Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ৪৬৩ – ছায়াঘাতক

    কাজী মায়মুর হোসেন এক পাতা গল্প421 Mins Read0
    ⤷

    ছায়াঘাতক – ১

    এক

    আগুন ঝরা সেপ্টেম্বর মাস।

    বালির বিশাল শুকনো সাগরের মাঝে এবড়োখেবড়ো প্রাচীন ভাঙা কিছু দেয়াল। কেউ জানে না কত শত বছর আগে পরিত্যক্ত হয়েছে মিশরের পশ্চিম মরুভূমিতে এই দুর্গটা।

    ফাটল ধরা উঁচু মিনারের চূড়ায় বসে ঘাড় কাত করে ধুলোভরা কয়েকটা জিপ আসতে দেখছে গলাছেলা, ধেড়ে এক শকুনী। দুর্গের বিধ্বস্ত ফটক পেরিয়ে উঠানে থামল গাড়িগুলো। খটাক্ আওয়াজে খুলে গেল সামনের জিপের দরজা। তপ্ত বালিতে বুটপরা পা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল এক লোক। আড়মোড়া ভাঙল। বহু দূর থেকে এসেছে বলে আড়ষ্ট দেহের মাংসপেশি। কয়েক মুহূর্ত পর কপালে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করল জ্বলজ্বলে সাদা সূর্যটার মতিগতি। কোথাও একফোঁটা হাওয়া নেই। এদিকটা যেন হাবিয়া দোজখের জ্বলন্ত উনুন।

    গাড়ি থেকে যে নেমেছে, তার নাম জমির শেখ। গোটা দুনিয়ার ওপর খেপে যাওয়া আরব বিশ্বের কুখ্যাত এক দস্যু সে। আদি বাস ছিল বাগদাদে। ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন বিমানবাহিনীর যত্রতত্র নির্বিচার বোমা বর্ষণে পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান ও বাড়িঘর সব হারিয়ে এখন দলবল জুটিয়ে নিয়ে সর্বত্র দস্যুতা করে বেড়ানোই তার নেশা ও পেশা। বুকের ভিতর সারাক্ষণ জ্বলছে তার প্রতিহিংসার আগুন। প্রতিজ্ঞা নিয়েছে: যারা তার এতবড় ক্ষতি করেছে, তাদের বুকেও জ্বালবে আগুন, কাউকে ছাড়বে না। জর্জ বুশের কারণে জ্বলবে আমেরিকা, টনি ব্লেয়ারের কারণে খেসারত দেবে ব্রিটেন, যারা যুদ্ধবাজ বুশকে সাহায্য করেছে— তারাও কেউ ছাড় পাবে না। ইজরায়েল, ফ্রান্স, জার্মানি… এমনকী আরব বিশ্বের যারা এই অন্যায় যুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে রেখে নিজেদের চামড়া বাঁচিয়েছে, সুবিধা লুটেছে, তাদেরও রেহাই নেই। ফলে যা হবার তা-ই হয়েছে: মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি সরকার ঘোষণা করেছে, কেউ জমির শেখকে ধরিয়ে দিতে পারলে তাকে বিশ মিলিয়ন ইউএস ডলার পুরস্কার দেয়া হবে।

    ফলাফল: ধরা পড়ল জমির শেখ। সৌদি আর্মড পুলিশের হাতে। মার্কিন সরকার চাইল তাকে। বলা বাহুল্য, তাদের খুশি করতে সব সময়েই প্রস্তুত সৌদি প্রশাসন। জমির শেখকে ভরে দেয়া হলো গুয়ান্তানামোর টর্চার সেলে।

    বন্দিশিবিরে পুরো আড়াই বছর প্রচণ্ড মারধর ও নির্যাতন সহ্য করে একটা কথা ভাল করেই বুঝে গেল জমির মুসলিম, খ্রিস্টান বা ইহুদি, প্রতিটা ধর্মের মানুষই আসলে তার শত্রু। স্রষ্টা বলে আসলে কেউ নেই। মানবজাতির উপর তীব্র ঘৃণা জন্মাল তার মনে। তখনই ঠিক করল, একবার মুক্তি পেলে কাউকে ছাড়বে না সে। কাউকে না।

    একরাতে তিনজন আমেরিকান প্রহরীকে খুন করে দ্বীপ থেকে উধাও হলো জমির। মিশরে এসে আবারও গড়ল ছোট একটা সন্ত্রাসী দল। তবে তার দলের সবাই লুটের ভাগ পেয়েই সন্তুষ্ট থাকল, কেউ জানল না কী আছে জমির শেখের মনে, কী করতে চলেছে সে। প্রস্তুতি নিচ্ছে জমির, আজ বা কাল, বেইমান মানুষগুলোকে একহাত দেখিয়ে দেবে সে। সেজন্যে মরতেও দ্বিধা নেই তার।

    গাড়িগুলো থেকে নামল জমির শেখের এগারোজন অনুচর। সবার চোখ দলনেতার ওপর। ক’জনের গায়ে মিলিটারি কমব্যাট ফেটিগ, আবার কারও পরনে টি-শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট। ছয়জনের কাঁধে ঝুলছে একেএস-৭৪ অ্যাসল্ট রাইফেল। গাড়ির ভেতর প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি। অস্ত্রের মাযলে এখনও পোড়া করডাইটের কটু গন্ধ।

    পরিত্যক্ত দুর্গের চারপাশে চোখ বোলাল জমির শেখ। ডানহাতে খস খস করে চুলকে নিল তিনদিনের খোঁচা-খোঁচা দাড়িভরা চিবুক। বিগত ছত্রিশ ঘণ্টার ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবছে সে।

    ভালই ধোঁকা দেয়া গেছে। হামলার পর পর আকাশে উঠেছিল পুলিশ ও মিলিটারির হেলিকপ্টার। তবে ভুল জায়গায় খুঁজেছে অ্যান্টি-টেরোরিস্ট ফোর্স। এখন আসওয়ান থেকে এক শ’ মাইলেরও বেশি দূরে এই মরুভূমিতে তাদেরকে খুঁজছে না কেউ। কে বলবে ঘণ্টা তিনেক আগেই আসওয়ান থেকে কায়রো রওনা হওয়া উত্তরমুখী এক টুরিস্ট ট্রেনে দলবল নিয়ে হামলা করেছিল জমির শেখ।

    রক্তাক্ত ওই দৃশ্যের কথা মনে পড়তেই হাসল নিষ্ঠুর দলনেতা। কিছুই করার ছিল না নিরস্ত্র টুরিস্টদের। আগ্নেয়াস্ত্রের শত শত গুলি ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়েছে ছয়টা বগির সবার বুক-পেট। তাজা রক্তে ভেসে গেছে রেল লাইন ও দু’পাশের বালি-পাথর। নিপুণভাবে আরেকটা কাজ শেষ করতে পেরে ভাল লাগছে জমির শেখের।

    বছর কয়েক আগে হাটশেপসিউট-এর মন্দিরে গামা আল-ইসলামিয়ার দলে ভিড়ে ষাটজন টুরিস্ট খতমে অংশগ্রহণ করেছিল জমির। সেসময়ে অ্যান্টি-টেরোরিস্ট কমাণ্ডোদের হাতে অন্যরা খুন হলেও বেঁচে যায় সে। এরপর মাঝে মাঝেই টুরিস্ট বাসে অ্যাম্বুশ করেছে। বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে টুরিস্ট রিসোর্ট। এ ছাড়া, নীল নদের কিছু ক্রুয়ারে হামলা করে খুন করেছে আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীদেরকে। মোটরসাইকেলে হাজার হাজার পেরেক রেখে তৈরি করেছে সুইসাইড বম। তার নির্দেশেই দু’হাজার পনেরো সালে খান আল-কালিহি বাজারে শতখানেক মানুষ খুন করেছিল আত্মহত্যাকারী বোমারু মোটরসাইকেল আরোহী।

    জমির শেখের জন্যে এসব বড় কিছু নয়। প্রতিভা আছে, লোকবল আছে, কাজেই তার চোখ আরও ওপরে। ছড়াতে শুরু করেছে উত্তর আফ্রিকায় সন্ত্রাসী জাল। যোগাযোগ রাখছে মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। অবশ্য, বড় কিছু করতে হলে চাই কোটি কোটি ডলার। কিছু দিন হলো সেই সমস্যা নিয়েই ভাবছে সে।

    আপাতত খুনে মরুভূমির দাবদাহ থেকে রক্ষা পাওয়া জরুরি। দিন শেষে মেরুর হিমঠাণ্ডা নামতে দেরি আছে- তার আগে মগজটা প্রায় সেদ্ধ করে দেবে বজ্জাত সাদা সূর্যটা। অবশ্য, ভাঙা দুর্গের দেয়ালের আড়ালে ঠাঁই নিতে পারবে তারা। আরও চাই দরকারি একটা জিনিস। ওটা হয়তো পাবে এখানে। ক্যান্টিন মুখে তুলে শেষ কয়েক ঢোক পানি শুকনো গলায় ঢালল জমির শেখ। তাতে মিটল না তৃষ্ণা। কালো নিসান পেট্রল জিপের ভেতর ছুঁড়ে ফেলল ক্যান্টিন। শার্টের আস্তিন দিয়ে মুখ মুছল সে।

    দলে সবচেয়ে কমবয়সী সদস্য মুস্তাক। সে হাসছে বলে দুই ঠোঁট গিয়ে ঠেকেছে কানের কাছে। উঠানের মাঝে বৃত্তাকার পাথুরে দেয়াল দেখাল সে। ‘বলেছি না?’

    কড়া চোখে তাকে দেখল জমির শেখ। প্রায় অচেনা কারও কথা শুনলে এত দিনে কবরে পচে যেত সে। এই ছোকরাকে বিশ্বাস করবে কি না, সেটা জেনে নেয়ার সময় হয়েছে এবার।

    বৃত্তাকার দেয়ালের পাশে থেমে নিচে তাকাল জমির। শাট্ বেশ গভীর। নিচে অন্ধকার। উঠান থেকে তুলে নিয়ে প্রাচীন কূপে ছোট একটা পাথর ফেলল সে। ছলাৎ আওয়াজের জন্যে কান পাতল। কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে গেলেও তলা থেকে এল না কোনও আওয়াজ।

    ‘তুমি বলেছিলে পানি থাকবে,’ চাপড় মেরে ঘাড় থেকে স্যাওফ্লাইটাকে খুন করল জমির।

    চুপচাপ মাথা নেড়ে আস্তে করে কাঁধ ঝাঁকাল মুস্তাক। কূপের পাশে এসে দাঁড়াল আখলাক। ঘামে ভেজা চকচকে টাকমাথাটা সবুজ তোবড়ানো বেসবল ক্যাপ দিয়ে মুছে নিয়ে আবার পরল সেটা। সবসময় ওটা মাথায় রাখে ও। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের আগেই উচিত ছিল ফারাফ্রা মরূদ্যানে চলে যাওয়া।’

    মাথা নাড়ল জমির। মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে ওই মরূদ্যান। ওখানে থাকে একদল বেদুঈন। জায়গাটা জঙ্গিদের জন্যে স্বর্গ হলেও বেদুঈনদের ভেতর হয়তো রয়েছে গুপ্তচর। গোপনে পুলিশের কাছে তথ্য বিক্রি করবে সে। রেলগাড়িতে হামলার পর পেরিয়ে গেছে কয়েক ঘণ্টা। রেডিয়ো ও টিভির কল্যাণে চারদিকে নিশ্চয়ই ছড়িয়ে পড়েছে সংবাদ। সুতরাং মরূদ্যানে হাজির হওয়া এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

    ‘কূপে নামো,’ মুস্তাককে নির্দেশ দিল জমির শেখ। প্রতিবাদ করতে গিয়েও ছেলেটার মনে পড়ল, কোনও তর্ক না করেও জমিরের হাতে খুন হয়েছে অনেকে।

    দলে সবচেয়ে বয়স্ক লোক দাড়িওয়ালা রহমান ও পেটমোটা জামিল। তারা একটা জিপের বুল বার-এ দড়ি বেঁধে অন্যপ্রান্ত মুস্তাকের কোমরে বাঁধল।

    ভয় পেয়েছে, চকচক করছে তরুণের দু’চোখ। তবে নির্দেশ না মেনে উপায় নেই তার। তিন সাগরেদ দড়ি ধরে ওর ওজন নেয়ার জন্যে তৈরি হওয়ার পর, পাথুরে দেয়াল টপকে কৃপে নেমে পড়ল মুস্তাক।

    সংকীর্ণ গভীর কূপ। বেশ অনেকক্ষণ নামার পর নিচের মেঝেতে ঠেকল মুস্তাকের বুটের সোল। আঁধারে কুঁজো হয়ে দু’হাতে খামচে তুলল শুকনো বালি। খট-খট করছে চারপাশ। ঘাড় কাত করে ওপরে তাকাল তরুণ। অনেকটা ওপরে কূপের গোল মুখ। ওখানে আছে আকাশের অবারিত সুনীল বিস্তার ও স্বাধীনতা। ওপর থেকে চেয়ে আছে ক’জন। ‘কুয়ায় পানি নেই,’ চেঁচিয়ে বলল মুস্তাক। ওর কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি তুলল বদ্ধ কূপে।

    কী যেন সাঁই করে নেমে এল ওপর থেকে। চমকে গেছে মুস্তাক। ভারী জিনিসটা খটাস্ করে পড়ল ওর মাথার ওপর। কয়েক মুহূর্তের জন্যে বিবশ হলো তরুণ। ভীষণ টলমল করছে দুই পা। হাতটা রাখল কপালে। ফাটা ভুরু বেয়ে দরদর করে পড়ছে রক্ত। পা সরাতেই টের পেল, মেঝেতে পড়ে আছে একটা ফোল্ডিং কোদাল।

    ‘গাধার বাচ্চা— শালা, তুই-ই আমাদেরকে এখানে এনেছিস,’ ওপর থেকে এল জমির শেখের কণ্ঠ। ‘গর্ত খুঁড়ে দ্যাখ পানি আছে কি না।’

    ‘কোন্ হারামি শুঁটকি মাগীর পুটকি দিয়ে যে বেরিয়েছে শুয়োরের বাচ্চাটা!’ বিড়বিড় করল তরুণ মুস্তাক।

    ভাবেওনি তার কণ্ঠস্বর পৌছুবে ওপরে। সংকীর্ণ কূপে প্রতিধ্বনিত হয়ে সবই পৌঁছে গেছে জমিরের কানে। প্রতিক্রিয়া হলো মারাত্মক। দলের অন্যরা দেখল ঝড়ের বেগে নিসান গাড়ির পাশে গেল জমির। পেছনের সিট থেকে নিল এম৬০ লাইট মেশিন গান। ককিং বোল্ট টান দিয়ে কূপের পাশে এসে অস্ত্রের দীর্ঘ মাযল শাফটের ভেতর ভরল জমির। চিৎকার করে বলল, ‘কুত্তার বাচ্চার ওপর আলো ফ্যাল্!’

    মুখ বিকৃত করল আখলাক। ‘জমির, আমার মনে হয়… দাউদাউ আগুনে জ্বলছে জমির শেখের দুই চোখ। চাপা স্বরে বলল, ‘টর্চ মারো শুয়োরের বাচ্চার ওপর!

    তারা বিশ বছর ধরে বন্ধু, তবে জমির শেখের বিরোধিতা করলে তার ফলাফল এখন হবে খুব খারাপ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ম্যাগলাইট জ্বেলে গহ্বরে আলো ফেলল আখলাক।

    গাল বকে চোর-চোর চেহারা করেছে মুস্তাক।

    দ্বিধাহীন ভঙ্গিতে এম৬০ লাইট মেশিন গানের বাঁট কাঁধে তুলল জমির, তারপর কয়েক পশলা গুলি করল নিচের দিকে। খানখান হয়েছে মরুভূমির নীরবতা।

    কোথাও লুকিয়ে পড়ার উপায় নেই মুস্তাকের। প্রথমে চাইল কাদামাটির দেয়াল বেয়ে উঠে যেতে। কিন্তু শুকনো কাদা ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে মেঝেতে। মেশিন গানের নল মুস্তাকের দিকে তাক করল জমির। কূপের ভেতর নানাদিকে লেগে ছিটকে গেল একরাশ গুলি। জমিরের পায়ের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে বুলেটের চকচকে খালি খোসা। চুপ করে টর্চ তাক করে রাখল আখলাক। পিছিয়ে গিয়ে কানে হাত চাপা দিল অন্যরা।

    বিশাল ডানা মেলে মিনারের চূড়া থেকে আকাশে ভেসে উঠেছে গলাছেলা শকুনী। গুলির আওয়াজ পছন্দ নয় তার।

    কয়েক সেকেণ্ড পর গুলিবর্ষণ থামাল জমির। হাতে আলতো করে ধরেছে এম৬০। কঠোর চোখে দেখল আখলাককে। ‘মনে রেখো, যতই পুরনো বন্ধু হও, আর কখনও আমার কথার অবাধ্য হবে না।

    ‘দুঃখিত,’ বিড়বিড় করল আখলাক।

    বৃত্তাকার দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেশিন গান রাখল জমির। স্বাভাবিক সুরে বলল, ‘এমনিতেই প্রথম থেকে ওকে পছন্দ হয়নি আমার।’ আখলাকের হাত থেকে টর্চ নিল সে। আলো ফেলল কূপের ভেতর। নিচে মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে তরুণ মুস্তাক। দেহটা অর্ধেক তলিয়ে গেছে শুকনো কাদা ও ধুলোয়।

    ‘আমাদের বোধহয় রওনা হওয়া উচিত, অন্যদিকে চেয়ে বলল আখলাক।

    কিন্তু কূপের ভেতর অন্যকিছু দেখেছে জমির। মেঝে থেকে বিশ ফুট ওপরের দেয়ালে টর্চের আলো ফেলল সে। ওখানে শাফটের দেয়াল খসে পড়েছে গুলির তোড়ে।

    জায়গাটা খুব অস্বাভাবিক।

    শুকনো কাদার মাঝে ওটা সাধারণ পাথর নয়। মসৃণ। কারুকাজ করা। প্রাচীন এক অদ্ভুত ভাষায় কীসব যেন লেখা।

    চোখ সরু করল জমির। ‘ওটা কী?’

    ‘কী দেখছ?’ জানতে চাইল আখলাক।

    জবাব দিল না জমির। টর্চ পকেটে রেখে টান দিয়ে তুলল দড়ি। নিচের অংশ গুলির আঘাতে ছিঁড়ে রয়ে গেছে কূপের মেঝেতে। দড়িতে মেখে আছে মুস্তাকের রক্ত। তাতে সমস্যা নেই জমিরের। দড়ির শেষ অংশ নিজের কোমরে বাঁধল সে। কর্কশ স্বরে বলল, ‘আমাকে নামাও।’

    কয়েকজন মিলে তার ওজন টেনে ধরতেই শাফটে নেমে পড়ল জমির। সামনের দেয়ালে পা রেখে নামছে। ঠিক জায়গায় এসে পকেট থেকে বের করল টর্চ। ডানহাতে রেখেছে কমব্যাট ছোরা। ওটা দিয়ে খুঁচিয়ে তুলতে লাগল শুকনো কাদা। ঝরঝর করে নিচে মুস্তাকের লাশের ওপর পড়ছে ধুলোবালি। একটু পর ঢাকা পড়বে দেহটা।

    পাগলের মত ছোরা চালাচ্ছে জমির। একমিনিট পেরোবার আগেই জেনে গেল, ওটা একটা পাথরের স্ল্যাব। বালিমাটির ভেতর গভীরভাবে গেঁথে আছে ওটা। আরও খুঁড়তেই জমির বুঝল, ওপাশে আছে প্রাচীন কোনও চেম্বার। বহুকাল ধরে লুকিয়ে আছে মাটির নিচে।

    টর্চের আলোয় পাথরের বুকে অদ্ভুত ভাষা দেখছে জমির। চট্ করে বুঝে গেল, ওগুলো হাজারো বছর আগের হায়ারোগ্লিস্। ভাবছে, পাথরের এই স্ল্যাবের, ওদিকে হয়তো আছে দামি কিছু।

    কিন্তু জিনিসটা কী?

    জানতে হবে!

    দলের উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল জমির। ‘আমার ব্যাগটা ফেলো!’

    কয়েক সেকেণ্ড পর কূপে পড়ল ছোট এক মিলিটারি ন্যাপস্যাক। দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়ছে, খপ্ করে ওটা ধরল জমির। ঘাড়ে জড়িয়ে নিল ব্যাগের স্ট্র্যাপ। পকেট থেকে নিল শেপ করা প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ।

    পাঁচ মিনিট পর আরেক হাঁক ছাড়ল জমির। ফলে দড়ি টেনে তাকে তোলা হলো ওপরে। কৌতূহলের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবাই।

    ‘জিনিসটা কী?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল আখলাক।

    জবাব না দিয়ে রিমোট ডেটোনেটর বের করল জমির। হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিল, এবার এখান থেকে সরে যেতে হবে।

    দলনেতার পিছু নিয়ে জিপগাড়িগুলোর ওদিকে চলে গেল সবাই। মাটিতে বসে পড়ে চার্জ অ্যাকটিভেট করল জমির।

    কূপ থেকে ছিটকে বেরোল কমলা আগুন ও ধূসর ধোঁয়া। আকাশ থেকে পড়ছে মাটি, পাথর ও বালি। মুখ- মাথা ঢাকল সবাই। উঠানের এদিকটা ঢেকে গেছে ঘন ধোঁয়ায়।

    ধুলোবালি থিতু হওয়ার আগেই আবারও কূপের পাশে পৌঁছুল জমির। কুণ্ডলী পাকিয়ে রাখা দড়ি ফেলল গহ্বরের ভেতর। টর্চের আলোয় দেখল শাফটের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ধূলিকণা ও ধোঁয়া।

    বিস্ফোরণের ধাক্কায় ধসে গেছে কূপের একদিকের দেয়াল। টনকে টন ধুলোবালির নিচে চাপা পড়েছে মুস্তাকের লাশ। তবে মৃত তরুণের কথা আগেই ভুলে গেছে জমির। বুঝতে পারছে, তার ধারণাই ঠিক। পাথরের স্ল্যাবের ওদিকে রয়েছে কোনও চেম্বার। শেপ করা চার্জের কারণে দুই ফুট পুরু পাথরের স্ল্যাব হয়েছে খুদে জানালার মত। ওখানে আলো ফেলল জমির। দলের কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে নেমে গেল শাফটের ভেতর। টর্চের পেছনের দিক দিয়ে গুঁতো মেরে খসিয়ে দিল ছোট কয়েকটা পাথর খণ্ড। হাত ভরে দিল গর্তের ভেতর। ঘর্মাক্ত আঙুলে লাগল শীতল হাওয়া।

    হাত টেনে নিয়ে ভেতরে টর্চের আলো ফেলে উঁকি দিল জমির। ওদিকের দৃশ্যটা দেখে চক্ষু চড়ক গাছ হলো তার!

    দুই

    ফ্রান্স।

    একটু আগে নরম্যাণ্ডি শহরের বুকে নেমেছে নীলচে আঁধার। আকাশে অজস্র রঙিন নক্ষত্রের মেলা।

    এইমাত্র অফিসে তালা মেরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের সুন্দর, ছিমছাম অ্যাপার্টমেন্টে ফিরেছে মাসুদ রানা, মানসিকভাবে ভীষণ পরিশ্রান্ত। ক’দিন হলো গুছিয়ে নিচ্ছে রানা এজেন্সির নতুন এই শাখা। সাড়াও পাচ্ছে স্থানীয় ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে। এরই ভেতর ছয়টা কেস পেয়েছে ওরা। বিসিআই থেকে আসা চার নতুন এজেন্টের প্রত্যেকেই ব্যস্ত। তাদের প্রতিদিনের দেয়া রিপোর্ট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে রানা। বারবার মনে হচ্ছে, অফিসে বসে ফাইল ঘেঁটে সময় নষ্ট করা ওর কাজ নয়। কিন্তু মনের সে-কথা বলবে কাকে!

    পরিষ্কার বলে দিয়েছেন বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান, ‘রানা, আমাদের এখন টাকা দরকার… প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। অনেক, অনেক। সময় বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেছে অফিসের ব্যয়। সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে হলে জরুরি দরকার প্রচুর আল্ট্রামডার্ন গ্যাজেট, অনেকগুলো সুপার কমপিউটার ও অন্তত দ্বিগুণ সংখ্যক প্রশিক্ষিত জনবল। এতদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানান ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছ তোমরা ক’জন সোনার টুকরো ছেলে-মেয়ে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? তোমাদের বুকভরা দেশপ্রেম, সততা ও প্রচণ্ড শ্রম সত্ত্বেও আধুনিক টেকনোলজি প্রয়োগের অভাবে অন্যান্য দেশের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির চেয়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি আমরা।’

    বসের নির্দেশে এক এক করে ইউরোপ ও আমেরিকার বড় শহরগুলোতে রানা এজেন্সির শাখা খুলছে রানা। যা আয় হচ্ছে, তার সিংহভাগ অর্থ পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে দেশে। গত চারমাস ইউরোপ ও আমেরিকায় নানান শহরে চরকির মত ঘুরেছে রানা। টু শব্দ না করে ছুটির দিনেও কাজ করেছে সহকর্মীদেরকে পাশে নিয়ে। তবে আজ বিকেলে বিস্মিত না হয়ে পারেনি। বুক ভরে গেছে কৃতজ্ঞতায়। ওদেরকে সত্যিই ভালবাসেন কট্টর বুড়োটা। খোঁজ রেখেছেন ঠিকই। তাই না-চাইতেও ছুটি দিয়েছেন পুরো এক সপ্তাহের। মেসেজে আরও লিখেছেন, ‘তোমার সহকর্মীদেরকেও জানিয়ে দাও, এখন থেকে আগের মতই সপ্তাহে দু’দিন, মানে, শনি- রবিবার ছুটি থাকবে।’

    হাত-মুখ ধুয়ে লিভিংরুমের সোফায় বসল রানা। টিভি চালু করল না। ঠিক করেছে, একটু পর কিচেনের ফ্রিয থেকে খাবার নিয়ে গরম করে নেবে মাইক্রোআভেনে। একবার ভাবল, এক মগ কফি নেবে কি না। পরক্ষণে বাতিল করল চিন্তাটা। ঘুমের বারোটা বাজিয়ে লাভ নেই। মনে এল সোহেলের কথা। বিয়ের জন্যে বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে ওকে। ওর প্রেমিকা নীলা তো রাজি হয়েই আছে। কিন্তু কেন যেন দ্বিধায় পড়েছে সোহেল। ওর মুক্ত বিহঙ্গ অন্তর এখনই চাইছে না বাঁধনে জড়িয়ে যেতে।

    আমার নিঃসঙ্গতা সংক্রামিত করল বোকাটাকে? আনমনে ভাবল রানা।

    লক্ষ্মী মেয়ে নীলা। সংসার করলে সুখেই থাকবে সোহেল।

    রানার মনে পড়ল সোহানার কথা। আমেরিকায় আছে ও। দু’দিন আগে খালাতো বোনের ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। রানাকে ফোন করেছিল রাত বারোটায় বলেছিল, বড্ড একা লাগছে। সব থাকা সত্ত্বেও কী যেন নেই ওর জীবনে।

    চুপ থেকেছে রানা। দেশের কাজ করতে গিয়ে ভয়ঙ্কর সব ঝুঁকি নিতে হয় ওদেরকে। যখন তখন খুন হবে। তাই দু’জনেই জানে, যে পেশা বেছে নিয়েছে, সেখানে সংসারের কথা ভাবাও আসলে মহাপাপ।

    বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস এল রানার। ক’দিন হলো ছেড়ে দিয়েছে সিগারেট। তবে একটা শলার জন্যে কেমন উসখুস করছে মন। নিজেকে ধমক দিল: বিড়ি খেয়ে মরে কাজ নেই তোর!

    সোফা ছেড়ে ড্রিঙ্ক কাউন্টারের কাছে গেল রানা। ওর দিকে জুলজুল করে চেয়ে আছে হান্ড্রেড পাইপার্সের সুঠাম বোতল। ওটার দিকে হাত বাড়িয়েও থমকে গেল। এইমাত্র পাশের টেবিলে টিট-টিট আওয়াজে বেজে উঠেছে ল্যাণ্ডফোন।

    ঘনিষ্ঠ কোনও বন্ধু?

    খুব বাজে দুঃসংবাদ নয় তো?

    পরিচিত কোনও ক্লায়েন্ট?

    রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল রানা। ‘হ্যালো?’ ওদিক থেকে যে পরিচিত কণ্ঠস্বর এল, একদম চমকে গেল রানা।

    ‘হ্যাঁ, রানা। কেমন আছ?’

    ‘ভাল আছি। আপনি?’ ওদিকের মানুষটার বক্তব্য শুনতে তৈরি রানা। ভাল করেই মনে আছে, প্রাক্তন এই ব্রিটিশ কর্নেল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে করুণভাবে মরত ও কঙ্গোর জঙ্গলে।

    ‘আমি ভাল নেই, রানা। আসলে সাহায্যের আশায় কল করেছি তোমাকে।’

    ‘সাহায্য? আমার?’ ভুরুজোড়া কুঁচকে গেল রানার।

    ‘বেশ ক’জনের কাছে খোঁজ নেয়ার পর তবে পেয়েছি তোমার মোবাইল ফোন নাম্বার। কিন্তু মনে আছে, অচেনা ফোন কল রিসিভ করো না। তাই বাধ্য হয়ে রানা এজেন্সির কয়েকটা শাখায় ফোন করে জেনেছি তুমি এখন কোথায় আছ।

    ‘আপনাকে কষ্ট করতে হলো বলে আমি সত্যিই দুঃখিত,’ আন্তরিক সুরে বলল রানা।

    ‘না, ঠিক আছে,’ বললেন কর্নেল। ‘তবে ফোনে আর কিছু বলতে চাই না, রানা। ব্যাপারটা গোপনীয়। তুমি কি একবার আসবে আমার এখানে?’

    ‘আপনি এখন কোথায় আছেন, কর্নেল?’

    ‘ইতালির স্যান রেমো শহরের সামান্য দূরে, সাগরে নোঙর করা একটা ইয়টে ক’মুহূর্ত পর বলল রানা, ‘আগামীকাল পৌছে যাব, কর্নেল।’

    ‘গুড! অসংখ্য ধন্যবাদ, রানা। তুমি স্যান রেমোয় পৌঁছুলে তোমার মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেব কোন্ ডকে আসতে হবে। আমার মোটর লঞ্চ তোমাকে পৌঁছে দেবে ইয়টে।’ ক্লিক শব্দে কেটে গেল লাইন।

    ভয়ানক বিপদে না পড়লে সাহায্য চাওয়ার মানুষ নন কর্নেল (অব.) জন ব্রাউন। কেন যেন শীতল অনুভূতি নামল রানার মেরুদণ্ড বেয়ে। আগামীকাল ভোরেই রওনা দেবে ভেবে নিয়ে সোজা বেডরুমে ঢুকল ও। চুপচাপ শুয়ে পড়ল বিছানায়। কিছুক্ষণ মেডিটেশনের পর ঘুমিয়ে গেল নিশ্চিন্তে।

    .

    …ধুপ-ধাপ শব্দে পাঁজরে বাড়ি মারছে রানার পাগলা হৃৎপিণ্ড। চারপাশে কালো আঁধারে ভীষণ হুলুস্থুল, বিকট সব রণহুঙ্কার। গুলির আওয়াজ ছাপিয়ে আসছে আহত মানুষের আর্তনাদ। সবই যেন স্লো মোশন সিনেমা। জঙ্গলে আগ্নেয়াস্ত্রের মাযলের মুখে ঝলসে উঠছে সাদা-কমলা আগুন। ঘন ঝোপ-ঝাড় ও উঁচু উঁচু গাছকে পাশ কাটিয়ে ছুটে আসছে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর একদল সন্ত্রাসী। লাল লকলকে আগুনে পুড়ছে পেছনের বাড়ি। ভীষণ উত্তপ্ত রানাদের শেষ এই আশ্রয়। ফুরিয়ে এসেছে গুলি। ওদেরকে ঘিরে ফেলেছে শত শত নরপশু।

    হঠাৎ করেই রানার দিকে এগিয়ে এল একলোক। আগুনের লালচে পটভূমিতে কালো পিশাচের মত দেখাল তাকে। হিংস্র লোকটার দু’চোখ থেকে ঝরছে তীব্র ঘৃণা। শক্ত হাতে ধরেছে পিস্তল। মালের কালো গর্তটা বিশাল লাগছে। ওই গহ্বর যেন ভয়ঙ্কর এক সুড়ঙ্গ, রানাকে নিয়ে যাবে অন্য জগতে।

    কিছু করার আগেই গর্জে উঠল পিস্তল। কান ফাটানো আওয়াজ শুনল রানা। তখনই চোখের সামনে বিস্ফোরিত হলো জগতের সমস্ত সাদা আলো…

    .

    গভীর রাতে ঘুম ভাঙতেই ঝট্ করে বিছানায় উঠে বসল রানা। দরদর করে ঘামছে। চারপাশে নিকষ কালো আঁধার। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, ও আছে ফ্রান্সে, রানা এজেন্সির ব্রাঞ্চ অফিসের দোতলায়, ওর অ্যাপার্টমেন্টে। এখনও লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড।

    বাজে দুঃস্বপ্ন!

    বেশ কয়েক বছর ধরে মাঝে মাঝেই তাড়া করছে ওকে। এবার আর গাফিলতি নয়, ঢাকায় ফিরেই সব জানাবে হেড অফিসের সাইকোঅ্যানালিস্ট কাউন্সেলারকে।

    অন্ধকারে পাশের বেডসাইড টেবিলে রাখা ল্যাম্পের সুইচ টিপল রানা। নেমে পড়ল বিছানা থেকে। থামল গিয়ে ড্রিঙ্ক কাউন্টারের সামনে। বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে নিল দুই আউন্স উইস্কি। এক ঢোকে শেষ করল সোনালি তরল। বিড়বিড় করল, ‘এবার হয়তো ঘুমাতে পারব।’

    ইতালিয়ান রিভিয়েরায় স্যান রেমো শহর। কাছেই নীল সাগর। ওখানে নিজস্ব ইয়টে ওর জন্যে অপেক্ষা করবেন প্রাক্তন ব্রিটিশ এসএএস কর্নেল জন ব্রাউন। আগেই টিকেট বুক করেছে রানা। ভোরে এয়ারপোর্টে গিয়ে উঠবে নিসগামী বিমানে।

    খালি গ্লাস টেবিলে রেখে বেডরুমে ফিরল রানা। কয়েক মিনিট পেরোবার আগেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

    তিন

    সোনাঝরা ভূমধ্যসাগরীয় ফুলেল সকাল।

    নয়টায় ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার নিস শহর থেকে একটু দূরে কোতে দ্য’যুর ইণ্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়েতে অবতরণ করল ব্রিটিশ এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমান। পরবর্তী পাঁচ মিনিটে টার্মিনালে গিয়ে ঢুকল যাত্রীরা। বিশ মিনিট পর দরকারি কাগজপত্র দেখিয়ে রোদের ভেতর রাস্তায় বেরিয়ে এল মাসুদ রানা। একটা ভলভো ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল পাশে। ক্যানভাস ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে উঠে পড়ল ও পেছনের সিটে।

    ইতালির সীমান্ত পেরিয়ে একঘণ্টা পর পৌঁছুল সাগরতীরে স্যান রেমো শহরে। নগরীর প্রাচীন অংশে মহাব্যস্ত লা পিগনা স্কয়্যারে মাঝারি মানের এক হোটেলে উঠল রানা। একরাতের জন্যে নিয়েছে সিঙ্গেল রুম। কী ধরনের বিপদ, বলেননি কর্নেল জন ব্রাউন, তবে অনুরোধ করেছেন, যাতে ইয়টে তাঁর সঙ্গে দেখা করে রানা। আজ থেকেই শুরু ওর ছুটি। প্রয়োজনে রয়ে যাবে এ দেশে। অবশ্য আশা করছে, কর্নেলের ঝুট-ঝামেলা চুকেবুকে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

    হোটেলের ভেতরে শীতল পরিবেশ। মার্বেল পাথরের তৈরি মেঝে। খট-খট আওয়াজ তুলছে প্রতি পদক্ষেপে। আজ স্বাভাবিক কোনও দিন হলে পুরনো বাড়িটার সৌন্দর্য উপভোগ করত রানা। নিচের পাহাড়ি এলাকায় প্রাচীন শহরের শত শত বাড়ি, জায়গায় জায়গায় চার্চ ও বহু দূরে রঙিন পাহাড়ি দিগন্ত। আরেকদিকে কোটি ঢেউ বুকে নিয়ে ঝিকমিক করছে সুনীল ভূমধ্যসাগর।

    কিন্তু আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে রানার মনটা। রুমে ঢুকে বিছানার ওপর ব্যাগটা রেখে দরজা বন্ধ করে আবারও নামল লবিতে। হোটেল ত্যাগ করে পা রাখল ব্যস্ত পিয়াযযাতে।

    নীলাকাশে একফোঁটা মেঘ নেই। বেশ গরম পড়েছে। সুতির হালকা জ্যাকেট খুলে হাতের ভাঁজে ঝুলিয়ে নিল রানা। এয়ারপোর্টে ওর মোবাইল ফোনে কল করেছিলেন কর্নেল ব্রাউন। বলে দিয়েছেন, ওকে যেতে হবে পোর্টো ভেক্কিয়োতে। ওটাই শহরের পুরনো বন্দর। জেটির পশ্চিমে দুপুর বারোটায় রানাকে তুলে নিয়ে তাঁর মোটর লঞ্চ পৌঁছে দেবে ইয়টে।

    তাতে বিস্মিত হয়নি রানা। পরিচিত হওয়ার কয়েক দিনের ভেতর জেনেছিল: জাহাজ, ইয়ট ও নৌকার বিষয়ে ব্রিটিশ কর্নেল একজন বিশেষজ্ঞ। ছুটি পেলেই চলে যান রোদেলা কোনও বন্দরে। যদিও রানা জানে না, সেসময়ে তাঁর কোনও ইয়ট ছিল কি না। হঠাৎ করেই ও উপলব্ধি করল, সত্যি বলতে প্রাক্তন কর্নেল জন ব্রাউন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। কঙ্গোর জঙ্গলে লড়াইয়ের পর পর তাঁকে ফুল কর্নেল করা হয় এসএএস ফোর্সের তরফ থেকে। মহারানির কাছ থেকে সাহসিকতার জন্যে পুরস্কৃত হলেও কয়েক মাসের ভেতর চাকরি ছেড়ে অবসর নেন তিনি। অথচ, সামনে ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। পরের চার-পাঁচ বছরে হয়ে যেতেন মেজর জেনারেল। চুপচাপ ধরনের মানুষ। তবে তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেনি বলে মনে মনে এখন নিজেকে মৃদু বকাঝকা দিল রানা। কর্নেলের স্ত্রী জেনি ব্রাউনের সঙ্গে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল ওর। বছর দুয়েক আগে খবর পেয়েছিল, দক্ষিণ আমেরিকায় মারা গেছেন মহিলা। তখন খোঁজ নিয়ে জেনেছে, চার মাস আগেই তাঁর শেষকৃত্য হয়ে গেছে। এতদিন পর ফোন করে কর্নেলের মনটা আবারও ভারাক্রান্ত করতে ইচ্ছে হয়নি রানার।

    কর্নেলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ নেই ওর। তবে কোনও দিনও ভুলবে না, আজও বেঁচে আছে কার কল্যাণে। মানুষ তো নানান ধরনের হয়। কেউ ভাল, কেউ খারাপ, কেউ ভাল-মন্দে মেশানো। চট করে কাউকে হিরো বলে ধরে নেয়া যায় না। কিন্তু কাউকে অসমসাহসী এবং উপকারী মানুষ বললে, তিনি ওর বস্ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। তাঁর পর পরই প্রাক্তন কর্নেল জন ব্রাউনের কথাই বলবে রানা।’

    একবার শুনেছিল, ইতালিতে শিপ ইয়ার্ড খুলেছেন তিনি। সেটা নিয়েই হয়তো ঝামেলা।

    চট্ করে হাতঘড়ি দেখল রানা। একটু আগে এগারো সংখ্যা স্পর্শ করেছে ডায়ালের বেঁটেখাটো কাঁটা। এয়ারপোর্ট টার্মিনাল থেকে বেরোবার আগে স্যান রেমোর ছোট একটা মানচিত্র কিনেছে ও। ওটা একবার দেখে নিয়ে হাঁটতে লাগল পশ্চিমে। ওদিকেই নীল সাগর।

    শহরের প্রাচীন অংশে ভাঙাচোরা সব আর্চওয়ে ও পুরনো বাড়ি। প্রতি বছরের মত হাজারো টুরিস্টের সমাগমের পদধ্বনি শুনে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে ঘুমন্ত এই শহর। গোলকধাঁধার মত গলির মাঝ দিয়ে নানান বাঁক ঘুরে এগিয়ে চলেছে রানা। মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছে রাস্তাগুলোর সাইন।

    আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর বাতাসে সাগরের নোনা গন্ধ পেল রানা। আঁকাবাঁকা এক গলি পেরোতেই সামনে পড়ল পুরনো বন্দর। রুপালি বালি বুকে নিয়ে ধনুকের মত বাঁকা সৈকত গেছে দূরে। ভিড়ভাট্টা তো নেই-ই, আশপাশেও নেই সাগর দর্শনার্থী। বিছিয়ে আছে কাঁচের মত মসৃণ, শান্ত, নীল ভূমধ্যসাগর। তীরে লুটিয়ে পড়ছে ছোট ছোট ঢেউ। বন্দরে চকচকে অসংখ্য রঙিন নৌকা ও ছোটবড় ইয়ট— মৃদু দুলছে ঢেউয়ের দোলায়। পেরেকের মত শত শত মাস্তুল যেন খোঁচাতে চাইছে নীলাকাশটাকে। সাগরে গেছে অন্তত দশটা জেটি। সবচেয়ে দূরে পশ্চিমের জেটিতে ভিড়বে কর্নেল ব্রাউনের পাঠানো মোটর লঞ্চ। ওদিকে একচিলতে বাঁকা সৈকত।

    রাস্তা থেকে পাথরের ক’টা সিঁড়ির ধাপ বেয়ে সৈকতে নামল রানা। জুতোর নিচে কুড়মুড় আওয়াজ তুলছে নুড়িপাথর। আপাতত সৈকতে কেউ নেই। তবে টুরিস্ট সিযন ভালভাবে চালু হলেই চারপাশে শুরু হবে মানুষের ভিড় আর হল্লা।

    এখন শেষ-সকাল।

    উষ্ণ রোদ পড়ছে রানার মুখে। ফিসফিস করে কীসব বলে ওর মাথার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে সাগরের লবণাক্ত হাওয়া। আরেকবার হাতঘড়ি দেখল রানা। তাকাল বন্দরের দিকে। একটা ইয়টের পাশে থেমেছে দুই লোক। তবে পশ্চিমের জেটিতে কেউ নেই। এখনও দেখা নেই কর্নেল ব্রাউনের লঞ্চের। সৈকতের বালিতে সামান্য গেলেই বন্দরের প্রাচীর। ওখানে রয়েছে পাথরের 1 কয়েকটা ধাপ। ওগুলো টপকে উঠতে হবে ওয়াকওয়েতে। সামান্য দূরেই সাদা রঙের ডক।

    সৈকতে দাঁড়িয়ে সাগরের দিকে তাকাল রানা। বুক চিরে বেরোল চাপা দীর্ঘশ্বাস। কেন যেন মনে পড়ে গেছে রডরিকের কথা। কুচকুচে কালো মানুষটা বলেছিল: আই লাভ ইউ, ম্যান!

    ওকে বাঁচাতে পারেনি রানা।

    সেই কবে মরে গেছে মানুষটা। অথচ সাগরতীরে দাঁড়ালে আজও মনে পড়ে ওর কথা।

    আর কম বয়সের প্রেম… নিষ্ঠুর হৃদয়ের অপরূপা সেই রাফেলা বার্ড!

    মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ জন্মেছিল রানার মনে।

    কিন্তু হলো না। আর এগোল না মেয়েটা।

    রানাকে ভালবেসেও ভুল বুঝে দূরে সরে গেল রাফেলা।

    ভীষণ… ভীষণ অভিমান হয়েছিল রানার। কখনও মেয়েটার সঙ্গে দেখা করে বলা হয়নি: না, এভাবে চলে যেয়ো না আমার জীবন থেকে! তুমি আমাকে ভুল ভাবছ, রাফেলা। আমি ক্রিমিনাল নই!

    কী এক চরম হতাশা নিয়ে ফিসফিস শব্দে সাগরের বুকে ফিরছে ফুরিয়ে যাওয়া ক্লান্ত ঢেউ। বসে পড়ে চ্যাপ্টা, ছোট্ট একটা নুড়িপাথর নিল রানা। গায়ের জোরে ছুঁড়ল সাগরের বুকে। ঢেউয়ের মাঝে পড়ে সাদা ফেনা তৈরি করল ওটা। ছুটন্ত চাকতি ব্যাঙ-বাজির মত বারবার লাফিয়ে চলে গেল বহু দূরে। তারপর তলিয়ে গেল টুপ্ করে।

    আনমনে ভাবল রানা: একদিন আমিও এভাবে হারিয়ে যাব…

    ওর বুক চিরে বেরোল আরেকটা দীর্ঘশ্বাস। জোর করে নিজেকে বাস্তবে ফেরাল।

    জানা দরকার কী ধরনের বিপদে পড়েছেন কর্নেল ব্রাউন।

    বড় কোনও ঝামেলা। নইলে ডাকতেন না ওকে।

    পায়ের কাছে আরেকটা নুড়িপাথর পেয়ে ওটা তুলে নিল রানা। চোখের কোণে দেখল সামান্য নড়াচড়া। বন্দরের মুখে হাজির হয়েছে সাদা একটা মোটর লঞ্চ। বোধহয় এসেছে ওকে তুলে নিতেই। কিছুক্ষণ পর জানবে কেন ওকে ডেকেছেন কর্নেল ব্রাউন।

    হাত থেকে নুড়ি ফেলে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে ওয়াকওয়েতে উঠল রানা। পা বাড়াল একটু দূরের জেটির দিকে।

    আর তখনই শুনল আতঙ্কিত চাপা আর্তচিৎকার।

    চার

    তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল আর্তনাদ। কণ্ঠস্বর মহিলার। ভীষণ ভীত সে। বরফের মূর্তির মত জায়গায় জমে গেল রানা। ঝট্ করে ঘুরে তাকাল সৈকতের দিকে।

    এদিকেই ছুটে আসছে মেয়েটা, মাত্র ষাট গজ দূরে। পরনে বারমুডা শর্টস ও হালকা ডেনিম শার্ট। দু’হাতে বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছে হ্যাণ্ডব্যাগ। ওটার স্ট্র্যাপ দুলছে গলা ও ঘাড়ে। বাতাসে উড়ছে মেয়েটার দীর্ঘ কালো চুল।

    মেয়েটাকে ধাওয়া করে আসছে দুইজন লোক। তাদের একজন জলহস্তির মত ভারী গড়নের, অন্যজন পেশিবহুল চিকন লোক। দু’জনের পরনে টি-শার্ট ও জিন্স। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে মেইল ট্রেনের মত ধাওয়া দিচ্ছে তারা। তাদের দৌড়ের গতি মেয়েটার চেয়ে বেশি

    দূর থেকেও রানা বুঝল, খুব ভয় পেয়েছে মেয়েটা।

    কয়েক সেকেণ্ডে ওকে প্রায় ধরে ফেলল দুই বদমাশ। অপেক্ষাকৃত হালকা লোকটা পৌঁছল আগে। খপ্ করে চেপে ধরল মেয়েটার ব্যাগের স্ট্র্যাপ। হ্যাঁচকা টানে নিজের দিকে নিতে চাইল ব্যাগটা। তাতে তাল হারিয়ে নুড়িপাথরে পিছলে পড়ল মেয়েটা। বিভূঁইয়ে সব হারাবে বুঝে সাহায্য পাওয়ার জন্যে আবারও চিৎকার করে উঠল। ‘বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও!’

    স্ট্র্যাপ ধরে জোর টান দিল হালকা দেহের ছিনতাইকারী। মেয়েটার বুকে চেপে বসে তাকে প্রায় চ্যাপ্টা করে দিল মুসকো লোকটা। এক হাঁটু রেখেছে বেচারির তলপেটের ওপর। একহাতে চেপে ধরেছে গলা। পাগলের মত দু’পা ছুঁড়ছে মেয়েটা। জোর টান দিয়ে স্ট্র্যাপ থেকে ব্যাগটা ছিঁড়ে ভেতরের জিনিসপত্র ঘাঁটতে শুরু করেছে হালকা লোকটা।

    সাহায্য করবে এমন কেউ নেই। দিনদুপুরে সর্বস্ব ডাকাতি হচ্ছে মেয়েটার। খুনও হতে পারে।

    ক’সেকেণ্ড আগেই হাত থেকে জ্যাকেট ফেলে ছুট দিয়েছে মাসুদ রানা। ওয়াকওয়ে থেকে পাথুরে ধাপ বেয়ে নেমে পৌঁছে গেছে সৈকতে। তীরবেগে ছুটছে রানা। পরিষ্কার দেখেছে, ব্যাগ কেড়ে নিয়েছে হালকা লোকটা। তার মোষের মত সঙ্গী চেপে বসেছে মেয়েটার বুকে। ফড়াৎ করে ছিঁড়ল বেচারি মেয়েটার ডেনিম শার্ট। মুখ ঢেকে গেছে মাথাভরা চুলে। চিৎকার করতে করতে এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে সে। যতই চেষ্টা করুক, সাধ্য নেই উঠে বসবে। তখনই কোমরের বেল্ট থেকে ছোরা বের করল ভারী লোকটা। এবার এক পোঁচে কাটবে গলাটা।

    তবে দুই ছিনতাইকারী দেখেনি দূর থেকে ছুটে আসছে এক যুবক। প্রথমে রানাকে দেখল ব্যাগধারী ছিনতাইকারী। কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে সরাসরি মোষকে টার্গেট করেছে রানা। নিজের কাজে সে লোক এতই ব্যস্ত, চমকে ওঠারও সময় পেল না।

    মুহূর্তে লোকটাকে খুন করতে পারত রানা। তবে ওর মনে ভেসে উঠল ট্রেইনারের কথা: বাধ্য না হলে খুন করবে না কাউকে।

    সরাসরি মুসকোর ঘাড়ে খটাস্ করে নামল রানার কঠিন এক ফ্লাইং কিক।

    ‘ওরে! শালা মেরে ফেলল!’ বলেই মেয়েটার ওপর থেকে কাত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে সৈকতে পড়ল মোটকা। অন্তত একমাস ঘাড় নাড়াতে পারবে না। বেদম ব্যথায় যে হাঁ-টা করেছে, সেখানে পুরে দেয়া যাবে প্রমাণ আকারের আস্ত শাঁখ-আলু। দূরে গিয়ে পড়েছে তার হাতের ছোরা। প্লীহা ফাটবে না এমন এক মাপা লাথি মেরে তাকে নরক ঘুরতে পাঠাল রানা।

    এরই ভেতর বিপদ বুঝে ব্যাগ ফেলে দৌড় দিয়েছে চিকন ছিনতাইকারী। তীরের বেগে চলেছে রাস্তার দিকে। ধাওয়া করে তাকে ধরবে ভেবেছিল রানা, কিন্তু মেয়েটা দুর্বল স্বরে গুঙিয়ে উঠতেই সে-চিন্তা বাদ দিল। টলমল করে উঠে বসতে গিয়েও শুয়ে পড়ল মেয়েটা। লাল হয়ে ছিলে গেছে গলা। সৈকতের বালিতে একগোছা চুল। রাগী চোখে ভারী লোকটার দিকে আঙুল তাক করল সে, ‘খুনি!’

    ‘তুমি ঠিক আছ?’ জানতে চাইল রানা।

    পাঁচ ফুট দূরে উঠে দাঁড়াল ভারী গড়নের ছিনতাইকারী। একহাত ঘাড়ে, অন্যহাত পেটে। একবার তিক্ত চোখে রানাকে দেখে নিয়ে থপ-থপ আওয়াজে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইল সে।

    তাকে যেতে দিল রানা। ঘুরে মেয়েটাকে উঠে বসতে সাহায্য করল।

    কাশতে শুরু করেছে বেচারি। অস্থির শ্বাস নিচ্ছে হাঁপানি রোগীর মত। কাঁপা হাতে দেখাল নিজের ব্যাগ। ইংরেজিতে বলল, ‘আমার ব্যাগটা, প্রিয়!’

    রানা বুঝে গেল হাঁপানির টান বেড়েছে মেয়েটার। তিন গজ দূরে ব্যাগ। ভেতরের সব ছড়িয়ে পড়েছে নুড়িপাথরের ওপর। মেকআপ, পার্স, চিরুনী, স্মার্টফোন…

    অ্যাযমা ইনহেলার!

    দ্রুত গিয়ে নীল ছোট্ট স্প্রেটা তুলল রানা। ‘এটার কথা বলছ?’

    ঘন ঘন মাথা দোলাল মেয়েটা। খপ্ করে রানার হাত থেকে নিল ইনহেলার। খাপ খুলে স্পাউট পুরল মুখের ভেতর। দু’বার টিপল প্লাঞ্জার। কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে বসে থাকার পর বড় করে শ্বাস নিল। স্বস্তিতে ঝুঁকে গেল দু’কাঁধ। মুখ তুলে তাকাল রানার দিকে। চোখ থেকে কেটে যাচ্ছে শঙ্কা। তবে কথা বলতে গিয়ে কেঁপে গেল কণ্ঠ: ‘আগের চেয়ে ভাল লাগছে। আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন, সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ।’

    মেয়েটার কথার সুর ইংল্যাণ্ডের কাউন্টিগুলোর। কয়েক মুহূর্ত ওকে দেখল রানা। বয়স হবে পঁচিশ কি ছাব্বিশ। মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে খোলা, কালো চুল। নরম মনের অসুস্থ এক মেয়ে।

    বিরান সৈকতে চোখ বোলাল রানা। উধাও হয়েছে দুই ছিনতাইকারী। নিচু স্বরে বলল ও, ‘উঠে দাঁড়াতে পারবে?’

    বোধহয়, ভোঁতা কণ্ঠে বলল মেয়েটা।

    হাত ধরে তাকে উঠতে সাহায্য করল রানা। একটু দুলছে মেয়েটা। ঠেস দিল রানার কাঁধে। গলার কাছে ছিঁড়ে গেছে শার্টের বোতাম। লজ্জা পেয়ে দু’হাতে স্তন ঢাকল সে। লালচে হয়েছে মুখ। অন্যদিকে ঘুরে তাকাল রানা। সরে গিয়ে ছড়িয়ে পড়া টুকটাক জিনিস ব্যাগে পুরতে লাগল মেয়েটা। কয়েক মুহূর্ত পর টেনে নিল চেইন।

    ‘মুচি পাবে শহরে,’ বলল রানা। ‘সহজেই স্ট্র্যাপ মেরামত করে দেবে সে।’

    ‘থ্যাঙ্কস্,’ বিড়বিড় করল মেয়েটা।

    ‘তোমার সঙ্গে আর কেউ নেই? স্বামী বা বন্ধু?’

    মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘বেড়াতে এসেছি একা।’

    ‘কোন্ হোটেলে উঠেছ?’

    ‘ওটা শহরের আরেক প্রান্তে।’

    বন্দরের পশ্চিমের জেটিতে ভিড়েছে মোটর লঞ্চ। হাতঘড়ি দেখল রানা। দুপুর বারোটা। ঠিক সময়ে এসেছে কর্নেলের লোক। এবার যেতে হবে। তবে মেয়েটাকে একা রেখে যেতে ইচ্ছে করল না ওর। হয়তো কাছেই কোথাও লুকিয়ে আছে ছিনতাইকারীরা। সুযোগ পেলে হামলে পড়বে আবার। রানার মনে হলো, উচিত ছিল পিটিয়ে ওই দু’জনকে অজ্ঞান করে দেয়া। সেক্ষেত্রে মেয়েটার জন্যে মনে দুশ্চিন্তা আসত না। বারবার দূরের রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে বেচারি। রানা বুঝে গেল, কী ভাবছে সে।

    হাতে সময় নেই যে শহরে যাবে, বা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করবে। নালিশ করলে তাতে কোনও কাজ হবে বলেও মনে হয় না। এক মুহূর্ত পর রানা বুঝল, এবার কী করতে হবে ওকে।

    মোটর লঞ্চ থেকে নেমেছে বেসবল ক্যাপ পরা দোহারা শরীরের এক লোক। পরনে সাদা প্যান্ট ও পোলো শার্ট নৌযান বোলার্ডে বাঁধল সে। জেটি থেকে ডকের দিকে আসছে। কাকে যেন খুঁজছে তার চোখ।

    লঞ্চের দিকে আঙুল তাক করল রানা। মেয়েটাকে বলল, ‘ওই লঞ্চে উঠব। চাইলে যেতে পারো। ইয়টে উঠে মুখ- হাত ধুয়ে বিশ্রাম নিতে পারবে। …যেতে চাও?’

    নার্ভাস চোখে রানাকে দেখল মেয়েটা। চোখে দ্বিধা।

    ‘বিশ্বাস রাখতে পারো আমার ওপর,’ পকেট থেকে সবুজ পাসপোর্ট বের করে দেখাল রানা। ‘আমার নাম মাসুদ রানা। জাতে বাঙালি। তোমাকে একা রেখে যেতে চাইছি না। ওদিকে দূরের ইয়টে আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন এক ভদ্রলোক। কথা সেরে নিতে বেশিক্ষণ লাগবে না। আশা করি ঘণ্টাখানেক পর তোমাকে পৌঁছে দিতে পারব হোটেলে।’

    কথা শুনে দ্বিধা আরও বাড়ল মেয়েটার। ভয় নিয়ে তাকাল রানার চোখে। চট করে দেখল লঞ্চ। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে নিচের ঠোঁট। চোখ গেল সৈকতে পড়ে থাকা ছোরার ওপর। একবার শিউরে উঠল। বেসুরো কণ্ঠে বলল, ‘আমার নাম অ্যানি রবার্ট। আপনার কোনও ঝামেলা না হলে আমিও সঙ্গে যাব।’

    ‘সমস্যা নেই, অ্যানি,’ বলল রানা। ‘তোমার কোনও বিপদ হবে না।’

    ওয়াকওয়ের দিকে আসছে লঞ্চের পাইলট। তার চোখ পড়ল রানা ও অ্যানির ওপর।

    রানা হাত নাড়তেই পাল্টা হাত নাড়ল সে।

    এখনও মৃদু টলছে অ্যানি। নার্ভাস ভঙ্গিতে মুখ থেকে চুল সরাল। রানা দেখল, শকের জন্যে এখনও ফ্যাকাসে বেচারির চেহারা।

    ওর পিছু নিয়ে ওয়াকওয়েতে উঠল মেয়েটা। কংক্রিটের ওপর পড়ে আছে কোঁচকানো জ্যাকেট। ওটা তুলে এগিয়ে দিল রানা। ‘পরে নাও।’

    জ্যাকেট পেয়ে পরে নিল অ্যানি। কৃতজ্ঞ চোখে দেখল রানাকে। ‘আপনি খুব দয়ালু। অনেক ধন্যবাদ।’

    ‘ধন্যবাদ পাওয়ার মত কিছু করিনি,’ বলল রানা। ‘খারাপ লাগছে, এত বাজে কিছুর ভেতর দিয়ে যেতে হলো তোমাকে।’

    ওয়াকওয়েতে লঞ্চের পাইলটের সামনে গিয়ে থামল ওরা। হাসল লোকটা। ‘মিস্টার রানা?’

    মৃদু মাথা দোলাল রানা।

    ‘আমি গ্যারি স্যাণ্ডার্স,’ বলল লোকটা, ‘আমাকে পাঠানো হয়েছে আপনাকে সেইবার-এ পৌছে দেয়ার জন্যে।’ অ্যানির দিকে তাকাল সে। ‘আমাকে বলা হয়েছিল আপনি একা আসবেন।’

    মাথা নাড়ল রানা। ‘ইনি অ্যানি রবার্ট। আমার সঙ্গে আছেন।’

    কাঁধ ঝাঁকাল স্যাণ্ডার্স। ‘সমস্যা নেই। আসুন।’

    জেটিতে উঠে লঞ্চের দিকে চলল ওরা।

    ‘কোনও বিপদ হবে না তো?’ ফিসফিস করে রানার কাছে জানতে চাইল অ্যানি।

    ‘দুশ্চিন্তা কোরো না,’ বলল রানা।

    ‘আমি সৈকতে বেড়াতে আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা, তিক্ত চেহারা করল অ্যানি। ‘আপনি না থাকলে আজ হয়তো মরেই যেতাম!’

    ‘অন্যদিকে মন সরিয়ে নাও। একটু পর সব ভুলে যাবে।’

    ওরা লঞ্চে উঠতেই ইঞ্জিন চালু করল গ্যারি স্যাণ্ডার্স। স্টার্নে বসেছে অ্যানি। রানা বো-র কাছে। জল কেটে ঘুরছে টুইন প্রপেলার। জেটি পেছনে ফেলে বন্দরের মুখ লক্ষ্য করে চলল লঞ্চ। কিছুক্ষণ পর পেছনে হারিয়ে গেল স্যান রেমোর সবুজ উপকূল। রইল শুধু নীল দিগন্ত। কম কথার লোক স্যাণ্ডার্স। চুপচাপ হুইল ধরে বসে আছে। অ্যানির মুখ এখনও ফ্যাকাসে। চেয়ে আছে দূর সাগরে। ওর ওপর চোখ রেখেছে রানা। শকের প্রভাব দেখলেই সাহায্য করবে।

    পুরো বিশ মিনিট নীল আয়নার মত মসৃণ সাগর চিরে এগোল লঞ্চ। চারদিকে কোথাও তীরের চিহ্ন নেই। কিছুক্ষণ পর বলে উঠল গ্যারি স্যাণ্ডার্স, ‘ওই যে, সামনে সেইবার।’

    ঘুরে তাকাল রানা। ভেবেছিল বড়সড় ইয়ট দেখবে। তবে কয়েক শ’ গজ দূরে ওটা চকচকে, সাদা বিশাল এক ভেসেল। আগে কখনও এত বড় ইয়ট দেখেনি রানা। তিনতলা বাড়ির চেয়েও উঁচু সুপারস্ট্রাকচার। তিনখানা ডেক। জলযানটা দৈর্ঘ্যে অন্তত আড়াই শ’ ফুট।

    রানাকে চমকে যেতে দেখে খুশি হয়ে হাসল স্যাণ্ডার্স। ‘দুর্দান্ত সুন্দর, তাই না? ছিয়াশি গজ লম্বা। বড়লোকরা বলেন সুপার ইয়ট।’

    ‘ওটা কর্নেল ব্রাউনের?’ জানতে চাইল রানা।

    মৃদু মাথা দোলাল লঞ্চের পাইলট। ‘শুধু কি তা-ই? ডিযাইন করেছেন, তৈরিও করেছেন উনি নিজে। ওটা ব্রাউন এন্টারপ্রাইযের ইয়ট বহরের সেরা- ফ্ল্যাগশিপ।’

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ৪৬৯ – কিলিং মিশন
    Next Article মাসুদ রানা ৪৫৮ – মহাপ্লাবন

    Related Articles

    কাজী মায়মুর হোসেন

    অদৃশ্য ঘাতক – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৬৮ – স্বর্ণলিপ্সা

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    ধাওয়া – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মৃত্যু উপত্যকা – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    খুনে ক্যানিয়ন – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৪৮ – মৃত্যুঘণ্টা

    July 25, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }