Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মায়াজাল – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প137 Mins Read0
    ⤷

    ১. এই সেই মেয়ে

    এই সেই মেয়ে।

    মেয়েটার পিঠের ওপর আলতো একটু হাতের স্পর্শ দিয়ে সুনন্দার দিকে ঠেলে দিলেন উকিল ব্রজনাথ।

    ঠেলে দিলেন বললে হয়তো ঠিক বলা হয় না, ঠেলে দিতে চেষ্টা করলেন বলাই ঠিক।

    কারণ মেয়েটা যেন মাটির সঙ্গে পুঁতে গিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ল না।

    কিন্তু সুনন্দাই কি আবেগে উথলে উঠল? ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে টেনে নিল তাকে? না, অন্তত এই মুহূর্তে তা করল না সুনন্দা। শুধু সোফার ওপর বসে পড়ল।

    শিথিল দেহখানাকে যেন নিক্ষেপ করল আধহাত পুরু ডানলোপিলো সিটটার ওপর। সেই মুহূর্তে কোন কথা ও বলতে পারল না। ভারী ভারী বুকটা কেবল ওঠা পড়া করতে লাগল ভিতরের আলোড়নে।

    এতক্ষণ মেয়েটাকে পাশের ঘরে রাখা হয়েছিল। এইমাত্র ডাকিয়ে আনা হয়েছে। ওর সম্পর্কে যা কিছু বলবার ওর আড়ালে বলে নিয়েছেন ব্রজনাথ। উনিশ বছর আগের সেই একটি রাতের কাহিনী।

    সেই এক নীতিধর্মহীন অন্যায় বাসনা জর্জরিত নিষ্ঠুর পাপের কাহিনী।

    জগতের নিষ্ঠুরতম পাপ। নিষ্ঠুরতম আর কুৎসিততম।

    কুৎসিততম বৈকি! মায়ের বুক থেকে সন্তানকে কেড়ে নেওয়ার মত কুৎসিত পাপ আর কি আছে জগতে?

    অস্ফুটবাক্ শিশু।

    অর্থহীন দু একটি শব্দে শুধু মাকে বোঝতে শিখেছে ইচ্ছে অনিচ্ছে, চাওয়া না-চাওয়া। টলে টলে হাঁটে, দু চার পা গিয়ে বসে পড়ে। সাদা শিল্কের রিবন আঁটা লাল শাটিনের একটি ফ্রক পরা।

    উনিশ বছর পরেও সেই শাটিনের ফ্রকটার গড়ন মনে করতে পারছে সুমন্দা। হয়ত উনিশ বছর ধরে মনে করেছে বলেই মনে করতে পারছে।

    সেই ফ্রকটাকে কি হারিয়ে ফেলেছে ওরা? পরিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে? জীর্ণবিবর্ণ হতে হতে কোন এক সময় ধূলোর সঙ্গে মিশে গেছে? সুনন্দা আর কোনদিন দেখতে পাবে না সেই ফ্রকটাকে?

    কিন্তু ফ্রকটার ছবি সুনন্দার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে ফেলছে কেন?

    উনিশ বছর ধরে শুধু সেই লাল শাটিনের ফ্রকটাকেই কি মনে মনে লালন করেছিল সুনন্দা? তার জন্যেই অধীর হয়েছিল? আবেগে কম্পিত হয়েছিল?

    ব্রজনাথ বললেন, আপনি কি অসুস্থতা বোধ করছেন মিসেস রায়। জল খাবেন?

    সুনন্দা মাথা নাড়ল।

    তাহলে তাকিয়ে দেখুন। দেখুন আপনার সেই সবে পাতাধরা চারা গাছটুকু কী সুন্দর হয়ে উঠেছে! কী লাবণ্য, কী সুষমা!

    কবির মত করে কথা বলছেন ব্রজনাথ। সুনন্দার জন্যেই বলছেন। সুনন্দাকে সহজ করে তোলবার জন্যে, সচেতন করার জন্যে।

    তবু সহজ হতে, সচেতন হতে দেরি লাগছে সুনন্দার।

    শেষ পর্যন্ত জলই খেল এক গেলাস। পুরো এক গেলাসই খেল।

    ব্রজনাথ আনালেন বেয়ারাকে দিয়ে।

    জল খেয়ে আস্তে মেয়েটির দিকে হাত বাড়াল সুনন্দা। বলল–এস, কাছে এসে বসো।

    না, ওর থেকে বেশি কিছু বলতে পারল না সুনন্দা।

    সুনন্দার থেকে মাথায় লম্বা, এই কালোপাড় সাদা শাড়ি আর প্লেনকালো ব্লাউজ পরা কুড়ি বছরের তরুণী মেয়েটার মধ্যে সেই লাল শাটিনের ফ্রকটাকে খুঁজে পেতে দেরি লাগছে সুনন্দার।

    ব্রজনাথ বললেন, লজ্জা পাচ্ছ কেন সীমা, সবই তো শুনে এসেছ তুমি। দেখ এই তোমার মাকে। এত ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও কী দুঃখিনী! একটি মাত্র সন্তান, সবেধন নীলমণি। তাকে হারিয়ে ফেললেন। চোরে চুরি করে নিয়ে গেল। ভেবে দেখ সীমা, কী অসহায় সেই যন্ত্রণা, তারপর থেকে এই উনিশটি বছর সেই তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে এসেছেন উনি। এতদিনে সমুদ্রের তীর দেখা গিয়েছে, রাত্রির শেষ হয়েছে। তুমি এসেছ তোমার মা-র কাছে। এখন তুমিই পারবে স্নেহ আর সেবা দিয়ে ওঁর এই দীর্ঘকালের যন্ত্রণার ক্ষত দূর করতে, ওঁর হাহা করা মনকে ভরিয়ে তুলতে।

    ব্রজনাথ এ বাড়ির উকিল মাত্র।

    তবু ব্রজনাথ সুনন্দার চরম দুঃখের পর পাওয়া এই পরম সুখের দিনে যেন আবেগে প্রকম্পিত হচ্ছেন।

    কিন্তু সুনন্দা বিহ্বল। সুনন্দা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

    সুনন্দা সীমাকে টেনে নিয়ে চেপে ধরতে পারছে না সেই হাহা করা বুকটায়। অথচ ব্রজনাথ যখন বার্তাটি এনেছিলেন? যখন নরম নীচু গলায় বলেছিলেন অদ্ভুত একটা খবর আছে মিসেস রায়!

    তখন? তখনও কি সুনন্দা অমন বিহ্বল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিল?

    না। তা তাকায় নি।

    তখন মুহূর্তের মধ্যে ছিটকে উঠেছিল সুনন্দা। তীব্র তীক্ষ্ণ বুকচেরা একটা স্বর বলে উঠেছিল, আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করতে এলেন ব্রজনাথবাবু?

    ব্রজনাথ হেসেছিলেন।

    শ্রদ্ধা স্নেহ আর করুণার সংমিশ্রণে গঠিত একটু মৃদু হাসি। তারপর বলেছিলেন, ঠাট্টা করবার আমার কি সাধ্য বলুন? ঠাট্টা যা করবার স্বয়ং বিধাতা পুরুষই করছেন। তবে মানুষের পক্ষে বড় মর্মান্তিক সেই ঠাট্টা। তবু–তবুও আমি বলব মিসেস রায়, দেরিতে হলেও তিনি যে তার ভুল সংশোধন করেছেন, এর জন্য তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

    সেদিন ভয়ঙ্কর রকমের বিচলিত হয়ে উঠেছিল সুনন্দা। উনিশ বছর আগের সেই দুরন্ত শোক যেন নতুন করে তাকে উন্মাদ করে দিয়েছিল।

    সেদিন সুনন্দা এলোমেলো হয়ে উঠেছিল।

    ব্রজনাথ বলেছিলেন, স্থির হোন মিসেস রায়! স্থির হোন। ভগবানের অসীম করুণাকে স্মরণ করুন, কৃতজ্ঞতা জানান। এই আশঙ্কা করেই আমি আপনার হারানো সন্তানকে একেবারে আপনার কাছে এনে হাজির করি নি। জানতাম আপনি চট করে নিজেকে চেক করতে পারবেন না। আর সেও

    ঢোক গিলেছিলেন ব্রজনাথ, তারপর আরও শান্তস্বরে বলেছিলেন সেও আতঙ্কিত হবে। …এটাই ভাল হবে যে একটা দিন সময় পাবেন আপনি, মনকে প্রস্তুত করতে। কাল আসবে সে আমার সঙ্গে।

    তখন সুনন্দা ব্যাকুল হয়েছিল, উদ্ভ্রান্তের মত বলেছিল–না না, আজই আনুন তাকে।

    ব্রজনাথ তা আনেন নি। ব্রজনাথ বুঝিয়েছিলেন তাতে সুনন্দার ক্ষতিই হবে। কারণ সে যদি এত আবেগ এত ব্যাকুলতা দেখে ভয় পায়, হয়তো সহজে কাছে আসতে পারবে না।

    একটা দিন সময় নিয়েছিলেন ব্রজনাথ, আজ এনেছেন সীমাকে।

    তার পালয়িত্রী মা যে নাম দিয়েছিল তাকে সেই নামেই এসে দাঁড়িয়েছে সে। কিন্তু সুনন্দার দেওয়া, ওর নিজের মা-র দেওয়া যে একটা নাম ছিল, সেটা কি মুছে গেছে? একেবারে ভুলে গেছে সুনন্দা?

    না। সুনন্দার অস্থিমজ্জায় দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে মিশে আছে সে নাম। সেই নাম বহাল হবে আজ থেকে সীমার।

    সেই নামেই প্রথম ডাকল সুনন্দা।

    যখন তার থরথর করা বুক একটু স্থির হল, যখন তার কথা বলবার সহজ স্বর ফিরে এল, তখন সোফা থেকে উঠে ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে দুটি হাত ওর দুকাঁধে রেখে বলল, তুই আমার কাছে আসতে ভয় পাচ্ছিস? তুই যে আমার টুলু। আমার টুলা।

    ব্রজনাথ উদ্বেলিত হয়ে উঠছেন, ব্রজনাথ চেয়ারে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না। ব্রজনাথ উঠে দাঁড়ালেন। গলা থেকে কেমন একটা শব্দ উঠল।

    যেন এই মুহূর্তটাকে একটা নাট্যমুহূর্তে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ভিতরটা নিসপিস করছে ব্রজনাথের। ব্রজনাথ কি সীমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দেবেন সুনন্দার বাহুবন্ধনের মধ্যে?

    দিতে হল না। প্রাকৃতিক নিয়মেই গড়ে উঠল নাট্যমুহূর্ত। সীমা সুনন্দার বুকে এলিয়ে পড়ল।

    সুনন্দা সীমাকে সেই বুকের মধ্যে মিলিয়ে নিতে চাইল। বুঝি বা পিষে ফেলতে চাইল। –টুলু! টুলা! আমার টুলটুল! মা বল, মা বলে ডাক একবার।

    মা!

    বড় রকমের একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল ব্রজনাথের রুদ্ধশ্বাস বুক থেকে।

    ব্রজনাথ আশঙ্কায় কণ্টকিত ছিলেন এতক্ষণ। ভাবছিলেন মিলনের প্রথম লগ্নটা যদি ব্যর্থ হয়, পরম প্রাপ্তির অনুভূতিটা যদি দেখা না দেয়, গান কি ঠিক সুরে বাজবে?

    ব্রজনাথ এ সংসারের আত্মীয় নন। ব্রজনাথ উকিল মাত্র।

    কিন্তু ব্রজনাথ কি আত্মীয়ের বেশি নয়?

