Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025

    সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভ্রমণ সমগ্র ২ – নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেন এক পাতা গল্প110 Mins Read0

    অপারেশন ম্যাটারহর্ন

    তোমরা নিশ্চয়ই সেই জাপানী মহিলার নাম শুনেছো, শ্রীমতী তাবেই, যিনি এই বিশ্ব নারীবর্ষে এভারেস্ট শিখর জয় করলেন। কিন্তু তোমরা কি জানো, একবার দু’জন ভারতীয় ছাত্রী দুরারোহ ম্যাটারহর্ন শিখর বিজয়ে বেরিয়েছিল? ম্যাটারহর্ন আপ্লসের একটি শৃঙ্গ। যেমনি উঁচু তেমনি খাড়াই—বিশেষত তার দক্ষিণমুখ পর্বতারোহীদের পক্ষে বশ মানানো প্রায় অসাধ্য। বছর তেরো চোদ্দ আগের কথা—দুটি ভারতীয় মেয়ে ঠিক করল তারা ম্যাটারহর্নের দক্ষিণমুখ জয় করবে। তারা কোনোদিন মাউন্টেনিয়ারিং শেখেনি বটে, কিন্তু তাদের সাহস ছিল খুব। কেম্ব্রিজে পড়তে গিয়েছিল দুজনে ভারতবর্ষের দুই কোণ থেকে। গিয়ে ভাব হয়ে গেছে। যেমনি মনে হওয়া অমনি ঈস্টারের ছুটিতে পিঠে হ্যাভারস্যাক ফেলে, হাতে স্লিপিং ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল তারা দুজনে,—লক্ষ্য ম্যাটারহর্ন। সম্বল কষ্টেসৃষ্টে জমানো কয়েকটি পাউণ্ড, কিছু দেশের ডালমুট, কিছু ডিম, চীজ, রুটি, জেলি, এক শিশি ইনস্টান্ট কফি। এছাড়া ম্যাপ, কমপাস, হুইসিল আর টর্চ তো আছেই। কিছু চুইংগামও।

    ম্যাটারহর্নে চড়তে গেলে যেতে হয় ৎসেরমাট একটা ছোট্ট পাহাড়ী গ্রামে। ৎসেরমাট-এ যেতে গেলে প্রথমে যাওয়া দরকার জেনিভা শহরে, ট্রেন ধরতে। রেণুকা আর নবনীতা তো খুব কষ্টেসৃষ্টে একটা ট্রেনে করে প্রথমে গেল লণ্ডন, তারপর লণ্ডন থেকে আরেক ট্রেনে ডোভার, তারপর জাহাজে চড়ে ডোভার থেকে ক্যালে (সেটা ফ্রান্সে), ফের ট্রেনে চড়ে ক্যালে থেকে লিয়ঁ—আবার ট্রেন বদলে লিয়ঁ থেকে জেনিভা (সেটা সুইটজারল্যাণ্ডে)। রেলগাড়ি বদল করে জেনিভা থেকে ৎসেরমাট চলল। পথে অনেকবার চীজ কিনল, রুটি কিনল, কলা কিনল। রেণুকা আবার মাছ-মাংস খায় না। সে তামিলনাড়ুর মেয়ে। অন্যজন বাঙালি।

    জেনিভার ট্রেনটা সোজা ৎসেরমাট পাহাড়ে ওঠে না কিন্তু। পথে আবার একটা ছোট স্টেশন এসে ফুরনিক্যুলার ট্রেনে চাপতে হয়। সেই শুঁয়োপোকার মতো খুদে খুদে ট্রেনগুলো পাহাড়ে চড়তে ওস্তাদ। তার চাকার গায়ে দাঁত-দাঁত কাটা শেকল পরানো, আবার রেললাইনেও দাঁত-দাঁত খাঁজকাটা, ট্রেন শেকল আর দাঁত দিয়ে সেই লাইন কামড়ে কামড়ে খাড়া হয়ে পাহাড়ে ওঠে, খসে-টসে পড়ে যায় না। পথে প্রথমে গ্রাম ছিল, ক্ষেতখামার—আপেলবাগান ছিল, গরু-ভেড়া চরছিল, গয়লানীরা বেড়াচ্ছিল—দৃশ্য-টুশ্য স্বাভাবিক ছিল। তারপর ক্রমশ কমতে লাগল ঘরবাড়ি, মানুষবসতির চিহ্ন। কেবল বাড়তে লাগল ঝর্ণা আর, ঝাউবন। আর বরফ। ট্রেনের গতি কমে এল। মাঝে মাঝে টানেলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে, ছাদ থেকে জলের ফোঁটা পড়ছে,—মাঝে মাঝে গ্লেশিয়ার পার হচ্ছে। মস্ত মস্ত ঠাসা বরফের নদীর নাম গ্লেশিয়ার—বহু শত সহস্র বছর ধরে এইসব বরফ জমেছে—এরা নদী, কারণ খুব আস্তে হলেও, এদের গতি আছে। বছরে যদি দুই কি তিন ইঞ্চি এগোয়, সেটা তাদের পক্ষে উদ্দাম গতিবেগ। মাঝে মাঝেই গাঢ় শ্যাওলার চাদর ঢাকা মাঝে মাঝে গভীর, চওড়া খাঁজ, খোঁদল, ফাটল। কোথাও বা গর্ত। বরফের নদীর রং ঠিক সাদা নয়, কেমন স্বপ্নের মতো সবজে, নীল-মতন। হঠাৎ হঠাৎ অনেক সময়ে এইসব গ্লেশিয়ারের অংশ ধসে পড়ে গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তুষার ধস’ এই ভয়ঙ্কর শব্দটি আপ্লসের এইসব পার্বত্য গ্রামে প্রবল ভীতিকর, অলুক্ষনে। ৎসেরমাট সবাই ‘স্কী’ করতে যায় বোঝা যাচ্চে, নয়ত পাহাড়ে চড়তে। এছাড়া আর কেনই বা যাবে? এই ছোট্ট ট্রেনের ভেতরে দেয়ালে লম্বা লম্বা তাক তৈরি করা আছে। তাতে স্কী রাখা। আমরা দুজন স্কী করতে জানি না। পোশাক দেখলে অবশ্য বোঝবার উপায় নেই—এত যত্ন করে স্কী-পোশাক নকল করেছি। যত বরফ বাড়তে লাগল, তত আমার মনে হতে লাগল, ম্যাটারহর্নের দক্ষিণমুখ আমরা ম্যানেজ করতে পারব কি?”ভাই রেণুকা, ওটা এবার ছেড়েই দে বরং। যাই, গিয়ে দেখে-টেখে আসি। বড় বড় পর্বতারোহীরাই যা পারেন না, আমরা কি তা পারি? পাহাড়ে চড়ার আইনকানুনগুলোও তো ঠিক শেখা হয়নি আমাদের। তার চেয়ে বরং বাঁদিক থেকেই এবারের অভিযানটা চালানো যাক—যে-দিকটাতে স্বাভাবিক খাঁজ কেটে রেখেছেন ভগবান। ঈশ্বরের যদি ইচ্ছে হত দক্ষিণ দিক দিয়ে লোকেরা ওঠে তাহলে কি উনি এদিকেই খাঁজ কাটাতেন না? কী হবে ভাই শুধু শুধু প্রকৃতির বিরুদ্ধতা করে?”— তোমরা মনে রেখো যে, তখনও ভারতবর্ষের মেয়েদের পর্বতারোহণের চল ছিল ন। তাছাড়া আমরা দুজন পার্বতী নই কোনওরকমেই দুজনেরই সমতলে জন্ম, সমতলেই মানুষ হয়েছি। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের আশা এবং উৎসাহ পর্বতপ্রমার আকাশচুম্বী।

    ছোট্ট স্টেশন ৎসেরমাট-এ নামলুম মাত্র ক’জন যাত্রী। শুধু আমরাই ভারতীয়। নামতেই দেখি ক্ৰাচ-বগলে কয়েকজন লোক গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে। হাড়কাঁপানো শীতে হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে গান গাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ক্রাচ কেন? একসঙ্গে এতগুলো খোঁড়া লোক? স্টেশনের সামনেই দেখি এক রাজসূয় কাণ্ড—কী সুন্দর একটা ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছে, কী তার রং, কী তার ঢং। অপু-দুর্গার রেল দেখতে ছোটার মতন, অগ্র-পশ্চাৎ বিস্মৃত হয়ে ম্যাটারহর্ন অভিযাত্রী- যুগল ঘোড়ার গাড়িটার পেছন পেছন ছুটলাম। যেন কোমরে ঘুনসি-বাঁধা আদুড়-গা অপোখণ্ড; কৌতূহলে এতই ডগমগ আমরা। না জানি কারা চড়েন এই গাড়িতে? এ দৃশ্য তো সুলভ নয় পশ্চিমি শহরে—একটা বরফমোড়া স্বপ্নরাজ্যে এটা বরং মানিয়ে গেছে। রথ থামল ‘পোস্ট অফিস’ লেখা একটা দরজার সামনে। ভেতর থেকে কোন রাজা-রাজকন্যে বেরুবেন, দেখব বলে আকুল নয়নে দাঁড়িয়ে আছি—প্রথম নামল ক্রাচ। তারপর মানুষ। আরো ক্রাচ আরো মানুষ। নারী, পুরুষ, শিশু। সবার বগলেই ক্রাচ—ছোট্ট ক্ৰাচ, বড় ক্রাচ, বেঁটে ক্রাচ, লম্বা ক্রাচ। ইত্যাদি।

    ব্যাপারটা কী? এত ক্ৰাচওলা লোক কেন—একি কেবল খোঁড়াদের দেশ? হটস্প্রিং-টিং আছে। রাজগীরের মতো।”—ও হরি, তাই বল! আমি এবার নিশ্চিন্ত হলাম। রাজগীরে যেমন লাঠি হাতে পঙ্গু লোকের ছড়াছড়ি, এও তেমনি। সুইটজারল্যাণ্ডের রাজগৃহ এটা। বরফ-নদীর নীচে হটস্প্রিং। ঈশ্বরের কী আশ্চর্য লীলা। প্রকৃতির কী অপ্রাকৃত ইন্দ্রজাল? আহা, এ গাড়িটা তাহলে খোঁড়াদের গাড়ি? কৌতূহল মিটল।—এবার গেলুম মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে।

    ইয়ুথ হস্টেলে জায়গা নেই। একটাও হোটেল আমাদের বসবাসের যোগ্য নয়, কারণ সেখানে আধ-বেলা ঠাঁই নেবার মতনও রেস্ত আমাদের নেই। একটা পাঁসিয়নেটে গেলুম। এক গৃহস্থ মহিলা বাড়িতে ঘর ভাড়া দেন। এদেশে এটাই রীতি। তিনিও বললেন, জায়গা নেই। শুধু ছাদের ঘরটায় জায়গা আছে—কিন্তু খাট মাত্র একটা। আমরা যত বলি খাট-বিছানা চাই না, আমরা মেঝেতে দিব্যি স্লিপিং ব্যাগ পেতে শোব—মহিলা বলেন, “ওসব চলবে না, খাটে শোয়া চাই। একজন মাত্র থাকো, অন্যজন অন্যত্র পথ দ্যাখো।”—তাই কি হয়? আমরা শেষে বললুম, “দুজনেই ঐ ঘরে শোব।” উনি বললেন, “তাহলে আমাকে পুলিশে ধরবে।” আমরা বললাম, “একজনের ভাড়া নিন তাহলে। দুজনের নেবেন না। আপনি কাউকে ফ্রী থাকতে দিলে পুলিশের কী?”—আমাদের নাছোড়বান্দামি এবং আহ্লাদপনা দেখে শেষটা তিতিবিরক্ত হয়ে মহিলা বললেন, “যাও—যা খুশি করগে যাও, দুজনে মিলে এক বিছানায় ঠাসাঠাসি করে মর, আমি জানি না।”—আনন্দের চোটে তাঁকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল—কিন্তু দুধ-ঘি-সর খেয়ে সুইস মহিলাদের বপু এমনই বিপুল হয়, সে সাহস হল না। মহা আনন্দে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আমরা ঘুপচি ঘরে গেলাম। ঘরে আলো জ্বলছিল না। প্রথমেই ঘুরে ঘুরে আবছা অন্ধকারে আলোর সুইচ খুঁজতে লাগলাম। এক একবার রেণুকার মাথায় ঠোক্কর লাগে, আর “আহা! আহা!” বলতে-বলতেই ঠাস করে আমারও মুণ্ডু ছাদে ঠুকে যায়—এমনিভাবে সুইচ খোঁজা চলল। দরজার বাঁয়ে, দরজার ডাইনে, খাটের এপাশে, খাটের ওপাশে, নাঃ নেই। সুইচ কোত্থাও নেই। তবু ভাল যে টর্চ আছে সঙ্গে। ক্লান্ত হয়ে খাটে বসলাম। সিংগল খাট। নরম তুলতুলে তোশকের ওপর দুধের ফেনার মতো চাদর টানটান পাতা। একটাই মাত্র কম্বল, ভাঁজ করা আছে। বিছানায় বিলেতের ধরনে চাদর গোঁজা নয়। রেণুকা দেখল, দরজায় ছিটকিনি—অর্থাৎ তালা নেই। হোয়াট? নো লক, নো লাইট? রেণুকার মুখ শুকিয়ে গেল। “তুইও যেমন! আমাদের আছেটা কী, যে চোরে নেবে? লক দিয়ে কী হবে?”—রেণুকা খুব চটে গেল।—”আছেটা কী? কেন, তুমি রামায়ণ পড়োনি? সীতাহরণের কথা জান না? ছেলেধরার কাহিনি শোননি কখনও?” বাঃ।—যত বলি, “ওরে রেণুকা, তুইও সীতা নোস, আমিও সীতা নই, তাছাড়া সে-রামও নেই, সে-রাবণও নেই,”–কে শোনে কার কথা! “দ্যাখ্ রেণুকা, এতেই ভয়? ভুললে চলবে না, আমরা ম্যাটারহর্নের দক্ষিণাপথ অভিযাত্রী।” রেণুকা ধমক দিয়ে উঠল—”পাহাড়ের বিপদ আলাদা। তা বলে ঘরের বিপদে ভয় করবে না?” রেণুকার মাউন্টেনিয়ারিং-এর মুডটা নষ্ট হয়নি দেখে সান্ত্বনা পেলুম।

    এদিকে পেট চোঁচো করছে। খিদেয় নাড়ীভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি কিছু ডিমসেদ্ধ রুটি জ্যাম খেয়ে বেশ খানিকটা জল খেলুম। কলে গরমজল ছিল না, যে কফি গুলবো। থাক, জলটা হয়তো আদিতে হটস্প্রিংয়ের কে জানে? নিশ্চয় খেলে শরীর ভাল হবে। —কী ঠাণ্ডা জল রে বাবা! ঘরটাও ঠাণ্ডা, হীটেড নয়। একটা হীটার অছে, পয়সা ফেললে জ্বলা উচিত, যেমন জ্বলে ইংলণ্ডের ভাড়াবাড়িতে। কিন্তু পয়সা ফেলব কোথায়? এই চিলেকুঠুরিতে সস্তার সত্যিই তিন অবস্থা—হাঁটার আছে কিন্তু পয়সা ফেলার ব্যবস্থা নেই, অমনিও জ্বলছে না। এটা ওটা টিপেটুপে দেখলুম, নাঃ, হীটার নট জ্বলন নট কিচ্ছু। সুইচ নেই।—একেই পথশ্রমে শরীর অতিরিক্ত ক্লান্ত, তায় ঘর কনকনে ঠাণ্ডা, শুতে পারলে বাঁচি—কিন্তু রেণুকা অরক্ষিত রুমে কিছুতেই ঘুমোবে না। সে ঘরের একটি মাত্র চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে রইল-দরজা বন্ধ না হলে শোবে না। এ তো কলকাতা থেকে পুরী যাওয়া নয়, এ হচ্ছে ম্যাটারহর্ন অভিযান। সঙ্গে তো দেশের মতো বেডিং-ট্রাঙ্ক-বালতি-লণ্ঠন কিছুই নেই, যা দিয়ে দরজায় ঠেকা দেবে! শেষে টেবিলটাই টেনে এনে দোরে ঠেস দিয়ে, তার ওপরে চেয়ারটাকে তোলা হল। নিচু সিলিংয়ে প্রায় ঠেকে যাচ্ছে। দেখে মনে হয় শুধু ছাদ থেকে দড়িটা বেঁধে ঝুলে পড়লেই হল, যেন ফাঁসি-যাবার সব বন্দোবস্ত পাকা। রেণুকা এবার শুতে রাজি হল। কিন্তু সমস্যা কে খাটে, কে মাটিতে? কেবা আগে প্রাণ করিবেক দান? এ বলে তুই খাটে শো। ও বলে তুই খাটে শো। শেস পর্যন্ত ঠিক হল দুজনেই খাটে শোব। কম্বলখানি টেনে নিয়ে কোটটোট মোজাটোজা সুদ্ধু দুজনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লুম– বুট দুটো খুলে রাখলুম দোরগোড়াতে। শুয়ে পায়ে স্লিপিং ব্যাগ দুখানি চাপা দিলুম—দিয়ে শুরু হল ঠক-ঠকানি। রেণুকার সীতাহরণের ভয় কাটছে না, আমার নিমোনিয়ার ভয় ঢুকেছে। ঘুম হল তা সত্ত্বেও। সকালবেলার আলোয় যেই জানালার চৌকো কাঁচগুলো জলরং হয়ে ফুটে উঠতে শুরু করল, আমি উঠে পড়লুম। উঠতে গিয়ে মুখে কী একটা নোংরা সুতোর মতন ঠেকল। টেনে ছিঁড়ে ফেলতে গেছি যেই, অমনি টুক করে জোর আলো জ্বলে উঠল ঘরে।—ওটাই সুইচ। সিলিং থেকে ঝুলছে।

    রেণুকাও উঠে বসল। দেখা গেল দরজায় টেবিল, টেবিলের ওপরে চেয়ার, তার ওপরে দুটো হ্যাভারপ্যাক, তার নিচে দু-জোড়া বুটজুতো। আমাদের গায়ের পাশেও সিলিং থেকে ঝুলন্ত একটা ময়লা সুতো। সেটা টানবামাত্র হাটার গরম হতে শুরু করল। ঘরেই বেসিন। মুখ ধুয়ে বাসিরুটি চীজ কলা ডিমসেদ্ধ নিয়ে বসা হল। ফরাসী রুটি বাসী হলেই ভয়ানক শক্ত হয়ে যায়। ভাঙা যায় না পর্যন্ত। ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে ভিজিয়ে নরম করে তাই খানিকটা খেলুম দুজনে… উপায় কী। পয়সা কম, খিদে বেশি। খেয়ে-দেয়ে ছেঁড়া কাগজ, রুটির গুঁড়ো, ডিমের খোলা, কলার খোসা, সবই সযত্নে পকেটে পুরে ফেলা হল। কারণ খেতে-খেতেই নজরে পড়েছে দরজার গায়ে একটা নোটিশ টাঙানো…ঘরের মধ্যে খাদ্য গ্রহণ নিষিদ্ধ। এখন কোণের টুকরিতে আবর্জনা ফেললেই ঝি এসে খপ করে ধরে ফেলবে। ধরলে নিশ্চয়ই জরিমানা হবে। জরিমানা হলে ম্যাটারহর্নে ওঠা হবে না। তাই প্রমাণ লোপের প্রচেষ্টায় লেগে গেলাম দু’জনে। ভয়ে ভয়ে নিচে গেছি…কী জানি দেখে যদি বুঝতে পারে যে আমরা ঘরে খেয়েছি? মাত্র একটা পাতলা কম্বল দিয়েছে, আর ছিটকিনি দেয়নি কেন…এসব অভিযোগ করার মতন মনের জোর আর বাকী ছিল না,….নিজেরাই যেহেতু নিয়ম ভেঙেছি। আইন অমান্য করে নিজেরাই চোর হয়ে গেছি। রেণুকার মুখটা যদিও বেশ অপরাধী-অপরাধী দেখাচ্ছিল, তবুও দরজায় ছিটকিনি নেই কেন—এই মর্মে সে মৃদু অনুযোগ তুলতে গেল। অমনি মহিলা সোজা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। আর যায় কোথায়? তক্ষুনি আমাদের রাগ হয়ে গেল। পকেটের কলার খোসা-টোসার কথা ভুলে গিয়ে আমরা রেগে বললুম, চাই না থাকতে, একখানা মোটে পাতলা কম্বল, দোরে তালা নেই, তার আবার মেজাজ কত! শুনে মহিলা রাগ করলেন না, অবাক হয়ে গেলেন। “কম্বলটা তো অতিরিক্ত, ওটা একটা তো কী, অত মোটা লেপটা রয়েছে না?”

    “লেপ? কোথায় লেপ?”

    “কেন? বিছানায়?”

    “কৈ কৈ, ছিল না তো? লেপ-টেপ কিছু ছিল না।”

    “কিচ্ছু ছিল না? দেখাচ্ছি ছিল কিনা!” বলেই মহিলা থপ থপ করে বাড়ি কাঁপিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। পিছন পিছন আমরাও। এসে দেখি উনি বড়ো বালিশটা তুলে তার তলা থেকে যেন ম্যাজিকে, দু’ভাঁজ করা লম্বা চওড়া, বিশেষরূপে স্থূলবপু একটা পালকের লেপ টেনে বের করলেন। সেটা বিছানা জুড়েই পাতা ছিল। ধবধবে ওয়াড় পরানো সেই নরম লেপের ওপরেই আমরা সারা রাত্রি চেপে শুয়ে থেকে শীতে কেঁপেছি। ইংলণ্ডে বিছানা করার ঢংটা অন্যরকম বলে ব্যাপারটা মোটে ধরতেই পারিনি অন্ধকারের মধ্যে। লেপকে লেপ বলে চিনিনি…তোশক ভেবেছি। মহিলা জীবনে এমনধারা উজবুক গাঁইয়া দেখেননি আমাদের মতো।…তিনি হেসে আর বাঁচেন না!

    এবার রওনা ম্যাটারহর্নের উদ্দেশ্যে। ম্যাটারহর্নে চড়ব বলে আমরা দুজনে প্রথমে গেলাম মুদির দোকানে। তাজা নরম রুটি কিনব, কলা কিনব…কিছু কার্বোহাইড্রেট ও ভিটামিনযুক্ত খানা চাই। গায়ে বল না সংগ্রহ করে উঠব কী করে ম্যাটারহর্নের দক্ষিণাপথ বেয়ে? দু’খানা চকলেটও নিতে হবে। পর্বতারোহণে সব সময় চকলেট খেতে হয়, বইয়ে পড়েছি। চকলেট এনার্জি দেয়। চারিদিকে তুষাররাজ্য, মাঝে মধ্যে দু’ একজন ক্ৰাচবিহীন মানুষজন দেখলেই আমরা উৎসাহিত হচ্ছি…”দ্যাখ দ্যাখ, এর কিন্তু ক্রাচ নেই। আমাদের মতোই।” শীত প্রচণ্ড কিন্তু আমাদের কষ্ট হচ্ছে না। আপাদমস্তক পশমে ঢাকা…পায়ে পেল্লায় স্নো-বুট, হাতে ইয়া ইয়া চামড়ার দস্তানা, গায়ে স্কী-জ্যাকেট, পরনে স্কী-প্যান্টস, মাথায় গরম ফেট্টি বাঁধা, গলায় কাশ্মীরী স্কার্ফ। ধরাচুড়োর কোনও অভাব নেই। আমি কেবলই খুব মনোযোগ দিয়ে রেণুকাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছি…আর ভাবছি, আমাকেও অমন স্কী-বিবিটি দেখাচ্ছে নিশ্চয়। একই তো পোশাক দুজনের। সাদা তুষারে রোদ পড়লে চোখ ঝলসে যায়, তাই সানগ্লাস পরা নিয়ম। রেণুকার চোখে বিলিতি কালো চশমা…আমার যেহেতু একটা চশমা আছে, তার ওপরে দু গুণ এঁটেচি ধর্মতলার সানগ্লাস। তাতে স্মার্টনেসও দু গুণ হয়। আত্মবিশ্বাসে টে-টুম্বুর আমরা আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে ম্যাটারহর্নের দিকে এগোচ্ছি। পা টিপে, কারণ বরফ খুবলে পথ যদিও কেটেছে, সে-পথ খুবই পিছল। দুজনকেই দিব্যি, খোকা-মেম খোকা-মেম লাগছে, একমাত্র রসভঙ্গ করছে মাথার ফেট্টির নীচে থেকে ঝুলন্ত দুটো কালো বিনুনি। লেজের মতো দোদুল্যমান সেই বেণীর ডগায় দুলছে আমাদের এতোল-বেতোল দু’টি পাতি-খুকুর প্রাণ! সোঁদা গন্ধওলা দিশি-দেহাতী মন! আঃ, বেণীদুটো যদি না থাকত, কিংবা বগলে যদি ক্রাচ থাকত তাহলেই কেউ বলতে পারত না আমরা বিদেশী। বরফ ভেঙে হাঁটা বড়োই কষ্টকর কর্ম। ফুটপাথের দু পাশে কোমর অবধি উঁচু বরফের পাঁচিল, মাঝখানটা কুপিয়ে পরিষ্কার করা। কিন্তু অত্যন্ত পিচ্ছিল। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া নেই, ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে, রোদ নেই। মন-খারাপ-করা মন-খারাপ-করা একটা আলো। তা হোকগে। আমরা বেরিয়েছি যে উদ্দেশ্যে তা থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না। ম্যাটারহর্ন আমাদের ডাকছে। আসার অগে কেম্ব্রিজে যা কিছু ছবির বই, ট্যুরিস্ট অফিসে প্রাপ্তব্য সবকিছু কাগজপত্তর ভাল করে পড়ে ফেলেছি। ম্যাটারহর্ন অভিযানের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। এবার ভাল সঙ্গী জুটলেই হল। ঠিক উঠে পড়ব।

    …কিন্তু ভাই রেণুকা, এই রাস্তাই যদি এত কঠিন, এত পিছল হয়, তাহলে ম্যাটারহর্নের গা বেয়ে কি আমরা উঠতে পারব? আমরা তো কিং-কং নই। টারজানও নই। পর্বতারোহণের বুটজুতোই আলাদা, তার নীচে কাঁটা মারা থাকে। আমাদের সে-সব নেই। পড়ে যাব যে ভাই হ্যাঁ ভাই রেণুকা, এবারে ম্যাটারহর্নটা বাদ দিলে কেমন হয়? ডান-বাঁ দু দিকটাই তো বরফ দিয়ে ঢাকা। এ-জুতোয় কি হবে? ধুৎ তেরি। ভীরু বাঙালি কোথাকার। শুরুতেই কু গাওয়া?…রেণুকা ধমক দিতেই রাগ হয়ে গেল। ভীতু বলা? বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি! মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি! সেই আমাদের ভীতু বলা?… ঠিক হ্যায়। চালাও পানসি…ম্যাটারহর্ন! মনে মনে রাগলেও মুখে কিছু বলতে পারলুম না, কারণ আগেই চোখে জল এসে গেছে। রাগলে এই দুর্দশা হয় আমার। সুবিধা এই যে, রেণুকারও তাই হয়। মনে মনে আবৃত্তি করে নিলুম…দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে…লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার। পা যেন কিছুতেই পিছলে না যায়।…অবশেষে পৌঁছে গেলুম সেই জায়গায়,…যেখানে সকলেই বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ কিনা ম্যাটারহর্নের পাদদেশে। অহো, কী দুঃসহ স্পর্ধা! ঠিক যেমনটি দেখেছি ছবিতে…তেমনি সিধে, খাড়া উদ্ধত, স্পর্ধিত গিরি-শৃঙ্গ ম্যাটারহর্ন একটু ত্যাড়াব্যাকা এক বিপুল শিবলিঙ্গের মতন সাদা বরফে প্রোথিত হয়ে আছে…ধূসর আকাশ ফুঁড়ে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলুম। তারপর খোঁজ নিয়ে জানলুম, আজ অভিযাত্রী দল যাবে না। আজ নাকি ব্যাড ওয়েদার, তাই শখের অভিযাত্রীদের আজ যাত্রা নাস্তি।

    আহ্! শুনে যেন বুক থেকে একটা ম্যাটারহর্ন পাহাড় নেমে গেল। ভাই রেণুকা, আজ তাহলে একটু দেখি-টেখি, বেড়াই-টেড়াই? কাল চড়ব, কেমন? কাল যখন রোদ্দুর উঠবে, হয়তো একটু বরফও গলবে, তখন উঠব, সেই বেশ হবে।…এত দূর পথশ্রমের ক্লান্তি আজও কাটেনি। এই ভাল হল। আমরা কখন যে পথ ছেড়ে প্রশস্ত বরফের মাঠে নেমে পড়েছি তা টেরও পাইনি। এই মাঠে শিক্ষানবিশি চলছে—স্কী-ইং এবং স্কেটিং ছাত্রদের। বরফের মধ্যে কয়েকটি তাঁবুও খাটানো রয়েছে। এদের কী সহ্যশক্তি রে বাবা!

    রং-বেরঙের পোশাকে স্কার্ফ উড়িয়ে চঞ্চল চপল গতিতে নেচে বেড়াচ্ছে অজস্র মানুষ—নারী, পুরুষ, শিশু। কেউ স্কীতে, কেউ স্কেটে। স্কেটিং-এর জন্য একটু শক্ত বরফ চাই, স্কীর জন্য চাই অনেকটা জায়গা, গ্লেশিয়ারই ভাল। মোহিত হয়ে আমরা এগোচ্ছি, এখানে ক্ৰাচ-ওলা কেউ নেই—আমাদের পা হাঁটু অবধি তুষারে ডুবে যাচ্ছে, একটা একটা করে টেনে বের করছি, ফের পদপাত করছি, ফের পদোদ্ধার করছি—বেশ অভ্যাস হয়ে এসেছে—যেন আজন্ম এভাবেই চলা-ফেরা করেছি গড়িয়াহাটে, কলেজ স্ট্রীটে। রেণুকার মোহিত দৃষ্টি কালো চশমা ভেদ করেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুজনেরই নাক বেয়ে, চশমা বেয়ে, চিবুক বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির জল গড়াচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম রেণুকাটা সত্যি বড্ড কালো। এই সাদা তুষারের রাজ্যে সাদা চামড়ার লোকগুলির মধ্যে রেণুকাকে যেন তাল-ভঙ্গকারী লাগছে। এক সেকেণ্ড মাত্র। তার পরেই মনে পড়ল রেণুকাও নিশ্চয় আমাকে দেখে ঠিক ভাবছে, এঃ, নবনীতাটা বড্ডই কালো দেখছি!—তার মানে যতই স্কী-বিরিটি সাজি না কেন আমরা, রেণুকার মধ্যে ঢেউ তুলছে যে অগাধ রসম-সম্বর, আর আমার ভেতরে যে গজগজ করছে ঠনঠনের ঝোল-ভাত, সেটা বাইরে থেকেও বেশ দেখা যাচ্ছে। আমরা যে আলাদা, আমরা যে ভিন-দেশী সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না, সেটা আমাদের গায়েই লেখা আছে। ভেবে একটু মুখ গোমড়া হল—ভাবলুম: কালো জগৎ আলো। কেষ্ট কালো, কালী কালো, আমি-রেণুকাই বা কালো হব না কেন? শক-হুণ দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন—সে দেহে একটু ঘনত্ব থাকবে না? এই তো ভাল—এমনি ট্যান চামড়া পাবার খুবই মিষ্টি। বলা অবশ্য উচিত না, আমি ভাবলুম, কিন্তু আমার মুখটাও তো খুব একটা তেমন কিছু বিচ্ছিরি নয়—এইসব ভাবতে ভাবতে মনটা যেই প্রফুল্ল হয়ে উঠছে…অমনি কানে এলে মার্কিন আওয়াজ—”হাই। তোমরা বুঝি পাকিস্তানী?”

    “পাকিস্তানী হতে যাব কেন?” রেণুকা এক ধমক দেয়।

    “সরি।” সড়াৎ করে স্কী চালিয়ে আধ মাইলটাকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল ছেলেটি। আমি বললুম,

    “অমন করে না বললেই হত! ওরা কিছু জানে না।

    “পাকিস্তান কি আগে ভারতীয়টা মনে আসে না?”

    “তবে কি তোমরা ভারতীয়?” চমকে উঠে দেখি স্কী চালিয়ে সে আবার ফিরে এসেছে। “হ্যাঁ। তুমি বুঝি মার্কিনি?”

    “হ্যাঁ। পশ্চিম জার্মানি থেকে বেড়াতে এসেছি। ছুটিতে।”

    “তুমি কি হটস্প্রিং-এর জন্য এসেছ?” রেণুকা প্রশ্ন করে।

    “হটস্প্রিং? এখানে হটস্প্রিং আছে নাকি, এই বরফের মধ্যে?”

    “কী জানি? সেইরকমই তো মনে হচ্ছে।”

    “আমি তাড়াতাড়ি অন্য কথাটাও জিজ্ঞেস করি।

    “তবে কি কোনও আশ্রম-টাশ্রম আছে? সাধু-সন্তের মন্দির? ভেল্কি-মিরাকল জাতীয় কিছু? আছে নাকি?”

    আরো আশ্চর্য হয়ে গেল মার্কিন ছেলেটি।

    “ভেলকি? সাধু-সন্তের মন্দির? তোমরা কি তীর্থযাত্রী?”

    “আমরা বলে তীর্থের দেশ ভারতবর্ষ থেকে এসেছি, আমাদের খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, বিলেতে আসব তীর্থ করতে।” গঞ্জনা দিয়ে ওঠে রেণুকা।

    “সরি, আমরা জানি, সব ভারতীয়ই হিন্দু কিন্তু—”

    মার্কিন ছেলেকে এক থাবায় থামিয়ে দিয়ে আমি বলি—”কে বলেছে সব ভারতীয়ই হিন্দু? জানো সেটা সেকুলার স্টেট? সেখানে সর্বধর্ম সমন্বয় ঘটেছে—হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ-ক্রীশ্চান- পার্সি-জুইশ সব আছে।”

    “জুইশও?” অবাক হয়ে বলে ছেলেটি, “আমিও জুইশ।”

    “কিন্তু এখানে তীর্থস্থান আছে কিনা বললে না তো?” রেণুকা ভবী ভোলেনি, “কিংবা হট স্প্রিং?”

    “আমি তো কই কখনো শুনিনি তীর্থ আছে বলে। কিন্তু কেন? তোমরা কি ভূতত্ত্বের ছাত্র—নাকি সমাজতত্ত্বের? একবার বলছ হট স্প্রিং চাই, একবার বলছ তীর্থস্থান চাই। লোকে তো এখানে ধর্মকর্ম করতে আসে না, আসে খেলাধুলো করতে। স্কী করতেই আসে। তোমরা কেন এসেছ?” “আমরা এসেছি ম্যাটারহর্নে চলব বলে। কিন্তু এখানে এত বাতের রুগী কেন? এত পঙ্গু, বেতো রুগীর ভিড় দেখেই ভাবলুম হট স্প্রিং আছে, নয়তো কোনও মিরাকল।”

    “বেতো রুগী কোথায় পেলে এতো?”

    “কেন, পথে-ঘাটে, সর্বত্রই তো। সবার বগলেই তো দেখি ক্রাচ!” এবারে হাসির তোড়ে বরফ ফাটিয়ে দিলে মার্কিন ছেলেটি! “বাত—বেতো? পঙ্গু?” তার হাসি থামে না, এরা তো সবাই স্পোর্টসম্যান—কেউ স্কী করতে গিয়ে পা ভেঙেছে, কেউবা পিছলে পড়ে। আছাড় না-খেয়ে কেউ স্কী করতে শেখে কখনো? বেতো হবে কেন, এরা খেলোয়াড়! এরা মাউন্টেনিয়ার! বেতো! হা হা হা। ওঃ—তাই বলছো হট-স্প্রিং? হাউ অ্যাবসার্ড! মিরাকল! হাউ ক্রেজী!” হোহো হাসিতে আমাদের কলিজা ফাটিয়ে দিয়ে তিনি সড়াৎ করে স্কী চালিয়ে অন্তর্হিত হলেন। দূরে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল তাঁর নীল জ্যাকেট। হাসিটা প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো আমাদের কানে—এবং প্রাণে। এই বরফেও বুঝতে পারছিলুম আমাদের কান-ফান গরম হয়ে উঠেছে—রাগ, লজ্জা দুয়ে মিলে একটা বিশ্রী অনুভূতি। তায় পাগুলো সব দেবে দেবে যাচ্ছে নরম বরফে, টেনে হিঁচড়ে তুলে তুলে আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে সদর রাস্তার দিকে ফিরতে লাগলুম। কেউ কারুর দিকে তাকাচ্ছি না।

    রাস্তার ওপর পৌঁছে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। আরামসে স্বাভাবিক নিয়মে যেই দুপা হেঁটেছি, “যাক বাবা বাঁচা গেল” ভেবেছি, অমনি ঘটল সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা। সড়সড় সড়াৎ। বিনা-স্কীতে, বিনা-স্কেটে, আমি দিব্যি স্পীডের মাথায় আচমকা পাহাড়ী পথের ঢালু রাস্তায় অপসৃত হলুম। যেন স্পেস ক্যাপসুলের মধ্যে ইজিচেয়ারে বসে আছি—এমনি গা-এলানো ভঙ্গিতে, উপবিষ্ট শরীরে অনায়াসে পা দিয়ে শুকনো ডালপালার বেড়া ভেঙে একজনদের বাড়ির পিছনের উঠোনে ঢুকে যাচ্ছি দুর্নিবার গতিতে। দ্যাখ্-না-দ্যাখ্ তাদের মুরগীর খাঁচার অভ্যন্তরে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছি। বিদ্যুৎ-চমকের মতো প্রথমেই মনে হল—রেণুকাকে সাবধান করা দরকার—হুইসিল? ভাবামাত্র পিঠের ওপর আচম্বিতে জোড়া বুটের জোর ধাক্কা!—”বাবা গো! গেলাম!” সমস্বরে বললুম রেণুকা এবং আমি। “সো সরি।” আবার ডুয়েটে বলা। ইতিমধ্যে অভিমন্যুর মতো অবস্থা হয়েছে আমাদের। স্বাস্থ্য-উজ্জ্বল, পরাক্রান্ত এবং যুদ্ধরাজ মোরগকুল তথা রণচণ্ডী মুরগীসকল আমাদের সসৈন্যে আক্রমণ করেছে। তারা তেড়ে এসে ‘ট্রেসপাসারদিগকে’ যত্রতত্র প্রবল শক্তি সহকারে ঠুকরে দিচ্ছে—এবং ভীম বিক্রমে কক্-কক্-কক্-কক্ আওয়াজে ভয়াল রণহুঙ্কার দিচ্ছে। মুরগীকে রাম-পাখি কেন বলা হয় সেদিন বুঝেছিলাম। যে-কোনও রাক্ষসসেনাকে তারা অবলীলায় হারিয়ে দিতে পারবে! দূর থেকে দেবতারা যেমন রামকে উৎসাহ দিতেন—এখানেও তেমনি খাঁচার বাইরে থেকে মুরগীদের শৌর্য, বীর্য, একাগ্রতা এবং ঐক্যবদ্ধতাকে উৎসাহিত করেছিল একটি উতলা ব্যাঘ্রের মতো কুকুর। এই সমবেত তাণ্ডবের মধ্যে সতত ঠোক্করমান মুরগী ও মোরগ-সংযোগে আমরা দুজন দুঃসাহসিক পর্বত অভিযাত্রী—খাঁচার মধ্যে পা ছড়িয়ে হতভম্ব বসে আছি। চশমা ছিটকে পড়েছে বটে, কিন্তু ধর্মতলার সানগ্লাস ভাঙেনি। স্তম্ভিত রেণুকার মাথায় কিছু তুষার, কিছু উড়ো পালক। দেখে বুঝলুম আমারও দৃশ্য নিশ্চয়ই তথৈবচ। চারপাশের দিকে চেয়ে ব্যথা বিস্ময় ভুলে আমরা হড়বড়িয়ে হেসে ফেললুম।

    হাসব না? এরকম দৃশ্য তো খুব চেনা আমাদের। ঠিক এইটে না হোক, এমন ধরনের কাণ্ডকারখানা তো লরেল-হার্ডিতে কতই দেখেছি! তফাত এই যে, ঘটনাটা সত্যি আর পাত্রপাত্রী আমরা নিজেরা! ব্যাকগ্রাউন্ডে অচঞ্চল মহিমায় ম্যাটারহর্ন—আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে গৃহপালিত পশুপক্ষীর মিলিত কূজন-গর্জন। কোনওরকমে সেই প্রবল পরাক্রম পক্ষীসেনার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করেছিলুম সেদিন। ভেঙে যাওয়া রেড়াটি গলেই পালিয়ে এলুম গৃহস্থের আঙিনা থেকে, রণমূর্তি মুরগীদের দিকে বিষদৃষ্টি হানতে হানতে। কেবলই চোরাচাউনিতে দেখছিলুম এদের চিল্লা-চিল্লিতে গৃহকর্তা আবির্ভূত হলেন কিনা—নাঃ, কেউ দেখেনি। সরু পিচ্ছিল পাহাড়ী পথের ঢালু বেয়ে দেখা গেল অনেকটা যেন স্কী-চিহ্নের মতোই আমার ও রেণুকার সুদীর্ঘ পতন-চিহ্ন সদ্যটানা গতিময় রেখা হয়ে ফুটে আছে। দাগখানা দেখেই যেন কোমরটা ফের কনকন করতে লাগলো।

    আমরা দুই বন্ধু এবার পরস্পরকে ক্রাচ করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পিছল বরফে পা গেঁথে পা গেঁথে অগ্রসর হলুম।

    “কালই আমরা জেনিভায় ফিরে যাব, কী বলিস? এ জায়গাটা তো দেখা হল।”

    রেণুকা চুপ। চোখে জল।

    “তখনি বলেছিলুম, প্রকৃতির বিরুদ্ধতা করা উচিত নয়। করার ইচ্ছেটাও করা উচিত নয়। দেখলি তো?”

    “আমাদের ম্যাটারহর্ন চড়া হল না।”

    খোঁড়াতে-খোঁড়াতেই ফুঁপিয়ে উঠল রেণুকা—”এত কষ্ট করে এসে, কেবল মুরগীর খাঁচাতে ঢোকা হল!”

    “দুঃখ করিস না রেণুকা—ম্যাটারহর্ন কি যার-তার কপালে থাকে?”

    একটা কাফে-তে ঢুকে হট চকলেট খেতে খেতে আমরা ভাবলুম, আজ রাত্রেই জেনিভায় রওনা হব। বিদায় ম্যাটারহর্ন, বিদায় মুরগী-সকল!

    হট চকলেট খেয়ে উঠে রাস্তায় বেরিয়েই মনে হল, আকাশে বাতাসে যেন একটা আশ্চর্য তফাত। রোদ কি উঠেছে? না তো? বৃষ্টিটা কি ধরলো? তাও না। তবে? বেশ ব্যথা করছে কোমরটা—দুজনেই ক্রাচ ধরে আস্তে খুঁড়িয়ে হাঁটছি আর ভাবছি ব্যাপার কী? একটু নতুন আভা যেন ফুটে উঠেছে পথে-ঘাটে লোকজনের চোখে-মুখে। এই আভাটা আগে তো ছিল না? কী হয়েছে বল তো? রেণুকা, দেখেছিস, লোকেরা আমাদের দিকে একটা কেমন চোখে তাকাচ্ছে?

    রেণুকা এতক্ষণে পুরোনো আধো-আধো গলায় কথা বলল। রেণুকা বলল, “ওরা কিনা বুঝেছে আমরাও ওদের মতোই স্পোর্টসম্যান—ম্যাটারহর্নে চড়তে গিয়ে আহত হয়েছি! তাই সম্ভ্রম করছে। এতক্ষণ বোধহয় ভেবেছিল কোনও উজবুক ট্যুরিস্ট-ফুরিস্ট হবে!”*

    [* সর্বৈব সত্য ঘটনা। স্থান, কাল, পাত্র কোনোটিই কাল্পনিক নয়। ]

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅ্যালবাট্রস – নবনীতা দেবসেন
    Next Article উত্তমাশা অন্তরীপ এবং – নবনীতা দেবসেন

    Related Articles

    নবনীতা দেবসেন

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025

    সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.