Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1047 Mins Read0

    মৃন্ময়ী – ৮

    আট

    একদিন বাড়ি এসে শুনলাম, মিমি এসেছিল। মিমি কলকাতা থেকে কাকে ধরে আমাদের কজনের পাশ ফেলের খবর নিয়ে এসেছে। ওদের প্রভাব আছে—আনাতেই পারে। সবার আগে আমাদের বাড়িতে এসে খবর দিয়ে গেছে, মাসিমা বিলু পাশ করেছে। মিমি নাকি আনন্দে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, তোমার দাদা পাশ করেছে—তোমাদের কী আনন্দ! দাদাকে বল, হ্যাঁ।

    মায়াকে ঘরে ডেকে বললাম, ও কোন ডিভিসনে পাশ করেছে জিজ্ঞেস করলি না!

    সেই তো! মায়া কেমন অবাক হয়ে গেল। মিমিদির খবরটা নেওয়া হয় নি। সে ছুটে গেল বাইরে, মাকে বলল, মিমিদি পাশ করেছে মা?

    —জানি না তো!

    বাবাকে বলল, মিমিদি পাশ করেছে বাবা?

    —কিছু তো বলল না!

    হঠাৎ পরিবারের সবাইকে কেন জানি আমার সহসা স্বার্থপর মনে হল। যে মেয়েটা বাড়ির ছেলের খবর বয়ে দিয়ে যায় তার পাশ ফেলের খবরটা নেওয়ার দরকার পর্যন্ত কেউ মনে করল না। মিমির পাশ ফেল নিয়ে কোনো কথা বলার অপেক্ষা সে-রাখে না। র‍্যাংক নিয়ে তার ভাবনা।

    বাবা হঠাৎ বললেন, হ্যাঁ বলেছে। ও নিজ থেকেই যেন একবার বলল, আমিও পাশ করেছি মেসোমশাই। এসেই মিমি আমাকে তোর মাকে প্রণাম করল। আসলে খেয়াল ছিল না।

    খেয়াল না থাকারই কথা। বাবার কাছে এত বড় খবর কেউ কখনও আজ পর্যন্ত দিয়ে যায় নি। মিমি এসেই নাকি চলে গেছে। তোর মা বলল, একটু বস। মিষ্টিমুখ করে যেতে হয়।

    সে নাকি বলেছে, আর একদিন হবে।

    তবু বাবা ছাড়েন নি—সে হয় না মা, তুমি এত বড় খবর নিয়ে এলে, একটু মিষ্টিমুখ করবে না হয় না। বস। বলেই নাকি মাকে বলল, দুধ দাও। দুটো মোয়া দাও। পূজার সন্দেশ আছে দাও। নাড় করেছিলে সেদিন, থাকলে দাও।

    সব খবরই মায়ার। বলল, জানিস দাদা মিমিদিকে দেখলে আমার কেমন কষ্ট লাগে। তুই কখন এসে পড়বি ভয়ে তটস্থ থাকে। যতক্ষণ বসেছিল, কেবল রাস্তার দিকে চোখ। মিমিদি চোরের মতো আসে। তুই কিন্তু আবার মিমিদিকে বলতে যাস না। মিমিদি আমাদের বাড়ি এলে ক্ষেপে যাস কেন বুঝি না। ছোড়দা মিমিদিকে কিছুতেই ছাড়বে না। ছোড়দার এক কথা, মিমিদি কোথায় তুমি নাটক করছ বল না। আমি দেখতে যাব।

    —মিমি কি বলল?

    —বলল, না, ও তোমাকে দেখতে হবে না। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। দেখছ তো মেসোমশাই সারাদিন এক দণ্ড বসে থাকেন না। সব কিছুর প্রতি কি যত্ন। ঘরবাড়ি, গাছপালা সব। তোমরা যদি মানুষ হও তবে তাঁর এ-সব করা সার্থক।

    আমার মনে হল, বেশ উপদেশ ঝাড়ছে মিমি। এ-বাড়ির সবার মানুষ হওয়া নিয়ে ভাবনা। কে তাকে এত দায় চাপিয়ে দিল।

    আমার মুখ গোমড়া দেখে মায়া বলল, তোর কাগজ দু-একদিনের মধ্যে বের হবে। তোকে একবার মিমিদি যেতে বলেছে।

    —কোথায় যাব! বাড়িতে পাওয়া যায় না।

    —সে তো বলে যায় নি। কেবল বলল, দাদাকে বল, পাশের খবর দিয়ে গেলাম, দাদাটি যেন একবার দয়া করে দেখা করে।

    মিমির সঙ্গে আমার যে দেখা হয় না তা নয়। আমাদের কাগজে অস্থায়ী অফিসে দেখা হয়। কখনও বিকালে টাউন হলের মাঠে বসে যখন সবাই আড্ডা মারি তখন দেখা হয়। ওর সঙ্গে চার পাঁচজন পার্টির ক্যাডার থাকে। জরুরী কাজের খবরটুকু দিয়েই উধাও। অস্থায়ী অফিসে লেখা নিয়ে কখনও কোনো বিতর্কে মিমি সহজে জড়িয়ে পড়তে চায় না। কারণ জানে যত লেখা সম্পর্কে সে খুঁটিনাটি ত্রুটি উল্লেখ করবে, তত আমি ত্রুটিগুলো আদৌ ত্রুটি নয়, শিল্পের খাতিরে মানিয়ে গেছে, এমন বলে তার বিরোধিতায় নামব। কাজেই চুপচাপ থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে করে। আমার সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই এমনও ভাবতে পারে হঠাৎ দেখলে কেউ। সে আমাকে একা পেতে চায়। কিন্তু এই একা পাওয়ার মধ্যে আমার দু দু-বার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে ওকে সতীসাধ্বী ভাবতে কষ্ট হয়। এটা আবার হলে মাথা বিগড়ে যেতে পারে।

    মায়া আমাকে চুপচাপ থাকতে দেখে বলল, জানিস দাদা, মিমিদি না যাবার সময় কেমন শুকনো মুখ করে চলে গেল।

    —কেন বাবা কিছু বলেছে?

    আমি জানি বাবা তো আমার কাউকে কোন রূঢ় কথা বলেন না। মিমিকে তো বলতেই পারেন না। মিমি বাবার কাছে মৃণ্ময়ী, সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। যে সংসারে যাবে ধনে জনে লক্ষ্মী বিরাজ করবে।

    –নারে দাদা, বাবা কি বলবে! বাবা শুধু বললে, মিমি বিলুর আর একটা সুখবর আছে। তুমি জানলে খুবই খুশি হবে। ও একটা চাকরি পাচ্ছে। প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারি। মুকুলের জামাইবাবু করে দিচ্ছে। সংসারে এটা আমাদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় খবর।

    মায়া তারপর থেমে দরজার বাইরে উঁকি দিল। তারপর ফের আমার টেবিলটার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, শুনেই মিমিদির মুখটা কেমন শুকনো হয়ে গেল। মিমি কি চায় না, একটা প্রাইমারী স্কুলে আমি মাস্টারি করি।

    খুব সাহসী মানুষের মতো বললাম, বাদ দে। ওর শুকনো মুখ দেখলে তো আমাদের পেট ভরবে না। প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারি কি খারাপ কাজ! কত ছেলে লাইন দিয়ে আছে। নিজের লোক না থাকলে, এ-কাজও এখন কারো জোটে না। তারপর মনে হল মায়াকে এ-সব বলে লাভ নেই। আমি প্রাইমারী স্কুলে মাস্টারি করি, তাতে কার কি পছন্দ অপছন্দ এ-সব ভাবলে চলবে না। আর এটাও ভেবে কুল পাই না, মিমিরা তো শ্রমিক দরদী, গরীব মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করতে চায়। তাদের কাছে মানুষের কাজ দিয়ে মনুষ্যত্বের বিচার হয় না। কেউ ছোট না, কেউ বড় না। সবাই সব কাজে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ছোট ভাববার কোনো কারণই থাকতে পারে না। সে তবে কেন আমার এত বড় খবরে শুকনো মুখ করে চলে গেল! আসলে সে আমাদের ভাল চায় না।

    মায়া বলল, মিমিদি কিন্তু বলে গেল তোকে যেতে। কোথাও আর যাবে না বলেছে। বাড়ি গেলেই দেখা পাবি।

    —কেন, ও যে মহেশ নাটকে শুনছি আমিনর পাঠ করবে!

    —সে তো কিছু বলল না। কেবল যাবার সময় আমাকে চুপি চুপি বলে গেল, দাদাকে বলবে কিন্তু। বলবে আমি কোথাও আর যাচ্ছি না। সারাদিন বাড়িতেই থাকব। বলবে কিন্তু লক্ষ্মীটি।

    মিমি আর কাউকে এ-কথা বলে যেতে পারে না। মায়া মেয়ে বলেই তাকে বলে যেতে পেরেছে।

    মায়া বোঝে সব। বোঝে বলেই বোধ হয় গোপনে এত কথা বলল। দরজায় উকি দিয়ে দেখার মধ্যে টের পেলাম মায়ার মধ্যেও সেই নারী-মহিমা জগে উঠছে। নারী বলেই সে বুঝতে পারে মিমিদির কষ্ট কত গভীর।

    আমার মন-মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মায়া আরও কিছু বলতে চায়, কিন্তু আমি জানি ও কি বলবে। বলবে কবে যাচ্ছিস দাদা। পিলুকে দিয়ে খবর পাঠাতে বলেছে।

    —সে আমি বুঝব। এখন যা তো। আসলে কেন জানি নিজেকে একা পাবার জন্য ছটফট করছিলাম। এটা কি মিমির আত্মসমর্পণ। মিমি কোথাও যাবে না বলে গেছে। ওর নাটক, মিছিল, ভাষণ আমার অপছন্দ বোঝে। মুখে প্রকাশ না করলেও আমার আচরণে সে টের পায়, তার গান, তার জনসভায় বক্তৃতা আমার অপছন্দ। রক্ষণশীল পরিবারে বড় হলে যা হয় এবং গরীব হলে তো কথাই নেই। সব মিলে মিমির আত্মপ্রকাশের প্রতি আমার বিরুপ ধারণাই গড়ে উঠেছে। মিমি কিছু একটা হতে চায়, কিছু করতে চায়। তার মধ্যেও আগুন জ্বলে উঠেছে। সহসা সেই আগুন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেবার এত বড় কী কারণ থাকতে পারে! মিমির এ-সব ছলনা নয় তাই বা কে বলবে!

    .

    যাই যাই করেও সাত আট দিন হয়ে গেল মিটার বাড়িতে যাওয়া হয়ে উঠল না। আসলে একটা বড় ঝড়ের আশংকা করছি। এই ঝড়ে আমাদের দুজনকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে কে জানে।

    মুকুলের বাড়ি যাবার মুখে ভাবি, একবার ঘুরে আসা যাক। এত করে বলার কী আছে! মিমি যাই ভাবুক আমার পক্ষে এই কাজের সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না। মা বাবার মুখের দিকে তাকালে আমি আরও কেমন অসহায় বোধ করি। মাঝে মাঝে মনে হয় যে মেয়ে এস ডি ও সাহেবের গাড়িতে হাওয়া খেতে যায়, তার পক্ষে আমার সামান্য চাকরি নিয়ে ভাববারই বা কী থাকতে পারে। আসলে আমি একটু বেশি ভাবছি। মিমির উপর আমার অধিকারই বা কতটুকু। মিমি দুবার সামান্য দুর্বলতা প্রকাশ করেছে ঠিক— তাই বলে আমিই তার সব এমন কোনো লক্ষণ ফুটে ওঠে নি। আমাদের মধ্যে ভালবাসাবাসির কোনো কথাই হয় নি। ভালবাসাবাসির ব্যাপারটা মিমির কাছে ন্যাকামি মনে হতে পারে। আমি নিজেও সে ভাবে কিছুই ভাবি নি। ভাববার সাহসও হয় নি। কটা দিন নিজের মধ্যে একটা প্রবল সংশয় নিয়ে ঘোরাফেরা করছি মা’র বুঝতে কষ্ট হলো না!

    খেতে বসলে মা বলল, তোর কী হয়েছে বল তো!

    —কী হবে আবার!

    —কিছু খেতে চাস না। চোখ মুখ শুকনো। আয়নায় একবার নিজেকে দেখেছিস!

    তা আয়নায় রোজই তো নিজেকে দেখি। একটু বেশি বেশিই দেখি। আমার প্রতিবিম্বের সঙ্গে কথা হয়। সে বলে, কী বিলুবাবু এত কি দেখছ!

    —কিছু দেখছি না।

    —দেখছ বাবা, লুকিয়ে যাচ্ছ। যাও না ঘুরে এস। ভয় কি!

    একটা ব্যাপারে আমি বেশ তাজ্জব বনে গেছি। মিমি বলে যাবার পরও সাত আট দিন হয়ে গেল, আমি যাই নি, মিমিও আসে নিকেন গেলাম না জানতে। তবে মায়া কি নিজের অনুমান থেকে কথা বলেছে। দাদাকে যেতে বল। বলেই যেতে পারে—কিন্তু তার সঙ্গে যাবার সময় মুখ শুকনো— এ-সব বুঝল কি করে মায়া! ছেলেমানুষ সে। মিমির অন্য কোনো দুশ্চিন্তা থাকতে পারে। সেটা কি আমি জানি না। চোখে চোখ পড়লে আজকাল সে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মিমির কিছু একটা হয়েছে। কেমন দায়সারা কথাবার্তা সেরে সাইকেলে অদৃশ্য হয়ে গেল সেদিন। চোখের নিচে কালি পড়েছে।

    পরদিন দেখি মুকুল হাজির। সে এসেই বলল, প্যানেলে নাম উঠে গেছে। তারপর অপরূপা’ কাগজের দু’কপি আমার হাতে দিয়ে বলল, মিমি দিয়েছে। আট দশ দিনের মধ্যেই এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যাবে। কাছে কোথাও কোনো স্কুলে দিতে বলেছে ছোড়দি। বাড়ি থেকেই করতে পারবে। আজকাল মুকুলকে বাড়ির ছেলে বলেই ধরে নিয়েছে মা বাবা। বাবা বললেন, এখানেই দুপুরে দুটো খেয়ে যেও।

    মুকুল রাজী হয়ে গেল।

    দুপুরের খাওয়া রে সাইকেলে দু’জনে বের হব। সাধারণত দু’জনে বের হলে, আমাদের মধ্যে আশ্চর্য এক প্রাণের সঞ্চার হয়। আজ মুকুল হয়তো লক্ষ্য করে থাকবে, আমি সকাল থেকেই খুব মনমরা হয়ে আছি। এত বড় একটা সুখবরের পরও আমি রে রে করে উঠতে পারছি না। কোথায় যেন কেবল কুণ্ঠাবোধ করছি। বের হবার মুখে মুকুল সহসা বলল, কি ব্যাপার বল তো, আজকাল তুমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছ।

    —কি জানি, আমি তো বুঝতে পারছি না। আমার জীবনে যে বড় একটা ঝড় উঠে গেছে মুকুলকে বলতেও পারছি না।

    মুকুল বলল, মিমিকেও দেখছি কেমন হয়ে যাচ্ছে। দু-দিন এসে তোমার খোঁজ নিয়ে গেছে।

    —কিছু বলল?

    —না তেমন কিছু না! তোমার কিছু হয়েছে কিনা জানতে এসেছিল।

    —কিছু হয়েছে মানে!

    —এই অসুখ-বিসুখ।

    —অ! আর কিছু বলেনি?

    —না।

    এরপর থাকা গেল না।

    বললাম, নাটক করতে যাচ্ছে না!

    —না, বাড়িতে ওর কিছু একটা হয়েছে। কোথাও যাচ্ছে না।

    ভিতরটা আমার কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। মুকুলের সঙ্গে সাইকেলে গঙ্গার ঘাটের দিকে চলে গেলাম। সেখানে একটা পুলের নিচে ফাঁকা মতো জায়গায় দুজনে শুয়ে থাকলাম। মুকুল সারাক্ষণ চৈতালি প্রসঙ্গে কথা বলল। চৈতালি ফার্স্ট ডিভিসন পেয়েছে। বাংলায় অনার্স নেবে। সে আমাদের এক বন্ধু মারফৎ একটি কাগজ চৈতালির বাড়িতেও পাঠিয়েছে। খুব সর্তক এই পাঠানোর ব্যাপারে মুকুল। যেন ও পাঠায় নি, বন্ধুটি হাতে করে নিয়ে গেছে। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছে সে। কেবল বলল, কি যে হবে!

    আমি বললাম, কী আবার হবে, খুশিই হবে!

    আসলে আমাদের বয়েসটা এমন যে আমরা শুধু স্বপ্নই দেখতে জানি! কিন্তু সেই স্বপ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পাই। আমাদের জীবনের শুরুটাই ভাল করে হয় নি। অথচ রাজার মতো বেঁচে আছি মনে হয়। যুদ্ধ জয়ের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। সেই যুদ্ধটা কি কেবল জানি না।

    মুকুলকে বললাম, আমার একই কাজ আছে। যাচ্ছি। মুকুলকে লালদীঘির ধারে ছেড়ে দিয়ে টাউন হলের দিকে চলে গেলাম। মিমিদের বাড়ি সোজা সামনে। মিমিদের বাড়ি আমি এই নিয়ে তৃতীয়বার যাচ্ছি। বাড়িতে ঢুকতেই কেমন অস্বস্তি লাগে। সদর দরজায় দারোয়ান। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। বললাম, মিমি বাড়ি আছে?

    —আছে। যান।

    মিমিদের বাড়ি মানুষের যাতায়াত একটু বেশিই। সামনেই ফুলের বাগানে সেই কাকাতুয়া পাখিটি আমাকে দেখে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, দিদিমণি, বিলু দাদা। আমি এ বাড়িতে আসার প্রথম দিনে কাকাতুয়া পাখিটার সামনে দাঁড় করিয়ে মিমি বলেছিল, বিলু দাদা। পাখিটার আশ্চর্য স্মরণশক্তি। কাকাতুয়া পাখি এত সুন্দর কথা বলতে পারে আমি জানতাম না। সামনে বিশাল বারান্দা। বড় বড় থাম। শ্বেত পাথরের টাইল বসানো। উজ্জ্বল আলোতে গোটা বারান্দা ঝকঝক করছে। ভিতরে ঢুকতেই দেখি সিঁড়ির মুখে মিমি। আমার আসার খবর পাখিটার কাছে থেকে পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে যেন ছুঁটে এসেছে। এসেই আমাকে ভিতরের বসার ঘরে ঢুকতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। যেন সে তার সব রকমের যুদ্ধ জয় করায় যে অপার শক্তি বহন করে বেড়াচ্ছিল, আমাকে দেখা মাত্র সব তার কে হরণ করে নিয়েছে। একেবারে স্থাণুবৎ। আমি নিচে। সিঁড়ির মুখে রেলিং ভর করে মিমি। দামী মুর্শিদাবাদ সিল্ক পরনে। লাল নীল রঙের লতাপাতা শাড়িতে। মিমি আশ্চর্য এক দেবী মহিমায় প্রকাশিত। কিছু বলছে না। বড় ধীরে ধীরে নেমে আসছে। সন্তর্পণে। এদিক ওদিক হলেই যেন টলে পড়ে যাবে।

    মিমি রেলিং ধরে নেমে আসছে। খুব সর্তক পায়ে। আমাকে অপলক দেখছে।

    আমিও কেমন বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছি। উঠে গিয়ে হাত ধরে নামিয়ে আনলে যেন ভাল হয়। ওর কি কোনো বড় রকমের অসুখ করেছে। এত চঞ্চল ছিল ক দিন আগে, আর কি হয়ে গেছে।

    ধীরে ধীরে কাছে এসে বলল, বোস!

    আমার উদ্বেগ সারা চোখে মুখে টের পেয়ে মিমি হাসল। বড় নির্জীব হাসি। বললাম, তোমার কী হয়েছে পরী?

    পরী বড় আস্তে বলল, কিছু না। যাক তবু যে এলে। কবে থেকে আশায় আছি তুমি আসবে। সারাদিন বারান্দায় বসে থাকি। রাস্তায় মানুষজন দেখি। তোমাকে দেখতে পাই না। যেন মিমির খুব কষ্ট হচ্ছিল কথাগুলো বলতে।

    আমি বললাম, তুমি বোস। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন!

    সে সোফার হাতলে ভর করে বসল।

    আমার হঠাৎ কি যেন হল। বললাম, কী হয়েছে তোমার। কী হয়েছে বলবে তো! না ভাল্লাগে না। কিছু বলছে না। কী মেয়ে রে বাবা।

    —কিছু হয় নি। সত্যি বলছি কিছু হয়নি। সে এইটুকু বলে সোফায় মাথা এলিয়ে দিল। চোখ ছাদের দিকে। ছাদে ঝোলান ঝাড়লণ্ঠন, বাতাসে রিন রিন করে বাজছে। দেয়ালে বড় বড় তৈলচিত্র, মিমিদের পূর্বপুরুষদের সব বাঘা বাঘা ছবি। মোটা গোঁফ, মাথায় পাগড়ি। গলায় পাথরের মালা। দামী পোশাকে মানুষগুলো বংশগৌরব রক্ষা করে চলেছে। দেয়ালে ঝুলে থেকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, তোমার আস্পর্ধার শেষ নেই। ছবিগুলোর দিকে তাকাতে আমার কেন জানি ভয় করছিল। এত বড় প্রাসাদতুল্য বাড়িতে দু-একজন ঠাকুর চাকরের দেখা পাওয়া গেল। ওরা সিঁড়ি ধরে উঠে যাবার সময় আমাকে দেখে ঠিক চিনতে পেরেছে। কালী বাড়ির বাবাঠাকুরের বড় অনুগ্রহভাজন এই তরুণ যুবক। তারা বোঝে এ-বাড়িতে বাবাঠাকুরের সুবাদে আমার আলাদা মর্যাদা আছে। যাবার সময় দূর থেকেই গড় হয়ে ওরা উঠে যাচ্ছে।

    মিমির দাদুকে দেখছি না। আমি যতবার এসেছি, দেখেছি তিনি বসার ঘরে কারো জন্য যেন অপেক্ষা করছেন। সিল্কের পাঞ্জাবি পাট করা ধুতি পরনে, পায়ে রুপোলি কাজ করা চটি। তিনিই ডেকে হেঁকে মিমিকে উপরে খবর পাঠিয়েছেন।

    ওর বাবা কাকারা অবশ্য এতটা ডাকাডাকি করেন না। দেখলেই প্রশ্ন কেমন আছ? বাবাঠাকুর কেমন আছেন? আজ কাউকে দেখছি না।

    মিমি বলল, কাগজটা দেখলে?

    —দেখেছি।

    —কভার? -দেখেছি।

    —কভার পছন্দ হয় নি?

    —হয়েছে।

    —আমি জানি তুমি কী পছন্দ কর। দুটো প্রজাপতি একটা ফুল এঁকেছি এজন্য। কোনো ঝাণ্ডামার্কা ছবি আঁকি নি। তোমার খুব ভয় ছিল ও-রকম ছবি হবে বলে।

    —ভয় না। মুশকিল কি জান, আমার বাবা একরকমের, তোমরা একরকমের আবার তুমি আর এক রকমের। আচ্ছা পরী তুমি বিশ্বাস কর, আমরা এ-ভাবে মানুষকে শোষণ থেকে উদ্ধার করতে পারব? আমরা নিজেরা যদি কাজে এবং মননে ঠিক না থাকি—এই বাহ্যিক বিপ্লবের আড়ম্বরে আসল ইস্যুটাই হারিয়ে যাচ্ছে না। মানুষ যদি নিজের ঘর থেকে বিপ্লব শুরু না করে, বাইরের লোক এসে বিশেষ করে তোমাদের মতো মানুষেরা তাদের ভাল ভাল কথা বললেই শুনবে কেন। তাদের সঙ্গে তোমাদের জীবনের কোনো মিলই নেই।

    —আজ না হয় এ-সব কথা থাক। আমি তোমাকে জানি অনেক পীড়ন করেছি। আজ আমার সঙ্গে এ-সব বলে শত্রুতা নাই করলে।

    এ-সময় মনে হল সিঁড়ি ধরে কেউ আসছে। হাতে ট্রে। চা খাবার উপর থেকে আসছে।

    মিমি উঠে গিয়ে ট্রেটা হাতে নিল। সন্তর্পণে টেবিলে রেখে দু-কাপ চা বানাল। একটা আমাকে দিল, মিষ্টির প্লেট, জল দিল। নিজে এক কাপ চা সামনে রেখে বসল। আঁচল দিয়ে গা ঢাকল ভাল করে। শাড়ি টেনে পায়ের পাতা ঢেকে দিল।

    মিমির এই বসার ভঙ্গি আমাকে এক আশ্চর্য সুষমার জগতে নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারি। ওর দীর্ঘ ঋজু চেহারা, দেবীর মতো চোখ মুখ, তিল ফুলের মতো নাক এবং এলোমেলো চুলের সুঘ্রাণ কোনো এক অলৌকিক মহিমার কথা যেন আমাকে কানে কানে বলছে।

    মিমি বলল, খাও।

    —আমি কিছু খাব না। তুমি এ-রকম কেন হয়ে গেলে। কেন! কেন। অসুখ করে নি বলছ, হয় মিছে কথা বলছ, নয় এড়িয়ে যাচ্ছ আমাকে।

    —তুমি তো আমার কিছুই পছন্দ করতে না বিলু! আমি তো সব ছেড়ে দিয়েছি।

    —ছেড়ে দিতে তো বলি নি! তুমি যেমন আছ তেমনি থাক। তবু ভাল হয়ে যাও। আমি তোমার সব মেনে নেব।

    —ঠিক বলছ মেনে নেবে?

    —হ্যাঁ। আমি অপছন্দ করি বলে, পার্টি, নাটক মিছিল সব তুমি ছেড়ে দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে এ আমি কখনও চাই নি। সত্যি বলছি চাই নি।

    —কিন্তু আমি যে সব ছেড়ে দিতে চাই। পায়ের নিচে মাটি থাকলে কিছুই ছেড়ে দিতে আমার কষ্ট হবে না। গাছ তো মাটিতে বেঁচে থাকে। আমার গোড়া উপড়ে নিতে চায় এখন সবাই।

    —সবাই মানে।

    —মা বাবা কাকা দাদু সবাই।

    —তারা তোমার খারাপ করবে কেন!

    –করছে।

    হঠাৎ যেমন হয় ক্ষেপে যাবার স্বভাব আমার, চিৎকার করে বলে উঠি, কি হয়েছে খুলে বলবে তো!

    —আগে কথা দাও।

    —কি কথা!

    —আমার পায়ের নিচেকার মাটি সবাই সরিয়ে নিলেও তুমি নেবে না।

    –সবাই সরিয়ে নিলে, আমি একা কি করতে পারি।

    —ওটুকু থাকলেও আমি ফুল হয়ে ফুটে থাকতে পারব।

    এসব হেঁয়ালিপূর্ণ কথা আমার মাথায় ঠিক খেলছে না। মিমি কি বলতে চায়। মিমির কি বাসনা?

    বললাম,পরী প্লিজ, তুমি খুলে বল। খুলে বল কী হয়েছে। না হলে আমি এক্ষুনি চলে যাব।

    সহসা পরী হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, বিলু তুমি আমার চরম শত্রু। তুমি কেন এত বড় সর্বনাশ আমার করলে। কেন, কেন। কি করেছি আমি! আমার কি দোষ!

    আমি হতবাক। আমি ওর সর্বনাশ করেছি। বড় নিচ মনে হলো নিজেকে। পরীর সম্পর্কে কোথাও তো কোনোদিন কোনো কুৎসা রটনা করেছি আমার মনে পড়ে না। আমার জন্য পরীর জীবন নষ্ট হয়ে গেল।

    আমি কথা বলছি না দেখে, মাথা নিচু করে রেখেছি দেখে পরী ধীরে ধীরে উঠে চলে গেল। সামনের বেসিনে গিয়ে চোখে জলের ঝাপটা দিল। আঁচলে মুখ মুছে ফের এসে বসল। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে। আমাদের দুজনের কারোরই মনে নেই সামনে চা ঠাণ্ডা হচ্ছে। আমরা কেমন দুজনেই অতলে ডুবে যাচ্ছিলাম। বিশেষ করে আমি। কিছু বলারও সাহস পাচ্ছি না। পরীর সর্বনাশ করতে আমি কোনো দিন চাই নি। পরীকে কেউ নিন্দা করলে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে যেত। সেই পরী আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে।

    উঠে পড়ে বললাম, জেনে শুনে কোনো সর্বনাশ আমি তোমার করি নি। না জেনে করলে ক্ষমা করে দিও।

    সহসা মিমি তার শীর্ণ হাত বাড়িয়ে আমার হাত চেপে ধরল। কি ঠাণ্ডা হাত! কিছু বলছে না। আমারও মনে হল বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে গেছি। নড়তে পারছি না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। বসে পড়লাম। মিমি অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় বলল, তুমি চাকরিটা নিচ্ছ!

    —না নিলে কি উপায়!

    —পড়াশোনা বন্ধ করে দিচ্ছ?

    —আপাতত তাই।

    আর এ সময়েই দেখলাম মিমির দাদু সিঁড়ি ধরে নেমে আসছেন। আমাকে দেখেই যেন তিনি স্বর্গ হাতের কাছে পেয়ে গেছেন। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে তিনি কাছে চলে এসে বললেন, কখন এসেছ?

    —এই খানিকক্ষণ।

    —ভাল হয়েছে। তুমি মিমিকে একটু বুঝিয়ে যাও তো—ও তোমার কথা শোনে। পরেশ চন্দ্ৰ কে চেন! আরে আমাদের সদরের এস ডি ও। পাকা কথা দিতে পারছি না। বড় অশান্তি চলছে। ঝড়। দেখেছ তো কী চেহারা করেছে। অথচ পরেশের বাবার খুব আগ্রহ—এমন সুপাত্র কেউ হাতছাড়া করে! তুমি বল।

    —করা উচিত নয়।

    সহসা মিমি সাপের মতো ফণা তুলে উঠে দাঁড়াল। গেট আউট। আই সে গেট আউট। তুমি কে আমার। উচিত অনুচিত তুমি ঠিক করবে।

    দাদু সহসা খুবই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেন, ছি! মিমি কী হচ্ছে! তুই এটা কী বলছিস বিলুকে?

    মিমি আবার ভেঙে পড়ল, দাদু তুমি জান না, ও আমার কত বড় শত্রু, দাদু তুমি জান না, ওর শত্রুতার শেষ নেই। তারপর সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল। মুখে আঁচল চেপে সে তার হাহাকার কান্না সমালাচ্ছে।

    আমি এ সময় কি করব বুঝতে পারছি না। আমরা দুজনেই ধরা পড়ে গেছি। মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। উঠে যে বের হয়ে যাব সে সাহসও নেই, শক্তিও নেই।

    কেমন ঘাবড়ে গেছি খুব। মিমির দাদু এখন কী বুঝলেন কে জানে। পাশে বসে বললেন, ও কি! চা খাবার কিছু খেলে না।

    —খাচ্ছি।

    তিনি হাসলেন, নরেশ, ও নরেশ।

    যেন সবাই উৎকর্ণ হয়ে থাকে- নরেশ হাঁক শুনেই নেমে আসছে।

    —আর এক কাপ চা দে বিলুকে।

    আমি বললাম, থাক। চা খাব না।

    —তবে মিষ্টিগুলো খাও।

    তারপরই তিনি বললেন, ওর কোনো ইচ্ছেই আমরা অপূর্ণ রাখি নি বিলু। কিন্তু মেয়েদের একটা বয়েস থাকে, যখন সব মানিয়ে যায়। পরে আর মানায় না। ও কিছুতেই রাজী হচ্ছে না। বাবাঠাকুরও বলেছেন, রাজযোটক। হাতছাড়া করবি না। কী ফ্যাসাদে পড়েছি বল। পরেশের দেবদ্বিজে ভক্তি প্রবল। বাবাঠাকুরের কাছে মাঝে মাঝে চলে যায়। তারপর কি ভাবলেন, তুমি তো জান বিলু আমরা সব অবহেলা করতে পারি কিন্তু বাবাঠাকুরের নির্দেশ অমান্য করতে পারি না। বাড়ির সব কাজে তাঁর অনুমতি না হলে চলে না।

    আমি শুধু বললাম, যাই।

    —না যাবে না। বোস। তোমার সঙ্গে পরামর্শ আছে।

    আসলে এই মানুষটি কালীবাড়িতে দেখেছেন, কথায় কথায় বাবাঠাকুর আমাকে ডেকে পাঠাতেন। বলতেন, নে তুই আমার পাশে বোস। বই খুলে রাখ। ভুল হলে ধরিয়ে দিবি। বাবাঠাকুরের ভুল ধরিয়ে দিতে আমিই পারি, কারণ বাবাঠাকুর হয়ত আমাকে খুব অনাথ ভেবেছিলেন। আমার বিষণ্ণতা বাবাঠাকুরের মধ্যে কোনো অপত্য স্নেহেরও জন্ম দিতে পারে— যে কারণেই হোক মন্দিরে একমাত্র থানের ফুল বেলপাতা আমিই তুলে সবার হাতে দিতে পারতাম। আর কাউকে তিনি মন্দিরে ঢুকতে দেন না। অবশ্য বদরিদা এবং বৌদি ঢুকতে পারে। এসব পরীর দাদু জানেন বলেই হয়ত আমার পরামর্শ এই পরিবারে এত বেশি দরকার।

    অথচ আমি বুঝতেই পারছি না—সংকট শুধু তো এ-পরিবারের নয়। আমারও।

    কাজেই বলতেও পারলাম না, আমি ছেলেমানুষ—এত বড় সংকটে আমার পরামর্শে কী আসে যায়।

    তবু বসে আছি। উঠতে পারছি না।

    তিনি বললেন, তুমি মিমিকে বুঝিয়ে বল। এখন বলে লাভ নেই। মাথা ঠাণ্ডা হোক। পরে বলবে।

    কবে আবার আসছ?

    —দেখি।

    —দেখি না, আমি ভেবেছিলাম নিজেই যাব। কিন্তু মিমির এক কথা। গিয়ে দেখ না! বিলু ওদের বাড়ি আমাদের যাওয়া পছন্দ করে না। গেলে খারাপ হবে বলে শাসিয়েছে। তুমি কাল সকালে আসবে। আসছ তো!

    আমার কী হল কে জানে, বললাম, দাঁড়ান, আমি এখনই কথা বলছি।

    দাদুর মুখটি কেমন শুকিয়ে গেল। এত বড় মানুষ, দাপট যাঁর সারা শহরে, সেই মানুষ মিমি সম্পর্কে এত দুর্বল এই প্রথম টের পেলাম।

    তিনি বললেন, তোমাকে আবার অপমান করতে পারে।

    বলার ইচ্ছে হল, অপমান আমার গা-সওয়া। দেশ ভাগের পর থেকেই নানাভাবে মান-অপমানে জ্বলছি। মিমি আমাকে আর কি অপমান করবে! ওর অপমান অমার কাছে কত মধুর যে এখন এই বুড়ো মানুষটিকে বোঝাই কী করে।

    মিমির দাদু উপরে উঠে গেলেন।

    মিমি আবার নেমে আসছে।

    আমি হেসে ফেললাম। বড় অভিমানী বালিকা। মুখ থমথম করছে।

    বললাম, বোস।

    মিমি বসল।

    —আমি মাস্টারি করি তুমি চাও না।

    মিমি চুপ করে থাকল।

    —মানুষ এতে ছোট হয়ে যায় না।

    কেমন বালিকার মতো মিমি বলল, তুমি তাহলে যে আর পড়াশোনা করতে পারবে না। তুমি জান না বিলু তুমি কি তুমি জান না, জানলে পেটি একটা মাস্টারি করতে যেতে না।

    —মাথা ঠাণ্ডা করে ভাব। তুমি তো জান আমার বাড়ির অবস্থা।

    —জানি।

    –চাকরিটা অভাবের সংসারে পড়ার চেয়ে বেশি দরকার। আচ্ছা তুমি বুঝছ না কেন, ইচ্ছে থাকলে মানুষ কী না করতে পারে।

    —তা পারে।

    —তবে।

    মিমি এবার আমার দিকে তাকাল। বড় শান্ত চোখ। বলল, পারবে?

    —পারতেই হবে। আমার স্বপ্নই আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আগুন যখন জ্বালিয়ে দিয়েছ, দেখ না সে কতটা জ্বলতে পারে। সামান্য একটা চাকরি করলেই আমার ভেতরের আগুন নিভে যাবে তোমাকে কে বলল। অবোধ বালিকার মতো এসব ভাবলেই বা কী করে।

    হঠাৎ মিমির চোখ কোমল হয়ে গেল। আমার হাত ধরে বলল, বিলু আমি যে তোমার আয়নায় নিজেকে দেখতে ভালবাসি। আমার মরণ হল না কেন। তুমি যদি ছোট হয়ে যাও, সরু গলিতে ঢুকে পড় সেখান থেকে আমি তোমাকে কী করে বের করে আনব?

    —সরু গলি তো শেষ পর্যন্ত বড় সড়কে গিয়ে মেশে।

    পরী আজ এই যেন প্রথম বুঝতে পারল, আমি তার চেয়ে পৃথিবীর এই গাছপালা, মাঠ, নদী এবং বড় সড়কের কথা বেশি জানি। শুধু বলল, তুমি যা ভাল বোঝ কর। আমার কিছু বলার নেই। তারপরই পরী বড় বিমর্ষ হয়ে পড়ল। বলল, দাদুর কাছে কিছু শুনলে?

    —শুনেছি।

    —কী করব বলে যাও।

    আমি বললাম, একবার বাবাঠাকুরের কাছে আমাকে যেতে হবে আর কি। আমি জানি তিনি সাধক মানুষ। তিনি রাজযোটক বলতেই পারেন। কিন্তু তোমার যে অমত আছে তা তো তিনি জানেন না। শুধু বাবাঠাকুরকে এই খবরটাই দিতে হবে। ভেবো না।

    আর সঙ্গে সঙ্গে পরী সত্যি যেন অবোধ বালিকা হয়ে গেল। আমাকে জড়িয়ে ধরল, বিলু, আমি তোমার পায়ে পড়ব। দোহাই তুমি আমাকে রক্ষা কর।

    সেবারে মিমি গোটা পরিবারটিকে সংকট থেকে ত্রাণ করার জন্য আমার পা ছুঁয়েছিল অনিচ্ছায়। এবং তারই হেতুতে আমি প্রথমে মিমির কাছে মার বিষয় হয়ে গেছিলাম। ফাঁক পেলে মিমি আমাকে আড়ালে আবডালে হেনস্থা করেছে। আজ সে নিজের ইচ্ছায় পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

    বললাম, উঠি মিমি। মাথা খারাপ কর না আমি আছি।

    মিমি বলল, তুমি আছ বলেই আমি বেঁচে থাকব। তুমি আছ বলেই আমি আর নষ্ট হয়ে যেতে পারব না। তারপর মিমি আমার সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এল। বলল, শুনবে না?

    —কী শুনব?

    —সেই কবিতাটা। ‘জীবন বড় দুরন্ত বালকের হাতছানি।

    —এখন!

    মিমি চোখ নামিয়ে নিল। আমি বুঝি, অমার কবিতা পাঠে সে কোথাও মুক্তির স্বাদ খোঁজে। কেন জানি মনে হল আজ সারাক্ষণ পরীর পাশে বসে থাকি। পরীকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মনের সঙ্গে আমার কথার এতটুকু যে মিল থাকে না মিমিই বোধ হয় সেটা সবার আগে টের পায়। বললাম, বল। শুনি।

    পরী প্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে আমার কবিত, আবৃত্তি করে গেল— যতদুর যাই অগাধ স্বার্থপরতা/যত দূরেই যাক, একদিন থাকে না তার কোলাহল :/ সে হয় অবনত বৃক্ষ মৃত্যু তীক্ষ্ণ সুধা/ফুল যদি ফোটে, ফুটে থাকে আমার ঈশ্বর/ শেষ বিকেলে।। যদি হেঁটে যায়—আমার প্রতিমা / প্রতিমার মতো দুই হাতে থাকে তার করবদ্ধ অঞ্জলি/ আমার সব অপমান মিছে/ সে আছে বলেই বেঁচে থাকি, বাঁচি/ জীবন বড় এক দুরন্ত বালকের হাতছানি।

    মিমি এবার চোখ খুলে আমাকে দেখল। উদ্ভাসিত চোখ। কুয়াশার জলে ধোয়া মুখ। সব বিবর্ণতা যেন নিমেষে কেটে গেছে। বললাম, বাবা ঠিকই বলেন।

    পরী বলে, কী বলেন?

    —ও মিমি হবে কেন, ও তো মৃণ্ময়ী। বাবা তোমাকে পরী বললে রাগ করেন। মিমি বললেও। পরী আর কোনো কথা বলল না, শুধু বের হবার সময় বলল, সাবধানে যেও।

    আমি বের হয়ে রাস্তায় নেমে গেলাম। সাইকেলে চলে যাচ্ছি। পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাব, পরী বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে আমাকে লক্ষ্য রাখছে। পৃথিবীটা যেন অন্যভাবে আজ আমার সামনে হাজির। সরু রাস্তাটা বড় সড়কে কোথায় গিয়ে পড়েছে আমাকে তা আজ থেকে পরীর জন্য যেন খুঁজে বার করতেই হবে।

    চার পাশের আলো ঘরবাড়ি পাকা সড়ক ধরে গাছপালার ছায়ায় চলে যাচ্ছি। যাচ্ছি, না বার বার ফিরে আসছি। কার কাছে। পরীর কাছে! যত দূরেই যাই সে যেন টানে। পরীর উপর দিয়ে বড় একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেই ঝড় থেকে শেষ পর্যন্ত যদি তার আত্মরক্ষা না করতে পারি। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। শহর পার হয়ে গুমটি ঘরের কাছে আসতেই গভীর অন্ধকার। রেল- লাইন পার হয়ে পঞ্চানন তলার মাঠে আমি। মাথার উপর আকাশ আর অজস্র নক্ষত্র। ধরণী শান্ত। শস্যক্ষেত্রে আবাদের শুরু। কোথাও কীটপতঙ্গের আওয়াজ। জীবনে পরী না থাকলে আমি কত নিঃস্ব এই প্রথম টের পেলাম। এবং পরীর জন্য আশ্চর্য আবেগে ভেসে গেলাম। নিজের জন্য কেউ এ- ভাবে কাঁদে আগে জানতাম না। আমার চোখ পরীর কথা ভেবে জলে কেন যে ভেসে যাচ্ছিল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }