Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1047 Mins Read0

    মানুষের ঘরবাড়ি – ২

    দুই

    বাবার দূর সম্পর্কের এক ভাই কাছাকাছি শহরটায় থাকেন। তাঁর কাছে খবর পেয়েই এখানে চলে আসা।

    ফলে আমাদের মনে হত, এতদিন আমরা অজ্ঞাতবাসে ছিলাম। এখন থেকে বনবাসের পালা। অন্তত বাবার কথাবার্তা এবং আচরণে এসবই মনে হত। বাবা কোথাও আর জায়গা পেলেন না, এখানে পাণ্ডববর্জিত একটা বনভূমিতে শেষ পর্যন্ত চলে এলেন।

    ঘর বলতে বাঁশের খুঁটিতে দরমার বেড়া। টিনের চালের একটা বাছারি ঘর। আকাশ সামান্য ফর্সা হলে ঘরও ফর্সা হয়ে যায়। জ্যোৎস্না রাতে বেড়ার ফাঁকগুলো এক একটা এক এক রকমের। কোনোটা তারাবাতির মতো, কোনোটা যেন মোমবাতির শিখা। বাঁশ কেটে মাচান করে দিয়েছেন বাবা। লম্বা মাচান। খলফা ফেলে মাচানকে সমতল করা হয়েছে। মা, পিলু, মায়া, পুনু বড় মাচানটায় শোয়। ছোটটা আমার আর বাবার। দুটো ছেঁড়া মশারি। কতকালের পুরনো বাবাও বলতে পারবেন না। রং একেবারে কালো—ধুলো ময়লা লাগলে নতুন করে টের পাবার উপায় নেই। তালিমারা এত যে আসল মশারিটা কবেই উবে গেছে।

    সকালে ঘুম ভাঙলে দেখলাম বাবা পাশে নেই। বোধহয় রাত থাকতেই উঠে পড়েছেন। মানুষের ঘরবাড়ির বুঝি আলাদা একটা গন্ধ থাকে। সকাল না হতেই বাবা গন্ধটা পান। তখন আর বিছানায় থাকতে পারেন না। এত শীতেও কাবু হন না বাবা। এত ঠাণ্ডা যে কাঁথার ভেতর হাত পা জমে যায়। টিনের চাল বলে ঠাণ্ডাটা আরও বেশি। দরমার বেড়ার ফাঁকে হা হা করে শীত ঢুকে যায়। লেপ কাঁথা সব বরফ। বাবা পাশে শুয়ে থাকলে বেশ গরম থাকে। উঠে গেলেই শীতটা যেন আমাকে একলা পেয়ে বেশ জেঁকে বসে।

    সূর্য ওঠার আগে বাবা তাঁর ঘরবাড়ির সীমানাটা প্রতিদিনের মতো একবার ঘুরে দেখবেন। বেশ চিন্তাশীল মানুষের মতো তখন তাঁকে হাঁটতে দেখা যায়। পাঁচ মাসে বিঘে পাঁচেক জমির বেশ কিছুটা সাফ করা হয়ে গেছে। শীতের সময় বলে হিম পড়ে থাকে ঘাস পাতায়। কোথাও শুকনো কাটা জঙ্গল, কোথাও আগুনে ডালপালা পোড়ে নি বলে আধপোড়া ঘাসপাতা। সব মাড়িয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাবেন বাবা। কোন দিকটায় হাত দেওয়া দরকার, কোনদিকে হাত লাগালে তাড়াতাড়ি সাফ হবার কথা—সব ভেবে ভেবে দেখা। তারপর যেমন পালংয়ের জমি, পেঁয়াজের জমি, সীমের মাচান, লাউয়ের মাচান, কোথাও সামান্য জমিতে মুলো চাষ, সব জমিতে বীজ বপনের পর কার কতটা বাড়বাড়ন্ত প্রতিদিন সকালে না দেখতে পেলে যেন তাঁর ভাল লাগে না। এ-সময়টুকু এইসব হাতে- বোনা ফসলের সঙ্গে থাকতে পারলে যেন বেঁচে যান মানুষটা। আয়ু বাড়ে তাঁর।

    আর মনে হত বাবা সারারাতই জেগে থাকেন সকাল হবার আশায়। কতক্ষণে সকাল হবে। যে গাছগুলো বড় হয়ে উঠেছে, অথবা যে লতায় ফুল আসবে, কখন কার কি পরিচর্যার দরকার রাতে শুয়ে শুয়ে কেবল বুঝি ভাবেন। কখন কোথাও দাঁড়িয়ে কোথাও বসে অতি সন্তর্পণে সব কিছু ঠিকঠাক করে দিতে দিতে দেখতে পান সকাল হয়ে গেছে। পাখিরা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে অন্য আকাশে। ঘরবাড়ি মিলে বাবার সকালটা আমাদের চেয়ে কেমন অন্য রকমের মনে হয় তখন।

    বিছানায় শুয়ে বাবার গলা শুনতে পাই—উঠে পড় সবাই। সূর্য উঠে গেছে আর বিছানায় থাকতে নেই।

    পূব আকাশটা সামান্য ফর্সা হলেই বাবা সূর্য ওঠার কথা বলতেন। তখন আমাদের কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে হত না। কাঁথা গায়ে শুয়ে থাকার ভেতর ভারি আরাম। কুঁকড়ে শুয়ে থাকি। চোখে রাজ্যের ঘুম। বাবা চান তাঁর সঙ্গে আমিও এই সব চাষ আবাদ ঘুরে ফিরে দেখি।

    এ-ভাবে বুঝতে পারি বাড়িটার চারপাশে ধীরে ধীরে সব শস্যক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। খুব সকালে মাও বোধ হয় শস্যের গন্ধ পায়। আর শুয়ে থাকতে পারে না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে পড়ে।

    এখানে আসার পর বাবা কিছু পেঁপে গাছ লাগিয়েছেন। কোথা থেকে নিয়ে এসেছেন দুটো চাঁপা কলার গাছ। বড় যত্ন সহকারে গাছ দুটো জমির একপাশে লাগিয়েছেন। এতসব দেখেই বোধ হয় মা বাবাকে আবার নির্ভরশীল মানুষ ভাবতে পারছে। কথায় কথায় বাবাকে সেনাপতি বলে আর ঠাট্টা করে না।

    এবং দেখা গেল, বাবা কিছু কলাপাতা এনে মায়াকে বললেন, অ আ লেখ। আমাকে বললেন, তোর বইগুলো বের কর, মানুর কাছে যা। পরীক্ষাটা দিতে হয়।

    পরীক্ষাটা দিতে হয়, যেন অনেকদিন পর কথাটা বাবার মনে পড়ে গেল। দেশ ছেড়ে আসার পর গত দু’বছর কথাটা আমার এবং বাবার কারো মনে ছিল না। জমিজমা এবং মানুষের ঘরবাড়ি হয়ে গেলেই বুঝি কথাটা মনে হয়। পিলুকে বাবা কিছুতেই পড়াতে বসাতে পারেন না। তা ছাড়া পিলু খুব একটা আজকাল ভয়ও পায় না। অভাবী মানুষের সন্তানেরা বুঝি একটু বেশি বেয়াড়া হয়। পিলু যে বের হয়ে গেল, বাবা পিলুকে কিছু বলতে পর্যন্ত সাহস পেলেন না। পিলু এখন সিক্স-সেভেনে পড়তে পারত। দুটো বছর বাবার সঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরে ওর স্বভাবটাও কিছুটা বাউণ্ডুলে হয়ে গেছে। অবশ্য ঠিক বাউণ্ডুলে না বলে বরং বলা যায় পিলু মা’র দুঃখ অথবা অভাববোধটা বোধহয় আমার চেয়ে বেশি টের পায়। সে যতটা পারে মা’র জন্য বাবার জন্য কাজ করে বেড়ায়। কেউ তাকে আর ঘাঁটায় না। দেখা গেল পিলু আসছে, হাতে পায়ে কাদা মাখা— কোঁচড়ে সব পুঁটি ট্যাংরা মাছ। কোনো গর্ত থেকে সব ধরে এনেছে। হয়তো দেখা গেল পিলু মাথায় করে নিয়ে আসছে এক ঝুড়ি গোবর। কখনো কোঁচড়ে গিমা শাক। সে বাড়িতে বাবার মতো ইতিমধ্যেই আংশিক সংসারী মানুষ হয়ে উঠছে।

    বাবা একদিন ভারি আশ্চর্য একটা খবর নিয়ে এলেন। বনটার শেষ প্রান্তে কেউ ঠিক আমাদের মতো মানুষের ঘরবাড়ি গড়ে তুলছে। বাবা সারাটা সকাল তাদের বাড়িতেই ছিলেন এবং কতদিন পর একজন প্রতিবেশী পাওয়া গেল ভেবে বোধহয় বাড়ির কথা ভুলে গিয়েছিলেন। এসে সারাটা দিন, নিবারণ দাস আর নিবারণ দাস। তাঁর দুই বউ। বড় সংসার। বাদশাহী সড়কের ধারে বনের একটা অংশ কিনে ফেলেছে। বাবা এখানটায় তাঁর ঘরবাড়ি করে যে ভুল করেন নি, নিবারণ দাসের মতো বিচক্ষণ লোকের আগমনের সংবাদ দিয়ে সেটা বার বার মাকে বোঝাতে চাইলেন। বিচক্ষণ কে বেশি, যে আগে করল, না যে পরে।

    বিকেলে ঠিক বাবার বয়সী সেই লোকটা আমাদের বাড়িতে এসে ডাকাডাকি শুরু করে দিল, ঠাকুর- কর্তা আছেন। বাবা তাড়াতাড়ি জঙ্গল থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হলেন। জঙ্গলের ঝোপঝাড় কাটছিলেন বলে মাথায় মুখে ঘাসপাতা লেগে ছিল। নিবারণ দাস এসেছেন, নিবারণ দাস, খোঁজ-খবর করতে এসেছেন—বারে বা দেশ ছেড়ে আসার পর বাবার জীবনে কত বড় ঘটনা, বোধ হয় আর ইহজীবনে এত বড় ঘটনা ঘটেছে বাবার জীবনে, নিবারণ দাসের আসা দেখে, আদর আপ্যায়ন দেখে আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হল। বাবা তাকে তামাক খাওয়ালেন, এবং এমন একটা জায়গা বসবাসের জন্য নির্বাচন করেছে বলে তাকে বাবা কত যে সাধুবাদ দিলেন। লোকটা মাকে কর্তা মা কর্তা মা করছিল। মাও বেজায় খুশী, আর লোকটির কথাবার্তা হাবভাব অদ্ভুত আপনজনের মতো। যেন এই ব্রাহ্মণ পরিবারের কথা শুনেই এখানে চলে আসা। সাত পুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে গঙ্গা পাড়ে আসা। পালা পার্বণে যদি একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ না পাওয়া যায় তবে বেঁচে থাকার আনন্দ থাকে না। এমন কি দুজনে বসে ঠিকও করে ফেলল, আগামী শনিবারে শনিপুজা করবে নিবারণ দাস। বাবার একজন যজমান পাওয়া গেল তবে।

    লোকটা চলে যাওয়ার পর বাবা কিছুক্ষণ কেমন ধন্দ লাগা মানুষের মতো বসে থাকলেন। লাখ টাকা লটারি পেয়েছে শুনলে দুঃখী মানুষের মুখে যেমন রা সরে না বাবারও বুঝি তেমন কিছু হয়েছে। বসে আছেন তো আছেনই। আমাদের ভয় ধরে গেল। ডাকলাম, বাবা। মা বলল, হ্যাঁগো তুমি কি ভাবছ অত!

    বাবা কেমন সুদূরের মানুষ হয়ে গেছেন। খুব ধীরে ধীরে বললেন, ভাবছি মানুষের বাড়িঘরের কথা। বাবার এই ধরনের আত্মদর্শন ঘটলেই কেমন আমাদের সব গোলমাল ঠেকে। কাছে বসে বললাম, লোকটা সত্যি শনিপুজা করবে তো বাবা! মাও বলল, হ্যাঁগো, সত্যি করবে তো! এত সুখ শেষ পর্যন্ত কপালে সইবে তো!

    বাবা কেমন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ করবে। একবার যখন বলে গেছে তখন দ্যাখ মিথ্যে হবে না।

    আর আমার মনে হল, বাবা কাল সকালেই চলে যাবেন, কি দাস মশাই পূজা তা হলে হচ্ছে। আর যদি না হয়, তবে বাবা না আবার ভিরমি খেয়ে পড়ে যান। কে দেখবে তখন! ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি কাল তোমার সঙ্গে যাব।

    —কোথায় যাবি?

    —নিবারণ দাসের বাড়ি।

    —কেন?

    তোমার কি হবে-না-হবে শেষ পর্যন্ত বলতে পারলাম না। বললাম শুধু, দেশের মানুষ এসেছে, ঘরবাড়ি করছে, দেখে আসব।

    বাবা খুব ভারিক্কি গলায় বললেন, শনি পূজার দিন নিয়ে যাব।

    শনিবারের জন্য আমাদের তখন কি আকুলি-বিকুলি। মাও শনিপূজা একটা না করলে হয় না এমন বায়না ধরলে বাবা বললেন, হবে হবে। সবই তো হয়ে যাচ্ছে। কোনটা বাকি থাকছে! আগে একটা পঞ্জিকা কিনি। পঞ্জিকা না হলে পুরুত মানুষের মান-সম্মান থাকে না।

    শনিবারের আশায় পিলু পর্যন্ত সুবোধ বালক হয়ে গেল।

    শনিবার সত্যি এসে গেল। বাবা বেশ বিকেলেই আমাদের নিয়ে রওনা হলেন। কতকাল পর আমরা আবার সম্মানিত মানুষ। আমাদের জামা প্যান্ট খারে কাচা হয়েছে। কালীর পুকুরে মা সারা দুপুর আমাদের ছেঁড়া তালিমারা যা জামাকাপড় ছিল সব ধুয়ে ঘাসের ওপর শুকোতে দিয়েছে।

    আমরা যাচ্ছিলাম। রাস্তাটা বেশ মনোরম লাগছিল। কখনও এদিকটায় আসা হয় নি। বাবার গায়ে নামাবলী। মা সঙ্গে থাকলে একেবারে সপরিবারে শনিপূজা সেরে আসা হত। দু-একবার বাবা যে বলেন নি তা নয়। কিন্তু নিবারণ দাস বিশেষ কিছু বলে যায় নি বলে আত্মসম্মানে মা’র লেগেছে। বোধহয় সে জন্যই আসে নি। তবে মা বলেছে, আমি গেলে বাড়িটা খালি থাকবে না!

    আমরা আমাদের তালিমারা ছেঁড়া জামা প্যান্ট পরে রওনা হয়েছি। মা চুলে কাকুই দিয়ে দিয়েছে। ভুরুর ওপরে একটু কাজলের ফোঁটা। মার এতদিন পর মনে হয়েছে তার সন্তানেরা ভারি সুন্দর দেখতে। এবং চারপাশে যা বনজঙ্গল, আর ভূত-প্রেত কখন কার নজর লেগে যাবে ভয়ে মা মাথায় একটু থুথু দিয়ে বা পায়ের গোড়ালী থেকে সামান্য ধুলো মাখিয়ে দিয়েছে মাথায়। যতই রাত হোক, যতই অপদেবতার ভয় থাকুক, আমরা তার বাইরে। মা কত সহজে আমাদের সব বিপদ থেকে যে রক্ষা করে থাকে।

    ব্যারাকবাড়িতে তখন প্যারেডের হুইসিল বাজছে। এখন প্যারেড না থাকলে বাবা বোধহয় ঘুরে ব্যারেকের পথটা ধরে যেতেন। বাবা যে কত বড় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের সন্তান এটা বোঝাবার এমন একটা মৌকা হাতছাড়া হয়ে গেল বলে বোধহয় মনে মনে এখন আপসোস করছেন। ক’মাস হয়ে গেল, তবু পুলিসের কোয়ার্টারগুলোতে পূজা পার্বণে বাবার একদিনও ডাক পড়েনি। দেশ ছেড়ে সবাই এদেশে এসে মুচি মেথর সব ঘোষ বোস বনে যাচ্ছে। বাবা যে তেমন একজন কেউ নন কে জানে। বাবা কিছুতেই বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারছিলেন না। নামাবলী গায়ে খালি পায়ে শনিপূজা সারতে যাচ্ছেন বাবা, যেন হাবিলদার সুবেদারের সঙ্গে দেখা হলেই বলা, যাচ্ছি শনিপূজা করতে। নিবারণ দাস শনিপূজা করছে। এসে হাতে পায়ে ধরল, কি আর করা যায়, শনিঠাকুর বলে কথা। কিন্তু প্যারেডের সময় কে আর কাকে লক্ষ্য করে! বাবা অগত্যা যেন বনের মধ্যে ঢুকে গেলেন।

    রাস্তাটা বেশ মনোরম লাগছিল। কখনও এদিকটায় আমি আসিনি। দু-পাশে বড় বড় শিরীষ গাছ, তার ছায়া এবং লতাপাতায় ঢাকা আশ্চর্য সব বনঝোপ। আমাদের পায়ের শব্দে পাখিরা উড়ে গেল ঝোপ থেকে। এবং কোথাও সুন্দর কুরচি ফুল ফুটে আছে। নাকে সুবাস এসে লাগছে। পায়ে হাঁটা একটা পথ এঁকে বেঁকে কতদূরে যে চলে গেছে মনে হয়।

    বাবা অনেকটা আগে চলে গেছেন। একটা ছোট বাঁকের মাথায় বাবা অদৃশ্য হয়ে যেতেই কেমন ভয় ধরে গেল। ডাকলাম, বাবা। পিলু বলল, আমি ঠিক চিনি। তুই আয়। মায়া বাবার নাগাল পাবার জন্য দৌড়চ্ছিল। আমি পিলু বাবাকে ধরার জন্য তারপর একসঙ্গে ছুট লাগালাম। বাবাকে আমাদের খুব এখন ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। পিলু পর্যন্ত বাবার কথা শুনছে। সে বাবার নাগাল কিছুতেই ছাড়ছে না। আমার গায়ে হাফশার্ট। পা খালি আমাদের সবার। বেশ উঁচুনিচু পথ। দু’পাশের সব ঝোপজঙ্গল রাস্তা ঢেকে রেখেছে। কিছুটা প্রায় লাফিয়ে যেতে হচ্ছে কখনো। মনে হল পিলু এ-সব অঞ্চলে ঘুরে গেছে। সে-ই সব খবর দিচ্ছিল আমাকে। বলল, ডান দিকে ঐ যে দেখছিস, দেখতে পাচ্ছিস না দাদা, বড় বড় দুটো বাঁশঝাড়, ওপাশে গেলে একটা পোড়ো বাড়ি আছে। তারপর আছে তোর কারবালা, পরে মাঠ, রেললাইন। কারবালায় তোকে একদিন নিয়ে যাব। ইঁটের ভাটা আছে একটা। নবমী বলে একটা বুড়ি থাকে। কচু আর বন আলু সেদ্ধ করে খায়। কোনো দুঃখ নেই। লোক দেখলেই ফোকলা দাঁতে হাসে, ওমা তুমি কেগা! সুমার বনে একা ঘুরে বেড়াচ্ছ।

    আমার ভাল লাগল না। পিলুর বেজায় সাহস। কোনো বনের ভেতর বুড়ি থাকলে ডাইনী বুড়ি না হয়ে যায় না। বুড়িটা যদি পিলুকে ছাগল ভেড়া বানিয়ে রাখে।

    পিলু বলেছিল, জানিস দাদা, বুড়িটার দুটো বড় ছাগল আছে। কত বড় শিং। ভাবলাম মাকে বলব, মা, বুড়িটা দেখবে পিলুকে বাঁদর বানিয়ে রেখে দেবে।

    —কত তুকতাক জানতে পারে।

    পিলু হাসত। বলত, তুই খুব ভীতু স্বভাবের। আমরা হেঁটেই যাচ্ছি; রাস্তা আর শেষ হচ্ছে না। বনবাদাড়ের রাস্তা বুঝি কখনও শেষ হতে চায় না। সূর্য আর দেখা যাচ্ছে না। এত ঘন গাছপালা যে মাথার ওপরে আকাশ আছে বোঝা যাচ্ছিল না। দিনের বেলাতেই গা ছমছম করছে। ফিরতে রাত হয়ে যাবে। কেমন ভয় লাগছিল। রাতে আমরা ফিরব কি করে। যদিও বুঝতে পারছিলাম এ- সব বলা যায় না। বাবা খুব গুরুগম্ভীর গলায় বলবেন, তুমি বামুনের ছেলে। তোমার তো ভয় থাকার কথা নয়। বাবার কিছু দৃঢ় বিশ্বাস আছে। যেমন সব ভূতপ্রেতের কথায় এলে বাবা অনায়াসে বলবেন, বামুনের বাচ্চা, কেউটের বাচ্চা এক। সবাই ভয় পায়।

    পিলু বাবার কাছাকাছি হাঁটছে। মায়া মাঝখানে। সবার শেষে আমি। মাঝে মাঝে আমি কতদূরে আছি বাবা ঘাড় ফিরিয়ে দেখছিলেন।

    বাবার ডান হাত ধরে রেখেছে মায়া। সে পুজোর সব খেয়ে নেবে বলছে। পেট ভরে সিন্নি খাবে, মুড়ি খাবে, নারকেল বাতাসা খাবে, যেন এমন অতীব এক ভোজন কতকাল পরে প্রায় উৎসবের মতো এসে গেছে।

    আমি জানি, বাবা, আজ ভারি তন্ময় হয়ে যাবেন পুজোয় বসে। বেশ নিয়ম নিষ্ঠা, যা দেখলে নিবারণ দাস আখেরে আর সাহসই পাবে না, পুজো-পার্বণে অন্য বামুনের কথা ভাবতে। একেবারে বাবা যেন আত্মীয়ের মতো অথবা পরম হিতাকাঙক্ষী মানুষ, পূজার সুফল কি, কেন এইসব পালাপার্বণ, হিন্দুধর্ম, তার দেবদেবীর কি মাহাত্ম্য এবং পাঁচালী পড়লে গেরস্থ মানুষের যা কিছু ফললাভ বাবা ব্যাখ্যা করে যাবেন।

    পিলু বলল তখন, দাদা যাবি?

    —কোথায়?

    —কারবালাতে।

    —আমার ভয় করে।

    —ভয় কি রে!

    —ওখানে মুসলমানদের কবরখানা আছে।

    —তাতে কি!

    —কত সব মানুষের কঙ্কাল!

    —তুই দেখেছিস?

    —দেখব কি করে?

    —তবে। শেষে সে অভয় দেবার মতো বলল, একটাও থাকে না। শেয়ালেরা সব খেয়ে নেয়। সে একবার একটা শেয়ালকে মাঠের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। প্রায়, যা বর্ণনা পিলুর, বাঘ- টাঘের শামিল। সে কিছুদুর পর্যন্ত শেয়ালটার পেছনে দৌড়েছিল। এবং বনের ভেতর ঢুকে যেতেই ভারি একা মনে হয়েছিল নিজেকে। আর বোধ হয় ভয়ও করছিল। দাদা সঙ্গে থাকলে অন্তত সেটুকু থাকত না। এবং এ-জন্যই মাঝে মাঝে তোষামোদ দাদাকে— যাবি দাদা। কত রকমের সব ফলের কথা, এবং বড় বড় বন-আলু তুলে আনা যায়-এক একটা আলু পনের বিশ সের ওজনের। একবার তো সারাদিন পিলুর দেখা নেই। মা বার বার বলেছিল, কোথায় যে গেল ছেলেটা। বাবার সাদাসিধে কথা। গেছে কোথাও ঠিক চলে আসবে। সকালে পিলু কিছু না খেয়ে বের হয়ে গেছে সেদিন। মার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছে। মা রেগে গিয়ে খেতে দেয় নি কিছু। রাগের মাথায় যদি একটা কিছু করে ফেলে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মা না খেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে—আমিও কতবার ডাকাডাকি করেছি। ব্যারাকের মাঠে এবং বাদশাহী সড়কে উঠে দেখে এসেছি। নেই।

    মা তখন প্রায় ভেউভেউ করে কেঁদেই দিত। মায়া এসে বলল, ছোড়দা আসছে। ছোড়দা মাথায় কি একটা অতিকায় বহন করে আনছে। কাছে এলে দেখতে পেলাম অতিকায় বন-আলু। প্রায় হাতির সাদা দাঁতের মতো। মা’র যত রাগ, নিমেষে উবে গিয়েছিল—এতবড় বন-আলু মা জীবনেও দেখে নি। প্রায় দু হাতে মাথা থেকে নামাতে গেলে পিলুর প্যান্ট হড়হড় করে নেমে গেল পেট থেকে। কিছই খায় নি বলে পেটটা কোথায় ঢুকে গেছে। হাতে পায়ে মুখে—শরীরের সর্বত্র মাটি কাদা এবং সেদিন ওকে পুকুরপাড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে বাংলা সাবানে শরীর পরিষ্কার করে দিয়েছিল মা। একটা আলুতে আমাদের কতদিন চলে যাবে। খেতে বসে পিলুর সাম্রাজ্য জয়ের কথা শুনতে শুনতে মা কেবল চোখের জল ফেলছিল। বাবার মতো পিলুকে সেই থেকে কেন জানি মাঝে মাঝে আমার ভারী সমীহ করতে ইচ্ছে হত।

    তখনই বাবা বললেন, এসে গেছি।

    বনটার শেষ। এদিকেও সেই বাদশাহী সড়ক ঘুরে গেছে। এবং বোঝাই যায় পুব-উত্তরে কিছু দক্ষিণেও বনটাকে একটা হাঁসুলির মতো এই বাদশাহী সড়ক প্রায় সবটা ঘিরে রেখেছে। ঠিক রাস্তার ধারেই দুটো দোচালা টিনের ঘর নিবারণ দাসের। পুব-দক্ষিণ খোলা বলে সকাল দুপুরের সবটা রোদই বাড়িটা পায়।

    সাঁজ লেগে গেছে। আমাদের দেখে নিবারণ দাস হাতজোড় করে ছুটে আসছে। একটা জলচৌকিতে বাবাকে বসতে দেওয়া হল। বারান্দায় একটা হারিকেন জ্বলছে। খোলা উঠোনে বেশ বড় গামলায় দুধ, চালের গুঁড়ো। সাদা পাথরে ঠাণ্ডা নারকেলের জল। দাসের দুই বউ আমাদের দেখে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ছেলেমেয়েরা পরিষ্কার জামাকাপড় পরে সেজেগুজে আছে। বড় মেয়েটা শাড়ি পরেছে। ঢপ ঢপ করে প্রণাম বাবাকে। তারপর আমাকে পিলুকে লুটের বাতাসার মতো প্রণাম করতে থাকল। আমরা কত বড় মানুষের ছেলে এই বুঝি প্রথম টের পেলাম। পিলু দেখলাম মুখ বেশ গম্ভীর করে রেখেছে। ওর জামার নিচে প্যান্ট, প্যান্টে দড়ি পরানো নেই। পরিয়ে দিলেও থাকে না। এখন পিলু এত গম্ভীর যে মনে হয় দম বন্ধ করে আছে। দম আলগা করে দিলেই হয়েছে। প্যান্ট আবার হড়হড় করে নিচে নেমে না যায়। ভাগ্যিস বড় মেয়েটা একটা শতরঞ্চ পেতে বারান্দার একপাশে বসতে দিল। তাড়াতাড়ি যেন নিজের গরজেই আর মান-সম্মানের ভয়ে পিলুকে টেনে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলাম। আর আমরা সবাই নিরীহ মানুষের মতো পুজার ভোগসামগ্রী সতৃষ্ণনয়নে দেখার সময় মনে হল বুড়ি মতো কেউ লাঠি ঠুকে ঠুকে এদিকটায় আসছে। হারিকেন তুলে আমাদের মুখ দেখছে। ফোকলা দাঁতে বলছে, এ যে সব কার্তিক ঠাকুর এক একজন। বলেই লাঠি পাশে রেখে মাথা ঠুকতে থাকল। আমাদের তখন একেবারে হতভম্ব অবস্থা।

    বাবা পদ্মাসনে বসে আছেন। আমরা তাঁর ছেলেপুলে কে দেখলে বলবে? আমরা কি করছি, কি- ভাবে আছি একবারও মুখ ফিরিয়ে দেখছেন না। কেবল পুজোর ফুল, নৈবেদ্য, ঘট, আমের পল্লব, সিঁদুরের থান, তিল তুলসী সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিচ্ছেন। নিবারণ দাস বাবার পা ধুইয়ে দিয়েছে জলে। পা মুছে দিয়েছে। এত বড় মানুষটা বাবাকে এ-ভাবে সমাদর করতেই আমরা আরও নিরীহ গোবেচারা হয়ে গেলাম। বাবার মান-সম্মান এখন সব কিছুই আমাদের স্বভাব-ধর্মের ওপর নির্ভর করছে।

    চারপাশে আর কোনো লোকালয় নেই। দূরে এই কিছু জমি পার হয়ে গেলে চৌমাথা। বাদশাহী সড়ক ফুড়ে রাস্তাটা গেছে রাজবাড়ির দিকে। চৌমাথায় বড় পাটের আড়ত।

    বারান্দায় হ্যাজাকের আলো। এখানে বসেও দেখা যায় পাটের আড়তে কাজকর্ম হচ্ছে।

    নিবারণ দাস বলল, পাটের আড়ত দেব ভেবেছি কর্তা। কেমন হবে? চারপাশে বাবা ফুল চন্দন ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন। বাড়িটা জুড়ে বেশ পূজা পূজা গন্ধ। বাবা ভারি নিপুণ গলায় বললেন, লক্ষ্মী আপনার বাঁধা দাসমশাই। যাতে হাত দেবেন সোনা ফলবে। বাবার কথা অমৃত সমান ভেবেছে নিবারণ দাস।

    আমার কেবল মনে হয়েছিল, আমাদের জন্য কেন বাবা এমন আশীর্বাদ ঈশ্বরের কাছে চেয়ে নেন না। কত সহজে বাবা নিবারণ দাসকে অমৃত সমান কথা বলে দিতে পারলেন। আমার বাবা বেশ সুশ্রী মানুষ, লম্বা এবং গৌরবর্ণ। আর বাবা এত অভাবের ভেতরও শরীর বেশ কোমল এবং মাথা ঠিক রাখতে পেরেছেন। পূজায় বাবাকে কে কি দিল—এই যে শনির পূজা, একটা বড় গামছা দিতে পারত নিবারণ দাস-কত না জানি দক্ষিণা দেবে, অথচ সে-সব বাবা আদৌ গ্রাহ্য করেন না এবং বেশ সময় নিয়ে নিষ্ঠা সহকারে পূজা করে গেলেন। শান্তির জল দিলেন সবাইকে। সুর ধরে পাঁচালী পাঠ করলেন। সবাইকে প্রসাদ মেখে সিন্নি, চাল কলা এবং আমাদের হাতে হাতেও দিলেন। কাউকে বেশি না কম না। মায়া যে রাস্তায় পইপই করে বলেছে পেট ভরে সিন্নি খাব—সেসব যেন বাবা একেবারেই ভুলে গেছেন। অবস্থা এমন যে শেষ পর্যন্ত বাবা তাঁর ছেলেমেয়েদের বাড়ি পর্যন্ত চিনে নিয়ে যেতে পারলে হয়। এত কমে এত বেশি পুণ্য হয় না—বাবাটা যে কি। রাগে ভেতরটা গরগর করছিল।

    পিলুর দিকে তাকিয়ে আরও বেশি রাগ হচ্ছিল। তুই কি রে! নিজের স্বভাবধর্ম মানুষ এ-ভাবে ভুলে যায়! তুই পর্যন্ত একবার বলতে পারলি না, আমাকে আর একটু দাও বাবা। তুই চাইলে বাবা দুবার আমাকেও দিত। মায়া পেট ভরে সিন্নি খাবে বলেছিল—কথাটা মনে পড়ত বাবার।

    তখনই দাসের মা বলল, কর্তা, এত প্রসাদ খাবে কে?

    দাসের মা’র কথা শুনেই আবার নড়েচড়ে বসা গেল।

    বাবা বললেন, আসবে। মানুষজন আসবে। এলে দেবেন, প্রসাদ নামমাত্ৰ।

    তখন ভগবানকে বললাম, হা ভগবান, মানুষের বাবা এত নিষ্ঠুর হয়। পূজার দক্ষিণা মাত্র তিন আনা পয়সা। তিন আনা পয়সাই তামার। পয়সা কটা বাবা আঁচলের কোণায় শক্ত করে বাঁধলেন। দুবার টেনে দেখলেন, খুলে পড়ে-টড়ে যেন না যায়। গামছায় ভোজ্য দ্রব্য বলতে সামান্য চাল, দুটো নাতি-বৃহৎ বেগুন, একটা হরিতকী, ছোট ছোট লাল জরুলের মতো দুটো আলু খুব যত্নের সঙ্গে নিয়ে নিলেন। এই সামান্য পাওনার বিনিময়ে বাবা লোকটাকে কত বড় কথা বলে গেল! বাবা যখন উঠব ডঠব করছেন, নিবারণ দাস বলল, এরা তো কিছুই খেল না। কর্তামার জন্য একটু এবং এই বলে সে একটা বড় জামবাটিতে অনেকটা সিন্নি, চাল কলা ফল গামছায় বেঁধে দিল নিজে। বাবা কিছুই দেখছেন না, যত কথা বলছেন দাসের সঙ্গে। আমাদের চোখ চকচক করছে। তার মেয়ের একটা ভাল বর খোঁজা দরকার। বাবা নিজের ওপরেই ভারটা নিয়ে নিলেন এবং এমন সব মানুষজনের খবরাখবর দিলেন বাবা, যে নিবারণ দাস বাবাকেই এ-বিপদে একমাত্র কাণ্ডারী ভেবে ফেলল।

    ফেরার পথে একটা হারিকেন দিয়ে দিল। নিবারণ দাস কথা বলতে বলতে কিছুটা পথ এগিয়ে দিচ্ছিল। সিন্নি প্রসাদ নিবারণ দাসের হাতে। যে-ভাবে বাবা আর নিবারণ দাস কথাবার্তায় মশগুল হয়ে গেল, না জানি পুঁটুলিটা দাসের হাতেই থেকে যায়। যা আমার একখানা বাবা, ফেরার পথে শুধু হারিকেনটাই হয়তো ধরা থাকবে হাতে! পিলু বোধ হয় এটা টের পেয়ে বেশ কায়দা করে বলল, জ্যাঠা আমাকে দিন। আমি নিচ্ছি।

    জ্যাঠা বলল, পারবে তো?

    পিলু ঘাড় উঁচিয়ে বলল, খুব।

    যখন কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে নিবারণ দাস টর্চ জ্বেলে চলে গেল তখন পিলু তার স্বভাব-ধর্ম ঠিক রাখতে পারল না। হাত ঢুকিয়ে একটা কলা বের করে বলল, দাদা খা।

    আবার বের করে নিল দু টুকরো নারকেল। মায়াকে দিল, আমাকে দিল। সে নিজেও রাক্ষসের মতো সব মুখে ফেলছিল।

    বাবা বললেন, বেশ তো ভাল ছেলে হয়ে ছিলে বাবারা। জঙ্গলে ঢুকতে না ঢুকতেই স্বমূর্তি ধারণ করলে বাবারা। তোমার মা’র জন্য কিছু রেখ!

    আমরা এ-ভাবে হেঁটে যাচ্ছিলাম। আমার হাতে হারিকেন। অন্ধকার ঘোলাটে পৃথিবী ফুঁড়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। আলোতে আমাদের ছায়াগুলো কখনও লম্বা কখনও ছোট হয়ে যাচ্ছিল। পিলু সবার আগে। এবং জানি মা খলপার দরজা বন্ধ করে রাস্তায় কোনো শব্দের জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছে। মা না একা আবার ভয় পায়। আমরা তখন প্রায় দৌড়ে সেই অন্ধকার বনভূমি পার হবার চেষ্টা করছিলাম। পৃথিবীতে এ-কটা প্রাণী বাদে এই বনভূমি এবং অন্ধকারে কিছু জোনাকি পোকা—বনের মধ্যে মা নিশীথে আমরা কতক্ষণে ফিরছি সেই আশায় বসে রয়েছে। বাড়ির কাছে আসতেই পায়ে ভীষণ জোর এসে গেল। দৌড়ে দরজায় উঠে গেলাম। ডাকলাম, মা আমরা এসেছি। ওঠো। মা লম্ফ হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে প্রথমেই বলল, তোর বাবা কোথায়?

    —আসছে।

    আমরা মা’র যেন কেউ না। বাবার জন্য লম্ফ হাতে মা উঠোনে নেমে গেল।

    বাবা যাতে ভাল দেখতে পান সেজন্য লম্ফটা আরো উঁচু করে ধরল।

    মনে হল মা আমার নিমেষে আকাশবাতি হয়ে গেছে। সবার ওপরে হাত। হাতে লম্ফ। লম্ফের আলো দাউদাউ করে জ্বলছে। বাবা আলোর দিকে এগিয়ে আসছেন। বাবাকে খুব শক্তিশালী যুবকের মতো মনে হচ্ছিল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }