Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1047 Mins Read0

    অন্নভোগ – ২

    দুই

    দাদার সেই একটা বিষয়ে পাশ পিলুকে এখন কিঞ্চিৎ বিভ্রমে ফেলে দিয়েছে। তার চেয়েও বেশি বিভ্রমে ফেলে দিয়েছে, দাদা কোথায় যেতে পারে এমন কোনো নিশ্চিত ধারণা বাবার আছে—তা না হলে বাবা ধরে নিলেন কেন যাত্রা শুভ। সে নিজেও পঞ্জিকা দেখে থাকে আজকাল। ‘যাত্রা শুভ’ এই বাক্যটি কোন্ দিক নির্ণয় করছে—উত্তরে দক্ষিণে, না পুবে পশ্চিমে, অথবা নৈঋত কিংবা ঈশান কোণ—কারণ যাত্রা শুভ তো বড় একটা সব দিকে হয় না। তবে কী দাদা কোন দিকে গেছে বাবা মনে মনে ঠিক করে যাত্রা শুভ কথাটা বললেন!

    পিলু বলল, দাদা কোথায় গেছে তুমি জান!

    —কোথায় যাবে। কলকাতা ছাড়া আর কোথায় যাবে তোমার দাদা। কলকাতায় না গেলে তার নাকি কিচ্ছু হবে না। তোমার মাকে তো প্রায়ই বলত। গরীবের ঘোড়া রোগ। লেখাপড়ার পাট তুলে ইস্কুল আর আড্ডা। মুকুল বলে গেল একদিন, মর্নিং-এ বি কম ভর্তি হয়ে যাও বিলু। কলেজে নতুন কমার্স ক্লাস নাকি সরকার অনুমোদন করেছে। মাথা পাতল না। তোর মাও বলল। মিমি এসে বলে গেল, মাসিমা আপনি বলুন, যদি রাজি হয়।

    পিলু অবশ্য এতটা জানে না।

    তবে গরীবের ঘোড়া রোগটি কী সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। রাত জেগে এক গাদা পাণ্ডুলিপি দেখত। পড়ত। পছন্দ হলে রাখত। না হলে অমনোনীত লিখে এক পাশে ফেলে রাখত। অপরূপা’য় সব গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, এমন কী এদিকটায় নিজেই ডামি তৈরি করত। এস ডি ও সাহেবের সঙ্গে জিপে কোথাও পরীদি যাচ্ছে দেখতে পেলেই আরও ক্ষেপে যেত। তখন নিজেই রাত জাগত, কেন জাগত কে জানে—টেবিলে বসে এক একটা লাইন লিখত আবার কেটে দিত। কেমন ছটফট করত ভিতরে।

    আসলে দাদার এই ঘোড়া রোগ কে ধরিয়েছে।

    কে বলেছিল কাগজ বের করতে!

    দাদা কেন যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা লিখত তার খাতায়। মাথা মুণ্ডু সে কিছুই বুঝত না। অথচ দাদার বন্ধুরা তাকে বাহবা দিত। পরীদি নাকি বলত, বিলু আমাদের গর্ব। সব এক ব্যাচের কবি। এক ডালের পাখি। দাদার ছাপা কবিতা পড়ে মাথামুণ্ডু সে কিছুই বুঝত না—অথচ এই নিয়ে অযথা সবার গর্ব প্রকাশই দাদার মাথাটাকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। দাদার এই নির্বাসনের জন্য কেন জানি এ-মুহূর্তে শুধু বাবাই দায়ী ভাবতে পারল না। দাদার বন্ধুরাও কম দায়ী নয়।

    সেদিন তো সুধীনদারা এসে জোর করেই দুটো কবিতা দাদার খাতা থেকে টুকে নিয়ে গেল। কলকাতায় যাচ্ছে সুধীনদা। এক ফাঁকে বড় বড় কাগজের অফিসে ঢুঁ মেরে আসবে বলেছে।

    দাদা কিছুতেই রাজি না।

    —ধুস তোমরা যে কী কর না! ও-সব কবিতা মফঃস্বল পত্রিকায় চলে। আমার তেমন কবিতাই নেই। লিখতেই পারি না।

    মুকুলদা দাদাকে অভিযোগ করেছিল, বিলু তুমি শামুকের মতো গুটিয়ে থাক কেন বলতো। সুধীনদাকে দিতে আপত্তি কেন!

    —না আমার দেবার মতো কিছু নেই।

    —বললেই হল। বলে জোর করে দাদার কবিতার খাতাটা কেড়ে নিল।

    তার দাদাটা কেমন কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে বলেছিল, কী যে তোমরা পাগলামি শুরু করলে বুঝি না। বলছি নেই। কলকাতার কাগজে দেবার মতো কোনো লেখা নেই।

    নিখিলদা দাদাকে জোরজার করে ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে গেছিল।

    পিলু একটা দুটো কথা থেকে বুঝতে পেরেছিল আসলে এটা পরীদিরই কাজ। পরীদিই সুধীনদাকে কলকাতায় পাঠিয়েছে। ‘অপরূপা’ কাগজের জন্য কিছু বিজ্ঞাপন, কারণ যারা বিজ্ঞাপনদাতা, তাদের কেউ কেউ পরীদির সম্ভবত আত্মীয় হয়। চিঠি লিখে সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। শুধু একবার গিয়ে সই করে ব্লক আরও কী সব বোধহয় কোনো ছাড়পত্র—সে যাই হোক পিলু বুঝেছে দাদার এই স্বার্থপরতার জন্য তার বন্ধুরাও কম দায়ী নয়। পরীদি তো বটেই।

    দাদার শেষ বিষয়ে পাশটা কী তবে এই ঘোড়ায় চড়ে বসা! ভাবতেই পিলুর কবেকার সব দৃশ্য মাথায় পাক খেতে থাকে।

    বাবা পর পর প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন।

    —ফিরতে এত দেরি। কোথায় ছিলে।

    দাদা তবু রা করছে না।

    বাবা বললেন, আমরা সব দুশ্চিন্তায় ঘর বার করছি—তুমি ফিরছ না, চিন্তা হয় না। সেই কোন সকালে বের হয়ে গেছ। মানু কী বলল? রেজাল্ট আসেনি!

    —এসেছে।

    —তবে?

    —পাশ করতে পারিনি।

    বাবা কেমন সহজে গোটা ব্যাপারটা লঘু করে দিয়ে বলেছিলেন, তাতে কী রামায়ণ মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে। জীবনে সবাই পাশ করে।

    তারপর হেসে বাবা বলেছিলেন, কটা বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলে।

    শুধু এই একটি বাক্যেই পিলু যেন টের পেয়েছিল সেদিন বাবা তার কোন স্তরের মানুষ। পুত্রটির পরীক্ষাই তার কাছে বড়, কী পড়ছে না পড়ছে বাবার পক্ষে খোঁজখবর রাখাও সম্ভব না। টোলের পড়াশোনা একরকমের পুত্রটির পড়াশোনা আর একরকমের।

    দাদা বলেছিল, দশটা বিষয়।

    বাবা বলেছিলেন, কটাতে পাশ করেছ?

    দাদা কেঁদে ফেলেছিল বলতে গিয়ে, ন’টা বিষয়ে। আর বাবার তখন আশ্চর্য সরল হাসি। তার জন্য কান্না। জীবনে কে কবে সব বিষয়ে পাশ করে। যাও হাতমুখ ধুয়ে খেতে বস।

    এ-সব পুরানো স্মৃতি দাদা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় বার বার মনে পড়ছে।

    তখনই পিলুর মনে হল, বাবা তাকে কিছু বলছেন, অথচ সে শুনতে পাচ্ছে না।

    বাবা মাঝে মাঝে নিস্তেজ গলায় কথা বলে থাকেন জলে পড়ে গেলে সাঁতার না জানলে যা হয়ে থাকে—বাবার চোখে মুখে সহসা কেমন ত্রাস ফুটে উঠতে দেখেছিল সে।

    সে বাবার কাছে গিয়ে বলল, কিছু বলছ!

    —চিঠিটা কোথায়!

    —আমার কাছে।

    —ওটা দাও।

    দাও বললেই, দেওয়া যায় না। সে বলতেও পারে না, ওটা আমার কাছে থাক।

    হঠাৎ বাবার কাছে দাদার চিঠিটা এত জরুরী কেন, সে তো এ-বাবাকে চেনে না! বাবা কী নিজে যাবেন, চিঠি হাতে রায়বাহাদুরের কাছে যাবেন। তাঁর পুত্র বিশ্বর হয়ে ক্ষমা চেয়ে আসবেন।

    বাবা চিঠিটা পড়েছেন কী! তিনি যে স্বভাবের মানুষ, তাতে তাঁর মেজ পুত্রকে সম্বোধন করে লেখা চিঠি, নাও পড়তে পারেন। বয়স হলে পুত্র কন্যাদের নিজস্ব জগত তৈরি হয় গোপন এক মহাবিশ্ব, বাবা যদি ভেবে থাকেন, সেখানে প্রবেশ করা তাঁর বয়সে অনুচিত, তিনি চিঠিটা না পড়েও দিয়ে দিতে পারেন।

    তবে না পড়লে চিঠিটা দেবার পর এতক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারতেন না। নিশ্চয় কী লিখল জানতে চাইতেন। গোপন বিষয় ছাড়াও তো চিঠিতে কিছু লেখা থাকে—তার আশাতেই প্রশ্ন করতেন, কী লিখেছে তোমাকে। কিন্তু বাবা চিঠিটা তার হাতে দেবার পর একটাও প্রশ্ন করেন নি। দাদার চিঠি সম্পর্কে কিছু জানার আগ্রহ হবে না হয় না। তবু কী ভেবে পিলু বলল, তুমি পড়নি।

    —পড়ব না কেন! পড়েছি। আর একবার পড়ে দেখা দরকার। চিঠিটা কোথায় রাখলে!

    —আছে।

    পিলু জানে চিঠিটা বাবার কাছে ফেরত দিলে, ওটা আর সে নাও পেতে পারে। এমন কী চিঠিটা বাবা গোপনও করে ফেলতে পারেন। একজন অনুঢ়া যুবতীকে এর সঙ্গে জড়ানো হয়েছে। এটা বাবার মতো মানুষের পক্ষে কোনো অপযশের কারণ হতে পারে—কিংবা বড় পুত্রের পক্ষেও। তার জন্য রায়বাহাদুর নাতনিকে বিলাসপুরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এক ধরনের ঔদ্ধত্য প্রকাশ দাদার,এমন মনে করেও চিঠিটি তিনি গোপন করে ফেলতে পারেন। মুখে বলা, আর লিখিতভাবে থাকার মধ্যে যে আকাশপাতাল প্রভেদ এ মুহূর্তে পিলু তা টের পেয়েই বলল, দেখি—কোথায় যে রাখলাম!

    সে এবার তার ঘরে ঢুকে গেল। আসলে সে চিঠি খুঁজছে না। চিঠিটা তার পকেটেই আছে। দাদা কী নিয়ে গেল সঙ্গে! বোধহয় বাবা একবার নিজেই ঘরটায় ঢুকেছিলেন। মা, মায়া, এবং অন্য সবাই। সে দেখল, দাদার সুটকেসটা নেই। কিন্তু যদি কলকাতায় যায়—টাকা পয়সা কোথায় পাবে।

    মাইনে পেয়েতো দাদা সব টাকা মা’র হাতে তুলে দেয়। প্রথম মাইনে পাবার দিনটা তার মনে আছে। সকাল থেকেই সবাই খুব প্রসন্ন। দাদার প্রথম সরকারি উপার্জন। এর আগে দাদা দু-একটা টিউশন করে যা পেত, তাও তুলে দিত মা’র হাতে। দাদা স্কুল থেকে ফিরে আসছে না কেন, কারণ সেদিন কেন জানি মনে হয়েছিল, দাদার ফিরতে দেরি হচ্ছে।

    ঘুরে ফিরেই বার বার বাড়ি।—দাদা এল। আবার ঘুরে ফিরে বাড়ি—দাদা এল!

    বাবা বাড়ি ঢোকার মুখে জামগাছের নিচে দাদার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বলেছিলেন—আসেনি। আসবে। এতো আর পূজার দক্ষিণা নয়, ঝনাৎ করে দু-পয়সা, বেশি হলে এক টাকা, আঁচলের খুঁট থেকে খুলে দেওয়া। কোনো সই সাবুদ নেই। সরকারের টাকা তো আর আঁচলের খুঁটে বাঁধা থাকে না, যে হাত পাতলেই পাবে। দেরি হতেই পারে।

    বাবার কাছে এবং গোটা পরিবারের পক্ষে এই সরকারি উপার্জনের প্রথম দিনটি ফলে উৎসবের মতো ছিল।

    দাদা ফিরে এলে, মা মায়াকে বলেছিল, জলচৌকিটা এগিয়ে দে। বাবা বারান্দার এক কোণায় ফুল তোলা আসনে বসে তামাক টানছিলেন। চোখ তুলে—এবং এত প্রসন্ন যে পুত্রের ফিরে আসা সম্পর্কে আদৌ তাঁর আগ্রহ আছে বোঝা গেল না। পিলু জানে তার খুবই দুঃস্বভাব। সে বাবা-মাকে এক দণ্ড সুস্থির হয়ে বসতে দেয় না। সে বাবাকে যেন কিছুটা ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেবার মতো বলেছিল, দাদা এসেছে। দাদা এসেছে।

    বাবা চোখ খুলে বলেছিলেন, চেঁচাচ্ছ কেন! দাদাকে একটু বিশ্রাম করতে দাও। কতদূর থেকে এসেছে। দুপুরের রোদ মাথায় করে এসেছে। ঠাণ্ডা হতে দাও।

    দাদার প্রাইমারী স্কুল, দু ক্রোশ দূরে। বনজঙ্গলে বসতি গড়ে তোলা একজন মানুষের পক্ষে সেটা যে আদৌ কোনো দূরত্ব নয় পিলু জানে। সাইকেলে যেতে কী আর সময় লাগে! আসলে দাদা তার কত বড় চাকরি করে কত তার গুরুত্ব বোঝাতে চেয়েছিলেন। সরকারি চাকরি সোজা কথা! আশি টাকা মাইনে সোজা কথা! পাঁচ মণ চালের দাম সোজা কথা!

    পিলু জানে বাবার কাছে টাকার দাম মণ প্রতি চালের কত দর তার হিসাবে। বাবা সারা মাসে যজন-যাজনে পান বেশি হলে দশ বারো সের চাল। সিকি, দু-আনি দক্ষিণা পেলে বাবা হতবাক। দু এক পয়সাই বরাদ্দ বেশি। যাঁরা সিকি দু-আনি দেয় তাঁরা বাবার কাছে বড়ই মূল্যবান, দেব দ্বিজে ভক্তি তাঁরা আছেন বলে আছে।

    অবশ্য তার বাবাটি দক্ষিণা কিংবা ভোজ্য গ্রাহ্য করেন না। পূজ, পূজাই। এক পয়সাও পূজা, এক আনারও পূজা। কিছু না দিলেও তিনি পুজা বিধিমতোই শেষ করেন। সবাই সমান দিতে পারবে কেন। তবু যে ধর্ম রক্ষা করছে দু-এক পয়সা দিয়ে, সেটাই বাবার কাছে বড়। মা’র এক কথা, সারাদিন না খেয়ে শেষে এই দু-মুষ্টি ভিক্ষা নিয়ে এলে। কার মুখে দেব বল! ওদেরই বা বলি কী আক্কেল। সব কিছুর দাম বাড়ে, ঠাকুরের বেলায় সেই এক পয়সা, দু-পয়সা।

    বাবার তখন বোধহয় ভিতরে পীড়ন শুরু হয়। ঠাকুর দেবতা তুষ্ট থাকলে সংসারে সুখ বাড়বে সেই আশায় তিনি পৈতৃক পেশায় লেগে আছেন। এর মধ্যে তাঁর যে ঈশ্বর উপাসনার তাগিদও আছে বাবার চোখ মুখ দেখলে পিলু টের পেত। মা’র অভিযোগের উত্তরে শুধু বলতেন, আঃ কী যে বলছ ধনবৌ!

    তখনই সে শুনতে পেল, কী পেলে! কোথায় রেখেছ। এতক্ষণ লাগে খুঁজতে!

    সেও জবাব দিল, পাচ্ছি না তো।

    —এই তো তোমাকে দিলাম।

    —তা তো জানি।

    —তোমরা সবাই দেখছি আলগা স্বভাবের হয়ে যাচ্ছ। চিঠিটার গুরুত্ব বোঝো। অন্য কারো হাতে পড়লে কী হবে জান!

    —কী আবার হবে। পিলু ঘরে বসেই আছে। চিঠিটা পরীদিকে না দেখিয়ে, দেওয়া ঠিক হবে না।

    সে পরীদিকে খবরটা না দেওয়া পর্যন্ত সুস্থির হয়ে বসতেও পারছে না। সে বাবাকে কিছুটা অন্যমনস্ক করে দেবার জন্য বলল, দাদা যে গেল, টাকা পয়সা পেল কোথায়। যেখানেই যাক থাকবে কোথায়, খাবে কী!

    —তোমার দাদা তা জানে। তা ভালই বোঝে। ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

    -–ও তো মাইনে পেয়ে মা’র হাতেই এসে দিয়ে দেয়।

    —মাকে জিজ্ঞেস কর দিয়েছে কি না!

    অবশ্য সে জানে, মা’কে দাদা টাকা দিয়েছে কিনা, বাবা জানেন না হয় না। এ মাসের আজ তিন তারিখ। নিজের কাছে টাকা রাখার তো স্বভাব নয় দাদার।

    বাবাই বললেন, ভাগ্যিস তোমার মা বলেছিলেন, এখন রাখ, পরে নেব। হাতজোড়া দেখছ না! নিই কী করে! তোর মা পাটিসাপটা করবেন বলে চাল বাটছিলেন। ভুলে সেও দেয়নি, আর তোমার মায়েরও খেয়াল ছিল না। টাকাটা সে বোধহয় সঙ্গেই নিয়ে গেছে। এটাও বুঝবে, তাঁরই ইচ্ছে।

    —কী পেলে?

    ঘর থেকে পিলু কিছুতেই বের হচ্ছে না। এটা ফেলছে, ওটা টানছে। যেন বাবা টের পায় সে বসে নেই—খুঁজে দেখছে, ভুলে চিঠিটা কোথায় গুঁজে রেখেছে।

    —তোমাদের ঐ দোষ। চিঠিটা বাঁ-হাতে নিয়েছ। বাঁ-হাতে কোনো জিনিস কোথাও রাখলে মনে থাকে না। খুঁজে পাবে কী করে। কাণ্ডজ্ঞানের এত অভাব থাকলে চলে।

    আসলে পিলু এত ত্রাসের মধ্যে ছিল যে বাঁ-হাত না ডান-হাতে বাবার কাছ থেকে চিঠি নিয়েছে মনে করতে পারছে না। সাইকেলের হ্যাণ্ডেল ধরে ছিল—বাঁ-হাত হতেই পারে। তার ভুলও হয়নি। তবে তার হয়ে বাবাই যেন পথ বাতলে দিলেন। চিঠিটা না দিলেও চলবে—বাঁ-হাতে নিয়ে সে কোথায় রেখেছে কিছুতেই আজ আর মনে করতে পারবে না।

    তবে দাদা টাকা পয়সাও সঙ্গে নিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যতটা ত্রাসে পড়ে গেছিল, এখন আর ততটা ত্রাসের মধ্যে নেই। দাদা এবার না বলে কয়েও ফেরার হয়নি—টাকাপয়সাও সঙ্গে আছে— দুর্ভাবনা নেই। চিঠি রেখে গেছে। দাদা স্টেশনে গিয়ে বসে থাকতে বারণ করেছে।

    সে জামা প্যান্ট পাল্টে শহরে যাবে বলে সাইকেল বের করতে গেলেই বাবা বললেন, কোথায় যাচ্ছ? চিঠি খুঁজে পেলে না?

    —এসে খুঁজব। এবং বাবাকে আর বেশি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে বড় ঘর থেকে সাইকেল বের করে দ্রুত উধাও হবার সময় শুনল, বাবা ডাকছেন, কোথায় বের হলে!

    সে রাস্তায় পড়ে প্যাডেলে জোরে চাপ দেবার সময় হাত তুলে দিল—আসছি। সে দেখল না বাবা কতটা ক্ষুব্ধ। কিংবা তার যেন মনে হল, তাকালেই বাবা দৌড়ে এসে সাইকেলের ক্যারিয়ার টেনে ধরবেন। -কোথায় যাচ্ছ বলে যাবে না?

    দু’পাশে গাছপালা, নতুন বাড়িঘর, ছাগল গরু এবং রাস্তায় কুকুর বাঁচিয়ে মানুষকে বাঁচিয়ে পর্লকে ক্যাম্পের ভিতরে ঢুকে গেল। তারপর বড় সড়কে। প্রায় সে উড়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছে না পরীদির কথা চিঠিতে থাকায় কী এমন ত্রুটি হয়েছে। বাবা কেন ভাবছেন, এর মধ্যে একজন মেয়েকে জড়িয়ে দিয়ে বিশ্ব ঠিক কাজ করেনি।

    বাবার অসুবিধা সে বোঝে। তাঁর বড় যজমান নিবারণ দাস চিঠিটা দেখতে চাইতে পারে। কিংবা দেবীদারা খবর পেয়েই চলে আসবেন, অন্য প্রতিবেশীরাও। খবর ছড়িয়ে গেলে যা হয়। সকাল বেলাতেই বাড়িতে এক প্রস্থ হুলস্থূল গেছে। এবার ধীরে ধীরে আরও সব পরিচিত মানুষজন এসে দাদার খবর নেবে। বাবাই বলবেন, দাদা কলকাতায় গেছে। চিঠি রেখে গেছে। কেন যে এই মতিভ্রম ছেলের বুঝি না, তারপরই বাবা এখন যে নতুন আপ্তবাক্যটি বলে থাকেন, তাই হয়তো শেষে বলে মানসিক শান্তি পাবার চেষ্টা করবেন—কেহ আত্মাকে আশ্চর্যবৎ মনে করে, কেহ বা আশ্চর্যবৎ বলিয়া আত্মাকে বর্ণনা করে, আবার কেহ আশ্চর্য বলিয়া শোনে—কিন্তু ইহার বিষয় শুনেও কেহই ইহাকে বোঝে না।

    পিলু দাদাকে দেখে এটা হাড়ে হাড়ে টের পায়। সে কি দাদাকে ঠিক বোঝে না! কার উপর দাদার এত ক্ষোভ। চিঠি পড়ে বুঝেছে পরীদির উপর কোনো ক্ষোভ নেই, বাবার উপরেও না। দাদা সব দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে কেন যে ফেরার হয়ে গেল! দাদাকে এত দেখার পরও সত্যি সে তাকে বোঝে না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }