Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1047 Mins Read0

    মৃন্ময়ী – ১

    এক

    শেষ পর্যন্ত সাদুল্লা আমগাছটায় মুকুল আসায় বাবার গাছ লাগানো যেন ষোল আনা সার্থক। বাবার একটাই দুঃখ ছিল, গাছের কলমটা তাহলে সৈয়দ আলি ঠিক দেয় নি। সব গাছে মুকুল আসে, এটায় আসে না কেন—হাতের দোষ মনে করতে পারেন না। তবে তো সব গাছই বাঁজা থাকত। মাটির দোষ মনে করতে পারছেন না, তবে তো কোন গাছেরই এত বাড় বাড়ন্ত হত না। পরিচর্যার অভাব, তাই বা কি করে ভাবেন—গাছের সঙ্গে তাঁর নিবিড় ঘনিষ্ঠতার কথা তল্লাটের কে না জানে।

    আমার কলেজের সহপাঠী মুল পর্যন্ত একখানা সার্টিফিকেট দিয়ে গেছে বাবাকে। গাছতলায় মাদুরে শুয়ে মুলের কেন জানি মনে হয়েছিল, এমন গাছপালা নিয়ে ঘরবাড়ি বাবার মতো মানুষের পক্ষেই সম্ভব। কথাটা বাবার কানে উঠতেই বলেছিলেন, এরা বেঁচে থাকে বলে মানুষ বেঁচে থাকে। পাখপাখালি উড়ে আসে। কীটপতঙ্গ ফড়িং প্রজাপতি কী নেই বাড়িটাতে। একটা বাড়ির এ সবই হ’ল গে শোভা। মানুষ কেন বোঝে না এটা, তিনি তার মানে ধরতে পারেন না।

    নতুন গাছের প্রথম পাকা আমটি গৃহদেবতার ভোগে দেওয়া হয়। তারপর আমরা। আরও পরে প্রতিবেশীরা। এবং নতুন গাছের আম কেমন সুস্বাদু খেতে, সবাই না জানলে গাছটা লাগানোর সার্থকতা যেন তাঁর কাছে থাকে না।

    ঘরবাড়ির বিষয়ে বাবা বড় সতর্ক থাকেন। মুকুল সাইকেলে আসে। সে শহরে থাকে। এই আসা- যাওয়াটা বাবার কাছে ভারি গর্বের বিষয়। বড় পুত্রের সহপাঠী এবং বন্ধু—তিনি তাকে নিজ হাতে আম কেটে না খাওয়াতে পারলে শান্তি পান না। থালায় সাজানো কাটা আম। লাল টকটকে আভা বের হচ্ছে। কাটার আগে তার নানাবিধ প্রক্রিয়া—অর্থাৎ আমটির বোঁটা কেটে ফেলে জলে কিছুক্ষণ রেখে দেওয়া, এতে ভেতরের কস মরে যায়। ঝাঁঝটি থাকে না। আম খাওয়ার নিয়মকানুন বাবা এত সময় ধরে বোঝাতে শুরু করেন যে মুকুল বিরক্ত না হলেও আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।

    এ সময় মুকুল বড় বেশি সহিষ্ণুতার পরিচয় দেয়। গাছতলায় মাদুর বিছিয়ে দুই সমবয়সী তরুণের তখন কথোপকথন এ রকমের

    —তুমি বিলু রাগ কর কেন বুঝি না। মেসোমশাই এতে এক ধরনের তৃপ্তি পান। আমার তো বেশ ভাল লাগে শুনতে। দেশ ছেড়ে এসে কত কষ্ট করে বাড়িঘর বানিয়েছেন, গাছপালা লাগিয়েছেন, তাঁর গর্ব তো হবেই।

    আসলে মুকুল আমাকে প্রবোধ দেয়। বাবার ব্যবহারে কেউ ক্ষুণ্ণ হতে পারে এটা সে চিন্তা করতেই পারে না।

    চৈত্রের ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। বৈশাখের খর রোদে কখনও আমরা সাইকেল চেপে বাদশাহী সড়কে উঠে যাই। ঘরবাড়ির আকর্ষণের চেয়েও কি এক বড় রহস্য আমাদের বাইরে টানে। বাদশাহী সড়কের দু-পাশে গাছপালা —কখনও ছায়া, কখনও রোদ্দুর—আমরা তার ভেতর দিয়ে ছুটি।

    আমদের ছুটতে ভাল লাগে।

    আমাদের কেউ দেখতে পায়, ধু ধু মাঠের উপর দিয়ে দুই সাইকেল আরোহী যাচ্ছে। কেউ দেখে, কোনো গাছের নিচে বসে আছি আমরা।

    আবার কোনো নদী পার হয়ে যাই।

    জ্যোৎস্না রাতে আমরা দুজন বন্ধু মিলে কখনও চলে যাই জিয়াগঞ্জে। গঙ্গার জল নেমে গেছে। বালির চরা জেগেছে। হাঁটু জল ভেঙে সেই চরায় উঠে রাতের জ্যোৎস্না দেখি। নক্ষত্র দেখি। দূরে শ্মশান।

    আমাদের মধ্যে ক্রমে এক নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। বোধহয় কোন গভীর রহস্যময় বনভূমিতে ঢুকে যাবার আগে সবার এটা হয়।

    অর্থহীন ঘোরা। লালদীঘির ধারে সাইকেলে চক্কর মারি। কথা আছে কেউ এই পথ দিয়ে যাবে। আমরা তাকে দেখব। সে নারী, তার নারী মহিমা ঝড়ো হাওয়ার মতো আমাদের কিছুক্ষণ বিহ্বল করে রাখে।

    আসলে লক্ষ্মীর মৃত্যুর পর আমি আর কালীবাড়িতে থাকতে পারি নি। একজন নারী জীবনের চারপাশে না থাকলে কত অর্থহীন, সেই দেবস্থানে তা প্রথম টের পাই। লক্ষ্মী আমার কে হয়, কি হয় জানি না, কিন্তু লক্ষ্মী না থাকলে দেবস্থানের গাছপালার পাতা নড়ে না, ঝিলের ঘাটটা বড় নির্জন, রেললাইন কোনো দূরের কথা বলে না, এটা টের পেয়েছিলাম। এক গভীর বিষণ্ণতা আমাকে তিলে তিলে গ্রাস করছিল। বাড়ি এলে বাবা মুখ দেখেই টের পেয়েছিলেন, কিছু একটা আমার হয়েছে। বাবা, মা, ঘরবাড়ি ভাইবোন সবাই মিলে কত সহজে সেই গভীর অন্ধকার থেকে আবার আমাকে আলোয় পৌঁছে দিয়েছিল।

    বাবা বলেছিলেন, তবে বাড়িতেই থাক। আর যেয়ে কাজ নেই। দেখি মানুকে বলে দু’ একটা টিউশন ঠিক করে দিতে পারি কিনা।

    টিউশন ঠিক হল, তবে শহরে নয়। মিলের ম্যানেজারের কোয়ার্টারে। তার দুই মেয়ে অষ্টম এবং দশম শ্রেণীর ছাত্রী। শহরের স্কুলে তারা ঘোড়ার গাড়িতে যায়। কুড়ি টাকা দেবে। রোজ সকালে তাদের এখন পড়াবার দায়িত্ব আমার। একটা পুরানো সাইকেল এখন আমার নিত্য সঙ্গী। দু-চার ক্রোশের দুরত্ব আমার কাছে কোন আর সমস্যাই নয়।

    সাইকেলটার সঙ্গে আমার মেজ ভাই পিলুর বড় বেশি শত্রুতা। কোনো কারণে সাইকেল না নিয়ে বের হলে, পিলু তার উপর খবরদারি করবেই। সাইকেলটার কিছু না কিছু অঙ্গহানি না করে সে ছাড়বে না।

    পিলু কেন বোঝে না এই সাইকেলটা আমাকে আবার নিরাময় করে তুলেছে। লক্ষ্মীর অপমৃত্যুতে সহসা আমি থমকে দাঁড়িয়েছিলাম — যেন সে আমার সব শক্তি হরণ করে নিয়ে ঝিলের ওপারে উধাও হয়ে গেল। বাবা, নিবারণ দাসের আড়ত থেকে সাইকেলটা নিয়ে না এলে আমার মধ্যে আবার বেগের সঞ্চার হত না। সাইকেলটার খবর দিয়ে বাবা বলেছিলেন, তুমি দেখ সাইকেলটা চড়তে পারো কি না। আমার সঙ্গে অবশ্য পিলুও সাইকেলটা আয়ত্তে এনে ফেলেছিল। সে বলত, দিবি দাদা তোর সাইকেলটা, চড়ব।

    পিলু সাইকেলটার হ্যাণ্ডেল ধরে রাখত। আমি ওপরে উঠে চালাবার চেষ্টা করতাম। বাবা যজন যাজন সেরে ফেরার পথে আমার আবার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে দেখলে শাস্তি পেতেন। বলতেন, সাবধানে চালিও। হাত পা কেট না। হাত পা কাটলেও তেমন কিছু আসত যেত না। কারণ বাড়ির সীমানায় ভেরেণ্ডা গাছের বেড়া। তার কষ ক্ষতস্থানে বড় উপকারী। বড় হতে হতে গাছপালার গুণাগুণ সম্পর্কে আমাদেরও অনেক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চার হয়েছে। সাইকেলটা যে আমার পিলু বোঝে। সে কারণে- অকারণে চড়তে পারলেই খুশি। বড় বেশি জোরে চালাবার স্বভাব। সাইকেলটা ওর নয় বলে কেমন মায়া দয়া কম। কখনও স্পোক ভেঙে রাখে, কখনও হ্যাণ্ডেল বাঁকিয়ে ফেলে। পুরানো লজঝরে সাইকেলে যে যত্ন নিয়ে চড়তে হয় সেটা সে বোঝে না।

    সাইকেলটায় চড়ে বসতে পারলে কেন জানি মনে হয়, সামনের দূরত্ব বড় কম। রেল-লাইন, টাউন- হল, পুলিশ ব্যারাক, খেয়াঘাট সব বড় কাছে। গায়ে ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগে। নিজেকে বড় হাল্কা মনে হয় সারা আকাশ জুড়ে মেঘ সঞ্চার হতে শুরু করলে, সাইকেলটা ঘর থেকে বের করে নিই। তারপর যেদিকে চোখ যায় উধাও হয়ে গেলে টের পাই ভেতরের সব মেঘ কখন কেটে গেছে। বাবা কি করে যে টের পান সংসারে বেঁচে থাকতে হলে বিলুর এখন একখানা সাইকেলের দরকার, যে বয়সের যা।

    মিলের টিউশনির খবরটা এনেছিলেন নরেশ মামা। বাবার দেশ-বাড়ির সঙ্গে নরেশ মামার কি যেন একটা সম্পর্ক আছে। ওরা আমাদের জমিটা পার হলে যে আম বাগানটা ছিল সেখানে বাড়িঘর তুলে কিছুদিন ধরে আছেন। বনটা যথার্থই এখন একটা কলোনি হয়ে গেছে। চার পাঁচ বছর আগেকার সেই নিরিবিলি ভাবটা একেবারেই নেই। রাস্তাঘাট হচ্ছে। পুলিশ ক্যাম্পের সামনে সারবন্দি সব ঘরবাড়ি উঠে গেছে। নিশি করেরা তিন ভাই। সবাই দেশ ছেড়ে চলে এসেছে। বাবাই চিঠি দিয়ে খবরটা জানিয়েছিলেন। জলের দরে জমি। চলে এস। পরে এলে আর ফাঁকা পড়ে থাকবে না। ফলে আমাদের বাড়ির লপ্তে পর পর সব বাড়িগুলি, বাবার দেশ-গাঁয়ের মানুষে ভরে যেতে শুরু করেছে।

    জমির বিলি বন্দোবস্ত রাজবাড়ির উপেন আমিনকে দিয়ে করানো হচ্ছে। টাক মাথা মানুষটি। গোলগাল চেহারা। জামা কাপড় ফিটফাট। বিক্রমপুরে বাড়ি। কথায় কথায় বিক্রমপুরের মানুষ বলে এক ধরনের গর্ব দেখানোর চেষ্টা আছে। এদিকটায় এলে, একবার হাঁক দেবেনই, বাঁডুজ্যে মশাই আছেন।

    সাইকেলের ঘণ্টির শব্দ শুনলেই বোঝা যেত আমিন এসেছে। তার সঙ্গে থাকে যদুপতি বলে একজন পেয়াদা। মাথায় লম্বা জোকারের মতো টুপি। কোমরে বেল্ট। তাতে ছাপ মারা কাশিমবাজার রাজ এস্টেট। এই ছাপটি দেখিয়ে সে এখন বাড়তি পয়সা কামায়। গায়ে খাকি শার্ট, পায়ে কেডস্। হাফপ্যান্ট খাকি রঙের। চুল সজারুর মতো খাড়া। খ্যাংরা কাঠি আলুর দম হয়ে উপেন আমিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের হাসি পায়। চালচলনে রাশভারি, গম্ভীর কথাবার্তা—এ জমিতে কেন, এখানে কার গরু? এ গাছ কে কেটেছে! বাঁশঝাড়ে হাত দাও কেন? রাজবাড়িতে নালিশ ঠুকে দেব। জমি এখনও সব বিলিপত্তন হয় নি বলে, সবাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সীমানা বাড়িয়ে নেবার। যদুপতির বড় সতর্ক নজর। কাঠা, দুকাঠা বাড়তি জমি একটা বিড়ি খাইয়েও কেউ কেউ সীমানার মধ্যে টেনে নিয়েছে। যদুপতিকে কিছু দিলেই হল। একখানা পেঁপে। তাই সই। একফালি কুমড়ো, তাতেও খুশি। যদুপতির ব্যাগটায় উঁকি দিলে এমন সব নিদর্শন পাওয়া যাবে বলে, পিলুর বড় ওর পাশে ঘোরাঘুরি করার স্বভাব। পিলু বলবে, দেখি আজ তোমার কি আদায় হল।

    যদুপতি বলবে, হ্যাঁ ঠাকুর, তুমি আমার ঝোলা দেখছ কেন?

    পিলু বলবে, ল্যাংরা বিবির হাতায় বসতে দেবে বল?

    —মাছ নেই।

    —হ্যাঁ আছে।

    —ও তো দেড়মণি দু-মণি মাছ। তোমার কম নয় তোলার।

    — যদুপতিকা, তুমি একবার দিয়েই দেখ না।

    যদুপতি একলা না যে দেবে। যদুপতির সঙ্গে আরও একজন পেয়াদা এই তল্লাটে ঘুরে বেড়ায়। রাজা না জানলেও, ওরা জানে এই সুমার আমবাগান এবং বনভূমি ছাড়া কোথায় কি হাতা আছে, পুকুর দীঘি আছে—কোনটায় কি মাছ বড় হচ্ছে—কাগে বগে সম্পত্তি ঠুকরে না খায়, সেজন্য দিনমান সাইকেলে চক্কর দিয়ে বেড়ানো। পাহারার কাজ যদুপতির।

    এই যদুপতি আগেও এসেছে। তবে খুব কম। তখন সে আমার বাবার কাছে কোনো কিছুর প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে থাকত না। বনভূমির মধ্যে বাবা একলা সাহস করে বাড়ি ঘর বানাচ্ছে দেখে সে কিছুটা তাজ্জবই বনে গেছল। তার ভাবনা, এত বড় গভীর বনে কে যে বাবার মাথায় এমন একটা দুর্বুদ্ধি ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। তবু রাজবাড়ির স্বার্থ বলে কথা—যার নুন খেতে হয় তার গুণ গাইতে হয়। জমি যে নিষ্ফলা নয় সেটাই ছিল বাবার কাছে যদুপতির একমাত্র সান্ত্বনা। সান্ত্বনা দিয়ে বলত, বসে যখন গেছেন, তখন আর ঠেকায় কে! দেখুন না কি হয়! পাকিস্তান একেবারে উজাড় করে সব বেটারা পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসছে। শহরের এত কাছে এমন খোলামেলা জায়গা আর কোথায় পাওয়া যাবে! যদুপতিও জানত, বাবা যা একখানা মানুষ, কখন না জানি আবার লোটা কম্বল নিয়ে গরুর গাড়িতে ফের উঠে বসেন। সেই ভয়ে সে সব কাজেই বাবাকে বাহবা দিত। একটা গাছ লাগালেও। তা আপনার হাত লেগেছে গাছ কথা না করে পারে! একজন বাড়িঘর করে যখন বনটায় বসে গেছে তখন আবাসযোগ্য জায়গা অন্যের ভাবতে কষ্ট হয় না। বাবা চলে গেলে সেটাও যাবে। ফলে যদুপতি এদিকটায় খুব কমই আসত। যেন ভয়, এসেই দেখবে আর ঘরবাড়ি নেই। বাড়ির মানুষজন সব চলে গেছে। কারণ যদুপতি এলেই বাবার তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন, আর কে নিল জমি?

    —তিনখানা দরখাস্ত পড়েছে।

    —কে নিল জমি?

    —সন্তোষ সরকার পীলখানার পাশের জমিটা নিয়েছে।

    —কে নিল জমি?

    —টাঙ্গাইলের সরকাররা।

    জমির বিলি বন্দোবস্তের কথা বলে একখানা পরচা বাবার চোখের সামনে মেলে ধরত। বলত, দেখেন, সোজা রাস্তাটি যাবে কারবালার সড়কে। বাদশাহী সড়ক থেকে আর একটা রাস্তা যাবে মিলে। এই যে আমবাগান দেখছেন, এখন দু’শ টাকা বিঘা প্রতি উঠেছে। এখানটায় বাজার হবে। এটা স্কুলের মাঠ। বাবা পরচা, দেখে কেমন আবেগের সঙ্গে বলতেন, হলেই বাঁচি। বিলুটার যা হোক একটা গতি হল। পিলুটা না হয় যজমানি করবে। ছোটটাকে নিয়েই ভাবনা। কোথায় যে পড়াশোনা করবে।

    যদুপতির কথাই শেষ পর্যন্ত ঠিক। নরেশ মামা এসে একটা স্কুলেরও গোড়াপত্তন করে ফেললেন। একা মানুষ। চুল ছোট করে ছাঁটা। হাঁটুর ওপর কাপড় পরেন। গায়ে ফতুয়া। রেওয়া রাজস্টেটে কাজ করতেন। সম্প্রতি অবসর নিয়ে ছোট ভাইয়ের কাছে চলে এসেছেন। স্ত্রী বেঁচে নেই। ছেলে আসানসোলে কোন এক কারখানায় কাজ করে। মেয়েরও বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। ঝাড়া হাত পা। মানুষকে বসে থাকলে চলে না, কিছু একটা করতে হয়। তিনিই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বললেন, কিছু দাও। একটা ঘর খাড়া করি। নরেশ মামা একমাত্র গ্র্যাজুয়েট। কলোনিতে তাঁর কথা কেউ ফেলতে পারে না। এমন একজন মানী ব্যক্তি বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাত পাতলে কে আর না দিয়ে থাকতে পারে। বাবাও দিলেন, জমির খড় এবং বাঁশ। বললেন, চৌধুরী মশাই, নগদ টাকা তো হবে না।

    চৌধুরী মামা এতেই খুশি। তিল সঞ্চয় করলে তাল হয় সে কথাটিও বলে গেলেন। চৌধুরী মামাদের বাড়ির পরে একটা ডোবা এবং বাঁশের জঙ্গল এখনও চোখে পড়ে। ওটা কিনেছে পরাণ চক্রবর্তীরা। বামুনের বাড়ি হওয়ায় বাবার যে মৌরসীপাট্টা ছিল, সেটা যাবার ভয়ে কেমন তিনি কিঞ্চিৎ মনক্ষুণ্ণ ছিলেন। বাড়িতে গৃহদেবতা আছে, না নেই, সে সব খবর সংগ্রহ করে এনে একদিন বলেছিলেন, বুঝলে ধনবৌ, বাড়িতে ঠাকুর নেই সে আবার কেমন বামুন। মা-ও বলেছিল, দেখ কি জাত। এ দেশে এসে তো সবাই কায়েত বৈদ্য বামুন হয়ে গেল। জাতের আর বাছবিচার থাকল না।

    নরেশ মামা আমাকে একটু কেন জানি অন্য চোখে দেখেন। আমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে যান। পড়াশোনার খবর নেন। এবং আমি যে খুব মেধাবী এটাও তাঁর খুব কেন জানি মনে হয়। আচার-আচরণে আমার- প্রতি তাঁর একটা কেমন স্নেহপ্রবণ মন আছে বুঝতে পারি। এটা হয়ত আমিই এই অঞ্চলটার একমাত্র কলেজ-পড় যা বলে কিংবা আমার মধ্যে এমন কিছু গোপন বিনয় থাকতে পারে যা কোন বিদ্যোৎসাহীকে বিদ্যাদানের জন্য উৎসাহ যোগায়। আমাদের সংসারে যে বড় বেশি অভাব আছে তাও তিনি টের পান। তাঁর কাছেই খবর পাওয়া গেল, মিলের ম্যানেজার ভূপাল চৌধুরীর বাবা নরেশ মামার গাঁয়ের লোক। খবরটা বারাই নিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন, বুঝলে ধনবৌ, মহজুমপুরের মনমোহন চৌধুরীকে মনে আছে? রাসুর বিয়েতে গিয়েছিলেন।

    মা মনে করার চেষ্টা করলে বাবা বললেন, মনে নেই জোয়ান মানুষটা হেই বড় একটা লম্বা ঢাইন মাছ বরদির হাট থেকে জেলেদের দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মার বোধহয় তখন বালিকা বয়স। বাবার বোধহয় তখন কৈশোর কাল—সে যাই হোক মা সহসা মনে করে বললেন, হ্যাঁ গালের একটা দিকে শ্বেতী আছে না।

    —ওঁরই ছেলে মিলের ম্যানেজার। আমাদের দেশের লোক।

    আমার তখন যথেষ্ট ক্ষেপে যাবার কারণ থাকে। এই একটা সমাচার – বাবার দেশের লোক মিলের ম্যানেজার—এখন এই সম্বল করে না আবার নিবারণ দাসের আড়তে চলে যান। যার এতদিন শুধুই পুত্র-গৌরব সম্বল ছিল, সে আর একটা গৌরবের হদিশ পেয়ে না আবার গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু হয়ে যান এটা আমি চাই না। তাঁর দেশের লোক একজন ম্যানেজার হয়েছে ত কি হাতি ঘোড়া হয়েছে!

    বাবা স্নানে যাবার আগে কথা হচ্ছিল। শীতকাল এলে বাবা রোদে বসে বেশ সময় নিয়ে তেল মাখেন শরীরে। দিব্যকান্তি বাবার। শীতকালে এত তেল মাখেন যে শরীরের গাত্রবর্ণ ঈষৎ রক্তাভ হয়ে ওঠে। তেলের বাটি সামনে। জলচৌকিতে বাবা বসে। শীতের রোদ্দুর গাছপালার জন্য বাড়িটাতে এমনিতে কম ঢোকে। আকাশের প্রান্তে ঘাড় হেলিয়ে সূর্যদেব তবু যে কিছুটা কিরণ দেন, সে উঠোনটা বড় বেশি প্রশস্ত বলে। এই খানিকটা রোদের আশায়, রোদে বসে তেল মাখার আশায় বাবার শীতকালে স্নান করতে একটু বেশিই বেলা হয়ে যায়। মা’র গজগজ বাড়ে। তেলের বাটি সামনে নিয়ে প্রথমে নখাগ্রে তা ঈশ্বরেভ্যো নমঃ বলে ঊর্ধ্বগগনে পাঠাবেন। তারপর ঈশান নৈঋত কোণে নখাগ্রে তেল সিঞ্চন এবং পরে বসুন্ধরার প্রতি এবং এভাবে বুড়ো আঙ্গুলের নখে, নাসিকা রন্ধ্রে, চোখের দুই কোণে, কর্ণকুহরে এবং নাভিমূলে তেল স্পর্শ করানোর পর তাঁর আসল মাখামাখিটা শুরু হয়। বাবার যে জীবনে সর্দি কাশি হয় না তার মূলে নাকি এই তৈল কৃপাধার নামক মোক্ষম প্রয়োগের জের। সুতরাং আমার কথায় তাঁর নিরতিশয় মর্দনে মনসংযোগ বিনষ্ট হলে কেমন হতবাক হয়ে বললেন, কি বললে!

    —না বলছিলাম, এই মানে ম্যানেজার কি হাতি ঘোড়া নাকি!

    —হাতি ঘোড়া হতে যাবে কেন। ম্যানেজার সোজা কথা! দেশের ছেলে, মিলের ম্যানেজার কত বড় কথা!

    আমি জানি বাবার পৃথিবী এক রকমের। আমার আর এক রকমের। কালীবাড়ি থাকতে রায়বাহাদুর থেকে সব ধনপতি কুবেরের সঙ্গে আমার মেলামেশার সুযোগ হয়েছিল। দূরত্ব না থাকলে কৌতূহল থাকে না। সমীহভাব গজায় না। কাছাকাছি এতসব ডাকসাইটে মানুষকে দেখেছি বলেই একজন ম্যানেজার আমার কাছে তেমন আর জীবনে গুরুত্ব পায় না। আর কি জানি কি হয়, সহজে কাউকে আর শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে রাজি থাকি না। বরং কারো প্রশংসায় কেমন ভেতরে ক্ষুব্ধ ভাব জাগে।

    বাবা বললেন, কটা লোক মিলের ম্যানেজার হতে পারে বল। আর কত বড় কাপড়ের মিল। যোগেশ সরকারকে তো চিনতে। মিলের কেরানীবাবু—কি দাপট ছিল গাঁয়ে।

    যোগেশবাবুকে আমি চিনি। নারায়ণগঞ্জে থাকত বাসা করে। যোগেশ সরকারের ছেলে সুকেশ গ্রীষ্মের ছুটি-ছাটায় দেশের বাড়িতে আসত। টেরি কাটত। ইস্তিরি করা জামা প্যান্ট পরত। সুকেশের দিদি গন্ধ তেল মাখত। জানালায় বসে নীল খামে চিঠি লিখত। সব সময় পায়ে চটি পরে থাকত। এ সব আমাদের কাছে ছিল তখন ভিন্ন গ্রহের খবর। কতদিন সুকেশের দিদির নীল খামে চিঠি ডাক বাক্সে ফেলে দেবার জন্য, বিলের জল ভেঙে হাইজাদির কাছারি বাড়িতে উঠে গেছি।

    আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বাবা বললেন, কি চুপ করে থাকলে কেন। বল! একজন কেরানীর এত দাপট হলে ম্যানেজারের কত দাপট হতে পারে। একটা মিল চালানো সোজা কথা। হাজার লোক কাজ করে। সবার খবর রাখতে হয়। তার মর্জিতে মিলের ভোঁ শুনতে পাও। কটা বাজল টের পাও। সে না থাকলে সব ফাঁকা। কত দূর থেকে এই মিলের বাঁশি শোনা যায়। লোকটা তার দড়ি ধরে বসে থাকে। সে টানলে বাজবে, না টানলে বাজবে না।

    বাবার সঙ্গে আজকাল আমার তর্ক করার স্বভাব জন্মেছে। আগে এটা একেবারে ছিল না। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে কথায় পেরে না উঠলে গুম মেরে যান। ছেলে লায়েক হয়ে গেছে মনে করেন। তখন কেন জানি আমাকেই হার মানতে হয় বাবার মুখের দিতে তাকিয়ে। যেন আমি তর্ক করছি না, বাবার পিতৃত্বের অধিকার হরণ করে নিচ্ছি। বলেছিলাম, এগুলো কথা হল বাবা!

    মাথার তালুতে হাতের তালু সহযোগে বাবা প্রায় তখন তবলা বাজাচ্ছিলেন। মুখের উপর কথা বলায় কিঞ্চিৎ রুষ্ট। রুষ্ট হলে, হাত পা এমনিতে মানুষের কাঁপে। বাবার তালুতে তালু সহযোগে তেলের ক্রিয়াকলাপ প্রসার লাভ করেছে মস্তিষ্কে, না তিনি ক্ষেপে গিয়ে এমন অধীর চিত্ত হয়ে পড়েছেন যে হাত নামাতে ভুলে গেছেন বুঝতে পারলাম না। বেগ থামাবার জন্য বললাম, তাই বলে আপনি একজন ম্যানেজারকে নিয়ে গর্ব করতে পারেন না। তিনি তো আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নন।

    —ঠিক। তবু যার যতটুকু সম্মান প্রাপ্য দিতে হয়। সংসারে এতে সুখ আসে। বিদ্যাসাগর প্রাতঃস্মরণীয়। কোটিতে গুটি। ম্যানেজার লাখে এক। দাবার বড়ের মতো যার যেমন বল। তাই বলে কেউ ছোট নয়। মানুষকে বড় ভাবার মধ্যেও একটা মহত্ত্ব থাকে। এ সব সংসারে শিক্ষণীয় বিষয়। এগুলো তোমার পরিচয়। তুমি শুধু আমার সন্তান এই পরিচয়ের সঙ্গে মিলের ম্যানেজার তোমার দেশের লোক কথাটা কত গুরুত্ব বাড়ে বুঝতে শেখ।

    আসলে বাবা যা বলতে চান বুঝতে পারি। মানুষের এ ভাবে একটা ডাইমেনশান তৈরি হয়। ছিন্নমূল পিতা তাঁর পুত্রের এবং পরিবারের ডাইমেনশান খুঁজতে চান বলেই এত সব কথা। আমি অগত্যা মেনে নিয়ে বলেছিলাম, কখন পড়াতে যেতে হবে।

    বাবা বলেছিলেন, সকালে যেতে পার, বিকালে যেতে পার, সন্ধ্যায় যেতে পার। যেমন তোমার সুবিধা। নরেশ চৌধুরীই তোমার হয়ে বলে এসেছেন।

    —কবে থেকে যেতে হবে?

    —পয়লা জ্যৈষ্ঠ। তবে আমি রাজি হইনি।

    —রাজি হন নি মানে!

    —দিনটা ভাল না। গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান ভাল না। তুমি বুধবার সকালে যাবে। তিথি নক্ষত্র ঠিক আছে।

    এবং খবরটা নরেশ মামাকে দিতে হয়। আমার একটা টিউশন সত্যিই দরকার হয়ে পড়েছে। কলেজে পড়লে টিউশন করার হক জমে যায়। মাগ্যি গন্ডার বাজারে টাকাটা নেহাত কম না। কুড়ি টাকায় এক মণ চাল হয়ে যায়। মা-র সাদাসিধে হিসাব। সংসারে এক মণ চালের দাম বিলু রোজগার করে আনবে সোজা কথা না। টিউশনের প্রথম টাকায় কি কি হবে তারও একটা তালিকা তৈরি হয়ে গেল। পিলু বারান্দায় বসে বড়শির সুতো পাকাচ্ছিল। সে তালিকাটি শুনছিল বোধহয়। তার মনঃপুত হয় নি। ছিপ বঁড়শি সব একদিকে ঠেলা মেরে রেখে রান্নাঘরে হাজির। মা-র এলাকা এটা। মা পছন্দও করে না পিলু যখন তখন রান্নাঘরে ঢুকে যাক। কারণ রান্না না হতেই ওর এটা ওটা হাত বাড়িয়ে খাবার স্বভাব।—দাও না মা, তিলের বড়া একটা। দাও না মা একখানি ডিমের ওমলেট। মা তখন ভারি রেগে যায়।—খেতে বসলে দেব কি। সুতরাং পিলু রান্নাঘরে ঢুকে যাওয়ায়, মা তার রান্না করা তরিতরকারি সামলাতে থাকল। পিলু সেদিকে মোটেই গেল না। কেবল বলল, দাদা তোর দেখিস কিছু হবে না।

    এমন কথায় মা খুব রেগে গেল।—তুই বড় অলুক্ষণে কথা বলিস পিলু, এমন বলতে নেই।

    —ঠিকই বলেছি। দাদা কথা দিয়ে কথা রাখে না। রহমানদা এতগুলি টাকা দিল, সব সাবাড়। নবমীকে দাদা শীতের চাদর কিনে দেবে বলেছিল।

    —দেওয়ার সময় তো যায় নি। পরে হবে।

    পিলু বলল, কথা দিলে কথা রাখতে হয়।

    আমি বললাম, কথা রাখা হবে। কথা রাখা হবে না কে বলেছে?

    —কথা রাখা হয়নি, আমি বলছি। নবমী শীতে বড় কষ্ট পায়।

    পিলুর সব মনে থাকে। নবমীকে আমি কথা দিয়েছিলাম, একটা চাদর দেব প্রথম উপার্জনের টাকায়। বদরিদা আমায় হাত খরচ দিতেন সামান্য। পিলুর মতে ওটিই আমার প্রথম রোজগার। সেখান থেকে সঞ্চয় করে উচিত ছিল নবমী বুড়িকে একটা চাদর কিনে দেওয়া। সেটা হয়ে ওঠেনি। পিলু এতে সংসারের অমঙ্গল হচ্ছে ভেবে থাকে। সে তালিকাটির সামান্য পরিবর্তন করে বলল, একটা চাদরের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মরে যাবে- সে হয় না। দাদা টাকা পেলেই সে একটা চাদর কিনে আনবে এই জেদ ধরে বসে থাকলে মা বলল, অত দান ধ্যান করবে কোত্থেকে। তোমাদের বাবার কি জমিদারি আছে। হুট করে কথা দিলেই হয়। হবে না। এখন হবে না যাও।

    —একশ বার হবে। দাদার টাকা, তোমার টাকা না।

    মা কেমন রোষে উঠল। আমার টাকা না, কার টাকা। পেটে না ধরলে আসত কোত্থেকে। দাদাকে পেতে কোথায়। দাদার রোজগার হত কোত্থেকে

    বাবা বারান্দায় বসে সব শুনছিলেন। চোখ বুজে মা-ছেলের কথা কাটাকাটির মজা উপভোগ করছেন। বোঝ এবার। ছেলেরা বড় হচ্ছে, বোঝ এবার। আমিই তো কেবল দানছত্র খুলে বসে থাকি—এখন কে করে। গ্রহগুরু বাড়ি এলে ফলটল দিতে হয়, দিতে গেলেই তোমার বাজে। সংসারের কুটো গাছটি পর্যন্ত তোমার লাগে। আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর রমণী। বাবার মুখ দেখে টের পাই তিনি এ সবই চোখ বুজে ভাবছেন। একটা কথা বলছেন না। মায়া বলছে, দিক না না। দাদার এতে খুব ভাল হবে।

    —দিয়ে দাও না। সবই দিয়ে দাও। কে বারণ করেছে।

    বাবা আর যেন পারলেন না। তিনি স্নানে যাবার আগে বললেন, পিলু যখন বলেছে দাও।

    —বললেই দিতে হবে, ও কি বাড়ির কর্তা। বিলুটার একটা ভাল জামা নেই। কি পরে যাবে? ভেবেছ!

    বাবা আর রা করলেন না। পিলু বুঝল সুবিধে হবে না তর্ক করে। মা একখানা যেন কিরীটেশ্বরী। হাতে খড়্গা তুলেই আছে। তবু মাকে জব্দ করার জন্য সে নিমেষে হাত বাড়িয়ে দুটো তিলের বড়া নিয়ে ছুট লাগাল। মাও আমার ক্ষেপে গেছে ততোধিক। হাতে খুন্তি নিয়ে ছুটছে মেজ পুত্রটির পিছু পিছু। মেজ পুত্রটির নাগাল পাওয়া কঠিন। সে যত দৌড়ায় না তার চোয়ে বেশী লাফায়। মাকে দেখিয়ে দুরে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছে। মা’র চিৎকার, খেতে আসিস। দেব খেতে। শুধু ভাত দেব। গোনা গুনতির গুঁড়া তোর এত নাল গড়ায় জিভে। তোর কোথাও জায়গা হবে না দেখিস।

    পিলুর ভ্রূক্ষেপ নেই।

    আমি বললাম, ঠিক আছে আর বকো না। নবমীকে চাদর দিতে হবে না। তোমার কথা মতোই সব হবে।

    —দিতে হবে না তো বলি নি, পরে দেবে। ম্যানেজারের বাসায় তোমার টিউশনি—এক জামা গায় দিয়ে গেলে ওরাই বা কি ভাববে।

    —পিলুর দোষ নেই মা। আমি বলেছিলাম, ওকে দেব। এখনও দেওয়া হয়নি। কথা দিলে খেলাপ করতে নেই।

    মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোরা যে হুট করে কথা দিস কেন বুঝি না। কথা যখন দিয়েছিস, দিবি। তবে আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি, পিলুকে আমি খেতে দিচ্ছি ত আমার নাম সুপ্রভা দেবী নয়।

    সে তুমি দিও না। যেমন পাজি ছেলে, বুঝুক না খেয়ে থাকলে কেমন লাগে।

    খেতে বসার সময় দেখলাম, মায়া আমার বাবার আর পুনুর আসন পেতেছে। পিলুকে যখন খেতে দেওয়া হবে না ঠিক হয়েছে তখন আর আসন পেতে কি হবে। মা দেখছিল মায়ার কান্ড। কিছু বলছে না। একবার উঠোনে বের হয়ে দেখল তার মেজ পুত্রটির সাড়া শব্দ পাওয়া যায় কি না। না নেই। মা’র রাগ পড়ে গেছে বুঝতে পারি। রাগ পড়লেও জেদ কমে না। পিলুর খোঁজ খবর দরকার। মা কিছু না বললেও এটা আমাদের যেন বোঝা উচিত। অথচ আমরাও পিলু সম্পর্কে উচ্চ বাচ্য করছি না দেখে কেমন গুম মেরে গেল। এবং এ সময় দেখেছি, মা’র রাগ যত বাবার উপর। বাবা আসনে বসলে বলল, নাও খেয়ে নাও। নিজেরটা ষোল আনা – আর কে খেল না খেল দেখার দরকার নেই। ভাতের থালা সামনে রেখে বলল, আর এক দন্ড বাড়িটাতে থাকতে ইচ্ছে হয় না। আমার হয়েছে মরণ। এক একজন এক এক রকমের। যাব যেদিকে দুচোখ যায় বেরিয়ে।

    বাবা বললেন, বিলু যা তো বাবা ডেকে নিয়ে আয়। না এলে খেতে বসেও শান্তি পাবি না। এবং পিলুকে ডেকে এনে খেতে বসালে, মা আমাদের চেয়েও বেশি বেশি দিল পিলুকে। বলল, দেখিস, চাদরের একটা কত দাম দেখিস। কথা দিলে কথা রাখতে হয়। কবে মরে যাবে, না দিলে শেষে পাপ হবে। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি। ভয় লাগে বাবা।

    রাতে ভাল ঘুম হয় নি। মাথায় দুশ্চিন্তা থাকলে যা হয়। সকালে উঠে টিউশনিতে যেতে হবে। বাবা দিনক্ষণ দেখে রেখেছেন। অন্ধকার থাকতেই তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি শুয়ে শুয়ে স্তোত্রপাঠ করছেন।

    আমার আর পিলুর জন্য বাড়িতে একখানা তক্তপোষ হয়েছে। ওটায় আমরা শুই। রান্নাঘরের পাশে মাটির দেয়াল দিয়ে একখানা ঘর। ওটাতে আমরা থাকি। পুবের ঘরে মা, পুনু, মায়া আর বাবা থাকেন এখন। স্তোত্র পাঠ আজ একটু বেশি জোরে জোরেই হচ্ছে।

    এখন একখান উঠোনের চার ভিটের চারখানা ঘর। একটা গোয়াল, একটা ঠাকুরের একটা আমাদের আর একটা বাবা-মার। উঠোনের কোণায় একটা পেয়ারা গাছ। পুবের ঘরের কোণে ডালিম গাছ। তার পাশে তুলসী মঞ্চ। টালির লম্বা বারান্দায় একখানা কাঠের চেয়ার থাকে। জলচৌকি থাকে। ঘরবাড়িতে বাস করতে হলে এগুলোর দরকার, বাবার ধীরে ধীরে এ সব বোধ জাগ্রত হচ্ছে দেখে মা খুব খুশি। রাতে চেয়ার এবং জলচৌকি ভিতরে তুলে রাখতে হয়। মানুষের আবাস হলে চোর- বাটপাড়েরও উপদ্রব বাড়ে। ইতিমধ্যে মা’র একখানা কাঁসার গ্লাস চুরি যাওয়ায় বাবা মাঝে মাঝে লন্ঠন জ্বেলে গভীর রাতে বারান্দায় বসে তামাক খান। অথবা শুয়ে থাকলেও শোনা যায় বাবার গুলা কারি। যেন, বাড়ির এই গাছপালা ইতর প্রাণীসহ সবাইকে জানিয়ে দেওয়া ঘরবাড়ির মানুষটা ঘুমান না। কোনো শব্দ হলেই টের পাবেন। বৃথা তোমাদের ঘোরাঘুরি।

    মাথায় দুশ্চিন্তা এইজন্য, ম্যানেজারের দুই মেয়েকে আমি কতটা সামলাতে পারব। ছোটটি নাকি বড়ই চঞ্চল। টিউশনের অভিজ্ঞতা দেবস্থানে বছর দেড়েক ঝালিয়েছি। ওরা শত হলেও আমারই গোত্রের। দরকারে প্রহার কিংবা নীল ডাউন যখন যা খুশি করাতে পেরেছি—কিন্তু এখানে দুই বালিকা না বলে কিশোরী বলাই ভাল—তারা আমাকে কতটা সুনজরে দেখবে—ভয়টা এখানেই। পড়া ঠিকমতো করবে কিনা, কিংবা আমাকে ফ্যাসাদে ফেলার জন্য এমন সব কঠিন টাস্ক রেখে দেবে যাতে দুরবস্থার এক শেষ। আর অঙ্ক বিষয়টি এমনিতেই আমার কব্জার বাইরে। ইংরাজির পাংচুয়েশন কিংবা টেনস ভেতরে সব সময় কেমন টেনসান সৃষ্টি করে—শেষে না অপদস্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়। অধীত বিদ্যার তুলনায় একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে যেন টিউশনটা নিয়ে। রাতে দুশ্চিন্তাটা বেশ করেই মাথায় জাঁকিয়ে বসেছিল— শেষ রাতের দিকে ঘুম লেগে এলেও, বড় পাতলা ছিল ঘুম। বাবার স্তোত্রপাঠে তাও ভেঙে গেল।

    মা রোজই খুব সকালে ওঠে। আজ যেন একটু বেশি সকালে উঠে পুকুরে বাসন মাজতে চলে গেছে। জমির শেষ লপ্তে জঙ্গল সাফ করতে গিয়ে একটা ছোট্ট পুকুরও আবিষ্কার করা গেছিল। এমন কি তার ঘাটটাও বাঁধানো। আমরা পুকুরটা আবিষ্কার করে তাজ্জব হয়ে গেছিলাম। ঘাটটার সানে অশ্বত্থের গাছ। আর এমন ঝোপঝাড় যে আমরা ওর ভিতরে ঢুকতেই সাহস পেতাম না। এমন কি পিলু পর্যন্ত একবার গভীর আগাছার এবং কাঁটা গাছের জঙ্গলে ঢুকে দেখেনি কি আছে। ঘাটলাটার বড় জীর্ণ অবস্থা। ভাঙাচোরা। অনেকটা পাড় ভেঙে যাওয়ায় সিঁড়ির ধাপ আর স্পষ্ট বোঝা যায় না। মাটির ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে আছে যেন। বাবা মাটি সরিয়ে জঙ্গল সাফ করে এবং আরও কিছুটা খুঁড়ে ফেললে, যে জলের দেখা মিলল, তাতে করে সম্বৎসর জল সরবরাহের ব্যবস্থা হয়ে গেল। মা বাসন মাজে, কাপড় কাচে, এমন কি চানের জন্যও মা আর কালীর পুকুরে যায় না। পুকুর না বলে ডোবা বলাই ভাল। তবে বাবা এটাকে পুকুরই বলতে চান। টাকা পয়সা হাতে এলে পাড়ে আরও কিছুটা মাটি ভরাট করে দিলে পুকুরই হয়ে যাবে। যদিও এক কোণায় আছে বাঁশের ঝাড়, বাঁশপাতা পড়ে পুকুরের জল কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যায় তবু বাবা আশা রাখেন এই জলে স্নান থেকে আরম্ভ করে গৃহদেবতার ভোগের রান্নার জলও মিলে যাবে।

    এতদিনে যেন আমরা বুঝতে পারি বাবা কেন জমি সাফ করতে করতে সহসা সব থামিয়ে দিলেন। পাঁচ বিঘের মধ্যে বিঘে চারেক উদ্ধারের পরই বাবা আর এগোলেন না। বাবা কি মাকে ঘরবাড়ির শেষ খবর আচমকা দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন, তুমি আমাকে সোজা মনে কর না। জমি আমি চিনি। আমি কেন, সেই আদিকাল থেকেই এই জমির উপর মানুষের প্রলোভন। ঘরবাড়ি করেছে। ঘাটলা বাঁধিয়েছে। এখানে যে মাটির নিচে কোন নীল কুঠি কিংবা পর্তুগীজ লুটেরাদের গুপ্তধন পোঁতা নেই কে বলবে! ধীরে ধীরে সব তুমি পেয়ে যাবে।

    বাবা অবশ্য পুকুরটার খবর পান গত পূজার পর। আমি বাড়ি এলে, বাবা টের পান, ভিতরে আমার বড় কষ্ট। লক্ষ্মী আত্মঘাতী হওয়ায় আমি কেমন ভেঙে পড়েছিলাম। রাতে ঘুমাতে পারতাম না। যেন দেখতে পেতাম লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে আছে এক শস্যক্ষেত্রে। বুকের কাছে একটা পুঁটুলি। সে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে পুঁটুলিটা খুলে দেখাবে বলে। তারপর খুলে দেখালেই সেই এক দৃশ্য, একটা ছাগশিশুর কাটা মুণ্ডু। চোখ স্থির। কান খাড়া। কলাপাতায় রক্তের দাগ। এমন একটা দুঃস্বপ্নের তাড়নাতেই আমাকে শেষ পর্যন্ত দেবস্থান ছাড়তে হয়। বাবা নানা প্রকার অমোঘ ভয় নিবারণী ওষুধ এবং টোটকা সংযোগে আমাকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টায় ছিলেন। বাবার একনম্বর টোটকা ছিল একটি নিম গাছ রোপণ। সেটি আমাকে দিয়ে রোপণ করালেন। আত্মঘাতী হলে আত্মার বড় স্পৃহা হয় বাতাসে ভেসে বেড়ানোর। সে মুক্তি চায়। নিমগাছটি যত বড় হবে, যত এর সেবায় আমার জীবন নিযুক্ত থাকবে তত লক্ষ্মীর মায়া কাটবে। ইহজীবনে সবই মায়া এমনও বোঝালেন। মন খারাপ লাগলে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা কর। কথা বল, জীবনে দেখবে নতুন পাতা গজাচ্ছে। একজনের মৃত্যুতে সংসার আটকে থাকলে ঈশ্বরের লীলা খেলার মাহাত্ম্য কোথায়। তাঁরই ইচ্ছেতে সব। তুমি আমি নিমিত্ত মাত্র। মহাকালের গর্ভে তুমি আমি এই গাছপালা প্রাণীজগৎ এবং বসুন্ধরা কে নয়—সব হারিয়ে যাবে। তবে এত ভাবনা কেন! এ বাবাকে আমি তখন চিনতে পারি না। বাবার টোটকা যে কত ফলদায়ক হপ্তাখানেক পার না হতেই বুঝেছিলাম।

    বয়স মানুষকে কত প্রাজ্ঞ করে বাবাকে না দেখলে বোঝা যায় না। সবচেয়ে বিস্ময় লাগে বাবা যেন আগে থেকেই সংসারের মঙ্গল অমঙ্গল টের পান। তাঁর অভয় আশ্চর্য রকমের সান্ত্বনার জন্ম দেয়। সকালেই বাবা বললেন, যাবার আগে ঠাকুর প্রণাম করে যেও। প্রথম যাচ্ছ। সাবধানে যাবে।

    এ সব কথা কেন—বুঝি! আশ্রয় এবং আত্মবিশ্বাস মানুষের বড় দরকার। ঈশ্বরের প্রতি নির্ভরশীল হওয়ার এটাই একটা বড় সুবিধা। এবং ঠাকুর প্রণাম সেরে নরেশ মামার দেওয়া চিরকুটটি পকেটে পুরে যখন রওনা হলাম তখন কেন জানি মনে হল, আমি অনেকটা দুশ্চিন্তা-মুক্ত।

    নরেশ মামার নির্দেশ মতো আমি মিলের একনম্বর গেটে গিয়ে চিরকুটটি দেখালেই গেট খুলে দেবে। মিলের ভেতরটা কি রকম জানি না। পিলুর ভারি ইচ্ছা ভেতরটায় ঢুকে দেখে। মা বলেছে, বিলু তো যাচ্ছে। একদিন তোকে নিবে যাবে।

    আমার কেন জানি এ সব কথাতে পিলুর উপর বড় রাগ হয়। কেমন আদেখলা স্বভাব পিলুর। আমি একজন গৃহশিক্ষক মিল-ম্যানেজারের-যেন ম্যানেজারের চেয়ে আমার সম্মান কম না—সমানে সমানে যখন, তখন কিনা তুই আমার ভাই হয়ে একটা মিল দেখার বাসনা মনে মনে পুষে রেখেছিস! তোর কি বুদ্ধিসুদ্ধি হবে না! হলে কি হবে, গোঁয়ার হলে যা হয়, সে মাকে বলে রেখেছে, দাদা গেলে আমিও যাব।

    —তা যা না, কে বারণ করেছে। আমার সঙ্গে কেন! অবশ্য সবই মনে মনে—কারণ পিলুকেও জানি, অভিমান তার বড় বেশি। আজকাল অভিমান হলে সে আমাকে এড়িয়ে চলে। যেন আমার সঙ্গে সত্যি পিলুর একটা ব্যবধান গড়ে উঠেছে। বলেছিলাম, আগে যাই তো, পরে দেখা যাবে।

    পিলু বলেছিল, আমি জানি, দাদা আমাকে নেবে না!

    —জানিস তো বেশ।

    কথা-কাটাকাটির পর্বে বাবার উদয় হয়। – লেগে গেল খণ্ডযুদ্ধ। নিয়ে যেতে তোমার আপত্তিটা কিসের!

    আপত্তি কেন, আমিও বুঝি না। কালীবাড়িতেও পিলু গেলে আমি রাগ করতাম। রাগের হেতু একটাই, পিলু গেলে যেন সবাই টের পেয়ে যাবে আমরা কত গরীব। কারণ পিলুর পোশাক-আশাক আচরণ সবই গরীব মানুষের মতো। বাইরে বের হয় নি। বের হলে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করলে বুঝত ভিতরের দৈন্য ভাবটা সবাই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। পিলুর সেই সুযোগই হয় নি। লে হয় তো গিয়েই হামলে পড়ে বলবে, এটা কি, ওটা কি, ঐ তারের লাইনটা কোথায় গেছে! টিপে দিলে আলো জ্বলে—ওরে বাবা, রেডিওতে গান হলে সে তাজ্জব বনে যায়। একখানা যন্ত্র না দাদা- কি করে হয়। কি করে হয়, তার ব্যাখ্যা কম লোকই জানে। তাই বলে চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে থাকা কি যে বাজে ব্যাপার। পিলুটা তা বোঝে না।

    রাস্তায় বের হলেই কেমন মৃদুমন্দ হাওয়া লাগে গায়ে। বেলা যত বাড়ে রোদের তাত তত বাড়ে। লু বয়। গরম হাওয়া বাড়িটার উপর দিয়ে বয়ে যায়। গাছপালাগুলির অন্তরালে থাকে ঠাণ্ডা এক জগৎ। দুপুরের গরম কেমন আটকে রাখে তারা। বিকালে এই গাছের ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকার মধ্যে আছে এক অশেষ আরাম।

    কলোনি থেকে দুটো পথেই যাওয়া যায় মিলে। বাড়ি থেকে বের হয়ে চৌধুরী মামাদের বাড়ির পাশ দিয়ে ঢুকে গেলে পড়বে তেলির বাগান। জায়গাটায় কত বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে থাকে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। আর তার ছায়া অনেকখানি পথ জুড়ে। গ্রীষ্মকাল বলে একটু বেলাতেই কেমন গরমে হাঁসফাঁস করে শরীর। ছায়ার লোভে সেই পথটাই আমায় টানে। সাইকেল যত চলে, তত ভেতরে এক গুঞ্জন। আমি বড় হয়ে যাচ্ছি। আমার অস্তিত্বের সংকট তৈরি হচ্ছে। আমি নিজেই একটা যেন আলাদা গ্রহ। আমার এই গ্রহে সুমার মাঠ যেমন আছে, আছে পাহাড় এবং ফুলের উপত্যকা এবং গভীরে দেখতে পাই হিংস্র শ্বাপদেরা চলাফেরা করে বেড়ায়। ছোড়দি এবং লক্ষ্মী আর রায়বাহাদুরের নাতনি মিলে আমার ভেতর বেঁচে থাকার বড় হবার সংকট সৃষ্টি করে গেছে। এই সংকটই আমাকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ছুটিয়ে মারছে। গোপনে সব সুন্দরী তরুণীরাই আমার প্রেমিকা হয়ে যায়। নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার সময় দেখতে পাই, ওরা দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত তুলে দিয়েছে। ওদের অবাক করে দেব, আমার বাহাদুরিতে ওরা চোখ বিস্ফারিত করে তাকাবে, আমার মধ্যে গড়ে উঠবে কোন গৌরবময় অধ্যায়—এমনই যেন আমার আকাঙক্ষা।

    রাস্তাটা এসে কারবালার সড়কে মিশেছে। তারপর সোজা উত্তরে—দু তিনটে পাটের আড়ত পার হয়ে চৌমাথায়। বাঁ দিকে ঘুরে গেলে বড় লাল ইটের দালান, সামনে লন, পরে ঘাটলা বাঁধানো বিশাল পুকুর এবং তারপরই মিলের পাঁচিল আরম্ভ। রাস্তার ডান দিকটায় নিচু সমতল জমি। ধান পাটের চারা হাওয়ায় দুলছে। মিলের এক নম্বর গেটের পাশে টিনের শেড দেওয়া যামিনী পালের চায়ের দোকান। দুটো টুল, কেতলি, কাঁচের গ্লাস, টিন ভর্তি লেড়ো বিস্কুট। দু-একজন লোক ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে, চা খাচ্ছে। একটা লোক টুলে শুয়ে এই সাত সকালে দিবানিদ্রা দিচ্ছে। একটা গুম গুম আওয়াজ ভেসে যাচ্ছে বাতাসে।

    পাঁচিলটা এত উঁচু যে ভিতরে কি আছে কিছুই দেখা যায় না। আমি, পিলু রাস্তাটায় আরও দু- একবার এসেছি। পাঁচিলটার ও পাশটায় এক রহস্যময় জগৎ আছে এমন কেবল মনে হত। একটা কাপড়ের মিল কত বড় হয় আমাদের জানা নেই।

    গেটের দারোয়ানকে চিরকুটটা দেখাতেই আমাকে সেলাম করল। এটা খুবই আমার কাছে অভাবিত বিষয়। নিজের পোশাক-আশাক আর একবার ভাল করে দেখলাম। আয়না থাকলে এখানেও মুখখানা আর একবার ভাল করে দেখতাম। আজকাল কু-অভ্যাস হয়ে গেছে, গোপনে আর্শিতে নিজের মুখ উবু হয়ে পড়ে দেখতে বড় ভালবাসি।

    বাবার সামনে আর্শিতে মুখ দেখা যায় না। আর্শি নিয়ে টেরি কাটলে এবং বারবার মুখ দেখলে বাবা কেমন ক্ষুব্ধ হন। তাঁর কাছে এটা হয়ত বেয়াদপির সামিল। কারণ দু-একবার তাঁর চোখে পড়ে গেলে তিনি বলতেন, এ সব কু-অভ্যাস ছাড়। এগুলো ভাল না। এতে নিজেকে ছাড়া তোমার আর কিছু আছে ঘরবাড়িতে মনে হয় না। বাবা মা দুজনেই বিষয়টা পছন্দ করত না। ফলে এটা আমারও মনে হয়েছে মানুষের অনেক কুঅভ্যাসের মধ্যে একটা। যেমন বাবার কাছে, চা খাওয়া, সিগারেট খাওয়া কুঅভ্যাসের মধ্যে পড়ে এবং বাবা যে তামাক খান তাও খুব ভাল একটা অভ্যাস নয় তখন কথায় কথায় তা ধরিয়ে দিতে ভুলে যান না। এটা আমার হয়েছে রহমানদার কাছে থাকতে। তখন আমি বাড়ি থেকে পলাতক। সেখানে এক ছোড়দিকে আবিষ্কারের পরই কুঅভ্যাসটা গড়ে উঠেছে। ছোড়দিকে দেখার পরই মনে হয়েছে, আমার কিছু নিশ্চয়ই আছে যা ছোড়দিকে ক্ষেপিয়ে দেয়। সেই অভ্যাসটা দেবস্থানে বেড়েছিল। লক্ষ্মী দেখলে বলত, মাস্টার তুমি দেখতে খারাপ না গো। আয়নায় এত কি দেখছ হামলে পড়ে।

    এ সবই বোধহয় বড় হওয়ার লক্ষণ। একদিন আমি আর মুকুল সেলুনে গিয়ে দাড়ি গোঁফ চেঁচে ফেললাম। নরম সবুজ দাড়িতে গাল ভরে থাকলে কেমন বেঢপ লাগে নিজেকে। এবং সেদিনটায় বাড়িতে বাবার কাছে প্রায় পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম। বাবা এ দরজা দিয়ে ঢোকে ত আমি ও দরজা দিয়ে বের হয়ে যাই। কুকর্ম করে ফেললে, পিতার কাছে পুত্রের যে অপরাধ ধরা পড়ে এও যেন অনেকটা তাই। মায়া তো চিৎকার করে বলেই ফেলেছিল, ওমা দাদাকে কেমন লাগছে দ্যাখ মা। দাদা তুই কিরে!—যা ভাগ বলে সরিয়ে দিয়েছিলাম মায়াকে। পিলুটার গোঁফ এখন উঠব উঠব করছে। দু-তিন বছরে পিলু হঠাৎ বেড়ে গিয়ে যেন আমার মাথা ছুঁয়ে ফেলছে। মাঝে মাঝেই পাশে দাঁড়ালে, মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, মা দেখ, আমি দাদার সমান হয়ে গেছি না?

    পিলু আমার সমান হবে লম্বায় কিছুতে সহ্য হত না। বলতাম, তুই আমার সমান লম্বা হবি, তা’লেই হয়েছে। নরেশ মামার স্কুলে পিলু ভর্তি হয়েছে। মায়া যায়। পুনু কলাপাতায় অ আ লেখে। সেও শ্লেট বগলে করে স্কুলে যাবার জন্য মাকে তাড়া লাগায়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }