Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মহড়া – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প205 Mins Read0
    ⤶

    ৪. গান্ধারী স্নান করছিল

    গান্ধারী স্নান করছিল।

    তক্ষর লেখা নাটক ‘রূপমতী’ দেখতে যাবে আজ। সাতটাতে আরম্ভ। পুজো দেরিতে ছিল বলে ‘শীত শীত’ ভাব এসে গেছে এরইমধ্যে। হালকা নীল বাথটাবে গরম জলের কল খুলে দিয়ে সামান্য বাথ-সল্ট ছড়িয়ে নেমে পড়ল নগ্না গান্ধারী অতিকায় একটি রাঁজহাসের মতো।

    গরম জলের ধুয়ো ফিস ফিস করে কিছু বলে এখন স্তব্ধ হয়ে গেছে। আয়নাটা ঝাঁপসা। ওর শরীরের ছায়াকে চেনা যাচ্ছে না। দীর্ঘশ্বাস পড়ল গান্ধারীর। এমনিই পড়ে, যখন-ই ও একটু মনোযোগের সঙ্গে স্নান করে। এই গরম অথবা ঠাণ্ডা জল-ভরা বাথটাবেই ওর জীবনের অনেক স্বপ্নই গলে গেছে বাথ-সল্টেরই মতো। হয়তো, অনেক মেয়ের-ই যায়। ছেলেরা নির্লজ্জ। তাই তাদের ভাবনা বা তাদের জীবনের উদোম, হাহাকার তারা হয়তো প্রকাশ করে কখনো-কখনো, কিন্তু মেয়েরা পারে না। ন্যাংটো কথাটার প্রতি এক গভীর অসূয়া নিয়েই তারা বড়ো হয়। ন্যাংটো কথাটা যে, শুধু উলঙ্গ শরীরের-ই সমার্থক নয় একথা তারা অনেকেই ভুলে যায়। ন্যাংটো যা, তাই-ই আড়ালহীন সত্যি। ন্যাংটো শরীরেরই মতো এই ন্যাংটো জীবনও কাউকেই দেখাতে বড়োই অনীহা ওদের। প্রফেসর প্রসূনস্যারের মেয়েরা হয়তো অন্যরকম হবে। হতে পারবে! গান্ধারীর এত শিক্ষা, এত বিত্ত, এত অর্থ নিয়েও জীবনটা এই বাথটাবে ভাসানো প্লাস্টিকের রঙিন প্রাণহীন কোনো সুন্দর পরিযায়ী হাঁসের-ই মতো কাটিয়ে গেল। অথচ ছেলেবেলা থেকেই ভেবেছিল যে, বিদ্রোহ করবে। ওর নিজের মতো করে সম্পূর্ণ ইচ্ছায় নিজের আনন্দে ভর করেই বাঁচবে জীবনে। কিছুই হল না। তার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ করার মতো সাহসও হল না আজ অবধি লোকে কী বলবে ভেবে। মাকেও বলা হল না স্পষ্ট করে একদিনও যে, মা তোমার দাস-দাসী অর্থ সব ই আছে অথচ নিজেও কখনো বাঁচার মতো বাঁচোনি জীবনে, বাবার পাশের গাধাবোট হয়ে এক নদী থেকে অন্য নদীতে ভেসেই বেড়িয়েছ। ‘জীবন’ কাকে যে বলে, এই একটা জীবন কেমন করে কাটানো উচিত সেসব সম্বন্ধে তোমার কখনো ভাববার অবকাশটুকুও হল না। অথচ দাঁড়িয়ে আছ, দাঁড়িয়ে নয়; এখন শুয়ে আছ মৃত্যুর চৌকাঠে। না, বাঁচলে তুমি নিজে; না, বাঁচতে দিলে আমাকে।

     

     

    মা কী ভাববে, মনে দুঃখ পাবে বলেই মাকে সে-কথা কোনোদিনও বলতে পারল না।

    আর তার স্বামী? সে এতই বেশি আত্মবিশ্বাসী, সংসারে যে, একজন নারীর গাড়ি-বাড়ি স্বামী-পরিচয়, স্বাচ্ছল্য ছাড়াও আরও কিছুমাত্র চাওয়ার থাকতে পারে, এই ভাবনাটুকু তার পক্ষে ভাবা অসম্ভব। সে অনেক কৃতী পুরুষমানুষের মতোই মনে করে যে, সেও স্বয়ম্ভ। স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার মধ্যেও যে, কোনোরকমের অপূর্ণতা থাকতে পারে এমন হীনম্মন্যতা তার কোনোদিনও হবে না। এই উচ্চম্মন্যতাটাই ওর একমাত্র অসুখ। তাই-ই পারেনি গান্ধারী। গান্ধারী নিজে মানুষ নিতান্ত ভালো এবং নরম বলেই পারেনি তার ভালোমানুষ কিন্তু স্কুল শরীর এবং বুদ্ধির স্বামীর অহমিকার কাঁচের স্বর্গকে ভেঙে দিতে। এই ধরনের মানুষকে ঘেঁটে দিলে তারা আর বাঁচে না। এদের মেরুদন্ড সাপের মেরুদন্ডের-ই মতো হয়। তাতে একটু আঘাত লাগলেই সমস্ত শরীরে বৈকল্য আসে। পারেনি গান্ধারী। পারবে পারবে ভেবেই পার করে দিল এতগুলো বছর। পারা হল না। ছেলেবেলার শুকনো পাতা-ওড়া অবুঝ প্রত্যাশায় ভরা দুপুরবেলায় ভাঁড়ার ঘরে বসে লুকিয়ে আচার খাওয়ার মতো ছিঁচকে চুরির জীবন এই বড়োবেলায় এসে আর ভালো লাগে না। এই জীবনের ভাঁড়ারে ছেলেবেলার সুন্দর সব গন্ধ এবং রং নেই। জলপাই বা কুল জম্পেশ করে ধনেপাতা, শুকনো বা কাঁচালঙ্কা আর একটু নুন আর একটু চিনি দিয়ে মাখলে যে-গন্ধ বেরোত, জিভ যেমন করে ভরে আসত জলে সেইসবের কিছুই আর নেই, এই পরিণত বয়সের ভাঁড়ারঘরে।

     

     

    জিভে জল আসে না আর। শুধু চোখে আসে।

    গান্ধারীর নাম ‘গান্ধারী’ রেখেছিলেন তার মা। হয়তো জেনেশুনেই রেখেছিলেন। গান্ধার রাজ সুবলের কন্যা ছিলেন গান্ধারী। ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন সুবল রাজা গান্ধারীর। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের হাতে স্বেচ্ছায় তাঁর পিতা সমর্পণ করেছিলেন গান্ধারীকে। দুর্যোধন এবং অন্যান্যদের জন্ম দেন তিনি। সুন্দরী এবং শিক্ষিতা হলেও, বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো আপত্তিই করেননি গান্ধার-দুহিতা গান্ধারী। এই ঝিরাটোলির গান্ধারীও করেনি। জন্মান্ধ স্বামীকে অতিক্রম করে যাবেন না বলে, মহাভারতের গান্ধারী সবসময়েই কাপড়ের টুকরো দিয়ে নিজের চোখ বেঁধে রাখতেন। এই গান্ধারীও রাখে অদৃশ্য কাপড়ের টুকরোতে। ব্যাসদেব বর দিয়েছিলেন যে, গান্ধারীর শতপুত্র হবে। চোখবাঁধা নারীর সঙ্গে জন্মান্ধ পুরুষের মিলনে চক্ষুম্মান সন্তান জন্মাবার কথা নয়। চোখ থেকেও যাদের চোখ থাকে না, তেমন-ই হওয়ার কথা ছিল তাদের। বাথটাব-এ শুয়ে থাকা এই গান্ধারীর একটিও সন্তান নেই। জানে না, কোন দেবতা বা অপদেবতার বরে বা শাপে এমন হল।

    নিজের নগ্ন শরীরের বিভিন্ন প্রদেশে সুগন্ধি জলের উষ্ণতা ও চাপ অনুভব করতে করতে তক্ষ রায়ের কথা ভাবতে লাগল গান্ধারী। মুখহীন তক্ষ রায়। শুধুমাত্র মুখহীন তক্ষ রায়কেই ভালোবাসতে পারে গান্ধারী শুধু তার শক্ত সুগঠিত দারুণ শরীরটার জন্যেই। নিশ্চয়ই তার মনের জন্যেও। মন কি মাথার ভেতরে থাকে? না, বুকের ভেতরে? কে জানে?

     

     

    বিশু পায়চারি করছিল স্টেজের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। বেশ হয়েছে কিন্তু সেটগুলি। সত্যিই যেন মার দুর্গ। সুপ্রতীপের আলো ফেলার কায়দায় জেহাজ-মেহালের আলোজ্বলা রাত, রূপমতী-মেহলের পেছনে নিমারের উপত্যকায় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের রঙের খেলা যেন, জীবন্তই হয়ে উঠেছিল স্টেজ-রিহার্সালের দিনে। পুরো ঝিরাটোলিতে ‘রূপমতী’ নাটক যেমন, সাড়া জাগিয়েছে তেমন, সাড়া ইদানীংকালে কোনো কিছুই জাগায়নি। ক্লাবের হলে পাঁচ শোজন লোকও হয় না কখনো। সাত-শো টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে কাল অবধি। আজকের খবর রাখে না। একস্ট্রা চেয়ারও আনতে হয়েছে। পাঁচটাকা, তিনটাকা, দু-টাকার টিকিট। ঘর থেকে পনেরো হাজার টাকা দিয়েছিল। আর দিতে হবে না বলেই মনে হচ্ছে। উলটে ক্লাব ফাণ্ডে মোটা টাকা জমে যাবে।

    নাটক আরম্ভ হতে আর দু-ঘণ্টা বাকি। সকলেই এসে গেছে বোকাদার নির্দেশমতো। গোপেন, সূর্য আর রীতির কিছু কিছু ডায়ালগ ওরা বসে বসে প্লে-রিডিং করে নিচ্ছে। স্টেজ রিহার্সালের দিনে ওদের ডায়ালগ-এ গোলমাল হয়েছিল।

    এ কটা দিন যেন এক ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। রিহার্সাল দিতে দিতে একরকমের নেশা ধরে গিয়েছিল। একে, অন্যের আত্মীয়ই হয়ে উঠেছিল যেন। কাল থেকে সন্ধেগুলো একেবারে ফাঁকা ঠেকবে। ওরা সকলেই যেন, এক ঠাস-বুনোন পরিবারের সভ্য। সব পরিবারেই যেমন, মাঝে মাঝে ভুলবোঝাবুঝি, মন-কষাকষি, রাগারাগি হয়-ই; এ পরিবারেও হয়েছিল। এখন নাটক আরম্ভর আগে সকলেই একজোট। সকলের মনেই চাপা উত্তেজনা। কী হবে? কেমন হবে? নিখুঁত করা চাই। এই-ই ভাবনা প্রত্যেকের।

     

     

