Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাল্যবান – জীবনানন্দ দাশ

    জীবনানন্দ দাশ এক পাতা গল্প189 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৮. ব্যবস্থা আবার আগের মতন

    মাল্যবানের ঘরের জিনিসপত্র ব্যবস্থা আবার আগের মতন দাঁত খিচিয়ে উঠল; নোংরা হলদে কাগজের স্তুপ চার দিকে, জানালার ভেতর দিয়ে ক্রমাগত রাস্তার ধুলো ধোঁয়, অঝোর গোলাপায়রার বাসা, মেঝের চার দিকে চুরুটের টুকরো খাতলানো চরুট তামাকপাতা ছাই দেশলাইয়ের কাঠি, পাখির পালক বিষ্ঠা, পুরোনো বাতিল লণ্ঠনের টুকরো-টাকরা, ভাঙা চিমনির কাচের রাশ; তেল, অ্যাসিড, ওষুধের নোংরা শিশি-বোতলের জাঙ্গাল, হাঁড়িকুড়ি কলসি, বস্তা ও ঝুড়ি একগাদা, আট-দশ জোড়া হেঁড়া থ্যাবড়া প্যানেলা আর ক্যাম্বিসের জুতো, ময়লা জামা মশারীর নুড়ি—আশ্চর্য দৈববলে কোনো শব্দ হচ্ছে না, কোনোকিছুকে নড়তেও দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু সমস্ত ঘরের ভেতর সুটকি বুড়ি ডাইনি বুড়ি গুপী বুড়িদের কান্নাকাটি হামলা বলাৎকার চলছে যেন দিনরাত,–মাল্যবান টের পাচ্ছিল, উপলব্ধি করছিল।

    ফুলদানীটা সে ঘরের এক কোণে ফেলে রেখেছিল। উৎপলা যখন এ-জিনিসটাকে পছন্দ করল না, তখন থেকেই এটার ভেতর কেমন একটা শ্রীছাঁদের বাপান্ত গরমিল বেরিয়ে পড়েছে যেন—এক রাশ হাঁড়িকুড়ির ভেতর ফুলদানীটাও কানা ভেঙে গড়িয়ে পড়ে রইল।

    এই ঘরের ভেতরেই একদিন একটা বেড়ালের ছানা আশ্রয় নিল। রাত্রে ঘুমিয়েছিল, ঘরের ভেতর মড়াকান্না শুনে উঠতে হল, উঠে বসল। বুঝতে পারল, নিশ্চয়ই এই খোলা জানালার ভেতর দিয়ে বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে কেউ। মানুষ যে-জিনিস নিজে সহ্য করতে পারে না, পরের ঘাড়ে তা চাপাতে তার এত লোভ—এমন কৌশল; ভাবছিল মাল্যবান; কিন্তু বাচ্চাটাকে নিয়ে করা যায় কী? যে-রকম ভাবে বেনো হাওয়ার মুখে হাঁ করে কাঁদছিল বাচ্চাটা, তাতে ওপরের ঘরের মানুষেরও ঘুম ভেঙে যেতে পারে।

    রাস্তার দিকের জানালা দিয়েই এটাকে আবার ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারা যায়–তারপর জানালা দিয়ে পারা যায় বন্ধ করে বেড়ালের ছানাটার তারপরে কী হবে, সে-কথা ভেবে মাথা ঘামিয়ে কী দরকার। পৃথিবীতে বেড়াল-কুকুরের বাচ্চারা পথ কেটে নেয়—কিংবা যায় মরে। মৃত যে, তার তো রফা হয়ে গেল; গোলকধাঁধাটা সামনের থেকে সরে গেছে; নির্দেশ চাই না, সহানুভূতি সমাশ্রয়ের দরকার নেই আর; সব-চেয়ে শান্তি বেঁচে থাকার ব্যথা, বৈভব নেই। কিন্তু তবুও সে-রকম শান্তি বেড়াল-ছানাটাকে পাইয়ে দিতে ভরসায় কুলিয়ে উঠল না মাল্যবানের।

    রাত দুপুর : কোথাও কোনো দুধ নেই, খাবার নেই; বাচ্চাটাকে কিছুই দেওয়ার উপায় নেই এখন; বিছানায় বসে-বসে অনেকক্ষণ এর কান্না সহ্য করতে লাগল মাল্যবান। মাল্যবান-পর্বত যেন সহ্যাদ্রি হয়ে গেলে তবুও কান্না থামবে না—এমনই আনস্ত্য এর। একে-একে অনেক কথা ভেবে যাচ্ছিল মাল্যবান; ভাবছিল, এই বাচ্চাটার বাপ-মার কথা, কেমন হাত-পা ঝেড়ে জীবনকে ঝাড়ছে তারা; এই বাচ্চার ঝাড়টাকে জন্ম দেবার আগে কালোকিষ্টি রাতে আর জ্যোৎস্না-রাতে পরীতে পেয়ছিল সে ধাড়ি বেড়াল দুটোকে; কী না করেছিল তারা; কিন্তু আগামী ঋতুর ছানাগুলোকে জন্ম দেওয়ার আগে আবার তারা দুর্নিবার ভাবে জোড় মেলাবে এসে, কিন্তু এখন তারা গত ঋতুর সমস্ত বিগত ঋতুর কৃতকর্মের দায়িত্বের থেকে খালাস। জীবনকে তারা এ-রকম করে ফাকি দেয়, তবুও প্রশ্রয় পায় জীবনের কাছ থেকে নব-নব ঋতুসমাগম হলেই-বার-বার-বার-বার! মানুষকে তো এ-রকম আচার-ব্যবহারের জন্যে ঢের গভীর শাস্তি দিত জীবন। থাক, তবুও এর বাপ-মাকে কোনো শাস্তি দিতে চায় না সে।

    মাল্যবানের ভাবনার মোড় ঘুরে গেল, পরীতে-পাওয়া মিথুনের কথা ভুলে গেল সে; মনে-মনে বললে, কথায়ই বলে কুকুর-বেড়ালের জীবন-বাস্তবিক, সে-সব জীবের এমিই ঢের কষ্ট। হয়তো দুচার মাস বয়েস এই ছানাটির, মা নেই, ভাই-বোন কিছু নেই জবালার ছেলের পিতৃপরিচয় নেই বলে কোনো উদ্বেগও নেই বটে, মাল্যবান, একটা চুরুট জ্বালিয়ে নিয়ে ভাবছিল—

    কিন্তু, মড়াকান্নায় তোলপাড় হয়ে উঠছিল; চুরুটে কয়েকটা টান দিয়ে ভাবছিল : এমন শীতের দুর্বার রাতে কোথাকার একটা মিকড়ে হারামজাদা জানালার ভেতর দিয়ে অন্ধকার খুপরির ভেতর এটাকে সটকাল!

    সে এক সময় ছিল বটে, মাল্যবান উপলব্ধি করল, যখন মানুষের শিশুর এ-রকম ব্যাপার হলে এতক্ষণে কত দিক দিয়ে হৈ-চৈ পড়ে যেত, কিন্তু মানুষের পৃথিবী তো আজ-কাল পাগলাগারদ—সেখানে মানুষের শিশু আর বেড়ালের ছানার একই অবস্থা।

    মশা নেই ঘরে; ইঁদুরে কামড়াতে পারে সেই ভয়ে মশারী টানিয়ে শুয়েছিল মাল্যবান; মশারীটা তুলে বালিশে ঠেস দিয়ে চুরুট মুখে বসে রইল সে।

    একটু পরে উঠে গিয়ে বাতি জ্বালাল।

    মানুষের নড়াচড়ার শব্দে, আলো দেখে, ভয় পেয়ে বাচ্চাটা একটু থামল। কিন্তু মাল্যবান বিছানায় এসে বসতেই আবার সেই কান্না। সমস্ত ট্রাম-বাস-লরির নটখটি ঘড়ঘড়ির চেয়ে এ-কান্না ঢের আলাদা জিনিস; এ-জিনিস সহ্য করতে হলে সৃষ্টিটাকেই বুঝে দেখতে হবে, উপনিষদের ও আইনস্টাইন হোয়াইটহেডের ঈশ্বরের হিসেবের মিল-গরমিলটাকে; অনেক সহানুভূতি সহিষ্ণুতার দরকার।

    মাল্যবান কেমন অসময়ে তা হারিয়ে ফেলল।

    বিছানার থেকে লাফিয়ে উঠে তেরিয়া হয়ে সে বাচ্চাটাকে তাড়া করল। এত জঞ্জাল এই ঘরের ভেতর—এমন সব অসম্ভব জায়গায় লুকোয়—এমন ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে—বিছানায় ফিরে আসতে না-আসতেই আবার ভরসা পেয়ে এমন প্যানপ্যানানি শুরু করে যে, মাল্যবানের ঘেন্না ধরে গেল একেবারে।

    এবার সে বাচ্চাটাকে ধরলই।

    ধরে এমন জোরে তাকে দেয়ালে আছড়ে মারল যে, দুই মুহূর্তের ভেতরেই সেটা কাৎরাতে-কাৎরাতে মরে গেল।

    এর পর পাঁচ-ছ দিন মাল্যবান কারুর সঙ্গে কথাও বলতে পারল না আর। স্ত্রীর কাছে, অফিসে চোর;—সংসারের সমাজের পৃথিবীর ডাঙার ওপর দিয়ে নৌকো চালিয়ে নেয় যে মনপবনের আশ্চর্য দেবতা, তার কাছে তামাকের হুঁকোর জলের ভেতর জোঁকের মতো যেন নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইল মাল্যবানের মন।

    উৎপলা যে তাকে এত উপেক্ষা করে, এটা তার ভালো লাগে, বাঘের মাসি বেড়ালকে মেরে ফেলেছে মাল্যবান, ঘরের ভেতর নারী-সোনালিব্যাঘ্রের হিংস্রতায় হৃদয়হীনতায় কেমন একটা নিপট নিগুঢ় তৃপ্তি পায় সে। নিচের ঘরের সমস্ত বিশৃঙ্খলা ও দুর্গতির ভেতর স্ত্রী-পরিত্যক্ত নচ্ছার মানুষ বলে নিজেকে সে বার-বার প্রতিপাদন করে দেখতে চায়, এ তার ভালো লাগে; নিজেকে অবিচারিতঅভালোবাসিত—বিড়ম্বিত মানুষ বলে খতিয়ে নিতে-নিতে মনটা লঘু হয়ে ওঠে তার; জীবনের থেকে কুবাতাস দুর্ভাগ্য অবিচার অভালোবাসা যদি শুকিয়ে যায়, তাহলে পথ থাকে না আর।

    তুমি ক-দিন থেকে মাছ খাচ্ছ না যে?

    কেমন আঁশটে গন্ধ। মাল্যবান বললে।

    কেন, পেঁয়াজ-মশলা দিয়ে বেশ তো রাঁধে ঠাকুর।

    ভালো করে ভাজে না-বলে দিল একটা কথা মাল্যবান।

    তুমি কি পুড়িয়ে খেতে চাও?

    না, না——মাল্যবান আঙ্গুল ছড়িয়ে, হাত মুঠো করে, আঙ্গুল ছড়িয়ে, হাত মুঠে করে বললে, বরফ-দেওয়া মাছ কি-না, কেমন কাঠের মতন। খেতে ইচ্ছে করে না।

    বরফ-দেওয়া মাছ এ মোটেই নয়। বেশ তো জিনিস! টাটকা। পুকুরের। নিজে কিনে আন, অথচ নিজে বুঝতে পার না?

    মাল্যবান কোনো কথা বললে না।

    কই-মাছ খেতে পার। বেশ তো লাগে খেতে।

    কিন্তু মাল্যবান বিনে মাছেই চালাতে লাগল। কোনো দিন দই খায়; কোনো দিন খায় না; ফেলাছড়া করে খায়। বৌয়ের ন্যাওটা নয় আর। খুব কম কথা বলে। কোনো নালিশ নেই, আপত্তি নেই, মাথার চুলে তেল নেই, দেরি নেই। অন্য অনেকে হলে মাল্যবানকে চেপেই ধরত, খুলে বলো তো, হচ্ছে কী সব, টেসে গেলে কোথায়, সাপটে না খাবে তো জাপটে ধরব বলে তোলপাড় করে তুলত তাকে; কিন্তু উৎপলার চোখে কিছু পড়ল না যেন; ভালোই হল; মাল্যবানের রক্তের মনের শান্ত সাত্ত্বিকতা নষ্ট করবার জন্যে কেউ হাত কচলাল না; সে যা চাচ্ছিল, সেই পটনিশ্চয়তা বিনিঃশেষে দেওয়া হল তাকে; বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে চায়? সাপুড়ের চুবড়িতে থাকতে চায়? থাকুক। কেউ বাধা দিতে গেল না। কোনো গোলমাল নেই।

    কিন্তু একটা বেড়ালছানা খুন-মাল্যবানের মতন মানুষের জীবনেও এ-ব্যাপারটার অখাদ্য অপরাধের তীক্ষ্ণতা দিনরাতের ঘষা খেতে খেতে নষ্ট হয়ে ক্ষয় পেয়ে গেল। সে তার আগের জীবন ফিরে পেল। বেড়ালছানাটার কথা মাঝে-মাঝে মনে হয় বটে, কিন্তু তার নিজের জীবনের আবেদন ঢের বিেশ। মাছ মাংস ডিম অফিস খবরের কাগজ টাকাকড়ির চিন্তা বৌয়ের এটা-ওটা-সেটা উনপঞ্চাশটা বাতাস গোলদীঘি চুরুট—নানা রকম স্রোতের ভেতর হারিয়ে গেল সে। সাধারণ সাংসারিক মানুষ হয়ে উঠল আবার। এক-একদিন খুব বেশি রাত বিছানায় জেগে থেকে-থেকে মাল্যবানের মনে হয়, কাদাপাঁকের ভেতরে একটু শূয়োরের মতো সমস্ত দিন জীবনটা যেন তার ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বেড়ায়; বেড়ালের ছানার মৃত্যু তাকে বেশ একটা চমৎকার মুক্তি দিয়েছিল : স্ত্রীর মমতা বিমুখতার ঢের ওপরে চলে গিয়েছিল সে, অফিসের কাজে যে-কোনো মুহূর্তে ইস্তফা দিয়ে চলে যাবার মতো একটা সহজ স্বাধীনতা এসেছিল মনের ভেতর, রক্তমাংসের শরীরে পাখির মতো লঘুতা এসেছিল যেন তার, যেন সে অনেক ওপরে উড়ে চলে যেতে পারে, জীবনের উপেক্ষা আকাঙ্ক্ষা লোভ কিছুই যেন নাগাল পায় না তাকে আর; চোত-বোশেখে পাড়াগাঁর দুপুরে বিকেলের অনির্বচনীয়তার ভেতর প্যাট প্যাট করে ফাড়া ওড়া শিমুলের তুলোর মতন আশ্চর্য ধীমুক্তির স্বাদ পেয়েছিল সে নীলিমায়-নীলিমায় সুর্যে রৌদ্রে আকাশ-পথের পাখির পালকে–মউমাছির পাখনায়—তারপরে কোন্ নীলিম নিঃঝুম পরলোকের দেশে। কিন্তু দিনের বেলা এ-সব কথা মনে থাকে না বড় একটা তার মনে পড়লেও দাগ বসাতে পারে না তেমন।

    এই-ই হওয়া উচিত। মাল্যবানের মতন মানুষের পক্ষে সমস্তটা দিন অফিস বা সংসারের অন্য যে-কোনো মানুষের মতন জীবন কাটানোই স্বাভাবিক। রাতের বেলাটাও তার তাদের মতোই কেটে যেত, যদি উৎপলার মতো এক জন সত্তমা স্ত্রী এসে বাদ সাধত। উৎপলার সম্পর্কে এসে জীবন ধাক্কা আঘাত উপলব্ধির ভেতর দিয়ে চলেছে। এ না হলে সে তার অফিসের মাইতি-দে-গড়গড়ি-গুইবাবুদের মতো এড়িগেড়ি বাচ্চায় ঘর ভরে ফেলে সিঁদুর-ধ্যাবড়ানো ফোকলাদেতো শাকচুন্নীদের নিয়ে ঘর করত। কিন্তু উৎপলাকে নিয়ে তার জীবন সে-রকম নয় তো। উৎপলা ওদের মতন নয়—আর-এক রকম।

    রোববার সকালবেলা মাল্যবান ঝিকে বললে, মাকে একটু ডেকে আনো তো। তিন-চার বার ঝিকে ওপরে পাঠাতে হল।

    উৎপলা নিচে নেমে এল; বললে, তোমার লজ্জা করে না?

    কেন?

    ঝিকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠাচ্ছিলে?

    তোমার কাছে লোকজন ছিল, আমি তো নিজে গিয়ে ডাকতে পারি না।

    লোকজন চলে যাওয়া পর্যন্ত তর সইল না? আমি ওপরের ঘরে কী করি-না করি, নিচের ঘরে বসে তুমি সে-সব গণেশ ওল্টাবে! আচ্ছা পেটোয়া গণেশ তো বাবা–

    যাক, ওরা তো চলে গেছে—

    তুমিই তো তাড়ালে—

    যে জন্যে তোমাকে ডেকেছিলাম—আমার এই ঘরটার কথা তোমাকে কদিন থেকেই বলব-বলব ভাবছি। ঘরটা কেমন থুবড়ি খেয়ে পড়ে আছে দেখছ তো।

    ঘরের দিকে না তাকিয়েই উৎপলা বললে, তার আমি কী করব।

    তোমাকে একটু গুছিয়ে দিতে বলছি—

    মাল্যবানের আতলস্পষ্ট বেকুবির দিকে তাকিয়ে উৎপলা কোনো কথা বললে না আর।

    ওপরে যারা ছিল, তারা চলে গেছে?

    এ-কথার জবাব না দিয়ে উৎপলা ওপরে চলে যাবার উপক্রম করছিল; পা বাড়াতেই কী যেন একটা জিনিস টপ করে টস করে উৎপলার পায়ের ওপর পড়ে ভেঙে ঝোল ছড়িয়ে দিল শ্লিপার বাঁচিয়ে উৎপলার পায়ের মাংসে চামড়ায়। দুহাত পেছিয়ে গিয়ে আলসের দিকে তাকাতেই পাখিটাকে চোখে পড়ল; মাল্যবানের জুড়ির মতোই বোকা বোকা বেকুব পাখিটার দিকে কেমন যেন থাকতে চায় চোখ; কেমন অদ্ভুত জায়গায় ডিম পেড়েছে, ডিমটাকে ফেলে দিয়েছে হয়তো নিজের অজান্তেই বেশি নড়াচড়া ঘোরাফেরা ডানা ঝাপটাতে গিয়ে পা নাড়া দিয়ে; কী যে হয়ে গেছে, ডিম যে পড়ে গেছে, ভেঙে গেছে, সেদিকে খেয়াল নেই পাখিটার, হারানো নষ্ট ডিম সম্বন্ধে কোনো চেতনা নেই। কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে আলসের ওপর, গলা ফুলিয়ে বক-ব্রুকম-ব্রুকম-ব্রকম-ব্রুক ইর-র-রিরম-র-রুক করছে পাখিটা। উৎপলা জোরে-জোরে হাততালি দিতেই আরো একটা পাখি বেরিয়ে এল বীমের আড়াল থেকে; উড়ে চলে গেল পাখি দুটো।

    মেঝের ওপর পাখির বিষ্ঠা পালক ভাঙা ডিমের লালা নিজের আঁশটে এঁটো পায়ের দিকে তাকিয়ে উৎপলা বললে, খুব আগুনদার সোনার দরে গুদোম ভাড়া দিচ্ছে বুঝি জংলি পায়রার ঝাড়–

    তা দিচ্ছে, উৎপলার কথা ফুরোবার আগে মাল্যবান বললে; বেশ সমাহিত শান্তভাবে বললে, পাখিরা আর কদূর কী করবে; মানুষরা পাখিদের চেয়ে শয়তান; নাহলে পৃথিবীটা এরকম পৃথিবী হয়! নাঃ, ও-পাখিগুলোকে আমি কিছু বলি না।

    আমি জাল পেতে রাখব। এক-একটা করে ধরে ঠাকুরকে দেব। এ-সব কেঁদো পায়রার মাংস খেতে বেশ

    একটা বেড়ালের ছানা মেরে ফেলেছিলাম এক দিন, মাল্যবান বললে, উৎপলার কথা সে শুনেছে-কি-না-শুনেছে, বোঝা গেল না; সেই থেকেই এ-সব বিষয়ে খুব সাবধশনে চলতে আরম্ভ করেছি। এসব প্রাণীদের কিছু বলি না আমি।

    বেড়ালের ছানা কে মেরেছিল?

    আমি। মাল্যবানের চোখ খানিকটা বুজে এল।

    কবে?

    এই দিন পঁচিশেক আগে।

    কোথায়?

    এই ঘরেই।

    কৈ আমি দেখিনি তো।

    সে রাত-দুপুরে হয়েছিল; কে এক জন ক্যাঁক করে ছেড়ে দিয়ে গেল। বাচ্চার কান্নায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর—বলে সে থামল।

    সেটাকে চাড় দিয়ে থেঁৎলে দিলে তুমি?

    মাল্যবান উৎপলার মুখের দিকে তাকাল একবার; পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে নিয়ে চোখ বুজে ভেতরের দিকে তাকাল মাল্যবান; ভিজে পর্দার ওপর কামলণ্ঠনের ছবির মতো এসে পড়ল সব : সেই রাত্রি, সেই বেড়ালের ছানা, ছানাটাকে (ছবি চলতে আরম্ভ করল) কেমন বিশ্রী ও নিকষ অপকৌশলে ধরে ফেলেছিল সে—কেমন অন্ধ হয়ে দেয়ালে আছড়ে মেরেছিল, কেমন কাত্রাতে-কাত্রাতে মরে গেল বাচ্চাটা—সেই সবের দিকে আপ্রাণ করুণায় দাঁত-মুখ খিচিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাল্যবান বললে, মানুষ হওয়া হবে কবে, তাই ভাবছি; কোনো দিক দিয়েই হতে পারিনি তো আজো। চেষ্টা করছি; করছি? মুক্ষিদের কিছু বলি না আমি; ময়লার লপসি করছে ঘরদোর; খুব ভোগান্তি বটে, কিন্তু তাতে আর কী, আমি নিজের মনে থাকি; ওদের চাল-চিঁড়ে দিই, যব খেতে ভালোবাসে, মেঝের ওপর ছড়িয়ে রাখি, খায় আর হাগে, হাগে আর খায়; মানুষের ভেতর দু-চার জনকে ছেড়ে দিলে প্রায়-মানুষই এদের চেয়ে ঢের খারাপ কাজ করে। বলতে-বলতে মাল্যবান লজিকের সিড়ি ভেঙে-ভেঙে অবশেষে উৎপলার পায়ের দিকে না তাকিয়ে পারল না, পাখির ডিমের লালায় ঝোলে নষ্ট হয়ে গেছে পাটা—

    কিন্তু এই পাখিগুলো, উৎপলার আগাপস্তলায় চোখ দুটোকে বেশ খানিকক্ষণ পাক খাইয়ে নিয়ে মাল্যবান বললে, একেবারে বেহেড হয়ে ডিম পাড়ে। যেন পাবাদামের গাছ থেকে বাদাম টপাটপ করে ঝরে। দিন-দিন মাল লোকসান করে,

    মাল্যবান কিছুক্ষণ চুপ মেরে থেকে হাতের চুরুটটা জ্বালিয়ে নিয়ে আকাশ-পাতালের অনেক বিশৃঙ্খল ঢেউ গুনে দেখল, তাদের সাজিয়ে নিয়ে কোনো নির্দেশের মতো মুক্তোপ্রবাল দেখল যেন জ্বলে উঠে জলের শিখর-চুড়ো হয়ে যেতে, এবং বেশ খানিকক্ষণ পরে সেই অনলটিকেই ব্যাখ্যা করে বললে, কিন্তু, তাই বলে গুলতি ছুঁড়ে ওদের মারা উচিত কি? উচিত নয়।

    তারপরে স্পষ্ট হয়ে বললে, তোমার নীলাম্বরীটা ঠিক আছে তোত ভিজিয়ে দেয়নি তো?

    আহা, কী মানিয়েছে তোমাকে এই ময়ূরকণ্ঠী নীলে—মাল্যবান ভাবছিল, যেন উত্তরাকে নেত্য শেখাচ্ছেন বৃহন্নলা। নাচের ঘোরে মিলে-মিশে গেছে উত্তরা-বৃহন্নলাকে উৎপলা কে বৃহন্নলা–অনির্বচনীয় দেখাচ্ছে উৎপলাকে;–অথচ দাঁড়িয়ে আছে, সত্যিই তো আর নাচছে না, নড়ছেও না; অথচ দেখাচ্ছে উৎপলাকে যেন ক্ষুরধারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—পুরুষের যে-তিলোত্তম পেলে মেয়েমানুষকে মহানারীর মতো দেখায়, সেই রকম।

    আমাকে কয়েকটা বালিশের ওয়াড় তৈরি করে দেবে? বলো তো কয়েকগজ মার্কিন নিয়ে আসি।

    উৎপলা যাবার জন্যে তৈরি হল, থাক, দর্জির বাড়িই দেওয়া যাবে।

    স্ত্রীর সঙ্গে সেও ওপরে চলল।

    গিয়ে চললে, আমাকে একটা পান দিতে পার? ভেবেছিলাম, ছেড়ে দেব। কিন্তু লোভ সামলাতে পারি না।

    কিন্তু, উৎপলা নড়ছিল-চড়ছিল না; ছাদের ওপর রোদে বাতাসে একটা ডেক চেয়ারে বসে ঘাড় কাৎ করে বেণী খসাতে লাগল! খুব আমেজ এসেছে উৎপলার শরীরের রসে উপলব্ধি করে নিজেরও গ্রন্থিতে-মাংসে একটা মন্থর, সুখ্যাত মদির সুখানুভব ছড়িয়ে পড়ছিল মাল্যবানের। কিন্তু, ওপরে থেকে লাভ নেই কোনো, মাল্যবানের মনে হল; এখন নিচে চলে যাওয়া উচিত।

     

    নিচে গিয়ে মাল্যবান ঠিক করল, ঘরদোর সে নিজেই গোছাবে। তারপর মনে হল, ঝিকে দিয়ে গুছিয়ে নেবে। ঝি রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল। মাল্যবান একটা বিড়ি জ্বালিয়ে ভাবল, গুছিয়ে কী লাভ!

    কিন্তু পরক্ষণে সে নিজেই গোছাতে লাগল। বিশৃঙ্খলা ও নোংরামির ভেতর মনটা কেমন রিচখিচ করে ওঠে; কিন্তু সেদিনকার মতন পর্বত ঝেড়ে নিখুঁত ভাবে গোছাতে গেল না; ঘরটা ঝাঁট দিয়ে, জিনিসপত্র ঠিকঠাক রেখে দিয়ে, বিছানার চাদর বদলে, নোংরা কাপড়গুলো কাছেই একটা লন্ড্রিতে ফেলে দিয়ে এসে কাজ সাঙ্গ হল তার।

    রাতের বেলা বড্ড শীত; মোজাগুলো সব ছেড়া, একটা পুলওভার কিছুতেই কেনা হয় না, গায়ের আলোয়ান তেলে জলে রোদে বাতাসে ছাই হয়ে ছিড়ে-ছিড়ে পড়ছে, কয়েকটা তালিও মেরেছে সে, বড় বিশ্রী লাগে, একটা নতুন আলোয়ান কিনতে ইচ্ছে করে, ডোরাকাটা কালো মশারীটার ছ্যাঁদার অন্ত নেই, নোংরা পচা ছারপোকা গুঁইগুই করছে, একটা মস্ত বড় ছিবড়ের জঙ্গল হয়েছে মশারীটা।

    রাতের খাওয়া-দাওয়ায় পর নিচের ঘরে একটা ঠাণ্ডা টিনের চেয়ারের বসে মাল্যবানের মনে হচ্ছিল, দূর, এ-রকম জোড়াতালি দিয়ে জীবন কাটিয়ে কী লাভ, কার লাভ!

    বিছানায় এসে বসে মনে হল, জীবনটা এই রকমই হ্যাচকা ব্যাপার। বিছানায় শুয়ে পড়ে কেই বা এখন শুতে যেত ভাবছিল মাল্যবান; বসে-বসে কথাবার্তা গল্প–তারপর শীতের রাতে—তারপর সারাটা শীতের রাত–এমন স্ত্রী কি আমি পেতে পারতাম না। হড়পা বানের ঠাণ্ডা স্রোতে যেন মুর্গি আমি হাঁসের মতো সাঁতার কাটতে চাচ্ছি, বাজপাখির মতো উড়ে যেতে চাচ্ছি। আমার জীবনের বানচালের ব্যাপারটা এই রকম। কিন্তু বড় বেশি আত্মপ্রেম হয়ে পড়েছে তো আমার : যেন একটি ব্যক্তি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই, যেন ব্যক্তিসমুদ্র নিয়ে যে মানুষের ও সময়ের ইতিহাস তৈরি হচ্ছে সেটা কিছু নয়। লেপ মুড়ি দিয়ে শীতের খুব গভীর রাতে আজকের আবহমানের ও ব্যক্তিসমুদ্রের রোল—যা নির্ব্যক্তিত্বে বিশোধিত হয়ে ফেণার কণার মতো তাকে টেনে নিয়ে চলেছে অন্ধকারের থেকে খুব সম্ভব আরো ব্যাপক অন্ধকারের ভেতর—সেই সুর শুনতে পেল সে; অতএব আলোকিত হয়ে উঠল যেন তার মন; আস্তে-আস্তে সময়ের আশ্চর্য সমগ্রতার কাছে আত্মসমর্পণ করে স্থির হয়ে উঠতে থাকল তার মন।…

    এত বেশি স্থির হল যে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅগ্রন্থিত কবিতা – জীবনানন্দ দাশ
    Next Article শ্রেষ্ঠ কবিতা – জীবনানন্দ দাশ

    Related Articles

    জীবনানন্দ দাশ

    ঝরা পালক – জীবনানন্দ দাশ

    August 14, 2025
    জীবনানন্দ দাশ

    ধূসর পাণ্ডুলিপি – জীবনানন্দ দাশ

    August 14, 2025
    জীবনানন্দ দাশ

    বনলতা সেন – জীবনানন্দ দাশ

    August 14, 2025
    জীবনানন্দ দাশ

    মহাপৃথিবী – জীবনানন্দ দাশ

    August 14, 2025
    জীবনানন্দ দাশ

    সাতটি তারার তিমির – জীবনানন্দ দাশ

    August 14, 2025
    জীবনানন্দ দাশ

    শ্রেষ্ঠ কবিতা – জীবনানন্দ দাশ

    August 13, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }