Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মার্ক টোয়েন গল্পসমগ্র

    মার্ক টোয়েন এক পাতা গল্প767 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    এলোঞ্জো ফিজ ক্লারেন্স ও রোজান্না এথেলটন-এর প্রেম

    এলোঞ্জো ফিজ ক্লারেন্স ও রোজান্না এথেলটন-এর প্রেম
    The Loves of Alonzo Fitz Clarence and Rosannah Ethelton

    ০১.

    একটা তীব্র শীতের দিনের প্রাক্-মধ্যাহ্নকাল। মেইন রাজ্যের ইস্টপোর্ট শহর সদ্য ঝরা গভীর বরফের নীচে চাপা পড়ে আছে। রাজপথে স্বাভাবিক হট্টগোলও নেই। রাস্তা বরাবর যতদূর তাকানো যায় শুধু মৃত্যু-সাদা শূন্যতা ও তদনুরূপ নিস্তব্ধ তা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। অবশ্য আমি বলছি না যে নিস্তব্ধতা চোখে দেখা যায়। সেটা বরং শোনা যায়। গলি গুলো সব যেন লম্বা গভীর খানা, দুই ধারে খাড়া বরফের দেয়াল। এখানে ওখানে হয় তো কাঠের বেলচার অস্পষ্ট দূরাগত শব্দ শুনতে পাবেন, আর যদি অতি দ্রুত চোখ মেলে তাকাতে পারেন তাহলে হয়তো এই সব গলির যে কোন একটায় মুহূর্তের জন্য দেখতে পাবেন অনেক দূরে একটি কালো মূর্তি ঝুঁকে পড়েই অদৃশ্য হয়ে গেল এবং পরমুহূর্তেই আবার দেখা দিল; তার ভাবভঙ্গী দেখেই আপনি বুঝতে পারবেন যে এক বো–ভর্তি বরফ ছুঁড়ে ফেলবার জন্যই সে এসেছিল। কিন্তু আপনাকে খুব দ্রুতগতি হতে হবে। কারণ ঐ কালো মূর্তিটি বেশীক্ষণ থাকবে না, বেচার মাল খালাস করেই সে বাড়ির দিকে ছুটে যাবে। হ্যাঁ, বাইরের ঠাণ্ডা বিষাক্ত বরফ ঠেলা-ওয়ালারাই হোক আর যেই হোক কেউই বেশীক্ষণ বাইরে থাকতে পারে না।

    ইতিমধ্যে আকাশ কালো হয়ে উঠল; উঠে এল বাতাস; প্রচণ্ড ঝাপ্টা মেরে দমকা হাওয়া বইতে লাগল; সেই হাওয়ায় গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ পিছনে সামনে, সর্বত্র ঝরে পড়তে লাগল। তেমনি একটা ঝড়ো হাওয়ার তাড়নায় রাস্তা বরাবর সাদা বরফের স্তূপ কবরের মত জমে উঠল; আবার একমুহূর্ত পরে একটা ঝাপ্টা এসে সেই স্তূপের মাথার উপরকার বরফ কে বিন্দু বিন্দু আকারে ছড়িয়ে দিয়ে সেগুলিকে অন্যত্র সরিয়ে দিচ্ছে-ঠিক যেন প্রচণ্ড ঝড়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথা থেকে পুঞ্জ পুঞ্জ ফেনা ছড়িয়ে পড়ছে; আবার তৃতীয় একটা ঝাঁপটা এসে সব কিছুকে যেন ধুয়ে মুছে আপনার হাতের মত পরিষ্কার করে রেখে যাবে। যেন একটা তামাসা; একটা খেলা; কিন্তু প্রত্যেকটি ঝাপ্টার ফলেই পাশের গলি-পাথরগুলিতে কিছু না কিছু বরফ জমবেই।

    এলোঞ্জো ফিজ ক্লারেন্স তার উষ্ণ সুসজ্জিত বসবার ঘরে আস্তিনে ও বুকে লাল সাটিন বসানো চমৎকার একটা নীল ড্রেসিং গাউনে শরীর ডেকে বসে ছিল। প্রাতরাশের ভূঞাবশেষ সামনে পড়ে আছে; খাবার টেবিলের সুন্দর ও দামী বাসনপত্র ঘরের অন্য সব আসবাবপত্রের শোভা, সৌন্দর্য ও মহার্ঘতার সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে গেছে। অগ্নিকুণ্ডে জ্বলছে আরামদায়ক আগুন।

    একটা প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপ্টা এসে জানাল গুলোকে কাঁপিয়ে দিল; আর বরফে র একটা প্রবল ঢেউ যেন সশব্দে সব কিছুর উপর এসে আছড়ে পড়ল। সুদর্শন অবিবাহিত যুবকটি আপন মনেই বলে উঠল:

    এর অর্থ আজ আর বাইরে যাওয়া নেই। বেশ তো, আমি এতে খুসি। কিন্তু সঙ্গী-সাথীর কি হবে? মা হলে অবশ্য ভালই হয়; সুসান। মাসিও ভালই; কিন্তু এরা তো সব সময়ই আছেন। আজকের মত দিনে চাই নতুন আগ্রহ, নতুন মানুষ, তবেই তো বন্দীদশার একঘেয়েমি ক্ষুরধার হয়ে উঠবে। কথাটা তো শুনতে ভালই হল, কিন্তু এর কোন অর্থ হয় না। একঘেয়েমির ধারে কেউ শান দিতে চায় না, চায় বরং উল্টোটা।

    ম্যান্টে লপিসের উপরকার সুদৃশ্য ফরাসী ঘড়িটার দিকে সে তাকাল।

    ঘড়িটা আবার বিগড়েছে। এই ঘড়িটা কখনও সঠিক সময় জানে না; যখন বা জানে তখন নিজে মিথ্যা বলে-আসলে ব্যাপারটা একই। আলফ্রেড!

    কোনো সাড়া এল না।

    আলফ্রেড!..চাকরটা ভাল, কিন্তু ঐ ঘড়িটার মতই অনিশ্চিত।

    এলোঞ্জো দেয়ালের বৈদ্যুতিক ঘণ্টার বোতাম হাত রাখল। একমুহূর্ত অপেক্ষা করে আবার হাত দিল; আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে বলে উঠল:

    নির্ঘাৎ ব্যাটারি খারাপ হয়েছে। কিন্তু একবার যখন শুরু করেছি, সময়টা জানতেই হবে। দেয়ালের কথা বলার চোখের কাছে গিয়ে একটা বাঁশী বাজিয়ে ডাকল, মা। পর পর আরও দুবার ডাকল।

    না, এতেও কিছু হল না। মায়ের ব্যাটারিও খারাপ হয়ে গেছে। বুঝতে পারছি, নীচের কাউকে জাগাবো যাবে না।

    রোজউড–এর টেবিলেটায় বসে বাঁ দিককার কোণের উপর থুতনিটা রেখে যেন মেঝেকেই বলল: মাসি সুসান!

    একটি মধুর নীচু গলায় জবাব এল, কে? এলোঞ্জো?

    হ্যাঁ। আমি এত আলস্য ও আরাম বোধ করছি যে নীচে নামতে পারছি না; কিন্তু বড়ই ফাঁসাদে পড়েছি।

    আরে, ব্যাপার কি?

    ব্যাপার গুরুতর; তোমাকে বলতে পারি।

    আঃ, আমাকে উৎকণ্ঠায় রেখ না। বল কি ব্যাপার?

    আমি জানতে চাই, এখন সময় কত?

    কী বিচ্ছু ছেলেরে বাবা! আমাকে কি দুশ্চিন্তায়ই ফেলেছিল। এই কি সব?

    হ্যাঁ-বিশ্বাস কর। শান্ত হও। আমাকে সময়টা বলে দাও আর আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ কর।

    ঠিক নটা বেজে পাঁচ মিনিট। না, কোন দক্ষিণা দিতে হবে না-তোমার শুভেচ্ছা তুলে রাখ।

    ধন্যবাদ।

    উঠে দাঁড়িয়ে সে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ঠিক নটা বেজে পাঁচ মিনিট। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, আরে, তুমি দেখছি। আগের চাইতে ভাল কাজ করছ। মাত্র চৌত্রিশ মিনিটের হেরফের। ভেবে দেখছি….ভেবে দেখছি….তেত্রিশ আর একুশ মিলে চুয়ান্ন; চুয়ান্নর চারগুণ দুশ ছত্রিশ। এক বাদ দিলে থাকে দুশ পঁয়ত্রিশ। ঠিক আছে।

    ঘড়ির কাঁটা দুটো ঘুরিয়ে একটা বাজতে পঁচিশ মিনিট বাকি রেখে বলল, এবার দেখ, কিছুক্ষণের জন্য ঠিক চলতে পার কিনা.. নইলে তোমাকে নিলামে তুলে দেব!

    আবার টেবিলে বসে বলল, সুসান মাসি!

    বল।

    প্রাতরাশ খেয়েছ?

    হ্যাঁ, একঘণ্টা আগে।

    খুব ব্যস্ত কি?

    না-তবে কিছু সেলাই করার আছে। কেন?

    সঙ্গী কেউ আছে?

    না, তবে সাড়ে নটায় একজনের আসার কথা আছে।

    আমার কাছেও যদি কেউ আসত। কারও সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

    খুব ভাল কথা, আমার সঙ্গেই কথা বল।

    কিন্তু কথাটা খুবই গোপনীয়।

    ভয় পেয়ো না-সোজা বলে ফেল, আমি ছাড়া এখানে আর কেউ নেই।

    বুঝতে পারছি না বলব কিনা, কিন্তু

    কিন্তু কি? আঃ চুপ করে থেক না। এলোঞ্জো, তুমি তো জান আমাকে বিশ্বাস করতে পার-তুমি ভাল করেই তা জান।

    তা তো জানি মাসি, কিন্তু কথাটা খুবই গুরুতর। এর সঙ্গে আমি গভীরভাবে জড়িত-আমি নিজে, সারা পরিবার-এমন কি সারা সমাজ।

    ওঃ এলোঞ্জো, আমাকে বল! এর একটি শব্দও কেউ জানবে না। কি ব্যাপার?

    মাসি, সাহস করে যদি বলতে পারতাম-

    আঃ এলোঞ্জো, দয়া করে বলে যাও। আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমার কথা ভাবি। সব কিছু আমাকে বল। আমাকে বিশ্বাস কর। ব্যাপার কি?

    আবহাওয়া!

    আবহাওয়া উচ্ছন্নে যাক! লন, আমি ভাবতে পারছি না কেমন করে তুমি আমার সঙ্গে এরপ ব্যবহার করতে পারলে।

    ঠিক আছে, ঠিক আছে মাসি, আমি দুঃখিত। সত্যি বলছি, আমি দুঃখিত। এমন আর কখনও করব না। আমাকে ক্ষমা করলে তো?

    করলাম; যদিও আমি জানি করা উচিত নয়। যেই আমি আজকের কথা ভুলে যাব অমনি তুমি আবার আমাকে বোকা বানাবে।

    না, না, তা কিছুতেই করব না, কিন্তু এই আবহাওয়া, ওঃ, এই আবহাওয়া। জোর করে মনকে চাঙ্গা রাখতে হয়। বরফ, বাতাস, ঝড় আর তীব্র ঠাণ্ডা! তোমার ওখানে আবহাওয়া কেমন?

    গরম, বৃষ্টি, বিষাদ। ছাতা মাথায় শোকযাত্রীরা রাস্তায় চলেছে; ছাতা বেয়ে জলের স্রোত বয়ে চলেছে। যতদূর চোখ যায় খোলা ছাতার একটা উঁচু পথ যেন এগিয়ে চলেছে। মনকে প্রফুল্ল রাখবার জন্য ঘরে আগুন, আর ঠাণ্ডা রাখবার জন্য জানালা রেখেছি খুলে। কিন্তু সব বৃথা, কিছুই কোন কাজে আসছে না।

    কি যেন বলতে গিয়েও এলোঞ্জো থেমে গেল। এগিয়ে গিয়ে জানালায় দাঁড়াল। বাইরের শীতার্ত জগতের দিকে তাকাল। ঝড় সামনের বরফ কে তীব্রবেগে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে; জানালার খড়খড়ি খট খট শব্দে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে; একটা পরিত্যক্ত কুকুর লেজ তুলে মাথা নীচু করে কঁপতে কাঁপতে দেয়ালের গায়ে এসে আশ্রয় খুঁজছে; একটি তরুণী বাতাসের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটু সমান বরফ ভেঙে এগিয়ে চলেছে। এলোঞ্জো শিউরে উঠল; দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এর চাইতে তো ময়লা জল আর গু মোট বর্ষাও ভাল।

    জানালা থেকে এক পা সরে এসে কি যেন শোনবার আশায় কান পাতল। একটা পরিচিত গানের অস্পষ্ট মধুর সুর তার কানে বাজল। নিজের অজ্ঞাতসারেই মাথাটা একটু সামনে ঝুঁকিয়ে সেই সঙ্গীত-সুধা সে পান করতে লাগল; তার হাত-পা নড়ছে না, শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা বলা কঠিন। গায়কিতে কিছু ত্রুটি ছিল, কিন্তু এলোঞ্জোর কাছে সেটা ত্রুটি না হয়ে অতিরিক্ত মাধুর্য হয়ে দেখা দিল। গান থেমে গেলে একটি গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে সে বলল, আ, মধুর বিদায় ক্ষণে গানটি এত ভালভাবে গাওয়া আমি কখনও আগে শুনিনি।

    দ্রুতপায়ে টেবিলে ফিরে গিয়ে এক মুহূর্ত কান পেতে শুনে একটু চাপা গলায় বলল, মাসি, এই স্বর্গীয় গায়িকাটি কে গেল?

    তার আসার আশায়ই তো এতক্ষণ ছিলাম। মাসখানেক বা মাস দুই আমার কাছেই থাকবে। তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। মিস-

    দোহাই তোমার, একটু সবুর কর সুসান মাসি। তুমি যে কি কর একবার ভেবেও দেখ না!

    এক দৌড়ে সে শোবার ঘরে চলে গেল এবং মুহূর্তকাল পরেই বেশবাস পরিবর্তন করে ফিরে এসে রুক্ষ মেজাজে বলে উঠল:

    চুলোয় যাক! আগুন-রঙা পটি লাগানো আকাশ-নীল ড্রেসিং-গাউন পরা অবস্থাতেই তো মাসি আমাকে এই পরীটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিল! একবার একটা কিছু মাথায় চাপলে মেয়েদের আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।

    তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গিয়ে সাগ্রহে বলল, মাসি, এবার আমি প্রস্তুত। বলেই একান্ত আগ্রহে ও শালীন ভঙ্গীতে হাসতে হাসতে অভিবাদন জানাতে লাগল।

    ঠিক আছে। মিস্ রোজান্না এথেলটন, আমার প্রিয় বোন-পো মিঃ এলোঞ্জো ফিজ ক্লারেন্স-এর সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। এস! তোমরা দুজনই ভালমানুষ; দুজনকেই আমি পছন্দ করি; কাজেই তোমরা দুজন এবার কথা বল, আমি বরং ততক্ষণ গৃহস্থালীর কিছু কাজকর্ম করি। বস রোজান্না; এলোঞ্জো, তুমিও বস। বিদায়; তবে বেশী দূরে আমি যাব না।

    এলোঞ্জো সারাক্ষণ মাথা নোয়াচ্ছিল আর হাসছিল, এবং কাল্পনিক চেয়ারে কাল্পনিক তরুণীকে বসবার ইঙ্গিত করছিল। এবার নিজেই আসনে বসে মনে মনে বলল, আঃ, কী ভাগ্য! এবার বাতাস উঠুক, বরফ পড়ুক, আকাশরে মুখে কুটি ফুটুক! আমার তাতে কি যায় আসে।

    শুরু হল কথার পর কথা। নানান কথার ভিতর দিয়ে দুটি যুবক-যুবতীর মধ্যে পরিচয় ঘনিষ্ঠ তর হল। সাধারণ পোশাকেই যুবতীটি অপরূপ সুন্দরী। সে যখন কোন উৎসব উপলক্ষে বা নাচের জন্য সাজগোজ করে তখন না জানি তাকে কেমন দেখায়!

    এলোঞ্জোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে অনেক সময় কাটিয়ে দিল। যত সময় যায়, তত কথা বাড়ে। কিন্তু এক সময় চোখ তুলে ঘড়িটার দিকে তাকাতেই তার সারা গালে লালের ছোপ ছড়িয়ে পড়ল। বলে উঠল

    এবার বিদায় মিঃ ফিজ ক্লারেন্স; আমাকে এবার যেতেই হবে!

    এত তাড়াতাড়ি সে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল যে জবাবে যুবকটি যে বিদায়-সম্ভাষণ জানাল সেটা তার কানেই গেন না। ভ্রূকুটি কুটিল ঘড়িটার দিকে চোখ রেখে সে দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট দুটি ঈষৎ ফাঁক করে বলল;

    এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিট! প্রায় দুঘণ্টা, অথচ মনে হচ্ছে বিশ মিনিট ও নয়! হায়, না জানি উনি আমাকে কি ভাবলেন!

    ঠিক সেই মুহূর্তে এলোঞ্জোও ঘড়ির দিকেই তাকিয়ে ছিল। সেও বলে উঠল:

    তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি! প্রায় দুঘণ্টা, আর আমার তো দুমিনিট বলেও মনে হচ্ছে না! ঘড়িটা কি তাহলে আবার বকর-বকর করতে শুরু করেছে? মিস এথেলটন! দয়া করে আর এক মিনিট। এখনও ওখানেই আছেন তো?

    হ্যাঁ; কিন্তু তাড়াতাড়ি করুন। আমি এখনই চলে যাচ্ছি।

    দয়া করে বলবেন কি এখন কটা বাজে?

    মেয়েটির মুখ আবার রাঙা হয়ে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, আমকে এ কথা জিজ্ঞাসা করছে; লোকটি কি নিষ্ঠু র! তারপর আশ্চর্য রকমের নকল নিস্পৃহতার সঙ্গে বলল, এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিট।

    ওঃ, ধন্যবাদ! আপনাকে তো এখন যেতেই হবে, তাই না?

    হ্যাঁ।

    আমি দুঃখিত।

    কোন জবাব নেই।

    মিস্ এথেলটন!

    বলুন।

    আপনি-আপনি এখনও আছেন, তাই না?

    হ্যাঁ; কিন্তু জলদি করুন। আপনি কি বলতে চান?

    দেখুন-মানে-বিশেষ কিছু নয়। এখানটা বড়ই নির্জন। আমি জানি, আব্দারটা একটু বেশীই হয়ে যাবে, কিন্তু আপনি কি আবারও আমার সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারেন না-মানে, অবশ্য যদি আপনার বিশেষ অসুবিধা না হয়?

    আমি ঠিক জানি না-কিন্তু ভেবে দেখব। চেষ্টা করব।

    ওঃ, অনেক ধন্যবাদ মিস এথেলটন!….ঐ যা! সে চলে গেল, আর আবার ফিরে এল সেই কালো মেঘ, বরফ–ঝড়, আর উত্তাল হাওয়া। কিন্তু সে তো বলে গেল বিদায়, শুভ প্রাতঃকাল তো বলে নি। সে বলেছে বিদায়!… যাই হোক, ঘড়িটা ঠিকই ছিল। দুটো ঘণ্টা। যেন ডানায় বিদ্যুৎ জড়িয়ে এসেছিল!

    আসনে বসে স্বপ্নালু চোখে সে অনেকক্ষণ আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল:

    কী আশ্চর্য! মাত্র দুঘণ্টা আগে ছিলাম মুক্ত মানুষ, আর এখন আমার হৃদয় পড়ে আছে সান ফ্রান্সিস্কো-তে!

    ঠিক সেই সময় রোজান্না এথেলটন তার শোবার ঘরে জানালার পাশে বসে একখানা বই হাতে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে, বর্ষণস্নাত সমুদ্র গোল্ডেন গেট -এর উপর আছড়ে পড়ছে, আর মনে মনে বলছে, বেচারি বালে থেকে সে কত আলাদা; বার্লে-র তো খালি মাথা, আর সম্বলের মধ্যে আছে কণ্ঠ স্বর নকল করবার অদ্ভুত কৌশল!

    .

    ০২.

    চার সপ্তাহ পরে মিঃ সিড়নি এরমন বার্লে টেলিগ্রাফ হিল-র সুসজ্জিত বসবার ঘরে একটি ভোজসভার আয়োজন করে সান। ফ্রান্সিস্কের সাহিত্যিক মহল, কিছু জনপ্রিয় অভিনেতা ও বোনাজা-র জমিদারবাবুদের কণ্ঠ স্বর ও ভাবভঙ্গীর নকল করে সকলকে প্রচুর আনন্দ দান করছিল। তার বেশবাস সুশোভন, চে হারাও সুদর্শন। শুধু চোখটা ঈষৎ টেরা। তাকে বেশ হাসিখুশিও দেখাচ্ছে। একটা অস্বস্তিকর প্রত্যাশা নিয়ে সে বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। একসময়ে একটি কেতাদুরস্ত পরিচারক এসে গৃহকত্রীর হাতে একটা চিঠি দিল, আর সেও কি বুঝে মাথা নাড়ল। মনে হল, তাতেই মিঃ বার্লের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল, কারণ তার উৎসাহ ক্রমেই কমতে লাগল, আর তার একচোখে ফুটে উঠল হতাশা, এবং অন্য চোখে দেখা দিল ক্ষোভ।

    যথাসময়ে লোকজনরা চলে গেল। রইল শুধু সে আর গৃহকত্রী। তখন সে বলল:

    এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। সে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। সব সময়ই একটা না একটা ওজুহাত তুলছে। শুধু যদি তার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম, কথা বলতে পারতাম-কিন্তু এই প্রতীক্ষা-

    আপনি যাকে এড়িয়ে চলা বলছেন হয় তো সেটা একটা আকস্মিক ঘট নামাত্র। উপরের ছোট বসবার ঘরে গিয়ে একটু আরাম করুন গে। গৃহস্থালীর কাজের কিছুটা সুরাহা করেই আমি তার ঘরে যাব। তখন সে যাতে আপনার সঙ্গে দেখা করে তার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে পারব।

    ছোট বসবার ঘরটি তে যাবার জন্যই সে উপরে যাচ্ছিল, এমন সময় সুসান মাসি-র ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ঈষৎ খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে একটা পরিচিত উল্লসিত হাসির শব্দ তার কানে এল; কাজেই কোন রকম শব্দ না করেই বা কথা না বলেই সে সাহসের সঙ্গে ঘরের ভিতরে পা দিল। কিন্তু তার উপস্থিতি সম্পর্কে ঘরের লোকদের সচেতন করবার আগেই এমন কিছু কথা সে শুনতে পেল যাতে তার অন্তর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল, তার তরুণ রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। একজন বলছে:

    এই তো এসেছে সোনা!

    তারপর সে শুনতে পেল, তার দিকে পিছন ফিরে রোজান্না এথেন্টন বলছে: তোমারও এসেছে প্রিয়তম!

    সে দেখল, রোজান্নার শরীর ক্রমাগত নীচু হচ্ছে; সে শুনল, রোজান্না কাকে যেন চুমো খাচ্ছে-একবার নয় বারবার। তার বুকের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। তাদের মন-ভাঙা সংলাপ সমানেই চলেছে:

    রোজান্না, আমি জানতুম তুমি সুন্দরী, কিন্তু এ রূপ যে চোখকে ঝলসে দেয়, অন্ধ করে দেয়, নেশা ধরায়!

    এলোঞ্জো, তোমার মুখে এ কথা শুনতে কী যে ভাল লাগছে। আমি জানি এ সত্য নয়, তবু এ জন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি

    জানতাম তোমার মুখোনি সুন্দর, কিন্তু বাস্তবের সৌন্দর্য ও মহত্ত্বের কাছে আমার কল্পনার সৃষ্টি যে কত তুচ্ছ!

    অজস্র চুম্বনের শব্দ আবার বালের কানে এল।

    রোজান্না আমার, তোমাকে ধন্যবাদ! এ ফটোগ্রাফ আমার চেহারার চাইতে দেখতে ভাল, কিন্তু তুমি যেন তা ভেব না। মনের মানুষ!

    বল এলোঞ্জো।

    আমি কত সুখী রোজান্না।

    আঃ এলোঞ্জো, আমার আগে কেউ কোনদিন জানে নি ভালবাসা কাকে বলে, আর আমার পরেও যারা আসবে তারাও জানবে না সুখ কাকে বলে। একটি উজ্জ্বল মেঘলোকে, মন্ত্রমুগ্ধ বিমূঢ় উল্লাসের সীমাহীন আকাশে আমি ভেসে বেড়াচ্ছি।

    আঃ, আমার রোজান্না!-তুমি তো আমারই, তাই নয় কি?

    একান্ত-একান্তই তোমার এলোঞ্জো, আজ এবং চিরদিন! আমার সকল দিন, সকল রাতের স্বপ্নকে ঘিরে একটি মাত্র গানই বাজছে, আর

    সে গানের একটি মাত্র ভাষা- মেইন রাজ্যের ইস্টপোট–এর এলোঞ্জো ফিজ ক্লারেন্স, এলোঞ্জো ফিজ ক্লারেন্স!

    চুলোয় যাক। তার ঠিকানা তো পেলাম! মনে মনে গর্জে উঠে বার্লে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল।

    এলোঞ্জোর অজ্ঞাতেই তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল তার মা বিস্ময়ের প্রতিমূর্তি হয়ে। মাথা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত তার গোটা দেহ এমনভাবে লোমের পোশাকে ঢাকা যে চোখ ও নাক ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে যেন শীতের প্রতীক, কারণ তার সর্বশরীরে বরফের গুঁড়ো ছড়ানো।

    রোজান্নার অজ্ঞাতেই তার পিছনেও দাঁড়িয়ে ছিল সুসান মাসি, সেও যেন বিস্ময়ের প্রতিমূর্তি। সে যেন গ্রীষ্মের প্রতীক, কারণ তার পরিধানে স্বপ্নবাস, আর সজোরে পাখা চালিয়ে সে তার মুখের ঘাম দূর করবার চেষ্টা করছে।

    দুটি নারীর চোখেই আনন্দের অশ্রু।

    এই ব্যাপার! মিসেস ফিজ ক্লারেন্স হেঁকে উঠল, এলোঞ্জো, তাহলে এই জন্যই ছসপ্তাহ ধরে তোমাকে কেউ ঘর থেকে টেনে বার করতে পারে নি।

    সুসান মাসিও হেঁকে বলল, এই ব্যাপার! রোজান্না, তাহলে এই জন্যই গত ছসপ্তাহ যাবৎ তুমি একবারে সন্ন্যাসিনী বনে গিয়েছ!

    দুটি যুবক-যুবতী মুহূর্তে সলজ্জ ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াল। চোরাই মালের ব্যবসায়ীরা বিচারপতির দণ্ডাদেশের জন্য যে ভাবে অপেক্ষা করে থাকে তাদের অবস্থাও তখন ঠিক সেই রকম।

    আশীর্বাদ করি বাবা! তোমার সুখেই আমার সুখ। মায়ের বুকে এস এলোঞ্জো!

    আমার বোনপোর জন্যই তোমাকে আশীর্বাদ করি রোজান্না! তুমি আমার বুকে এস!

    তারপর টেলিগ্রাফ হিল-এ ও ইস্টাপোর্ট স্কোয়ার-এ আনন্দাশ্রুর জোয়ার বয়ে গেল, হৃদয়ের সঙ্গে হল হৃদয়ের মিলন।

    দুই বাড়িরই বড়রা চাকরদের ডেকে পাঠাল। একজনকে হুকুম করা হল, হিকোরি কাঠ দিয়ে বড় করে আগুন জ্বালাও, আর আমাকে এনে দাও গরমাগরম লেমনেড।

    অন্যজনকে হুকুম করা হল, আগুন নিভিয়ে ফেল, আর আমাকে এনে দাও দুখানি তালপাতার পাখা এ এক কুঁজো বরফ–জল।

    তারপর যুবক-যুবতীকে ছেড়ে দেওয়া হল। বড়রা মশগুল হয়ে রইল এই মধুর বিস্ময়ের কথা ও বিয়ের আয়োজনের আলোচনায়।

    এর কয়েক মিনিট আগেই কারও সঙ্গে দেখা না করে বা মৌখিক বিদায় না নিয়েই মিঃ বার্লে টেলিগ্রাফ হিল-র বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। মেলোড্রামার জনপ্রিয় অভিনেতার মতই সে দাঁত কড়মড় করতে লাগল। ওকে সে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না! এই আমার প্রতিজ্ঞা! মহান প্রকৃতি তার শীতের লোমের পোশাক খুলে ফেলে বসন্তের মরকত শোভায় সাজবার আগেই সে হবে আমার!

    .

    ০৩.

    দুই সপ্তাহ পরে। তিন-চারদিন ধরেই কয়েক ঘণ্টা পরে পরেই বেশ ভক্ত-ভক্ত দেখতে একটি সুবেশ পাদরি এলোঞ্জার সঙ্গে দেখা করছে। লোকটি র চোখ একটু টেরা। তার কার্ডে পরিচয় লেখা, সিন্‌সিনাটির রেভাঃ মেল্টন হারভে। সে জানিয়েছে, স্বাস্থ্যের জন্যই সে পাদরির কাজ থেকে অবসর নিয়েছে। যদি সে বলত খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য তাহলে তার সুন্দর চেহারা ও সুগঠিত দেহ দেখেই বোঝা যেত যে সে ভুল বলেছে। টেলিফোনের ব্যাপারে একটি উন্নত ব্যবস্থা সে আবিষ্মর করেছে, আর সেটার ব্যবহারের প্রচলন করেই সে জীবিকা অর্জন করতে প্রয়াসী। সে বলেছে, বর্তমানে টেলিগ্রাফের মারফতে কোন গান বা কনসার্ট কে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পাঠাবার সময় যে কেউ ইচ্ছা করলে টেলিগ্রাফের তারে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং তার সঙ্গে নিজের টেলিফোনের সংযোগ করে লুকিয়ে সেই গান শুনতে পারে। আমার এই আবিষ্মর সে সব বন্ধ করে দেবে।

    এলোঞ্জো জবাব দিল, দেখুন, চুরি করে গান শুনলে তো গানের মালিকের কোন ক্ষতি হচ্ছে না, কাজেই তাতে তার কি যায় আসে?

    কিছুই যায় আসে না, রেভারেণ্ড বলল।

    তাহলে? এলোঞ্জো সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।

    রেভারেণ্ড বলল, ধরুন, গান-বাজনার বদলে মাঝ পতে যদি চুরি করে এমন কিছু শোনা হয় যা প্রেমের ব্যাপার অত্যন্ত গোপনীয় ও পবিত্র, তাহলে?

    এলোঞ্জোর মাথা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত শিউরে উঠল। বলল, স্যার, এটা তো অমূল্য আবিষ্কার। যেমন করে হোক এটা আমার চাই-ই।

    কিন্তু আবিষ্কারটি কে সিনসিনাটি থেকে আনবার পথে একান্ত অকারণেই বিলম্ব ঘটতে লাগল। ধৈর্যহারা এলাঞ্জার আর বিলম্ব সয় না। রোজান্নার মিষ্টি কথাগুলি তার সঙ্গে সঙ্গে একটা হীন চোরও শুনে ফেলবে এ চিন্তাই তার কাছে বিষতুল্য। রেভারে মাঝে মাঝেই আসে আর বিলম্বের জন্য দুঃখ জানিয়ে বলে, ব্যাপারটা ত্বরান্বিত করতে সে নানা ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে। কিন্তু এলোঞ্জার মন তাতে সান্ত্বনা পায় না।

    একদিন বিকেলে রেভারেণ্ড সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলোঞ্জোর দরজায় টোকা দিল। কোন সাড়া নেই। সে ঘরে ঢুকল, সাগ্রহে চারদিকে দেখল, আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিল, তারপর দৌড়ে টেলিফোনটার কাছে গেল। যন্ত্রের ভিতর দিয়ে ভেসে এল মধুর বিদায়ক্ষণ গানটির দূরাগত অপূর্ব সুন্দর সুর-লহরী। গানের মাঝ পথেই সে বাধা দিল; এলোঞ্জোর গলার স্বর হুবহু নকল করে কিছুটা অধৈর্যের সঙ্গে বলল;

    হৃদয়ের রাণী!

    কে? এলোঞ্জো?

    দয়া করে এ সপ্তাহে ও গানটা আর গেয়ো না-বরং আধুনিক কিছু গাও।

    এমন সময় সিঁড়িতে সুখী মানুষের স্বচ্ছন্দ পদক্ষেপ শোনা গেল। পৈশাচিক হাসি হেসে রেভারেণ্ড জানালার ভেলভেটের ভারী পর্দার। আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। এলোঞ্জো যেন উড়ে গেল টেলিফোনের কাছে।

    বলল: প্রিয় রোজান্না, এস একসঙ্গে কিছু গাওয়া যাক।

    তিক্ত বিদ্রুপের স্বরে সে বলল, আধুনিক কিছু কি?

    তুমি যদি চাও তো তাই হোক!

    ইচ্ছা হয় তুমিই গাও!

    কণ্ঠ স্বরের কঠোরতর যুবকটি বিস্মিত হল, আহত হল। বলল:

    রোজান্না, এ তো তোমার মত কথা নয়।

    মিঃ, ফিজ ক্লারেন্স, তোমার অতি ভদ্র উক্তি যদি তোমার উপযুক্ত হয়, তাহলে আমার এই উক্তিও আমার উপযুক্ত।

    মিস্টার ফিজ ক্লারেন্স রোজান্না, কোন রকম অভদ্র উক্তি তো আমি করি নি।

    ওঃ, তাই বটে! অবশ্য তাহলে আমিই তোমাকে ভুল বুঝে ছি, আর সেজন্য সবিনয়ে ক্ষমাও চেয়ে নিচ্ছি। হা-হা-হা! কিন্তু তুমিই তো বললে, আজ আর এ গান গেয়ো না।

    আজ আর কি গাইবে না বললে?

    অবশ্যই যে গানের কথা তুমি বলেছ। হঠাৎ আমরা কত দূরে চলে গেছি।

    আমি কখনও কোন গানের কথা বলি নি।

    নিশ্চয় বলেছ।

    না, বলি নি।

    আমি বলতে বাধ্য যে তুমি বলেছ।

    আমিও পুনর্বার বলছি, আমি বলি নি।

    আবারও দুর্ব্যবহার! এই যথেষ্ট স্যার। আমি কোনদিন তোমাকে ক্ষমা করব না। আমাদের সব সম্পর্কের এখানেই ইতি।

    তারপরেই ভেসে এল উচ্ছ্বসিত কান্নার শব্দ। এলোঞ্জো সঙ্গে সঙ্গে বলল:

    ওঃ, রোজান্না, তোমার কথা ফিরিয়ে নাও! এর মধ্যে একটা ভয়ংকর রহস্য আছে, আছে একটা মারাত্মক ভুল। তুমি বিশ্বাস কর, সত্যি বলছি কোন গান সম্পর্কেই আমি কিছু বলি নি। সারা পৃথিবীর বিনিময়েও আমি তোমাকে আঘাত দিতে পারি না!..রোজান্না! সোনা!…কথা বল। বলবে না?

    সব চুপ। একটু পরে এলোঞ্জো শুনতে পেল, মেয়েটির ফোঁপানি দূরে সরে যাচ্ছে। তার অর্থ সে টেলিফোনের কাছ থেকে সরে গেছে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের মনেই বলল, সব দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান আর দরিদ্রাশ্রমগুলোতে টু মেরে মাকে খুঁজে বের করব। একমাত্র মা-ই বোঝাতে পারবে যে ওকে আঘাত দিতে আমি চাই নি।

    মিনিট খানেক পরে শিকারের চলাফেরার খোঁজ জানা বিড়ালের মতই রেভারণ্ড গুঁড়ি মেরে টেলিফোনের কাছে গিয়ে হাজির হল। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, চোখের জলে কপা একটি নরম অনুশোচনা-ভরা কণ্ঠ স্বর শোনা গেল:

    প্রিয় এলোঞ্জো, আমারই ভুল হয়েছে। এমন নিষ্ঠুর কথা তুমি বলতে পার না। হয় ঈর্ষার বশে আর না হয় তামাসা করে অপর কেউ নিশচয় তোমার গলার স্বর নকল করে কথা বলেছে।

    রেভারেণ্ড এলোঞ্জোর গলা নকল করে ঠাণ্ডা স্বরে বলল:

    তুমিই তো বলেছ, আমাদের সব সম্পর্কের ইতি হয়ে গেছে। তবে তাই হোক। তোমার অনুতাপে আমার দরকার নেই, ও সব আমি। ঘৃণা করি।

    তারপরই জয়লাভের শয়তানী উল্লাসে সে সেখান থেকে চলে গেল; টেলিফোন সংক্রান্ত কাল্পনিক আবিষ্কার নিয়ে আর কোন দিন সে। বাড়ি মাড়াল না।

    তার চার ঘণ্টা পরে মাকে খুঁজে নিয়ে এলোঞ্জা বাড়িতে ফিরল। সান ফ্রান্সিস্কের বাড়িতে খোঁজ-খবর নিল, কিন্তু সেখান থেকে কোন সাড়া মিলল না। নির্বাক টেলিফোনের সামনে বসে তারা অপেক্ষাই করতে লাগল।

    অবশেষে সান ফ্রান্সিস্কোতে যখন সূর্য অস্ত গেল, আর ইস্টপোর্টে সন্ধার পরেও সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় কেটে গেল, তখন বার বার উচ্চারিত রোজান্না! ডাকের জবাব এল।

    কিন্তু হায়রে! এ যে সুসান মাসির গলা। সে বলল: সারা দিন আমি বাইরে ছিলাম। এইমাত্র ফিরেছি। এখনই দেখছি সে কোথায় আছে।

    ওরা অপেক্ষাই করতে লাগল-দুমিনিট–পাঁচ মিনটি–দশ মিনিট। তারপর ভয়ার্ত কণ্ঠে র এই মারাত্মক কথাগুলি ভেসে এল:

    সে চলে গেছে, মালপত্র নিয়েই গেছে। চাকরদের বলে গেছে, অন্য কোন বন্ধুর কাছে যাচ্ছে। কিন্তু তার টেবিলে এই চিরকুট টি পেয়েছি। শোন আমি চলে গেলাম। আমার খোঁজ করো না; আমার বুক ভেঙে গেছে; আর কখনও আমার দেখা পাবে না। তাকে বলো, মধুর বিদায় ক্ষণে গানটি যখনই গাইব তখনই তার কথা আমার মন পড়বে, কিন্তু ওই গানটিকে নিয়ে যে নিষ্ঠুর কথাগুলি সে বলেছে তা আমি ভুলে যাব। এই তার চিঠি। এলোঞ্জো, এলোঞ্জো, এ সবের অর্থ কি? কি হয়েছে?

    কিন্তু এলোঞ্জো মরার মত বিবর্ণ ও শক্ত হয়ে বসে রইল। তার মা ভেলভেটের পর্দা সরিয়ে জানালাটা খুলে দিল। ঠাণ্ডা তার মনটা একটু তাজা হল। সব কথা সে মাসিকে জানাল। পর্দাটা সরাবার সময় একটা কার্ড ছিটকে মেঝেয় পড়েছিল। মা সেটা তুলে পড়তে লাগল: মিঃ সিড়নি এপ্পারনন বার্লে, সান ফ্রান্সিস্কো।

    দুষ্কৃতকারী! চেঁচিয়ে কথাটা বলেই এলোঞ্জো ছুটে বেরিয়ে গেল; নকল রেভারেণ্ডকে খুঁজে বের করে সে তাকে উচিত শাস্তি দেবে। কার্ড টা থেকেই সব কিছু পরিঙ্কর হয়ে গেছে। তাছাড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ভালবাসার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তাদের জীবনের পূর্বাপর অন্য সব প্রেমিক-প্রেমিকার কথাই খোলাখুলিভাবে বলেছিল-সব প্রেমিক প্রেমিকারাই তাই করে থাকে।

    .

    ০৪.

    পরবর্তী দুমাসে অনেক কিছু ঘটল। শুধু এইটুকু জানা গেছে যে, বেচারি বাপ-মা-হারা রোজান্না অরিগ্ন-এর অন্তর্গত পোর্ট ল্যাণ্ড-এ তার ঠাকুমার কাছেও যায় নি, অথবা তাকে কোন খবরও দেয় নি; শুধু টে লিগ্রাফ হিল-এর বাড়িতে যে চিরকুট টা সে রেখে গিয়েছিল তারই একটা নকল তার কাছে পৌঁচেছে। যেই তাকে আশ্রয় দিয়ে থাকুক-অবশ্য যদি সে এখনও বেঁচে থাকে-তাকে নিশ্চয় বলা হয়েছে যেন কাউ কে তার খোঁজ খবর না দেওয়া হয়, কারণ তাকে খুঁজে বের করবার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।

    এলোঞ্জো কি তার আশা ছেড়ে দিয়েছে? না, দেয় নি। সে নিজেকে বুঝিয়েছে, যখনই মন খারাপ হবে তখনই সেই মধুর গানটি সে গাইবে; সেই গান শুনেই আমি তাকে খুঁজে পাব। কাজেই বিছানায়র পুটুলি ও একটা বহনযোগ্য টেলিফোন সঙ্গে নিয়ে সে দেশ-দেশান্তরের পথে বেরিয়ে পড়ল। অনেক সময়ই লোকরা অবাক হয়ে দেখল, একটি শীর্ণদেহ, বিবর্ণমুখ, দুঃখজীর্ণ মানুষ অনেক কষ্ট স্বীকার করে নির্জন সব জায়গায় টেলিগ্রাফের থাম বেয়ে উপরে উঠছে, একটা ছোট বাক্সকে কানের কাছে ধরে ঘণ্টাখানেক সেখানে বসে থাকছে, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে নেমে আবার শ্রান্ত পা ফেলে ফেলে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। তাকে পাগল ও বিপজ্জনক লোক মনে করে চাষীরা তাকে লক্ষ্য করে অনেক সময় গুলি ও ছোড়ে। ফলে তার জামা-কাপড়গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল, শরীরের অনেক জায়গাও কেটে ছেড়ে গেল। কিন্তু অসীম ধৈর্য সব কিছুই সে সয়ে গেল।

    এই তীর্থযাত্রার গোড়ার দিকে সে বলত, আহা, মধুর বিদায়ক্ষণে গানটা যদি একবার শুনতে পেতাম! কিন্তু যাত্রার শেষের দিকে বড় দুঃখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে সে বলত, আহা, অন্য কিছুও যদি শুনতে পেতাম।

    এইভাবে এক মাস তিন সপ্তাহ কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত কিছু দরদী লোক তাকে ধর নিয়ে নিউ ইয়র্ক-এর একটা বেসরকারী পাগলাগারদে রেখে দিল।

    সে কোন রকম হা-হুতাশ করল না, কারণ সে শক্তি ও তার ছিল না, আর সেই সঙ্গে ছিল না মন, ছিল না কোন আশা। সুপারিন্টে ণ্ডেন্ট দয়া করে নিজের আরামদায়ক বসবার ঘর ও শোবার ঘর তাকে ছেড়ে দিল এবং সস্নেহে তার সেবা-শু শষা করতে লাগল।

    এক সপ্তাহের শেষের দিকেই রোগী প্রথম নিজের বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল। একটা সোফায় বালিশে হেলান দিয়ে আরাম করে শুয়ে সে মার্চ মাসের বাতাসের বিষণ্ণ সঙ্গীত ও নীচে কার রাস্তার চলমান মানুষের পদধ্বনি শুনছিল-তখন সন্ধা ছটা, সারা নিউ ইয়র্কের লোক কাজের শেষে ঘরে ফিরছে। অগ্নিকুণ্ডে আগুন জ্বলছে; জ্বলছে দুটো পড়ার বাতি; কাজেই বাইরেটা ঠাণ্ডা হলেও ঘরের ভিতরটা বেশ গরম ও আরামদায়ক। মৃদু হেসে এলোঞ্জো ভাবতে লাগল, কেমন করে প্রেমের উন্মাদনা জগতের চোখে তাকে পাগল প্রতিপন্ন করেছে। এমন সময় অনেক দূর থেকে একটি অস্পষ্ট মধুর সুর ভেসে এসে তার কানে বাজল। তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল; ঠোঁট ফাঁক করে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সে কান পাতল। গানের সুর বয়েই চলেছে-সেও কান পেতে আছে, শুনছে, নিজের অজ্ঞাতেই ধীরে ধীরে উঠে বসেছে। অবশেষে সে চেঁচিয়ে উঠল:

    এই তো! এই তো সে! আহা, সেই স্বর্গীয় সুর-লহরী!

    সাগ্রহে নিজেকে টানতে টানতে নিয়ে গেল ঘরের সেই কোণে যেখান থেকে শব্দটা আসছে; পর্দাটা সরাতেই দেখা গেল একটি টেলিফোন। সে ঝুঁকে পড়ল এবং সুরের রেশ কেটে যেতেই সোচ্চারে বলে উঠল।

    ওঃ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, শেষ পর্যন্ত পেলাম! প্রিয়তম রোজান্না, আমার সঙ্গে কথা বল! সে নির্মম রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে; সেই শয়তান বালে আমার গলার স্বর নকল করে দুর্বিনীত কথা শুনিয়ে তোমাকে আঘাত দিয়েছিল!

    রুদ্ধশ্বাস নীরবতা। এলোঞ্জোর মনে হল যেন এক যুগের প্রতীক্ষা। তারপর ভাষার রূপ নিয়ে ভেসে এল একটি অস্পষ্ট শব্দ:

    ওঃ এলোঞ্জো, ঐ মূল্যবান কথাগুলো আর একবার বল!

    এই তো সত্য কথা, আসল সত্য কথা রোজান্না প্রিয়; তোমাকে প্রমাণ দেব, উপযুক্ত, যথাযথ প্রমাণ!

    ওঃ এলোঞ্জো, আমার পাশে থাক! এক মুহূর্তও আমাকে ছেড়ে যেয়ো না! আমাকে বুঝতে দাও যে তুমি আমার পাশেই আছ! আমাকে বল, আর কোন দিন আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হবে না। আহা! কী সুখের মুহূর্ত, কী আনন্দের মুহূর্ত, কী স্মরণীয় মুহূর্ত!

    এই মুহূর্তটি কে আমরা মনে রাখব রোজান্না। প্রতি বছর ঘড়িতে যখন এই সময়টি বেজে উঠবে, তখন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এই মুহূর্তটি কে স্মরণ করে আমরা অনুষ্ঠান করব, আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি বছর অনুষ্ঠান করব।

    তাই করব, তাই করব এলোঞ্জো।

    রোজান্না আমার, আজ থেকে সন্ধ্যা ছটা বেজে চার মিনিট হবে।

    বিকেল বারোটা বেজে তেইশ মিনিট হবে।

    সে কি, রোজান্না, তুমি কোথায় আছ?

    হনলুলু-তে স্যাণ্ডুইচ দ্বীপে। আর তুমি কোথায় আছ? আমার পাশেই থাক; মুহূর্তের জন্যও আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। সে আমি সইতে পারি না। তুমি কি বাড়িতেই আছ?

    না সোনা, আমি আছি নিউ ইয়র্ক-এ-ডাক্তারের হাতে রোগী।

    একটা বেদনাদীর্ণ আর্তনাদ এলোঞ্জোর কানে গুঞ্জন করে উঠল, ঠিক যেন একটা আহত ঊশের কর্কশ গুঞ্জন পাঁচ হাজার মাইল পার হয়ে এসে কানে বাজল। এলাোে তাড়াতাড়ি বলে উঠল;

    শান্ত হও গো মেয়ে। ও কিছু নয়। তোমার আবির্ভাবের মধুর গুণে এর মধ্যেই আমি ভাল হয়ে উঠেছি রোজান্না!

    বল এলোঞ্জো উঃ কী ভয়ই না তুমি পাইয়ে দিয়েছিলে। এবার বল।

    শুভ দিনটি কবে বলে দাও রোজান্না!

    কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর জবাব এল ভীরু নীচু গলায়, আমার লজ্জা করছে-কিন্তু আনন্দের সঙ্গে, সুখের সঙ্গে। তুমি-তুমি কি চাও খুব তাড়াতাড়ি হোক?

    আজ রাতেই রোজান্না! আঃ, আর দেরী করার ঝুঁকি নেওয়া চলে না। এখনই হোক!-আজ রাতে, এই মুহূর্তে!

    আঃ, কী উতলা মানুষরে বাবা! কিন্তু আমার এক বুড়ো কাকা ছাড়া এখানে তো আর কেউ নেই। তিনি সারা জীবনই ধর্ম-প্রচারকের কাজ করেছেন, এখন অসবর নিয়েছেন। শুধু তিনি আর তার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। আমার বড় ইচ্ছা, তোমার মা আর তোমার সুসান মাসি যদি-

    রোজান্না প্রিয়, বল আমাদের মা ও আমাদের সুসান মাসি।

    হ্যাঁ, আমাদের মা ও আমাদের সুসান মাসি।

    হ্যাঁ, আমাদের মা ও আমাদের সুসান মাসি-তুমি যদি খুসি হও তো এই কথা বলে আমিই খুসি। আমার ইচ্ছা, তারাও উপস্থিত থাকেন।

    আমারও তাই ইচ্ছা। আচ্ছা, সুসান মাসিকে যদি তুমি তার করে দাও, তাহলে তার আসতে কত দিন লাগবে?

    সানফ্রান্সিস্কে থেকে স্টীমার ছাড়বে আগামী পরশু। পথে লাগবে আট দিন। তাহলে তিনি এসে পৌঁছবেন ৩১ শে মার্চ।

    তাহলে দিন স্থির কর ১লা এপ্রিল; তাই কর রোজান্না।

    রক্ষে কর! আমরা যে এপ্রিল ফুল হয়ে যাব এলোঞ্জো

    আরে, সেদিনের সূর্য যখন সারা পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়বে তখন আমরাই হব সব চাইতে সুখী দুটি জীব। তাহলে আমাদের কিসের ভয়? ঐ ১লা এপ্রিলই স্থির কর সোনা।

    আমিও সর্বান্তঃকরণে বলছি, ১লা এপ্রিলই স্থির হোক।

    আঃ কী সুখ! সময়টাও বলে দাও রোজান্না।

    আমার পছন্দ সকালবেলা, তখন সব কিছু খুসিতে ভরা থাকে। সকাল আট টা হলে কেমন হয় এলোঞ্জো?

    সারাদিনের মধুরতম ক্ষণ-কারণ সেই ক্ষনেই তুমি আমার হবে।

    কিছুক্ষণ ধরে একটা অস্পষ্ট অথচ উন্মত্ত শব্দ শোনা গেল-যেন ঠোঁটে তুলো লাগানো বিদেহী দুই আত্মার মধ্যে চুম্বন-বিনিময় হচ্ছে।

    তারপর রোজান্না বলল, এক মিনিট অপেক্ষা কর সোনা; একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল; সেই ডাক এসেছে।

    যুবতীটি বড় বসবার ঘরে গিয়ে একটা জানালার পাশে বসে বাইরের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে তাকাল। তার মুখ লালা ও গরম হয়ে উঠেছে। সে নিজেকেই হাওয়া করতে লাগল। ছেঁড়া নীল নেকটাই বাঁধা ও আধখানা সিল্ক র টুপি মাথায় একটি কানাকা ছেলে দরজার ফাঁকে মাথাটা গলিয়ে হাঁক দিল, ফ্রি স্কো হাওল!

    শরীরটাকে খাড়া করে বেশ একটা গম্ভীর্যপূর্ণ ভাব এনে মেয়েটি বলল, ভিতরে পাঠিয়ে দাও। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝকঝকে বরফে সেজে-তার মানে অত্যন্ত হাল্কা সাদা আইরিশ পোশাকে সেজে-মিঃ সিড়নি এপ্পারনন ঘরে ঢুকল। সে সাগ্রহে সামনে এগিয়ে গেল, কিন্তু মেয়েটি এমন ভঙ্গী করল এবং এমন ভাবে তাকাল যে সহসা লোকটি নিজেকে সংযত করে নিল। নিস্পৃহ গলায় মেয়েটি বলল, কথামতই আমি এখানে এসেছি। তোমার কথায় আমি বিশ্বাস করেছিলাম, তোমার অনুরোধ মেনে নিয়েছিলাম, বলেছিলাম দিন স্থির। করব। দিন স্থির করেছি ১লা এপ্রিল-সকাল আটটা। এবার যেতে পার।

    ওঃ, প্রিয়তমা আমার, সারা জীবনের কৃতজ্ঞতা যদি-

    একটি কথা নয়। ঐ সময় পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আর কোন দেখা সাক্ষাৎ নয়, কোন রকম যোগাযোগ নয়। না-কোন মিনতি নয়; এটাই আমার সিদ্ধান্ত।

    লোকটি চলে গেলে ক্লান্ত দেহে সে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। নানা দুঃখ-দুর্দশার দীর্ঘ অবরোধ তার শরীরকে ক্ষয় করে দিয়েছে। সে ধীরে ধীরে বলল, অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছি। যদি আর একঘন্টা আগে এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থাটা থাকত-উঃ, কী সাংঘাতিক, কী বাঁচাই না বেঁচে ছি! আর আমি কি না এই প্রবঞ্চক, মিথ্যাচারী বিশ্বাসঘাতক রাক্ষসটাকে ভালবাসতে যাচ্ছিলাম! না, এবার এই শয়তানীর জন্য তাকে অনুতাপ করতে হবে!

    এবার এই ইতিহাসকে শেষ করতে হবে, কারণ বলবার মত আর বিশেষ কিছু নেই। পরবর্তী এপ্রিলের ২রা তারিখে হনলুলু আড় ভার্টাইজার পত্রিকায় এই বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়েছিল;

    বিবাহ-গতকাল সকাল আট ঘটিকায় নিউ ইয়র্ক-এর রেভাঃ ন্যাথেলিনয়েল ডেভিস-এর সহযোগিতায় রেভাঃ নাথান্ হেস-এর পৌরহিত্যে যুক্তরাষ্ট্রের মেইন রাজ্যের ইস্টপোর্ট-এর অধিবাসী মিঃ এলোঞ্জো ফিজ ক্লারেন্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন রাজ্যের পোর্টল্যাণ্ড-এর অধিবাসিনী মিস রোজান্না এথেন্টন-এর বিবাহ-কার্য এই শহরে টেলিফোনযোগে সুসম্পন্ন হইয়াছে। কনের বান্ধবী সানফ্রান্সিস্কের মিসেস সুসান হাউল্যাণ্ড, কনের কাকা ও কাকীমা রেভাঃ মিঃ হেস ও তার স্ত্রী বিশেষ অতিথি হিসাবে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। সানফ্রান্সিস্কে-র মিঃ সিড়নি এঙ্গানন বার্সে-ও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু বিবাহ-অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকিতে পারেন নাই। ক্যাপ্টেন হথর্ন-এর সুন্দর ইয়ট খানি মনোরমভাবে সজ্জিত হইয়া অপেক্ষা করিতেছিল; সুখী কনে ও তাহার বন্ধুবান্ধবীরা সঙ্গে সঙ্গেই সেই ইয়ট–এ চাপিয়া লাহাইনা ও হ্যাঁলিয়াকালা অভিমুকে শুভযাত্রায় রওনা হইয়া গিয়াছে।

    ঐ একই তারিখের নিউ ইয়র্ক-এর সংবাদপত্রগুলিতেও এই বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়েছিল;

    বিবাহ-গতকাল সকাল আড়াই ঘটিকায় হনলুলু-র রেভাঃ নাথান হেস-এর সহযোগিতায় রেভাঃ ন্যাথেনিয়েল ডে ভিস-এর পৌরহিত্যে মেইন রাজ্যের ইস্টপোর্ট নিবাসী মিঃ এলোঞ্জো ফিজ ক্লারেন্স এবং অরিগন রাজ্যের পোর্টল্যাণ্ড নিবাসিনী মিস রোজান্না। এথেন-এর বিবাহ কার্য এই শহরে টেলিফোনযোগে সুসম্পন্ন হইয়াছে। বরের পিতামাতা ও বন্ধুবান্ধবরা উপস্থিত থাকিয়া প্রায় সূর্যোদয় পর্যন্ত প্রচুর ভূরিভোজনে ও নানা আমোদ-প্রোমোদে আপ্যায়িত হন এবং বরের বর্তমান স্বাস্থ্যের জন্য আরও দূর অঞ্চল ভ্রমণ নয় বলিয়া একুয়ারিয়াম-এর উদ্দেশ্যে সকলে যাত্রা করিয়াছেন।

    সেই স্মরণীয় দিনটির অবসানকালে মিঃ ও মিসেস এলোঞ্জো ফিজ ক্লারেন্স নানা সময়ে তাদের বিভিন্ন বিবাহ-যাত্রায় স্মৃতি রোমন্থনের মধুর আলোচনায় ডুবে ছিল, এমন সময় সহসা তরুণী স্ত্রীটি বলে উঠল, ওহো লোনি, বলতে ভুলেই গিয়েছি! যা করব বলেছিলাম তাই করেছি।

    কি করেছ প্রিয়া?

    ঠিক করেছি। তাকে এপ্রিল ফুল করেছি। আর এ কতা তাকে বলেছিলাম। আঃ কি রকম একখানা সারপ্রাইজ দিয়েছি! কালো। পোশাক পরে ঘর্মাক্ত কলেবরে বেচারি দাঁড়িয়েছিল, কতক্ষণে বিয়ে করবে। তার কানে কানে যখন আসল কথাটা বললাম তখন তার মুখের অবস্থাটা তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছিলে। আহা, তার শয়তানীর ফলে অনেক হৃদয়-বেদনা আমি ভোগ করেছি, অনেক চোখের জল ফেলেছি, কিন্তু এবার সুদে-আসলে সব মিটিয়ে নিয়েছি। প্রতিশোধের বাসনা বাসা বেঁধেছিল আমার বুকের মধ্যে। তাই তাকে থাকতে অনুরোধ করেছিলাম; বলেছিলাম, তার সব দোষ আমি ক্ষমা করেছি। কিন্তু সে থাকল না। বলে গেল, প্রতিশোধ নেবার জন্যই সে বেঁচে থাকবে; বলে গেল, আমাদের জীবনকে সে অভিশপ্ত করে তুলবে। কিন্তু তা সে করতে পারবে না। পারবে কি?

    কখনও পারবে না রোজান্না!

    এই কাহিনী যখন লেখা হচ্ছে তখন পর্যন্ত সুসান মাসি, অরিগন-এর ঠাকুরমা, নব দম্পতি ও তাদের ইস্টপোর্ট বাসী বাবা-মা সকলেই সুখে আছে; আর সুখেই থাকবে বলে মনে হয়। সুসান মাসি কনেকে দ্বীপ থেকে এনে তাকে সঙ্গে করে মহাদেশ পেরিয়ে পরস্পরের প্ৰীতিমুগ্ধ স্বামী ও স্ত্রীর প্রথম মিলনের সাক্ষী হয়ে পরম সুখ ভোগ করেছে-কারণ সেই মুহূর্তটির আগে তারা কেউ কাউকে চোখে দেখে নি।

    যার দুষ্ট চালিয়াতির ফলে দুটি যুবক-যুবতীর বুক ভেঙে যাবার উপক্রম হয়েছিল, নষ্ট হতে বসেছিল তাদের জীবন, সে হতভাগ্য বার্লে সম্পর্কে একটি কথা বললেই যথেষ্ট হবে। জনৈক পঙ্গু ও অসহায় মিস্ত্রি তার প্রতি খারাপ ব্যবহার করেছে এই কথা ভেবে তাকে খুন করতে উদ্যত হতেই বার্লে একটা জ্বলন্ত তেলের কড়াইতে পড়ে যায় এবং তুলে আনবার আগেই তার মৃত্যু ঘটে।

    [১৮৭৮]

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঝাঁপতাল – মন্দাক্রান্তা সেন
    Next Article বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন – মুহম্মদ আবদুল হাই
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }