Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    শ্রীশ্রীচণ্ডী – অনুবাদ : পঞ্চানন তর্করত্ন

    September 9, 2025

    পুলিশ কাহিনী ১ – পঞ্চানন ঘোষাল (প্রথম খণ্ড)

    September 9, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ১৪৩ – অপহরণ-১

    কাজী আনোয়ার হোসেন এক পাতা গল্প181 Mins Read0

    অপহরণ-১.৮

    আট

    ল্যাঙ্গার পরিবারের বাড়িটা খাঁটি ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য রীতির নিদর্শন হলেও, মূল অংশের সাথে অন্যান্য যে-সব অঙ্গ-কাঠামো যোগ হয়েছে সেগুলোকে কোন রীতির সাথে মেলানো কঠিন কোথাও কোথাও বারান্দার পরিসর ছোট করে সেখানে তোলা হয়েছে উল্লট আকৃতির ঘর, খামখেয়ালী করে যেখানে-সেখানে তৈরি করা হয়েছে দরজা বা জানালা। গোটা বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের ঢালে, চারদিক থেকে গাছপালা দিয়ে ঘেরা, বাড়ি থেকে লেক মিশিগান পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। কাঁটাতারের ঘেরা আছে, সেটা নিচের বালুকাবেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। রাস্তার ধারের অন্যান্য বাড়িগুলোও বড় আকারের, পরস্পরের কাছ থেকে দূরে, এবং সুরক্ষিত।

    বাড়িটায় ঢোকার দুটো মাত্র পথ-সৈকত একটা, অপরটা সামনের গেট। গেট খুললেই বাইরে গাড়ি-পথ, পথটা বড় রাস্তার সাথে মিশেছে। প্রেসিডেন্টের মেয়ে এখানে আসার পর থেকে দুটো পথই পাহারা দিচ্ছে ইউ.এস. সিক্রেট সার্ভিস। একটা পিঁপড়ে গলার উপায় নেই।

    বুধবার সকাল, রানা স্যাম গ্রেসনের ভূমিকা নেয়ার পর দু’দিন পেরিয়ে গেছে। গাড়িটা সামনের গেটে থামাল ও, গেট-হাউস থেকে একজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখে হাতল ঘুরিয়ে জানালার কাঁচ নামাল।

    লম্বা-চওড়া লোক, পরনে সাধারণ একটা বিজনেস স্যুট, বুকের সামনে কোটের ভাঁজে লাল আর সাদা রঙ করা একটা পিন। বগলের কাছটা ফুলে নেই, কিন্তু রানা জানে শোল্ডার হোলস্টার পরে আছে লোকটা।

    সিক্রেট সার্ভিস এজেণ্ট, কাজেই বেল্টের সাথে আটকানো আছে ট্র্যান্সমিটার। তার দুটো দেখা গেল। একটা জ্যাকেটের ভেতর দিয়ে ওপর দিকে উঠেছে, কলারের কাছে বেরিয়ে একটা প্লাস্টিক প্লাগের সাথে জোড়া লেগেছে, প্লাগটা রয়েছে লোকটার কানের ভেতর, হিয়ারিং এইড-এর মত। অপরটা বেরিয়েছে বাঁ আস্তিন থেকে, হাত সমান উঁচুতে একটা মাইক্রোফোনের ভেতর ঢুকেছে সেটা।

    মাইক্রোফোনের সুইচ সারাক্ষণ অন করা থাকে।

    ‘গুডমর্নিং,’ বলল রানা। লক্ষ করল, গেট-হাউসের ভেতর আরও একজন লোক রয়েছে, কাঁচের জানালায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে এদিকে।

    ‘আপনার কোন সাহায্যে আসতে পারি?’ জিজ্ঞেস করল এজেণ্ট।

    ‘আমি স্যাম গ্রেসন।’

    সামনের দিকে ঝুঁকল লোকটা, তীক্ষ্ণ চোখে ভেতরটা দ্রুত জরিপ করে নিল।

    ‘ইয়েস, মি. গ্রেসন। আপনার আইডেনটিফিকেশন।’ হাত পাতল সে।

    গ্রেসনের পাসপোর্ট বের করল রানা, জানালা দিয়ে বাড়িয়ে দিল।

    খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল এজেণ্ট। মুহূর্তের জন্যে তাকে ইতস্তত করতে দেখল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে গেট-হাউসের দিকে লোকটা তাকাতে একটা হার্টবিট মিস করল ও। বিসমিল্লাতেই গলদ নাকি?

    পাসপোর্ট থেকে চোখ সরিয়ে রানার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল এজেণ্ট। ‘এক মিনিট।’ সিধে হলো সে, ঘুরল, ব্যস্ত পায়ে এগোল গেট-হাউসের দিকে।

    মনে সংশয় দেখা দিলেও আত্মবিশ্বাস হারাল না রানা। যেন সন্দেহ হয়েছে বা কোন জালিয়াতি ধরা পড়েছে, এরকম ভান করা সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের স্বভাব। আসলে হয়তো কিছুই না। আগন্তুকদের নার্ভ পরীক্ষা করার এটা একটা কৌশল। কান খাড়া করল রানা। কিন্তু গেট-হাউস থেকে মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। তবে দু’জনকেই দেখতে পাচ্ছে ও। আলোচনা শেষ করে দু’জনেই রানার দিকে ফিরল, জানালা দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকার পর ওদের একজন হাত বাড়িয়ে তুলে নিল টেলিফোনের রিসিভার।

    সঙ্কটময় মুহূর্ত, শুরু না হতেই ব্যাপারটা কেঁচে যেতে পারে। আত্মবিশ্বাসে একটু চিড় ধরল রানার। সাথে কোন অস্ত্রও নেই। স্যাম গ্রেসনকে সার্চ করা যেতে পারে, না-ও হতে পারে। ঝুঁকিটা রানা নেয়নি

    কথা শেষ করে ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখল লোকটা। সঙ্গীকে কি যেন ইঙ্গিত করল। সঙ্গী, প্রথম লোকটা, গেট-হাউস থেকে বেরিয়ে এল। সোজা রানার দিকে চোখ রেখে হেঁটে আসছে। তার হাবভাবে একটা ঢিলেঢালা ভাব রানার দৃষ্টি এড়াল না।

    ‘সব ঠিক আছে বলেই মনে হচ্ছে, মি. গ্রেসন,’ পাসপোর্টটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল এজেণ্ট। ‘আপনার লাগেজগুলো দেখতে হবে।’

    ‘অবশ্যই।’

    গাড়ি থেকে নেমে পিছনে চলে এল রানা, তালায় চাবি ঢুকিয়ে বুট খুলল। রানা এক পাশে সরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল এজেন্ট, তারপর ওর সুটকেসের ঢাকনি তুলে ভেতরটা নেড়েচেড়ে দেখল। অভ্যস্ত, দক্ষ হাত। প্রচুর সময় নিয়ে পরীক্ষা করল ক্যামেরা ব্যাগটা। দ্রুত হাতে খুলে ফেলল ক্যামেরার কয়েকটা পার্টস। প্রতিটি অতিরিক্ত ফিল্ম খুঁটিয়ে দেখল। ইতোমধ্যে ব্যাক সীটের পিছনে কাঁচ-ঢাকা জানালার কার্নিসে বার কয়েক তাকানো হয়ে গেছে। বাদামী কাগজে মোড়া বড়সড় একটা প্যাকেট রয়েছে ওখানে।

    ক্যামেরা ব্যাগ রেখে দিয়ে রানার দিকে তাকাল এজেণ্ট। ‘প্যাকেটে কি?’

    এক গাল হাসল স্যাম গ্রেসন ওরফে মাসুদ রানা। ‘প্রেসিডেন্টের মেয়ের জন্যে সামান্য একটা উপহার।’

    প্যাকেটটা ধরে নিজের দিকে টানল এজেণ্ট। ‘ভাগ্যিস উপহার প্যাকেট করার জন্য আলাদা কোন পয়সা দিতে হয় না।’

    রানা একটু আহত হবার ভান করে জিজ্ঞেস করল, ‘তারমানে কি আপনারা…?’

    ‘হ্যাঁ, মি. গ্রেসন। প্যাকেটটা ছিঁড়ে দেখতে হবে আমাদের। নিয়ম, ভাই। সমস্ত উপহার আমাদের পরীক্ষা করতে হয়। ওটা আপনাকে রেখে যেতে হবে।’

    কাঁধ ঝাঁকাল রানা, ‘ঠিক আছে।’

    প্যাকেটটা বুকের সাথে চেপে ধরে গেট-হাউসের দিকে হাঁটা দিল এজেণ্ট। মাঝপথে থামল সে, ফিরল রানার দিকে। ‘এবার আপনি ভেতরে ঢুকতে পারেন। গাড়ি-পথের পর বাঁ দিকে বাঁক নেবেন। গ্যারেজটা পিছন দিকে। ওঁরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’

    .

    এক এক করে দুটো রিপোর্টই পড়ল ইন্সপেক্টর বব হাডসন। থমথমে হয়ে উঠল চেহারা।

    প্রথম রিপোর্টটা এসেছে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে। হতভাগা আদম সন্তান যে ব্রিটিশ নাগরিক, সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার, স্যাম গ্রেসন। ইয়ার্ডের ফাইলেই তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে-না, তার কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। এক সময় রয়্যাল এয়ারফোর্সে চাকরি করেছিল।

    দ্বিতীয়টা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি যাতে বলা চলে অস্বাভাবিক কোন কারণে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু, আশ্চর্য, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকেও মারা যায়নি লোকটা। নার্ভাস সিস্টেম বা ব্রেনে কোন ক্ষতি হয়নি। রক্তে অ্যালকোহলের পরিমাণ প্রচুর, নেশাগ্রস্ত হবার জন্যে যথেষ্ট, তবে লিভার তাতে রিয়্যাক্ট করেনি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

    পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে নির্জলা একটা সত্যই বেরিয়ে আসে। আটাশ বছরের এক যুবক মারা গেছে, অথচ বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা মৃত্যুর কারণ বলতে পারছেন না। কিভাবে এবং কেন, কোন প্রশ্নেরই উত্তর তাঁদের জানা নেই।

    এটাও একটা উত্তর। একটা প্রমাণ।

    আপনমনে মাথা ঝাঁকাল ইন্সপেক্টর বব হাডসন। স্যাম গ্ৰেসন কে জানে সে। কিন্তু লোকটা সম্পর্কে আরও অনেক কথা জানতে হবে তাকে। দেরাজ খুলে ভেতর থেকে একটা সরকারি ফর্ম বের করল সে। ফর্মটা পূরণ করে পাঠালেই ওয়াশিংটন, এফ.বি.আই.কমপিউটর থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য এসে যাবে।

    .

    দরজায় একজন হাউজকীপার অপেক্ষা করছিল, পথ দেখিয়ে দোতলায় নিয়ে এসে রানাকে ওর কামরায় দিয়ে গেল। ছোটখাট মহিলা, আলাপী, হাসিটুকু লেগেই আছে মুখে। মি. গ্রেসন, আপনি এসেছেন শুনে মিসেস কেনটারকি যা খুশি হবেন না! কখন থেকে তাগাদা দিচ্ছেন আমাকে, দেখো না ছেলেটা এল কিনা! এই মুহূর্তে টিউলিপকে নিয়ে তিনি ব্যস্ত, ছাড়া পেলেই চলে আসবেন। বেশিরভাগ দিন একটা থেকে তিনটে পর্যন্ত ঘুমায় টিউলিপ। এই দু’ঘণ্টা, আর সাতটার পর-টিউলিপ যখন রাতের জন্যে বিছানায় ওঠে-ব্যস, নিজের সময় বলতে মিসেস কেনটারকির এটুকুই। বড় ভাল মানুষ, আমাদের মিসেস কেনটারকি। এত নরম।

    ঠোঁটে মৃদু হাসি, কোমল দৃষ্টি চোখে, মাথা ঝাঁকাল রানা।

    ‘কিছু দরকার হলে রিঙ করবেন,’ দরজার কাছে থেমে বলল হাউজকীপার। ‘বসে বসে অপেক্ষা করতে যদি খারাপ লাগে, যেখানে খুশি বেড়িয়ে আসতে পারেন। সৈকতের দিকে যদি যান, ভাল লাগবে।

    ‘ধন্যবাদ, হয়তো একবার যেতেও পারি।’ একা হয়েই একটা সিগারেট ধরাল রানা, গ্রেসনের রূপালী সিগারেট কেস টেবিলে রেখে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সামনেই লন, তারপর লেক। এক ধারে গাছপালার ফাঁকে গেস্ট হাউসের ছাদ দেখা গেল। জানালা দিয়ে যা কিছু দেখল, সব গেঁথে নিল মনে। ও জানে, সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা গেস্ট হাউসটাকে অপারেশন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করছে। ওখান থেকেই তারা সরাসরি যোগাযোগ রাখে ওয়াশিংটন হেডকোয়ার্টারের সাথে।

    গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দুটো আগেই পেয়েছে রানা, হাউজকীপার জানিয়ে গেল, ওগুলো নির্ভুল। রাতে টিউলিপের শুতে যাবার সময়টা-সন্ধে সাতটা। আর, ইচ্ছে করলেই যখন খুশি বাড়ির সবখানে যেতে পারবে ও। এর আগে কাগজ-পত্রে দেখেছে ও, এখন ঘুরেফিরে নিজের চোখে দেখতে পাবে সব। চোখে দেখাটা জরুরী: বাড়ি থেকে লেক কত দূরে, কাঁটাতারের বেড়া কোত্থেকে শুরু হয়ে কোথায় থেমেছে, গার্ডরা কে কখন কোথায় থাকে।

    মুখে সিগারেট নিয়ে জানালার দিকে পিছন ফিরল রানা। সুটকেস খুলে ভেতর থেকে কাপড়চোপড় বের করল। ও বের না করলে, চাকরদের কেউ করতে পারে। সুটকেসটা কেউ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করুক চায় না ও।

    তবে চাকরবাকররা রহস্যটা ধরতে পারবে বলে মনে হয় না। সিক্রেট সার্ভিস এজেণ্ট তো পারেনি। সুটকেসের তলায় একটা ফলস বটম রয়েছে, আসলে ঠিক ফলস বটম নয়; ওটাকে স্রেফ দ্বিতীয় একটা স্তর বলা যেতে পারে-আক্ষরিক অর্থে, তৃতীয় স্তর। ওখানে আর কিছু নয়, শুধু বাদামী, বেশ বড়, চ্যাপ্টা একটা ব্যাগ আছে। ফলস বটমের সাথে এমনভাবে সাঁটা, ওটার অস্তিত্ব টের পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এক্স-রে করলেও ধরা পড়বে না। সহজে খোলার কোন উপায় নেই। গোপন কোন কৌশল, ব্যাপারটা তাও নয়; লুকানো কোন লিভারও নেই। সেলাই খোলার জন্যে ছুরি লাগবে।

    রানা যে কোন ঝুঁকি নিচ্ছে, ঠিক তা নয়। প্ল্যানটা সফল করার জন্যে একটা জিনিস একান্তই ওর দরকার, বাদামী পেপার ব্যাগে করে সেটাই নিয়ে এসেছে ও। না, কোন আগ্নেয়াস্ত্র নয়। অস্ত্র নিয়ে আসার মত বোকামি করছে না ও।

    তবে জিনিসটাকে খেলনাও বলা চলে না।

    .

    ইন্সপেক্টর বব হাডসনের কাছে এফ.বি.আই. রিপোর্ট পৌঁছুল। তিন হপ্তা আগে পর্যন্ত স্যাম গ্রেসনকে ওরা চিনত না। একুশ দিন আগে সিক্রেট সার্ভিস তার সম্পর্কে একটা সিকিউরিটি ইনভেস্টিগেশনের নির্দেশ দেয়। স্যাম গ্রেসন তদন্তে উতরে যায়, কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। তদন্তের রিপোর্ট সিক্রেট সার্ভিসকে পাঠিয়ে দিয়েছে এফ.বি.আই.।

    সিক্রেট সার্ভিস? সিক্রেট সার্ভিস কেন স্যাম গ্রেসনকে নিয়ে মাথা ঘামাল?

    একটা সিগারেট ধরাল বব হাডসন। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে না সাপ বেরিয়ে পড়ে, ভাবল সে। রানার উপহার খুব কাজ দিল।

    প্রথম দিনই সিক্রেট সার্ভিসের লোকেরা রানার ঘরে রেখে গেল ওটা। ডিনার সেরে ঘরে ফিরে দেখতে পেল রানা। পরদিন সকালে ও টিউলিপকে দিল ওটা।

    কাগজের মোড়ক খুলল রানা, মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুদ্ধশ্বাসে টিউলিপ বলল, ‘গ্রিজলি বেয়ার! ও মা, এ যে দেখছি আমার চেয়েও বড়!’

    ‘প্ৰায়।’

    ‘তুমি খুব ভাল,’ মৌখিক হলেও, মূল্যবান একটা সার্টিফিকেট পেয়ে গেল রানা। ডান হাতের একটা আঙুল রানার মুখের সামনে তুলল সে। ‘তোমার সাথে আমার চিরকালের ভাব হয়ে গেল।’

    ‘ও, আচ্ছা, তাই নাকি?’ টিউলিপের তর্জনীর সাথে নিজের তর্জনী এক করল রানা।

    খেলনা ভাল্লুকটাকে আদর করতে করতে টিউলিপ বলল, ‘তুমি একটা আনাড়ি।

    থতমত খেয়ে রানা জিজ্ঞেস করল, ‘কেন বলো তো?

    ‘কিছু যদি না বোঝো, জিজ্ঞেস করে বুঝে নিতে হয়, বুঝলে?’

    ‘ও, আচ্ছা…!’

    ‘থাক, আর ও-আচ্ছা করতে হবে না,’ ভাল্লুকের গায়ে একটা হাত রাখল টিউলিপ, আরেক হাত পাকা গিন্নীর মত রাখল নিজের কোমরে। ‘চিরকালের ভাব মানে বোঝো তুমি? মানে হলো, তোমার সাথে আমি কখনও আড়ি নিতে পারব না।’

    ‘বাহ, খুব মজা হবে তাহলে…।’

    খিল খিল করে হেসে উঠল টিউলিপ। ‘কিছুই দেখছি জানো না! যখনই আমি বললাম তোমার সাথে আমার চিরকালের ভাব হয়ে গেল তখুনি তোমার উচিত ছিল গালটা নিচু করা, আমি যাতে পা__ দিতে পারি।’

    ‘দুঃখিত, ভুল হয়ে গেছে,’ বলে ঝুঁকল রানা, ওর গালে চুমো খেলো টিউলিপ।

    টিউলিপের সাথে পরিচয় কালই হয়েছে, কিন্তু মিসেস কেনটারকির বন্ধু হিসেবে রানাকে সে মিষ্টি একটু হাসি উপহার দিয়েই গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল, কাছে আসার বা ঘনিষ্ঠ হবার কোন চেষ্টা করেনি। এই বয়সেই তাজ্জব হবার মত ব্যক্তিত্ব মেয়েটার। তার সবকিছুর মধ্যে মার্জিত একটা ভাব রয়েছে। মনে মনে রানা খুশি, টিউলিপের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দরকার ছিল, সেটা পাওয়া গেছে।

    ভাল্লুকটাকে নিয়ে মেতে উঠল টিউলিপ, সেদিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল রানা। মেয়েটার আনন্দ ওর মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে। এত দামী একটা উপহার দেখে মিসেস কেনটারকি মৃদু আপত্তি তুলল। রানা বলল, ‘দোকানের শো-কেসে দেখে ঝোঁকটা সামলাতে পারলাম না।’

    মিসেস কেনটারকি গর্বের ভাবটুকু চেহারায় লুকিয়ে রাখতে পারল না। এই উপহার হোয়াইট হাউসে তার মর্যাদা আরেকটু বাড়াবে। ওখানে ফিরে গিয়ে সবাইকে সে বলতে পারবে, আমার বান্ধবীর ছেলে দিয়েছে। চাপা হাসি ফুটল তার মুখে। তবে জিনিসের মত জিনিস, দিলে এই রকম উপহারই দিতে হয়। আমি খুশিই হয়েছি, স্যাম।’

    ‘ধন্যবাদ, মিসেস কেনটারকি। টিউলিপ, দেখো দেখাই, হাত-পা কেমন নড়াচড়া করে…,’ সামনের দিকে ঝুঁকে কোথায় চাবি আছে দেখিয়ে দিল ও।

    আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল টিউলিপ, নতুন করে মেতে উঠল খেলনাটাকে নিয়ে। হাত-পা শুধু সামনে আর পিছনে আসা-যাওয়া করে, কিন্তু টিউলিপ সেগুলোকে এ-পাশে ও-পাশে ঘোরাতে চেষ্টা করল। শক্ত করে তৈরি করা হয়েছে, সহজে ভাঙবে না।

    সিগারেট ধরিয়ে মিসেস কেনটারকির দিকে ফিরল রানা। ‘দেশে, মানে, লণ্ডনে কখনও যাবেন বলে মনে হয়?’ মৃদু হেসে জানতে চাইল ও।

    ‘বোধহয় না,’ বলে টিউলিপের দিকে তাকাল মিসেস কেনটারকি। ‘বাচ্চাটার সাথে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছি, বুঝতেই তো পারো। ও যেন আমারই সন্তান…।

    মেঝে থেকে একটা চিৎকার উঠল।

    কামরার অন্য মাথায় বসে রয়েছে একজন এজেন্ট, চমকে উঠে তাকাল সে। কোন বিপদ নয় বুঝতে পেরে আবার চেয়ারে হেলান দিল সে, মুখ গুঁজল পেপারব্যাক বইটায়।

    টিউলিপের দিকে তাকাল রানা। প্রায় কেঁদে ফেলার মত অবস্থা হয়েছে মেয়েটার, চোখে টলমল করছে পানি। ভাল্লুকটা কাত হয়ে পড়ে রয়েছে কার্পেটে, একটা বাহু টিউলিপের হাতে। বাহুটার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে বেচারি। মুখ তুলে রানার দিকে একবার তাকাল, ভেজা দৃষ্টিতে অপরাধী ভাব।

    ‘আশ্চর্য, হাতটা ছিঁড়ল কিভাবে!’ চেয়ার ছেড়ে কার্পেটে উবু হয়ে বসল রানা। ‘কই, দেখি তো!’ টিউলিপের কাছ থেকে নিয়ে হাতটা পরীক্ষা করল ও। তারপর ভাল্লুকের গায়ে, যেখান থেকে হাতটা খসে গেছে, ভাল করে দেখল। ভেতরে সাদা তুলো দেখা গেল। এদিক ওদিক মাথা নাড়ল রানা। ‘কিসের সাথে আটকে ছিল কে জানে, গায়েব হয়ে গেছে।’ অক্ষত দ্বিতীয় বাহুটা টেনে-টুনে পরীক্ষা করতে গেল ও, সেটাও খসে এল।

    নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না টিউলিপ, ফুঁপিয়ে কেদে উঠল। তার মাথায় একটা হাত রাখল রানা। ‘ছি-ছি, কাঁদে না। খুলে গেছে তো কি হয়েছে, আবার জোড়া লাগিয়ে দেয়া যাবে…।’

    ছুটে গিয়ে মিসেস কেনটারকির কোলে মুখ গুঁজল টিউলিপ। তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠল।

    মিসেস কেনটারকির দিকে তাকাল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘আর জোড়া লাগানো গেছে! ওটা আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাব। নতুন একটা আদায় না করে দোকানদারকে ছাড়ছি না!’

    .

    সেদিনই, আরও পরে, টিউলিপকে নিয়ে মিসেস কেনটারকি বাইরে বেড়াতে বেরুল। গার্ড হিসেবে কয়েকজন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টও গেল ওদের সাথে। চাকরবাকর, কর্মচারী, সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট, সবার দৃষ্টি এড়িয়ে চুপিসারে দোতলায় নিজের কামরায় উঠে এল রানা। দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ও। না, ওর পিছু নিয়ে কেউ দোতলায় ওঠেনি। অন্তত করিডরে কারও পায়ের আওয়াজ নেই। ক্লজিট থেকে সুটকেসটা নামাল ও। ফলস বটমের চারদিকে ছুরি চালিয়ে বাদামী পেপার ব্যাগটা বের করল।

    সন্তর্পণে দরজা খুলল রানা। সাথে সাথে ছুটে পালাল একটা বিড়াল। ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে শুরু করল দেয়ালঘড়িতে। টিক টিক করে উঠল একটা টিকটিকি। ধীর পায়ে করিডর ধরে এগোল রানা। হলরূমে কেউ নেই, তবে একদিকের করিডরে ফিসফিস করে যুবতী চাকরানীর সাথে কথা বলছে প্রৌঢ় এক কর্মচারী। রানাকে দেখে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল দু’জনেই, তাড়াতাড়ি সরে গেল ওখান থেকে।

    হলরূমে কিছুটা সময় কাটাল রানা। এক সময় বুঝল, ধারে কাছে কেউ নেই। মিসেস কেনটারকির কামরার দিকে এগোল ও। পাশাপাশি দুটো কামরা, একটা টিউলিপের। দুটো ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। হলরূম থেকে মিসেস কেনটারকির ঘরে ঢুকল রানা। ঢুকেই আস্তে করে বন্ধ করে দিল দরজা।

    মিসেস কেনটারকির ড্রেসিং টেবিল দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে। সাবধানে, কোন আওয়াজ না করে, দেয়ালের কাছ থেকে সেটাকে সরাল রানা। ড্রেসারের পিছনে হার্ডবোর্ড, টেপ দিয়ে তাতে পেপার ব্যাগটা আটকাল। টেবিলটা আবার জায়গা মত বসিয়ে চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ল স্বস্তির।

    মাঝখানের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলল রানা। দোরগোড়া থেকেই দেখতে পেল, খেলনা ভাল্লুকটা বিছানার গোড়ায়, কার্পেটের ওপর পড়ে রয়েছে। কাছের একটা টেবিলে রয়েছে বাহু জোড়া। আপনমনে মাথা ঝাঁকাল রানা, দরজা বন্ধ করে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে।

    .

    ওয়াশিংটন, সিক্রেট সার্ভিস হেডকোয়ার্টার। ডেস্কে ফিরে এসে একটা চিরকুট পেল জেরি অ্যাডামস। চিরকুটে বলা হয়েছে, নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিসের ইন্সপেক্টর বব হাডসনকে টেলিফোন করতে হবে তার। খুবই নাকি জরুরী ব্যাপার।

    রিসিভার তোলার জন্যে ফোনের দিকে হাত বাড়াল জেরি অ্যাডামস।

    হঠাৎ তার চোখ পড়ল হাতঘড়ির দিকে। সর্বনাশ! ডেপুটি ডিরেক্টরের সাথে মীটিং আছে না! সেটাও তো ভয়ানক জরুরী। উঁহুঁ, ইন্সপেক্টর বব হাডসনকে অপেক্ষা করতে হবে।

    .

    ল্যাঙ্গার পরিবারের সাথে নির্বিঘ্নে দুটো দিন কাটিয়ে দিল রানা। টিউলিপের মামার সাথে রাজনীতি, আর মামীর সাথে থিয়েটার নিয়ে আলাপ করল। ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ছেলেকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হলো মিসেস কেনটারকি, তবে টিউলিপের দায়িত্ব ঘাড়ে থাকায় খাতিরের নামে রানার ওপর অত্যাচার চালাবার সুযোগ পেল না সে। যাকে রানা চেনেই না, সেই গ্রেসনের মা সম্পর্কে মজার মজার গন্ধ শুনল রানা মিসেস কেনটারকির মুখে, সবই ছেলেবেলার। চাকরবাকর আর কর্মচারীদের সাথেও খুব ভাব হয়ে গেল ওর। সিকিউরিটি গার্ডরা সবাই গম্ভীর প্রকৃতির, কিন্তু রানার সদা প্রসন্ন উপস্থিতি তাদের চেহারাতেও কোমল একটা ভাব এনে দিল। সুযোগ সময় পেলেই তাদের সাথে গন্ধ করল রানা। আর টিউলিপের সাথে, তাকে নিয়ে প্রচুর ছবি তুলল।

    এমন মেহমান হয় না, একবাক্যে স্বীকার করল সবাই। যেমন ভদ্র, তেমনি মার্জিত। দ্বিতীয় দিনের শেষ ভাগে ওকে বিদায় নিতে দেখে সবারই মন খারাপ হয়ে গেল। মাত্র দু’দিনেই লোকটা যেন আপনজন হয়ে উঠেছিল।

    টিউলিপের মামী আর মিসেস কেনটারকি সামনের ঘরে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল। রাত আটটা। ব্যাগগুলো নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল রানা।

    মিসেস কেনটারকি বাড়িয়ে দিল হাতটা। ‘এত তাড়াতাড়ি তুমি চলে যাচ্ছ, মেনে নিতে ইচ্ছে করছে না,’ বলল সে। ‘কথা দাও, সময় করে আবার একবার বেড়াতে আসবে।’

    হ্যাণ্ডশেক করল রানা। ‘আমেরিকায় এলে নিশ্চয়ই আসব।’ মিসেস কেনটারকির পিঠে একটা হাত রাখল ও, ঝুঁকে চুমো খেলো গালে। ‘মাকে আপনার গন্ধ শোনাবার জন্যে অস্থির হয়ে আছি।’

    গভর্নেসের চোখ ছলছল করে উঠল। ‘স্যাম, তোমার মাকে আমার ভালবাসা জানাবে। বলবে, এরপর যেন তোমার সাথে সে-ও একবার এসে বেড়িয়ে যায়।

    ‘বলব। আপনার স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখবেন। পৌঁছেই চিঠি দেব।’ ব্যাগ তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল রানা। হঠাৎ থমকাল ও, দ্রুত ঘুরল। চেহারা দেখে মনে হলো, কি যেন মনে পড়ে গেছে। ‘ধেত্তেরি, ভাল্লুকটার কথা একদম ভুলে গেছি!’

    ‘তাই তো! কিন্তু…থাক না, স্যাম।’

    ‘থাকবে মানে?’ হেসে ফেলল রানা। ‘এত শখ করে একটা উপহার দিলাম, তাও কিনা ভাঙা! কচি মেয়েটা কি রকম দুঃখ পাবে বলুন তো। না-না…।’ ব্যাগগুলো মেঝেতে নামিয়ে রেখে, কারও দিকে না তাকিয়ে, সিঁড়ির দিকে হন হন করে এগোল ও।

    ঘরে ঢুকে রানা দেখল, টিউলিপ ঘুমাচ্ছে। দরজা বন্ধ করল, কিন্তু তালা লাগাল না। দরজার সামনেই এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল স্থির হয়ে, শব্দটা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করল। না, বাইরে থেকে আসছে না। টিউলিপের নিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজ।

    নিঃশব্দ পায়ে এগোল রানা। বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। জ্যাকেটের বুক পকেট থেকে এরই মধ্যে হাতে চলে এসেছে একটা ঝর্না কলম। ক্যাপ খুলল, বেরিয়ে পড়ল সূঁচাল সিরিঞ্জের ডগা। ডগাটা টিউলিপের নগ্ন বাহুতে ঠেকাল ও।

    প্লাঞ্জারে মৃদু চাপ দিল রানা। ধীরে ধীরে বাড়াল চাপ। পরিমিত মাত্রায় সোডিয়াম পেন্টোথাল পুশ করছে ও।

    চামড়া ফুঁড়ে সূঁচের ডগা ভেতরে ঢুকতেই ঝাঁকি খেলো টিউলিপের হাত। তার হাতের সাথে রানার হাতও নড়ল, তবে চামড়ায় ঢুকে পড়া সূঁচের ডগা এক চুল কাঁপল না। মুহূর্তের জন্যে চোখ মেলল টিউলিপ, তারপরই ক্লান্তিতে বুজে এল। এই মুহূর্তে চেতন আর অচেতন অবস্থার মাঝখানে রয়েছে মেয়েটা। ওষুধের মাত্রা একটু বেশি হয়ে গেলে, মারা যেতে পারে। মাত্রা বেশি হয়ে গেছে কিনা বুঝতে হলে মেডিকেল ইকুইপমেন্টের সাহায্য দরকার, কিন্তু সে-সব রানার হাতের কাছে নেই। নিজের বিচার বুদ্ধি আর আন্দাজের ওপর কাজ করছে ও। টিউলিপের বয়স, ওজন, ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে মাত্রা ঠিক করা হয়েছে, ভুল হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

    ইঞ্জেকশন পুশ করার পর টিউলিপকে পরীক্ষা করল রানা। পালস রেট যা আশা করেছিল, তাই; বিচলিত হওয়ার মত কিছু নয়। হার্টবিটও নিয়মিত। বিছানার কাছ থেকে দ্রুত সরে এল রানা।

    ড্রেসিং টেবিলের পিছনে হাত গলিয়ে বাদামী পেপার ব্যাগটা খুলে আনল ও। ব্যাগের ভেতর থেকে বেরুল একটা গ্রিজলি বেয়ার-বড়সড় আরও একটা খেলনা ভাল্লুক। এটারও বাহু নেই। তবে প্রথমটার সাথে দু’জায়গায় অমিল আছে। এটার ঘন পশমের ভেতর লুকানো চেইন আছে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত লম্বা, টানলে মাঝখান থেকে দু’ভাগ হয়ে খুলে যায় খেলনাটা। আর, ভেতরে কিছু নেই, চ্যাপ্টা। ভেতর দিকে বেলুনের মত কোমল গা। চাপ পড়লে বেলুনের মতই ফুলে উঠবে ভাল্লুক। প্লাস্টিক নাকের ফুটোগুলো দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারবে।

    চ্যাপ্টা ভাল্লুকটাকে মেঝেতে ফেলে সমান করল রানা। সিধে হয়ে আবার একবার পরীক্ষা করল টিউলিপকে। তারপর বুকে তুলে নিল তাকে। ওর পিছনে খুলে গেল ঘরের দরজা।

    ধ্বক করে উঠল রানার বুক।

    ‘স্যাম, আমি…।’ মিসেস কেনটারকি বোবা বনে গেল। দোরগোড়ায় পাথর হয়ে গেছে সে। মুখ ঝুলে পড়ল, চোখ জোড়া বিস্ফারিত। আতঙ্কে বিকৃত হয়ে উঠল তার চেহারা। ‘স্যাম!’

    টিউলিপকে বুকে নিয়েই মিসেস কেনটারকির দিকে এগোল রানা, এখন আর নামাবার সময় নেই। এক পা পিছিয়ে চৌকাঠের ওপর দাঁড়াল মিসেস কেনটারকি। রানার চেহারায় উদ্বেগ। ‘দেখুন তো, টিউলিপ কেমন হাঁপাচ্ছে—বোধহয় অসুস্থ,’ শান্ত গলায় বলল ও।

    ‘অ্যা? কি? ও, আচ্ছা, তাই বলো…।’ এগিয়ে এল গভর্নেস, টিউলিপকে নেয়ার জন্যে বাড়িয়ে দিল হাত দুটো। এরই মধ্যে ঘাম দেখা দিয়েছে তার চেহারায়। তবে আগের চেয়ে অনেকটা শান্ত। হতভ’ মনে হলো, কিন্তু আতঙ্ক কাটিয়ে উঠেছে।

    প্রৌঢ়ার হাতে টিউলিপকে তুলে দিল রানা, কিন্তু মেয়েটার পিঠে একটা হাত থেকেই গেল। পিছিয়ে আসার ভান করে মিসেস কেনটারকির মুখের দিকে অপর হাতটা তুলল ও। চমকে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল মিসেস কেনটারকি। তার কানের পিছনে পৌঁছে গেল রানার হাত, আঙুল দিয়ে নার্ভ সেন্টারে জোরে একটা খোঁচা মারল।

    পিছুতে গিয়ে টিউলিপকে ছেড়ে দিল মিসেস কেনটারকি, অজ্ঞান দেহটাকে বাঁ হাতে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরল রানা। ডান হাতটা মিসেস কেনটারকির ঘাড়ের পিছনে চলে গেছে। দ্বিতীয় নার্ভ সেন্টারে আরও একটা খোঁচা খেলো গভর্নেস। খোলা মুখ দিয়ে চিৎকার বেরুবার আগেই টলে উঠল সে, আপনা থেকে বন্ধ হয়ে গেল হাঁ। তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে উঠল তার চেহারা। খালি হাতটা দিয়ে তার পতন রোধ করল রানা। মিসেস কেনটারকি জ্ঞান হারিয়েছে। তার হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল। ঢিল পড়েছে মুখের পেশীতে।

    গভর্নেসের বগলের তলায় ডান হাত রেখে, তার সাথে হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হলো রানা, বসল। আলতোভাবে কার্পেটের ওপর গড়িয়ে পড়ল মিসেস কেনটারকি।

    .

    সিক্রেট সার্ভিস এজেণ্ট জেরি অ্যাডামস আবার অফিসে ফিরল সাড়ে সাতটায়। ডেস্কে তখনও চিরকুটটা পড়ে আছে। হাত বাড়িয়ে ফোনের রিসিভার তুলল সে, ডায়াল করল নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিসের দফতরে। অপরপ্রান্তে রিসিভার তুলল ইন্সপেক্টর বব হাডসন। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল অ্যাডামস।

    ইন্সপেক্টরের কথা শেষ হতে অ্যাডামস বলল, ‘হয়তো আপনার কথাই ঠিক, ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। স্যাম গ্রেসন সম্পর্কে কেন আমরা সিকিউরিটি চেকের ব্যবস্থা করেছিলাম, আমি জানি না। খোঁজ নিচ্ছি। ধন্যবাদ।’

    এরপর রেকর্ড ডিভিশনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করল অ্যাডামস। কি তার দরকার জানিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। খানিক পরই তথ্যগুলো পেয়ে গেল সে।

    স্যাম গ্রেসন মিসেস কেনটারকির বন্ধু। তাকে ইণ্ডিয়ান স্প্রিঙে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

    প্রেসিডেন্টের মেয়ে! ইণ্ডিয়ান স্প্রিঙে টিউলিপ রয়েছে!

    দ্রুত হাতে আবার রিসিভার তুলে ডায়াল করল অ্যাডামস। কিন্তু লাইন এনগেজড। এক লাফে চেয়ার ছাড়ল সে, ঘর থেকে হলরূমে বেরিয়ে এল হন হন করে। প্রোটেকশন অফিসে ঝড়ের বেগে ঢুকল সে। ডিউটি অফিসারকে গ্রাহ্য না করে সেকশন চীফের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

    ‘একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে,’ দ্রুত, প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল অ্যাডামস। স্যাম গ্রেসন সম্পর্কে সব কথা, যতটুকু জানে সে, হড়বড় করে ব্যাখ্যা করল।

    ‘কিন্তু তা সম্ভব নয়,’ সেকশন চীফ মাথা নেড়ে বলল। স্যাম গ্রেসন মারা যায়নি। কাল সকালে ইণ্ডিয়ান স্প্রিঙে বহাল তবিয়তেই পৌঁচেছে সে। কথাটা শেষ করেই আঁতকে উঠল সে, চোখ জোড়া বিস্ফারিত হয়ে উঠল। কি ঘটেছে উপলব্ধি করতে পেরে এক সেকেণ্ড পাথর হয়ে থাকল সে। তারপরই ডাইরেক্ট লাইনের দিকে হাত বাড়াল। মিশিগানকে বিপদ সঙ্কেত দিতে হবে।

    .

    টিউলিপের মামী তখনও সামনের ঘরে বসে আছে, গন্ধ করছে একজন সিকিউরিটি এজেন্টের সাথে। সিঁড়িতে রানা উদয় হতে, দু’জনেই মুখ তুলে তাকাল।

    রানার বগলের তলায় রয়েছে খেলনা ভাল্লুকটা। কোমরে ঠেকিয়ে রেখে, ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে। যথেষ্ট ভারী, কিন্তু ধরে থাকার ভঙ্গি দেখে মনে হবে খুবই হালকা।

    দরজার কাছাকাছি পৌঁছে থামল ও। ‘মেয়েটার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি,’ বলল ও। ‘ওর সাথে মিসেস কেনটারকি আছেন।’

    মিসেস ল্যাঙ্গার হাসল। ‘সময় করে আরেকবার এসো, বাপু। দু’দিনই মেয়েটা তোমার ন্যাওটা হয়ে উঠেছিল। ক’টা দিন মন খারাপ করে থাকবে।’

    ‘না এসে উপায় আছে,’ হাসতে হাসতে বলল রানা। ‘টিউলিপ আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে। চলি তাহলে, কেমন? এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে…।’ খালি হাত দিয়ে ক্যামেরার ব্যাগটা তুলে কাঁধে ঝোলাল ও।

    সিকিউরিটি এজেন্ট ওর দিকে এগিয়ে এল। ‘দিন, সুটকেসটা আমি নিয়ে যাই।’

    মৃদু হাসল রানা। ‘ধন্যবাদ, আমিই পারব। আপনি বরং দরজাটা খুলুন।’ সুটকেস তুলল ও। ‘ধন্যবাদ, মিসেস ল্যাঙ্গার। আপনাদের আতিথেয়তা আমি কখনও ভুলব না।’

    ‘তোমাকে পেয়ে আমরা সবাই খুব আনন্দে ছিলাম।’

    ‘গুডবাই।’

    রানার গাড়ি বাইরে অপেক্ষা করছে। পিছনের বনেট তুলে সুটকেসটা রাখল ও। ব্যাক সীটে ঠাঁই পেল খেলনা ভাল্লুক। হাত তুলে নাড়ল ও, শেষবার বিদায় নিল সবার কাছ থেকে। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দরজা খুলে উঠে পড়ল গাড়িতে।

    বিশ্বাস হচ্ছে না এত সহজে নিয়ে যেতে পারছে টিউলিপকে।

    ইঞ্জিন স্টার্ট নিল। ধীরে ধীরে গেটের দিকে এগোল গাড়ি।

    .

    ল্যাঙ্গার কটেজের পিছনে গেস্ট হাউস, ঝন ঝন শব্দে সেখানে একটা ফোন বেজে উঠল। ওয়াশিংটনের সাথে সরাসরি লাইন ওটা। ডিউটি-রত এজেণ্ট রিসিভার তুলে এক মুহূর্ত অপরপ্রান্তের কথা শুনল। চোখের পলকে ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার চেহারা, রিসিভার ছেড়ে দিয়ে এক ছুটে কামরা থেকেই বেরিয়ে এল সে। কেউ দেখলে ভাববে, লোকটার গায়ে বোধহয় আগুন ধরে গেছে।

    ‘গ্রেসন কোথায়?’ সামনের ঘরে ঢুকেই চিৎকার করল সে।

    মিসেস ল্যাঙ্গার মুখ তুলে তাকাল। থতমত খেয়ে গেছে। ‘কেন, এইমাত্র তো চলে গেল। কিছু হয়েছে নাকি?’

    তাকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটল এজেণ্ট, একসাথে দুটো করে সিঁড়ির ধাপ টপকে উঠে এল দোতলায়। টিউলিপের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বার কয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল সে। না জানি ভেতরে ঢুকে কি দেখবে!

    দরজা ঠেলে ভেতরে তাকাল সে। পরম স্বস্তি বোধ করল সাথে সাথে। বিছানায় শুয়ে রয়েছে টিউলিপ। কিন্তু তারপরই নতুন করে ভয় পেল সে।

    এক ছুটে ঘরে ঢুকল এজেণ্ট। চাদরের নিচে শুয়ে রয়েছে টিউলিপ। কিন্তু চাদর নড়ছে না কেন? মেয়েটার নিঃশ্বাস…

    ছোঁ দিয়ে চাদরটা তুলে নিল সে। হিম শীতল একটা অনুভূতি হলো তার। এত ভয় জীবনে কখনও পায়নি।

    চাদরের তলায় টিউলিপ নয়, খেলনা ভাল্লুকটা রয়েছে। ঘরে কোথাও টিউলিপকে দেখা গেল না।

    পিছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে সংবিৎ ফিরল তার। মিসেস ল্যাঙ্গারকে দেখা গেল দোরগোড়ায়। ‘কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘টিউলিপ…।’ বিছানার দিকে দৃষ্টি পড়তে মাথায় যেন বাজ পড়ল। চিৎকার করার জন্যে হাঁ করল সে। তাকে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল এজেণ্ট লোকটা।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ১৪৪ – অপহরণ-২
    Next Article মাসুদ রানা ৪৫৯ – অন্তর্যামী

    Related Articles

    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৩৮৫-৩৮৬ – হ্যাকার (দুই খণ্ড একত্রে)

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৬ – টপ টেরর

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৪ – নরপশু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৩ – ধর্মগুরু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫২ – কালো কুয়াশা

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫১ – মায়া মন্দির

    July 22, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    শ্রীশ্রীচণ্ডী – অনুবাদ : পঞ্চানন তর্করত্ন

    September 9, 2025

    পুলিশ কাহিনী ১ – পঞ্চানন ঘোষাল (প্রথম খণ্ড)

    September 9, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.