Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প110 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৪. তুমি ছুঁয়ো না আমাকে

    প্রতি রাতে যতই আমি আলতাফকে বলি যে তুমি ছুঁয়ো না আমাকে, সে ছোঁবেই। সে ছুঁতে চাইবেই, না ছুঁলে তার স্বস্তি নেই। ছুঁলে আমার অস্থিরতা, না ছুঁলে তার অস্থিরতা। ভীষণ এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। যখন ও শোবার জন্য বিছানায় যায়, আমি ড্রইং রুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে বই বা ম্যাগাজিন পড়ি। শুতে না যাবার ছুতো করি। আলতাফ অনেকক্ষণ বিছানায় অপেক্ষা করে ড্রইং রুমে আসে।

    –’কী তুমি শুতে যাবে না?’ ওর পরনে একটি কেবল লুঙ্গি থাকে। ওর খালি গা দেখলে আমার কেমন ঘেন্না ধরে। বলেছি কত ঘুমোবার সময় ট্রাউজার পড়, আর টি শার্ট না হোক স্যাণ্ডা গেঞ্জি হলেও পড়। তা না, আলতাফের লুঙ্গি না হলে চলবে না। আর থাকতে হবে খালি গায়ে। বুকে হাত বুলাবে আর আমাকে আড়চোখে দেখবে। দূর থেকে একগাদা মাংস দেখে কুকুর যেমন জিভ চাটে, আলতাফও মনে মনে বোধহয় নিজের লালা নিজে গিলে খায়। সেও বোধহয় তার লোভের লাল জিভখানা বারবারই চাটে।

    আমি বিরক্ত হই আলতাফের ডাকাডাকিতে। বলি–আমি এখনই শোব না। ঘুম পাচ্ছে না।

    –বিছানায় এস, ঘুম পাবে।

    আলতাফ দাঁত বের করে হাসে। যেন বিছানায় আজ খুব মজার জিনিস আছে, ঘুম না পেয়ে যায়ই না।

    –তুমি শোও। আমি পরে আসব। আমি বই থেকে মুখ না তুলেই বলি।

    আলতাফ চলে যায় বেডরুমে। আমি তার ঘুমিয়ে যাবার অপেক্ষা করি। ঘুমিয়ে গেলে বিড়ালের মত নিঃশব্দে হেঁটে শুতে যাব। যেন সে না জাগতে পারে, জেগে যেন সে আমাকে সারারাত জাগিয়ে না রাখতে পারে। রাত প্রায় দুটো বাজলে আমি শুতে যাই। আলতাফ না ঘুমিয়ে শুয়ে ছিল। আমাকে দেখেই বলে–এখন আর শুতে এলে কেন? রাত তো শেষ করেই এলে।

    ওর রাগের কারণ আমি বুঝি। কিন্তু আমার ইচ্ছে না করলে কী করব আমি। আমার ভেতরে সে আগুন কেবল জ্বালিয়ে দেবে, নেভাবে না–এ কী করে মেনে নেব? নেভাবার নিয়ম তো আমার জানা নেই, জানা থাকলে হয়ত নিজেই কিছু চেষ্টা করতাম। আমি উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ি। আলতাফের কথার কোনও উত্তর দিই না।

    –কী ব্যাপার কথা বলছ না যে!

    –বলতে ইচ্ছে করছে না।

    ওর গলা যত উঁচু, আমার গলা তত খাদে। আমি বিছানার এক কিনারে আলতাফের শরীরে যেন আমার শরীর না লাগে এমন আলগোছে শুয়ে থাকি।

    –তোমার হয়েছে কী বল তো? আলতাফ ভারি গলায় জিজ্ঞেস করে।

    –কিছুনা।

    –কিছু না বললেই হবে? তোমার কিছু একটা হয়েছে। তুমি আমাকে লুকোচ্ছ। আমাকে কিন্তু অবহেলা করছ তুমি।

    –বোধ হয় করছিই।

    –আমি সারাদিন কার জন্য পরিশ্রম করি বল, এই সংসারের জন্য, তোমার জন্য। তোমার জন্য, আর বাড়ি ফিরে যদি তোমার বিশ্ন মুখ দেখতে হয়, ভাল লাগে? কি এত দুঃখ তোমার?

    এর কোনও উত্তর আমি দিতে পারি না। লজ্জা হয়, সংকোচ হয়। কেন মন বিষণ্ণ থাকে, বুঝি, দুঃখ কেন, বুঝি; কিন্তু বোঝাতে পারি না। আলতাফ অভিমান করে, রাগ করে। এপাশ-ওপাশ করে। আমার স্থির শান্ত শরীরের দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকায়। আমি নিজেকে সংবরণ করি। জলের লোভে লোভে সমুদ্রের কাছে যাব আর সে আমাকে সমুদ্রের উতল নোনা জোয়ারে একলা রেখে চলে যাবে, আমি সাঁতার জানি না, ভাসব ডুবব, আমার কষ্ট হবে, ভীষণ কষ্ট হবে আমার–এই ভেবেই আমি। সংবরণ করি। তৃষ্ণা গুলো সংযত করি।

    আমি ধীরে খুব শান্ত কণ্ঠে বলি–কাল থেকে আমি অন্য ঘরে ঘুমোব।

    –কেন?

    –আমার ইচ্ছে।

    এক বিছানায় ঘুমোলে আমি টের পাই আলতাফের নিশ্বাসের হলকা আমার গায়ে লাগছে, আমার গা গরম হচ্ছে। গা কেন গরম হয়? না হলেও তো পারে। না হলে চমৎকার যুবকটিকে আমি আরও বেশি ভালবাসতে পারতাম। আরও বেশি তার কাছে আসতে পারতাম, শরীরের না হোক, মনের কাছে।

    মনের কাছে আসতে গেলে কোনও বাধা তো থাকা উচিত নয়। মনই তো সব থেকে বড়। মনের কাছে শরীর বড় তুচ্ছ। তবু আমি জানি না কেন আমি বলি–আমার ইচ্ছে হয় না তোমার সঙ্গে ঘুমোতে। আমার প্রব্লেম হয়।

    আলতাফ চুপ হয়ে থাকে।

    ওর জন্য মায়াও হয় আমার। মায়া হয় বলে যদি আমি ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে যাই, আমাকে সে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে। অন্ধকারে একটি ভালবাসার স্পর্শ ধীরে ধীরে শিথিল করবে আমার শরীর। আলতাফকে আমি ভালবাসতে চাই, কিন্তু এসবের জন্যই পারি না। এই জড়িয়ে ধরা এই চুমু খাওয়া এসব আজকাল বড় বিব্রত করে আমাকে। বড় অবিন্যস্ত করে।

    অনেকক্ষণ চুপ থেকে আলতাফ আমার গা ধাক্কা দিয়ে বলে–তুমি খুব বাড়াবাড়ি করছ, হীরা।

    –কিরকম বাড়বাড়ি? ওর ধাক্কায় মোটেও না চমকে বলি।

    –খুব সেক্স ক্রেজি হয়ে উঠছ।

    –তাই নাকি? যদি তা-ই হই অসুবিধে কী?

    –অল্পে তোমার মন ভরছে না। তোমার অনেক বেশি চাই।

    –সে তো তোমার চাই। আমি তো চাইছি না কিছুই। আমি দিব্যি পাশ ফিরে ঘুমিয়ে থাকতে চাই। তুমি আমাকে ডিসটার্ব না করলেই পারো।

    –আমি তোমাকে ছুঁলে তুমি ডিসটার্ব ফিল কর?

    –হ্যাঁ করি।

    –বলছ কী তুমি? আলতাফ তড়াক করে উঠে বসে। বলে–তুমি আমাকে অপমান করছ হীরা।

    –হ্যাঁ করছি।

    আলতাফের বাস পড়ে জোরে। সে আমার শরীর ধরে আবার ঝাঁকুনি দেয়। বলে–তুমি কি ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার স্বামী?

    –না মোটেও না। ভুলব কেন? বরং খুব বেশি করেই মনে থাকে।

    –তাহলে আমাকে তোমার সহ্য হবে না কেন? আমি কি তোমার পর?

    –স্বামী হলেই বুঝি আপন হওয়া যায়?

    আলতাফ বিছানায় বসা ছিল, দাঁড়িয়ে যায়। উঠে পায়চারি করে ঘরময়। ফোঁস ফোঁস শব্দ হয় ওর রাগের। বলে-তবে কে তোমার আপন শুনি? কোন আপন মানুষ তুমি ফেলে এসেছ? আমাকে তুমি পর ভাবছ, আমি তোমার স্বামী আর আমিই তোমার পর?

    আমি পাশ ফিরে মাথার বালিশটি বুকে জাপটে ধরি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি–আমাকে ঘুমোতে দাও। এত রাতে তোমার এসব বোকা বোকা কথা আমার ভাল লাগছে না। আলতাফ বাথরুমে যায়। মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়। টেনশন হলে সে এরকমই করে আমি ঘুমোতে চাই। আলতাফ পারলে সারারাত জেগে থাকুক। আমার কী যায় আসে! আমি যখন জেগে থাকি ও কি আমার খবর নেয়?

    আলতাফ সারাঘর হাঁটে আর বলে–তুমি কি চাও বল তো? কী দিলে তোমার তৃপ্তি হবে। তোমার জন্য আমি সব করব। বল, মুখ ফুটে বল কি চাও।

    –তুমি ভাল করেই জানো আমি কী চাই।

    –কাল মার্কেটে চল। যা ইচ্ছে হয় কেননা। তবু তুমি আমার সঙ্গে এসব করো না।

    –মার্কেট থেকে কী আনতে চাও আমার জন্য? সুখ পাওয়া যায়? পাওয়া যায় সুখ তোমাদের নিউমার্কেটে? গাউছিয়ায়? গুলশানে? মৌচাকে? পাওয়া যায়?

    আমার ভেতরে লাভার উদগীরণ দেখি। আলতাফ চুপ হয়ে যায়। চুপ না থেকে ও করবে কী। ওর কী আর করবার আছে? ওকে আমি দোষ দিই না কিন্তু ও আমাকে অস্থির করে মারবে কেন? আমার কি পাওয়ার কিছু নেই? আমার কি শূন্যতাকেই একমাত্র গন্তব্য বলে ধরে নিতে হবে? রাত বাড়তে থাকে। আলতাফ একবার বিছানায় শোয়, একবার ওঠে, সে গজরাতে থাকে রাগে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

    সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি আলতাফ ঘরের ইজিচেয়ারে বসা। চোখ জানালার দিকে। জানালাটির ওপারে একসারি দেবদারু। দেবদারুরও রূপ আছে। কী চমৎকার সুঠাম বৃক্ষ। আমি বিছানা থেকে না উঠেই রাতের শিশির ধোয়া বৃক্ষের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। আলতাফ কি সারারাত ঘুমোয়নি? আমি উঠে দাঁড়াই ওর চেয়ারের পেছনে। হাত রাখি চুলে। চুলগুলো কী সুন্দর! ঘন। ছেলেদেরও এত ঘুন চুল হয়! আমি আঙুল বুলিয়ে দিই ওর চুলে। আলতাফ আমার স্পর্শ বোঝে। রিয়েক্ট করে না। যেমন ছিল তেমন বসে থাকে। আমি ওর চুলে হাত বুলোই আর বলি–তুমি আমার ওপর রাগ করো না। রাত হলে আমি অন্য রকম হয়ে যাই। রাত হলে কী যে হয় আমার! আমার।

    আলতাফকে শিশুর মত স্নিগ্ধ লাগে দেখতে। ওর নিঘুম রাতের কষ্টের কথা ভেবে আমারও কষ্ট হয়। কতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। ও একটি বাক্যও আমার জন্য খরচ করে না। সকালে ওর জন্য নিজের হাতে নাস্তা করি। চা দিই। চুপচাপ সে খেয়ে ওঠে। কথা বলে না। বলি–এত রাগ?

    আলতাফ তবুও কথা বলে না। জুতোর গটগট শব্দ তুলে অফিসে চলে যায়। এই যে আমি তোকে জুতোর ফিতে পর্যন্ত বেঁধে দিলাম। যাবার সময় বললাম–একটু হাসো। তারপরও হাসল না সে। গেটে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লাম, একবার ফিরে তাকাল না।

    দুপুরে ফোনে সে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলল, আমার সঙ্গে বলল না। বিকেলেও ফিরল না। ফিরল রাতে। শাশুড়ির সঙ্গে ড্রইং রুমে বসে কথা বলছিলাম, রুমে ঢুকেই আলতাফ বলল–এত রাত পর্যন্ত আপনি জেগে আছেন? আলতাফের মা হেসে বললেন–তুই এত দেরি করলি বাবা?

    –আর বলবেন না। এক বন্ধুর বিয়ে ছিল।

    –ও।

    আমি পাশে বসে মা ছেলের কথপোকথন শুনে গেলাম। এক বন্ধুর বিয়ে অথচ আমাকে সামান্য জানানোও হয় না। বিয়ে বাড়িতে যাওয়া না হয় বাদই দিলাম। তাছাড়া আমি যে একটি মানুষ বসে রইলাম। আমি যে তাদের কেউ হই, বোঝা গেল না। কোন বন্ধু, কী নাম, কার সঙ্গে বিয়ে হল, মেয়ে খুব ভাল, লেখাপড়া জানা মেয়ে, বড় ফ্যামিলি, বাবা ইঞ্জিনিয়ার, মেয়ের ভাই বোনেরা কানাডা থাকে, ইত্যাদি নিয়ে আলতাফ তার মায়ের সঙ্গে গল্প করল। তারা দুজনেই ভুলে গেল আমার উপস্থিতি। আমি নিঃশব্দে চলে এলাম ঘরে, শোবার ঘরে, এই ঘরটিই তো মূলত আমার ঘর, কারণ এখানে আমি স্বামী নিয়ে শোব। আমার তো শোওয়াই একমাত্র কাজ। আমি ঘরে বাতি নিবিয়ে শুয়ে থাকি। আলতাফ ঘরে ঢুকেই ষ্টিকবা জ্বালায়। আমার চোখে হঠাৎ বাতি এসে পড়লে রাগ ধরে বড়। বলি–লাইট বন্ধ কর।

    –আমি অন্ধকারে কাপড় ছাড়ব?

    –জানি না। তুমি লাইট বন্ধ কর।

    আলতাফ বাতি জ্বালিয়েই সার্ট খোলে, লুঙ্গি পরে লুঙ্গিখানা সঁতে কামড়ে প্যান্ট আর আণ্ডার ওয়ার খোলে। আমি দেখি আর আমার রাগ ধরে। বাতি জ্বালিয়ে রেখেই সে বাথরুমে যায়। বাথরুমে আবার একটি গান ধরে আলতাফ। ‘এক পেয়ার ক্যা নাগমা হ্যায়…..।‘ গানের সূরটি আমার ভাল লাগে। সূরটি ভাজতে ভাজতে সে ঘরে আসে। আমি তখন চোখ বুজে শোয়া। সূরটি সে ছাড়ে না। বাতিও নেয় না। আলতাফের সূর আমার সব রাগ জল করে দেয়। আমি আলোকিত ঘরটিতে ঘুমোবার প্রস্তুতি নিই। আমি লক্ষ্য করি আলতাফ আমার সঙ্গে কথা বলছে না। আমাকে সে স্পর্শও করছে। সকাল হয়। সে অফিসে চলে যায়। আমি তার সঙ্গে ছায়ার মত ঘুরি। আমাকে সে দেখেও দেখে না। তার বাবা মার সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেয়। বাড়িতে আমি যে। একটি প্রাণী সে ভুলে যায়। অথবা দেখায় সে ভুলে আছে। আসলে ভোলে না। সে যে ভোলে না সে কি আমি বুঝি না? বুঝি কিন্তু কিছু বলি না। কিন্তু কতদিন এরকম চলবে? কতদিন? রাতে পাশে শুয়ে ছটফট করে আলতাফ। ও যে দিন দিন অন্যরকম হয়ে উঠছে বুঝি। আমার কষ্ট হয়, আলতাফের জন্য মায়া হয়। একবার ইচ্ছে হয় তাকে দোষ দিই, আবার এমনও মনে হয় দোষ বোধ হয় আমারই। দোষ যারই থাক আমরা কেন উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখব? সম্পর্কটি স্বাভাবিক করবার জন্য তাগিদ আমারই থাকে বেশি। শাশুড়ি একদিন ডাকলেন তার ঘরে, বললেন–আলতাফ এমন চুপচাপ থাকে কেন বৌমা?

    –জানি না।

    –জানি না মানে? শাশুড়ি পাল্টা জিজ্ঞেস করেন। আমার কোনও উত্তর না পেয়ে তিনি আবার বলেন–তোমাকেই তো জানতে হবে। তুমি ছাড়া আর জানবে কে!

    –সে কেন চুপচাপ থাকে সে প্রশ্ন তো তাকেই করতে পারেন। আমি কি তার সব জানি? শাশুড়ি বেজায় রাগ করেন। রাগলে তিনি জোরে জোরে শ্বাস ফেলেন। ফর্সা মুখোনা লাল হয়ে ওঠে। তিনি সম্ভবত বুঝে পান না তার সুপুত্রের প্রতি আমি এই অন্যায় আচরণ কেন করছি। মোটাসোটা মহিলা, বাতের ব্যথায় প্রায়ই কাতরান, বাহুতে ঘড়ির চেইনের মত কী একটা লাগিয়েছেন কৰ্জিতেও একটি পিতলের চুড়ি। এক রাতে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন, আমি গিয়ে হাত পা টিপে না দিয়ে বললাম–এসব কী লাগিয়েছেন, এগুলো খুলে ফেলুন। এগুলো লাগালে ব্যথা আরো বাড়ে মনে হয়।

    –কি বললে? শাশুড়ি কটমট করে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন।

    আমি এরকমই। যা বলতে ইচ্ছে করে বলে ফেলি। বলবার আগে সাত পাঁচ ভাবব এমন নই। শাশুড়ির মূল প্রশ্ন আলতাফের হয়েছে কী, এত প্রাণবান ছেলের এমন উদাস ভাব কেন, কেন চুপচাপ থাকে বাড়িতে। আমি মনে মনে বুঝি কেন সে কথা কম বলে, সে যে আমি তাকে আমাকে ছুঁতে বারণ করেছি বলে অভিমান করে চুপ থাকে তা কিন্তু নয়। সে অনেকটা বাঁচেও বৈকি। আমাকে অস্থিরতা দান করা থেকে এ তো একরকম বাঁচাই।

    আলতাফ কিন্তু বেশিদিন গাম্ভীর্য ধারণ করতে পারে না। আমাকে সে ছোয়, ছুঁতে তাকে হয়ই। আমি তার নিশপিশ আঙুল দেখে বুঝি সে একটি সোমখ নারী শরীরের জন্য কি ভীষণ কাতরাচ্ছে। বসেছিলাম, শোবার ইচ্ছে করছিল না সেদিন। গুণগুণ গান করছিলাম আমার ইচ্ছা করে তোদের মত মনের কথা কই, ওলো সই। আলতাফ বোধহয় মন দিয়ে শুনছিল, সে বসেইছিল এই আশায় যে আমি তাকে খেতে ডাকব, যেমন ডেকে নিই শ্বশুর শাশুড়িকে, আমার সেদিন কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করছিল না। কেবল গান গাইতে ইচ্ছে করছিল। খেতে কোনও ইচ্ছে নেই। খোলা জানালা পথে এক আকাশ পূর্ণিমা হুড়মুড় করে ঢুকছে ঘরে, আমার মুখে এসে পড়ছে তার আলো, তার অবাধ আলো। খেতে আমার না ইচ্ছে করতেই পারে। আমারই যে সবাইকে ভাল লাগাবার দায়িত্ব থাকতে হবে, তা কেন! আলতাফ একাই খেয়ে আসে। আমাকে ডাকে না। ডাকে না বলে আমার যে খুব কষ্ট হয়, তা নয় কিন্তু। আমি যেমন বসেছিলাম তেমনই থাকি। পূর্ণিমায় একা একাই স্নান করি। খেয়ে এসে আলতাফ শোয় বিছানায়। শুয়ে বেডসুইচ অন করে। এক ঘর জ্যোৎস্নার মধ্যে দজ্জালের মত আচমকা উপস্থিত হয় এক থোকা বিদ্যৎ। আমি অলস বসে থাকি ইজিচেয়ারে। আলতাফই হঠাৎ প্রশ্ন করে–খাওয়া টাওয়াও বাদ দিয়েছ নাকি? এত রাগ?

    –রাগ? রাগ আমি করব কেন? সে তো তুমি করেছ। আমার সঙ্গে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছ।

    –এসবের কারণ তো তুমিই।

    –তাই নাকি?

    আমার কণ্ঠে শ্লেষ টের পাই। শ্লেষ আলতাফের কণ্ঠেও, বলে–গান গাইছ মনের কথা কইতে নাকি ইচ্ছে করছে। কার সঙ্গে তোমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে শুনি? সখী না সখা? একেবারে না খেয়ে লেগেছ মনে হচ্ছে?

    আলতাফের কথার উত্তর আমার দিতে ইচ্ছে করে না। চোখ বুজে শুনি শুধু। আলতাফ হাসি খুশি থাকলে আমার সমাদর হয় এই বাড়িতে, সে বিষণ্ণ হলেই আমি তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বস্তু হয়ে যাই। এ কেমন নিয়ম?–খাচ্ছো না কেন? আলতাফ হঠাৎ প্রশ্ন করে।

    –খিদে নেই বলে।

    –খিদে হবে কেন? সারাদিন বসে থাকলে খিদে হয়?

    –কী করব বল? লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে। তাতে তো সময় কাটত।

    –সময় কাটাবার কিছু পাচ্ছো না তুমি, আশ্চর্য! বাড়িতে কাজ করতে চাইলে কাজ কী কম আছে? ছোট ছোট কাজগুলো তো করতে পারো। আমি তো বলছি না তুমি কাপড় চোপড় ধোও, ঘরদোর মোছ।

    –তার মানে তুমি দয়া করে হালকা কাজগুলো করতে বলছ, যেখানে বড় কাজগুলোই আমার করা উচিত ছিল।

    –যা বোঝ তাই।

    আমি উত্তরে আর কথা বলি না। কী আর বলবার আছে। তার সঙ্গে তো আমার বিয়েতে এরকম শর্ত হয়নি যে আমি তার বাড়ির কোনও কাজে হাত দেব না। বরং স্বামীকে সেবা করবার একটি কথা আকারে ইঙ্গিতে বাড়ির সকলে আমাকে বলেছে।

    রাত বাড়তে থাকে। আমার ভাল না লাগা গুলোওে বাড়তে থাকে। বিছানায় শুতে যে যাব সে ইচ্ছে করে না। আলতাফ ঘুমোয় না, তার না ঘুমোবার কারণ বুঝি, চাইছে আমি শুতে যাই, সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ুক আমার ওপর। ভাবতেই গা রি রি করে ওঠে। নিজেকে মাঝে মধ্যে এরকমও বোঝাই যে যতই হোক, স্বামী যখন, স্বামী যা চায় তা

    পূরণ করাবার দায়িত্ব তো আমারই। আমাকে তো তার ইচ্ছের কাছে মেলে দিতেই হবে আমার শরীর, এমন কি মনও। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ইজিচেয়ারটিতে, জানালার বাইরে থেকে আবার হাসনুহেনার ঘ্রাণ আসে। ঘ্রাণটি আমাকে বড় উতলা করে। একটি স্পর্শ আমার তন্দ্রা বা নিদ্রা যা হোক না কেন, ভাঙায়। চেনা স্পর্শ। বড় চেনা তার আলিঙ্গন, তার আদর আহ্লাদ। আমি সেই পর্শের ঘ্রাণ নিই, যেমন নিই হাসনুহেনার তীব্র সুগন্ধ। এই পৰ্শটি বড় আদরে আমাকে বিছানায় নিয়ে যায়। শুইয়ে দেয়। ধীরে ধীরে আলতো হাতে নিদ্রালু কাপড়গুলো সরিয়ে দেয়। তারপর, আমি যদি নদী হই, কে যেন আমার শরীরে সঁতরাতে চায়। প্রাণপণ সঁতরাতে চায়। নিঃশ্বাস ঘন এবং দ্রুত হয় তার। সে কখনও সাঁতার জানত বলে মনে হয় না আমার। সে যে এত চেষ্টা করে সঁতরাতে! আমি বলি তুমি এভাবে সঁতরাও এভাবে পা নেড়ে, ওরকম হাত নেড়ে, সে সবই করতে চায়, পারে না। দ্রুত যখন বাস পড়ে তার, একবার মায়া হয় যে বেচারা চাইছে অথচ পারছে না আর একবার রাগও ধরে যে সে পারবে না আর আমার জল ঘোলা করবে, আমি তা মানব কেন? কতরাত পর্যন্ত যে সাঁতরাবার চেষ্টা করে আলতাফ জানি না। বিরক্ত হতে চাই না কিন্তু শরীরই বিরক্ত হয়। আমার শরীরই তার সাঁতার না জানা শরীরকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সরিয়ে যে দিই তাতে কিছু বলবার থাকে না আলতাফের। সে করুণ চোখে তাকায় আমার দিকে। জ্যোৎস্নায় তার চোখের তারা দূরের নক্ষত্রের মত জ্বলে। সকালে উঠে আলতাফ আমার দিকে তাকায় না। যেন খুব ব্যস্ত সে, এত ব্যস্ত যে তাকাবার সময় পর্যন্ত নেই। আমি হেসে বলি–আজ যে এত দৌড়োচ্ছ, টিফিনও মনে হচ্ছে নেবে না।

    –পূর্বাণীতে লাঞ্চ করে নেব।

    –এত টাকা তোমার, সরকারি চাকরিই বা কর কেন?

    –ও তুমি বুঝবে না।

    –ও।

    আলতাফ কথাগুলো বলে কিন্তু চোখের দিকে না তাকিয়ে। তাকাতে লজ্জা হয় নিশ্চয়। তড়িঘড়ি চলে যায় অফিসে। ওর অফিস যাওয়া দেখে আমারও ইচ্ছে করে অফিস যেতে। আমি একদিন বলেছিলাম আলতাফকে সকাল বেলা উঠে আমিও যদি অফিস যেতে পারতাম!

    আলতাফ হো হো করে হেসেছিল। হাসবারই তো কথা। বাড়ির বউ, যাকে কি না ঘর সংসারে ভাল, দেখতে ভাল বলে আনা হয়েছে, সে যদি ঘর সংসার ছেড়ে চাকরি করতে চায় তবে তো হাসতেই হবে। শাশুড়ি সেদিন ভিসিআরে ছবি দেখবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। রমজানকে দিয়ে ছবি আনালেন তিনি। রূপ কি রাণী চোর কে রাজা। আমি নাম দেখে ঠোঁট উল্টে বললাম–দুর এসব বাজে। শাশুড়ি হেসে বলেন–আরে না না, দেখই না।

    ছবি যখন চলছিল, শাশুড়ির হাতে ছিল তসবিহ, তিনি এনজয় করছিলেন। আমি অবাক হয়ে শাশুড়ির হাসি হাসি চোখমুখ দেখছিলাম। শাশুড়ি সারাদুপুর ছবি দেখলেন। আমি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম তার বিছানায়। রাতে ঘুম হয় না, তাই ঘুমও পায়, আর এই ধরনের ছবি আমাকে জাগিয়ে রাখবার কোনও ক্ষমতা রাখে না।

    বিকেলে ফেরে আলতাফ, সকালের চেয়ে স্বাভাবিক। বলে–চল যাই আজ সাভারে যাই, নিজে গাড়ি চালাব কেমন? সাভারে ঘুরে জয় নামে রেস্তোরাঁয় খেয়ে চলে আসব কেমন?

    আমি বলি–চল।

    আলতাফ আমাকে খুশি করবার জন্য এই প্রস্তাব করেছে আমি বুঝি। দিন দিন আমি যেভাবে ক্ষেপে উঠছি, আমাকে খুশি না করালে তার চলবে কেন।

    আমরা একসঙ্গে বাইরে যাচ্ছি দেখে শাশুড়ির মুখেও হাসি ফোটে।

    গাড়ি যখন দ্রুত ছুটে চলে আমি দুদিকের নদী খাল বৃক্ষ ও মানুষ দেখি। আলতাফ কলকল করে কথা বলে। ওর বেশির ভাগ কথাই এরকম, লোকে আমাদের বলে চমৎকার জুটি। বলে প্রেম ট্রেম ছিল নাকি আগে থেকে। আলতাফ ভাল চালায় গাড়ি, তবু বলে কী ভয় পাচ্ছো না তো? ধর দুজনে যদি মরে যাই এমন একসিডেন্ট হয়?

    –মরব। আমি শান্ত কণ্ঠে বলি।

    আমি মরব এই খবরটি শুনে আলতাফ পুলকিত হয়। আমি আলতাফের সঙ্গে মরবার জন্য মরব, ব্যাপারটি যে মোটেও সেরকম নয় তা আমি বোঝাতে পারি না তাকে। সে ভেবেই নেয় তাকে আমি ভালবাসি। সাভারের সবুজ বৃক্ষ রাজি আমার ভেতরে অদ্ভুত এক ভাল লাগা জন্ম দেয়। আমি এই প্রকৃতির সন্তান। এই সবুজ অরণ্যে বাস করা বোধহয় অনেক সুখের। গুলশানের বাড়ি ফেলে যদি এই অরণ্য বাসে যাই এরকম যখন ভাবছি আলতাফ বলে–সাভারে আমার জমি আছে জানো তো? এখানে একটা বাগান বাড়ি করব। আমরা বুড়ো বয়সে এখানে থাকব, কেমন? আমার নিভৃত বনবাসের ভাবনায় আলতাফের এই সংসার চিন্তা আমাকে গোপনে আহত করে। অরণ্যে কি ইটের দালান তুলে থাকতে হয়?

    সারাপথ আলতাফই কথা বলে, আমি কেবল সবুজ দেখি। দু’চোখ ভরে সবুজ দেখি।

    রাতে ‘জয়ে’ খাই। খেতে খেতে আলতাফ বলে–তুমি কি কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে হীরা?

    –হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

    –মাঝে মাঝে ভয় হয়।

    আমি হেসে বলি-ভয় হবার কারণটা বল তো?

    –তুমি যেন ঠিক আগের মত ব্যবহার কর না।

    –আগে মানে?

    –বিয়ের পর পর। বিয়ের দিন তো তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোলে। এখন কি ঘুমোও বল?

    –দিন কি সবসময় একরকম থাকে?

    –কেন, থাকে না কেন?

    –মানুষ বড় হয়। বুদ্ধি বাড়ে। দিন বদলেছে, আমিও বদলেছি।

    আমি বদলে গেছি এই খবরটি শুনে আলতাফ আর কোনও প্রশ্ন করে না।

    এছাড়া আমার আর কী বলবার আছে। আমার যদি তাকে জড়িয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে না করে আমি করব কী! নিজের ইচ্ছের সঙ্গে কতদিন প্রতারণা করা যায়।

    সাভার থেকে ফিরে দুজনে যখন শুই বিছানায় গা হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে বলি–আমি যদি ব্লু ফিল্ম দেখতে চাই?

    –ব্লু ফিল্ম দেখবে?

    –হ্যাঁ। আমার কণ্ঠ কাঁপে সামান্যও, ভয়ে কিংবা দ্বিধায়।

    –ব্লু ফিল্ম দেখতে চাও? এসব শেখালো কে তোমাকে? ছি ছি তুমি যে এত নিচে নেমে গেছ আমার জানা ছিল না। আলতাফের ঠোঁট বেঁকে ওঠে ঘৃণায়।

    –স্বামী স্ত্রী ব্ল দেখবে, অসুবিধে কী? আমি হেসে বলি।

    -বাজে কথা বলো না। আলতাফ রীতিমত ধমক লাগায় আমাকে। প্যান্ট খুলে সে লুঙ্গি পরে। লুঙ্গির ওপর দিয়ে উরুসন্ধি চুলকোয়। ঘরে ওর মুজো খুলবার দুর্গন্ধ ছড়ানো! শাশুড়ির ঘর থেকে হিন্দি ছবির শব্দ ভেসে আসে। আলতাফ চেঁচিয়ে ওঠে বু ফিল্মের কথা তুমি শুনলে কোথায়?

    –আশ্চর্য, ব্লু না দেখি নামটা পর্যন্ত শুনব না এ তুমি ভাবলে কী করে? তুমি কি ভাব আমি আকাশ থেকে পড়েছি? কিছুই বুঝি না, জানি না কিছুই!

    সে চোখ নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করে–ব্লু দেখতে চাও, আমার মনে হয় বু তুমি আগেও দেখেছ।

    বলি–দেখিনি, কিন্তু দেখার খুব ইচ্ছে।

    –আর নাম নেবে না এসবের, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। আলতাফ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

    সে হঠাৎ এক টানে তার শরীরের কাছে আমাকে নিয়ে যায়। আমি ছাড়িয়ে নিতে চাই। নিজেকে। বলি–তুমি কিছু করো না কিন্তু।

    –কী করব না?

    –চুমু দেবে না। কাপড় খুলবে না।

    –তুমি কি কোনও প্রেম ট্রেম করেছ বিয়ের আগে? আলতাফের চোখের তারায় পেণ্ডুলামের মত সন্দেহ দোলে।

    –না।

    –মিথ্যে বলছ। আলতাফের লোমহীন বুকে শিশির কণার মত জমে ওঠে ঘাম।

    –আমি মিথ্যে বলি না।

    আলতাফ সঁড়াশির মত আমার দুবাহু চেপে ধরে। বলে–নিশ্চয়ই তোমার তার কথা মনে পড়ছে।

    –কার কথা?

    –কার আবার?তোমার প্রেমিকের।

    লোকে ঠা ঠা করে যেভাবে হাসে সেরকম হেসেই আমি বলি–মোটেও না।

    –যদি তোমার বাবা মার কাছে বলে দিই এসব?

    –মিথ্যে বলবে কেন?

    –আমি বুঝি সব।

    –বুঝলে এসব বলতে না।

    –আমাকে তুমি সহ্য করতে পারো না। কেন পারো না? আমি স্মার্ট নই? গুছিয়ে কথা বলতে পারি না? ম্যানার জানিনা? তোমাকে শাড়ি কাপড় গয়না গাটি কিনে দিই না? তোমাকে অবহেলা করি, বল?

    –মোটেও না।

    –তবে?

    তবের উত্তর আলতাফকে আমি দিইনা। দিতে ইচ্ছেও করে না। প্রথম প্রথম মনে হত সব বোধহয় একদিন ঠিক হয়ে যাবে, আর আমার অস্থির লাগবে না। আমরা দু’জন এক সঙ্গে ঘুমোতে পারব। একজন জাগবে, একজন ঘুমোবে–এমন হবে না। কিন্তু দিন যায়, বছর পার হয়, যা ছিল তাই থেকে যায়। ঠিক এরকমই। এক বিছানায় প্রতি রাতে আলতাফের শরীর ঘেসে আমাকে শুতে হয়। না শুলে চিৎকার করে বাড়ি ‘মাথায় তোলে। শরীর তাকে সঁপে না দিলে চলবে না। আমি কিছু পাই ৰা না পাই তার তো পেতেই হবে। তার ক্ষুধার্ত থাকলে চলবে কেন? আলতাফ কোনও ত্যাগে বিশ্বাসী নয়! তার সবটুকু খাওয়া চাই, আর কারও খাওয়া হোক না হোক। তার সবটুকু পাওয়া চাই, আর কারও পাওয়া হোক বা না হোক। আমি আলতাফকে ঠিক বুঝতে পারি না। তাকে যত বারই এ বিষয়ে বলা হয়, সে বলে তোমারই দোষ।

    আমি যতবারই চমকে উঠি আমার আবার দোষ কোথায়। আলতাফ বলে–তুমি কোঅপারেট কর না বলেই এমন হয়।

    –আমি কোঅপারেট করি না?

    –না।

    –কি বলছ তুমি? আর কী করে কোঅপারেট করা যায়? তুমি যা বল তাই তো আমি শুনি। সেদিন উপুড় হতে বললে, তাই হয়েছি।

    –হয়েছ। কিন্তু মন থাকে অন্যদিকে। অন্য কিছু ভাব তুমি।

    আমি হঠাৎ চুপ হয়ে যাই। আসলে কী আমি অন্য কিছু ভাবি। আমি তো এরকম ভাবি আমার খুব পেতে ইচ্ছে করছে আলতাফকে, আমি তাকে সবটুকু পেতে চাই। পেতে চাইলেই কী হয়? আমার কেবল আশায় বসতি।

    সে শুতে আসে। আমার নীরবতাকে বেশ উপভোগ করে আলতাফ, আমি বুঝি। আমাকে দোষ দিয়ে সে মনে মনে একধরণের তৃপ্তি লাভ করে। সে যে ভুল বলছে, মিথ্যে বলছে–তা সে মনে মনে বুঝলেও আমার কাছে স্বীকার করে না। ব্লু ফিল্ম খারাপ মেয়েরা দেখে, যারা দেখে তারা বিকৃত মানসিকতার মেয়ে, তাদের মত আমি যেন কখনও না হই কারণ আমি ভদ্র ঘরের মেয়ে, আমার পারভারশানে যাওয়া উচিত নয় ইত্যাদি বলতে থাকে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আলতাফের কথাগুলো আমার ঘুমের নেপথ্য সঙ্গীতের কাজ করে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন
    Next Article ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }