Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1047 Mins Read0

    মানুষের ঘরবাড়ি – ৯

    নয়

    বাড়িতে ঠাকুরের অভিষেক হয়ে যাবার পর গাছপালা বনের মধ্যে আমাদের অনেকটা ভয় কেটে গেল। কাছে পিঠে নতুন আবাস এখনও তেমন গড়ে ওঠেনি। তেমনি মাঠ পার হলে পুলিসের ব্যারাক, কালীর দীঘি, বাদশাহী সড়ক— কেবল সেই চৌমাথায় নিমতলার কাছে নিবারণ দাসের বাড়ি এবং তার আশেপাশে আরও সব বাড়ি উঠছে। নতুন কলোনির পত্তন হচ্ছে। সাপ-খোপের উপদ্রব তেমন একটা কমেনি। বৈশাখ শেষ না হতেই জ্যৈষ্ঠ। খরা। ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুর, মাঠ-ঘাট ঘাস সব হেজে গেছে। মাটি ফেটে চৌচির। মনে হত দুপুরটা এক গনগনে আঁচের আগুনের কুন্ড। এরই মধ্যে পিলু কোথা থেকে কোঁচড় ভর্তি করে আম সংগ্রহ করে আনত। ঝড়-বৃষ্টি রোদ্দুর সবই সে সহজে সহ্য করতে পারে।

    এখন এই বাড়িতে আমার বাবার সাধ বলতে আর কিছু ফল টলের গাছ লাগানো। পাঁচ বিঘে জমির সবটা এখনও সাফ হয়নি। উত্তরের দিকে একটা বড় জঙ্গল রয়েই গেছে। বছরের ওপর হল আমাদের এই নতুন আবাস। এখন আর এ জায়গাটাকে মনেই হয় না অচেনা-অজানা, ভুতুড়ে সাপখোপ অথবা শেয়াল-খাটাশের একমাত্র আস্তানা। ঠাকুরঘরটা হয়ে যাবার পর বাবা একদিন দুটো জবা ফুলের ডাল নিয়ে এলেন। তিনি গেছিলেন বেলডাঙার কাছে বহুলা গাঁয়ে। নিবারণ দাসের বড় শ্যালকের বিয়ে। বিয়ের কাজ সেরে ফেরার সময় দুটো জবা ফুলের ডাল সঙ্গে এনেছেন। বিয়ে দিয়ে পেয়েছেন প্রণামীর টাকা আর একটা পুরোহিত বরণ। কিছু চাল-ডাল। অন্য সময় বাবা যখন এ-ভাবে ফিরে আসেন তখন উপার্জনের নিমিত্ত কতদূর যেতে হয়, এমন সব সাধুবাক্য সংকল্পের মতো পাঠ করেই থাকেন। এবারে অন্য রকম। সব কোনো রকমে নামিয়ে রেখে হাঁকতে থাকলেন—ও ধনবৌ, তোমার সুপুত্ররা সব কোথায়? কাউকে দেখছি না। বাবা ফিরেছেন বিকেলে, তখন কী আর বাড়ি থাকা যায়। এবং বাড়ির পাশে কোথাও কোনো বাড়ি ছিল না বলে, শুধু বন-জঙ্গল ছিল বলে, বনের গাছপালা, লতাপাতা, সরু পথ, বুনো ফলের সন্ধান অথবা কোথায় গভীর বনে লিচু গাছ আবিষ্কার করা যায় সেই নেশায় বিকেল হলেই আমি পিলু কখনও মায়া সঙ্গে থাকত— বের হয়ে পড়তাম, কারণ আমরা কয়েক বারই এমন কিছু আবিষ্কার করেছি এই বড় বনটাতে যাতে বাবা পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। এবং আমাদের কাছে বাবাকে স্তম্ভিত করার আনন্দ ছিল পৃথিবী জয় করার মতো। বাবা দু’দিন বাড়ি নেই, বাবা ফিরে এলে তাঁকে নতুন কোনো খবর দিতে পারব না, সেটা কেমন আমাদের কাছে খারাপ লাগত। এটা লিচুর সময়। আম, কাঁঠাল, লিচু, গোলাপজাম, জাম, জামরুল সবই এ সময়টাতে হয়। কাঁঠাল গাছ এবং দুটো আনারসের গাছ প্রথম আবিষ্কার করেছিল পিলু। আমি একবার একটা সরু পথ ধরে যাবার সময় প্রথম একটা আম গাছ তারপর আরও বনের গভীরে ঢুকে গেলে বুঝলাম, ওটা আমেরই বাগান, তারপর পিলু খবর নিয়ে এল বনটায় একটা বাতাবী লেবুর গাছও আছে, তখন আমি আর কি আবিষ্কার করব—একটা বাঁশ বাগানের মধ্যে যে ছোট্ট ঢিবি ছিল, সেখানে একটা কচ্ছপ আবিষ্কার করে এসে বাবাকে খবরটা দিলাম। বাবা বাড়ি না থাকলে যথার্থ স্বাধীন, খাও-দাও ঘুরে বেড়াও। তারপর মায়া আমি কখনও কোনো গভীর বনের মধ্যে ঢুকে নিরিবিলি গিমা শাক খুঁজে বেড়াই। বাবা আমার খুব গিমা শাক খেতে ভালবাসেন।

    এ-হেন দিনে বাবা বাড়ি ফিরে স্বাভাবিকভাবেই অমাদের তাঁর স্বগৃহে উপস্থিত থাকতে না দেখে খুব ক্ষেপে গেলেন। মাকে বোধহয় দুটো মন্দ কথাও বলে ফেললেন। আগের মতো আর তো মা’র প্রতি বাবার শংকাভাবটা নেই। নানা জায়গায় ঘুরে বাবা তাঁর খেরো খাতার লিস্টি মিলিয়ে সব যজমান এবং শিষ্যদের পুরো একটা তালিকা রচনা করে ফেলেছেন। এ দেশে আসার পর এতদিন লিস্টি ঠিক করতেই চলে গেছে।

    এখন আমাদের অবস্থা যেন ফিরে গেছে, মা’র এবং বাবার আচরণে এটাই মনে হত। এবং অবস্থা ফিরে যাওয়ার মূলে বাবা, তিনি তাঁর গাছের শেকড়-বাকড় সত্যি মাটিতে এবার পুঁতে দিতে পেরেছেন। বনের শাক, কচু লতাপাতার ওপর আর যেহেতু সংসারটা নির্ভরশীল নয়, তখন তাঁর ছেলেমেয়েরা যখন-তখন বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে, বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে, এটা তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না। বাবা জবা ফুলের ডাল দুটো নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। ঠাকুরঘরের পাশে লাগাবেন, না একটি সুন্দর ফুলের বাগান তৈরি করবেন, ফুলের বাগান তৈরি করতে হলে এলোমেলোভাবে লাগালে চলবে না। ক’হাত বাই ক’হাত বাগানটা হবে, রাস্তা থেকে কিভাবে বাগানের সবটা দেখা যাবে এ-সব ভাবনায় পীড়িত হচ্ছিলেন। তাছাড়া যার ওপর ভরসা করে সব তিনি লাগাবেন, সেই মেজ পুত্রটি এখন বাড়ি নেই। মেজ পুত্রটি তাঁর তো পুত্র নয় সাক্ষাৎ দেবতা। পছন্দমতো জায়গায় গাছ লাগানো ঠিক না হলে তিনি সেটি তুলে তাঁর পছন্দমতো জায়গায় লাগাবেন। তাতে গাছ বাঁচুক-মরুক কিছুই আসে যায় না। আর কাজটি এমন নিখুঁত সতর্কতার সঙ্গে করা হবে যে বাড়ির কাক-পক্ষিটি পর্যন্ত টের পাবে না। এভাবে দামী দামী কটা গাছের চারাই তিনি বিনষ্ট করেছেন। সুতরাং বাবার সমস্যার শেষ নেই। তিনি তাঁর স্ত্রী সুপ্রভা দেবীকে খুব মোলায়েম গলায় বললেন, আপনার মেজ পুত্রটির কি এখন আসার সময় হয়েছে?

    মা বুঝতে পারে বাবা তাঁর সন্তান-সন্ততিদের বাড়ি ফিরে না দেখতে পেয়ে খুব রেগে গেছেন। আজকাল যজমান এবং শিষ্যরা মাসান্তে ঠাকুরের নামে দু-পাঁচ-দশ টাকা মনিঅর্ডার করে থাকে। অন্যান্যবার এসেই প্রথম বাবা সাধারণত বারান্দায় বসে হুঁকো সাজতে না সাজতেই বেশ মধুর স্বরে বলতেন, ও ধনবৌ, টাকা-পয়সা কিছু এল? সাধারণত কিছু এসেই থাকে। দু টাকা পাঁচ টাকা মাঝে মাঝেই এসে থাকে। তাতে খুব একটা সমারোহে সংসার চলে যায় না—কোনো রকমে ডালভাতের সংস্থান হতে পারে—এই ডালভাতের সংস্থান করতে পারাটা একটা উদ্বাস্তু পরিবারের পক্ষে কত কৃতিত্বের ব্যাপার সেটা বাবার হুঁকো খাওয়ার সময় মুখ না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। এবারে তিনি হুকোটি পর্যন্ত ছুঁলেন না। মা নিজেই হুঁকো সেজে বাবার সামনে এনে দিয়ে বলল, কোথাও গ্যাছে, আসবে। বাবার মাথা ঠাণ্ডা করার এর চেয়ে মোক্ষম দাওয়াই আর কি থাকতে পারে! এতদূর থেকে এসে স্ত্রীর এমন আপ্যায়নে বিগলিত হয়ে গেলেন। বললেন, গেছে কোথায়?

    —কোথায় যাবে আবার। পিলু বোধহয় ব্যারেকে গেছে। মায়া বিলুকে বলেছি, তোর বাবা ফিরবে, দেখা দুটো গিমা শাক পাস কি না। এখন বর্ষা পড়েছে, কোথাও গজাতে পারে। তুমি তো গিমা শাক খেতে খুব ভালবাস। গাছে দুটো বেগুন হয়েছে। বেগুন দিয়ে রাতে গিমা শাক করব ভেবেছি।

    এ-সবই হয়ে থাকে সংসারে এখন। সামান্য চাল ডাল নুন তেল থাকলে আর কোনো উচ্চাশার কথা ভাবা হয় না। বাবা জবা ফুলগাছটা লাগাবার ঠিক আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম। আমি আর মায়া। আমাদের কোঁচড় ভর্তি গিমা শাক। বাবা দেখে তো বেজায় খুশী। বললেন, জবা ফুলের ডাল দুটো কোথায় লাগাবি? যেন আমি যেখানে পছন্দ করব সেখানেই লাগানো হবে। বাবা তাঁর নতুন আবাসটির কোথাও আর কোনো ত্রুটি রাখতে চাইছেন না। এই সুমার বন-বাদাড়ে পূজার ফুলের খুবই অভাব। বিশেষ করে শ্বেত জবা রক্ত জবা এই দুটো ফুল পূজার অপরিহার্য অঙ্গ। পুজায় বসে বাবা সে সব ফুল পাবেন কোথায়? বাগদি পাড়ার কাছে একটা করবী ফুলের গাছ শেষ পর্যন্ত কিছুটা বাবাকে স্বস্তি দিয়েছে। পুলিস ব্যারাকে ফুলের গাছ বলতে ম্যাগনলিয়া, গোলাপ, বোগেনভেলিয়া। এমন সব ফুল যা একটাও পূজায় লাগে না। সেজন্য বাবা রোজ সকালে স্নান করার সময় ল্যাংড়ি বিবির হাতা থেকে দুটো একটা পদ্ম তুলে আনেন। ভবিষ্যতে যাতে পূজায় ফুলের অভাব না হয়, স্থলপদ্ম গাছ, শিউলি ফুলের গাছ এবং কিছু দোপাটি ফুলের চারা ইতিমধ্যেই লাগিয়ে ফেলেছেন। আর বাবা বাড়ি না থাকলে পূজার ভার আমার ওপর। পঞ্চদেবতার পূজা, গনেশের পূজা, লক্ষ্মীর ধ্যান, এই সব মন্ত্র একটা খাতায় লেখা থাকে। আমি দেখে দেখে মন্ত্র আওড়াই আর ‘এষ দীপায় নম, এষ ধুপায় নম’ করি। তখনই সংসারে পিলু সব চেয়ে বেশি খাপ্পা হয়ে যায় আমার ওপর। যেহেতু আমাদের খুব শৈশবে পৈতা হয়েছে—পিলুর ধারণা পূজা করার এক্তিয়ার তারও আছে। কিন্তু বাবা বাড়ি থেকে যাবার আগে পূজার ভার যেমন আমার ওপর অর্পণ করেন, তেমনি বাড়িঘর দেখাশোনার ভার পিলুর ওপর অর্পণ করে যান। এতে পিলু বাবার ওপর রুষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু মুশকিল পিলু সকাল হলেই পেট ভরে খেতে চাইবে। পিলুর পুজো করার কথা থাকলে সে না খেয়ে পূজোয় বসবে না, আসলে অত বেলা পর্যন্ত আজকাল আর না খেয়ে একেবারেই সে থাকতে পারে না। আর ওর ঈশ্বরে বিশ্বাসও খুব একটা প্রবল নয়। যদিও ঈশ্বরের প্রতি ভূতের ভয়ের মতো একটা ভয় তার সব সময়ই আছে।

    বাবা বললেন, আমার মেজ পুত্রটি না এলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। এবং এক সময় মেজ পুত্রটি এক বোঝা কাঠ মাথা থেকে নামিয়েই বাবার কাছে ছুটে এল। পিলু কাছে এলে হুকোটি ওর হাতে দিয়ে বললেন, এখন অনেক কাজ। পিলু হুঁকোটি যথাস্থানে রেখে এলে বাবা বললেন, দুটো জবা ফুলের ডাল এনেছি। একটা শ্বেত জবা, একটা রক্ত জবার। কোথায় লাগাবি?

    পিলু এত বড় গুরুদায়িত্বের কথা ভেবে প্রথমে সামান্য হকচকিয়ে গেল। বাবা গাছটাছ তাঁর মর্জি মতোই লাগান। তারপর দ্বিতীয়বার আবার সেই গাছটাছ পিলুর মর্জি মতো লাগানো হয়। কোনোটা বাঁচে কোনোটা মরে। কিন্তু জবা ফুলের ডাল দুটিকে দু’বার দুজনের মর্জিমতো লাগালে ধকল সইতে পারবে না। এবং এমন মহার্ঘ ডাল দুটোকে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বাবা বাধ্য হয়ে তাঁর দ্বিতীয় পুত্রের শরণাপন্ন হলেন।

    বাবার দ্বিতীয় অথবা মেজ পুত্রটি পেছনে দু’হাত রেখে প্রথমে ঠাকুরঘরের চারপাশটা ঘুরে দেখল। যেসব গাছটাছ আছে, যেমন একটা স্থলপদ্মের গাছ, পাশে দুটো গোলাপের গাছ, টগর এবং জুঁই ফুলের গাছ, তার পাশে সুন্দর মতো একটা করবীর চারা বেশ সতেজ ডাল মেলে দিয়েছে, পিলুর জায়গাটি কেন জানি লাল জবাফুলটির জন্য পছন্দ হয়ে গেল। সে উঠোনে গিয়ে বলল, বাবা দাও, লাগাচ্ছি।

    ওই লাগাক, ওর মর্জিমতো কাজটা হলেই শেষ পর্যন্ত গাছটা বাঁচবে ভেবে বাবা বললেন, কোথায় লাগাবি ঠিক করেছিস?

    —করবী গাছটার পাশে।

    মেজ পুত্রটি এমনিতে তাঁর বেশ বুদ্ধিমান। কিন্তু জায়গা নির্বাচনের কাজটি যে ঠিক হয়নি এবং সোজাসুজি ঠিক হয়নি বললেও মেজ পুত্রটির শেষমেষ যদি নিজের জেদ বজায় রাখার নিমিত্ত আবার দু’বারের ঠেলা সামলাতে হয় গাছটাকে তবেই গেছে। তিনি ডালটি এবং একটা খুরপি নিয়ে ওর সঙ্গে এলেন। বললেন, সত্যি জায়গাটা খুব ভাল। গরু-ছাগলে খেতে পারবে না। কিন্তু করবী গাছটা বড় হয়ে গেলে তোর জবার ডালটা আলো-বাতাস একেবারেই পাবে না।

    এমন একটা সাধারণ সত্য-জ্ঞানের অভাব ভেবে পিলু কেমন বাবার ওপরই কাজের ভারটা ছেড়ে দিল। তারপর আমাকে, মাকে ডাকল। আমরা প্রায় বাড়ির সবাই, এমন কি কুকুরটা পর্যন্ত যতক্ষণ ডাল দুটো লাগানো না হল দাঁড়িয়ে থাকলাম। এবং বাবা এবারে যেন নিশ্চিন্ত মনে বললেন, যাক ধনবৌ, তোমার লাল জবা, শ্বেত জবাও হয়ে গেল।

    আসলে বাবা আমার তাঁর সেই দেশ বাড়ির কথা বুঝি এতদিনেও এক বিন্দু ভুলতে পরেননি। বাড়িটার জন্য বাবা কী যে না করছেন। ফলের গাছের একটা লিষ্টিও বাবা এক রাতে বসে কুপির আলোতে বানিয়ে ফেললেন। মানুষের ঘরবাড়ি করতে যা যা লাগে তার কোনো ত্রুটি থাকুক বাবা সেটা একদম পছন্দ করতেন না।

    মা একদিন বাবার এত উৎসাহের মধ্যেই বলে ফেলল, সবই হচ্ছে, খুঁজে পেতে সব শিষ্য যজমানদের ঠিকানা নিয়েছ, সব খেরো খাতায় লিখে রেখেছ, ছেলে ক’টাও বড় হচ্ছে। শুধু তোমার ঘর-বাড়ি বানালেই চলবে, বিলু পরীক্ষাটা দেবে না? পিলুকে শহরের স্কুলে দেবে না? মায়া বাড়িতেই পড়তে পারে। ছোটটার না হয় বয়স হয়নি…।

    বাবা নিশ্চিন্ত মনে বললেন, ও হয়ে যাবে। মানুষের বাড়িঘর হয়ে গেলে সব হয়ে যায়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাক্স থেকে বইগুলো বার কর। বসে থাকলে তো পেট ভরবে না।

    বাবা তাঁর পছন্দমতো কাজ না হলে নির্বিঘ্নে সব ভুলে যেতে ভালবাসেন। তিনি বই বাক্স থেকে কবেই বের করে দিয়েছেন। যখন দু-চার দিনের মতো খাবার মজুত ঘরে থাকত, তখন আমাদের পড়ার কথাটা বাবার মনে পড়ত। প্রায় সকালেই উঠে বাবা হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিতেন। নিজেই মাদুর পেতে বলতেন, পড়তে বোস। বইটই নিয়ে এস, দেখি কে কতটা এগোলে। মাসাধিককাল পর পর তিন-চার দিনের বাবার এই প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমরা খুবই ওয়াকিবহাল ছিলাম। আমরাও তখন উচ্চস্বরে পড়তাম। সবচেয়ে উচ্চস্বরে পড়ত তাঁর মেজ পুত্রটি। সে রাজ্যবর্ধনের বোন রাজশ্রীর সেই আগুনে ঝাঁপ দেবার মুখের দৃশ্যটি খুব মনোযোগসহকারে পড়ত। গ্রহবর্মা মালবরাজ দেবগুপ্ত আর বাংলার রাজা শশাঙ্কের মিলিত সৈন্যবাহিনীর কাছে পরাজয়ের পাতাগুলিও সে পড়ত গলা ফাটিয়ে। আর মাঝেমাঝে নিজের বোন মায়া দেবীকে কিল চড় ঘুষি বাবার অলক্ষ্যে যখন যেটা সুবিধা ব্যবহার করে চলত।

    আমাদের এই তিনজন পড়ুয়ার মধ্যে মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতেন বাবা। বাবার কোলে যিনি থাকতেন, তার প্রতাপ সবার চেয়ে বেশি। সে খুশিমতো যার তার বই টেনে নিত, চিবুত, কখনও কোনো বই-এর পাতা ছিঁড়ে ফেলত। তার সব অধিকার ছিল। বাবা মাঝে মাঝে তার ছোট পুত্রটির কান্ডকারখানায় বিব্রত হয়ে বলতেন, আহা কী করলি। দিলি তো ছিঁড়ে। ধমক দিলেই ছোট ভাইটির ভারী বদ অভ্যাস ছিল। নির্ঘাত সে বাবার কোলে পেচ্ছাব করে দেবে। বাবাও সেই ভয়ে খুব জোরে কিছু বলতে সাহস পেতেন না। কোল থেকে তুলেও দিতেন না। কারণ মা’র তো সকাল থেকে কাজের অন্ত থাকে না। মাকে গিয়ে জ্বালাতন করবে ভয়েই বাবা সব উপদ্রব সরল মানুষের মতো সহ্য করে যেতেন। ছোট সন্তানকে তাঁর শাসন করার কোনো অধিকারই মা বাবাকে দেয়নি। এছাড়া এ-সব ব্যাপারে বাবার ভীষণ আপেক্ষিক তত্ত্বে বিশ্বাস ছিল।

    আমি প্রথমে কিছু ইংরেজি কবিতা পড়লাম। কবিতাগুলি ক’দিন পড়লে বেশ মুখস্থ হয়ে যায়, না পড়লে আবার সহজেই ভুলেও যাওয়া যায়। বাবার সামনে কখনই বাংলা সংস্কৃত পড়ি না। কারণ বাংলা এবং সংস্কৃত পড়লেই তাঁর অধীত বিদ্যার মধ্যে পড়ে যায়। তিনি তখন এমন সব অদ্ভুত প্রশ্ন করতে থাকেন যে, আমার আসল পড়াটাই আর হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ বাবা আমার সংস্কৃতে এবং বাংলাভাষায়, এমন কী ইতিহাস, ভূগোল, স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের বহর বোঝাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সকালটা কীভাবে যে নষ্ট করে দেন! তাঁর মেজ পুত্রটি বাবার এই দুর্বলতা বিলক্ষণ টের পায় বলেই প্রথমে ইতিহাস ধরেছে। বাবা একটা কথাও বলেননি। তারপর বাংলা–বাবা তেমনি চোখ বুজে শুনে যাচ্ছেন। উচ্চারণে ত্রুটি ঘটলে কেবল সেটা ধরিয়ে দিচ্ছেন। বাবা কিছুদিন আগে তাঁর জ্ঞানের বহর বোঝাতে গিয়ে যে শেষ পর্যন্ত একবিন্দু আমাদের কারো পড়া হয়নি, মা সেটা ধরিয়ে দিতেই মৌনীবাবা সেজে এখন ছেলে কোলে নিয়ে প্রায় মহাদেবের মতো বসে আছেন।

    আর সেই বাবা সহসা বলে উঠলেন, ওরে বিলু অঙ্ক করছিস না কেন?

    বললাম বইটার হাফ নেই বাবা।

    —জ্যামিতি?

    —ওটা আনতে হবে।

    বাবা তারপর মোটামুটি হিসাব নিয়ে বুঝতে পারলেন, আমার বই-এর সংখ্যা যথার্থই কম। এবং বাবা যেন এটা আজই জানলেন, তেমনভাবে বললেন, তবে শহরে চল, মানুকে বলে-কয়ে কিছু পুরনো বইটই পাওয়া যায় কিনা দেখি। কি কি নেই একটা লিষ্টি করে ফেল।

    এই লিষ্টি আজ নিয়ে মোট পাঁচবার করা হল। কে. পি. বসুর অ্যালজাব্রা আছে। তবে সবটা নেই। জ্যামিতির হাফ আছে। কারণ দু’বছরের টানা হ্যাঁচড়া। এবং আমার আর কখনও পড়াশোনা হবে ভাবিনি। যতই বাবা বলুন, বাড়িঘর হয়ে যাক তখন দেখা যাবে। কখনও প্ল্যাটফরমে, কখনও পোড়ো বাড়িতে থাকতে থাকতে ভাবতেই পারিনি, এ দেশে এসে কখনও আমাদের শেষ পর্যন্ত বাড়িঘর হবে। সুতরাং বেশ নিশ্চিন্তই ছিলাম। কিন্তু বাড়িঘর হয়ে যাওয়ার পর পরীক্ষাটা না দিলে যেমন বাবার সম্মান থাকে না, তেমনি এই বাড়িঘর বানানোর কোনো অর্থ হয় না।

    বিকেলেই বাবা শহরে মানুকাকার কাছে নিয়ে গেলেন। রাস্তায় বললেন, কাকাকে বলো তোমার কী কী বই নেই। যখন পুরো লিষ্টি দিলাম, তখন সেই কাকাটি হতবাক। বললেন, কি করে পরীক্ষা দিবি? চার মাসও তো বাকি নেই। কলেজিয়েট স্কুলের হেড মাস্টারমশাই কাকার বন্ধু লোক। কাকা আবার আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি একটি চিরকুট লিখে তাঁর এক শিক্ষকের কাছে পাঠালেন। তিনি তাঁর দুই ছাত্রের ঠিকানা দিলেন। ওদের বাড়তি বই-টই যদি থাকে। ওরা পাঠালো খেলোয়াড় বিনয় দাসের কাছে। সে এবারে পরীক্ষা দিচ্ছে না। তার বইগুলি যদি পাওয়া যায়। কিছু পাওয়া গেল, কিছু পাওয়া গেল না। বইগুলি যে নেই বলল না। বললে, বিনয় দাসের বাবা মুদিখানার মালিক তাকে আর আস্ত রাখত না। যাই হোক এই করে যখন কিছু বই নিয়ে শেষ পর্যন্ত অনেক রাতে বাড়ি ফিরলাম, মা আমার খুবই আশ্বস্ত হলেন। যে মা, কখনও জানেই না, কোন্ বই-এর কি নাম সেও লণ্ঠন জ্বেলে উবু হয়ে বসল। সব বই দেখে বলল, এর তো দেখি ভেতরে সব পাতা কাটা রে। কেমন সুন্দর করে কেটেছে দেখ।

    বাবা বললেন, সত্যি তো!

    আমি বললাম, বাবা বিনয় দাস চারবার চেষ্টা করে পারেনি। বোধহয় সেজন্য মা সরস্বতী রাগ করে সব ভাল ভাল জায়গাগুলি বই থেকে চুরি করে নিয়েছেন।

    বাবা বললেন, তবু তো বই। এই বা কে দেয়। মন দিয়ে পড়লে ওতেই পাস করে যাবে।

    বাবা বলতে কথা। বাবার কথা ফেলা যায় না। তখন সেই বই সম্বল করেই আমার পড়াশোনা আরম্ভ হয়ে গেল। প্রাইভেট পরীক্ষার্থী আমি। বাবা এক ফাঁকে নিবারণ দাসের আড়তেও চলে গেলেন। বলে এলেন, দাসমশাই বড় ছেলে আমার এবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে। শুধু নিবারণ দাস কেন, যার সঙ্গেই দেখা হত একথা সেকথার ফাঁকে বাবা বলতেন, বড়টা এবার প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবে। বাবার কাছে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়টা বড়ই গৌরবের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল শেষ পর্যন্ত। ম্যাট্রিক পরীক্ষার চেয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষাটা আরও যেন গম্ভীর শোনায়। বাবা সব সময় খুব জরুরী কথাবার্তায় খুব সাধুভাষা ব্যবহারের পক্ষপাতী। এবং এভাবেই এই বাড়িতে শীতকালও এসে গেল। এখন পিলু পর্যন্ত আমাকে সমীহ করতে শুরু করেছে। আমার পড়ার জন্য বাবা শেষ পর্যন্ত একটা হারিকেনও কিনে ফেললেন।

    আর আমি জানি, বাবা যেখানেই এখন যাচ্ছেন, বিয়ের কাজে অথবা কোনো পুজো-আর্চার ব্যাপারে- ঠিক কথায় কথায় তাঁর বড় ছেলে কত লায়েক, কী পরীক্ষা দিচ্ছে সে-সম্পর্কে বিশদ আলোচনা না করে ছাড়ছেন না। বাড়ি ফিরলেই বাবা বলতেন, জগদীশ বলল, প্রবেশিকাটা পাস করলেই কর্তা আপনার আর কোনো ভাবনা নেই। অফিসে চাকরি হয়ে যাবে। বাবার ছেলে অফিসবাবু হবে শুনে মা খুব অমায়িক হয়ে যেতেন। মা বলতেন, হাত-মুখ ধুয়ে একটু কিছু খাও। কোন সকালে তো বের হয়েছ।

    এই বাড়িঘর, গাছপালা এবং বনভূমির মধ্যে রাতে আমার উচ্চস্বরে পড়া বাবার চোখে-মুখে এক আশ্চর্য প্রশান্তি এনে দিত। তিনি মাঝে মাঝে গুড় ক গুড়ক করে তামাক টানতেন। আর কখনও সকালে সেই পড়াশোনার মধ্যেই পিলু খবর দিত এই বিরাট বনভূমির কোন দিকটার সব গাছপালা কেটে লোকে নতুন আবাস তৈরি করছে এবং আমার মনে হত পিলুর ভারি কষ্ট হত এতে। এই বনভূমিটা যেন পিলুর সাম্রাজ্য—সবাই কে কোথা থেকে এসে সব গাছপালা কেটে ফেলছে। বনভূমির সেই আদিম আশ্চর্য রহস্যটা মরে যাচ্ছে বলে পিলুকে প্রায়ই খুব ম্রিয়মান দেখাত। কুকুরটাকে নিয়ে সে আগে যেমন এই বনভূমির অভ্যন্তরে ঢুকে অদ্ভুত সব খবর নিয়ে আসত আমাদের জন্য, এখন আর তেমন পারে না। গাছপালা কেটে ফেলায় উষর জমির মতো দেখায় এবং সেখানে মাঝে মাঝে শোনা যায় বাঁশ কাটার শব্দ। বাবার খুব তখন আনন্দ। পূজা শেষ করে বাবা যত জোরে সম্ভব শঙ্খে ফুঁ দিতেন। কাঁসর ঘণ্টা বাজাতেন। পিয়ন আসত ঠাকুরের নামে আসা যজমান অথবা শিষ্যদের মনি অর্ডার নিয়ে। কেউ পাঁচ টাকা, কেউ দশ টাকা মাসোহারা দেয়। আর বাবার কিছু যজমান নিবারণ দাসই ঠিক করে দিয়েছে। শহরের মানুকাকাও ভাল পুরোহিতের খোঁজে কেউ এলে বাবাকে খবর পাঠায়। আর যারা বাবার মতো নতুন ঘরবাড়ি করছে, দিনখন দেখাতে এলে বলে দেন, ঠাকুরের ফুল-তুলসী নিয়ে যাও। ওতেই হয়ে যাবে। জায়গাটার কথা বললে বলেন, মাটি মাটি। তার তুলনা নেই ভুবনে। যেখানেই আবাস, সেখানেই মানুষের সবকিছু। বাবার এমন সুন্দর কথা ওদের খুব ভাল লাগত। পূজা-পার্বণে দিন দিন যে শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে এটা বোঝা যাচ্ছিল—সবই বাবার স্বভাবগুণে।

    এ-ভাবে শীতকাল শেষ হয়ে গেল এই বনভূমিটায়। এখন আর আগের মতো একে আমরা ঠিক বনভূমি বলতে পারি না। কারণ বাদশাহী সড়কের ধারে ধারে সর্বত্রই মানুষের নতুন বাড়িঘর উঠে যাচ্ছে। ভেতরের দিকে, অর্থাৎ যে সুমার বনটা প্রায় মাইলব্যাপী কারবালা পর্যন্ত চলে গেছে এবং যেখানে কবে কোন আদ্যিকালে একটা ইটের ভাটাও কেউ করেছিল—কেবল সে জায়গাটা কেন জানি মানুষ এখনও ঠিক পছন্দ করছে না। ফলে ওদিকটার বড় বড় শিরিষ গাছগুলি থেকে পাতা ঝরতে লাগলো ঠিক আগের মতই; কিছু শাল গাছ অথবা পিটুলি গাছের পাতাও ঝরছে। রোদের তাত বাড়ছে। মাঠে অথবা কোনো শস্যক্ষেত্রে আগে যে খরগোস সজারুর উপদ্রব ছিল তাও ক্রমে কমে আসতে লাগল। কিছু বড় বড় গো-সাপ ছিল বনটাতে, ওদের আর বিশেষ দেখা পাওয়া যেত না। রাতে শিয়ালের সেই তীব্র চিৎকার ক্রমে দূরবর্তী শব্দের মতো মিহি হয়ে যেতে থাকল। এবং এত সবের মধ্যেই আমায় একদিন শহরে যেতে হল পরীক্ষা দিতে। মা কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে দিল। বাবা-মাকে প্রণাম করতে হল। ঠাকুরের ফুল বেলপাতা বাবা পকেটে দিয়ে দিলেন। অর্থাৎ পরীক্ষায় কৃতকার্য হবার জন্য বাবার বিশ্বাসে যা কিছু দরকার সবই করা হল।

    পরীক্ষার কটা দিন বাড়ি থেকে বাবা কোথাও বের হলেন না। পূজার সময় বেড়ে গেল। শালগ্রামের মাথায় বোঝা বোঝা তুলসী পাতা চাপাতে থাকলেন বাবা। শহরে আমি পরীক্ষা দিচ্ছি। বাড়িতে বাবা ঠাকুরের কাছে পরীক্ষা দিচ্ছেন। ধৈর্যের পরীক্ষা বোধহয়। কারণ বাবার জানা যত দেবতা আছেন সবার উদ্দেশেই ফুল চন্দন দিতে দিতে বিকেল হয়ে যেত বাবার। কেউ বাদ গেলে ষড়যন্ত্র করে বাবার সব ভণ্ডুল করে দিতে পারে। শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতে সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দেখি মা খুবই উৎকণ্ঠায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। মায়া ভাইকে কোলে নিয়ে রাস্তার গাছপালা দেখাচ্ছে। পিলু রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল আমি কখন ফিরব। কেবল বাবা নেই। ঠাকুর ঘরের দরজা বন্ধ। মাকে বললাম, বাবা কোথায়?

    ঠাকুর ঘরে সেই সকালে ঢুকেছে এখনও পুজোই শেষ হচ্ছে না।

    বুঝলাম, তাঁর বড় পুত্রের জন্য বাবা আজ তেত্রিশ কোটি দেবতাকেই খুশী করতে ব্যস্ত। তাঁর নিজের এত সখের বাড়িঘরের কথা মনে নেই। প্রিয় কুকুরটার কথা মনে নেই। দেবতাদের তুষ্ট করতে গিয়ে দিন শেষে বেলা যায় তাও তিনি বুঝি ভলে গেছেন।

    ঠাকুর ঘরের দরজার সামনে এগিয়ে গেলাম। খুব সতর্ক গলায় ডাকলাম,—বাবা।

    বাবা রা করলেন না।

    আবার ডাকলাম, বাবা, আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল।

    বাবা কেমন ধ্যানমগ্ন গলায় বললেন, শেষ বলো না। পরীক্ষা সবে শুরু হল। কী অর্থে কথাটা বললেন, বুঝতে পেরে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাবা তখন ডাকলেন, হাত-পা ধুয়ে ঠাকুর প্রণাম কর এবং এ-সবে আমার কিঞ্চিৎ বিশ্বাসের অভাব ছিল। তবু বাবার কথা। ঘরে ঢুকে ঠাকুর প্রণাম করলে সামান্য চরণামৃত দিলেন হাতে। এত সবের পর বাবার পুজো শেষ ধরতে পারলাম। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। পরীক্ষার ভালমন্দের কথা তিনি আজ পর্যন্ত একবারও জিজ্ঞেস করলেন না। সবই ঠাকুরের কৃপা, ভাল-মন্দ বলে যেন কিছু নেই। শুধু নিজের কাজটুকু করে যাও। বাবার এমন সব কথা আমরা অনেকবার শুনেছি। মা মাঝে মাঝে একই কথা শুনে রেগে যেত। কিন্তু পরীক্ষার কটা দিন বাবার পুজো আর্চায় মা সাংসারিক অনটনের কথা বলে এতটুকু বিব্রত করল না। বাবার সঙ্গে মাও এ-ক’টা দিন খুবই ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে বুঝতে পারলাম।

    ফল বের হবার আগ পর্যন্ত বাবা আমাকে কোথাও গেলে সঙ্গে নিতে শুরু করলেন। শহরে মানুকাকার বাড়ি গেলে বললেন, সব তাঁরই ইচ্ছে। তোমার ভাইপো তো এবারে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিল। তোর তো জানাশোনা আছে অনেক। দেখিস যদি কিছু করতে পারিস। নিবারণ দাসের আড়তে নিয়ে গেলেন একদিন। বললেন, প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছে পুত্র।

    এই প্রবেশিকা পরীক্ষা বাবার জীবনে তাঁর বাবার জীবনে কখনও ঘটেনি। অতবড় পরীক্ষা দিয়েছে ছেলে, তাকে দশজনের কাছে নিয়ে যাওয়া বাবার খুবই দরকার। তাঁর বড় ছেলে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছে, কত বড় কথা!

    ফল বের হবার দিন শহরে গেলাম। মানুকাকা বললেন, তুমি এক বিষয়ে ফেল করেছ। স্কুলের মন্টু মাস্টার খবরটা দিয়ে গেছে। খুব দমে গেলাম। তিনি ফের বললেন, দু’ মাস পরে পরীক্ষা হবে। তখন পরীক্ষাটা দিতে পারবে। অঙ্ক পরীক্ষা। দুটো মাস আর কতই বা সময়। মন দিয়ে পড়াশোনা করলে পাস করে যাবে। কিছুই ভাল লাগছিল না। বাড়ি ফেরার পথে সাহেবদের একটা নির্জন কবরখানা পড়ে। বড় বড় সব ঝাউগাছ। সেখানে সারাটা দুপুর শুয়ে থাকলাম। কেবল বাবার মুখটা আমার চোখে ভেসে উঠছে। তাঁর কত বিশ্বাস আমার ওপর। এখন মুখ দেখাব কী করে। কী করি। ফেরার হলে কেমন হয়। তখনই মা’র সেই বিষণ্ণ মুখ ভেসে উঠল। বাবার সব আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং তাঁর পুত্র গৌরব নিমেষে কেউ হরণ করে নিয়ে গেল। তবু কেন জানি পিলু মায়া ছোট ভাইটার কথা ভেবে ফেরার হতে ইচ্ছে হল না। সাঁঝ লাগার আগে গুটি গুটি বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলাম। রাস্তাটা যেন আজ কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। পুলিস ব্যারাক পার হতেই বড় মাঠ। মাঠে পড়েই দেখলাম, সবাই বাড়ির রাস্তায় গাছের নিচে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। পিলু ছুটতে ছুটতে আসছে। মায়া ছুটতে গিয়ে পড়ে গেল। অন্য দিন হলে ভ্যাক করে কেঁদে দিত। আজ তার কান্নার কথা মনে পড়ল না। কতক্ষণে আমার কাছে পৌঁছবে! ওরা কাছে এলে কীভাবে যে বলব, পরীক্ষায় পাস করতে পারিনি পিলু। পিলু এ-কথায় সবচেয়ে বোধহয় বেশি ভেঙে পড়বে এবং বনভূমিটা থেকে আমরা যে ঘরবাড়ি ছিনিয়ে নিয়েছি, আমার মনে হল খবরটা পাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই বনভূমি বাড়িটাকে গ্রাস করে ফেলবে। পিলু চিৎকার করে বলল, দাদা, পাস করেছিস?

    কিছু বললাম না। কারণ বলতে পারছিলাম না কিছু। আমার চোখ ফেটে জল আসছে! বাবা এগিয়ে এসে বললেন, পাস করলি?

    আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না, কেঁদে ফেললাম।

    বাবা বললেন, কান্নার কী আছে? সবাই বুঝি পাস করে!

    বাবার কথায় ভেতরের দুঃখটা সহজেই কত লাঘব হয়ে গেল।

    বাবা আবার বললেন, ক’ বিষয়ে পাস করেছিস?

    এটাই বোধহয় বাবার শেষ সান্ত্বনা। বললাম, ন’ বিষয়ে পাস। অঙ্কে ফেল।

    বাবা বিজয় গৌরবে এবার আমার হাত ধরে ফেললেন। বললেন, দশটা বিষয়ের মধ্যে ন’টা বিষয়ে পাস—কম কথা হল! এটা তো পাসই। জীবনে কে কবে সব বিষয়ে পাস করেছে। বড় হলে বুঝতে পারবি। –

    এবং তারপর থেকে আমার সেই নির্দিষ্ট অঙ্ক পরীক্ষার দিনটি পর্যন্ত যার সঙ্গে দেখা হত বাবা বলতেন, বড় পুত্র দশটা বিষয়ের মধ্যে নটাতেই পাস করেছে। একদিন নিবারণ দাসের পাটের আড়তেও খবরটা দিতে চলে গেলেন বাবা। বললেন, কম বড় কথা না। কী বলেন দাসমশাই!

    দাসমশাই আড়তে বসে হুঁকাটি বাবার হাতে দিয়ে বললেন, সত্যি ভারি গৌরবের কথা। বাবা আনন্দে তখন তন্ময় হয়ে তামাক টানছেন। পুত্র-গৌরবের হাসিটি তাঁর মুখে লেগেই আছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }