Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1047 Mins Read0

    মানুষের ঘরবাড়ি – ৩

    তিন

    নিবারণ দাস পরদিনই সকালে এসে হাজির। একটা চাটাই পেতে দিল মায়া। মা ঘোমটা টেনে বলল, তোর বাবাকে ডেকে দে। বাবা এ-সময়টাতে কোথায় থাকেন সংসারে সবাই জানে। সীমানা বরাবর জিয়ল গাছের ডাল পুঁতে নিজের জমি ঠিক করে নিচ্ছেন। বাবা এলে দাস বলল, এলাম কর্তা। একটা দিনক্ষণ দেখে দিন। শুভদিনে আড়ত খুলব ভাবছি।

    বাবা বলল, দাসমশাই, পাঁজি তো নেই।

    এবং দাসমশাই পরদিনই একটা নতুন পঞ্জিকা উপহার দিয়ে গেল। দিনক্ষণ জেনে গেল। বাবা পঞ্জিকাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভারি অভিভূত হয়ে বসে থাকলেন। বড় মূল্যবান সামগ্রীর মতো বইটাকে দেখতে থাকলেন। কাছে গেলে ধমকে উঠলেন, এখানে কি, যাও! পাছে বইটাতে আমরা কেউ হাত দিই ভয়ে একদম কাছে ভিড়তে দিলেন না। দূর থেকেই আমরা যতটা পারলাম আশ মিটিয়ে দেখলাম। খুবই ভাগ্যবান মানুষ বাবা—আস্ত একটা পঞ্জিকা নিবারণ দাস উপহার দিয়ে গেল—ভাগ্যে লেখা না থাকলে এ-সব হয় না। এখানে আসার পর কতবার তো চেষ্টা করেছেন শহর থেকে বইটা আনিয়ে নেওয়ার। কিছুতেই হয়ে ওঠে নি। গত জন্মের পুণ্যফলেই এখনও যা কিছু হচ্ছে। বিশেষ করে বইটা পেয়ে বাবা কেমন খুবই ছেলেমানুষ হয়ে গেলেন। পাতা খুলে খুব সন্তর্পণে একের পর এক দেখে যেতে থাকলেন। কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন অমূল্য ধন তাঁর কাছে আছে, আর যদি জানতে পারে মানুষেরা, অমোঘ দিনক্ষণ বলে দিতে পারে মানুষটা তবে অঞ্চলের একজন সেরা মানুষ হতে বেশী আর সময় লাগবে না।

    বইটা পেয়ে দু-তিন দিন বাবা নাওয়া-খাওয়ার কথাই ভুলে গেলেন। বাড়িঘরের কথা মনে থাকল না। সারাটাক্ষণ উবু হয়ে গোটা পঞ্জিকাটা পড়ে বোধ হয় শেষ করে ফেললেন। কোনো পাতায় আবার দুটো লাইন দেগে দিলেন। বইটা কোথায় রাখা যাবে, এই নিয়েও বড় সমস্যা দেখা দিল। পিলুকেই বেশি ভয় বাবার। ছবি দেখতে গিয়ে ছিঁড়ে না ফেলে। মলাট দেবার মতো বাড়তি কাগজ নেই। তিনি বইটি রাখার মতো কোনো জায়গাই ঘরে নির্বাচন করতে পারলেন না। ট্রাংক ভাঙা। যে কেউ খুলতে পারে। নিবারণ দাস দিলই যখন বাড়তি একটা তালা চাবি দিলে পারত। কোথায় এখন যে রাখা যায়!

    মা বলল, দাও তুলে রাখি।

    —কোথায়?

    —কেন ট্রাংকে।

    —থাকবে ভাবছ?

    —থাকবে না তো কে খাবে!

    —তোমার মূর্তিমান শ্বাপদেরা সব করতে পারে। সব খেতে পারে।

    পিলু বলল, আমি ধরব না তো বলেছি।

    আমিও বললাম, কেউ ধরবে না বাবা, তুমি ভাঙা ট্রাংকটাতেই রাখ। মা বলল, তোরা কিছু বলতে যাস না। তারপর কিছু হলে সব দোষ তোদের।

    কিন্তু সারা দিন ধরে পঞ্জিকাটা বাবাকে ভারি বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে রেখেছে। তিন দিনের দিন বাবা শেষ পর্যন্ত ট্রাংকে রাখাই স্থির করলেন। এত করেও পঞ্জিকার ভবিতব্য সম্পর্কে খুব একটা সংশয় থেকে গেল তাঁর। পিলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার তো সংসারের সব কিছুই কাজে লাগে। এটাকে আর কাজে লাগাতে যেও না।

    পিলু বলল, আমি ধরবই না।

    যতই বলুক, আমিও বাবার মতো শেষ পর্যন্ত পিলুই অনিষ্টের কারণ হবে ভাবলাম। কারণ পিলুকে বিশ্বাস নেই। সে আজকাল সহজেই একশ রকমের মিথ্যে কথা বলতে শিখেছে। এবং সেবারে বাবা প্রায় মাসখানেক বাদে নিরুদ্দেশ থেকে ফিরলে আনন্দে পিলু বনটার এমন সব জীবজন্তুর খবর দিয়েছিল তার সাহসিকতা প্রমাণের জন্য যে একটা কথাও সত্যি না। বাবার একটা আমলকী গাছের চারা পিলু তুলে নিয়ে তার পছন্দমতো জায়গায় ফের পুঁতে দিলে গাছটা মরে গেল। পিলু স্বীকারই করল না সে কাজটা করেছে। আমরাও ঠিক দেখি নি, বাবা বাড়ি নেই, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই, পিলু বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়—এরই মধ্যে কখন সে কাজটা করেছিল আমরা কেউ জানিও না। অথচ পিলু ছাড়া এত বড় দুঃসাহসিক কাজ আর কেউ করতে পারে না। তিন ক্রোশ দূর থেকে বাবা হেঁটে গিয়ে চারাটা এনেছিলেন। ফিরতে ফিরতে সাঁজ লেগে গেছিল। বাবা সকালে গর্ত করে গাছটা লাগিয়েছিলেন। পিলু বলেছিল, তুমি রাস্তার পাশে লাগালে বাবা! সব আমলকী লোকে চুরি করে নিয়ে যাবে। এই সুমার বনে লোক আসবে কোত্থেকে? পিলু বলেছিল, গাছটা বড় হতে হতে সুমার বনটা আর থাকবেই না। মানুষজন ঠিক চলে আসবে। ফল হলে চুরি যাবে ভয়ে সে ঠিক গাছটা ঘরের পেছনে বেশ একটা নিরিবিলি জায়গায় পুঁতে দিয়েছিল বোধ হয়। এবং শেষে মরে গেছে বলে বেশ কিছুদিন বাবা বাড়ি ফেরা পর্যন্ত ভাল মানুষ হয়েছিল। বাবার চেঁচামেচিতে বুঝতে পেরেছিলাম, পিলুর খুব সদাশয় হয়ে যাওয়ার মূলে ছিল গাছটা।

    তবে আমাদের সৌভাগ্য বাবা রাগ খুব বেশিক্ষণ পুষে রাখতে পারেন না। খেতে বসে বাবা পিলুর পাতে বড় পুঁটি মাছটা তুলে দিয়ে বলেছিলেন, খা। একটা অমালকী গাছ কোথায় আবার পাব! আমলকী ফল অজীর্ণ রোগে কত কাজে লাগে জানিস!

    পিলু বেশ বড় মাছটার লেজ ধরে দুবার মাছটা চাটল। তারপর এক গাল হেসে বলল, জান বাবা ক’টা বাবু মতো লোক এসে না বনটা দেখে গেছে।

    বাবা বললেন, কারা ওরা?

    —আমি তখন না বাবা মাঠে ছিলাম। আমাকে বলল, খোকা তুমি থাকো কোথায়। বনের ভেতরে বাড়িটা দেখালে বলল, এই জঙ্গলে তোমরা থাক। ভয় লাগে না?

    জঙ্গল বলায় পিলুর খুব রাগ হয়েছিল। সে বলেছিল, জঙ্গল কোথায়। এটা তো একটা বন।

    —তোমার বাবা বাড়ি আছেন?

    —বাবা কোথায় গেছেন।

    —কোথায়, জান না?

    —না। বাবা মাঝে মাঝে আমাদের ফেলে চলে যান।

    এতে বোধ হয় বাবার আত্মসম্মানে লেগেছে। তিনি বললেন, কোথায় যাই আবার। দেশ গাঁয়ের লোক কে কোথায় এসে উঠছে খুঁজতে হয় না। এখানে আমাদের আর কে আছে! ওরা কোথাকার লোক জিজ্ঞেস করলি না?

    —বলল কোটালি পাড়ার লোক।

    —কোন কোটালিপাড়া? বুলতার কোটালিপাড়া না ফরিদপুরের কোটালিপাড়া। আর একটা কোটালিপাড়া আছে কিশোরগঞ্জের কাছে। এতকিছু বোঝ আর এটা বোঝ না। কোন কোটালিপাড়া জিজ্ঞেস করতে হয়। ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার মজুমদার মশাইরা তো রানাঘাটে বাড়ি করেছে।

    বাবার ভূগোল এত জানা যে মাঝে মাঝে মনে হত অনায়াসে বাবা পৃথিবীর সব খবর দিয়ে যেতে পারেন। আসলে বাবা জমিদার এস্টেটে আদায়ের কাজ করেছেন। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হত বাবাকে। কত সব মানুষ পৃথিবীতে বাবার চেনা হয়ে গেছে। তখন বাবার জন্য আমরা গর্ববোধ না করে পারতাম না।

    বাবা আবার ফিরে আসায় সংসারে সবাই ফের নিশ্চিন্ত। ক’টা দিন আবার পেট ভরে খাওয়া। বাবা একটা দিন কোথায় কি ভাবে কাটিয়েছেন সারাক্ষণ সেই গল্প। কোথায় অনেকদিন পর কার বাড়িতে এই কর্তাঠাকুরটিকে পাবদা মাছের ঝোল খাইয়েছে তার বিশদ ব্যাখ্যা টীকা সহকারে মাকে বোঝাচ্ছিলেন। — পাবদা মাছ, তবে বুঝলে ধনবৌ, দেশের মতো না। তেমন পাবদা মাছ এ দেশে পাওয়া যাবে কেন! এবং এই পাবদা মাছ প্রসঙ্গে বাবা এমন নিদারুণ সব ঝালঝোল শুকতোনির গল্প করছিলেন যে রাতে আর আমাদের কিছুতেই ঘুম আসছিল না। আমরা সবাই মশারির ভেতর থেকে মুখ বার করে বাবার পাবদা মাছ খাওয়ার গল্প শুনছিলাম।

    পিলু বলে ফেলল, আমরা একদিন খাব বাবা।

    —খাবে তো পাবেটা কোথায়। খেতে হলে রানাঘাটে যেতে হয়।

    পিলু বলেছিল, রানাঘাট কতদূর বাবা?

    —অনেক দূর। বড় হলে যাবে।

    আমি বললাম, ও মা, তুই কিরে। আমরা যখন এদেশে এলাম তখন তো রানাঘাটের ওপর দিয়েই এলাম।

    —সত্যি! পিলুর যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।

    মা বলল, ওর মনে না থাকারই কথা।

    —রানাঘাটে আমরা রাতে ট্রেন বদল করলাম না বাবা! স্টেশনে ম্যাজেন্টা রঙের আলো। কি রকম অদ্ভুত একটা দেশ মনে হচ্ছিল আমার। আর কত গাড়ি। এদিকে গাড়ি ওদিকে গাড়ি। মাথার ওপর দিয়ে একটা পুল চলে গেছে। ঘটাং ঘটাং শব্দ।

    পিলুর বুঝি মনে হল ওটা একটা স্বপ্নের দেশ। সে বড় হয়ে একবার রানাঘাটে যাবে বলল। বাবাও খুব আত্মবিশ্বাসের গলায় বললেন, এত দেশে গেছ আর রানাঘাটে যাবে না সে হয়!

    এত দেশ বলতে তো আমাদের নিয়ে বেড়ালছানার মতো দুটো বছর এখানে সেখানে বাবা ঘুরে বেড়িয়েছেন। নবর বাবার খোঁজে তিনি সেই যে আমাদের প্ল্যাটফরমে ফেলে চলে গেলেন আর আসেনই না। সারাদিন না খেয়ে থাকার পর পিলু একটা বাড়ির পাশে শসার মাচান আবিষ্কার করে ফিরে এল। বিকেলে সে আমাকে নিয়ে সব দেখাল। আট দশটা কচি শসা। আমাদের চোখ মুখ এত ক্ষুধার্ত থাকত যে লোকে দেখলেই তেড়ে মারতে আসত। মা তো নির্বিকার। স্টেশনে দিনের পর দিন বাবার ফিরে আসার আশায় বসে আছে। পিলু সারাদিন না খেয়ে থাকলে ভীষণ বেয়াড়া হয়ে যায়। মাকে যা খুশি গাল দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় দেখি দূরের মাঠে সোরগোল। পিলু কাছে কোথাও নেই। মাঠে দেখছি একদল ছেলে পিলুকে ঠ্যাঙাবে বলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আর পিলুর সেই আর্ত চিৎকার- দাদা রে। সেই প্রথম আমার মাথায় ভীষণ একটা বুনো মোষ তাড়া দিয়ে উঠেছিল। ছুটে গিয়েছিলাম। সবার ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলেছিলাম, আমার ভাইকে ছেড়ে দিন। ও শসা চুরি করেনি। আমরা খুব গরীব। বাবা তিন চারদিন হল কোথায় গেছে।

    সেই ষন্ডামতো ছেলেগুলো আমাকে দেখে কি ভাবল জানি না, পিলুকে ছেড়ে দিয়েছিল। বলেছিল, হারামজাদা, তোমার ভাইকে সহ এবার তোমাকে প্যাদাব। আবার যদি দেখি এদিকে ঘুরঘুর করছ কখনও।

    সবিনয়ে বলেছিলাম, আর আসব না ইদিকে। পিলুর দিকে তাকিয়ে খুব গার্জেনি গলায় বললাম, তুই চুরি করেছিস। সত্যি করে বল?

    —নারে দাদা। মিছি মিছি ওরা আমাকে ধরে নিয়ে ঠ্যাঙাবে বলছে।

    ওরা চলে গেলে পিলু ভারি সন্তর্পণে বলল, বাবাকে খুঁজতে যাবি আবার?

    —কোথায়?

    —চল না। বলে সে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল বড় একটা ইঁটের ভাটায়। কেবল জঙ্গল আর আগাছা। সামনে বড় বড় সব শিরীষ গাছ। পর পর সব উইয়ের বড় ঢিবি। ঢিবিগুলি পার হলে সুন্দর মতো দুটো মিনার। বোধহয় এখানে কোনো দরগা আছে। মেলা বসে কখনো। সে কি সব চিহ্ন দেখে ক্রমে গভীর জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছিল। এখানে বাবা কেন মরতে আসবে বুঝতে পারছিলাম না। সে একসময় শিশুর মতো সরল গলায় বলল, এই যে পেয়েছি। ঘাস পাতা সরিয়ে ফেলল সে দু হাতে।। জ্বলজ্বল করছে কটা কচি শসা। সত্যি পিলু চুরি করেছে তবে। পিলু চুরি করেছে বাবা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবেন। সে বলল, দাদা, তুই বাবাকে বলে দিস না। কিরে বলে দিবি না তো?

    পিলুর এত ভারি কষ্টের মুখ আর আমি জীবনেও দেখিনি। বললাম, বলব না। পিলুর ওপর রাগটাও আর বেশিক্ষণ থাকল না। পেটের খিদেটা যে কি, যে কোনো কুকর্মই এসময় খুব মহৎ কাজ মনে হয়। কিছুক্ষণ আগে যে, পিলুকে সেই ষন্ডামতো ছেলেগুলো ঠ্যাঙাবে বলে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, শসা ক’টা পিলু বাদে যে আর কেউ চুরি করেনি—ওরা ঠিকই ভেবেছিল, এবং আমার ভাই পিলু, তা ছাড়া পিলু আমার বাবার মতো মানুষের ছেলে, আমার সম্মানে খুব লেগেছিল—সেসব কিছুই আর মনে পড়ছিল না।

    চারপাশে তাকিয়ে বললাম, কেউ আবার যদি দেখে ফেলে?

    —কত বড় জঙ্গল। কেউ এখানে আসেই না।

    সত্যি বনজঙ্গলটা বেশ বড়। অদুরে রেল-লাইন, ইস্টিশান, লাল ইঁটের বাড়ি। পাড়াগাঁয়ের মানুষজনের চলাফেরার শব্দ ছাড়া আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শসা ক’টা জামার তলায় লুকিয়ে ফেলা দরকার। কে কোথায় আবার দেখে ফেলবে। এত সব গাছপালা, পাখি কাউকে যেন বিশ্বাস নেই। প্ল্যাটফরমে আমাদের থাকা খাওয়া এবং শসা ক’টা কি যে অমূল্য ধন তখন, আমি খাব, পিলু খাবে, মা খাবে, মায়া তো সব ক’টা একাই খেয়ে নিতে চাইবে। কিন্তু মা যদি না খায়। চুরি করা শসা মা না-ও খেতে পারে। তা ছাড়া মা’র মাথাও খুব একটা ঠিক নেই। বাবার আক্কেলের কথা ভেবে অদৃষ্টকে শাপমণ্যি করছে। আর কেন যে ইষ্টিশানে ফিরে এলেই আমরা দু ভাই হুটোপুটি লাগিয়ে দিই। এই বুঝি ট্রেন থেকে বাবা নামলেন। কত লোক আসে ট্রেনে অথচ বাবার মতো মানুষ ট্রেন থেকে একজনও নামেন না। তখন পিলুর এই দুর্বুদ্ধিকে দুঃসময়ে বাহবা না দিয়ে পারা যায় না। পিলুর প্রতি বরং প্রগাঢ় ভালবাসাই আমার প্রবল হয়ে উঠল।

    পিলু বলল, দাদা তুই একটা খা, আমি একটা খাই। সে একটা আমাকে দিল, নিজে নিল একটা। আর একটা শসা দেখিয়ে বলল, এটা মায়ার। এটা খাবে মা। দুটো থাকল, কাল সকালে খাব। পিলু খুব হিসেবী মানুষের মতো বলল, বাবা ফিরে না আসাতক আমাদের বেঁচে থাকতে হবে দাদা। সেদিন প্ল্যাটফরমে ফিরে আসতে বেশ রাত হয়ে গেল।

    বাবার হাতে পয়সা নেই। রেলগাড়িতে বাবার টিকিট লাগে না। পয়সা না থাকলে মানুষের যা হয়। খুব মিশুকে স্বভাবের মানুষ—যেখানেই তিনি যান একসময় ঠিক ঠাকুরকর্তা বনে যান। ফলে পয়সা না থাকলেও কিছু আসে যায় না। ঠিক ট্রেনে চড়ে দূরদেশে চলে যেতে পারেন। বাবা কোথায় কি খান, কি পরেন কে জানে! কোথায় ভাল মাছ দুধ পাওয়া যায়, চালের দাম কত কিংবা কোথাও যদি কিছু যজন যাজন করা যায় সেই আশায় বোধ হয় কেবল বাবা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দেশ ছেড়ে এসে বাবা খুব অথৈ জলে পড়ে গেছেন—কিছু একটা করা দরকার, বাবার মুখের দিকে আমরা আর তখন তাকাতে পারতাম না।

    প্ল্যাটফরমের পানি পাড়ে বলল, কোথায় গেছিলে ছেলেরা? বাবার খোঁজ মিলল।

    পিলু বলল, বাবা কি আমার নিখোঁজ হয়েছে?

    —শুনেছি তোমাদের ফেলে কোথায় চলে গেছে।

    আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল পানি পাঁড়ের কথায়। বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আমার বাবা কি তেমন মানুষ। আমাদের জন্য তাঁর কত দুর্ভাবনা। তবু কিছু বললে, কি আবার ভাববে, ওদের দয়াতেই এখানে পড়ে আছি। আবর্জনার মতো ঝেড়ে ফেললে যাবটা কোথায়!

    পিলু এবং আমি খুবই সন্তর্পণে হাঁটছি। জামার নিচে বাকি ক’টা শসা। ধরা পড়ে গেলেই হয়েছে। সবচেয়ে ভয় আমার নিজের মার্কেই। বলতে পারব না চুরি করে এনেছি। বরং বলা ভাল বড়বাবুর বউ দিয়েছে। কিন্তু মা তবে সকালেই জল আনতে গিয়ে বড়বাবুর বউকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারবে না। আমাদের এই দুঃসময়ে এতটুকু কেউ দয়া দেখালেই মা ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ে। সুতরাং বুদ্ধি- বিবেচনায় যখন মাথায় কিছুই আসছিল না, পিলু বলল, মাকে সত্যি কথা বললে কিছু বলবে না দেখিস। এবং মাকে সব খুলে বলতেই কেমন তাড়াতাড়ি শসা ক’টা লুকিয়ে ফেলল। ধমক খেতে হতে পারে, এমনকি, ঠ্যাঙাতেও পারে—আর কত সহজে মা আমার, শসা ক’টা লুকিয়ে ভাল মানুষের ঝি হয়ে গেল।

    আমি মায়ের যেহেতু খুব সুপুত্র, বললাম, পিলুর কি সাহস মা!

    ছোট বোন মায়া পাশে পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। পুনুটাও ঘুমে অচেতন। কেবল আমরা তিনজন প্ল্যাটফরমে জেগে। যেন যে কোনো সময় দেখব প্ল্যাটফরম পার হয়ে বাবা চলে আসছেন। মা শুধু বললো, ভগবান তো মানুষকে উপোষ রাখেন না।

    পিলু দিগ্বিজয়ী বীরের মতো বলল, মায়া ওঠ। দেখ কি এনেছি।

    মা বলল, না বাবা না। ডাকিস না। অনেক করে ঘুম পাড়িয়েছি, খাব খাব করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। থাকুক। সকালে তো হাতের কাছে কিছু নেই। নীল লণ্ঠন দুলিয়ে একটা লোক হেঁটে চলে গেল। মা এই লোকটাকে দেখলেই মাথায় বড় ঘোমটা টেনে দেয়। ছেঁড়া মাদুর কাঁথায় একটা সংসার লেপটে আছে। বড় করুণ দেখায় প্ল্যাটফরমটা। যাত্রীরা তাকায়, দেখে। নতুন এই সব উদ্বাস্তুতে সব স্টেশনগুলি ভরে যাচ্ছে। কোনো সময় অযথা গালিগালাজও করতে থাকে কেউ। আমাদের সব গা- সওয়া হয়ে গেছে। মনেই করতে পারছি না, আমাদের আবাস ছিল একটা। সেখানে শিউলি ফুলের গাছ ছিল। শরৎকালে আমরা ভাইবোনেরা মিলে ফুল তুলেছি। স্থলপদ্ম গাছ থেকে পদ্ম তুলে এনেছি। বাবা হাট থেকে তাজা আস্ত ইলিশ কিনে এনেছেন। বাড়িতে লক্ষ্মীপূজা হয়েছে। আমের দিনে আম, লিচুর দিনে লিচু পেট ভরে খেয়েছি। বড় মাঠ ছিল, কখনও পার হয়ে গেছি তা। পুজোর ছুটি পড়লে স্কুল থেকে ফেরার পথে নৌকা ডুবিয়েছি জলে—কিছুই আর মনে করতে পারছি না। যেন কতদিন থেকে এমন একটা প্ল্যাটফরমে পড়ে আছি। আমাদের বাড়িঘর ছিল এখন দেখলে কে আর এটা বিশ্বাস করবে। আর সেই কবে থেকে একটা ট্রেন আসে যায়, সূর্য ওঠে আকাশে, শরতের জ্যোৎস্নায় পৃথিবী ভেসে যায়, বাবা তবু আসেন না। বাবার মতো মানুষ আর নেমে আসেন না ট্রেন থেকে।

    ঘুম থেকে সকালে উঠেই অবাক। ট্রেন থেকে বাবা নামছেন। ইয়া বড় বড় পুঁটলি। ডেকেডুকে যেন গোটা প্ল্যাটফরমটাকেই কাঁপিয়ে তুলছেন। —নামা নামা। পিলু, ও বিলু, বাবা তাড়াতাড়ি আয়। ধর সব। দেখিস যেন কিছু থেকেটেকে না যায়। শ্রাদ্ধের কাজটাজ কিছু সেরে বাবা ফিরেছেন। আমরা টেনে টেনে নামাচ্ছি। মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছি। ছেঁড়া শীতলপাটিতে বসে বাবা তখন তালপাতার হাওয়া খাচ্ছেন।—তা দেরি হল একটু। বামুন মানুষ, হাতের কাছে কাজ, ফেলে আসি কি করে।

    আমার মা তখন শুধু চোখের জল ফেলছিল। কিছু বলছে না। সব গোছগাছ করে রাখছে। সকালের রোদ আমাদের খুব মনোরম লাগছিল। এমন সুন্দর দিন মানুষের জীবনে খুব কমই বুঝি আসে। পিলু তখন ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছিল। পুনু বাবাকে দেখেই কোলে গিয়ে বসে পড়েছে। মায়া বাবাকে হাওয়া করছে। টের পেলাম, আমার বাবার হাতেও একটা নীলবাতি আছে। বুঝতে পারলাম, সিগনাল ডাউন। আমাদের গাড়ি ছাড়ার আবার সময় হয়ে গেছে। কোথায় গিয়ে গাড়িটা শেষ পর্যন্ত থামবে জানতাম না। আমাদের ছিল তখন এখানে সেখানে ছুটে বেড়ানোর জীবন। একটা নীলবাতি নিয়ে বাবা তাঁর বাড়িঘর খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }