Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ১৪৪ – অপহরণ-২

    কাজী আনোয়ার হোসেন এক পাতা গল্প192 Mins Read0

    অপহরণ-২.৫

    পাঁচ

    সামনে যানবাহনের বেয়াড়া ভিড়, কিন্তু ফাঁক গলে তীরবেগে ছুটল জেফ রিকার্ডের গাড়ি। জানেন ট্রাফিক পুলিস আটকাতে পারে, তবু স্পীড লিমিট মানছেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোয়াইট হাউসে পৌঁছুতে হবে তাঁকে

    সরাসরি হোয়াইট হাউসে ঢুকল গাড়ি, গেট পেরোবার সময় হাত নাড়লেন গার্ডদের উদ্দেশে, ঘ্যাচ করে ব্রেক কষে থামলেন ওয়েস্ট উইং এনট্রান্সের সামনে। ভেতরে ঢুকে একজন এইড-কে পাশ কাটালেন নিঃশব্দে, একটা দরজা খুলে স্টাফ অফিসে চলে এলেন।

    ‘মি. ডিরেক্টর।’ তাঁর পিছু পিছু এল এইড।

    কিন্তু জেফ রিকার্ড তাকে দেখেও দেখলেন না। একটা আউটার অফিসে ঢুকলেন তিনি, কামরাটা ওভাল অফিসকে ঘিরে রেখেছে।

    রিচার্ড কনওয়ের সেক্রেটারি, ঘুমহীন লাল চোখে রাজ্যের উদ্বেগ নিয়ে মুখ তুলল। অপর একজন লোক উত্তেজিতভাবে মেয়েটার ডেস্কের সামনে পায়চারি করছে। লোকটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্টের গেট-কীপার বলা হয় তাকে। ঘরে ঢুকতেই সে-ও ঝট্ করে জেফ রিকার্ডের দিকে তাকাল। ‘আপনি ছিলেন কোথায়, স্যার? এক ঘণ্টা ধরে কোথাও খুঁজতে বাকি রাখিনি আমরা…।’

    প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন জেফ রিকার্ড। ‘প্রেসিডেন্টের সাথে এই মুহূর্তে কথা বলতে হবে আমাকে,’ বলে ভারী দরজাটার দিকে এগোলেন তিনি।

    তাঁর পথ আগলে দাঁড়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেক্রেটারি। ‘এখন কিভাবে সম্ভব, স্যার? তিনি ই.ও.বি.-তে যাবার জন্যে রওনা হয়ে গেছেন। প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন।’

    ‘প্রেস কনফারেন্স?’ আকাশ থেকে পড়লেন জেফ রিকার্ড ।

    ‘আপনি জানেন না? প্রেসিডেণ্ট রিজাইন করতে যাচ্ছেন!’

    হতভ’ জেফ রিকার্ড লোকটার দিকে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। ‘কিন্তু কেন?’

    অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেক্রেটারি শুধু উদ্বিগ্ন নয়, উদ্‌ভ্রান্ত উন্মাদ হয়ে রয়েছে। ‘একমাত্র ঈশ্বর জানেন! কিভাবে যেন তাঁর ধারণা হয়েছে, টিউলিপ কিডন্যাপ হওয়ার জন্যে একমাত্র তিনিই দায়ী। এবং তিনি যদি পদত্যাগ করেন, টিউলিপকে আটকে রাখার আর কোন কারণ থাকবে না কিডন্যাপারদের ‘

    চোখ ছোট করে জেফ রিকার্ড বললেন, ‘তাকে তোমার থামাতে হবে।’

    হতাশায় মুষড়ে পড়ার ভঙ্গি করে হাত নাড়ল সেক্রেটারি। ‘চেষ্টার ত্রুটি করিনি, স্যার। সবাই আমরা ফেল করেছি। তিনি কারও কথা শুনবেন না।’

    ‘চেষ্টা করে দেখতে বলছি না, আমি বলছি তাকে থামাও! স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গর্জে উঠলেন সি.আই.এ. চীফ। ‘শোনো, ইউ বাস্টার্ড, প্রেসিডেন্ট মারাত্মক একটা ভুল করতে যাচ্ছেন। এই মুহূর্তে এখানে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে হবে তোমার। তাঁকে বলো, পামেলা কনওয়ে মারা গেছে। যা খুশি বলো, শুধু ফিরিয়ে আনা চাই তাঁকে। সাবধান, আসার পথে কারও সাথে তাঁকে কথা বলতে দিয়ো না। ‘

    গেট-কীপার এক মুহূর্ত স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল, তারপর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।

    ডেস্কের পিছনে বসা মেয়েটার দিকে তাকালেন জেফ রিকার্ড চোখ লাল করে কোন লাভ হবে না। নিজেকে সামলাও, সারারাত ব্যস্ত থাকতে হবে। কোন রকম ইতস্তত না করে দরজা খুলে ওভাল অফিসে ঢুকলেন তিনি-একা।

    .

    নসোসে যাবার পথে, দু’পাশে সার সার গাছ। কিছু গাছ কেটে ফাঁকা একটা জায়গা বের করা হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে পাকা পার্কিং লট। এই মুহূর্তে দুটো গাড়ি রয়েছে ওখানে। লোহার চেইন দিয়ে তৈরি আধুনিক বেড়া ঘিরে আছে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ। রাত প্রায় দশটা। দিনের আলো অনেক আগেই নিভে গেছে, সেই সাথে বিদায় নিয়েছে শেষ ট্যুরিস্ট লোকটাও।

    রানা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখান থেকে ধ্বংসাবশেষ কিছুই দেখা যায় না। জায়গাটাকে ঘিরে আছে মাথা উঁচু সার সার গাছ, আর ঝোপ-ঝাড়। তবে পাহাড়ের মাথা থেকে ফ্লাডলাইটের আলো আসছে নিচে, গেট হাউসটা পরিষ্কার দেখা গেল। স্যুভেনিরের দোকানটা বন্ধ, বন্ধ টিকেট কাউন্টারও। কাউন্টারের পাশের কামরাটাই গার্ডরূম, ওখান থেকে গেট পাহারা দেয় গার্ড।

    বাতাসের সাথে ভেসে এল কফির গন্ধ, আর রেডিওর গান। গাছের আড়াল থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল রানা, কাঁকর ছড়ানো পথ এড়িয়ে নরম মাটিতে পা ফেলে এগোল ও। গেট হাউসের দিকে যাচ্ছে, পিছন থেকে। কাছাকাছি পৌঁচেছে, রেডিওর গান বন্ধ হয়ে গেল। অনুষ্ঠান ঘোষক গ্রীক ভাষায় সময় বলছে। তারপর শুরু হলো খবর।

    মেঝেতে চেয়ারের পায়া ঘষা খাওয়ার আওয়াজ শুনল রানা। কংক্রিটের মেঝেতে বুট জুতোর শব্দ হলো। খবর পাঠকের গলা মাঝপথে থেমে গেল, ডায়াল ঘোরাল কেউ। অন্য স্টেশন ধরা হলো, আবার গান শোনা গেল। ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসল গার্ড।

    গার্ড হাউসের দেয়াল ঘেঁষে এগোল রানা। বাঁক নিল। পরের দেয়ালের কিনারায় এসে উঁকি দিয়ে তাকাল সামনে। মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে গার্ডরূমের দরজা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান পেতে থাকল ও। তারপর ঝুঁকে এক মুঠো কাঁকর তুলে নিল, ছুঁড়ে দিল বেড়া লক্ষ্য করে।

    লোহার ওপর পাথর বৃষ্টি হলো, বেশ জোরালই হলো আওয়াজটা। শুনতে পেয়ে রেডিও বন্ধ করল গার্ড, কান পাতল। কিন্তু চেয়ার ছেড়ে নড়ল না।

    আরও এক মুঠো কাঁকর তুলল রানা।

    এবার নড়ে উঠল চেয়ার। ঘরের ভেতর থেকে পায়ের আওয়াজ এগিয়ে এল দরজার দিকে। দরজার পাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রানা, মুখ খুলে নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। নড়ে উঠল একটা হাত, দেখে নিল রিভলভারটা বেল্টে ঠিক মত আছে কিনা।

    দরজা খোলার শব্দ।

    চৌকাঠ পেরিয়ে আলো-অন্ধকারে বেরিয়ে এল গার্ড।

    লোকটাকে ঘাড় ফেরাবার কোন সুযোগই দিল না রানা। এক হাতের কিনারা দিয়ে ওর ঘাড়ের পাশে প্রচণ্ড এক কোপ মারল, অপর হাত দিয়ে চেপে ধরল মুখ। তারপর দুই হাত দিয়ে অজ্ঞান দেহটাকে ধরে ফেলল মাটিতে পড়ার আগেই, নামিয়ে রাখল ধীরে ধীরে।

    টেনে গার্ডরূমের ভেতরে আনা হলো লোকটাকে। পকেট থেকে প্লাস্টিক সিরিঞ্জ বের করল রানা। সারারাত ঘুমোবার জন্যে যথেষ্ট তরল ভ্যালিয়াম আছে সিরিঞ্জে।

    চারদিকের দেয়ালগুলোর ওপর চোখ বুলাল রানা। ফিউজ বক্সটা দরজার পিছনে। এক ঝটকায় খুলল সেটা, ভেতরের ওয়্যারিং পরীক্ষা করল, যা খুঁজছে পেয়ে গেল। মাস্টার সুইচ ধরে টান দিল জোরে, মাথার ওপর বালবটা নিভে যেতে অন্ধকার হয়ে গেল গার্ডরূম, একই সাথে নিভে গেল বাইরে পাহাড়ের মাথার ওপর ফ্লাডলাইট।

    দরজার পিছনে আরও একটু সরে দাঁড়াল রানা। শুরু হলো অপেক্ষার পালা।

    পাঁচ মিনিটও পেরোল না, খোঁজ নিতে এল দ্বিতীয় গার্ড। বাইরের চাঁদের আলোকে ম্লান করে দিয়ে জ্বলে উঠল তার টর্চ। গেটের ওদিক থেকে ভেসে এল পায়ের আওয়াজ।

    একটু পরই তার গলা শোনা গেল, ‘রিকো?’

    মেঝেতে পড়ে থাকা গার্ড একচুল নড়ল না।

    ‘রিকো?’ এবার আগের চেয়ে জোরে ডাকল।

    গার্ডরূমে কোন শব্দ নেই।

    টর্চের আলো কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে গার্ডরূমের দরজা থেকে সরে গেল, ভেতর থেকে গেটের তালা খুলছে দ্বিতীয় গার্ড। ঘড় ঘড় শব্দে খুলে গেল লোহার গেট, কাঁকর ছড়ানো পথে বুট জুতোর ভারী আওয়াজ এগিয়ে আসতে লাগল। গার্ডরুমের ভেতর আলো পড়ল টর্চের।

    আলোর পিছু পিছু ভেতরে ঢুকল গার্ড। ‘রিকো!’ হাঁটু ভাঁজ করে সঙ্গীর পাশে বসল সে। লাফ দিয়ে দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রানা, হাতের কিনারা দিয়ে এ-লোকটার ঘাড়েও প্রচণ্ড এক রদ্দা মারল। সঙ্গীর পাশে ধরাশায়ী হলো লোকটা। পকেট থেকে আবার সিরিঞ্জটা বের করল রানা।

    তারপর, সাবধানের মার নেই ভেবে, দু’জনের মুখেই টেপ লাগিয়ে দু’জোড়া হাত পিছমোড়া করে বাঁধল ও। সিধে হয়ে দাঁড়াল, পিছিয়ে গিয়ে কাজগুলো কেমন হয়েছে খুঁটিয়ে দেখল। হাত দু’জোড়া বাঁধার পরও বেশ খানিকটা রয়ে গেছে নাইলন কর্ড, সেটা দিয়ে পা দু’জোড়াও বাঁধল এবার।

    গার্ডরুম থেকে বেরিয়ে গেট পেরোল ও, উঠে এল পাহাড়ে। কাইরাটোস নদীর ওপর এখানে এককালে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল মিনোস প্রাসাদ। প্রাচীন বা আধুনিক যে-কোন মানের বিচারে প্রাসাদটা ছিল বিশাল। বহুতল প্রশস্ত কাঠামোর বিস্তার ছিল পাঁচ একরেরও বেশি জায়গা জুড়ে, সে-যুগে একসাথে আশি হাজার লোকের জায়গা সংকুলান হত। প্রাগৈতিহাসিক যুগের স্থাপত্য-বিস্ময়, সে-সময় এমনকি প্রাচীন গ্রীস সভ্যতারও সূচনা ঘটেনি।

    আগাম কোন আভাস না দিয়ে মৃত্যু গ্রাস করে নসোসকে। নদীটা এখনও রয়ে গেছে বটে, কিন্তু প্রাসাদটা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছে, পাথরের স্তূপ ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সম্ভবত ভয়ঙ্কর কোন ভূমিকম্প ঘটেছিল, তাতেই চার হাজার বছর আগে মিনোয়ান সভ্যতার পরিসমা—ি ঘটে যায়।

    আছে শুধু ধ্বংসাবশেষ, আর্কিওলজিস্টের শাবলের আঘাত খাবার জন্যে। একতলার কাঠামো দেখে মনে হয়, পুরোটাই ছিল পাথরের তৈরি-মাঝখানে প্রকাণ্ড উঠান, চারদিকে মোটা ভিত, ভিতের পাথর কেটে তৈরি শয়ে শয়ে ঘর। ভাঙা, ফাটল ধরা পাথরের ফাঁকে ঝোপ গজিয়েছে।

    কিছু কিছু দেয়াল, দশ বিশটা ঘরের অংশবিশেষ, মেরামত করা পাঁচিল, থামের ওপর পাথুরে বারান্দা, ভাঙাচোরা খিলান, ইত্যাদি দেখে কন্ধনা করে নিতে হয় গোটা ব্যাপারটা কি রকম ছিল। কাত হয়ে পড়া কিছু পিলার, টাওয়ার, আর পাঁচিল খাড়া করা হয়েছে, নতুন করে রঙ চড়ানো হয়েছে গায়ে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই রয়েছে বুল’স হর্ন-কারুকাজ করা পাথুরে বুল’স হর্ন, একেকটা মানুষ সমান উঁচু, এককালে প্রাসাদ পাঁচিলের মাথায় শোভা পেত, মধ্য যুগের কোন দুর্গের চারধারে টাওয়ারের মত।

    পাহাড়ের গোড়া থেকে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে, কান পেতে শুনল রানা। নদীর কলকল ছলছলও এখান থেকে পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যায়। দূরে হেরাক্লিয়ন শহরের আলো জ্বলছে। তাছাড়া মানুষের তৈরি কোন আলো এই মুহূর্তে নেই এখানে। চার হাজার বছর আগে ধ্বংস হবার পর নসোস যেমন ছিল প্রায় তেমনি আছে। বড়, কালো একটা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ল চাঁদ। ধ্বংসাবশেষের চারদিকে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে রানা ভাবল, প্রতিটি সভ্যতাই আসলে অভিশপ্ত, এক সময় না এক সময় ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষ সৃষ্টি করতে ভালবাসে, কিন্তু তার ধ্বংস-প্রবণতা আরও জোরাল। এই মানুষই তো পৃথিবীকে কয়েকশোবার ধ্বংস করার মত পারমাণবিক বোমা তৈরি করে রেখেছে। এবং তৈরি করাই হয়েছে ফাটাবার জন্যে। এত সাধের আধুনিক সভ্যতা, তাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে, শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

    গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক থেকে। চিন্তার ডালপালা গজাল। সভ্যতা বটে, আধুনিকও বটে, কিন্তু কাদের জন্যে? গোণা-গুণতি কয়েকটা উন্নত দেশের কথা বাদ দিলে, বাকি দুনিয়ার কয়েকশো কোটি লোক মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের কাছে এই সভ্যতার কানাকড়ি দাম নেই। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, বুদ্ধিমান এবং বিবেকবান প্রাণী হয়েও মানুষ এখনও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে পারেনি। মানুষ না খেয়ে মরছে, অথচ তারই পাশাপাশি বিপুল ব্যয়ে চলেছে অস্ত্র তৈরির প্ৰতিযোগিতা।

    এ-সব চিন্তা মাথায় ঢুকলে নিজেকে বড় অসহায়, দুর্বল, আর অক্ষম মনে হয় রানার। বরাবরের মত আজও মাথা থেকে সব বের করে দিয়ে শান্ত হবার চেষ্টা করল ও। দুনিয়াটাকে উদ্ধার করা ওর কর্ম নয়, কাজেই সময়মত চিন্তা-ভাবনার লাগাম টেনে ধরা দরকার, তা না হলে পাগল হতে হবে।

    মেঘের ফাঁক থেকে উঁকি দিল চাঁদ। পাথুরে পথ ধরে এগোল রানা। এই পথ এক সময় তাজা রক্তে ভেসে গেছে। ভাঙাচোরা, এবড়োখেবড়ো ভিতের পাথর বেঢপ আকৃতির ছায়া ফেলেছে চারদিকে। কোথাও কোথাও গভীর খাদ দেখা গেল, এককালে ওগুলোয় তেল, মদ এই সব রাখা হত। কয়েকটার ভেতর উঁকি দিল রানা, অন্ধকার-তল পর্যন্ত দৃষ্টি চলে না।

    ধ্বংসাবশেষের ওপর দিকে চোখ বুলাল রানা, প্রাসাদের যে ক’তলা আজও টিকে আছে। এত সব পাথরের নিচে, ওর পায়ের তলায় মাটির নিচে, আণ্ডারগ্রাউণ্ড প্যাসেজ আছে, জানে রানা। একবার ঢুকলে বেরিয়ে আসা সমস্যা, গোলকধাঁধার মত। গাইড বা ম্যাপ ছাড়া ওখানে নামতে সাহস পায় না কেউ। কড়া নিষেধও আছে।

    হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল রানা। রাত বাড়ছে, অনেক কাজ বাকি।

    .

    প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে আছেন জেফ রিকার্ড, স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন ফোনের দিকে। দুনিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ ফোন ওটা। আড়ি পাতা যন্ত্র আছে কিনা রোজ পরীক্ষা করা হয়, কোন কোন সময় দিনে দু’বার। সেজন্যেই এখানে এসেছেন তিনি।

    আসতে পেরেছেন সেজন্যে ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। রিচার্ড কনওয়েকে কোনভাবেই পদত্যাগ করতে দেয়া যায় না।

    দরজা খোলার আওয়াজ। সি.আই.এ. ডিরেক্টর মুখ তুললেন। অফিসে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন প্রেসিডেণ্ট। তাঁর চিবুক ঝুলে পড়েছে, চেহারা ম্লান। কিন্তু চোখ দুটো যেন দু’টুকরো অঙ্গার, জ্বলজ্বল করছে।

    রাগ? ভাবলেন জেফ রিকার্ড। অসন্তোষ?

    ‘কি বলার আছে তোমার, জেফ?’ প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন করলেন, প্রাণপণ চেষ্টায় ভাবাবেগের লাগাম টেনে ধরায় কর্কশ শোনাল তাঁর কণ্ঠস্বর।

    চেয়ার ছেড়ে নড়লেন না জেফ রিকার্ড। কামরার অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো পুরানো বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘কিভাবে কি ঘটেছে সব আমি বুঝতে পেরেছি। এক মুহূর্ত থামলেন তিনি, তারপর আবার বললেন, ‘বিকট একটা সমস্যা, রিচার্ড!’

    .

    ওয়াশিংটন দূতাবাসে ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখলেন ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডর। চেয়ারে হেলান দিয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। এইমাত্র হোয়াইট হাউস থেকে অদ্ভুত একটা অনুরোধ পেয়েছেন— শুধু অদ্ভুত নয়, ভীষণ জরুরী। ব্যাপারটা হজম করতে তিন সেকেণ্ড সময় লাগল তাঁর, তারপরই সামনের দিকে ঝুঁকে একটা বোতামে চাপ দিলেন। জ্যান্ত হয়ে উঠল ইন্টারকম।

    ‘ইয়েস, স্যার?’

    ‘ফরেন অফিসের সথে নিরাপদ একটা লাইন চাই,’ অ্যামব্যাসাডর বললেন। ‘এই মুহূর্তে।’

    পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যে সেই একই অনুরোধ পেলেন আরও চারজন অ্যামব্যাসাডর। ইন্টারন্যাশনাল অপারেটররা সারারাত ধরে ব্যস্ত থাকল—সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অসংখ্য বার্তা গেল আর এল। ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী, গ্রীস, এবং ইসরায়েলের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স তৎপর হয়ে উঠল অকস্মাৎ।

    টানার মত সুতো যেখানে যা ছিল, সবগুলো টানলেন সি.আই.এ. চীফ জেফ রিকার্ড, শুধু একটা বাদে। ল্যাংলির সাথে তিনি কোন যোগাযোগ করলেন না। তাঁর নিজের এজেন্সি, সি.আই.এ-র সাহায্য তিনি নেবেন না।

    .

    রানার মতই কালো পোশাক পরা এক লোক মেরামত করা সাউথ গেট দিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকল। এখান থেকেই শুরু হয় ট্যুর। ভেতরে ঢুকে এক মুহূর্ত থামল সে, তারপর দ্রুত পা চালিয়ে সামনে এগোল, খোলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল বিশাল উঠানে সিঁড়ির মাথায় আবার একবার থামল সে। চাঁদের আলো পড়ল তার মুখে।

    কর্নেল উইলিয়াম অবসন।

    অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল রানা। ‘আপনি তো দেরি করার লোক নন,’ বলল ও। বিশ মিনিট আগেই মাঝরাত পেরিয়ে গেছে।

    ‘এর মানে কি, মি. রানা? এ-সব আপনি কি শুরু করেছেন?’

    ‘শুরু করেছি!’

    ‘করেননি? কি দরকার ছিল এই লুকোচুরি খেলার? এখন থেকে খুঁজছি আপনাকে? আপনার উচিত ছিল গেটের কাছে আমার সাথে দেখা করা।

    শ্রাগ করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। ‘ও, এই কথা,’ সকৌতুকে বলল ও। ‘কি করব বলুন, এই জায়গাটাই আমার পছন্দ হয়ে গেল কিনা। তাছাড়া, আপনিও নিশ্চয় মানবেন, জায়গাটার একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে।’ সামনের প্রশস্ত দৃশ্যাবলীর ওপর চোখ বুলাল ও। ভাবল, ক্ষমতার আসন হিসেবে নসোস আদর্শ জায়গা, মিনোয়ান সম্রাটরা তা বুঝেছিলেন। প্রাচীন পাহাড়শ্রেণী চারদিক থেকে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে সমতল ভূমিতে। নিচে জলপাই ঝোপ, সাইপ্রেস গাছ, গভীর জঙ্গল-জমাট অন্ধকারের সবটুকু দূর করতে পারেনি ম্লান চাঁদের আলো। নদীর ছলছল আর ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া রাতটা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। ‘তাছাড়া, মি. অবসন,’ বলল রানা, ‘আপনার সাথে আমার কথা আছে।

    ‘কথা আছে? কথা বলার সময় কোথায়! মেয়েটা কই?’

    ‘টিউলিপ এখানেই আছে,’ বলল রানা।

    ‘ধৈত্তেরি, এখানে কোথায়?

    ‘ওই নিচে।’ সিঁড়ি ঢেকে রাখা একটা সমতল ছাদের দিকে ইঙ্গিত করল রানা। পাশাপাশি পাঁচ প্রস্থ সিঁড়ি প্রাসাদের নিচের স্তরে নেমে গেছে। কোন কোন সিঁড়ি তিন-চার তলা পর্যন্ত নেমেছে, নিচে গলি-উপগলির গোলক ধাঁধা। ‘ঠিক কোথায়, সেটা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার বিশ্বাস চেষ্টা করলে পারবেন আপনি। দিন দশেকের মধ্যে পেয়ে গেলে আপনাকে আমি ভাগ্যবান বলব।’ কথা শেষ করে অবসনের দিকে ফিরল ও।

    পাল্টা দৃষ্টি হানল কর্নেল। ‘তারমানে? সাম কাইণ্ড অভ জোক?’

    মাথা নাড়ল রানা। ওর ঠোঁটে নিষ্ঠুর এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। ‘তা বলতে পারেন। কি জানেন, কেউ আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলে আমিও তাকে নিয়ে ঠাট্টা করি-অভ্যেস।’

    ‘কি বলতে চান পরিষ্কার করে বলুন।’ রাগ সামলে রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে অবসন।

    ‘তাহলে শুনুন। টিউলিপ আমার কাছে রয়েছে। আপনি তাকে চান। আপনি তাকে পেতেও পারেন। কিন্তু তার আগে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে আমার। মেয়াদ কমে গেল কেন? হঠাৎ এত তাড়াহুড়োর কারণ কি? আসলে কি ঘটছে?

    ‘মি. রানা!’

    ‘নির্ভেজাল সত্য কাহিনী, মি. অবসন,’ ভারী গলায় বলল রানা। ‘নিন, শুরু করুন।’

    একদৃষ্টে রানার দিকে তাকিয়ে থাকল অবসন, চোখে আগুন ঝরছে। তারপর হঠাৎ নিজেকে সামলে নিল সে। কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, ‘বেশ। শুনবেনই যখন শুনুন। অন্ধ কথায় বলব। বসুন।’

    রানা বসল না। হেলান দিল, পাথুরে বুল’স হর্নে কাঁধ ঠেকাল।

    ‘আমি খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছি, মি. রানা,’ বলল অবসন। ‘এবং বিপদের মধ্যে। মেয়াদ কমিয়ে আনার অনেক কারণের একটা হলো, ভুয়া সূত্র তৈরি করার জন্যে ডানিয়েলকে পাওয়া যাবে না।’

    ‘সে মারা গেছে।’

    ভুরু কুঁচকে তাকাল অবসন। ‘আপনার জানার কথা নয়।’

    ‘অনুমান।’

    ‘হ্যাঁ, মারা গেছে।’

    ‘আহা।’

    ‘শুধু মারা যায়নি, খুন হয়েছে—জেফ রিকার্ডের এজেন্টরা খুন করেছে ডানিয়েলকে ‘

    ‘তাই?’

    ‘জেফ রিকার্ড সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ নেই,’ বলে চলল অবসন। ‘যা যা করবে বলে আশা করেছিলাম, সব করেছে সে, বরং আরও বেশি করেছে। নিজের স্বার্থে পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে লোকটা। তার জন্যে আমাদের তিনজন কী এজেণ্ট মারা গেছে। শুধু মারা যাওয়াই যথেষ্ট খারাপ। প্রত্যেকে ওরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজেণ্ট ছিল। কিন্তু বিপদ হলো প্রতিটি কেসে কেলেঙ্কারির বীজ আছে। কোন একটা যদি ফাঁস হয়ে যায়, সি.আই.এ. ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’ রাগের সাথে মাথা নাড়ল অবসন। ‘সঠিক জানি না কিভাবে সে এই সর্বনাশ করতে পারল, তবে আন্দাজ করতে পারি। আমার ধারণা প্রথম থেকেই জেফ রিকার্ডের হয়ে কাজ করছিল ডানিয়েল।’

    রানার চিবুক ঝুলে পড়ল, বিস্ময় গোপন করার কোন চেষ্টাই করল না ও। ‘ডানিয়েল জেফ রিকার্ডের হয়ে কাজ করছিল? তারমানে জেফ রিকার্ড জানে…?’

    ‘হ্যাঁ। জেফ রিকার্ড আপনার সম্পর্কে জানে। আপনি কোথায় আছেন, তাও। তাড়াহুড়োর কারণ এবার পরিষ্কার হয়েছে, মি. রানা?’ প্রশ্নটা অবসন একটু ব্যঙ্গের সুরে করল।

    বিস্ময়ের ধাক্কা এখনও যেন কাটিয়ে উঠতে পারেনি রানা।

    ‘আরও আছে,’ বলল অবসন। ‘যেমন আশা করেছিলাম, জেফ রিকার্ড সত্যি সত্যি রাশিয়ানদের কাছে গেছে। ঈশ্বর জানেন কত জন কে.জি.বি. এজেণ্ট আপনার খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! সে যাই হোক, আমরা আমাদের কেস প্রমাণ করেছি। আমি সন্তুষ্ট! এখন শুধু আমরা মেয়েটাকে হোয়াইট হাউসে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেই…’

    কথাটা অবসন শেষ করতে পারল না। বিদ্যুৎবেগে আধপাক ঘুরে দাঁড়াল সে। সন্ত্রস্ত।

    অকস্মাৎ নসোসের ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠেছে।

    চারদিকে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোর বন্যা বয়ে গেল। তারপরই শোনা গেল পিস্তলের তীক্ষ্ণ আওয়াজ, বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট। একটা বুল’স হর্নের ডগা বিস্ফোরিত হলো, ধুলোর মেঘ দেখা গেল বাতাসে। আওয়াজ শুনে বোঝা গেল ওদের পিছনের উঠানে কোথাও লাগল বুলেটটা।

    কাছাকাছি ভিতের নিচু একটা কিনারায় আড়াল নিল অবসন। বেল্ট থেকে এক ঝটকায় রিভলভার বের করল রানা, বুল’স হর্নের নিরেট গোড়ায় গা ঢাকা দিল।

    উঠানের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে ভেসে এল কথাগুলো। ভারী একটা কণ্ঠস্বর। ভাষাটা ইংরেজি হলেও, উচ্চারণ ভঙ্গি রুশ। ‘স্রেফ সাবধান করে দেয়ার জন্যে গুলি করা হলো, পিকেরিং। তুমি জানো, লক্ষ্য কখনও ব্যর্থ হয় না আমাদের। মাথার ওপর হাত তুলে লক্ষ্মী ছেলের মত বেরিয়ে এসো।’

    হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে রানার দিকে তাকাল অবসন, চোখে বিপন্ন বিস্ময়।

    ‘আরও একটা ওয়ার্নিং শট, পিকেরিং।’

    দ্বিতীয় বুলেটটা এল আরেক দিক থেকে, উঠানের উল্টো দিকের দেয়ালে লাগল।

    পাথরের ওপর শুয়ে পড়ল রানা, ক্রল করে ভিতের নিচু পাঁচিলের কাছে, অবসনের কাছাকাছি চলে এল। পকেট থেকে আগেই একটা পিস্তল বের করে নিয়েছে অবসন। ধীরে ধীরে খাড়া হলো সে, পাঁচিলের মাথার ওপর উঁকি দিল। গুলি হলো না, কারও গলাও শোনা গেল না। আবার নিচু হলো সে। বলল, ‘কোথায় রয়েছে ওরা বুঝতে পারছি না।’ ফিসফিস করে বলল, ‘আসলে যে ব্যাপারটা কি তাও মাথায় ঢুকছে না।’

    কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘অথচ আপনি বললেন রাশিয়ানরা নাকি আমাকে খুঁজছে।’

    ‘এটা ঠাট্টা করার সময় নয়, মি. রানা। ওরা আমাদের কোণঠাসা করে ফেলেছে।’ আবার সে উঁকি দিয়ে পাঁচিলের ওদিকে তাকাল।

    ‘আমাদেরকে?’ শব্দ করে হেসে উঠল রানা। ‘আমি যেন শুনলাম লোকটা শুধু আপনার নাম বলল-পিকেরিং!’

    মুহূর্তের জন্যে নড়ল না অবসন। ধীরে ধীরে ঘুরল সে, রানার দিকে ফিরল। চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল, তাকিয়ে থাকল রানার হাতের দিকে। রিভলভারের নলটা তার কপালের কাছ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে।

    যখন অ্যাকশনে ছিল, মাঠকর্মী থাকার সময়, হেনরি পিকেরিং কোডনেমটা ব্যবহার করত উইলিয়াম অবসন। ল্যাংলির কী এজেণ্ট, যাদের সরাসরি পরিচালনা করত সে, তারা সবাই তাকে পিকেরিং হিসেবে চিনত। বিদেশী এজেন্টদের মধ্যে রানাই বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি যে উইলিয়ামের কোডনেমটা জানে। নাম দুটো হলেও, লোক একজন। তবে রানা তাকে কখনও পিকেরিং হিসেবে সম্বোধন করেনি। অর্থাৎ রানা যে জানে তা অবসন জানে না।

    মুখে কোন নির্দেশ দিতে হলো না, হাতের পিস্তল ফেলে দিল অবসন। তার চেহারায় শুধু ভয় নয়, ঘৃণাও দেখতে পেল রানা। চোখ দুটো জ্বলছে, তবে দৃষ্টিতে এখনও যেন খানিকটা অনিশ্চিত ভাব। ব্যাপারটা এখনও সে বুঝছে না।

    ‘এখনও সময় আছে, পিকেরিং, বেরিয়ে এসো। তোমাকে আমরা খুন করতে চাই না। আমরা তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলে এসেছি।’

    রানার মুখের ওপর স্থির হয়ে থাকল অবসনের দৃষ্টি। ‘এসব কি ঘটছে?’

    ‘ওদের কথা শুনলেই তো পারেন,’ বলল রানা। ‘ওরা আপনার বন্ধু, আমার নয়।’

    ‘এ স্রেফ পাগলামি! আপনার কথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না!’

    ‘আপনি, মি. ডেপুটি ডিরেক্টর!’ বলে হাসল রানা। ‘গন্ধটা ভালই ফেঁদেছিলেন, কিন্তু একটু খুঁত থেকে গিয়েছিল। জেফ রিকার্ড নন, বেঈমান আসলে আপনি নিজে। প্রথম থেকে। সি.আই.এ-তে আপনিই সেই ফাটল-কে.জি.বি-র চর। এর সাথে আমাকে জড়িয়ে কাজটা আপনি ভাল করেননি, মি. পিকেরিং।’

    প্রতিবাদ করতে গেল অবসন, কিন্তু কোন লাভ নেই বুঝতে পেরে ক্ষান্ত হলো। রানার দিকে তাকিয়ে থাকল সে, ধীরে ধীরে চেহারা থেকে মিলিয়ে গেল রাগ, ঘৃণা, আর বিমূঢ় ভাবটুকু। তার চিবুক ঝুলে পড়ল। পরমুহূর্তে গম্ভীর হলো সে। ঠাণ্ডা হয়ে এল দৃষ্টি। তিক্ত একটু হাসল সে। ‘ভুল হয়েছে, আপনাকে বিশ্বাস করা আমার উচিত হয়নি। আপনি অতি বড় ধড়িবাজ।’

    ‘নিন্দার জন্যে ধন্যবাদ দেয়ার নিয়ম নেই,’ বলল রানা। ‘উচিত হয়নি, কিন্তু তবু বিশ্বাস করেছেন। ‘

    ‘বাধ্য হয়েছিলাম। আর কেউ ছিল না যে কাজটা করতে পারত।’

    শ্রাগ করল রানা। ‘সত্যি, ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছিলেন। সি.আই.এ-র ডেপুটি ডিরেক্টর আসলে কে.জি.বি-র একজন এজেণ্ট—মাই গড! কি রকম চাপের মধ্যে থাকতে হয়েছে আপনাকে, আন্দাজ করতে পারি। মস্কো থেকে তাগাদা, ওয়াশিংটনের মন যোগানো-সত্যি ভারি কঠিন কাজ। ব্যাপারটা কত দিন থেকে চালাচ্ছেন?’

    ‘বহু বছর।’

    মাথা ঝাঁকাল রানা। অবাক হয়নি ও। পিকেরিং যোগ্য লোক, সব সময় তাই ছিল। অসম্ভব কঠিন একটা কাজ এত বছর ধরে সুষ্ঠুভাবে করতে পারায় মনে মনে লোকটার প্রশংসা করল ও।

    কিন্তু প্রশংসার সাথে দায়িত্বের কোন সম্পর্ক নেই।

    ‘এই কাজটায় আপনি হাত দিলেন কেন?’ রানা কৌতূহলী হলো।

    ‘আপনি যা বললেন-মস্কোর তাগাদা। এখন যে পদে আছি, মস্কো তাতে সন্তুষ্ট নয়। বলল, আরও একটু ওপরে উঠতে হবে আমাকে। জেফ রিকার্ডের পদটা পেতে হবে।’

    তাহলে এই। জেফ রিকার্ডের পদ। হঠাৎ করে খাপে খাপে মিলে গেল সব। প্রেসিডেন্টের মেয়েকে কিডন্যাপ করো, স্বভাবতই মেয়ের সন্ধান পাওয়ার জন্যে বন্ধু সি.আই.এ. চীফের ওপর নির্ভর করবেন তিনি। তারপর জেফ রিকার্ডকে ভুয়া সূত্র পাইয়ে দিয়ে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাও। এরকম বার কয়েক করলেই প্রেসিডেন্ট উপলব্ধি করবেন তার বন্ধু নিতান্তই অযোগ্য, তাকে দিয়ে কোন কাজ হবে না। মেয়ে কিডন্যাপ হলে এমন একটা ইস্যু তৈরি হবে, কেউ ব্যর্থ হলে তাকে তিনি ক্ষমা করবেন না।

    ‘আর আপনি হবেন উদ্ধারকর্তা,’ বলল রানা, ‘টিউলিপকে নিয়ে গিয়ে প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দেবেন। প্রেসিডেণ্ট বরখাস্ত করবেন জেফ রিকার্ডকে, আপনি হবেন তাঁর প্রিয় বন্ধু এবং সি.আই.এ. চীফ।’

    কথা না বলে রানার দিকে তাকিয়ে থাকল অবসন। উত্তর দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

    ‘ব্রিলিয়্যাণ্ট,’ বলল রানা। ‘প্ল্যানটা সফল হতেও পারত।’

    ‘এখনও পারে।’

    ‘আমার তা মনে হয় না।’

    ‘কেন? আপনি আমাকে খুন করবেন?’

    ‘আরে না!’ বলে সশব্দে হেসে উঠল রানা।

    মাঝে মধ্যে এমন এক একটা পরিস্থিতির উল্লব হয়, কে.জি.বি. আর সি.আই.এ. দুই ইন্টেলিজেন্সের মধ্যে সমতা বিধান করা দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় রানার। ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে যেটা ভাল মনে হয় সেটাই করতে হয় ওকে। চাপে পড়ে হোক বা অনুরোধে, আমেরিকার অনেক কাজ করে দিয়েছে রানা। আমেরিকানরা চেয়েছে রাশিয়ার ক্ষতি হোক, রানাও ভাব দেখিয়েছে তাতে তার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, আমেরিকানদের ভুল বুঝিয়ে পার পেয়ে গেছে রানা, রাশিয়ানদের কোন ক্ষতি হতে দেয়নি। এই তো মাত্র কিছুদিন আগে রাশিয়ানদের মেরিলিন চার্ট নিয়ে আসার কাজটা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল সি.আই.এ.। চার্টটা ঠিকই আনা হয়, কিন্তু আমেরিকানরা পায় নকল চার্ট, আসলটা ফেরত যায় মস্কোয়।

    না, ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে রাগের মাথায় অবসনকে রানা খুন করবে না। সমতা বিধানের একটা দায়িত্ব অনুভব করছে ও। এত বছর ধরে আমেরিকানদের গোপন তথ্য রাশিয়ায় পাচার করেছে অবসন, কি কি তথ্য পাচার করেছে তা আমেরিকানদের জানতে দেয়া উচিত। অর্থাৎ অবসনকে মরতে তো দেয়া যায়ই না, পালাতেও দেয়া যায় না। তাকে আমেরিকানদের হাতে তুলে দেবে রানা, তারা ওকে নিয়ে যা খুশি করে করুক। অবসন এটাকে যদি শাস্তি বলে মনে করে, সে শাস্তি তার পাওনা হয়েছে।

    তবে, অবসন যদি কথা না শোনে, তাকে মেরে না ফেলে রানার কোন উপায় থাকবে না।

    পাঁচিলের উল্টোদিকের গায়ে আরেকটা বুলেট লাগল। তারমানে রাশিয়ানদের ক্রস-ফায়ারের মাঝখানে পড়ে গেছে ওরা। শুধু সময়ের ব্যাপার, এক সময় না এক সময় গায়ে গুলি লাগবেই।

    রানা নিজের জায়গায় স্থির থাকল।

    চোখে অবিশ্বাস নিয়ে রানার দিকে তাকিয়ে আছে অবসন। ‘বুঝেছি! আপনি মারবেন না, কিন্তু ওদের দিয়ে আমাকে মারাবেন!’

    ‘উঁহুঁ। যেখানে আছেন থাকুন, নড়বেন না।’ উঠে দাঁড়াতে গেল রানা।

    ‘ওটা ছিল আমাদের শেষ ওয়ার্নিং, পিকেরিং,’ কর্কশ শোনাল অচেনা কণ্ঠস্বর। ‘হয় এখুনি বেরিয়ে এসো, তা না হলে সরাসরি গুলি…।’ রুশ কণ্ঠস্বর হঠাৎ করে নিস্তেজ হয়ে পড়ল, তারপর একেবারে থেমে গেল। নেমে এল জমাট নিস্তব্ধতা। তারপরই অন্ধকার নামল। মাথার ওপর নিভে গেল ফ্লাডলাইট।

    লাফ দিয়ে সিধে হলো রানা। সত্যি অবাক হয়েছে এবার, ভান করছে না। আঙুলগুলো রিভলভারের বাঁটে শক্ত হলো আরও, অবসনের দিকে তাক করে ধরে আছে। চাঁদের আলোয় সামনেটা যত দূর দেখা যায় তীক্ষ্ণ চোখ বুলাল।

    অবসনের দৃষ্টিও ঘুরে গেল। সে যা দেখছে রানা তা দেখছে না। ধীরে ধীরে তার চেহারায় স্বস্তি ফুটে উঠল।

    অবসনের দিকে তাকাল রানা, তারপর ঘাড় ফেরাতে শুরু করল। কিন্তু পিছন থেকে নির্দেশ এল, ‘রিভলভার ফেলে দাও, রানা।

    একসেকেণ্ড স্থির হয়ে থাকল রানা। তারপর ধীরে ধীরে আলগা করল মুঠো, হাত থেকে খসে পড়ল রিভলভার।

    বুল’স হর্নের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে জিনা, আলো আর ছায়া খেলা করছে তার মুখে। তার এক হাতে একটা অটোমেটিক। আরেক হাতে ছোট একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস, টেপ ডেক, দুটো পিস্তল, আর অ্যামপ্লিফায়ার। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সাহায্যে আলো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছিল রানা। পিস্তল দুটো এমনভাবে সেট করেছিল ও, একটা গুলিও ওদের গায়ে লাগার কথা নয়।

    জিনার হাতের দিকে তাকিয়ে মাস্টার সুইচটা দেখল অবসন। সব বুঝল সে। রানার দিকে ফিরে ফেটে পড়ল রাগে। ‘টেপ! ইউ বাস্টার্ড! আগেই আমার আন্দাজ করা উচিত ছিল!’

    কাঁধ ঝাঁকিয়ে রানা বলল, ‘আমার যা জানার ছিল আমি তা জেনেছি।’

    ‘তারমানে সবটুকুই আপনার অনুমান?’

    হাসল রানা। ‘কিন্তু এখন আমি জানি। আপনি কে.জি.বি. এজেণ্ট। জিনাও তাই।

    মিষ্টি করে হাসল জিনা। ‘তোমার আশ্চর্য লাগছে?’

    ‘কেন আশ্চর্য হব,’ নিরীহ ভঙ্গিতে বলল রানা। ‘কোন কোন সাপ দু’মুখো হয় না?’

    জিনার হাসি নিভে গেল, দেখে তুমি বোধ করল রানা। পিকেরিঙের দিকে ফিরল ও। নিজের পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়েছে সে। রানার বুকের দিকে তাক করে ধরে আছে। রানা তাকে খুন করত না, কিন্তু উল্টোটা সত্যি নয়। রানাকে খুন করা ছাড়া অবসনের কোন উপায় নেই।

    ‘আর তো সময় নষ্ট করা চলে না,’ বলল পিকেরিং। ‘মেয়েটা কোথায়?’

    পিস্তল থেকে চোখ তুলল রানা। আরেক পিস্তলের দিকে তাকাল। দু’জনেই ওরা সতর্ক, রানার প্রতিটি নড়াচড়া কড়া দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল ও। তারপর ঝুলে পড়ল কাঁধ দুটো। নিষ্প্রভ হয়ে গেল চোখের দৃষ্টি। চেহারায় পরাজয় মেনে নেয়ার সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠল পরিষ্কার। ‘বেশ। আসুন। নিয়ে যান মেয়েটাকে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ৪৬৬ – ধ্বংসযজ্ঞ
    Next Article মাসুদ রানা ১৪৩ – অপহরণ-১

    Related Articles

    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৩৮৫-৩৮৬ – হ্যাকার (দুই খণ্ড একত্রে)

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৬ – টপ টেরর

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৪ – নরপশু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৩ – ধর্মগুরু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫২ – কালো কুয়াশা

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫১ – মায়া মন্দির

    July 22, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.