    সুনন্দার স্বামী শোভন রায় কি চিরদিন তার এই হিতৈষী বন্ধুটিকে বড় ভাইয়ের শ্রদ্ধা সম্মান দিয়ে আসেন নি? অবশ্য ব্রজনাথ খুব বেশি গায়ে-পড়া কোনদিনই নয়। শোভনলাল যতই ঘনিষ্ঠতার বন্ধনে বাঁধতে চেষ্টা করুন, ব্রজনাথ সাধ্যমত সম্পর্কের দূরত্ব বজায় রেখে এসেছেন। অন্তত শোভনলালের অন্তঃপুরে ঢুকে দাদার পোেস্টটা কায়েমী করে ফেলবার ঝোঁক তার কোনদিনই দেখা যায় নি।

    সে ঝোঁক থাকলে হয়তো অবস্থা অন্যরকম হত।

    কিন্তু ব্রজনাথ অবস্থাকে স্বাভাবিক সৌজন্যের রীতিতেই চালু রেখেছেন। শোভনলালের মৃত্যুর পর থেকে সুনন্দার সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে হয়, কিন্তু বাইরের দিকের বসবার ঘরে ছাড়া বসেন না কোনদিন।

    মিসেস রায় ছাড়া সম্বোধন করেন না কখনো।

    তবু হৃদয়ের আবেগ মাঝে মাঝে প্রকাশ হয়ে পড়ে। শ্রদ্ধার আবেগ, স্নেহের আবেগ, সুনন্দার ভাগ্যহত জীবনের জন্য করুণার আবেগ।

    হ্যাঁ, ভাগ্যহত বৈ কি। প্রভূত ঐশ্বর্যের মাঝখানে বসেও সুনন্দা হতভাগিনী। কে কবে শুনেছে, কটা দিনের জন্যে বিদেশে বেড়াতে গিয়ে কেউ একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আসে?

    মৃত্যু নয়। চোর!

    চোরে চুরি করে নিল সুনন্দার বুকের মাণিকটুকুকে। উনিশ বছর আগের তরুণী সুনন্দা, নতুন মা হয়েছে। সেই মাতৃত্বের গৌরবে আর পুলকে সর্বদা ছল ছল করছে।

    টুলু যা কিছু করে, তারই এক আবেগময় ব্যাখ্যা করতে ছুটে আসে শোভনের কাছে। বলে, কী ছাইয়ের কাজ আর কাজ। বেড়াতে এসেছ তাও কাজ। দেখ তো এসে টুলু কেমন করে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে।

    শোভন বলত–তুমি এত বেশি দেখছ যে আমার আর না দেখলেও চলবে।

    ইস, তাই বৈকি! ছিঁড়ে দেব তোমার দোকানের হিসাবের খাতা।

    তাহলে তোমার টুলুর রূপোর দোলনা-খাটের অর্ডারটা ক্যানসেল করা হোক?

    হেসে হেসে বলত শোভন বাতিল করা হোক জাপানী পেরাম্বুলেটারের বায়না?

    ভাল হবে না বলছি ওসব কথা বললে। ঠিক আছে। থাক তুমি তোমার সাধের ফার্নিচারের দোকান নিয়ে, আমার রইল টুলু।

    ভারি অস্থির ছিল সুনন্দা। ভারি চঞ্চল।

    আবার এক সময় ছুটে আসত, দেখ তো দেখ তো এই নতুন জামাটা পরে টুলাকে কেমন দেখাচ্ছে? উঃ বাবা, পথের শত্রু ফিরে চায় টুলুর দিকে, আর তুমি বাপ হয়ে একবার তাকিয়েও দেখ না।

    শোভন বলত, পথের শত্রু নই বলেই তো তাকাই না। বেশি দেখলে নজর লাগে জান না? নজরে নজরে ক্ষয়ে যায়।

    যায়! যত সব সেকেলে কুসংস্কার! ওই সব আবোল তাবোল বলে সাফাই গাওয়া হচ্ছে। ঠিক আছে, আমি আমার ধনকে নিয়ে বনকে যাব

    শোভন হেসে ফেলত, বনে যাবার বাড়তি একটা টিকিট তাহলে আমার জন্যে কিনো। তুমি যেমন তোমার টুলুকে এক মিনিট না দেখলে অজ্ঞান হও, আমি যে তেমনি

    বক্তব্যটা অবশ্য আর কথা দিয়ে শেষ করে না শোভন।

    সুনন্দা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আহা, কী তুলনার ছিরি হল?

    ছিরি না হোক, সত্যভাষণ হল। বলত শোভন।

    কিন্তু সে সত্য কি শেষ অবধি রাখতে পারলেন প্রৌঢ় শোভন রায়? পারলেন না, অনায়াসে ছেড়ে চলে গেলেন সুনন্দাকে। গেলেন বিনা নোটিসে।

    দোকান থেকে এসে বললেন, এক গ্লাস জল দাও। বললেন, শরীরটা কেমন করছে।

    ব্যস। তাকিয়েও দেখে গেলেন না সুনন্দার দিকে। ভেবেও দেখলেন না এতবড় বাড়িটায় একা সুনন্দা থাকবে কি করে?

    কিন্তু সেদিন, সেই আগেকার দিনে সুনন্দার জন্যে ভাবনার অন্ত ছিল না শোভনের। নিজের শোককে চাপা দিয়ে, সুনন্দার সমস্ত অভিযোগে অবিচলিত থেকে সুনন্দার সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন। নীরব সান্ত্বনায় ভরিয়ে রেখেছেন তাকে।

    তবু অবিরত একটা অভিযোগের ভাব মনে পোষণ করে এসেছে সুনন্দা টুলুর প্রতি শোভনের যথোপযুক্ত টান ছিল না, তাই ভগবান টুলুকে নিয়ে নিয়েছেন।

    বেচারা শোভন হয়তো নীরবই থেকেছে, হয়ত বা কখনও বলেছে, ভগবান নেননি সুনন্দা। নিয়েছে মানুষ।

    মানুষের কি সাধ্যি? ভেঙে পড়েছে সুনন্দা যদি ভগবান না বিমুখ হন?

    শোভন কোনদিন একথা বলে নি, কিন্তু সুনন্দা, তোমার ভালবাসাটা কি তাহলে একেবারে মূল্যহীন? তোমার ত্রুটিহীন ভালবাসার সাধ্য হল না ঈশ্বরকে প্রসন্ন রাখতে?

    তখন যে সুনন্দা শুধু কাঁদে। তখন তো আর সেই আগের সুনন্দা নয়।

    কিন্তু যখন আগের ছিল? সেদিন ছুটে ছুটে এসে শোভনকে ঠেলা মেরে সচেতন করে তুলে বলেছিল, কালকের সেই লাল শাটিনটা ফ্রক করে ফেললাম। দেখ–দেখ কী মার্ভেলাস দেখাচ্ছে টুলাকে!

    সেই ফ্রক পরে বেড়াতে গিয়েছিল টুলু চাকরের সঙ্গে।

    এ বাড়ির আরও সব চেঞ্জার প্রতিবেশীদের বাসার কাছাকাছি নিয়ে বেড়াবার হুকুম দিয়েছিল সুনন্দা।

    দেখুক, সবাই দেখুক তার টুলুকে। নজর লাগাকে বিশ্বাস করে না সে।

    কিন্তু সেদিন কেউ কি দেখেছিল সেই লাল শাটিনের আবরণে মোড়া গোলগাল পুতুলটিকে?

    না, কেউ সাক্ষী দিতে পারে নি, টুলু আর টুলুর চাকরকে দেখেছে।

    বাতাস হয়ে উড়ে গেল চাকরটা? মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়ে গেল?

    .

    ছেলে হারানোর ঘটনা পৃথিবীতে নতুন নয়। কত রকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই এ ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু নতুন নয় বলে কি মাতৃহৃদয়ের হাহাকার কিছু কম হয়?

    তবু সে হাহাকারের ওপর হয়তো স্তর পড়ে নতুন শিশুর আবির্ভাবে। হারিয়ে যাওয়া সন্তানের তুলে রাখা জামা জুতো খেলনা পুতুলগুলি আবার মাটিতে নামে গভীরতর নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে। যেসব বস্তু তাকে দিয়ে উঠতে পারা যায় নি, দেওয়া হয়নি, সে বস্তু সংগ্রহ করে এনে একে দিতে পারলেও যেন একটা শান্তি আসে। কথা প্রসঙ্গে একটি নিশ্বাসের সঙ্গে তার নামটুকু উচ্চারণ করা ছাড়া আর বড় কিছু থাকে না। কিন্তু সুনন্দার জীবনে আর নতুন শিশুর আবির্ভাব ঘটল না।

    তাই উনিশ বছর ধরে সেই লাল শাটিনের ফ্রকটি সুনন্দার মনের মধ্যে জীবন্ত হয়ে আছে একটি রক্তাক্ত বিদারণ রেখা টেনে রেখে।

    ডাক্তার বলেছিল, আর আশা নেই। প্রথম সন্তানের জন্মকালে ভিতরের যন্ত্র বিকল হয়ে গেছে। আশ্চর্য, সেই বিকলযন্ত্র দেহ আর বিকল মনটাকে নিয়ে অনায়াসে বেঁচে রইল সুনন্দা। আর শোভন রায় তাঁর অপরিসীম কর্মক্ষমতা আর অটুট স্বাস্থ্য নিয়েও ফেল করলেন হার্ট।

    শোভন বেঁচে থাকতেও ইদানীং কাজ-কারবার বিষয়-সম্পত্তি সবকিছুর দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন শুধু উকিল নয় ম্যানেজার ব্রজনাথকে। শোভন মারা যেতে তো আরোই দায়িত্ব পড়ল। সুনন্দা তো তাকিয়ে দেখা দূরে থাক, কানেও শোনে না। শোনাতে এলে শুনতে চায় না।

    প্রথম প্রথম ভারি বিপন্ন বোধ করতেন ব্রজনাথ। বলতেন, আপনি এভাবে আমার সঙ্গে নন কোঅপারেশন করলে আমার কি অবস্থা হয় বলুন তো?

    সুনন্দা বলত–ধরে নিন আমিও মারা গেছি!

    অদ্ভুত অবস্থায় কেটে গেছে ব্রজনাথের সেই দিনগুলো।

    সামান্য একটা সই করাবার দরকার হলেও সুনন্দার কাছে সাতবার আর্জি করতে হত।

    দাসী কখনো এসে বলত, মা ঘুমোচ্ছেন। কখনো বলত, ডাকতে পারলাম না, কাঁদছেন। কখনো বলত, দরজায় খিল লাগিয়ে বসে আছেন, একশো ডাকাডাকিতেও খুললেন না।

    অবশেষে একদিন ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করলেন ব্রজনাথআপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করেন মিসেস রায়?

    অবিশ্বাস!

    তা ছাড়া আর কি বলি বলুন? এক একটি সাইনের জন্যে এত অসুবিধেয় পড়তে হয় মাঝে মাঝে, নিশ্বাস ফেললেন ব্রজনাথ, আপনার দোকানের কর্মচারীরা কী যে ভাবে! যথাসময়ে মাইনে দেওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না–

    লজ্জিত হয়ে উঠেছিল সুনন্দা। মরমে মরে গিয়েছিল।

    ছি ছি, নিজের শোককে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে এত বড় করে তুলে যথেচ্ছাচার করেছে সে। কিন্তু তা করলে চলবে কেন? সত্যিই যখন সে যথাসর্বস্ব মিশনে দান করে দিয়ে সন্ন্যাসিনী হয়ে চলে যাচ্ছে না।

    চিরদিন বিলাসে অভ্যস্ত জীবন, কৃচ্ছসাধনের স্বরূপই জানে না ভাল করে। সে দিন থেকে চৈতন্য হল সুনন্দার।

    বিনা বাক্যে, বিনা বিলম্বে ব্রজনাথের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করল। কিন্তু সে কাজে কর্তব্য পালনই হয়, দিনের শূন্যতা পূর্ণ হয় না।

    ক্রমশই অসহনীয় হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গতা।

    একদিন ব্রজনাথকে ডেকে পাঠাল সুনন্দা। বলল, আর তো টিকতে পারছি না। ভাবছি আমার এক ভাইপোকে এনে কাছে রাখি।

    ব্রজনাথ একটু চিন্তিত হয়ে বলেন, রাখবেন, সে তো খুবই ভাল কথা, কিন্তু একটা বাচ্ছার দায়িত্ব

    সুনন্দা একটু হাসল। বাচ্ছা নয়।

    বাচ্ছা নয়? তবে?

    এঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে।

    ব্রজনাথের চোখে একটা ধূসর ছায়া পড়ল। কিন্তু কণ্ঠস্বর ছায়ামুক্ত, বরং যেন উৎফুল্ল।

    ওঃ তবে তো কথাই নেই, বরং আপনার দায়-দায়িত্ব দেখতে পারবে।

    সুনন্দা আর একটু হাসল, আমার দায়-দায়িত্ব দেখতে তো আপনিই আছেন, সে জন্যে না। এ শুধু আমার নিজের জন্যেই।

    হ্যাঁ, শুধু নিতান্ত টিকতে না পারার কষ্টটা লাঘব করতে চায় সুনন্দা। কিন্তু ব্রজনাথকে না জানিয়ে তো কোনও কাজই করে নি সুনন্দা শোভনলালের মৃত্যুর পর থেকে। তাই এই প্রশ্ন।

    ভাইপো!

    ভাইয়ের ছেলে!

    সুনন্দার দাদা বৌদিকে তো দেখেছেন ব্রজনাথ। সেই যে শোভনলালের আকস্মিক মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন প্লেনে করে।

    পুনায় থাকেন। মিলিটারিতে চাকরি করেন। ছুটি কদাচ মেলে।

    এসেছিলেন ভগ্নীপতির মৃত্যু সংবাদে, শ্রাদ্ধ শান্তি না ঢুকতেই চলে যেতে হয়েছিল। ছেলে মেয়ে অনেকগুলি, তাদের কাউকে নিয়ে আসেন নি, তাই কাউকে ব্রজনাথ দেখেন নি। যে ছেলেটির কথা বলছে সুনন্দা, সেটি সুনন্দার দাদা অলকেন্দ্রর মেজ ছেলে। তখন সে স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিচ্ছে। এখন ছেলেটি যাদবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে এসেছে, হোস্টেলে ভর্তি হয়েছে, তাই সুনন্দার ইচ্ছে হোস্টেলে না থেকে পিসির কাছে থাকুক।

    খুবই স্বাভাবিক ইচ্ছে, বলেছিলেন ব্রজনাথ, আপনার ঘর সন্তান সন্ততিতে পূর্ণ থাকলেও এ ইচ্ছে হতে বাধা ছিল না। এই তো নিয়ম সংসারের। নিকট আত্মীয় কলকাতায় থাকতে ছেলে হোস্টেলে থেকেই বা পড়বে কেন? কিন্তু কথা হচ্ছে–ব্রজনাথ বলেছিলেন, আপনার ভাইপো, বলাটা আমার সমীচীন হচ্ছে না, তবুও না বলে পারছি না মিসেস রায়, যা দেখছি আপনার ভাইপোর বয়েসটি বড় খারাপ, আর এই শহরটি ততোধিক খারাপ, এ ঝুঁকি নেওয়া সোজা নয়। হোস্টেলে থাকে চাপে থাকে, আপনার কাছে থাকা মানে বুভুক্ষু মাতৃহৃদয়ের উজাড় করা স্নেহের কাছে

    সুনন্দা মৃদু হেসেছিল। বলেছিল, স্নেহাস্পদের অকল্যাণ ডেকে আনবে, এমন অসঙ্গত স্নেহ আমি দেব না ব্রজনাথবাবু, আর বয়সের কথা বলছেন? সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সে ছেলে একটি হীরের টুকরো।

    আর তবে কোন যুক্তি থাকতে পারে ব্রজনাথের?

    –আপনার দাদার মত আছে তো?

    –রাজী করিয়েছি।

    অতঃপর সেই হীরের টুকরোটিকে বাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করল সুনন্দা।

    তা লেখায় পড়ায় আচারে আচরণে স্বভাব মাধুর্যে হৃদয়ের ঔদার্যে ছেলেটি হীরের টুকরোই বটে! সে এসে থাকার সঙ্গে সঙ্গে চাকর বাকরগুলো যেন তার চরণে হৃদয় সমর্পণ করে বসল।

    মাঝে মাঝে রায় কোম্পানি, অর্থাৎ ফার্নিচারের ওই দোকানটাতেও যায় উদ্দালক। তারাও ওর কমনীয় মুখ আর কোমল কথায় মুগ্ধ।

    আর সুনন্দা?

    সে তো ব্রজনাথের ভাষায় তার বুভুক্ষু মাতৃহৃদয়ের উজাড় করা স্নেহ দিয়ে ডুবিয়ে রেখেছে উদ্দালককে, ডুবে বসে আছে নিজে।

    শুধু ব্রজনাথই তেমন সুচক্ষে দেখেন না ছেলেটাকে। তার মনে হয় তার দিকে চোখ পড়লেই ও যেন ব্যঙ্গ হাসি হাসে।

    হয়তো তাঁর সেই ধারণাটা নেহাৎ ভুলও নয়। ব্যঙ্গ না হোক, কৌতুকের হাসি হাসে উদ্দালক, ব্রজনাথের ওই সাজানো সাধু ভাষায় গড়া কথা শুনে। বলে, উনি যেন সর্বদা ওঁর মাই লর্ডের সামনে কথা বলছেন। যেন ওঁর দুদিকে দুপক্ষের মক্কেল দাঁড়িয়ে আছে।

    এই কৌতুকটাকেই ব্যঙ্গ ভাবেন ব্রজনাথ, আর অপ্রসন্ন হন। কিন্তু অপ্রসন্ন হয়ে আর কি হবে। যতদূর দেখা যাচ্ছে, পাকাপাকি দত্তক না নিলেও, প্রায় পুষ্যিপুতুরই করে নিচ্ছে সুনন্দা উদ্দালককে। দেখা যাচ্ছে তার প্রথম সোপান।

    ব্রজনাথ অবশ্য বলেছিলেন একদিন, আপনার তো অনেকগুলি ভাইপো ভাইঝি, তা সবাইকে বঞ্চিত করে একজনকে দিলে, একটু অবিচার করা হবে না কি?

    সুনন্দা হেসে উঠেছিল বঞ্চিত করা বলছেন কেন ব্রজনাথ বাবু? তারা তো আর আমার এই সম্পত্তির ওপর দৃষ্টি দিয়ে বসে নেই? আমার দাদার অবস্থাও এমন কিছু খারাপ নয়, যথেষ্ট ভালই বরং। চারটি ছেলে তার, তাদের মধ্যে একজনকে যদি আমি একটু মেহদৃষ্টিতে দেখি, যদি তাকে কিছু দিই, আর সকলের ওপর অবিচার করা হবে কেন সেটা? তাছাড়া আর একটু হেসে কথার উপসংহারে এসেছিল সুনন্দা–তাছাড়া একেবারে বিনা স্বার্থেও তে দেব না আমি। আমার তো জীবনের শেষ পরিণতি আছে? ও আমাকে দেখবে। সম্পত্তিটা পেলে তো আমায় ফেলতে পারবে না?

    এ কথা শুনে অবশ্য ব্যঙ্গ হাসি হেসেছিলেন ব্রজনাথ। বলেছিলেন, ফেলতে পারবে না সেটা লিখিয়ে নেবেন?

    নাঃ, লিখিয়ে নেব না। শুধু অলিখিত একটা চুক্তি থাকবে দুজনের মধ্যে।

    আমাকে মাপ করবেন মিসেস রায়, বলেছিলেন ব্রজনাথ, আপনার সরলতা আমার শ্রদ্ধা উদ্রেকের চাইতে হাস্যোদ্রেকই করছে। আমরা ল-ইআররা যেখানে বাস করি, সেটা হচ্ছে মনুষ্য

    জগতের ভিতর পিঠ। যেখানে পালিশ নেই, মলাট নেই, একেবারে উগ্র নগ্নতা। তাই আপনার এই সরলতাকে প্রশংসা করতে পারছি না। নিজের গর্ভজাত সন্তানই মাকে কত ঠকায়, সে খবর রাখেন আপনি?

    সুনন্দার মুখটা একটু লাল হল। বলল–তেমন দুর্ভাগ্য হলেও তো করবার কিছু থাকে না ব্রজনাথ বাবু! তবু বলব এ সন্দেহ করলে, আমার পিতৃবংশের সম্ৰান্ততার প্রতি অবিচার করা হবে।

    ক্ষমা চাইছি আমার ধৃষ্টতার জন্যে, মিসেস রায়, তবু আপনার কাছে হাতজোড় করছি, এখুনি একেবারে যথাসর্বস্ব দান করে বসবেন না, এখনো আপনার জীবনের অনেক বাকী।

    তা সুনন্দাও অবশ্য তখুনি সর্বস্ব ত্যাগ করতে বসে নি, শুধু ওই অলিখিত চুক্তি রচিত হচ্ছিল, উদ্দালকের সঙ্গে যতটা না হোক, তার মায়ের সঙ্গে।

    ছেলে বড় জিনিস!

    দশটি থাকলেও কারও মনে হয় না–অনেকগুলো আছে একটা বিলিয়ে দিই। অথবা আমার তো অনেক আছে, ওর নেই, ওকে দান করি।

    দত্তক যারা দেয়, কোন প্রাণে দেয় কে জানে। তবে দিয়েদিলাম না, অথচ আমার ছেলেটিকে কেউ একটু বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখে প্রাণ ঢেলে দিচ্ছেগুচ্ছে, সেটা মন্দ নয়।

    সুনন্দার ভাজও সেই হিসেব হাতে রেখেছেন। এমনিতে তো এঞ্জিনিয়ার ছেলে তার আঁচলতলায় বসে থাকবে না, দেশ বিদেশে ছুটবেই। কাছছাড়া তো হলই পড়ার শুরু থেকে। তা এই কাছছাড়া বাবদ যদি দুর্ভাগিনী ননদটার একটু শান্তি হয়, সেটা মহৎ লাভ। আবার সে বাবদ যদি ছেলেটার ভবিষ্যৎ জীবন পথ আরও মসৃণ হয়, সেটাও কম লাভ নয়।

    তাই ক্রমশই উদ্দালক পিসিমার সম্পত্তিতেই পরিণত হচ্ছে।

    ছুটি হলে মা বাপের কাছে যায়।

    তাও সব সময় পুরো ছুটিটা কাটিয়ে আসে না। সুনন্দার দাদা লেখেন, বালগোপাল তো মা যশোদাকে ছেড়ে থাকতেই পারে না দেখছি, এসেই যাই যাই করছে।

    তা সবটাই যে একেবারে পিসিমার প্রতি বিগলিত স্নেহ তাও নয়। কলকাতার খেলাধূলো বন্ধু আচ্ছা, এ বাড়ির সর্বেসর্বা হয়ে থাকার পরিতৃপ্তিময় স্বাধীনতার সুখ, এগুলোও কম কাজ করে না।

    এসবের আকর্ষণ অনেক।

    তাছাড়া উদ্দালুকের স্বভাব দরদী মন সুনন্দার নিঃসঙ্গতাকে সূক্ষ্ম তারে অনুভব করতে পারে।

    কখনো কখনো বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে কখনো কখনো ছাদে পাটি পেতে চুপচাপ শুয়ে থাকে সুনন্দা। যেন আপনাকে অনন্ত শূন্যতার মাঝখানে হারিয়ে ফেলে।

    তখন উদ্দালক এসে কাছে বসে। তখন তোলে সেই মেয়েটার কথা। সেই উনিশ বছর আগের কথা।

    ও যেন অনুভব করে এই মুহূর্তে এ আলোচনার প্রয়োজন আছে। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই সব প্রশ্নই করে, আচ্ছা পিসিমা ছবি নেই কেন?

    একটা নিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছিল বাবা, কত ছিল। পুরো একটা অ্যালবামই ছিল। পুলিস থেকে চাইল, তখন আশায় পড়ে বুক ছিঁড়ে দিয়ে দিলাম। আর ফেরত দিল না। কতদিন ধরে ঘোরালো তারপর বলল হারিয়ে গেছে। মেয়েও গেল, তার চিহ্নটুকুও গেল।

    আশ্চর্য! আচ্ছা, যে স্টুডিও থেকে তুলিয়েছিলে? তাদের কাছে তো নেগেটিভ থাকে?

    সে খোঁজেও ত্রুটি হয় নি বাবা। তোমার পিসেমশাই শেষকালে খুবই চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্য প্রবল হলে যা হয়। শুনলাম সে স্টুডিওই উঠে গেছে লোকসানের দায়ে। তার মালিকের কোনও পাত্তা পাওয়া যায় নি।

    আচ্ছা পিসিমা, তোমার কি মনে হয়?

    আগে কত কি-ই মনে হত বাবা, আবার কিছুই মনে হত না। সব কেমন ঝাপসা হয়ে যেত। মারা গেছে, চাকরটার সুষ্ঠু কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, ভাবতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু ঝাঝার মত অতটুকু টাউনে ওরকম একটা কিছু ঘটলে সে কি চাপা থাকত?

    পুকুর-টুকুর ছিল না?

    নাঃ, পুকুর কোথা?

    শুকনো কুয়ো-টুয়ো

    সব দেখা হয়েছিল। লোক লাগিয়ে কাঁটা নামিয়ে।

    ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই কথা।

    আবার একসময় সুনন্দাই বলত, ভাবি সে আমার জিনিস ছিল না। থাকলে থাকত। এখন ভগবান তোকে বাঁচিয়ে রাখুন, সুস্থ রাখুন।

    দুধের সাধ কি আর ঘোলে মেটে পিসিমা? হেসে উঠত উদ্দালক।

    সুনন্দা বলে–তুই আমার ক্ষীর। আবার একটু পরে হয়ত বলত যাকগে ওসব কথা থাক। তুই বরং একটা গান গা।

    গান! আমার আবার গান?

