Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    শ্রীশ্রীচণ্ডী – অনুবাদ : পঞ্চানন তর্করত্ন

    September 9, 2025

    পুলিশ কাহিনী ১ – পঞ্চানন ঘোষাল (প্রথম খণ্ড)

    September 9, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ৪৬৬ – ধ্বংসযজ্ঞ

    কাজী আনোয়ার হোসেন এক পাতা গল্প453 Mins Read0

    ধ্বংসযজ্ঞ – ২৯

    ঊনত্রিশ

    জাহাজে ওঠার পর লামিয়াকে একটা কেবিনে বিশ্রাম নিতে পাঠাল রানা। এরপর কনফারেন্স রুমে ‘ক্যাপ্টেন মিচাম আর মুরল্যাণ্ডের সঙ্গে আলোচনায় বসল। দশ মিনিট নিল সন্ধ্যা থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ওদেরকে জানাতে।

    রানার কথা শেষ হলে গ্রুপারের ওপর হামলার খবর জানালেন মিচাম, আসিফের খবরটা দিলেন। তারপর ডাইরেক্টেড-এনার্জি ওয়েপনের ব্যাপারে তানিয়ার থিয়োরি সম্পর্কে যতটা জানেন, মুরল্যাণ্ডের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খুলে বললেন রানাকে।

    ‘ডাইরেক্টেড-এনার্জি?’ ভ্রূকুটি করল রানা। ‘এ তো সায়েন্স ফিকশন। সত্যি সত্যি কেউ তৈরি করতে পেরেছে বলে শুনিনি। আমেরিকান সরকার তো স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভের নামে এ-নিয়ে অনেকদিন থেকেই গবেষণা করছে। অমন একটা অস্ত্র পাওয়া গেলে উড়ন্ত মিসাইল ধ্বংস করে দেয়া যাবে।’

    ‘আমরা থিয়োরির কথা বলছি,’ বললেন মিচাম’। ‘আসলে জিনিসটা কী, তা কেউ জানে না। তবে আলামত যা পাওয়া গেছে, তাতে ব্যাপারটা সত্যি হবার সম্ভাবনা আছে।’

    ‘কিন্তু আটলান্টিকের মাঝখানে একটা যেন-তেন জাহাজের ওপর ওটা ব্যবহার করে লাভ কী?’

    কেউ জবাব দেবার আগেই ইন্টারকমের লাইট জ্বলে উঠল, ওপাশ থেকে কথা বলল কমিউনিকেশন্স অফিসার।

    ‘একটা কল আছে, ক্যাপ্টেন। নুমা ডিরেক্টর কথা বলতে চান।’

    ‘স্পিকারে দাও।’

    খড়খড় করে উঠল স্পিকার, এরপর শোনা গেল অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের পরিচিত গলা। ‘আমি জানি তোমাদের ওখানে অনেক রাত হয়েছে, তারপরেও বোধহয় ঘুমাতে পারোনি কেউ?’

    ‘আমরা আলোচনায় বসেছি, অ্যাডমিরাল,’ জানালেন মিচাম।

    ‘একটা খটকার জবাব পাচ্ছি না, স্যর,’ যোগ করল রানা। ‘আরাতামা মারুর মত একটা সাধারণ জাহাজের ওপর হামলা করা হলো কেন? জলদস্যুর হামলা, বা ইলেকট্রো- ম্যাগনেটিক অ্যাটাক-কোনোটার জন্যেই ওটা লোভনীয় টার্গেট নয়। আগে যে-তিনটে জাহাজ হারিয়ে গেছে, সেগুলোর বেলাতেও একই কথা খাটে।’

    ‘আগেরগুলোর ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারব না, তবে আমার ধারণা, ওগুলো ছিল টেস্ট কেস,’ বললেন অ্যাডমিরাল। ‘অস্ত্রটার কার্যক্ষমতা হয়তো পরীক্ষা করা হয়েছিল ওগুলোর ওপর। তবে জাপানি জাহাজের ব্যাপারটা আমি জানি। শুধু পরীক্ষার জন্যে নয়, ওটাকে আক্রমণ করার পেছনে আরও বড় একটা উদ্দেশ্য ছিল।’

    ‘কী সেটা?’

    ‘বলছি। নুমা হেডকোয়ার্টারে বসে ল্যারি কিং’ তার কম্পিউটারে একটা হিসাব কষছে-থিয়োরিটিক্যালি অমন একটা অস্ত্র তৈরি করতে হলে কী কী লাগবে। জবাবটা ওর ভাষায় অত্যন্ত সরল—বেশি বেশি।’

    ‘বেশি বেশি?’ বিভ্রান্তি ফুটল রানার কণ্ঠে। ‘বেশি বেশি কী?’

    ‘সবকিছুই,’ বললেন অ্যাডমিরাল। ‘বেশি এনার্জি, বেশি মিনারেল, বেশি টাকা। এত বেশি, যেটা সহজে কারও পক্ষে ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাস, সে-কারণেই হামলা করা হয়েছিল আরাতামা মারুর ওপর। টাইটেনিয়ামের প্রলেপ দেয়া ওয়াইবিসিও-র একটা শিপমেন্ট ছিল ওতে। জিনিসটা একটা সঙ্কর ধাতু… অত্যন্ত দামি… শক্তিশালী সুপারকণ্ডাক্টিং ম্যাগনেট তৈরিতে লাগে।’

    ‘আর সেই ম্যাগনেট দরকার এনার্জি ওয়েপন বানানোর জন্যে, রাইট?’ আন্দাজ করল রানা।

    ‘এগয্যাক্টলি,’ অ্যাডমিরাল বললেন। ‘সোজা কথায় বলতে গেলে, এনার্জি সংক্রান্ত যে-কোনও প্রজেক্টেই সুপার- কণ্ডাক্টর প্রয়োজন। হাই-এনার্জি লেভেলে সাধারণ ম্যাগনেট অতিরিক্ত তাপ ছড়ায়। কিন্তু সুপারকণ্ডাক্টরের ভেতর দিয়ে কোনও ধরনের বাধা ছাড়াই চলতে পারে এনার্জি।’

    ‘এই জিনিস দিয়ে তা হলে এখন অস্ত্র বানানো হয়েছে?’ মুরল্যাণ্ডের প্রশ্ন।

    ‘ল্যারির তা-ই ধারণা। রেক থেকে যেসব নমুনা তুলে এনেছে আসিফ আর তানিয়া, সেগুলো দেখার পর আর কোনও সন্দেহ থাকে না।’

    ‘কে করছে এসব, কিছু ধারণা করতে পারেন?’ জানতে চাইল রানা।

    ‘এখনও না,’ বললেন অ্যাডমিরাল। ‘কোনও টেরোরিস্ট গ্রুপ হতে পারে, কিংবা কোনও উগ্রবাদী দেশ বা গোষ্ঠী। আজকাল কিছুই অসম্ভব নয়।’

    ‘টাকা কোত্থেকে আসছে, তা বের করা যায় না? প্রচুর খরচ হচ্ছে এতে… তারমানে কোথাও না কোথাও তার রেকর্ড থাকছে।’

    ‘আমরা খোঁজ নিতে শুরু করেছি। সুপারকণ্ডাক্টিং মিনারেলের বড় বড় লট বিক্রির খবরও পাওয়া গেছে বেশ কিছু। ডজনখানেক নামসর্বস্ব কোম্পানি করেছে এসব কেনাকাটা। হাবভাবে মনে হচ্ছে, সুপারকণ্ডাক্টিং মিনারেলের বাজার খালি করে দিতে চাইছে কেউ।’

    ‘কোথায় যাচ্ছে এসব মিনারেল?’

    ‘বলা কঠিন। বললাম তো, নামসর্বস্ব কোম্পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। সেগুলো আবার বিভিন্ন ভুয়া কর্পোরেশনের সাবসিডিয়ারি হিসেবে উদয় হয়। অচেনা উৎস থেকে আসে টাকা। কেনাকাটা শেষ হওয়া মাত্র কোম্পানিগুলো আবার তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। খুবই জটিল একটা চক্র। আইনের চোখে অবশ্য এসবের মধ্যে অবৈধ কিছু নেই। ঠিকমত ট্যাক্স দেয়া হয়, সবার পাওনা ঠিকঠাক মিটিয়ে দেয়া হয়… কোথাও কোনও অভিযোগ ওঠার পথ রাখে না।’

    ‘ব্যাপারটা ঠিক মিলছে না,’ চিন্তিত গলায় বলল রানা। ‘বাজার থেকে এত মিনারেল যদি কিনতে পারে, তা হলে জাহাজ থেকে লুঠ করার দরকার কী?’

    ‘আরাতামা মারুর ওই ধাতুটা বাকি সব মিনারেলের চেয়ে ভিন্ন,’ বললেন হ্যামিলটন। ‘দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সুপারকণ্ডাক্টর ওটা। নয়শো টেসলা ফিল্ড স্ট্রেংথে অনায়াসে কাজ করতে পারে।

    টেসলা নামে নব্বইয়ের দশকে একটা দুর্দান্ত রক ব্যাণ্ড ছিল,’ ঠাট্টার সুরে বলল মুরল্যাণ্ড। ‘আপনি কীসের কথা বলছেন?’

    ‘ওটা ম্যাগনেটিক ফিল্ড পরিমাপের একটা একক,’ জানালেন অ্যাডমিরাল। ‘জাপানের ভাসমান ট্রেনের কথা নিশ্চয়ই শুনেছ… ওরকম একেকটা ট্রেনকে শূন্যে তোলার জন্যে চার টেসলা ক্ষমতার সুপারকণ্ডাক্টর লাগে, তারমানে নয়শো টেসলায় এক ধাক্কায় সোয়া দু’শো ট্রেন বাতাসে ভাসিয়ে তোলা যাবে।’

    বড় করে শ্বাস ফেললেন ক্যাপ্টেন মিচাম। ‘বুঝতে পেরেছি। অস্ত্র যখন বানাচ্ছেই, সবচেয়ে শক্তিশালীটা বানাতে চাইছে। সেজন্যেই লুঠ করেছে ওয়াইবিসিও। স্বাভাবিক কায়দায় জিনিসটা সম্ভবত কিনতে পারছিল না।’

    এখনও ধন্দ কাটেনি রানার। ‘কার্গোটা যথেষ্ট গোপনীয়তার মাঝে… সবার চোখে ধুলো দিয়ে পাচার করা হচ্ছিল হংকঙে। তা হলে জলদস্যুরা খবর পেল কীভাবে?’

    ‘যারা জানত, তাদের মাঝ থেকেই খবর ফাঁস হয়েছে,’ অনুমান করল মুরল্যাণ্ড।

    ‘কে কে জানত, অ্যাডমিরাল?’

    ‘স্রেফ তিনটে পক্ষ,’ বললেন অ্যাডমিরাল। ‘যারা কিনেছে, যারা বিক্রি করেছে, আর যারা জাহাজে তুলে পাচার করছিল।’

    ‘কার্গো হারালে ক্রেতার কোনও লাভ নেই,’ বলল রানা। ‘জাহাজ ডুবিয়ে জাহাজমালিকও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাকি রইল কেবল বিক্রেতা। জিনিসের দাম আগেই পেয়ে গেছে সে, হারালে কিছুই যায়-আসে না। বরং নিজেই যদি লুঠ করতে পারে, দ্বিতীয়বার বিক্রি করতে পারবে অন্য কারও কাছে, কিংবা নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারবে। সবদিক থেকেই লাভবান হচ্ছে সে।’

    ‘আপনি একটু বেশিই কল্পনা করে ফেলছেন, মি. রানা, ‘ সন্দিহান গলায় বললেন মিচাম। ‘ভুল পথে দৌড়াচ্ছেন না তো?’

    ‘না,’ বললেন অ্যাডমিরাল, ‘ও ঠিকই বলছে। এর পেছনে বিক্রেতার ভূমিকা থাকতে পারে। আরাতামা মারুর লগবুক, লোডমাস্টারের নোটস্ আর ম্যানিফেস্ট আছে আমার কাছে। বন্দর ছাড়ার আগে নিয়ম মোতাবেক ওগুলোর কপি ইমেইলে পাঠিয়ে দেয়া হয় মিতসুকির হেডকোয়ার্টারে। ইন্টারেস্টিং কয়েকটা ব্যাপার আছে ওতে। সংক্ষেপে বলছি। ডুবে যাবার তিনদিন আগে সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে পৌছায় জাহাজটা, চীনে নেয়ার জন্যে বিভিন্ন ধরনের আকরিক লোড করে। এরপর হেডকোয়ার্টার থেকে অর্ডার আসে, আরও দু’দিন বন্দরে অপেক্ষা করার জন্যে। নতুন আরেকটা কার্গো নাকি আসবে।’

    ‘ওয়াইবিসিও?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

    ‘হ্যাঁ। শেষ পর্যন্ত সেই কার্গো যখন এল, বেশ কিছু অসঙ্গতি দেখতে পেলেন ক্যাপ্টেন লারসেন। আমাদের কপাল ভাল, সেগুলো তিনি তুলে রেখেছেন লগবুকে। প্রথম অসঙ্গতি… বন্দরের সাধারণ শ্রমিকেরা জাহাজে ওই কার্গো লোড করেনি, করেছে শ্বেতাঙ্গ আর অশ্বেতাঙ্গের একটা মিশ্র দল। আচার-আচরণে তাদেরকে মিলিটারি বা প্যারামিলিটারি ইউনিটের মত লেগেছে ক্যাপ্টেনের কাছে।’

    ‘সেটা কি খুব অস্বাভাবিক?’ জিজ্ঞেস করল মুরল্যাণ্ড। ‘আমি তো শুনেছি, মার্সেনারিদের দখলে সিয়েরা লিওনের বহু খনি আছে। নিজেদের মাল নিজেরাই হয়তো তুলে দিতে এসেছিল।’

    ‘আসল কথা হলো, ওয়াইবিসিও খনিতে পাওয়া যায় না, বললেন অ্যাডমিরাল। ‘আরেকটা অসঙ্গতি: গ্রুপটার লিডার চাইছিল পুরো কার্গো যেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা নির্দিষ্ট হোল্ডে রাখা হয়। লোডমাস্টার প্রথমে তাতে রাজি হয়নি, ঝগড়া করেছে, শেষমেশ হার মানতে বাধ্য হয়েছে ওদের জেদের মুখে।’

    ‘কারণটা কী? তাপমাত্রার কোনও প্রভাব কি আছে ওয়াইবিসিও-র ওপরে?

    ‘না। একটাই ব্যাখ্যা এর—পুরো কার্গো একটা নির্দিষ্ট হোল্ডে রাখতে চেয়েছে, যাতে পরে সহজে খুঁজে পাওয়া যায়… আনলোড করা যায়।’

    ‘তা হলে ওই বিক্রেতাই আমাদের জলদস্যু, উপসংহার টানলেন মিচাম।

    ‘আর এই জলদস্যুর কাছে এনার্জি ওয়েপন ছিল,’ যোগ করল রানা। ‘তারমানে সব একই লোকের কাজ। এরাই সুপারকণ্ডাক্টরের বাজার খালি করে দিতে চাইছে।’

    ‘কেন, সেটাই প্রশ্ন। সুপারকণ্ডাক্টরের জন্যে পাগল হয়ে গেছে ওরা, যেখানে যা পাচ্ছে সব কিনে নিচ্ছে বা কেড়ে নিচ্ছে। চীনাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিল, বিপদের পরোয়া করল না… এর পেছনে বড় কোনও উদ্দেশ্য থাকতে বাধ্য। ‘

    ‘সান্তা মারিয়ায় ব্যাটারা কেন হাজির হয়েছে, তা আন্দাজ করতে পারছি এবার,’ গম্ভীর গলায় বলল রানা। ‘আরাতামা মারুর সেই জলদস্যুর লিডারটাই হামলা করেছিল আমার ওপর। ফ্রেঞ্চ টিমটাকেও নিশ্চয়ই তার সাগরেদরাই খুন করেছে।’

    ‘কিন্তু লোকটা বাঁচল কীভাবে?’ বিস্মিত গলায় বললেন মিচাম। ‘আমরা নিজ চোখে ওদের বোট বিস্ফোরিত হতে দেখেছি। পানিতে কয়েকজনের লাশও পেয়েছি।’

    ‘আমাদেরকে ধোঁকা দেবার জন্যে কয়েকজনকে বলির পাঁঠা বানিয়েছিল। বাকিরা বিস্ফোরণের আগেই নেমে গিয়েছিল পানিতে।

    ‘তারপর? ওদেরকে তুলে নেবার মত কোনও জাহাজ ছিল না ত্রিসীমানায়। আকাশে কোনও হেলিকপ্টারও দেখিনি আমরা। সাঁতার কেটে নিশ্চয়ই আফ্রিকায় চলে যায়নি?’

    ‘না। কিন্তু আসিফ আর তানিয়ার ওপর আক্রমণটা করা হয়েছিল পানির নিচে। এর অর্থ, সাবমেরিন আছে এদের কাছে।’

    ‘তা হলে সত্যিই একটা মাদার শিপ ছিল ওদের,’ দমে যাওয়া গলায় বললেন মিচাম। ‘পানির ওপরে নয়, নিচে। দিনে দিনে আরও কত কী যে দেখব! টেরোরিস্টরাও আজকাল সাবমেরিন ব্যবহার করছে। ‘

    ‘টাকা থাকলে এখন যে-কেউই সাবমেরিন কিনতে পারে,’ বললেন অ্যাডমিরাল। ‘আমাদের কাছে খবর আছে, রাশা থেকে পুরনো টাইফুন ক্লাসের বেশ কিছু সাবমেরিন গোপনে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে, যেগুলো স্ক্র্যাপইয়ার্ডে নিয়ে ভেঙে ফেলার কথা ছিল।’

    ‘টাইফুন ক্লাস যথেষ্ট বড়,’ রানা বলল। ‘চাইলে কার্গো ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আরাতামা মারু থেকে কার্গো সরাবার জন্যে ওরকম একটা সাবমেরিনই দরকার। ওটা এখানেও ব্যবহার করা সম্ভব।’

    ‘এখানে!’ ওর কথার অর্থ ধরতে পারছেন না মিচাম।

    ‘সাগরের তলার ওই ম্যাগনেটিক টাওয়ারটার কথা বলছি। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটা সুপারকণ্ডাক্টর। এমন জিনিসই তো খুঁজে বেড়াচ্ছে লোকগুলো। হঠাৎ করে সান্তা মারিয়ায় হাজির হলো কেন, বুঝতে পারছেন না? নেপচুনকেও ভয় দেখিয়ে বাধ্য করা হয়েছে বন্দরে ফিরে আসতে। টাওয়ারটা এখন অরক্ষিত। ‘

    ‘আমাদের অনুপস্থিতিতে ওখানে মাইনিং করবে বলে ভাবছেন?

    ‘পর্তুগিজ নেভির সঙ্গে কথা হয়েছে আমার,’ অ্যাডমিরাল বললেন। ‘আগামীকাল দুপুরে ওখানে অ্যান্টি-সাবমেরিন কেপেবিলিটির একটা ফ্রিগেট পাঠাচ্ছে ওরা।’

    ‘তারপরেও কমপক্ষে বারো ঘণ্টা সময় পাচ্ছে লোকগুলো,’ বলল রানা।

    ‘বারো ঘণ্টায় কতটুকুই বা মাইনিং করতে পারবে?’

    ‘অনেক। মাটি খুঁড়তে হচ্ছে না ওদেরকে। বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যতটুকু পারে ভেঙে নেবে টাওয়ার থেকে, সাবমেরিনে ভরবে। টাইফুন ক্লাসের মিসাইল বে-তে পনেরো হাজার টন কার্গো ধরে।’

    নীরবতা নেমে এল কনফারেন্স রুমে। খানিক পর মুরল্যাণ্ড বলল, ‘বেশ, ধরে নিই ওদের হাতে টাইফুন ক্লাসের সাবমেরিন আছে, টাওয়ার থেকে মিনারেলও সংগ্রহ করার চেষ্টা করবে। এখানে আমাদের কী করার আছে?’

    চিন্তার বিষয় বটে। টর্পেডোওয়ালা একটা সাবমেরিনের বিরুদ্ধে নেপচুন একেবারেই অসহায়।

    ‘কিছুই করার নেই আমাদের,’ বললেন মিচাম। ‘নেভির ফ্রিগেট না পৌঁছুনো পর্যন্ত ওরা যা-খুশি-তাই করতে পারবে। ঠেকাবার উপায় নেই।’

    সেটা রানাও বুঝতে পারছে, কিন্তু মানতে পারছে না মন থেকে। হার মেনে নেয়া ওর স্বভাবে নেই। ভাবছে, ওদেরকে ঠেকানোর নিশ্চয়ই কোনও উপায় আছে। কী সেটা? মাথায় চিন্তার ঝড় বইল। হঠাৎ হাসি ফুটল ওর মুখে।

    ‘যদি না ঠেকাই?’ বলল ও। ‘ওখানে গিয়ে রেকগুলোর মাঝে লুকিয়ে থাকতে পারি আমরা। সাবমেরিনটা যদি আসে, সুযোগ বুঝে একটা ট্রান্সমিটার লাগিয়ে দেব খোলে। এরপর দূর থেকে ট্র্যাক করব সিগনাল। ব্যাটারা কোত্থেকে আসছে, আর কোথায় ফিরছে, তা জানা গেলে বাকিটা সামাল দেবার জন্যে বহু লোক আছে।’

    মুরল্যাণ্ড আর ক্যাপ্টেন মিচামের চেহারা দেখেই বোঝা গেল, প্ল্যানটা পছন্দ হয়েছে তাঁদের। কিন্তু নুমা ডিরেক্টর চুপ করে রইলেন।

    ‘অ্যাডমিরাল, স্যর?’ ডাকলেন মিচাম।

    ‘ঝুঁকি খুব বেশি,’ এবার বললেন হ্যামিলটন। ‘তারচেয়ে কয়েকটা অ্যান্টি-সাবমেরিন এয়ারক্র্যাফট পাঠালে ক্ষতি কী? ফ্রিগেট পৌঁছুবার আগ পর্যন্ত জায়গাটার ওপর নজরদারি করতে পারবে ওরা।’

    ‘সাবমেরিনটা তা হলে আর ধারেকাছেই ঘেঁষবে না, স্যর,’ বলল রানা। ‘ওদের পরিচয় জানার সুবর্ণ সুযোগটা হারাব আমরা।’

    ‘তোমরাই বা ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সাবমেরিনের কাছে পৌঁছুবে কীভাবে?

    মুরল্যাণ্ডের সঙ্গে চোখাচোখি করল রানা।

    ‘আমরা হ্যামারহেডে চড়ে যাব, অ্যাডমিরাল, বলল ও।

    .

    মিটিং শেষ হলে নেপচুনের ওয়ার্কশপে চলে গেল মুরল্যাণ্ড, ট্রান্সমিটার নিয়ে কাজ করার জন্যে। জিনিসটা একদিকে যেমন চোখ এড়ানোর মত ছোট্ট হওয়া চাই, অন্যদিকে শক্তিশালী সিগনাল ছড়াতেও সক্ষম হতে হবে। আবার এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে ভালমত আটকে থাকে সাবমেরিনের খোলে, পানির তোড়ে খুলে পড়ে না যায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জাদু দেখাবে, কথা দিয়ে গেল সে।

    ক্যাপ্টেন মিচাম গেলেন ব্রিজে। জাহাজের সমস্ত অপ্রয়োজনীয় বাতি নিভিয়ে ফেলার হুকুম দিলেন, যাতে অন্ধকারে ছেয়ে যায় পুরো কাঠামো। এরপর খবর দিলেন ভিলা দো পোর্তোর পুলিশে—ডকসাইডে দুটো প্যাট্রোল কার পাঠাতে অনুরোধ করলেন জাহাজের নিরাপত্তার জন্যে। নেপচুনের ওপর নজর রাখার জন্যে আশপাশে যদি কেউ ঘুরঘুর করে, আশা করছেন পুলিশ দেখে কেটে পড়বে সে। সবার অলক্ষে হ্যামারহেড নিয়ে ডুব দিতে সুবিধে হবে রানা আর মুরল্যাণ্ডের।

    লামিয়া চলে যাবে, ওকে বিদায় দেবার জন্যে জাহাজ থেকে নেমে এল রানা। ডকের শেষ প্রান্তে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল গাড়ির জন্যে।

    ‘কে আসছে?’ জানতে চাইল রানা। ‘তোমার হ্যাণ্ডলার?’

    ‘আমি স্পাই নই যে আমার হ্যাণ্ডলার থাকবে,’ মৃদু হেসে বলল লামিয়া। ‘অভিভাবক বলতে পারো। এসব কাজে আমি একেবারে আনাড়ি কিনা, তাই আমাকে গাইড করার জন্যে পাঠানো হয়েছে ভদ্রলোককে।’

    ‘তাঁর নামটা জানতে পারি?’

    ‘কেন নয়? রাবিনোভিচ… মেজর ইভান রাবিনোভিচ।’

    এফএসবি, মানে রাশান ইন্টেলিজেন্সের কোনও এনফোর্সার বোধহয়, অনুমান করল রানা। একদিক থেকে সেটা ভাল।

    ‘মেজর রাবিনোভিচের কাছাকাছি থেকো,’ বলল ও। ‘দরজা বন্ধ রাখবে সবসময়।

    ‘বিপদের আশঙ্কা করছ? আমি তো কারও টার্গেট নই। আজ ওরা তোমার পেছনে লেগেছিল। আমি ওদের চেহারাও ঠিকমত দেখিনি।’

    ‘তারপরেও… সাবধান থাকা ভাল। তুমি ওদেরকে আইডেন্টিফাই করতে পারবে কি পারবে না, তা তো আর ওরা জানে না। আমার সঙ্গে ছিলে, তাই তোমাকেও পথের কাঁটা ভেবে বসতে পারে।’

    ‘বেশ, সাবধান থাকব,’ কথা দিল লামিয়া। ‘আর কিছু?’

    ‘সাগরের তলায় ওই বিমানটায় কেন ডাইভ দিয়েছিলে, বলবে?’

    মৃদু হাসল লামিয়া। ‘মেজর সেটা পছন্দ করবেন না।’

    জোরাজুরি করল না রানা। বলল, ‘তা হলে তাঁর মত বদলাবার অপেক্ষায় রইলাম। আগামীকাল বা পরশু নাহয় আবার জিজ্ঞেস করব।’

    বিষাদ ভর করল লামিয়ার চেহারায়। ‘যদি ভুল করে না থাকি, আগামীকাল ফিরে যেতে হবে আমাকে, রানা। আর কোনোদিন আমাদের দেখা হবে না।

    ‘অতটা নিশ্চিত হয়ো না,’ হালকা গলায় বলল রানা। ‘রাশায় প্রায়ই আসা-যাওয়া করতে হয় আমাকে। দেখবে, হঠাৎ একদিন তোমার দরজায় হাজির হয়ে গেছি। মানে, তোমাদের দেশের ঠাণ্ডায় যদি কাবু হয়ে না যাই আর কী।’

    ‘আমার কাছে এলে তোমাকে ঠাণ্ডা নিয়ে ভয় পেতে হবে না,’ দুষ্টু গলায় বলল লামিয়া।

    হেডলাইটের আলো দেখা গেল। একটা সেডান এসে থামল রাস্তার ধারে। রুক্ষ চেহারার একজন রাশান লোক বসে আছে ড্রাইভারের আসনে। কোনও কথা বলল না সে।

    রানার গালে একটা চুমো দিল লামিয়া। ফিসফিসাল, ‘বিদায়, রানা।’ তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। উঠে বসল ড্রাইভারের পাশে।

    চলতে শুরু করল গাড়ি।

    .

    ঘণ্টাখানেক পর, হ্যামারহেড যখন আটলান্টিকের কালো পানি চিরে ম্যাগনেটিক পাথরে গড়া টাওয়ারটার দিকে ছুটতে শুরু করল, তখনও রানার ভেতরে রয়ে গেছে লামিয়ার স্মৃতির রেশ। অদ্ভুত এক আকর্ষণ বোধ করছে ও মেয়েটার প্রতি— সৌন্দর্য বা রূপ-যৌবন দেখে নয়, বরং ব্যক্তিত্ব আরও আকৃষ্ট করেছে রানাকে। স্পাই নয়, কোনও ধরনের মিলিটারি ট্রেইনিংও নেই, তারপরেও চরম বিপদের মুহূর্তে একবিন্দু ঘাবড়ায়নি, বরং তাল মিলিয়ে চলেছে রানার সঙ্গে। আনাড়ি হওয়া সত্ত্বেও তাকে কেন গোপন মিশনের জন্যে বাছাই করেছে রাশান ইন্টেলিজেন্স, বুঝতে অসুবিধে হয় না। দু’ঘণ্টা লাগল গন্তব্যে পৌঁছুতে; প্রায় পুরোটা সময় রানা ওকে নিয়ে ভাবল।

    জাহাজের গোরস্থানের কাছাকাছি পৌঁছে গতি কমানো হলো। এবার সাবধানে এগোচ্ছে হ্যামারহেড।

    ‘সোনার অ্যারে-তে কিছু শুনতে পাচ্ছি না,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘সাইটে ওরা পৌঁছে গেলে এতক্ষণে অনেক আওয়াজ হতো।’

    ‘ভিজুয়াল রেঞ্জে পৌঁছে যাবার কথা আমাদের,’ বলল রানা। ‘বাতি জ্বালো।’

    সুইচ টিপল মুরল্যাণ্ড। হলদে আলোর দুটো রেখা ছড়িয়ে পড়ল সাগরের তলদেশে। কাদার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা রেকগুলোর দিকে তাকিয়ে আরেকবার বিস্ময় ভর করল রানার মনে। একই জায়গায় একসঙ্গে এত জাহাজ সচরাচর ডোবে না। এখানকার সঙ্গে একটা জায়গারই শুধু মিল পাচ্ছে ও-প্রশান্ত মহাসাগরের ট্রাক লেগুন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান নেভি ওখানে ডুবিয়ে দিয়েছিল ষাটটা জাপানি জাহাজ। বছরদুই আগে সেখানে ডাইভ দেবার সুযোগ হয়েছিল ওর। তবে সেখানে রেকগুলো এখানকার চেয়ে অনেক বেশি ছড়ানো-ছিটানো ছিল।

    ‘লিবার্টি শিপটার পেছনে গিয়ে ঘাপটি মারা যাক,’ প্রস্তাব দিল মুরল্যাণ্ড। ‘তা হলে টাওয়ারের দিক থেকে আমাদের কেউ দেখতে পাবে না।’

    মাথা ঝাঁকাল রানা। ওর কোলের ওপর গ্রেভইয়ার্ডের একটা হাতে আঁকা চার্ট রয়েছে। সেটা দেখে সাবধানে এগিয়ে নিয়ে চলল হ্যামারহেডকে, একটু পরেই পৌঁছে গেল বিশাল জাহাজটার পাশে। নেমে এল বালির ওপর। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে ওর। নিজেদেরকে অ্যাকোয়েরিয়ামের ডেকোরেশন পিসের মত লাগছে, যেন সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিশাল একটা জাহাজের মডেলের পাশে। জাহাজের খোলে মস্ত বড় এক ফুটো।

    ‘বাতি নেভাও,’ নির্দেশ দিল রানা।

    আবারও সুইচ টিপল মুরল্যাণ্ড। বাতি নিভে যেতেই কালিগোলা অন্ধকার গ্রাস করল হ্যামারহেডকে। মুখের সামনে হাত ধরলেও কিছু দেখা যাচ্ছে না।

    ‘বাতাস কতটুকু আছে?’ জানতে চাইল রানা।

    ‘দশ ঘণ্টার মত।’

    ‘বেশ,’ নড়েচড়ে আয়েশ করে বসল রানা। ‘মেহমানদের জন্যে অপেক্ষা করা যাক।’

    .

    চার ঘণ্টা পর কাঁধে মুরল্যাণ্ডের টোকা পেয়ে সজাগ হলো রানা। রাতভর বিশ্রাম মেলেনি, তাই পালা করে ঘুমিয়ে নিচ্ছে ওরা।

    ‘কিছু ঘটেছে?’ বলতে বলতে সোজা হলো ও, সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঠুকে গেল ক্যানোপিতে। হাঁটুও বাড়ি খেল সামনের প্যানেলে।

    ‘হ্যাঁ,’ পেছনের সিট থেকে বলল মুরল্যাণ্ড। ‘সূর্য উঠছে।’ ক্যানোপির স্বচ্ছ আবরণ ভেদ করে ওপরে তাকাল রানা। আবছা আলো দেখা যাচ্ছে ওপরে। নিচে অবশ্য এখনও অন্ধকার। কবজিতে বাঁধা ডাইভ ওয়াচের লিউমিনাস ডায়াল সময় দেখাচ্ছে: সকাল সাতটা। তারমানে, ওপরে ভালমতই ফুটেছে দিনের আলো।

    আড়মোড়া ভাঙার আরেক দফা ব্যর্থ চেষ্টা করল ও, গুঙিয়ে উঠল আবারও হাঁটু-মাথা বাড়ি খাওয়ায়। মুরল্যাণ্ডকে বলল, ‘ভবিষ্যতে কোনও সাবমারসিবল ডিজাইন করতে হলে নড়াচড়ার একটু জায়গা রেখো।’

    ‘খুব অসুবিধে হচ্ছে বুঝি?’

    ‘লোকাল বাসের সিটও এরচেয়ে খোলামেলা হয়। ওফ, হাতে-পায়ে খিল ধরে গেল।’

    ‘চঞ্চলমতি লোক নিয়ে এই এক মুশকিল, একটুও স্থির হয়ে থাকতে পারে না,’ ফোড়ন কাটল মুরল্যাণ্ড। ‘আরে বাবা, প্রমোদতরীতে চড়োনি তুমি। প্রমোদতরী হলে শুধু নড়াচড়া কেন, শোয়া-বসা, খেলাধুলা… এমনকী খাওয়াদাওয়ারও ব্যবস্থা রাখতাম।

    খাওয়ার কথা শুনে পেট মোচড় দিয়ে উঠল রানার। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। খিদে পেয়েছে বেশ। ‘ভুল করেছি, শুকনো কিছু খাবার আনলেও পারতাম,’ বলল ও।

    ‘খাওয়ার সময় পাব তা ভাবিনি। আমার তো ভয় হচ্ছিল, ওরা হয়তো আমাদের আগেই এখানে এসে কাজ শুরু করে দেবে। তখন কাছ ঘেঁষা কঠিন হয়ে যেত।’

    কপালে ভাঁজ পড়ল রানার। ‘ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। হাতে সময় নেই ওদের, নেভির ফ্রিগেট আসার আগেই যতটা পারে টাওয়ারের পাথর সংগ্রহ করার কথা। আসছে না কেন? হাইড্রোফোনে কিছু শুনতে পাচ্ছ?’

    ‘নাহ্।’

    ‘শিয়োর?’

    ‘হেডফোন পরে থাকতে থাকতে কানে ঘা হয়ে গেল, আর তুমি কিনা… অবশ্যই শিয়োর। মাছের গান ছাড়া কিছু শুনতে পাচ্ছি না।’

    ‘মাছেরা গান গাইছে? মাথাটা গেছে তোমার। একটু বেশি সময় ধরেই হাইড্রোফোনে কান লাগিয়ে রেখেছ।’

    কথাটা বলেই সচকিত হলো রানা। বেশি সময়… হ্যাঁ, সত্যিই বড় বেশি সময় নিচ্ছে প্রতিপক্ষ।

    ‘আসবে না ওরা,’ বলল ও। ‘বাতি জ্বেলে দাও!’

    ‘কেন?’

    ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আর টাওয়ার ভেঙে যথেষ্ট পরিমাণ পাথর সরাবার মত সময় নেই। ভুল করেছি আমরা।’

    সুইচ টিপতে শুরু করল মুরল্যাণ্ড। প্রথমে কন্ট্রোল প্যানেল আর ভেতরের বাতি জ্বালল, দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এলে জ্বেলে দিল বাইরের লাইটগুলো। সবজে-হলুদ আলোয় আলোকিত হলো সাবমারসিবলের চারপাশ।

    ‘সব আগের মত আছে,’ টাওয়ারটাকে অক্ষত দেখে হতাশ গলায় বলল রানা। ক্ষীণ একটা সন্দেহ ছিল, অন্ধকারে চুপিসারে হয়তো পাথর সরিয়ে নেয়া হয়েছে, ওরা টের পায়নি… তবে বাস্তবে তেমন কোনও লক্ষণ দেখা গেল না।

    মুখ ফিরিয়ে লিবার্টি শিপটার দিকে তাকাল ও। উজ্জ্বল আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওটার শরীর। ওয়াটারলাইনের ঠিক নিচে বিশাল এক গর্ত হাঁ করে আছে—ওটাই ডুবিয়েছে জাহাজটাকে। কিন্তু কীভাবে হলো এই গর্ত? টর্পেডো বা বোমার আঘাত? তবে কি এই জাহাজটাও অংশ নিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে? নাহ্, অতটা পুরনো হতে পারে না। অন্তত গায়ে জমে থাকা শ্যাওলার স্তর সে-সাক্ষ্যই দিচ্ছে। খুব সামান্যই জমেছে। বড়জোর দেড়-দু’বছর, তার বেশি হবে না কিছুতেই।

    অন্যদিকে পড়ে থাকা রেকগুলোর দিকে এবার তাকাল রানা। সবচেয়ে কাছে যেটা পড়ে আছে, ওটা একটা দুই- ইঞ্জিনের সেসনা বিমান। কনস্টেলেশন বিমানটার ব্যাপারে কী বলেছিল লামিয়া, মনে পড়ল ওর। অ্যালুমিনিয়ামে গড়া বিমানের ওপর ম্যাগনেটিজমের কোনও প্রভাব পড়ার কথা না। কথাটা সেসনার বেলাতেও খাটে। বিমানটা লোহার তৈরি নয়। তা হলে ক্র্যাশ করল কেন, টাওয়ারের এত কাছেই বা এল কী করে?

    সেসনার ওপারে কাদার মধ্যে মুখ গুঁজে আছে একটা নব্বুই ফুট দীর্ঘ ফিশিং ট্রলার। দূর থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, তবে গত কয়েকদিনে ওটার ওপর দিয়ে আসা- যাওয়া করেছে বেশ কয়েকবার। রানার মনে পড়ল, ট্রলারটার গায়েও সামুদ্রিক শ্যাওলা খুব কমই দেখেছে।

    চিন্তায় ডুবে গেল রানা। তবে কি ম্যাগনেটিজমের কারণে সামুদ্রিক উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে? নইলে রেকগুলোর গায়ে ঠিকমত শ্যাওলা-শামুক-আগাছা জমতে পারছে না কেন?

    অতিকায় লিবার্টি শিপের দিকে আবারও নজর ফেরাল ও। চোখ আটকে গেল বিশাল ফুটোটায়। পরমুহূর্তে একশো একটা বাতি যেন জ্বলে উঠল মাথার ভেতরে, কেটে গেল সব কুয়াশা।

    ‘আমি একটা গাধা!’ বলে উঠল ও। ‘মস্ত বড় গাধা!’

    ‘সরল স্বীকারোক্তির জন্যে ধন্যবাদ,’ পেছন থেকে টিপ্পনী কাটল মুরল্যাণ্ড। ‘কিন্তু কীসের জন্যে এমন আত্মোপলব্ধি এল, দয়া করে খুলে বলবে কি?’

    ওর কথা যেন কানেই গেল না রানার। আনমনে নিজেকে প্রশ্ন করল, ‘এত বড় বোকামি করলাম কী করে?’

    ‘বোকামিটা কোথায় করলে, সেটা না জানলে বলি কী করে? আমি তো আর বোকামির ওপর বিশেষজ্ঞ নই।’

    ‘কিন্তু স্যালভিজ ওয়ার্কের ওপর তো বিশেষজ্ঞ?’ ঘাড় ফিরিয়ে বন্ধুর দিকে তাকাল রানা। ‘আমরা দু’জনেই পানির তলা থেকে প্রচুর জাহাজ তুলেছি, প্রয়োজনে ডুবিয়েও দিয়েছি। নিজেই বলো, নুমার রিফ-বিল্ডিং প্রোগ্রামে কতগুলো অচল জাহাজ ডুবিয়েছ তুমি?’

    ‘পঞ্চাশটা তো হবেই।’

    ‘তার ভেতর বেশ কয়েকটায় আমিও তোমাকে সাহায্য করেছি। জাহাজ কীভাবে ডোবাই আমরা?’

    ‘কীভাবে আবার? ওয়াটারলাইনের নিচে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে।’

    ‘এই জাহাজটা দেখো।’

    সেকেণ্ডারি একটা লাইট জ্বালল মুরল্যাণ্ড, ওটার মুখ ঘোরানো যায়। আলোটা ফেলল লিবার্টি শিপের গর্তে। রানা কী বলতে চাইছে, তা বুঝে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে।

    ‘স্টিল প্লেটগুলো বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে,’ গম্ভীর গলায় বলল মুরল্যাণ্ড। ‘তারমানে বাইরে থেকে কিছুর আঘাতে বিস্ফোরণ ঘটেনি, ভেতরেই ঘটেছে বিস্ফোরণ।’

    ‘ওয়াটারলাইনের নিচে,’ যোগ করল রানা। ‘জাহাজটা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ডুবিয়ে দিয়েছে, ববি।’

    ‘দুর্ঘটনা হতে পারে না? জাহাজটায় কার্গো হিসেবে কোনও বিস্ফোরক দ্রব্য ছিল কি না, তা তো জানি না আমরা। গর্তটা কত বড়, দেখেছ? এত বড় তো দরকার ছিল না। আমরা এরচেয়ে অনেক ছোট ফুটো করে জাহাজ ডোবাই।’

    ‘কারণ, আমাদের কোনও তাড়া থাকে না। ছোট ফুটো করা হয়, যাতে আস্তে আস্তে ঢোকে পানি… জাহাজটা ধীরে- সুস্থে সোজা হয়ে নিচে নামে… কৃত্রিম রিফটা যাতে ঠিকমত তৈরি হয়। কিন্তু তুমি যদি লোকের চোখ এড়িয়ে খুব দ্রুত একটা জাহাজ ডোবাতে চাও, বড় ফুটোই করতে হবে।’

    হ্যামারহেডের ইঞ্জিন চালু করল রানা। সাগরের মেঝে থেকে শরীর জাগাল, তারপর ভাসিয়ে নিয়ে চলল রেকগুলোর ওপর দিয়ে। ফিশিং ট্রলারটার কাছে গিয়ে লিবার্টি শিপের মতই মস্ত এক ফুটো পাওয়া গেল। একই ধরনের ড্যামেজ দেখা গেল তৃতীয় আরেকটা ফ্রেইটারের গায়ে।

    ‘একটা রেকের গায়েও এক বছরের বেশি শ্যাওলার গ্রোথ নেই,’ রানা বলল। ‘আছে স্রেফ ওই কনস্টেলেশনটার গায়ে। ওটাই একমাত্র জেনুইন রেক। আর এগুলো… না, ববি, ডেভিল’স্ ডোরওয়েতে বছরের পর বছর ধরে জাহাজ বা বিমান ডুবছে না। এখানে যা দেখছি, সবই খুব সম্প্রতি ডোবানো হয়েছে… কাছাকাছি সময়ে।’

    মুরল্যাণ্ডের চোয়াল ঝুলে পড়েছে। ‘এসব আমরা আগেই খেয়াল করলাম না কেন?’

    ‘কারণ আমরা সারাক্ষণ বিজ্ঞানীদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি, পাথরের ওই টাওয়ারটা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। অন্য কোনও কিছু নিয়ে মাথা ঘামাইনি।’ ফ্রেইটারের পাশে হ্যামারহেডকে নামিয়ে আনল রানা। ‘এই গোরস্থান… ওই ম্যাগনেটিক টাওয়ার… পুরোটাই একটা ধাপ্পা।’

    ‘কিন্তু কেন?’ মুরল্যাণ্ডের কণ্ঠে অবিশ্বাস। ‘এসব করে লাভটা কী? কে-ই বা করতে যাবে এসব?’

    রানা বুঝতে পারছে, প্রশ্নগুলোর জবাবের মধ্যে লুকিয়ে আছে পুরো রহস্যের চাবিকাঠি। মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে ওর। অশুভ কিছুর আভাস দিচ্ছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, কী যেন ধরা পড়তে পড়তেও পড়ছে না। এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, যা যা জানা গেছে… সব খতিয়ে দেখতে শুরু করল। যোগসূত্র খুঁজছে সবকিছুর মাঝে, তা হলে হয়তো বোঝা যাবে এই ধাপ্পার উদ্দেশ্য।

    যারা আরাতামা মারুর ওপর হামলা করেছিল, তারাই, যদি এর পেছনে থাকে, ধাপ্পাটা কীভাবে সাহায্য করছে তাদের? কোনও সুপারকাক্টিং মিনারেল পাচ্ছে না তারা, টাকা-পয়সাও আসছে না এখান থেকে। বরং এত বড় একটা নাটক সাজাবার জন্যে একগাদা টাকা তাদেরকেই খরচ করতে হচ্ছে।

    ‘ব্যাপারটা পাবলিসিটি হতে পারে?’ বলল মুরল্যাণ্ড।

    ‘তার জন্যে আরও সহজ… আরও সস্তা কায়দা আছে, ‘ মাথা নেড়ে বলল রানা। ‘তা ছাড়া বড় কোনও পাবলিসিটিও হয়নি এখানকার।’

    আসলেই তাই। প্রাথমিক ঘোষণার পর আবিষ্কারটা নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি কেউ। দলে দলে ছুটে এসেছে শুধু ম্যাগনেটিজম আর সুপারকণ্ডাকশন বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।

    সত্যটা উপলব্ধি করতেই চমকে উঠল রানা। ‘বিজ্ঞানীর দল,’ বলল ও। ‘হ্যাঁ, ওদের পেছনেই লেগেছে এরা।’

    ‘মানে?’ ভুরু কোঁচকাল মুরল্যাণ্ড।

    ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল রানা। বলল, ‘স্রেফ মিনারেল নয়, সেই মিনারেলকে কাজে লাগাবার জন্যে দক্ষ লোকও চাই ওদের। আমার ধারণা যদি ঠিক হয়, তা হলে সেসব লোককে একত্র করার জন্যেই সাজানো হয়েছে এই ধাপ্পা… সোজা কথায় টোপ! এখন স্রেফ জাল গোটানো বাকি।’

    ‘মাই গড!’

    কন্ট্রোলে হাত রেখে থ্রটল বাড়াল রানা। হ্যামারহেড চলতে শুরু করতেই নাক তুলল ওপরদিকে। ছুট লাগাল সারফেসের পানে। যত দ্রুত সম্ভব ভেসে উঠে নেপচুনে খবর পাঠাতে হবে। সতর্ক করে দিতে হবে বিজ্ঞানীদের।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ৪৬৩ – ছায়াঘাতক
    Next Article মাসুদ রানা ১৪৪ – অপহরণ-২

    Related Articles

    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৩৮৫-৩৮৬ – হ্যাকার (দুই খণ্ড একত্রে)

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৬ – টপ টেরর

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৪ – নরপশু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫৩ – ধর্মগুরু

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫২ – কালো কুয়াশা

    July 22, 2025
    কাজী আনোয়ার হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৫১ – মায়া মন্দির

    July 22, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌) – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত

    September 9, 2025

    শ্রীশ্রীচণ্ডী – অনুবাদ : পঞ্চানন তর্করত্ন

    September 9, 2025

    পুলিশ কাহিনী ১ – পঞ্চানন ঘোষাল (প্রথম খণ্ড)

    September 9, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.