Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মায়াজাল – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প137 Mins Read0
    ⤶

    ৪. সেই শাস্তি

    কিন্তু কতটা সেই শাস্তি?

    অন্তত সীমার জন্যে কতটা শাস্তি ধার্য করতে পারবে আদালতের আইন আর বিচার?

    আবার যতীন সেনের কলোনীর বাড়িতে ফিরে এসে নিঃশব্দে বাসন মাজা, রান্না করা, সাবান কাঁচার চাইতেও বেশি? তাই করছে এখন সীমা, সব কাজ করছে মাকে ছুটি দিয়ে।

    বলছে–আমি তো অনেকদিন আরাম খেয়ে এলাম, ভাল ভাল খেয়ে গায়ে জোর করে এলাম, এইবার খাটি।

    এ খাটুনির সঙ্গে কর্পোরেশনের স্কুলের সেই চাকরিটাও যোগ হল। বাইরে গিয়েছিল সীমা মাস কতকের জন্যে, তাই বলে চাকরিটা আর ফিরে পাবে না?

    না, স্কুলের ওরা জানে না কোথায় গিয়েছিল সীমা। কলোনীর এরা জানে।

    পদ্ম রাধা নীলা স্বপ্ন, আর তাদের বাড়ির সকলে। জানে পাড়ার সবাই।

    কোন এক বড়লোকের গিন্নী নাকি হঠাৎ কোথায় সীমাকে দেখে ভালবেসে ফেলেছিলেন, তাই বলে কয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন পুষবেন বলে। বিধবা গিন্নী, পুরুষশূন্য বাড়ি, তাই আপত্তি করেনি সীমার মা বাপ। ভেবেছিল থাক, একটা মেয়েই খেয়ে পরে ভালভাবে থাক।

    অবিশ্যি এ আশাও ছিল, মেয়েটা চালাকি করে গিন্নীর কাছ থেকে কিছু কিছু হাতিয়ে এনে ভাই বোন মা বাপকে দেবে থোবে। কিন্তু সে আশায় ছাই দিয়েছে মেয়ে।

    নিজের মান বজায় রাখতে কিছু চায়নি কিছু নেয়নি। অতএব কিছু দেয়ওনি। সেই যা। একদিন

    সে তো এরা সবাই দেখে গেছে, শুনে গেছে, গালে হাত দিয়েছে। ছি ছি করেছে।

    তারপর?

    তারপর যা স্বাভাবিক তাই হয়েছে।

    শখ মিটে গেছে গিন্নীর। কি বুঝি একটু রাগ হয়েছিল, একবস্ত্রে বিদেয় দিয়েছে।

    দেবেই তো। কথাতেই তো আছে বড়র পীরিতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণেক চাঁদ! শখ হয়েছিল হাতে চাঁদ দিয়েছিল। এখন যে হাতে দড়ি না দিয়ে শুধু বিদেয় দিয়েছে এই ঢের বলতে হবে।

    ঘুচে গেল রাজকন্যেগিরি!

    নাও এখন হাভাতে যতীন সেনের ঘরে এসে মোটা চালের ভাত রাঁধো, আর রাস্তার কলে গিয়ে কানা-ভাঙা চটা-ওঠা কলাই-করা বাসন মাজো!

    .

    –অহঙ্কারের ফল ফলে বুঝলি দিদি!

    বলেছিল সীমার পিঠোপিঠি বোনটা! যেদিন ফিরে এসেছিল সীমা বাপের হাত ধরে।

    সেদিন মরিয়া যতীনের তেজ করে বেরিয়ে যাবার পর থেকে দুর্গানাম জপ করছিল বসে বসে যতীনের বৌ। আর ভাবছিল, হে ভগবান ওর যেন পথে থেকে মতি ফেরে। যেন গিয়ে রাগারাগি করে সত্যি সব প্রকাশ করে না দেয়।

    কিন্তু ভগবান যথারীতি তার কথা শুনলেন না।

    মেয়ে নিয়ে ফিরে এল যতীন রাগে ফুলতে ফুলতে। লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটা কিনা গায়ের গহনাগুলো পর্যন্ত খুলে খুলে ফেলে দিয়ে এল!

    একটা গিন্নীমত কে যেন বলে উঠেছিল, থাক থাক গায়ের গহনাগুলো আর ফেরৎ দিচ্ছ কেন বাছা! যে মানুষ দিয়েছে ওসব, সে কখনই দেওয়া জিনিস ফেরৎ নেবে না। ও তুমি যেমন পরে আছ থাকো।

    পাজী মেয়ে সে কথা না শুনে গলা থেকে হাত থেকে কান থেকে খুলে খুলে তার সামনেই ফেলে দিয়ে চলে এল! কেন, থাকলে তো সেগুলো ভাঙিয়েও কিছুদিন চলতো! মেয়ে তো নয় শত্রু! পরম শত্রু!

    সীমার মা দেখল দামী একখানা শাড়ী পরে এসে দাঁড়াল মেয়ে ন্যাড়া হাতে ন্যাড়া গলায়। এসেই বলে উঠল–মা ছেঁড়া খোঁড়া নেই একখানা কিছু তোমার? দাও না, পরে লজ্জা নিবারণ করি।

    –শাড়ী! আমার ভেঁড়া শাড়ী পরে লজ্জা নিবারণ করবি তুই?

    ডুকরে কেঁদে উঠল সীমার মা।

    –ওই হতভাগা সর্বনেশে বুঝি সব ফাস করে ফিরিয়ে নিয়ে এল তোকে? ওরে একী লক্ষ্মীছাড়া বুদ্ধি হল ওর? তবু তো একটা পেটও অন্যত্র ভরছিল। আবার সেই বুড়ীর কুলতলায় এসে জুটল। এখন কিনা মেয়ে আমার পুরনো ছেঁড়া ন্যাকড়া পরে লজ্জা নিবারণ করবে!

    সীমা ততক্ষণে ঘরে ঢুকে পরনের সেই ক্রেপ বেনারসীর শাড়ীটা ছেড়ে সত্যিই মায়ের দরুন শতজীর্ণ একখানা শাড়ী পরে এসে দাওয়ায় দাঁড়িয়েছিল। মায়ের কথার শেষাংশে অদ্ভুত একটা তিক্ত করুণ হাসি হেসে বলে ওঠে–আশ্চর্য! আস্ত এতবড় একখানা মেয়ে বেচে কিছুই পাওনি তোমরা? উকিল বুড়ো এতই ঠকিয়েছিল তোমাদের?

    যতীন সেন তীব্র স্বরে বলে–ঠকাবে না কেন? বিশ্বসুদ্ধ লোকই ঠকাবে। ভগবান যাকে ঠকিয়েছে, তাকে আবার জেতাবে কে? তুমি মেয়ে হয়ে ঠকালে না বাপকে? এই যদি তুমি এতদিনে একবারও মনে ভাবতে তাইতো বাবা আমায় পাঠিয়েছে কেন, তাহলে আজকের এই কেলেঙ্কারিটা ঘটতো?…ঘটতো না। এখন পাঁচজনের সামনে উদারতা দেখিয়ে ছেড়ে দিল, সত্যি ছাড়বে ভেবেছিস? এই যদি না বাপ বেটিকে সাতটি বছর শ্রীঘর বাস করতে হয় তো কি বলেছি। মানুষ জাল করা অমনি নয়!

    সীমা দাওয়ার ধারে পা ঝুলিয়ে বসেছিল, সেই অনেক দিন আগের মত খুঁটিতে মাথা ঠেকিয়ে। এখন মাথাটা সোজা করে বলে–তাই বা মন্দ কি বাবা? দুদুটো লোকের সাত সাতটা বছরের মত অন্নচিন্তা ঘুচবে। আমাদের সদাশয় গভর্মেন্ট হয়তো বা দয়ার পরকাষ্ঠা দেখিয়ে তোমার নাবালক ছেলে মেয়েদের এবং অসহায় স্ত্রীর জন্যে কিছু মাসোহারারও ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। সব দিক দিয়েই লাভ!

    ভালই হল! সীমার মা তেতো হাকুচ গলায় বলে লাভের মধ্যে এই হল, দুদিন বড় মানুষের ভাত খেয়ে এসে আরও চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখল মেয়ে। এখন ওই বাক্যি বুলি শোনো বসে বসে। এত মেয়ে মানুষের মরণ হয়, আমার কেন মরণ হয় না তাই ভাবি।

    সীমার পিঠোপিঠি বোনটা বলে উঠেছিল–হবে কেন? ভগবানের দয়া হাড়ে হাড়ে টের পাবে কে তাহলে? এখনো কত বাকী!

    বড় মানুষের ভাত না খেয়েও বাক্যি বুলিতে যে সেও কিছু কম যায় না, সে কথা মনে পড়ে না তার মার।

    .

    এই।

    এই হল প্রথম দিনের অভ্যর্থনার নমুনা। তারপর গেছে কয়েকটা দিন। কাটা হয়ে থেকেছে যতীন সেন কখন পুলিস আসে। তারপর ক্রমশ ভয়টা ঝাপসা হয়ে গেছে।….চলছে দিন।

    সীমাকে কলোনীর সকলের কাছে জনে জনে বলতে হয়েছে তার যাওয়া আসার ইতিহাস। কিন্তু ওর কথা বিশ্বাস করবে কে? ও যদি বলে নিজের ইচ্ছেয় চলে এসেছে সে, আর ভাল লাগছিল না বলে, সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা?

    তবু সবাই এখনো দেখা হলেই সকৌতূহলে প্রশ্ন করে–আচ্ছা তারা আর খোঁজ খবর করেনি?…আশ্চয্যি বাবা! একটা মায়া মমতাও তো পড়ে মানুষের? একটা জীব জন্তু পুষলেও পড়ে। বড়লোকদের প্রাণই আলাদা!

    বলছে। বলে বড় সুখ পাচ্ছে।

    সীমা নির্বিকার!

    সীমা কলতলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে কল খালি হওয়ার অপেক্ষায়। এ যেন কোন এক পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে সীমা তিলে তিলে। মা কাড়াকাড়ি করে বাসন নিয়ে, সাবান সেদ্ধ কাপড় নিয়ে, সীমা ছাড়ে না। চিরদিনের জেদী মেয়ে সীমা!

    মা বলে–মরবি নাকি খেটে খেটে?

    মেয়ে হেসে উঠে বলে–পাগল হয়েছ? এক্ষুণি মরব মানে?

    ***

    –আমি জানতাম।

    উচ্চারণ করেছিল উদ্দালক যেন নির্লিপ্ত নির্মমের মত।

    জানতাম! অনেকদিন থেকেই জানতাম! সব বলেছিল আমায় সীমা। পুলিসে দিতে হলে আমাকেই আগে দিতে হবে।

    উদ্দালকের মা রুদ্ধ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করেছিলেন–তুই জেনেছিলি? তবু প্রকাশ করিসনি?

    –নাঃ!

    –কেন? কেন এমন অন্যায় হতে দিয়েছিলি দুলু? বিষগাছের শেকড় আরও গম্ভীর হতে দিয়েছিলি কেন?

    –পারিনি, বলতে পারিনি মা! হতভাগা মেয়েটা প্রতিদিন বলেছে প্রকাশ করে দেবে, বিদায় নেছে! আমিই ঠেকিয়ে রেখেছিলাম।

    –কিন্তু আমি তো এর অর্থ বুঝতে পারছি না দুলু? কী উদ্দেশ্য ছিল তোর? রাস্তার একটা লোক এসে তোর পিসিকে ওই রকম সর্বনেশে ঠকানো ঠকাচ্ছিল, আর তুই তাতে সাহায্য করছিলি?

    –পিসির জন্যেই।

    –পিসির জন্যেই?

    উদ্দালকের মা উদ্দালকের মুখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিলেন– শুনছ কথা? পিসির জন্যেই পিসিকে ঠকাতে সাহায্য করছিল ও। তার মানে, একটা মাটির ঢেলা নিয়েই যদি শালগ্রাম ভেবে মত্ত থাকে তো থাকুক, এই তত?

    সুনন্দার সেই তুলনাটাই সুনন্দার ভাজ ব্যবহার করেন।

    সুনন্দার দাদা ছেলের মুখের দিকে তাকান। তার অন্যদিকে ফেরানো মুখের দিকে।

    কী দেখেন তিনি ছেলের মুখে?

    তাই এমন অদ্ভুত কথাটা বলে বসেন?

    বলেন–তা সেটাও একটা কারণ বৈ কি! ওর অতখানি আনন্দ আর বিশ্বাসের ওপর হাতুড়ি বসাতে বেধেছিল হয়তো।….কিন্তু দুলু, শুধুই কি পিসির জন্যে? আর কারও জন্যে নয়?

    চমকে মুখ তোলে উদ্দালক।

    বাপের দিকে তাকায়। বাপের সেই স্থির নির্নিমেষ দৃষ্টি সহ্য করতে পারে না, আবার চোখ নামায়।

    তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে মায়ের মুখ, তীব্র হয়ে ওঠে দৃষ্টি!

    তারপর সহসাই বলে ওঠেন–তা বটে। জানাই যখন হয়ে গেছল পিসির মেয়ে নয়, বাধা কি আর?

    উদ্দালক কি আবার চমকে ওঠে?

    না কি উদ্দালক মায়ের দিকে অমন অপলকে তাকায় শুধু শুধুই? কয়েকটা সেকেণ্ড!

    মায়ের চোখের দিকে বরং তাকানো যায়, যায় না বাপের চোখের দিকে।

    .

    যায় না বলেই হয়তো পিসির রোগশয্যার পাশে আত্মগোপন করেছে সে আজ কদিন। সদা সন্ত্রস্ত ভঙ্গীতে রোগীর ঘরে থাকলে, কে তাকে প্রশ্নে জর্জরিত করতে আসবে?

    হ্যাঁ, সেদিন থেকে একেবারে শয্যা নিয়েছে সুনন্দা। রক্তচাপ, দুর্বলতা, বুক ধড়ফড়, অরুচি, অক্ষুধা, ইত্যাদি বহুবিধ অসুখে শুয়ে পড়েছে সে।

    বুক ভেঙে যাওয়া বলে চলতি একটা কথা আছে না? অর্থ কি তার? সুনন্দার কাছে কি সে তার অর্থ নিয়ে এসে হাজির হয়েছে?

    সুনন্দার ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া ঘরখানা ছিল সীমার, সে ঘরের দরজা আজ কদিন বন্ধ রাখা আছে।

    দরজা হাট করা ঘরের শূন্যতাটা বড় বেশি স্পষ্ট আর প্রকট হয়ে ওঠে। সুনন্দা হাহাকার করে বলেছে সে কথা। সেই বন্ধ দরকার দিকে তাকিয়ে উদ্দালক মনে মনে অদ্ভুত একটা ক্ষুব্ধ হাসি হাসল।…বেশ মজার নিয়ম আমাদের সমাজের! শ্রদ্ধা ভক্তি স্নেহ ভালবাসা সবাই আসন পাবে, সবাই মর্যাদা পাবে, তাই নিয়ে যত বাড়াবাড়ি আতিশয্যই কর না কেন, নিন্দনীয় হবে না, কিন্তু প্রেম?

    খবরদার! খবরদার! নাম কোরো না–নাম কোরো না। সে কখনোই ওই হৃদয় বৃত্তিদের কাছে বৃত্তি পাবে না। প্রেম অপাঙক্তেয়, প্রেম নিন্দনীয়, প্রেম লজ্জাকর!

    অতএব এ বাড়িতে সবচেয়ে সহজ আর সাধারণরূপে থাকতে হবে উদ্দালককে। উদ্দালকের পক্ষে সম্ভব নয় একবার ওই বন্ধ কপাটটার ওধারে গিয়ে বসে! দেখে কোথায় কি জিনিস কেমন করে ছড়িয়ে রেখে চলে গেছে সীমা।

    সীমা যখন সাজগোজ করে নীচের তলায় নেমে গিয়েছিল, তখন তো ভাবেনি, আর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠবে না সে।…ভাবেনি। ভাবেনি, যেসব প্রসাধন বস্তুগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেছে, জীবনে আর কোনদিন সেগুলোয় হাত দেবে না।

    সকালবেলাও একসঙ্গে খেয়েছিল সবাই। সুনন্দার আদরের টুলুর ভাত খাবার রূপোর সেই থালাটা বাসনের আলমারির এক পাশে পড়ে আছে বোধহয় ধূলোপড়া হয়ে।…

    সীমার আলনায় যে শাড়ীগুলো ঝুলছে, সেগুলো রাখার সময় কি সীমা স্বপ্নেও ভেবেছিল, অনন্তকাল ধরে ঝুলেই থাকবে ওইগুলো? যেখানে যেমন রেখে গেল সে, সেখানে তাই থাকবে চিরকাল? আর সব কিছুর ওপর দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হবে?

    সুনন্দা কেঁদে কেঁদে শয্যা নিয়েছে, সেটা দুঃখবহ, উদ্দালকের চোখটা ভিজে এলে তা হাস্যকর।

    আর একবার ভাবল উদ্দালক। অদ্ভুত সমাজ আমাদের! জগতের মধ্যে যে বস্তু সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে শুভ্র, সেই বস্তুই লজ্জার। একান্ত লজ্জার।

    উদ্দালকের শরীরে লজ্জার বালাই ছিল না, এখন উদ্দালককে লজ্জা শিখতে হয়েছে।

    নইলে সমাজে নিন্দনীয় হতে হবে উদ্দালককে। লোকে বলবে বেহায়া! বলবে অসভ্য!

    আর উদ্দালকের মা বাপ উদ্দালকের দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন

    কিন্তু উদ্দালক তো শিশু নয়?

    সে কি একবার সীমার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না? বলতে পারে না, সমস্ত সংসার তোমায় ত্যাগ করে করুক, আমি আছি তোমার পাশে!

    বলতে পারে না–সীমা, তোমার জালের জাল ভেদ করে সত্য মূর্তিতে এসে দাঁড়াও সকলের সামনে, সেদিনের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও আমায়!

    পারত হয়তো।

    কিন্তু বাদ সেধেছে সুনন্দা। প্রতি মুহূর্তে যায় যায় অবস্থা ঘটিয়ে! সারাক্ষণ বাড়িতে আটকে রেখেছে!

    তবে সন্ধান সে জানে সীমার। জানে কোন্ কলোনীতে থাকে যতীন সেন।

    ইচ্ছে করলেই যেতে পারে। কিন্তু এখন সে ইচ্ছে করছে না উদ্দালকের।

    মা বাবা ফিরে যান, তারপর দেখা যাবে।

    তাছাড়া সীমা একটু স্থির হোক, একটু শান্ত হোক!

    নিজেকে তাই কদিন আটকে রেখেছে উদ্দালক এই রোগশয্যার পাশে! আর অবিরত মনে মনে মহলা দিচ্ছে সেই কথাটির, যে কথাটি প্রথমেই গিয়ে দাঁড়িয়ে বলবে সীমাকে।

    সীমা, অনেক তো হল, এবার চলো!

    সীমা কি উত্তর দেবে সেটাও মনে মনে আন্দাজ করে। অভিমানী সীমা অবশ্যই কঠিন মুখে। বলবে, কোথায় যাব?

    তার উত্তরে উদ্দালক বলবে, আমার কাছে, আমার ঘরে।

    হ্যাঁ, এই কথাটিই ভেবে ঠিক করে রেখেছে উদ্দালক।

    আর সেই ঘরটিও ঠিক করছে মনে মনে।

    মা বাবার চলে যাবার আগের দিন সব কথা খুলে তাদের কাছে বলবে উদ্দালক। নিজের সব। তারপর প্রশ্ন করবে, এখন বল, এই জালিয়াত মেয়েকে ঘরে নেবে কি না! যদি না পারো, যদি তোমাদের মন ঘৃণায় বিদ্বেষে কঠিন হয়ে ওঠে, জোর করব না তোমাদের ওপর, কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিতে হবে মা! উপায় নেই আমার। আমি আমার হৃদয়ের কাছে বদ্ধ, বিবেকের কাছে বদ্ধ।

    .

    উদ্দালকের মা-বাপও কিছু ভাবছিলেন বৈকি। ছেলের দিকে তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রেখে অনেক কিছুই ভাবছেন তারা। সেই ভাবনার শেষে একদিন বোনের কাছে এসে বসলেন সুনন্দার দাদা। সস্নেহ কণ্ঠে বললেন–আজ কেমন আছিস রে নন্দা?

    সুনন্দা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে–ভালই!

    –বলছিস তো ভাল, দেখাতে তো পারছিস না তা? আমার তো এদিকে ছুটি ফুরিয়ে এল, ভাবছি তোকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাই।

    –আমাকে? সুনন্দা চমকে উঠে বলে–আমি কোথায় যাব?

    –কেন আমাদের কাছে? বাপের বাড়ি যায় না মেয়েরা?

    –এখন থাক দাদা!

    –কেন এখন থাকবে কেন? এখনই তো দরকার! আমরা চলে যাব, দুলুরও কলেজ খুলে যাবে, আর তুই বসে বসে সেই মেয়েটাকে ভাববি! এই তো!

    –দাদা! চমকে ওঠে সুনন্দা।

    তীব্রস্বরে বলে–কোন মেয়েটার কথা ভাবব আমি?

    দাদা মৃদু হেসে বলেন–যে মেয়েটার জন্যে শয্যা নিয়েছিস! দেহপাত করছিস! তোর ঠাকুর ঘরটাকে পর্যন্ত ভুলে গেছিস।

    –কক্ষনো না!

    সুনন্দা উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে–কক্ষনো না। কক্ষনো আমি কারুর কথা ভাবছি না! কেন, অসুখ হয় না মানুষের?

    –আহা রেগে উঠছিস কেন? শুয়ে পড়, শুয়ে পড়। অসুখ তো হয়ই মানুষের, তবে তার একটা কারণও থাকে।

    –সেই পাজী মেয়েটা আমার অসুখের কারণ?

    ধপ করে শুয়ে পড়ে সুনন্দা-কক্ষনো না।

    দাদা মৃদু হেসে বলেন,–মনকে চোখ ঠেরে লাভ কি বল তো নন্দা? মেয়েটাকে যে তুই বড্ড ভালবেসে ফেলেছিলি সেটা তো আর মিথ্যে নয়?

    –আমি বোকা, আমি মুখ, আমি আহাম্মক তাই, তাকে

    কথা শেষ করতে পারে না সুনন্দা, বালিশে মুখ গুঁজে শোয়।

    দাদা ওকে শান্ত হতে একটু সময় দিয়ে তারপর আস্তে বলেন–মুখ আহাম্মক বোকা আমরা সবাই নন্দা! নিজেকেও আমি কম ধিক্কার দিচ্ছি না। যখন শুনলাম মেয়ে ফিরে পেয়েছিস তুই, তখন অত সহজে সেটা বিশ্বাস না করে সন্দেহ করা উচিত ছিল আমার। আসা উচিত ছিল ছুটি নিয়ে। সে দোষের বিচার করতে হবে বৈ কি। কিন্তু সে তো আলাদা কথা। আসল কথা–তোকে তো বাঁচাতে হবে? তাই ভাবছি কলকাতার এই লোকসমাজ থেকে কিছুদিন সরে পড়া দরকার তোকে নিয়ে। সেই সঙ্গে মেয়েটাকেও নিয়ে যাই।

    মেয়েটাকে? মেয়েটাকে নিয়ে যাবে তুমি?

    সুনন্দা ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলে, আমাকে কি পাগল পেয়ে ঠাট্টা করছ দাদা?

    –ছিঃ নন্দা একথা বলছিস কেন? তোর মনের ভেতরটা কি দেখতে পাচ্ছি না আমি?

    –দাদা! সুনন্দা ডুকরে কেঁদে উঠে বলে–আর তাকে কোন্ সুবাদে আনতে যাব?

    –আহা সে যা হয় একটা সুবাদ তৈরি করে নেওয়া যাবে। মোট কথা, তোর একটু চেঞ্জের দরকার হয়েছে, আর সেই মেয়েটা কাছে না থাকলে তোর কাছে স্বর্গও মিথ্যে!

    –দাদা, দাদা গো! সেই পাষাণীকে চেন না তুমি! সে যে কতবড় নিষ্ঠুর, কতবড় কসাই, সে কথা আমি জানি রুদ্ধকণ্ঠে জোর এনে কথা শেষ করে সুনন্দা–আমি মরে গেছি শুনলেও সে দেখতে আসবে না।

    দাদা হেসে ফেলে বলেন–মরে গেলে আর মড়াটা দেখতে এসে কী করবে? জ্যান্ত থাকতেই যাতে আসে সেই চেষ্টা দেখি!

    সুনন্দা বালিশে মাথা ঘষতে ঘষতে বলে–পারবে না দাদা, পারবে না। মান রাখবে না তোমার। ফিরিয়ে দেবে, আসবে না। বলবে, তোমার বাড়ি যাব কেন? আর সেই পাজী বাপটা নিশ্চয় তাকে আসতে দেবে না! শুধু শুধু তুমি

    কথা আর শেষ করতে পারে না সুনন্দা, আরও কেঁদে ওঠে।

    আর ভাবতে থাকে, দাদা ছেলেমানুষ! দাদা সরল! দাদা চিরদিন মফস্বলে কাটিয়ে, কলকাতা শহর আর সেই শহরের মানুষরা যে কী বস্তু তা জানে না! তাই দাদা ভাবছে আমার মন ভাল রাখতে আবার তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসবে। অসম্ভব! অসম্ভব! আমি তো জেনেছি সে মেয়েকে।

    সুনন্দার বৌদিও বলেছিল–অসম্ভব! হতেই পারে না, অসম্ভব।

    কিন্তু সুনন্দার দাদা–নিজ সঙ্কল্পে অটল। সুনন্দাকে একবার নিজের কাছে নিয়ে যাবেন তিনি। আর তার ঔষধার্থে সেই সীমাকে। হয়তো–অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝতে হবে, তা হোক! কঠিন কাজেই তো রোম্যান্স!

    তবে সে রোম্যান্সে সাহায্য নিতে হবে ছেলের। উদ্দালকের!

    .

    টাকা! টাকা দেখাতে এসেছিল।

    ছেঁড়া চটের থলিতে আনা অকিঞ্চিৎকর বাজারটা নামিয়ে দিয়ে যতীন বিকৃত গলায় বলে–কী লম্বাই চওড়াই! কী চান? টাকা? কত টাকা? হাজার? দুহাজার? পাঁচ হাজার? চলুন দিয়ে দিচ্ছি।…দিচ্ছেন টাকা! কি আর বলব, ভগবান মেরেছে, নইলে একটি ঘুষিতে ওই সব বড়মানুষদের লম্বাই চওড়াই ঘুচিয়ে দিতাম।

    এই টাকার কথা বহুবার শুনিয়েছে যতীন, তার স্ত্রী কন্যা সকলেরই জানা। স্ত্রী কখনো চুপ করে থাকে, কখনো বলে–জেলে দেয়নি এই ঢের, আবার টাকা দেবে!

    সীমা সবসময়ই চুপ করে থাকে।

    আজ হঠাৎ সীমা কথা কয়ে ওঠে।

    বলে–তুমি যদি ওদের কনডিশান মানতে, দিতই নিশ্চয় টাকা। তা না হলে দেবে কেন?

    কনডিশান? কনডিশান আবার কি ছিল?

    ক্রুদ্ধ গলা যতীনের। অশান্ত অস্থির যতীন সেন!

    সীমা শান্ত! সীমা সেই শান্ত গলায় বলে–যিনি টাকার কথা বলেছিলেন, তিনি পাঁচজনের সামনে দেখাতে চাইছিলেন, তুমি ব্ল্যাকমেল করে টাকা চাইতে এসেছ! তুমি সেটাই স্বীকার করে নিলে দিতেন টাকা।

    যতীন গর্জন করে বলে ওঠে–তা সেটা তো স্বীকার করে নিতামই। যাচ্ছিলাম তো তাই বলতে, এই তুমি! তুমি আমার ধর্মের ধ্বজা মেয়ে বলতে দিলে তা? কেন তুমি বলতে পারলে না, ওই আমার পালক পিতা, লোকটার মাথার একটু দোষ আছে! সেইটুকু বললেই মিটে যেত! তা নয় ধর্মিষ্ঠি হলেন মেয়ে। একঘর লোকের সামনে কবুল করে বসলেন–ওগো ওই আমার নিজের বাবা! আমার জন্মদাতা পিতা! বাঁধলেন পুণ্যের ছালা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির!

    যতীন-গিন্নী এতক্ষণ নীরবে দাওয়ায় চারটি লাল লাল চাল ঢেলে তার কাকর বাছছিল, এবার মুখ তুলে নিশ্বাস ফেলে বলে–সে কথা আমিও অনেকবার বলি। তুমি মাথা পাগল মানুষ, না হয় অভাবের জ্বালায় ক্ষেপে উঠে একটা নিবুদ্ধিতা করে বসেছিলে, সীমা ইচ্ছা করলেই একটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে একটু সামলে নিতে পারত! বলতে পারত-বরাবরই ওঁর একটু মাথার দোষ! তাতে সাপও মরত, লাঠিও ভাঙত না। যুধিষ্ঠির হয়ে তো ভারি লাভ হল! সেই মাগীকেও তো যা নয় তাই অপদস্থে পড়তে হল! অতটা না করলে, পাঁচজনের সামনে হেয় না হলে, নির্ঘাত ওই সীমাকে আবার টানতো, হয়তো মাসোহারা দিত! তা সব দিক থেকে সবই ঘুচল!

    একথা সত্যি, সীমা ইচ্ছে করলেই এদের দুঃখু ঘোচাতে পারত, কিন্তু সে ইচ্ছে করেনি সীমা। কোন সময় নাতা এতই যদি ধর্মজ্ঞান, তবে আর গিয়েছিল কেন ঢং করে? জাল করছি অন্যায় করছি, এ তো জেনেই গিয়েছিল।

    সীমা মৃদু হেসে বলে–তা সত্যি মা! জেনে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার বাইরে তো আর কিছু জানতাম না। মানুষ বলতে শুধু তোমাদেরই দেখেছি আজীবন, অন্য আর এক রকমের মানুষ দেখলাম গিয়ে। দেখলাম সেই মানুষের সংস্পর্শে এসে সাপ ব্যাং-ও বদলে যেতে পারে।

    –তাই বদলালে!

    যতীন সেন ব্যঙ্গতিক্ত স্বরে বলে–চোরের মেয়ে সাধু হলে! অথচ অতটা সাধু না হলে, হাজার দুহাজার ঘরে আসতই সেদিন!

    সীমা হঠাৎ হেসে ফেলে বলে–সে আপসোস যে তোমার আর যাচ্ছে না বাবা? মনে কর স্বপ্ন দেখেছ একটা। যেমন ছিলাম আমি তোমার ঘরে, বরাবর তেমনই আছি!

    মনে করব!

    যতীন সেন ক্ষুব্ধ রুক্ষ গলায় বলে-করতাম মনে, যদি পেটে দুটো ভাত পড়ত ঠিক সময়ে।

    –তা তুমি তো কিছু করতেই চাও না বাবা! বললাম কর্পোরেশনে একটা কাজ রয়েছে

    কাজ! সেই রাস্তায় রাস্তায় ডি ডি টি ছড়িয়ে বেড়ানোর কাজ? সেই কাজ তো? বাপকে ওই চাকরি করতে বলতে লজ্জা করল না তোর?

    -কেন? লজ্জা করবে কেন বাবা? তবু তো সৎপথ। সর্বদা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতে হবে না, ওই পুলিস এল বলে–

    কথা শেষ হবার আগেই সীমার ছোট ভাই অরুণ হঠাৎ বাইরে থেকে ছুটতে ছুটতে এসে চাপা গলায় বলে বাবা পুলিস!

    –অ্যাঁ। তার মানে? পুলিস কি?

    –পুলিসই তো! নইলে জিগ্যেস করবে কেন,–খোকা জানো তুমি এখানে যতীন্দ্রনাথ সেন বলে এক ভদ্রলোক কোথায় থাকেন?

    –পুলিসের পোশাক?

    না তা নয়, এমনি। কিন্তু পুলিস নইলে তোমায় খুঁজবে কেন? অবলীলাক্রমেই কথাটা বলে ছেলেটা।

    পুলিস ব্যতীত আর যেন কেউ তার বাবাকে ডাকবে না, ডাকতে পারে না, এই তার ধারণা।

    সীমা বিরক্ত স্বরে বলে-পুলিস ছাড়া আর কেউ ডাকতে পারে না? অসভ্য ছেলে!

    সীমার মা বিরক্ত কণ্ঠে বলেন–তা ওকে বলে কি হবে? কর্তা পুরুষ নিজেই রাতদিন পুলিসের ভূত দেখছেন, ওরা তাই শুনছে তো?

    সীমা আরও বিরক্ত গলায় বলে–ভূতই তো হয়েছি মা আমরা! নতুন ভূত আর কি দেখব? যা অরুণ, বলগে যা, দেখিয়ে দিচ্ছি–

    –এই সীমা খবরদার!

    যতীন বলে–যেতে হবে না কারুর। ঘুরে মরুক সে! আমার হুকুম, কেউ যাবে না।

    সীমা চুপ করে যায়।

    বাবার এই হুকুমের ওপর আর কি বলা চলে? আর বলার দরকারই বা কি?

    সীমা ভাবে, অচেনা একজন ভদ্রলোক যদি যতীন সেন নামক লোকটার সন্ধান জানতেই চেয়ে থাকে, সীমার কি?

    সীমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল বলেই তো আর কপার কোনও কারণ ঘটেনি!

    অতএব সীমা চুপ করে যাবে। চুপ করে থাকবে। চুপ করিয়েই রেখেছে নিজেকে।

    ভিতরটা যখন উত্তাল হয়ে ওঠে, অকারণ খানিকটা কাজ করতে বসে। মোটা রূঢ় কাজ। হয়তো কয়লা ভাঙা, হয়তো সাবান কাঁচা, হয়তো বা উঠোনের মাটি খুঁড়ে গাছ লাগানো।

    .

    জবর দখল কলোনীতে এই সুখটুকু আছে। মাটির উঠোন! মা বসুমতীর স্পর্শ! গরীবের কাছে এ স্পর্শটুকু পরম মূল্যবান। গরীবের নিত্য আহার্যের তালিকায় যারা আসর জমায়, সেই লাউ কুমড়ো পুঁই শিম, ঢ্যাঁড়স, উচ্ছে, ইত্যাদি আনাজের রাজ্যের সেই সিডিউল কাস্টেরা সহজেই ওই সামান্য, মাটির স্নেহেই জন্মলাভ করতে পারে, বাড়বাড়ন্ত ফসলে মাটির ঋণ শোধ করতে পারে।

    মন উত্তাল হয়ে উঠলেই সীমা উঠোনের ওই গাছগুলোর পরিচর্যা করে। ঘোট ভাইটা একদিন বলেছিল–দিদি এত গাছ করিস, রজনীগন্ধা গাছ করবি? আমার একটা বন্ধু বলেছে নিস তো দেব।

    সেদিন সীমা হেসে উঠেছিল।

    বলেছিল, রজনীগন্ধা? আরে দূর! ওর ডাঁটায় কি চচ্চড়ি রাঁধা যায়?

    ছোট ভাই সতেজে বলেছিল, সব জিনিসই কি খেতে হবে? দেখতে ভাল নয় রজনীগন্ধা?

    সীমা ওর রাগে হেসেছিল। বলেছিল, দেখতে ভাল জিনিস গরীবের জন্যে নয় রে! গরীবের সব জিনিসই খেতে হয়! সব সব!

    .

    সে যাক, আপাতত বাইরে কোথাও কেউ একজন যতীন সেন নামক ভদ্রলোকের ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং যতীন সেনের হুকুম হয়েছে কেউ তাকে সে ঠিকানা দেখিয়ে দেবে না।

    তা হুকুম আর কার উপর হয়েছে?

    মাত্র যতীন সেনের নিজের এক্তারের লোকগুলোর ওপরই তো? কিন্তু কলোনীতে কি আর কোনও লোক নেই? তারা জানে না যতীন সেন কোন্ কুঁড়েটায় থাকে?

    অতএব সেই একজন একটু পরেই এই কুঁড়ের উঠোনে এসে দাঁড়ান।

    –কে? না বলে কয়ে ভদ্রলোকের বাড়িতে-বলে তেড়ে এগিয়ে এসেই থতমত খেয়ে যায় যতীন সেন।

    ভদ্রলোক হাত তুলে নমষ্কার করে হাস্যবদনে বলেন, কী মশাই, কী রাগ আপনার? সেই চলে এলেন আর গেলেন না? আমি এদিকে টাকাটা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

    টাকা।

    টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকটা?

    ইয়ার্কি নাকি? এ আবার একটা নতুন চাল। আর কিছু নয়, ভুলিয়ে বাসা থেকে বার করে নিয়ে পুলিসের হাতে ধরে দেবে! কথায় ভেজাতে এসেছে।

    অতএব যতীন সেন ভেজে না, তীব্রস্বরে বলে, দেখুন আমি গরীব, আমি হতভাগা, আমার সঙ্গে ঠাট্টা মস্করা করতে আসবার দরকার আপনার নেই। যেতে পারেন।

    ভদ্রলোক পকেট থেকে একগোছা একশো টাকার নোট বার করে এগিয়ে ধরে হেসে বলেন, কী আশ্চর্য, ঠাট্টা করব কেন? কথা হয়েছিল সেদিন—

    যতীন সেন সেই মোহময় বস্তুটার দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলে না। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে এগিয়ে ধরে বলেন, নিন।

    যতীন আস্তে হাত বাড়ায়।

    যতীনের মুখে কথা নেই।

    যতীনের স্ত্রী বেড়ার ধার থেকে অনবরত যে ইশারা করছে ভদ্রলোককে যত্ন করে বসাবার জন্যে, সে দিকে দৃষ্টিই নেই যতীনের।

    টাকাগুলো সত্যি, না জাল! না কি নম্বরী নোট গছিয়ে দিয়ে ফাঁদ পাতবার ফন্দি! হাত থেকে পড়ে যায় টাকাটা।

    নাঃ আপনার দেখছি টাকাকড়ির দরকার নেই। কিন্তু আমি যে সত্যবদ্ধ হয়ে আছি, না নিলে অশান্তিতে মরব।

    টাকাটা তুলে নিয়ে এদিক ওদিক তাকান তিনি।–কই আর কেউ আছেন না কি?

    যতীন এবার নেয়।

    গম্ভীর গলায় বলে,–আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

    ভদ্রলোক হেসে উঠে বলেন–না পারবেন কেন সেটাই বলুন? কবে কখন আপনার সঙ্গে কি কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। সেদিন আপনি চটেমটে বেরিয়ে এলেন। টাকাটা নিয়ে এলেন না। অথচ ঠিকানা জানা নেই। খুঁজে খুঁজে কোন মতে

    কিন্তু এত আপনি করবেন কেন? সেটাই তো সন্দেহ। নম্বরী নোট গছিয়ে দিয়ে পুলিসে ধরিয়ে দেবেন কিনা কে বলতে পারে?

    ভদ্রলোক তবুও হাসেন? যেন খুব একটা মজা দেখছেন

    । বলেন, আপনাকে পুলিসে দেবার জন্যে এতসব করতে যাবার তো কথা নয়। বিনা কষ্টেই তো দেওয়া যেত, সেদিন তক্ষুনি। কাজেই বুঝতে পারছেন ওতে আমাদের দরকার নেই। আমাদের যা দরকার সেটাই জানাতে এসেছি।…আমি কলকাতার মানুষ নয়, বাইরের মানুষ, সেই কোন্ দূর দূরান্তরে থাকি। ছুটিতে এসেছিলাম, চলে যাচ্ছি। যাবার সময় আপনার মেয়েটিকে নিয়ে যেতে চাই!

    দপ্ করে জ্বলে ওঠে যতীনতার মানে? নিয়ে যেতে চান মানে? কী ভেবেছেন কি?

    -নাঃ মশাই ভারি রগচটা আপনি। কথা কয়ে সুখ নেই।…মা লক্ষ্মী, তুমি শোন তো, এস এদিকে।

    সীমার হাতে মাটি খোঁড়বার খুরপি, সীমার হাতে কাপড়ে ধুলো মাটি। ভদ্রলোককে দেখে নিথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেড়ার গা ঘেঁষে। ডাক শুনে শুধু একবার যেন কেঁপে উঠল, কিন্তু নড়ল না।

    ভদ্রলোক অতএব নিজেই এগিয়ে যান। বলেন–শোনো! তোমার বাবার কাছে একটা প্রস্তাব করছিলাম, আমি দেরাদুনে ফিরে যাচ্ছি কদিন পরে, যাবার সময় তোমাকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছি, তা তোমার রগচটা বাবা তো মারতেই উঠলেন আমায়, তুমি কি বল?

    সীমা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একবার ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে–আমরা গরীব, অভাবে পড়ে অন্যায় করেছি, তার জন্যে যে শাস্তি ন্যায্য তাই দিন। পুলিসেই দিন আমাকে আর আমার বাবাকে। এছাড়া শান্তি পাচ্ছি না আমি।

    ভদ্রলোক এবার আস্তে বলেন–শাস্তি তো তোমার হয়ে গেছে মা! এখনো হচ্ছে, হয়েই চলেছে। আর কত শাস্তি চাও?

    –আরও অনেক অনেক। সত্যিকার শাস্তি।

    ভদ্রলোক আবার হাসেন।

    হেসে হেসে বলেন–সত্যিকার শাস্তিই দেওয়া হবে তোমায়। সেই উদ্দেশ্যেই আসা, একেবারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্ডার দিতে এসেছি।

    -কী বললেন? সীমা যেন শিউরে ওঠে।

    ভদ্রলোক কিন্তু আত্মস্থ–ওই তো বললাম, আমার বাড়িতে যেতে হবে, চিরকালের জন্যে

    -না না না!

    ভদ্রলোক মৃদু হাস্যে বলেন–আমায় না হয় না বলে ফিলোচ্ছ, সবাইকে পারবে?

    –আমায় মাপ করুন, আমায় ক্ষমা করুন–বলে সীমা ছুটে পালিয়ে যায়, আর সীমার বাপ।

    যতীন সেন এই দুর্বোধ্য নাটকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

    তবে বেশিক্ষণ থাকে না, হাতের মধ্যে এসে পড়েছে রাজার ঐশ্বর্য! নগদ পাঁচ হাজার টাকা –একসঙ্গে কবে দেখেছে যতীন সেন? ব্রজনাথ উকিলের কাছে মেয়ে জমা দিয়েও তো নয়।

    এই টাকা দিয়ে সে একটা দোকান দেবে, ধীরে ধীরে ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।…মেয়ের সাহায্যে ভবিষ্যৎ গড়ে তোেলা তো আর হল না।

    এ টাকা এখুনি লুকিয়ে ফেলতে হবে।

    পাওনাদাররা টের পেলে এক মুঠোও বাকি থাকতে দেবে না, রাক্ষস সংসারের নাগালের মধ্যে এলেও খাবল দিতে আসবে। টাকা বড় ভয়ানক জিনিস। ওর ব্যাপারে মা বাপ ভাই বন্ধু স্ত্রী পুত্র পরিবার কাউকে বিশ্বাস করতে নেই।

    কিন্তু কোথায় সেই লুকনো জায়গা?

    যতীন সেনের বাড়ি কি তিন মহল? ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ আছে যতীন সেনের?

    গচ্ছিত রাখতে পারে এমন কোনো প্রতিষ্ঠাপন্ন বড়লোক আত্মীয়ের লোহার সিন্ধুক আছে? নিজের দেহের সঙ্গে কতক্ষণ রাখা যায়? চানও তো করতে হবে তাকে?

    .

    লোহার গেটটার সামনে এসে দাঁড়াল সীমা।

    এ বাড়ির লোহার গেটের সামনে গাড়ি থেকে নেমে ভিন্ন কখনো দাঁড়িয়েছে সীমা? দাঁড়ায়নি!

    গেট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেছে, আবার গাড়ি থেকে নেমে গেটে ঢুকেছে।

    শেষ বেরিয়ে গিয়েছিল পায়ে হেঁটে, আজ আবার পায়ে হেঁটেই ঢুকল।

    গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।

    আশ্চর্য! আশ্চর্য!

    দারোয়ান শোভাবাহাদুর ঠিক আগের মতই সসম্ভ্রমে অভিবাদন জানিয়ে সরে দাঁড়াল, গেট খুলে দিল।

    সীমা কি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলও?

    হয় তো হাসল! হয়তো বা কৃতজ্ঞতার হাসি সেটুকু।

    হয়তো বা তৈরি করা!

    ভিতরে ঢুকতেও কি মুখে হাসি রাখতে পারবে সীমা? নীচের তলার ঝি চাকরদের সামনে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে পারবে অকুণ্ঠিত দৃঢ় পদক্ষেপে?

    তারপর?

    সিঁড়ি দিয়ে উঠে?

    প্রথম কার সামনে পড়বে?

    সে কথা জানে না সীমা। দোতলায় হলে বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কি সবাই? না আপন আপন ঘরে নিথর হয়ে বসে আছে?…সিঁড়ির মাঝখানে উঠে পা এত ভারী হয়ে আসছে কেন?

    ঝি চাকরগুলোর হতভম্ব দৃষ্টির ভারে?

    তবু আশ্বর্য হচ্ছে বৈ কি সীমা। কেউ বাধা দিচ্ছে না তাকে, কেউ কিছু বলছে না।

    সীমার অকুণ্ঠিত দৃঢ় পদক্ষেপই কি মূক করে দিয়েছে ওদের?

    নইলে এই জালিয়াৎ মেয়েটার স্বরূপ তো উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে সকলের কাছেই!

    আচ্ছা চোর জোচ্চোর জালিয়াৎ এদের জন্যেও কি ঈশ্বরের কৃপা থাকে? নইলে কারুর মুখোমুখি পড়ল না কেন সীমা? ভারী পর্দা ফেলা নিথর ঘরগুলোর একটা ঘরে নিঃশব্দে ঢুকতে পেল কি করে?

    কে? কে? কে?

    সুনন্দা চমকে বিছানায় উঠে বসল। দিন দুপুরে কি সে ভূত দেখেছে?

    –টুলু!

    সুনন্দার অজ্ঞাতসারেই বুঝি কাঁপা কাঁপা গলায় এই নামটা উচ্চারিত হয়।

    সীমা এ ভুল ভেঙে দেয় না। সীমা প্রতিবাদ করে ওঠে না, না, আমি সীমা!

    সীমা শুধু কাছে এগিয়ে আসে। আস্তে বলে–আমার অসাধ্য কাজ নেই দেখতে পাচ্ছেন তো?

    সুনন্দা ব্যাকুল ভাবে বলে–ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না! সামনের জানলাটা খুলে দাও তো!

    সীমা এগিয়ে গিয়ে রোগীর ঘরের মৃদু অন্ধকারের ছায়া ঠেলে সরিয়ে দেয়, বন্ধ জানলাটা : ঠেলে খুলে দিয়ে।

    হঠাৎ মূক হয়ে গেল সুনন্দা।

    যেন গলার স্বর বন্ধ হয়ে গেল। একটু আগেই যে কথা বলেছে সে, ভুলে গেল সে কথা। তাকিয়ে রইল শুধু সামনের মানুষটার দিকে।

    এখন সীমার কণ্ঠই প্রথমে কাজ করল।

    –টাকাটা রাখুন!

    টাকা! কিসের টাকা?

    সুনন্দা এবার চমকে ওঠে।

    –যেটা আপনার দাদা আমার বাবাকে দিয়ে এসেছিলেন।

    সুনন্দা এবার আত্মস্থ হয়।

    শান্ত ভাবে বলে–ফিরিয়ে নেবার জন্যে কি কেউ দেয়?

    –কিন্তু সব দেওয়াই কি নেওয়া যায়?

    সুনন্দা নিঃশ্বাস ফেলে বলে–নেবার ইচ্ছে না থাকে বিলিয়ে দিক তোমার বাবা, আমি যা দিয়েছি তা ফেরৎ নিতে পারি না।

    সীমার মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে।

    সীমা ব্লাউজের মধ্যে লুকনো টাকার বাণ্ডিলটা বার করে সুনন্দার বিছানার উপর নামিয়ে রেখে বলে, সব সময় কি একথা বলা যায়? কত রকম অবস্থা আসে, দেওয়া জিনিসও ফেরৎ নিতে হয়। সেই ভেবেই নিন–

    কী বললি? কী বললি বেইমান নেমকহারাম!

    সুনন্দা ডাক্তারের নিষেধ ভুলে বিছানা থেকে নেমে পড়ে একটা হাত বাড়িয়ে সীমার ডান হাতটা চেপে ধরে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে–তা তুই বলতে পারিস, তোর মুখে সবই শোভা পায়। দেওয়া জিনিস ফিরিয়ে নিতে যদি পারতাম, তা হলে আমার এই হাল হত না আজ! ফিরিয়ে নিতে পারছি না, সেই ঘেন্নায় মানুষের সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না তা জানিস? জানবি না, বুঝবি না, অন্য মাটি দিয়ে গড়া যে তুই!

    হাতটা আস্তে ছাড়িয়ে নেয় সীমা।

    মৃদু স্বরে বলে–আমি যাই।

    -যাবি? এক্ষুনি যাবি? নিষ্ঠুর পাজী মেয়ে! সেদিন সেই যজ্ঞি বাড়ি থেকে না খেয়ে চলে গেলি

    হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে সুনন্দা,–আজ আবার অমনি মুখে চলে যেতে চাস? মানুষের প্রাণ বলে কি কিছু নেই তোর ভেতর?

    হঠাৎ মাটিতে বসে পড়ে সীমা।

    বলে–তবে দিন কী খেতে দেবেন দিন।

    .

    সীমা জানে না সুনন্দার শারীরিক অবস্থা কতটা খারাপ, জানে না সুনন্দার বিছানা থেকে ওঠা বারণ, তাই বলে দিন তবে কী খেতে দেবেন দিন।

    আর সুনন্দা যখন শাড়ির আঁচল লুটিয়ে টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, তখনো বুঝতে পারে না এটা তার এতদিন পরে প্রথম ওঠা!

    সীমা ভাবে ওটা আবেগের প্রতিক্রিয়া।

    তাই সীমা নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে পাশের দিকের ওই বন্ধ কপাটটার দিকে। সীমা একদা ওই ঘরে বাস করে গেছে। তখন দরজাটা খোলা থাকত। শুধু দরজায় একটা পর্দা ঝুলত। সেটা কখনো স্থির হয়ে পড়ে থাকত দুঘরের মধ্যে ব্যবধান রচনা করে, কখনো বাতাসে উড়ে এঘর ওঘর এক করে দিত।

    এখন কপাট পড়ে গেছে।

    আর কোনদিন ব্যবধান ঘুচবে না।

    ঘুচবে না, ঘোচা সম্ভব নয়, কিন্তু সুনন্দা কেঁদে ওঠে কেন? সে কি কেবলমাত্র সুনন্দার মায়ার মন বলে, আর একটা অভাগা মেয়ে উৎসব আয়োজনের মাঝখান থেকে কিছু খেয়ে যায়নি বলে? একটা পোষা বিড়াল কুকুর তার মুখের খাবার ফেলে চলে গেলে মায়ার মন মানুষের যেমন হয় তেমনি?

    .

    বন্ধ দরজার ওপিঠে কি এখনো সীমার স্মৃতির কোন অবশিষ্ট আছে? সে ঘরে কি কেউ কোনদিন একবার গিয়ে দাঁড়ায় না? অসতর্কে একটা নিশ্বাস ফেলে না?

    সুনন্দার ভাই সীমাকে তার বাপের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুনন্দার ভাইপো? নিজে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস সংগ্রহ করতে পারে নি বলেই কি এই পথ ধরতে গেছে সে? অভিভাবকদের কৃপার পথ!

    সুনন্দা খাবার নিয়ে আসার আগেই কি পালাবে সীমা? আরও একবার প্রমাণিত করবে কত বড় ইতর, অকৃতজ্ঞ, আর হৃদয়হীন সে?

    কিন্তু সেই হৃদয়হীনতা প্রমাণিত করবারই বা পথ কোথায় এখন? সুনন্দার খাটের উপর যে পড়ে আছে পাঁচ হাজার টাকার নোটর বাণ্ডিল! সুনন্দার কান্নায় বিচলিত না হলেই হত, পালালেই হত। কে জানে, এখন যে লোকটা বাড়ি নেই, সে লোকটা হঠাৎ এসে পড়বে কিনা।

    কী করবে তখন সীমা?

    .

    সুনন্দা ধরা পড়ল ফ্রিজিডেয়ারের সামনে!

    সীমা উপরে উঠে আসার ক্ষণকাল পরেই–বলাই বাহুল্য নীচের তলার দাসী চাকরগুলো উঠে এসেছিল, এবং উঁকিঝুঁকি মারছিল, তারপর হেড় ঝি মানদা উদ্দালকের মায়ের কাছে গিয়ে এই রসালো খবরটা পরিবেশন করেছিল। তিনি শুনেই উদগ্র কৌতূহলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়ালেন।

    সুনন্দা ফ্রিজিডেয়ার খুলে একটা বড় প্লেট নিয়ে খাবার সাজাচ্ছে। যা পাচ্ছে সামনে, সব নিচ্ছে।

    থতমত খাওয়ার পর শিউরে উঠলেন মহিলাটি।–ঠাকুরঝি তুমি উঠে এসেছ, ব্যাপার কি?

    সুনন্দা চোখের ইশারায় কাতর মিনতি জানায় চুপ করবার জন্যে। আর পশ্চাদবর্তিনী মানদাকে কঠোর স্বরে বলে ওঠে–এখানে গুলতানি করছিস কেন? যা নীচে যা! কারুর থাকবার দরকার নেই ওপরে! রাধা কি করছিস ওখানে? যা, যা চলে যা!

    উদ্দালকের মা ঠাণ্ডা গলায় বলেন–আমিও কি নেমে যাব ঠাকুরঝি?

    কী আশ্চর্য! কী বলছ বৌদি! আমি–মানে, শুধু মানে মেয়েটা লজ্জা পাবে তাই, দোহাই তোমায় পরে সব বলব

    -তা আমার হাতেই দাও না হয় ওটা? সব সুদ্ধ পড়ে যাবে শেষটা

    না না না,–সুনন্দা চাপা ব্যাকুল কণ্ঠে বলে কিছু হবে না আমার, আর কিছু হবে না। শুধু একবারটি ও আমার হাতে খাক।

    তাকিয়ে দেখে না তার বৌদি কোন্ অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

    সেই যথেচ্ছ খাবারের রাশি এনে নামিয়ে দেয় সুনন্দা সীমার সামনে। ধপ করে বসে পড়ে বলে–সব খেতে হবে তোকে আমার সামনে বসে বসে।

    .

    কিন্তু এই ঘরের দরজায় ঝুলে থাকা পর্দাটার ওপারে তখন সমুদ্র কল্লোল। কারও মতে, সেই মেয়েটা চুপি চুপি এসে মায়াকান্না কেঁদে সুনন্দার কাছ থেকে বাগিয়ে ফেলেছে টাকার গাদা, তার ওপর আবার চব্যচোষ্য খেতে বসেছে। নোটগুলোকে অবশ্য জানলার বাইরে থেকে দশটাকারই ভেবেছে তারা। কিন্তু তাই কি কম?

    অন্যদলের মতে, চুপিসাড়ে এসেছিল চুরির মতলবে। কোথায় চাবি, কোথায় আলমারি, সন্ধান তো নিয়ে গেছে সব কিছুর। তা নিয়ে-টিয়ে হঠাৎ ধরা পড়ে গেছে। নিদ্রাভিভূতা সুনন্দার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। অতএব আর কি করবে কান্না ছাড়া? খাবারের থালার সামনে বসে তাই কেঁদেই চলেছে। তা সুনন্দাও চালাকি করেছে, খাবার খাওয়ানোর ছুতো করে আটকে ফেলেছে একটু, এখন দাদাবাবু কি মামাবাবু কেউ একজন এলে হয়।

    .

    সমুদ্র কল্লোল, কিন্তু চাপা।

    আমাদের যদি বলে, তোদের চোখের সামনে দিয়ে উঠে গেল ধরলি না? আমরা বলব আমাদের কী দোষ, ওই বাহাদুর মুখপোড়া ঢুকতে দিয়েছে কেন….আমরা বলব আমরা চোক্ষেও দেখিনি।….কিন্তু আশ্চয্যি, আমাদের চোখে যেন ধুলোপড়া দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল।….

    মামীমাও নেমে এসেছেন, যোগ দিয়েছেন তাদের সঙ্গে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছেন, কখন এল, প্রথম কে দেখল….ইত্যাদি। এই দৃশ্যের মাঝখানে নাটকের নায়কের প্রবেশ!

    –কী ব্যাপার? হঠাৎ এমন গোলটেবিল বৈঠকের কারণ? মা, মন্ত্রণালয়টা তো তেমন সুবিধেজনক জায়গায় হয়নি। চল চল ওপরে চল, সোফায় বসে আরাম করে ঘটনার বিবরণ শুনি।

    উদ্দালকের মা ঝিয়েদের সঙ্গে আলাপমগ্ন অবস্থায় ছেলের চোখে পড়ে যাওয়ায় বিশেষ বিরক্তি বোধ করলেও, চেপে গিয়ে বলেন–ঘটনা আবার কি?

    –আহা একটা কিছু নিশ্চয়! পিসিমার শরীর ঠিক আছে তো?

    –শরীর ঠিকই আছে, মাথাটাই যা বেঠিক হয়ে গেছে–বলে উঠে যান ভদ্রমহিলা।

    পিছু পিছু উদ্দালকও। কিছু যেন একটা অনুমান করছে সে।

    না, অনুমান ভুল নয়।

    সুনন্দার পাশেই বসে পড়ে বলে ওঠে উদ্দালক–যা ভেবেছি বর্ণে বর্ণে সত্য।

    কী অনুমান, কী সত্যিসুনন্দা ব্যাকুলভাবে বলে–তুই আবার এখন এলি কেন? একেই তো মেয়েটা এককণাও মুখে তুলতে পারছে না! তুই যা বাপু!

    –তবে যাই।

    –কিন্তু কি যেন অনুমান করছিলি বললি?

    –অনুমান করতে করতে আসছিলাম, ঠিক এমনি একটা দৃশ্য দেখতে পাব গিয়ে। কারণ এইমাত্র জবরদখল কলোনীর যতীনবাবুর ওখান থেকে আসছি কিনা?

    -কোথা থেকে? কোথা থেকে আসছেন?–সীমা চোখের জল সমেত চোখটাই তুলে চমকে প্রশ্ন করে–কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?

    –ওই তো বললাম। গিয়ে দেখলাম কন্যাহারা পিতা বুক চাপড়ে কাঁদছেন, এবং হারানো কন্যার প্রতি অভিশাপের স্রোত বহাচ্ছেন।

    -কি বলছিস দুলু? খুলে বল।

    আর খুলে বলা! যতীনবাবুর অকৃতজ্ঞ কন্যা নাকি বাবার সদ্য-লব্ধ কয়েক হাজার টাকা চুরি করে উধাও হয়ে গেছে, তাই স্নেহময় পিতা তার উদ্দেশে কিছু স্নেহবাণী বর্ষণ করছেন, এ হেন সময় আমি সেখানে গিয়ে উপস্থিত।….উঃ অনেক কষ্টে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি, আর একটু হলেই ইট খেয়ে এই অমূল্য প্রাণটি বিনষ্ট হত!..কিন্তু পিসিমা, সংসারের সব খাবারগুলোই কি ওই অপাত্রের পাত্রে ঢালতে হয়? আমিও তো রয়েছি একটা সুপাত্র–

    সুনন্দার মুখটা সহসা একটা নতুন আলোয় ভরে ওঠে। সুনন্দা সেই আলোভরা মুখে বলে– তোর মতন সুপাত্রের জন্যে অন্য জিনিস রেখেছি।…কিন্তু টুলু, শুধু জালিয়াতি নয়, চুরিতেও ওস্তাদ তুই! বাবার বাক্স থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে এসেছিস আরও আপনার লোকেদের দিবি বলে?

    –মা!

    উঁহু মা নয়, আর মা নয়। মায়ার জালে আর নয়, এখন পিসিমা! শুধু পিসিমা!

    সীমার চোখের জল কি শুকিয়ে গেছে?

    সীমার গলায় জোর এল কি করে?

    –তুমি কিন্তু আমায় টুলু বলছ মা!

    –বলব, বেশ করব! আমার খুশি আমি টুলু বলব তোকে। দুলু আর একবার তোকে যেতে হবে সেখানে, চল আমিও যাব। চোরাই টাকাটা ফেরৎ দিয়ে বলিগে সেই হতভাগাটাকে, মেয়েকে আর তুমি পাচ্ছ না!

    –তুমি যাবে?

    –যাবই তো।

    –খুনের দায়ে ফাঁসিতে লটকাতে চাও আমায়?

    –ফাঁসিতে নয়, ফাঁসে। যে ফাঁস নিজে বসে বসে বানিয়ে রেখেছিস! আর আমার কিচ্ছু হবে না রে দুলু! চল্ ওঠ!

    ⤶
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশুধু তারা দু’জন – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article নদী দিকহারা – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }