Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ১৪৪ – অপহরণ-২

    কাজী আনোয়ার হোসেন এক পাতা গল্প192 Mins Read0

    অপহরণ-২.৭

    সাত

    পায়চারি করতে করতে ভোর হয়ে গেল।

    খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রীট পাহাড়ের মাথায় সূর্য উঠতে দেখছে পিকেরিং। তার পিছনের একটা টেবিলে রেডিও সেটটা রয়েছে, সারারাত কেটে গেল একবারও জ্যান্ত হয়ে ওঠেনি। রাস্তায়, নসোসের দু’পাশে, নিজের দু’জন এজেন্টকে পাহারায় রেখেছে পিকেরিং, তারা কোন রিপোর্ট করেনি। রিপোর্ট করার কিছু থাকলে তো। পুলিস অবশ্য খুব ছুটোছুটি করেছে, তাও সারারাত নয়।

    হতে পারে রানা হয়তো এখনও ধ্বংসাবশেষের ভেতর রয়ে গেছে, ভাবল পিকেরিং। রানা হয়তো প্ল্যান করেছে ঘণ্টা কয়েক পর ট্যুরিস্টদের জন্যে গেট খুলে দিলে তখন পালাবার চেষ্টা করবে। সম্ভব, কিন্তু মনে হয় না। রানার কাজের ধারা ওরকম নয়। সে জানবে, ট্যুরিস্টদের জন্যে গেট খোলার পরও পুলিস থাকবে। সাদা পোশাকে লক্ষ্য রাখবে তারা। উঁহুঁ, আরও নিরাপদ কোন পথ ব্যবহার করবে রানা।

    হয়তো পথটা এরই মধ্যে পেয়ে গেছে সে। পিকেরিঙের কাঁধ ঝুলে পড়ল। জানালা দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে বটে, কিন্তু গাল দিচ্ছে অবিরাম-রানাকে নয়, নিজেকে। একটা দরজা খোলার আওয়াজ হওয়ায় তার মরা-বাপ এতক্ষণে রেহাই পেল।

    সারটভ।

    ‘ধরেই নিচ্ছি নতুন কিছু ঘটেনি?’

    মাথা নেড়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল পিকেরিং।

    ‘তারমানে তুমি ফেল করেছ।’

    ঝট্ করে ফিরল পিকেরিং। ‘ফেল? বিচারটা কে করে?’

    ‘আমি নই,’ বলল সারটভ। একটা চেয়ারে বসল সে। ‘এইমাত্র মস্কোর সাথে যোগাযোগ করেছিলাম।’

    বুকের ভেতর কিসের একটা মোচড় আর গড়াগড়ি অনুভব করল পিকেরিং, চিনতে পারল সে, ভয়ের অনুভূতি। মনের জোর খাটিয়ে ঝেড়ে ফেলল সেটা। ‘আমি বলব এখুনি তার কোন দরকার ছিল না।’

    ‘হয়তো।’ কাঁধ ঝাঁকাল সারটভ। ‘কিন্তু ওরা যে তোমার ওপর খুব খুশি নয় সেটা পরিষ্কার জানা গেছে। ওদের দৃষ্টিতে তুমি এখন একটা…বোঝা। সুতো ওরা কেটে ফেলতে চাইছে।’

    ‘তাই? স্রেফ চোখ উল্টে নেবে?’

    মাথা ঝাঁকাল সারটভ। ‘স্বীকার করি, সিদ্ধান্তটা রূঢ়।’

    ‘রূঢ়? বলো, মৃত্যুদণ্ড! আশ্চর্য, আর কি চায় ওরা? ওদের আমি অ্যারো, এগম্যান, মেরিলিনকে পাইয়ে দিয়েছি। সম্ভবত রানাকেও, তাই না?’

    ‘তা বটে,’ বলল সারটভ। ‘মস্কো সেজন্যে তোমার ওপর কৃতজ্ঞ। কিন্তু ওরা তোমাকে যে অ্যাসাইনমেণ্ট দিয়েছিল সেটায় তুমি ব্যর্থ হয়েছ: সি.আই.এ-র ডিরেক্টর পদে কে.জি.বি.-র একজন এজেন্ট। শুধু যে অ্যাসাইনমেণ্টে ব্যর্থ হয়েছ তাই নয়, নিজের বেলুনও তুমি ফাটিয়ে দিয়েছ, ফাঁস হয়ে গেছ তুমি। তোমার হাত খালি, মুঠোয় কিছুই নেই যে দর কষবে।’

    ঝাড়া ত্রিশ সেকেণ্ড রাশিয়ান লোকটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল পিকেরিং। তারপর হঠাৎ গভীর হতাশায় মুষড়ে পড়ে দ্রুত, অস্থিরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। ‘সত্যি, ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছিলেন,’ রানার বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল তার। ‘মস্কো থেকে তাগাদা, ওয়াশিংটনের মন যোগানো-সত্যি ভারী কঠিন কাজ।’ কঠিন বটে, কিন্তু এতদিন সুষ্ঠুভাবেই করে এসেছে সে।

    বিপর্যয়টা উপলব্ধি করতে পারল পিকেরিং-একসাথে দু’পক্ষকে হতাশ করেছে সে। মস্কো তার ব্যর্থতায় অসন্তুষ্ট, ওয়াশিংটন তার বেঈমানীতে হতভ’। দু’পক্ষই এখন তার গর্দান নিতে চাইবে।

    রাতে সারটভের কাছ থেকে সব শুনেছে পিকেরিং। গোটা ব্যাপারটা চমৎকারভাবে সাফল্যের দিকে এগোচ্ছিল। পিকেরিঙের প্ল্যান সফল হতে যাচ্ছে দেখে মস্কো উল্লাস বোধ করছিল। পিকেরিং কোণঠাসা করে ফেলেছিল জেফ রিকার্ডকে। সাহায্যের জন্যে সত্যি সত্যি জেফ রিকার্ড রাশিয়ানদের কাছে গিয়েছিলেন-দূতাবাসের পোলোনভের কাছে। বলাই বাহুল্য, পোলোনভ ঘটনাটা মস্কোকে জানায়। জেফ রিকার্ড পিকেরিংকে সন্দেহ করছে, মস্কোর জন্যে এটুকু জানাই যথেষ্ট ছিল।

    মাথার চুলে ঘন ঘন আঙুল চালাল পিকেরিং। কে জানত এমনটি ঘটবে।

    শেষরক্ষার নিশ্চয়ই কোন না কোন উপায় আছে।

    জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল সে। মাথায় একটা আইডিয়া এল। আছে, উপায় আছে। প্ল্যান একই থাকবে, একটু শুধু রদবদল দরকার। সারটভের দিকে ফিরল সে। ‘আবার যোগাযোগ করো মস্কোর সাথে,’ বলল সে। ‘ওদের বলো, অ্যাসাইনমেণ্ট এখনও সফল করা যায়।’

    ‘কিভাবে?’

    ‘প্ল্যান একটু বদলে। মেয়েটাকে উদ্ধার করে তাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাব। তবে সমস্ত দোষ চাপাব রানার ওপর।’

    ‘রানার ওপর? কিন্তু জেফ রিকার্ডকে কি বলবে? তার সাথে তোমার দীর্ঘ সময় যোগাযোগ নেই। তার কি ব্যাখ্যা দেবে? তাকে তুমি কিভাবে সামলাবে?’

    ‘টিউলিপকে নিয়ে বাড়ি ফিরলে সে কিভাবে সামলাবে আমাকে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল পিকেরিং। ‘জেফ রিকার্ড আমাকে সন্দেহ করে, কিন্তু কিছুই সে পরিষ্কার জানে না। টিউলিপকে বাবা-মার হাতে তুলে দিয়ে আমি তার সন্দেহ দূর করব। অন্তত এতে করে, খানিকটা জটিলতা সৃষ্টি হবে। তারপর আমি তার সন্দেহ রানার দিকে ফেরাব।’

    ‘আর রানা, স্বভাবতই, মারা যাবে।’

    ‘অবশ্যই। যোগাযোগ না করার কারণ হিসেবে বলব, যখন জানতে পারলাম টিউলিপকে রানা কিডন্যাপ করেছে, সি.আই.এ-র সাথে সমস্ত যোগাযোগ কেটে দিই আমি, কারণ আমি আগে থেকেই জানতাম সি.আই.এ-তে রানার অনেক বন্ধু আছে। জেফ রিকার্ড তাদের মধ্যে একজন নয়, আমার জানা ছিল না। কি করতে হবে আমি বুঝতে পারিনি।’

    এই প্রথম ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল সারটভের ঠোঁটে। ‘বলা যায় না, এতে কাজ হতে পারে।’

    ‘কাজ হতেই হবে!’ জোর দিয়ে বলল পিকেরিং।

    ‘তবে, কাজ হবে কি হবে না নির্ভর করছে রানাকে তোমার খুঁজে পাবার ওপর।

    ‘ওরা যদি আমাকে সময় দেয়, রানাকে আমি ঠিকই খুঁজে বের করব। জানোই তো, এখনও সি.আই.এ-তে আমার লোকজন আছে। ওখানে ওদের আমি ঢুকিয়েছি। ওরা সবাই এখনও আমার প্ৰতি বিশ্বস্ত।’

    এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল সারটভ। তারপর শ্রাগ করল সে। ‘ঠিক আছে, দেখব ওরা কি বলে।’

    মাথা ঝাঁকাল পিকেরিং। পরম স্বস্তিবোধ করল সে। এই প্রস্তাব মস্কোকে মেনে নিতে হবে। সারটভ কামরা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, জানালার দিকে পিছন ফিরে তার চলে যাওয়া দেখল সে। এরই মধ্যে রানাকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে দিয়েছে। কি করবে রানা, কি করতে পারে?

    রানাকে তার পেতেই হবে। এর কোন বিকন্ধ নেই। পেতে হবে টিউলিপ কনওয়েকে। এরও কোন বিকন্ধ নেই। চার বছরের একটা বাচ্চা, পিকেরিঙের শেষ আশা। বেঁচে থাকার একমাত্র অবল’ন।

    এথেন্সে সকাল হলো, গ্রীক ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টর এখনও তাঁর অফিসে বসে আছেন। সামনের চেয়ারে আরেকজন লোক রয়েছে। দু’জনের মাঝখানে ডেস্কে, একটা রিপোর্ট।

    রিপোর্ট থেকে চোখ তুলে এজেণ্ট লোকটার দিকে তাকালেন ডিরেক্টর। দ্রুত, ছোট্ট করে একবার মাথা ঝাঁকালেন। তারপর ক্রেডল থেকে তুলে নিলেন রিসিভার।

    মহাসাগর পেরিয়ে আরেক মহাদেশের সাথে যোগাযোগ হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে সরাসরি হোয়াইট হাউসের লাইন পেলেন তিনি। আরও এক মিনিট লাগল অপরপ্রান্তে জেফ রিকার্ডকে পেতে।

    ‘হেনরি পিকেরিঙের সন্ধান পাওয়া গেছে, মি. রিকার্ড,’ গ্রীক ইন্টেলিজেন্স চীফ বললেন। সংক্ষেপে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন তিনি।

    কাইরাটস নদীতে মাছ ধরছিল এক জেলে। নসোস ধ্বংসাবশেষে বারবার উজ্জ্বল আলো জ্বলতে নিভতে দেখে তার সন্দেহ হয়। তার মাছ ধরা শেষ হয়েছিল, ফেরার পথে পুলিসকে ব্যাপারটা জানায় সে। হেরাক্লিয়ন পুলিস সাথে সাথে সেখানে একটা পেট্রল কার পাঠায়।

    নসোসে পৌঁছে পুলিস দেখে অজ্ঞান করে গার্ডদের হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। পরে জানা যায়, ইঞ্জেকশন পুশ করে তাদের অজ্ঞান করা হয়েছিল। পুলিস অফিসার বড় ধরনের বিপদ আশঙ্কা করে আরও পুলিস চেয়ে রেডিও সিগন্যাল পাঠায় হেরাক্লিয়নে।

    একজন লোক, আমেরিকান, দু’জন পুলিসকে খুন করে বেড়া টপকে পালিয়েছে। বেড়ার বাইরে তার গাড়ি ছিল। ধ্বংসাবশেষ সার্চ করে একটা লাশ পাওয়া গেছে-মেয়ের। সন্ধান নেয়া হয়েছে, কিন্তু তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট এথেন্সে রেকর্ড করা নেই। নমুনা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ওয়াশিংটনের পথে।

    ‘কিন্তু,’ গ্রীক ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টর বললেন, ‘ফটো দেখে লোকটাকে আমরা চিনতে পেরেছি। হেনরি পিকেরিং। না, কোন সন্দেহ নেই। তবে দুঃখের বিষয়, আমরা জানি না তিনি এখন কোথায়।’

    অপরপ্রান্ত থেকে জেফ রিকার্ড কথা বললেন।

    তারপর আবার মুখ খুললেন গ্রীক চীফ, ‘আরও একটা ব্যাপার। ধ্বংসাবশেষে আরেকজন লোককে দেখা গেছে। দেখা গেছে বললে ভুল হবে; সে একজন পুলিসকে আহত করে। লোকটা কে সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই নেই। তবে হেনরি পিকেরিং পালাবার আগে একটা নাম ধরে ডাকেন। আমার এজেন্টের মুখে শুনেছি, নামটা ছিল-রানা।’

    ওয়াশিংটনে ভুরু কুঁচকে উঠল জেফ রিকার্ডের। রানা? তারপর, অকস্মাৎ, তাঁর চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রানা?

    হ্যাঁ, অবশ্যই! কিংবদন্তীর নায়ক মাসুদ রানা! ইণ্ডিয়ান স্প্রিঙে ঢুকে প্রেসিডেন্টের মেয়েকে কিডন্যাপ করার সাহস বা স্পর্ধা একমাত্র তারই থাকতে পারে। বিদ্যুৎ চমকের মত রানার অতীত রেকর্ডগুলো এক এক করে মনে পড়ে গেল তাঁর। এই তো সেই কাপু উ-সেনকে খুন করেছিল? এই তো সেই রানা, রাশিয়া থেকে মিগ-৩১ চুরি করে এনেছিল? মেরিলিন চার্ট এনে দিয়েছে-মাসুদ রানাই তো!

    পিকেরিঙের সাথে যোগাযোগ ছিল রানার। মেরিলিন চার্ট সংগ্রহ করার কাজটা রানা নাকি নিতে চায়নি, বুঝিয়ে-শুনিয়ে পিকেরিংই তাকে রাজি করিয়েছিল। দু’জনের মধ্যে একটা ভাল সম্পর্ক না থেকেই পারে না। পিকেরিংই তো অসলোয় গিয়েছিল, যেখানে রানা মারা গেছে বলে রটানো হয়েছিল। পিকেরিংই লাশটা সনাক্ত করার ব্যবস্থা করে।

    রানা তাহলে মারা যায়নি!

    ফোনের রিসিভার রেখে দিয়ে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন জেফ রিকার্ড। ‘বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে,’ থমথমে গলায় বললেন তিনি, ‘কিন্তু না বলেও পারছি না। বিকট একটা সমস্যায় পড়ে গেছি আমরা। তোমার মেয়ে কার কাছে আছে আমি জানি। বিদেশী এক ভয়ঙ্কর লোকের হাতে।’

    ‘কে সে? কি চায় সে? কে তার বস্? কার হয়ে কাজ করছে ইডিয়েটটা?

    ‘তার নাম মাসুদ রানা,’ জেফ রিকার্ড বললেন। ‘সম্ভবত কারও হয়েই কাজ করছে না। মুশকিল হলো, সে যদি স্বেচ্ছায় ধরা না দেয়, তাকে ধরা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করি আমি। তার অতীত রেকর্ড জানি বলেই এ-কথা বলছি।’

    ‘সি.আই.এ…’

    প্রেসিডেণ্টকে থামিয়ে দিয়ে সি.আই.এ. চীফ বললেন, ‘সি. আই.এ. দিয়ে কাজ হবে না, রিচার্ড। তবে, একটা ব্যাপারে তোমাকে আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি, টিউলিপের কোন ক্ষতি মাসুদ রানা করবে না। সারা দুনিয়ায় এ-ই একমাত্র স্পাই, ফুল ছেঁড়া যার স্বভাব নয়।

    স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ডেভিড কপারের, তা প্রায় এক বছর হলো। নির্জনতা ভালবাসে, তাই হেরাক্লিয়ন শহরের একধারে আশ্রয় নিয়েছে সে। বাড়িটার সামনে, রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর গাড়ি থামিয়ে রানা ভাবল, হয়তো সুসানের সাথে বিয়েটা টিকল না বলেই সি.আই.এ. ছেড়ে চলে আসে কপার।

    কিংবা তার ধারণা সি.আই.এ-র চেয়ে এয়ারফোর্সের চাকরিতে অনেক বেশি নিশ্চয়তা আছে।

    ডিভোর্সের পর কপারের সাথে রানার আর দেখা হয়নি। তবে টেলিফোনে দু’একবার আলাপ হয়েছে, জানে হেরাক্লিয়ন ইউ.এস. এয়ারফোর্স বেসে ডিউটি করে সে, কিন্তু বাস করে বেসের বাইরে। পুরানো বন্ধু, দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও খবরাখবর রাখতে হয়।

    ওকে দেখে নিশ্চয়ই ভূত দেখার মত চমকে উঠবে কপার।

    গাড়ি থেকে নামার আগে পিছনের সীটের নিচে ওর আরোহীকে ভাল করে একবার পরীক্ষা করল রানা। নিচে নেমে তালা দিল দরজায়। লন পেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। প্রথমে একবার, দশ সেকেণ্ড বাদে পরপর দু’বার চাপ দিল কলিং বেলের বোতামে।

    বাড়ির ভেতর আলো জ্বলে উঠল। দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে কপার। এরপর আলোকিত হলো পোর্চ। খুলে গেল দরজা।

    দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ডেভিড কপার। খালি পা, গায়ে পুরানো একটা বাথরোব। সেই আগের চেহারা, একটুও বদলায়নি। লম্বা কালো চুল, রানার সমান লম্বা, মায়াভরা চোখ। আর সেই অতি পরিচিত ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি।

    কিছুই বলল না কপার, স্রেফ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল চোখ জোড়া, ঝুলে পড়ল চোয়াল। ‘শালা ঘাড় মটকাতে এসেছে।’

    ‘সুযোগ দেয়ার জন্যে ঘরে ডাকো,’ মুচকি হেসে বলল রানা। ‘কিংবা পোর্চের আলোটা অন্তত নেভাও।

    ‘রানা!’ উল্লাসে ফেটে পড়ল কপার। বিশাল পাখির মত উড়ে এল সে রানার গায়ে। সজোরে জাপটে ধরে পিষতে লাগল বন্ধুকে বুকের সাথে। ‘আরে, এ যে দেখছি রক্তমাংসের মানুষ!’ দ্রুত একবার রাস্তার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল সে-অভ্যেস। মাসুদ রানা মানেই তো মূর্তিমান বিপদ

    জড়িয়ে ধরে রেখে রানাকে ভেতরে নিয়ে এল সে। বোকা নয় অথচ বোকার মত হাসছে। ‘হায় ঈশ্বর, এরপরও কি করে বিশ্বাস করি, ইডিয়েটটা মরে গেছে!

    ‘বুঝতেই পারছ, যারা রটিয়েছে আর যারা বিশ্বাস করেছে তারাই ইডিয়েট।’

    ‘গাল দাও, মারো, যা খুশি করো, কিন্তু মোরো না, ভাই!’ রানাকে ছেড়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করল কপার, আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল রাস্তার ওপর। ‘কিন্তু এই অসময়ে এখানে তুমি কি করছ বলো তো?’

    ‘সে এক লম্বা কাহিনী। আগে এক কাপ কফি খাওয়াও দেখি,’ বলল রানা।

    ‘শুধু কফি? ঠিক আছে, আপাতত কফিই চলুক। সারারাতই তো পড়ে আছে, মদের মধ্যে গড়াগড়ি খাব দু’জনে। মৃত বন্ধুকে ফিরে পাওয়া ক’জনের ভাগ্যে ঘটে—সেলিব্রেট করব না!’

    মুচকি হেসে কপারের পিছু পিছু কিচেনে ঢুকল রানা।

    হাতে কফির কাপ নিয়ে পুরানো দিনের গন্ধে মেতে উঠল দুই বন্ধু। কথা বলতে বলতে হঠাৎ এক সময় অন্যমনস্ক হয়ে উঠল কপার, নিচু গলায় জানতে চাইল, ‘সোহানার খবর কি?’

    ‘আছে আর কি…।’

    ‘নিশ্চয়ই ভাল নেই…’

    চট্‌ করে তাকাল রানা। ‘তোমার এ-কথার মানে?’

    ‘এমন একজনকে ভালবাসে বেচারি যাকে বিয়ে করা যাবে না-ভাল থাকে কি করে?’ এদিক ওদিক মাথা নাড়ল কপার। ‘তুমি যে একটা কি! ঈর্ষা হয়, বুঝলে, ঈর্ষা হয়। ওরকম একটা মেয়ে আমাকে যদি ভালবাসত, তার জন্যে স্রেফ জান দিয়ে দিতাম।’

    প্রসঙ্গটা এড়াতে চাইল রানা। হেনরি পিকেরিংকে ইদানীং দেখেছ নাকি?’ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল ও।

    ‘পিকেরিং? হেল, নো। ও-সব থেকে একেবারেই বেরিয়ে এসেছি আমি। বোধহয় এখনও সে ল্যাংলির ডেস্কে আঠার মত আটকে আছে।’

    ‘সব সময় নয়। মাঝে মধ্যে ফিল্ডেও তাকে দেখা যায়।’

    ‘ইন্টারেস্টিং!’

    ‘যোগ্য লোক।’

    ‘এসপিওনাজ জগতের সেরা,’ বলল কপার। ‘অবশ্য এখন ওকে বুড়োই বলা যায়।’ রানা আর কপারের বয়সের ব্যবধান অনেক হলেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে কোন অসুবিধে হয়নি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জন্যেই এটা সম্ভব হয়েছে। অত্যন্ত যোগ্য এজেণ্ট ছিল কপার। পিকেরিঙের সাথে তার বয়সের ব্যবধান খুব বেশি নয়।

    ‘হ্যা,’ বলল রানা। ‘মাঠে কাজ করার জন্যে তার বয়স একটু বেশি হয়ে গেছে। তাছাড়া, লোকটাকে আমার কোন দিনই খুব একটা পছন্দ হয়নি। আমি তাকে বিশ্বাস করি না।’

    কপারের মুখের হাসি দপ্ করে নিভে গেল। বোকার মত তাকিয়ে থাকল রানার দিকে। তারপর সে তার ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে হাত বুলাল। ‘কথাটা আরেকবার বলো।’

    ‘ঠিকই শুনেছ,’ আশ্বস্ত করল রানা।

    ‘মাই গড! কি বলছ তুমি, রানা!’

    ‘ঠিকই বলছি। হেনরি পিকেরিংকে আমি বিশ্বাস করি না।’ হঠাৎ হেসে উঠল কপার। ‘ওহ্-হো! ভুলেই গিয়েছিলাম। ওটা তো তোমার একটা বৈশিষ্ট্য। কাউকে বিশ্বাস না করা।’

    মাথা নাড়ল রানা। ‘তোমাকে আমি বিশ্বাস করি।’ মুচকি হাসল কপার। ‘অবশ্যই, যতক্ষণ তোমার চোখের সামনে থাকি! বাট ক্রিস্ট! পিকেরিং? সে ডেপুটি ডিরেক্টর!’

    ‘জানি।’

    যা জানার ছিল জেনে নিয়েছে রানা। কপারের সাথে যোগাযোগ নেই পিকেরিঙের। হাত নেড়ে বিরক্তিসূচক একটা ভঙ্গি করল ও, যেন এ-প্রসঙ্গে তার আর কোন আগ্রহ নেই। কফির কাপে চুমুক দিল। ‘সুসান কেমন আছে?’

    হঠাৎ প্রসঙ্গ বদল লক্ষ করে থাকলেও কপালের চেহারা দেখে কিছু বোঝা গেল না। ‘সুসান, তাই না?’ তিক্ত হাসল সে। ‘ভরণপোষণের জন্যে মাসে কাঁড়িকাঁড়ি টাকা গুনতে হচ্ছে, পাপের প্রায়শ্চিত্ত বলতে পারো।’ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল সে, টেবিলে কনুই, দু’হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ রগড়াল। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দেরাজের ভেতর থেকে দুটো অ্যাসপিরিন বের করল। ট্যাবলেট খেয়ে টেবিলে ফিরে এল আবার। ‘সুসানের নামটা শুনেই মাথা ধরে গেল। শেষ খবর জানি, পাঁচ ছেলের বাপ এক পেইণ্টারের সাথে ঢলাঢলি করছে। প্রথমে পালা করে আমার সব ক’জন বন্ধুর সাথে শুয়েছে, তুমি বাদে। বাদ দাও ওর কথা। তবে একটা কথা জানি, ও আবার বিয়ে না করা পর্যন্ত আমার ধনী হবার কোন সম্ভাবনা নেই।’ কথা শেষ করে আবার চেয়ার ছাড়ল সে। টলতে লাগল।

    দেখেও রানা কিছু বলল না।

    ‘হলো কি আমার!’

    ‘আবার বুঝি রাত জাগছ?’

    চেষ্টা করে একটু হাসল কপার, যেন দুষ্টামি করে ধরা পড়ে গেছে। টেবিল থেকে দূরে একটা চেয়ারে ধীরে ধীরে বসল সে।

    ‘এয়ারফোর্স কেমন লাগছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

    ‘ভাল। দু’বেলা দু’ঘণ্টা করে ডিউটি, বাকি সময় স্বাধীন। সামান্য উত্তেজনা। ভাল এই জন্যে যে কাছাকাছি সুসান আছে এই অনুভূতিটা নেই।’

    ‘গুড।’

    ‘জেসাস! কি ঘটতে চলেছে!’

    তারপর হঠাৎ মুখ তুলে রানার দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পারল। চেয়ার ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করল, কিন্তু খানিকটা উঠে আর পারল না। চোখের দৃষ্টি ভোঁতা হয়ে আসছে, যেন অনেক দূরে তাকিয়ে আছে। ‘কফির সাথে, তাই না?’ মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সে।

    নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল রানা।

    ‘কি জিনিস?’

    ‘স্থায়ী কিছু নয়,’ বলল রানা। পকেটে হাত ভরে খুদে আকৃতির একটা পিল বের করে দেখাল কপারকে। ডিয়াটল, হেরাক্লিয়নের একটা ফার্মেসি থেকে চুরি করা। চুরি ধরা পড়লে ফার্মেসির মালিক থানায় রিপোর্ট করবে বলে মনে হয় না। দু’চারটে ট্যাবলেট চুরি হলে কে আবার থানা-পুলিস করতে যায়।

    ‘ক’টা?’ জানতে চাইল কপার।

    ‘দু’দিন ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্যে যথেষ্ট। ঘুম ভাঙার পর দারুণ ভাল লাগবে তোমার। আমার কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে তোমাকে মিথ্যে কথা বলতে হবে না। দু’দিনের মধ্যে এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাব আমি।’

    ‘ধন্যবাদ। দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ছে কপার। ঘাড়ের ওপর মাথা সোজা রাখতে পারছে না। আর মাত্র একটা প্রশ্ন করল সে, ‘কেন?’

    ‘দুঃখিত, কপার, সব বলার মত সময় নেই হাতে। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। খুব দরকার ছিল বলে এই পথ বেছে নিতে হয়েছে আমাকে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ…’

    ‘আমারও তাই ধারণা,’ কথাগুলো জড়িয়ে এল কপারের। ‘গুরুত্বপূর্ণ না হলে…’ এক ছুটে তার কাছে চলে এল রানা, চেয়ার থেকে কপার পড়ে যাবার আগেই তাকে ধরে ফেলল।

    কাঁধে ফেলে অজ্ঞান দেহটাকে দোতলায় নিয়ে এল রানা। বেডরূমে ঢুকে বিছানায় শুইয়ে দিল। কপারের চাবি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ও। গ্যারেজটা পিছন দিকে, রাস্তা থেকে দেখা যায় না। গাড়িটা ছোট একটা সাদা ফিয়াট। সেটা বের করে, গ্যারেজে নিজেরটা ঢুকিয়ে রাখল রানা। তারপর পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে এল টিউলিপকে।

    দু’ঘণ্টা পর ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল রানা। ‘ক্যাপটেন ডেভিড কপার বলছি। আজ যেতে পারব না বলে ফোন করছি। মনে হয় ফ্লু হয়েছে আমার।’

    ‘শুনে দুঃখ পেলাম, স্যার,’ অপরপ্রান্ত থেকে ডিউটি অফিসার বলল। ‘আপনার সেকশনকে এখুনি আমি জানিয়ে দিচ্ছি।’

    ‘ধন্যবাদ। কাশতে কাশতে রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা। টিউলিপকে নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে, কপারের ফিয়াটে উঠে স্টার্ট দিল।

    হেরাক্লিয়ন এয়ারপোর্ট টার্মিন্যালে ঢোকার মুখে ধূসর রঙের একটা মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে আছে, প্যাসেঞ্জার সীটে বসে রয়েছে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের একজন এজেন্ট। একই দরজার কাছে পিঠে আরও ছয়জন ব্রিটিশ এজেন্টের ডিউটি পড়েছে। বাকি তেরো জন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাহারা দিচ্ছে এয়ারপোর্ট ভবন, মেইন গেট, লাউঞ্জ, টিকেট কাউন্টার এবং ডিপারচার লাউঞ্জ।

    ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স এম-সিক্সটিন-এর এজেণ্ট ওরা সবাই, হেরাক্লিয়ন আর চানিয়া এয়ারপোর্ট পাহারা দেয়ার দায়িত্ব বর্তেছে ওদের ওপর। অন্যান্য এজেন্সির লোকেরা বন্দর, রাস্তা, যানবাহন, হোটেল, কাস্টমস ইত্যাদি পাহারা দিচ্ছে। ক্রীট থেকে হাজার হাজার লোক বেরিয়ে যাচ্ছে, তাদের সবার মুখের ওপর চোখ বুলানো হচ্ছে। কিন্তু মাসুদ রানা এখনও কারও চোখে ধরা পড়েনি।

    মাসুদ রানা। মার্সিডিজে বসে লোকটা ভাবল, কে এই মাসুদ রানা? কি করেছে সে? নিশ্চয় সাংঘাতিক একটা কিছু হবে। প্রথমে বলা হলো, হেনরি পিকেরিংকে খোঁজো, এখন আবার নতুন একজন যোগ হলো—মাসুদ রানা। যতটুকু শুনেছে সে, পাহারা শুধু ক্রীটেই বসানো হয়নি। ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে চলেছে, ভয়ঙ্কর আর গোপনীয়। সরাসরি ফরেন অফিস থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের।

    কিন্তু ফরেন অফিস নির্দেশ পেল কোত্থেকে? ডাউনিং স্ট্রীট? নাকি হোয়াইট হাউস থেকে? আয়োজনের বহর, আর জরুরী হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বাকিংহাম প্রাসাদ থেকেও এসে থাকতে পারে নির্দেশটা। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবার আলামত কিনা কে জানে!

    তার গাড়ির ডান দিক ঘেঁষে একজন ইউ.এস. এয়ারফোর্স অফিসার হেঁটে গেল। হয়তো এই লোকটার ওপরও নজর রাখা হচ্ছে, ভাবল ব্রিটিশ এজেণ্ট। কিংবা এই লোকটার ওপরও দায়িত্ব বর্তেছে সবার ওপর নজর রাখার। কে যে নজর রাখছে না, বলা কঠিন। এয়ারপোর্টে নাকি তারা শুধু একা নয়, গ্রীক ইন্টেলিজেন্স এজেন্টরাও তৎপর। নিশ্চয়ই আমেরিকানরাও ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে। দু’জন ইসরায়েলী এজেন্টকে তো চিনতেই পেরেছে সে।

    সবাই নজর রাখছে, কিন্তু মাসুদ রানার কোন পাত্তা নেই। না মাসুদ রানার, না হেনরি পিকেরিঙের। আচ্ছা, সি.আই.এ. কি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নাকি? তা না হলে হেনরি পিকেরিঙের মত লোককে…সেই তো সি.আই.এ-র ডেপুটি ডিরেক্টর!

    নাহ্, ব্যাপার নিশ্চয়ই খুব গুরুতর।

    এয়ারফোর্স অফিসার টার্মিনাল ভবনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, এই সময় মার্সিডিজ থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙল সে। মুখের সামনে হাত তুলে লম্বা হাই তুলল। বসে থাকলে ঘুম পায়, একটু হাঁটাহাঁটি করা যাক। এই মাত্র একটা এয়ারপোর্ট বাস এল, আরোহীদের নামিয়ে দিল টার্মিনাল ভবনের সামনে। আরও পঞ্চাশ জন লোক। পরীক্ষা আর প্রশ্ন করে দেখা যাবে, এরা কেউ নয়।

    আবার এদের মধ্যেই থাকতে পারে মাসুদ রানা। এমন কি গর্ভবতী ওই মেয়েলোকটাও হতে পারে হেনরি পিকেরিং! কিন্তু পিকেরিং বা রানা সন্দেহ করে এদের সবাইকে ঘেরাও করতে পারে না তারা। সবাইকে যদি আলাদা করে জেরা আর পরীক্ষা করা হয়, দশ বছর সময় লাগবে।

    আরেকটা হাই তুলে বাসটার দিকে পিছন ফিরল লোকটা। ডেভিড কপারের সেক্রেটারির বয়স মাত্র উনিশ, এয়ারফোর্সে নতুন ঢুকেছে। দুনিয়াটা ঘুরে দেখার বড় শখ তার, হেরাক্লিয়নে এসে তার ভালই লাগছে। তবে দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, এখানে তাকে বেশিরভাগ সময় ডেস্কে বসে থাকতে হয়।

    ‘আমি দুঃখিত, ক্যাপটেন ডেভিড কপার আজ অসুস্থ,’ ফোনের অপরপ্রান্তের যুবতীকে বলল সে। ‘কাল রাতে তিনি ন্যাটো রিপোর্ট বাড়িতে নিয়ে গেছেন, কিন্তু আজ তিনি আসছেন না।

    যুবতীও একজন সেক্রেটারি, কিন্তু উঁচু পদের। বেসের কমাণ্ডিং অফিসারের কাজ করে সে। ‘তাহলে কাউকে তার বাড়িতে পাঠাতে হবে,’ নির্দেশের সুরে বলল সে। ‘ব্রাসেলস একটা উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করে আছে। রিপোর্টটা আজ সি.ও. সাহেবের না দেখলেই নয়।’

    কাউকে। যুবক এয়ারম্যান জানে কাউকে বলতে কাকে বোঝানো হলো। ‘ইয়েস, ম্যা’ম,’ বলল সে, ‘এখুনি যাচ্ছি আমি।’

    টিকেট কাউন্টারের পিছনে বসা সুন্দরী মেয়েটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকল। এমন সুদর্শন পুরুষ সহজে চোখে পড়ে না। খেয়াল হতে লজ্জা পেল সে, লোকটা তার দিকে সবজান্তার হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। রাঙা মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল সে, বলল, ‘আপনি অলিম্পিক এয়ারলাইন্সে এসেছেন, সেজন্যে আমরা কৃতজ্ঞ, ক্যাপটেন কপার।’ মনে মনে আরেকবার ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ির প্রশংসা করল সে, সুন্দর দাড়ি সুন্দর মুখেই মানায়। ‘এই নিন। আমাদের এথেন্স ফ্লাইট আর চল্লিশ মিনিট পর টেক-অফ করবে। রিটার্ন ডেটটা আমি খালি রেখেছি।

    ‘ধন্যবাদ।’ হাসল রানা। ইচ্ছে করেই রিটার্ন টিকেট বুক করেছে ও। নগদ টাকা কোন সমস্যা নয়, সাথে এখনও এক লাখ ডলার রয়েছে। কিন্তু বাইরে কয়েকজন ব্রিটিশ আর ইসরায়েলী এজেন্টকে দেখে এসেছে ও। ভেতরেও নিশ্চয়ই আছে ওরা। তারমানে কিছুই ওরা চেক করতে বাকি রাখবে না—কেউ শুধু একদিনের টিকেট কাটছে কিনা তাও ওরা নির্ঘাত চেক করবে।

    কপারের মানিব্যাগ বের করে টিকেটের দাম মেটাল রানা। ‘সাত ন’র গেট,’ বলল মেয়েটা। ‘পৌঁছে দেয়ার জন্যে আপনার সাথে কোন লাগেজ আছে নাকি?’

    হাতে ঝুলে থাকা গারমেণ্ট ব্যাগটা দেখল রানা। ‘না, ধন্যবাদ। এটা আমি নিজেই নিয়ে যেতে পারব।’

    অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট, কাস্টমস চেকিঙের কোন ঝামেলা নেই।

    যুবক সেক্রেটারি আবার কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল। না, তবু কোন সাড়া নেই ভেতর থেকে। বেস থেকে বার কয়েক টেলিফোনও করেছে সে, কেউ রিসিভার তোলেনি। তাহলে? অসুস্থ ক্যাপটেন গেল কোথায়? দরজার সামনে, ধাপের ওপর খবরের কাগজটা পড়ে রয়েছে। তারমানে সত্যি ক্যাপটেন বাড়িতে নেই! রাতটা তিনি অন্য কোথাও কাটিয়েছেন।

    অবাক কাণ্ড!

    ঘুরে ধাপ ক’টা টপকাল সে, গাড়ির কাছে ফিরে যাচ্ছে। কি মনে করে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্যাপটেন না হয় বাড়ি নেই, কিন্তু ন্যাটো রিপোর্টটা? গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেণ্ট, নিশ্চয়ই বাড়িতেই রেখে গেছেন। সামনে থেকে বাড়ির পিছন দিকে চলে এল সে।

    খানিকক্ষণ চেষ্টা করতেই কিচেনের একটা জানালা খোলা গেল।

    ক্যাপটেনের কিছু বলার থাকবে না, কারণ মিথ্যে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নিয়েছেন তিনি। ফ্লু হয়েছে, হাহ্! খোলা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকল এয়ারম্যান।

    পশ্চিম জার্মানীর এজেন্টে গিজগিজ করছে এথেন্স এয়ারপোর্ট। তিনজনকে দেখামাত্র চিনতে পারল রানা। হেরাক্লিয়নে ব্রিটিশ আর ইসরায়েলী, এখানে পশ্চিম জার্মানী-ওরে সর্বনাশ!

    কারা পাঠিয়েছে ওদের? পিকেরিং?

    না। পিকেরিং হলে কে.জি.বি. বা পূর্ব ইউরোপের এজেন্টদের পাঠাত। জেফ রিকার্ড? তাই হবে। জেফ রিকার্ড আর রিচার্ড কনওয়ে যুক্তি করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে-যেভাবে হোক মাসুদ রানাকে খুঁজে বের করো। মিত্র সবগুলো দেশের ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নাও!

    রানা ভাবল, কতক্ষণ ওদের চোখে ধুলো দিয়ে থাকতে পারবে সে? যেন মনে হচ্ছে গোটা দুনিয়াই ওর বিরুদ্ধে চলে গেছে।

    টার্মিনাল ভবন থেকে বেরিয়ে এল ও। কেউ ওর পথ আটকাল না। কেউ পিছু নেয়নি। ইউনিফর্মটা সত্যিই কাজের। রাস্তার মুখে এসে ট্যাক্সি নিল ও। ড্রাইভারকে বলল, ‘ওমোনিয়া স্কয়ার।’

    চৌরাস্তায় পৌঁছে ট্যাক্সি নিল রানা, বাকি পথটুকু পায়ে হেঁটে এগোল। পিছন ফিরে একবারও তাকাল না, শুধু একই রাস্তা দু’বার পেরোল, সার সার দোকানের কাঁচ মোড়া শো-কেসে চোখ রেখে দেখে নিল কেউ ওর পিছু নেয়নি। আধ মাইল হেঁটে পৌঁছে গেল জেনোফোন গ্যালারিতে। মৃদু ঠেলা দিয়ে দরজা খোলার সময় ভেতরে কোথাও সুমধুর বেল বেজে উঠল।

    ওকে ঢুকতে দেখে সামনে এগিয়ে এল রোগা-পাতলা এক মহিলা। কপালের ওপর চুলে পাক ধরেছে, চেহারায় অদ্ভুত এক আলিস্যির ভাব, যেন বাস্তব দুনিয়ার প্রতি তার কোন আগ্রহ বা মনোযোগ নেই। আসলে ঠিক উল্টোটা সত্যি, সমস্ত ব্যাপারে তীক্ষ্ণ নজর আর মনোযোগ না থাকলে সি.আই.এ. এখানে তাকে দায়িত্ব দিত না। তার গলার সাথে চেইনে একজোড়া চশমা ঝুলছে। শিন্ধীসুলভ সাদামাঠা কাপড় পরে আছে, ম্লান মুখ দেখে মনে হয় কত দিন যেন ভাল করে খাওয়াদাওয়া করেনি। রানা জানে, মহিলা সম্পর্কে বলা হয়, পিকাসোর পর আধুনিক আর্ট সম্পর্কে তার চেয়ে ভাল আর কেউ জানে কিনা সন্দেহ।

    ‘মে আই হেলপ ইউ?’ জোর করে হাসল মহিলা, নির্লিপ্ত সুরে জানতে চাইল।

    ‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘আমি কেলীর সাথে দেখা করতে এসেছি।’

    ‘কেলী।’ নামটা উচ্চারণ করে রানার আপাদমস্তক দেখল মহিলা। ‘আসুন আমার সাথে, প্লীজ।’

    কেলী হেওয়ার্থ গ্যালারির বুককীপার, বসে পিছনের একটা অফিসে। তার গোপন দায়িত্বটা হলো, সি.আই.এ. এথেন্স স্টেশনের আইডেনটিফিকেশন ডিপার্টমেণ্ট পরিচালনা করা। কেলীর অনুমতি ছাড়া একটা চামচিকেরও সাধ্য নেই নিচের তলায় নামে।

    পেশার খাতিরেই সি.আই.এ. এথেন্স স্টেশনে কে কোথায় কি কাজ করে খোঁজ-খবর রাখতে হয় রানাকে। যেমন ওই পেশার খাতিরেই সারা দুনিয়ায় এমন কিছু লোকের সাথে বন্ধুত্ব করে রানা যারা হুবহু না হলেও, প্রায় ওর মতই দেখতে। প্রায় সমান লম্বা, চুলের রঙ এক, নাক-চোখ মেলে, চোখের রঙ মেলে, শারীরিক গড়নে তেমন গুরুতর কোন পার্থক্য নেই—এ-ধরনের বন্ধুদের মধ্যে ডেভিড কপারও ছিল একজন। রানা জানে, কেলী হেওয়ার্থ কপারকে চেনে, কিন্তু ওদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আছে কিনা ওর জানা নেই। ঝাড়া দু’ঘণ্টা ধরে চেহারা বদল করেছে ও, আয়নায় নিজেকে ডেভিড কপার বলেই মনে হয়েছে, কিন্তু কপারের ঘনিষ্ঠ কোন বান্ধবীর চোখে ধুলো দেয়া সম্ভব না-ও হতে পারে।

    ‘ডেভিড! এখানে তুমি কি করছ?’

    প্রথম দর্শনে উত্তীর্ণ হলো রানা। মেটাল র‍্যাকে গারমেন্ট ব্যাগটা রাখল ও, এটায় অফিস স্টাফরা কোট রাখে। তারপর হ্যাট খুলে র‍্যাকের মাথায় রাখল। ‘পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, হ্যালো বলতে এলাম।’

    ‘এ্যাদ্দিন পর! যাক, একেবারে যে ভুলে যাওনি সেটাই আমার ভাগ্য!’ পরমুহূর্তে কেলীর চেহারায় কেমন যেন একটা সন্দেহের ভাব ফুটে উঠল। চেহারা থেকে ভাবটুকু দ্রুত মুছে ফেলে হাসল সে। ‘দারুণ দেখাচ্ছে তোমাকে! এয়ারফোর্সে আছ কেমন?’

    ‘আকাশে আকাশে থাকি, মাটির মানুষদের সাথে ঠিক মত যোগাযোগ রাখতে পারি না,’ বলল রানা, ডেভিড কপার সম্ভবত ঠিক এ-ভাষাতেই কথা বলত। কিন্তু কেলী সুন্দরী মেয়ে, কাজেই তাকে খুশি করতে হয়। ‘তবে তোমার কথা আমার সব সময় মনে থাকে। বিশ্বাস করো, তোমার নাকের পাশে ওই যে তিলটা, আমার বন্ধুরা সবাই ওটার কথা জানে।

    খুশি হলো কেলী, প্রশংসা শুনলে কোন্ মেয়েই বা না হয়!

    কিন্তু কেলী শুধু সুন্দরী নয়, বুদ্ধিমতীও। হাসল বটে, হঠাৎ হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করতেও ছাড়ল না, ‘তোমাকে কেমন যেন অন্য রকম লাগছে। কেন বলো তো?’ তার ভুরু কুঁচকে উঠল। তারপর আবার হাসল সে। ‘পেয়েছি! তোমার চশমা!’

    ‘ভাবছিলাম কখন তুমি লক্ষ করবে।’

    ‘স্মার্ট ডেভিড কপার, একচুল বদলাওনি,’ কটাক্ষ হানল কেলী। ‘ইউনিফর্মের ওপর একটা কাপড় চাপা দাও, ইউরিপিডিস হিসেবে চালিয়ে দেয়া যাবে।’

    কেলীর ডেস্কের এক কোণে বসল রানা। ‘ইউরিপিডিস কি চশমা পরত?

    শ্রাগ করল কেলী। ‘নিশ্চয়ই পরত। কুপি জ্বেলে এত লেখা লিখল কিভাবে? এথেন্সে দিন কয়েক থাকছ তো, না-কি?’

    ‘নির্ভর করছে তোমার ওপর।’

    একটা ভুরু উঁচু হলো কেলীর।

    ‘নির্ভর করছে ক’টা লাল ফিতে তুমি খুলতে পারো তার ওপর। তুমি হয়তো শুনেছ, আমাকে এয়ারফোর্স ইন্টেলিজেন্সে কেরামতি দেখাবার সুযোগ দেয়া হয়েছে?’

    ‘না, শুনিনি; তবে আশ্চর্য হচ্ছি না। তোমার অভিজ্ঞতা ওরা কাজে লাগাতে চাইতেই পারে।’

    মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘একটা প্রায়োরিটি অ্যাসাইনমেণ্ট দেয়া হয়েছে আমাকে।’ গলা খাদে নামাল ও, ‘টপ সিক্রেট। কনফিডেনশিয়াল।’

    কথা না বলে রানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল কেলী। ‘টিউলিপ কনওয়ে,’ আবার ফিসফিস করে বলল রানা। কেলীর চোখ জোড়া মুহূর্তের জন্যে অস্থির হয়ে উঠল! ‘ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার, তাই না?’

    ‘ভয়ঙ্কর কি বলছ,’ কেলীর দিকে ঝুঁকে গলা আরও খানিক খাদে নামাল রানা, ‘বলো, ডিনামাইট! গত পাঁচ বছরে এরকম সঙ্কটে পড়িনি আমরা। ওকে যদি আমরা তাড়াতাড়ি উদ্ধার করতে না পারি—’ কথা শেষ না করে হাত দিয়ে গলায় ছুরি চালাবার ভঙ্গি করল রানা।

    গম্ভীরভাবে মাথা দোলাল কেলী। ‘পিকেরিং এথেন্সে এসেছে জানার পরই আমি বুঝতে পারি, সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে। তোমার সাথে দেখা হয়েছে?’

    মাথা কাত করল রানা। ‘হেরাক্লিয়নে। শোনো বলি, আমাকে একটা ফাইল দেখতে হবে। যদি বাধ্য হই, চ্যানেল ধরেই এগোব আমি। তবে আশা করছি তুমি আমাকে ঝামেলার মধ্যে ফেলতে চাইবে না।’

    ‘কি ফাইল?’

    ‘বলো কার।’

    ‘কার?’

    ‘পল রিজওয়ে।’

    ‘নিশ্চই,’ বলল কেলী। ‘তার ফাইল তো এমন কি ক্লাসিফায়েডও নয়।’

    রানা তা জানে, সেজন্যেই পল রিজওয়ের নামটা বলেছে ও। ‘আর তাছাড়া,’ আবার বলল কেলী, ‘কোন্ সাহসে তোমাকে আমি না বলি? ভাল করেই জানি, ইচ্ছে করলে যে-কোন মুহূর্তে ডিনামাইট দিয়ে গোটা বিল্ডিংটা উড়িয়ে দিতে পারো তুমি।’

    ‘তা পারি,’ হাসতে হাসতে বলল রানা। ‘যদি দিই, তোমার তখন ডিউটি থাকবে না।’

    হেসে ফেলল কেলী। ‘পটাতে শিখেছ ভালই। চলো, দেখিয়ে দিয়ে আসি।’

    কপালের হ্যাটটা র‍্যাকের মাথা থেকে তুলে নিল রানা। ‘অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমার এই উপকার আমার মনে থাকবে।’ গারমেণ্ট ব্যাগটাও হাতে নিল ও। ‘আশা করা যায়, প্রেসিডেন্টও ভুলে যাবেন না।’

    .

    আরও কিছু কাজ সারল রানা। দু’ঘণ্টা পর ডেভিড কপারের নাম লিখে হোটেল অ্যামব্যাসাডরে কামরা ভাড়া করল। এক রাতের টাকা অগ্রিম দিল।

    অ্যামব্যাসাডর পরিষ্কার হোটেল, সার্ভিস চার্জও বেশি নয়। একা যতক্ষণ থাকবে, আশা করা যায় নিরাপদেই থাকবে টিউলিপ। আরেকটা সুবিধে হলো, হোটেলটার পিছন দিকে দরজা আছে, চুপিচুপি আসা-যাওয়া করতে পারবে রানা।

    গারমেণ্ট ব্যাগ থেকে বের করে বিছানায় শোয়াল টিউলিপকে। ভাঁজ খুলে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিল চাদরে। নিজের স্বার্থেই টিউলিপকে এখন হারিয়ে ফেলা চলবে না রানার। একমাত্র টিউলিপই ওর বেঁচে থাকার গ্যারান্টি। কিন্তু আরেক অর্থে, টিউলিপ একটা বোঝাও বটে। তার চেহারা বদলানো অত্যন্ত কঠিন কাজ। প্রতি পদে ওকে দেরি করিয়ে দিচ্ছে সে, মরি করে দিচ্ছে গতি। সাথে যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ ধরা পড়ার ভয়। সাথে না থাকলে অনায়াসে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে রানা। টিউলিপকে নিয়ে তা সম্ভব নয়।

    মেঝেতে পায়চারি শুরু করল রানা। গোটা ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। নিঃসঙ্গ, অসহায় হয়ে পড়েছে ও। বি.সি.আই. বা রানা এজেন্সির সাহায্য নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ জেফ রিকার্ড সব ক’জন এজেন্টের ওপর কড়া নজর রাখার ব্যবস্থা করেছে।

    জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল অ্যাসাইনমেণ্টটা। কেঁচে গেছে। প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করার সাথে সাথে অ্যাসাইনমেণ্টের ধরনটা বদলে গেছে সম্পূর্ণ। দু’ভাগ হয়ে গেছে শত্রুপক্ষ, দু’পক্ষই খুঁজছে ওকে। বাস্তব পরিস্থিতি হলো, গোটা এসপিওনাজ জগৎটাকেই ওর পিছনে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে।

    নিজেকে রানা স্মরণ করিয়ে দিল, কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না।

    পিকেরিঙের কথা ভাবল ও। কে.জি.বি. তো তাকে সাহায্য করছেই, সি.আই.এ-রও একটা অংশ তার অনুগত। টিউলিপ যতক্ষণ রানার কাছে থাকবে, পিকেরিং ওকে বাঁচতে দেবে না।

    আরও বড় হুমকি জেফ রিকার্ড। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। রানাকে দেখামাত্র খুন করার নির্দেশ দিতে পারেন। জীবিত ধরা পড়লে বিচারের ব্যবস্থা করবেন।

    কপালে কি আছে কে জানে! ইলেকট্রিক চেয়ার? নাকি যাবজ্জীবন? কারাগারে বেঁচে থাকার চেয়ে মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকতেই পছন্দ করবে ও।

    নিজের জন্যে কোটা ভাল জানে রানা। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হাতে টিউলিপকে তুলে দিয়ে গায়েব হয়ে যাওয়া। অন্য আর সব কিছু বোকামি।

    কিন্তু বাধা রয়েছে দুটো। কারও ওপর বিশ্বাস নেই ওর, কাজেই টিউলিপকে কারও হাতে তুলে দেয়া যায় না। আরেকটা বাধা হলো গর্ব। পেশাগত একটা গর্ব। সবারই থাকে। ওর বুদ্ধিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, এক হাত না দেখিয়ে ছাড়বে না ও। পিকেরিংকে পরাজিত হতে দেখতে চায়। শেষ করতে চায় কাজটা। শেষ করতে চায় ন্যায্য ভাবে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের চেয়ে পিকেরিং অনেক বেশি শক্তিশালী, তাদের হাতে টিউলিপকে ছেড়ে দেয়া মানেই তাকে পিকেরিঙের হাতে তুলে দেয়া।

    আরও একটা ব্যাপার রানার পক্ষে এড়ানো সম্ভব নয়। টিউলিপের প্রতি দায়িত্ব। নিষ্পাপ মেয়েটা তো কোন দোষ করেনি। প্রেসিডেন্টের মেয়ে বলে নয়, টিউলিপ কোন মেথরের মেয়ে হলেও তার প্রতি এই দায়িত্ব পালন করত রানা। কোন অবস্থাতেই তাকে পিকেরিঙের হাতে তুলে দিত না।

    হ্যাঁ, বদলে গেছে অ্যাসাইনমেণ্ট। এটা আরও কঠিন। শত্রুর কাছ থেকে পালানো চলবে না, তাদের চোখে ধুলো দিয়ে সরাসরি হোয়াইট হাউসে ঢুকতে হবে ওকে।

    রানার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল। বেশি সাহস দেখানো হয়ে যাবে? স্বেচ্ছায়, বোকার মত, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছে ও?

    কাঁধ ঝাঁকিয়ে চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল রানা। প্রকাণ্ড ঝুঁকি, তা ঠিক। কিন্তু পুরস্কারও তো বিরাট। পিকেরিংকে পরাজিত করতে পারলে একটা অন্যায়ের অবসান ঘটবে। টিউলিপকে তার বাবা-মার হাতে তুলে দিতে পারলে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

    সাফল্য এলে উল্লাসের সাথে আসবে আত্মতৃপ্তি।

    বাধা আর বিঘ্ন যাই থাক, টিউলিপকে বাড়ি নিয়ে যাবে রানা।

    তারপর হেঁটে বেরিয়ে আসবে।

    তারপর মাসুদ রানার কোন অস্তিত্ব না থাকে নাই থাকবে। মাসুদ রানা না থাকলে কাকে শাস্তি দেবে মার্কিন প্রশাসন? কাকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসাবে? কিংবা কার স্বাধীনতা কেড়ে নেবে?

    হাওয়া হয়ে যাবে সে বেমালুম।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ৪৬৬ – ধ্বংসযজ্ঞ
    Next Article মাসুদ রানা ১৪৩ – অপহরণ-১

    Related Articles

    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৩৮৫-৩৮৬ – হ্যাকার (দুই খণ্ড একত্রে)

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৬ – টপ টেরর

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৪ – নরপশু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৩ – ধর্মগুরু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫২ – কালো কুয়াশা

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫১ – মায়া মন্দির

    July 22, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.