Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    শ্রীশ্রীচণ্ডী – অনুবাদ : পঞ্চানন তর্করত্ন

    September 9, 2025

    পুলিশ কাহিনী ১ – পঞ্চানন ঘোষাল (প্রথম খণ্ড)

    September 9, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ১৪৩ – অপহরণ-১

    কাজী আনোয়ার হোসেন এক পাতা গল্প181 Mins Read0

    অপহরণ-১.৭

    সাত

    গাড়িটা সরকারি নম্বর লাগানো কালো একটা সিডান। সরকারি ন’রের সুবিধে হলো, অজায়গায় পার্ক করলেও ট্রাফিক পুলিস গাড়িটা সরিয়ে নিয়ে যাবে না, বা জরিমানা টিকেট লাগাবে না।

    পোর্ট এলাকায় প্রচণ্ড ভিড়, এখানেও রানাকে কনুই আর হাঁটু চালাতে হলো। ফিফটি-সেকেণ্ড স্ট্রীটের পশ্চিম মাথায়, বিরানব্বই ন’র জেটিতে যেতে হবে ওকে। দূর থেকেই কুইন এলিজাবেথ টু কে দেখা গেল, রাতের আকাশকে আলোকিত করে নোঙর ফেলে আছে। প্রতিটি জেটির জন্যে আলাদা করে একটা বিল্ডিং, বিশাল হলরূমের ভেতরে ঢুকে নিউজস্ট্যাণ্ডের সামনে দাঁড়াল রানা। অদূরেই কাস্টমস চেক-পোস্ট। এখুনি জাহাজ থেকে নেমে এদিকে আসবে আরোহীরা, তার জন্যে শান্তভাবে অপেক্ষা করছে অফিসাররা।

    হালকা নীল স্যুট পরেছে রানা, নিচে গাঢ় নীল শার্ট। খাস আমেরিকান সাজার জন্যে ছদ্মবেশ আর মেকআপ নিতে হয়েছে ওকে। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সব কিছু বদলে ফেলেছে। ছোট করে ছাঁটা চুল, পরিপাটি করে আঁচড়ানো। নির্লিপ্ত, শান্ত ভাব চেহারায়, দাঁড়াবার ভঙ্গির মধ্যে অসীম ধৈর্য। দেখে যে কেউ ভাববে, সরকারি কর্মচারী।

    আরোহীরা জাহাজ থেকে নামতে শুরু করল। ঠাণ্ডা চোখে প্রত্যেকের ওপর চোখ বুলাল রানা। কয়েকশো ফটো আর ফিল্ম দেখে চেহারাটা মনে গেঁথে নিয়েছে ও, লোকটাকে একবার দেখলেই চিনতে পারবে। ফটো আর ফিল্ম তোলা হয়েছে লণ্ডনে, সাবজেক্টের অজান্তে ধোয়া অবস্থায় দু’দিন আগে রানার হাতে পৌঁছায় ওগুলো। অবসন মিথ্যে বলেনি, এমন কিছু নেই যা ওদের নাগালের বাইরে। পৃথিবীর যে-কোন প্রান্ত থেকে যে-কোন জিনিস আনিয়ে দিতে পারে সি.আই.এ। আপন মনে হাসল রানা, পারে না শুধু প্রেসিডেন্টের মেয়েকে কিডন্যাপ করতে।

    বারবার পড়ে লোকটার ডোশিয়ে মুখস্থ হয়ে গেছে রানার। স্যাম গ্রেসন। ম্যানচেস্টার, ইংল্যাণ্ডে জন্ম। বয়স আটাশ। ছ’ফিট লম্বা। কালো চুল। খয়েরি চোখ। পেশায় ফটোগ্রাফার।

    রানার সাথে শারীরিক গড়ন পুরোপুরি মেলে না, তবে তাতে কিছু এসেও যায় না। মেলে না চেহারাও, কিন্তু মেলানো হবে। রানার এখন যা গায়ের রঙ, লালচে সাদা, সেটাও স্যাম গ্রেসনের সাথে মিলবে না। গ্রেসন ধবধবে সাদা। তারমানে গায়ের রঙ আবার একবার বদলাতে হবে রানাকে।

    হাতে সুটকেস আর কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে এল স্যাম গ্রেসন। খবরের কাগজে মুখ লুকিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে এসে দাঁড়াল রানা। পাঁচ মিনিট পর কাস্টমস থেকে ছাড়া পেয়ে গ্রেসনও বেরিয়ে এল। কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে ভরল রানা, গ্রেসন ট্যাক্সি ডাকার আগেই তার পথরোধ করে দাঁড়াল। ‘মি. গ্রেসন? মি. স্যাম গ্রেসন?’

    মুখ তুলল গ্রেসন, অবাক হয়েছে। ‘জ্বী, হ্যাঁ। কেন বলুন তো?’

    ‘জন রেইনার,’ বলল রানা। ‘ইউ.এস. সিক্রেট সার্ভিস। ভাঁজ খুলে একটা কার্ড দেখাল ও।

    কার্ডে চোখ বুলিয়ে রানার দিকে তাকাল গ্রেসন। ‘কোথাও কিছু ভুল হয়েছে, স্যার?’

    ‘না,’ লোকটাকে আশ্বস্ত করে ক্ষীণ হাসল রানা। ‘ইণ্ডিয়ান স্প্রিঙের জন্যে ক্লিয়ার্যান্স দেয়ার আগে আরও কিছু তথ্য চাই আমরা। সাথে গাড়ি আছে। যাবার পথে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন, আমি আপনাকে হোটেলে নামিয়ে দেব।’

    ‘বেশ তো,’ রানার সাথে হাঁটতে শুরু করে বলল গ্রেসন। মার্জিত যুবক, অক্সফোর্ডে শেখা উচ্চারণ ভঙ্গি। ডানিয়েলকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে রানা, গ্রেসনের গায়ে হাত তোলা চলবে না। কাজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে আটকে রাখা হবে ওকে। ‘আমার রূম রিজার্ভ করা হয়েছে হলিডে ইন-এ, রানা গাড়ি ছেড়ে দিতে বলল গ্রেসন।

    মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘জানি।’

    নিঃশব্দে হাসল গ্রেসন। ‘তা তো জানবেনই, আপনাদের কাজই তো এই।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল গ্রেসন। ‘পোর্টে এসে পাকড়াও করলেন, নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।’

    ‘ক্লিয়ার‍্যান্স দেয়া দারুণ ঝামেলার ব্যাপার,’ বলল রানা। ‘কাজ তো আর একটা নয়, সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় আমাদের। আজ রাতে যে-করেই হোক আপনার সাথে দেখা করা দরকার ছিল, তাই হোটেলে না গিয়ে সরাসরি পোর্টে চলে এলাম। দু’জনেরই সময় বাঁচল।’

    ‘ধন্যবাদ,’ বলল গ্রেসন। ‘হলিডে ইন কি খুব দূরে?’

    ‘এমনিতে দূরে নয়, কিন্তু সিক্সথ্ এভিনিউ-এ আগুন লাগায় ওদিকের সব রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম লেগে গেছে। অনেকটা ঘুরে যেতে হবে আমাদের।

    রানা জানে, নিউ ইয়র্কে এটাই গ্রেসনের প্রথম বেড়াতে আসা। তবে লণ্ডনে বসে ম্যানহাটনের ম্যাপ যোগাড় করা কঠিন কিছু নয়, পোর্ট থেকে হোটেলের দূরত্ব হয়তো জানা আছে ওর। সেজন্যেই একটা গন্ধ বানিয়ে বলতে হলো।

    ফরটি-সেকেণ্ড স্ট্রীটে লাল আলো দেখে গাড়ি থামাল রানা, পকেট থেকে রূপালী সিগারেট কেস বের করে রানার সামনে খুলে ধরল গ্রেসন।

    ‘না, ধন্যবাদ, ডিউটিতে রয়েছি,’ বলল রানা। ‘আমরা উনিশশো বিরাশি থেকে উনিশশো চুরাশি পর্যন্ত, এই দু’বছর সম্পর্কে জানতে চাই। দু’বছর আপনি ইংল্যাণ্ডে ছিলেন না।’

    ‘না, অস্ট্রেলিয়ায় ছিলাম।’

    লালের জায়গায় সামনে সবুজ আলো জ্বলে উঠল। শহরের দিকে নয়, দক্ষিণ দিকে ছুটল গাড়ি। ‘কি করছিলেন?’

    ‘বলতে পারেন বেড়াচ্ছিলাম। অবশ্য দু’একটা স্টুডিওতে কাজ করেছি। আর, হ্যাঁ, ছবি তুলেছি প্রচুর।’

    ‘বিস্তারিত বিবরণ দেয়া সম্ভব?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

    গ্রেসন শুরু করল, কিন্তু রানা মন দিয়ে শুনছে না। সবই জানা আছে ওর। লোকটাকে কথা বলাবার পিছনে দুটো কারণ রয়েছে। সময়টা পার করা, আর গ্রেসনকে ব্যস্ত রাখা। গন্তব্যে পৌঁছুনোর আগে লোকটার মনে যেন কোন সন্দেহ না জাগে।

    পনেরো মিনিট পর লোয়ার ম্যানহাটনে পৌঁছুল গাড়ি। এদিকের রাস্তাগুলো প্রায় অন্ধকার, রাস্তার ন’রে কোন নিয়ম শৃঙ্খলা নেই। বারো-র পর একশো এক, তেরো-র কোন খবর নেই। কত বার যে কত দিকে বাঁক নিল গাড়ি, দিশা পাওয়া অসম্ভব। ভাগ্যিস রানা আগেভাগে এসে সবটুকু রাস্তা দেখে রেখেছিল। তিনবার আসা-যাওয়া করেছে ও, ভুল হবার কোন উপায় নেই। আরেকবার বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে ক্যানাল স্ট্রীটে ঢুকল গাড়ি।

    এতক্ষণে থামল গ্রেসন।

    রানা বলল, ‘গুড, এতেই চলবে। তবে, জানেনই তো, আপনার কথা যাচাই করতে হবে আমাদের। চিন্তার কিছু নেই, সব যদি সত্যি বলে থাকেন, ক্লিয়ার্যান্স পেতে আপনার কোন অসুবিধে হবে না।’

    ‘তবু কি রকম সময় লাগবে?’

    শ্রাগ করল রানা। ‘এক কি দু’দিন। চূড়ান্ত ক্লিয়ার্যান্স আসবে ওয়াশিংটন থেকে।’

    মাথা ঝাঁকাল গ্রেসন।

    ‘জানালা দিয়ে বাইরে তাকান, অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখতে পাবেন,’ বলল রানা। ‘এলাকাটাকে নিউ ইয়র্কের কলঙ্ক বলতে পারেন।’

    ‘তাই!’ আগ্রহী হয়ে উঠল গ্রেসন।

    পরবর্তী ইণ্টারসেকশনে পৌঁছে ডান দিকে বাঁক নিল রানা। চওড়া এভিনিউ, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে অসংখ্য খুদে বার আর সস্তাদরের নোংরা হোটেল। প্রতিটি হোটেল আর বারের সামনে খাদ্য, পানীয়, ইত্যাদির নাম এবং মূল্য-তালিকাসহ একটা করে ধুলো ঢাকা বোর্ড রয়েছে, বোর্ডের পাশেই অন্ধকার গর্ত—ওই গর্ত দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। ফুটপাথ আছে, তবে আবর্জনার স্তূপে ঢাকা। সেই আবর্জনার ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে অনেক লোক-সবাই ওরা নেশাগ্রস্ত মাতাল। ভিজে গায়ে নর্দমা থেকেও উঠতে দেখা গেল কয়েকজনকে। শুধু নিগ্রোরা নয়, ওদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ও রয়েছে।

    আবার ডান দিকে বাঁক নিল রানা, চায়না টাউনকে পাশ কাটিয়ে এল। এরপর বাঁ দিকে মোড় ঘুরে ঢুকল লিটল ইটালিতে। লাল আলো দেখে আরেকবার থামতে হলো।

    পর্যটনের আনন্দ পেতে শুরু করেছে গ্রেসন। সারাক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। ‘স্বপ্নেও ভাবিনি নিউ ইয়র্কে এরকম জায়গা থাকতে পারে। সময় করে ওখানে একদিন যাব আমি…জায়গাটার নাম কি?’

    ‘বোয়েরী। হ্যাঁ, নিউ ইয়র্ক দেখতে হলে প্রচুর সময় দরকার,’ মন্তব্য করল রানা।

    আলো বদলাল।

    ওদের সামনে অন্ধকার রাস্তা। বাঁ দিকে একটা পরিত্যক্ত ওয়্যারহাউস। ডান দিকে সার সার দোকান, কিন্তু সবগুলো আজকের মত বন্ধ হয়ে গেছে। নাক বরাবর সামনে বহুতল আবাসিক ভবন, প্রতিটি জানালা হয় বন্ধ না হয় ভারী পর্দা ঝুলছে। রাস্তায় কোন আলো নেই, কারণ মদের পয়সায় টান পড়লে পাড়ার যুবকরা লাইটপোস্ট থেকে টিউব খুলে নিয়ে যায়।

    গোটা এলাকার মাথায়, চল্লিশ পাড়া দূরে, এমপায়ার স্টেট বিল্ডিঙের আলো আকাশ ছুঁয়ে আছে। পিছনে এবং সামনে রাস্তায় রাস্তায় যানবাহন আর মানুষজনের ভিড়, এখান থেকে অনেকটা দূরে।

    এদিকটা শুধু অন্ধকার নয়, সম্পূর্ণ নির্জন।

    আরও খানিক দূর এগোল গাড়ি। হঠাৎ সামনে চোখ ধাঁধানো হেডলাইটের আলো জ্বলে উঠল। ঘ্যাচ করে ব্রেক কষল রানা।

    ‘কি ব্যাপার?’

    না, এখনও ভয় পায়নি গ্রেসন। হেডলাইটের পিছনে কি আছে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু রানা জানে একটা ভ্যান আছে।

    আলোটা রাস্তার মাঝখানে। গ্রেসন অপেক্ষা করছে, সিক্রেট সার্ভিস এজেণ্ট আলোটাকে পাশ কাটিয়ে এগোবে। ‘কি একটা জায়গা!’ তাচ্ছিল্যের সাথে বলল সে। ‘হোটেলটা নিশ্চয়ই এদিকে কোথাও নয়?

    ‘না,’ বলল রানা। ‘না, হোটেল এখান থেকে বহু দূরে, মি. গ্রেসন।’

    দ্রুত রানার দিকে ফিরল গ্রেসন। চেহারায় ভয়ের কোন ছাপ নেই। বিস্মিত হয়েছে সে, একটু হকচকিয়ে গেছে, কিন্তু এখনও অস্থির নয়। ‘সামনে কি? পথ ভুল করেছেন?

    গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিল রানা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কি দেখল কে জানে, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল গ্রেসন। মি. রেইনার—।’ রানার হাত নড়ে উঠল, দেখে আঁতকে উঠল সে, পিছিয়ে সীটের কোণে চলে যাবার চেষ্টা করল, হাত দুটো আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে উঠে এল মুখের সামনে। ‘না! কেন! প্লীজ! গ…’ দরজার গায়ে হাতল হাতড়াতে শুরু করল সে, আতঙ্কিত চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।

    রাস্তা খালি। ঘাড়ের ওপর প্রচণ্ড এক ঘুসি খেলো গ্রেসন। এক ঘুসিতেই জ্ঞান হারাল সে।

    রানা গাড়ি থেকে, আর ডানিয়েল ভ্যান থেকে নামল। ডানিয়েলের মুখে দু’দিনের না কামানো দাড়ি। হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোয় চোখের নিচের কাটা দাগটা আগের চেয়ে লালচে দেখাচ্ছে। ফুটপাথ থেকে কেনা ধূসর রঙের স্যুট। মাথাভর্তি ধূসর চুল বাতাসে উড়ছে। শার্টটা এক বছর ধোয়া হয়নি। মনে মনে বিরক্ত হলো রানা, এমন নোংরা ছদ্মবেশ নেয়ার কি মানে!

    কেউ কারও সাথে কথা বলল না। দু’জন ধরাধরি করে গাড়ি থেকে নামাল গ্রেসনকে। অজ্ঞান দেহটাকে তোলা হলো ভ্যানের পিছনে। দরজা বন্ধ করল ডানিয়েল, তারপর আলো জ্বালল। দ্রুত কাপড় বদলাতে শুরু করল রানা।

    কাপড় বদলে কালো একটা মেটাল বক্স খুলল রানা। ভেতর থেকে বেরুল আয়না, চিরুনি আর ব্রাশ, তোয়ালে, চুল রঙ করার তরল কলপ, চামড়া রঙ করার মলম, চোয়াল ফোলাবার জন্যে একজোড়া সিলিকন প্যাড, পাসপোর্টের ফটো পেজ, ইত্যাদি।

    নতুন ফটো লাগানো পাতাটা গ্রেসনের পাসপোর্টে ব্যবহার করা হবে। কেমিকেলের সাহায্যে নতুন পাতাটাকে পুরানো চেহারা দেয়া হয়েছে, পাসপোর্টের বাকি অংশের সাথে যাতে মিল খায়। গ্রেসনের পাসপোর্ট থেকে ফটো লাগানো পাতা সরিয়ে ফেলা হবে। নতুন ফটোয় যার চেহারা দেখা গেল তাকে ঠিক হুবহু স্যাম গ্রেসনের মত মনে হবে না, আবার রানা বলেও মনে হবে না।

    ত্রিশ মিনিট পর ফটোর চেহারা পেল রানা। নিজের চোখে নিজেই খয়েরি ক্যাপ লাগিয়েছে। আবার কালো করে নিয়েছে চুল। মোটা সোল-এর জুতো পরে ইঞ্চি দুয়েক লম্বাও হয়েছে। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। গ্রেসনের নয়, লণ্ডন থেকে আনানো শার্ট আর স্যুট পরে আছে। ওগুলো কেনা হয়েছে গ্রেসনের পরিচিত দোকান থেকে।

    আয়নায় নিজেকে দেখে হাসল রানা। গ্রেসনের পরিচিত কারও সাথে দেখা না হয়ে গেলে, উতরে যাবে ও।

    রানার গাড়ি হুস করে চলে গেল, সেদিকে একদৃষ্টে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকল ডানিয়েল। তারপর ভ্যানের দরজা বন্ধ করে গ্রেসনের দিকে ফিরল সে। মেঝেতে পড়ে আছে গ্রেসন, এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

    লোকটার কোন ক্ষতি করা চলবে না, বারবার সাবধান করে দিয়েছে রানা। নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে, যতদিন না বিপদ-মুক্ত সময় আসে। কিন্তু কত দিন, রানার কোন ধারণা আছে?

    পরিচয় ফাঁস হবার ভয় রানার আছে বলে মনে হয় না। কার নাম ফাঁস করতে পারে গ্রেসন, সিক্রেট সার্ভিস এজেণ্ট জন রেইনার? তাতে রানার কিছুই এসে যায় না। কিন্তু রানার মত আত্মবিশ্বাস ডানিয়েলের নেই। ডানিয়েল রানার মত ছদ্মবেশ নিতেও পটু নয়।

    রানার ডোশিয়ে-তে লেখা আছে, নিরীহ মানুষের সাথে নিষ্ঠুর হতে পারে না ও। যারা এসপিওনাজ জগতে আছে তারা এটাকে গুণ বলে স্বীকার করবে না। এমন অনেক পরিস্থিতি দেখা দেয়, পাইকারী হারে নিরীহ মানুষ খুন করা দরকার হয়ে পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতি প্রত্যেক এজেন্টের জন্যে পরীক্ষার মত, পাস করতে পারলে বিপদ কেটে যাবে, ফেল মারলে শুধু নিজে নয়, সংশ্লিষ্ট সবাই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

    ডানিয়েল নিজের ক্ষতি করতে চায় না। চায় না সি.আই.এ-র ডেপুটি ডিরেক্টরের ক্ষতি হোক। না, নিরীহ লোকদের প্রতি তার কোন দরদ নেই। গ্রেসন একটা হুমকি, লোকটাকে খতম করার জন্যে এটুকু জানাই তার জন্যে যথেষ্ট।

    দ্রুত কাজে হাত দিল সে। অজ্ঞান দেহটা টেনে এনে দেয়ালের গায়ে বসার ভঙ্গিতে খাড়া করল। লেদার ব্যাগ থেকে এক বোতল হুইস্কি বেরুল। গ্রেসনের মুখ বাঁ হাত দিয়ে খুলে রাখল। বোতলের মুখ ঢুকিয়ে দিল দুই সারি দাঁতের মাঝখানে। গ্রেসনের মুখ থেকে বাঁ হাত সরিয়ে নিল সে, বাঁকা করা আঙুলের গিঁট দিয়ে চাপ দিল গলায়। গলার পেশীতে ঘন ঘন চাপ পড়ায় ঢোক গেলার ভঙ্গি করল গ্রেসন। অন্ধ অন্ধ করে হুইস্কি নামছে পেটে।

    এরপর গ্রেসনের স্যুট, শার্ট, টাই, জুতো, আর মোজা খুলে নিল ডানিয়েল। নিজে যেমন পরে আছে, স্যালভেশন আর্মির বাতিল করা জুতো-জামা, গ্রেসনকেও তাই পরাল। কাজটা শেষ করে হাতঘড়ি দেখল সে। যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছে, এতক্ষণে নিশ্চই রক্তের সাথে মিশে গেছে হুইস্কি।

    ব্যাগটা থেকে একটা মেটাল বক্স বের করল ডানিয়েল, বক্স থেকে বেরুল প্লাস্টিক সিরিঞ্জ। ভেতরে বাতাস ছাড়া কিছুই নেই। সুইয়ের মুখ অস্বাভাবিক সরু, চামড়ায় কোন দাগ থাকবে না। খুব সাবধানে গ্রেসনের বাহুতে সুইটা বেঁধাল সে, লক্ষ্য রাখল চাপ যাতে বেশি না পড়ে। প্লাঞ্জারে আঙুল রেখে মৃদু ঠেলা দিল, মুক্তি দিল বুদ্বুদটাকে। রক্তপ্রবাহের সাথে হার্টে চলে যাবে ওটা।

    বাতাসের খুদে একটা বুলেট।

    হলিডে ইনের পথে অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েছে রানা, নিজের অজান্তে বোয়েরী-তে আবার ফিরে এল গ্রেসন। তাকে নিয়ে ভ্যান থেকে জড়াজড়ি করে, প্রায় গড়াতে গড়াতে নিচে নামল ডানিয়েল। চারপাশের বদ্ধ মাতালরা ওদের দেখেও দেখল না। নর্দমায় নেমে আবার উঠল ডানিয়েল, গ্রেসনকেও টেনে তুলল। তারপর অন্ধকার এক কোণে শুয়ে থাকল সে, পরস্পরের হাত-পা প্যাচ খেয়ে থাকল। দু’জনের চোখেই স্থির দৃষ্টি, যেন তাকিয়ে আছে কিন্তু দেখছে না কিছু।

    খানিক পর উঠে হেঁটে চলে এল ডানিয়েল, পিছনে পড়ে থাকল গ্রেসন। এখানে কেউ গ্রেসনকে চেনে না। আরেকজন মাতাল। লাশকাটা ঘরে ঠাঁই পাবে। বেওয়ারিশ লাশ।

    .

    হলিডে ইনের ডেস্ক ক্লার্ককে পাসপোর্টটা দিয়ে সিগারেট ধরাল রানা। লোকটা পাসপোর্টের ওপর চোখ বুলাল শুধু, খুঁটিয়ে দেখল না।

    ওপরতলায়, গ্রেসনের রির্জাভ করা কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ করল রানা। বিছানায় উপুড় হয়ে শুলো, গ্রেসনের ফাইলগুলো পড়বে।

    টেপ আর মুভি ফিল্ম ডানিয়েলকে দিয়ে এসেছে রানা, সব নষ্ট করে ফেলা হবে। সাথে করে নিয়ে এসেছে ডোশিয়ে, স্টিল ফটো, এফ.বি.আই. রিপোর্ট, আর সিক্রেট সার্ভিস ক্লিয়ার‍্যান্স। ক্লিয়ার‍্যান্সটা সই করা হয়েছে তিন দিন আগে।

    আর রয়েছে চিঠিগুলো, পঁচাত্তর হাজার থেকে ঘেঁটে উদ্ধার করা। এই পঁচাত্তর হাজারের ভেতর থেকেই স্যাম গ্রেসনকে আবিষ্কার করেছে রানা।

    ওগুলো আবার একবার পড়তে শুরু করল ও।

    .

    ‘ডিয়ার মিসেস কেনটারকি,

    আমাদের কখনও দেখা হয়নি, তবে মায়ের মুখে শুনতে শুনতে আপনার সম্পর্কে কিছু জানতে আমার আর বাকি নেই। ডরোথি গ্রেসনের বড় ছেলে আমি। আমার ছেলেবেলার অর্ধেকটাই কেটেছে আপনার আর মায়ের স্কুল-জীবনের গন্ধ শুনে। আমার আমেরিকায় বেড়াতে যাবার প্ল্যানটা যখন পাকা হয়ে গেল, মা আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন, আপনার সাথে অবশ্যই আমি যেন দেখা করি।

    এপ্রিলের উনিশ তারিখে কুইন এলিজাবেথ টু আমাকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক সিটি পোর্টে নোঙর ফেলবে। ওখানে আমি দু’রাতের জন্যে হোটেল রূম রিজার্ভ করেছি। তারপর ওয়াশিংটনে যাবার ইচ্ছে রাখি।

    আমি জানি, প্রেসিডেন্টের মেয়ে টিউলিপ কনওয়ের গভর্নেস আপনি। আমার ভারি শখ, সম্ভব হলে হোয়াইট হাউসটা এক বার দেখি। কিন্তু সম্ভব যদি না হয়, শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে যেখানে বলবেন সেখানেই আপনার সাথে আমি দেখা করব।

    কোন ব্যবস্থা করা যাক বা না যাক, দয়া করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লিখবেন। আপনার সাথে দেখা হওয়ার আনন্দ থেকে আমি বঞ্চিত থাকতে চাই না। মা আপনাকে ভালবাসা জানিয়েছেন।

    আন্তরিকতার সাথে

    স্যাম গ্রেসন।’

    মিসেস কেনটারকি ক’দিন পরই জবাব দিলেন:

    ‘ডিয়ার স্যাম,

    ডরোথির ছেলে! চিনি, চিনি, তোমাকে আমি চিনি। ডরোথি এমন একটা চিঠি লেখেনি যাতে তোমার গন্ধ ছিল না। অবশ্যই আমার সাথে দেখা হবে তোমার। ডরোথির ছেলে আমেরিকায় আসবে, আর আমার সাথে দেখা হবে না, এ-ও কি সম্ভব!

    তবে, দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তুমি যখন আসবে আমি তখন ওয়াশিংটনে থাকব না। প্রেসিডেন্ট এবং মিসেস কনওয়ে মেক্সিকো সফরে যাচ্ছেন। তুমি নিউ ইয়র্ক থাকার সময় ওদের যাত্রা শুরু হবে। ওরা রওনা হবার পর আমিও টিউলিপকে নিয়ে মিশিগানে চলে যাব, খুকুমণির মামার বাড়ি।

    তবু আমি তোমাকে হোয়াইট হাউস দেখাবার ব্যবস্থা করে দিতে পারি, তবে একটু ভেবে দেখো দেখি তোমার পক্ষে কি মিশিগানে আসা সম্ভব হবে?

    তোমার মাকে আমার অগাধ ভালবাসা জানাবে।

    প্রীতি এবং শুভেচ্ছা সহ

    লুসি কেনটারকি।’

    .

    ‘ডিয়ার মিসেস কেনটারকি,

    হ্যাঁ, মিশিগানে যাব আমি। প্লেনে করে ক্যালিফোর্নিয়া যাবার প্ল্যান আছে, ধারণা করছি মিশিগান বোধহয় পথেই কোথাও পড়বে। কখন এবং কোথায় দেখা করব জানাবেন।

    শ্রদ্ধা জানবেন।

    স্যাম গ্রেসন।’

    .

    ‘ডিয়ার স্যাম,

    তুমি আসতে পারবে শুনে কি যে খুশি হয়েছি! না, ক্যালিফোর্নিয়া আসার পথে মিশিগান পড়বে না, তবে পথ থেকে খুব একটা দূরেও নয়।

    মিসেস কনওয়ের ভাই লেক মিশিগান, ইণ্ডিয়ান স্প্রিঙে বাস করেন, ওখানে আমরা উঠব। ম্যাপে চোখ বুলালেই তুমি দেখতে পাবে, জায়গাটা পেটোস্কি-র একেবারে কাছাকাছি। মিসেস ল্যাঙ্গার, টিউলিপের মামী, দু’এক রাত তোমার বেড়াবার কথা শুনে আপত্তি তো করেনইনি, বরং খুশি হয়েছেন। সিক্রেট সার্ভিসকে তোমার নাম-ঠিকানা ইত্যাদি দিতে হয়েছে। আশা করি তুমি কিছু মনে করবে না। এ স্রেফ নিয়ম রক্ষা, অপরাধমূলক কোন কাজ যদি না করে থাকো, ক্লিয়ার্যান্স পেতে কোন সমস্যা হবে না।

    কখন তুমি পৌঁছাবে, তাড়াতাড়ি জানাও আমাকে, স্যাম। তোমাকে দেখব এই আশায় অস্থির হয়ে আছি। প্রীতি এবং শুভেচ্ছা সহ।

    লুসি কেনটারকি।’

    .

    গ্রেসনের আরও একটা জবাব আছে, কিন্তু রানা সেটা অন্যগুলোর সাথে সরিয়ে রাখল। আরও যা কিছু জানা দরকার, ইণ্ডিয়ান স্প্রিঙে পৌঁছে জানা যাবে। তার আগে, সামনের দুটো দিন, নিউ ইয়র্কে থাকতে হবে ওকে-গ্রেসনের ছদ্মবেশ নিয়ে। এই দু’দিন গ্রেসন যা করত, তাই করতে হবে ওকে। পকেট থেকে একটা কোয়ার্টার বের করল ও, ছুঁড়ে দিল শূন্যে, হাতের উল্টো পিঠে পড়ল সেটা। স্ট্যাচু অভ লিবার্টি। নিউ ইয়র্ক হারবার থেকে শহর দেখা শুরু করবে রানা।

    একটা সিগারেট ধরিয়ে গ্রেসনের ফাইল পুড়িয়ে ফেলল ও। বাথরূমের সিঙ্কে আগুন নিভল, ট্যাপ খুলে দিতেই ছাইগুলো নেমে গেল নর্দমায়।

    চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। মনটা যে শুধু খুঁত খুঁত করছে তাই নয়, কেন যেন মনে হচ্ছে কোথাও মারাত্মক একটা ভুল করে বসেছে ও।

    ভুলটা কি হতে পারে অনেক ভেবেও বের করতে পারল না রানা। এবার ব্যাগ থেকে নয়, পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করল। এনভেলাপের ওপর নানারকম সীল মারা। ‘শুধু যার জন্যে প্রযোজ্য তার দেখার অধিকার আছে,’ এই কথাটাও টাইপ করা রয়েছে। ভেতর থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করল রানা। কাগজটার মাথায় হোয়াইট হাউসের প্রতীক চিহ্ন ছাপা রয়েছে, প্রেসিডেনশিয়াল রাইটিং প্যাড। আরেক মাথায় তারিখ লেখা-দিন, মাস, বছর সহ। প্যাডের মাঝখানে অন্ধ কয়েকটা লাইন টাইপ করা:

    ‘এই কাজে আমার পূর্ণ সম্মতি আছে। জরুরী একটা লক্ষ্য অর্জনের জন্যে টিউলিপকে অন্ধ ক’দিন নিজের কাছে রাখার অনুমতি মাসুদ রানাকে দেয়া হলো। এর জন্যে তাকে কোনভাবেই দায়ী বা অভিযুক্ত করা যাবে না।

    প্রেসিডেণ্ট অভ ইউনাইটেড স্টেটস।’

    নিচে স্পষ্ট অক্ষরে নিজের নাম সই করেছেন প্রেসিডেন্ট। পরিচিত সই, নকল বলে মনে হলো না।

    কাগজটা এনভেলাপে ভরে, এনভেলাপটা সযত্নে পকেটে রাখল রানা। কেউ যদি বেঈমানী করে, বা কোথাও যদি কোন ঘাপলা দেখা দেয়, প্রেসিডেন্টের এই চিঠি রক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করবে।

    .

    ওয়াশিংটন মনুমেন্টের ওপর দিয়ে উদয় হলো মেরিন ওয়ান, ভোঁতা নাক আকাশের দিকে সামান্য উঁচু হয়ে আছে। হোয়াইট হাউসের দক্ষিণ লনের দিকে এগোল সেটা।

    কালো কাঁটাতারের বেড়া ঘেঁষে লোকজনের ভিড় জমে উঠেছে। তবে আগেভাগেই চিন্তা করে হেলিকপ্টারের ল্যাণ্ডিং প্যাড এমন জায়গায় তৈরি করা হয়েছে যে প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে সেদিকে এগোবার সময় দর্শকরা তাঁকে দেখতে পাবে না। সমস্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, সেইই-স্ট্রীট পর্যন্ত। আবার হেলিকপ্টার টেক-অফ না করা পর্যন্ত রাস্তাগুলোয় কিছুই নড়াচড়া করতে পারবে না।

    কোথায়, কোন্ রুট ধরে কোন্ দিকে যাবে হেলিকপ্টার, মিলিটারি পাইলট আর অন্ধ কয়েকজন সিকিউরিটি অফিসার ছাড়া কেউ তা জানে না।

    মেরিন ওয়ানের গন্তব্য এনডু এয়ারফোর্স বেস। এয়ারফোর্স ওয়ান ওখানে প্রেসিডেন্টের জন্যে অপেক্ষা করছে। প্রেসিডেন্টের মেক্সিকো সফরের জন্যে সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ক্রুরা।

    হোয়াইট হাউসের ভেতরের মাঠে সাংবাদিক আর ফটোগ্রাফাররা মাথা নিচু করে ছুটোছুটি শুরু করল। সবার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল মেরিন ওয়ান, রোটর ব্লেডের বাতাসে মাথায় এলোমেলো হলো চুল, গায়ে সেঁটে বসল শার্ট আর জ্যাকেট। ছুটে গিয়ে বিশাল যান্ত্রিক ফড়িং তার নির্দিষ্ট জায়গায় বসে পড়ল। বাতাসের বাধা না থাকায় আবার হাঁটাহাঁটি শুরু করল লোকজন।

    মিলিটারি অফিসাররা হ্যাচ খুলল, জায়গা মত বসিয়ে লক করল সিঁড়ি। কর্মচারীদের মুখ্য দু’জন সচিব ওয়েস্ট উইং দিককার ঝোপ ঘুরে বেরিয়ে এল, গম্ভীর রাশভারী চেহারা। হাতে ব্রীফকেস, কোন দিকে না তাকিয়ে হন হন করে এগিয়ে এসে মেরিন ওয়ানে উঠে পড়ল তারা।

    এরপর দেখা গেল ফার্স্ট লেডিকে। ডিপ্লোম্যাটিক এনট্রান্স দিয়ে বেরুলেন তিনি, প্রবেশ পথের ওপর রঙিন শামিয়ানা টাঙানো। ক্যামেরাগুলোর দিকে ফিরে মৃদু হাসলেন। হাত নাড়ালেন। তারপর মেয়ে টিউলিপের দিকে ফিরলেন। ভিড় এড়িয়ে, গভর্নেস মিসেস কেনটারকির সাথে দাঁড়িয়ে আছে সে, মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব। মেয়ের সাথে দু’একটা কথা বললেন ফার্স্ট লেডি, গাল টিপে দিয়ে হাসলেন, দ্রুত একবার আলিঙ্গন করলেন, তারপর উঠে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে।

    সবশেষে এলেন প্রেসিডেণ্ট। তাঁকে দেখা মাত্র সাংবাদিকদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। বৈদ্যুতিক আলোর মত তাঁর মুখে ঝিক্ করে উঠল হাসি। ঝুঁকে, মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন।

    ক্লিক, ক্লিক…। অসংখ্য ক্যামেরা সচল হয়ে উঠল। দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন প্রেসিডেণ্ট। ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এল তাঁর হাসি। গভর্নেসের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। ‘ওর দিকে ভালভাবে নজর রাখবেন।’

    মাথা ঝাঁকাল মিসেস কেনটারকি। মেয়ের সাথে কি মধুর সম্পর্ক প্রেসিডেন্টের, জানা আছে তার। বাপ এত্তোটুকুন মেয়ের সাথে এখনি এমন সব রসিকতা করেন, লজ্জায় তারই কান গরম হয়ে ওঠে মাঝে মধ্যে। চুমোর জন্যে মেয়ের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে প্রায়ই তিনি বলেন, ‘অভ্যেস করো, তা না হলে বয়-ফ্রেণ্ডদের চুমো খেতে গেলে অসুবিধে হবে।’ সবাই জানে, মেয়েকে তিনি সবার চেয়ে বেশি ভালবাসেন। মিসেস কেনটারকি প্রেসিডেন্টের হাত স্পর্শ করল, বলল, ‘আপনি জানেন তা আমি সব সময় রাখি।’

    ‘হ্যাঁ,’ প্রেসিডেণ্ট গলা পরিষ্কার করলেন। টিউলিপের দিকে তাকালেন আবার। ‘শান্ত হয়ে থেকো, মা,’ বলে তিনি কোটের বাটন-হোল থেকে একটা গোলাপ কুঁড়ি খুলে মেয়ের মাথায় পরিয়ে দিলেন, তারপর অনেকটা যেন ঝোঁকের বশে, আলিঙ্গন করলেন মেয়েকে। বিড় বিড় করে বললেন, ‘যীশু তোমাকে দেখবেন।

    মৃদু ঠেলা দিয়ে বাপকে একটু সরিয়ে দিল টিউলিপ। বাপের চোখে চোখ রেখে ঠোঁট টিপে হাসল সে। তারপর জড়িয়ে ধরল বাপকে, চুমো খেলো গালে।

    মেয়েকে পাল্টা আদর করে নামিয়ে দিলেন প্রেসিডেণ্ট। পিছন দিকে একবারও না তাকিয়ে হেলিকপ্টারে উঠে গেলেন তিনি।

    .

    ইন্সপেক্টর বব হাডসনের চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি ফুটে উঠল। ডেস্কের ওপর দিয়ে ইউনিফর্ম পরা বিট পুলিসের দিকে রাগের সাথে তাকাল সে। ‘বোয়েরী-তে আরেকটা মাতাল মারা গেছে, তো হয়েছেটা কি? এরকম তো প্রায়ই মারা যাচ্ছে।’

    কেশে গলাটা পরিষ্কার করল বিট পুলিস। ‘কিন্তু, স্যার, এই  লোকটার ব্যাপার একটু অন্য রকম।’

    ‘অন্য রকম মানে?’ জিজ্ঞেস করল বব হাডসন, কুঁচকে উঠল ভুরু। ম্যানহাটন সাউথের হোমিসাইড ডিভিশনে নতুন এসেছে সে, চীফ হয়ে। বোয়েরী তার এলাকার মধ্যে পড়ে। ওখানকার মাতালদের কুকীর্তি সম্পর্কে শুনতে শুনতে এরই মধ্যে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে তার।

    ‘লোকটার পরনে একটা আণ্ডারঅয়্যার ছিল,’ বলল বিট পুলিস। ‘আণ্ডারঅয়্যারে দোকানের নাম লেখা স্টিকার রয়েছে। রিজেন্ট স্ট্রীটের একটা দোকান, স্যার।’

    ‘রিজেন্ট স্ট্রীট? কোথায় সেটা? ব্রুকলিনে নাকি?’ জানতে চাইল হাডসন।

    ‘না, স্যার,’ বলল পুলিস লোকটা। ‘আমেরিকায় নয়, লণ্ডনে সেজন্যেই আমার মনে হলো…’

    ‘লণ্ডন, মানে ইংল্যাণ্ড?’ দাঁতের ফাঁকে চুরুট তুলতে গিয়েও থেমে গেল হাডসন।

    মাথা ঝাঁকাল বিট পুলিস। ‘গায়ে কাপড়চোপড় যা রয়েছে, সব নোংরা, পুরানো, দু’এক জায়গায় ছেঁড়া। কিন্তু আণ্ডারঅয়্যারটা একেবারে আনকোরা নতুন। কিভাবে সম্ভব? তাও আবার লণ্ডন থেকে কেনা!’

    ‘তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে চুরুট নিভে গেল,’ অভিযোগের সুরে বলল হাডসন। ‘তবে, হ্যাঁ, তোমার সাবজেক্টটা ইন্টারেস্টিং।’ নতুন করে চুরুট ধরিয়ে একগাল সুগন্ধি ধোঁয়া ছাড়ল সে। তারপর চিন্তিত দৃষ্টিতে পেট্রলম্যানের দিকে তাকিয়ে থাকল। ‘কাজেই, পোস্ট মর্টেমের নির্দেশ দিতে হয়। সব ব্যবস্থা করে ফেলো তাহলে। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সাথেও যোগাযোগ করো, বুঝলে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট চেক করো। হতভাগা আদম সন্তানটি কে ছিল আমি জানতে চাই।’

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ১৪৪ – অপহরণ-২
    Next Article মাসুদ রানা ৪৫৯ – অন্তর্যামী

    Related Articles

    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৩৮৫-৩৮৬ – হ্যাকার (দুই খণ্ড একত্রে)

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৬ – টপ টেরর

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৪ – নরপশু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৩ – ধর্মগুরু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫২ – কালো কুয়াশা

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫১ – মায়া মন্দির

    July 22, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    শ্রীশ্রীচণ্ডী – অনুবাদ : পঞ্চানন তর্করত্ন

    September 9, 2025

    পুলিশ কাহিনী ১ – পঞ্চানন ঘোষাল (প্রথম খণ্ড)

    September 9, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.