    একটা দিন রীতিকে কাছাকাছি এবং মঞ্চে প্রেমিকা হিসেবে পেয়েই বিশু যেন, বর্তে গেছে। ওর পরিবারে ঐশ্বর্য অঢেল। কিন্তু রুচি নেই। সাহিত্য, সংগীত, নাটক, এসব-ই ওদের পরিবারে পাপ; অন্যায়। বিশুই প্রথম এই পরিবারের ঐতিহ্যবিরোধী কাজ করল। রীতি যে, ওকে পছন্দ করে না, এমন হয় না। ও নিজে তো করেই। কিন্তু রীতিকে বিয়ের প্রস্তাব সে, কখনোই দিতে পারবে না। বুড়হাটিলায় যাওয়ার পথের দু-পাশের বনে বনে, কত সুন্দর সব ফুল ফুটে থাকে। তাই বলে কী সব ফুল-ই ছিঁড়তে আছে? যে-ফুলের যোগ্য ফুলদানি তার নেই, সে-ফুল বনেই ফুটে থাকুক, বনপথের শোভা বাড়াক; মুগ্ধ করুক পথচারীকে। রীতি ওর পরিবারের পরিবেশে একেবারেই বেমানান হবে। মুক্ত, উদার, খোলামেলা আবহাওয়ায় বড়ো হয়েছে মেয়েটি। বিশুদের বাড়ির টাকাপয়সা, এক-নম্বর, দু-নম্বর হিসেবের খাতা, কর্মচারী ঠকানোর নানারকম প্রক্রিয়ায় কালো হয়ে থাকা আবহাওয়াতে বেচারির এমন ফুলের মতো মনটাতে কালি লেগে যাবে। রীতিকে সত্যিই ভালোবাসে বলেই, রীতিকে বিয়ে করতে পারবে না বিশু।

    হত, যদি ও আলাদা হয়ে গিয়ে অন্য বাসা নিয়ে থাকত। পারত যদি। কিন্তু বিশুর পয়সাসর্বস্ব, দাম্ভিক অথচ অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ বাবা এবং করুণাময়ী মা, ও আলাদা হয়ে চলে গেলে হয়তো হার্ট-অ্যাটাক হয়েই মারা যাবেন। এই ভয়েই রীতিকে দূরে রাখে সবসময়ে। মনে মনে।

     

     

    সেদিন সকালের রিহার্সালের পর রীতি ওর সঙ্গে ফিরছিল। হঠাৎ-ই বলেছিল, ওর জিপে করে পৌঁছে দেওয়ার কথা। অসময়ের বৃষ্টি নেমেছিল। তাও হঠাৎ-ই। ভিজে-ধুলো থেকে গন্ধ উঠছিল সোঁদা-সোঁদা। বিশু ভাবছিল, হয়তো রীতির ঠোঁটের গন্ধও এমন। রীতিই বলেছিল, হঠাৎ। পদ্মবনের পথেই চলুন। ঘোরা হলে হবে। এই শরতের হঠাৎ বৃষ্টিতে পদ্মবিলের রূপ দেখে যাই চলুন।

    বলে, জিপের স্টিয়ারিং-ধরা হাতে হাত ছুঁইয়ে বলেছিল, দাঁড়ান। একটু দাঁড়ান এখানে।

    প্লিজ। দারুণ! না?

    জিপটা দাঁড় করিয়েছিল বিশু। অবাক হয়ে বলেছিল এখানে? হঠাৎ?

    বাঃ। না দাঁড়ালে, পদ্মবিলের কথা শুনবেন কী করে? শুনুন শুনুন। কী সুন্দর পাখি ডাকছে একটা বিলের মধ্যে থেকে। কী পাখি ওটা?

    কে জানে? ওসব পাখি-টাখির কথা তক্ষদাই জানে। বিশু বলেছিল।

     

     

    কী সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে, না? পদ্মবনের জলে বৃষ্টির জল মিশে। ফড়িং উড়ছে। আহা! চরের কাশফুলগুলো সব বুড়ির চুলের মতো লেপটে রয়েছে ডাঁটির সঙ্গে। দেখছেন? এই বৃষ্টিতে কারো লাভ আবার কারো ক্ষতি! তাই-না? অন্যরকমও তত হতে পারত। সকলেরই লাভ হতে পারত তো? কী?

    বিশু একটা সিগারেট ধরিয়েছিল পকেট থেকে লাইটার বের করে। আগেকার দিনের যাত্রায় যেমন স্বগতোক্তি করতেন, নায়ক-নায়িকারা দর্শকদের শুনিয়ে শুনিয়ে, রীতিও যেন, তেমন-ই করছিল। রীতি ওর দিকে সরে এসে গায়ে গা-ছুঁইয়ে বলল, ও মা! ওটা কী? আপনার ডান কাঁধে ওটা কী?

    চমকে উঠে বিশু দেখেছিল, হলুদ প্রজাপতি একটি।

    রীতি হাততালি দিয়ে বলেছিল, শিশুর মতো; কী মজা। এবার নির্ঘাত বিয়ে হবে আপনার। বড়োলোকের ছেলের বিয়ে। কত কী ভালোমন্দ খাওয়া যাবে!

    বিশু প্রজাপতিটাকে সিগারেটের ধুয়োয় ফুঁ দিয়ে, উড়িয়ে দিয়ে হাসি হাসি মুখে রীতির দিকে চেয়েছিল।

     

     

    রীতি অপ্রস্তুত মুখে বলেছিল, হাসছেন যে!

    এমনি!

    সরে গেছিল রীতি সিটের ও-পাশে। বিশু জানে যে, রীতির ব্যবহারে কোনো সস্তা ব্যাপার নেই। অনেক ঢলানি মেয়ের মতো গায়ে পড়ে না ও। রীতি, অনেক প্রচলিত মেয়েলি রীতির ই ব্যতিক্রম। রীতির প্রতি যে, ওর বিশেষ এক দুর্বলতা আছে, সেটা প্রকাশ করতে চায় না বিশু। কী লাভ? যে-স্বপ্ন সত্যি হবে না, এ-জীবনে সেই স্বপ্ন সত্যি করার মিথ্যে চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করলে নিজেকে অপমানও তো করা হয়। বিশেষ করে ভালোবাসার ক্ষেত্রে। বিশু তো একা নয়। ওরাই তো গরিষ্ঠ সংখ্যায়। মানুষ হয়ে জন্মাবার দুঃখ অনেক। এবং অনেকরকম।

    রীতি আয়নার সামনে বসেছিল, মেয়েদের গ্রিনরুমে।

    মুখের মেক-আপও নেওয়া হয়ে গেছিল। নিজের দিকে আয়নায় চেয়ে ওর বিশ্বাস-ই হচ্ছিল না যে, ও রীতি। ও যে, রূপমতীই সে-সম্বন্ধে ওর নিজের আর একটুও সন্দেহ ছিল না। তার বয়েস যেন পাঁচ-শো কত বছর হল! নাকি ছ-শোই? যেন, রূপমতী হয়েই জন্মেছিল ও নবাব-বাদশাদের অঙ্কশায়িনী হবে বলে। মাণ্ডুর জেহাজ-মেহালের আর রূপমতী-মেহালের অলিন্দ আর ঝরোকার মধ্যে দিয়ে বড়ো বড়ো পল্লবমন্ডিত দিঘল কালো সুরমা টানা চোখ মেলে অতীতের ঘরে বসে ভবিষ্যৎকে চোখ দিয়ে ছোঁবে বলেই।

     

     

    বাজবাদাদুর-বেশি বিশুকেই প্রথমে দেখল গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে। বিশুও চমকে উঠল রূপমতীকে দেখে। রূপমতীও তাই। দু-জনে মুগ্ধ হল, দু-জনকে এই নবরূপে দেখে। পোশাক কি মানুষের মানসিকতাকে বদলে দেয়? হয়তো দেয়।

    বিশু বলল, আপনি কী বলেন রীতি, বাকি জীবনটা বাজবাহাদুর আর রূপমতী হয়ে কাটাতে পারলে বেশ হত, তাইনা?

    রূপমতী হাসল। বলল, আমার আপত্তি ছিল না কোনোই। রোজকার আটপৌরে জীবন একেবারেই অসহ্য। দমবন্ধ লাগে আমার। রূপমতী হতে পারলে, আধম খাঁদের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করতে সহজে রাজি ছিলাম। তারপর একমুহূর্ত থেমে, একটু দ্বিধা করে বলল; এমনকী ধর্ষিতা হতেও।

    বিশু কিছু বলার আগেই, বোকাদা দৌড়োতে দৌড়োতে এল উলটোদিকের উইংসের মধ্যে থেকে। এবং স্টেজের কোণাতে সেটের একটি অংশের সঙ্গে, পা লেগে যাওয়ায় দড়াম করে আছাড় খেল।

    নাক ফেটে রক্ত গড়িয়ে গেল।

    বোকাদা বলল, ডেটল! ডেটল!

     

     

    কে যেন, দৌড়ে গেল ডেটল আনতে। পাঁচুডাক্তারকে ডাকতে।

    তক্ষদা বলল, এত এক্সাইটেড হওয়ার কী আছে, বোকা?

    আঁছে। আঁছে। মাঁত্র এঁকঘণ্টা বাঁকি। দেঁয়ার ইঁজ মেঁনি এঁ স্লিঁপস বিঁটুইন দাঁ কাঁপ এঁণ্ড দ্যা লিঁপস। পঁড়োনি? উঁ, উঁ। যঁতক্ষণ না আঁচাচ্ছি বিঁশ্বাস নেই। বঁদনাম হঁলে তোঁ আঁমার-ই হঁবে।

    লাগেনি তো বোকা?

    এঁখন লাঁগার সঁময় নেঁই। গোঁপেনটা এঁখনও এঁসে পৌঁছোল না দেঁখেছ। এত্ত ইরেসপনসিবল না। বাঁঙালির কিঁসসু হঁবে না। কিঁসসু হঁবে না। ডেঁটল।

    বলেই, বোকাদা সেটের পেছনের রহস্যময় অন্ধকারে হারিয়ে গেল। এবং তার পেছনে পেছনে পাঁচুডাক্তারের কম্পাউণ্ডার ডেটলের শিশি আর তুলো হাতে। এইসব ইভেনচুয়ালিটির জন্যেই তাকে ধার চেয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল পাঁচুডাক্তারের কাছ থেকে।

     

     

    তক্ষ রায় বাঁ-দিকের উইংসের গভীরের প্রায়ান্ধকারে হাতল-ভাঙা চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল। কোনো গুহাবাসী জানোয়ারের-ই মতো তক্ষও অন্ধকারে, নইলে নিদেনপক্ষে প্রায়ান্ধকারেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে অনেক বেশি।

    জোরে ধোঁয়া ছাড়ল। আঃ।

    একহাতের কেটলিতে গরম চা আর অন্য হাতের আর ওর বুকের মধ্যে গোঁজা ভাঁড়-এর পাহাড় নিয়ে, চা দিতে এল ছেলেটা।

    রুন বলল, সামোসাভি লাওরে। এ ছোঁওড়া!

    লায়া বাবু। আভভি লায়া। ইকদম গরম গরম নিকাল রহা হ্যায় উস্তাদ।

    হ্যাঁ। লেতে আনা। বোকাদা সবাইকেই বলেছিল যে, যে, যেমন পারে সঙ্গে হেল্পিং হ্যাঁণ্ডস নিয়ে আসতে। নানারকম কাজে সাহায্য হবে। রুন কাউকেই আনতে পারেনি। বোকাদা এনেছে দুখিয়া পাগলাকে। পাগলা অনেক কাজ করে দিয়েছে। সেট টানাটানি করা থেকে চেয়ার সাজানো। গাঁজায় দম দিয়েই এসেছে বোধ হয়। শো-এর পরে এখানেই লুচি-মাংসর বন্দোবস্ত আছে আজ। আর কালাকাঁদ। সকলেই পেট ভরে খেয়ে যাবে।

     

     

    তক্ষ রায়ের পাশে চেয়ার টেনে বসল রুন। তক্ষ লক্ষ করল যে, ও নিজে এবং গাধ্ব পাঁড়ের দোকানে দিনে একটি টাকা এবং দু-বেলা খাওয়ার বিনিময়ে আঠারো ঘণ্টা কাজ করা এই ল্যাংড়া শিশুটি ছাড়া এইমুহূর্তে প্রত্যেকেই নাটকের পোশাকে সেজে রয়েছে। রীতি, বিশু, রুন এরা সকলেই তাদের নিজেদের নিজস্বতাকে কিছু সময়ের জন্যে হলেও বাসি কাপড়ের মতো ছেড়ে ফেলে যেন, অন্য কেউই হয়ে উঠেছে। জীবনে ঠিকাদারি-করা বিশু নবাব। জীবনে কাউকেই ভালো না-বাসতে-পারা রীতি সেই নবাবের প্রেমিকা। ভীরুতম মানুষ সূর্য দুর্ধর্ষ সেনাপতি। এইসব অল্পবয়স্ক অনভিজ্ঞ ছেলে-মেয়েদের পবিত্র মুখগুলিতে শরতের শেষরাতের শিশিরের গন্ধমাখা স্বপ্নর-ই মতো মঞ্চের লাল-নীল আলোরা স্বর্গের পাখির মতো খেলা করবে একটু পরেই। নিজেদের গমগমে গলার-স্বর অ্যামপ্লিফায়ারে শুনে নিজেরাই চমকে চমকে উঠবে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে নিজেদের গলার স্বরকে। নিজেদের অস্তিত্বকে জীবনে যত না বাসে, তার চেয়েও অনেক বেশি করে।

    এই মঞ্চ এক দারুণ ব্যাপার। ভাবছিল তক্ষ রায়। জীবনের সঙ্গে মঞ্চের মতো এমন গভীর ‘মিল’ বড়ো কম জিনিসের-ই আছে। প্রত্যেকেই তো পৃথিবীতে আসে কোনো কোনো বিশেষ ভূমিকাতে জীবনের মঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে কানফাটানো হাততালি পেয়ে ফিরে যেতে। অন্তত প্রত্যেকের-ই কাম্য তাই-ই থাকে। পাদপ্রদীপের আলো কাউকে-বা তার নিজের মাপের চেয়েত অনেক-ই বড়ো করে তোলে; আবার কোনো জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বকেও নিষ্প্রভ।

    এই মঞ্চ বড়ো এক গোলমেলে জায়গাও বটে।

    কেউ কেউ কোনো বিশেষ ভূমিকায় অভিনয় করেই চলে যায়। অনেক সময়ে নিজেরও অজান্তে। কেউ কেউ সে, ভুল ধরতে পারে, অনেক-ই দিন মহড়া দেওয়ার পর। কেউ, বা চিতাতে পৌঁছেও পারে না। তবে, তক্ষ রায় একটা কথা নিঃসন্দেহেই মানে যে, নিজের বহুল-মহড়ার নাটক, আধুনিক মানুষদের মধ্যে খুব কম মানুষ-ই সত্যি সত্যি মঞ্চস্থ করতে পারে, বা হয়েছে বলে দেখে যেতে পারে। আসলে এই নিরবধি-মহড়ার আর এক নাম-ই হয়তো ‘জীবন’। ঝিরাটোলির প্রতিঘরে-ঘরেও এই মুহূর্তে অসংখ্য অসহায় মানুষ ও মানুষী তাদের নিরুক্ত যন্ত্রণায় বা’য় হয়ে মরা-গাছের মতো চোখ মেলে বিভিন্ন ভূমিকাতে উঁচু বা নীচু গ্রামের স্বরে মহড়া দিয়ে যাচ্ছে। আজ সন্ধেতে যে, রূপমতী’ নাটক মঞ্চস্থ হবে তারসঙ্গে এই দৈনন্দিনতায় স্নান; অগণ্য গার্হস্থ্য নাটকের অমিল অনেক-ই আছে। সেইসব বর্ণহীন দৈনন্দিনতার মঞ্চে এত সাজসজ্জা নেই, নকল-হিরের গয়নারও ঝিকিমিকি নেই; নারীরা পাঁয়জোর পরা পায়ে রুনুঝুনু তুলে হাঁটে না সেখানে, নেই ঝলমল পোশাকও। হৃদয়ের ধুকপুকুনি আর চোখের অস্বস্তি পুরোপুরি ডুবিয়ে দেওয়ার জন্যে তীব্র রং-বেরঙের আলো আর প্রলেপের পর প্রলেপের সুগন্ধি প্রসাধনও অনুপস্থিত সেখানে। সেইসব মহড়া বড়ো ন্যাড়া, ন্যাংটোত্ব ভারি করুণ।

    তা ছাড়া, রূপমতী’ তো একটু পর-ই মঞ্চস্থ হবে। কিন্তু ওইসব নাটকের মহড়াই সার। হাজারে মঞ্চস্থ হবে একটি বা দুটি।

    রুনের মেক-আপ নেওয়া শেষ হল। রীতিমতো উত্তেজিত বোধ করছে ও। চেঞ্জার যাঁরা এসেছেন এবার পুজোয়, তাঁরাও অনেক টিকিট কেটেছেন। তক্ষ রায়ের লেখা নাটক শুনেই এত উৎসাহ তাঁদের। বড়োশহরের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই সাহিত্য, সংগীত, বা সংস্কৃতির কোনো প্রভাব বিশেষ না থাকলেও তাঁরা মনে করে থাকেন, তাঁরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন সেইসব রুগণপ্রাণের প্রাণীদের! বিহারের এই মফসসল শহরে এসে তাঁরাই যদি, তক্ষ রায়ের নাটক না দেখে যান তাহলে কলকাতা ফিরে অফিস আর বসবার ঘরে চায়ের কাপে তুফান তুলবেন কীকরে? সকালে বিকেলে মিষ্টি আমেজের শীতকে উপভোগ না করে, উলটে তাতে আতঙ্কিত হয়ে গলায় কম্ফটার, মাথায় বাঁদুরে টুপি এবং পায়ে গলফ শু পরে, মাইল দুয়েক হেঁটে যে, ক্যালোরি ক্ষয় করলেন তা অচিরেই ঠোঙা-ভরতি শিঙাড়া ও জিলিপি কিনে এবং গোগ্রাসে খেয়ে পুরিয়ে নিয়ে গায়ে জোর করে যাচ্ছেন তাঁরা অনুক্ষণ। ক্যালোরি যতটা-না পুড়ছে, পূরিত হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। কিছু সুন্দরী মেয়েও এসেছে এবারে। তবে শহরের সুন্দরীরা বড়োই ফ্যাকাশে। ইট-চাপা ঘাসের মতো। ঝিরাটোলির মেয়েদের মতো রোদ-বৃষ্টির আশীর্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত। আজ অবধি অনেক সুন্দরীই দেখল, রুন। তবে রীতির মতো একজনও না।

    তক্ষদার পাশে চেয়ারে বসে রুন ভাবছিল, রীতি যতই বলুক তার পক্ষে মা-বাবাকে দুঃখ দিয়ে বই আর রেকর্ডের ব্যবসা করা সম্ভব হবে না! বাঁশের ব্যবসাই করবে ও।

    অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

    পারল না। সংস্কার বড়োগভীরে শিকড় নিয়েছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে তার জন্মসূত্র ছাড়া আর কোনো সূত্রের-ই মিল নেই। সে একটা একেবারে আলাদা মানুষ। আলাদা মনের, আলাদা শিক্ষার; আলাদা মানসিকতার। তবু যতদিন তাঁরা আছেন ওই দমবন্ধ গর্তেই কাটাতে হবে বাকি জীবন।

    বাবা বলেছেন, ওসব যাত্রা-টাত্রা দেখে সময় নষ্ট করেন না তিনি। মা দয়াপরবশ হয়ে রাজি হয়েছেন আসতে, পাশের বাড়ির ফুলুপিসিকে নিয়ে। ফুলুপিসি খুব ভালো বড়ি দেন মুগ ডালের। ভালো পাটিসাপটা পিঠেও বানাতে পারেন। মায়ের কাছে শুনেছে, ফুলুপিসিমাদের দেশ ছিল নাকি, বরিশালে। সাঁতার কাটতে কাটতে জলের মধ্যে নকশিকাঁথাও নাকি বুনতে পারতেন তিনি, কিশোরী বয়েসে। জলের সূচ, জলের সুতো, জলের কাঁধা। এখন সব-ই জলের তলে। মাঝে মাঝে স্মৃতির মাছে ঘাই মেরে যায়। বুড়বুড়ি ওঠে। স্বগতোক্তি। ঝিরাটোলির যত কেচ্ছা সব-ই ফুলুপিসির মুখস্থ। তক্ষ রায়ের আধুনিক নাটক ‘রূপমতীর’ প্রকৃত গুণগ্রাহী হবেন তাঁরাই। ভাগ্যিস তক্ষদা জানে না।

    আরও দুটো কার্ড পেয়েছিল। স্নিগ্ধ আর সৌম্যকে দিয়েছে। ওরা নাটক সম্বন্ধে ভাবে টাবে। তবে যতখানি বোঝে, বাত্তেলা দেয় তার চেয়ে বেশি। যারা আসলে বোঝে, তারা অতকথা বলে না।

    তক্ষদা বললেন, চাওয়ালা ছোঁড়াটা কোথায় গেল, দ্যাখো তো ভায়া। শিঙাড়াও আনবে বলল গরম গরম। আজ দুপুরে খাওয়াও হয়নি।

    কেন?

    পেজ-মেকআপের দিন ছিল আজ। ক্যান্টিনে যাওয়ার সময়ই পেলাম না। এদিকে বোকা বলেছিল, চারটের মধ্যে না এলে ওর নার্ভাস ব্রেক-ডাউন হবে। কাজ শেষ করতে করতেই বেলা হয়ে গেল। সময়ই পেলাম না খাবার।

    ওই যে, এসে গেছে।

    রুন বলল, ল্যাংড়া ছেলেটাকে দেখিয়ে।

    ডাকসাইটে ইন্টেলেকচুয়াল তক্ষ রায়েরও যে, খিদে নামক অতিসাধারণ কোনো মানডেন বোধ থাকতে পারে এবং উনিও অমন গোগ্রাসে খেতে পারেন নিজের চোখে না দেখলে, বিশ্বাস হত না রুন-এর।

    রুনও নিল দুটো শিঙাড়া। খেতে খেতে বলল নার্ভাস তো হওয়ারই কথা। আমরা ছোট্টরোলে অভিনয় করছি তাতেই এত নার্ভাস। আর বোকাদা তো ডিরেক্টর-ই!

    নার্ভাসনেসের কী আছে?

    নেই? স্টেজ থেকে সামনে অডিটোরিয়ামের দিকে চাইলেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। প্রথম লাইনেই দেখব হয়তো, আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল চৌরাশিয়াজি বসে আছেন ইয়া ব্বড়া গোঁফ নিয়ে।

    তক্ষদা শিঙাড়াগুলো খেয়ে আর এক কাপ চা হাতে নিয়ে বলল, একটা নিয়ম আছে।

    কী নিয়ম?

    অডিটোরিয়ামের প্রথম সারিতে যারা বসে থাকবেন তাদের মনে করবে ছাগল। দ্বিতীয় সারির মানুষদের ভেড়া। তারপরের লাইনের মানুষদের গোরু। তারপরের লাইনে গাধা। এইরকম আর কী। আসলে, যতদূর অবধি তাকালে মুখ চেনা যায় চোখদুটি সেই সীমাটি পার করিয়ে অন্ধকারে তুলে রাখতে হয়। যে-সীমান্তর ওপারে শত্রু-মিত্র নারী-পুরুষ সব শুধুমাত্র কালো কালো অস্পষ্ট মুন্ডু হয়ে ফুটে থাকে; সেখানে। দেখবে নার্ভাস লাগছে না। তা ছাড়া, মনে করবে তুমিই ধন্য করে দিচ্ছ সকলকে অভিনয় করে। তোমার নার্ভাসনেস আসবে কেন?

    হাত দুটোও কম গোলমাল করে না।

    রুন বলল। হ্যাঁ। তা ঠিক কিন্তু।

    মনে করবে তুমি জগন্নাথ।

    তা তো আর হয় না।

    তাহলে একটা হাত সেনাপতির জোব্বার ভেতরে চালান করে দেবে। একটামাত্র বাইরে থাকলে সেটা ম্যানেজ করা অত কঠিন হবে না।

    বলেই বললেন, বাজে ক-টা?

    রুন লক্ষ করল তক্ষ রায়ের হাতে ঘড়ি নেই। নিজের হাতঘড়িও খুলে রেখে এসেছে গ্রিনরুমে। তাই বলল, দেখে আসছি। আর বোধ হয় মিনিট পঁয়তাল্লিশ আছে। লোক আসতে শুরু করবে একটু পরেই। আপনি ঘড়ি পরেন না?

    পরি-না তা নয়, পরি কখনো-সখননা। আসলে, ঘড়ি তো এখন পুরুষের একটি অলংকার বিশেষ হয়ে গেছে। ডাক্তার, বাবুর্চি অথবা সুমেরু-কুমেরু অভিযাত্রীরা ছাড়া ঘড়ি কী এদেশে কারোর-ই খুব একটা দরকার হয়? ঘড়ি তো হাতে বাঁধাই থাকে। তাকায় ক-জন? নিজের সময়মতো অফিসে আসে, নিজের সময়মতো বাড়ি যায়। ঘড়ির দিকে তাকালে দেশের চেহারা এতদিনে অন্যরকম হয়ে যেত।

    তবু, অসুবিধে হয় না?

    নাঃ। অন্য সবাই তো পরে। সময় জিজ্ঞেস করে নিই দরকার পড়লে। তবে সময়কে আমি ঘেন্না করি বড়ো।

    সে কী?

    হ্যাঁ। এই ঘড়ির ‘টিকটিক’ মনে করিয়ে দেয় যে, সময় চলে যাচ্ছে। সুযোগ চলে যাচ্ছে। কিছুই করা হল না, পাওয়া হল না; দেওয়া হল না। মিছিমিছিই সময় যৌবন, জীবন সব চলে যাচ্ছে। ঘড়ি দেখতে আমার বিচ্ছিরি লাগে।

    বোকাদা দৌড়ে এল ভেতর থেকে লন্ডন খাঁকে সঙ্গে করে। তার ডান গালে দাড়ি লাগানো হয়েছে। ধবধবে বাঁ-গাল চকচক করছে। খুব যত্ন করেই দাড়ি কামিয়েছে অরু আজ। ওর গার্লফ্রেণ্ড ঝরনা আসবে বলেছে। যখন দেখা হবে তার সঙ্গে তখন, এই দাড়ির আঠা লেগে থাকবে চ্যাটচেটে হয়ে সেটা অরু জানে না। রুন জানে। রুন, এর আগেও দু-একবার। নাটক করেছে ওদের কলেজের স্টেজে।

    কী হল?

    তক্ষদা শুধোলেন।

    বোকাদা কথা বলল, এখন আর সূর্পণখার মতো নয়।

    লজ্জন খাঁ যেখানে, বাজবাহাদুরকে কুর্নিশ করে চলে যাচ্ছে হোশাঙ্গাবাদের লড়াই-এর প্রস্তুতির জন্যে, তখন তার ভঙ্গিটা কীরকম হবে? মানে, নবাবের প্রতি লন্ডনের মনোভাবটা কেমন হবে? আই মিন ফেশিয়াল এক্সপ্রেশান?

    বলেই বলল, তাড়াতাড়ি বলো, টাইম নেই।

    যদি সেনাপতি জানেই, যে-যুদ্ধ এবং রাজকার্য ছাড়া আর সবকিছুই করেন তাঁর নবাব, হাজার হাজার দিশি-বিদেশি মেয়েমানুষের শরীর নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন, গায়িকা রূপমতীর সঙ্গ এবং গান-বাজনা নিয়েই যিনি থাকেন; সে নবাবের-ই জন্যে যাচ্ছেন আধম খাঁর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে, তার মনোভাব কেমন হতে পারে? জাঁহাপনা আকবরের সেনাপতি আধম খাঁর শৌর্য-বীর্যর কথা তো লজ্জন খাঁর অজানা ছিল না!

    সংগীত, প্রেম, এসবের কোনোই কী ভূমিকা নেই? তা ছাড়া মিলিটারিতে তো রাজাকে আর ঊর্ধ্বতন অফিসারকে অন্ধভক্তি করতেই শেখানো হয়েছে চিরদিন। হয়নি কি?

    মানলাম সব-ই। তবে প্রায় আত্মহত্যাই করতে যাওয়ার আগে, লজ্জন খাঁ নিজের দিকটাই তো ভাববেন? ভাববেন, এই হতভাগার জন্যে নিজের মুভুটিই আকবরের সেনাপতির কাছে জিম্মা দিতে হচ্ছে। সেইমুহূর্তে তো তাঁর মুখে একধরনের ঘৃণা, অবজ্ঞা এবং অসহায়তাই ফুটে ওঠা উচিত। ঘুসখোর অফিসারের সৎ পেশকারের মুখে যেমন, ফুটে ওঠে যখন তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর ঘাড়ে বন্দুক রেখেই অন্যজন শিকার করছেন।

    শুনলি তো! যা এবারে। দাড়ি লাগিয়ে নে।

    বোকাদাও চলে যাচ্ছিল। তক্ষদা পিছু ডাকল, বলল; বোকা।

    বোকাদা ফিরে এল।

    এখন কেন, এইসব ডিটেলস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ? এতে সকলেই কনফিউজড হয়ে যাবে। এ তো আর প্রফেশনাল দল নয়। একটু-আধটু খুঁত না হয় থাকলই।

    আমি ‘পারফেকশন’-এ বিশ্বাস করি তক্ষদা। চেষ্টা করছি যতটুকু পারি ভালো করে উতরে দিতে তোমার ‘রূপমতী’কে আমার সাধ্যমতো! এরপর খারাপ হলেও আমার বিবেক’-এর কাছে পরিষ্কার থাকব।

    তক্ষদা কিছু না বলে তাকাল বোকাদার দিকে। প্রায়ান্ধকারেও তক্ষদার চোখ দেখে মনে হল রুন-এর, চোখ-দুটিতে অবাক হওয়ার ভাব। কোন মানুষের ওপর যে, অন্য কোন মানুষ কখন এসে জবরদখল নেয়, তা বোধ হয় আমাদের বোঝাবুঝির বাইরে। বোকাদা মানুষটাকে নিয়ে ওরা কম হাসি-ঠাট্টা করেনি। কিন্তু আজ শো-এর দিনে পৌঁছে দেখছে যে, জিনিয়ার্স ইজ নাইনটি পার্সেন্ট পার্সপিরেশন অ্যাণ্ড ওয়ান পার্সেন্ট ইন্সপিরেশন’-এ কথাটা বোধ হয় ঠিক-ই। তা ছাড়া বোকাদা না থাকলে রূপমতী’ কখনোই মঞ্চস্থ করা যেত না। সব ক্লাব, সব প্রতিষ্ঠানেই একজন করে বোকাদা থাকেন-ই। তারাই পুরো সংস্থাটিকে ধরে রাখেন, এগিয়ে নিয়ে যান; অথচ নাম হয় হয়তো তক্ষ রায়দের-ই।

    হঠাৎ দুখিয়া পাগলা অডিটোরিয়াম থেকে স্টেজে উঠে আসার জন্যে স্টেজের দু-পাশে যে, ছোটোসিঁড়ি আছে কালো পর্দা ঢাকা, তা দিয়ে উঠে এল। সুপ্রতীপের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট, ছেলেটির নাম জানে না রুন; তবে মুখ চেনা, বাহাদুরগঞ্জ-এর দিক থেকে অনেকদিন সাইকেলে আসতে দেখেছে; বলে উঠল, অ্যাই পাগলা! ভাগ ভাগ। তু ক্যা কর রহা হ্যায় হিয়?

    দুখিয়া ডান হাতের দু-টি আঙুল দিয়ে তার নিজের নাক টিপে ধরে বলল, কোই চিজকি বু অ রহা হ্যায়?

    বু? কওসি বু? খুশবু ইয়া বদবু?

    বদবু! বদবু!

    মগর কৌওন চিজকি? উত্তর না দিয়ে, বদবু! বদবু’! বলতে বলতে দুখিয়া পাগলা স্টেজের পেছনে চলে গেল।

    ছেলেটি হেসে উঠল। রুনও তাকে দেখে হেসে উঠল।

    তক্ষদা হাসলেন না। দুখিয়ার দিকে চেয়ে থাকলেন যতক্ষণ না, মিলিয়ে যায় সে। তক্ষ হাসল না কারণ ও লক্ষ করেছে যে, প্রত্যেক পাগলের মধ্যে কিছু ঐশ্বরিক এবং ভৌতিক লীলাখেলা থাকে। চিন্তিত হল ও!

    লাইটিং-এর ইনচার্জ সুপ্রতীপ বলল, অ্যাই কাদির, চার নম্বরটা ছোটো কর, আরও ছোটো, বাঁ-দিকে সরা সামান্য। হ্যাঁ-অ্যাঁ! মনে থাকে যেন, তুই কন্সট্যান্টলি রূপমতীকে ফলো করবি। কখন কোন রং মনে আছে তো?

    হ্যাঁরে বাবা! বিরক্ত গলায় বলল কাদির। তারপর নীচু গলায় তার সঙ্গীকে বলল, যাতে সুপ্রতীপ শুনতে না পায় এমন করে, রূপমতীকে ফলো করে মরি আর কী! সারাশহর ফলো করছে আর আমি শালা কোন ছাতার লাইট-অ্যাসিস্ট্যান্ট!

    কথাটা তক্ষ এবং রুন দু-জনেই শুনল এবং গম্ভীর হয়ে গিয়ে দু-দিকে চেয়ে রইল।

    রুন উত্তেজিত বোধ করছিল। সিগারেট ধরাল একটা। স্টেজে ওঠার আগে আরও একটা খাবে। আরম্ভ হতে আর পঁয়ত্রিশ মিনিট টাক আছে। বাইরে গাড়ি, সাইকেল, রিকশা, স্কুটার আর মোটরসাইকেলের মিশ্র আওয়াজ। পুরুষ ও নারী কন্ঠের শোরগোল! বেশিকথা বলছেন চেঞ্জার বাবুরাই। বড়োশহরের ট্রাম-বাসের আওয়াজের মধ্যে কথা বলে ওঁদের গলার স্বরটা বোধ হয় উঁচুগ্রামে বাঁধা হয়ে যায়। ইচ্ছে করলেও আর নীচুতে নামাতে পারেন না, জীবনযাত্রার মান বাড়িয়ে ফেলা মানুষের-ই মতো।

    বোকাদা আর একবার গ্রিন-রুম থেকে দুখিয়া পাগলাকে নিয়ে বাইরে এল। এখন উইংসের দু-পাশে নানা লোক! এতলোকে সাহায্য করতে এসে, অসুবিধেই ঘটাচ্ছে। দুখিয়া পাগলাকে ধমকে বলল বোকাদা, এক্ষুনি গেট খুলে যাবে। এখন অডিটোরিয়ামের দিকে যেয়ো না। বরং বাইরের গেটে গিয়ে দাঁড়াও। পরক্ষণেই গলা নামিয়ে বোকা বলল দুখিয়ার কানে কানে, বউদি এল কি না, দেখে আমাকে বলে যেয়ো তো! বুঝলে দুখিয়া?

    বোকাদার কথার উত্তর না দিয়ে, দুখিয়া পাগলা প্রচন্ড চিৎকার করে উঠল। বলল, সমঝা আভভি! কওনচি কা বু!

    বোকাদা ওর চিৎকারে চমকে উঠল। তারপর-ই সামলে নিয়ে বলল, কওনচি কা?

    দুখিয়া পাগলা দুটি হাত দু-টি কানে ঠেকিয়ে বললঃ মওত।

    মওত?

    জি হাঁ! মওত কা বু! মৃত্যুর গন্ধ।

    ঠিক সেই সময়েই প্রচন্ড শব্দ করে একটি মোটরসাইকেল এসে, যেন, স্টেজের মধ্যেই ঢুকে পড়ে; থেমে গেল। বিশুদের ঠিকাদারি ফার্মের ওভারশিয়ার ত্রিপাঠীজি মোটরসাইকেল থেকে নেমেই একহাতে গাঢ় লাল-রঙা হেডগিয়ারটি ধরে জোরে দৌড়ে এলেন বাঁ-দিকের উইংসের মধ্যে। ছোটোবাবু! ছোটোবাবু?’ করতে করতে। প্রথমে বোকাদাকে দেখতে পেয়েই উচ্চস্বরে বললেন, আরে এ বোকাবাবু! খাতরা বন গ্যায়া। মালকিন আভভি গুজর গ্যয়ি।

    ছেলেদের গ্রিন-রুম-এর ভেতর থেকে বাজবাহাদুরের পোশাকে বিশু এবং অন্যান্যরাও দৌড়ে এল। মেয়েদের গ্রিন-রুম থেকেও সকলে।

    বিশুর মা ও বাবা ছেলেদের থিয়েটার দেখবার জন্যে বেরোচ্ছিলেন। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসেছে গাড়িবারান্দার নীচে, মোহিনীদেবী গাড়িতে উঠতে যাবেন, দরজাতে হাত রাখা; ঠিক সেই সময়েই বুকে ব্যথা। সিঁড়িতেই পড়ে গেলেন। তাঁকে গাড়িতে তুলে সোজা বদ্রীদাস হাসপাতালে। ডাক্তার দেখেই বললেন, শেষ। গাড়ির পেছন পেছন ত্রিপাঠীজি হাসপাতাল অবধি গেছিলেন। সেখান থেকেই সোজা এখানে। ঘামে কপাল ভেজা।

    এদিকে গেট খুলে দেওয়া হয়ে গেছে। পিলপিল করে লোক ঢুকছে টিকিট হাতে করে। অডিটোরিয়ামের মধ্যে থেকে গমগমে আজয়াজ আসছে একটা। স্যুভেন্যির-এর দাম করা হয়েছে দু-টাকা। অনেক অ্যাডভার্টাইজমেন্টও পাওয়া গেছে। কলকাতার এক সোসকে দিয়ে তক্ষদা বিখ্যাত লেখকদের শুভেচ্ছাবাণীও আনিয়েছেন। তার সঙ্গে খেলার নতুন ডি এম ইয়াং ওড়িয়া আই এ এস অফিসার মহাপাত্র সাহেবের শুভেচ্ছাও ছাপা হয়েছে। জোর শোরগোল আসছে ভেসে, বাইরে থেকে। এরইমধ্যে বাজবাহাদুর, ওরফে বিশু তার দুর্ধর্ষ মেক-আপ নিয়ে হাঁটু-ভেঙে বসে পড়ল উইংসের কাঠের পাটাতনের ওপর। তারপর দু-হাতে কালো দাড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে ঝলমলে পোশাক চড়-চড় আওয়াজে খুলতে খুলতে ডুকরে কেঁদে উঠল ‘মা! ও মা!’ বলে। পরক্ষণেই মাটিতে লুটোতে লাগল আধখোলা পোশাক পরে কাটা-পাঁঠার মত। বাহুতে মুখ ঢেকে।

    তক্ষ রায় বিশুকে দেখতে দেখতে নিশ্চল হয়ে বসে আর একটা সিগারেট ধরাল। ধুয়ো ছেড়ে ভাবল, ছোঁড়াটার ইন্টেলেকচুয়াল হতে দেরি আছে অনেক। তা ছাড়া, ওর বাবাই বা কেমন লোক? মারাই যখন গেলেন ভদ্রমহিলা, সে-খবরটা তিনঘণ্টা পরে পাঠালেই বা কী হত বিশুর কাছে? এতগুলো মানুষের এতদিনের পরিশ্রম ইনভলভমেন্ট, নিষ্ঠা, এতমানুষের এতদিনের প্রত্যাশা, টিকিট-কেটে আসা; সব-ই মাঠে মারা গেল। ছিঃ।

    পরে যদি কখনো নাটক লেখে তাতে শুধু, একটিমাত্রই চরিত্র রাখবে। সমষ্টিই ব্যক্তির সবচেয়ে বড়োশত্রু।

    ভাবছিল তক্ষ।

    জানে না, ক-টা বাজে এখন? তবে, অনেক সময় বয়ে গেল। এখন আর কোনো শোরগোল নেই। ভাগ্যিস ডি এম এবং এবং এস পি এসেছিলেন। পুলিশের সাহায্যও নিতে হয়েছিল। বোকাদা মাইকে অ্যানাউন্স করেছেন যে, পনেরো দিন পরে যে শনিবার, সেই শনিবার রাতে ওই টিকিট নিয়ে এলেই ‘রূপমতী’ দেখা যাবে।

    তবে চেঞ্জাররা অনেকেই অখুশি। অতদিন ওঁদের মধ্যে অনেকেই থাকবেন না। সেই নিয়ে আলোচনা, গুঞ্জরন করতে করতে চলে গেছেন ওঁরা। বিশুকে গান্ধারীদি নিজেই গাড়ি করে নিয়ে গেছেন। সঙ্গে গোপেন আর সূর্যও গেছিল। বিশু একেবারেই ভেঙে পড়েছে। আসলে সংসারে কোন মানুষের শেকড়-বাকর যে, ঠিক কতখানি গভীরে প্রোথিত থাকে তা, ছিন্নমূল হওয়ার মুহূর্তটিতেই সঠিক বোঝা যায়। তক্ষ রায়ও এই কথাটা বুঝেছিল, যখন তার মা চলে যান।

    দুখিয়া পাগলা কীসব বিড় বিড় করতে করতে, একা একা চলে গেছে অনেকক্ষণ। লাল রঙা গামছাটা মাথায় জড়িয়ে নিয়ে! বিশুর মা মারা যাওয়াতে ওর কষ্ট হয়নি বিন্দুমাত্র। কষ্ট হয়েছে, লুচি-মাংস খাওয়া হল-না বলে। কষ্টর স্বরূপটা এক একজন মানুষের কাছে এক একরকম। তা বলে, কারো কষ্টই ফেলনা নয়। মেক-আপ-ম্যানরাও কিছুক্ষণ আগে নিজেদের জিনিসপত্র গোছগাছ করে চলে গেছেন। যাদের অভিনয় করার কথা ছিল, তারাও প্রায় সকলেই গেছে। প্রায় সকলেই বিশুদের বাড়িতেই; একে একে মালোয়ার রাজন্যদের ঝলমলে পোশাক ছেড়ে আবার সাধারণ সব আটপৌরে মানুষ-মানুষী হয়ে গিয়ে। অডিটোরিয়াম এখন একেবারেই ফাঁকা। আলোও নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাইরের মোঙ্গফুলিওয়ালা, ভেলপুরিওয়ালা, চাটওয়ালারাও মনে মনে, অচেনা বিশুর অচেনা মাকে অভিসম্পাত দিতে দিতে, যার যার জায়গায় ফিরে গেছে। মাথায় বোঝা আর বুকে আশাভঙ্গতা নিয়ে।

    তক্ষ রায় এতক্ষণ ক্লাবের পেছনদিকের মাঠটার কোণের দেওয়ালঘেঁষা মহুয়া গাছ তলাটার নীচে চেয়ার পেতে একা একা বসে বসে ওই হঠাৎ ভেঙে যাওয়া খুশির মেলার গুটিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা লক্ষ করছিল, একটার পর একটা সিগারেট খেতে খেতে। একজন লেখকের জীবনের কোনো অভিজ্ঞতা’ই ফেলা যায় না। একসময় অবচেতনের ভাঁড়ার থেকে সবকিছুই অনবধানে কলমের গোড়ায় পৌঁছে যায়। নিজের অভিজ্ঞতাকে কোন লেখক, কেমনভাবে কাজে লাগাতে পারেন তার ওপরই নির্ভর করে তাঁর লেখকত্বের মান। তক্ষ ভাবছিল, শুধু গার্হস্থ্যর নাটক-ই নয়, হয়তো বেশির ভাগ নাটকের-ই মহড়া থেকে উঠে এসে, মঞ্চে বাসা বাঁধা হয়ে ওঠে না। রূপমতী’ কী আর কখনো হবে? পনেরোদিন অনেক-ই লম্বা সময়। বোকা, ওর নাক ঘেঁতো হয়ে যাওয়ার পর নাকি সুরে ঠিক-ই বলেছিল “দেয়ার আঁর মেনি এ স্লিপস বিটউইন দ্যাঁ কাঁপ অ্যাণ্ড দ্য লিপস। যা জমিয়ে তুলেছিল ওরা, সব-ই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। বিজয়া-মুডও চলে যাবে লোকের। বোধ হয় হবে না আর রূপমতী।

    আর তিনদিন বাদেই কোজাগরি পূর্ণিমা। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারধার। আজকে স্কুটারটা আনেনি তক্ষ। কাল সকাল থেকেই হর্নটা বাজছিল না। আনোয়ারের দোকানে দিয়ে দিয়েছিল কাল সন্ধেতেই। কথা আছে, আজ রাতে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে আনোয়ার নাগেশ্বরের জিম্মাতে।

    বুকের মধ্যেটা যে, একটু ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল না, তা নয়। তবে এই চাঁদের রাতে কাঁকরের ওপর হিম-পড়া মিষ্টি-গন্ধভরা পথে আস্তে আস্তে ভাবতে ভাবতে হেঁটে যেতে বেশ, ভালোও লাগছিল। পথের দু-পাশে শালগাছের ছোটো ছোটো জটলা। গাঢ় হয়ে যেন কানাকানি করছে ওরা! মেহগনিও পুঁতেছিল সাহেবরা। ফাঁক ফাঁক করে। মহিরুহ। আদিবাসী ও অন্যান্য গরিব মানুষেরা এখন প্রাচীন মেহগনির বুক-পিঠ খাবলে খাবলে তুলে নিয়ে গিয়ে, জ্বালানি করে ঝিরাটোলির ভদ্রলোকদের বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে। ইংরিজি খবরের কাগজে জ্বালাময়ী ভাষায় ইকোলজি আর বন-সংরক্ষণ প্রসঙ্গে প্রবন্ধ লেখা-শিক্ষিত মানুষেরাই সেই জ্বালানির বোঝা কিনে চা এবং ডাল-ভাত রান্না করে খাচ্ছেন দু-বেলা। শিক্ষা ব্যাপারটার মতো একটা বাজেশব্দ আর দ্বিতীয় বোধ হয় নেই। ডিগ্রি এবং ভালো বাংলা বা ইংরিজি লিখতে-বলতে পারার সঙ্গে শিক্ষার কোনোই সাযুজ্য যে নেই, এই দেশে এ-কথাটা বার বার-ই মনে হয় তক্ষর।

    কোকিল ডাকছে অসময়ে ডানদিকের ঢালু জমির ওপরের সোনাঝুরি গাছ থেকে। ওর পুলকভরা ডাক শুনে মনে হচ্ছে, ও-ও পাগলা হয়ে গেছে দুখিয়া পাগলার মতোই! সাড়া দিচ্ছে তার দোসর, পথের বাঁ-দিকের একটি মস্ত অমলতাস গাছের ডালে বসে। সময় মানে না এখন কেউই। কোকিলও মানেনি।

    এক ঘোরের মধ্যেই হেঁটে চলেছে তক্ষ একা একা। এই মেলা-ভাঙা রাতে নারীসঙ্গর জন্যে ওর হতাশ মনটা আকুলি-বিকুলি করছে। শুনেছে ডাকাতরা ডাকাতি বা মানুষ খুন করে আসার পর তীব্রকামে জরজর হয়। আর ইন্টেলেকচুয়ালরা কি আশাভঙ্গতার পর? কে জানে? আজ গান্ধারী যদি আসে ওর কাছে, একটা কিছু ঘটে যাবে। এই রাতের অনুষঙ্গর ভূমিকাটুকুও খুব কম নয়। পরিবেশের অনুষঙ্গের তারতম্যে কত কীই যে, ঘটে যায় এক একজন মানুষের জীবনে! তক্ষর জীবনে এতদিনেও কেন ঘটল না তেমন কিছু? কল্পনায়, জোড়াখাটে একা শুয়েই কি চিরদিন নারীশরীরের সান্নিধ্যর মহড়া দিয়েই কেটে যাবে এই জীবন? পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ড়া ইন্টেলেকচুয়ালও যে, শরীর ছাড়া বাঁচে না। নারীদের কথা নারীরাই বলতে পারে। পুরুষদের শরীর বড়ো কষ্টের। বড়োই!

    তক্ষ রায় এই জীবনে কোনো অভিশাপ নিয়েই জন্মেছিল। সেই অভিশাপ তার মুখটিতে আঁকা হয়ে গেছে। এই মুখে চেয়ে পৃথিবীর কোনো কুকুরিরও প্রেম জাগে না মনে।

    ‘…কেন তারার মালা গাঁথা, কেন ফুলের শয়ন পাতা, কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে? যদি প্রেম দিলে না প্রাণে কেন আকাশ তবে এমন চাওয়া চায় এ মুখের পানে? তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন আমার হৃদয় পাগল-হেন তরী সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে…যদি প্রেম দিলে না প্রাণে।

    রীতি এই গানটি বড়ো ভালো পায়। গান খুব-ই ভালো জিনিস। রবীন্দ্রনাথের গান তো বটেই। তবে কখনো কখনো তক্ষ রায়ের মতো ইন্টেলেকচুয়ালেরও শুধুমাত্র গান শুনেই সব খিদে মেটে না। গান, সে যত ভালো গান-ই হোক না কেন, পূর্ণজীবনের একটি দিক-ই মাত্র। পূর্ণতা অনেক-ই বড়ো এবং গভীর ব্যাপার।

    ফাঁকা পথে, উলটোদিক থেকে মনে হল, খুব জোরে একটা সাইকেল আসছে চাঁদের আলোয় ভেসে। দূরাগত সাইকেল থেকে একটি নারী ও একটি পুরুষ কণ্ঠস্বর জোর হচ্ছে ক্রমশ। কাছে আসতেই দেখল তক্ষ যে, রীতি আর রুন।

    তক্ষদা? এখনও বাড়ি যাননি? সাইকেল জোরে ব্রেক কষে থামিয়ে দু-দিকে দু-পা নামিয়ে দিয়ে বলল রুন।

    নাঃ। এই-ই তো যাচ্ছিলাম।

    লুকিয়ে ছিলেন কোথায় এতক্ষণ?

    রীতি বলল।

    লুকোইনি তো! আড়ালে ছিলাম। মহুয়া-তলায়।

    মনে মনে বলল, আমার যা রূপ! এ কী লুকোনো যায়? চাঁদের আলোয় তো বিশেষ করে।

    মুখে বলল, তোমরা? ফিরলে যে আবার?

    আমার হাতঘড়িটা ফেলে এসেছি মেয়েদের গ্রিনরুমে। মেক-আপ ম্যানরা সবাই কি চলে গেছেন?

    হ্যাঁ বোধ হয়। কাউকেই তো দেখলাম না। তবে দারোয়ান আছে।

    আছে? বাঃ আচ্ছা। এগোই তাহলে আমরা। দেখি। পাওয়ার আশা কম। কে নিয়ে গেছে? কাকে ধরব এখন?

    পাবে। মানুষের ওপর বিশ্বাস রেখো।

    রীতি উত্তর দিল না। না-বলে-বলল, বেশি জ্ঞান দেয়!

    রুন প্যাডলে জোরে চাপ দিল। কিরকির’ আওয়াজ করে এগিয়ে গেল সাইকেলটা।

    বলল, চললাম।

    তক্ষ বলল, এসো।

    তক্ষ এখন হিসিডার মোড়ে এসেছে। এখন আর ফিরে-আসা রীতিদের সঙ্গে দেখা হবে না। ওর পথ ওদের থেকে অনেক দূরে বেঁকে গেছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো সেগুন গাছ একটি দ্বীপের মতো ঘিরে আছে জলিমেমের পোড় বাংলোটা। ছেলেবেলায় রিফর্মেটরির পাশের মাঠে স্কুলের ফুটবল ম্যাচ খেলে সাইকেল নিয়ে যখন-ই ফিরত, অন্ধকার হয়ে গেলেই; এই জায়গাটায় এসে ভয় করত ওর খুব-ই। মা এবং অন্যান্যদের কাছে শুনেছিল যে, জলি মেমসাহেব নাকি খুব-ই কুশ্রী দেখতে ছিলেন। কোনো অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ই তাঁকে বিয়ে করেনি। বান্ধবীও করেননি তাঁকে। তাঁকে চায়নি কোনো শিক্ষিত ভারতীয়ও। সুন্দর পিয়ানো বাজাতেন জলি মেমসাহেব। লেখাপড়া করতেন খুব। দারুণ লাইব্রেরিও ছিল নাকি। গভীর রাতে তাঁর পিয়ানো শুনে অনেক পুরুষ-ই নিশির ডাকের মতো ঘুমঘোরে হেঁটে যেতেন দরজা খুলে। তারপর পাগল হয়ে যেতেন। গান্ধারীর নিজের সেজোমামাও ওইভাবেই পাগল হয়ে গেছিলেন। জলি মেমসাহেব শেষে একদিন নাকি, তাঁর মুণ্ডা পাঙ্খাপুলারকে দিয়ে জোর করে আদর করিয়ে নেন।

    মেয়েরাও কি পুরুষদের-ই মতো কষ্ট পায় এই শরীরের জন্যে? জলিমেমও কি তক্ষর মতোই কষ্ট পেতেন? তাকে এই বাড়িটি লিখে দেওয়ার লোভ দেখিয়েই নাকি রাজি করান সেই বিবাহিত মুণ্ডা পাঙ্খপুলারকে।

    সেই আদরে জলি মেমসাহেব গর্ভবতী হয়ে যান। এবং যেদিন তা জানতে পান তার পরদিন-ই রিভলবার দিয়ে সেই পাঙ্খপুলারকে আগে আর পরে নিজেকে গুলি করে মারেন। এই বাড়িতেই। ওয়ারিশ ছিল না কোনোই তাই এখন চোর-ডাকাতের আড্ডা। খুনজখম ধর্ষণ ও ঘটে মাঝে মাঝে। রাতের পর এই মোড় সকলেই এড়িয়ে যায়। পদ্মবিলের শুনশান নির্জন পথ দিয়ে যায় লোকে তবুও এদিকে আসে না। তক্ষর আসতেই হল। কারণ ও হেঁটে বাড়ি যাবে। অন্যপথে অনেকই ঘুর হত। আরও আধমাইল হাঁটলে যদি রিকশা পায় কোনো। তা ছাড়া এতবছর জলিমেমের পোড়োবাড়িকে ভয় করত ও। আজকে কেন যেন, এক ধরনের আকর্ষণ-ই বোধ করছে। জলিমেমের সঙ্গে আজ ভারি একাত্মতা বোধ করছে তক্ষ।

    .

    ডান দিকে ঘুরে জলিমেমের বাংলোর মোড়। ঠিক সেইসময়-ই হঠাৎ ডানা ফরফর করে একটা সাদা লক্ষ্মীপেঁচা উড়ে এল ওর মাথার ওপরে সেই পোড়োবাড়িটা থেকে। এসেই, লক্ষ্মীপেঁচাটা ডেকে উঠল মিষ্টিস্বরেঃ ‘তক্ষদা’!

    চমকে উঠল তক্ষ। থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ কে যেন, ওর পিঠে নরম মেয়েলি হাত ছোঁয়াল। অমনি কর্কশ স্বরে পেঁচাটা পেঁচার-ই মতো ডেকে উঠল ‘র্কিচি কিচি কিচর কিচি-কিচর।

    খুব-ই ভয় পেয়ে তক্ষ রায় পেছন ফিরতেই দেখে, রীতি। পাশে রুন দাঁড়িয়ে আছে সাইকেল নিয়ে।

    দের আসার শব্দও পায়নি। জলিমেমের কথা ভাবতে ভাবতে বোধ হয়,

    অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল তক্ষ। তোমরা? এ-পথে এলে যে? আপনি একা যাচ্ছেন। জলিমেমের বাড়ি তো সামনেই। ভাবলাম, দেখেই যাই, পেতনির খপ্পরে পড়লেন কি না।

    রীতি বলল।

    বাবাঃ। ভাগ্যিস পেলাম ঘড়িটা। ঠিক জায়গাতেই ছিল। পার্ট-টুতে বিহার থেকে সেকেণ্ড হওয়ায় বাবা কিনে দিয়েছিলেন এই ঘড়িটা। এইচ এম টি’ কোয়ার্টজ। হারালে, দুঃখ হত ভারি। বেচারা বাবা। এই চোখ নিয়েও তক্ষ রায়ের ‘রূপমতী’ দেখতে এসেছিলেন রিকশা চেপে। চ্যাটার্জিকাকা অবশ্য ওঁর গাড়ি করে নিয়ে গেলেন ফেরার সময়। রূপমতী হওয়া হল না আমার।

    তক্ষ দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। রুনকেও দিল একটা। রুন অবাক হল একটু। কখনো অফার করেনি তক্ষদা। এই প্রথম। দেশলাই বের করে নিজেরটা জ্বেলে, তক্ষদারটাও জ্বেলে দিল।

    সিগারেটের ধোঁওয়া ছেড়ে তক্ষ বলল, মন খারাপ?

    প্রশ্নটা করল দু-জনকেই। কিন্তু দু-জনেই বুঝল যে, রীতিকেই করা হল।

    রীতি বলল, তা তো হবেই একটু। তবে বেচ্চারি বিশু। একমুহূর্ত পর বলল, কিন্তু আপনার মন-ই তো সবচেয়ে বেশি খারাপ হওয়ার কথা!

    তক্ষ বলল, কেটে কেটে; আমার মনের কথা ছাড়ো। কোনো-সময়েই ভালো থাকে না

    তাই-ই? মাথার চুল ঝাঁকিয়ে রীতি বলল। এটা স্বাস্থ্যর লক্ষণ নয়। যাই বলুন। মাঝে মাঝে আসবেন আমাদের বাড়ি। আমিও যাব। ইহুদি মেনুহিনের নতুন রেকর্ডটা শোনাবেন তো? গেলে?

    নিশ্চয়ই।

    রুন বলল, আপনার জন্য কি রিকশা পাঠিয়ে দেব মোড় থেকে?

    নাঃ। ঠিক আছে। হেঁটেই যাব।

    তাহলে আমরা এগোই?

    বেশ।

    ওরা দু-জনে কথার টুকরো-টাকরা উড়োতে উড়োতে সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে ওদের পথে চলে গেল। ওরা তো যাবেই। যৌবনের আশীর্বাদে সম্পৃক্ত ওরা। যৌবন চলে না যাওয়ার আগে, যৌবন যে, কী অমূল্য সম্পদ তা কেউই বোঝে না। তক্ষও বোঝেনি। অবশ্য তক্ষর কথা…

    ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল তক্ষ অনেকক্ষণ। যখন একা একা হেঁটে আসছিল এই লক্ষ্মীপূর্ণিমার আগের দ্বাদশীর চাঁদের আলোয় ভেসে ভেসে, তখন ভেবেছিল, আজ রূপমতীকেই শয্যাসঙ্গিনী করবে তক্ষ। বড়ো সুন্দর দেখাচ্ছিল রীতিকে। রূপমতী, কে জানে আরও কত বেশি সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু অতবেশিতে প্রয়োজন ছিল না কোনো ওর। মেক-আপ নেওয়া চুমকি বসানো ঘাঘড়া, নকল হিরের সাতনরি হার আর নাকছাবিতে তীক্ষ্ণনাসা দীর্ঘাঙ্গী রীতিকে রূপমতীর থেকে যেন, একটুও আলাদা করা যাচ্ছিল না।

    কিন্তু আজ বড়োই আশাভঙ্গতার দিন। মনের মধ্যে যে, এই নাটকটি মঞ্চস্থ না-হওয়াটা কতখানি বেজেছে, তা তক্ষ রীতি ও রুনের চলে যাওয়ার আগের মুহূর্ত অবধিও যেন যথার্থভাবে বুঝতে পারেনি। নাঃ। আর মহড়া দিতে ভালো লাগে না! এক নাটক এবং কল্পনার বহুশয্যাসঙ্গিনী নিয়ে। ভিন্ন রাতে ভিন্নজন। না, না। বেলা বয়ে যায়। বেলা বয়ে যায়। চামদুর রাজবাড়িতে পেটাঘড়িতে ঘণ্টা বাজে। রাত নটা বাজল। এই সময় আকবরের সেনাপতি আধম খাঁ যে হোশাঙ্গাবাদে এসে পৌঁছেছে এই খবর নিয়ে ঘোড়া-টগবগিয়ে দূতের আসার কথা ছিল রূপমতী মেহালের ছাদে রূপমতীর সঙ্গে বিশ্রাম্ভালাপে-রত বাজবাহাদুরের কাছে। কত রাত এই নাটক নিয়ে কেটে গেছে। শুধু মহড়াই দেওয়া হল। মিছিমিছি!।

    সেগুনের পাতাগুলো সার সার ওপরে নীচে, সমান্তরালে হাতির কালো গোলাকৃতি কানের মতো দেখাচ্ছিল রুপোলি রাতে। সেগুনের গায়ের গন্ধ ভাসছে থম-ধরা হিম-পড়া রাতে।

    জলি মেমসাহেবের এই বাড়িতে দিনের বেলাতেও বদ-মতলব ছাড়া কেউ কখনো ঢোকার সাহস করে না। কেমন দেখতে ছিলেন এই জলি মেমসাহেব? তক্ষর চেয়েও কুশ্রী কি? যদি তাঁর বয়স বছর ত্রিশেক কম হত আর তক্ষর, বছর-ত্রিশ বেশি অথবা রীতির বছর বারো বেশি? যা হলে হত, তা খুব কম-ই হয়, এ-সংসারে।

    আজ বাড়ি যাবে না ঠিক করল তক্ষ। কাঁধের ঝোলা থেকে ডিরেক্টর স্পেশ্যালের বোতলটা বের করল। নাটকের পর সেলিব্রেট করবে ভেবে এনেছিল। বোকাটা এমনিতে খায় না। তক্ষ দিলে হয়তো খেত। তক্ষ নিজে তো নিয়মিত খায় না। গান্ধারীর সঙ্গে খেয়েছিল সেদিন। অনেকদিন পর। আজ আবার।

    বোতলটা খুলেই ঢকঢকিয়ে মুখে ঢালল অনেকখানি। নিট। মুখ বিকৃত হয়ে গেল ওর। পেটের মধ্যে চিন চিন করে উঠল। সেগুনের ছায়ার ঘন অন্ধকারের মধ্যে আস্তে আস্তে ঢুকে গেল ঘোরের মধ্যে তক্ষ রায় জলি মেমসাহেবের খোঁজে। নেশার ঘোরে নয়। ওর মস্তিষ্কের মধ্যে অন্য ঘোর লেগেছিল। না, না। না। আজ আর কোনো মহড়া নয়। মহড়া দিয়ে দিয়ে বড়োই ক্লান্ত হয়ে গেছে ও। কী পরে আছেন জলি মেমসাহেব এখন তা কে জানে। নাইটি কি? কী রঙের? এখন কি তিনি পিয়ানোর সামনে বসে আছেন? কী বাজাচ্ছেন? মোৎজাট? নাকি মেণ্ডহেলসন?

    কে যেন, হঠাৎ তক্ষকে বলল সংক্ষিপ্ত নীচুগ্রামের যৌনতামাখা গলায়ঃ ‘হাল্লো! হাল্লো!’

    চমকে উঠে, পোড়ো-বাড়ির বারান্দায় তাকাতেই কী একটা, ছোট্টপাখি জংলি কেলাউন্দা ঝোঁপ ছেড়ে সোজা আকাশের দিকে। আবার বলল ‘হাল্লো! হাল্লো! হাল্লো!’

    গা ছমছম করে উঠল তক্ষর। তবু, ও এগিয়ে চলল। বারান্দায় এসে উঠে আবারও বোতলটা খুলে মুখে ঢালল। মস্তিষ্ক অবশ হলে ভয়ও নাম-না-জানা পাখিটার-ই মতো উড়ে যাবে।

    গাছগাছালির ফাঁক-ফোকর দিয়ে আসা হিমের রাতের চাঁদের আলো বাদামি-রঙা ইট-বের হয়ে থাকা বারান্দাটার ওপরে আলো-ছায়ার ডোরাকাটা গালচে বিছিয়ে দিয়েছে। লিভিং রুমের সিঁড়ির ওপরে উঠে, সেই ডোরাকাটা গালচের ওপরে আস্তে করে বসল তক্ষ। লাল ধুলো জমে আছে পুরু হয়ে! কুশনের কাজ করল। বাঃ। বোতলটা হাতে রেখে, ব্যাগটাকে বালিশের মতো করে, পেছনে রেখে হেলান দিল।

    ভেতরে কে যেন, কথা বলছে। খুব চাপা গলায়। জলি মেমসাহেব?

    কান খাড়া করল তক্ষ।

    বাইরের পৃথিবী নির্জন। কিন্তু বা’য়। কত ফিসফাস রাতপাখির দীর্ঘশ্বাস; মেঠো ইঁদুরের গায়ের খুদের গন্ধ এই চাঁদের রাতের সেগুনগন্ধী পোড়োবাড়িতে মিশে রয়েছে। জলিমেমসাহেব-ই কি? কে জানে? তোমার গায়ের গন্ধ কেমন ছিল গো? তুমি কুশ্রী বলে, তুমি যে, নারী’–এই কথাটি পর্যন্ত কি কোনো পুরুষ স্বীকার করতে চায়নি? তোমার সুন্দর ফিগারের তোমাকে ‘তুমি’ই বলি। যে আত্মার কাছে থাকে সে তো আত্মীয়ই! তোমার ঘুম পাড়ানো অথবা আগুন-জ্বালানো পিয়ানো-বাজানোতেও কেউ কি আকৃষ্ট হয়নি? যেমন হয়নি, কোনো নারী, তক্ষ রায়ের এত্ত গুণ থাকা সত্ত্বেও। মুখের দাম, মুখোশের দামের চেয়েও অনেক-ই কম; যদি সে মুখ কুশ্রী হয়। তাই না জলি মেমসাহেব? যা হয়ে গেছে। আর হবে না। তক্ষ রায় আজ থেকে যক্ষ হয়ে পাহারা দেবে তোমাকে। তুমি হয়ে যাবে যখের ধন। কেউই আর অবহেলা করতে পারবে না তোমাকে! তোমার দুঃখ বোঝে, বুঝেছে এমন পুরুষ অন্তত একজন আছে এই নিষ্ঠুর মুখের-সৌন্দর্য-সর্বস্ব পৃথিবীতে। মন কেউই দেখে না, দেখে না গুণ; শুধু মুখ-ই দেখে। এমনকী মুখোশও।

    প্রতিমুহূর্তর ঘড়ি-সর্বস্ব মহড়াময় অস্তিত্বর হাত থেকে তক্ষ রায়ও মুক্তি চায়। জলি মেমসাহেবের-ইমতো। কিছু মানুষ সংসারে আসে বটে, কিন্তু তাদের জায়গা দেয় না সংসার। কোল পেতে দেয় না শুতে। ছায়া দেয় না একটুও, তাদের হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট, বুকে বুক, রাখে না তারাও; যাদের সে, সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবাসে। কোয়াসিমোদোর-ই মতো এসমারেলরা তাদের দেখে আতঙ্কিতই হয় শুধু। তাদের শুধুই সভাতে মালা পরায়, ঘন ঘন ফোটো তোলে ফ্লাশ-বালব নিয়ে, বাড়ির দরজা অবধি এক-শো নারী এসে পৌঁছে দিয়ে যায়, ঘটা করে পরমবিনয়ের সঙ্গে।

    বাড়ির মধ্যে কেউই ঢোকে না। শোয়ার ঘরে তো নয়ই।

    বোতলটা ব্যাগ থেকে আবারও বের করতে গিয়ে হাতে কী যেন, ঠেকল। ছুরিটা! রেমিংটনের ছুরি একটা। শেষদৃশ্যে রীতির ওরফে রূপমতীর কোমরে খাপসুদ্ধ এই ছুরিটা থাকার কথা ছিল। ভালো ছুরি প্রোডাকশন ম্যানেজার কানাই জোগাড় করতে পারেনি বলে, তক্ষ নিয়ে এসেছিল ব্যাগে ভরে অফিসে যাওয়ার সময়। খাপটাতে নিজে হাতে রং করেছিল সময়ানুগ করার জন্যে। এটা তক্ষর বাবার ছুরি। বাবার শিকারের শখ ছিল। জানোয়ার মেরে চামড়া ছাড়াতেন তিনি এটা দিয়ে।

    আঃ। কী দারুণ যোগাযোগ। ও জলি। কোথায় গেলে তুমি? এ-বাড়ির কোন ঘরে তুমি নিজের এই কষ্টর জীবন নিভিয়ে দিয়েছিলে? এখন কী মজা বলো তো? যক্ষর ঔরসে যক্ষিণী কি গর্ভিণী হবে? জানা নেই। ছেলেমেয়ে কে চায়? আমার ও তোমার সহবাসের সন্তান? সে যে, অসম্ভব কুশ্রী হবে। আমার এবং তোমার কুশ্রীতার আগুন হাওয়া পাবে তাতে। পৃথিবীর সব লোক-ই তাদের দিকে চেয়ে আঁতকে উঠবে ঘেন্নায়। কুশ্রী হওয়ার যে, কী দুঃখ তা, শুধু কুশ্রীরা জানে। নাগো জলি? আর মহড়া নয়। আজ রাতে একটি সত্যি নাটক, দারুণ নাটক, যক্ষলোকের নাটক মঞ্চস্থ হবে এই চাঁদের আলো আর ছায়ার ডোরাকাটা গালচের ওপর মেণ্ডহেলসনের ওপাস চোদ্দোই মেজর এ, পিয়ানোতে। “রেণ্ডো ক্যাপ্রিসিওসো” বাজিয়ে চাঁদের আলোয় ভেজা সেগুনবনে ঝড় তুলবে তুমি; জলি। আমি বাজবাহাদুর হব, তুমি রূপমতী; স্বল্পক্ষণের মধুক্ষরণের মৌমাছি। রানিই হোয়য়া তুমি। মৌমাছি রানি।

    বোতলটা প্রায় শেষ করে, ছুরিটা খাপ থেকে বের করে ডান হাতে ধরে, বাঁ-হাতের কবজির ওপর চেপে ধরতে যাবে যেই যক্ষ হতে-চাওয়া তক্ষ, ঠিক সেইসময়েই জলি মেমসাহেবের অন্ধকার লিভিংরুমের ভেতর থেকে প্রচন্ড জোরে কে যেন, চিৎকার করে উঠলঃ ‘ক্যা কিয়া, ঔর মিল্যা ক্যা? হ্যাঁঃ। হ্যাঁঃ। হ্যাঁঃ।‘

    ভয়ে, চমকে উঠল তক্ষ। যক্ষ হওয়া হল না ওর। অন্ধকারের ভেতর থেকে অন্ধকারতর একটি ছিপছিপে ছায়ামূর্তি উড়ে এসে রুপোঝুরি বারান্দায় পৌঁছেই যেন, রুপোর মূর্তি হয়ে গেল।

    দুখিয়া? দুখিয়া পাগলা?

    অবসন্ন ক্লান্ত, হতাশ কণ্ঠে বলল তক্ষ।

    আবার বলল, স্বগতোক্তির মতো; দুখিয়া?

    জি হাঁ। ক্যা কিয়া, ঔর মিলা ক্যা?

    বলেই, ওর গাঁজার কলকেটা এগিয়ে দিল তক্ষর দিকে।

    সেটাকে হাত বাড়িয়ে নিল তক্ষ। কিছু না ভেবেই। ছুরিটা ব্যাগের মধ্যে রেখে দিল, আস্তে আস্তে।

    দুখিয়া বলল, আমি বড়ো পাপী বাবু। ভেবেছিলাম, এই নতুন নির্জন জায়গায় এসে আমার সিদ্ধি হবে। হল না। রোজ-ই যা হয় আজও তাই-ই হল, এই কথাটা…

    তক্ষ দুখিয়ার কথা বুঝতে পারল না। বোঝার চেষ্টাও করল না। ওর নেশাও হয়েছিল বেশ, অত তাড়াতাড়িতে অতখানি নিট হুইস্কি খেয়ে। গাঁজার কলকেটা ফেরত দিল দুখিয়াকে।

    তারপর উঠে পড়ল বারান্দা থেকে।

    দুখিয়া হেসে উঠল। বলল, পালিয়ে যাচ্ছ? পালাবে কোথায়? নতুন জায়গায় যাচ্ছ? হিঃ হিঃ। সিদ্ধি নেই। মুক্তি নেই। প্রত্যেকটা দিন, প্রত্যেকটা রাত একইরকম। হুবহু। যা করে যাচ্ছ তাই-ই করে যেতে হবে। যা চাইছ তা চাওয়া হয়েই থাকবে কল্পনায়, সত্যি হবে না কোনোদিনও। যেমন, আজ তোমাদের যাত্রাটা হল না। মাংস-লুচি খাওয়া হল না আমার। কত্তবছর খাইনি।

    তক্ষ বলল, চলো দুখিয়া আমার সঙ্গে। খাওয়াব তোমাকে।

    সত্যি? লুচি-মাংস? দুখিয়ার দু-চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল লোভে। বলল, হ্যাঁ। চলো। কেন জানি না, লুচি-মাংসর জন্য মন উচাটন হয়েছে আজ। আমি জানি, আমার মুক্তি নেই। এখনও এই ছোটো ছোটো লোভে আটকে আছি।

    দুখিয়া বলল, তবু, চলো। একটা স্বপ্ন সত্যি হোক তবু।

    দ্বাদশীর চাঁদের মোহময়তায় পোড়োবাড়ির বাগানের ঝুঁকে-পড়া গাছগাছালির ডোরাকাটা সাদা-কালো আলো-ছায়ার গালচে মাড়িয়ে শ্লথপায়ে এগিয়ে চলল দু-জন লক্ষ্যভ্রষ্ট মানুষ।

    সেই পাখিটার বাসা বোধ হয় এই বাগানেই। ছায়ামূর্তির মতো ওদের দুজনকে চলে যেতে দেখে পাখিটা আবার সেই অদ্ভুত ‘হাল্লো। হাল্লো।‘ বুক চমকানো ডাক ডাকতে ডাকতে ফিরে এল চাঁদের রাতে ভেসে।

    ওদিকে তাকাল না আর তক্ষ।

    জীবনের খুব বেশি বাকি নেই আর। বার বার, পেছনে ফেরার সময় নেই। নাম না জানা রাতপাখি ছাড়া ওকে “হাল্লো” বলবে না আর কেউই। বড়ই একা লাগে। কুশ্রীমুখটি আর অনুক্ষণ চিন্তাক্ষরিত মস্তিষ্ক নিয়ে অনেক মান-সম্মান যশ-এর বালাপোশে নিজেকে মুড়ে রাখা সত্ত্বেও মানুষের মতো বেঁচে থাকতে বড়োই কষ্ট। এইরকম একাকিত্বর কষ্ট হয়তো বিধাতা শুধু স্বল্পসংখ্যক মানুষদের-ই দিয়েছেন। এই কষ্টর কথা সকলের বোঝারও নয়!

    দূরে ঘুঘটটোলির আলো দেখা যাচ্ছিল! কয়েকটি সাইকেলরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। পানের দোকানের আয়নাতে পথ-পাশের ফিকে জ্যোৎস্না অন্ধকারের সঙ্গে মিশে প্রতিফলিত হয়েছে। যারা পারে, যাদের মানসিকতা অন্যরকম, তারা কত সহজে তাদের শরীরের একাকিত্ব ঘুচিয়ে নিচ্ছে ঘুঘটটোলির দেহপসারিনিদের কাছে গিয়ে।

    তক্ষ পারে না, পারেনি।

    দুখিয়া আবারও নিজের মনেই বলল কী মজা! লুচি-মাংস খাব আজ।

    ম্লান হাসি হাসল তক্ষ। বলল, খাবে। চলো।

    দুখিয়া কত সহজে সুখী হতে পারে। ঈর্ষা হল ওকে খুব।

    মাংসই বেঁধেছে আজ নাগেশ্বর। বেশি করে আনতেও বলেছিল। সকাল থেকেই তক্ষ ঠিক করেছিল যে, রূপমতী’ সাকসেসফুলি মঞ্চস্থ হওয়ার পর বোকার সঙ্গে হুইস্কি খাওয়ার পর এই রাতে…।

    ভেবেছিল, এই দ্বাদশীর রাতে সব কাজ শেষ করে কোনো নরম পাখির মতো সাথিকে সঙ্গে করে তার নদীপারের নির্জন বাসে ফিরবে। তার জন্যে আসন পেতে রেখে এসেছিল, লুচি-মাংস খাওয়াবে বলে। বিছানায় বুনোফুল ছড়িয়ে রাখতে বলেছিল নাগেশ্বরকে। ভেবেছিল, রূপমতী’ নাটকের-ই মতো আজ ওর জীবনের মহড়া-ক্লান্ত এক বিশেষ নাটকও মঞ্চস্থ হবে।

    ভেবেছিল…

    এসেছে সাথি। কিন্তু অন্য সাথি।

    বহুদূর থেকে নদীর গন্ধ ভেসে আসছিল। কোজাগরি পূর্ণিমার তিন-চাঁদ আগের চাঁদের চাল-ধোওয়া জলের মতো তরলিমায় পৃথিবীর শরীর ভেসে যাচ্ছে। নাক তুলে গন্ধ নিল তক্ষ। বনজ-গন্ধর সঙ্গে রাতের গায়ের গন্ধর সঙ্গে নদী থেকে আসা জলজ সব গন্ধ মাখামাখি হয়ে রয়েছে। একটা ‘টি-টি’ পাখি ডেকে ফিরছে ঝাঁটি জঙ্গলের ওপরে ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে।

    নারীর আর নদীর গন্ধ অনেক-ই দূর থেকে পায় ও। দূরের গন্ধ দূরে–তবু পায় এখনও–

    দুখিয়া লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছিল সামনে সামনে, মাথায় গামছাটা পাক দিয়ে বেঁধে। মুখ ফিরিয়ে বলল ও, পাঁঠার মাংস? পাঁঠার মাংস তো সত্যিই?

    হ্যাঁ! পাঁঠার-ই মাংস।

    কে বেঁধেছে? তোমার বউ?

    না।

    দুখিয়া যেন, উড়ে চলেছিল। গাঁজা খেলে বোধ হয় শরীর হালকা হয়ে যায়।

    দুখিয়া আবারও বলল, বউ নয় তো কে তবে?

    সে আছে একজন।

    থাকলেই হল কেউ। গিরস্থি মানুষের আওরাত ছাড়া চলে? আচ্ছা, ঝাল দিয়েছে তো সে মাংসের ঝোলে?

    দিয়েছে। দেয় তো।

    বড়ো বড়ো আলু থাকবে? ঘি? গরমমশলা? আঃ।

    জানি না। বোধ হয় থাকবে।

    অন্যমনস্ক গলায় তক্ষ বলল, দুখিয়াকে।

    সব সময়েই খুব বেশি করে ঝাল দিতে বলবে রান্নায়। জিভে স্বাদ আসবে। ঝালে; বিস্বাদ পালায়। জানো তো? জিভের; জীবনের।

    জানি।

    তক্ষ বলল।

    বলেই, দুখিয়া পাগলার দিকে চমকে তাকাল। ভাবল, সত্যিই কি জানে?

    চাঁদের আলোতে দূরের আঁকা-বাঁকা কারো নদীর দুই পারের আবছা গাছপালা আর ঝাঁটি জঙ্গলের ছায়া, নদীর মধ্যে আলো জ্বেলে মাছ-ধরা মুণ্ডা পুরুষদের কথা-বার্তার ভেসে-আসা টুকরো-টাকরায়, এই রাত, বড়ো মোহময় হয়ে উঠেছে। চলতে চলতে তক্ষর মনে হল যে, এই মোহাবিষ্ট প্রকৃতির মধ্যেও যেন, কোনো নাটকের মহড়া চলছে এই মুহূর্তে। কোনো সর্বলোকের যাত্রার বিবেকের-ই মতো তার-ই মধ্যে একলা ‘টি-টি’ পাখিটা ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে, উড়তে উড়তে প্রায় অসংলগ্ন পা-দুটি নাড়িয়ে-নাড়িয়ে জ্যোৎস্না চাড়িয়ে, চাড়িয়ে ঘুরে ঘুরে তার ভূতুড়ে ডাক ডাকছে বারে বারেঃ ‘হট্টি-টি-হট-টি-টি-টি-হট’।

    পাখিটা নিশ্চয়ই জানে, যেমন তক্ষ জানে যে; ওই চাঁদের রাতের প্রকৃতির মধ্যে, যে নাটকের মহড়া চলেছে তাও কোনোদিনও মঞ্চস্থ হবে না।

    মহড়ার-ই আর এক নাম ‘জীবন’!

    ⤶
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদীপিতা – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article মহুয়াকে – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }