Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1047 Mins Read0

    অন্নভোগ – ৩

    তিন

    ভোর রাতে মিমির মনে হল বেশ শীত শীত করছে। শীত করার জন্য ঘুম ভেঙেছে, না কোনো শব্দে, সে ঠিক বুঝতে পারছে না। ইদানীং তার রাতে ঘুম ভাল হয় না। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায়— কেন যে দেখতে পায় সহসা কোনো দূরবর্তী পাহাড় শীর্ষে সে দাঁড়িয়ে আছে আর অদৃশ্য কোনো বেহালাবাদক সামনের মরুভূমি অতিক্রম করছে। মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে না, আশ্চর্য সুরের ধ্বনি কানে আসছে। অথবা সে স্বপ্ন দেখে, একজন পরিব্রাজক এইমাত্র তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। তার মুখে হিম ঠাণ্ডা বালির ঝাপ্‌টা এসে লাগছে। সে পথ চিনে যেতে পারছে না। যেদিকে দু-চোখ যায় শুধু মরু সদৃশ অঞ্চল। কোথাও গর্ত থেকে মুখ বার করে রেখেছে মরু শৃগাল। সে যেন হেঁটে যাচ্ছে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে। ঝড় ঝাপটায় তার বসন ভূষণ আলগা হয়ে যাচ্ছে। সে বোঝে প্রকৃতি ক্রমেই তার শরীরের উপর থাবা বসাতে চায়। সে তখন মুখ দু-হাতে ঢেকে চিৎকার করে ওঠে।

    বিলু তাকে চড় মারার পর থেকেই কিছুটা যেন অনিদ্রার সে শিকার হয়েছে।

    এতদিন সে বিলুকে একরকমভাবে চিনেছিল—চড় মারার পর অন্যরকম ভাবে। সে কেন যে খেলাটা খেলতে গেল! সে তো বছর দুই তিন হয়ে গেল বিলুর সঙ্গে মিশছে। বোধহয় তার দিক থেকেই প্রবল আকর্ষণ ছিল। বিলু তো সব সময় তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। বিলু কী তার অধিকারের কথা বুঝিয়ে দিয়ে গেল! সে আর কোনো হালকা চালে বিশ্বাসী নয়। বিলুর চোখে কী যেন আছে—না হলে তার এই মরণ কেন। সে কী করবে না করবে, সেটা তার মাথা ব্যথা। অথচ কেন যে বলা, না তোমাকে এটা সাজে না, ওটা কর না, কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল এ-সব বলার জন্য! পরেশবাবুকে ডেকে না আনলেই পারত। সে শুনেছে—বিলুর রেলে চাকরি হচ্ছে। অথচ বিলু নিজে বলেনি-এমন কী দাদু পর্যন্ত গোপন করে গেছিলেন। কেন যে মাথায় আগুন ধরে গেছিল, দ্যাখ তবে। সে জানে পরেশবাবুর সঙ্গে আবার হেসে খেলে আড্ডা দিলে, তার গাড়িতে ঘুরতে বের হলে দাদুর মাথার ক্যাড়া নেমে যাবে।

    মিমি উঠে বসল।

    তার হাই উঠছে। সে আলো জ্বালাল। বাথরুম পেয়েছে। বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে জলও দিল।

    তারপর আর শুতে ইচ্ছা করল না। দরজা খুলে দোতলার বারান্দায় এসে সোফায় গা এলিয়ে দিল। ঝাড় লণ্ঠনের নিচে সে অন্ধকারে বসে আছে। কাল পার্টির সেমিনার আছে লালগোলাতে। তার যাওয়া দরকার। কিন্তু বাড়িতে যে-ভাবে অশান্তি শুরু হয়েছে তাতে যাওয়া কঠিন। দাদু তাঁর ঘর থেকেই বার হচ্ছেন না। মেশোমশাইকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন না কি। সে পার্টি অফিস থেকে রাতে ফিরে ঠাকুর চাকরের মুখে খবরটা পেয়েছিল।

    দাদু নাকি কান্নাকাটি পর্যন্ত করেছে।

    সে বোঝে দাদুর দুঃখটা কোথায়। তিনি শহরের প্রভাবশালী মানুষ। সারাদিন সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ভিড়। দিন রাত লোকজনের অপেক্ষা। গাড়ি শহরে বের হলে লোকজন সম্ভ্রমে সরে দাঁড়ায়। তাঁর পক্ষে বাড়ি বয়ে এত বড় অপমান সহ্য করা কঠিন। আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা সাম্রাজ্যবাদী এবং বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থাই এ জন্য দায়ী সে এটা বোঝে। এও বোঝে বিলু বোকার মতো কাজটা করে ফেলেছে। সে নিজেকেও এর জন্য কম দায়ী মনে করে না। তবু কোথায় যেন এক আশ্চর্য নাড়ীর টান থেকে গেছে এই প্রাসাদের ইট কাঠে। সে ইচ্ছে করলে পার্টি করতে পারে—জনসভায় বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দিতে পারে, এমন কী পার্টির তরফ থেকে পথ-নাটিকায়ও অংশ নিতে পারে— তবু বের হয়ে কোনো উদ্বাস্তু যুবকের সঙ্গে সে হাত ধরে হেঁটে যেতে পারে না। অদৃশ্য নিষেধ বুঝি আঁকা ছবির মতো ফুটে ওঠে দেয়ালে।

    আসলে সে ভাল নেই।

    বাবাকে বিলাসপুরে ট্রাঙ্ককল করা হয়েছিল। দাদু কী বলেছেন, সে জানে না। মেসোমশাইকে কী অভিযোগ করেছেন তাও সে জানে না। বাবা মা ভাই বোনেরা চলে এসেছে।

    কেন যে কালীবাড়িতে নতুন মাস্টারকে দেখতে গিয়ে এই ফ্যাসাদ। দেখা না হলে, কিংবা লক্ষ্মী যদি তাদের নতুন মাস্টারের ভীতু স্বভাবের কথা না বলত, তবে কে বিলু, কে পিলু কিংবা ‘অপরূপা’ কাগজ নিয়ে তার মাথাব্যথা থাকত না। বিলুর মধ্যে কবিতার গুণ—এ-সব কত কিছু ছাইপাঁশ তার যে মনে আসছে—সে এ-সব ভেবেই আজকাল বিষণ্ণ হয়ে যায়। তার কিছু ভাল লাগে না।

    দাদু তার স্বাধীনতায় কখনও হস্তক্ষেপ করেন না। সে যে-ভাবে বাঁচতে চায়, বাঁচতে পারে— এত দিন এমনই মনে হত। কিন্তু দাদুর অসুস্থতা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ ছাড়া বিলুকে এ-ভাবে আগুনের মধ্যে সেই যেন ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে। বিলুর রেলের চাকরি এক দণ্ডে বানচাল করে দিল। মাত্র ক’দিনের ছলনাতেই দাদু কাবু হয়ে গেছিলেন। সে বুঝেছিল, দাদু তাকে বিশ্বাস করেছে। সেজেগুজে পরেশচন্দ্রের সঙ্গে বের হয়ে সে যে অভিনয় করেছিল, দাদু বিশ্বাসই করতে পারতেন না। বিলুও বিশ্বাস করতে পারল না, তার চাকরিটা ভণ্ডুল করে দিতে হলে এ-ছাড়া তার অন্য উপায়ও ছিল না।

    বিলুকে দেশ ছাড়া করায় দাদুর এই চক্রান্ত মাথা পেতে নিতে পারেনি। একজন তার অভিনয়ে ঠকেছে।

    অন্যজন তাকে বিশ্বাস করে ঠকেছে। ভেবেছে, আসলে সে পরেশের। তার মতো গরীব বাবার পুত্রের পক্ষে দুর্লভ।

    বাড়ির সামনে বাগান। বাহারি সব বিদেশী ফুলের গাছ—সাদা কাকাতুয়া দাঁড়ে টাঙানো। ছবির মতো সব কিছু। সকাল হবার মুখে। আকাশ পরিষ্কার। কিছু নক্ষত্র চোখে পড়ছে। বাগানের এক কোণায় বড় একটা শেফালি গাছ—নিচে সাদা ফুল সারা রাত ধরে ঝরেছে।

    শরতের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। কী আকাশে, কী লতাপাতায় কিংবা গাছপালার মধ্যে। এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও ঋতুটির বোধহয় বৈরাগ্য আছে যে জন্য মিমি বিশাল কাঠের কারুকাজ করা চামড়ার নরম গদিতে মাথা এলিয়ে দিতে পেরেছে। দাদু তাকে ডেকেছিলেন, পিসি ছোটকাকা ছিলেন পাশে। ন’ কাকীমা, ছোট কাকীমাও তাকে বুঝিয়েছেন। মাথা গরম করিস না মিমি। বাবা তোর কাছে কথা চাইছে। তুই কথা দে।

    তার বাবা মা ঘৃণায় তার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেননি।

    মিমি জানে কথা দিলেই, দাদু এ-যাত্রায় হয়তো ভাল হয়ে উঠবেন। এ বয়সে কতটা মানসিক উদ্বেগ থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন সে বোঝে। যেন বিলু বাড়ির ঐতিহ্যের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।

    সে ন’ কাকীমাকে বলেছিল, কেন যে তোমাদের ছেলেমানুষী বুঝি না! এখনই কী বিয়ে করব। পড়াশোনা শেষ করতে দাও।

    —পড়াশোনার বন্ধের কথা উঠছে কেন বুঝি না। অবুঝ হবে না। দেখছ তো বাড়িটার কী হাল হয়েছে!

    দাদুর যদি কিছু হয়!

    কিছু হলে সবাই তাকে দায়ী করবে।

    এই শরীর এত মহার্ঘ—তার রূপ আছে এবং সে জানে হেঁটে গেলে, সব মানুষ যেন চঞ্চল হয়ে পড়ে। সে তার লাল রঙের সাইকেলে চক্কর মারার সময়ও টের পায়—মানুষজন তাকে দেখছে। শহরের সর্বত্র তার অবাধ যাতায়াত। রোজ একবার সকালে কিংবা বিকেলে সে পার্টি অফিসে গিয়ে বসবেই—নানা বর্ণের পোস্টার সে লিখতে ভালবাসে। ছবি আঁকতে ভালবাসে। মানুষের শক্ত হাত মুষ্টিবদ্ধ উপরে তোলা—সে যা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে এই সব ছবিতে তা সে ধরে রাখতে চায়।

    অথচ বিলুটা কী যে ছেলেমানুষী করে বসল। সে জানে বিলুর আর কিছুদিন পাত্তা পাওয়া যাবে না। চোরের মতো তাকে এড়িয়ে চলবে। দেখা হয়ে গেলে কথাও বলবে না। তাকেই গিয়ে বলতে হবে, কই এ সংখ্যায় তোমার কবিতা নেই কেন। কিংবা বিলুকে স্বাভাবিক করে তোলার দায়ও তার।

    অথচ পরেশচন্দ্র তাকে ছাড়বে না। হবু কবি তিনিও একজন। সে জানে কবিতা লেখার এই অপচেষ্টা সে কাগজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলেই। পরেশচন্দ্র যেন তার দাসানুদাস। সে কেন যে তাকে ঠিক একজন পুরুষের মতো ভাবতে পারে না। বিলুর তেজ কিংবা অহঙ্কারের ছিটেফোঁটা তার মধ্যে নেই। ইস যদি সামান্য বিলুর স্বভাব পেত তবে তার পক্ষে কথা দেওয়া বোধহয় কষ্ট হত না। কিছুটা বেলেল্লাপনাই মনে হয় অথবা একটা অভুক্ত কুকুরের মতো তার পেছনে লেগে আছে। ভাবলেই কেন যে ওক উঠে আসে।

    সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানেরা একটু বেশি বোধহয় গো-বেচারা হয়ে থাকে। পরেশচন্দ্রের যো হুকুমের তালিকায় নাম উঠে যেতেই সে তার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করে না।

    সে যে কী করে!

    সাময়িক দুর্বলতা হতে পারে—তবে এ-মুহূর্তে তার কাছে এটাই বড় সত্য। বিলু যা স্বভাবের তাকে নিয়ে কতদূর যাওয়া যাবে সে এখনও ঠিক জানে না। আজ আবার তাকে ডাকা হবে সে জানে। আজ বোধ হয়, বাবাও থাকবেন। সে তার বাবাকে সমীহ করে। বাবাকে এড়িয়ে চলারও স্বভাব গড়ে উঠেছে সেই শৈশব থেকে। বাড়িতে তার কাকা কাকীমারাই বেশি আপন। মাকে সে নিজের কেউ ভাবতেই পারে না। দেখলেও মনে হবে না মা-মেয়েতে কোনো সম্পর্ক আছে।

    এটা কী কোনো প্রতিক্রিয়া কিংবা অভিমান থেকে! তার পিঠাপিঠি ভাই বোনেরা যেন মা-বাবার কাছ থেকে তাকে অবাঞ্ছিত করে রেখেছে। শৈশবের কোনো অদৃশ্য অনাগ্রহ তাকে এ-ভাবে কী শেষে বাইরে টেনে নিয়ে গেল! এ-সব কী কোনো ক্ষোভ থেকে। কিংবা সে এ-পরিবারে দাদু ছাড়া আর কাউকে কী সে ভাবে ভালবাসে না!

    সে তার মধ্যে এতদিন ধরে আশ্চর্য এক তাজা প্রাণের সাড়া পেত। সে এক দণ্ড তার ঘরে বসে থাকতে পারত না। সে গড়ে উঠছিল নিজের মতো। ঝড় উঠে গেল কবে সে নিজেও যেন জানে না।

    সে তো রওনা হয়েছিল অনুকূল বাতাসে। এমন দুর্বিপাকে তাকে পড়ে যেতে হবে কে জানত।

    বাবার হুকুম হয়ে গেছে, বাড়ির বার হবে না।

    হুকুম, মিটিং মিছিল বন্ধ।

    হুকুম, পরিবারের মান সম্মান নষ্ট করার কোনো অধিকার তোমার নেই।

    হুকুম, যদি মনে কর পরিবারের চেয়ে তোমার ইচ্ছের দাম বেশি তবে সম্পর্ক ত্যাগ করতে পার। আমরা কিছু বলব না।

    তখনই এত কেন বুকে হাহাকার বাজে।

    জন্ম জন্মান্তরের এক অনড় প্রস্তরের নিচে তাকে যেন পিষে ফেলার ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

    সে আগের মতো আর কী নেই। তার মধ্যেও কেমন এক অর্থহীন জীবন বেঁচে থাকা গড্ডালিকা প্রবাহ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। সুধীনদা ফোন করলে বলেছে, যা ভাল বোঝো কর।

    সুধীনদার প্রশ্ন, তোর শরীর ভাল নেই।

    —কেন বলত!

    —কেমন ধরা গলায় কথা বলছিস!

    সে কী কথা বললেই ধরা পড়ে যায়। সবাই কী তবে রহস্য টের পেয়ে গেছে। বিলু যে বাড়ি বয়ে এসে তাকে অপমান করে গেছে, সবাই কী জেনে গেছে! জানতেই পারে। পিলুর যা স্বভাব, সে তো বিলুর বন্ধুদের বাড়ি চেনে। সে বলতেও পারে সব। তবে তাকে কেউ বিলু সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করেনি। বিলুর সঙ্গে কী হয়েছে জানতে চায়নি।

    সে কেন যে হু হু করে কেঁদে ফেলল। আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছে। সকালের রদ্দুর বারান্দায়, কেউ দেখলে ভাবতেই পারে মিমি আঁচলে মুখ আড়াল করে ঘুমিয়ে আছে হয়তো। তখনই যেন কে বারান্দায় ঢুকে বলল, তোমার চা মিমিদি।

    মিমি সে অবস্থাতেই বলল, রেখে যাও।

    সে জানে মোহনদা চা রেখে চলে যাবে। এদিকের বারান্দাটা তার একান্ত নিজস্ব। তার ঘরের লাগোয়া। তার ঘরের দরজা দিয়েই এই বিশাল বারান্দায় ঢুকতে হয়। ঘরটা সে নিজের পছন্দমতো বেছে নিয়েছে। ঠিক অন্দরেও না, আবার সদরেও না। নিচের তলাটা একটা পুরো হলঘর। হলঘর পার হয়ে দাদুর বিশাল বসার ঘর। হলঘরে মাঝে মাঝে দাদুর সঙ্গে জেলার কংগ্রেস নেতাদের বৈঠক হয়। তখন সারা রাত্রি বাড়িটা গম গম করে। এঁরা সব মফঃস্বল শহর থেকে আসেন। কাঁদি, জিয়াগঞ্জ, জঙ্গিপুর, এমন কী আরও দূরবর্তী গ্রাম দেশ থেকেও। জেলা কমিটি গঠন নিয়ে, নির্বাচন নিয়ে কথা হয়। দাদুর পরামর্শমতো কোন অঞ্চল থেকে কে প্রার্থী হবে ঠিক করা হয়। যদিও কংগ্রেসের আলাদা অফিস আছে। হাজারদি ব্যাঙ্কের পুরো দোতলাটাই অফিস। নিজস্ব মুখপত্র আছে। তাতে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচীর সঙ্গে জেলার মানুষের অন্নকষ্টের কথাও থাকে।

    আর তার ঘরে সামান্য একটা তক্তপোষ ছাড়া তেমন কিছু নেই। টেবিল চেয়ার আছে—র‍্যাক আছে। কিছু বই, কলেজের এবং মার্ক্স-এর উপর। লেনিনের ছবি ছাড়া ঘরে কোনো ছবিও টাঙানো নেই। দাদু বলতেন, সন্ন্যাসিনী দেখছি দিন দিন আরও বেশি গোঁড়া হয়ে উঠছেন। ঘরে আর সামান্য আসবাবপত্র রাখলে লেনিন সাহেব নিশ্চয়ই রাগ করবেন না।

    মিমি বলত, ঘরে একদম জঞ্জাল বাড়াবে না। বেশ আছে। তোমার ঘরে ঢুকে তো বলি না, এটা নেই কেন, ওটা নেই কেন। আমার চলে যায়।

    দাদু প্রথম দিকে খুব রগড় করতেন—লেনিন সাহেবের যাদুটা কী বলত! তোমার মতো চৌকস রামণীকে হাত করে ফেলল। সারা জীবন এত পিছু পিছু ঘুরলাম, এ বুড়োটার ছবি দুরে থাক, তার কথাও দিনে একবার মনে হয় না তোমার!

    তার টাঙানো ফটো নিয়ে দাদুর পরিহাসে সে যোগ দিতে পারত না। কেবল বলত, ঠিক আছে যাও। আমার কাজ আছে। সে তার পাঠ্য বইয়ে নিমগ্ন হবার ভান করত। নোট নিত কাগজে। সে মেধাবী ছাত্রী, দাদুর এই এক অহঙ্কার আছে। রেজাল্ট বের হলে, দাদু হাঁ হয়ে যায়। এক কথা দাদুর- সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াস পড়িস কখন! দারুণ রেজাল্ট দেখছি। কী যে বালকের মতো খুশিতে একে ওকে ফোন করা শুরু হয়ে যায় তখন।

    সে আয়নায় দেখেছে ক’দিনেই চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।

    সে অবাক হয়ে ভাবে এত বড় অপমানই বা সে হজম করে গেল কী করে। বিলুর কী এ-ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না ক্ষোভ প্রকাশের। বাড়াবাড়ি করে ফেলল। তাহলে তুমি এই! ঠোটের কোণে সামান্য হাসি ঝলসে উঠল মিমির।

    সে ভাবল—না, মোকাবেলা যখন করতেই হবে, তখন তাকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। সে চা খেয়ে ডাকল, মোহনদা, আমার চানের জল দিতে বল।

    তার নিজস্ব বাথরুমে এখনও জলের বন্দোবস্ত হয়নি। তার যাতে অসুবিধা না হয়, ইদানীং বাথরুমটা তার জন্য করা হয়েছে। তবে জলের লাইন এখনও আসেনি। ড্রামে জল ভর্তি থাকে। কুমুদ তার নিজস্ব কাজের মেয়ে। তবে কাচাকাচির কাজ সে নিজেই করে থাকে। নিচ থেকে জল টানতে কষ্ট হয় বলে কুমুদ জল টেনে দেয়। তার এটা খারাপ লাগে। অন্দরের বাথরুম এত দূরে যে সেখান থেকে জল টেনে আনার চেয়ে নিচ থেকে জল টেনে আনা ঢের সুবিধা।

    কুমুদকে এ-কাজটা করতে হচ্ছে তার অমতে। কোনো কারণে হাত পা খোঁড়া হলে, জল টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যেতেই পারে—দাদুর গোয়ার্তুমি—তুমি দিদি আমার কথা শুনছ না, এবং দাদু বোধহয় যতটা দ্রুত সম্ভব করে দেবেন বলেই—কটা দিনের জন্য কুমুদ জল তুলে দিক এমন সম্মতি নিয়েছিল তাঁর কাছ থেকে।

    দাদুর এক কথা, তোর এত জেদ কেন বলত দিদি। তুই কী আমাদের বৈভব সহ্য করতে পারিস না।

    মিমি বলত, পচে গেছে সব। এ-ভাবে হয় না। বাড়ির ভিতরটা ছিমছাম, টবে গোলাপ গাছ,— আর রাস্তায় বের হলে মরা কুকুর বেড়ালের পচা গন্ধ— কাঁচা ড্রেনের গন্ধ খারাপ লাগে না দাদু তোমাদের!

    —এ-জন্য কে দায়ী। আমি!

    —এই সমাজ ব্যবস্থা

    দাদু কিঞ্চিত রূঢ় গলায় বলতেন, কোনো সমাজ ব্যবস্থাই আমাদের সহ্য হবে না। নিজেরা যতদিন না ঠিক হচ্ছি। আমরা কাজ করি না, কাজ করলে তার পেছনে লাগি। এমন আত্মকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা হাজার বছরের পরাধীনতার জের।

    বড় বড় কথা বলে দাদুকে ক্ষেপিয়ে দিতে সে ভারি মজা পায়। পরে দাদু গট গট করে নেমে গেলে সে জানালার পাশে এসে ফিক করে হেসে ফেলে। বুড়ো সারাদিন সবার সঙ্গে মেজাজ নিয়ে কথা বলবে। দু-দিন হয়তো তার সঙ্গে কথাই বলবে না। স্রোতের বিরুদ্ধে সে গা ভাসিয়ে দিয়েছে বলে দাদুর কম অনুতাপ না-আবার মনে হয়, রক্তের তেজ মরে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দাদু হাসতে হাসতে বলবেন, এই যে গোমড়ামুখী, দ্যাখ কী সাজে সেজেছি।

    দাদু তার বড় পরিপাটি স্বভাবের। সিল্ক না হয় মটকার পাঞ্জাবি, পাজামা পাটভাঙ্গা এবং কাঁধে চাদর—চিরদিন এই পোষাকেই দেখে এসেছে। মিহি খদ্দরের ধুতিও পরেন মাঝে মাঝে। জেলার কুটির শিল্পের সমজদার কত তিনি, পোষাকেই বুঝিয়ে দেন। কালীবাড়ির বাবাঠাকুর তাঁর জীবন্ত বিগ্রহ। দেয়াল জোড়া অয়েল পেন্টিং, বিলু বাবাঠাকুরের কাছে একসময় মানুষ—এ-জন্য বিলুর অবাধ যাতায়াতে কোনো অসুবিধা হয়নি—তবে তার সঙ্গে বিলুর সম্পর্ক টের পেয়ে দাদুর চক্রান্তের কথা মনে হলে মাথা গরম হয়ে যায়। দাদুর উপর ঘৃণায় মুখ কুঁচকে যায়।

    দাদু তুমি এত ছোট কাজ করতে পারলে!

    বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে বিলুকে রেলে চাকরি দেবে বলেছ। তাকে দরখাস্ত করতে বলেছ। সার্টিফিকেটের নকল এটেস্ট করে দেবে বলে তাকে ঘুরিয়েছ। জানি চাকরিটা তার হতই—কিন্তু পরিণামের কথা ভাবলে না। সাদাসিধে ছেলেটাকে চাকরি দিয়ে বিদেয় করতে চেয়েছিলে। সে তোমাদের পরিবারে এত অবাঞ্ছিত। তোমরা মনে কর আমি কিছু বুঝি না। এবং এইসব চিন্তাভাবনাই তাকে কেন যে মাঝে মাঝে পরিবারের প্রতি তিক্ত করে তুলছে।

    কুমুদ এসে বলল, মিমিদি, ভিতরে যান।

    তার বুক ধড়াস করে উঠল। পরিবারের সবাই এক দিকে। কেউ তার পক্ষ নিয়ে কথা বলবে না। সবাই ভাবছে মাথা খারাপ। বিলুর সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেই হল! কিন্তু তাই বলে বিয়েতে মত দিতে হবে—তার বিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সবার কাছে। তাও পরেশচন্দ্র—মিমির শরীর কেমন শক্ত হয়ে গেল। সে ঝড়ের বেগে ঢুকে কী বলতে গিয়ে দেখল সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে- তাকে কী স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। তার পোষাক কী অবিন্যস্ত। সে নিজেকে দেখে চোখ ফেরাতেই অবাক— দাদুর ঘরে কাকে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে!

    প্রায় হেঁচড়ে টেনে আনা হচ্ছে।

    সে ছাড়া পেতে চাইছে। কেবল বলছে, আমি কী করেছি! আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কেন! ইস লাগছে! তারপরই সে চিৎকার করে উঠেছিল, মিমিদি, দেখ আমাকে কী করছে! আমাকে নাকি বেঁধে রাখা হবে। আমি ঢুকেছি কেন। না বলে কয়ে ঢুকে পড়েছি কেন!

    মিমির চোখে আগুন জ্বলছে। সেদিনও বিলুর খবর নিতে এসে পিলু ভারি বিপদে পড়ে গেছিল। দাদা ফেরেনি, সকালে তার দাদুর সঙ্গে দেখা করে ফিরে যাবার কথা। ফেরেনি। মা বাবা চিন্তা করছে। সে কতদূর থেকে হেঁটে এসেছিল। আসতেই কুমুদ, মন্মথ, মোহনদারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পরী ধীরে ধীরে নেমে গিয়ে বলেছিল, ছেড়ে দাও। ছাড় বলছি। সব চাকর বাকরেরা সোজা হয়ে গেছিল। সে পিলুকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে। সরবত, মিষ্টি সাজিয়ে দিয়ে বলেছে, খা। তোর দাদা ফিরবে। ভাবিস না। পিলুটা কী মানুষ না, সেদিন এ-ভাবে জব্দ হবার পর আবার এসেছে! এরা তো তার দাদাকে নাগাল না পেয়ে ভাইটির উপর শোধ নিতে চাইছে। বাবার হুকুম জারি, আমার মেয়ের গায়ে হাত! আমি কখনও ক্ষমা করব! কুকুর দিয়ে খাওয়াব। চাবকাব। বাবা কেমন উন্মাদের মতো চিৎকার করছিলেন। বড়বাবুর হুকুম তালিম করতেই এ-কাজ। কিন্তু পিলুর আসার এত কী জরুরী হয়ে পড়ল!

    সে ছুটে গেল!

    পিলুকে ছিনিয়ে নিয়ে আড়াল করে দাঁড়াল।

    —একদম গায়ে হাত দেবে না।

    পরিবারের সবাই থ। পরীর এই রুদ্রমূর্তি তারা যেন জীবনেও দেখেনি। দাদুর কাতর কথাবার্তা, কাকাদের কাতর অনুনয় কিছুই মিমির কানে যাচ্ছে না। সে ফুঁসছে। হঠাৎ সে উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠল, রামবিলাস, রামবিলাস। তারপর নিজেই ঝড়ের বেগে করিডোর ধরে ছুটতে থাকলে, পিলু এক দণ্ড দেরি করল না। পরীদির পিছু পিছু সেও পালাতে গেলে মিমি কেমন হুঁস ফিরে পেল। সরল এক বালকের প্রভাবে পড়ে গেল। সে এটা কী করতে যাচ্ছিল! পিলুই যেন সম্বিত ফিরিয়ে এনেছে। -পরীদি এত ছুটছে কেন। পড়ে যাবে। পিলু জানে না, সে আজ এসপার ওসপার করতে চেয়েছিল। পিলুর জন্য পারল না।

    পিলু দেখছে, মিমিদি হঠাৎ সিঁড়ির মুখে ধপাস করে বসে পড়ল। মিমিদি হাঁপাচ্ছে। সে পেছনে তাকিয়ে দেখল, বাড়ির লোকজন কিছুটা ছুটে এসে থেমে গেছে। এমন কী রায়বাহাদুর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। মনেই হচ্ছে না তিনি অসুস্থ।

    সে ডাকল, এই পরীদি। ছুটছিলে কেন! কী হয়েছে। আমি চলে যাচ্ছি।

    কারণ পিলুকে নিয়েই বাড়িতে বড় রকমের তাণ্ডব ঘটতে যাচ্ছিল। পরীদি যে-ভাবে ছুটে যাচ্ছিল, তাতে কিছু একটা করে বসাও বিচিত্র নয়। তাকে হেনস্থা করতে দেখেই পরীদি আগুন হয়ে জ্বলছিল। আগুন নিভে গেলে যেমন চারপাশে ছাই পড়ে থাকে— কিংবা বিধ্বস্ত কোনো দৃশ্য—এ মুহূর্তে যেন বাড়িটার সেই চেহারা হয়েছে।

    হঠাৎ পরীদি উঠে তার দিকে ছুটে এল। তারপর চুলের মুঠি ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাতে থাকল, তুই এলি কেন মরতে। তোরা আমাকে আর কত অপমান করবি। বল, বল কেন এলি! লজ্জা হয় না, কীরে কথা বলছিস না কেন, লজ্জা হয় না, আবার যে এলি! তোকে সেদিন তাড়া করল, তবু তবু কেন এলি! কেন এলি। বলেই পিলুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

    মানুষের কী যে থাকে। পিলুর সঙ্গে যেন পরীর জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক। নিজের ভাই বোনদের প্রতি তার কোনো টান নেই। তারা ছুটি-ছাটায় এলে দিদিকে এড়িয়ে চলে। পিলু যে কখন সেই মায়া- মমতার জায়গা বেদখল করে ফেলেছে পরী বোধহয় নিজেও জানত না। অথবা আজন্ম এই বৈভবের মধ্যে বাস করে, মানুষের অসহায় জীবন তাকে তাড়া করে থাকতে পারে। পিলু, বিলুর এক কালের প্রচণ্ড দারিদ্র্য হয়তো পরীকে টেনেছে।

    সে যাই হোক, পিলু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, আমার কী দোষ! দাদা আবার কোথায় চলে গেছে। তোমাকে কী সব লিখে গেছে।

    পরীদি যেন আর কাউকে পরোয়া করে না। সারা বাড়ির প্রতি কেমন ঘৃণায় মুখ চোখ শক্ত করে রেখেছে। পরীদি ইচ্ছে করলে যে সব করতে পারে তাও তার কেন জানি বিশ্বাস করতে কষ্ট হল না। তার দিকে অপলক তাকিয়ে বলছে, তোর দাদা কোথায় গেছে! বলে যায়নি।

    —না। বলে গেলে ছুটে আসব কেন। এই দেখ না চিঠি।

    পরীদি কাছে থাকলে সে আর কাউকে ডরায় না। অথচ আগে মনে আছে সে বাবার চাষ করা আনাজ শহরের বাজারে বেচতে এলে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকত। কী বিশাল বড় বড় থামওলা বাড়ি। কত বড় উঠোন। দোতলার জানালায় কাঠের কারুকাজ করা ঝালর। সব চেয়ে তার অবাক লাগত বাড়িটার শেষ মহলের পাশে কি বিশাল ফুল ফলের বাগিচা। একটা বিশাল সাদা পাখি দাঁড়ে ঝাপটাচ্ছে। সাদা রঙের পাখিটাকে সে কতদিন অবাক হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখত। পরীদির মতো সুন্দর মেয়েটা এ-বাড়ির সে চিন্তাই করতে পারত না।

    পরীদির মুখ কালো হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বলল, আয় ভাই। কিছু মনে করিস না। আমার মাথা ঠিক নেই। তোর পরীদি মরে গেলে তোর কষ্ট হত ভেবেই, আর কিছু করতে সাহস পেলাম না। আসলে সে যে নিচের মহলে যাচ্ছিল, দাদুর চাবুকটা এনে সবাইকে এলোপাথাড়ি চাবকাতে চেয়েছিল— সব ভুলে গেছে। তার মধ্যে কী করে যে সহসা আত্মহননের ইচ্ছে জেগেছিল কেন এমন হয়, চাবুক আনতে যাচ্ছিল, না সিঁড়ি ধরে ছাদে উঠে যেতে চেয়েছিল—কিছুই মনে করতে পারছে না।

    কে কী বলছে, কী দেখছে তার প্রতি পরীদির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেমন কিছুটা জড়তায় ভুগছে পরীদি। পিলু চিঠিটা বের করতে গেলে বলল, আমার ঘরে চল। পরিবারের সবাই দেখছে মিমি পিলুকে নিয়ে তার ঘরে ঢুকে যাচ্ছে।

    বিশাল করিডোর লম্বা, কতদূর যেন চলে গেছে! এতবার এসেও, নিচের ঠাকুর দালানের কোণটায় কী আছে জানে না পিলু। কিংবা নিচের ঘরগুলিতে কারা থাকে জানে না। কিছুটা পরিত্যক্ত বলেই মনে হয় ঘরগুলি। প্রায় সময় দেখেছে দরজা বন্ধ। জ্বালালি কবুতরের ওড়াউড়ি। কেউ একটা ঢিল পর্যন্ত মারতে সাহস পায় না। সকালে একবার এসে দেখেছিল, উঠোনে ছোলা মটর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কবুতরগুলো জড় হয়ে খাচ্ছে। মানুষজন পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও ভয় পাচ্ছে না।

    মনে হয় কবুতরগুলো সব পোষা। সকালবেলায় দু’জন কাজের লোক বালতি বালতি জল এনে উঠোন বারান্দা ধুয়ে দিচ্ছে। কারণ হেগে মুতে সব নোংরা করে রাখার স্বভাব। এত জ্বালায়, তবু এ-সব কবুতর এ-বাড়ির কোনো শুভবার্তা বহন করে থাকে দেখলে এমনই মনে হয়। যেন এদের দেখভাল করার জন্যও বাড়িতে আলাদা কাজের লোক রাখা আছে।

    পিলু অনুসরণ করছে।

    সে কখনও বাড়ির এত ভিতরে ঢুকতে সাহস পায়নি। এক একটা ঘর পার হয়ে বারান্দা —লাল রঙের মেঝে, আয়নার মতো চক চক করছে। তার পায়ের ছাপ পড়ছে। ধুলো বালি মাখা পা। মুহূর্তে সারা বাড়িটা সে নোংরা করে ফেলেছে। তার নিজেরই সংকোচ হচ্ছিল। পরীদি ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। বারান্দার শেষ মাথায় সবাই এখনও দাঁড়িয়ে আছে। যেন বাড়ির মিমি, মৃণ্ময়ী সত্যি তাদের কেউ হয় না। তার তো ভয় ভিতরে। বার বার পেছন ফিরে দেখছে আর গুটি গুটি এগুচ্ছে। পারলে এক লাফে সিঁড়ি ধরে নেমে পালাত।

    নিচে সাইকেল। সাইকেলে উঠে বসলে কে আর নাগাল পায়। কিন্তু চিঠিটা সব মাটি করেছে। পরীদিকে চিঠিটা না দেখিয়ে গেলেও সে শান্তি পাচ্ছে না। তা-ছাড়া দৌড়ে পালাতে গেলেও সে শান্তি পাচ্ছে না। তা ছাড়া দৌড়ে পালাতে গেলেও পারবে না। এত মসৃণ মেঝে যে সে ভয়ে পা টিপে টিপে হাঁটছে। একটু অন্যমনস্ক হলেই যেন আছাড় খাবে— কিংবা পড়ে গিয়ে তার হাত পা ভাঙবে। সবাই তখন হা-হা করে হাসবে। কিন্তু পরীদি যখন ছুটে যাচ্ছিল সিঁড়ির দিকে তখন তো সেও ছুটে যাচ্ছিল দিকবিদিক জানশূণ্য হয়ে। বোধ হয় তখন সে নিজের মধ্যে ছিল না।

    ঝাড় লণ্ঠনের রঙির কাচ হাওয়ায় সামান্য দুলছিল। বিচিত্র বাহার ফুটে উঠেছে।

    সে পরীদির ঘরে ঢুকে যেতেই যেন মনে হল নিজের ঘর বাড়িতে ফিরে এসেছে। তার ভয় নেই। তার চালচলন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। চিঠিটি এবার পরীদিকে দিতে হয়। পরীদি নিজেই পড়ে দেখুক। কিন্তু আশ্চর্য, চিঠি সম্পর্কে পরীদির যেন কোনো কৌতূহলই নেই। ঘরে ঢুকে বলল, বোস। পালাবি না।

    সে এ-ঘরটায় এসে বসলে আশ্চর্য এক মৃদু সৌরভ পায়। বকুল ফুলের মতো সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াতে থাকে। হয়তো ঘরটার পিছনে কোনো বড় বকুল গাছ আছে। কিন্তু অসময়ে তো বকুল ফুল ফোটে না। কে জানে, কোথাও কোনো গাছে বারো মাস বকুল ফুল ফুটে থাকে কিনা। এদের কোনো কিছুর সঙ্গেই তাদের জীবনের মিল নেই। সাদা পাখিটার নামই জানত না। কাকাতুয়া দেখতে এ-রকমের হয় পরীদিদের বাড়ি আসার পর জানতে পেরেছে। টিয়া, ময়না কত তো পোষা পাখি আছে। কিন্তু এ-বাড়ির পক্ষে যেন কাকাতুয়া পাখি না থাকলে সম্ভ্রমে বাধে।

    তাকে বসিয়ে রেখে পরীদি বারান্দার দিকে গেল কেন বুঝল না। কাকে ডেকে কি বলল, ঘরের ভেতর থেকে সে তাও অনুমান করতে পারল না। সে একা তক্তপোষে বসে পা দোলাচ্ছে। আর তখনই দেখল, টানা-হেঁচড়াতে তার সার্টের হাতা ছিঁড়ে গেছে। কোথাও জ্বালা হচ্ছে। পিঠের দিকে, ছাল চামড়া উঠে গেছে এবং জ্বালা হচ্ছে পরীদির ঘরে ঢুকে বসতেই টের পেল।

    দাদার জন্য তাকে যে কী ভাবে হেনস্তা হতে হচ্ছে, কত যে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে-শুধু তাকে কেন, বাড়ির সবাইকে— মা তো এখন দরজায় বিকাল হলেই চুপচাপ বসে থাকবে—বাবাও ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়বেন। পক্ষকালও পার হবে না। ছাতা বগলে শহরে চলে আসবেন। মুকুলদার বাড়ি বাবা চেনেন। ওদের পি তরু ডি-র কোয়ার্টারের পাশে বড় কদমফুলের গাছ। যেন কোনো পরিব্রাজক অপেক্ষা করছে, মুকুলদা তো সেবারে দাদা নিখোঁজ হয়ে গেলে এমন ভাবেই বাবার নিখোঁজ সন্তানের অপেক্ষার কথা বর্ণনা করত।

    একজন প্রবীণ মানুষ বসে আছে গাছতলায়।

    ডাকলেও বাবা বাড়িতে ঢুকতেন না। তাঁর যা জামা কাপড় তাতে যেন যেখানে বসবেন সেখানেই ময়লা লেগে যাবে। বাবার এই সংকোচের কথাও মুকুলদা বলেছে দাদাকে। –তোমার কষ্ট হয় না বিলু, মেসোমশাই সকাল নেই বিকাল নেই, গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছেন দেখি। বৌদি কত করে বলেছেন, ভিতরে এসে বসুন। মুকুল বাড়ি নেই। আসবে।

    বাবার এক কথা—ও ঠিক আছে। গাছের ছায়ায় বেশ ঠাণ্ডা।

    ঘরে যে পাখা আছে বাবার বোধ হয় তাও জানা ছিল না। কিংবা তিনি তখন পুত্রের মুখ ছাড়া এবং গাছ তলার ছায়া ছাড়া আর কিছুর মধ্যে বোধ হয় সান্তনা পেতেন না।

    মুকুলদা ফিরে এসে দেখলেই বলত, এ কি মোসোমশাই গাছের নিচে বসে আছেন ভিতের আসুন।

    বাবার তখন এক প্রশ্ন, তোমাদের কাছে কোনো চিঠি দিয়েছে। মাস দুই তো হয়ে গেল। আমরা বেঁচে আছি না মরে গেছি তারও তো খোঁজ নিতে হয়।

    মুকুলদা বলত, কী যে খারাপ লাগত বলতে, না মেসোমশাই বিলু কোনো চিঠি দেয়নি। গ্যারেজের কাজে মন বসছে না আপনাকে বললেই পারত।

    বাবার কাছে যেন এটা খুবই বিড়ম্বনার সামিল ছিল। বার বার খোঁজ নিতে এসে তিনি যেন মুকুলদাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিলেন।

    কখনও বলতেন, আর বল না, ওর মা তো ঘরে এক দণ্ড শান্তিতে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। তাই বার বার আসি। কিছু মনে কর না।

    মুকুলদা কত বুঝিয়েছে, চিঠি এলেই খবর দিয়ে আসব। আপনি ভাববেন না।

    বাবা বোধ হয় মনে করতেন, তাঁর বার বার আসা মুকুলদার পছন্দ না। মুখ কাঁচুমাচু করে নাকি বলতেন, ও ঠিক আছে। তবে বাড়িতে বসে থাকি, পূজা-আর্চায় মন বসছে না—কী করি, একটু হেঁটে এলে ভিতরের কষ্টটা দমন থাকে। খোঁজ নিতে আসি বলে কিছু ভেব না।

    মুকুলদা তো একদিন ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে বলেছিল, তুমি মানুষ বিলু! এমন সরল সোজা মানুষটাকে কষ্ট দিতে তোমার খারাপ লাগে না। যেন সব দায় তাঁর। দেশ ছেড়ে এসে এক দণ্ড বসে থাকেন না। আর তুমি গ্যারেজে বনিবনা হল না বলে পালালে। মেসোমশাই কী বুঝবেন, কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ। তোমার মানুকাকাই তো বলেছেন, যা নম্বর তাতে আর চাকরি জুটবে না। হাতের কাজ শিখুক— করে কম্মে খেতে পারবে।

    তারপর মুকুলদা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলেছিল, সব দোষ তোমার। বললেই পারতে, পড়ব, গ্যারেজে ক্লিনারের কাজ আমি করতে পারব না। তা না সবার উপর অভিমান করে নিরুদ্দেশ। আর বলি বাঙাল কাকে বলে—তুমি কী করে ভাবলে দেশের প্রধানমন্ত্রী তোমার অপেক্ষাতে বসে আছেন। দেশভাগের জন্য তোমাদের এই দশা, তাঁর এ জন্য দায়িত্ব রয়ে গেছে তোমার জীবনের সুবন্দোবস্ত করা—এ সব তোমার মাথায় আসে কী করে। বাঙাল কী আর সাধে বলে।

    পিলু আমগাছের ডালে বসে সব শুনত। গাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে দাদারা মজার মজার গল্প করত— তার দাদার বন্ধুরা শহরের মানুষ—আদব কায়দাই আলাদা। দাদার বন্ধুরা সাইকেলে দল বেঁধে এলে কী খুশি হন বাবা। বনজঙ্গলে বাস করা একজন উদ্বাস্তু মানুষের এত সৌভাগ্য হবে বাবা যেন কল্পনাও করতে পারতেন না। ঘরের ভাল মন্দ, আমের দিনে আম, জাম জামরুল, যে দিনকার যা, খাঁটি দুধ এক গ্লাস করে—যেন বাবা তাঁর আর বাড়ি করার গৌরব এর মধ্যে টের পেতেন। সেই দাদাটা শেষে পরীদিকে মারল। বাবার অন্নপূর্ণাকে মারল!

    অথচ পরীদির কোনো ক্ষোভ নেই।

    যত ভাবছে অবাক হয়ে যাচ্ছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }