Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ১৪৪ – অপহরণ-২

    কাজী আনোয়ার হোসেন এক পাতা গল্প192 Mins Read0

    অপহরণ-২.৬

    ছয়

    ‘পোলোনভকে আমি ব্ল্যাকমেইল করেছি,’ জেফ রিকার্ড বললেন।

    ঝট্ করে মুখ তুললেন প্রেসিডেন্ট। ‘কি করেছ?’

    ‘ভুল শোনোনি। অনেক দিন আগে পোলোনভ একটা মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ে। সেটা তেমন কিছু না, কিন্তু মেয়েটা ছিল লাল চীনের এজেণ্ট।’ সি.আই.এ. চীফ হাসলেন। ‘প্রথমে পোলোনভ জানত না, যখন জানল সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে—গোপন কিছু কাগজ-পত্র নিয়ে ভেগেছে মেয়েটা। মস্কোও ব্যাপারটা টের পায়নি, ডকুমেন্টগুলো হারিয়ে গেছে বলে তাদের বুঝ দেয় পোলোনভ। আমরা প্রথম থেকেই ব্যাপারটা জানতাম, দু’জনের অনেক ঘনিষ্ঠ ছবিও যোগাড় করা সম্ভব হয়েছিল। কে.জি.বি-র হাতে ওগুলো পড়লে পোলোনভকে মস্কোয় ডেকে পাঠানো হবে। কাজেই পিকেরিং এথেন্সে চলে যাবার পর সাহায্যের জন্যে পোলোনভের কাছে যাই আমি।’

    ‘সাহায্যের জন্যে তুমি রাশিয়ানদের কাছে গেলে?’ ক্লান্ত চোখের ওপর একটা হাত বুলালেন প্রেসিডেণ্ট। ‘ভাগ্যিস যাবার সময় আমাকে বলোনি!’

    তোমাকে তো বললামই কেন আমি তোমার কাছে আসতে পারিনি।’

    ‘হ্যাঁ, জানি। তোমার ধারণা হয়েছিল আমিই হয়তো টিউলিপকে কিডন্যাপ করিয়েছি।’

    ‘বিশ্বাস আমি ভুলেও করিনি, কিন্তু তবু আমার নিশ্চিতভাবে জানার দরকার ছিল।

    ‘পরিস্থিতির কথা ভেবে এ নিয়ে তর্কে যাব না। থাক ওসব কথা। পোলোনভ প্রসঙ্গ শেষ করো।’

    ‘আমি ওদের সেরা এজেন্টকে পিকেরিঙের পিছনে লাগাতে বলি,’ শুরু করলেন জেফ রিকার্ড। ‘বলি, পিকেরিং যা যা করবে, সব রিপোর্ট করতে হবে আমাকে। না বলার উপায় ছিল না তার। পিকেরিঙের পিছনে সারটভ নামে এক এজেন্টকে লাগায় সে। এবং সত্যি সত্যি পিকেরিঙের গতিবিধি রহস্যময় হয়ে ওঠে। কিন্তু সারটভকে দেখে ফেলে সে, খসিয়েও ফেলে। কিন্তু আমার ধারণা, এ অসম্ভব।’

    ‘কেন?’

    ‘কারণ সারটভ এত ভাল যে যার পিছু নেবে তার চোখে কক্ষনো ধরা পড়বে না, যদি না স্বেচ্ছায় ধরা পড়তে চায়, যদি না তার ওপর নির্দেশ থাকে ধরা পড়ার। কাজেই, পিকেরিঙের চোখে সারটভ কেন ধরা পড়ল তার ব্যাখ্যা একটাই: পোলোনভ, কে.জি.বি-র পদস্থ অফিসার, চায়নি পিকেরিংকে অনুসরণ করা হোক।’

    ভাগ্যের প্রহসন উপলব্ধি করে তিক্ত একটু হাসলেন জেফ রিকার্ড। সি.আই.এ-তে পিকেরিঙের নিজস্ব লোক আছে এই ভয়ে তিনি কে.জি.বি-র সাহায্য নিতে যান, জানা ছিল না কে.জি.বি-রই লোক পিকেরিং।

    ‘কেন? জিজ্ঞেস করলাম নিজেকে,’ বলে চললেন তিনি। ‘বলতে গেলে হঠাৎ করেই সব খাপে খাপে মিলে গেল। কে চাইতে পারে অ্যারোর মৃত্যু? রাশিয়ানরা। শুধুমাত্র রাশিয়ানরা। এ-ব্যাপারে আমাদের চিন্তা-ভাবনা প্রথম থেকেই সঠিক ছিল। কিন্তু রাশিয়ানরা অ্যারোর পেট থেকে সমস্ত কথা আদায় না করে তাকে মারবে না। যদি না তাদের আগে থেকেই সব জানা থাকে, সি.আই.এ-র ভেতর নিজেদের এজেন্টের মাধ্যমে।

    ‘পিকেরিং।’

    ‘হ্যাঁ, হেনরি পিকেরিং। সবচেয়ে জঘন্য জাতের বেঈমান। ঈশ্বর, তাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম।’

    আশ্চর্য শান্ত কণ্ঠে প্রেসিডেণ্ট জানতে চাইলেন, ‘তোমার ভুল হতে পারে?’

    ‘পারে। কিন্তু হয়েছে বলে মনে হয় না।’

    ‘কিন্তু কেন সে টিউলিপকে কিডন্যাপ করবে? না হয় ধরে নিলাম রাশিয়ানদের হয়ে কাজ করছে সে, রাশিয়ানরা চাইছেটা কি? চাওয়া তো দূরের কথা, কি চাইবে তার আভাস পর্যন্ত ওরা আমাকে দিচ্ছে না। হোয়াট ইজ দ্য মোটিভ?’

    ‘আমার তিনজন কী এজেণ্টকে সরানো, অবভিয়াসলি।’

    ‘কিন্তু তুমি নিজেই বলেছ, টিউলিপকে কিডন্যাপ না করেও ওদেরকে তারা সরাতে পারত।’

    ‘ডাইভারসন,’ জেফ রিকার্ড পকেট থেকে প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরালেন। সিগারেট তিনি খান না বললেই চলে, শুধু যখন ভয়ানক উত্তেজনার মধ্যে থাকেন তখন ধরান, কিন্তু দু’একটার বেশি টান দেন না। ‘এসপিওনাজ জগতের সাধারণ নিয়ম হলো চোখের বদলে চোখ। তারা যদি আমাদের কোন এজেণ্টকে খুন করে, দেরি না করে উপকারটা আমরাও ফিরিয়ে দিই। কিংবা উল্টোটা ঘটে, আমরা ওদের একজনকে সরালে ওরা আমাদের একজনকে সরায়। তাই, নতুন নতুন এজেণ্টকে চাকরি দেয়ার ঝামেলা এড়াবার জন্যে দু’পক্ষের মধ্যে অলিখিত একটা চুক্তি আছে-একান্ত বাধ্য না হলে কেউ কোন পক্ষের লোককে মারি না।’ কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি। ‘টিউলিপকে কিডন্যাপ করার উদ্দেশ্য, আমরা যেন ভাবি খুন-খারাবিগুলো অন্য কোন শত্রু করছে। প্রথমে মারল অ্যারোকে। তারপর এগম্যানকে। তারপর মেরিলিনকে। আরও অনেক এজেন্টকে মারতে চাইবে ওরা, তালিকাটা নিশ্চয়ই ছোট নয়। কিন্তু চায় না আমরা পাল্টা প্রতিশোধ নিই। সেজন্যেই টিউলিপকে কিডন্যাপ করা দরকার মনে করেছে।’

    ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে থাকলেন প্রেসিডেণ্ট। ‘মাঝে মধ্যে চিন্তা হয় আমার, ওদের চেয়ে কোন দিক থেকে আমরা ভাল কিনা।’

    ‘আমরা লড়ি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে,’ স্বতস্ফূর্ত দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে জবাব দিলেন জেফ রিকার্ড।

    ‘এবং ঈশ্বর আমাদের পক্ষে।’ ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল প্রেসিডেন্টের ঠোঁটে। টুং-টাং শব্দে একটা বেল বেজে উঠল তাঁর ডেস্কে। ফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে একমুহূর্ত শুনলেন, তারপর নামিয়ে রাখলেন। ‘ফ্রেঞ্চরা রাজি হয়েছে,’ বললেন তিনি।

    মাথা ঝাঁকালেন জেফ রিকার্ড। ‘গুড। ফ্রেঞ্চ, ব্রিটিশ, ওয়েস্ট জার্মানস, অ্যাণ্ড গ্রীকস। শুধু ইসরায়েলীদের জবাব পেতে বাকি থাকল।’

    ‘ওরা বেনিয়ার জাত, ঠিকই সহযোগিতা করবে,’ প্রেসিডেন্ট বললেন। ‘জানে সহযোগিতা না করলে আমার সরকার একটা সেণ্টও সাহায্য দেবে না—অন্তত যতক্ষণ মানিব্যাগ আমার জিম্মায় আছে।’

    আপনমনে হাসল জেফ রিকার্ড। এ লোক তাঁর চেনা, একে তিনি পছন্দ করেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘পদত্যাগ করোনি বলে এখনও কি দুঃখিত?’

    ‘কি জানি। এখনও করতে পারি।’ বন্ধু জেফ রিকার্ড প্রতিবাদ করতে যাচ্ছেন দেখে একটা হাত তুলে তাঁকে বাধা দিলেন প্রেসিডেণ্ট। ‘হেনরি পিকেরিংকে সন্দেহ করি বলে কিছুই কিন্তু বদলায়নি, জেফ,’ বললেন তিনি। ‘এ থেকে শুধু জানা গেছে কেন আমরা প্রতারিত হয়েছি, আর কেন কি ঘটেছে তার খানিকটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। তাছাড়া, পরিস্থিতি সেই আগের মতই আছে।’

    জেফ রিকার্ড গম্ভীর হয়ে উঠলেন। কিন্তু তিনি কোন মন্তব্য করলেন না।

    ‘ভেবে দেখো না, আমি যদি প্রেসিডেণ্ট না হতাম, টিউলিপ কি কিডন্যাপ হত? হত না। পামেলাকেও এত ভুগতে হত না। টিউলিপ, পামেলা, দু’জনেই ওরা আমার উচ্চাকা—ক্ষার খেসারত দিচ্ছে, তাই নয় কি? মূল্য আমাকেও কম দিতে হচ্ছে না। সব কিছুর পিছনেই তো একটা কারণ-আমি প্রেসিডেণ্ট।’ মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালেন তিনি। ‘উত্তরটা আমার জানা নেই, জেফ। হয়তো এ-ব্যাপারটা মিটে গেলে পদত্যাগ করাই আমার উচিত হবে।’

    এক মুহূর্ত ইতস্তত করে মাথা ঝাঁকালেন জেফ রিকার্ড। বন্ধুর বক্তব্য তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন। বললেন, ‘মিটে যাবে, এইটুকু গ্যারান্টি তোমাকে আমি দিতে পারি। খুব তাড়াতাড়িই মিটবে। এখন আর আমাদের হাত থেকে পালাবার কোন উপায় নেই পিকেরিঙের। দুনিয়ার অর্ধেক ইন্টেলিজেন্স এজেণ্ট খুঁজছে তাকে, তাই না?’

    .

    ওপরতলার চাতালে রয়ে গেল পিকেরিং। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল রানা, কাছাকাছি পিছনে থাকল জিনা। জিনার হাতে একটা টর্চ জ্বলে উঠল, নিচের গাঢ় অন্ধকারে আলো ফেলল সে।

    পাঁচ প্রস্থ সিঁড়ি আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। কাঠের বিমগুলো অসম্ভব মোটা, পিলারগুলো মিনোয়ান ধাঁচের, সবগুলো সিঁড়ি আর নিচের স্তরের কামরাগুলোকে ঠেক দিয়ে রেখেছে। মাসুদ রানা-১৪৪

    b8

    রঙচঙে পিলারের ফাঁক গলে ফালি ফালি চাঁদের আলো নিচেও কিছু কিছু জায়গায় নেমে এসেছে। চারদিকে ম্লান আলো, ঘন আর হালকা ছায়া, এবং গাঢ় অন্ধকার। একটা ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছুল ওরা। ঘুরল। নামতে শুরু করল আরেক প্রস্থ সিঁড়ির ধাপ বেয়ে।

    এর চেয়ে আরও দূরের বিপদ আঁচ করতে শিখেছে রানা। জিনার পিস্তল ওর পিঠে ঠেকে নেই বটে, কিন্তু ঠেকে থাকলে যতটুকু চাপ অনুভব করত প্রায় ততটুকুই অনুভব করছে ও। জানে, কোন রকম চালাকির চেষ্টা করতে দেখলে সরাসরি হৃৎপিণ্ডে গুলি করবে ডাইনীটা। সিঁড়ির গোড়ায় নেমে এল ও।

    প্রাসাদের পশ্চিম শাখায় রয়েছে ওরা, এদিকের অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় রাজ-পরিবারের লোকজন বসবাস করত। ট্যুরিস্টদের জন্যে বিরাট এক আকর্ষণ জায়গাটা। মসৃণ দেয়াল জুড়ে সার সার বাংলা 4 সংখ্যার আকৃতি নিয়ে জ্যামিতিক নকশা। ডান দিকে একটা দরজার ওদিকে লম্বা করিডর। এই করিডরের কোথাও বাস করতেন স্বয়ং সম্রাট। দরজা পেরিয়ে করিডরে বেরিয়ে এল রানা, দেয়ালের নকশাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্যে থামল না, বা মূর্তিগুলোর পরিচয় সম্পর্কে লেকচার দিল না। লম্বা করিডর ধরে খানিকদূর এগোল ও।

    ‘কোথায়?’ পিছন থেকে কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করল জিনা। ‘কে?’ নিরীহ ভঙ্গিতে পাল্টা প্রশ্ন করল রানা। ‘আমরা? নাকি টিউলিপ?’

    ‘মানলাম তোমার খুব সাহস,’ ব্যঙ্গের সুরে বলল জিনা। ‘জীবনের ওপর কোন মায়া নেই। আমি জানতে চাইছি, আর কতদূর? কোথায় রেখেছ টিউলিপকে?’

    ‘আর বেশি দূরে নয়, কাছেই,’ বলল রানা। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ও।

    ‘সাবধান!’ চাপা স্বরে গর্জে উঠল জিনা।

    রানার পিঠের পেশী কিলবিল করে উঠল, ওগুলোর যেন নিজস্ব প্রাণ আছে। ‘বোকার মত গুলি কোরো না, তাহলে টিউলিপকে খুঁজে পাবে না। শোনো, তোমার সাথে আমার কথা আছে, জিনা। আমি ঘুরছি…।’

    ‘না!’

    ঘুরতে শুরু করেও স্থির হয়ে গেল রানা। জিনার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভয় পাইয়ে দিয়েছে ওকে। ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না, মেয়েটা নির্ঘাত গুলি করে বসবে। ‘শোনো, জিনা, আমার একটা প্রস্তাব আছে,’ আবেদনের সুরে বলল রানা। ‘এসো, আমরা একটা চুক্তি করি।’

    ‘পাগল!’

    ‘আহা, আগে শোনোই না!’ ব্যস্ত সুরে বলল রানা। ‘কাজটার জন্যে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার ফি পেয়েছি আমি। টাকাটা ব্যাংকে আছে। আমার প্রস্তাবে রাজি হও, অর্ধেক, মানে এক বিলিয়ন ডলার দেব তোমাকে।’

    খিল খিল করে হেসে উঠল জিনা। রানার অসহায় অবস্থা বুঝতে পেরে ভয় কেটে গেছে তার, কৌতুক বোধ করছে। সুর করে বলল, ‘এ-ক-বি-লি-য়-ন ড-লা-র! ওমা, সে তো অনেক টাকা!’

    ‘তোমার কোন ভয় নেই, জিনা,’ এখনও রানা জিনার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে। ‘পিকেরিং কিছু বোঝার আগেই তাকে আমরা কাবু করে ফেলব। কে.জি.বি-কেও ফাঁকি দেয়া সম্ভব, প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্যে চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে নেবে তুমি। সব ব্যবস্থা আমিই করে দেব। ইচ্ছে করলে রানা এজেন্সিতে কাজ করতে পারবে তুমি, কিংবা কাজ না করে সারাটা জীবন ভোগবিলাসে কাটিয়ে দিতে পারবে। সবচেয়ে খুশি হব তুমি যদি আমার সাথে থাকো, মানে তুমি আর আমি বাকি জীবন যদি একসাথে কাটিয়ে দিই, মন্দ কি? ভেবে দেখো।’

    একটা মাত্র শব্দ উচ্চারণ করল জিনা, ‘গবেট!’

    ‘কেন, জিনা, কি হারাবে তুমি? ভেবে দেখেছ, কি বিপদে পড়তে যাচ্ছ? একদিন না একদিন পিকেরিং ধরা পড়বেই, তখন কি অবস্থা হবে তোমার? আমি তোমাকে জীবনের নিরাপত্তা দেব, প্ৰাচুৰ্য দেব,…’

    ‘আর একটাও কথা নয়,’ কঠিন সুরে বলল জিনা। ‘এগোও!’

    ‘কিন্তু কারণটা বলবে না?’ ব্যাকুল সুরে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘এরচেয়ে ভাল প্রস্তাব আর কি আশা করো তুমি?’

    ‘তোমার কোন প্রস্তাবই আমাকে টলাতে পারবে না, মাসুদ রানা,’ শান্ত গলায় বলল জিনা। ‘কারণ হেনরি পিকেরিংকে আমি ভালবাসি।’

    চুপ করে থাকল রানা। তারপর বলল, ‘ও। তারমানে সি.আই.এ. চীফের বউ হবার স্বপ্ন দেখছ তুমি।’

    ‘কেন, যদি প্রেসিডেণ্টের বউ হই তোমার আপত্তি আছে?’ শব্দ করে হাসল জিনা, লম্বা করিডরে প্রতিধ্বনি উঠল। কে বলতে পারে, হেনরি পিকেরিং একদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে না?’

    কাঁধ ঝুলে পড়ল রানার, হতাশ ভঙ্গি করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ‘চেষ্টা করে দেখলাম আর কি। আমার কপাল মন্দ।

    ‘টিউলিপকে পিকেরিঙের হাতে তুলে দিই, তারপর অনুরোধ করে দেখব ওকে, তোমার ওপর যদি একটু দয়া করে,’ বলল জিনা। ‘যদিও মনে হয় না যে তোমাকে ও বাঁচিয়ে রাখতে চাইবে।’ ছোট্ট একটু শব্দ করে রানার পিছনে হাসল সে, রানার কানে অশ্লীল আর কদর্য শোনাল। ‘তাতে কিন্তু হিতে বিপরীত ও ঘটতে পারে, রানা। ওকে তো তুমি চেনো না, আমি অনুরোধ করলে ও হয়তো আমাকেই হুকুম করবে তোমার কনুই আর হাঁটুতে গুলি করার জন্যে। তারপর শেষ গুলিটা, বুকে বা মাথায়, ও নিজেই হয়তো করবে।’

    না।

    চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রানার, কিন্তু জিনা তা দেখতে পেল

    ‘চলো,’ আদেশ করল জিনা।

    এক মুহূর্ত পর পা বাড়াল রানা। বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে আরেক লম্বা করিডরে চলে এল ওরা, এদিকে দু’পাশের ঘরগুলোর আকৃতি অন্য রকম।

    এখানে চাঁদের আলো নেই, টর্চের পিছনে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। টর্চের আলোয় মাঝে মধ্যে সামনের দেয়াল দেখতে পেল রানা, মসৃণ বা রঙ করা নয়, কর্কশ পাথর। এবার ঘরগুলোর ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ওরা। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে, কখনও বাঁ দিকে কখনও ডান দিকে। প্রাসাদের কারখানা ছিল এগুলো, হাতের কাজ শেষ হয়নি এমন সময় ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। অসমা কাজের পাশে পড়ে আছে যন্ত্রপাতি, আতঙ্কিত কারিগররা পালিয়েছে। ঘর থেকে সরু প্যাসেজে, আবার ঘরে, গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলল রানা। ট্যুরিস্টদের যে-সব জায়গায় ঘুরতে দেয়া হয়, সে-সব জায়গা থেকে দূরে সরে এসেছে ও। এদিকের বাতাসে ভাপসা একটা গন্ধ। নিকষ কালো অন্ধকার।

    আবার কথা বলে উঠল জিনা, যতটা না উদ্বিগ্ন তারচেয়ে বেশি রাগান্বিত। ‘কি করছ শুনি? নিশ্চয়ই আরও শর্টকাট কোন পথ আছে।’

    ‘দুঃখিত,’ বলল রানা। ‘থাকলেও আমি চিনি না।’

    দাঁড়িয়ে পড়ল জিনা, তারপর আবার অনুসরণ করল রানাকে। ঘুরে প্রাসাদের উল্টো দিকে চলে এসেছে ওরা। এদিকে শুধু স্টোরেজ রূম, প্রত্যেকটা সরু আর লম্বা। বেশ কয়েকটা খালি নয়। মেঝেতে, একপাশে উঁচু হয়ে আছে মাটির পাহাড়। আধুনিক যন্ত্রপাতি দেখা গেল, আর্কিওলজিস্টরা রেখে গেছে। হঠাৎ করে নয়, ধীরে ধীরে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল রানা। জিনা আগের মত নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ওর পিছনে থাকল। একটা দরজা পেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরল ওরা, সামনে আরেকটা দরজা।

    ‘দেখো, সাবধানে,’ সতর্ক করে দিল রানা। ‘মাথার ওপর দিকে ভারা বাঁধার খুঁটি আর তক্তা আছে।’

    চৌকাঠের তলার কাঠ পেরোবার সময় মাথা নিচু করল রানা। টর্চের আলো ওপর দিকে ফেলল জিনা। লোহা, আর কাঠের খুঁটি, পিলার, ক্রস-বিম, ইত্যাদির সামনে রয়েছে রানা, তার ওপর একটা চোখ রাখল সে। রানা বলল আর সে বিশ্বাস করল, তেমন মেয়ে জিনা নয়। টর্চের আলো ওপর দিকে ফেলে নিজের চোখে দেখে নিল-হ্যাঁ, সত্যি, মাথার ওপর ঝুলে রয়েছে ভারা বাঁধার অসংখ্য খুঁটি আর তক্তা।

    মাথার ওপর, নাগালের মধ্যে একটা বাঁশ দেখতে পেয়ে সেটা ধরল রানা, নিচে ওর পা আরেকটার ওপর পড়ল। চৌকাঠ পেরিয়ে এল জিনা।

    শূন্যে।

    খোলা একটা পাথুরে শ্যাফট। খাড়া টানেল, ওপরের দিকে উঠে সিলিঙে ঠেকেছে, চল্লিশ ফিট নিচে শেষ হয়েছে গিয়ে মেঝেতে। এখানে প্রাকৃতিক কোন আলো নেই, তবে শ্যাফটটা আগে এক বার এসে দেখে গিয়েছিল রানা। নিচের মেঝেতে বড় আকারের একটা সাদা পাথর আছে, তা থেকেই আন্দাজ করা যায় শ্যাফটটা কি কাজে ব্যবহার করা হত। পাতাল সমাধি, বলি দেয়া মানবসন্তানের শেষ আশ্রয়।

    দরজার কিনারা থেকে খসে পড়ছে বুঝতে পেরে আহত পশুর মত একটা দুর্বোধ্য আওয়াজ বেরিয়ে এল জিনার গলা থেকে। পিস্তল আর টর্চ উড়ে গেল হাত থেকে, পাখির ডানার মত বাতাসে ঝটপট ঝটপট করতে লাগল হাত দুটো, তাল সামলে নিয়ে চৌকাঠের ওপর থাকার ব্যর্থ চেষ্টা। টর্চের আলো সুনিপুণ বৃত্ত রচনার ভঙ্গিতে ঘুরল। নিচে কোথাও থেকে উঠে আসা একটা খুঁটির মাথায়, আড়াআড়িভাবে বাঁধা মোটা বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে রানা। মুহূর্তের জন্যে এক হলো দু’জনের দৃষ্টি। জিনার চোখে নগ্ন আতঙ্ক, চরম উপলব্ধি, করুণ আবেদন, আর নিÔল আশা।

    তাল হারিয়ে ফেলল জিনা, হাত দুটো রানার দিকে বাড়িয়ে দিল। টর্চটা আধপাক ঘুরে নিচের দিকে মুখ করল, এবার পিস্তলটার মতই দ্রুত নামতে শুরু করল নিচের দিকে, আলোটা পড়ল নিচের মেঝেতে।

    আলো-আঁধারের মধ্যে আর্তনাদ শোনা গেল। রানার সামনে দিয়ে একটা ছায়া সরে যেতে বাতাসের মৃদু স্পর্শ পেল ও। নিচে আলো, মাঝখানে পতনশীল জিনা, ওপরে রানা। প্রথম একটা ধাতব শব্দ উঠে এল, সাদা পাথরে পিস্তলটা পড়ল। দ্বিতীয় শব্দের সাথে নেমে এল গভীর অন্ধকার। তারপর পাথরে আছাড় খেলো মাংস আর হাড়। চিৎকার থেমে গেল। নেমে এল নিস্তব্ধতা।

    তাজা রক্ত গড়াল প্রাচীন পাথরে।

    লাফ দিয়ে চৌকাঠ পেরোল রানা। দরজার পাশে একটা গর্তে হাত ঢুকিয়ে একটা রিভলভার, আর একটা টর্চ বের করল। কাজে লাগবে জানত, তাই এখানে এগুলো লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল।

    ফিরতি পথে ছুটল ও।

    .

    ধ্বংসাবশেষের গভীর তলদেশ থেকে ভেসে এল ভোঁতা আর্তনাদ, সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল হেনরি পিকেরিঙের। অটল দাঁড়িয়ে থাকল সে, বোঝার চেষ্টা করল ঠিক কোন্ দিক থেকে এল আওয়াজটা। তারপর সিঁড়ির মাথার দিকে এগোল সে, যে-পথে রানাকে নিয়ে নেমে গেছে জিনা। পিস্তলটা শক্ত করে ধরল।

    মেয়েলি গলা? নাকি পুরুষের? বলা অসম্ভব। এ-ও হয়তো রানার কোন চালাকি, খোলা জায়গা থেকে সরিয়ে নিচের অন্ধকারে নামাতে চায় তাকে।

    জিনার কথা ভাবল সে। মেয়েটার প্রতি তার আস্থা আছে। যেমন সুন্দরী, তেমনি নিষ্ঠুর। শত্রু নিধনে ওর জুড়ি মেলা ভার। মিষ্টি হাসবে, লোভ দেখাবে, একটু একটু করে কাছে টানবে, প্রয়োজনে বিছানায় উঠবে-আহ্, বিছানায় জিনা তুলনাহীন-উজাড় করে দেবে নিজেকে, তারপর ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ধরে রেখে ছুরি চালাবে গলায়। ট্রেনিং পাওয়া এজেন্ট, রানা তাকে বিপদে ফেলতে পারবে না।

    তারপর সে রানার কথা ভাবল। রানা আর টিউলিপ, তার প্ল্যানের গুরুত্বপূর্ণ দুটো উপাদান। টিউলিপ হলো ট্রাম্প কার্ড, ওটা দেখিয়েই খেলা জিতে নেবে সে। ওকে উদ্ধার করে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করবে হোয়াইট হাউসে। রানার বুদ্ধি আছে, ঠিক ধরে ফেলেছে ব্যাপারটা। জেফ রিকার্ড যেখানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, হেনরি পিকেরিং সেখানে সম্পূর্ণ সফল। এই সাফল্যের বদলে সামান্য একটা দাবি-ডিরেক্টরের পদ। প্রেসিডেণ্ট আপত্তি করবেন না। কেন আপত্তি করবেন? সে কি তার মেয়েকে উদ্ধার করে আনেনি? জেফ রিকার্ড কি অযোগ্যতার প্রমাণ দেয়নি?

    কিন্তু টিউলিপ ছাড়া পিকেরিঙের প্ল্যান ভণ্ডুল হয়ে যাবে। জেফ রিকার্ডের মতই অযোগ্য বলা হবে তাকে। ওয়াশিংটনে সে নিন্দার পাত্র হবে। আরও ভয়ঙ্কর, মস্কোয় সে নিন্দার পাত্র হবে।

    হ্যাঁ, টিউলিপকে তার দরকার। রানাকেও। সে-ই একমাত্র বাইরের লোক যে গোটা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে। তাই ওকে ফিরতে দেয়া হবে না। এখানে, এই নসোসেই থেকে যেতে হবে ওকে। খুব বড় একটা হুমকি, কাজেই বাঁচিয়ে রাখা চলে না।

    ব্যাপারটা নিয়ে জিনার সাথে একটু তর্ক হয়েছে পিকেরিঙের। জিনার একটা শখ ছিল, পিকেরিং সেটা অগ্রাহ্য করেছে। রানাকে নিয়ে বিছানায় শুয়েছে জিনা, তাই তার ইচ্ছে নিজের হাতে খুন করবে ওকে। মেয়েটার মধ্যে এই অদ্ভুত একটা বিকৃতি রয়েছে। কোন শত্রুকে তৃ’ি দিলে নিজের হাতে তার প্রাণপ্রদীপও নিভিয়ে দিতে চায়। শুধু যে বিকৃত রুচি তা নয়, জিনার উল্লট কিছু আশাও আছে। তার ধারণা, সি.আই.এ. ডিরেক্টর হবার পর পিকেরিং তাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে।

    আপনমনে হাসল পিকেরিং। ভালোয় ভালোয় সব মিটে গেলে জিনাকে মস্কোয় ফেরত পাঠাবে সে। কাছেপিঠে এরকম একটা পিশাচিনী থাকলে মন লাগিয়ে কাজ করা যায় নাকি?

    উঠান পেরিয়ে এল পিকেরিং, লাফ দিয়ে একটা নিচু পাঁচিলে চড়ল। এখান থেকে ধ্বংসাবশেষের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। প্রাসাদের আণ্ডারগ্রাউণ্ড অংশ থেকে ওপরে উঠে আসার অনেকগুলো পথ রয়েছে। বেশিরভাগই মেঝের গায়ে সাধারণ গর্ত। এই গর্ত থেকে একা রানার পক্ষে উঠে আসা কোন সমস্যা নয়, কিন্তু হাতে বা কাঁধে টিউলিপ থাকলে তা পারবে না। কাজেই ওকে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে। সিঁড়ি রয়েছে দু’দিকে-এক দিকে পাশাপাশি পাঁচটা, আরেক দিকে একটা। যেদিক থেকেই উঠে আসুক রানা, টিউলিপকে নিয়ে বা একা, সাথে জিনা থাক বা না থাক, এখান থেকে তাকে ঠিকই দেখতে পাবে পিকেরিং। সে-ই প্রথম দেখতে পাবে।

    উঠতে রানাকে হবেই। বেরুবার আর কোন পথ নেই।

    পায়ের আওয়াজ! উঠানের উল্টো দিক থেকে! কেন?

    কে যেন পা টিপে টিপে হাঁটছে। দক্ষিণ গেটের ধাপ বেয়ে উঠে আসছে কেউ। এক ঘণ্টা আগে ওই পথ দিয়ে পিকেরিং নিজেই এসেছে।

    রানা? অসম্ভব। তবে কি রানার আরেকটা কৌশল?

    কুঁজো হলো পিকেরিং, পিস্তল ধরা হাতটা তুলল, শক্ত করে অপর হাতে ধরল কব্জি।

    হুইসেলের আওয়াজ। পাখির ডাক। বেরুল মানুষের গলা থেকে। নিশ্চয়ই একটা সঙ্কেত। পাহাড়ের গোড়ায় একটা সুইচ অন করা হলো। মাথার ওপর চোখ ধাঁধানো ফ্লাডলাইটের আলো জ্বলে উঠল। নর্থ পোর্চ, আর পাঁচ প্রস্থ সিঁড়ির ওপর ব্যগ্র দৃষ্টি বুলাল পিকেরিং। ঝট্ করে তাকাল উঠানের দক্ষিণ সিঁড়ির দিকে। রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিল যান্ত্রিক একটা কণ্ঠস্বর।

    ‘পুলিস! অস্ত্র ফেলে দিয়ে বেরিয়ে আসুন। সব কটা বেরুবার পথ আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।’ ইংরেজি নয়, ভাষাটা এবার গ্রীক। মুখের সামনে বুলহর্ন নিয়ে কথা বলছে কেউ।

    চিৎকার করে পিকেরিং বলল, ‘তোমার চালাকি আমি ধরে ফেলেছি, রানা!’

    এবার গ্রীক নয়, ইংরেজিতে নির্দেশ এল, ‘হেরাক্লিয়ন পুলিস! মাথার ওপর হাত তুলে বেরিয়ে আসুন!’

    চুপ করে থাকল পিকেরিং। অপেক্ষা করছে।

    ‘আপনাকে সাবধান করছি, মিস্টার, গুলি করার জন্যে তৈরি হয়ে আছি আমরা।

    হঠাৎ সিঁড়ির মাথায় একটা ছায়ামূর্তিকে দেখা গেল-প্ৰথমে শুধু মাথা, তারপর কাঁধ। সাদা শার্ট, সোনালি আর কালো চাপরাস, কালো ক্যাপ। দু’হাতে ধরা একটা পুলিস রিভলভার।

    পিকেরিং আর অপেক্ষা করল না। গুলি করল।

    লোকটার শরীর শূন্যে উঠে গেল, এক সেকেণ্ড ঝুলে থাকল সেখানে, তারপর পিছন দিকে হেলে পড়ল। সিঁড়ির নিচে, চোখের আড়ালে হারিয়ে গেল দেহটা। হঠাৎ করে আরও দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল কুঁজো হয়ে, এদেরও সাদা শার্ট, আর কালো ক্যাপ। ছুটছে তারা, এক আড়াল থেকে আরেক আড়ালে সরে যাচ্ছে। তিনজন, চারজন।

    পুরো এক ব্যাটালিয়ন পুলিস! সত্যি সত্যি পুলিস!

    লাফ দিল পিকেরিং, নিচু পাঁচিল থেকে নেমে ছুটল। পাথরের গায়ে আঁচড়াআঁচড়ি করে উঠে পড়ল উঁচু আরেক পাঁচিলের মাথায়। এক, দুই, তিন, একের পর এক ছুটে এল বুলেট। পাঁচিলের মাথা থেকে আরেক দিকে লাফ দিয়ে পড়ল সে। বাঁ দিকে ঘুরে ছুটল, খোলা পেভমেন্টের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে দৌড়াচ্ছে, সামনের নিচু পাঁচিলগুলো টপকে যাচ্ছে লাফ দিয়ে। অনেকগুলো আড়াল পেলেও মাত্র দু’এক জায়গায় থামল সে। পুলিস খুন ছেলেখেলা ব্যাপার নয়, তাও আবার বিদেশের মাটিতে। ধরা পড়লে নির্ঘাত… পিকেরিঙের চিন্তা থমকে গেল। ধরা পড়লে মানে? ওরা কি তাকে ধরার চেষ্টা করছে?

    জান নিয়ে পালাতে হবে। রুখে দাঁড়াবার সময় নয়। টিউলিপ কনওয়ের কথা মনে পড়ল, মনে পড়ল রানার কথা, কিন্তু ওদের ভাবনা পরে ভাবলেও চলবে। সে শুধু এখন আশা করতে পারে, চিৎকারটা জিনার ছিল না, ছিল রানার। আশা করতে পারে, জিনার হাতে চলে এসেছে টিউলিপ। এবং জিনাও পালাবার একটা পথ পেয়ে যাবে।

    বেড়া লক্ষ্য করে ঝেড়ে দৌড় দিল পিকেরিং। বেড়াটা টপকাবার সময় পিছনে পায়ের আওয়াজ শুনল সে। আহত পশুর মত দুর্বোধ্য আওয়াজ বেরিয়ে এল গলা থেকে। অনেক দিন হলো ফিল্ড থেকে অবসর নিয়েছে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দৌড়-ঝাঁপ করা অভ্যেস নেই। হাপরের মত হাঁপাতে লাগল সে। বেড়ার মাথা থেকে আলুর বস্তার মত ঘাসের ওপর ধপাস করে পড়ল। মনে হলো, অনেকগুলো হাড় ভাঙল। কিন্তু পরমুহূর্তে ক্যাঙারুর মত লাফ দিল সে, তীর বেগে ছুটল আবার।

    সামনে মাঠ। পিছনে চিৎকার। চারদিকের মাটি বুলেট লেগে ছিটকাল। ভাগ্যই বলতে হবে, একটাও তার গায়ে লাগল না। রেঞ্জের বাইরে চলে এল সে। তারপর অকস্মাৎ তার সামনে যমদূতের মত উদয় হলো একজন পুলিস, পিস্তল ধরা হাত তুলে লক্ষ্য স্থির করল।

    গুলি করল পিকেরিং। বন করে ঘুরে গেল লোকটা, দড়াম করে আছাড় খেল মাটিতে। লাফ দিয়ে তাকে টপকাল সে, ফাঁকা চাতালের দিকে ছুটল। রেখে যাওয়া গাড়িটা দেখতে পেল সে।

    গাড়িতে উঠে ইগনিশনে চাবি ঢোকাল পিকেরিং, হাত দুটো কাঁপছে বলে মা-বাপ তুলে গাল দিল নিজেকে। চাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ল গাড়ি, নতুন এক ঝাঁক বুলেট একটা টায়ারকেও ছুঁতে পারল না। স্পীড তুলল পিকেরিং, হেরাক্লিয়নের দিকে ছুটল গাড়ি।

    মাইলখানেক এগিয়ে হঠাৎ মোড় ঘুরল পিকেরিং, কাঁচা পথ ধরে একটা ফার্মহাউসের দিকে এগোল। গোলাঘরের প্রকাণ্ড দরজা হা হা করছে। ভেতরে ঢুকে এঞ্জিন বন্ধ করল, তালা দিল গোলাঘরের দরজায়। জানালার নিচে এসে মাথা তুলল, উঁকি দিল বাইরে। রাস্তা দিয়ে সগর্জনে ছুটে গেল একজোড়া পুলিস কার।

    মেঝেতে বসে পড়ল পিকেরিং, ঘন ঘন হাঁপাচ্ছে, উত্তেজনা আর ক্লান্তিতে কাঁপছে সারা শরীর। ভাগ্যিস এই আস্তানার ব্যবস্থা আগেই করে রেখে গেছে জিনা! পিকেরিং তার কাপড়চোপড়, কাগজ-পত্র, অফিশিয়াল পাসপোর্ট, সব রেখে গিয়েছিল এখানে। আরেকটা গাড়ি আছে লুকানো। টেলিফোনও আছে।

    বিপদ আপাতত কেটে গেছে, কিন্তু নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়াল বাজপড়া মাথা। প্রচণ্ড ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখল সে। ব্যথা শুধু মাথাতেই নয়, গোটা পিঠও ধপ ধপ করছে। আর বুকের ভেতর ফুসফুসকে যেন খিঁচুনি রোগে ধরেছে। একটু বিশ্রাম নিই, ভাবল সে, তারপর ফোন করব। সতর্ক অবস্থায় নিজের লোকজন অপেক্ষা করছে, ডাক পেলেই ছুটে আসবে তারা।

    টিউলিপ যদি জিনার হাতে থাকে, তাকে নিয়ে এখানে চলে আসবে সে। কিন্তু মিথ্যে স্বপ্ন না দেখে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া দরকার এখন। চিৎকারটা রানার ছিল না, ছিল জিনার, বিশ্বাস করতে না চাইলেও মনের ভেতরটা সে-কথাই গাইছে।

    নসোস থেকে বেরিয়ে আসবে রানা। যেভাবে হোক, পালাবার একটা রাস্তা ঠিকই বের করে নেবে সে। তবে চার বছরের একটা বাচ্চাকে নিয়ে পায়ে হেঁটে কত দূর যেতে পারবে?

    হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই গাড়ি আছে রানার। সম্ভবত তারই মত একটায় চড়ে এসেছে, আরেকটা কাছেপিঠে লুকানো আছে। আর গাড়ি মানেই রাস্তা।

    এই রাস্তাটা উত্তর-দক্ষিণ লম্বা, নসোস থেকে বেরুবার এটাই একমাত্র পথ।

    দু’হাতে মাথার চুল খামচে ব্যথাটা কমাবার চেষ্টা করল পিকেরিং। টলতে টলতে দাঁড়াল সে। দরজার দিকে পা বাড়াতেই একটা আওয়াজ ঢুকল কানে। ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে পিস্তলটা কোমর থেকে বের করে আনল।

    ‘গুলি কোরো না!’

    গোলাঘরের পিছন থেকে এগিয়ে আসছে এক লোক। চওড়া অবয়ব। চওড়া কাঁধ। স্লাভিক চেহারা।

    ‘সারটভ?’

    রুশ এজেণ্ট ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল।

    ‘এখানে তুমি কি করছ?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল পিকেরিং।

    ‘দেখতেই পাচ্ছ-তোমার সাথে যোগাযোগ।’

    ‘এমন বোকামি করে কেউ! আরেকটু হলে তো তোমাকে আমি মেরেই ফেলতাম!’

    ‘ঝুঁকি না নিয়ে উপায় ছিল? অন্ধকারে বুঝব কি করে লোকটা তুমি?

    ‘যোগাযোগ করার দরকার পড়ল কেন তাই বলো। আমার হাতে সময় নেই। ‘

    ‘সময় তোমাকে তৈরি করে নিতে হবে, কমরেড।’

    রাগে ছোট হয়ে গেল পিকেরিঙের চোখ। ‘কি?’

    জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে, সরে এসে সেই আলোয় দাঁড়াল সারটভ। ‘বড় একটা সমস্যায় পড়েছি আমরা,’ বলল সে। ‘জেফ রিকার্ড তোমার পরিচয় জেনে ফেলেছে।’

    কোথায় অদৃশ্য হলো রাগ, স্তম্ভিত বিস্ময়ে সারটভের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল পিকেরিং। মাথার ভেতর কিলবিল করে উঠল তীক্ষ্ণ মুখ কতগুলো প্রশ্ন। কিভাবে? কেন? কি ঘটেছে?

    শুধু অভিজ্ঞ নয়, প্র্যাকটিক্যাল লোক, নিজেকে পিকেরিং দিশেহারা হতে দিল না। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ধাক্কাটা সামলে নিল সে। প্রশ্নগুলোর উত্তর তাকে পেতেই হবে, উত্তরগুলোর ওপর নির্ভর করছে জীবন-মৃত্যু, কিন্তু এই মুহূর্তে উদ্‌ভ্রান্ত হওয়া সাজে না। ‘ঠিক আছে,’ বলল সে। ‘তারমানে প্ল্যান বদলাতে হবে। টিউলিপকে নিয়ে নসোসে রয়েছে রানা। ওকে পেতে হবে আমার।’

    .

    পাঁচ প্রস্থ সিঁড়ির গোড়ায় প্রায় পৌঁছে গেছে রানা, এই সময় দপ্ করে জ্বলে উঠল আলো, সেই সাথে বুলহর্নে নির্দেশ শোনা গেল। পুলিস! পুলিস এল কোথা থেকে?

    একটা ভাঁড়ার ঘরে গা ঢাকা দিল রানা, ওখানে আকাশের দিকে মুখ খোলা সরু একটা শ্যাফট রয়েছে। লাফ দিল ও, কিনারা ধরে ঝুলে পড়ল, তারপর পাথুরে দেয়ালে হাঁটু আর কনুই ঠেকিয়ে মাথা উঁচু করে উঁকি দিল বাইরে।

    গ্রাউণ্ড লেভেল থেকে গোটা দৃশ্য পরিষ্কার দেখা গেল। বেড়া টপকে পালাচ্ছে পিকেরিং, তার পিছু পিছু ছুটছে পুলিস। তবে আরও পুলিস রয়েছে, ধ্বংসাবশেষের ভেতর তল্লাশি চালাচ্ছে তারা।

    মেঝেতে নামল রানা। এক সেকেণ্ড চিন্তা করল। তারপর করিডর ধরে আবার ফিরে এল রাজকীয় অ্যাপার্টমেন্টগুলোর কাছে। পিছন থেকে ভেসে এল ফিসফাস গলার আওয়াজ, বুট জুতোর ভোঁতা শব্দ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে পুলিস। গ্রীক ভাষায় নির্দেশ শোনা গেল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সশস্ত্র লোকজন। ছুটন্ত পায়ের শব্দ, এদিকেই আসছে।

    কামরাটা ভাল করে দেখল রানা। খালি কামরা, নগ্ন চারটে দেয়াল, আর মসৃণ সিলিং-লুকোবার কোন জায়গা নেই। নিঃশব্দ পায়ে, দ্রুত, উল্টোদিকের দরজা দিয়ে ইংরেজি বর্ণমালার এল আকৃতির একটা করিডরে বেরিয়ে এল ও। করিডর থেকে আরেক চেম্বারে ঢুকল। আগেরটার চেয়ে ছোট এটা, দেয়ালে নীল ডলফিন আঁকা। নসোস-রাণী সখীদের নিয়ে খেলা করতেন এখানে। গোলকধাঁধার শেষ মাথা বলা চলে।

    দরজা আরও একটা আছে, সরাসরি রাণীর কামরায় ঢোকা যায়। তারপর ছোট একটা প্যাসেজ, প্যাসেজের মাথায় খুদে একটা ঘর-রাণীর বাথরূম।

    বাথরূমে কোন আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়নি, ট্যুরিস্টরা শুধু দিনের বেলা আসতে পারে এখানে। মেঝেতে লম্বা হয়ে রয়েছে বড়সড় পাথরের তৈরি বাথটাব, আজও অটুট। ভাবতে আশ্চর্য লাগে শেষবার রাণী এখানে গোসল করার পর চার হাজার বছর পেরিয়ে গেছে।

    বাথটাবের পিছনে হাঁটু মুড়ে বসল রানা, তারপর শুয়ে পড়ল। ওর পথ ধরেই এগিয়ে আসছে পায়ের আওয়াজ। এল আকৃতির করিডরে পৌঁছে গেছে পুলিস। অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ, তার মধ্যে একজোড়া রাণীর কামরায় ঢুকল। আরও কয়েক জোড়া পিছু পিছু ঢুকল। হঠাৎ সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর আবার এগোল। ছোট্ট প্যাসেজে বেরিয়ে এল লোকগুলো। বাথরূমের দিকে আসছে।

    রানার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠল।

    সবাই আসছে না, মাত্র দু’জন।

    নিথর পড়ে থাকল রানা, এক চুল নড়ল না। অক্সিজেনের অভাবে বুক ফেটে যাবার অবস্থা হওয়ায় মাত্র দু’একবার শ্বাস নিল ও।

    বাথরূমের দরজায় পৌঁছুল একজোড়া পা। পিছু পিছু এল আরেক জোড়া। দাঁড়িয়ে আছে ওরা। মাকড়সার জাল না কি যেন নাকে ঢুকল, হাঁচি আসতে চাইল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকগুলো, চলেও যাচ্ছে না, ভেতরেও ঢুকছে না। নাক আর মুখে হাত চাপা দিয়ে হাঁচি আটকে রাখল রানা।

    টর্চের আলো পড়ল বাথরূমে।

    আলোটা খুদে কামরার কোণগুলোয় ঘোরাঘুরি করল কিছুক্ষণ, বার কয়েক বাথটাবের কিনারা ছুঁয়ে গেল। রানা যেন জড়পদার্থ, নড়ছে না। হঠাৎ টর্চ ধরা হাতটা দ্রুত ঘুরে গেল, আলোটা মেঝের নির্দিষ্ট একটা জায়গার ওপর স্থির হলো।

    ‘ওটা কি?’

    এক মুহূর্ত কোন শব্দ হলো না। তারপর একজোড়া পা চৌকাঠ পেরিয়ে কামরার ভেতর ঢুকল। বাথটাবের পাশে মেঝের ওপর হাত বুলাল সে। সিধে হলো। ‘পয়সা। আমেরিকান।

    আবার নিস্তব্ধতা নামল।

    দোরগোড়া থেকে অপর লোকটা হেসে উঠল। ‘তাতে কি? রোজ হাজার হাজার ট্যুরিস্ট আসছে, পকেট থেকে পড়ে যেতে পারে না? দেখাই তো যাচ্ছে কেউ নেই এখানে—চলো!’

    টর্চের আলো নিভে গেল। আবার শব্দ হলো পায়ের। দূরে সরে যাচ্ছে।

    বসল রানা। উঁকি দিয়ে বাথটাবের ভেতর তাকাল। তলাটা গাঢ় রঙের চাদরে ঢাকা। চাদরটা সরাল ও।

    নির্ভাবনায় আগের মতই ঘুমাচ্ছে টিউলিপ কনওয়ে। সারা মুখে নিবিড় প্রশান্তি, বন্ধ পাতার ভেতর চোখের মণি একটুও নড়ছে না। আবার তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে রানা, বেচারি জানে না তার ওপর দিয়ে কি ধরনের বিপদ যাচ্ছে। এক অর্থে ঘুমের ওষুধই টিউলিপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। আরেকটা বাস্তব সত্য হলো, টিউলিপই এখন রানার একমাত্র রক্ষাকবচ। টিউলিপকে হারালে ওর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

    টিউলিপের পালস পরীক্ষা করল রানা, স্বাভাবিক। তার গায়ে চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে দিল, তারপর চাদর সহ তুলে নিল কাঁধে। বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল ও।

    সেই খালি কামরাটার বাইরে, করিডরে, পাহারায় রয়েছে একজন পুলিস। পিছিয়ে এসে কামরাটা আরেকবার খুঁটিয়ে দেখল রানা। নিরেট দেয়াল। সিলিঙে কোথাও ফাঁক-ফোকর নেই। ওর পিছনে রাণীর কামরা, গোলকধাঁধার শেষ প্রান্ত। বেরুবার শুধু এই একটাই রাস্তা।

    টিউলিপকে মেঝেতে নামিয়ে রাখল রানা। দরজা দিয়ে উঁকি দিল আবার করিডরে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা। হাত দুটো দু’পাশে ঝুলে আছে ঢিলেঢালা ভাবে। কিন্তু চোখ সতর্ক। ডান হাতে রিভলভার।

    কোমরের বেল্ট থেকে নিজের রিভলভারটা বের করল রানা। দরজার আরেক পাশে সরে গিয়ে রিভলভারটা তুলল। সাবধানে লক্ষ্যস্থির করল ও। তারপর ট্রিগার টেনে দিল

    আঁতকে উঠে লাফ দিল পুলিস। রিভলভার ধরা হাতটা তুলল, গুলি করার জন্যে তৈরি। লোকটা ঘুরেছে, তবে যেদিক থেকে গুলি হলো সেদিকে নয়, টার্গেটের দিকে। মাথার ওপরকার বালবটা বিস্ফোরিত হলো, গুঁড়ো কাঁচ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। তারপর ধীরে ধীরে ঘুরল সে, দু’হাতে শক্ত করে ধরে আছে রিভলভার, প্রায় অন্ধকার লম্বা করিডরের শেষ মাথার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ডান দিকের খোলা দরজাগুলো দিয়ে রাজকীয় অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়া যায়, বাঁ দিকের দরজাগুলো দিয়ে যাওয়া যায় কারিগরদের কারখানায়। দু’পাশের যে-কোন দরজা দিয়ে ভাঁড়ার ঘর, পোশাক ঘর, খেলা ঘর, বসার ঘর, ইত্যাদি আরও অনেক ঘরে যাওয়া যায়। করিডরের শেষ মাথায় ছোট, খিলান আকৃতির একটা ভারী দরজা, তালা ঝুলছে।

    গুলিটা কোত্থেকে হয়েছে বোঝার উপায় নেই।

    এক পা সামনে বাড়ল লোকটা। কোথাও কোন শব্দ নেই। সাহস একটু বাড়ল। আরও এক পা এগোল সে।

    প্রতিটি পদক্ষেপ শুনতে পাচ্ছে রানা। দরজার সামনে থেকে সরে এসেছে ও, পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দরদর করে ঘামছে। রিভলভারটা বেল্টে গুঁজে রেখেছে ও। হাত দুটো পিছনের দেয়ালে সেঁটে রয়েছে। সাবধানে, ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে লোকটা। দরজার দিকে দাঁড়াল।

    দরজার ভেতর অন্ধকার। উঁকি দিল সে। স্যাৎ করে দোরগোড়ায় বেরিয়ে এল রানা, রিভলভার ধরা হাতে ঝাপটা মারল জোরে, খটাস করে মেঝেতে পড়ল সেটা। অপর হাত দিয়ে লোকটাকে কাছে টানল রানা, নিজের বুকের ওপর। চিৎকার করার জন্যে মুখ খুলেছিল লোকটা, কিন্তু রানার কাঁধ তার মুখচাপা দিল। ধস্তাধস্তি শুরু করল লোকটা, তার পিঠ থেকে হাত সরিয়ে চোয়ালের পাশে গলায় জোরে মারল রানা। নার্ভ সেন্টারে তীব্র ব্যথা নিয়ে জ্ঞান হারাল পুলিস। ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটু।

    ধীরে ধীরে তাকে মেঝেতে নামিয়ে রাখল রানা। টিউলিপকে কাঁধে নিয়ে করিডরে বেরিয়ে এল ও। ছোট খিলান আকৃতির দরজার দিকে দ্রুত পা চালাল। পুরানো তালাটা আগেই সরিয়ে ফেলেছে রানা, যেটা ঝুলছে সেটা ওর নিজের তালা। পকেট থেকে চাবি বের করে খুলল সেটা। টিউলিপের পিঠে একটা হাত রেখে ভেতরে ঢুকল।

    এটা ঠিক কোন কামরা নয়। এক কালে ছিল বটে, এক সময় আবার হয়তো বা হবে। স্রেফ একটা গুহা, মাটি আর খোঁড়াখুঁড়ির যন্ত্রপাতিতে ঠাসা-কোদাল, শাবল, চাকা লাগানো ঠেলাগাড়ি, মাটির তৈরি তৈজস-পত্রের ভাঙা অংশ, ইত্যাদি। বিধ্বস্ত একটা চেম্বার, ট্যুরিস্টদের দেখানোর জন্যে নয়। ম্যাপে এটার হদিশ পাওয়া যাবে না।

    বৈদ্যুতিক আলোর কোন ব্যবস্থা নেই এখানে, সিলিং থেকে শুধু একটা ব্যাটারিচালিত ল্যাম্প ঝুলছে। আর রয়েছে নসোসের সর্বশেষ আবিষ্কার-একটা টানেল, ঢালু হয়ে নেমে গেছে পাহাড়ের গোড়া পর্যন্ত, প্রাসাদের আবাসিক এলাকার বাইরে।

    পাথুরে মেঝের ওপর দিয়ে সাবধানে এগোল রানা। শুধু যে ঢালু তাই নয়, বাঁকা হয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেছে সুড়ঙ্গটা। তবে তাড়াহুড়ো করার এখন আর কোন দরকার নেই, টিউলিপকে নিয়ে পালাতে পেরেছে রানা।

    টানেলের মুখ দেখা গেল। এক মিনিট পর খোলা বাতাসে বেরিয়ে এল ওরা।

    রানার পিছনে, পাহাড়ের মাথায় ফ্লাডলাইট জ্বলছে। সামনে শুধু অন্ধকার—চাঁদ আছে বটে, কিন্তু এই মুহূর্তে মেঘে ঢাকা পড়েছে। টানেলের মুখ থেকে বেশ কিছুদূর ভাল আড়াল পাওয়া গেল। প্রচুর মাটি অনেক দূর পর্যন্ত দশ পনেরো ফিট উঁচু হয়ে আছে। চাকা লাগানো ঠেলাগাড়ি গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে। নদীর কিনারা আড়াল করে আছে সাইপ্রেস গাছের সারি।

    তীরে একটা বোট, ঢেউয়ের দোলায় একটু একটু দুলছে। সাধারণ একটা নৌকো, ইঞ্জিন নেই। রশি টেনে নৌকোটাকে কাছে আনল রানা। ঘাস থেকে দু’হাতে তুলল টিউলিপকে। নৌকার পাটাতনে শুইয়ে দিল তাকে।

    নোঙর তুলল রানা। স্রোতের টানে খানিকদূর সরে এল নৌকো, তারপর পানিতে বৈঠা নামাল ও। আলো, পুলিস, আর হেনরি পিকেরিঙের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ওরা

    বেশি দূরে নয়, রাস্তার পাশে জঙ্গলে রানার একটা গাড়ি লুকানো আছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ৪৬৬ – ধ্বংসযজ্ঞ
    Next Article মাসুদ রানা ১৪৩ – অপহরণ-১

    Related Articles

    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৩৮৫-৩৮৬ – হ্যাকার (দুই খণ্ড একত্রে)

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৬ – টপ টেরর

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৪ – নরপশু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৩ – ধর্মগুরু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫২ – কালো কুয়াশা

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫১ – মায়া মন্দির

    July 22, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.