Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    থ্রি এএম – নিক পিরোগ

    September 3, 2025

    থ্রি টেন এএম – নিক পিরোগ

    September 3, 2025

    থ্রি টোয়েন্টিওয়ান এএম – নিক পিরোগ

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাছের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    নারায়ণ সান্যাল এক পাতা গল্প107 Mins Read0

    মাছের কাঁটা – ১

    ১

    “মৈত্রেয়ী তখন একমুহূর্তে বলে উঠলেন, ‘যেনাহং নামৃতা স্যাম কিমহং তেন কুর্য্যম্।’ যার দ্বারা আমি অমৃতা হব না, তা নিয়ে আমি কী করব।… উপনিষদে সমস্ত পুরুষ ঋষিদের জ্ঞানগম্ভীর বাণীর মধ্যে একটিমাত্র স্ত্রী-কণ্ঠের এই একটিমাত্র ব্যাকুল বাক্য ধ্বনিত হয়ে উঠেছে এবং সে ধ্বনি বিলীন হয়ে যায়নি—সেই ধ্বনি তাঁদের মেঘমন্দ্র শান্ত স্বরের মাঝখানে অপূর্ব একটি অশ্রুপূর্ণ মাধুর্য জাগ্রত করে রেখেছে। মানুষের মধ্যে যে পুরুষ আছে উপনিষদে নানা দিকে নানাভাবে আমরা তারই সাক্ষাৎ পেয়েছিলুম, এমন সময়ে হঠাৎ এক প্রান্তে দেখা গেল মানুষের মধ্যে যে নারী রয়েছেন তিনিও সৌন্দর্য বিকীর্ণ করে…”

    হঠাৎ রবীন্দ্র রচনাবলীটা বন্ধ করে বাসু-সাহেব তাঁর একক শ্রোতার দিকে তাকিয়ে দেখেন। দেখেন, রানি দেবী তাঁর হুইল-চেয়ারে ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন। চোখ দুটি বোজা।

    —ঘুম পাচ্ছে?—প্রশ্ন করলেন বাসু-সাহেব।

    চমকে উঠে রানি দেবী বললেন, না, শুনছি, পড় তুমি—

    —ভাল লাগছে না, নয়?

    ম্লান হাসলেন রানি দেবী। মাথাটা নেড়ে সত্যি কথা স্বীকার করলেন।

    —তবে থাক! এস কিছু গান শোনা যাক। বল, কী বাজাব?

    উঠে গেলেন রেডিওগ্রামের দিকে।

    —গান থাক। তুমি এখানে এসে বসো তো। কয়েকটা কথা বলার ছিল।

    সন্দিগ্ধ চোখে বাসু-সাহেব তাকিয়ে দেখলেন একবার স্ত্রীর দিকে। এসে বসলেন তাঁর পরিত্যক্ত চেয়ারে : বলো?

    —দেখো, আমাদের যা গেছে তা আর কোনোদিন ফিরবে না। আমি না হয় পঙ্গু হয়ে পড়েছি, তুমি তো হওনি! তুমি কেন এভাবে জীবনটাকে বরবাদ করছ?

    বাসু-সাহেব নিরুত্তর স্তব্ধতায় বসে থাকেন। পাইপটা পর্যন্ত জ্বালেন না। একটা দম নিয়ে মিসেস বাসু বলেন, তুমি আবার প্র্যাকটিস শুরু করো।

    হঠাৎ কৃত্রিম হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন পি.কে.বাসু। পাইপটা ধরাতে ধরাতে বলেন, এই কথা। আমি ভাবছি, না জানি কোন সিরিয়াস্ প্রসঙ্গ তুলবে তুমি।

    মিসেস বাসু জবাব দিলেন না। বাসু মুখ তুলে তাঁর দিকে চাইলেন, বললেন, কী হল আবার?

    —আমি সিরিয়াসলিই কথাটা আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। তোমার যদি আপত্তি থাকে, তবে থাক—হুইল-চেয়ারের চাকাটায় পাক মারতে যান। বাসু হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলেন তাঁকে। বলেন, কী বলছ রানু! তা কি হয়?

    —কেন হবে না? মাইথনে সেদিন মিঠুর সঙ্গে যদি তার মা-ও মারা যেত তাহলে তুমি এমন করতে পারতে? এমন সংসার-ত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো…না, না, আমাকে বলতে দাও, প্লিজ, আমি সেন্টিমেন্টাল কথা বলব না, প্র্যাটিকাল কথাই বলব।

    বাসু পাইপটা কামড়ে ধরে বলেন, বেশ বলো।

    —আমি কী বলব? এবার তো তোমার বলার কথা। কেন প্র্যাকটিস্ ছেড়ে দেবে তুমি?

    —কী হবে প্র্যাকটিস্ করে, রানু? টাকা আমাদের যা আছে, দুজনের দুটো জীবন কেটে যাবে। নাম-ডাক? ও নিয়ে কোনো মোহ আমার নেই। তা-ছাড়া এই অবস্থায় তোমাকে একলা বাড়িতে ফেলে রেখে আমি কোর্ট-কাছারি করতে পারি?

    —না, টাকার জন্যে নয়। নাম-ডাকও নয়—কিন্তু তোমার শিরদাঁড়াটা যে ভাঙেনি এটা আমাকে বুঝে নিতে দাও!… তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ, পঙ্গু হয়ে যাচ্ছ। তোমার কি বিশ্বাস চোখের উপর এটা প্রতিনিয়ত দেখেও আমি মনে শান্তি পেতে পারি?

    এবার আর রসিকতা করলেন না বাসু-সাহেব। বললেন, কথাটা যখন তুললে রানু, তখন খোলাখুলিই বলি। কথাটা আমিও ভেবেছি। তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের সামনে দীর্ঘ জীবন পড়ে রয়েছে। ‘নেগেশান’ দিয়ে অত বড় ফাঁকটা ভরিয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের বাঁচতে হবে। এভাবে নয়—বই পড়ে, গান শুনে, দাবা খেলে— মানে জীবনকে অস্বীকার করে নয়। কাজের মাধ্যমেই আমরা অতীতকে ভুলতে পারব—’আমরা’ মানে আমি আর তুমি! কিন্তু সে জীবন-সঙ্গীতে ঐকতান চাই। রেজনেন্স হওয়া চাই। তুমি গাইবে, আমি শুনব, আমি বাজাব, তুমি শুনবে—তা নয়! পারবে?

    —তুমি আমাকে শিখিয়ে দাও! তুমি তো জান আমার কতটুকু শক্তি।

    —জানি! কিন্তু তোমার মনে কতখানি জোর তাও আমি জানি! বেশ সেই পথেই

    মাছের কাঁটা চিন্তা করি। দু-চারদিন পরে তোমাকে জানাব। কিছু একটা পথ খুঁজে বার করতেই হবে।

    —নিশ্চয়ই খুঁজে পাব আমরা।

    .

    ব্যারিস্টার পি.কে. বাসুকে যাঁরা চেনেন না তাঁদের জন্য কিছু পূর্বকথন দরকার। এখন ওঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। এককালে দুর্ধর্ষ প্র্যাকটিস্ ছিল ওঁর। কলকাতার বারে সবচেয়ে নামকরা ক্রিমিনাল লইয়ার। কোর্ট, বার অ্যাসোসিয়েশান, ক্লাব, টেনিস এই নিয়ে ছিল তাঁর জীবন। সহধর্মিণী রানি বাসুও স্বনামধন্যা। গানের আসরে শৌখিন গাইয়ে হিসাবে তাঁর ছোটাছুটিরও অন্ত ছিল না। রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত মাসে পাঁচ-সাতখানা তাঁকে গাইতেই হত। অ্যাপয়েন্টমেন্টে ঠাসা থাকত কর্তা-গিন্নির দিনপঞ্জিকা।

    তারপর একদিন। একটি খণ্ডমুহূর্তে একেবারে বদলে গেল সব। মাইথনে বেড়াতে গিয়েছিলেন ওঁরা। কর্তা-গিন্নি আর ওঁদের দশ বছরের একমাত্র মেয়ে সুবর্ণ বা মিঠু। পথ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মিঠু শেষ হয়ে গেল। বাসু-সাহেব বেঁচে ফিরে এলেন প্রায় অক্ষত, আর তিন মাস পরে যখন মিসেস বাসু হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলেন তখন জানা গেল, তাঁর মেরুদণ্ডের একটি অস্থি কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি আর কোনোদিন সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। সন্তানের জননী হতে পারবেন না।

    প্র্যাকটিস্ ছেড়ে দিয়েছিলেন বাসু-সাহেব। স্ত্রীকে সাহচর্য দেওয়াই হল এর পর থেকে তাঁর দৈনন্দিন কাজ। অদ্ভুত আমুদে লোক—প্রথম পরিচয়ে কেউ বুঝতেই পারত না—ওঁর জীবনের অন্তরালে লুকিয়ে আছে এতবড় একটা ট্র্যাজেডি। পঙ্গু স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এখানে-ওখানে। রানি দেবীকেও হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না তিনি উত্থানশক্তি-রহিত—কিন্তু তাঁর মুখখানা বিষাদ মাখানো

    ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও না কি ধান ভানে। এই ধুরন্ধর প্রতিভাশালী ক্রিমিনাল ল’ইয়ারটিও নাকি তেমনি বেড়াতে গিয়েও তাঁর পেশাগত কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন দু-একবার। আগরওয়াল ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক ময়ূরকেতন আগরওয়ালের মৃত্যু-রহস্যের কথা হয়তো কেউ কেউ শুনে থাকবেন। সেখানে ঐ খুনের মামলায় সুজাতা চট্টোপাধ্যায় আর কৌশিক মিত্র নামে দুজন জড়িয়ে পড়েছিল। বাসু-সাহেব তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সাহায্যে ঐ দুজনকেই সে মামলা থেকে উদ্ধার করে আনেন। এসব খবর একদিন খবরের কাগজে ফলাও করে বার হয়েছিল তা হয়তো আপনাদের নজরে পড়েছে। তারপরেও আরেকটি খুনের কিনারা তিনি করেছিলেন দার্জিলিঙের এক হোটেলে। হোটেলটার নাম “দ্য রিপোর্’—সদ্য খোলা হয়েছিল। বস্তুত ঐ হোটেল খোলার উদ্বোধনের দিনেই অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে। হোটেলের মালিক ঐ সুজাতাই—সুজাতা চট্টোপাধ্যায় নয়, সুজাতা মিত্র। ইতিমধ্যে কৌশিক মিত্রকে সে বিয়ে করেছে। সুজাতার বাবা নাকি কী একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেন। সেসব ইঞ্জিনিয়ারিং খটমট ব্যাপার। আমার ঠিক মনে নেই; মোটকথা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সেই আবিষ্কারের পেটেন্টটা বেচে সুজাতা লাখ-দেড়েক টাকা পায়। সেই টাকাতেই হোটেল-বিজনেস শুরু করেছিল ওরা স্বামী-স্ত্রী। বাসু-সাহেব আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে হোটেলের উদ্বোধনের দিন ওখানে যান। হোটেলে থাকতেই ঐ খুনের কিনারা করেন। শুনেছি, সেই ঘটনাটার উপর ভিত্তি করে একটি গল্পের বইও লেখা হয়েছে—তার নাম “সোনার কাঁটা”।

    যাক্ ওসব অবান্তর কথা। যে কথা বলছিলাম। স্বামী-স্ত্রীর ঐ কথোপথনের পর থেকেই বাসু-সাহেব ভাবছিলেন কী করে নতুনভাবে বাঁচার ব্যবস্থা করা যায়। উত্থানশক্তিরহিতা স্ত্রীকে জড়িয়ে কেমন করে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়া যায়। ঠিক এমনই সময়ে ওঁদের বাড়িতে এসে দেখা করল কৌশিক আর সুজাতা। বাসু-সাহেবের নিউ আলিপুরের বাড়িতে। বাসু-সাহেব ওদের আপ্যায়ন করে বসালেন। সুজাতা আর কৌশিক দুজনেই ওঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন। খুশিয়াল হয়ে ওঠেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। বলেন, খুব খুশি হয়েছি তোমরা দেখা করতে আসায়। কবে এসেছ দার্জিলিং থেকে? হোটেল কেমন চলছে?

    সে কথার জবাব না দিয়ে সুজাতা বলে, রানু-মামিমা কোথায়?

    বাসু-সাহেব আসলে বিপুল ঘোষ, আই.এ.এস.-এর মামাশ্বশুর। সেই সুত্ৰে সকলে তাঁকে ‘মামু’ বলে ডাকত। বিপুল ঘোষ ছিলেন ডি.এম.। যে জেলা-সদরে কৌশিক আর সুজাতার সঙ্গে তাঁর আলাপ সেখানকার অফিসার্স ক্লাবে বাসু-সাহেব হয়ে পড়েছিলেন সর্বজননীন মামু। সেই সুবাদেই কৌশিক-সুজাতা ওঁকে ‘বাসুমামা” বলে ডাকে।

    বাসু-সাহেব বলেন, আছে ভিতরে। খবর পাঠাচ্ছি, কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি। হোটেল রিপোজ্ কেমন চলছে। এবার গ্রীষ্মকালে ওখানে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসব ভাবছি। এবার কিন্তু গেস্ট হিসাবে নয়, রেগুলার বোর্ডার হিসাবে।

    কৌশিক বললে, আমরা দুঃখিত বাসুমামু। আমাদের হোটেলে আপনার ঠাঁই হবে না। অন্য কোনো হোটেল বুক করুন।

    হো হো করে হেসে ওঠেন পি. কে. বাসু। বলেন, ওরে বাবা! এত রাগ! পয়সা দিয়ে থাকব বলায়? একবারে—’ঠাঁই হবে না?’

    কৌশিক বললে, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। শুধু সেজন্য নয়। হোটেলটা আমরা বিক্রি করে দিয়েছি।

    —বিক্রি করে দিয়েছ। সে কি গো। কেন?

    —চলছিল না। পুজোর সময় কিছুদিন, আর গরমের সময় কয়েক সপ্তাহ—ব্যাস! বাকি সাত-আট মাস তীর্থের কাকের মতো হাপিত্যেস করে বসে থাকা। সবচেয়ে হরিল শীতকালের কটা মাস। দেড় বছর চালালাম—এস্টাব্লিশমেন্ট খরচই ওঠে না। তাই সুযোগমতো একটা অফার পাওয়া মাত্র লক্-স্টক-ব্যারেল বেচে দিলাম।

    —বেশ করেছ! তুমি হলে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার। হোটেল-বিজনেস কি তোমার পোষায়? তা নতুন কি বিজনেস ধরেছ?

    —ধরিনি কিছু। সব বেচে-বুচে ঝাড়া-হাত-পা হয়ে কলকাতায় চলে এসেছি।

    —উঠেছ কোথায়?

    —হোটেলে। একটা বাসা খুঁজছি। আর একটা বিজনেস। লাখ-দেড়েক টাকা ক্যাপিটাল আছে। তাই সুজাতা বললে, চলো, বাসুমামার কাছ থেকে একটু লিগ্যাল অ্যাডভাইস নিয়ে আসি।

    বাসু-সাহেব সুজাতার দিকে ফিরে বলেন, তোমাদের বাসুমামা চেম্বার অফ কমার্স-এর কেউ নন সুজাতা। এখানে আমি কী পরামর্শ দেব? খুন-জখম রাহাজানি যদি কখনও করে ফেল তখন বাসুমামার কাছে এস। পরামর্শ দেব।

    সুজাতা মাথা নেড়ে বললে, উঁহু! খুন-জখম রাহাজানি যদি কখনও করে বসি তবে আর যার কাছেই যাই, আপনার কাছে আসব না। ভরাডুবি হবে তাহলে!

    —কেন, কেন? এভাবে আমার বদনাম করার মানে?

    —বদনাম নয়, বাসুমামু—আপনিই বলেছিলেন একদিন যে, যখন প্র্যাক্‌টস্ করতেন তখন সত্যিকারের অপরাধীর কেস নাকি আপনি নিতেন না!

    —কারেক্ট।

    কৌশিক অবাক হয়ে বলে, নিতেন না! কেন?

    চুরুটটা ধরাতে ধরাতে বাসু-সাহেব বলেন, ওটাই ছিল আমার প্রফেশনাল এথিক্স। যার এজাহার শুনে বুঝতাম সে নিরপরাধ, তার কেসই আমি নিতাম। যাকে মনে হত সত্যিকারের অপরাধী তাকে বলতাম–হয় ‘গিলটি প্লিড’ করে সাজা নাও, নয় অন্য কোনও উকিলের কাছে যাও।

    কৌশিক বলে, সেরেছে! সব উকিল যদি তাই বলে তবে অপরাধীগুলো ডিফেন্স পাবে কোথায়?

    —পাবে না।

    —কিন্তু পিনাল কোড তো বলছে যে, অপরাধীরও ডিফেন্স পাবার অধিকার আছে। যে অপরাধীর আর্থিক সঙ্গতি নেই তাকে তো সরকারি খরচে ডিফেন্স পাইয়ে দেওয়া হয়।

    —তুমি ভুল করছ কৌশিক। পিনাল কোড একথা বলছে না যে, অপরাধীর ডিফেন্স পাওয়ার অধিকার আছে, বলছে অভিযুক্তের আছে, আসামির আছে। ‘অভিযুক্ত আসামি’ আর ‘অপরাধী’ শব্দ দুটোর অর্থ পৃথক। কিন্তু এসব আইনের কচকচি বন্ধ করো। দাঁড়াও, তোমাদের রানু মামিমাকে আগে খবরটা দিই।

    বাসু-সাহেব টেবিলের তলায় একটা ইলেকট্রিক বেল টিপলেন। এসে হাজির হল একটি বছর দশ-বারোর চটপটে ছোকরা।

    —এই বিশে! এঁদের চিনিস?

    —বিশু কৌশিক আর সুজাতাকে এক নজর দেখে নিয়ে বললে, হুঁ। সিনেমা করেন।

    সুজাতা হেসে ওঠে। বাসু-সাহেব বলেন, দুর গরু! এঁরা সিনেমা করেন না। তুই ভিতরে গিয়ে তোর মা-কে বলে আয়, দার্জিলিং থেকে সুজাতা আর কৌশিক এসেছে।

    সায় দিয়ে বিশু ভিতর দিকে চলে যাচ্ছিল। বাসু-সাহেব তাকে ফিরে ডাকেন—এই বিশে, দাঁড়া! কী বলবি?

    —বলব কি, যে দার্জিলিং থেকে সুজাতা আর কৌশিক এসেছে।

    —তাই বলবি! বেটাচ্ছেলে। কী শেখাচ্ছি এতদিন ধরে?

    —তাই তো বললেন আপনে।

    —আমি বললাম বলে তুইও বলবি? না! তুই গিয়ে বলবি দার্জিলিং থেকে সুজাতা দেবী আর কৌশিকবাবু এসেছেন। বুঝেছিস?

    —আজ্ঞে আচ্ছা—এক ছুটে চলে যায় ভিতরে।

    কৌশিক প্রশ্ন করে, নিউ রিক্রুট?

    —সদ্য আমদানি। তবে ইন্টেলিজেন্ট খুব—

    সুজাতা বলে, তাহলে আপনি ও বিষয়ে কোনো পরামর্শ দেবেন না? ঐ আমাদের নতুন ব্যবসা কী জাতীয় হবে সেই প্রসঙ্গে?

    —কে বলেছে দেব না? ক্রিমিনাল লইয়ার হিসাবে আমার বলার কিছু নেই, কিন্তু তোমাদের মামু-হিসাবে পরামর্শ দিতে দোষ কী? বল, কিসের বিজনেস করতে চাও তোমরা? কৌশিক তো শিবপুরের বি.ই.। ঠিকাদারি পোষাবে?

    কৌশিক মাথা নেড়ে বললে, না! আমরা যৌথভাবে আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। এমন একটা পথের নির্দেশ দিন যাতে আমরা দুজনেই ব্যবসায়ে খাটতে পারি। ঠিকাদারি ব্যবসায়ে প্রায় হান্ড্রেড পার্সেন্ট কাজই টেকনিকাল—তাছাড়া ও ঠিকদারি আমার পোষাবেও না।

    বাসু-সাহেব বিচিত্র হেসে বললেন, তবে কী পোষাবে? গোয়েন্দাগিরি?

    একটু বক্রোক্তি ছিল কথাটার ভিতর। কৌশিক, সাময়িকভাবে, ঘটনাচক্রেই বলতে পারি, সুজাতার বাড়ি গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েছিল। এই সূত্রেই সুজাতার সঙ্গে তার পরিচয়, প্রণয় ও পরে পরিণয়। কৌশিক কিন্তু রসিকতার ধার দিয়েও গেল না। বললে, কথাটা আপনি মন্দ বলেননি। বক্সীমশায়ের তিরোধানের পর কলকাতা শহরে নামকরা প্রাইভেট গোয়েন্দা আর কেউ নেই। ফিল্ড আছে, কম্পিটিটার কেউ নেই।

    সুজাতা ভ্রুকুঞ্চিত করে বলে, বক্সী মশাই মানে?

    —ব্যোমকেশ বক্সী! নাম শোনোনি?

    —ও! ব্যোমকেশ বক্‌সী! তুমি কি তাঁর শূন্য আসনে বসতে চাও নাকি?

    কৌশিক কারও উদ্দেশ্যে যুক্তকর কপালে ছোঁয়ালো। বললে, আমি তো পাগল নই। ব্যোমকেশ বক্সী ছিলেন দুর্লভ প্রতিভা। তাঁর মতো গোয়েন্দা আর হবে না; কিন্তু তাঁর তিরোধানের পর কেউ তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে না, এটাই বা কি কথা?

    —কিন্তু আমার সেখানে ভূমিকা কী?—জানতে চায় সুজাতা

    —যুগ পাল্টে গেছে সুজাতা। ব্যোমকেশবাবু যে-যুগের মানুষ তখনও ‘উইমেন্‌স্‌ লিব’ কথাটার জন্ম হয়নি। এখন যদি আমি ঐ জাতের একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে বসি তাহলে তুমি-আমি সমান পার্টনার হিসাবে কাজ করতে পারি। বাসুমামু কী বলেন?

    —তোমাদের ব্যাপার তোমরা বলবে, আমি কী বলব?

    —সুজাতা ছদ্ম-অভিমান করে বললে, বা রে! গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিচ্ছেন?

    —মোটেই নয়! তোমরা যদি চাও—তলা থেকে ঐ মইটা আমিই ধরে থাকতে রাজি আছি!

    —সুজাতা আর কৌশিক পরস্পরের দিকে তাকায়। বলে, কী রকম?

    বাসু-সাহেব গম্ভীর হয়ে বলেন, জোস্‌ অ্যাপার্ট, কয়েকটা কথা তোমাদের বলে নিতে চাই রানু এসে পড়ার আগে। রানু কিছুদিন থেকে খোঁচাচ্ছে আমি যেন আবার প্র্যাটিস্ শুরু করি। আমি রাজি হইনি—ওর কথা ভেবেই। তোমরা যদি সিরিয়াসলি এই প্রস্তাবটা গ্রহণযোগ্য বিবেচনা কর তাহলে আমার প্রস্তাবটা হচ্ছে এই রকম : আমার বাড়িটা দোতলা। ইংরাজি ‘U’ অক্ষরের মত। একতলায় দুটো উইং। পুবদিকের উইং-এ হবে আমার ল-অফিস আর লাইব্রেরি। মাঝখানের অংশটা আমাদের রেসিডেন্স। পশ্চিমদিকের উইংটা হবে তোমাদের প্রাইভেট ডিটেক্‌টিভ এজেন্সির অফিস। একতলা কমপ্লিট। এবার এস দোতালায়। উপর তলায় তিনখানি ঘর। তোমাদের ফ্ল্যাট। গোটা বাড়িটা হচ্ছে আমাদের দুজনের রেসিডেন্স-কাম- অফিস। তোমাদের কাছে যারা কেস নিয়ে আসবে তাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইস নিতে হবে। তাদের তোমরা পাঠিয়ে দেবে ইস্টার্ন-উইং-এ, আমার অফিসে। আবার আমার কাছে যারা ফৌজদারি মামলায় পরামর্শ করতে আসবে তাদের হামেশাই দরকার হবে একজন প্রাইভেট গোয়েন্দার সাহায্য—আমার টেকনিকের জন্য। ঐ জুনিয়র ব্রিফ্ সাজিয়ে দেবে আর কোর্টে দাঁড়িয়ে কথার মারপ্যাচে লিগ্যাল রেফারেন্স দিয়ে কর্তব্য শেষ করার পাত্র আমি নই। ফলে আমরা হতে পারব পরস্পরের পরিপূরক।

    কৌশিক বলে ওঠে, গ্র্যান্ড আইডিয়া।

    —সুজাতা বলে, কিন্তু একটা শর্ত আছে। আপনি এখনই বলছিলেন, এবার গ্রীষ্মকালে আপনি হোটেল রিপোজে যাবার কথা চিন্তা করছিলেন—আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে নয়, রেগুলার বোর্ডার হিসাবে। আমরা যদি এ বাড়ির দোতলায় থাকি তবে ভাড়া দিয়ে থাকব

    বাসু-সাহেব বলেন, রাজি আছি। তবে শর্ত একটা কেন হবে? অনেকগুলি শর্ত হবে।

    —যেমন?

    —ধরো—আমি তোমাদের কেস্ দিলে তোমরা কমিশন চার্জ দেবে। তোমরা আমাকে কেস পাঠালে আমি কমিশন দেব। এসব তো গেল বিজনেসের ডিটেল্স। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে—হেঁশেল হবে একটা। সুজাতা তার ইনচার্জ। তৃতীয়ত দুটি অফিসের জন্য একটিমাত্র রিসেপশান কাউন্টার–এই সেন্ট্রাল ব্লক-এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কম্বাইন্ড রিসেপশান কাউন্টার—এই সেন্ট্রাল ব্লক-এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কম্বাইন্ড রিসেপশনিস্ট একজনই হবেন—তিনি তোমাদের রানু-মামিমা!—ঐ যে নাম করতে করতেই এসে গেছেন উনি।

    সুজাতা উঠে আসে তাঁকে প্রণাম করতে। রানি বলেন, থাক, থাক

    কৌশিক বলে, থাক নয়, মামিমা–আজকে প্রণাম করতে দিতেই হবে। আপনার পায়ের ধুলোর বিশেষ প্রয়োজন আমাদের নতুন বিজনেস-এর উদ্বোধন দিনে।

    —আবার উদ্বোধন! কিসের বিজনেস্ তোমাদের?

    —শুধু আমাদের নয়, আপনাদেরও। আপনি আর মামুও আমাদের পার্টনার। রানি দেবী আকাশ থেকে পড়েন। বাসু তখন মিটিমিটি হাসছেন।

    সুজাতাই পরিকল্পনাটা সাড়ম্বরে পেশ করে। রানি উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। বলেন, এ খুব ভাল হবে। এই নির্বান্ধব পুরীতে তাহলে কথা বলার লোক পাব এবার থেকে! এস সুজাতা, তোমাকে হেঁশেলের চার্জ বুঝিয়ে দিই!

    সুজাতা বলে, সে কি মামিমা, শুভস্য শীঘ্রম্ মানে এই মুহূর্ত থেকেই নয়! আমরা আজকালের মধ্যেই চলে আসব। একটা কাজ কিন্তু এখনও বাকি আছে। আমাদের প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফার্মটার একটা নামকরণ করতে হবে। মামীমা, আপনিই নাম দিন। রানি দেবী আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করেন। বলেন, ওরে বাবা! ও আমার কর্ম নয়। তোমরা বরং তোমার মামাকে ধরো।

    —বেশ আপনিই নাম দিন—সুজাতা ঘুরে বসে বাসু-সাহেবের মুখোমুখি।

    বাসু পাইপটা ধরাচ্ছিলেন। বলেন—উঁ? নাম দিতে হবে? বেশ দিচ্ছি। তোমাদের প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির নাম হবে—’সুকৌশলী’!

    সুজাতা এবং কৌশিক দুজনেই লাফিয়ে ওঠে—গ্র্যান্ড নাম।

    —উহু-হু! তোমরা নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থটা না বুঝেই লাফাচ্ছে মনে হচ্ছে!

    —ব্যুৎপত্তিগত অর্থ! মানে?

    —লেডিজ-ফার্স্ট আইনে প্রথমেই সুজাতার ‘সু’, তার পিছনে পিছনে যথারীতি অনুগামী কৌশিকের-’কৌ’! বাকি শলীটা হচ্ছে ‘খলু পাদপুরণে’। সমস্ত কথাটা একটা ব্যঞ্জনা দিতে!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপথের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল
    Next Article সোনার কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    Related Articles

    নারায়ণ সান্যাল

    অলকনন্দা – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    আম্রপালী – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    বিশ্বাসঘাতক – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    সোনার কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    পথের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    থ্রি এএম – নিক পিরোগ

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    থ্রি এএম – নিক পিরোগ

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    থ্রি এএম – নিক পিরোগ

    September 3, 2025

    থ্রি টেন এএম – নিক পিরোগ

    September 3, 2025

    থ্রি টোয়েন্টিওয়ান এএম – নিক পিরোগ

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.