Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ডুগডুগির আসর – প্রশান্ত মৃধা

    September 22, 2025

    উইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম

    September 22, 2025

    কেরী সাহেবের মুন্সী – প্রমথনাথ বিশী

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মহাপ্রস্থানের পথে – প্রবোধকুমার সান্যাল

    প্রবোধকুমার সান্যাল এক পাতা গল্প210 Mins Read0

    পুনরাগমন

    “পথের সাথী, নমি বারম্বার।
    পথিক জনের লহো নমস্কার।
    ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি, ওগো দিনশেষের পতি
    ভাঙা বাসার লহ নমস্কার।।
    ওগো নব-প্রভাত জ্যোতি,
    ওগো চিরদিনের গতি,
    নূতন আশার লহ নমস্কার।
    জীবন-রথের হে সারথি, আমি নিত্য-পথের পথী
    পথে চলার লহ নমস্কার।”

    তিন দিন বাস করে, ১৫ই জ্যৈষ্ঠের প্রভাতে আমরা শেষ বিদায় ও অভিবাদন জানিয়ে অখণ্ড পুণ্য সঞ্চয় করে পরিতৃপ্ত মনে রওনা দিলাম। নষ্ট স্বাস্থ্য ও লুপ্ত শক্তি যেন কোন্ এক মন্ত্রবলে ফিরে পেয়েচি। নূতন উৎসাহ ও নব অনুপ্রেরণা, সতেজ প্রাণধারা,-এমন সুস্থ ও সহজ আর কোনোদিন বোধ করিনি। যত অস্বাস্থ্য ও ক্লেদকালিমা রেখে এলাম বদরীনাথে। স্ফীত দেহ, উল্লসিত মন, চলৎশক্তিমান দুটি পা, রক্তের উত্তেজনা ও একটি অপরিমেয় প্রাণলীলা নিয়ে চলেচি সঙ্গে। আমাদের নবজন্ম হয়েচে। প্রভাতে ঝোলাঝুলি কাঁধে নিয়ে লাঠি দুলিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে চললাম। দু’ঘণ্টায় এলাম হনুমান চটি, মধ্যাহ্নে এলাম পাণ্ডুকেশ্বরে। সন্ধ্যার পরে গিয়ে পৌঁছলাম বিষ্ণুপ্রয়াগ ও যোশীমঠ পার হয়ে, একেবারে সিংহদ্বারে। রাত্রে শয়নের সময় হিসাবে দেখা গেল, আজ আমরা উনিশ মাইল পথ হেঁটেচি! অসীম শক্তি এখন আমাদের পায়ে।

    পথ আমাদের পরিচিত, কোথায় কি আছে জানি। আপাতত লালসাঙ্গায় আমাদের ফিরে যেতে হবে, সেখান থেকে নূতন পথে কর্ণপ্রয়াগের দিকে যাবে! সকলেরই এখন তাড়াতাড়ি। তীর্থ শেষ হয়ে গেচে, পাহাড়ের দেশ হয়ে উঠেচে অসহনীয়, আরো দশ এগারো দিন আন্দাজ হেঁটে ট্রেনে উঠতে পারলে হয়- সমতল দেশ দেখবার জন্য সকলের মন হা হা করছে। আমরা প্রত্যেকদিন এখন বুঝতে পারি কোথায় সারবো মধ্যাহ্ন-ভোজন এবং কোথায় করা যাবে রাত্রিবাস। দ্বিতীয় দিন আমরা গরুড়গঙ্গায় রাত কাটালাম। সিংহদ্বার থেকে গরুড়গঙ্গা ষোলো মাইল। পরদিন মধ্যাহ্নে পৌঁছলাম বাবলা চটি, আহারাদির পর আবার রওনা হয়ে বিকালে লালসাঙ্গায়। তিনদিন হেঁটে এবার আমরা ক্লান্ত হয়েচি। হাঁটতে হাঁটতে আবার কানে লেগেছে তালা, মন হয়ে উঠেচে উদাসীন, স্মৃতিশক্তি গেচে কমে। যাই হোক, খোঁজ-খবর করে নির্মলা তার সেই হারিকেন লন্ঠনটা আবার উদ্ধার করে নিল। সন্ধ্যার তখনো কিছু বিলম্ব রয়েচে, লালসাঙ্গায় নাড়িয়ে আবার আমরা হাঁটুতে শুরু করলাম। এবার পেয়েচি নূতন পথ, হরিদ্বার থেকে এই পথ এসেচে কর্ণপ্রয়াগ হয়ে। নূতন পথে দু’মাইল গিয়ে সেদিনের মতো আমরা কুবের চটিতে রাত্রির মতো আশ্রয় নিলাম। তিনদিনে হাঁটা হলো পঞ্চাশ মাইল পথ।

    আবার প্রভাতে যাত্রা। পথে-পথে বিশ্রাম নেওয়া, গোপালদার তামাক খাওয়া, আফিম গেল, আবার হাঁটা। দু’একজন ছাড়া বুড়ীরা উঠেচে সবাই কাণ্ডিতে, সারবন্দী হয়ে কাণ্ডিওলারা চলচে। সকাল বেলায় আমরা শ্রীনন্দ প্রয়াগ পার হয়ে চললাম। এখানে দেখা গেল না ও অলকানন্দার সঙ্গম। প্রবাদ, রাজা নন্দ পূর্বকালে এখানে যজ্ঞ করেছিলেন। ছোট্ট একখানি শহর। এখান থেকে গরুড়ে যাবার নূতন রাস্তা শুরু হয়েছে। নন্দপ্রয়াগে মহেশানল শর্মার দোকান থেকে কয়েকখানি হিমালয়ের আলোকচিত্র সংগ্রহ করা গেল। খাঁটি শিলাতুর জন্য এই দোকানখানি বিখ্যাত। শীত কমে গেচে, রৌদ্র উঠচে প্রখর হয়ে। কোথাও পাহাড় ছেড়ে পাহাড়ে, কোথাও বা পাহাড় থেকে পাহাড়ে নাচি। পথ এখনো অনেক বাকি। মধ্যাহ্নে এসে পৌঁছলাম সোনলা চটি এবং সন্ধ্যায় গিয়ে উঠলাম জয়কীতে। মাঝখানে রইলো লঙ্গাসু চটি।

    পরদিন বেলা আন্দাজ ন’টার সময় কর্ণপ্রয়াগের তীরে এসে পৌঁছলাম। সম্মুখে উপলখণ্ডময় বিপুল বিস্তৃত নদী, পিন্দার গঙ্গা ও অলকানন্দার সঙ্গম। প্রকাশ, নদীর তীরে পর্বত-সমীপে একদা কুন্তীপুত্র কর্ণ পিতা সূর্যদেবের দর্শন পেয়ে অভেদ্য কবচাদি বর লাভ করেছিলেন। নদীর ওপারে দক্ষিণের পথ গেচে রুদ্র প্রয়াণের দিকে, বাম দিকের পথটি সোজা চলে গেচে মেহলচৌরীর উদ্দেশে। আজ আমরা এইখান থেকে অলকানন্দাকে বিদায় দেব। যাত্রীরা নদীর সঙ্গমে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করে।

    নদীর পুল পার হয়ে সম্মুখে একটা দীর্ঘ চড়াই পাওয়া গেল। ফেরবার মুখে চড়াই-পথ বড় গায়ে বাজে। উপায় নেই, হাঁপাতে হাঁপাতে শহরে এসে উঠলাম। বেশ বড় শহর। বড়-বড় পাহাড়ী রাস্তা, সরকারি বাংলা, হাসপাতাল, দোকান- বাজার-একান্তে একটি মান্যগণ্য ডাকঘর, পুলিশের থানা। জল-হাওয়া চমৎকার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা ধর্মশালার দোতলায় এসে উঠলাম। খাঁটি গরম দুধ এবং সুস্বাদু জিলিপি কর্ণপ্রয়াগের এক উপাদেয় বস্তু।

    যথারীতি রান্নাবান্না এবং আহারাদি। এখানে একটি বিচ্ছেদের পালা ঘটলো। আমাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, দুর্যোগ ও দুর্দিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু, পথনির্দেশক, ছোড়িদার অম্রা সিং এখান থেকে বিদায় নেবে। আজ মনে পড়লো, সে আমাদের আত্মীয় নয়, সে পর, তাকে চলে যেতে হবে। দেবপ্রয়াগের দিকে কোন্ এক দুর্গম পর্বতের চূড়ায় তার ছোট্ট একখানি গ্ৰাম। ঘরে তার পিতামাতা, ভাই-ভগ্নি এবং নববিবাহিতা পত্নী বর্তমান যাত্রীর দলকে মেহলচৌরীর পথে ছেড়ে দিয়ে চলে তাকে যেতেই হবে। মানুষের পরিচয় ব্যবহারে, মানুষ আত্মীয় হয়ে ওঠে ঘনিষ্ঠতায়। দুঃখের দিন, দুর্যোগে রাত যাকে নিয়ে অতিবাহিত করেছি, সে বন্ধু, সে পরমাত্মীয়, তাকে ছাড়তে গেলে বুকে বড় বাজে, মনের ভিতর থেকে প্রাণপণ শক্তিতে যেন একটা শিকড় উৎপাটন করে ফেলতে হয়। অম্রা সিং পথের মানুষের স্বল্প হৃদয় জয় করেচে,-বিজয়ী সে, ভাগ্যবান সে।

    যার যা সাধ্য-কাপড়, চাদর, জামা, গামছা, কম্বল ও টাকা, অকৃপণ হাতে তার ঝুলিতে সবাই ভরে দিল। বদরীনাথ যা পাননি তাই পেলে অম্রা সিং দেবতা পান পূজা, মানুষ পায় প্রীতি। অম্রা সিং আমাদের বড় আপন, আপনার চেয়েও আপন।

    এবারে ভার পড়লো আমার উপর যাত্রীদের চরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সঙ্গে সঙ্গে চলেচে জ্ঞানানন্দের দল। জ্ঞানানন্দ সম্পর্কে ইতিমধ্যে নানা কথা রটেচে। অম্রা সিংয়ের কাছে পথ সম্বন্ধে নানা উপদেশ গ্রহণ করে বেলা তিনটে নাগাদ আবার আমরা যাত্রা করলাম। কথা রইলো আমি যাবো সকলের পিছনে পিছনে। পথে তখনো রৌদ্র প্রখর হয়ে রয়েচে।

    গাড়নদীর তীরে তীরে পথ এবার একটু সমতল নদীতে নেমে এবার সহজেই জলের তৃষ্ণা মেটানো যায়। আস্তে আস্তে চলেচি, সকলে পিছনে পিছনে। নদীর ওপারে কোথাও-কোথাও গ্রামের চিহ্ন দেখা যাচ্চে। নদীর জলে তখনো রোদ ঝিকমিক করচে। সমতল পথ পেয়ে হাঁটার সুবিধে হয়েছে। গোপালদাকে আজ এগিয়ে যেতেই হবে, আগে-আগে গিয়ে চটিতে স্থাণু দখল করলে রাত্রে ভারি অসুবিধা হয়। অম্রা সিং নেই, অতএব এবার থেকে আমাদেরই সব দেখে-শুনে নিতে হবে।

    ছেড়ে যাবার আগে গোপালদা তামাক খেতে বসলেন; পাশ দিয়ে জ্ঞানানন্দের দলের মেয়েরা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল। সকল দলেই নারীর সংখ্যা বেশি। তারা যেন কী একটা রূঢ় আলো ক’রে চলেচে।

    ‘সারা পথ পার হয়ে এলাম, এমন ঢলানিপনা কোথাও দেখিনি মা।’

    ‘বড় মানুষের মেয়ে মা, ওদের ঢঙই আলাদা!”

    ‘হাঁটুতে যদি না পারবি, কাণ্ডি কি ডাণ্ডি কল্পেই হতো? গেরস্তর মেয়ে হয়ে হুট বলতেই ঘোড়ায় উঠলি, নোকনজ্জা নেই শরীরে? এদিকে ত সিঁদুর মুছে শুধু হাতে এসেচিস, এত প্রাণের মায়া কেন?’

    ‘তাই বটে পাঁচুর-মা, এখনকার জোয়ান বয়সের মেয়ের যত বেয়াড়া ধরন।’

    বুড়ীগুলো নানা কথা কইতে-কইতে চলে যাচ্ছিল।

    বললাম, ‘এরা কার ওপর হঠাৎ এমন প্রচণ্ড হয়ে উঠলো?’

    গোপালদা বললেন, ‘তোমায় বলতে ভুলেচি ভাই, মনে আছে সেই ছুঁড়িকে, সেই যে বাবার ওখানে?’

    তাঁর দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, তারপরে বললাম, ‘কার কথা বলচেন?’

    ‘কি আশ্চর্যি, সেই যে চশমাপরা দিদিমা আর তার বিধবা নাতনী –’

    ‘তাঁরা ত চলে গেচেন।’

    ‘না, আজ কর্ণপ্রয়াগে দেখা হ’লো আমার সঙ্গে। মেয়েটা উঠেচে একটা ঘোড়ায়, পায়ে নাকি ব্যথা হয়েছে। আসচে তাদের দল পেছনে। আচ্ছা, আমি এখন এগোই ভাই।’ বলে গোপালদা তার মোটা লাঠি নিয়ে বেঁটে ভালুকের মতো অগ্রসর হয়ে গেলেন। তামাক খেয়ে তিনি পথে সাঁতার কাটতে থাকেন।

    কয়েক পা পিছনে হেঁটে পথের একটা বাঁকে মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই চৌধুরী মশায়ের দলটাকে দেখতে পেলাম। একটা জটলা জমেছে। নাতনী তার মাঝখানে পাহাড়ের একটা খাঁজে পা রেখে ঘোড়ায় ওঠবার চেষ্টা করছেন। একটা হাসাহাসি চলচে। দূর থেকে দেখতে পেয়ে তিনি হেসে বললেন, ‘আপনি মুখ ফিরিয়ে এগিয়ে যা নৈলে আমার ঘোড়ায় ওঠা হবে না।’

    তথাস্তু। আবার ফিরে চলতে শুরু করলাম। বেশ জোরে জোরেই পা চালিয়ে দিলাম। মাইল খানেক আন্দাজ একাকী চলে গিয়ে খটাখট্ শব্দে ফিরে দেখি, অশ্বারোহিণী কাছাকাছি এসে পড়েছেন। সঙ্গে-সঙ্গে আছে একটা সহিস। পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম ঘোড়র গতি মন্থর হ’লো। দড়ির রাশ দুই হাতে ধরে তিনি বললেন, ‘নমস্কার। ‘

    ‘নমস্কার।’

    ‘ভালো আছেন ত? ভাবছিলাম বুঝি আর দেখা হ’লো না,-পথ ত ফুরিয়ে এল। আপনার সঙ্গে সেই বুড়ো লোকটি, তাকে দেখতে পেয়ে পথে তবু যাহোক একটু আশ্বস্ত হলাম। বুঝলাম, শীতের পরেই বসন্ত। খুব তাড়াতাড়ি এসেচেন যা হোক।’

    ‘আপনাদের সব ভালো?’

    ‘আড়ষ্ট হয়ে কথা বলবেন না। দিদিমারা আছেন অনেক পেছনে, ঘোড়ার পায়ের সঙ্গে মানুষের পা মেলেনা। হ্যাঁ, সব ভালো নয় আমার পায়ের তলায় ব্যথা, দিদিমা কিছুতেই শুনলেন না, একটা ঘোড়া জুটিয়ে দিলেন। আপনি এখন দেশে ফিরবেন ত?’

    ‘তাই ভাবচি।’

    তিনি হেসে বললেন, ‘এখনো ভাবছেন? ধন্য ভাবুক আপনি; আপনার মুখের সঙ্গে বোধহয় মনের মিল নেই! এত ভাবছেন কী? হাত-পা ছেড়ে ভেসে যান্।’ যেন একটা প্রাণের ঝড় বইছে, জীবনের প্রাচুর্য। নির্বাক হয়ে চলেচি।

    ‘আপনারা সব বেরিয়েচেন পুণ্য করতে, আমার ওসব নেই। বহু তীর্থে গেচি, কিন্তু তীর্থ করতে নয়, এমনি।’ হেসে পুনরায় বললেন, ‘আমার বেশ লাগে ঘুরে বেড়াতে। এখানে আসার কিছুই ঠিক ছিল না, আসবার তিন চারদিন আগে কলকাতা থেকে এসেছিলাম কাশীতে দিদিমার কাছে; দিদিমা ভাসবেন তীর্থে। বললাম, আমিও যাবো। কিছুতেই কেউ ছাড়বে না! বললাম, যাবই আমি। কীসের এত বাঁধাবাঁধি। দেশ-বিদেশের নামে আমার মন পাগল হয়ে ওঠে, সত্যি বলচি আপনাকে।’

    বললাম, ‘অমন হিন্দী আর উর্দু শিখলেন কেমন করে?’

    তিনি বলিলেন, ‘বাঙালীর মেয়ে কিন্তু বাংলায় যে থাকতে পাইনে। বাংলার সঙ্গে সম্পর্ক সুধু বই-কাগজে। ওদিকে বহুদিন ছিলাম পাঞ্জাবে। আজকাল ইউপির সব শহরগুলো আমি সারা বছর ধরে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে বেড়াই। কিছু ভালো লাগে না।’

    রাঙা রৌদ্র উঠলো পাহাড়ের মাথায়, দিন এল অবসান হয়ে। কোনো কোন পাহাড়ের গর্ভে এরই মধ্যে অন্ধকার জচে। নদীর একদিকে শ্বেতকরবীর জঙ্গল, আর একদিকে কাঁটাবন। নদীর দিকে তাকিয়ে মাঝে-মাঝে আলাপ চলচে।

    ‘-এ কিন্তু আমার বিশ্রী লাগচে, আমি যাবো জোড়ায় আর আপনি যাবেন হেঁটে,- চ্চু, কি রে, জল খাবি নাকি?-আমার কলেবরের ভারটি ত কম নয়, ক্ষণে ক্ষণে বেচারার গল্প শুকিয়ে উঠচে—’ ঘোড়ার ঘাড়ে তিনি একবার খাত বুলিয়ে দিলেন।

    পথের উপরে নেমেচে একটি ঝরনা, ঘোড়াটা গলা নামিয়ে তার উপর মুখ দিল। অশ্ববর নিতান্ত নিরীহ এবং নিস্তেজ, রোগা-পল্কা দেহ, এরা সাধারণত পাহাড়ে বোঝা নিয়ে যাতায়াত করে। মালও বয়, মানুষও বয়।

    সেমালী চটি ছেড়ে সিয়োলী চটির কাছাকাছি এসে পড়েচি! কথা কইতে- কইতে প্রায় পাঁচ মাইল পথ পার হয়ে গেচে। তিনি একবার পিছন ফিরে তাঁর দলের পথের দিকে তাকালেন।

    ‘আমার ঘোড়ার নাম কি জানেন?-বিন্দু! বিন্দুর ছেলে নয়! এদিকে আবার দেখুন, কী কাণ্ড! আমার সহিসটার নাম ভদ্রসমাজে অচল। কী নাম জানেন?-প্রেমবল্লভ। ভেঙে দু’খানা করেও ডাকবার উপায় নেই, বেয়াড়া শোনায়।’

    দু’জনের হাসিতে পথ মুখরিত হ’লো। মোড় ঘুরতেই চটি পাওয়া গেল। বৃক্ষচ্ছায়াময় ফলের বাগানে ঘেরা সিরোলী চটি। ঘোড়া থেকে নেমে তিনি পথের ওপারের চটিতে গিয়ে উঠলেন, আমি এলাম এপারে গোপালদার আশ্রয়ে।

    রাত্রে দিদিমার সঙ্গে পরিচয় হ’লো। মেয়েরা সুবিধা পেলেই সহজে পারিবারিক গল্প টেনে আনেন। তাদের বাড়ি কাশীতে। পরিবারপরিজন সম্বন্ধে নানা আলাপ চলতে লাগলো। তিনি নারীর যে পিতৃপরিচয় দিলেন তা’তে সহজেই চিনতে পারলাম। নাতনীর নাম রাণী।

    –

    –’মা-বাপ নেই, স্বামীর হ’লো অকালমৃত্যু, ছেলেটি করতো সরকারি চাকুরি। এখন মামার বাড়িতেই প্রায় থাকে। অল্পবয়সে এই অবস্থা হ’লো-কি ভাগ্যি যে কিছু মাসোহারা পায়।’

    পরিচয়াদির পর উঠে এলাম। চৌধুরী মশায় প্রভৃতির জন্য রাত্রের আহারাদির ব্যবস্থাটাও করে দেবার ভার এল আমার উপর। খানিক পরে পোয়া- তিনেক পুরি ভাজিয়ে যখন তাঁদের চটির ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন দেখি দিদিমা ও রাণী জপে বসেচেন। দাঁড়িয়েই রইলাম। বহুক্ষণ পরে তাদের জপ শেষ হলো। বললাম, ‘দামটা এখুনি চুকিয়ে দি, তিন পুরি-সাড়ে সাত আনা।

    রাণী একটা টাকা বার করে দিলেন, ভাঙানি আমার সঙ্গেই ছিল, বাকি পয়সা ফেরৎ দিলাম! পয়সাগুলি উলটে-পালটে দেখে তিনি হেসে বললেন, ‘এ ছোট দোয়ানি, এ কি চলবে?’

    বললাম, ‘চালাতে জানলে অচলও চলে।’-বলে চলে এলাম।

    শেষ বসন্তের নদীর রূপ গৈরিকবসনা তপঃশীর্ণা বৈরাগিনীর মতো, বালুময় তীরে-তীরে তার পিঙ্গলজটা রুদ্র সন্ন্যাসীর আনাগোনা, তার পর একদিন সেই নদীর সর্বাঙ্গে নামে বর্ষা, আসে জোয়ারের বেগ, দুই কূল। তার প্রাণের ঐশ্বর্যে আন্দোলিত হয়ে ওঠে! জীবনেও তাই।

    প্রভাতের রৌদ্রে চারিদিক আলোকিত হয়েচে। আজকের পথ আবার পর্বতের গহ্বরে প্রবেশ করেচে। ধীরে-ধীরে ভটোলী চটি পার হয়েচি। কথা ছিল পথে আমাদের দেখা হবে। আমি আগে আগে যাবো মাইল দুই এগিয়ে, তারপর তিনি দল ছেড়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে পিছন থেকে এসে আমাকে ধরবেন। অর্থাৎ, এই কথাটা আমরা দু’জনেই আন্দাজ করে নিয়েচি, আমাদের কথালাপ আর কেউ না শুনলেও চলবে। সকল কথা ত আর সকলের জন্য নয়! ভটোলী চটি পার হয়ে অনেকদূর এসে পড়েচি। দল-বল সবাই এগিয়ে গেচে। গোপালদা একবার একটু বসে তামাক খেয়ে চলে গেচেন। মেহলচৌরী পর্যন্ত পথটা শেষ করে দেবার জন্য সকলেরই পায়ে একটা তাড়া আছে। আগে ছিল পথ অতিক্রম করার একটা কঠিন সাধনা, এখন সে সাধনাও নেই, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিও নেই, আজকাল পথের প্রতি সকলেরই বিতৃষ্ণ। কিন্তু একজন মানুষ তাদের মধ্যে রয়েচে, যে, পথটাকে আর পীড়াদায়ক মনে করছে না, তার পায়ে এসেচে অক্লান্ত চলার নেশা, অফুরন্ত উৎসাহ। সে পেয়েছে একটি সহজ ও সবল গতি। সে বল্‌চে-

    ‘পথের আনন্দ বেগে অবাধে পাথেয় কর ক্ষয়!’

    ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে পিছন ফিরে দেখি, দূর থেকে আসছেন অশ্বারোহিণী। পিছনের নদী ও পর্বতের পটভূমিকায় তাকে ঐতিহাসিক যুগের দুর্গাবতী কিংবা লক্ষ্মীবাই বলে মনে হচ্চে। ঘোড়ার পিঠে বসবার ভঙ্গীটি বেশ তেজোদ্দীপ্ত পরনে পরিচ্ছন্ন শাদা একখানি থান, মাথায় অল্প ঘোমটা, গায়ে সেই ঘন বেগুনী রঙের চাঁদরখানি। পাশে-পাশে প্ৰেমবল্লভ আচে বিড়ি টানতে টানতে।

    কাছাকাছি এসে বললেন, ‘ভাগ্যি আপনি যানি কৈলাসে!”

    বললাম, ‘ভাগ্যি আপনি এসেছিলেন বদরীনাথে!’

    কথার পিঠে কথা শুনে তিনি হেসেই খুন। পরে বললেন, ‘কাল রাতে খাওয়া হয়েছিল?’

    হা-বিধাতা, এই কি ঘোড়ায় চড়া মেয়ের মতো প্রশ্ন? হেসে বললাম, ‘এ যে একেবারে অন্তরঙ্গের কথা!’

    তিনি হেসে চুপি চুপি বললেন, “দিদিমারা আসছেন, আপনি পা চালিয়ে আর একটু এগিয়ে যান।’

    বললাম, ‘না, দিদিমার সুমুখেই আমি গল্প করবে আপনার সঙ্গে।’

    ‘আপনি কি স্বরাজ পেয়ে গেচেন, যান বলচি এগিয়ে।’ সস্নেহে তিনি ধমক দিলেন। তিনি বুঝতে চান না যে, চৌর্যবৃত্তি আমার প্রিয় নয়।

    অতএব এগিয়েই গেলাম। যেতে যেতে আদবদরি এসে পড়লো। সুমুখেই চত্বরের উপরে নারায়ণের একটি প্রাচীন মন্দির, মন্দিরেব গায়ে ধরেচে বহু ফাটল,-তারই পিছনদিকে কাছাকাছি অতি জীর্ণ-শীর্ণ একখানি গ্রাম। কাছেই একটি স্বচ্ছতোয়া ঝরনা। লোকের ধারণা এখানকাব ঝরনার জল স্বাস্থ্যের পক্ষে অতি উপকারী। ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় আজ অনেকখানি পথ আসা গেচে, আরো এখনো অনেকখানি যাওয়া যাবে। নিতান্ত ক্লান্ত না হলে এবেলা আর কেউ চটিতে আশ্রয় নেবে না। দেখা গেল, আধবদরির ঠাকুর-দর্শনের জন্য সকল দল এসে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। বুঝলাম, সুমুখে দোকানে কিছু জলযোগ করে আবার সবাই হাঁটতে শুরু করে। সুতরাং আবার অগ্রসর হলাম।

    অগ্রসর হলাম বটে কিন্তু আজ সকাল থেকে এই নদী, আকাশ, পর্বত ও দূরের গ্রামগৃহগুলির নিকট ইঙ্গিত পেয়ে ভিতর থেকে মহাকবি কবিতার কয়েকটি ছত্র স্বতঃউৎসারিত হচ্ছে—

    ‘দাও আমাদের অভয় মন্ত্র, আশোক মন্ত্ৰ তব।
    দাও আমাদের অমৃত মন্ত্র, দাও গো জীবন নব।
    যে জীবন ছিল তব তপোবনে,
    যে জীবন ছিল তব রাজাসনে,
    যুক্ত দীপ্ত সে মহাজীবনে চিত্ত ভরিয়া লব।
    মৃত্যু তরুণ শঙ্কাহরণ দাও সে মন্ত্র তব!’

    অতীত তিরিশটি দিনের সঙ্গে এখনকার দিনগুলির আর মিল নেই, আবার উত্তীর্ণ হয়ে এসেচি নূতন আলোয় ও নব অধ্যবসায়ে। জীবনের গতি এমনি। আবার সে পেয়েছে একটি নূতন বেগ। আজ ভাবচি চিত্তধর্মের কোনো নির্দিষ্ট নীতি নেই, চিত্তলোকের কামনার কোনো বাঁধাধরা পদ্ধতি নেই, নিজের আনন্দের পথ সে নিজেই নির্বাচন করে নেয়, সংস্কারের বাধায় সে আপন উৎসকে রুদ্ধ করতে রাজি নয়। আজ সে তাই বন্ধনহীন পক্ষ বিস্তার করে উড়েচে আকাশে-আকাশে।

    ‘কী ভাবচেন?’

    মুখ ফিরিয়ে বললাম, ‘এই যে, আসুন। ভাবচি আপনার চাদরখানির রং বেগুনী না হয়ে সবুজ হলে কেমন হতো!’

    ‘কী বললেন?’

    ‘বল্‌চি যে আপনার ঘোড়াটা হাঁটে কিন্তু দৌড়ায় না।

    ‘দৌড়ায় না বলেই রক্ষে। দৌড়ালে আমার কাহিনী অন্য রকম লেখা হ’তো।’

    ‘কী রকম?’-বললাম।

    তিনি বললেন, ‘দিদিমা বলছিলেন, ঘোড়ায় চড়েচিস বটে রাণী, কিন্তু ছুটিসনে যেন ভাই। অর্থাৎ, ঘোড়াটা আমাকে নিরুদ্দেশে না নিয়ে গিয়ে ঠিক জায়গায় যেন পৌঁছে দেয়। আমি ত আর কিওয়ার নই, আমি হচ্ছি এর বোঝ।’

    তা বটে। বললাম, ‘এবেলা কতদূর যাবেন?’

    ‘চলুন না যতদূর যাওয়া যায়। দিদিমার পায়ে আবার একটা অসুখ আছে, বেশি পথ হাঁটলে পা ফুলে ওঠে। চৌধুরী মশায়েরও শরীর খারাপ।’

    নানা আলাপ চলতে লাগলো। এক সময় তিনি বললেন, ‘তীর্থ ত সারা হ’লো, তারপর? এসে কী লাভ হলো?’

    ‘পুণ্য!’

    ‘সে ত আপনাদের, কিন্তু আমার?’

    ‘আপনার অন্তত পাপক্ষয় ত খানিকটা হ’লো!”

    সহসা তাঁর মুখে গাম্ভীর্যের ছায়া দেখা গেল। শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘সে মিথ্যে নয়, এদেশে জন্মানোই পাপ।’-আবার তিনি হাসলেন। হেসে বললেন, ‘কিন্তু আমার ত পাপ নেই! ‘

    বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘সে কি, হিন্দুধর্মের মেয়ের পাপ নেই!’

    ‘মেয়েদের নিয়ে অনেক রকমের ধারণাই চলতি আছে!’ রাণী বললেন, ‘কিন্তু সে যাক গে। আমি ত দেখচি আমার লাভ হলো কিছুদিন ঘানির জোয়াল থেকে ছাড়া পাওয়া, পাহাড়ে-বনে হাঁটাহাঁটি, এই ঘোড়ায় চড়াটা।’

    নানা কথায় এক সময় জিজ্ঞাসা করে বসলাম, ‘আচ্ছা, আপনার স্বামী কতদিন মারা গেচেন?’

    ‘দোহাই আপনার!’ বলে তিনি একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন, ‘দয়া করে সহানুভূতি প্রকাশ করবেন না। অল্পবয়সের বিধবাদের জন্যে কান্নাকাটি,-ওটা ত, লেগেই আছে। আপনি আর কেন তাদের দলের দলী হন? যেটুকু সময় হাতে আছে, সেটুকু আমাদের তীর্থযাত্রার আনন্দে ভ’রে উঠুক। অনেক কান্না আছে মানুষের জীবনে। কিন্তু কে তার খোঁজ রাখে? দুনিয়াসুদ্ধ লোক আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আহা! আহা বললেই যেন আমার পিঠে চাবুক পড়ে!

    তা বটে।

    ক্ষেতী চটি পার হতেই সূর্য এলেন প্রায় মাথার উপরে। পথ এবার চড়াই এবং সংকীর্ণ। মানুষের সমাগম আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না, দুই ধারের অরণ্য নিবিড় হয়ে এসেচে। দুই পাশে বৃক্ষলতার ঘন জটলায় এই পরিদৃশ্যমান দিবালোক মাঝে মাঝে ছায়ান্ধকারে আবৃত হচ্চে। ঝিল্লীরব শুনতে পাচ্চি। অরণ্য-পুষ্পের সংমিশ্রিত গন্ধে পথের হাওয়া কোথাও কোথাও ভারাক্রান্ত। লতাবিতানের ফাঁকে ফাঁকে বসন্তের বাতাস থেকে থেকে আপন উচ্ছ্বাসে মর্মরিত হয়ে উঠচে।

    চড়াইটা পার হওয়া অত্যন্ত কষ্টকর, ঘোড়াটা ক্লান্ত হয়ে এসেছে। সহিস ছিল পিছনে-পিছনে, এবার সে সুমুখে এসে লাগাম ধরে ঘোড়াটাকে টানতে- টানতে উঠতে লাগলো। পথটা অতিরিক্ত কর্কশ এবং ভাঙাচোরা।

    ‘এত বেলা, নাওয়া-খাওয়া নেই, আপনার নিশ্চয় চলতে কষ্ট হচ্চে।’

    বললাম, ‘আমিও সেই কথাই ভাবচি। ভাবচি এমন ভয়ানক পথ অথচ চলতে কষ্ট হচ্ছে না কেন! বিশ্রাম পর্যন্ত নেবার চেষ্টা নেই!’

    আমার কথায় হয়ত প্রচ্ছন্ন পরিহাস প্রকাশ পেয়ে থাকবে-সুতরাং রাণী কৌতুক-কটাক্ষে চেয়ে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, ‘সত্যিই তাই; নিজের শক্তি যে কোথায় জমা থাকে নিজেরাই জানতে পারিনে।’

    দেড় মাইল পথ পার হয়ে যখন গণ্ডাবাজ চটিতে এসে পৌঁছলাম তখন আন্দাজ বেল্ প্রায় একটা। আর নয়, সুমুখের ছোট চালার ভিতরে এসে ঝোলাঝুলি নামালাম। রাণী নেমে এলেন ঘোড়া থেকে। সহিসটা ঘোড়াকে নিয়ে কোথায় যেন দানাপানি খাওয়াতে গেল। নির্জন চটি, দোকানওয়ালা থাকে পথের নিচে সুমুখে পথের ওপারে একটা ঝরনা ঝর-ঝর করে নাচে। ভয়ানক মাছির উৎপাত। তিনি গায়ের চাদরখানা খুলে দিয়ে বললেন, “পায়ে ঢাকা দিয়ে বসুন, আমি আসচি মুখে-চোখে জল দিয়ে, আর সবাই না এলে ত রান্নাবান্নার ব্যবস্থা হবে না।’

    মুখ ধুয়ে তিনি আবার এসে মুখোমুখি বসলেন, মাছির দৌরাত্ম্যের জন্য বাধ্য হয়ে চাদরের আর একটা দিক তিনি পায়ের উপর টেনে দিলেন। বললেন, ‘এমন করে কি বিদেশে-বিভুঁয়ে একলা আসে? শরীরগতিক বলা ত যায় না, দেশে গিয়ে কিছুদিন বিশ্রাম নেবেন; শান্ত হয়ে থাকবেন।’

    অঘোরবাবুর স্ত্রীর নিকট বিদায়ের দৃশ্যটা সেদিন আমার মনে জ্বল্ জ্বল্ করচে, সেই ভয়ানক আঘাত আমি ভুলিনি; ব্রহ্মচারীর সঙ্গে যে-ঘনিষ্ঠতা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেচে তাও স্পষ্ট মনে করতে পারি; পথে আর কোথাও স্নেহ-মমতার বন্ধন সৃষ্টি করবে না। হৃদয়াবেগের খেলায় অনেক দুঃখ পেয়েচি। অনেক ভেঙেছে, অনেক রামধনু মিলিয়ে গেচে।

    বললাম, ‘এত তীৰ্থ, এত দেবদর্শন, তবু আপনার মুখে সেই ঘরোয়া মনের কথা?’

    রাণী বললেন, ‘ঘরোয়া মন নিয়েই ত’ তীর্থে এসেছিলুম।’ বলে হঠাৎ একবার পথের দিকে তাকিয়ে তিনি আমার পায়ের উপর থেকে চাদরখানা টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দিদিমারা আসচেন। রৌদ্র ও পথশ্রমে দিদিমার চেহারা একেবারে বদলে গেচে।

    কাছাকাছি এসে নাতনীকে দেখেই তিনি হঠাৎ ফেটে পড়লেন, “এই কি তোর মনে ছিল রাণী, যারা হেঁটে আসছে তাদের ওপর এতটুকু মায়াদয়া নেই? চল্ দেশে, বলবো গিয়ে সকলের সামনে এই কথা। এত অন্যায়, এত বেয়াদপি? কে তোমাকে আসতে বলেছিল এতটা রাস্তা? কেন দাঁড়াওনি ক্ষেতী চটিতে?” বলতে বলতে তিনি চালার ভিতরে এসে বসে পড়লেন,–’তোমাকে এনে আমার এত দায়িত্ব, এমন চোখে-চোখে রাখা! পরের মেয়ে, অল্প বয়েস, কেন তুমি এলে আগে আগে? জানো, আমার পায়ের অসুখ, চলতে পারিনে?’

    রাণী নীরব, আমি নতমস্তক। বোঝা গেল তার অভিযোগ এবং ভয়টা কোথায়! দেখতে দেখতে পিসি এবং আর একটি বৃদ্ধা এসে চটিতে উঠলেন 1 তিরস্কার এবং কটূক্তি সেই মৌনমুখী মেয়েটির উপরে বহুক্ষণ অবাধে বর্ষিত হতে লাগলো। ধীরে ধীরে উঠে পাশের চটিতে এসে ঢুকলাম। রান্নাবান্নার আর দেরি করলে চলবে না।

    ঘণ্টা দুই পরে ঝরনার জলে বাসন ধুয়ে যখন চটিওয়ালার কাছে হিসাব নিতে যাচ্ছি তখন চালার ভিতর থেকে গলা বাড়িয়ে রাণী বললো, ‘রান্নাবান্না করলেন, আমাদের একবার খেতে ডাকলেন না? আমাদের যে উপবাসেই দিন গেল!’ বলে তিনি শুধু হাসি হাসলেন।

    দিদিমারাও হাসলেন তাঁর সঙ্গে। বোঝা গেল আবহাওয়াটা হালকা হয়ে গেচে। দিদিমার দিকে ফিরে বললাম, ‘আপনারা রাঁধলেন না কেন?’

    তিনি বললেন, ‘দল-বল সব ছন্নছাড়া হয়ে গেচে। চৌধুরীদের ফেলে রেখে ত আমরা খেতে পারিনে ভাই’।

    অপরাহ্ণে যখন কালীমাঠি চটিতে এসে থামলাম তখন শরৎকালের মতো একখানা কানা মেঘ থেকে সপ্ সপ্ করে বৃষ্টি নেমেচে। মেঘের পারে পশ্চিমের আকাশ তখনো রাঙা রৌদ্রেরক্তাভ, সুতরাং বৃষ্টি দেখে চিন্তিত হবার কোনো কারণ নেই। গোপালদার দল পিছন দিক থেকে এসে আবার আমাকে গ্রেপ্তার করেছে। এখন আমরা গুটিচারেক বাঙালীর দল একত্র চলচি। স্বামীজির দল এসে মিলেচে। চারটি দলে প্রায় ষাট জন লোক, তার মধ্যে স্ত্রীলোক প্রায় পঞ্চান্ন জন। সবাই এসে থামল। দিদিমার দলের চৌধুরী মশাইদের এখনো দেখা নেই, সেই সকাল থেকে ছাড়াছাড়ি। এদিকে বৃষ্টি দেখে আর অধিক দূর অগ্রসর হওয়া সম্বন্ধে অনেকেই একটু ইতস্তত করতে লাগলো, শেষ পর্যন্ত আকাশের দিকে চেয়ে এগিয়ে যাওয়াই স্থির হ’লো।

    দিদিমারা আর এগোবেন না, চটিতে আশ্রয় নিয়ে আজ রাত্রের মত থেমে গেলেন, চৌধুরী মশাইরা তখনো এসে পৌঁছলেন না। তাইত, আমি কী করি, ন যযৌ ন তস্থৌ। চটির অঙ্গনে একটি ঝরনার মুখে রাণী একটা বালতি নিয়ে এসেছেন জল নিতে। জল দেখলেই তৃষ্ণা লাগে, অতএব জলপান করতে গেলাম। রাণী বললেন, ‘আপনি আজ এগিয়ে যান, এরা একটা বিশ্ৰী সন্দেহ করেচে…কাল মেহলচৌরীতে যেন নিশ্চয়ই দেখা হয়?’

    বললাম, ‘এর পরে দেখা হওয়া কি সঙ্গত?’

    মৃদু-কঠিন ও স্পষ্ট কণ্ঠে তিনি জবাব দিলেন, নিশ্চয় সঙ্গত। জানবেন আমি কারো অধীন নই!

    দলের সঙ্গে আবার পথ ধরলাম। এক মাইল পার হয়ে গিয়ে পাওয়া গেল রসিয়াগড় চটি। এই চটিতেই রাত্রিবাস। রাত্রে আহারাদির পর তামাক ধরিয়ে গোপালদা এক সময় বললেন, ‘আমি কিন্তু ভাই ওদের কথা বিশ্বাস করিনে, যে যাই বলুক।’

    বললাম, ‘ব্যাপার কী?’

    ‘ওই স্বামীজির দলের ওরা বলছিল তোমার কথা।’

    ‘কী বলছিল?’

    ‘তুমি যে-মেয়েটার নাম রেখেচ রাঙাশাড়ী, সে নাকি তোমার বিরুদ্ধে যা-তা বলেচে। তোমার কথা সবাই জিজ্ঞেস করছিল,-রাঙাশাড়ী বললে, তিনি ঘোড়ার ল্যাজ ধরে বৈতরণী পার হচ্ছেন! মেয়েটা অনি সবাইকেই খোঁচা দিয়ে কথা কয়। স্বামীজিরা সবাই নাকি হাসাহাসি করেছে। আমি আচ্ছা করে শুনিয়ে দিয়েচি?’

    বললাম, ‘এত কাণ্ড হয়েছে এর মধ্যে?’

    চুপি-চুপি গোপালদা বললেন, ‘হোক না, আমি ত জানি তোমাকে, তোমার গায়ে কাদা লাগে না, ওরা তোমাকে কতটুকু জানে ভাই?’

    বললাম, ‘সত্যিও ত’ হতে পারে গোপালদা?’

    ‘হোক সত্যি, ওতে আমি ভয় পাইনে, গঙ্গার জলে ময়লা এসে মিশলে গঙ্গা কি নোংরা হয়?’

    হেসে বললাম, ‘তবে ভালো কথাটাই বলি, ব্রহ্মপুত্র এসে মিলেচেন পদ্মায়।’

    পরদিন খাড়চটি ও ধুনারঘাটের ছোট পার্বত্য শহরটি যখন পার হয়ে দাড়িমড়ালী এসে পৌঁছলাম তখন সকাল হয়েচে। ধুনারঘাট থেকে পেয়েচি রামগঙ্গা নদী, আর পেয়েচি ছোট-ছোট প্রান্তর। কোথাও কোথাও মাঠে চাষ- আবাদ চলচে। ঢেউ-খেলানো প্রায়-সমতল পথ আশপাশে কয়েকখানি গ্রাম। গ্রামগুলি সমৃদ্ধিশালী। বেলা আন্দাজ ন’টার সময় আরো প্রায় সাড়ে চার মাইল হেঁটে এতদিন পরে আমরা গাড়োয়াল জেলার শেষপ্রান্ত মেহলচৌরীতে এসে পৌঁছলাম। ভেবেছিলাম মেহলচৌরী একটা হোমরা-চোমরা কিছু, কিন্তু সে যে এত সামান্য তা স্বপ্নেও ভাবিনি। এইখানে টিহরী-রাজ্যের শেষ। যে সমস্ত গাড়োয়ালী কুলী একদিন হরিদ্বার থেকে যাত্রীর বোঝা বহনের জন্য নিয়োজিত হয়েছিল, এইখান থেকে তারা বিদায় নেবে, এর পরে ব্রিটিশ-সীমানা; বিনা ছাড়পত্রে ব্রিটিশ-সীমানার মধ্যে প্রবেশ করবার হুকুম তাদের নেই। আমরা সবাই একই দেশের মানুষ, সবাই ভারতবাসী, অথচ কি একটা রাষ্ট্রগত সামান্য কারণে আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। মেহলচৌরী অত্যন্ত অপরিষ্কার ও অস্বাস্থ্যকর। পাশেই রামগঙ্গা নদী এবং নদীর উপরে একটা পুল।

    বেলা আন্দাজ এগারোটার সময় চৌধুরী মশায়ের দল মহাসমারোহে এসে পৌঁছলেন। সঙ্গে তাদের জন-দশেক কণ্ডিওয়ালা। রাণী এলেন ঘোড়ার পিঠে দূর থেকে পরস্পরের দেখা পেয়ে অলক্ষ্যে অভিবাদনের পালা সমাপ্ত হলো। তারপরে বিশ্রাম এবং আহারাদির আয়োজন। এদিকে গোপালদার দলের বামুন- মার সঙ্গে কি একটা কারণে আমার বাধলো বচসা; ক্রমে তিল হলো তাল। চারুর-মা চুপি চুপি বললে, ‘বা’ ঠাউর, ও বুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করাও তোমার অপমান, তুমি চুপ করে যাও।’

    হেসে বললাম, ‘ঝগড় ত করিনি চারুর-মা, ধমক দিচ্ছি।’

    চারুর-মা একগাল হেসে বললে, ‘ও, এটা তবে ঝগড়া নয়, ধমক? তাহ’লে আরো দুকথা শুনিয়ে দাও বা’ঠাউর, আমিও খুশী হই।’

    আমরা সবাই চুপি চুপি হাসাহাসি করতে লাগলাম, বামুন-বুড়ী নিল কান্না। স্নান করবার সময় হলো, গামছা নিয়ে এলাম রামগঙ্গায়। পাথর ভেঙে নিচে নামতে হয়। একটু-একটু বৃষ্টি পড়চে।

    স্নান সেরে সাবধানে ও সন্তর্পণে রাণী তখন নদী থেকে উঠে যাচ্ছিলেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বললেন, বাবারে, এমন চেঁচামেচি করতে পারেন আপনি? দেখূচি, নিতান্ত ছেলেমানুষ নন। শুনুন, এবার ওদের দল ছেড়ে দিন, চলুন আমাদের সঙ্গে, এক সঙ্গে ফিরবো। আর হ্যাঁ, আপনি এখান থেকে একটা ঘোড়া করুন, বুঝলেন, দু’জনে ঘোড়ায় থাকলে বেশ হবে!’

    ‘কিন্তু-’

    চোখ পাকিয়ে তিনি বললেন,–’আমার কথার অবাধ্য হবেন না’–বলে হেসে তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন।

    অম্রা সিং চলে গেচে, আজ কাণ্ডিওয়ালারাও বিদায় নিল। বিদায়ের দৃশ্যটি করুণ। তুলসী, কালীচরণ, দোতারাম, সবাই জানালো প্রীতিসম্ভাষণ। গাড়োয়ালীদের সে এক বিস্ময়কর সারল্য। চৌধুরী মশায়ের কাণ্ডিওয়ালারা ত কেঁদে কেটেই অস্থির। রাণী নাকি তাদের সকলের মাতৃরূপিণী; এমন দয়াবতী, স্নেহময়ী দেবীর দেখা তারা নাকি জীবনে পায়নি। রাণীর দানে তাদের ঝোলাঝুলি ভরে উঠলো। কাপড়, চাঁদর, পুরোনো কম্বল, বাসন এবং নগদ বকশিশ; পাওনা-গণ্ডার চেয়ে বকশিশের পরিমাণ বেশি হলো। সকলের চেয়ে যে কুলীটি বয়সে ছোট, সে কিছুই চাইল না, শুধু নিতান্ত শিশুসন্তানের মতো রাণীর আঁচলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। পর যখন আপন হয় তখন সে আপনার চেয়েও আপন। এমন দৃশ্য জীবনে কখনো দেখিনি। রাণীর চক্ষুও শুষ্ক রইলো না। রাজকন্যা ও দিনশ্রমিকের মধ্যে আজ আর কোনো ব্যবধান নেই। দুঃখে, দুর্যোগপথে-পথে এই দীর্ঘ চল্লিশ দিনে আজ তারা জালো, সে মা তাদের আপন মা নয়, বৃহৎ পৃথিবীর জনারণ্যে মা তাদের নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন।

    এদিকে আমাকেও বিদায় নিতে হ’লো সকলের কাছে। বামুন-বুড়ীর সঙ্গে বিবাদের পর গোপালদার দলকে আজ এইখান থেকেই ত্যাগ করতে হলো। যদি সম্ভব হয় দেশে গিয়ে আবার দেখা হবে। দীর্ঘকাল এসেচি গোপালদার সঙ্গে, সেই হৃষীকেশে আলাপ, আজ তাকে ছাড়তে বড় লাগলো। যাই হোক, বেলা তিনটা নাগাদ স্বামীজি ও গোপালদার দল ঘোড়ার পিঠে মালপত্র চড়িয়ে মেহলচৌরী পরিত্যাগ করে গেলেন। তখন বেলা অপরাহ

    চৌধুরী মশায়দের ভাবগতিক দেখে মনে হলো, আজ বুঝি মেহলচৌরীতেই রাত্রিবাস করতে হবে, তাদের বিশেষ তাড়া নেই। এদিকে রাণীক্ষেত পর্যন্ত একটা ঘোড়া নিজের জন্য ঠিক করেচি। ঘোড়া ঠিক করে’ চৌধুরী মশায়কে তাড়া দিলাম, তিনি অবশেষে যেতে রাজি হলেন।

    অতএব আর বাধা নেই। যাত্রা করতে বেলা পাঁচটা বেজে গেল। ঘোড়া পিঠে কম্বল ও ঝোলা চাপিয়ে লাঠিটা দিলাম সহিস মহেন্দর সিংয়ের কাছে,- সহিসটার বেশ ‘মাই ডিয়ারি’ ভাবগতিক। তারপর মাথায় রাজা শিবাজীর কায়দায় পাগড়ি বেঁধে বীরজনের মতো গিয়ে চড়লাম ঘোড়ার পিঠে। দড়ির জিন্ আর লাগা অশ্বারোহীর হাতে গাছের একটা ডাল। তা হোক্, তাই দিয়েই ঘোড়ার ল্যাজের দিকে আঘাত করে বললাম, হট্, হট্!

    ঘোড়া পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলো, কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে দেখি রাণী তার ঘোড়া হাঁকিয়ে আসচেন সহাস্য বদনে। পাহাড়ের একটা বাঁকে এসে আমরা একত্র হলাম। তিনি বললেন, ‘ঘোড়া আমাদের ছুটিয়ে দিই, পিছনে ধুলো উড়ুক, ওরা যেন দেখতে না পায়, কী বলেন?’

    বললাম, ‘কিন্তু তারপর?’

    ‘তারপর আবার কী, শাসন আর সন্দেহ মাথা চাপড়াতে থাকুক, আমরা এগিয়ে যাই।’

    ‘তারপর?’

    ‘তারপর, কা’র ঘোড়াটা ভালো তাই দেখচি।’-বলে তিনি হাসলেন।

    বললাম, ‘আমারটাই ভালো।’

    ‘ছাই ভালো, ওর চেয়ে আমারটার তেজ বেশি।’

    ‘আমারটা বেশি ছোটে।’

    ‘ছুটলেই আর ভালো হয় না, যেখানেই থামে সেখানেই মরে।’

    সূর্যদেব নামচেন অস্তাচলে। কোথাও কোথাও গাছে অরণ্যপক্ষীর সান্ধ্য কাকলী শুরু হয়েছে। দক্ষিণে নদীর উপরে নাচে ছায়ান্ধকার। দু’জন সহিস চলেচে পাশে-পাশে, তারা জমিয়েচে গল্প। আমরাও চলেচি পাশাপাশি। যেন স্বপ্নলোক থেকে দুটি পক্ষীরাজ আমাদের দুজনকে নিয়ে নামচে-নেমে আসচে শূন্যলোক পেরিয়ে।

    স্বর্গ থেকে বিদায়। ডাক এসেচে মর্ত্যভূমির, সেখানে আবার ফিরে যেতে হবে। সেই কলহ-কলঙ্ক, বিদ্বেষ ও মালিন্য, সামান্য স্নেহ ও প্রেম, শৌখীন বন্ধুত্ব, নগণ্য আত্মীয়তা। তবু ফিরে যেতে হবে। মহাপ্রস্থানের পৌরাণিক পথ ছেড়ে এসেচি কর্ণপ্রয়াগে; এপথ ঐতিহাসিক, দক্ষিণ-পূর্বে টিহরী-সীমানা মেহলচৌরী হয়ে এই পথরেখা চলে এসেচে বর্তমান সভ্য ভারতের দিকে, মানবসমাজকে এসে স্পর্শ করেছে। স্বর্গ প্রবাসে বহুদিন অতীত হয়েছে, স্মৃতি ও বিস্মৃতির একটি গোধূলি-আলোয় নেমে চলেচি, কানে আসচে মর্ত্যভূমির ক্ষীণ কলরব, জীবনের বিচিত্র জটিলতা হাতছানি দিয়ে ডাকচে। চল্, আবার নিচে নেমে চল্।

    মেহলচৌরী রইলো পিছনে। চড়াই পথে যাত্রীরা ধীরে-ধীরে উঠচে। আমাদের ঘোড়া চলেচে মন্থর গতিতে। সহিসরা আসচে পিছনে-পিছনে। দক্ষিণে খদের নিচে দিনন্তকালের অন্ধকার গুটি-গুটি দল পাকাচ্চে। সম্মুখে পর্বতের পারে পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে উঠেচে, সন্ধ্যা এসে বসচেন অপরাহ্ণের আসনে। বাম দিকের সানুদেশে চিড়-জঙ্গলে মন্থর বাতাস মাঝে মাঝে গুঞ্জন– ধ্বনি তুলে চলেচে। এদিকের পথ অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত,-রাণী তার ঘোড়া নিয়ে পাশাপাশি চলেচন। এক সময় বললেন, ‘ঠিক আমরা চলেচি ত, পথ ভুল হবে না?’

    বললাম, ‘এ-পথ ত ভুল হবার নয়, সোজা রাস্তা।’

    অল্প অল্প আলাপ চচে। যে-কথাটা বল্‌চি সে- কথাটা নিজেও শুচি, তিনিও বোধ করি কান পেতে আছেন তাঁর নিজের কথার প্রতি। এমনিই হয়। নিজের কথা যখন নিজের কানে শুনি, বুঝতে হবে কথার অতীত বস্তুকে আমরা উপলব্ধি করি।

    ‘চারিদিক কী সুন্দর হয়ে উঠেচে দেখচেন?’

    চারিদিক দেখলাম বটে, কিন্তু সে বিস্ময়কর রূপ বাহিয়ের, না আমারই অন্তরের? নারীর মধ্যে রয়েচে একটি রসের প্রকৃতি, হলাদিনী শক্তি, সে-শক্তি পুরুষের মধ্যে স্ফুরিত করে আনন্দ, অনুপ্রেরণা, মন্দিরের নিদ্রিত দেবতার কানে কানে বলে জাগরণীগান; মন নদীর পথে নামে বর্ষার ঢল, তার সর্বাঙ্গে আনে বেগ, তোলে জোয়ার, তাকে সক্রিয় করে, ছুটিয়ে নিয়ে চলে পরম লক্ষ্যের দিকে। কিন্তু আমার মধ্যে জোয়ারের প্লাবনের এই অধীন উচ্ছ্বাস-এর লক্ষ্য কতটুকু? এর গতি কোন্ দিকে? আমি ত’ জানি, আমাদের সামনে-পিছনে দু’দিকেই অজানা, শুধু মাঝখানের ক্ষণ-পরিচয়ের স্বল্প সীমানাটটুকুর মধ্যে আমাদের দুজনের চলাফেরা! হয়ত সেখানে অন্তরঙ্গতার একটুখানি আলো পড়েচে, হয়ত হলাদিনী শক্তির একটুখানি ক্ষণিক বিহ্বলতা দেখা দিয়েচে, কিন্তু তারপর আর কিছু নয়, আর কিছু নেই, আর কিছু থাকবে না। যেদিন ফিরে যাবো, দুজনে হারিয়ে যাবো দুই জগতে, মন-জানাজানির দাগ যেদিন মিলিয়ে যাবে, সেদিন ব্যবধানের দুই পারে ব’সে একজন কি আরেক-জনকে মনে করে কৌতুক করবে না? বিদ্রুপ করবে না নিজেকে?

    ঘোড়ার পিঠে গাছের ডাল আঘাত করে রাণী পুনরায় বললেন, ‘এবার কিন্তু আর আপনাকে চেনা যাচ্চে না।’

    ‘কেন?’

    ‘সন্ন্যাসী হয়েচে গৃহী। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবী, মাথায় পাগড়ি, বোধহয় এর রংটা এক সময় ছিল গেরুয়া! পুরুষ মানুষের চেহারা বড় তাড়াতাড়ি বদলায়!’

    বললাম, ‘বদ্‌লায় না কেবল মেয়েদের। তীর্থই করুক আর ঘোড়াতেই চড়ুক, আসলে তারা একই?”

    দু’জনেই আমরা হেসে উঠলাম।

    ‘খুব খানিকটা স্বাধীনতা পাওয়া গেচে কিন্তু, যাই বলুন। দিদিমাকে আমি বড় ভয় করি।’

    ‘তবে এই যে বললেন আপনি কারো অধীন নন্?’

    ‘সেটা নিতান্ত আর্থিক স্বাধীনতা—’ রাণী বললেন, ‘কিন্তু জানেন আমি কী ভয়ানক পরাধীন?’

    চুপ করে রইলাম।

    ‘এই অবস্থা হয়ে পর্যন্ত আমার অপমানের আর শেষ নেই! বাড়ির বাইরে পা বাড়ানো নিষেধ, জ্ঞাতি ভাই-ভগ্নিপতিদের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ, বই-কাগজ পড়া সকলের অপছন্দ-তার কারণ কি জানেন?-বয়স আমার অল্প। এই পিসিমাকে বড় ভয় করি; কারণ দেশে গিয়ে ভালো কথাটা উনি বলবেন না; মিথ্যেটাকেই বড় করে তুলে ধরবেন। দুঃখ আমায় বন্ধুর মতো চিরদিন আশ্রয় করেচে।’

    তাঁর নিশ্বাসে বাতাসটা ভারী হয়ে উঠলো। কথা আর মুখে কিছু এল না, চুপচাপ ঘোড়া হাঁকিয়ে চলতে লাগলাম।

    পথ এবার প্রথম দিকটা চড়াই, তারপর সমতল, চলতে আর বিশেষ কষ্ট নেই,-কিন্তু সেই পথের নানা বাঁক, নানা জটিলতা। কোথাও বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হচ্চে, কোথাও বা আমরা ঢুকচি একেবারে পাহাড়ের অন্দর-মহলে। ঘোড়া দুটি আমাদের শান্ত ও নিরীহ, তাদের চালাবার প্রয়োজন নেই, নিজেদের খেয়ালে তারা বৈরাগীর মতো উদাসীন হয়ে চলেচে। তারা জানে আমরা কতদূরে যাবো, কোথায় যাবো।

    এই দীর্ঘ তেত্রিশ দিনে যে অগণ্য যাত্রীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তাদের কথা ভাবচি। আজ তারা যদি আমাকে দেখে তবে চিনতে পারবে না। তেত্রিশ দিন ধরে যে-মানুষ, স্বল্পভাষী, নির্লিপ্ত ও উদাসী, আজ তার সেই চেহারার বদল হয়েচে। যে-মানুষ বিজনী, ছান্তীখাল, গুপ্তকাশী, রামওয়াড়া, উখীমঠ প্রভৃতির চড়াই-পথ মুখ বুজে পার হয়ে এসেচে, আজ তার এই শৌখীন অশ্বারোহণ,- তারা সত্যি অবাক হয়ে যেত। তাদের ধারণা আমি পাথরের কুচির মতো কঠিন, আমার মতো কষ্টসহিষ্ণু এবং স্বাস্থ্যবান যাত্রী এ-বছর নাকি একজনও আসেনি। তারা বোধ হয় দেখলেও বিশ্বাস করবে না যে, আমি আজ হয়েচি ফোয়ারার মতো মুখর, আমার মনের আকাশে চলচে রঙের খেলা, আমার সন্ন্যাসীবেশ খসে পড়েচে, অপরিচিতা এক নারীর সঙ্গে অরণ্যের পথে ঘোড়ায় চড়ে চলেচি, আমার ফুরিয়ে গেচে বদরীকাশ্রম যাত্রা, শেষ হয়ে গেচে তীর্থপথ! বিশ্বাস তারা করবে না, কারণ, সংসারের নিয়মই এই। সোজা মাপকাঠি দিয়ে মানুষকে আমরা মেপে রাখি, বিশেষ একটা গণ্ডীর মধ্যে তাকে আবদ্ধ করি, যার রঙ শাদা তাকে চিরদিন শাদা বলেই জেনে রাখতে চাই। জীবনের সহজ বিকাশকে ভয়ে-ভয়ে এড়িয়ে চলা সাধারণ মানুষের স্বভাব-মানব-ধর্ম কেবলই চাইচে পরিপূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করতে। যারা নীতির ক্রীতদাস, সমাজের চলতি সংস্কারের কাছে যারা আত্ম- বিক্রয় করেছে, চিত্তধর্মকে শত-শত কঠিন বন্ধনে বেঁধে যারা জীবনকে সংকুচিত করেচে, বঞ্চিত করেছে-আত্ম-বিকাশের পদ্ধতির সঙ্গে তাদের পরিচয় নেই।

    মানুষের সহজ প্রকৃতি, কেন বন্ধন-জর্জর? সহজ আনন্দের ক্ষুধা কেন নাগপাশে জড়ানো? মস্তিষ্ক কেন ন্যায়-অন্যায়ের বিচারবোধ দ্বারা ভারাক্রান্ত? সহজ হয়ে বাঁচা, সুস্থ মনে বাঁচা আমাদের কাম্য, সূর্যদেবতার দিকে শতদলের মতো বিকশিত হয়ে ওঠা আমাদের সাধনা-তবে কেন এত মন্দির, এত মসজিদ আর গীর্জার বাহুল্য? যারা ধর্মধ্বজী আর নীতিপ্রচারক-তারা কেন শাসন-শৃঙ্খল ছিন্ন ক’রে উন্মত্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে রণক্ষেত্রে? কেন এই হিংসা, হানাহানি, রক্তপাত আর সমাজবিপ্লব? যারা যুদ্ধ বাধায়, যুদ্ধ করে, যুদ্ধে মরে, যারা শান্তি আনে, আবার শান্তি ভাঙে, যারা আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য লক্ষ লক্ষ খুনীকে উত্তেজিত করে তোলে-তারা কে? দেবতা, না শয়তান? মানুষের হৃদয়ের ভাষা কেন শুকিয়ে মরে লোকচক্রান্তে? ভালোবাসা কেন পথের ধারে আঁচল পেতে উপবাসে মরে? মানুষের বহু তপস্যালব্ধ দেবত্ব কেন বার বার দানবীয় হিসেবে লৌহচক্রের তলায় দলিত হয়ে যুগে যুগে? কেন শান্তিবাদ, প্রেম, দয়া, স্নেহ, স্বপ্ন, সৌন্দর্যবোধ, দেবত্ব- চেতনা-ইত্যাদির মহত্তর জীবনদর্শনের সমস্ত আদর্শবাদ চূর্ণ করে আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ বারম্বার ছুটে যায় সর্বনাশা স্থুল বুদ্ধির পথে? কেনই বা আত্মসৃষ্ট হিংসা ঘৃণা বিদ্বেষ লোভ ক্রোধ মত্ততা-এদের অতিক্রম করে মানুষ আবার ফিরে আসে আনন্দের মধ্যে? মানুষ কি চিররহস্যময় নয়?

    আজ আমাকে বিশ্বাস তারা করবে না। এমন কথা তাদের কেমন করে বোঝাবো, শীতের পরে আসে বসন্ত, তারপরে নেমে আসে বর্ষা। একদা নিগূঢ় ধ্যান-তপস্যায় শংকরাচার্যের উত্তরধামের পথে চলেচিলাম, পরনে গৈরিকবাস, পিছনে বিলম্বিত জটা, সঙ্গে ছিল শ্মশানের প্রেতসঙ্গীদল, চক্ষু ছিল শিবনেত্র; উত্তরের হাওয়ায় দিনে দিনে আমার হৃদয়ের ভিতরে জমেছিল তুষারের স্তর,কঠিন নিশ্চল হিম-মরুরাশি। তারপরে নেমে এলাম চঞ্চল বসন্তের উপবনে, মালতী- মল্লিকা ছাওয়া অরণ্য-বীথিকায়, দক্ষিণের দাক্ষিণ্যে পেলাম খুঁজে মাধুর্যের আনন্দ! অস্থিমালার পরিবর্তে আমার অঙ্গে অঙ্গে আজ রাঙা পলাশের স্তবক; মাথায় ঋতুরাজের সোনার মুকুট, চিতাভস্মের বদলে পুষ্পরেণু, হাতের শিঙা হয়েছে বাঁশরী,-বসন্তের বন্যায় বৈরাগ্য ভেসে গেচে।

    .

    রাণী বললেন, ‘নিজের কথা বলে আপনাকে হয়ত দুঃখই দিলাম!’

    দূরে তখন বিভ্রাণী চটির আলো দেখা দিয়েচে। বললাম, ‘তা’তেই বা কুণ্ঠা কেন, দুঃখই আসে দুঃখের অতিথি হয়ে।’

    ‘বেশ, তাই আসুক।’ তিনি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, মনে আছে আপনার, রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটা?’-বলে তিনি নিজেই কোমল কণ্ঠে বলতে লাগলেন,-

    ‘রাজপথ দিয়ে আসিয়ো না তুমি, পথ ভরিয়াছে আলোকে
    প্রখর আলোকে।
    সবার অজানা, হে মোর বিদেশী,
    তোমারে না যেন দেখে প্রতিবেশী,
    হে মোর স্বপনবিহারী!
    তোমারে চিনিব প্রাণের পুলকে,
    চিনিব সজল আঁখির পলকে,
    চিনিব বিরলে নেহারি,
    পরম পুলকে।
    এসো প্রদোষের ছায়াতল দিয়ে, এসো না পথের আলোকে,
    প্রখর আলোকে।’

    হেসে বললাম, ‘ভদ্রলোক দেখচি মন্দ লেখেন না। আচ্ছা, এবার কিন্তু আমি এগিয়ে যাই।’

    ঘোড়াকে ছুটিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু ছোটানো অত সহজ নয়। আঘাত করলে খানিকটা এগোয়, আবার দেখতে দেখতেই তার গতি মন্থর হয়ে আসে। এমনি করেই চটির কাছাকাছি যখন এসে ঘোড়া থেকে নামলাম তখন বেশ অন্ধকার হয়েছে। সম্মুখে পাশাপাশি খান দুই কোঠা, কোলে বারান্দা, প্রথম চটিটার নিচে বেশ বড় একখানা খাবারের দোকান-রাতটা তবে মন্দ কাটবে না। চারিদিকে নানা গাছের জঙ্গল, পিছন দিকে খানিকটা খোলা সমতল জায়গা, পথের এপারে শানবাঁধানো একটা ঝরনা। একটু আগে বোধ করি এখানে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেচে, সমস্তটা স্যাঁতস্যাত করচে।

    চৌধুরী মশায় সদলবলে এসে হাজির হলেন। প্রথম চটির দোতলায় সবাই মিলে আশ্রয় নেওয়া গেল। পাশের বাড়িটায় একদল হিন্দুস্থানী ও মাড়োয়ারী এসে উঠলো। ঘোড়াগুলোকে নিয়ে মহেন্দর সিং ও প্রেমবল্লভ ঘাস-জল খাওয়াতে কোথায় নিয়ে গেল,—কথা রইলো ভোর রাত্রে আবার তারা এসে হাজির হবে। মোটঘাট খুলে দোতলার ঘরে ও বারান্দায় চৌধুরী মশায়রা বিছানা পাতলেন, নিচের পুরীর দোকান থেকে যৎসামান্য জলযোগের ব্যবস্থা হলো,-রাণী একটা বাতি নিয়ে ঝরনা থেকে জল নিয়ে গেলেন। বয়স যাদের অল্প, পরিশ্রমের ভাগটা তাদের উপরেই বেশি পড়ে।

    আহারাদির পর্ব শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই শয্যাগ্রহণ। ইতিমধ্যে সেই ট্যারোচোখো পিসির সঙ্গে কার যেন একটু মনোমালিন্য হলো, তিনি জলগ্রহণ না করেই বারান্দার ধারে কাঁথা-কম্বল বিছিয়ে শুলেন। পিসির সমস্ত হাসি-রসিকতার পিছনে থাকে একটি বিষাক্ত সাপের ফণা মানুষকে অতর্কিতে ছোবল মারাই তার রীতি। কিন্তু এই বিলীয়মান কোলাহলের ভিতর দিয়ে ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে তাকিয়ে যে দৃশ্য আমি সেদিন দেখেচি তা আজো স্পষ্ট মনে করতে পারি। রাণী যে দীক্ষা নিয়েচেন, সকাল-সন্ধ্যা তিনি যে জপে বসেন তা আমি জানতাম, আড়ালে-আবডালে লক্ষ্য করেচি। কিন্তু তার চেহারা যে এমন তা এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। সম্মুখে লন্ঠনের আলো জ্বল্‌চে, তারই কাছে আসনের উপরে তিনি ধ্যানে বসেচেন, চক্ষু দুটি মুদিত; মুখের উপরে শুধু যে তাঁর একটি অপূর্ব লাবণ্য ও দীপ্তি ফুটে উঠেচে তাই নয়, সে-মুখে একটি প্রশান্ত পবিত্রতা, সংযম ও সহজ কৃচ্ছ্র-সাধনার একটি অনির্বচনীয় মাধুর্য,–এমন জ্যোতির্ময় রূপ সহসা চোখে পড়ে না। আমি নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মানুষের চরিত্রের যারা সমালোচনা করে তাদের কথা আমি ধরিনে কিন্তু এর সঙ্গে আমার পরিচয় অল্পদিনের, কথায়-আলাপে প্রথমটা নানা বিরূপ ধারণা করেচি এর সম্বন্ধে,−সে ধারণা আমার সত্য নয়। তথাকথিত শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েদের জানি, এখনকার সমাজে তাঁদের সংখ্যা বেশ ভারী হয়ে উঠেচে; তাদের চাল-চলনে ও আচার-ব্যবহারে কলেজী ঢঙ, চেহারায় পালিশ, চরিত্রে চটুলতা, ছলনায় ভরা ভঙ্গী,—জানি তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার গোপন-তত্ত্ব। তাই প্রথম-প্রথম এঁর অনর্গল হাসি, বুদ্ধিদীপ্ত কথা, নিঃসংকোচ ব্যবহার ও সরস কথালাপ স্মরণ করে কখনো কখনো-ভ্রূ-কুঞ্চন করেছি তার প্রতি,—মনে হয়েছে ইনিও ত তাই, সেই একই বিরক্তিকর চরিত্রের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু না, এখানে মত পরিবর্তন করতে হ’লো! সেই রাত্রি, সেই অন্ধকার, সেই নানাজাতীয় যাত্রীর জটলা, সেই স্তিমিত দীপালোক, তার মাঝখানে বসে মন বললে, সাধারণের কোঠায় অবস্থান নির্দেশ করে দিয়ো না, তা’তে নিজেই তুমি ছোট হয়ে যাবে। মেয়েরা তোমার চোখে বড় যদি না হয় ক্ষতি নেই কিন্তু তোমার চোখের দোষে তারা যেন ছোট না হয়।

    পৃথিবীতে এত নাস্তিকতা, সন্দেহবাদ ও সিনিসিজম্, মনের এত মালিন্য ও চরিত্রের এত অধঃপতন, সাহিত্যের সুলভ রোমান্টিসিজম্ ও শৌখীন কল্পনা, সত্য ও ন্যায়ের তথাকথিত আদর্শের প্রতি মানুষের এত অবিশ্বাস-কিন্তু তৎসত্ত্বেও যা কিছু সদ্‌গুণ মানব-চরিত্রকে উজ্জ্বল করে তার মূল্য আমরা না দিয়ে থাকতে পারিনে। মানুষ যে-যে গুণের দ্বারা মহীয়ান্ হয়ে ওঠে, যেখানে সে দৃঢ় নৈতিক শক্তির পরিচয় দেয়, সেখানেই আমরা তার কাছে মাথানত করি। সেখানে তর্কও নেই অবিশ্বাসও নেই, সেখানে নতজানু হয়ে আমরা বলি, তুমি সাধু, তুমিই মহাত্মা।

    রাত্রে শীত পড়লো, কিন্তু কম্বলখানি ছাড়া যখন দ্বিতীয় শয্যা নেই তখন তাই নিয়েই বারান্দার এক কোণে স্থান নেওয়া গেল। উত্তর ও দক্ষিণ দিক খোলা, হু হু করে বাতাস বইচে,-নিচের গোলমাল শান্ত হয়ে এল, পাশের হিন্দুস্থানী দলের একঘেয়ে গানের গোঙানিও থেমে আসচে, আমার চোখে তন্দ্রা জড়িয়ে এল। মাথার কাছে চৌধুরী মশায় শুয়েচেন, অতি অমায়িক মানুষ এই চৌধুরী মশায়,—তারই পায়ের দিকে শুয়েচে ট্যারাচোখে পিসি, ধাঁধা করে পিসির নাক ডাকচে! বারান্দার ভিতর দিকে দলের অন্যান্য বৃদ্ধারা,-ঘরের ভিতর আছেন দিদিমা ও রাণী। রাত্রি নীরব ও নিশুতি, দু’দিন আগে গেচে অমাবস্যা। দ্বিতীয়ার শীর্ণ চন্দ্র কখন পশ্চিম আকাশে অদৃশ্য হয়ে গেচে, চারিদিক ঘোর অন্ধকার। পরিচ্ছন্ন নক্ষত্রগুলি দপ্ দপ্ করে জ্বল্‌চে।

    শীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিলাম, কেমন করে না জানি একসময় ঘুম ভেঙে গেল। আজ হাঁটা হয়নি, অতএব পরিশ্রমও নেই, গভীর নিদ্রা চোখে আর আসতে চাইচে না। একবার তাকিয়ে আবার চোখ বুজলাম। পরে আবার ছাঁৎ করে ঘুম ভাঙলো। মৃদু-লঘু পদশব্দে অন্ধকারে দৃষ্টি মেলে নিঃশব্দে তাকালাম। দেখি, অতি সন্তর্পণে একটি মানুষের ছায়া নিকটে এসে একবার ইতস্তত করে আবার ফিরে গেল। ঘরের ভিতরের অতি ক্ষীণ আলোকিত রাণীকে চিনলাম কেমন যেন অহেতুক আশঙ্কায় আড়ষ্ট হয়ে চোখ বুজে পড়ে রইলাম।

    পরদিন প্রভাতে ঘোড়া নিয়ে সর্বাগ্রে বেরিয়ে পড়লাম। আগে-আগে বেরিয়ে পড়াই যুক্তিযুক্ত মনে করেচি। বেরোবার সময় পিছনেও তাকাইনে, আগ্রহও দেখাইনে, যেন কতই উদাসীন। মাঝপথে রাণী পিছন থেকে এসে-যে আমার সঙ্গ নেন, তারপর দুজনে গল্প করতে করতে চলি, একথা কারো মনেও হয় না। অথচ তারা যে আমাদের পাহারা দিতে-দিতে আসবেন, চোখে-চোখে রাখবেন তার উপায়ও নেই; তারা আসছেন পায়ে হেঁটে, আমরা চলেচি ঘোড়ার পিঠে। আমাদের এই কলা-কৌশল সম্বন্ধে আলোচনা করে আমরা নিজেরাই হাসাহাসি করি। সামাজিক মানুষের মনের চেহারা আমরা জানি,-নর-নারীর স্বাধীন মেলামেশা, সহজ বন্ধুত্ব, পরস্পরের প্রতি স্বাভাবিক মমত্ববোধ, এসব তাদের চোখে অতিরিক্ত বিসদৃশ। স্ত্রী-পুরুষ সম্বন্ধে তাদের চিরদিন একই ধারণা, অন্য কিছু নেই। এই সামাজিক ও সংস্কারাচ্ছন্ন মনের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করতাম, তাকে জব্দ করবার জন্য আমাদের আগ্রহও বেড়ে যেত, তাদের শাসন সন্দেহ ও বাঁধাবাঁধিকে তাচ্ছিল্য করে আমরা গর্বভরে ‘কুচ পরোয়া নেই’ বলে চলে যেতাম, তারা আমাদের ধরাছোঁয়া পেত না।

    সকালবেলা সেদিন পিছন থেকে এসে তিনি ধরলেন। ফিরে দেখি, দুটি চোখ তার ঘুম-জড়ানো, গতরাত্রে বোধকরি সুনিদ্রা হয়নি,-মুখে হাসি। বললেন, ‘গুড মর্নিং! চ্চু, চ্চু, একটু আস্তে চল্ বাবা, তুইও কি বিরূপ হ’তে চাস্‌? এই প্রেমবল্লভ, বিন্দুকে একবার ধমক দে ত’! ঘোড়াটা দেখি পিসিমার চেয়েও এককাঠি!”

    হাসছিলাম। তিনি বললেন, ‘কাল রাত্রে একটু অন্যায় করে ফেলেছিলাম, – জানি আপনি ক্ষমা করবেন।’

    ‘কী বলুন ত?’

    তিনি সলজ্জকণ্ঠে বললেন, ‘শীতে আপনি কুণ্ডলী হয়ে পড়েছিলেন, একখানা কম্বল দিতে গিয়েছিলাম; কিন্তু দেবার সাহস হ’লো না। দু’পা এগোই আবার তিন-পা পিছিয়ে আসি,-রাত নিশুতি কিনা?‘

    চুপ করে রইলাম। তিনি বললেন, ‘ভয় পেলাম, সকালবেলা যদি আপনার ঘুম ভাঙতে দেরি হয়? লোকে দেখবে আমার কম্বল আপনার গায়ে! ওমা, কী জবাব দেবো? তার চেয়ে হোক্ কষ্ট আপনার, অনেক সহ্য করেছেন আপনি।- ভালো কথা, এই কবিতার টুকরোটা আপনি মুখস্থ করবেন। বদরীনাথের মন্দিরে বসে এইটি আমি আবৃত্তি করেছিলাম।’-এই বলে ঘোড়ার পিঠের উপর থেকে তিনি একখণ্ড কাগজ আমার হাতে দিলেন।

    কাগজখানা হাতে নিলাম, কিন্তু তিনি আর অপেক্ষা করলেন না, লাগামটার হেঁচকা দিয়ে নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেলেন।

    সেদিন জ্যোতির্ময় প্রভাত। অরণ্যে-অরণ্যে সূর্যদেবতা তখন ঐশ্বর্য ছড়িয়ে দিচ্চেন। একহাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে অন্য হাতে কাগজখানি খুলে পড়লাম-

    ‘মোর মরণে তোমার হবে জয়।
    মোর জীবনে তোমার পরিচয়।
    মোর দুঃখ যে রাঙা শতদল
    মোর ঘিরিল তোমার পদতল,
    মোর আনন্দ সে যে মণিহার
    মুকুটে তোমার বাঁধা রয়।
    মোর ত্যাগে যে তোমার হবে জয়।
    মোর প্রেমে যে তোমার পরিচয়।
    মোর ধৈর্য তোমার রাজ-পথ,
    সে যে লঙ্ঘিবে বন-পর্বত,
    মোর বীর্য তোমার জয়রথ।
    তোমার পতাকা শিরে বয়।’

    কিছুদূর এসে আবার তাকে পাওয়া গেল। তিনি ঘোড়া থামিয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন। পুরাতন গল্পের সূত্র ধরে পুনরায় আমরা একত্র চলতে শুরু করলাম। অনেক কথা তাঁর কাছে সংগ্রহ করে চলেচি। নিজের কর্মধাররা পরিচয় তিনি দিতে চান না, তাঁর লজ্জা আছে, তার চেয়ে বেশি আছে বিনয় ও নম্রতা। কিন্তু আমি ছাড়বার পাত্র নয়, তাঁর সব কথা জানতে চাই, আমার সাহিত্যিক প্রাণ পরম কৌতূহলে জেগে উঠেচে, তার দুঃখ-কাহিনীর মধ্যেও আমি গভীর আনন্দ প’ই। আমার কল্পলোকে তাকে নূতন করে সৃজন করতে থাকি, আমার অনুপ্রেরণার সকল আগল তিনি খুলে দিয়েচেন।

    ধীরে ধীরে চলেচি। তাঁর কথায় অজস্রতা, প্রাণের দুর্বার বন্যা-তারই প্রবাহে তার গল্প ভেসে চলেচে মুক্তধারায়।

    আমাদের আলোচনা হয় সমাজ, সাহিত্য ও সাধারণ জীবনযাত্রা সম্বন্ধে। তিনি উঁচুদরের বিদুষী মোটেই নন্, কিন্তু সমস্ত বিষয়ে তাঁর একটি সুনির্দিষ্ট ও সুদৃঢ় মতামত পেয়েচি। নিজের জীবন দিয়ে যে-বস্তু তিনি হৃদয়ঙ্গম করেননি তাকে কেবল তর্কে মেনে নিতে তিনি কোন মতেই রাজি নন্। সমস্ত কথালাপের ভিতর দিয়ে তার একটি সুরুচিসম্পন্ন ও ভদ্র মন আনাগোনা করে। মনটা তাঁর উত্তমরূপে সংস্কৃত।

    –

    মেয়েরা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে পুরুষের সংস্পর্শে এসে। নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা তার কম নয়, বহু দেশ পর্যটন করেছেন, বহু পরিবার ও পরিজনের মধ্যে মানুষ। এক ছোকরা ডাক্তারের সঙ্গে তার বিবাহ হয়, পশ্চিমের এক শহরে তিনি সংসার রচনা করতে যান, সেখানে স্বামীর কাছেই গানবাজনা, সামান্য ইংরেজী লেখাপড়া, হিন্দী ও উর্দু শেখেন,-শিক্ষয়িত্রীর কাছে শেখেন নানা শিল্পকাজ, সেলাইয়ের মেশিন চালানো, ছবি আঁকা,-কিন্তু সে অল্পদিন মাত্র, সেই নিভৃত সুখময় জীবন বিধাতার চক্ষে সইলো, স্বামীর হলো অকালমৃত্যু, তাঁকে মাথার সিঁদুর মুছে খালি হাতে ফিরে আসতে হলো। যে-বয়সে নারীর মন সংসার-স্বপ্নের ইন্দ্রজাল বোনে, সন্তান-সন্ততির ক্ষুধায় যে-বয়সে নারীর মাতৃ- হৃদয় বাৎসল্যরসে উচ্ছ্বসিত হতে থাকে, সেই বয়সে তার এত সম্ভবনাময় জীবন উত্তীর্ণ হয়ে এল দিক্‌চিহ্নহীন মরুভূমির পথে, সকল গতি হ’লো রুদ্ধ। ঝড়ে যে- পাখীর বাসা বিধ্বস্ত হয়ে গেচে তার আশ্রয় এখন গাছে-গাছে, কখনো তিনি থাকেন শ্বশুরবাড়িতে, কখনো মামার বাড়িতে, কখনো-বা এখানে-ওখানে। মামার বাড়িতে বেশির ভাগ থাকাই এখন সুবিধা। সুবিধা মামার বাড়িরই বেশি। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত কাজের চাকায় তিনি বাধা। সংসারের হিসাব-পত্র ভাড়ারের চাবি, ছেলেমেয়েদের তদ্বির, আপিস ইস্কুলের রান্নার আয়োজন, দাদামশায়ের সেবা,-অর্থাৎ নিশ্বাস নেবার সময় নেই। তার হাতে কবিরাজি ও হোমিওপ্যাথি ঔষধের আড়ৎ, অনেকেই আসে তার কাছে ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থা নিতে। যে-পল্লীতে তিনি থাকেন সেখানকার মেয়েরা দুপুর বেলায় তাঁর কাছে আসে সেলাই শিখতে, লেখাপড়া করতে। তিনি তাদের জামা, সেমিজ, ফ্রক ইত্যাদি তৈরি করে দেন। তাঁর জন্য বাড়ির কোথাও জঞ্জাল জমে না, ঘরদোর তাঁকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। বাড়িতে কেউ পীড়িত হলে সেবা-শুশ্রূষার ভার তার উপর। পালা-পার্বণ, পূজা-আর্চা নিয়ম-নিত্য-সমস্ত কিছুর আয়োজন ও বিলিব্যবস্থা তার হাতে। শ্বশুরবাড়ি মাঝে মাঝে যান, শাশুড়ী তাঁকে স্নেহ করেন, দেবর ও ভাশুর তাকে সম্মান করেন, কিন্তু সেখানে আছে নাকি স্বার্থের গন্ধ! তাদের ইচ্ছা, ভ্রাতৃজায়া তাঁদের সংসারে এসে থাকুন, মাসে-মাসে মাসোহারার টাকাগুলি তাদের হাতে আসুক,-কিন্তু এই গোপন স্বার্থপরতা রাণীর দৃষ্টি এড়ায়নি। যার জন্য শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তার মৃত্যু এক দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি করেচে।

    ‘শ্বশুরবাড়িতে শোষণ আর মামার বাড়িতে শাসন।’-রাণী বললেন, ‘মনে পড়ে কিছুকাল আগে পর্যন্তও একটু বিলাসপ্রিয় ছিলাম- ‘

    মুখের দিকে তাকাতেই তিনি হেসে বললেন, ‘ভারি অন্যায় বিধবার বিলাসপ্রিয়তা,-নয়? কিন্তু সে অতি সামান্য, ফল। জামা-কাপড় পরা আর চুল আঁচড়ে খুশি থাকা এমন কী অপরাধ? অথচ সেই অপরাধে দাদামশাই একদিন ডেকে যখন আমার চুল ছেঁটে ফেলতে বাধ্য করলেন, তিন দিন আমার চোখের জল পড়েচে,-আমার চুল পায়ের কাচে পড়ত! জানি চোখের জল ফেলা ছেলেমানুষী সর্বস্ব ত্যাগ করলেই বিধবার জীবন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তাও জানি কিন্তু বলতে বলতে তিনি ম্লান হাসি হাসলেন।

    মাসিচটি পার হয়েচি। পথ সমতল, কোথাও-কোথাও গ্রামের চিহ্ন দেখা যাচ্চে। গাছের ছায়ায় ঢাকা চওড়া পথ, পাহাড়ের চূড়াগুলি দূরে দূরে সরে গেচে। পল্লী-প্রান্তর নীরব, হু হু করে বসন্তকালের হাওয়া চলেছে। পথে আর ঝরনা পাওয়া যাচ্চে না, রামগঙ্গা নদী আছে কাছাকাছি। বুড়কেদারে মধ্যাহ্নের আহারাদি শেষ করে আবার অগ্রসর হলাম। আজকাল সুখ এবং স্বস্তি দুই লাভ করেচি। ঘোড়ায় চড়ে চলি এবং দিদিমার কাছে রাঁধা ভাত পাই, বাসন মাজতে হয় না। যেদিন দুঃখের মধ্যে হরিদ্বার থেকে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেদিন স্বপ্নেও ভাবিনি এত আনন্দের ভিতর দিয়ে আমার যাত্রা শেষ হবে। চারুর মা প্রমুখ গোলদার দল একবেলার পথ এগিয়ে গেচে, ইচ্ছা হচ্চে ছুটে গিয়ে তাদের ধরে আমার সৌভাগ্যের কথা শোনাই। গোপালদার ধৈর্য ও সহনশীলতায় আমি সত্যই বিস্মিত ও মুগ্ধ। কিন্তু একটা বড় চক্ষু-লজ্জার কারণ ঘটেছে, দিনের বেলা দিদিমা ও রাণী বেঁধে দেন, চৌধুরী মশাই যত্ন করে খাওয়ান অথচ মূল্য বাবদ কিছু গ্রহণ করতে রাজি নন্। আহারাদির সময় আমি সংকুচিত হয়ে উঠি। আমার সংকোচ ও চক্ষুলজ্জা দেখে রাণীও একটু ইতস্তত করেন। আমার সম্মানে আঘাত লাগা সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত সজাগ!

    সন্ধ্যায় পৌঁছানো গেল নলচটিতে। মনোরম স্থান। কাছেই একটা কদলীর জঙ্গল, তারই পূর্বদিকে ছোট্ট একটি ডাকঘর, ডাকঘরের নিকটেই ধর্মশালা। কিয়দ্দূরে একটি নিভৃত পুরাতন মন্দির, তারই কাছে জনকয়েক সংসারত্যাগী সাধুর একটি আশ্রম। ঘোড়া থেকে নেমে আমরা চটিতে এসে রাত্রির আশ্রয় নিলাম।

    আর সেই দুস্তর পথ নেই, সেই সংকীর্ণ আকাশ,-পর্বতরাজির জটলার মধ্যে প্রাণান্তকর চড়াই-উৎরাইও নেই। এখন আকাশের বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়, নদী এখন আর গর্জমান নয়, স্রোতের সেই অবিরাম ঝর-ঝর শব্দ আর নেই, এখন দেশের দিকে অনেকটা এগিয়ে এসেছি। সকালবেলায় যখন রাণীর সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন,-এবার একটু আগা-আলগা চলবেন, আবার ওরা সন্দেহ করেচে পিসি গোয়েন্দাগিরি করচে। বাস্তবিক, কী ইতর বলুন ত!’

    বললাম, ‘সবাই মানবে কেন আমাদের আচরণ?’

    ‘আপনার ঘোড়ায় চড়া নিয়ে ওরা নানা মন্তব্য করতে শুরু করেচে। এক কাজ করুন, ঘোড়াটা আপনি ছেড়ে দিন, তেমনি আগেকার মতন হেঁটে চলুন।

    ‘তাতে কী সুবিধে হবে?’

    ‘সুবিধে না হোক, সন্দেহ ঘুচবে। আর আপনার ঘোড়ায় চড়তে হবে না।’

    বললাম, ‘তথাস্তু।’

    তিনি বললেন একটা সামান্য কথা নিয়ে সন্দেহ। পথে দাঁড়িয়ে আপনি সেই-যে দুধ কিনে আমার হাতে দিয়েছিলেন, সেই কথা সালঙ্কারে পিসি বছিল দিদিমাকে। ভাগ্যি চৌধুরী মশাই ছিলেন সেখানে, তিনি বললেন, দুধ কিনে খাওয়ানোতে কোনো অন্যায় হয়নি। পথে এমন সবাই সবাইয়ের জন্যে করে।-যান্ আপনি এগিয়ে আঃ, একটু পা চালিয়ে হাঁটুন বলচি, ওরা আসচে।’

    সে এক কৌতুকপ্রদ ব্যাপার। যেন একটা সাংঘাতিক খেলায় মেতেচি দুজনে। বেশ বোঝা যায় মেয়েদের সম্বন্ধে মেয়েদের দৃষ্টি কী সজাগ, কেউ কারোকে বিশ্বাস করে না। কোথাকার কে এক সম্পর্ক-পাতানো পিসি, সঙ্গিনীদের চরিত্র-রক্ষার জন্য তার কী মাথা-ব্যথা এবং আগ্রহ। তার ধারণা, সে না থাকলে বাংলাদেশের বহু নারী চরিত্র ভ্রষ্টা হয়ে যেত। ভাগ্যি সে ছিল!

    রামগঙ্গার তীরে চৌখুটিয়া চটিতে এসে প্রচার করে দিলাম, কোমরে ব্যথা হয়েচে, ঘোড়ায় আর চড়বে না। রাণী অলক্ষ্যে হাসলেন। পাতার একখানি কুটীরের মধ্যে রান্নাবান্নর আয়োজন চলতে লাগলো। নিকটেই একটি গ্রাম, কয়েকখানি দোকান,-একখানি কামারের দোকানে হাতুড়ির কাজ চলচে। চটির পিছনে নদীর ধারে অল্প অল্প চাষ-আবাদের চিহ্ন দেখলাম। আজ অনেক দিন পরে স্নান করবার সুবিধা পাওয়া গেল। আবহাওয়াটা গরম। নদীর ধারাটি শীর্ণ, স্রোতোহীন, জল অতি নোংরা। তবু দোকানে যখন সাবান কিনতে পাওয়া গেল তখন আর কি, নদীর ধারে বসে ধুতি, পাঞ্জাবী ও চাদর পরিষ্কার করে নিলাম। দেখা গেল, ঘোড়, গোরু ও মানুষ পাশাপাশি স্নান করচে। রোদ বেশ প্রখর হয়ে উঠেচে; গ্রীষ্মদেশের দিকে এসেছি, কথায়-কথায় তৃষ্ণা পায়, পরিশ্রমের শক্তি কমে এসেছে। আর সামান্য পথ বাকি, দিন দুই পরেই আমরা রাণীক্ষেত গিয়ে পৌছব। স্নান সেরে এসে দেখি, পানীয় জলের নিতান্ত অভাব। পরম্পরায় জানা গেল, কিছুদূরে এক ভূমিগর্ভে চেয়ানো ঝরনার জল পাওয়া যায়। বাতি নিয়ে রৌদ্রপথে ছুটলাম। যে-উপায়ে সেদিন এক জলচিহ্নহীন শুষ্ক নদীর পাথরের নিচে থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে এনেছিলাম তা আজও স্পষ্টজনে পড়ে। দুই হাতে দুই বালতি জল এনে দিয়ে সকলকে খুশি করে দিলাম। আহারাদির পর দিবানিদ্রা। দিবানিদ্রার ভিত দিয়ে আমরা নূতন উদ্যম সঞ্চয় করি।

    নিদ্রার পর যথারীতি মোটঘাট বেঁধে যাত্রার আয়োজন করা গেল। ঘোড়ায় চড়ার নেশা ফুরিয়েচে, অতএব তার পিঠে ঝোলা-কম্বল চাপিয়ে এক বৃদ্ধাকে চড়িয়ে দিলাম, বৃদ্ধা আড়ষ্ট হয়ে চলতে লাগলো। অপরাহ্ণের রোদ্র তখনো রয়েচে। নিকটেই রামগঙ্গার পুল; পুল পার হয়ে দক্ষিণ দিকে আমরা অগ্রসর হলাম। পথ সমতল, দুধারে দেবদারু, খেজুর ও আমগাছের জঙ্গল, বাঁ-দিকে বহুদূর বিস্তৃত পাহাড়ের সানুদেশে চাষের জমি। সকলে একসাথেই চলেচি, রাণীকে নিভৃতে পাবার এবেলায় আর সুযোগ মিলচে না। ইচ্ছা করেই আজ চলেচি পিছনে-পিছনে। পাশে-পাশে আছেন চৌধুরী মশায়। পিসি রীতিমত পাহারা দিতে-দিতে দিদিমা ও অন্যান্য সঙ্গিনীদের সঙ্গে চলেচে। রাণীর দিকে তার প্রখর লক্ষ্য। বিড়াল যেন ওত পেতে থাকে ইঁদুর ধরার জন্য।

    কিন্তু বিধি সদয়। দেখতে-দেখতে আকাশের চেহারা গেল বলে। দিগ্‌ দিগন্ত আবৃত করে কৃষ্ণকায় মেঘ এল চারিদিক থেকে ঘনিয়ে। গাছের আগায় উঠলো ঝড়ের হাওয়া, দেখতে দেখতে মুষলধারে নামলো বর্ষণ। পাহাড়ের বৃষ্টি বিপজ্জনক, জলের ফোঁটাগুলি তীব্র ও ধারালো। সকলে বিভ্রান্ত হয়ে কে কোথায় আশ্রয় নেবে ঠিক নেই। কিন্তু আশ্রয়ই বা কোথায়? ভিজতে ভিজতে দ্রুতপদে চলা ছাড়া আর উপায় ছিল না। অনেকেরই কাছে ছিল অয়েলক্লথ-সাধারণত অয়েল ঢাকা দিয়ে এদেশে কাণ্ডিওয়ালারা যাত্রীদের মালপত্র বহন করে-সেই অয়েলক্লথের টুকরো মাথায় চাপিয়ে দিদিমা ও আরো দু একজন চলতে লাগলেন। রাণীকেও তারা এক টুকরো অয়েলক্লথে ঢাকতে ছাড়লেন না, ঘোড়ার পিঠে এক কিম্ভূতকিমাকার চেহারা নিয়ে তিনি চললেন। আমি পিছন থেকে হাসছিলাম।

    ঝড়। ঝড় আর বৃষ্টি। বৃষ্টি আর বজ্রপাত। গাছপালাগুলো যেন পাগলের মতো বেপরোয়া হয়ে উঠলো, বৃষ্টির বেগে চারিদিক প্লাবিত হতে লাগলো। ছুটতে ছুটতে কে কোথায় গেচে, চৌধুরী মশায় পর্যন্ত নিরুদ্দেশ। সেই দুর্যোগ ও জলধারার মধ্যে রাণী রাশ টেনে তার ঘোড়ার গতি মন্থর করে দিলেন। পাশ কাটিয়ে পার হয়ে যাচ্ছিলাম, তিনি ডেকে বললেন, ‘থাক্, আর ছুটতে হবে না, ভিজতে যেন কিছু বাকি আছে আপনার? না একটা ছাতা, না একটা ঢাকা,- আপনার সন্নিসিপনা দেখলে হাড় জ্বালা করে!

    ‘আপনি ত দিব্যি চলেচেন।’ মুখ ফিরিয়ে বললাম।

    ‘দিব্যি চলতে আর আপনি দিচ্চেন কই? ইচ্ছে হচ্চে আমিও হাল ছেড়ে দিয়ে ভিজে ভিজে চলি আপনার মতন। বলি, দেখলেন ত? এবার ওদের চিনতে পারলেন? পরের জন্যে যাদের বেশি মাথাব্যথা, বিপদের সময় নিজের প্রাণ নিয়েই তারা পালায়।-সত্যি, আপনার এত সাধের সাবান-কাচা জামা-কাপড়ের কী দশা হলো দেখুন। দ্বিতীয় বস্ত্ৰ ত নেই, দাতাকর্ণের মতন সব ত দান করে এলেন কর্ণপ্রয়াগে, এসব এখন শুকোবেন কেমন করে? চাদরখানাও ত গেল?’

    বললাম, ‘গায়ে-গায়ে শুকিয়ে যাবে।’

    বৃষ্টির ঝাপ্‌টায় আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। চোখে, মুখে, সর্বাঙ্গে আমাদের জল। তিনি জলে-ভেজা মুখে কপাল কুঞ্চন করে তিনি বললেন, গায়ে গায়ে গা জ্বলে যায় আপনার কথা শুনলে। অসুখ করলে এখানে দেখবে কে শুনি?’

    ‘কেন, আপনি?’-হেসে বলেই ফেললাম কথাটা।

    ‘তা হলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয় বটে।’-হঠাৎ পথের দিকে চেয়ে ঘোড়াটাকে চাবুক মেরে তিনি দ্রুতবেগে ছুটিয়ে দিলেন।

    পাহাড়ী দেশের বৃষ্টি, দেখতে-দেখতে আবার আকাশ হালকা হয়ে এল। শূন্য মনে ধীরে-ধীরে চলছিলাম। বৃষ্টি ধরে গেল, ঝড় থাম্‌লো, আকাশ হলো পরিষ্কার, পথে একটা পুল পার হয়ে দক্ষিণ দিকে চললাম। দেখতে দেখতে শেষ অপরাহ্ণের স্নান রৌদ্র আবার নির্লজ্জের মতো দেখা দিল। আরো মাইল দুই পথ হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার সময় আমরা এক ধর্মশালার কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম। স্থানীয় কয়েকজন হিন্দুস্থানী ভদ্রলোক এক দোকানের ধারে বসে গল্প করছিলেন। বাঙালীর দল দেখে তারা অগ্রসর হয়ে এসে আলাপ করলেন। সুমুখের ধর্মশালাটা বাসের অযোগ্য বিবেচনা করে তারা এদিকে একটা স্কুল-ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। স্কুল দেখেই বোঝা গেল, আশপাশে গ্রাম আছে। পণ্ডিতজি এলেন, তার সঙ্গে জনকয়েক বিদ্যার্থী। তার এসে দেশের সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন করতে লাগলো,-কংগ্রেসের অবস্থা কিরূপ, মহাত্মাজী কবে ছাড়া পাবেন, ধরপাকড় এখনো চলছে কি না, নানা প্রশ্নের ভিতর দিয়ে তাদের উৎসাহ ও আগ্রহ দেখে চমৎকৃত হলাম। শোনা গেল, আলমোড়া থেকে মাঝে- মাঝে তাদের কাছে দেশের সংবাদ আসে। ইংরাজ-শাসনের প্রতি তাদের ঘৃণা তারা জানিয়ে দিল।

    স্কুল-ঘরের বারান্দায় আমাদের আস্তানা পড়লো। বারান্দায় কোলে কয়েকটি ফুলের গাছ; পাশেই ছেলেদের খেলবার খানিকটা খোলা জমি, পশ্চিমদিকে কাঠের একটা কারখানা। বারান্দার একটা দিকে আমরা সবসুদ্ধ চৌদ্দজন যাত্রী আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টির জন্য তখনো কাপড়-চোপড় ও বিছানাপত্র স্যাঁতস্যাঁত করছে, কি ভাগ্যি যে পথের হাওয়ায় খানিকটা শুকোতে পেরেছিলাম। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনালো, দু’তিনটি হারিকেন জ্বালানো হ’লো। যাত্রীর জটলার মধ্যে রাণী ও দিদিমা ব্যস্ত হয়ে রইলেন। আজ অনেকদিন পরে ঝুলির ভিতর থেকে কাগজ আর কলম বার করে নোট লিখতে বসলাম। কত পথ, কত ঘটনা, কত স্মৃতি! জীবনের বাহ্য কাহিনীগুলি লেখা চলে, কিন্তু তার সর্বোত্তম মুহূর্তগুলির দুঃখ ও আনন্দকে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন কাজ। কলম নিয়ে বারান্দার একান্তে বসে তাই প্রথমেই মনে হলো, কী লিখি! লিখে জানানো যায় কতটুকু?

    সন্ধ্যা উত্তীৰ্ণ হ’লো কিন্তু এক ছত্রও নোট লেখা হলো না। এবেলা। আমাকে রান্না করতে হবে, চৌধুরী মশায় খাবেন আমার হাতে। বারান্দা পার হয়ে আসবার সময় আজ সন্ধ্যায় আবার অকস্মাৎ সেই চিত্ত চমৎকার দৃশ্য দেখলাম। জপ শেষ করে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রাণী বসে আছেন, হাতে তার সেই রুদ্রাক্ষের মালা! লণ্ঠনের আলোয় আমার দিকে তাকালেন, প্রসন্ন আয়ত চক্ষু, সে-চক্ষে স্বপ্ন ও তন্দ্রা-জড়ানো, আধনিমীলিত। যে-নারীকে দেখেছি পথে-পথে, যাকে দেখেচি ঘোড়ার পিঠে, যার কলহাস্য, কলকণ্ঠ ও প্রাণ-চাঞ্চল্যে সারা পথ সচকিত ও মুখর-এই মায়াময়ী যোগিনী সে নয়, এ তার এক আমূল পরিবর্তিত প্রতিকৃতি। দেহকে অতিক্রম করে তিনি যেন কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েচেন, আমাকে চিনতে পারলেন না। চোখের উপরে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছিলাম কিন্তু মাথা আমার হেঁট হয়ে এল, মুখ ফিরিয়ে ওপাশে গিয়ে দিদিমাকে বললাম, ‘কিছু আতে হবে আপনাদের জন্যে?’

    দিদিমা বললেন, ‘হবে ভাই, দোকানে আছে ছোলাভাজা আর প্যাড়া তাই আনো,–এই নাও পয়সা। প্যাড়াই এদেশে গতি।’

    কিয়ৎক্ষণ পরে প্যাড়া আর ছোলাভাজা এনে দাঁড়াতেই রাণী বললেন, ‘আমার হাতে দিন, দিদিমা বসেচেন জপে।’

    তাঁর হাতেই দিলাম, তিনি হেসে বললেন, ‘মেনি থ্যাংক্স!’

    .

    পরদিন বেলা আটটা। দ্বারিহাটের পাহাড়ী ছোট শহর পার হয়েচি। দুইটি পথ গেচে দুইদিকে, একটি আলমোড়ার দিকে, অন্যটি গিয়ে ছুঁয়েচে রাণীক্ষেত। রাণীক্ষেতের পথ ধরলাম, কাছেই ভৈরবের একটি পুরাতন মন্দির। মন্দিরের পিছন দিকে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, প্রান্তরের অসমতল কোলে-কোলে পাহাড়ী গাঁও। পথ ধীরে-ধীরে নিচের দিকে নামলো। এতদিন পরে আবার শ্রমিক নরনারীর দেখা মিলচে। কারো মাথায় কাঠ, কারো ঘাস, কারো বা গমের বস্তা: ঘোড়ার পিঠে কেউবা মালপত্র চড়িয়ে চলেচে। আমাদের দলে সবসুদ্ধ পাঁচটা ঘোড়া; চারটের পিঠে যাত্রী, একটার পিঠে মালপত্র। সারবন্দী হয়ে খটাখট শুরু করে পথের ধুলো উড়িয়ে ঘোড়ার দল চলেচে। অশ্বশ্রেণীর যে-রকম সাজ-সরঞ্জাম, এবং তাদের পিঠে বুড়ীদের চড়ে যাওয়ার যে হাস্যকর ভঙ্গী, তাতে মনে হলো অশ্বারোহণের মতো লজ্জাকর ব্যাপার পৃথিবীতে আর কিছু নেই। বুড়ীদের দিকে চেয়ে রাণীর হাসি আর থামে না।

    আজ রোদ অত্যন্ত প্রখর লাগচে, গরমে সবাই ক্লান্ত। ক্ষণে-ক্ষণে গলা শুকিয়ে উঠছে। ঝরনাও নেই, জলাশয়ও নেই। জলের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। কাল থেকেই রীতিমতো জলকষ্ট শুরু হয়েচে। শুষ্ক রুক্ষ গাছপালাহীন পাহাড়, ছায়া কোথাও নেই। গরমের এলোমেলো বাতাসে থেকে-থেকে চারিদিক ধুলোয় অন্ধকার হয়ে আসচে।

    জল, জল, জলের জন্য আমরা বড়ই কষ্ট পাচ্চি। সবরকমের পীড়ন সহ্য করেছি, কিন্তু জলাভাবের পীড়ন এই প্রথম। একটি ঘটি জল যদি কেউ এখন দেয় তবে এই ঝোলা-কম্বলটা অনায়াসে তাকে দান করতে পারি। চাতকের মতো উৎকণ্ঠিত তৃষ্ণায় জলের জন্য চারিদিকে তাকাচ্চি, কিন্তু কোথাও জল নেই। দশ মাইল পর্যন্ত এই জলকষ্ট।

    বেলা আন্দাজ বারোটার সময় এক দোতলা চটিতে এসে উঠলাম। এখান থেকে দূরে পাহাড়ের মাথায় রাণীক্ষেতের অস্পষ্ট শহরটি দৃষ্টিগোচর হচ্চে। চটিতে পৌঁছেই জলের জন্য ছুটোছুটি করলাম। কাছেই খানিকটা চাষের জমি, তারই আ’ল পার হয়ে নিচে নেমে গেলে নাকি একটি ঝরনার ধারা দেখা যায়। কিন্তু খানিকটা বিশ্রাম না নিলে আর চলতে পারচিনে। একটা দোকানঘরের দোতলায় উঠে ভিতরে বসে পড়লাম,-একেবারে চলৎশক্তিহীন। দু’চারজন মাত্র এসে পৌঁছেচেন, বাকি চৌধুরী মশায় ও দিদিমার কয়েকজন। রাণী অদূরে বসে আমার অবস্থাটা বোধকরি পর্যবেক্ষণ করচিলেন। কারো মুখে আর কথা নেই। এমন সময় মেঝের নানা জঞ্জালের ভিতর থেকে কি-একটা চকচক করে উঠলো, তুলে দেখি ছোট একটি তাম্রপাত, তার উপর লক্ষ্মীর দুইখানি চরণ ছাঁচে আঁকা। তখনই উঠে গিয়ে বিনামূল্যে সেই তামার পাতটি রাণীকে উপহার দিলাম। লক্ষ্মীর চরণ-চিহ্ন দেখে তিনি সাদরে সেখানি নিয়ে কাছে রেখে দিলেন। সামান্য রইলো অসামান্য হয়ে।

    অনেক কষ্টে জল সংগ্রহ করে তৃষ্ণা মিটানো গেল। দিদিমারা এলেন, তার সঙ্গে এলেন বিজয়াদিদি কাঁদতে কাঁদতে। কী ব্যাপার? দেখা গেল তাঁর পায়ের তলায় পাথরের কুচি ফুটে অপরিসীম যন্ত্রণা হচ্ছে, পথ আর তিনি চলতে পারছেন না। সকল টোটকা ও মুষ্টিযোগ ব্যর্থ হলো। বিজয়াদিদি পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় বিলাপ করতে লাগলেন। রান্নাবান্নার আয়োজন চলতে লাগলো।

    পড়ন্ত বেলায় আবার যাত্রা। বিজয়াদিদির অবস্থা দেথে রাণী নিজের ঘোড়াটি তাকে দান করলেন। অতএব আজ প্রথম রাণীর পদব্রজে যাত্রা। পায়ের ব্যথা তার সামান্যই আছে, এইটুকু পথ কোনোক্রমে যেতে পারবেন। একদিন তিনি একজোড়া চটি পায়ে দিচ্ছিলেন, আজ আবার পায়ে পরলেন ক্যাম্বিসের শাদা জুতা। পথ এ-বেলা অল্প-অল্প উৎরাই, চলতে কষ্ট নেই। আজ সকাল থেকে কথাবার্তা বলবার একেবারেই সুযোগ মিলচে, ডাইনে-বাঁয়ে সতর্ক চক্ষু, পিসির নিঃশব্দ পাহারা। এখন আর শাসন নেই, কেবল সতর্কতা। রাণীও তেমনি মেয়ে, যেন কিছুই নয় এমনিভাবে গা-গল্প করতে-করতে সঙ্গিনীদের সঙ্গে চলেচেন, আমার দিকে হস্তক্ষেপ করবার তার অবসর নেই। সব বুঝলাম। আমিও অখণ্ড ঔদাসীন্য বজায় রেখে আগে-আগে চলচি, রাণীকে যেন চিনিনে। রাণী আবার কে?

    গ্রামের ভিতর দিয়ে ভাঙা-চোরা আঁকা-বাঁকা পথ, সেই পথে একটা জীর্ণ কাঠের সাঁকো পার হয়ে বেলা চারটে নাগাদ আমরা গগাস-এ এসে পৌঁছলাম গগাস্ একটি জলাশয়ের তীরবর্তী ক্ষুদ্র পাহাড়ী শহর। পায়ে-হাঁটা আমাদের কয়েকজন যাত্রীকে দেখেই স্থানীয় কয়েকজন লোক ঘোড়া এনে হাজির করলো। ঘোড়া দেখেই রাণী খোঁড়া হয়ে বসলেন। বললেন, ‘এইটুকু হেঁটেই, বুঝলে দিদিমা, সেই ব্যথাটা আবার…সত্যি কী যে হলো আমার!”

    অতএব এবারে একটা শাদা রঙের তেজীয়ান ঘোড়া তিনি বেছে নিলেন। ভাড়া রাণীক্ষেত পর্যন্ত মাত্র এক টাকা। সঙ্গে একটা ছোকরা সহিস যাবে। এবারে চমৎকার সওয়ারি ঘোড়া। আমাকে ইঙ্গিতে এগিয়ে যেতে বলে তিনি ঘোড়ায় উঠলেন।

    আবার সুমুখে এক বিপুল বিস্তীর্ণ চড়াই। প্রথমটা ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু এইটিই শেষ চড়াই, শেষ পাহাড়, এইটি কোনোরকমে পার হতে পারলেই আমাদের মুক্তি। পথের হাত থেকে আমরা মুক্তি পাবো এবারের মতো, একথা ভাবতেই আনন্দ লাগছে। পথ আমাদের এবারের মতো বিদায় দেবে একথা ভাবতেও বেদনা অনুভব কচ্চি। কিন্তু কেন—কেন ভালো লাগচে এই আনন্দ- বেদনার তরঙ্গ দোলা? কী পেয়েচি? কীই-বা হারাবো?

    আর মাত্র সামান্য ছয় মাইল পথ। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল, খানিকটা বেশি পরিশ্রম করে সোজা উঠে গেলে পথ অনেকখানি শর্টকাট হয়। তাই করা গেল, দুর্দান্ত তেজে বেপরোয়া হয়ে, পিঁপড়ে যেমন দেয়াল বেয়ে ওঠে, তেমনি করে প্রায় আধ ঘণ্টা পরিশ্রমের পর খাড়া পাহাড়ের চূড়ার উপরে উঠলাম। অন্যান্য যাত্রীরা এ-পথের হদিস জানে না, তারা বহু পিছনে পড়ে রইলো। এর নাম কৌশলে পথ চুরি করা। যাদের ধারণা আমি পিছনে পিছনে আসচি, তারা শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখবে আমিই সকলের আগে। পথের ধারে একখানা বড় পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া গেল। যা ভেবেচি তাই, রাণীর সেই শাদারঙের তেজীয়ান ঘোড়াটা আসচে ছুটতে ছুটতে। কাঁধে আমার লালরঙের একটা গামছা ছিল, সেইটা তুলে নাড়তেই তার চোখে পড়লো। রক্তপতাকার সিগনাল! ঘোড়াটাকে আরো জোরে ছুটিয়ে তিনি কাছাকাছি এসে পড়লেন। প্রথমেই হাসতে-হাসতে বললেন, এবার খুব জব্দ হয়েচে ওরা-ওরা জানে আপনি অনেক পিছনে। ইস্ এখনো হাঁপাচ্চেন দেখচি? কিন্তু দাঁড়ালে চলবে না, চলুন। কী সুন্দর ঘোড়া পেয়েচি এবার দেখেছেন? ইচ্ছে হচ্চে বাড়ি নিয়ে যাই।’-নিশ্বাস ফেলে তিনি পুনরায় বললেন, ‘পথের শেষ দিকটা ভারি আনন্দ পেয়ে গেলাম, চিরদিন মনে থাকবে।

    চলতে চলতে আবার বললেন, ‘পায়ের ব্যথা একটুও নেই, সহজেই এটুকু হাঁটতে পারতাম, কিন্তু তাহ’লে আর কথা বলা যেত না আপনার সঙ্গে—ভাগ্যি ঘোড়াটা পাওয়া গেল!’

    অপরাহ্ণের রোদ স্তিমিত হয়েচে। চিড়গাছের ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে তার ঘোড় চলেচে। চারিদিকে একটি প্রশান্ত নীরবতা। এক-একবার বাতাস বয়ে যাচ্চে-সে-বাতাসে অরণ্যের মর্মরধ্বনি নয়, সেটি চিড়বনের দীর্ঘ নিশ্বাস, তাতে যেন সুস্পষ্ট বেদনার ঝলক। আমাদের এই অর্থহীন অচিরস্থায়ী বন্ধুত্বের দিকে তাকিয়ে কালের দেবতা যেন করুণ নিশ্বাস ফেলছেন আজ প্রভাত থেকে ক্ষণে- ক্ষণে একটি বিদায়ের সুর ধ্বনিত হচ্ছে আমরা পরস্পরের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পেরেছিলাম, তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবার সময় এসেচে। সহজে আমরা মিলেচি, সহজেই চলে যাবার চেষ্টা করছি। এ-কথা আর অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট মমত্ববোধের বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে, আসন্ন বিদায়ের আভাস আঘাত করচে তাকেই। আমরা জানি, আমাদের এই পরিচয়কে অধিকতর নিবিড় করেচে ওই উত্তুঙ্গ পর্বতমালা, ওই নদী, ওই অরণ্য-কান্তার, পিছনের ওই অনন্ত বিশ্ব-প্রকৃতির পটভূমি না থাকলে আমরা পরস্পরকে এমন একান্ত করে চিনতে পারতাম না। তিনি মৃদুকণ্ঠে বলেন, অনেক চৌর্যবৃত্তি করলাম আপনাকে নিয়ে, কিন্তু তার জন্যে আমার মনে কোনো গ্লানি নেই। আপনার সঙ্গে শেষের এই ক’টি দিন আমার জপের মালায় রুদ্রাক্ষের মতন গাঁথা থাকবে!’

    পাইন বনের ভিতর দিয়ে সূর্যাস্তের রক্তাভা থরথর ক’রে কাঁপছে দেখতে পাচ্চি-যেন তারই একটু কাঁপন রাণীর কণ্ঠেও এসে লাগলো। কিন্তু-হয়ত সেটুকু আমার পলকের ভ্রান্তি! থাক্-কোথাও কোথাও গাছের আগায় শুচি অরণ্যপক্ষীর কোলাহল, ওপারের পাহাড়ের চূড়ায় দিনান্তের ক্লান্ত রৌদ্র রাঙা হয়ে উঠেচে। তিনি পুনরায় বললেন, ‘জীবনে আর হয়ত দেখা হবে না আপনার সঙ্গে, কিন্তু তা’তে আমার দুঃখ নেই। আমার সকল কথা যে নিঃসংকোচে প্রকাশ করতে পেরেচি এইতেই আমার আনন্দ-হ্যাঁ, ভ্রমণ-কাহিনী কি আপনি লিখবেন? কোন্ কাগজে?’

    বললাম, ‘যদি লিখি ‘ভারতবর্ষে’ই লিখবো।’

    ‘ভালোই হবে, আমি ‘ভারতবর্ষে’র গ্রাহক। কিন্তু দেখবেন, সাবধান-আমার নাম-ধাম যেন প্রকাশ করবেন না!’

    মিনিট দুই থেমে তিনি পুনরায় বললেন, ‘অনুরোধ রইলো, আমার জীবনের সকল কথা আপনি প্রকাশ করে দেবেন। আপনার লেখায় জানতে পারবো আমি কী!

    হেসে বললাম, ‘সব কথাই বাদ দেবো, লিখবো সামান্যই।’

    তিনি বললেন, ‘আমার বিশ্বাস সুন্দর করে বললে সবই বলা যায়। আপনি সুন্দর করে লিখবেন। শুধু আমার কথা নয়, অন্য লেখাও। আপনার সকল রচনার ভিতর দিয়ে এক মহান্ জীবনকে যেন স্পর্শ করতে পারি—তার ভিতরে থাকবে মানুষের গভীর আনন্দ আর বেদনার দোলা!’

    চমৎকৃত হ’য়ে তার বাণী শুনে চলেচি। এই তাঁর এক অভিনব মূর্তি। তিনি বলে যেতে লাগলেন, অন্যায় ও অসত্যকে আমি যেন মার্জনা না করি; সমস্ত সামাজিক মিথ্যাচার, নির্লজ্জ বর্বরতা, মানুষের কুটিলতা ও অবমাননা-আমার রচনায় এদের বিরুদ্ধে যেন সর্বনাশা ধ্বংসের সুর ধ্বনিত হয়। যারা বঞ্চিত হয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পেরে মাথা যাদের হেঁট হয়ে গেচে, শতকোটি বন্ধনের মধ্যে বাসা বেঁধে যাদের নিশ্বাস রুদ্ধ হয়েচে-আমার সাহিত্যে যেন তাদেরই আত্মার ভাষা জেগে ওঠে। আমার গল্পের মধ্যে যে- মানুষের দল আনাগোনা করবে তারা যেন সকল বিরোধ ও অসত্য থেকে মুক্তি পায়, সকল মিথ্যা ও সর্বপ্রকার লজ্জা থেকে তারা যেন মহত্তর জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।’

    .

    ‘বাংলা বই-কাগজ আমি নিয়মিত পড়ি’,-তিনি বলতে লাগলেন, ‘রাতে যখন সবাই ঘুমোয় তখন আমার জাগবার পালা। কিন্তু পড়ে হাসিই পায়। এখনকার সাহিত্যের সঙ্গে খবরের কাগজের তফাৎ নেই। লেখার ভিতর দিয়ে আমি দেখি লেখকদের। কী তাদের সংকীর্ণ জীবন, স্থূল দৃষ্টি! পরিশ্রম আছে কিন্তু সান্ত্বনা নেই। নিজের মনোভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজের খুশি মতন তারা স্ত্রী- পুরুষের চরিত্র আঁকে, তাই তারা হয়ে ওঠে কলের পুতুল। পড়ে হাসি পায়। কিন্তু রাগ হয় তখন যখন দেখি তাই নিয়েই অক্ষম লেখকদের নানা কসরৎ, নানা কারিকুরি। জীবনে প্রেমের আর বীর্যের অস্বাভাবিক অভার তাদের চোখে পড়ে না, তাই তাদের সাহিত্য হয়ে ওঠে দুর্বল লালসার ইতিহাস, মরবিড়, মনের কুৎসিত অভিব্যক্তি।’

    কমলিকা যেমন ধীরে-ধীরে এক-একটি দল মেলে এক সময় পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়ে ওঠে, এই মেয়েটির পরিচয় তেমনি করেই পেলাম। সকল কথা তিনি এমন করে গুছিয়ে সেদিন বলেননি বটে, কিছু প্রকাশ করেছেন, কিছু অপ্রকাশিতই রেখে গেচেন, কিন্তু এই ছিল তাঁর মূল বক্তব্য।

    চার মাইল পথ পার হয়ে সন্ধ্যার সময় আমরা পথের শেষ চটিতে এসে শেষরাত্রির মতো আশ্রয় নিলাম। দূরে পূর্বদিকে রাণীক্ষেত শহরের কয়েকটি আলো এখান থেকে দেখা যাচ্চে; কাল প্রভাতে ওখানে গিয়ে পৌছব। পাশাপাশি দু’টি পাকা ঘর,-এমন সুন্দর থাকার জায়গা আমরা খুব কমই পেয়েছি; ঘরের কোলে একটি খাবারের দোকান। দোকানে রাত্রির আহারের বন্দোবস্ত করা গেল। কিয়ৎক্ষণপূর্বেই চৌধুরী মশায় ও দিদিমার দল সমারোহে এসে উপস্থিত হলেন এসেই কি-একটা কারণে দিদিমার সঙ্গে চটিওলার বিবাদ বাধলো দিদিমা একটু রাশভারি ও বদমেজাজী মানুষ,-রাগ করে জিনিসপত্র ও দলবল নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে উঠলেন। আমি একখানি চোকী আশ্রয় করে এদিকে পড়ে রইলাম। আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে ভাবচি রাণীর শেষ কথাগুলি। শুক্লপক্ষের শীর্ণ চন্দ্র তখন পাহাড়ের পশ্চিম-পারে অস্তে নেমেছে। কিন্তু আমার মনে কোথায় জমচে কথা, কোথায় লাগচে ব্যথা?

    পরদিন প্রভাতে প্রথম সূর্যের আলোয়, চিড় ও পাইনের আঁকাবাঁকা অরণ্যের পথে, গোয়েন্দা-পিসির তীক্ষ্ণদৃষ্টির উপর দিয়ে, শকুনি-সমাকীর্ণ এক শ্মশানের পাশ কাটিয়ে, চৌধুরী মশায়ের সঙ্গে গল্প করতে-করতে এতদিন পরে রাণীক্ষেতের প্রকাণ্ড শহরের তীরে এসে পৌঁছলাম। নিকটেই একটা গোরা- ছাউনী, তার পাশে সরকারি দপ্তর, হাসপাতাল, ক্লাব, বর্ডিং হাউজ, ডাক-বাংলা, স্যানাটোরিয়াম-শহরের নানা আসবাব। চারিদিকে একবার শূন্যচক্ষে তাকিয়ে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে রাণী বসে পড়লেন। এই প্রভাতকালেও মনে হলো তিনি যেন ক্লান্ত, বড়ই ক্লান্ত। হতাশা, অবসাদ ও কারুণ্যে তার চোখ দুটি যেন আচ্ছন্ন। তাকে রেখে এগিয়ে গেলাম। পথ ঘুরতেই দেখা গেল অসংখ্য দোকান, বাজার, হোটেল, বাসাবাড়ি, ফিরিওয়ালা, অগণ্য লোকের আনাগোনা,-ওদিকে একদল মোটর বাস! অবাক হয়ে মোটরগুলিকে দেখলাম। চাকাগুলির দিকে তাকিয়ে দ্রুতগতির আনন্দে উল্লসিত হলাম। ভুলেই গেচি যন্ত্রসভ্যতার কথা,-সমস্ত কিছুর থেকে হয়েচে বিচ্ছেদ, অনাত্মীয়তা। সভ্যতা, সৌজন্য ও সামাজিকতার খোলস আবার পরতে হবে।

    প্রথমেই চায়ের দোকানে গিয়ে উঠলাম। যে নিঃশব্দ নীরবতায় দীর্ঘকাল ধরে’ অতিক্রম করে এসেচি তার সঙ্গে এখনকার কী প্রভেদ লোহা-লক্কড়ের, কুকুর ও মোরগের ডাক, গির্জার ঘণ্টা, গোরা-ছাউনীর ব্যাগ-পাইপের বাজনা, দোকানদারদের হাঁকডাক, মোটরের আওয়াজ, পথিকজনের উচ্ছল আলাপ, হাসি-তামাশা, হর্ণ-এর শব্দ একেবারে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। এদের সঙ্গে আজ আমাদের কোথাও মিল নেই, আমরা যেন নূতন দেশের মানুষ; বঙ্গ ও পার্বত্য প্রকৃতি আমাদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আমাদের আচার-ব্যবহার, ধরন-ধারণ-এই শহর- সভ্যতার আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্বিত চেহারা দেখে নিজেরাই আমরা বিস্ময় ও কুণ্ঠায় একান্ত সরে গেলাম। আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদে, হাব-ভাবে, আচার আচরণে, অঙ্গ-ভঙ্গীতে যেন হিমালয়ের বন্য-প্রকৃতি বাসা বেঁধেছে; পরস্পরের দিকে চেয়ে আর আমাদের মুখে কথা সরচে না। আদিম যুগের সভ্যতালেশহীন মানুষ আমরা যেন সহসা ছিটকে এসে পড়েচি তথাকথিত সভ্যতার কোলাহলের মধ্যে, নির্জন হিমালয়ের গহ্বরে আবার আমাদের পালিয়ে যেতে ইচ্ছা হচ্চে।

    আমরা চৌদ্দজন। প্রত্যেকে দু’টাকা ভাড়া দিয়ে এখান থেকে একান্ন মাইল দূরবর্তী হলদুয়ানি স্টেশন পর্যন্ত মোটর বাস নিযুক্ত করা গেল। বেলা প্রায় আটটার সময় গাড়ি ছাড়লো। বাঁ-দিকে একটা পথ এখান থেকে নেমে আলমোড়া পর্যন্ত চলে গেচে, আলমোড়া থেকে ভিকিয়াসে। আমাদের গাড়ি ছুটলো কাঠ-গুদামের দিকে। পাহাড় থেকে ধীরে-ধীরে নাচি, প্রশস্ত বাঁধানো পথ, এক ধারে পাথরের পাঁচিল, গভীর নিচে একটি নদী বইচে, ওপারে অরণ্য,- অরণ্যের ভিতরে কোথাও কোথাও কুলুকুলু ঝরনার ধারা বইচে। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। ঘূর্ণীর মতো ঘুরে-ঘুরে গাড়ি নাচে, কোথাও দিচ্ছে ঝাঁকুনি, কোথাও দিচ্চে নাগরদোলার মতো দুলিয়ে!

    অদ্ভূত লাগচে এই পতি, এই দ্রুততা; মনে হচ্চে এর চাকাগুলি আমাদেরই, আমারাই ছুটচি-যেন ক্লান্তি নেই, অবসাদ নেই। আমাদের মনে, আমাদের চিন্তায়, আমাদের চরিত্রে যেন সেই অফুরন্ত পথ-পথের পর পথ। গাড়ির ভিতরে বসেও আমরা হাঁটচি কেবলই হাঁটচি। আমাদের পা থেমে নেই। বুড়ীরা গাড়ির ভিতর বমি করতে শুরু করলো,-এ তাদের সইবে কেন? তাদের শরীরের সঙ্গে লেগেচে যন্ত্রযানের সংঘাত। রাণী বসেচেন পিছনের সীট-এ, আমার বাঁ-দিকে বসেচেন চৌধুরী মশায়। পাড়িটা খুব ছোট, ঠাসাঠাসি করে বসে আছি। কারো গায়ের উপরে কারো হাত, কারো পায়ের মধ্যে কারো পা জড়ানো-একবার নিজের পা চুলকোতে গিয়ে কার যেন পায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। ভিড়ের মধ্যে আপন স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা কঠিন।

    বেলা প্রায় সাড়ে দশটার সময় হলদুয়ানি স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। শেষ জ্যৈষ্ঠের রৌদ্রে তৃষ্ণার্ত চারিদিক ধু-ধু করচে। ঠাণ্ডা দেশ থেকে অকস্মাৎ যেন অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম, গ্রীষ্ম-মধ্যাহ্নের প্রচণ্ড আগুনের হলকায় সর্বাঙ্গ যেন ঝলসে যেতে লাগলো। উঁচু থেকে হঠাৎ এই গরমে নিচে নেমে কেমন যেন দম আটকে আসছে, হাঁ করে বারেবারে নিশ্বাস টানতে লাগলাম। রাণীর মুখে আর কথা নেই, হিমালয় ছেড়ে এসে কোথায় যেন তাঁর মন ভেঙে গেচে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে তিনি আর কথা বলচেন না। একটা দোকানের একখানা চৌকীর উপরে তিনি উদাসীন হয়ে বসে রইলেন জিনিসপত্র সমেত আবার আমরা তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীশালায় এসে সে বেলার মতো আশ্ৰয় নিলাম। গুরু-নিশ্বাসের অস্বস্তিতে শরীর ভারি খারাপ লাগছে। রাণী যেন মন্ত্রবলে বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা। এক সময় আড়ালে পেয়ে মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে, যেমন উদ্বেলিত আকুলতায় আপন শিশুকে কুশল প্রশ্ন করেন তেমনি কোমলকণ্ঠে বললেন, ‘এ কি হোলো মুখের চেহারা, শরীর যেন ভালো নেই মনে হচ্চে?’

    বললাম, ‘নিশ্বাস টানতে কষ্ট লাগছে।’

    তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘ও, রেসপিরেশনের গোলমাল। অমন হয়। আমার কাছে ওষুধ আছে, আপনি গিয়ে চৌধুরী মশায়কে বলুন, আমি এখনই ওষুধ বার করে দেবো।’

    ঔষধ সেবন করে শরীর সুস্থ হলো। চৌধুরী মশায় চুপ করে শুয়ে থাকতে বললেন। শুয়েই রইলাম। দিনের বেলায় আর গাড়ি নেই, সুতরাং সমস্ত দিন বিশ্রাম নিয়ে বিকাল ছ’টায় ট্রেনে চড়ে বসলাম। বালামৌ-র টিকিট কেটেচি, নৈমিষারণ্য হয়ে যাবার হচ্ছে। একখানি কামরা আমরা সকল বাঙালী মিলে অধিকার করেচি। ছোট গাড়ি, কিন্তু হু হু করে ছুটচে। গ্রীষ্মকালের দীর্ঘদিন অবসান হয়ে এল, প্রান্তরের পরপারে সূর্যদেব নামলেন অস্তাচলে, শেষ দিবসের ক্লান্ত চোখে নেমে এল তন্দ্রা, দূরের পর্বতমালা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেল। দিদিমা, রাণী ও চৌধুরী মশায় চলন্ত গাড়ির মধ্যেই বসলেন জপে

    রাত সাড়ে নটায় বেরিলি স্টেশনে গাড়ি বদল করে কাশীর গাড়িতে সবাই মিলে ওঠা গেল। গাড়িতে খুব ভিড়, অসহ্য গরম। বহু চেষ্টাতেও কোথাও ঠাণ্ডা জল পাওয়া গেল না, সবাই অস্থির তৃষ্ণায় অবসন্ন হয়ে এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রইলাম। ক্লান্তি, পরিশ্রম, গ্রীষ্মাধিক্য ও অনাহারে সবাই নেতিয়ে পড়েছে, গাড়ির গতির দোলা সকলে সহজেই ঘুমিয়ে পড়তে লাগলো। আর কোথাও টু শব্দটি নেই। জানালায় মাথা কাৎ করে রাণীর চোখেও তন্দ্রা এল; আমি উঠলাম বাঙ্কের উপরে।

    ঠিক সময়টিতে আচমকা ঘুম ভাঙলো। রাত আড়াইটে বেজে গেচে। সবাই গভীর ঘুমে অকাতর। নিচে নেমে দেখি সজাগ দৃষ্টিতে চেয়ে রাণী বসে রয়েচেন। তার চোখে ঘুম নেই, যেন ঘুম কোনোদিনই ছিল না। প্রান্তরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে পাষাণমূর্তির মত বসেছিলেন।

    বললাম, ‘বালামৌ পার হয়ে গেছে?

    রাণী চোখ তুলে কয়েক মুহূর্ত আমাকে লক্ষ্য করলেন, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘যদি যায় তাতেই বা কি, বালামৌতে আপনার নামা হবে না।

    ‘কেন?’

    নিদ্রিত দিদিমার দিকে চেয়ে ধমক দিয়ে তিনি বললেন, ‘বাড়ি ফিরতে হবে আপনাকে! কাশী থেকে এসেচেন, কাশীই চলুন। আর তীর্থ করবার দরকার নেই, খুব হয়েচে।’

    বললাম, ‘কিন্তু আমার টিকিট যে বালামৌর?’

    তিনি বললেন, ‘পথে বদলে নিলেই হবে।’

    চুপ করে রইলাম। তিনি যেন আবার চিন্তার সমুদ্রে ডুব দিলেন। কিন্তু সে কয়েক মুহূর্ত মাত্র, তারপরেই আমার দিকে ফিরে উজ্জ্বল চক্ষে চেয়ে বললেন, ‘এই বা কী? কতটুকুই বা? এও ত’ মিথ্যে, এও ত’ অর্থহীন! আপনি কি কিছু বিশ্বাস করেন? ইহকাল? পরকাল? পুনর্জন্ম?’

    তাঁর ললাটে, চক্ষে, অধরে, হৃৎপিণ্ডে-এ কি অধীরতা, এ কি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ! কিন্তু সাধ্য ছিল না তাঁর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবার। দ্রুতগামী ট্রেনের বাহিরে ঘন অন্ধকার রাত্রিও রইলো তাঁর প্রশ্নে নিরুত্তর। চির নিরুত্তর!

    দেখতে-দেখতেই গাড়ি এসে বালামৌ স্টেশনে থামলো। রাত তিনটে বাজে। নামা হ’লো না বটে কিন্তু গাড়ির ঝাঁকুনিতে সবাই জেগে উঠলো। দিদিমা উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি নামলে না তাই এখানে?’

    বললাম, ‘আর থাকগে দিদিমা, এ-যাত্রায় নৈমিষারণ্য আর হলো না।’

    ‘তা বটে, এত পরিশ্রমের পর,-ওমা, বসে-বসেই তোর নাক ডাকচে গা, বলি অ রাণী? আহা, একেবারে বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্চ, আর খাওয়া-দাওয়া নেই কিনা আজ দু’দিন—’

    নিদ্রার এমন চমৎকার নিখুঁত অভিনয় দেখে পেটের ভিতর থেকে হাসি ফেনিয়ে উঠতে লাগলো। রাণী জানাতে চান না যে, তিনি এতক্ষণ জেগে ছিলেন। আমাদের মনের আকাশ আবার স্বচ্ছ হয়ে গেচে!

    প্রভাতে পৌঁছলাম লক্ষ্ণৌ। প্যাসেঞ্জার-গাড়িতে যেতে অনেক দেরি হবে তাই লক্ষ্ণৌতে গাড়ি বদলে নেবার জন্য আবার নেমে পড়লাম। অনেক সময় আছে, ঝোলা-কম্বল রেখে স্টেশনের রেস্তোরাঁয় চা খেয়ে বাইরে এসে একখানা টাঙা ভাড়া করে শহর-ভ্রমণে বেরোলাম। প্রভাতের আলোয় সুন্দর লক্ষ্ণৌ নগরী তখন চোখ মেলেছে। পথঘাট, দোকান-বাজার পার হয়ে, নবাবগণের প্রাসাদের কোল ঘেঁষে গাড়ি চললো। পুরাতন-দুর্গ, ঐতিহাসিক ভগ্নাবশেষ, লাটের প্রাসাদ, ময়দান, গোমতী নদী, ওপারে বিশ্ববিদ্যালয়-সকলের উপর চোখ বুলিয়ে বুলিয়ে ঘণ্টা দুই পরে বাজার থেকে একজোড়া স্লিপার কিনে আবার স্টেশনে এলাম। দেরাদুন এক্সপ্রেস আসতে তখন আর দেরি নেই। গাড়ি এল, জিনিসপত্র নিয়ে সবাই উঠলাম, উঠবার সময় ছেঁড়া শাদা ক্যাম্বিশের জুতোটা লক্ষ্ণৌ স্টেশনকে উপহার দিয়ে এলাম। দুস্তর হিমালয়ের বিচিত্র ইতিহাস ও অজস্র স্মৃতি নিয়ে অনাদৃত সে পথের প্রান্তে পড়ে রইলো। কাঁকরে-পাথরে, তুষারে, বর্ষায় ওই জুতো জোড়াটা ছিল আমার পরম বন্ধু। আমার পায়ের তলায় আশ্রয় নিয়ে আমাকে সকল দুরবস্থা থেকে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে! ওকে পথের উপরে ফেলে প্রতি পদক্ষেপে ওর হৃদয় দলিত করেচি। আজ করুণ দুই চক্ষু মেলে ও যেন বহুদূর পর্যন্ত আমার দিকে চেয়ে রইলো।

    রোদ প্রখর হতে লাগলো, খোলা প্রান্তরের চারিদিকে আগুন ছুটচে। আকাশ ধূসর বর্ণ, কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই, জল-জলাশয় শুকিয়ে গেচে,-গাড়ি চলেচে দ্রুতগতিতে। দেশ-দেশান্তর পার হচ্চি, সব যেন নতুন বলে মনে হচ্চে। সমস্তই যেন পূর্বজন্মের পরিচয়, জন্মান্তরে এসে কিছুই যেন চিনতে পারচিনে।

    ফয়জাবাদ, অযোধ্যা, শাহাগঞ্জ পার হ’লো, পার হলো জৌনপুর, -অবেলার পড়ন্ত রৌদ্রে আমরা পুনর্জন্মপ্রাপ্ত তীর্থযাত্রীর দল আবার কাশী স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। সমস্ত দেশটা শেষ জ্যৈষ্ঠের আগুনে হা হা করে জ্বলচে।

    স্টেশন থেকেই সকলকে বিদায় দিলাম। লোকালয়ে মাঝখানে এসে সকল সম্পর্ক আমাদের শেষ হয়ে গেল। আজ অনুভব করলাম আমরা নিতান্তই পর, আত্মীয়তার বন্ধন কোথাও নেই। পথের পরিচয়, পথের শেষেই চুকে গেল। ভিড়ের ভিতরে দাঁড়িয়ে রাণী কি-যেন বলতে গেলেন, কিন্তু সুযোগ মিললো না, তার কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে এল। রুদ্ধ হলো চিরদিনের জন্য।

    নির্জন রৌদ্রের পথে পরিশ্রান্ত আমি একখানা এক্কায় চলেচি, অতি মন্থর স্তিমিত গতি, ঘোড়ার গলায় ঝুমঝুম্ করে ঘুঙুর বাজচে। উৎসাহহীন, নিরানন্দ, নিস্পৃহ। আমি কি নিদ্রিত, আমি কি জাগ্রত? কোথায় চলেচি, কে রয়েচে পথ চেয়ে? কে চলে গেল পথ দিয়ে? মনের চেহারা এমন কাঙালের মতো হয়ে ওঠে কেন? এতবড় তীর্থ পর্যটনে কেন নেই আনন্দ? আমি যে চির-পরিব্রাজক, চির- তীর্থপথিক! তবে কী সব মিথ্যে, সমস্তই অর্থহীন! পরকাল, পুনর্জন্ম,—তবে কি বিশ্বাস নেই জীবনে, সান্ত্বনা নেই মরণে?

    আধনিমীলিত চক্ষে দূরে রৌদ্র-জ্বালাময় আকাশের দিকে চেয়ে বললাম-

    ‘কোথা বক্ষে বিঁধি কাঁটা ফিরিলে আপন নীড়ে
    হে আমার পাখী,
    ওরে ক্লিষ্ট, ওরে ক্লান্ত, কোথা তোর বাজে কথা,
    কোথা তোরে রাখি?’

    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রত্যন্ত বাংলায় গুপ্তবিদ্যা – প্রবোধকুমার ভৌমিক
    Next Article রত্নদীপ – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ডুগডুগির আসর – প্রশান্ত মৃধা

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ডুগডুগির আসর – প্রশান্ত মৃধা

    September 22, 2025
    Our Picks

    ডুগডুগির আসর – প্রশান্ত মৃধা

    September 22, 2025

    উইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম

    September 22, 2025

    কেরী সাহেবের মুন্সী – প্রমথনাথ বিশী

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.