    তা হোক। বেশ তো গাস তুই।

    তা গায় উদ্দালক। শুধু গলায়। গলা ভাল সেইটুকুই কাজে লাগে।

    এইভাবেই চলছিল। হয়ত এইভাবেই চলত। হঠাৎ নিস্তরঙ্গ জলে এসে পড়ল প্রকাণ্ড এক পাথরের চাই।

    সে পাথর ফেললেন ব্রজনাথ।

    ব্রজনাথ এসে সুনন্দাকে নিভৃতে ডেকে বললেন, অদ্ভুত একটা খবর আছে মিসেস রায়!

    কী সেই খবর? যা একা সুনন্দাকে নিভৃতে ডেকে শোনাতে হয়? কারও কোনও ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতায় কি রায় কোম্পানি দেউলে মেরে যেতে বসল?

    প্রথম মুহূর্তে সেই কথাই ভেবেছিল সুনন্দা। সঙ্গে সঙ্গে মনকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিল সেই বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী শোনবার জন্যে! কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনীর পরিবর্তে এতবড় একটা অবিশ্বাস্য কাহিনী শোনাবেন ব্রজনাথ একথা কে ভেবেছিল। উনিশ বছর আগের সেই রহস্যের যবনিকা উত্তোলিত হয়েছে। সেই অন্তহীন অন্ধ প্রশ্নের উত্তর মিলেছে।

    একটা অসাড় চিত্তের পৃষ্ঠপটে কে যেন চকিত বিদ্যুতের ঝিলিক হানছে।… আলোর বুদ্বুদ উঠছে মিলিয়ে যাচ্ছে। আলোর কমলের ওপর এসে এসে পড়ছে কুয়াশার আস্তরণ।

    বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের আলোছায়া। আশা-নিরাশার আলোছায়া। সুনন্দা ব্যাকুল হচ্ছে।

    তারপর কী হল আগে বলুন–বলে বলে চিৎকার করে উঠছে সুনন্দা।

    কিন্তু ব্রজনাথ দ্রুতছন্দে আসছেন না। ব্রজনাথ থেমে থেমে রয়ে রয়ে সেই অবিশ্বাস্য কাহিনী ব্যক্ত করছেন।

    .

    ব্রজনাথ বলছেন, উনিশ বছর আগে ছোট সেই টাউনটায় আরও একজন গিয়েছিল। এক সন্তানক্ষুধাতুরা বন্ধ্যানারী।

    কিন্তু কেন গিয়েছিল? হাওয়া বদলাতে? নাকি সুনন্দার সঙ্গে পূর্বজন্মের শত্রুতা সাধতে? ঈশ্বর জানেন গত জন্মে কে কার কাছে অপরাধী ছিল। কে কার নিমিত্ত হল।

    বন্ধ্যা নারী। একটি শিশুর বাসনায় উন্মাদ। সেই অতৃপ্ত হাহাকারের উপর আর এক শূন্যতার হাহাকার, স্বামী বিমুখচিত্ত। স্বামী উম্মুঙ্খল।

    সেই মন নিয়ে ঈশ্বরের সাধনা করতে পারত সে। পারত লোকসেবায় মন দিতে। কিন্তু তা পারে নি সে। একটি কচি কোমল শিশুদেহের কল্পনা তাকে উন্মাদ করে দিত। সেই উন্মাদনার মুখে, দেখতে পেল টুলুকে। কেমন করে যেন একদিন সুনন্দার চাকর গিয়ে পড়েছিল তাদের বাড়ির সামনের বাগানে।

    চোখ জ্বলে উঠল উন্মাদিনীর। হাতছানি দিয়ে ডাকল চাকরটাকে।

    তারপর ধীরে ধীরে সেই হাতছানি দেওয়া হাত এগিয়ে এল টাকার তোড়া নিয়ে। চাকরটাকে হাত করতে দেরি হল না অতএব।

    যে সন্ধ্যায় সেই হিতাহিত জ্ঞানহীনা ধর্মাধর্ম জ্ঞানহীনা নারী ওই ছোট্ট টাউনটা থেকে পালাবে, পালিয়ে গিয়ে মিলিয়ে যাবে একটা বিরাট শহরের অগাধ জনসমুদ্রের মধ্যে, সেইদিন বিকেলে লাল শাটিনের ফ্রক পরে বেড়াতে বেরিয়েছিল টুলু চাকরের সঙ্গে।

    অনেক টাকা নিয়ে দেশে চলে যেতে পারলে, বিবেককে দাবানো যায় বৈকি। মহা মহা শিক্ষিত লোক দাবাচ্ছে, ভাল ভাল ন্যায়-নীতিজ্ঞরা দাবাচ্ছে, বড় বড় আইনের ধ্বজাধারীরা দাবাচ্ছে, আর এ তো সামান্য একটা চাষার ঘরের ছেলে।

    টাকাটা নিয়ে গিয়ে দেশে বিঘেকয়েক জমি আর দুটো মোষ কিনতে পারলেই তো একজন গৃহস্থ হয়ে বসা যায়। ছেড়ে আসতে হয় না নবপরিণীতা বধূকে, দারিদ্রগ্রস্ত মা-বাপ ভাই বোনকে।

    আর? আর জীবনভোর মনিবের জুতো ঝাড়তে হয় না। হয় না সে জুতোর ঠোক্কর খেতে।

    সামান্য একটু বিবেকের কামড়। তার বেশি আর কিছু না। মেয়েটাকে মেরেও ফেলছে না, কেটেও ফেলছে না। পথেও ফেলে দিয়ে যাচ্ছে না।

    একটা মা-র কাছ থেকে আর একটা মা-র কাছে গচ্ছিত রাখছে।

    চাকরটা মনে মনে কী ভেবেছিল, তার ব্যাখ্যা ব্রজনাথই করেন এইভাবে। আরও বলেন, –ব্যাটা বোধহয় ভেবেছিল আপনার তো তবু আবার হবার সম্ভাবনা আছে। এই মানুষটার সে দিনও নেই আর। বয়সে মেয়েমানুষটা নাকি আপনার মায়ের বয়সী।

    তারপর কী হল বলুন আগে।

    তারপর?

    তারপরের কথা তো আর পরপর জানেন না ব্রজনাথ। ব্রজনাথের এক ডাক্তার বন্ধু তার এক রোগিণীর মৃত্যুকালের স্বীকারোক্তির সূত্রে এই নাটকীয় কাহিনী শুনিয়েছিলেন ব্রজনাথকে।

    ব্রজনাথকে সব বলে বলেছিলেন, আমার তো মনে হচ্ছে এই মেয়েই আপনার সেই শোভন রায়ের মেয়ে। স্থান-কাল-পাত্র সবই তো মিলে যাচ্ছে হুবহু।

    এমন কি মৃত্যুপথযাত্রী নাকি এ কথাও বলেছে–লাল টুকটুকে জামা পরা সেই মেয়েটাকে বুকে চেপে ধরা মাত্র মনে হল, এ যেন আমারই জন্মজন্মান্তরের। লাল টুকটুকে জামাটাও কি মিলে যাবে অন্যের সঙ্গে?

    এই সেই মেয়ে। আবার বলেছিলেন ব্রজনাথ।

    একবছরের অস্ফুটবাক্ শিশুটি আজ কুড়ি বছরের ভরন্ত যুবতী।

    রং? তা সেই দুধে শিশুর গোলাপী রং কি আর বজায় থাকে চিরকাল? তাছাড়া অনেক ঐশ্বর্যে ভরিয়ে রাখবার সংকল্প নিয়ে মেয়ে চুরি করেছিল যে, সহসা নিজেই সে হয়ে গেল গরীব। স্বামী মারা গেল। গেল আরও অনেক কিছু–দুঃখের সাগরে ভাসল মেয়েটাকে নিয়ে।

    কিন্তু তার পরিচয়? ডাক্তার জানে না?

    ওইটি প্রশ্ন করা চলবে না। সেই ডাক্তার বন্ধু বলেছিল ঘাড় নেড়ে, তা হয় না। সে বলা যায় না। তুমি তো জানো ভাই আমাদের ব্যবসার মূলমন্ত্র। ডাক্তার আর উকিল, এদের পেট আলগা হলে চলে না। রোগীর আর মক্কেলের লুকোনো কথা সযত্নে গোপন করতে হয়।

    তা বলে এত বড় একটা অপরাধের কথাও?

    তাতে কি। তুমি উকিল, তুমি আবার ধর্মকথা কইছ কোন্ মুখে? খুনীকে সাধু আর সাধুকে খুনী সাজানোই যাদের পেশা।

    কিন্তু

    ওর আর কিন্তু নেই। বুঝলাম জঘন্য অপরাধ। গর্হিত অপরাধ। কিন্তু আর কি সেই অপরাধিনীকে এনে তোমাদের ধর্মাধিকরণের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে? সুপ্রীম কোর্টের অনেক ঊর্ধ্বে আর এক মহাবিচারকের যে বিচারশালা, সেখানের কাঠগড়া আছে তার জন্যে।

    সুনিপুণ ভঙ্গিমায় আলঙ্কারিক ভাষায় সমস্ত ঘটনা উদঘাটিত করলেন ব্রজনাথ। জানালেন এখন সম্প্রতি মেয়েটি আছে সেই মৃতা মহিলাটির পরিচিত একটি দরিদ্র পরিবারে। ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না তাদের, এর উপর আবার একটা পরের মেয়েকে পোষা! যতই মোটা ব্যবস্থায় থাক, তবু

    শিউরে উঠেছিল সুনন্দা। তার টুলুর সম্পর্কে এই অবহেলাকর উক্তিতে প্রাণটা করকর করে উঠেছিল তার।

    যে সুনন্দার বাড়িতে পাঁচ ছটা ঝি-চাকর রাজার হালে খাচ্ছে মাখছে, সেই তার টুলু রেশনের মোটা চালের ভাত খাচ্ছে, মোটা ক্যাটকেটে শাড়ি পরছে!

    তবে হাঁ। সেই পালিকা মা এইটুকু করে গেছেন টুলুর। একটু লেখাপড়া শিখিয়ে গেছেন। নেহাৎ মুখ করে রেখে যাননি। ইন্টারমিডিয়েট অবধি পড়িয়েছিলেন তিনি। তারপর তো হয়েই গেল তার। এখন ওই উদ্বাস্তু কলোনিতে

    উথলে উঠেছিল সুনন্দা।

    আপনি এখনি নিয়ে আসুন।

    ব্রজনাথ বললেন, না মিসেস রায়, সেটা ঠিক হবে না। এতদিনই যখন গেল, একটা দিনে আর–

    আপনি কেন এতদিন পরে বললেন?

    কী মুশকিল! শোনামাত্রই তো আপনাকে শুনিয়ে একটা এলোমেলো কাণ্ড করতে পারি না। যদি বাজে খবর হয়? যদি অন্য মেয়ে হয়? আপনাকে বৃথা আশায় কম্পিত করেনা মিসেস রায়, সেটা আমি যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করি নি। সব খোঁজ নিয়ে, জেনে বুঝে নিঃসংশয় হয়ে তবে। হ্যাঁ তবেই বলেছেন ব্রজনাথ, এবং একটা দিন প্রস্তুত হতে সময়ও. দিলেন মা মেয়েকে।

    .

    আজ নিয়ে এসেছেন।

    আজ সুনন্দার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছেন, এই সেই মেয়ে।

    এখন কি নাম তোমার?

    মেয়েটি এবার মুখ তুলে স্পষ্ট গলায় বলল, সীমা সেন।

    না না, সেন নয়। আজ থেকে তুমি রায়।

    তাহলে আমার ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট বদলাতে হবে!

    সীমার এই স্পষ্ট ধরনের বাস্তব কথায় সুনন্দা কি একটু চমকালো? ভাবল কি, এর মধ্যে টুলু কোথায়?

    কিন্তু ব্রজনাথ তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গকে সামলে নিলেন। বললেন, ওসব তোমার ভাবতে হবে না মা! ওর জন্যে আমি আছি। করতে তো এখন অনেক কিছুই হবে। রায় কোম্পানির এতবড় বিজনেস, এই সব বিষয় সম্পত্তি সব কিছুরই তো মালিক হলে তুমি এখন।

    সীমাকে অন্তঃপুরে নিয়ে এল সুনন্দা।

    স্নেহটা উথলে উঠতে গিয়ে কেমন যেন পিছিয়ে আসছে। এ যে সম্পূর্ণ আস্ত একটা মানুষ। একে তিল তিল করে গড়ে তোলবার তো কোথাও কোনখানে অবকাশ নেই।

    আর, ওর মনের আবরণ? এই কুড়ি বছরের জল হাওয়া পরিবেশ পরিস্থিতিতে গঠিত কঠিন সেই আবরণ ভেদ করে ঢুকতে পারবে সুনন্দা ওর অন্তরে? না কি প্রতিহত হয়ে ফিরে আসবে সুনন্দার হৃদয়? তবু চেষ্টা করতে হবে বৈকি। সে চেষ্টায় জয়ীও হতে হবে সুনন্দাকে।

    ছেলের বিয়ে দিয়েও আস্ত একটা মানুষকে তো ঘরে আনে লোকে। তার হৃদয় স্পর্শ করতে চেষ্টা করে।

    .

    এই তোমার ঘর। কাল সারাদিন ধরে গুছিয়েছি। সুনন্দা ওকে হাত ধরে খাটের ওপর বসাল।

    চারিদিকে চোখ ফেলে দেখে সীমা। তার পরিচিত জগতের বাইরের সব বস্তু, বিলাসিতার উপকরণ। এরকম ঘরদোর জানলা মেজে খাট বিছানা আসবাব আয়োজন আর কোথাও দেখেছে সীমা?

    দেখেছে। সিনেমার ছবিতে। দৈবাৎ এক আধদিন পরের পয়সায়। তা ছাড়া আর কোথাও না। কি সীমার জীবনটাও তো নাট্যকাহিনীর পর্যায়ে পড়ছে। সিনেমার ছবির মতই আশ্চর্য কাণ্ড ঘটছে।

    এই দেখ, এইটে বাথরুম। এর মধ্যে তোমার যা যা দরকার সব জিনিসই পেয়ে যাবে।

    সীমা তাকিয়ে দেখে হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে বলে, এসবের কিছুই দরকার হবে না আমার।

    দরকার হবে না! দরকার হবে না কেন? সুনন্দা আহত দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়েটার এত খটখটে কথা কেন?

    সীমা হেসে উঠে বলে, দরকার হবে না কেন জানেন? জীবনেও কখনো ওসব জিনিস চোখে দেখি নি বলে। ব্যবহারই জানি না এত সবের।

    ও, এই কথা। সুনন্দার স্নেহের সমুদ্রে জোয়ার ওঠে। আহা বাছা রে! কত কষ্টের মধ্যে মানুষ হয়েছে! কত দুঃখে কাটিয়েছে এতগুলো দিন! কথাবার্তাও ঠিক খটখটে নয়। কৃত্রিমতা বর্জিত, সরল। একেবারে সরল। সুনন্দাও অতএব হাসে।

    অভ্যাস হতে আর কতক্ষণ লাগবে? এই তো, এইটা হচ্ছে শাওয়ারের ট্যাপ, এইটা স্নানের টবের

    সীমা সেদিকে না তাকিয়েই বলে, আপনার বাড়িতে তো অনেক ঝি-টি থাকবার কথা, নেই? তাদেরই কাউকে পাঠিয়ে দিন না। আপনি কেন এত কষ্ট করছেন?

    ঢেউ ফিরে আসে।

    সুনন্দা আহত কণ্ঠ গোপন করতে পারে না। বলে, এতে আমার কষ্ট হচ্ছে ভাবছ কেন? আমার কত আনন্দ আজ। আর আমাকে আপনি বলছ কেন? আমি তোমার মা। তুমি বলবে।

    নিজেই যে তুই বলতে গিয়েও বলতে পারছে না, তুমি বলছে, সেটা মনে পড়ে না সুনন্দার।

    সীমা ওর ওই আহত কণ্ঠে বোধকরি একটু অপ্রতিভ হয়। তাই মাথাটা নীচু করে বলে, সময় লাগবে।

    .

    সময় লাগবে। সময় লাগবে! কিন্তু সময় লাগলে কি চলে? অনেক সময় যে বয়ে গেছে।

    দাসদাসী আশ্রিত অনুগত আত্মীয় প্রতিবেশী সবাই এসে দাঁড়াচ্ছে, দেখছে, প্রশ্ন করছে। অধিক প্রশ্ন করা অবশ্য সুনন্দার নিষেধ। ছোট ছোট প্রশ্ন। নাম কি, কোন্ পাড়ায় থাকতে এতদিন, কতদূর পড়েছ, এই সব।

    নাম?–তা নাম তো শুনেইছ সবাই, সীমা।

    কোন্ পাড়ায় থাকত? একটা পাড়ায় তো আর আজীবন নয়। পূর্ববঙ্গ থেকে যখন চলে এসেছিল, কত ঘাটের জল খেতে হয়েছিল তখন ওর পালক পিতামাতাকে।

    ও মা, কী সর্বনাশ! পাকিস্তানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মাগী?

    পাকিস্তানে নয়, পূর্ব বাঙলায়। উনিশ বছর আগে পাকিস্তান কথাটার সৃষ্টি হয় নি।

    পড়া? দুটো পাস করেছিল। পয়সার অভাবে আর পড়া হয়ে ওঠে নি।

    পয়সার অভাবে? আহা হা! তোরই বাপের পয়সায় কত গরীবের ছেলে লেখাপড়া শিখে, তরে গেল।

    না, এর আর উত্তর দেয় না সুনন্দার হারানো মেয়ে, খুঁজে পাওয়া মেয়ে।

    আশ্চর্য, যখন খুঁজে খুঁজে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল, তখন পাওয়া গেল না। আর যখন সমস্ত খোঁজার শেষ হয়েছে, তখন–অপ্রত্যাশিত এই পাওয়া।

    সীমাকে ওর ঘরে প্রতিষ্ঠিত করে স্বামীর জন্যে বড় কান্না কাঁদল সুনন্দা। সেই যদি পাওয়াই গেল, কটা বছর আগে কেন গেল না? শোভনকে কেন হাহাকার করা প্রাণটা নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হল?

    কিন্তু না, সুনন্দার আর সে দিন নেই। ইচ্ছেমত পড়ে কদবার।

    সুনন্দার জীবনে কর্তব্যের ডাক এসেছে। অপরিচিতাকে আপন করে নিতে হবে। দূরকে নিকট। সুনন্দাকেই ভাঙতে হবে আড়ষ্টতার বাধা। নিজের এবং ওর। নইলে শাস্ত্রে কেন বলেছে স্নেহ নিম্নগামী। সুনন্দাকেই অপর্যাপ্ত স্নেহ ঢেলে ভরিয়ে তুলতে হবে ওর শূন্যতা, ভিজিয়ে তুলতে হবে ওর শুষ্কতা। ওর দিক থেকেই দেখতে হবে সবটা। মায়ের প্রতি অগাধ ভালবাসা এখুনি কোথায় পাবে ও?

    .

    ব্রজনাথ পরামর্শ দিয়ে গেছেন এখুনি চট করে ওর গত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করে কাজ নেই। মনটা কঠিন হয়ে যাবে, বিমুখ হয়ে যাবে। তাছাড়া এত ঐশ্বর্য এত আড়ম্বর জীবনে তো কখনো চোখে দেখে নি, ভিতরে ভিতরে একটা হীনমন্যতা-বোধ আসাই স্বাভাবিক। আস্তে আস্তে সহজ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ওকে ওর বিচ্ছিন্ন শিকড়ের সঙ্গে জুড়তে হবে।

    আর একটা কথা। বলেছিলেন ব্রজনাথ, আপনার ভাইপোটি তো এখন ছুটিতে বাড়ি গেছে। তা বলছিলাম কি, প্রথমটা তার হোস্টেলে এসে উঠলেই ভাল হত না?

    সুনন্দা অবাক হয়ে বলেছিল, কেন?

    না, মানে, বলছিলাম সীমা, মানে আপনার গিয়ে কি বলে টুলু, একটু অপ্রতিভ হতে পারে তার সামনে।

    কী যে বলেন ব্রজনাথবাবু! নস্যাৎ করে দিয়েছিল সুনন্দা তার আশঙ্কা, বরং একটা কাছাকাছি বয়সের মানুষ পাবে। সেখানেও তো ভাইবোন ছিল না। একটা দাদা পেয়ে বাঁচবে। দুলুও তো আমার ছেলেই।

    দুলু। উদ্দালকের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। টুলুর ধ্বনির সঙ্গে মিলিয়ে রাখা।

    এ নাম সুনন্দার দেওয়া, আদরের ডাক নাম। বাড়িতে ওকে পুরো নামেই ডাকে সবাই।

    সেই তো! সেইটিতো হচ্ছে কথা, বিজ্ঞ হাসি হেসেছিলেন ব্রজনাথ, আপনার প্রায় ছেলে বলেই তো ভাবনা। মানুষের মনস্তত্ত্ব বড় জটিল মিসেস রায়! পরস্পরের প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়াও অসম্ভব নয়।

    কী আশ্চর্য! কি বলছেন ব্রজনাথবাবু? ঠিকরে উঠেছিল সুনন্দা। এ কী কথা?

    ব্রজনাথ কিন্তু অপ্রতিভ হন নি। বলেছিলেন, আপনার সরলতাই জয়ী হোক এই প্রার্থনা করি মিসেস রায়। তবে কথাটা কি জানেন? মানুষ জীবটা নেহাৎ রক্ত-মাংসেই তৈরী। আর সেটা আমরা উকিলরা বড় বেশি জানি।

    তাঁ, সুনন্দাও তা জানে। মানুষ রক্ত-মাংসে তৈরী। কিন্তু সেই রক্ত-মাংসটাই তার শেষ কথা এ কথা সে মানে না। মানুষ শব্দটার অন্য অর্থ আছে।

    দুলু এসে টুলুকে হিংসে করবে! এত অনিয়ম সম্ভব? পৃথিবীতে তা হলে চন্দ্র সূর্য ওঠে কেন? বর্ষার পর শরৎ, আর তারপর হেমন্ত আসে কেন?

    উদ্দালক ছুটিতে বাড়ি গেছে। সুনন্দা তার জীবনের এই আকস্মিক তোলপাড় কাণ্ডর কথা আর চিঠি লিখে জানায় নি ভাইয়ের বাড়ি। জানানো সম্ভব হয় নি তার পক্ষে।

    কাগজ কলম নিয়ে বসেছিল একবার, কিন্তু শ্রীচরণেষু দাদা–বলেই থামাতে হয়েছে। কলম। কোন ভাষাই সুনন্দার মনের স্ট্যাণ্ডার্ডে পৌঁছতে পারে নি। তার জানা বাংলা ভাষাকে নিতান্তই জৈালো, পঙ্গু, দীন মনে হয়েছে।

    উদ্দালককে লিখবে তবে? নাঃ, তাও হয় না। তার থেকে সে আসুক। দেখুক। তারপর নিজের মা-বাপকে যেমন করে পারে খবরটা জানাক।

    কবে যেন আসবে উদ্দালক? ক্যালেণ্ডারে দাগ দেওয়া আছে না?

    তা সে যে ছেলে, কবে কখন কোন গাড়িতে আসছে কিছুই জানাবে না হয়তো। দুম্ করে একদিন এসে পড়বে। মেয়াদ ফুরোবার আগেই।

    .

    স্নান সারা হয়েছে। সীমা ঘুরে ঘুরে দেখছে। দাসী নিয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়িটার সর্বত্র।

    শুনেছিল এদের আর কোন ছেলেমেয়ে নেই। গিন্নীও তো বিধবা। তবে পুরুষের ব্যবহারের এত জিনিস কেন সর্বত্র?

    ওই সুন্দর সাজানো-গোছানো ঘরটা কার? আর স্ট্যান্ডের ওপর বসানো ওই ছবিখানা? মুখের সঙ্গে সুনন্দার মুখের তো যথেষ্ট আদল আছে। ছেলে আছে না কি মহিলাটির? এটা কি হল তবে? অঙ্কে মিলছে না তো! দেখে ফিরে যাচ্ছিল নীরবে, হঠাৎ বলে উঠল, ছবিটি কার?

    ঝি তারুর মা বলল, ওই যে বললাম, দাদাবাবুর ঘর এটা। কান কর নি বুঝি?

    দাদাবাবু? ছেলে আছেন?

    আহা, তা ছেলে বললেই ছেলে। ভাইপো আর ছেলে কি ভেন্ন? এই তুমি তো কথায় শোওয়া বয়সেই কোল ছাড়া, মানুষটার কী হাহা করা মন তা বল? তবু বাবু য্যাখন ছিল একরকম। বাবু যেতেই পাগল হয়ে ওই ভাইপোটিকে এনে কাছে রাখল। তবু তো বুক ঠাণ্ডা। তা তুমি সে বিষয়ে মনে কিছু কোরো নি। সে তোমার ছেলে একদিকে, দেবতা একদিকে। তোমায় যে হিংসে করবে তা ভেব না।

    হিংসে! সীমা ভুরু কুঁচকে বলে, আমায় হিংসে করতে যাবেন কেন?

    বলে ফেলেই বুঝেছিল তারুর মা, কথাটা বলা ভাল হয় নি। তাই সামলে নিয়ে বলে, না, সে কিছু না। ও এমনি কথার কথা বললাম। দাদাবাবু কি আর হিংসে করবার ছেলে?

    তা কোথায় তিনি? কলেজে গেছেন বুঝি?

    না, কলেজে নয়। ছুটি হয়েছে তাই মা-বাপের কাছে গেছে। এই বছর শেষ পড়ার পরীক্ষা দেবে।

    কৌতূহল সন্দেহজনক কি না, সেটা না ভেবেই প্রশ্ন করে সীমা, সেটা কোথায়? ওই মা বাবার বাড়ি?

    সেই যে গো ডেরাডুন না কোথায়। মায়ের দাদা তো মিলিটারি। তা মায়ের দাদাই বা বলছি কেন? তোমার তো মামা হন গো। সবই জানতে পারবে ক্রমশ। ঘরের ছেলে পরের হয়ে ছিলে এতদিন, চেনা-পরিচয় তো কিছুই নেই।

    আড়ালে গিয়ে ঝিমহলে কিন্তু এই হৃদ্যতার সুর বজায় রাখে না তারুর মা। বলে, কোথায় কাদের কাছে মানুষ হয়ে এসেছে এতকাল, দিব্যি পাকাচোকাটি হয়ে উঠেছে। এল বটে, ধাড়ি শালিখ পোষ মানলে হয়। বলব কি দাদাবাবুর ছবিখানা যেই চোখে পড়েছে, যেন কাঠ। তারপর নানা জেরা, এ ছবি কার? ছেলে নাকি? ভাইপো, তবু ভাল। তা থাকে কোথায়? …মানে মনের মধ্যে তো খেলছে আমিই সর্বেসর্বা।

    রজনী বলে, যাই বল বাপু, সত্যি কথা বলছি, মায়ের আহ্বাদ হয় হোক, আমার কেমন প্রাণের মধ্যে সুর বাজছে না। সেই ছোটকালে আসত তো আসত। এ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসা। দাদাবাবুকে কি আর স্থলকূল দেবে?

    মানুষ রক্তমাংসের জীব। এ তথ্য সবাইয়ের জানা। শিক্ষিত-অশিক্ষিত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই বোঝে–এই পরম সত্যকে চোখ বুজে অস্বীকার করা যায় না।

    অথচ সুনন্দা সেই চোখটাই বুজে বসে আছে। তাই থাকবে এই পণ।

    .

    পুজোর শেষে পুজোর ঘর থেকে কুশী ভরে ঠাকুরের চরণামৃত নিয়ে এঘরে আসে সুনন্দা। একটু পেটে পড়ক মেয়েটার, কে জানে কিভাবে মানুষ হয়েছে, কী না কি অখাদ্য খেয়েছে। পদবী তো বলল সেন। জাতটা বোধহয় খারাপ নয়, কিন্তু আচার-আচরণ?

    যে মেয়েমানুষ অতবড় পিশাচী, তার আবার আচার-আচরণের কোনও ঠিকঠাক আছে? শিক্ষা-দীক্ষা নিশ্চয়ই ভাল দেয় নি, নইলে অমন মুখখানি, কিন্তু কোমলত্ব নেই। কেমন যেন কাঠ কাঠ ভাব। যাক, সুনন্দা ঠিক করে নেবে। ভালবাসায় বনের পশু বশ হয়, এ তো নিজের পেটের সন্তান।

    নিজের পেটের সন্তান! ভাবতে গিয়েও যেন কিছুতেই অনুভবে আনা যাচ্ছে না। অত সব প্রমাণ দেখালেন ব্রজনাথবাবু, দ্বিধা করবার কিছুই তো নেই, নেই সন্দেহের। তবু যেন সেই অনুভূতির জায়গাটা থেকে থেকে অসাড় হয়ে যাচ্ছে।

    একেবারে অজানা ঘর থেকে মেয়ে নিয়ে এসে ছেলের বৌ করলে যেমন মনটা হয়ে থাকে, সুনন্দার মানসিক অবস্থাও অনেকটা তেমনি।

    হৃদয় উজাড় করে ভালবাসা দিতে ইচ্ছে করছে, ভাড়ার উজাড় করে উপহার, অথচ সন্দেহ জাগছে, যোগ্য পাত্রে পড়বে তো?

    তবু সুনন্দা জিতবেই। ওই মেয়েকে, তার টুলুকে, ভুলিয়ে দেবে সেই পিশাচীর শিক্ষা দীক্ষা স্মৃতি। আস্তে আস্তে ওর মধ্যে চেতনা জাগাবে, ও কোন্ ঘরের মেয়ে, ওর সামাজিক মান মর্যাদা কতখানি?

    স্নেহ ভালবাসা, অর্থ প্রতিষ্ঠা, স্বাচ্ছন্দ্য স্বাধীনতা, আড়ম্বর উপকরণ,–এতগুলো মন্ত্র দিয়ে বশ করে ফেলা যাবে না একটা তরুণী মেয়েকে?

    দারিদ্র্য আর অসুবিধের মধ্যে জীবন কেটেছে যার! কেটেছে প্রতিষ্ঠা পরিচয়হীন অতি সাধারণ এক গৃহকোণে।

    .

    না, অতিসাধারণ বললে তো কিছুই বলা হয় না। নির্লজ্জ কুৎসিত এক নগ্ন দারিদ্র। সেই দারিদ্র্যের দরজায় এসে নামলেন ব্রজনাথ।

    টিনের চাল, হঁট বার করা দেওয়াল, হ্যাঁচাবেড়ার রান্নাঘর, মাটির দাওয়া। সবই প্রায় নিজের হাতেই গড়া যতীন সেনের। জবরদখল কলোনির একাংশে তার এই বাড়ি। দু-একটা ঘরামীর সাহায্যে এই আস্তানাটি গড়ে তুলেছিল সে শেয়ালদা স্টেশন থেকে উঠে এসে।

    একটা চটা-ওঠা এনামেলের কাসিতে চারটি তেল-নুন মাখা মুড়ি নিয়ে খেতে বসেছিল যতীন সেন। কিন্তু একা ভোগের অধিকার জোটে নি। গোটা তিন চার ছেলে-মেয়ে হুমড়ি খেয়ে বসেছিল গুটিকয়েক প্রসাদ কণিকার আশায়।

    যতীনের যে ভাগ দেবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তা নয়, সারাদিনের পর জলখাবার বলতে তো এইটুকু জুটেছে। কিন্তু ছেলেগুলো তো পাড়ার ছেলে নয় যে দূর দূর করে খেদিয়ে দেবে? তাই দু-চারটে দিতেই হচ্ছে। একান্ত নিজের বলতে ফাটা কাঁচের গ্লাসটায় আধ গ্লাস কালো ঝুল চা।

    যতীনের পরনে একটা ময়লা চিরকুট খাটো লুঙ্গি, গা খালি, গলায় গোল করে পরা কালো দড়ির মত পৈতে।

    ছেলে-মেয়েগুলোর পরন-পরিচ্ছদ বাপের সাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যবর্জিত নয়। ছোট ছেলেটা বলে উঠল, বাবা, চা খাব।

    আবার চা-ও চাই? ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটি ছোঁড়ায় গিঠবাঁধা শাড়িপরা আধবয়সী স্ত্রীলোক। বলে উঠল, এক্ষুনি রুটি গিলিয়ে রেখেছি, তবু দেহি দেহি? পেটে কি রাক্ষস এসেছে নাকি? খবরদার বলছি, আহ্লাদ দিয়ে চাটুকু ওর গলায় ঢালবে না। উঃ, কবে যে এ দুর্গতির অবসান হবে!

    যতীন সেন বলে, ঘণ্টা মিনিট গুনছি। দেখি–

    বৌ বলে, ভগবানই জানেন। ভাবলে তো হাত পা কাঁপে!

    এই পরিস্থিতির সামনে ব্রজনাথ এসে দাঁড়ালেন। গাড়ি থেকে নামবার প্রশ্ন নেই। গাড়ি রাখতে হয় তিনবাঁকা গলির সেই শেষ প্রান্তের মোড়ে। কেঁচার আগা হাতে ধরে সন্তর্পণে কাদাজল বাঁচিয়ে এসেছেন।

    ব্রজনাথকে দেখেই যতীনগিন্নী ঝট করে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়, এবং ছেলে-মেয়ে কটা একটু সভ্য ভঙ্গী করে বসে।

    যতীনও মুড়ির কাসিটা একটু ঠেলে দিয়ে লুঙ্গিটা টেনে পায়ের ওপর নামিয়ে দিয়ে আসুন আসুন করে ওঠে।

    থাক, থাক, খাচ্ছ খাও, ব্রজনাথ বলেন, একটু বসলে হত।

    ওরে, এই শীগগির টুলটা–যতীন নিজেই ব্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে। কোল থেকে গোটাকয়েক মুড়ি ঝরে পড়ে, এবং চোখে পড়ে লুঙ্গিটায় এমন একটা গর্ত যে লজ্জা নিবারণ দুরূহ।

    ব্রজনাথের মত মাননীয় অতিথিকে দেখেও আসামাত্রই কেন যে যতীন তখন তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় নি সেটা বোঝা গেল।

    তা নড়াচড়া করতে হল না যতীনকে। বৌ ঘর থেকে একটা পায়া নড়বড়ে টুল এনে বসিয়ে দিয়ে গেল।

    যতীন নীচু গলায় বলল, তারপর?

    তারপর আর কি। হয়ে গেল সবই। তবে আড়ালে তো পেলাম না যে, আর একটু বুঝিয়ে পড়িয়ে দেব। যেমনটা আশা করেছিলাম, ঠিক তেমনটা হল না!

    তাই নাকি? যতীনের মুখটা শুকিয়ে যায়, গিন্নী কোন রকম ইয়ে করল নাকি?

    না, ইয়ে করবার কোনও স্কোপ রাখি নি। ব্রজনাথ বলেন, ব্রজ উকিল এমন কাঁচা কাজ করে না। তবে মেয়েকে তোমার নির্জনে আর একটু বোঝাতে হবে। মানে বিশ বছর আগের শুকিয়ে যাওয়া স্নেহধারা, তাকে আবার বালি খুঁড়ে বার করে নিয়ে গাছে সিঞ্চন! তা ইয়ে আপাতত কিছু রাখ খরচা বলে–

    যতীনের চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। যেমন জ্বলে ওঠে ক্ষুধার্ত জানোয়ারের চোখের সামনে খাবার দেখলে। মনে হয় বুঝি ব্রজনাথের হাত থেকে কেড়েই নেবে টাকাটা।

    তবে নেয় না। শুধু ঠোঁটটা একটু চেটে নিয়ে বলে, কত আছে?

    যা আছে দেখে নাও। আবার দেখা করব তোমার সঙ্গে।

    এই সময় যতীনের বৌ আবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। চাপা গলায় বলে–সীমাকে আর দেখা করতে দেবে না?

    দেবে। দেবে না কেন? তা এক্ষুনি কেন? এই তো দু দিন হল গেছে। মনটা একটু বসুক, একটু হতু হোক। আনব, আমিই আনব সঙ্গে করে। তবে বাসাটা তোমাদের বদলাতেই হবে।

    বদলাবার জন্যে তো হাঁ করে আছি। যতীন বলে, এই নরকের মধ্যে জানোয়ারের মত থাকতে থাকতে জানোয়ারই বনে গেছি। নইলে আর

    ব্রজনাথ ওঠেন। যতীন লুঙ্গির ভেঁড়াটার সঙ্গে নোটের গোছাটা মুঠো করে চেপে ধরে মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। আস্তে আস্তে কথা হয় তখন।

    ছোঁড়া ছুঁড়ীগুলো অবোধের মত চেয়ে থাকলে কি হবে, হাঁ করে কথা গিলবে। ব্রজনাথ চলে গেলেই হাজার প্রশ্ন করবে।

    ওদের মা-টিও তত কম নয়। ওদের তবু ধমকে ঠাণ্ডা করা যায়, তার বেলায় তাও চলবে না। এই পরিস্থিতিতে মানুষ হয়েছে সীমা। এইখান থেকে গিয়ে উঠেছে সুনন্দার অট্টালিকায়।

    .

    কোন্ কলেজে পড়েছিলে তুমি? জিগ্যেস করে সুনন্দা।

    সীমা মুখ তুলে বলে, কোনও কলেজেই নয়, প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়েছিলাম।

    প্রাইভেটে! ওঃ। তা আবার বি. এ. পড়। কলেজেই পড়।

    আপনার যা ইচ্ছে তাই হবে।

    জানলার কাছে বসে আছে সীমা। একধার থেকে মুখে আলো পড়েছে। নিষ্পলকে তাকিয়ে দেখছে সুনন্দা। ওই দৃঢ় কঠিন রেখাঙ্কিত মুখের কোন্ খাঁজটায় টুলু লুকিয়ে আছে। কই! কোথায়! ভগবান

    সেই অ্যালবামখানাও যদি থাকত! তাহলে সুনন্দা তার প্রত্যেকখানি ছবি ধরে ধরে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখত কোন্ ভঙ্গীটার মধ্যে সাদৃশ্য আবিষ্কার করা যায়।

    গান-টান শিখেছ কখনো।

    না সুযোগ পাই নি।

    শিখতে ইচ্ছে করত না?

    প্রশ্ন করে করে সুনন্দা কি ওর অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখে নিতে চায়? না কি বলবার মত কথা খুঁজে পাচ্ছে না বলেই এই সব অপ্রয়োজনীয় কথার চাষ?

    কিন্তু মেয়েটা সত্যিই বড় কাঠখোট্টা। সুনন্দার ইচ্ছে করে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চুলগুলি মনের মত করে আঁচড়ে বেঁধে দেয়। কিন্তু ও তো কাছে ঘেঁষেই না।

    তাই ও যখন বলে, যে ইচ্ছে মিটবে না, সে ইচ্ছে করে লাভ? সুনন্দা তখন চুপ করে থাকে। তারপর বলে, এখন তো তোমার অনেক ইচ্ছেই মিটতে পারে, কই কোন ইচ্ছেই তো জানাও না আমার কাছে? কোন আবদারই কর না?

    সীমা একটু হাসে। বলে, বিনা আবদারেই এত দিচ্ছেন, ইচ্ছে প্রকাশের আগেই এত পাচ্ছি, ইচ্ছে আবদারের ফাঁক পাচ্ছি কোথায়?

    আবার ঢেউ ওঠে। সুনন্দার মনটা আবার গলে পড়ে। ওর ওই হাসিটা তো বড় সুন্দর! হাসলে তো কই মুখের কাঠিন্য ধরা পড়ে না! আহা, সব সময়েই যদি এমনি হেসে থাকত, তাহলে সুনন্দা নিশ্চয় পারত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসতে, গায়ে মাথায় হাত বুলোতে, চুল বেঁধে দিতে। আর, আর হয়ত সেই ফাঁকে টুলুকে খুঁজে পেত!

    এই বেলা হাসির রেশটা রয়েছে। সুনন্দা সাহস সংগ্রহ করে তাই কাছে সরে এসে বলে, তা হোক, আমার তো সাধ হয়?

    আচ্ছা চেষ্টা করব। কিন্তু কি চাইতে হয় তাই তো জানি না। আপনার বাড়িতে এসে তো কত নতুন নতুন জিনিসের নাম শিখলাম, কত কত নতুন জিনিস দেখলাম। আর যে কি আছে জগতে তাই কি জানি?

    সুনন্দার বুকের ফল্গুধারায় কি বন্যার বেগ এল? সুনন্দা কি ভাবছে ওকে আমি ভুল বুঝছি? ও মোটেই কাঠখোট্টা নয়। শুধু, বড্ড বেশি সরল। গোড়া থেকেই ভুল করছি আমি। আমি কেন ভাবছি না ও কত অন্যরকম পরিবেশে মানুষ হয়েছে, কেন ভাবছি না এক বছর বয়সের পর ও আর আমাকে দেখে নি। আমি ওর ত্রুটি আবিষ্কার করছি, কই আমি তো ওকে স্নেহের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারছি না? তাই খুব কাছে, আরও কাছে, সরে এসে বলে, বেশ তো, গাড়ি করে দোকানে নিয়ে যাই চল। যা দেখবে, যা ইচ্ছে হবে

    শুধু শুধু এত টাকা নষ্ট করবেন কেন? শুকনো স্বর, শ্রীহীন বাক্য।

    সুনন্দা চমকে ওঠে। এ কী কথা! ও কি এক্ষুনি ওর বিষয় সম্পত্তি আঁট করতে চায়, তাই প্রথমেই সুনন্দার অপচয় নিবারণে হাত বাড়াচ্ছে?

    একে তবে স্নেহের বন্যায় ভাসাবে কি করে সুনন্দা?

    তা সেই পাপিষ্ঠ মেয়ে মানুষটার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই তো বেড়ে উঠেছে ও! হয়ত আবুহোসেনের মেজাজ নিয়ে অধিকারের দাবিতে সুনন্দার সঙ্গে লড়াই করতে আসবে।

    ও যে শোভন রায়ের মেয়ে, এ অধিকার কিনা না, ছি ছি! বড় সন্দিগ্ধ মন সুনন্দার। এখন যে ও বড় সুন্দর কথা বলছে। বড় পবিত্র, বড় মহৎ। আমি তো কত পাচ্ছি, আবার কেন মিথ্যে খরচ করবেন। কত গরীব লোক আছে জগতে, খেতে পায় না পরতে পায় না, অসুখ করলে ওষুধ পায় না

    সুনন্দার লজ্জা করে। তাই তাড়াতাড়ি বলে, সে তো বুঝি। তবু ভেবে দেখ আমি এই উনিশ বছর ধরে হাহাকার করে বেড়িয়েছি। আমার তো ইচ্ছে হয় কেউ মা বলে ডেকে বলুক মা আমায় এটা দাও চোখটা সজল হয়ে আসে সুনন্দার।–তখন শুধু বলতে শিখেছিল, দুদ থাবো না। তকোলেত দাও—

    শিখেছিলই বলে সুনন্দা–শিখেছিলি নয়। কি করবে দুটোয় যে মিলছে না। মেলানো যাচ্ছে না।

    এতদিন পরেও সে কথা মনে আছে আপনার?

    মনে থাকবে না? সুনন্দা চোখ মোছে। আর কি কেউ মা বলে ডাকল আমায়? আর কি কেউ দাও বলে চাইল? এতদিন পরে যদি বা ভগবান তোমায় এনে দিলেন, সুনন্দা উথলে ওঠে–তুমি এখনো আমায় আপনি বলছ। পর ভাবছ। আবদার করতে লজ্জা পাচ্ছ।

    সুনন্দার চোখের জল দেখে কি সুনন্দার টুলুর চিত্ত বিগলিত হয়? তাই নরম গলায় বলে, আপনিও তো আমায় তুই বলছেন না, বকছেন না, শাসন করছেন না।

    বকব? শাসন করব? তোকে?

    সহসা এক উত্তাল ঢেউ সুনন্দার যত্নে বাঁধা বাঁধ ভেঙে দেয়। ভেসে যায় মান-মর্যাদা। সুনন্দা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে তার টুলুকে। তোকে আমি শাসন করব?

    কথা শেষ হয় না। দরজার কাছে শব্দ ওঠে, কী ব্যাপার পিসিমা! শুনছি নাকি লোমহর্ষণ কাণ্ড! অলৌকিক ঘটনা! বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতে রিপোর্টাররা

    ঘরে আর ঢুকতে হয় না উদ্দালকের। ভিতরের দৃশ্য দেখে চুপ হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

    কিরে দুলু এলি? চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখে সুনন্দা। বলে, দেখ, ভগবান কী নিধি মিলিয়ে দিয়েছেন।

    সীমা আস্তে সুনন্দার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। সরে যায়। উদ্দালক একটু হেসে বলে, একেবারে নাটকীয়। আর আমি এসে পড়লাম ভয়ানক এক নাট্য মুহূর্তে।

    .

    আবার দেখা হয় খাবার টেবিলে। উদ্দালক আগে-ভাগেই এসে বসেছে। চেয়ারে বসে চেয়ারের পিঠটাকে পিঠ দিয়ে ঠেলছে। পা নাচাচ্ছে। স্থির হয়ে থাকতে পারে না সে একতিলও। সুনন্দা এখনো এসে হাজির হয় নি। উদ্দালকের প্রিয় তরকারি নারকেল কুমড়ো রান্না হচ্ছে নিরামিষ ঘরে। সুনন্দা তার তদারকিতে ব্যস্ত। বামুনঠাকুরের স্বাধীনতার ওপর ছেড়ে দিয়ে এলে স্রেফ নষ্ট।

    সীমা চেয়ারে বসে নি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অকারণ টেবিলের সাজসরঞ্জাম নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

    টেবিলে খেতে প্রথম দু-একদিন খুব অসুবিধে হয়েছিল, কিন্তু সে অসুবিধে কাটিয়ে উঠতে দেরি হয় নি তার। হয়ও না। বিলাসিতার অভ্যাস একদিনেই আরম্ভ করা হয়। তবু স্থির করেছে সীমা আজ উদ্দালকের সঙ্গে বসবে না। কি জানি, যদি হঠাৎ তার কোন অপটুতা উদ্দালকের চোখে পড়ে যায়।

    ছেলেটার মুখটায় যেন একটা ব্যঙ্গ হাসি মাখানো। ছবিতেও ছিল। কিন্তু ছবিটা তত খারাপ লাগে নি। ছবির হাসি সহ্য করা যায়, জলজ্যান্ত মানুষটাকে সহ্য করা শক্ত।

    কেন ওর ওই ব্যঙ্গ হাসি? সীমার উপস্থিতি কি ওকে ঈর্ষান্বিত করছে? ভাবছে সর্বেসর্বা ছিলাম, এ আবার কি উৎপাত! তাই সীমার লোভ, সীমার হ্যাংলামি, সীমার দুঃসাহসিক স্পর্ধাকে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের ছুরি দিয়ে বিঁধতে চাইছে? ব্রজনাথ তো মহা সর্বনেশে লোক! কই, এই ছেলেটার কথা তো বলেন নি সীমার কাছে?

    না, সত্যিই বলেন নি। সীমার কাছে না, সীমার মা-র কাছেও না। তারা জেনেছে, বাড়িতে কেবলমাত্র বিধবা মহিলাটিই থাকেন।

    যতীন সব জানে। যতীনের সঙ্গে আড়ালে চুপি চুপি কথা। এই ছেলেটার খবর জানলে সীমা বিদ্রোহ করত। বিধবা ধনবতীর কবরিত মাতৃস্নেহকে কবর থেকে তুলে কাজে লাগাতে আসত না।

    উদ্দালকের চেয়ারটা পড়তে পড়তে রয়ে গেল।

    হচ্ছিল! বলে ফেলল সীমা। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

    উদ্দালক নিজেকে সোজা করে নিয়ে মৃদু হেসে বলে, যাক, শ্ৰীমতী নিধির তাহলে কণ্ঠস্বর আছে। আমি তো ভাবছিলাম, বিধি যদি বা পিসিমার নিধিকে এতদিনে এনে জুটিয়ে দিলেন, সেটি আবার মূকবধির।

    সীমার মুখটা লাল হয়ে ওঠে। সীমা জানে না উদ্দালকের প্রকৃতিই ওই, ও হেসে ঠাট্টা করে ভিন্ন কথা বলে না। জানে না তাই যে ভুল ব্রজনাথ করেন, সেই ভুল সীমাও করে। ভাবে অহঙ্কারী, উন্নাসিক।

    উদ্দালক আবার বলে, তারপর, শ্রীমতী নিধি, আপনার আজকের গতিবিধির প্রোগ্রাম কি? আগে থেকেই ঠিক-ঠাক হয়ে আছে? না

    সীমা রুষ্ট মুখে বলে, সেটা আপনার পিসিমাকেই জিগ্যেস করবেন।

    উদ্দালক যেন আকাশ থেকে পড়ে, আপনি মানে? আমি হচ্ছি সবেধন নীলমণি একটি দাদা, আমায় আপনি! অচল অচল।

    সীমা আরও রুষ্ট মুখে বলে, আপনিও আমাকে আপনি বলেছেন।

    আহা হা, সেটা তো কৌতুকার্থে—

    গরীবদের প্রতি বোধহয় আপনার কৌতুক ব্যঙ্গ এসব খুব প্রবল?

    গরীব? গরীব আবার কে এখানে?

    কে তা আপনিও জানেন, আমিও জানি।

    কী সর্বনাশ! আমি তো জানি, এখন আমি আমার পিসিমা ঠাকুরানীর হারানিধি এবং রায় কোম্পানীর একেশ্বরী মালিকানী মিস রায়ের সঙ্গে কথা বলছি–

    সীমা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণস্বরে বলে, খুব হিংসে হচ্ছে, না?

    হিংসে? সেটা আবার কী হল?

    ওঃ জানেন না বুঝি? অবোধ শিশু! কিন্তু আমি জানতে পারছি

    কি পারছ?

    আমাকে দেখে রাগে হিংসেয় আপনার সর্বাঙ্গ জ্বলছে।

    হঠাৎ তড়াক করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে উদ্দালক, সর্বাঙ্গে দুহাত চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, কই?

    সীমা অবাক। না বলে পারে না, কি কই?

    আগুন! উঃ, এমন ভয় লাগিয়ে দিয়েছিলে! ভাবলাম অবোধ শিশু বৈ তো নয়, সর্বাঙ্গ জ্বলছে খেয়াল করছি না।

    আমাকে এত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ না করলেও চলবে আপনার। আমি চলে যাব।

    চলে যাবে। মানে?

    মানে আবার কি! কারও স্বার্থের হানি করে থাকার রুচি আমার নেই।

    না, বোবা কালা নয়, শুধু হেডঅফিসে একটু গণ্ডগোল। হেসে ওঠে উদ্দালক, আহা বেচারী পিসিমা, যদি বা বিনা ব্যঞ্জন ভাতে একটু শাক চচ্চড়ি জুটলো, তো সে আবার নুনে পোড়া। শেষে একটা পাগল মেয়ে–

    সীমা দৃঢ়স্বরে বলে, আচ্ছা বার করুন আপনার তূণে আর কি কি অস্ত্র আছে দেখি–

    অস্ত্র? অস্ত্র মানে? এ যে একেবারে নির্ভেজাল সত্য। পাগল না হলে বড়ভাইকে কেউ খামোকা গালমন্দ করতে বসে?

    বড়ভাই! শব্দটা মনের তার ছুঁয়ে গেল না–ঝঙ্কার তুলল না। সীমা বিরসমুখে বলে, ওসব আমার আসবে না।

    কি আসবে না?

    এই বড়ভাই টাই–

    সর্বনাশ! তবে কি ছোটভাই বানিয়ে দিদি সাজতে চাও নাকি? চলবে না, চলবে না। আমিও তাহলে অধিকার কায়েম রাখতে তুই বলতে শুরু করব। বুঝলে হে শ্ৰীমতী নিধি! কমসে কম আমি তোমার থেকে তিনটি বছরের বড়।

    সীমা ভুরু কুঁচকে বলে, আপনি বুঝি আমার ঠিকুজি কুষ্ঠী দেখে নিয়েছেন ইতিমধ্যে?

    ইতিমধ্যে মানে? পূর্বেবহুপূর্বে, তব জন্মক্ষণে। পিসিমা এবং পিসিমার ভ্রাতার খাতায় মহাশয়ার জন্মের সাল তারিখ মাস বার ক্ষণ লগ্ন সব কিছু লেখা আছে, বুঝলেন? চালাকিটি চলবে না।

    সীমা কি একটা বলতে উদ্যত হচ্ছিল, এই সময় সুনন্দা এসে দাঁড়াল উদ্দালকের স্পেশাল ডিশ নিয়ে।

    এই তোর নারকেল কুমড়ো। ও কিরে, টুলু তুই বসিস নি? হারে দুলু কি হল? বললাম বোনটিকে নিয়ে খেতে বোস ততক্ষণ, আমি আসছি। ভাত শুকোচ্ছে এদিকে, হাত গুটিয়ে বসে আছিস!

    উদ্দালক উদাস উদাস ভঙ্গী করে বলল, আর হাত! নেহাৎ গুটিয়ে বসে আছি তাই, নইলে হাতাহাতি হয়ে যেতে পারত।

    হাতাহাতি!

    তা না তো কি! তবে নেহাৎ নাকি তোমার এই গুণধর ভাইপোটির মেজাজ ওই ফ্রিজিডেয়ারের জলের মত, তাই কিছু একখানা হয়ে যায় নি। উঃ, তোমার এই কন্যাটির যা মেজাজ!

    সুনন্দা হেসে ফেলে। সুনন্দা এখন বিগলিত। সুনন্দার ভিতরকার দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সুনন্দা সীমাকে টুলু বলে গ্রহণ করতে পেরেছে তাই সুনন্দা খোলা মনের হাসি হেসে ওঠে।

    হল শুরু? কুঁদুলে ছেলে! বুঝলি টুলু, তোর এই দাদাটির একটি মাত্র কাজ আছে সংসারে, সবাইকে ক্ষেপিয়ে বেড়ানো। আমাকেও ক্ষ্যাপাচ্ছে, পুরুতমশাইকেও ক্ষ্যাপাচ্ছে, ডাক্তারবাবুকেও ক্ষ্যাপাচ্ছে; চাকর ঠাকুর বুড়ী তারুর মা কারুর রেহাই নেই ওর কাছে। আর এমন সব দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলেও মাথায়!

    উদ্দালক বলে, তা বলে পিসিমা অরিজিন্যাল ক্ষ্যাপাকে ক্ষ্যাপাবার সাহস আমার নেই। আমার তো ধারণা হচ্ছে ওর হেডঅফিসে রীতিমত গণ্ডগোল।

    দুলু, বাক্যি থামাবি? ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আয় টুলু বোস। সুনন্দার কণ্ঠে সুধা, চোখে বিগলিত স্নেহ।

    কিন্তু টুলু এগিয়ে আসে না। নীচু অথচ স্পষ্ট গলায় বলে, আমি একটু পরে খাব মা।

    ওমা সে কি কথা-সুনন্দার কণ্ঠে উদ্বেগ–পরে আবার কখন খাবি কার সঙ্গে? এই কদিন একা একা খেয়ে সারা হচ্ছিস। লজ্জা কি মা? ও তো তোর দাদা হয়। শুনতেই মামাতো ভাই, দেখিস নিজের দাদার থেকে অনেক বেশী। একঘণ্টায় আপনার করে নিতে পারে মানুষকে

    সহসা এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে যায় সীমার চোখে। হাসি গোপন করে বলে, ছাই পারেন। ঝগড়াটে!

    ওরে দুষ্টু মেয়ে, তুইও তো দেখছি কম যাস না। ইতিমধ্যেই ভাবটাব হয়ে গেছে? চালাকি হচ্ছে আমার সঙ্গে? নে বোস এখন। খেতে বসে দুজনে ঝগড়ার কমপিটিশান চালা।

    হারব, স্রেফ হেরে যাব পিসিমা। এতদিনের অহমিকা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আমার। এতসব উচ্চাঙ্গের কথার্বাতা জানেন তোমার শ্রীমতী নিধি, যে আমি উত্তর খুঁজে পাই না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।

    হুঁ, তুমি যে আমার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবার মত ছেলে! সুনন্দা হেসে বলে, আমার দেখছি এখন চাকরি হল তোদের ঝগড়া থামানো। তোরা-সহসা চোখ ভরে জল এসে যায় সুনন্দার, তোরা দুটি ভাইবোন হাসবি খেলবি ঝগড়া করবি, বাড়ি আমার সত্যিকার মানুষের বাড়ির মতন হয়ে উঠবে। শুধু তিনিই বুকভরা হাহাকার নিয়ে চলে গেলেন। কিছুই দেখতে পেলেন না।

    ঘরের হালকা আবহাওয়া সহসা ভারী হয়ে উঠে। সীমা একটা চেয়ারের পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে, সুনন্দা পিছন ফিরে চোখের জল মোছে, আর উদ্দালক ঈষৎ অপ্রতিভ ভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে, আর কিছু না পেরে জলের গ্লাসটাই মুখে তুলে ধরে।

    কিন্তু বেশীক্ষণ এ আবহাওয়া থাকে না। উদ্দালকই থাকতে দেয় না। হঠাৎ বলে ওঠে, পিসিমা, তোমার নিধির পোশাকী নামটা কি বল তো?

    সুনন্দা চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে বলে, তা আমায় জিগ্যেস করছিস কেন, যার নাম তাকেই জিগ্যেস কর?

    কি জানি, হয়তো ওই সূত্রেই আবার লাঠালাঠি হয়ে যেতে পারে।

    ওমা, নাম জিগ্যেস করার মধ্যে লাঠালাঠির সূত্র কোথায় রে?

    কী বলা যায়! খলের ছলের অভাব থাকে না জানোই তো।

    আড়ে আড়ে তাকায় উদ্দালক সীমার দিকে। হয়ত বলে বসবেন, কেন নাম জেনে কী দরকার? নাম নিয়ে কি হবে? নামেতে কী আসে যায়?

    সুনন্দা একটু অস্বস্তি বোধ করে। কি জানি মেয়েটা উদ্দালকের এই কৌতুকে কি ভাবছে। কিভাবে নিচ্ছে এই বেপরোয়া কথাবার্তা। তাই তাড়াতাড়ি বলে, নাঃ বাপু তুই-ই একের নম্বর ঝগড়াটে। দেখ দিকি ও বেচারা কেমনতর হয়ে যাচ্ছে তোর এই সব কথা শুনে।

    সীমা কিন্তু এ করুণা গায়ে পেতে নেয় না। গম্ভীর ভাবে বলে, কেমনতর হবার কিছু নেই। তবে ওঁর প্রকৃতিটা অনুধাবন করছি।

    প্রকৃতি মানে?

    মানে নেই। স্রেফ অর্থহীন, উদ্দালক বলে, কিন্তু তোমার এই জংলি মেয়েটাকে মানুষ করে তুলতে হবে তো?

    ওমা, আমি কোথায় যাব গো! তুই যে আমার টুলুকে জংলি টংলি যা খুশি তাই বলছিস!

    বলব না? ভীষণ খুশি লাগছে যে! তাইতো যা খুশি বলতে ইচ্ছে করছে। উঃ ভাবছি, ইহ সংসারেও মাঝে মাঝে গল্প উপন্যাসের কাহিনী ঘটে। কি বল পিসিমা? এখন বলুন তো ভদ্রমহিলা আপনার এতাবৎকালের ইতিহাস। স্মৃতির সমুদ্র মন্থন করে দেখুন দিকি মনে পড়ে কিনা প্রথম যখন আপনি চুরি হলেন, তখন

    সুনন্দা ঈষৎ বিচলিত স্বরে বলে, ওসব গল্প এখন রাখ দুলু, খেতে বোস বাবা। টুলু বোস মা। হারে নারকেল কুমড়ি খাস তো? আমার দুলু তো

    একটা এলোমেলো প্রসঙ্গ এনে সুনন্দা সীমার পুরানো জীবনের প্রসঙ্গ চাপা দিতে চেষ্টা করে। ব্রজনাথবাবু বলেছেন, এখন ওসব কথা না তুলতে। কারণ নানাকষ্টে মানুষ হয়েছে সীমা। সে সব কথা উঠলে বেচারা লজ্জা পাবে।

    কিন্তু সীমা বুঝি নিজের ভার নিজেই হাতে তুলে নিচ্ছে। তাই সুনন্দার প্রশ্নে মৃদু হেসে বলে, বাঙালদেশের মেয়ে নারকেল কুমড়ি ভালবাসব না?

    ওহে মহিলা, ভুল হচ্ছে, উদ্দালক বলে ওঠে। বাঙালদেশের মেয়ে নয়, তৎদেশে মানুষ!

    নে বাবা, তোদের খাওয়া আজ মাথায় উঠল দেখছি। দাদা বৌদি কেমন আছেন তা পর্যন্ত শোনা হল না এখনো। বল্ শুনি কেমন আছেন ওঁরা। কেমন আছে ছেলেমেয়েরা?

    সুনন্দা যেন আগলে বেড়ায় সীমাকে। ওর যেন মনে হয় সীমা আবার হারিয়ে যাবে।

    ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশুধু তারা দু’জন – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article নদী দিকহারা – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }