Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    শ্রীশ্রীচণ্ডী – অনুবাদ : পঞ্চানন তর্করত্ন

    September 9, 2025

    পুলিশ কাহিনী ১ – পঞ্চানন ঘোষাল (প্রথম খণ্ড)

    September 9, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ১৪৩ – অপহরণ-১

    কাজী আনোয়ার হোসেন এক পাতা গল্প181 Mins Read0

    অপহরণ-১.২

    দুই

    গ্রান্দ বেতান, এথেন্সের সেরা হোটেল। সাধারণত সম্রাট আর ধনকুবেররাই পায়ের ধুলো দেন এখানে। যুদ্ধের শেষ দিকে এই হোটেলেরই করিডরে আততায়ীর হাত থেকে কোন রকমে বেঁচে যান উইনস্টন চার্চিল।

    গ্রান্দ বেতানের একটা বার, রঁদেভো। ঝলমলে পর্দা, পালিশ করা কাঠ, আর চামড়া দিয়ে তৈরি চেয়ার, মাথার ওপর ঝুলছে ঝাড়বাতি। এক কোণে লম্বা মেহগনি কাঠের বার, ধনুক আকৃতির। এই বারের সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী, কূটনীতিক, আর গুপ্তচরদের সাথে নিচু গলায় কথা বলে বারটেণ্ডার-ট্যুর বুকে লেখা কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যে নয়। এপ্রিলের সন্ধ্যা ছ’টায় ধীরে ধীরে ভরে উঠছে ঘরটা। পুরুষদের প্রায় সবার পরনেই বিজনেস স্যুট, বেশিরভাগই ট্যুরিস্ট, জানে গ্রীসে বেড়াবার জন্যে গরমকালটাই একমাত্র সময়। লাবণ্যময়ী ললনারাও আছে, পরনে উজ্জ্বল পোশাক, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা টেবিলে থোকা থোকা ফুলের মত সাজানো। যন্ত্র-সংগীত বাজছে না, শুধু কথা বলার মৃদু গুঞ্জনের মাঝখানে থেকে থেকে শোনা যায় নারীকণ্ঠের মধুর হাসি, আর গ্লাসের ভেতর টুকরো বরফের টুংটাং নড়াচড়া। সুকুমার বারটেণ্ডার সাদা পোশাক পরে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাতে রূপালি ট্রে নিয়ে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে যাচ্ছে সে।

    লবি থেকে রঁদেভোয় ঢুকল মাসুদ রানা। ঝাড়বাতি থেকে গোলাপী আভা বেরুচ্ছে, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে চারপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল ও। যারা দূরে তাদের অনেককেই পরিষ্কার দেখা গেল না, তবে পরিবেশটা দেহ-মনে প্রশান্তির একটা সুবাতাস বইয়ে দিল। এ যেন অনেকটা যার বাড়ি নেই তার বাড়িতে ফিরে আসা। ওয়েটারের সাহায্যে কোণের একটা টেবিল নিল ও, এখান থেকে ঘরটার সবখানে দৃষ্টি চলে। চারদিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ওয়েটারের দিকে ফিরে অর্ডার দিল, ‘নির্জলা হুইস্কি।’

    কোন সন্দেহ নেই ভদ্রলোক আপাদমস্তক আমেরিকান, মনে মনে ভাবল ওয়েটার। বয়স আটাশ কি ঊনত্রিশ, ছ’ফিটের কাছাকাছি লম্বা, খেলোয়াড়সুলভ একহারা গড়ন, রোদে পোড়া তামাটে রঙ, লম্বা ফ্যাশনের চুল। নিশ্চয়ই কোন প্লেবয় হবে!

    মাসুদ রানা ছদ্মবেশ নিয়ে আছে। আজ আমেরিকান সেজেছে, কাজেই পাসপোর্ট পরিচয়-পত্র ইত্যাদির সাথে আচরণ, হাবভাব সবকিছুই একজন আমেরিকানের মত হয়ে উঠেছে। কাল আবার সাজতে পারে ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, বা রাশিয়ান, তারই সাথে ভাষাসহ আবার বদলে যাবে সবকিছু। নতুন একটা নামের সাথে ও সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ হয়ে ওঠে—কখনও এক ঘণ্টা, এক দিন, বা এক মাসের জন্যে। নামটা বদলে যাবার সাথে সাথে মানুষটাও বদলে যায়, বেরিয়ে আসে আরেক পরিচয়ে আরেক মানুষ। দুই ছদ্মবেশের মাঝখানে মানুষটা আবার মাসুদ রানা হয়ে ওঠে—নিখাদ বাংলাদেশী বাঙালী। রূপ আর পরিচয় বদলের এই অসাধারণ কৌশল আয়ত্তে আছে বলেই কারও মনে সন্দেহের উদ্রেক না করে যে-কোন আন্তর্জাতিক সীমান্ত অনায়াসে পেরোতে পারে রানা।

    ট্রে হাতে ফিরে এল ওয়েটার। মুখ তুলে তাকাল রানা। লোকজনের মাথার ওপর দিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালে চোখ রাখল ও। শুধু কণ্ঠস্বর শুনতে চায় ও। নানা ধরনের তথ্য সহ চারদিক থেকে ভেসে আসছে। এক এক করে কণ্ঠস্বরগুলো বাতিল করে দিল ও। নির্দিষ্ট একটা গলার জন্যে সজাগ হয়ে থাকল কান।

    বেশিরভাগই ইংরেজিতে কথা বলছে ওরা। কেউ কেউ ফ্রেঞ্চও বলছে। দু’একজন বলছে জার্মান। কেউ গ্রীক বলছে না।

