Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025

    সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভ্রমণ সমগ্র ২ – নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেন এক পাতা গল্প110 Mins Read0

    কর্ণাবতীর কূলে

    চলমান ফোন যন্ত্রগুলো আমাদের আজকাল কত কিছু করেকম্মে দেয়। আইনজীবী কপিল সিবাল তো তাঁর টেলিফোনে কবিতাও লেখেন, বললেন, যখনই মনে আসে, টপাটপ লিখে ফেলেন ফোনের ভেতরে। আমি অত দামী ফোন তো ব্যবহার করি না, বড়জোর ওষুধ খাবার সময়টুকু অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে পারি। কিংবা প্লেন ধরার সময়ে ঘুম ভাঙানো—তার বেশি নয়। কিন্তু আমার অজান্তেই যে আমার মোবাইল একটা বড় কাজ করে রেখেছিল, আজ সেটা আবিষ্কার করে মনে যেমন চমক, তেমনই আহ্লাদ হল। ফোন আমাকে বলছে ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট এ তরী’, মেসেজে মেসেজে শুধু গিয়েছে ভরি—অতএব মেসেজ মোছো! সেন্ট আইটেমস খালি করতে গিয়ে দেখি আরে? পরপর কতগুলো অত্যাশ্চর্য মেসেজ রয়েছে, কোনওটা চন্দনাকে পাঠানো, কোনওটা শৌণককে, কোনওটা পিকোকে, কোনওটা শ্রাবস্তীকে—তাতে সুন্দর সুন্দর সব বর্ণনা—দুঃখের বিষয় ভাষাটা ইংরিজি। কোথাও লিখেছি ‘আমি এখন একটা নীল জলে ভরা সুইমিং পুলের পাশে ছাতার নীচে সাদা কাঠের দোলনায় বসে দুলছি আর কফি খাচ্ছি—আকাশটা ঝকঝকে, পুলটা সাদা পাথর আর ঘন নীল জলের আশ্চর্য আলপনা’—মনে পড়ে গেল জায়গাটা তাজ চান্দেলা, খাজুরাহো। নন্দনা ঘরে বসে আমার কম্পিউটারে ই-মেল করছে, আজ তার শ্যুটিং ছুটি। সে সাঁতার কাটবে বলেই আমি এসে বসেছি—এই নীল পুকুরের পাশে, কিন্তু তার চিহ্ন নেই!”

    নন্দনা বিবিসির জন্য শার্প’স পেরিল’ বলে একটি ছবিতে রাজকন্যে সেজেছে। তারই শ্যুটিং চলছে খাজুরাহোতে। আমি দিল্লিতে একটা কনফারেন্সে এসেছিলুম, মেয়ের আব্দারে খাজুরাহোতে এসে পৌঁছে গেছি। আমি আগে আসিনি খাজুরাহোতে। ওদের ছবির শ্যুটিং হচ্ছে নানা জায়গাতে ঘুরে ঘুরে—ওরছাতে হয়েছে। ঝাঁসিতে হয়েছে, এখন চলছে রাণে কলসের ধারে। আমি তো রোজই যেতে চাই—কিন্তু প্রচণ্ড রোদে সারাদিন নাকি ধু ধু বালির মরুভূমিতে তাঁবুর মধ্যে বসে থাকতে হবে আমাকে।

    মেয়েকে কখনও ঘোড়ায় চড়ে কখনও উটে চড়ে কখনও দোলায় চড়ে প্রসেশন করে রাজকন্যেগিরি করতে হচ্ছে। আমি তবুও একদিন যাই! শুনেছি রাণে ফলস ভারি সুন্দর। আমাকে চন্দনা বলেছে সেই জলপ্রপাতের ধারে ধারে নাকি পাথরের মধ্যে চুনি পান্না জহরত কুচির বহুবর্ণ নুড়ি ছড়িয়ে থাকে—কুড়িয়ে এনে দেখতে চাই সত্যি কিনা? শুনেছি রাণেফলসের গভীর খাদে লাল চুনাপাথরের বড় বড় খণ্ডের মাঝখানে, নীল-সবুজ জলধারা হয়ে বয়ে যায় ‘কেন’ নদী। ‘কর্ণাবতী’র ডাকনাম ‘কেন’, বিলিতি শুনতে হলেও বিলিতি নয়, দিশি ডাকনাম। মধ্যপ্রদেশের প্রিয় নদী সে। যেমন আমরা আদর করে কংসাবতীকে ডাকি কাঁসাই বলে, ইরাবতীকে বলি রাভি। রাণে ফলসের খাদের ধাপে ধাপে নাকি রেখার পদচিহ্ন পড়েছিল, ‘কামসূত্র’ ছবির শ্যুটিংয়ের সময়ে। সেই থেকে তার ধুলোর দাম বেড়েছে।

    রাণে ফলস

    একদিন চলে গেলুম শ্যুটিং দেখতে রাণে ফলসের ধারে।

    সত্যি সত্যি অসাধারণ দৃশ্য শোভা, শুষ্ক, রুক্ষ, খোঁচা খোঁচা লালপাথরের চাঁইয়ের কোলে, রোগাপাতলা কচি নদীর শুরু। নীল-সবুজের ভীরু ঝিরিঝিরি-একেক জায়গায় একেকরকম রং, গড়ন, গভীরতা—জল প্রায় নেইই। কিছুটা ওপরে উঠলে আছে চওড়া জলাশয়ের মতো সেটাকে এরা বলে কুয়ো। তার মধ্যে কুমিরের রাজ্যপাট। তারা কখনও ডুবে থাকে, কখনও ভেসে থাকে, কখনও ডাঙায় উঠে রোদ্দুর পোয়ায়। পাঁচিল ঘেরা উঁচু একটা জায়গা থেকে নীচে উঁকি মেরে কুমির দেখতে হয়—(এই কুমির, তোর ঘাটকে উঠেছি!) জলকে নেমেছ, কী গেছ! আঃ, কুমিরদের সেদিন ফিস্টি!

    আমি উঠতে পারি না পাহাড়ে—নন্দনা একাই গেল দেখতে। কুমিরেরা তখন তাদের জলের তলার সংসারে ফিরে গিয়েছে, কিন্তু নীল-সবুজ অপরূপ জলরংটা তো দেখা হল নন্দনার!

    আমি গাড়িতে বসে বসে এদিক-ওদিক দেখছি আর ভাবছি—ব্যাপার কী? এত যে গ্ৰীষ্ম ভয়ানক হয় এখানে, সে তো জানা ছিল না? প্রত্যেকটা গাছ শুকনো, জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়া মূর্তি। এটার নাম জঙ্গল—প্রচুর গাছও রয়েছে, কিন্তু রুক্ষ, নিষ্পত্র। ছায়াহীন, শাখাকাণ্ডসর্বস্ব—এ কেমন অভিশপ্ত অরণ্য? তৃষিত মরুর মতো চেহারা?

    নন্দনা ফিরে আসার পর জিজ্ঞেস করি আমাদের ড্রাইভার পাণ্ডেজিকে। পাণ্ডেজি এই পাশের গ্রামেই থাকেন ‘সূর্যপুর’ নামের গ্রামে। তিনি বললেন, ‘কাকিমা, এখানে গত দশ বছর ধরে বৃষ্টি পড়েনি।’ (হ্যাঁ ‘কাকিমাই’–বাংলাতেই বললেন।) ট্যুরিস্ট যত আসেন এখানে, তাঁরা হয় বাঙালি, নয় সাহেব। তাই পাণ্ডেজি ইংরিজি আর বাংলা বলতে শিখে গিয়েছেন।

    ‘সে কী, দশ বছর বৃষ্টি হয়নি? তাহলে তো এই অঞ্চলে যেসব শিশুর বয়স দশ বছরের নীচে, তারা জানেই না, বৃষ্টি কাকে বলে?”

    ——তা তো জানেই না’– খুব সহজ স্বরেই পাণ্ডেজি বললেন, ‘আমার নাতিনাতনিরাই বৃষ্টি দেখেনি! আমাদের বনজঙ্গলের অবস্থা অতি করুণ! রাণে ফলসের জলধারাও শুকিয়ে গিয়েছে—এখান দিয়ে তোড়ে জলপ্রপাত ঝরে পড়ত, দূর থেকে তার গর্জনের শব্দ পাওয়া যেত—সে শব্দ আর শুনি না। জলই নেই!

    পাণ্ডেজি রেখার শ্যুটিং দেখেছেন, কোন কোন পাথরে পা রেখে রেখে রেখা নিচে নেমেছিলেন, নন্দনাকে সেইসব পাথরগুলি তিনি চেনাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু নন্দনা খুব ট্যালা, যত্রতত্র ধপাধপ পড়ে যায়। আমি তাই ওকে নিরস্ত করলুম। রেখার মুগ্ধ ভক্ত আমিও— অন্যভাবে বরং তাঁকে অনুসরণ করুক আমার মেয়ে—খাদে নেমে কাজ নেই।

    —তাহলে তোমার নুড়িপাথর কুড়োনো হবে কেমন করে মা? তুমিও তো নিচে নামতে পারবে না!’ মেয়ের উদ্বিগ্ন মুখ! সত্যিই তো—তবে থাক নুড়ি কুড়োনো, মেয়ে আগে। পাণ্ডেজি বললেন, ‘নুড়ি? এক্ষুনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ ঝরনার ধারে বোরড মুখে অকেজো এক সিকিউরিটি গার্ড ঘুরছেন। তাঁকেই ডেকে বললেন, ‘ভাইয়া নন্দনার মায়ের জন্য কিছু রঙিন নুড়িপাথর নিচ থেকে কুড়িয়ে এনে দাও তো। ততক্ষণ আমরা লাঞ্চ খেয়ে আসছি।’ লাঞ্চ খেয়ে আসতে না আসতে এক প্লাস্টিকের থলিতে পুরে হাস্যবদনে এতগুলো রঙিন নুড়ি নিয়ে এসে হাজির নিরাপত্তারক্ষী মশাই। নন্দনা নিজে খুশি হয়ে তাঁকেও খুশি করে দেয়। কিন্তু নিজের হাতে বেছে বেছে নুড়ি কুড়োনোর সেই আহ্লাদ কি এতে মেটে? সত্যিই নুড়িগুলোর অসামান্য বর্ণবৈচিত্র্য। আমার মনে পড়ে গেল শৈশবে চার বছর বয়সে কন্যাকুমারীর সৈকতে গিয়ে তিন-চার রকম রঙের বালি-কাঁকর দেখেছিলুম। হলুদ, লাল, মেরুন, সাদা, কালো। দেবীর বিয়ের জন্য রান্না করা ভোজ-মেয়ে কুমারী রয়ে গেল। দুঃখে উৎসবের সব খাদ্য সমুদ্রে ঢেলে দিলেন রাজা। সেই খাদ্য, চাল, ডাল, পোলাও এখন বালি-কাঁকর হয়ে পড়ে আছে! সে-বালি তখন ইচ্ছেমতো কুড়িয়ে আনা যেত, আবার তালপাতার বাক্সতে ভরে বিক্রিও হত। এখনকার খবর জানি না।

    রাণে ফলস থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবছি কেমন করে এই তন্বী ধারাটি পূর্ণতনু ‘কেন’ নদীতে পরিণত হল? ছবিতে দেখেছি, সে-নদী গায়ে গতরে বেশ ভালই! নন্দনাকে বলি, “চল কর্ণাবতীর তীরে পান্না অভয়ারণ্যে বেড়িয়ে আসি একদিন, তোর যেদিন সময় থাকবে।’ যেই সময় হল আমরা মা-মেয়েতে বেরিয়ে পড়লুম। নন্দনার সহকর্মী, ওই ছবিতে আরেক অভিনেত্রী ব্রিটিশ মেয়ে ক্যারোলিন বলল, ‘আমিও যাব—নইলে আমার কিছু দেখা হবে না—এদের কোনও ট্যুরিস্ট ইন্টারেস্ট নেই। ভাগ্যিস, নন্দনা, তোমার মা এসেছিলেন বেড়াতে? নইলে আমরা কেউ কিছুই দেখতাম না।’

    পান্না অভয়ারণ্য খুব বেশি দূরে নয়, ঘণ্টা দুয়েকের পথ। কর্ণাবতীর কূলে দুটি চমৎকার বিশ্রামের ঠাঁই আছে। একটা হচ্ছে ‘ট্রি-হাউস’—গাছের ওপরে মাচা বেঁধে চায়ের দোকান— আমি নাম দিতুম নিশ্চয় ‘ট্রি হাউস টি-হাউস।’ কিন্তু এদের দেওয়া নাম ‘গিল ট্রি-হাউস’। তারই পাশে আছে, ‘কেন রিভার লজ’। ‘টি হাউসে’ ঠাণ্ডা-গরম কাপের ও বোতলের পানীয় পাওয়া যায়। ‘কেন রিভার লজে’ খাদ্যদ্রব্য, লাঞ্চ, ডিনার—এইসব। প্লাস ৪টি ঘরও রাত্রিবাসের জন্য ভাড়া পাওয়া যায়—নদীর ওপরে ঝুঁকে আছে এই দুটি বিশ্রামাগার। আমরা ঠিক করলুম পান্না অভয়ারণ্যবিহারঅন্তে ‘ট্রি হাউসে’ গিয়ে চা খাব, তারপর পাশের ‘কেন রিভার লজে’ ডিনার সেরে হোটেলে ফিরব। অভয়ারণ্যে তো সন্ধ্যার পর থাকতে দেবে না। তখন সেই অরণ্য শুধু পশুদের অভয়ের জন্য রিজার্ভড। মানুষ বড় বিপজ্জনক জীব। নিশাকালে নট অ্যালাউড। বনে তখন বাঘেরা বেরোয়, জল খেতে আসে। জল তেষ্টা পেলে আসে হাতি, হরিণ, আর আসে দাঁতাল শুয়োর। যাকে আমরা বরাহ বলি। খাজুরাহো মন্দিরে একটি ‘বরাহদেবের মন্দির’ আছে। তিনি অবশ্য বিষ্ণুর অবতার।

    পাণ্ডেজি বললেন, ‘প্রথমে বরং চলুন আমরা যাই পাণ্ডব ফলসে। বিন্ধ্যাচলে যখন পাণ্ডবরা এসেছিলেন তাঁরা এইখানেই থাকতেন। দ্রৌপদীজি জল আনতেন ওই ঝরনা থেকে, ওঁদের সেই গুহাঘরটি আজও আছে। দেখবেন চলুন।’ চললুম। নন্দনা, ক্যারোলিন আর আমি। পথের পাশে পলাশ ফুটে লাল হয়ে আছে। ঘাসগুল্ম যদিও বেঁচে নেই, সবই শুকনো, মাটির অনেক নিচে থেকে জল টেনে এনে ফুল ফুটিয়েছে পলাশ! পাণ্ডেজি পলাশ ফুলের অন্য কী এক নাম যেন বলেছিলেন, এখন মনে পড়ছে না। কিন্তু বললেন, হোলির সময়ে যে ‘ফাগ’ তৈরি হয়, সেটি মেয়েরা তৈরি করে এই ফুল থেকে। ফাগুন মাসের ফাগ যে সত্যি সত্যি পলাশের রঙে তৈরি হয়, তা আমাদের জানা ছিল না এত রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেও! একটা পলাশ ফুলের ডাল আমাদের ভেঙে এনে দিলেন পাণ্ডেজি। বারণ নেই কোনও। পথের ধারের বনফুল এরা।

    পান্না ফরেস্ট

    পরিবেশের কারণে পেট্রলচালিত গাড়ি ভিন্ন অরণ্যে প্রবেশ নিষেধ।

    টিকিটপত্তর কেটে, আমরা নিজেদের গাড়ি নিয়েই পান্না অভয়ারণ্যে প্রবেশ করি। সঙ্গে একজন গাইড ভাড়া নেওয়া (পাণ্ডেজির অনিচ্ছা সত্ত্বেও) হল। এক তো বনজঙ্গলে পথ হারিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে নেই, আর দুই, তিনিই জানবেন কোন অঞ্চলে কোন জন্তুর দেখা মিলবে। এদিকে বৃষ্টি হয় বলেই মনে হল—বনাঞ্চল বেশ সবুজ। ‘কেন’ নদীর ব্রিজটি চওড়া। রাণে ফলসের সেই কৃশকায়া বালিকা ঝরনা এখানে স্ফীতমধ্যা প্রৌঢ়া। কর্ণাবতী নদীকে নদীর মতোই রূপসী দেখতে। পার হয়ে গিয়ে পান্না ফরেস্ট।

    আমাদের গাইড খুব যত্ন করে বনের প্রাণীদের সঙ্গে দেখাশুনো করিয়ে দিলেন। প্রথমেই বাঁদর পরিবারদের সঙ্গে মৈত্রীপূর্ণ দেখা। মা-বাবা-শিশুরা সপরিবারে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীতে ঘোরাফেরা করছে। তারপর ময়ূর-ময়ূরীরা।

    পান্না অরণ্যটি বিন্ধ্যাচলের একটি আশ্চর্য অংশে—পাহাড়ের চূড়োগুলি এখানে চ্যাপ্টা, ‘ফ্ল্যাটটপ হিলস’। মনে পড়ে গেল, কেপটাউনে এমনই এক চ্যাপ্টা শীর্ষ পাহাড় আছে ‘টেবলটপ’ বলে, টেবল মাউন্টেন তার নাম। পান্নার প্রধান অরণ্যসম্পদ, পশুপ্রাণী বাদে, তার অসাধারণ সেগুন কাঠের সংরক্ষিত জঙ্গল—বিখ্যাত সি পি টিক, যা ‘বার্মা টিক’-এর দিশি জবাব। (সি পি ছিল সেন্ট্রাল প্রভিন্সের নাম, এখন যা মধ্যপ্রদেশ) এই সেগুনবন এখন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, মানুষের অর্থলোভে চুরিচামারি হচ্ছে কাঠ। পান্না সেই অল্প কয়েকটি অরণ্যের অন্যতম যেখানে এখনও সেগুনবন আছে, কাঠুরের কুঠার এড়িয়ে। যেমন আছে চিতল হরিণ, নীলগাই, প্যান্থার। যেতে যেতে ঝরনা, ছোট ছোট পাহাড়ি নদী। জলাশয় পার হচ্ছি- হঠাৎ একটি পাহাড়ি ঝরনার জমে থাকা জলের ধারে দলে দলে হরিণ-হরিণী, হরিণশিশু দেখে আমরা মুগ্ধ। তারা গাড়ি ভর্তি দর্শক দেখতে অভ্যস্ত, আশ্রমমৃগের মতো নির্ভয়ে চেয়ে রইল জল খেতে খেতে। পালিয়ে গেল না। পালিয়ে গেল বুনো শুয়োরেরা কয়েকজন। যতক্ষণ পশ্চাৎ প্রদর্শন করছিল, দিব্যি ছিল। যেই মুখ ফিরিয়ে গাড়ি দেখল ছানাপোনা সমেত ছুট ছুট! এত ভীরু দাঁতাল হলে চলে? তবে না, চিতাবাঘ দেখিনি, বাঘও না। তাঁদের পাড়া দিয়ে বেড়ালুম কিন্তু তাঁরা রাত না হলে বেরোন না সাধারণত। খরগোশ আর শেয়ালেরা (নেকড়ে ভেবেছিলুম কিন্তু নাঃ নেকড়ে নয়! শেয়ালই।) নির্ভয়ে ঘুরছে।

    কর্ণাবতী নদীর এধারে পান্না অরণ্য। নদীর ওপাশে নদীকূলে একটি প্রাচীন রাজপ্রাসাদ দেখা যায়—সেখানে রাজাদের চড়ুইভাতির জায়গা ছিল। তাঁরা বন্ধুবান্ধব সঙ্গীসাথীদের নিয়ে শিকারে আসতেন। ওইখানে রানিদেব মহল, ভৃত্যদের মহল, সব আছে। মন্দিরও। ওপারের নদীতীরে সন্ধ্যার আলোতে মায়াময় হয়ে প্রাসাদশিখর, মন্দির, সব কিছুর সিলুয়েট ছবি ফুটেছিল গোধূলি আকাশের ঝলমলে পটভূমিকায়। আর নদীতে ছিল বেশ কিছু ঘুমন্ত, ভাসন্ত কুমির—তারা নাকি অরণ্যেরই অংশ, এই কুমিরগুলিও সরকারি সংরক্ষিত প্রাণী। পান্না

    অভয়ারণ্যে প্রচুর গাছ আছে, সব চেনাশোনা গাছ—মাঝে মাঝে ঝরনা আছে— একটু একটু ফাঁকা জায়গা— আর মাঝখান দিয়ে আমাদের পথ। একটা অচেনা-অদেখা ফুলের গন্ধ মাতিয়ে রাখছে বাতাস, হঠাৎ হঠাৎ আসছে, যাচ্ছে।

    ট্রি হাউস

    জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে আমরা চললুম ট্রি হাউসের দিকে। ট্রি হাউসের সিঁড়িটা চওড়া, আর নিচু নিচু—লাঠি নিয়ে আমিও উঠতে-নামতে পেরে গেলুম। গাছের ওপরে মাচা বেঁধে বারান্দা, তাতে চেয়ার-টেবিল পাতা, সামনে দিয়ে কর্ণাবতী শান্ত বয়ে যাচ্ছে— সূর্যাস্তের রক্ত ঝরছে তার বুকে। যতক্ষণ সম্ভব চেয়ে থাকা যায়। নৌকোবিহারও করা যায় কিন্তু আমার পক্ষে মাটি বেয়ে সেখানে নেমে নৌকোতে চড়া অসাধ্য। মেয়ে আর ক্যারোলিনও গেল না। তাছাড়া সময় ছিল না, মশা ও পতঙ্গ নিয়ে সন্ধ্যা চটপট নেমে পড়ল। আমরা একটি ওয়াইন নিয়ে তিনজনে খেলুম। সামনে নদীতে সূর্যাস্ত দর্শন করতে করতে ট্রি হাউসে বসে এটাই ইচ্ছে করল। পাণ্ডেজির গাড়ি অনেক দূরে ফেলে রেখে, আমাদের বেশ খানিকটা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে বাঁশের পুল পেরিয়ে। বনজঙ্গল ভেঙে। এই ট্রি হাউসেরই একজন লোক গিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এল গাড়ি থেকে। রাত আরেকটু বাড়ল। অরণ্যের সেইসব রহস্যময় শব্দ শুরু হল, যা কেবল নৈঃশব্দ্যকেই গাঢ় করে। আর গুচ্ছ গুচ্ছ জোনাকি জ্বলল, অন্ধকারকে গাঢ় করতে। একটু পরে কেন রিভার লজে গেলুম ডিনার খেতে। এই ট্রি হাউসটি যাঁর বানানো, তিনি এক সাহেব, তাঁর স্ত্রী এদেশি। তাঁদের নাতির নাম ‘বো’, তার আরও একটি হোটেল (সুইস কটেজ) আছে খাজুরাহোতে। সেটাই আমাদের সান্ধ্য আড্ডার ঠেক হয়েছে। বো তাই তার দাদুর হোটেলে জানিয়েছে তার বন্ধুরা যাচ্ছে। ফলে আমাদের বিশেষভাবে আদরযত্ন করা হল। ‘বো’ ছেলেটি নন্দনার বন্ধু। দলের আরেকজন সদস্য হয়ে গেছে এখন। তার সাহেব দাদু এখানেই সেটল করেছেন, মারাও গেছেন এখানেই। কিন্তু ‘বো’-র বাবা বিলেতে ফিরে গেছেন। তার মা এবং ঠাকুমা কিন্তু এখানে আছেন। আর চমৎকার দুটি কুকুর তার সর্বদার সঙ্গী। একটি বিশাল, আরেকটি ছোট্ট। বো ছেলেটিকে ভাল না লেগে উপায় নেই, এত পরোপকারী তার স্বভাব। পাণ্ডেজিরও স্বভাবটি খুব উষ্ণ, ভাড়ার গাড়ির ড্রাইভার বলে তাঁকে মনে হয় না। নন্দনার কাকাজ্যাঠা বলে মনে হচ্ছিল। আমাদের পান্না অরণ্য ভ্রমণ সর্বাঙ্গ সার্থক হল।

    পাণ্ডব ফলস

    পাণ্ডব ফলসের অরণ্যে ঢুকে পড়লে, অনেকটা ভেতর পর্যন্ত গাড়ি যায়—কিন্তু গাড়িরও টিকিট লাগে, তার যাত্রী মানুষদেরও। হেঁটে ঢুকলে টিকিট খরচ খুব কম। ক্যারোলিন হেঁটে ঢুকল। ভেতরে গিয়ে তাকে আমরা গাড়িতে তুলে নিলুম। পাণ্ডব ফলসে পৌঁছে সত্যিই আমরা বাদ্ধ। তার সৌন্দর্য দেখলে নিশ্বাস নিতেও সঙ্কোচ হয়— শান্তি বিঘ্নিত হবে না তো?

    আমার সেল-ফোনের ‘প্রেরিত সংবাদে’ পাণ্ডব ফলসের বর্ণনা রয়েছে ‘অপরূপ এক পাতাঝরা অরণ্যের মধ্যে একটি পাথরের ওপরে আমি বসে আছি। এই সেই বিন্ধ্যাচল পর্বত। দূরে যে ক্ষীণ ধারা, বর্ষা পেলে সেই খেপে উঠবে, ‘পাণ্ডব প্রপাত’ তার নাম। দ্রৌপদী এখানে গাগরী ভরণে আসতেন। আমি এখান থেকে চোখ বুজেই দেখতে পাচ্ছি সেই দৃশ্য।’

    পাহাড়ের ধাপে ধাপে সিঁড়ি নিচে নেমে ঝরনায় পৌঁছে গেছে, জলের কাছে, অনেক নিচে। আমার তো নামার প্রশ্ন নেই। পাণ্ডেজিও গেলেন না। নন্দনা আর ক্যারোলিন নামল। আমি ওপর থেকে দেখলুম, ঝরা পাতার পথে ওরা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। আধঘণ্টা পরে হৈ হৈ করতে করতে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল তিনজনে–এক স্বনিযুক্ত ছোকরা গাইড সহ। ওরা সব দেখে এসেছে, পাণ্ডবদের প্রবাসগৃহ, গুহাঘর। দ্রৌপদীর কলসি ভরার ঘাট। উঁচু উঁচু গাছে ঘেরা ঝরনা, বিন্ধ্যাচলের কালো পাথরের পাহাড়ের বুক চিরে ঝরছে। এখন জল খুব কম। কিন্তু বর্ষার পরে জল অনেক বেড়ে যাবে, তখন ঝরনার শব্দই বদলে যাবে! ছোকরা গাইড জানালেন, ‘এখান থেকেই জল দেখতে পাবেন তখন

    মন্দির

    আর প্রাকৃতিক সম্পদ না দেখে, এবারে আমাদের মন্দির দর্শনের পালা। নন্দনার পরবর্তী ছুটির দিনে। মন্দির দর্শনে আমরা মা-মেয়ে দুবার গেলুম। দিনের বেলায় গাইড সহ একবার, আর রাতের আঁধারে আলোক আর শব্দের লীলাময় ‘ধ্বন্যালোকে’ মন্দিরের নৈশ শোভা অবলোকন করে আসতে আরেকবার। রাতের প্রোগ্রামটা মন্দ নয়, তবে এমন কিছু আহামরিও লাগেনি আমাদের। অনেক কিছু উন্নতি করা সম্ভব এতে। তবে টিকিটের দাম বেশি নয়। প্রধানত মন্দিরগুলির ইতিহাসই একটু নাটকীয়ভাবে বলা হয়।

    দিনের বেলাতে সেই বাগানেই মন্দির দর্শন করলুম আমরা, গাইড নিয়ে। আমাদের ইংরিজিভাষী গাইডের বুক পর্যন্ত লম্বা কাঁচাপাকা দাড়ি। গাঁজাখোরের মতো রক্তচক্ষু। যদিও চশমার পিছনে। জানালেন, তিনি স্থানীয় লোক, জাতে ক্ষত্রিয়। আটটা ভাষা জানেন, তিনটি ইউরোপীয় ভাষা বলতে পারেন। পরনে হাফশার্ট, পায়ে চটি, হাঁটু অবধি গোটানো লুঙ্গি। কাঁধে লুটোনো চুল—তার ইংরিজিটি এতই স্বচ্ছন্দ, ওই ভজকট চেহারার সঙ্গে সেই বাক্পটুত্বের মিল নেই বিন্দুমাত্রও।

    তিনি আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলেন দেবীমণ্ডপ, আর বরাহ মন্দির দেখাতে। দুটি পাশাপাশি। কিন্তু কোথাও আমি ভেতরে ঢুকে দেখতে পাইনি, অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। সিঁড়ি ভাঙা আমার নিষিদ্ধ। গেছি নন্দনার গেস্ট হয়ে, কেমন করেই বা পা মচকে শুয়ে পড়ার রিস্কটা নিই? যদি শুয়ে পড়ি? এখানে ডাক্তার বদ্যি হাসপাতাল করবার লোক নেই। বেচারি নন্দনার শ্যুটিং চলছে। ওকে ডিস্টার্ব করা যায় না। আমাকে সতর্ক থাকতে হবে। সুতরাং কোনও মন্দিরেরই গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে পারিনি। ঈশ্বর ভাগ্যিস মন্দিরের মধ্যে বসে বসে ভক্তের জন্য অপেক্ষা করেন না? তিনি আমার মতোই অধীর, যত্রতত্র চলে আসেন ভক্তের সঙ্গে সুতোর গেরো বাঁধতে।

    আমরা খাজুরাহোর পশ্চিমদিকের মন্দিরগুচ্ছটিই কেবল দেখেছি। পূর্বেও আছে আরও একগুচ্ছ প্রাচীন মন্দির। কিন্তু আমার না ছিল হাতে সময়, না পায়ে জোর। আমি বেছে নিই পশ্চিমের বেশি পরিচিত মন্দিরগুলোই—যদিও অনেক হাঁটতে হয় ভেতরে। পরে অবশ্য জেনেছি, হুইল চেয়ার পাওয়া যেত—বিদেশের জাদুঘরে, চিড়িয়াখানাতে যেমন প্রতিবন্ধীদের জন্য সুব্যবস্থা থাকে, সেটা এখানেও আছে। কিন্তু সে তো জেনেছি পরে। ঘোরাঘুরি, হাঁটাহাঁটি মন্দ হল না চাঁদিফাটা রোদ্দুরের মধ্যে। মন্দিরগুলির বহিরঙ্গেই বন্দি রইল আমার চোখ, আমার মন। তাতেই মুগ্ধ মোহিত-অন্তরঙ্গ হওয়ার আর দরকার হল না। মেয়েরা মন্দিরে ঢুকল। এঁরা তো জ্যান্ত ঠাকুর নন, বিদেশিদের প্রবেশে বাধা নেই। ক্যারোলিন তো ব্লন্ড! জানি না, পাঁচিলের ওধারে ওই ভুঁইফোঁড় বিশাল বড় মাতঙ্গেশ্বরের শিবমন্দিরে (যেটি একমাত্র চালু মন্দির, রোজ পুজো-আচ্চা হয়, ঘণ্টা বাজে) বিদেশিরা প্রবেশ করতে পারেন কিনা। শুনলুম তিনি খুবই জাগ্রত দেবতা। ভক্তের প্রার্থনা শোনেন। কিন্তু দেবতা নিজে না টানলে নাকি তাঁদের দেখা মেলে না। ওই শিবমন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে সন্ধ্যারতি দর্শন এ যাত্রায় আমার কপালে ছিল না।

    দেবীমণ্ডপটি ছোট্ট মন্দির, তাতে দেবীমূর্তি আছেন। পাশাপাশি, বড়সড় বরাহ মন্দিরে এক বিশাল বরাহ অবতারের মূর্তি আছে। তার সর্বাঙ্গে বরাহ অবতারের মূর্তি আছে। তার সর্বাঙ্গে ছোট ছোট পৌরাণিক দেবদেবীর মূর্তি অতি যত্নে খোদাই করা হয়েছে—দেবদেবী, নরনারী, জীবজন্তু, গ্রহদেবতা, খেচর, জলচর, ভুচর, সব্বাই! বিশাল বরাহ মূর্তিটি মনোলিথ, একটি অখণ্ড বালিপাথর কুঁদে তৈরি করা। (মাতঙ্গেশ্বর শিবও নাকি তাই। শিবলিঙ্গ মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছেন, একটিই পাথর, এখনও নাকি দৈর্ঘ্য বাড়ছে তাঁর!) বরাহটি লম্বায় ২.৬ মিটার, আর দৈর্ঘ্যে ১.৬ মিটার। বরাহ অবতারের এখানে বরাহ মূর্তি—কিন্তু খাজুরাহোতেই জগদম্বী মন্দিরে বরাহ অবতার দেবতাদেহী। এক বলবান যুবকের দৈবশরীরে বরাহের মুণ্ড। কোলে যত্ন করে ভূদেবীকে বহন করছেন, প্রলয়ের জলধি থেকে তাঁকে রক্ষা করে। গ্রিক দানব মিনোটর-কে মনে পড়িয়ে দেয় এই বরাহমুণ্ড দেবমূর্তি। কিন্তু বরাহ মন্দিরের বিষ্ণু পুরোপুরিই বরাহ শরীর। (‘বরাহ’ আর ‘BOAR’ শব্দদুটিতে কেমন মিল?) তাঁর মনুষ্যদেহ নেই। তাঁর বরাহ শরীরে বরং ৬৭৪ জন দেবদেবী। গঙ্গা, যমুনা, মুখেমাথায় নবগ্রহ আশ্রয় নিয়েছেন। ইনিই বিষ্ণু, রক্ষক।

    মাতঙ্গেশ্বর শিবের মন্দিরে এখনও শিব-পার্বতীর বিবাহ হয় মহাশিবরাত্রির রাতে। রীতিমতো সব আচার-অনুষ্ঠান মেনে পুরোহিত ঠাকুর পার্বতী-শিবের বিয়ে দেন। কিংবদন্তিতে আছে ওই রাতেই তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। তারপরে তাঁরা দুজনে ১,০০০ দৈববর্ষব্যাপী গভীর প্রণয়ে লিপ্ত ছিলেন। খাজুরাহোর মন্দিরগুলির ভাস্কর্য আমাদের মনে পড়িয়ে দিতে চায়, এই ঐশী মহামিলনই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে প্রকৃতপক্ষে চালায়।

    কুড়িটির বেশি মন্দির আছে, প্রত্যেকটি আলাদা। আর দিনের আলোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের রূপ বদলায়—মূর্তিগুলোর মেজাজ বদল হয়- ভোরের আলো, দুপুরের রোদ, গোধূলি, সূর্যাস্ত, জ্যোৎস্না, তারার আলোয় তারা আলাদা হয়ে ওঠে।

    খাজুরাহো গ্রাম

    ১৮৩২-এ আলেকজান্দার কানিংহাম সাহেব খাজুরাহো গ্রামের মন্দিরগুলিকে পূর্বে ও পশ্চিমে, দুই ভাগে বিভক্ত করেন। শতশত বছর ধরে খাজুরাহো গ্রামটি গড়ে উঠেছে ‘খাজুর সাগর’ দীঘিটি ঘিরে। প্রাচীন গ্রামটি এখনও সুন্দর। একটি মন্দির দেখার ইচ্ছে ছিল আমার, হল না। চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির। এখানে ব্রহ্মার ও বামনদেবেরও মন্দির আছে, আর আছে জৈনমন্দির, পার্শ্বনাথ ও আদিনাথ মন্দির। আমাদের ওদিকটাতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। যাওয়া হয়নি এদিকেই মাতঙ্গেশ্বর শিবমন্দিরেও। শিবসাগরের ভীরে একটু অবশ্য নেমেছিলুম- শিবসাগরই এখানে গঙ্গার মতো পবিত্র জলের উৎস, সব শুভ কাজ তার জলেই হয়। আমাদের ভাগ্য ভাল, শিবরাত্রির ঠিক পরেই গিয়েছি, তখনও শিবরাত্রির মেলা চলছে। আমরা মেলাতে গেলুম।

    শিব-পার্বতীর বিবাহ উপলক্ষ্যেই এই গ্রাম্য মেলা বসে এবং একমাস চলে— গভীর রাত্রি পর্যন্ত মেলা চালু থাকে। গীতবাদ্য সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয় শিব-পার্বতীর বিবাহতিথি উদযাপন করতে। এরকম ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি আর কোনও দেবদেবীর কপালে জোটেনি। এই বিষয়ে অপূর্ব ভাস্কর্য আছে পার্শ্বনাথ ও দুলাদেও মন্দিরের গায়ে—শিব বরবেশে আসছেন ব্যান্ডপার্টি নিয়ে শোভাযাত্রা করে। দেবদেবী, যক্ষযক্ষী, অপ্সরা, কিন্নর-কিন্নরী, সকলেই ভিড় করে বর দেখছেন স্বর্গ-মর্ত্য জুড়ে। বর দেখতে দৌড়ে ছুটে বেরিয়ে আসছে মেয়েরা—আলুথালু বেশ তাদের—কেউ স্নান করতে করতেই ছুটে এসেছে— গায়ে বস্ত্র নেই, কেউবা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে হাতে চিরুনি-আয়না। কেউ চোখে কাজল পরছিল, কেউ পায়ে আলতা পরছিল। কেউ স্বামীর সঙ্গে প্রণয়লিপ্ত ছিল—সব কিছু ছেড়ে তারা পার্বতীর বর দেখতে ছুটেছে।

    বরাহ ও দেবীমন্দিরের বিপরীতে লক্ষ্মণমন্দির। খাজুরাহোর বৃহত্তম মন্দিরগুলির অন্যতম এই মন্দিরটি বয়োজ্যেষ্ঠও বটে, ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরি। লক্ষ্মণমন্দিরের নাম যে কেন লক্ষ্মণের নামে, তা আমি জানি না। গাইড জানালেন মন্দিরটি লক্ষ্মণের নয়, বিষ্ণুর। চান্দেলা রাজবংশের তৈরি। সিঁড়ির কারণে উঠতে পারিনি, ভেতরটি শুনলুম যথেষ্ট বড় এবং সুন্দর। বাইরে প্রচুর কারুকার্য আছে সিঁড়িতে ওঠার আগেই যা দেখা যায়। মন্দির প্রদক্ষিণ করতে করতে দেওয়ালের চিত্রগুলিতে ঠিক যেন চলচ্চিত্রের মতো ধাপে ধাপে গল্প ধরা দেয়। দক্ষিণের সরু গলিপথটি দিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখা যায় নানাবিধ যৌনক্রিয়ার ছবি। এতক্ষণ গাইড মশাই চমৎকার সব বিশ্লেষণ করে দিচ্ছিলেন আমাদের। এইবারে দুই মা-মেয়েকে নিয়ে তাঁর খুব অসুবিধে হল। তিনি বললেন, ‘এখানে নানারকমের দৃশ্য আছে, সেগুলো কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য নয়। আয়ুর্বেদে বলেছে, যৌন রোগ নিরাময়ের জন্য এসব স্পেশ্যাল চিকিৎসার আসন, যোগব্যায়াম। অনেকেই তা না জেনে এসব দেখে খাজুরাহোকে ভুল বোঝে!’

    আমি আর নন্দনা শুনে হাসি চেপে গম্ভীর হয়ে থাকি, তাঁকে লজ্জায় ফেলতে চাই না। কিন্তু পিছন থেকে এক সাহেব ভ্রমণকারী সরল বিস্ময়ে বলে ওঠেন, ‘তা-ই? কী আশ্চর্য! আমাদের গাইড বইতে তো কই তা লেখেনি? গাইড বই তো অন্য কথা বলছে? বলছে কামসূত্রের বিভিন্ন ভঙ্গির উদাহরণ এখানে, ফ্রি সেক্স এডুকেশন দিচ্ছে। আবার কেউ বলেছে সেই সময়ে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছিল সমাজে, তার চিত্র। আরও বিকল্প ব্যাখ্যা শুনেছি, এসব ভঙ্গি নাকি তন্ত্রসাধনার অঙ্গ, যাঁরা তৈরি করিয়েছেন তাঁরা তান্ত্রিক ছিলেন।’ আমি এবারে অপ্রস্তুত গাইডবাবুর সহায়তায় লাগি, সাহেবের সঙ্গে ভাব জমাই। কথা ঘুরিয়ে দিই। ‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’ তিনি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে এসেছেন, ভারতবর্ষ ভ্রমণে। কাল পুবদিকের মন্দিরগুলো, জৈনমন্দির ইত্যাদি দেখবেন। আজ দেখছেন পশ্চিমের মন্দিরগুলি। তিনি লেখক, কবিতা এবং ভ্রমণ সাহিত্য লেখেন—আর তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক। (হ্যাঁ, তাইই!) তবুও আমি তাঁকে বললুম না যে আমিও কবিতা লিখি, ভ্রমণ করি, আমিও তুলনামূলক সাহিত্য পড়াই। শুনতে বিশ্বাসযোগ্য লাগত না -প্রতিধ্বনির মতো শোনাত। আমাদের বেশ ভাবসাব হয়ে গেল। একটা কাফে আছে বাগানে, চা, বিস্কুট, লিমকা ইত্যাদি খাওয়া যায়। আমি সেখানে বসে পড়ি, নন্দনা আর ক্যারোলিন, গাইড এবং জার্মান বন্ধু দেবী জগদম্বীর মন্দির ও কাণ্ডারিয়া মহাদেবের মন্দির দর্শনে গেলেন। আমার পা প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে বসে পড়ল চায়ের দোকানে। এত উৎকীর্ণ প্রবলতম যৌনতার মধ্যে আমার চোখে লেগে ছিল শিব-পার্বতীর একটি প্রণয় চুম্বন—মধুর, শান্ত, সপ্রেম। ঝুঁটিবাঁধা শংকর কী সুন্দর আলিঙ্গন করে আছেন পার্বতীকে। কাম নয়, প্রেম।

    দেবী জগদম্বী আর চিত্রগুপ্তের মন্দিরে সবচেয়ে বেশি প্রণয় দৃশ্য আছে। যেন স্ত্রী-পুরুষের শরীরী প্রেমকে উৎসব করে তোলাই এই মন্দিরগুলির কারুকাজের প্রধান উদ্দেশ্য—নরনারীর কামকে সম্বর্ধিত করছে এই যুগল মূর্তিগুলি। ‘চিত্রগুপ্তের মন্দির’ শুনেই মৃত্যু, যম, কর্মফল ইত্যাদি মনে আসে আমাদের, কিন্তু খাজুরাহোর চিত্রগুপ্তের মন্দিরে গর্ভগৃহে যে দেবতা আসীন, তাঁর নাম সূর্যদেব। সাত ঘোড়ার রথ তাঁর আসনে খোদাই করা। পায়ে বুটজুতো, হাতে পদ্মফুল। যে ফুল সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে জাগে, আর সূর্যাস্তে ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের সূর্যদেবেরও পায়ে বুটজুতো, আর মুখে দাড়িগোঁফ দেখেছি। এখানেও জুতো দেখে অবাক হই না।

    দিনের বেলার মন্দির দর্শন শেষ হল—জার্মান বন্ধুর সঙ্গে কথা হল আমরা রাতে ফির মিলেঙ্গে। একটা পল্লিগীতি আর ফোক ডান্সের শো আছে সন্ধ্যাবেলায়, সরকারি জাদুঘরের প্রেক্ষাগৃহে। খুব আগ্রহ আমাদের, মধ্যপ্রদেশের লোকনৃত্য দেখব—লোকগীতি শুনব। গিয়ে দেখি, আরে? ব্যাপারটা তা নয়। পাহাড়ি, নাগা, ছৌ নাচ, সারা ভারতবর্ষেরই লোকনৃত্যগীত চলবে ওখানে। তিনশো না সাড়ে তিনশো টাকার টিকিটে ২৬ জানুয়ারির রোড শো দেখার ইচ্ছে নন্দনার বা আমার ছিল না। শুধু যদি মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে চেনা-পরিচয় করা হত, তাতে আমাদের ১০০ ভাগ উৎসাহ ছিল। কিন্তু এখানে যা হচ্ছে, তা শুধু কমার্শিয়াল জগাখিচুড়ি! বিদেশি ভ্রমণকারীদের তুষ্টিসাধন করতে।

    আমরা ফিরে চলি হোটেলে-’তাজ চান্দেলা’র শান্ত ঘরে। আজও ক্যামেরা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলুম, যেমন সেদিন একটাও ছবি তোলা হয়নি কর্ণাবতী নদীর, পান্নার হরিণের, ট্রি হাউসের সূর্যাস্তের—কিচ্ছু না। ছবি না হোক—ওরা বেঁচে থাকুক আমাদের চোখের তারায়, শিব-পার্বতীর সেই চুম্বনটির মতো।

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅ্যালবাট্রস – নবনীতা দেবসেন
    Next Article উত্তমাশা অন্তরীপ এবং – নবনীতা দেবসেন

    Related Articles

    নবনীতা দেবসেন

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025

    সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.