Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মায়াজাল – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প137 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২. বসবার ঘরে

    ব্রজনাথবাবু ডেকে পাঠান সীমাকে। বাইরে বসবার ঘরে। সুনন্দাকে জানিয়েছেন নাম পদবী বদলাতে সই স্বাক্ষর দরকার, দরকার দরখাস্ত করবার।

    নামটা থাক না। সীমা মুখ নীচু করে বলে, ডাকের নামটা তো রইলই মা তোমার, ওটা তো তোলা, পোশাকী, ওতে আর কী ক্ষতি?

    আমি যে তোকে একেবারে ধুয়ে মুছে নতুন করে নিতে চাই টুলু!

    সীমা হেসেছিল একটু। আমার এই কুড়ি বছরের জীবনটাকে কি একেবারে ধুয়ে মুছে উড়িয়ে দিতে পারবে মা? জ্ঞান হয়ে অবধি নিজেকে সীমা বলে ভাবার অভ্যাস হয়ে গেছে, হঠাৎ নতুন কোনও নামকে সত্যি আমার ভাবতে

    সুনন্দা অবুঝ নয়। সুনন্দা এ কথার যৌক্তিকতা বুঝেছে। সত্যিই তো, সুনন্দা মুছে ফেলতে চাইলেও ও ওর সেই অনেক ঘাটের জল আর অনেক আগুনে পোড়-খাওয়া জীবনটাকে মন থেকে মুছে ফেলবে কেমন করে? শ্বশুরবাড়িতে আসা মেয়ের বাপের বাড়ির স্মৃতির মত থাকবেই খানিকটা। আস্তে আস্তে ঝাপসা হবে।

    ব্রজনাথবাবু বলেছেন, যাদের কাছে ছিল, তারা নাকি একবার দেখবার জন্যে নির্বেদ প্রকাশ করছে।

    সুনন্দা বলেছিল–বেশ তো, আনুন না তাদের একদিন। না হয় নেমন্তন্ন করেই আসুন। আমারও তো উচিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। অপকর্ম যে করেছিল, সে তো মরেই গেছে। এরা তো কোনও দোষে দোষী নয়? বরং নিজেদের দুরবস্থার মধ্যেও একটা পরের মেয়েকে ঠাই দিয়েছিল। এরা ভাল, এরা সৎ। হা হা, আনুন তাদের একদিন।

    ব্রজনাথ মাথা নেড়েছিলেন–আসবে না। হতদরিদ্র অবস্থা হলে কি হয়, খুব মানী। নিজেদের ছেঁড়া জামা কাপড় পরে বড়লোকের বাড়িতে আসবে না। শুধু বলছিল সীমা যদি একদিন

    এ কথারও যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারে নি সুনন্দা। সত্যি, বড়লোকের থেকে গরীবের আত্মাভিমান বেশী, এ তো চিরকালের জানা কথা। তাই বলেছিল–বেশ, একদিন যাবেখন। আপনিই আনবেন ঘুরিয়ে।

    হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো নিশ্চয়। আপনার ড্রাইভারও যে তাদের অবস্থাটা দেখে এ তাদের ইচ্ছে। নয়। তাই ভাবছি ট্যাক্সি করে–

    ট্যাক্সি করে? ওমা, তাই বা কেন? ড্রাইভার না যায় দুলুই নিয়ে যাবে। কথার উপসংহারের ছেদ টানে সুনন্দা। তারপর আবার বলে ওঠে, যাক, ওই যে কি, পদবী বদলাতে টুলুকে আপনার দরকার হবে বলছিলেন–

    হ্যাঁ হ্যাঁ। বিশেষ দরকার। নাম পদবী দুই-ই তো পালটাতে হবে।

    না না, বলছিলাম ওই নামটা বদলাবার দরকার নেই, শুধু পদবী।

    নামটা থাকবে! ব্রজনাথ হাঁ করেন। সুনন্দাই তো নতুন নামের পক্ষে ছিল।

    সুনন্দা বলে, থাক, থাকুক। টুলুর নইলে মনে কষ্ট হবে। মনে মনে যতই যা হোক, ও তো সেই রাক্ষুসীকেই মা বলে জানত, তার দেওয়া নাম। সেন্টিমেন্ট বলে কথা আছে একটা।

    বেশ, আপনার যা ইচ্ছে। মেয়েদের পদবী বদলানোটা কিছুই না, বিয়ে হলে বদলায়ই তো। নামটা বদলানোরই অসুবিধে ছিল। যাক, সে যখন দরকার নেই

    .

    টুলু এসে দাঁড়িয়েছে, একা। সুনন্দা চলে গেছে। বলেছে, দুলুকে বলিগে। ব্রজনাথ সীমাকে বলেন, না না, ও সব দুলু-ফুলুকে দরকার-টরকার নেই। ট্যাক্সিই ভাল, বুঝলে? তবে বেশিক্ষণ থাকা চলবে না।

    সীমা মুখ তুলে নীচুস্বরে বলে, টাকা দিয়ে এসেছিলেন ওখানে?

    নিশ্চয়! নিশ্চয়! কী বলছ তুমি মা! আমি কি এমনই অবিবেচক?

    না আপনি মহৎ। সীমার ওষ্ঠে অতি সূক্ষ্ম অতি মিষ্ট একটু হাসি ফুটে ওঠে।

    তা মহৎ বৈকি। ওঁরই চেষ্টায় তো একটা সন্তানহারা জননীর চিত্তের প্রদাহ শীতল হল! আর ওঁরই বদান্যতায় তো একটা দুঃস্থ পরিবার উপবাসের উত্তাপ থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে।

    যতীন সেনের মর্মান্তিক দুরবস্থা দেখে পর্যন্ত প্রাণটা ফেটে গেছে ব্রজনাথের। তাই না নিজের পকেট থেকে মুঠো মুঠো টাকা দিয়ে আসেন তাকে খরচ বলে। ভদ্রলোকের ছেলে, সাহায্য বললে আহত হবে।

    মহৎ টহৎ কিছু না। মানুষের কর্তব্য যতটা সম্ভব করা যায়। যাক, মিসেস রায় তোমার ব্যবহারে সন্তুষ্ট তো?

    কি করে বলব বলুন?

    বাঃ সে কি! না না এটা তো ঠিক নয় মা। তুমি জানবে না? আমি তো তোমায় খুব বুদ্ধিমতী বলেই জানি। সর্বদা ওঁর সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। ওঁর হৃদয়ের সব স্নেহটুকু–যা ওঁর হারানো মেয়ের জন্যে হৃদয়ে ভরা ছিল, তার সবটুকু নিংড়ে বার করে নেবে। ওই ইয়ার ছোকরাটি, ওই ভাইপোটি মহা ঘোড়েল বুঝলে? ওঁকে একেবারে কবলিত করে ফেলেছিল, ওঁর সব স্নেহ ভালবাসা কেড়ে নিয়েছিল। আর কিছুদিন দেরি হলেই সব লেখাপড়া করিয়ে নিত নিজের নামে।

    যাক, নেয় নি তো? আবার সেই হাসির ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠে সীমার মুখে, তাড়াতাড়ি বাঁধটা দিতে পেরেছেন।

    তুমি আমায় ব্যঙ্গ করছ সীমা? ব্রজনাথ আহত হলেন। অভিমানী ব্রজনাথ।

    কি আশ্চর্য! ব্যঙ্গ করব কি? আপনি আমাকে দুর্দশার পাতাল থেকে স্বর্গে এনে পৌঁছে দিয়েছেন, আমি আপনাকে–

    কিছু না, কিছু না, আমি নিমিত্ত মাত্র। সবই নিজ নিজ অদৃষ্ট! নইলে মিসেস রায়ের তো আরো ভাইপো-ভাইঝি আছে, ওই ইয়ার ছোকরাটিই বা কেন! যাক, ওই কথাই রইল। আমি আসছি বিকেলে। ট্যাক্সিতেই যাব।

    ওদিকে কিন্তু সুনন্দা অন্য ব্যবস্থা করেছে ইত্যবসরে! উদ্দালককে নির্দেশ দিয়েছে টুলুকে তার পুরনো আস্তানায় একবার ঘুরিয়ে আনতে। বলেছে–সেখানে যেন বেশিক্ষণ থাকে না। সেই তো শুনেছি বস্তি, গলি, নোংরা আর নেহাৎ-ই হা-ঘরে মতন–তুই বরং তারপর ওকে একটু গড়ের মাঠে কি লেকে কোথাও

    উদ্দালক গিয়ে সে কথাই বলে–শ্ৰীমতী নিধি আজ বিকেলে একটু প্রস্তুত থাকবেন। আপনার মাতৃদেবীর আদেশ হয়েছে আপনাকে হয় লেকে নয় গড়ের মাঠে চরিয়ে আনতে। এখন যে মাঠের ঘাসে আপনার অভিরুচি।

    –দেখুন, ভাল হবে না বলছি।

    –যতক্ষণ আপনি আজ্ঞে ততক্ষণ ভাল হবার কোন আশা নেই। মান্য ভক্তি করে দাদা বলবে। গড় করবে তবে

    সীমা তীক্ষ্ণ একটু হেসে বলে, দাদা বলতে আমার দায় পড়েছে। দাদা আপনাকে আমি জীবনেও বলব না।

    –আচ্ছা, কেন বলত? উদ্দালক ঈষৎ অবাক হয়ে বলে–লক্ষ্য করে দেখছি প্রথমাবধিই তোমার আমাকে দাদা বলায় আপত্তি। কেন বলত? দাদা তো লোকে যাকে তাকেই বলে। বলে–পাড়াতুতো দাদায় দেশ ভরা। আর এ তো সত্যিকার জলজ্যান্ত মামাতো ভাই

    সীমার মুখটা কি পাংশু হয়ে ওঠে হঠাৎ? কিন্তু কেন? সুনন্দাকে তো নিতান্ত সহজেই মা বলতে পারছে আজকাল। তবে উদ্দালকের বেলাতেই বা ওই নিতান্ত সহজ দাদা ডাকটা কিছুতেই মুখে আসে না কেন? কেন, শুনলেই মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে? পণ করে বসে থাকে বলব না বলব না। বড় ভাইয়ের স্নেহ নিয়ে তো এগিয়ে আসছে উদ্দালক। সীমা কেন ছোট বোনের হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে পারছে না তা?

    আপনাকে আমার ভাবনা ভাবতে হবে না। আমার যেখানে যাবার নিজেই যাব।

    –তোমার ভাবনা ভাবতে আমার দায় পড়েছে। দায় পড়েছে কথাটার ওপর জোর দেয় উদ্দালক সীমার অনুকরণে। আবার বলে–আমি ভাবছি আমার পূজনীয়া পিসিমার কন্যার কথা। বিকেলে প্রস্তুত থেকো। তোমার সেই আগের বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছেন। ড্রাইভার বুঝি ছুটি নিয়েছে–

    সীমা ওর কথায় কান না দিয়ে বলে–আপনি গাড়ি চালাতে পারেন?

    গাড়ি? গাড়ি চালাতে পারব না? গাড়ি চালানো আবার একটা কাজ নাকি? শিখতে চাও? বল তো শিখিয়ে দিতে পারি।

    -মাইনে দেবার ক্ষমতা নেই, চাই বললে চলবে কেন? বিনা মূল্যে কিছু নিতে পারা যায়?

    উদ্দালক সহসা একটু গম্ভীর হয়ে যায়। বলে,–পারবে না কেন? ইচ্ছে থাকলেই পারা যায়। কিন্তু সে ইচ্ছে তোমার নেই।

    সীমা মুখ তুলে একটুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর বলে–আর এমন যদি হয়, ক্ষমতাই নেই।

    মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, উদ্দালক বলে মনে হয়, জীবনে কখনো বুঝি তুমি স্নেহ ভালবাসা শ্রদ্ধা সম্মান কিছুই পাও নি। তাই তার স্টকই নেই তোমার মধ্যে।

    উদ্দালক চলে যায়। উদ্দালক আহত হয়েছে।

    ওর মত ছেলেও আহত হয়? তা হয় বৈকি। কতগুলো দিন কেটে গেল, কত আগ্রহ করে ভাইয়ের ভালবাসা নিয়ে এগিয়ে এল সীমার হৃদয়ের কাছে, কিন্তু সীমা তার প্রতিদান দিতে পারছে না। সে ভালবাসা প্রতিহত হয়ে ফিরে যাচ্ছে।

    কিন্তু সীমা কি করবে? সীমার নিজেরও যে শাসন নেই। সীমার জিভ দুধের জন্যে উন্মুখ নয়, সে চায় লবণ স্বাদ। কিন্তু সমুদ্রে কি সে স্বাদের সাধ মেটে? মেটে না। তাই উদ্দালকের স্নেহ সমুদ্র কাজে লাগছে না।

    .

    যতীন সেনের বাড়িটা আজকে একটু ভব্য মূর্তি ধারণ করেছে।

    দাওয়াটা ঝাড়া মোছা, তার উপর একখানা নতুন মাদুর বিছানো। ঘরের ভিতরের চৌকির উপরকার বিছানাটা বহুকালের নিরাবরণতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়েছে একখানা কোরা মার্কিনের চাদর মুড়ি দিতে পেয়ে।

    ছোট ছেলেমেয়ে তিনটের গায়েও নতুন গেঞ্জি, কোমরে জাঙিয়া। হ্যাঁ, সোজাসুজি একই পোশাক এনে দিয়েছে যতীন, ছেলেমেয়ে বলে আলাদা বিভাগ রাখে নি।

    কি দরকার। আলাদা টালাদা করতে গেলেই তো একজনেরটা ভিজে থাকলে আর একজনেরটা পরার অসুবিধে। মেয়েটা গেঞ্জি পরতে পারে। ছেলেরা তো ফ্রক পরতে চাইবে না।

    অপেক্ষাকৃত বড় মেয়েটা তার সবচেয়ে ভাল শাড়িটাই পরে বসে আছে।

    যতীনের পরনে ফুটোহীন লুঙ্গী।

    যতীনের বৌয়ের অঙ্গে শুধু ফরসা শাড়িই ওঠে নি, একটা জামাও উঠেছে। আধ-ছেঁড়া একটা ব্লাউস। একজনের পরিত্যক্ত। সে আর কোনদিন ওইটার ওপর দাবী জানাতে আসবে না নিশ্চয়। সে এখন বড় লোক হয়েছে। দারুণ বড় লোক।

    মোটমাট যতীনের বাড়িটা আজ উৎসবের চেহারা ধারণ করেছে, যতীনদের বাড়ির সদস্যদের মনেও একটা আবেশময়, সম্ভাবনাময় উৎসবের ছোঁয়াচ।

    যতীনের বৌ ধীরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে,হ্যাগো, তিলের নাড় খাবে সীমা?

    -খাবে না কেন? যতীন বলে–তুমি নিজেই তো বললে-খুব ভালবাসে।

    -সে তো তখন বাসতো। তাই বাধীরার চোখে জল আসেজুটতো কই? কিন্তু এখন কত রাজা উজিরী জিনিস খাচ্ছে, আর কি মুখে রুচবে তিল আর ভেলিগুড়?

    যতীন মুখটা বিস্বাদ করে বলে মানুষের মেয়ে হলে রুচবে। অমানুষের মেয়ে হলে রুচবে না।

    বাপের হিসেব ধরতে হলে তো রুচবেই না। বলে ঠিকরে উঠে দাঁড়াল ধীরা, নামের মর্যাদা না রেখেই। না, নামের মর্যাদা রাখার ক্ষমতা আর নেই ধীরার। অনেক দিন হারিয়েছে।

    অথচ ছিল। যখন সেই এক নিভৃত পল্লীর কাকচক্ষু পুকুরের ধারে নতুন বানানো ছোট্ট গোলাপী রঙের বাড়িটিতে মাথায় ঘোমটা টেনে টেনে বেড়াতো। তখন ছিল সেই ক্ষমতা শেয়ালদা স্টেশনের পরিবেশ তার ঘোমটা খুলে দিয়েছে। শুধু মাথারই নয় মনেরও।

    জমিদারের গোমস্তা গেরস্ত যতীন সেন আজ সরকারের ভোল নিয়ে খাচ্ছে আর জবর দখলি জমিতে বাস করছে-তার বৌ কি আর কাজল পরা চোখ তুলে মিহি হাসি হাসবে?

    ওদের একটা জীবন ছিল। সে জীবনটা ওরা হারিয়ে ফেলেছে, ভুলে গেছে ওরা, আর একটা নতুন জাত তৈরি হয়েছে। হ্যাঁ নতুন জাত। সেই জাতের মাথার মধ্যে আর কোন কিছু নেই। আছে শুধু প্যাঁচ। কোন্‌খানে কতটা প্যাঁচ দিলে কি আদায় হতে পারে এ চিন্তা ছাড়া আর কোনও চিন্তা নেই যতীন সেনদের।

    সেই চিন্তাই করছিল যতীন। তুমি ব্ৰজ উকিল পাঁচ কসছ বসে বসে, ভাবছ যতীন যেন অবোধ অজ্ঞান। তোমার ভিক্ষামুষ্ঠিটুকুই তার পরম পাওয়া। কেন? বলি কেন? তোমার বুদ্ধি আছে আর তার নেই? তুমি বেড়াও ডালে ডালে তো সে বেড়ায় পাতায় পাতায়। সে ও

    দিদি এসেছে! দিদি এসেছে! তুমুল কলকল উঠল গুটি তিন চার কণ্ঠ থেকে।

    না বাড়ির গাড়ি নয়। রায় কোম্পানির কর্তীর সেই বিরাট গাড়িখানা এ পাড়ার রাস্তাতেই ঢুকবে না। ট্যাক্সিই। মোড়ের মাথা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রজনাথ ছেড়ে দিয়ে গেছেন। সীমার তাই ইচ্ছে।

    দিদি দিদি। আমাদের জন্যে কি এনেছ?

    সীমা মাদুরের ওপর বসে পড়ে। আর সহসা যেন একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষার জ্বালা অনুভব করে। দাওয়াটায় দিব্যি একখানা মাদুর পাতা হয়েছে। সীমার আমলে এ সব হয় নি। দু-খানা বই খাতা নিয়ে বিছিয়ে বসবার জায়গা পায় নি কোনদিন।

    আবার তখনি লজ্জায় লাল হয়ে গেল, ছি ছি, এই টুকুতে এই ভাবছে সীমা? কেন তবে চলে গেল সীমা এদের ছেড়ে? এদের দাওয়ায় মাদুর পড়বে, এদের বিছানায় চাদর পড়বে, এদের পেটে ভাত পড়বে, তাই না।

    কই দিদি দেখাচ্ছ না?

    সীমা সঙ্গে করে আনা সুটকেসটা খোলে। জামা কাপড় তেল সাবান বিস্কুট মিষ্টি! জনে জনে সকলের নাম করে।

    ভাগাড়ে চিল পড়ার মত কাণ্ড ওঠে একটা। এত সব কেন কিনেছে সীমা? সীমা কি দীর্ঘ দিনের অন্নঋণ শোধ করতে চায়?

    ধীরা জামাগুলি তুলে তুলে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, এত সব ভাল ভাল জামা কেন আনা বাপু, এই দামে দুটো তিনটে হত।

    সীমা মৃদু গলায় বলে, আবার হবে।

    ওমা, তা মাপটাপগুলো তো ঠিক হয়েছে, ধীরা বলে, চোখের আড়ালে থেকেও হয়েছে তো ঠিকঠাক।

    সীমা কিছু বলে না। শুধু ধীরার দিকে একবার চোখ তুলে তাকায়। লাল লাল ভারী ভারী চোখে।

    ধীরা লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি উঠে যায়। বলে, যাই মিষ্টি আনি। তিলের নাড় করেছি তোর জন্যে।

    তিলের নাড়ু! তবু ভাল। যতীন সেনের সংসার যে একদিনের বাজার খরচ বাঁচিয়ে সীমার জন্যে রাজভোগ আনিয়ে রাখে নি, এতেই কৃতজ্ঞ সীমা।

    যতীন বলে, মাগী কিছু বুঝতে-টুঝতে পারছে না তো?

    সীমা চোখ তুলে বলে, ওঁর সম্পর্কে একটু ভালভাবে কথা বল বাবা।

    ও বাবা! ইরি মধ্যেই খুব যে টান দেখছি। মেয়ে সন্তান এমনিই হয়, যতীন বলে, হুঁ, তা সেই মহিয়সী মহিলাটিই না হয় বলছি। সন্দেহ-টন্দেহ করছে না তো?

    না।

    করবে না জানতাম। তুই তো আমার কম ঘুঘু মেয়ে নয়। বলে কলোনিতে থিয়েটার করে ফাস্ট হলি সেবার। একটা ভাইপো আছে না?

    আছে।

    সে ছোঁড়া কেমন? ব্রজ উকিল তো বলে—

    বাবা আমি যাই।

    সে কি, এখুনি যাবি কি? তোর মা-র সঙ্গে দুটো গাল গল্প কর? ও যে একেবারে সীমা সীমা করে মরে যাচ্ছে

    কেন! সীমা দাঁড়িয়ে ওঠে। তীব্রকণ্ঠে বলে, আমার জন্যে আবার মরবার কি আছে? আমি, কত সুখে আছি, রাজার হালে আছি। সোনার খাটে গা রূপোর খাটে পা। ছানা চিনি আমার মুখে রোচে না, চপ কাটলেট আমি চিবিয়ে ফেলে দিই–

    যতীনের ছোট ছেলেটা আঁকড়ে ধরে সীমাকে। বলে, দিদি! ফেলে দিস?

    সীমা ওর দিকে তাকায়। যেন মাতালের নেশা ভঙ্গ হয়। ওর গায়ে হাত রেখে বলে, পাগল হয়েছিস? তাই আবার পারে মানুষ? ঠাট্টা বুঝিস না?

    বয়সে একটু বড় হয়ে যাওয়া বোন রীতা মুখটা সিঁটকে বলে, ঢং করে এ রকম একটা বাজে শাড়ি পরে এসেছিস কেন দিদি? ব্রজ উকিল তো গল্প করে গেল–গিন্নীর তিন আলমারি শাড়ি নাকি তোকেই দিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া প্রতিদিন শাড়ির ওপর শাড়ি আসছে।

    সীমা ওর ওই বিদ্বেষ তিক্ত মুখটার দিকে তাকায়। বিষাক্ত একটা কথা মুখের আগায় আসে, সামলে নেয়। না, আর নেশায় বুদ্ধিভ্রংশ হবে না সে।

    ছোট বোনের গায়ে হাত রেখে বলে, কেন শুনিস বুড়োর বাজে কথাগুলো। ওঁর ওসব। শাড়ি-টাড়ি পাবে ওই ভাইপোর বৌ। সে-ই সর্বেসর্বা!

    ভাইপো-বৌ! ধীরা চমকে ওঠে, সে আবার কে? ভাইপো-বৌ আছে নাকি?

    আহা ভাইপো যখন আছে, বৌও আসবেই একদিন!

    তবে যে বুড়ো বলেছিল কেউ কোথাও নেই। শুধু মাগী একলা।

    সীমা এত বিচলিত হচ্ছে কেন? সীমা কি এর আগে এই কলোনির লোকের কথাবার্তা শোনে নি?

    ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা সম্পর্কে এর চাইতে সমীহ সম্ভ্রমপূর্ণ বিশেষণ কবে ব্যবহার করেছে যতীন, ধীরা, ওদের ছেলে মেয়েরা?

    সীমা কী হঠাৎ আকাশ থেকে পড়ল? তাই এখান থেকে এই বন্ধ বাতাস থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবার জন্যে প্রাণ ছটফট করছে তার?

    যতীন সেন স্ত্রীকে ধমকায়, থামো, যা জানো না, তা নিয়ে ভ্যান-ভ্যান করো না। ভাইপো বোনপো ভাগ্নে ভাগ্নী থাকবে না লোকের? তা নিয়ে চিন্তার কি আছে? তবে ব্রজ উকিল যে মনে করেছে সে একাই ঘুঘু তা যেন ভাবে না। আমিও যতীন সেন। তেমন দেখলে ওই উকিলের কাছা খুলে দিয়ে

    বাবা আমি যাই।

    যাবে। যাবে। আর যে এখানে তিষ্ঠোতে পারছ না তা বুঝতেই পারছি। তা সঙ্গে কিছু এনেছ?

    না। সব খরচ করে ফেলেছি।

    কি, ওই সব জামা জুতো সাবান এসেন্স কিনে? কেন? অত সবের দরকার কি ছিল? নজর তিন দিনেই লম্বা হয়ে গিয়েছে দেখতে পাচ্ছি। সেই যে বলে না ফোঁটা চন্ননের ব্যাটা চন্দন বিলাস, এ দেখছি তাই। বলে টাকার জন্যে মরে যাচ্ছি আমি। হাঁ করে আছি কবে তুই আসবি, টাকার গোছা আনবি। নইলে ঘরের মেয়েকে কেউ পরকে বিলিয়ে দেয়? অনেক দুঃখেই

    সীমা উঠে দাঁড়াল। বিষতিক্ত একটু হাসি হেসে বলে, বিলিয়ে দেওয়া কথাটার অন্য মানে বাবা। অভিধানে দেখা। কিন্তু আমার কাছে অনেক বেশি আশা করলে চলবে কেন? আমার হাতে তো আর ওদের লোহার সিন্ধুকের চাবি নেই? তোমার আশ মিটবে এত টাকা আমি কোথায় পাব? আমায় হাত খরচ করতে যা দেন

    লোহার সিন্ধুকের চাবি বাগাবে। সেইজন্যেই তো পাঠানো হয়েছে তোমায়। গাঁজাখোর গোঁয়ারের মত চেঁচিয়ে ওঠে যতীন। শুধু তুমি রাজকন্যে হয়ে আরাম খাবে, এইটুকুর জন্যে এই রিস নিয়েছি আমি? এই বলে দিচ্ছি যে কোনও কৌশলে টাকা কিছু হাতাবে

    কথা দিতে পারছি না বাবা। সীমা শান্ত ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু কথার শেষটা কি ভঙ্গীর সঙ্গে খাপ খেল? শেষ কথা বলে, কিন্তু এই ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছি কি দাম ধার্য করা হয়েছিল তোমার সবচেয়ে সেরা মেয়ের? কটা টাকায় বেচেছিলে তাকে ব্রজ উকিলের কাছে? যে, সেই মেয়ে-বেচা টাকা এখুনি ফুরিয়ে গেল? তার থেকে দরিদ্রদশার এক কণাও ঘুচল না? এবার তবে আবার কোনও নতুন গল্প ফাঁদো। আরও একটা মেয়ে তো রয়েছে তোমার। বড় হয়ে ওঠা মেয়ে। এবার তাকে বেচে–রাগে ছুটে বেরিয়ে যায় সীমা। বোধকরি চোখের জল ঢাকতেই অত ছুট।

    .

    অনেকক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে রইল ধীরা। তারপর নিশ্বাস ফেলে বলল, পয়সার গরম এমনি জিনিস। ভাইবোনগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখল না, একবার মা বলে গলাটা ধরল না। আর আমি

    যতীন ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের সংমিশ্রণে গঠিত একটা শব্দ করে বলে, মেয়েমানুষ যে! নেমকহারামের জাত।

    অন্য দিন হলে এই মেয়েমানুষ শব্দটা নিয়ে খণ্ডপ্রলয় বেধে যেত ধীরার সঙ্গে। আজ আর কিছু হল না। চুপ করে রইল ধীরা। যেন এতদিন সীমা ওর কাছে ছিল, আজই প্রথম হারিয়েছে তাকে। আজই প্রথম বিচ্ছেদ।

    রীতা বলল, পদ্মদি মিনাদি রাধা ঊষা সবাই বেড়ার ওধারে ভীড় করে দাঁড়িয়ে রইল, কারুর দিকে তাকাল না দিদি। গট গট করে চলে গেল।

    হুঁ।

    যতীন নাকের পথে একটা দাবদাহকে বুক থেকে নামিয়ে বলে, যা বুঝেছি প্যাজ পয়জার দুই-ই হল! ঘরের চেঁকিই বিভীষণ হয়ে উঠল। এর থেকে যে সিনেমায় নামাতে চেয়েছিলাম, সে একশো গুণ ভাল ছিল। জটিল কুটিল পথ ধরতে গেলেই এই হয়। তখন মনে হত সংসারের অবস্থা ফেরাতে মেয়ে আমার বুঝি প্রাণ দিতে পারে, ইজ্জত দিতে পারে। উবে গেল সে মায়া মমতা! সনৎ দাসের মেয়ে দুটো তো দেখছি ওর চেয়ে ঢের ভাল। ইজ্জত বিকোচ্ছে, কিন্তু মা বাপ ভাই বোনকে বুকে করে আগলে রেখেছে। সংসারের অবস্থা ফিরে গেছে সনৎ দাসের।

    .

    আলোচনা ক্রমশই উদ্দাম হয়ে ওঠে।

    ঘৃণা আর ধিক্কারের ভাষা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। কলোনির আরও অনেকে এসে জড় হয়। পদ্ম মীনা রাধা ঊষা। যারা এতক্ষণ বেড়ার ওধারে থেকে নাটক অবলোকন করছিল।

    তারা অবশ্য প্রকৃত রহস্য জানে না।

    তারা জানে সীমাকে না কি কোন এক বড়লোকের বিধবা পুষ্যি নিয়েছেন। তাই কপাল ফিরে গেছে সীমার। এখন সীমা সোনা চিবোচ্ছে রূপো মাড়াচ্ছে। আর স্রেফ হাত খরচার জন্যে যা পাবে, তাতে যতীন সেনের অবস্থা ফিরিয়ে দিতে পারবে।

    প্রশ্ন উঠেছিল বটে জগতে এত লোক থাকতে যতীন সেনের মেয়েকেই বা হঠাৎ পুষ্যি নেবার ইচ্ছে হল কেন সেই বড়লোকের বিধবার? আর তাই যদি হল সব চেয়ে বড় মেয়েটা কেন? আরও তো ছেলে মেয়ে আছে যতীনের। ধাড়ি শালিখ কি পোষ মানে?

    এর আর নতুন কোনও উত্তর নেই, একটাই উত্তর। বহু নামে এক বরাত! অদৃষ্ট! কপাল।

    পাতা চাপা কপাল সীমার।

    সামান্য একটু বাতাসে সে পাতা উড়ে গিয়ে কপাল খুলে গেছে!

    সেই খোলা কপাল সীমাকে দেখতে এসেছিল ওরা। তার আগে বলাবলি করেছে অনেক কিছু। খুব কি সেজেগুজে আসবে সীমা? এক গা গহনা পরে? বড়লোকের পুষ্যি কন্যে হয়েছে যখন।

    তা হয়তো আসবে না। লজ্জা করবে।

    ছোট ছোট ভাই বোনের গায়ে জামা জোটে না। মার পরনে ছেঁড়া শাড়ী। অবিশ্যি বেশিদিন আর থাকবে না এরকম। সীমাই দুঃখু ঘোচাবে এদের। চাইকি সেই ধর্ম-মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আর দুএকটা ভাই বোনেরও গতি করে নেবে। নেবে না কেন, তাদের যখন লক্ষ্মীর ভঁড়ার।

    যতীন সেন না কি এই কলোনি থেকে উঠে যাবে। যা যাওয়াই স্বাভাবিক। বড়লোক হয়ে যাওয়া সীমা কি আর বাপ মাকে ফেলে রাখবে এখানে? তা ছাড়া নিজেই বা সে এই পচা গলিতে ঢুকবে কেন আর? বড়লোকদের তো অমন দশ বিশ খানা ভাড়াটে বাড়িও থাকে, তারই একখানা বিনি ভাড়ায় পাইয়ে দেবে বাপকে! পাতা চাপা কপাল একা সীমারই নয়। যতীন সেনেরও।

    এমনি অনেক আলোচনা অনেক কল্পনা চলেছে ওদের, সীমা চলে গিয়ে অবধি। যতীন সেনের প্রতি তীব্র একটা ঈর্ষায় গা জ্বালা করেছে। তবু দেখবার সাধ ষোলো আনা।

    তাই আজ যখন ধীরা পাবলিক কলে জল নেবার সময় টিপে টিপে খবরটা ছেড়েছিল, আর বলেছিল সীমার জন্যে খাবার করে রাখতে হবে, দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবার সময় আজ আর নেই ওর, অতএব সবাই তফাৎ যাও, সত্যিই সবাই তফাতে সরে গিয়েছিল ধীরাকে আগে সেরে নিতে দিয়ে।

    আশ্চর্য! টাকা বস্তুটা এমনই প্রভাবময়। টাকাবানের প্রতি হিংসে আসে, বিদ্বেষ আসে, কিন্তু কিছুতেই অগ্রাহ্য আসে না।

    তা ধীরা চলে গেলে ওরা জটলা করে ঠিক করেছিল সীমা যখন আসবে, দেখতে যাবে। অবিশ্যি লেখাপড়া নিয়েই বেশি বেশি থাকত সীমা, এই পদ্ম মিনা রাধা ঊষাদের মত শুধু ঘরসংসারী কাজ আর পাড়াবেড়ানো নিয়ে থাকত না। তবু একরকম বন্ধু বৈ কি। ওদের জন্যে সীমা এখানে একটা ইস্কুল বসাবার অনেক চেষ্টা করেছে, হয়ে না ওঠায় ওদের সেলাই ইস্কুলে ভর্তি হতে পরামর্শ দিয়েছে, আরও কত সূত্রে কথা বলেছে, মিশেছে।

    ওরা দেখবে না সীমার কখানা হাত বেরুলো?

    .

    এমনও হওয়া অসম্ভব নয়, সীমা সবাইকে মনে রেখে সকলের নামে নামে একখানা করে শাড়ী আনবে। খুব দামী না হোক, মাঝারি মত। বাচ্ছাদের জন্যে লজেঞ্চুস চকোলেট আনতে পারে। নয়তো এও হতে পারে আশে পাশে যে বাচ্ছাগুলো বড় ঘোরে। তাদের হাতে হাতে টাকা দেবে কিছু খাস বলে।

    .

    সারাদিন এইসব জল্পনার শেষে, এসে দাঁড়িয়েছিল ওরা।

    কিন্তু সীমা যেন ওদের বড় যত্নে আঁকা একখানা সুন্দর ছবির উপর কালির পোঁচ টেনে দিয়ে গেল। সীমা যেন ওদের সাজানো খেলাঘরে একখানা থান ইট বসিয়ে দিয়ে গেল।

    .

    সীমা চলে যেতেই বেড়ার এদিকে চলে এল ওরা। মুচকি হেসে বলে, কিরে রীতা, দিদি কি দিল?

    রীতা ঠোঁট উল্টে উত্তর দেয়, ওই যে ওখানে পড়ে আছে।

    তবু ভাল। আমাদের তো মনে হল চিনতেই পারল না তোদের দিদি। না একটু হাসি গল্প, না একটু খানিক বসা। বড় মানুষের পুষ্যি হলে বুঝি এমনিই হয়? রীতা দিদির উপর রাগে জ্বলছিল। অনেক আশায় নিরাশ করেছে দিদি।

    গিন্নীর সেই তিন আলমারি শাড়ীর থেকে লুকিয়ে দুচারখানা শাড়ী দিদি রীতার জন্যে নিয়ে আসবে, এটা যেন নিশ্চিত ছিল। তার বদলে কিনা একখানা সাধারণ ধনেখালি ডুরে!

    যখন লেখাপড়া করত, তখন যে খুব বলা হত, দেখ রীতা, মেয়ে বলেই যে বড় হয়ে গেলেই বিয়ে করতে হবে আর ঘরসংসার করতে হবে, তার কোন মানে নেই। মেয়েকেও ছেলের মত হতে হবে। দেখিস আমি কক্ষণো বিয়ে করব না। চাকরী করব, বাবার কষ্ট ঘোচাব সংসারের অবস্থা ফেরাব।

    রীতার অবশ্য তাতে খুব সায় ছিল, তবে রীতার বিয়েটা হওয়া দরকার। রীতা ঘরসংসার ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না। কিন্তু সে যাক, চাকরী না করেই তো দিদি রাজ ঐশ্বর্যের মালিক হয়ে গেল, তা এই কি প্রতিজ্ঞা রক্ষার নমুনা? দশটা টাকা দিয়ে গেল না মার হাতে? অথচ রীতা ভেবে রেখেছিল হয়তো একশো দুশো টাকা রীতাকেই দিয়ে যাবে হাতে গুঁজে, চোখের জল ফেলে।

    ছি ছি ছি!

    চারিদিক থেকেই ছি ছি ধ্বনি উঠছিল।

    এই ছিছিক্কারের মধ্যে ব্রজনাথ এসে দাঁড়ালেন।

    বলা বাহুল্য মোটেই সসম্ভ্রম সম্বর্ধনা পেলেন না।

    যতীন সেন বলে ওঠে, কোন ঘোটলোকের বাড়ি মেয়েটাকে ভর্তি করলেন মশাই? এই কদিনেই তো মেয়ে বাপের নাম ভুলে গেল! এ করব, তা করব অনেক তো আশ্বাস দিয়েছিলেন, নমুনা তো দেখছি চমৎকার। মেয়ে আমার এলেন শূন্য হাত ঢনঢনিয়ে, মা বলে দশটা টাকা হাতে দেবার ক্ষ্যামতা হল না। বলি মেয়েকে যে আমি আপনার হাতে সঁপে দিয়েছি সে কি অমনি? ….এর থেকে পাবলিক থিয়েটারে প্লে করতে দিলে তো আমার ছিল ভাল।

    ধীরা ওঘর থেকে শব্দভেদী বাণ ছোঁড়ে। বেশ ভালই ছোঁড়ে।

    ব্রজ উকিল রাগেন না, হেঁ হেঁ করেন।

    এসব যে একটু আধটু শুনতে হবে সে কথা ব্রজ উকিলের জানা। যেখানে শুধু অর্থলোভে এতবড় কাণ্ডটায় সায় দিতে পারে মানুষ, সেখানে সে লোভের পুরণ যে সহজে হবার নয় সে কথা ঘুঘু ব্রজনাথ না বুঝবেন কেন?

    কিন্তু সে যাক, আসামী কই? কোথায় সীমা? এসেই কি পাড়া বেড়াতে গেছে নাকি?

    পুরানো বান্ধবীদের জন্যে কাতর হয়েছিল বোধ হয়? অবিশ্যি হতে পারে। কিন্তু তাকে যে ব্রজ উকিল বলে নিয়ে এসেছেন দেরী না করতে।

    ডাক ডাক, কোথায় গিয়ে বসে আছেব্রজনাথ তাড়া দেন।

    আর সঙ্গে সঙ্গে তাড়া দিয়ে ওঠে যতীন সেন। ডাকব? কোন চুলো থেকে? সে কি এখনো এই আঁস্তাকুড়ে আছে নাকি? তিনটে বৈ চারটে কথা বলেনি, ঠিকরে বেরিয়ে গেল। আমায় কেবল মারতে বাকি রেখেছে

    তা রাখুক। বাকী না রাখলেও আপত্তি ছিল না ব্রজনাথের, নিজেরই তার দুঘা বসিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওই মেয়ে চামারটাকে। কিন্তু আসল কথায় যে মাথায় হাত পড়েছে।

    চলে গেছে! একা গেছে!

    এল ব্রজনাথের সঙ্গে, ফিরবে একা, সুনন্দা কি বলবে!

    আবার বলছে রাগারাগি করে চলে গেছে। গিয়ে রাগের মাথায় যদি ফাঁস করে দেয়।

    উঃ কী আপদ! এই হুঁড়ি হারামজাদীগুলো কি এতও নেমকহারাম!

    ছিলি ছাই গাদায় উঠেছিস সিংহাসনে, তার জন্যে চির কৃতজ্ঞ থাকবি তো–যে লোকটা হাত ধরে সেখানে উঠিয়েছিল তার কাছে! তা নয়, যেন ছুরি শানিয়ে বসে আছে খোঁচা মারবার জন্যে।

    তবু একটা ভাল যে গিন্নীর ওই পাজী ভাইপোটার সঙ্গে তেমন ভাব হচ্ছে না। হবে কি করে, পাজীটা মুখে যতই উদারতা দেখাক, মনে তো বুঝছে আমার বাড়া ভাতে ছাই পড়ল।

    আর মেয়েটাও বুঝছে ওই ভাইপোটার চোখ বিপজ্জনক। একা মহিলাকে অভিভূত করে রাখা যায়। কিন্তু ছোঁড়াটা ধুরন্ধর।

    ভাব হয়নি সেটা ভাল। কিন্তু এসব কি! মেয়েটা এত অসভ্য!

    তখন তো একেবারে সাদা কাগজে সই মারলি, আমায় যা করতে বলবেন করতে রাজী আছি, বলুন কি করতে হবে? হারানো মেয়ের অভিনয়? বেশ! এমনিতেই তো বাবা চেষ্টা করে বেড়াচ্ছিলেন যাতে পর্দায় নামাতে পারি। শুধু একটা শর্ত। এই সংসারটাকে টেনে তুলবেন আপনি। আমাকে দিয়ে যদি তার ব্যবস্থা হয়, মরতেও প্রস্তুত আছি আমি।

    এই তার পরিণাম। দুদণ্ড এসে ঝগড়া করে চলে গেলি!

    ছি ছি ছি! তবু ব্রজনাথের দায়িত্ব আছে। ছুটে ফিরে যান।

    .

    সীমা ফিরেছে? ব্যস্ত হয়ে এসে প্রশ্ন করেন।

    দুর্ভাগ্য তার যে পড়লেন উদ্দালকেরই সামনে। উদ্দালক হাতে একটা বই লোফালুফি করতে করতে বলল, গেল আপনার সঙ্গে, আর আপনি এসে জিগ্যেস করছেন ফিরল কি না?

    বরাত আমার তাই জিগ্যেস করছি। সেখানে ছেড়ে দিয়ে একটু ঘুরে আসতে গিয়েছিলাম। জানি গল্পগাছা করবে বসে বসে, করে নিক। মা বাপের–ইয়ে ওই যাদের মা না মাসী বলত তাদের সঙ্গে আর কি–আমি ঘুরে এসে নেব। তা গিয়ে শুনলাম একা গট গট করে চলে এসেছে।

    কই এখানে তো আসেনি!

    আসে নি তার মানে?

    মানে আপনিই জানেন।

    দেখ ছোকরা। তোমার ঔদ্ধত্য আমি অনেক সহ্য করেছি আর না–ব্রজ উকিল ক্ষেপে ওঠেন। সীমার অসভ্য আচরণ, যতীনের যাচ্ছেতাই, ধীরার গালমন্দ সর্বোপরি উদ্দালকের এই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাব ক্ষেপে ওঠার ইন্ধন জোগায়।

    তোমার পিসি ঠাকরুণ, ওই মিসেস রায়কে বলব, হয় আমায় রেহাই দিন, নয় তোমাকে সরান।

    সে কি, আপনাকে এক্ষুনি রেহাই দেবেন কি? উদ্দালক নিতান্ত ভাল মানুষের মত মুখে বলে, রায় কোম্পানীকে দেউলে করান, ব্যবসা লাটে তুলে বেনামীতে নীলামে ডেকে নিন, তবেই তো? এতদিন ধরে নৌকা বেয়ে কূলে এসে তরী ডোবাবেন?

    কী বললে! কী বললে বেয়াদপ ছোকরা–রাগে থর থর করে কাঁপতে থাকেন ব্রজনাথ। সন্দেহ থাকে না তার–সর্বনাশী মেয়েটা সব ফাস করে দিয়েছে। চড়াগলায় বলে ওঠেন, নিশ্চয় সে এসেছে, ডাকো তাকে, কেন সে আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করল শুনে যাই।

    ডাকা যাবে না, উদ্দালক নিরীহ গলায় বলল, মাথা ধরেছে। ঘর অন্ধকার করে ঘুমোচ্ছে।

    বেড়িয়ে ফিরে ঘর অন্ধকার করে ঘুমোচ্ছে?

    সুনন্দা বিরক্তি-মেশা গলায় বলে নিশ্চয় মাথা-টাথা ধরেছে। এই রকম একটা কিছু হবে এ-ভয় আমার ছিল। তাই ইচ্ছে ছিল না আবার পুরনো জায়গায় যাওয়া আসা করে। যতই হোক এতকালের জায়গা, চেনা পরিচিত জগৎ! মন খারাপ তো হতেই পারে।….তা দরকার কি ডেকে কষ্ট নেওয়া, ছেঁড়া চুলে গেরো দেওয়া! আমার তো এখনো ঠাকুর ঘরের কাজ শেষ হয়নি। আরতি পুজো সবই বাকি। শোবার ঘরে ঢুকতে পারব না, কি না কি ছুঁয়ে মরব। দুলু, দ্যাখ দিকি একবার মেয়েটা পড়ে কাঁদছে কিনা।…কাঁদছে নির্ঘাৎ। দ্যাখ বাবা!

    নিতান্ত বিরক্ত মন নিয়েই ঠাকুর ঘরে ঢোকে সুনন্দা। এ মন নিয়ে পুজো হয় না। কিন্তু উপায় কি? তাড়াতাড়ি সেরে নিয়েই যেতে হবে মেয়েটার কাছে।

    তবে পুজোর মন নিয়ে পুজোর ঘরে কবেই বা ঢুকতে পেয়েছে সুনন্দা!….ঢুকেছে কেবলই কান্নার মন নিয়ে। বিরহের কান্নার মন।

    সে কান্না পুজোর ঠাকুরকে পাবার আকুলতায় চিরবিরহী আত্মার ক্রন্দন নয়, নিতান্তই একটা ছোট্ট পুতুল হারিয়ে ফেলার কান্না সে।

    যখনই কোন কারণে মন উদ্বেল হয়ে উঠেছে, তখনই সুনন্দা কান্না লুকোতে ঠাকুর ঘরে ঢুকেছে। এই একটা পরম আশ্রয়ের আর আড়ালের জায়গা মানুষের। মানুষের দেওয়া আঘাতের বেদনাকে নিয়েও সেখানে গিয়ে উজাড় করে দেওয়া যায় নিজেকে। …আর কোন এক সময় হয়তো সেই আঘাতের বেদনাই বিরহ বেদনায় রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।

    কিন্তু আজ সুনন্দার মনে বেদনা নয়, বিরক্তি। এই মন নিয়ে বসে বসে নিজেকে উজাড় করে দেবার ইচ্ছে হবে না। কোনমতে হাতের কাজ সেরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে আনতে কষ্ট হবে। তাই উদ্দালককে পাঠিয়ে দিয়ে ব্যস্ত হাতে আরতির যোগাড় করতে থাকে সুনন্দা।

    .

    এ ঘরে উদ্দালক এসে ঢোকে।

    ফট করে আলোটা জ্বালতেই ধড়মড় করে উঠে বসে সীমা। বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়।

    উদ্দালক খাটের বাজুটার উপর উঠে পা দোলাতে দোলাতে বলে–যাক তবু ভালো, চোখ শুকনো। জলের বদলে আগুন! অবশ্য প্রাণবধের ব্যাপারে দুটোই সমান কার্যক্ষম। দেখো বাপু নিধি, ভস্ম-টস্ম করে বোসো না।

    সীমা চোখের সেই আগুনকে আরও তীব্র করে বলে ওঠে–আপনি এ ঘরে এসেছেন কেন? কে আপনাকে আসতে বলেছে?

    –বলেছেন অবশ্য আমার বিবেচনাময়ী পিসিমা। মানে স্বয়ং গৃহকর্ত্রী।

    –গৃহকর্ত্রী হলেই তিনি যাকে যা খুশি অর্ডার দিতে পারেন? কাউকে যদি কোনও একটি ঘরে দয়া করে থাকবার অনুমতি দিয়ে থাকেন তার সুবিধে, অসুবিধে পর্যন্ত দেখবেন না?

    উদ্দালক ঈষৎ অবাক হয়ে বলে–তুমি হঠাৎ হঠাৎ রেগে আগুন হয়ে ওঠো কেন বল তো? গুরুজনের সম্মান রাখার প্রশ্নটাও যেন ভুলে যাও মনে হয়। মানে বোঝা যায় না। ঈশ্বর জানেন কোন ধরনের পরিবেশে বেড়ে উঠেছ তুমি। তবু লেখাপড়াও তো শিখেছ? এভাবে কেন নিজেকে এ বাড়ির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে চাও? স্বাভাবিক বুদ্ধি, এবং বিদ্যেসাধ্যি এই দুটো মিলিয়ে একটা হিতাহিত জ্ঞানও তো থাকা উচিত।

    –যা উচিত তা যদি সকলের মধ্যে না থাকে? সীমা তীব্রস্বরেই বলে,–সবাই যদি আপনার মত মহামহিম না হতে পারে? এখন যান, আমার ভীষণ মাথা ধরেছে!

    উদ্দালক ঈষৎ গম্ভীর হয়ে বলে,–সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু রোগটা সারানোও তো দরকার?

    –না, কোনও দরকার নেই। আপনি যান।

    উঁহ উদ্দালক দৃঢ়স্বরে বলে–এত সহজে আমাকে হঠাতে পারবে, এ আশা ছাড়ো। পিসিমা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তার আদরিণী হারানিধি নির্জনে পড়ে অশ্রুবিসর্জন করছেন কিনা দেখতে। আর আমি ঠিক করেছি, শুধু দেখতে নয়, সে অশ্রুর মূল উৎপাটন করতে। কেন তুমি মন খারাপ করবে? যাঁদের কাছে এতদিন থেকেছ, তাদের জন্যে মন কেমন করা খুবই স্বাভাবিক, না করলেই বরং হৃদয়হীন বলতাম। তাই বলছি–তাদের তো কাছাকাছি এনে রাখলেই ভাল হয়

    -পাগলের মত কথা বলবেন না।

    নাঃ, সেই আপনি আজ্ঞে, দাদা না বলা! এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। আর তার প্রধান সোপান হচ্ছে, টুলু তুই! টুলু তুই এমন বেয়াড়া আড়বুঝো মেয়ে কেন রে? আমাকে কিছুতেই দাদা বলবি না কি জন্যে? কিছুতেই আপনার ভাববি না কি জন্যে? তাহলে লোকে যা বলে, সেটাই সত্যি বলে ধরে নিতে হবে?

    সীমা চমকে উঠে রুদ্ধকণ্ঠে বললে–কী বলে লোকে?

    –বলে? তা বেশ ভালো ভালো উঁচুদরের কথাই বলে। বলে, তোর বাবার বিষয় সম্পত্তিতে আমি নাকি আগে থেকেই ভাগ বসিয়ে বসে আছি, তাই তুই আমায় দুচক্ষে দেখতে পারিস না। তুই নাকি দারুণ হিংসুটে

    ভুল ভুল! সব মিথ্যে, সব বাজে।–বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ে সীমা।

    উদ্দালক আবার পা দোলানো সুরু করে বলে, তা বেশ, সেটা যে মিথ্যে, বাজে, ভুল, সেটাই প্রমাণিত করছিস না কেন? কেন সহজ প্রসন্ন মনে আমাকে দাদা বলে গ্রহণ করতে পারছিস না? এতে পিসিমা মনে কত কষ্ট পান সেটা ভেবে দেখ? ভেবে দেখ বেচারী মহিলাটির সারাজীবনের ইতিহাস।….সেই কোন অতীত কালে একটি শিশুকে কোলে পেলেন, নেহাতই আধো ভাষায় মা ডাক শুনলেন, তারপর হারালেন সে সব। ভগবান নিল না, নিল কিনা মানুষ! কতবড় কষ্ট সেটা ভাব! এমনি ভাগ্য, তারপর আর কোনও শিশু এল না ওঁর কাছে, সেই মা ডাক আর শুনলেন না। এর মধ্যে স্বামী গেছেন, একা সংসারে চলার কষ্ট পাচ্ছেন, উকিল ম্যানেজার সবাই মিলে ঠকাবার তাল খুঁজছে–

    –শুধু তারাই নয়,সীমা আবার উঠে বসে। বিদ্যুৎ গতিতে যেন।

    তারপর বিদ্যুৎ গতিতেই বলে,–শুধু তারাই নয়, সবাই। পৃথিবী সুদ্ধ সবাই আপনার পিসিমাকে ঠকাবার তাল খুঁজে বেড়াচ্ছে, ঠকাচ্ছে।

    উদ্দালক হেসে ফেলে বলে,–কথাটা অবশ্য খুব মিথ্যে বলনি। আত্মীয় বন্ধু, চাকর দাসী, যে সেখানে আছে, কেউ কিছুতেই সমর্থন করতে পারে না, একটি মাত্র বিধবা মহিলার এত টাকা থাকবে, রায় কোম্পানীর মত অতবড় একটা কোম্পানী থাকবে। কাজেই সে ভারটা যাতে সহজে লাঘব হয় তার চেষ্টা করবে না?…এই তো বেশী কথা কি, আমিই কি কম ঠকাচ্ছি, পিসিমা আমাকে পুষছেন, তাকে একটু দেখাশোনা করব বলে। অথচ ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে তিনিই আমার দেখাশোনা করছেন। আমি শুধু অন্ন ধ্বংসাচ্ছি। এও একরকম ঠকানো বৈকি। তা ওটা পৃথিবীর ধর্ম। তবু মানুষের হৃদয়ের দিকেও তাকাতে হবে। ভাবতে হবে ওই প্রতারিত বঞ্চিত আর চিরদুঃখে নিমজ্জিত মানুষটা যখন এতকাল পরে সেই হারানো সন্তানকে ফিরে পেল, তখন–সে যাতে সেই পাওয়াটা সম্পূর্ণ পেতে পারে তার জন্যে সবাই মিলে চেষ্টা করি।

    সীমা একটু অদ্ভুত হাসি হেসে বলে,আর যদি এমন হয় ওই ফিরে পাওয়াটাই একটা মস্তবড় প্রতারণা, তা হলে আর সর্ণের স্বাদ কে দিতে পারবে?

    উদ্দালক ঈষৎ থতমত খেয়ে বলে–ফিরে পাওয়াটা প্রতারণা! তার মানে?

    –কি? এত স্পষ্ট পরিষ্কার স্বীকারোক্তির পরও আপনি মানে খুঁজছেন?…হঠাৎ একটা নিষ্ঠুর। হাসি হেসে ওঠে সীমা,–ভারী আক্ষেপ আপনার, আপনাকে দাদা বলিনা বলে। তাই না? জানেন, আমি কী? ….কতবড় ঠগ জোচ্চোর! তবে আরও স্পষ্ট করে বলি শুনুন–এই রায় বংশের কেউ নই আমি। কোনদিনও ছিলাম না। স্রেফ নন্দীবাগান কলোনির যতীন সেনের মেয়ে।

    কী? কী বলছ?

    –ঠিক বলছি–আরও নিষ্ঠুর আর আত্ম-ধিক্কারের হাসি হেসে ওঠে সীমা–আরও শুনতে চান? শুনুন–শুনছেন যখন ভাল করেই শুনুন–আমার বাবা বেশ একটি মোটা টাকা নিয়ে আমাকে বেচেছেন, আপনাদের ধর্মপ্রাণ ব্রজ উকিলের কাছে। উকিল মশাই অবশ্য বিরাট এবং মহান একটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই এই পুণ্য কাজটি করেছেন।

    .

    বারে বারে হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

    পুজোর ঘরে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুনন্দা। ধীরে ধীরে হাত চালায়। ঠাকুরের ভোগ হবে, শয়ন হবে, সকালের আরতি পুজোর জন্যে আবার বাসনপত্র ধুয়ে মেজে রাখতে হবে, কাজ তো কম নয়। আর এ ঘরের সব কাজ সুনন্দা নিজের হাতেই করে।

    মনটা শান্ত করে নিত্যকর্মে মন দিল সুনন্দা। হাসছে টুলু। তার মানে মনের মেঘ কেটে গেছে। যাবে, যেতেই হবে। দুলুর হাতে পড়লে মরা মানুষও হাসে। ওর কাছে আর টুলুর মনখারাপ, মাথাধরা এসব ধোপে টিকল না।…এবার থেকে যেখানেই যাক, দুলুর সঙ্গেই যেতে বলব। কিছুতেই ওই উকিলবাবুর সঙ্গে পাঠাব না।…স্বীকার করছি তিনি আমার মস্ত উপকারী। উনি যা করেছেন তার জন্যে চিরঋণী হয়ে থাকব আমি, শুধু এ জন্মে কেন, হয়ত শত জন্মেও ওঁর ঋণ শোধ করতে পারব না আমি। উনিই আমার হারানো মাণিক উদ্ধার করে এনে দিয়েছেন, তবু হে ঠাকুর, তোমার কাছে তো কিছু ঢাকা থাকে না, সবই দেখছ তুমি, সবই জানছ বুঝছ, তাই তোমার কাছে স্বীকার করছি ওঁকে আমার ভাল লাগে না। ওঁকে আমার ভয় করে। মনে হয় উনি যেন টুলুকে নিয়ে কী এক প্যাঁচ কষছেন, যেন দিয়ে আবার কেড়ে নেবেন! …লোকটা চিরদিনই আমার হিতৈষী, এই রায় কোম্পানী উনিই দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, তবু চিরদিনই দেখলে কেমন যেন বিতৃষ্ণা আসে। টুলুও যে ওঁকে দেখতে পারে, তাও নয়। তাই ভাবছি ওঁর সঙ্গে আর পাঠাব না টুলুকে।….দুলু আমার সোনার ছেলে, চাদে কলঙ্ক আছে তো দুলুতে নেই। ও নিয়ে যাবে ওর বোনকে। সেই ভালো।

    চারদিক থেকে ভেবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে বাঁচে সুনন্দা। আরও বাঁচে আর একবার খুব সতেজ হাসির শব্দ শুনে।

    হ্যাঁ, হাসছিল টুলু। ক্ষুব্ধ ব্যঙ্গের হাসি।

    ঠিক সেই সময় আর একবার হেসে উঠল, সশব্দ সতেজ।

    হেসে উঠে বলছিল, হা, ওই আপনাদের রায় কোম্পানীর সর্বেসর্বা ব্রজনাথ উকিল! যেহেতু উনি দেখলেন, দীর্ঘকাল ধরে সিঁধ কেটে কেটে উনি যখন সবে সেই সিধের গর্তের মধ্যে দিয়ে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছেন, তখনই হঠাৎ রায় কোম্পানীর মালিক, তার এক ভাইপো পুষতে শুরু করলেন, আর ধূর্ত ভাইপোটার চোখে উকিলের স্বরূপ ধরা পড়ে গেল, সেই হেতু সেই ভাইপোটাকে সরিয়ে ফেলবার একটা উপায় আবিষ্কার করতে বসলেন তিনি।….ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক ওই ভাইপোটাকে গদিচ্যুত করতে হবে, সেই চিন্তা থেকেই আমার উদ্ভব।….

    উদ্দালক প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলে,কী? বলছ কী?

    –যা সত্য ঘটনা সবই বলছি। বলতে যখন বসেছি, সবটাই বলতে দিন। এই ছদ্মবেশ অসহ্য হচ্ছে। নিজেকে নরকের কীট মনে হচ্ছে। আর প্রতিনিয়ত আপনার ভোলা মনের স্নেহের ডাককে ফিরিয়ে দিতে দিতে–যাক কী বলছিলাম? হ্যাঁ, বুদ্ধিমান উকিলটি ভাবলেন, এই পরিস্থিতির মাঝখানে আসল কোনও মালিককে যদি খাড়া করা যায়, যে ওই ব্রজ উকিলের কথায় উঠবে বসবে নাচবে গাইবে, নাটক অভিনয় করবে, তাহলে তার সব দিক বজায় থাকে।…অতএব রচিত হল একটি গল্প। অনবদ্য গল্প! এক অলীক ডাক্তার, আর অলীক মহিলাকে নায়ক নায়িকা করে! নায়িকাটি মৃত্যুকালে ডাক্তারের কাছে স্বীকার করছেন

    টুলু!

    খাটের বাজুতে বসে থাকা উদ্দালক হঠাৎ বিছানায় বসে থাকা সীমার কাধটা চেপে ধরে রুদ্ধকণ্ঠে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে–টুলু!

    সীমা মুখ তুলে তাকায়।

    আস্তে নিজের কাঁধটা সরিয়ে নেয়।

    আর এবার ঈষৎ আস্তেই বলে,–খুব ভয় পাচ্ছেন, না? আর ঘৃণায় শিউরে উঠছেন? …ভাবছেন এতবড় পাপও সম্ভব? কিন্তু সীমা একটু হাসে, ব্রজ উকিল বললেন, ধর্মকাজ করলাম। একটি সন্তানহারা নারীর শূন্যকোলে তার হারানো সন্তানকে ফিরিয়ে এনে দিলাম, আর একটি বাস্তুহারা অন্নহারা দুঃখী পরিবারকে অন্ন জোগানোর প্রতিশ্রুতি দিলাম।…ভারি সুন্দর করে কথা বলতে পারেন উকিলবাবু। তবে ভদ্রলোক এত দেখে আর এত জেনেও এটা জানেন না যে, মানুষ যখন কিছু খেতে পায় না, তখন মুখ বুজে বসে থাকে। কিন্তু খেতে পেলেই তার হাঁ খোলে। সেই খোলা হাঁ তখন আরও চাওয়ার দাবি তোলে। অন্ন পেলে বস্ত্র চায়, বস্ত্র পেলে বাড়ি গাড়ি চায়, আর তাও যদি পেয়ে যায় তো কুবেরের ভাণ্ডারটাকেই চেয়ে বসে।…তাই জবর-দখল কলোনীর যতীন সেন এই রায় বাড়ির লোহার সিন্ধুকের চাবিটাই দাবি করে বসতে দ্বিধা করে না তার সেই বিক্রীকরা মেয়ের কাছে।

    কথার শেষে ঝুপ করে আবার শুয়ে পড়ে সীমা, আবেগে উদ্বেল হয়ে ওঠে তার দেহ।

    উদ্দালক এতক্ষণ অবাক অপলক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনছিল এই অসম্ভব অভাবনীয় কাহিনী। ভাবছিল–এ কী সত্যি! না এই মেয়েটা এতদিনের পরিবেশ থেকে চলে এসে বেদনায় আর পিসিমার বুভুক্ষু মাতৃস্নেহের প্রবল ধারায় হাঁপিয়ে উঠে শিকল কাটতে চায়। তাই এই গল্প। কে বানাচ্ছে এক অসম্ভব অনবদ্য গল্প? উকিল ব্রজনাথ, না সীমা নিজেই?

    কিন্তু সেই বানানো কাহিনী বলতে কি এমন আবেগ আসে?

    তবু উদ্দালক ধীর স্থির বিবেচনাশীল।

    উদ্দালক বোঝে, যদি সত্যিই সীমার গল্প সত্যি হয়, যদি সত্যিই সীমাকে নিয়ে এই ভয়ানক একটা ষড়যন্ত্র রচিত হয়ে থাকে, কিছুতেই চলবে না সে ষড়যন্ত্র সহসা উদঘাটিত করে বসা।

    তাহলে সুনন্দা পাগল হয়ে যাবে! সুনন্দা হার্টফেল করবে!

    সুনন্দাকে সেই শোচনীয় পরিণতি থেকে বাঁচাতেই মিথ্যার জাল বজায় রাখতে হবে যথাযথ। বজায় রাখতে হবে সুন্দর সুনিপুণ ভাবে।

    অতএব উদ্দালককেও নিতে হবে সেই ষড়যন্ত্রের অংশ। সেই মিথ্যার জাল বোনার কাজে তাকেও লাগাতে হবে হাত। পিসিমাকে সুখী করবার চেষ্টায় আনতে হবে নতুন উৎসাহ, ভাবতে হবে নতুন চিন্তায়।

    তাই উদ্দালক আস্তে ওর কেঁপে ওঠা পিঠটায় একটু হাত রেখে বলে,–সত্যি ঘটনা যাই হোক টুলু, তোমায় হাত জোড় করে মিনতি করছি যা বলেছ তা এখন ভুলে যাও। পিসিমার কাছে চট করে কিছু বলে বোসো না। বড় বেশি আঘাত পাবেন। বহুদিন ধরে ক্ষয় হয়ে যাওয়া মানুষটা হঠাৎ এই নতুন আঘাতের ধাক্কা সহ্য করতে পারবেন না। আমার এ মিনতিটা রাখো।

    তুই শব্দটা আর যেন সহজে মুখে আসে না। টুলু সেই সহজের মুখটায় পাথর চাপিয়ে দিল।

    সুনন্দার ঠাকুর ঘর বন্ধ করার শব্দ পাওয়া গেল। এইবার এখানে এসে পড়বেন।

    উদ্দালক তাড়াতাড়ি খাটের বাজু থেকে নেমে পড়ে, ব্যস্ত চাপা গলায় বলে–এই লক্ষ্মীমেয়ে, দোহাই তোমার উঠে পড়। অভিনয়ের ক্ষমতাটা আরও কিছুটা ভাল করে দেখিয়ে দাও……

    –আমি পারব না।

    –ভগবানের দিব্যি টুলু, দোহাই তোমার।

    সীমা উঠে পড়ে তীব্র ভৎর্সনাময় অথচ বেদনালাঞ্ছিত দুটি চোখ তুলে একবার উদ্দালকের দিকে তাকিয়ে রুদ্ধগলায় বলে–বেশ! তবে যেদিন এই মিথ্যা-জাল বাইরের ঝোড়ো হাওয়ায় ছিঁড়ে পড়বে, সেদিন আর আমার কোনও হাত থাকবে না। সেদিন ওঁকে বাঁচাবার দায়িত্ব কে নেবে, আপনিই বুঝবেন।

    জল উপছে পড়ে সেই দুই চোখে। আগুন উঁকি দেয় তার কোণে।

    উদ্দালক সেই বিচিত্র দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে–উনি নয় টুলু, মা।

    .

    ব্রজ উকিল কি সত্যই অভিমানে রায়বাড়ি ত্যাগ করলেন? মনের দুঃখে বিবাগী হয়ে গেলেন?

    আহা তাই কি সম্ভব! কূলে আসা তরণী নিজের হাতে ডুবিয়ে দেয় মানুষ, তাতে একটা ঢিল এসে পড়েছে বলে? যে দেয় দিক, ব্রজ উকিল অন্তত দেন না।

    তিনি বিষমুখে আবার হাসি টেনে এনে এ বাড়িতে এসে হাজির হন।

    অবশ্য মনে-মনে প্রস্তুত হয়েই হন।

    যদি ওই হাড় বজ্জাত মেয়েটা সব প্রকাশ করে দিয়েই থাকে, তিনি বলবেন–আমি কি করব বলুন? আমি যা শুনেছি, তাই আপনার কাছে এসে বলেছি। আমার সরল মন, পৃথিবীতে যে এত কাপট্য আছে, তা আমার ধারণার বাইরে, জ্ঞানের বাইরে।…তবে হ্যাঁ, সাজা যদি আপনি আমায় দিতে চান, যা দেবেন মাথা পেতে নেব। পুলিশে দিতে চান, তাও দিন। বুঝব এতক্কাল ওকালতি করে খেয়ে এসে যদি এমন ফাঁদে পড়তে পারি, তবে সে আহাম্মকির সেই শাস্তিই আমার হওয়া উচিত।

    নিজেকে মজবুত করেই পরদিন এলেন ব্রজ উকিল।

    শুধু একটা ভাবনা, ঢুকতে ঢুকতেই যদি সেই লক্ষ্মীছাড়া বদ ছেলেটার সামনে পড়ে যান। ওকে দেখলেই যেন ব্রজনাথের মাথা খারাপ হয়ে যায়। বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে আসে। মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে খেলায় চাল দিতে পারেন না। চালে ভুল হয়ে যায়।

    ছেলেটার কোনও বিপদ হয় না কেন ভগবান! শহরে এত লোক গাড়িচাপা পড়ে মরে!

    ভগবান অবশ্য ব্রজনাথের সব প্রার্থনা পূর্ণ করে উঠতে পারেন না। তবে একটা করেন। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই দেখা হয় না উদ্দালকের সঙ্গে।

    আর দেখেন, অবস্থা যথাযথই আছে। ব্রজনাথকে দেখে কেউ বঁটা বা জুতো নিয়ে তেড়ে আসে না, চাকর যেমন চেয়ার এগিয়ে দেয়, তেমনই দিল, যেমন বাড়ির মধ্যে থেকে চা আসে তেমনই এল।

    তার মানে ফাঁস কিছু হয়ে যায়নি।

    পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে মনে মনে একটু হাসলেন উকিল।

    হুঁ হুঁ বাবা, পথে এসো!

    এ জীবনে দেখলাম ঢের! মুখে আস্ফালন করে অন্যকে অপদস্থ করা যত সোজা, স্বার্থহানি করে বসা তত সোজা নয়।….বাছা তখন তো খুব মান দেখালেন, তেজ দেখালেন, বাপকে অপমান করে এলেন, ফিরে এসে তো বুঝলেন, কী রাজ্যিপাটটি ভাগ্যে জুটেছে!….

    তেজ দেখিয়ে সব ফাস করে ফেললেই তো এই সোনার খাটে গা আর রূপোর খাটে পা ত্যাগ করে ফের সেই যতীন সেনের ছেঁড়া কাঁথায় ফিরে যেতে হবে!

    হুঁ!

    বেশ গুছিয়েই বসেন উকিল।

    সুনন্দা আসে। বলে আজ আবার কি কাজ? সই?

    ব্রজনাথ হাসেন। অমায়িক হাসিনা আজ আর কোনও কাজ নিয়ে আসি নি। আজ শুধু ওই ইয়ে আপনার মেয়েকে দেখতে এসেছিলাম! কাল সেই পুরনো ইয়েদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের পর মনটা কেমন থাকল–মানে, হঠাৎ একা একা চলে এসেছিল তো? তাই ভাবলাম–

    সুনন্দা অবাক হয়ে বলে–সে কি? একা চলে এসেছে কি? আপনি?

    ব্রজ উকিল প্রমাদ গোনেন। এ যে তিনি নিজেই খাল কেটে কুমীর আনলেন! এ আলোচনা না ফাঁদলেই হত! হারামজাদা মেয়েটা এখানে এসে কিছুই বোস কাণ্ড করে নি তাহলে?

    উঃ কত বড় শয়তান!

    বাপকে অপমান করে আসার অর্থ তাহলে অহঙ্কার। সেই ছেঁড়া মাদুর আর ঘেঁড়া লুঙ্গি দেখে নাক সেঁটকানি! বুঝেছি!

    তা এসব চিন্তা ক্ষণ মুহূর্তের।

    নিজেকে তার মধ্যেই সামলে নেন ব্রজনাথ। হেসে বলেন–হ্যাঁ তা সে একরকম তাই বৈ কি, মিসেস রায়! আমি ওকে পৌঁছে দিয়ে ভাবলাম ওদের ওখানে বসে থেকে কি করব, যতই হোক আমি একটা বাইরের লোক, কথাবার্তা কইতে অসুবিধে বোধ করবে, একটু ঘুরে আসি। আধঘণ্টা–জাস্ট আধঘণ্টা, তার বেশি দেরী করিনি। গিয়ে শুনি–সেখান থেকে নাকি কেঁদে কেটে চলে এসেছে

    দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করেন ব্রজনাথ সুনন্দার অভিব্যক্তির।

    সুনন্দা ঈষৎ ভুরু কুঁচকে বলে, হ্যাঁ আমিও তাই বুঝলাম। মাথা ধরেছে বলে শুয়ে ছিল। দুলু অনেক ডেকেডুকে কথা বলে তবে–আচ্ছা সেই বাড়িটা কোথায়?

    উকিল হাত জোড় করে বলেন, ওইটি মাপ করতে হবে। তাদের কাছে আমি বাক্যদত্ত আছি। প্রকাশ করব না। জানে তো–আপনি অবস্থাপন্ন, আপনি মহৎ। নিশ্চয়ই তাদের ডাকবেন, দয়া প্রকাশ করবেন, তাই আগে থেকে সাবধান হয়েছে। এই তো দেখুন না, মেয়ে চলে আসার পর যখন গেলাম, বলল, দেখুন মায়ায় পড়ে দেখতে চেয়ে ছিলাম, এখন বুঝছি চাওয়াটা উচিত হয়নি। ওর মনে আর পুরনো স্মৃতি না জাগানোই ভাল।…আর চাইব না!

    সুনন্দা সেই অদেখা, অজানা ভদ্রলোকের মহৎ বিবেচনায় মুগ্ধ হয়। অতএব সেও কিছুটা মহৎ বিবেচনায় আসে, না না সে কি কথা! যাবে বৈ কি! যাবে। তাঁরা ওর কত করেছেন। তবে আরও কিছুদিন যাক। মনটা বসুক।

    –এরপর ব্রজনাথ প্যাঁচের কথায় আসেন।

    –তা আমায় এবার ছুটি দিন মিসেস রায়।

    –আপনাকে ছুটি? সে কী? কেন?

    সুনন্দা একসঙ্গে তিন চারটে প্রশ্ন করে বসে। এ ছুটি যে দু-চার দিনের নয়, চিরদিনের ছুটি, তা যেন ব্রজনাথের কথার সুরেই ধরে ফেলে সুনন্দা।

    ব্রজ উকিল মৃদু হেসে বলেন, কেন? অনেকদিন তো আপনার কাছে খাটলাম, এবার ক্লান্তি এসেছে। তাছাড়া আপনার ভাইপো বড় হয়েছে, সব বুঝতে শিখেছে, তাকেই দিন ভার।

    সুনন্দা হেসে ওঠে,–তাকে ভার দেব? হঠাৎ এ কী কথা?

    না না হঠাৎ নয়। এ আমার চিন্তার ফল মিসেস রায়। সে বুদ্ধিমান বিচক্ষণ, শিক্ষিত ছেলে, তার পিসির বিষয় সম্পত্তি নষ্ট হচ্ছে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক দৃষ্টি, কাজেই

    সুনন্দা বোঝে এ হচ্ছে অভিমান।

    উদ্দালকটা নির্ঘাৎ কোনও কড়া পরিহাস করে বসেছে। অতএব সুনন্দা উদ্দালককেই স্রেফ ওড়ায়। তার কথা যে ধর্তব্যের বস্তু নয়, সে কথা বলে বারবার। এবং এ কথাও বলে, উকিল সাহেব ছিলেন তাই এখনো রায় কোম্পানী টিকে আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি…

    তবু অভিমান দেখান ব্রজনাথ। বলেন রায় কোম্পানীর আসল মালিক তো এসেই গেছে, আর কারোরই কিছু করার দরকার হবে না।

    সুনন্দা সে কথাও উড়িয়ে দেয়, বলে ওটা একটা কথাই নয়।

    অতঃপর ব্রজনাথ প্রসন্নমনে প্রস্থান করেন।

    আর ভাবতে ভাবতে যান। আসল জালের ফাসটাই হাত ছাড়া হয়ে গেছে যেন। লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটা যে হঠাৎ এমন বিগড়ে যাবে, কে জানত!

    প্রথম সেই অবস্থাটা মনে পড়ল ব্রজনাথের। তখন সীমার কী উৎসাহ! হেসেখেলে কথা

    –অভিনয় আমি খুব করতে পারব। দেখবেন ফার্স্ট প্রাইজের যোগ্য অভিনয় করব। এ বরং ভালোই যে, একটা বাড়ির মধ্যে একটি মাত্র মহিলার কাছে মেয়ে সেজে অভিনয়। সংসার চালাবার জন্যে তো পাবলিক স্টেজেই নামতে যাচ্ছিলাম। যা তোক একটা কিছু না করে আর পারছি না, অবস্থা অসহ্য হয়ে উঠেছে।….

    আসার সময়ও কত সাহস! তাদের কত সান্ত্বনা দেওয়া! এ বাড়ির ভাত খেয়েই মতি বুদ্ধি বদলে গেল! ছি ছি!…আমায় যেন একেবারে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাবে। আচ্ছা কেমন তুমি ঘুঘু দেখছি! ফাঁদটা আগে দেখ তুমি!

    .

    কিন্তু ব্ৰজ উকিল আর নতুন কি জাল বিস্তার করবেন?

    সুনন্দাকে আঘাত থেকে বাঁচাতে, সুনন্দার জাল মেয়েকে যে নিত্য নতুন জালে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। তাকে কে বাঁচাবে সেই জটিল জাল থেকে? জালের ফাস যে হাতে নিয়েছে সে তো শুধু মজা দেখছে।

    .

    সুনন্দা বলে, যা দুলু, টুলুকে একটা সিনেমা দেখিয়ে নিয়ে আয়। ছেলেমানুষ, কত আর পড়ালেখা করবে?

    উদ্দালক বলে,–তুমিও চল না পিসিমা?

    –আমি? আমি সিনেমা যাব? না বাবা! তোর পিসেমশাই গিয়ে পর্যন্ত

    অতএব দুলু তারস্বরে ডাক দেয়,–এই টুলু, চল তোকে পথ দেখিয়ে সিনেমা দেখিয়ে আনি। মেলা যেন সাজতে বসিস নি আবার। তোদের মেয়েদের তো

    কোনদিন সুনন্দা বলে,–দুলু, টুলুকে নিয়ে একটু নিউ মার্কেটে যা না। কতদিন কিছু সখের জিনিস কেনে নি।

    দুলু চেঁচিয়ে বলে,–তাহলে অন্তত হাজারখানেক টাকা দাও সঙ্গে। টুলু যে সেই তৃষিত চাতকের মত সমস্ত দোকানের দিকে তাকাতে তাকাতে মার্কেটে ঘুরবে সে অসহ্য। আবার বলে,–এই টুলু, মনে মনে ঠিক করে নে কি কিনবি। নইলে হয়তো বাঁশবনে ডোম কানা হয়ে গোটাকতক সতরঞ্চিই কিনে বসবি।

    তারপর পথে বেরিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলে,–কেমন বাঁচিয়ে দিচ্ছি?

    –বাঁচিয়ে? না মরিয়ে? সীমা বদ্ধগভীর দৃষ্টিতে বলে,–দিনে দিনে তো আরও মরণের পথে এগিয়ে চলেছি।

    উদ্দালকও তেমনি দৃষ্টিতে বলে,–শুধু তুমি একা?

    –আর পারছি না। এবার মাকে বলে দিই একদিন। বলি মা, তোমার এই জাল মেয়েটাকে এবার বিদায় দাও।

    -তারপর?

    তারপর আর কি। জবরদখল কলোনীতে তো আজও আছে যতীন সেনের মাটির প্রাসাদ।

    –তারা আবার নেবে?

    –পায়ে পড়লে নেবে।

    –পিসিমার একটি ভাইপো বৌয়ের দরকার নেই?

    –চুপ! খবরদার! লোভ দেখিও না।

    –তাহলে কি চাও যে পিসিমার ভাইপোটা সন্নিসী হয়ে বেরিয়ে যাক?

    কথার ফুলঝুরি! কথার আলপনা! পথে ঘাটে বাইরে।

    বাড়ি এলে অবলীলাক্রমে টুলুর বেণী ধরে টেনে পিসিমার কাছে ধরে আনে উদ্দালক। বলে, এই দেখ পিসিমা, তোমার আদরের কন্যেটি আমাকে আদৌ মানছে না। বলছি যে আয় একটু অঙ্ক শেখাই, নইলে স্রেফ গাড়ু খাবি! বলে, কি দায় পড়েছে তোমার কাছে পড়তে।

    সুনন্দার চোখে নন্দনকাননের ছবি! এই তো চেয়েছিল সে। দুই ভাইবোন মিলে মিশে খাবে খেলবে, খুনসুড়ি করবে। সুনন্দার শূন্য হৃদয় পূর্ণ হয়ে থাকবে। তারপর একটি মনের মত পাত্র খুঁজে

    না, ঘরজামাই কথাটা শুনতে খারাপ। রায় কোম্পানীর একজন ডিরেক্টর করে দিলেই, মান মর্যাদা বজায় থাকবে তার।আর সুনন্দার এতবড় বাড়ি খালি পড়ে থাকতে কোথায় আর বাড়ি বানাতে যাবে সুনন্দার জামাই? অনেক স্বপ্ন, অনেক ছবি।

    ওদিকে সীমা বলে,–মা-র সঙ্গে আর এই ছলনা চালিয়ে যেতে পারছি না।

    ছলনা ভাঙলে মা-র খুব সুখ?

    তবে এই ভাবেই ন্যাকামি করে চালিয়ে যাব? কোনও দিক থেকে কোনও আঘাত আসবে না? মা তো আমার জন্যে পাত্র খোঁজবার কথা ভাবতে শুরু করেছেন।

    -তাই নাকি? বল কি?

    –আহা, আকাশ থেকে পড়লে যেন! বিয়ের বয়েস হয়নি আমার?

    –তাহলে তো দ্রুত ভাবতে হয় উপায়!

    কিন্তু কি ভাববে? কি ভেবে ঠিক করবে? সত্য প্রকাশ করলেই তো এই মুহূর্তে জালিয়াতির দায়ে ব্রজ উকিল আর কলোনীর যতীন সেনের সঙ্গে হাজতে গিয়ে উঠতে হবে সীমাকে। উঠতেই হবে।

    এতবড় মর্মান্তিক অপমান সহ্য করতে পারবে না সুনন্দা। নালিশ ঠুকে দেবেই। হয়তো বা অন্য রকমও হতে পারে। আশা, বিশ্বাস, ভালবাসা, হঠাৎ সবকিছু হারিয়ে হয়তো সুনন্দা হার্টফেল করে বসবে। অনেক দিনের দুর্বল হার্ট। সীমাকে যে বড় ভালবেসেছে সুনন্দা! বড় বেশি বিশ্বাস করেছে।

    সীমা এই বিশ্বাসের কাছেই কি পরাজিত হয় নি? সেও তো এসেছিল জেনে বুঝে, জালিয়াতির ধর্ম গ্রহণ করে। কলোনীর সনৎ দাশের মেয়েদের মত ইজ্জত বেচে ডুবে যাওয়া সংসারকে বাঁচাবার চেষ্টা না করে, করতে এসেছিল সতোকে বেচে।

    ভেবেছিল খুব সহজ। ভেবেছিল, আমি অভিনয়ে খুব পটু। ব্রজ উকিল থাকবে সহায়। বিষয়-সম্পত্তি সব কিছু আস্তে আস্তে চলে আসবে সীমার হাতে, তারপর সে হাত থেকে কিছু কিছু চলে যাবে হস্তান্তরে। তাই খুব পারব বলে দম্ভ করে কাজে নেমেছিল সীমা, কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল!

    সীমা ভাবে ভালবাসাটাকে অঙ্কের মধ্যে রাখি নি আমি। বিশ্বাসটাকে হিসেবের মধ্যে ধরি নি। আর বিবেককে? বিবেকের যন্ত্রণাকে? ওকে তো ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু সবাই আজ অসুবিধে ঘটাচ্ছে।

    সুনন্দার মনে কষ্ট না দিয়ে আরও কিছুদিন এইভাবে চালিয়ে যাওয়া যেত হয়তো, যদি না উদ্দালক এসে সামনে দাঁড়াত। সুনন্দাকে বাঁচাতে হলে উদ্দালককে ছাড়তে হয়। ছাড়তে হয়। জীবন, জীবনের স্বপ্ন, মন, চৈতন্য, আত্মা।

    না না, উদ্দালককে ছেড়ে আমি বাঁচতে পারব না–মনে মনে বলে সীমা–যা হয় তোক।

    কিন্তু যা হোকের স্বরূপ তো দেখিয়ে দিয়েছে উদ্দালক, বুঝিয়ে দিয়েছে। হাজত, জেল, বিচার, বিচারশালা! কুশ্রীতা, গ্লানি, লাঞ্ছনা, অপমান!

    তবে কি হবে? সুনন্দা কি তার মেয়েকে, মামাতো ভাইকে বিয়ে করতে দেবে? সে মেয়ে অনেকদিন অন্যত্র ছিল বলে? তাই কি সম্ভব?

    এদিকে সুনন্দা তখন অন্য জগতে আছে। ও তলে তলে ভাই ভাজকে চিঠি লিখে লিখে এবার আনাচ্ছে। সে চিঠিতে অভিমান আছে, অভিযোগ আছে। সুনন্দার এতদিনের হারানিধি ফিরে পাওয়া গেল, আর সুনন্দার সবচেয়ে যারা নিজের লোক, তারাই রইল উদাসীন হয়ে?

    একবার দেখতে এল না?

    দাদা লেখে–আরে বাবা, উদাসীন-টুদাসীন কিছু না। মিলিটারিতে চাকরি তো করলি না কখনো? বুঝবি কি? যাই হোক, এবার তারা আসছেন। উদ্দালককে জানাতে বারণ করেছে। সুনন্দা। হঠাৎ অবাক করে দিতে চায় তাকে।

    আর দাদা বৌদির উপস্থিতিতে উদ্দালকের পাশ করাকে উপলক্ষ করে দিতে চায় বিরাট একটি ভোজ।

    গোপন উদ্দেশ্য আরও গভীর। সীমাকে পরিচিত করাতে হবে আরও ব্যাপকভাবে। বন্ধু আত্মীয় দূর কুটুম্ব সকলের কাছে।

    কৌতূহলপরবশ হয়ে যারা এসেছে, তারাই শুধু দেখে গেছে, নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে সুনন্দা তো এতবড় আনন্দের ভাগ দেয়নি কাউকে? সেই ত্রুটি পূরণ করবে সুনন্দা।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশুধু তারা দু’জন – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article নদী দিকহারা – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }