তা কোণাকুণি উঠেছে পূব থেকে পশ্চিমে-লালমাটির পাহাড় পেরিয়ে যাচ্ছে সে। পূর্বদিগন্ত থেকে একটা গাড়ির উদয় হল, পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আগাগোড়া আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে ছুটলুম। সে জানতেও পারল না।

    ডানদিকে একটা কালো পাথরের চাঙড়ের গায়ে আগুন ধরিয়েছে একটা পলাশ গাছ। জলের ধারে মানুষের সংসার। ছোট ছোট কুঁড়েঘর। ছোট ছোট স্বপ্নসাধ। একটি শিশু একা একা খেলছে তার পিছু পিছু ঘুরছে এক কুকুর। একটা সাইকেল গেল, তিনজন সওয়ারী—তাদের একজনের হাতে একটা মস্ত হাঁড়ি। মানুষবসতি পেরিয়ে চলে গেল সাইকেল। মাথায় বড় বড় ঝুড়ি, কখনও কাঠের বোঝা, কখনও দু’টো তিনটে কলসী নিয়ে দ্রুত হাঁটছে রংচঙে ঘাঘরা পরা মেয়েরা। এতদূর থেকেও সে পদক্ষেপের ছন্দ মন হরণ করে। পুরুষমানুষের চিহ্ন নেই। কোথায় তারা? বোধহয় বেরিয়ে পড়েছে নৌকো নিয়ে। গাঁ-টা তো জেলেদের। তালাওয়ের বুক জুড়ে এদিক ওদিক বুক ফুলিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে অজস্র সাদা ত্রিকোণ।

    ‘দেশে’ একবার বুদ্ধদেব বসু একটি কবিতায় অন্তঃসত্ত্বা নারীর সঙ্গে বাতাসে ফুলে ওঠা পালের উপমা ব্যবহার করে খুব নিন্দিত হয়েছিলেন। আমি তখন বেশ ছোট। আমারও লজ্জা করেছিল। উপমাটা হয়তো শালীনতার সীমা অতিক্রান্ত—এমন মনে হয়েছিল। তারপর কি আশ্চয, এখন কোনও গর্বিতা অন্তঃসত্ত্বা জননীকে দেখলে সেই পালতোলা নৌকোর উপমাটা মনে পড়ে। আজ বুঝতে পারি, শিল্পী সার্থক হয়েছিলেন তাঁর উপমা চয়নে। এক অহংকারী সৌন্দর্য আছে দুটিতেই।

    এই বারান্দা আমাদের একটা ছোট্ট দ্বীপ উপহার দিয়েছে। সেই দ্বীপে বসতি নেই, বড় বড় গাছপালাও নেই, সেই দ্বীপে কোনও নৌকো যায় না; সে সারাদিন একলাটি শুয়ে থাকে চোখ বুজে, আমার মতোই। যেন ভোরে উঠে রোজ বড়তালাও এই ছোট্ট সবুজ মখমলের আসনটা যত্ন করে পেতে দেয়, সূয্যিঠাকুর বসবেন বলে। আবার ঠিক সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে নেয়। অন্ধকার জলে রোজ ডুবে যায় আমার দ্বীপ, ভোরের আলোর সঙ্গে আবার ভেসে ওঠে। বড়তালাও তার কালো আঁচলের তলায় সম্পূর্ণ ঢেকে নেয় আমার খুদে দ্বীপকে, রাত বাড়লেই। ঐ দ্বীপে একটিও বাতি নেই। জলের কত ব্যস্ততা-সারাদিনই জলে কত কিছুই ঘটে যাচ্ছে—কত রং বদল হচ্ছে—দ্বীপটার কিন্তু কোনও খেয়াল নেই। সে কেবল মাঝে মাঝে হঠাৎ রোদে ঝলসায়, আবার মাঝে মাঝে মেঘে ঝামরে মিইয়ে পড়ে; এটুকুই। ঠিক পাখিদের মতো ভোর হলেই হাজির আর সন্ধ্যা হলেই উধাও। কিন্তু একদিন চাঁদনি রাত্রে ঠিক ও ধরা পড়ে যাবে। চাঁদের সঙ্গে ওর গোপন দোস্তি আছে নিশ্চয়—চুপি চুপি ভেসে উঠবেই—কিন্তু এটা যে কৃষ্ণপক্ষ। এটা ওর অভিসারের সময় নয়।

    সুন্দরবনে কিছু দ্বীপ আছে, যারা জোয়ারে ডুবে যায় আর ভাঁটার সময়ে জেগে ওঠে। পাইনগাছের ডালে জ্যান্ত গুলি শামুক ঝুলতে দেখে অবাক পিকো টুম্পা বলেছিল, “মা, ওরাও কি কাঠবেড়ালির মতন গাছে চড়তে জানে?” শুনে আমাদের নৌকোর মাঝি, নরেনবাবু ওদের বুঝিয়েছিলেন—জোয়ারের সময়ে জল উঠলে ওরা গাছের ডালে আটকে যায়। ভাঁটার সময় জল নেমে গেলে আর কী করবে বেচারীরা, তাই ঝুলে থাকে। মানুষের জীবনেও এমনি দুর্ঘটনা অনেক সময়েই ঘটে যায়—ভরাজোয়ারের ধাক্কায় ভুল ঠাইতে এসে পড়ে ভুল প্ৰাণী চিরবন্দি হয়ে পড়ে।

    দ্বীপের প্রতি টান আমার চিরকালের। ছোটবেলায় যখন ঢাকুরিয়া লেকে সাঁতার শিখি তখন ধ্যানজ্ঞান ছিল কবে ওই গাছপালাভর্তি রহস্যময়ী দ্বীপটাতে সাঁতরে গিয়ে উঠব। কিন্তু দ্বীপের চেয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত সাঁতার দিতে শিখে গেলুম, অথচ দ্বীপে আর ওঠা হল না। নলিনদা বারণ করে দিলেন —”খবদ্দার, দ্বীপের ধারেকাছে যাবি না, ওইখানে জলে ভীষণ বেশি ঝাঁজি, পায়ে এমনই জড়িয়ে ধরবে, সব্বোনাশ হবে—আর অমন সুন্দর দ্বীপটাতে কেউই যায় না কেন বল্ দিকি? ওতে যে জাতসাপের বাসা ভর্তি।”—সত্যিমিথ্যে জানা হয়নি। দ্বীপটা অচেনাই রয়ে গেছে। আজও। আমার সবচেয়ে কাছের সবচেয়ে বেশি দেখা সম্পূর্ণ অচেনা দ্বীপ।

    ব্রহ্মপুত্র পার হতে গিয়ে অনেক দ্বীপ দেখেছি সে-নদীর বুকে। একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে নৌকো যাবার সময়ে, একটা গাছ হঠাৎ একগুচ্ছ ফুল ঝরিয়ে দিয়েছিল নদীর জলে—আর কী দ্রুতই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ব্রহ্মপুত্রের অধৈর্য স্রোত আমার দৃষ্টির আড়ালে। অতি দূর সমুদ্রের দিকে। সেই দ্বীপটিকে মনে আছে—যেন অতিকায় বৃদ্ধ অরণ্যের একচিলতে ধরা আছে তার ছোট্ট আয়তনে। এ গ্রহ থেকে হারিয়ে যেতে বসা রেনফরেস্টের সঘনগহন একটি বিন্দু। বড় বড় বৃক্ষলতায় ভরা। তার জঙ্গলে জনবসতি ছিল বলে মনে হয়নি। ঘরদোর দেখিনি। কেবল একটা ভাঙাচোরা নৌকো স্রোতে আছড়াচ্ছিল একটা পাথরের গায়ে। কে এসেছিল ওই নৌকোটা নিয়ে ঐ দ্বীপে? আর ফিরে যায়নি!

    রাইন নদীর বুকেও আছে অজস্র দ্বীপ, আর সেই সব দ্বীপে অগুনতি মধ্যযুগীয় কেল্লা। ঠিক ইংরেজি রূপকথার বইতে দেখা ছবির মতোই প্রাসাদ দুর্গ। একটা নৌকো করে যদি রাইন নদীর স্রোত ধরে ভেসে যাওয়া যায়—পথে দ্বীপের পরে দ্বীপে দেখা যাবে অবিকল স্বপ্নপুরীর মতো সব ধূসর দুর্গের চূড়ো। মনে হবে, ভেতরে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে স্বর্ণকেশী বন্দিনী রাজকন্যে। সেই রাইন নদীর দ্বীপগুলোকে যখন আজ মনে পড়ে—মনে হয় ওইখানে ঘুমিয়ে রয়েছে আমারও বাইশ বছর বয়েসটা।

    দ্বীপের সঙ্গে আমার হৃদয়ের যোগ ঠিক জলের মতন। ঘিরে ঘিরে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে। ছলাৎ ছলাৎ।

    মডেলটাউনের বাড়ির সামনেও একটা দ্বীপ ছিল। একটা শান্তশিষ্ট দীঘির মাঝখানে একটা শান্তশিষ্ট দ্বীপ। সেই দীঘিতে কোনও নৌকো ভাসত না, কেউ মাছ ধরতো না, কোনও শিকারীর বন্দুকের আওয়াজ উঠত না। সেই দ্বীপেও ছিল না জনবসতি। কখনও সাঁতার কেটে বেড়াতে যেতে দেখিনি কাউকে ঐ দ্বীপে।

    সারাদিন সূর্যই একা একা খুনসুটি করতেন ঐ দীঘিটার সঙ্গে। আর কত রঙেরই যে শাড়ি বদল করতো ঐ দীঘি সারাদিন ধরে। বুকুমা বলেছিল, “আমি তো সারাজীবন এখানে বসে থাকতে পারি তোর বারান্দায়—আর ঐ দীঘির সঙ্গে আকাশের আলোর খেলা দেখতে পারি।”—সেই দ্বীপটা ছিল এক হাজার পাখির সম্পত্তি। ভোর হলে ঝড়ের মতো ডানার শব্দ তুলে তারা উড়ে বেরিয়ে যেত কাজকর্মের চেষ্টায়, আবার আকাশে গেরুয়া ছোপ ধরলেই হু-হু শব্দে আপিসফেরতা বাবুরা ফিরে আসতেন সেই দ্বীপের বাসায়। ঐ পাখিদের দ্বীপ দেখিয়ে দেখিয়ে গপ্পো বানিয়ে বানিয়ে ভাত খাওয়াতুম পিকোলোকে। সামনে একটা দ্বীপ থাকলে, গল্প যেন আপনাআপনি গড়ে ওঠে।

    গ্লোরিয়া আর আমি, একজন ভারতবর্ষের কালো মেয়ে, আর একজন যুক্তরাষ্ট্রের কালো মেয়ে—দুজনেই স্বপ্ন দেখতুম, যদি একটা দ্বীপ কেনা যেত? গ্লোরিয়ার জীবনে স্বপ্নের শিকে ছিঁড়ল; “উইমেন অফ ব্রুস্টার প্লেস” পুরস্কার পেল। গ্লোরিয়ার প্রথম উপন্যাস থেকেই তার দ্বীপের মধ্যে বাড়ি উঠে এল। দ্বীপ কেনা না হোক, ছোট্ট একটা দ্বীপে একশ বছরের পুরনো একটা সাদা কাঠের বাড়ি, আর অনেকখানি জমি, আর নিজস্ব একটুকরো সমুদ্রসৈকত কিনে ফেলল গ্লোরিয়া। আর আমাকেও, যতদিন খুশি, সেখানে থাকার অনুমতি দিয়েছিল সে। এরকমভাবে স্বপ্ন সত্যি হতে আমি বেশি দেখিনি। জর্জিয়ার কাছে সাউথ ক্যারোলিনার উপকূলে এই দ্বীপপুঞ্জে শুধু ক্রীতদাসদের বসবাস ছিল। গ্লোরিয়ার বাড়ির উঠোনভর্তি বড় বড় বৃদ্ধ ওক গাছ, জটাজুট দাড়ির মতো তার ডালপালা থেকে মাটি পর্যন্ত লুটোচ্ছে হাল্কা সবুজরঙের “স্প্যানিশ মস্”—যেন শতসহস্র বিনুনী। অযত্নের গাছে, আগাছায়, লতায়, কাঁটায়, ফুলে, ফলে জংলা হয়ে ওঠা জমিটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে সোনালি বালিতে। পামগাছ, পান্থপাদপ, যুঁইফুল, ফণিমনসা, আঙুরলতা, কলাগাছের ঝোপ, আবার স্ট্রবেরিও। একফালি সোনালি সৈকত পার হয়ে জলের মধ্যে শরবন। যদুবংশের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। আর বালিভর্তি কত যে জীবজন্তু—কাঁকড়ার ঝাঁক দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আর গুটিগুটি চলেছে গুগলিশামুক, ঝিনুক, শঙ্খেরা। সবাই জলজ্যান্ত। নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। পাখিরাও শিকার করছে। শরবনের ওপারে পরিচ্ছন্ন নীলজল। চিংড়ি ধরার জাহাজ ভেসে যাচ্ছে দুপাশে পাখনা ছড়িয়ে। এ সমুদ্রে তেমন ঢেউ নেই, গর্জন করে না, গুঞ্জন করে দিনরাত। নোনাবাতাস গুনগুন করছে, আলোর রং হলুদ। এই দ্বীপের আলোর রং অন্য? গ্লোরিয়াও বলল, এটা ঠিক কথাই। সত্যিই রোদের রং এখানে অন্য। কোথাওকার মতো নয়। চারিদিকে লেগুন আর ব্যাকওয়াটার্স, আমাদের কেরালার মতন অনেকটা, মানুষ ডিঙি বেয়ে বেড়ায়। সমুদ্রের রংটাও এখানে বড় আশ্চর্য—অনেকটা সেই মেক্সিকোতে দেখা কানকুনের সমুদ্রের মতো স্বচ্ছনীল। এর একটা নাম আছে, জলরং। স্বপ্ননীল, শ্যাম্‌লা, শান্তিভরা বিস্তার। মানুষ অল্প, আর পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে বালি ছড়ানো ব্যক্তিগত সৈকত প্রচুর এই দ্বীপে। হোটেল নেই, ট্যুরিস্টের বন্দোবস্ত নেই বলেই রক্ষে। পাশেই আছে অন্য একটা দ্বীপ। সেটি শুধু ট্যুরিস্টদের জন্যই নির্দিষ্ট। তার চরিত্র আলাদা। এ গেঁয়ো গিন্নি। সে শহুরে বাঈজী।

    তবে হ্যাঁ, একটি গর্জন এখানে অতি প্রবল। এখানকার ‘ঝিল্লির রব” অদ্বিতীয়—দিনের বেলার সমস্ত শব্দকে ছাপিয়ে ওঠে। রাত্রের কথা তো বাদই দিচ্ছি। এদের যদি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে মিছিলে স্লোগান দিতে শেখান যেত, অনেক মানুষের শ্রম-লাঘব হত।

    গ্লোরিয়ার দ্বীপের বাসাতে সাতটা দিন যেন ঠিক একগুচ্ছ দিবাস্বপ্নের মতো কেটে গেল। কখনও বালির ওপর, কখনও দোলনায়, কখনও গাড়িতে ঘুরছি, কখনও উপুড় হয়ে লিখছি। দুজনে দুটো ঘরের মেঝেয় মৌরসীপাট্টা গেড়েছি। কাকপক্ষী ছাড়া প্রাণী বলতে আছে গাছে গাছে প্রচুর কাঠবেড়ালী, মাঠে ছুঁচো। একটা বনবেড়ালও দেখেছি একদিন গাছে। বাঘের মতন দেখতে কিন্তু বেজায় ভীতু। আমাদের দেখেই পড়িমরি ছুটে পালাল। কী সুন্দর ছন্দ তার।

    কিন্তু সে যাই হোক—দিনদুপুরবেলাতে এমনধারা ঝিঁঝির গর্জন শুনতে কাঠের মেঝেয় চাদর পেতে ঘুমিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা নর্থ আমেরিকা কেন, ভারতবর্ষের কোনও গ্রামেও কদাচ আমার হয়নি। এই দ্বীপের ভাষাও ইংরিজি নয়, গুলা। গুলার শব্দসম্ভার মূলত ইংরিজি, কিন্তু ব্যাকরণের গড়নটা ইংরিজি নয়। পূর্ব আফ্রিকার কোনও এক উপজাতীয় কথ্যভাষায় ব্যাকরণের খাপে খাপে বসানো হয়েছে ইংরিজি শব্দ। উচ্চারণও আলাদা। দ্রুত বললে বোঝা যায় না, ধীরে বললে কিন্তু শুনতে খুব মিঠে। আমেরিকাতে প্রথম ক্রীতদাসপ্রথা থেকে মুক্ত হয়েছিল এই দ্বীপের কালো মানুষরাই। এখানে জমিজমা, ক্ষেতখামার, বাড়িঘর, গির্জে, ইসকুল, সবকিছুর মালিকানা কালো মানুষের। অথচ এককালে প্রচুর নীলকুঠি ছিল এখানে। ছিল তুলোর চাষ, ধানচাষ, তামাকের ব্যবসা। জাহাজভর্তি ক্রীতদাস আসত আফ্রিকা থেকে। ৯ কিলোমিটার লম্বা আর আড়াই কিলোমিটার চওড়া এই দ্বীপটা যে কী সুন্দর! সাতটা দিন গ্লোরিয়ার কাছে ঠিক যেন মনে মনে, যেন কল্পনায় কেটে গিয়েছিল। দ্বীপের মধ্যে বাসা ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত। টিভি ছিল না, রেডিও ছিল না, খাটপালংক চেয়ার টেবিল কিছুই ছিল না আমাদের। শুধু দালানের মেঝের ওপরে একটা লাল টেলিফোন রাখা ছিল। আর সেখানে ও আমার ফোন এসেছিল। কলকাতা থেকে, কটক থেকে, লন্ডন থেকে।

    দ্বীপ? এখন কোন্ দ্বীপে দ্বীপান্তরী হবে মানুষ? দ্বীপ মানে আর বিচ্ছিন্নতা নয়। স্যাটেলাইট দিয়ে ঠিক ছুঁয়ে দেওয়া যাবে তোমাকে, যেখানেই তুমি যাও না কেন। “দ্বীপ” মানে একদিন ছিল বুঝি আলাদা পৃথিবী। যেখানে আলাদা এক টুকরো আকাশে, একটা অন্য সূর্য ওঠে। “দ্বীপান্তরে” পাঠানোর মানে ছিল যেন মানুষকে পৃথিবী থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া। এখন পৃথিবীই মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষ, তুই পালাবি কুথা?

    এখন উপায় শুধু নিজেকেই যদি একটা দ্বীপ করে নেওয়া যায়। জীবনের তরঙ্গ এসে আছড়ে পড়বে তোমার চারিধারে, সর্বাঙ্গে লাগবে ব্যস্ত বাস্তবতার ছোঁওয়া, অথচ তুমি অস্পৃষ্ট থাকবে নিজের মধ্যে নিজে, জনবসতিহীন সেই চিরকালের রেনফরেস্টের একচিলতে দ্বীপ হয়ে, অক্ষয় অরণ্য হয়ে, ঘাসেপাতায় বৃক্ষলতায় ফুলে ফলে ছায়াতে রোদ্দুরে। মাটির সঙ্গে যোগ থাকবে মূলের অদৃশ্য অন্তরীণ গভীরতায়। অনন্তের মধ্যে ভাসমান একবিন্দু শান্ত, সসীম সময়। চারিদিকে ছলাৎছল স্থলহীন তারল্যের স্রোত। তারই মাঝখানে শক্ত হয়ে সবুজ হয়ে স্থির থাকা।

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅ্যালবাট্রস – নবনীতা দেবসেন
    Next Article উত্তমাশা অন্তরীপ এবং – নবনীতা দেবসেন

    Related Articles

    নবনীতা দেবসেন

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025

    সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.