    জার্মান বলছে দু’একজন।

    প্রথম কণ্ঠস্বরটা পুরুষের, ভরাট। কথা শেষ হবার আগেই নারী কণ্ঠের সুরেলা হাসি, তারপর একই ভাষায় উত্তর। মেয়েটার বাচনভঙ্গি আমেরিকানদের মত, বই পড়ে জার্মান শিখেছে। সন্দেহ নেই নিজেকে জার্মান বলে পরিচয় দিতে গেলে বিপদে পড়বে মেয়েটা।

    রানা তাকাল, কিন্তু সরাসরি নয়। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে চোখ বুলাল ও। তারপর নির্দিষ্ট টেবিলে স্থির হলো দৃষ্টি। কদর্য আর সৌন্দর্যের এই মিলন সহজে চোখে পড়ে না। জার্মান লোকটাকে পৌরাণিক কাহিনীর দানব বললে অন্যায় হবে না। ভাঙাচোরা, এবড়োখেবড়ো, কাটাকুটির সহস্র দাগে ভরা প্রকাণ্ড মুখ, শুধু ঠোঁটের কোণ বেয়ে লালা ঝরছে না বলে গা ঘিন ঘিন করল না। এই চেহারায় মোহ-মুগ্ধ হাসি যেমন বেমানান তেমনি অশ্লীল। লাইটার জ্বেলে সামনের দিকে ঝুঁকল দানব, মেয়েটার ঠোঁটে ধরা সিগারেট ধরিয়ে দিল।

    মেয়েটাকে একপাশ থেকে সম্পূর্ণ দেখতে পেল রানা। শুধু সুরূপা নয়, দেহ-কাঠামোও ঠিক যেন বাংলা সংখ্যা ৪-সম্ভবত ৩৬-২৪-৩৬। মধুর কটাক্ষ হেনে হাসল সে, শিখার মাঝখানে দু’জোড়া চোখের দৃষ্টি এক হলো। দৃষ্টি নয়, যেন অগ্নিবাণ-মনে হলো দানবের শার্টের বোতাম গলে যাবে। আপনমনে হাসল রানা। এ-ধরনের মেয়েকে চেনা আছে ওর। শরীরে যৌবন আসার আগেই পুরুষদের দৃষ্টি কাড়তে শিখে ফেলে, কৈশোরেই অঘটন ঘটন পটিয়সী হয়ে ওঠে, সাহস বাড়ার সাথে সাথে যৌবনে হয়ে ওঠে রাক্ষসী। সমস্ত ঝক্কি পোহাতে হয় বাবাকে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় এ বাবা জন্মদাতা বাবা নয়।

    বারে সে-ই একমাত্র সম্পূর্ণ কালো ড্রেস পরে আছে। অত্যন্ত দামী একটা ম্যাক্সি। কালোকেশীর চোখ জোড়া হাস্যোজ্জ্বল। কয়েকটা জিনিস কন্ধনা করে নিল রানা—নেইলপলিশ আর অন্তর্বাসের রঙ গায়ের সাথে মেলানো, হলুদাভ মাখন।

    শরীরের সাথে মানানসই হেঁড়ে গলায় কথা বলছে লোকটা, সম্ভবত মদ্যপান করায় খেয়াল নেই প্রায় সবাই তার কথা শুনতে পাচ্ছে। কথা মানে, তুমি সুন্দর, তুমি বুদ্ধিমতী, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে জীবন ধন্য হলো, এইসব।

    নীলনয়না তাকে বলল, আমেরিকান মেয়েরা নারী-স্বাধীনতা ভোগ করছে।

    নারী-স্বাধীনতা? মেয়েটা ব্যাখ্যা করল, আমরা এখন আর রান্নাঘরে বন্দী নই।

    মাথা ঝাঁকাল লোকটা, তারমানেই অন্য ঘরে সময় কাটাবার সুযোগ বেড়ে গেছে!

    মেয়েটার মুখে দুষ্টু হাসি, বলল, সুযোগটা আমরা পুরোমাত্রায় নিচ্ছিও।

    সত্যি, ভাবল রানা, এই মেয়ে রান্নাঘরে ব্যস্ত, কন্ধনাও করা যায় না। মেয়েটার কথা শুনতে শুনতে আগের ধারণা পাল্টাল ও। আমেরিকান বাচন ভঙ্গি সুন্দর, কিন্তু যথেষ্ট নিখুঁত নয়। আসলে হয়তো জার্মান মেয়ে, ভান করছে আমেরিকান বলে। এমন ভাবে কথা বলছে যেন কোন স্কুলে শিখেছে মাতৃভাষা। মনে মনে আবার একবার হাসল রানা। ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ অন্য কাউকে বোকা বানাতে পারো, ভাবল ও, আমাকে নয়।

    চুনি বসানো কানের দুল পরে আছে। হঠাৎ নিষ্পলক হয়ে উঠল রানার দৃষ্টি। পেলব বাহু তুলে কান থেকে একটা দুল খুলে নিল মেয়েটা। দুলটা কয়েক সেকেণ্ড তালুতে নিয়ে দেখল। তারপর আবার পরল কানে।

    সঙ্কেতে কোন ভুল নেই। হ্যাঁ, ওর সাথেই দেখা করতে এসেছে রানা। কিন্তু দানবটাকে তাড়াবে কিভাবে?

    অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরাল রানা। মন চলে গেল ব্রাসেলসে।

    রুটিন ট্যুরে বেরিয়ে বেলজিয়ামে যাত্রাবিরতি, রানা এজেন্সির ব্রাসেলস শাখা ভিজিট করার পর প্ল্যান ছিল ফ্রান্সে চলে যাবে, কিন্তু তা আর হলো না। প্লেনের টিকেট কাটাও হয়ে গিয়েছিল, এই সময় বি.সি.আই. হেডকোয়ার্টার ঢাকা থেকে স্বয়ং মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের একটা মেসেজ পেল রানা।

    মেসেজটা এই রকম:

    ‘সি.আই.এ. খুব নাজুক অবস্থায় পড়েছে। ডেপুটি ডিরেক্টর কর্নেল উইলিয়াম অবসন রানা এজেন্সির সাহায্য চান। আমাকে আভাস দেয়া হয়েছে, সমস্যাটা নিয়ে ওদের প্রেসিডেন্টও খুব উদ্বিগ্ন। ব্রাসেলসেই অপেক্ষা করো, ওরা তোমার সাথে যোগাযোগ করবে। ওরা তোমার সাহায্য চায়, এটা গোপন থাকা দরকার। সম্ভব হলে সাহায্য করো। আমার ধারণা, রহস্যের ভেতর রহস্য থাকতে পারে-সাবধান। রা. খা.।’

    দু’দিন পরই অশীতিপর এক বৃদ্ধ যোগাযোগ করল রানার সাথে। রাস্তায় দেখা হলো, রাস্তা থেকেই বিদায় নিল লোকটা। পাশাপাশি বিশ মিনিট হাঁটল ওরা, বাক্য এবং কিছু কাগজ-পত্ৰ বিনিময় হলো। মাত্র কয়েকটা তথ্য জানতে পারল রানা। সি.আই.এ. এটাকে ডাবল রেড অ্যালার্ট বলে অভিহিত করছে। এসপিওনাজ জগতে আছে রানা, কাজেই অর্থটা জানা আছে। ডাবল রেড অ্যালার্ট মানে ভয়াবহ পরিস্থিতি-অপারেশন সংক্রান্ত যেকোন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়া ঠেকাবার জন্যে প্রয়োজনে নিরীহ মানুষকেও খুন করা যেতে পারে। রানাকে অনুরোধ করা হলো, এই মুহূর্ত থেকে ও যেন দুনিয়ার সবাইকে অবিশ্বাস করে। সি.আই.এ. বা রানা এজেন্সির কারও সাথে দেখা করা নিষেধ। নতুন পরিচয়পত্র পেল রানা, পেল আমেরিকান পাসপোর্ট আর এথেন্সের ওয়ানওয়ে টিকেট। বলে দেয়া হলো, ওর পরবর্তী কন্ট্যাক্ট জার্মানভাষী এক কালোকেশী মেয়ে, হোটেল জি.বি.-তে অমুকদিন অমুক সময় ওর সাথে যোগাযোগ করবে সে।

    ব্যস, আর কোন তথ্য এখনও পায়নি রানা। কাজটা কি জানে না ও। বসের মেসেজেও সে-সম্পর্কে কোন আভাস ছিল না। তবে মেসেজের শেষ লাইনটা মনে গেঁথে আছে: রহস্যের ভেতর রহস্য থাকতে পারে-সাবধান।

    শেষ চুমুকটা দিয়ে গ্লাস ধরা হাতটা একটু উঁচু করল রানা, ওয়েটারকে ইঙ্গিত করল আবার ভরে দিতে। লক্ষ করল, কালোকেশী ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো অনিশ্চয়তায় ভুগছে মেয়েটা। রানার সাথে চোখাচোখি হতে ফিরিয়ে নিল মুখ। খানিক পর আবার একবার তাকাল। জার্মান লোকটা বিল মেটাবার জন্যে পকেটে হাত ভরছে, এই সময় সিদ্ধান্তে এল মেয়েটা। রানা তার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শুনতে পেল।

    ‘মাফ করবেন, প্লীজ, সম্ভবত পরিচিত এক ভদ্রলোককে দেখতে পাচ্ছি।’

    জার্মান লোকটা কিছু বলার আগেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা, রানার টেবিলের দিকে এগোল। লম্বা পা, ম্যাক্সির নিচে যতটা দেখা যায় হলদেটে মাখন। হ্যাঁ, মেয়ে হাঁটতে জানে বটে। গুরু নিত’ে উথাল পাথাল ঢেউ তুলে এগিয়ে এল সে। ‘মাফ করবেন,’ টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল রানাকে, ‘আপনি কি…, তারপর নিজের অসমাপ্ত প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিল, ‘না, দুঃখিত, আমার ভুল হয়েছে।’ অস্বস্তি আর ক্ষমাপ্রার্থনার সুর। ‘আপনাকে আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছিল…।’

    স্মিত হেসে রানা বলল, ‘আমার দুর্ভাগ্য যে সে-লোক আমি নই। কিন্তু তাই বলে এসে ফিরে যাবেন?

    নিমেষে মধুর হাসি ফুটে উঠল কালোকেশীর চেহারায়। হাত দুটো এক সেকেণ্ডের জন্যে টেবিলের কিনারা ছুঁলো। ‘আমার বন্ধু আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। বিরক্ত করার জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত।’

    ‘কোন ব্যাপারই নয়।

    এভাবেই মেয়েটা ঢুকল এবং বেরিয়ে গেল রানার জীবন থেকে। রানা ছাড়াও আরও পাঁচ-সাতজন লোক তাকে বেরিয়ে যেতে দেখল বার থেকে। আর সবার মত মৃদু হাসল রানা,

    কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কারণে। মেয়েটার দেহ-সৌষ্ঠব ওর নজর কাড়লেও, ওকে মুগ্ধ করেছে তার গোপন আচরণটুকু। কারও চোখে ধরা না পড়ে কৌশলে টেবিলের ওপর ফেলে গেছে ভাঁজ করা খুদে একটা কাগজ। দরজার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে এক হাত দিয়ে গ্লাস তুলল ও, আরেক হাত ভরল পকেটে। পকেট থেকে হাতটা বেরুল সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিল ও। গ্লাসটা শেষ করতে হবে।

    .

    বিশ মিনিট পর। হোটেল থেকে বেরিয়ে রানা দেখল সন্ধে হয়ে গেছে। চৌরাস্তায় কাফে আর বার সবগুলো লোকে লোকারণ্য। রাস্তায় যানবাহনের তেমন ভিড় নেই, তবে ফুটপাথে পরস্পরের হাত ধরা প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্যে হাঁটা মুশকিল। ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল রানা, মায়াবতী রমণীর মত কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল ফুরফুরে বাতাস। আমেরিকান এক্সপ্রেস অফিসকে পাশ কাটাল ও। একটা বুকস্টলের সামনে থামল, চোখ বুলাল খবরের কাগজের হেডলাইনগুলোয়। তারপর রাস্তা পেরিয়ে এরমু স্ট্রীটে চলে এল। ধীর পায়ে, অলসভঙ্গিতে হাঁটছে। হাত দুটো পকেটে। এথেন্সে এই সময় সচরাচর যেমন দেখা যায়, আরেকজন গোবেচারা ট্যুরিস্ট। খানিকদূর এগিয়ে নিশ্চিত হলো রানা, কেউ ওর পিছু নেয়নি। বাঁ দিকে মোড় নিল ও। তারপর হঠাৎ ডান দিকের অন্ধকার মত রাস্তায় ঢুকে পড়ল পেত্রাকি স্ট্রীট-লোকজন নেই বললেই চলে।

    স্ট্রীট লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল রানা। এই সুযোগে ভাঁজ করা কাগজটা বের করল। ভাঁজ খুলে মেসেজটা পড়ল ও। এক লাইনের একটা মেসেজ। ‘৮ ন’র কিরিস্তু স্ট্রীট, সকাল আটটায় সেণ্ট পলের আইকন খোঁজ করো।’

    আবার হাঁটা ধরল রানা। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করল কাগজটা, ফেলে দিল নর্দমায়।

    .

    মনোরম সকালে গ্রান্দ বেতানের বিলাসবহুল স্যুইটে ঘুম ভাঙল রানার। উনিশ তলার কার্নিসে সার সার টব, লতাগাছগুলো মোজাইক দেয়াল প্রায় ঢেকে ফেলেছে। তারই ভেতর লুকানো আছে স্পীকার, পাখির কুজন ধ্বনি সারা শরীরে মধুর আবেশ এনে দিল। ঘুম ভাঙাবার এই কায়দা যান্ত্রিক হলেও, রোমাঞ্চকর লাগল রানার, মনে মনে হোটেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারল না।

    রূম সার্ভিসকে ফোনে ডেকে বাথরূম আর শাওয়ার সারল রানা। তারপর দাড়ি কামাল। প্রজাপতি আঁকা বড় একটা টাওয়েলে কোমর ঢেকে লিভিং রূমে ঢুকল ও, এবং ঢুকেই আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    প্রায় উলঙ্গই বলা যায়, দেবী মূর্তি। ঘরের মাঝখানে নয়, দেয়াল ঘেঁষে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেন একটা গ্রীক মাস্টারপীস। মেয়েটার চোখের পাতা নড়ছে দেখে আটকে যাওয়া নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে ছাড়ল রানা।

    ‘রূম সার্ভিস,’ চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক তুলে হাসল মেয়েটা। রানার আড়ষ্ট ভাবটা দারুণ উপভোগ করছে। ‘আপনার ব্রেকফাস্ট সিটিং রূমে দেয়া হয়েছে।’

    সদ্য কামানো গালে হাত বুলিয়ে মৃদু হাসল রানা। ‘ধন্যবাদ।’

    মেয়েটা নড়ল না। ‘আর কিছু দরকার হবে আপনার? গাড়ি? কোন চিঠি ডাকে ফেলতে হবে? কিংবা যদি কিছু কেনার থাকে। গাইডের দরকার হলেও বলতে পারেন…।’ রানার লোমশ, চওড়া বুকের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল সে।

    ‘না।’ সিটিং রূমের দরজার দিকে একবার তাকাল রানা। ‘এথেন্সে আমি নতুন নই। ধন্যবাদ।’

    ‘ডাকলেই আমাকে পাবেন,’ দেবী মূর্তি দরজার দিকে এগোল। ‘আমিই আপনার রুম সার্ভিস।’

    দরজা বন্ধ করে দিয়ে কোমর থেকে তোয়ালেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রানা। সিটিং রূমে ঢুকে দেখল, টেবিলের পাশে ঢাকা লাগানো ট্রে-তে সাজানো রয়েছে ব্রেকফাস্ট। খিদেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। চেয়ারে বসে ট্রে-র ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা।

    রসনাতৃপ্তির পর কফি নিয়ে সোফায় বসল ও, তেপয়ে মেলে ধরল কাল রাতে কেনা। এথেন্সের ম্যাপ। শহরের প্রতিটি এভিনিউ চওড়া আর সরল, আর সবগুলো গলি-উপগলি আঁকাবাঁকা। কিরিস্তু স্ট্রীট কোন্ দিকে ভুলে গেছে ও। খুঁজে বের করতে পাঁচ মিনিট লেগে গেল। প্লাকা হচ্ছে এথেন্সের পুরানো-ঢাকা, ওল্ড টাউন। অ্যাক্রোপোলিস পাহাড়ের গোড়ায় ঘিঞ্জি একটা এলাকা। হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সিদ্ধান্ত নিল, হাঁটবে। সকালের রোদে শহরের ওপর ঝুঁকে থাকা অ্যাক্রোপোলিসকে ভালই লাগবে দেখতে।

    আমেরিকান ট্যুরিস্টদের মত শিস দিতে দিতে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল রানা। সিনট্যাগমা চৌরাস্তার দিকে এগোল ও, কাল রাতে এখান দিয়েই খানিকদূর গিয়েছিল। গাছপালার নিচে কাফেগুলো এখন খালি। প্রেমিক-প্রেমিকারাও উধাও। বছরের এই সময়টায় গ্রীকদের প্রতি সদয় থাকেন অ্যাপোলো, মৃদুমন্দ বাতাস বইতে দিয়ে রোদের ধার খানিকটা ভোঁতা করে রাখেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তেতে উঠবে রোদ। মুখ তুলে পাহাড় চূড়ার দিকে তাকাল রানা, কয়েক শতাব্দী ধরে লোকজন বসবাস করছে ওখানে।

    ধীরে ধীরে রাস্তা-ঘাটে শহুরে ব্যস্ততা বাড়ছে। নতুন শহর পেরিয়ে এল রানা। প্লাকা-য় ঢুকতেই চারদিকের দৃশ্য বদলে গেল। মান্ধাতা আমলের সাদা চুনকাম করা বাড়ি, জুতোর বাক্স আকৃতির ইমারত, আঁকাবাঁকা রাস্তার ওপর গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক। এখানে রোদ নেই, বাতাসের প্রবেশ নিষেধ। রাস্তার দু’পাশে সার সার দোকান, কিন্তু প্রায় সবগুলোই বন্ধ। পরিত্যক্ত, নির্জন রাস্তা। শুধু বাচ্চা দুটো ছেলে মার্বেল নিয়ে খেলছে এক ধারে। দোতলার এক ছাদে চোখ পড়ল রানার। দুটো রুমাল দিয়ে কোমর আর বুক ঢাকা এক মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলিঙের ওপর ঝুঁকে পাপোশ ঝাড়ছে। এত বাড়ি-ঘর, অথচ একেবারে নির্জন এলাকা। যেন শহর ছেড়ে সবাই পালিয়েছে।

    কিন্তু সন্ধ্যার পরপরই জ্যান্ত হয়ে ওঠে প্লাকা। পুরানো শহরের তখন অন্য চেহারা। দোকানদাররা তখন ফুটপাথেও তাদের পসরা সাজায়। প্রতিটি জানালার ওপাশ থেকে ভেসে আসে গান-বাজনার আওয়াজ। ফুর্তিবাজ লোকেরা দলে দলে ঢুকে পড়ে গলির ভেতর, সেন্টে প্রায় ভিজে থাকে তাদের জামা। কারও এক হাতে থাকে মদের বোতল, আরেক হাত থাকে কোন সুন্দরী যুবতীর কোমর পেঁচিয়ে। প্রতিটি বারে জুয়ার আড্ডা বসে। পানাহার, এবং যৌন লীলার অবাধ অনুশীলন চলে সারারাত, সেই ভোর পর্যন্ত। তারপর যে যার ঠিকানায় ফিরে যায়, নির্জীব পড়ে ধোঁকে পরিত্যক্ত প্লাকা।

    প্লাতিয়া মেট্রোপোলিয়স-এর কাছে অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল পেরিয়ে এল রানা, বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়ল মিসিক্লিয়স স্ট্রীটে। সামনে সরু রাস্তা সিঁড়ির আকৃতি নিয়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে। এখানে প্রাণী বলতে একজোড়া বিড়ালকে শুধু দেখতে পেল রানা। ধাপগুলোর মাথা থেকে শুরু হয়েছে সরু একটা গলি, অ্যাগোরা ধ্বংসাবশেষের কিনারা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে পাহাড়ের দিকে। আরও সামনে দেখা গেল প্রায় খাড়া পাহাড়ের ঢাল। সেদিকে না গিয়ে অন্য দিকে বাঁক নিয়ে কিরিস্তু স্ট্রীটে ঢুকে পড়ল রানা।

    হোটেল আর দোকানের মাঝখানে আট ন’র বাড়ি, সাদা চুনকাম করা। হোটেলের দরজা খোলা, কিন্তু লোকজন দেখা গেল না। দোকানটা বন্ধ। বাড়ির দরজায় একটা সাইনবোর্ড রয়েছে-এখানে অ্যান্টিকস বিক্রি হয়। দরজায় নক করতে গিয়েও করল না রানা, ঠেলা দিতেই কবাট খুলে গেল। কাউকে দেখার আগেই অন্ধকার থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘সুপ্রভাত।’

    ‘সুপ্রভাত,’ জবাব দিল রানা।

    ঘরের ভেতর থেকে দরজার কাছে এসে থামল এক শক্ত-সমর্থ লোক। বয়স হবে পঞ্চাশের মত, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, রোদেপোড়া গ্রীক জেলেদের মত চেহারা। লোকটাকে ছাড়িয়ে রানার দৃষ্টি সামনে চলে গেল। আবছা আলোয় অ্যান্টিক জিনিস-পত্র দেখা গেল কয়েকটা র‍্যাকে। দেব-দেবীর খুদে মূর্তি থেকে শুরু করে হাতে রঙ করা ফুলদানী, সবই আছে। র‍্যাকের পিছনের দেয়ালে ঝুলছে ফ্রেমে বাঁধানো রাজা কনস্ট্যানটিন এবং তাঁর ডেনিশ বধূর ছবি।

    লম্বা কাউণ্টারের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা। ভেতরে ঢুকে রানা বলল, ‘আপনি বোধহয় আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। সেণ্ট পলের আইকন খুঁজছি আমি

    সবজান্তার হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল লোকটার মুখ। এ-ধরনের হালকা হাসি আশা করেনি রানা। লোকটা যে ওর কন্ট্যাক্ট নয়, এটুকু পরিষ্কার। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার নিরীহ অভাবগ্রস্তদের একজন সে, আসল ব্যাপার কিছু না জেনেই সি.আই.এ-র খুদে ঘুঁটি হিসেবে কাজ করে। এদের বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত, তা না হলে কাজ পেত না। হঠাৎ করে কালোকেশীর চেহারাটা মনে পড়ে গেল রানার। উঁহু, মেয়েটা নিরীহদের একজন নয়। তারমানে বিশ্বস্ততা ছাড়াও আরও অনেক গুণ আছে তার। হাসতে হাসতে বুকে ছুরি চালাতে পারে। বিষ মিশিয়ে সহাস্যে শয্যাসঙ্গীর হাতে তুলে দিতে পারে মদের গ্লাস।

    ‘আমি ডাকান,’ ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল লোকটা। ‘আপনি যা খুঁজছেন ওপর তলায় পাবেন।

    লোকটার দৃষ্টি অনুসরণ করে কাঠের এক প্রস্থ সিঁড়ি দেখতে পেল রানা। সিঁড়ির মাথায় দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। নিশ্চয়ই কারও ভুলে নয়।

    ‘উঠে যান,’ আবার বলল লোকটা। ‘তাঁকে আমি দেখিনি, তবে জানি ওখানে তিনি আছেন।

    তিনি আছেন! তারমানে কি একজন? কিন্তু ডাকান যদি দেখে না থাকে, জানবে কিভাবে ক’জন আছে?

    সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করে জ্যাকেটের বোতাম খুলে ফেলল রানা। রিভলভারটা কোমরের বেল্টে রয়েছে, নিচের দিকে মুখ করে। আগ্নেয়াস্ত্র বিশ্বস্ত বন্ধুর মত, স্পর্শেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সিঁড়ির মাথায় উঠে থামল রানা, আস্তে করে চাপ দিল কবাটে। দরজার ভেতর ঘরটা প্রায় অন্ধকার, জানালাগুলোয় ভারী পর্দা ঝুলছে। এক দিকের দেয়াল ঘেঁষে সার সার বেঢপ আকৃতি দেখা গেল, ছোট বড় কাঠের বাক্স ওগুলো। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল, আর একটা চেয়ার। উল্টোদিকে আরেকটা দরজা, ক্ষীণ আলোর আভা ঢুকছে ভেতরে। সম্ভবত ওদিকেও একটা সিঁড়ি আছে, সরাসরি রাস্তায় নামা যায়।

    লোকটাকে আগেই দেখেছে রানা, টেবিলের সামনে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। শাটার আর পর্দা লাগানো জানালার সামনে অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি। বেশ লম্বা, একহারা গড়নের। নাক-চোখ কিছুই দেখা গেল না।

    ভেতরে ঢুকে পেছনে হাত বাড়িয়ে দরজা বন্ধ করল রানা। ভাপসা একটা গন্ধ ঢুকল নাকে। অন্ধকার থেকে কথা বলে উঠল লোকটা, ‘গুডমর্নিং, রানা।’

    কণ্ঠস্বরটা রানার স্মৃতির ভাণ্ডারে একটা আলোড়ন তুলল, কিন্তু চেষ্টা করেও লোকটাকে চিনতে পারল না। ‘আলোকে এত ভয় কেন?’ জিজ্ঞেস করল ও।

    ‘সাবধানের মার নেই,’ বলল লোকটা। এক চুল নড়ছে না সে। ‘কাছে এসো। তোমার মুখ দেখতে দাও।’

    চুপ করে থাকল রানা। একমুহূর্ত নড়ল না। দু’জনের মাঝখানের দূরত্বটুকু আরেকবার মেপে নিল। তারপর দরজার কাছ থেকে ধীর পায়ে, সাবধানে সামনে বাড়ল। টেবিলের কাছ থেকে সারাক্ষণ দূরে থাকল ও, টেবিল ঘুরে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে ভারী পর্দা সামান্য একটু সরাতেই দিনের আলো ঢুকল ঘরে। লোকটার চেহারা পরিষ্কার দেখা গেল এবার। বিস্মিত হলো রানা, কিন্তু চেহারায় সেটা প্রকাশ পেতে দিল না। ‘ডিকসন, ইউ বাস্টার্ড!’ জানালার পর্দা আবার টেনে দিল রানা।

    রড ডিকসন এথেন্সের মার্কিন দূতাবাসে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ওই ধরনের ছোট একটা চাকরি করে, অন্তত শেষবার রানার সাথে দেখা হওয়ার সময় তাই করত। পয়সার বিনিময়ে তথ্যের জন্যে ডিকসনের মত জুনিয়র গ্রেড অফিসারদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয় রানা এজেন্সিকে। ডিকসনের আয়ের দুটো উৎস সম্পর্কে জানে রানা। একটা চেক আসে ইউ.এস. আর্মির ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে। ব্রাঞ্চের মাথা-খারাপ কর্তাব্যক্তিরা এ-ধরনের লোককে দিয়ে উল্লট সব কাজ করিয়ে নেয়। অন্তত একটা কাজের কথা রানার জানা আছে, ডিকসনই জানিয়েছিল। হুইস্কির খালি বোতলে কম্যুনিজম বিরোধী প্রচার-পত্র ভরে দানিয়ুব নদীতে ছেড়ে দিত ডিকসন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশা ছিল, স্রোতে ভাসতে ভাসতে রাশিয়ার উপকূলে চলে যাবে ওগুলো, দেখতে পেয়ে গ্রামবাসীরা উদ্ধার করবে, এবং মেসেজ পড়ে কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। ঘটনাটা শোনার পর রানা মন্তব্য করেছিল, বেকুব কি আর গাছে ধরে! ডিকসনের আয়ের আরও একটা উৎস হলো, এমসিক্সটিন-ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস। আয়ের আরও উৎস তার থাকতে পারে, ঠিক জানা নেই রানার। লোকটা দু’হাতে টাকা ওড়ায়। একটু সন্দেহের চোখেই দেখে ও। যদি শোনে পয়সা খেয়ে শত্রু পক্ষের হয়ে কাজ করছে, অবাক হবে না।

    ‘পুরানো বন্ধুকে এভাবে কেউ সম্বোধন করে না,’ রাগ নয়, অভিমানের সুরে বলল ডিকসন।

    ‘ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও যে তোমাকে আমি মেরে ফেলিনি।’ পকেট থেকে এক প্যাকেট গ্রীক সিগারেট বের করল রানা।

    লাইটার জ্বেলে রানার সিগারেট ধরিয়ে দিল ডিকসন। রানার মনে পড়ল, ছোটখাট তথ্যের জন্যে এক সময় প্রচুর টাকা খেয়েছে ডিকসন ওর কাছ থেকে। মাথা নিচু করে ছোট একটা কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালল ডিকসন। ল্যাম্পটা সস্তাদরের অ্যান্টিক। সলতে একটু লম্বা করল সে, কাঁপতে লাগল শিখা। ‘একে ঠিক সাবধানতা বলে না, তুমি যেন কিসের ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছ,’ লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রানা।

    ‘বসো,’ ইঙ্গিতে চেয়ারটা দেখাল ডিকসন। ‘না, ভয়ের কি আছে। তবে স্বীকার করছি, কাজটা আমার তেমন পছন্দ হয়নি। কাজ তেমন কিছুই নয়, অথচ কোটিবার সাবধান থাকতে বলে দেয়া হয়েছে আমাকে। ল্যাম্পের আলো বাইরে থেকে দেখা যাবে না। সিলিঙের বালব্ জ্বাললে দেখা যাবে।’ একটু থেমে আরেক প্রসঙ্গে চলে গেল, ‘জানা না থাকলে ধরতেই পারতাম না তুমি রানা।’

    মিথ্যে কথা। জানালার বাইরে সাদা চুনকাম করা দেয়ালে চোখ ধাঁধানো রোদ পড়েছে, বালবের আলো কেউ দেখতেই পাবে না। তবু তর্কের মধ্যে গেল না রানা। লক্ষ করল, বেঢপ একটা ভুঁড়ি বাগাতে শুরু করেছে ডিকসন। মাথায় চুলও আগের চেয়ে কম মনে হলো। ডিকসনের চেহারায় বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই, সিকিউরিটি এজেন্টদের চেহারা ঠিক এরকমই হওয়া উচিত। সারারাত লোকটার সাথে বসে মদ খেলেও পরদিন সকালে চেহারাটা স্মরণ করা কঠিন। ছোট করে ছাঁটা চুল। পরনে গাঢ় রঙের কনজারভেটিভ স্যুট। তবে এথেন্সের বহুলোকই আবছাভাবে হলেও জানে লোকটা আসলে কি। ডিকসন অতিরিক্ত সাবধান হওয়ায় একদিক থেকে ভালই হয়েছে, ভাবল রানা। ওর সাথে লোকে তাকে প্রকাশ্যে না দেখলেই ভাল।

    এক মুখ ধোঁয়া ছাড়ল রানা। ‘বলো, কি চাও তুমি আমার কাছে?’

    ‘আমার কিছু চাইবার নেই, দেবার আছে। দেরাজ থেকে একটা লেদার পাউচ বের করল ডিকসন, দু’জনের মাঝখানে টেবিলের ওপর রাখল সেটা। ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। ‘একই পার্টির কাজ করছি আমরা।’

    ‘কোন্ পার্টি?’

    ঘুরিয়ে উত্তর দিল ডিকসন, ‘পিটার ডানিয়েল আমাকে পাঠিয়েছে।’

    শ্রাগ করল রানা।

    ‘ডানিয়েল তোমাকে অধৈর্য না হতে অনুরোধ করেছে।’

    ডানিয়েলকে রানা চেনে না, অন্তত এই নামে চেনে না। ‘বলে যাও, আমি শুনছি।

    ‘তোমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ হবে এটা,’ বলে থামল ডিকসন, পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল। ‘কাজেই মুখ খুললে নিজেরই বিপদ ডেকে আনবে।’

    ‘এ-ধরনের প্রলাপ শোনার জন্যে আসিনি আমি,’ ধমকে উঠল রানা। ‘কাজের কথা থাকলে চটপট…’

    ‘ডানিয়েল যা বলতে বলেছে তাই বলছি আমি,’ বাধা দিল ডিকসন। ‘গোটা ব্যাপারটা টপ সিক্রেট, কাজেই তোমার নতুন পরিচয় কোন শুভানুধ্যায়ী, বন্ধু-বান্ধব, সহকারী সহকর্মী কাউকে জানানো চলবে না। সেজন্যেই ওরা নিজেদের লোক না পাঠিয়ে আমাকে পাঠিয়েছে।’

    ‘রানা এজেন্সির বেশিরভাগ কেস-ই টপ সিক্রেট,’ বলল রানা। ‘আর ছদ্মবেশের কথা যদি বলো, চেষ্টা করলে এজেন্সির এজেন্টরা ঠিকই আমার নতুন পরিচয় জেনে ফেলবে…।’

    আবার বাধা দিল ডিকসন, ‘তোমার বুঝি তাই ধারণা?’ বিষণ্ন একটু হাসি দেখা গেল তার মুখে, হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল একবার। ‘যদি বলি কেউ আর চেষ্টাই করবে না? এখন থেকে দশ মিনিট পর সংশ্লিষ্ট সবাই জানবে, বারো ঘণ্টা আগে মারা গেছে মাসুদ রানা।’

    চুপ করে থাকল রানা। সিগারেটে টান দিল। ব্যাখ্যার জন্যে অপেক্ষা করছে।

    ‘রেকর্ডে দেখা যাবে, কাল সকালে ব্রাসেলস ত্যাগ করেছ তুমি, অসলো-য় ল্যাণ্ড করেছ, কাস্টমস শেড থেকে বেরিয়ে একটা গাড়িতে চড়েছ। হোটেলে যাওয়ার পথে তোমার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে। স্থানীয় হাসপাতালে দু’ঘণ্টা পর মারা যাও তুমি।’

    ‘প্রচুর কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে, সন্দেহ নেই,’ বলল রানা। ভাবল, কে সেই ভাগ্যবান, ওর বদলে লাশ হতে হলো যাকে?

    ‘গাড়িটা ছিল একটা রেন্ট-এ-কার কোম্পানির-তুমি নিজে ভাড়া করেছিলে।’

    ‘অবশ্যই।’

    ‘আসলে বলতে চাইছি, গোটা ব্যাপারটা অফিশিয়াল-কোথাও কোন খুঁত রাখা হয়নি। মাসুদ রানা মারা গেছে। পোস্ট মর্টেমের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ঢাকাতেও পৌঁছে গেছে খবরটা, সম্ভবত এরই মধ্যে ক্লোজ করে দেয়া হয়েছে তোমার ফাইল। তোমার সম্পর্কে শত্রু এবং মিত্রদের কাছে আরও অনেক ফাইল আছে, সেগুলোও ক্লোজ হতে শুরু করেছে। কেউ যদি সন্দেহের বশে তোমার খোঁজ-খবর পাবার চেষ্টা করে, মাথা খুঁড়ে মরে গেলেও কোথাও কোন সূত্র পাবে না বেচারা।’

    ‘বুদ্ধিটা কার?’ কঠিন সুরে জানতে চাইল রানা। ‘জিজ্ঞেস না করেই মেরে ফেলল আমাকে?’

    ‘তোমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেনি, কিন্তু আমার বিশ্বাস তোমার বসের কাছ থেকে নিশ্চয়ই অনুমতি নেয়া হয়েছে, বলল ডিকসন। ‘ডানিয়েল তোমাকে বলতে বলেছে, কাজের ধরনটা এমনই যে সতর্ক হবার জন্যে এ-ধরনের আয়োজন একান্ত দরকার ছিল, তুমি যেন মাইণ্ড না করো।’

    ‘হুঁ।

    রানার অসহায়বোধটুকু উপভোগ করছে ডিকসন। অভ্যস্ত নয়, কর্তৃত্বের ভাব চেহারায় মানাচ্ছে না। প্রশ্ন আশা করলেও, রানা তার আশা পূরণ করল না। জানে, ও চুপ করে থাকলেই বেশি কথা বলবে ডিকসন।

    ‘আজ বিকেলে এথেন্স ছেড়ে যাচ্ছ তুমি,’ বলল ডিকসন। লেদার পাউচ খুলে ভেতর থেকে একটা এনভেলাপ বের করল সে, টেবিলের ওপর রাখল। এনভেলাপের ভেতর একটা সুইডিশ পাসপোর্ট পেল রানা। অটো এমারসন, ফার ব্যবসায়ী। কিছু চিঠিপত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, সুন্দরী এক মহিলার সাথে ফুটফুটে দুটো বাচ্চার ওয়ালেট সাইজ ফটো, ইত্যাদি রয়েছে।

    ‘বাচ্চা দুটো তোমার, ওদের মা তোমার স্ত্রী,’ বলল ডিকসন। ‘সুখী একটা পরিবার।’

    সবশেষে এনভেলাপ থেকে একটা প্লেনের টিকেট বেরুল, এথেন্স থেকে লণ্ডনের। আজ বিকেলের ফ্লাইট।

    ‘তোমার যা যা দরকার হবে, সব যোগাড় করেছি আমি,’ বলল ডিকসন। ‘জি.বি-তে ফিরে গিয়ে নতুন কাপড়চোপড় দেখতে পাবে। সবই স্টকহোম থেকে কেনা হয়েছে-লাগেজ, শেভিং গিয়ার, সমস্ত কিছু। এমনকি একটা উপন্যাসও পাবে, এই মুহূর্তে সুইডেনকে গরম করে রেখেছে।’

    ‘হুঁ।

    ‘তুমি চলে যাবার পর এদিকের সব পরিষ্কার করে ফেলব আমি। এথেন্সে তুমি যা কিছু কিনেছ, সব ফেলে যাবে। এমন কিছু তোমার সাথে থাকা চলবে না যা দেখে বোঝা যায় তুমি মাসুদ রানা। আশা করি এদিকটা তুমি লক্ষ রাখবে।’

    ‘তারপর, লণ্ডনে পৌঁছুলে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

    ‘পিকাডেলি-র অ্যামব্যাসাডর হোটেলে উঠবে। তারপর কি ঘটবে আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। এই পর্যন্তই আমার দৌড়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ১৪৪ – অপহরণ-২
    Next Article মাসুদ রানা ৪৫৯ – অন্তর্যামী

    Related Articles

    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৩৮৫-৩৮৬ – হ্যাকার (দুই খণ্ড একত্রে)

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৬ – টপ টেরর

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৪ – নরপশু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৩ – ধর্মগুরু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫২ – কালো কুয়াশা

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫১ – মায়া মন্দির

    July 22, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    শ্রীশ্রীচণ্ডী – অনুবাদ : পঞ্চানন তর্করত্ন

    September 9, 2025

    পুলিশ কাহিনী ১ – পঞ্চানন ঘোষাল (প্রথম খণ্ড)

    September 9, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.