Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ৪৭০ – কালবেলা

    কাজী মায়মুর হোসেন এক পাতা গল্প433 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কালবেলা – ৫ (মাসুদ রানা)

    পাঁচ

    ওকলাহোমার সেই খুনের ঘটনার দু’দিন পর।

    এসময়ে আয়ারল্যাণ্ডে পড়ে কনকনে শীত। উত্তাল সাগর থেকে হু-হু হিমঠাণ্ডা হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দেয় গ্যালওয়ে উপকূল। চামড়ার জ্যাকেটের কলার ওপরে তুলে দিল মাসুদ রানা। ম্লান দুপুরে আটলান্টিকের আকাশে ডিমের কুসুমের মত ঝুলছে লালচে সূর্য। আনমনে নুড়িভরা সৈকতে হাঁটতে গিয়ে রানা দেখছে ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে ওর ছায়া।

    সৈকতে একা থাকতে ভাল লাগে ওর। পা ফেলছে ধীরে ধীরে। জানা নেই এরপর কোথায় যাবে বা কী করবে। মাঝে মাঝে থেমে দেখছে সাগরের ধূসর ঢেউ। ভাবছে: ওরা যদি জানিয়ে দিত, কেন এত অর্থহীন হয়ে গেল ওর এই জীবন!

    আগেও এই সৈকতের রুক্ষ পাথরে ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখত রানা। অবশ্য সে-ও তো মেলা আগের কথা। একে একে ওর জীবন থেকে বিদায় নিলেন বাবা-মা-চাচা-ফুফু। নিজে নানা বিপদে জড়িয়ে গেলেও বেঁচেবর্তে রয়ে গেছে ও।

    রানার বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। ঝুঁকে সৈকত থেকে তুলে নিল একমুঠো নুড়িপাথর। এক এক করে ছুঁড়ল ঢেউয়ের ওপরে ফোঁস ফোঁস করা ফেনার ভেতরে।

    ‘আমি এখানে কী চাই?’ জিজ্ঞেস করল নিজেকে। সাগরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে চলল একটু দূরের বাড়িটার দিকে। কয়েক গজ গিয়ে আবারও থামল। খেয়াল করে দেখল উঁচু পাথুরে জমিতে দুর্গের মত ভিক্টোরিয়ান বাড়িটা। ওটার পেছনে এঁকে এঁকে গেছে ব্যক্তিগত সৈকত। এ- এলাকার প্রেমে পড়ে বাড়ি ও সরু সৈকত কিনে নিয়েছিলেন ওর চাচা। মৃত্যুর আগে সবই দান করে যান রানাকে।

    বহু বছর পড়ে ছিল বাড়ি। তারপর দেখে রাখবেন সেই শর্তে ওখানে বাস করতে এলেন নিঃসন্তান এক বয়স্ক দম্পতি। কয়েক বছরের ব্যবধানে নিউমোনিয়া ও ক্যান্সারে মারা গেলেন তাঁরা। তখন কাজে গছে না বলে বাড়ি ও সৈকত বিক্রি করে দিয়েছে রানা।

    অবশ্য এখন একদম বদলে গেছে বাড়িটা, এবং সেজন্যে অতীতের কথা ভেবে বুকে এসে ব্যথা লাগছে রানার। মনে মনে নিজেকে বলল: দুনিয়ায় কোনকিছুই চিরকালীন নয়। এমন কী মানুষের ভালবাসাও পাল্টায় নানান রঙ। জেসিকার কথা ভেবে তিক্ত হাসল রানা। নিজেকে বলল: ‘বলো তো, আসলে এখানে কেন এলে তুমি?’

    নুড়িভরা সৈকত যেখানে শেষ, তারপর পাথুরে সিঁড়ি, বেয়ে উঠলে বাড়ির পেছন উঠন। নতুন মালিক ভেবেছেন নিরাপত্তার কথা, তাই এখন বাড়ির শেষ সীমানায় লোহার সেফটি রেইলিং। সাগরের দিকে এক কনসার্ভেটরি রুমের কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যের লালচে দুর্বল আলো।

    বাড়ির পাশে সরু পথ ঘুরে চলে গেছে সামনের উঠনে। ওদিকে পৌঁছে মুখ তুলে তাকাল রানা। চাচার বাড়ি বেশি বদলে গেছে সদর গেটে ঝুলন্ত সাইনবোর্ডের জন্যে।

    ওখানে লেখা: গ্যালওয়ে গেস্ট-হাউস।

    নামটা দেখে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে রানার। কে যেন অন্তরের গভীরে বলে চলেছে: এ-বাড়ি কিন্তু তোমার আর নয়! তুমি এখন আর এটার মালিক নও!

    তা হলে আমি এখানে কী করছি? -নিজেকে জিজ্ঞেস করল রানা। কোন জবাব পেল না সেখান থেকে। বিষাদ-ভরা মন নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, এমন সময় শুনল পরিচিত কণ্ঠ। ‘মিস্টার রানা?’

    ঘাড় ফিরিয়ে মোটা এক মহিলাকে দেখতে পেল ও। তাঁর বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। মুখে মিষ্টি হাসি। পরনে ঢলঢলে নীল গাউন। ধূসর চুল খোঁপা করা। প্রথম দর্শনে তাঁকে মনে হবে বড় কোন হাসপাতালের হেডনার্স। বাড়িটার মত বদলে যাননি। রানা সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়ার সময় যেমন ছিলেন, তেমনই আছেন। বড়জোর আরও চওড়া হয়েছে কোমর। কে জানে, বিশ বছর বয়সেও হয়তো এমনই ছিলেন।

    জোর করে মুখে হাসি ফোটাল রানা। ‘দেখা হয়ে ভাল লাগছে, মিসেস অ্যাপলউড।’

    ‘আমারও, মিস্টার রানা,’ হাসলেন মহিলা।

    ‘আপনাদের ব্যবসা এখন কেমন চলছে?’ ভদ্রতা করে জানতে চাইল রানা।

    ‘খুব ভাল। আপনি কি ছুটিতে এসেছেন গ্যালওয়েতে?’

    ‘জী,’ বলল রানা, ‘এখন কেমন বোধ করছেন মিস্টার অ্যাপলউড?’

    ‘কোমরের অপারেশনের পর থেকে বেশ ভাল আছে। আজ গেছে গলফ খেলতে। সন্ধ্যার আগে আর ফিরবে না। আপনি ঘুরে গেছেন জানলে আড্ডা দিতে না পেরে খুব আফসোস করবে।’

    ‘আমারও ভাবতে গিয়ে খারাপ লাগছে, তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না,’ ডাহা মিথ্যা বলল রানা। গল্ফ খেলা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিরস গল্প শুনতে চরম আপত্তি আছে ওর। তার চেয়েও মারাত্মক এক বিষয় আছে মিস্টার অ্যাপলউডের। আর সেটা হলো তাঁর ব্যথাভরা কোমর। কীভাবে ট্যাড়া চোখ নিয়ে গর্তে গলফ্ বল ফেলে দেন, সেটাও কঠিন গবেষণার বিষয়। ডানচোখ চেয়ে থাকে সরাসরি সামনে, অন্য চোখটা দেখে আকাশের চাঁদ-তারা।

    ‘ভেতরে এসে ড্রিঙ্ক নিন, মিস্টার রানা,’ বললেন মিসেস অ্যাপলউড। ‘ক’দিন আগে আমরা বার চালু করেছি।’

    একটু দ্বিধা করে তাঁর পিছু নিল রানা। বাড়িতে ঢুকে মনে পড়ল ছোটবেলার স্মৃতি। আগে এন্ট্রান্স হলে ছিল কাঠের কালো প্যানেল। সেসব এখন নেই। আধুনিক করা হয়েছে রিসেপশন এরিয়া। মহিলার সঙ্গে হেঁটে রানা পৌঁছে গেল লিভিং ও ডাইনিং রুমের কাছে। এখন দুই ঘরের মাঝে কোন দেয়াল নেই। ফুলেল ওয়ালপেপার দেখে মনে মনে ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা। এ-ছাড়া দেয়ালে আছে কাঁচা রঙের কিছু সস্তা তৈলচিত্র। আগে ছিল না এমন এক আর্চওয়ে পেরিয়ে। ওরা পা রাখল নতুন কনসার্ভেটরি রুমে। রবিবারের ডিনারের জন্যে সাজানো আছে টেবিল ও চেয়ার। ঘরের অন্যদিকে ওক কাঠের মস্ত বার। লাউঞ্জে বসে চুপচাপ পত্রিকা পড়ছেন আশি পেরিয়ে যাওয়া বেশ ক’জন অতিথি।

    জানালার কাছে আর্মচেয়ারে বসে আছে এক মেয়ে। রানা অনুমান করল, তার বয়স হবে পঁচিশ। ছেঁটে রাখা বালিরঙা চুলের জন্যে তাকে কিশোরী বলে মনে হচ্ছে। পরনে সাদা টি-শার্ট ও নীল জিন্সের প্যান্ট। সামনে টেবিলে একটা মিনি ল্যাপটপ। পাশে হোয়াইট ওয়াইনের আধখাওয়া গ্লাস। মেয়েটাকে কালো এক নোটবুক থেকে কমপিউটারে তথ্য টুকতে দেখল রানা। বুঝে গেল, ছুটিতেও কাজ এড়াতে পারেনি বেচারি।

    আগ্রহ ভরা চোখে রানাকে দেখছেন মিসেস অ্যাপলউড হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘কী বুঝলেন?’

    ‘খুব সুন্দর করে সব গুছিয়ে নিয়েছেন,’ আবারও মিথ্যা বলল রানা।

    ‘সত্যিই?’ খুশি হলেন মহিলা। বারের পেছনে গিয়ে হাতে নিলেন বড় একটা মগ। আপনাকে কী দেব, মিস্টার রানা? আজকে আপনার জন্যে বিনে পয়সায় সার্ভ করা হবে।

    মিথ্যা ও ভদ্রতা বহুদূর নেয় মানুষকে, ভাবল রানা। ‘অনেক ধন্যবাদ। আমি নেব গিনেস বিয়ার।

    একটু পর বিয়ারে ভরা মগ ওর হাতে দিলেন ভদ্রমহিলা। কিছু বলতেন, কিন্তু তখনই বেল বাজল রিসেপশন এরিয়া থেকে। ব্যবসার কাজে হন্তদন্ত হয়ে ওদিকে ছুটলেন তিনি। একা হয়ে বারের স্টুলে বসে ঠাণ্ডা বিয়ারে চুমুক দিল রানা। নিজেকে বলল: এ-বাড়ি আগের মত নেই, সেটা জেনেও কাঁচা জখমে লবণ ঢালতে এলাম কেন?

    ফিরে এসে ওর চটকা ভাঙালেন মিসেস অ্যাপলউড। বললেন, ‘আরেকটা বিয়ার দিই?’

    ‘আপত্তি নেই,’ দীর্ঘশ্বাস চাপল রানা।

    ‘ওই যে সুন্দরী? জানালার দিকে চেয়ে নিচু স্বরে বললেন মহিলা। ‘উনি কিন্তু খুব নামকরা এক লেখিকা! ‘

    ‘তা-ই?’ ভদ্রতা রক্ষা করতে গিয়ে ঘুরে দেখল রানা। ছোট ল্যাপটপে টাইপ করছে মেয়েটা। অবশ্য তখনই নোটবুকের লেখা কম্পোজ শেষ হলো তার। চামড়ার ছোট্ট পাউচে ভরল নোটবুক। পায়ের কাছ থেকে কাপড়ের ব্যাগ তুলে ওটার ভেতরে রাখল পাউচ। কাজ শেষ করে আবারও টাইপ করতে লাগল ল্যাপটপে।

    ‘কী না জানি গ্যালওয়ে নিয়ে লিখছেন!’ বললেন মিসেস অ্যাপলউড। চকচক করছে দু’চোখ। হয়তো লিখবেন এই রেস্ট-হাউসের কথাও। আর তা হলে তো এটা হবে আকর্ষণীয় এক টুরিস্ট স্পট!’

    ‘আপনি ভাবছেন উনি লিখছেন গ্যালওয়ে রেস্ট-হাউসের খুন টাইপের কোন বই?’ জানতে চাইল রানা।

    ‘কে জানে!’ ওর কোমরে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে ফিক করে হাসলেন মিসেস অ্যাপলউড। আবার বাজল বেল। অর্ডার নিতে খদ্দেরের দিকে ছুটলেন তিনি।

    ছয়

    আধঘণ্টা পর মিসেস অ্যাপলউডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার সৈকতে ফিরল রানা। কৈশোরে গুগলিতে ভরা যে মস্ত চ্যাপটা পাথরে বসে সাগর দেখত, আজও ওটার ওপরে বসল। মিসেস অ্যাপলউড খাতির করে ওকে গিলিয়ে দিয়েছেন একে একে তিন পাইন্ট বিয়ার। নেশার ঘোরে এখন কমে গেছে ওর মানসিক যন্ত্রণা। ভাবতে শুরু করেছে: ওর এবার উচিত নিজের দিকে ফিরে চাওয়া। নিজেকে এভাবে শেষ করে দেয়া যৌক্তিক কারও কাজ নয়!

    ঢেউয়ের দিকে চেয়ে শপথ নিল রানা: আগামীকাল ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টি থাকুক বা রোদ, দৌড়ে আসবে পুরো সাত মাইল সৈকত। দেবে এক শ’ বুকডন ও এক শ’ সিটআপ।

    অবশ্য আজকের দিনটা ছুটি ধরে নিয়ে সময়টা পার করে দিলে বড় কোন ক্ষতি নেই। চামড়ার জ্যাকেটের পকেট থেকে নিল প্রিয় বন্ধু সলীল সেনের পাঠিয়ে দেয়া বাংলাদেশে তৈরি অ্যালকেমিস্ট সিরিজের বেনসন সিগারেটের প্যাকেট। ওটা থেকে নিয়ে জ্বেলে নিল ষোলোতম শলা। ধোঁয়ায় ফুসফুস ভরে নিয়ে চেয়ে রইল ধূসর সাগরের বুকে। পশ্চিমে অ্যালান দ্বীপকুঞ্জ পেছনে ফেলে চারপাশ ছেয়ে দিচ্ছে নন কালো মেঘের চাদর। একটু পর গ্যালওয়ে উপকূলে নামবে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি।

    নুড়িভরা সৈকতে পদশব্দ শুনে ঘুরে তাকাল রানা। ওর দেরি হলো না বালিরঙা চুলের মেয়েটাকে চিনতে। এ হচ্ছে সেই লেখিকা। পরনে টি-শার্টের ওপরে ফ্লিস দেয়া হালকা এক জ্যাকেট। কাঁধে ঝুলছে কাপড়ের ব্যাগ।

    কাছে এসে রানার দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসল মেয়েটা। নরম সুরে বলল, ‘হ্যালো! ম্লান সূর্যের রোদ এড়াতে কপালে তুলেছে হাত। সাগরের ঝিরঝিরে হাওয়া দুলিয়ে দিচ্ছে তার খাটো চুল।

    জবাবে ভদ্রতা করে হাসল রানা। সৈকতে একা থাকতেই ভাল লাগছিল ওর। ভাবেনি অন্য কেউ এখানে হাজির হবে।

    ‘আমি আবার বিরক্ত করছি না তো আপনাকে?’ বলল মেয়েটা।

    ‘না-না, তা নয়,’ জানাল রানা।

    চ্যাপটা পাথরের ওপর থেকে বালি সরিয়ে ওখানে বসল মেয়েটা। ‘জায়গাটা খুব সুন্দর, তা-ই না?’

    মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘ঠিকই বলেছেন।’

    ‘আমার নাম বেলা ওয়েস,’ বলল মেয়েটা। কথার সুরে রানা বুঝে গেল সে ইংরেজ।

    ‘আমি মাসুদ রানা, হাত বাড়িয়ে দিল রানা। মেয়েটার হাত নরম, তবে শক্ত করেই ধরেছে ওর হাত।

    ‘জানি, আপনার নাম মাসুদ রানা,’ বলল বেলা ওয়েস।

    ‘তা-ই?’ মেয়েটার চোখে তাকাল রানা।

    ‘মিসেস অ্যাপলউড বলেছেন আপনি আগে এই সম্পত্তির মালিক ছিলেন।’

    কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘পরে বিক্রি করে দিয়েছি।’

    ‘জায়গাটা সুন্দর। বাড়ি আর সৈকত বিক্রি করে নিশ্চয়ই এখন আপনার খুব আফসোস হয়?’

    জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাল রানা, ‘শুনেছি আপনি নাকি একজন লেখিকা?’

    মুচকি হাসল বেলা ওয়েস। ‘মিসেস অ্যাপলউড সুযোগ পেলেই পেটের সব কথা উগরে দেন।

    ‘মনে পাপ নেই বলেই হয়তো। তিনি বললেন, আপনি হয়তো আপনার উপন্যাসে লিখবেন তাঁদের গেস্ট-হাউসের কথা।’

    ‘তা হলে হতাশ হতে হবে তাঁকে। আমি আসলে বইয়ের লেখিকা নই।

    ‘তা-ই?’ আবারও সাগরের দিকে তাকাল রানা।

    ‘আমি আসলে একজন সাংবাদিকা।’

    কোন মন্তব্য না করে চুপ করে থাকল রানা।

    ‘সরি,’ বলল বেলা ওয়েস, ‘বুঝতে পেরেছি আমি আসলে আপনাকে বিরক্ত করছি। আমি বরং আসি।’

    অবহেলা করে বসেছে রানা। মেয়েটার দিকে তাকাল রানা। ‘আপনি মোটেই আমাকে এরক্ত করছেন না।’

    ‘না, এটা বুঝেছি যে আপনি একা থাকতে চান। আপনাকে বিরক্ত করেছি বলে দুঃখিত।

    ‘আমারই বরং দুঃখ প্রকাশ করা উচিত,’ বলল রানা। ‘আপনার সঙ্গে ভাল আচরণ করিনি।’ একটু থেমে বলল, ‘একটু পর বৃষ্টি নামবে। সৈকতের বহু দূরে আমার কটেজ। তাই আগেভাগে পৌঁছে যেতে চাই। আপনার কোন আপত্তি না থাকলে ঘুরে আসতে পারেন আমার ওখান থেকে।’

    দ্বিধা নিয়ে হাতঘড়ি দেখল বেলা। ‘একটা কাজ আছে। তবে তার আগে খানিকটা সময় পাব। এদিকটা তো আপনার চেনা। ঠিক আছে, তো চলুন, ঘুরে আসি সৈকতের ওদিকটা থেকে।’

    পাথর থেকে নেমে রওনা হলো ওরা। রানা বলল, ‘ওদিকে দেখার মত নতুন তেমন কিছু নেই।’ সৈকতের উত্তরদিকে আঙুল তাক করল ও। ‘ওদিকে যে মস্ত পাথর দেখছেন, ওটা ঘুরে রাস্তা গেছে শহরের দিকে। সে-পর্যন্ত সৈকত আর গেস্ট-হাউসের জমি। তার ওদিকে আছে আমার ভাড়া করা কটেজ। উপকূলীয় সরু এক রাস্তার এদিকে।’

    ‘আপনাকে গাইড হিসেবে পেয়ে খুশি হলাম।’

    ‘কথাটা বলেছেন, সেজন্যে ধন্যবাদ।’

    গেস্ট হাউস পেছনে ফেলে সৈকত ধরে হেঁটে চলল রানা ও. বেলা। মেয়েটা জানতে চাইল, ‘আমি কি ধরে নেব আপনার পরিবার নিয়ে কটেজে উঠেছেন?’

    ‘তা নয়। আমি একা মানুষ। সঙ্গে আর কেউ নেই।’

    ‘ব্যবসার জন্যে এসেছেন, না আনন্দের জন্যে?’

    ‘কোনটাই নয়।’

    ওদের ওপর দিয়ে ভেসে গেল কালো এক ছায়া। মুখ তুলে তাকাল ওরা। চওড়া ডানা মেলে সাগরে ভেসে গেল বড় এক গাল পাখি

    ‘আমি কখনও এত বড় পাখি দেখিনি,’ বলল বেলা।

    ‘এদিকে প্রচুর আছে,’ জানাল রানা। ‘পিঠ-কালো বড় গাল ওটা। যদি ওটাকে বড় বলে মনে করেন, তো অ্যালব্যাট্রেস দেখলে সত্যিই চমকে যাবেন। মাঝে মাঝে এদিকে উড়ে আসে।’

    সাগরের তাজা হাওয়া বুক ভরে নিল বেলা। ‘চারপাশ কী প্রশান্তিময়! বুঝলাম, কেন আবারও এখানে ফিরে এসেছেন। কিছু মনে করবেন না, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে: এখান থেকে চলে গিয়েছিলেন কেন?’

    ‘গত চার বছরেরও বেশি ছিলাম ফ্রান্সের নরম্যাণ্ডিতে।’

    ‘আপনি বাস করেন চমৎকার সব জায়গায়,’ হাসল বেলা। ‘আমি নিজে থাকি নিউবারিতে। ওখানে দেখার মত কিছুই নেই। বলুন তো, নিজের বাড়ি বলে এখন কোন্ জায়গাটাকে মনে করেন আপনি?’

    ‘আমার আসলে কোন বাড়ি নেই। ঘুরে বেড়াচ্ছি এখান থেকে ওখানে।’

    ‘এরপর কোথায় যাবেন বলে ভাবছেন?’

    ‘কোন পরিকল্পনা করিনি। আগে বা পরে যাব কোথাও।’

    হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল বেলা ওয়েস। ব্যাগের ভেতরে হাত ভরে বের করল ছোট ল্যাপটপ। স্ক্রিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘এক্সকিউয মি। আমার একটা মেসেজ আসার কথা।’

    ‘আপনি সবসময় ল্যাপটপ সঙ্গে রাখেন?’ বলল রানা।

    ‘যখন-তখন কাজে লাগে যে!’ কমপিউটার ব্যাগে রেখে চামড়ার সরু পাউচ বের করল বেলা ওয়েস। ওটার সামনের পকেট থেকে নিল দুটো মোবাইল ফোন। নীল মোবাইলের স্ক্রিন। অন করে দেখল। আনমনে মাথা নাড়ল। হতাশার সুরে বলল, ‘দূর!’ আবারও ফোন রাখল পাউচে। পাউচ চলে গেল ওর ব্যাগের ভেতরে।

    ‘খুব জরুরি কোন মেসেজ?’ বলল রানা।

    ‘রিসার্চের তথ্য পাওয়ার কথা,’ যেন এড়িয়ে যাওয়ার সুরে বলল বেলা। চেহারায় দ্বিধা। একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ভেবেছিলাম কেউ না কেউ ফোন করবে। যাক গে!’

    ‘রিসার্চের জন্যেই গ্যালওয়েতে এসেছেন?

    মাথা দোলাল বেলা। ‘আমাকে তুমি করে বলতে পারেন, রানা। অনুমতি পেলে আমিও তুমি করেই বলব।’

    ‘বেশ, বেলা।’

    ‘গত দশদিন এদিকে ঘুরেছি। কিলার্নি, লিমেরিক, অ্যাথলন… বহু জায়গা।’

    ‘তাতে কোন লাভ হয়েছে?’

    ‘তা হয়েছে। ভাবতেও পারিনি এমন সব তথ্য পেয়েছি।’

    ‘আমি অতিরিক্ত কৌতূহলী হতে চাই না,’ বলল রানা। হাসল বেলা ওয়েস। ‘গোপন রিসার্চ। আমি নিজেও এখন কিছু জানাব না। দয়া করে কিছু মনে কোরো না।’

    কিছু বলল না রানা। সাগর থেকে হু-হু করে আসছে শীতল হাওয়া। ক্রমে বাড়ছে তার বেগ। মুখ তুলে আকাশ দেখল রানা। খুব কাছে চলে এসেছে পাহাড়ের মত উঁচু কালো মেঘ। ‘আমাদের বোধহয় দৌড়ে গিয়ে কটেজে ঢুকতে হবে। যা ভেবেছি, তার অনেক আগেই বৃষ্টি চলে এসেছে।’

    ‘বাধ্য না হলে ল্যাপটপ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে চাই না।’

    ‘তোমার বইটি কী বিষয়ে, সেটাও বলা যাবে না?’

    ‘তা নয়, বইটি হবে ঐতিহাসিক বায়োগ্রাফি।’

    ‘চিনি এমন কারও ওপরে লেখা?’

    ‘তাঁর নাম লেডি জেনিফার হলওয়ে। উনিশ শতকে ডায়েরি আর বই লিখতেন। কবিও ছিলেন। তখনকার প্রথম সারির নারীবাদী। অবাক হইনি যে তাঁর নাম শোনোনি।

    ‘সত্যিই শুনিনি,’ বলল রানা। ‘তবে তোমার রিসার্চের কথা শুনে মনে পড়ল, জেনিফার হলওয়ে বোধহয় ছিলেন এবারডেন এস্টেটের মালিক লর্ড স্টার্লিংফোর্ডের স্ত্রী। একসময়ে ব্যালিনাস্লোর ক’মাইল দূরে মস্ত জমিদারি ছিল তাঁর স্বামীর।’

    ‘দশে দশ পেয়েছ। বুঝলাম স্থানীয় বহু কিছুই জানো!’

    ‘লর্ড স্টার্লিংফোর্ডের ব্যাপারে এদিকে কিংবদন্তী আছে। গ্রামের সরাইখানা বা পানশালায় গেলে শুনবে নিষ্ঠুর সেই ইংরেজ জমিদারের গল্প। নিরীহ মানুষের ওপরে অত্যাচার করতে করতে একসময় পাগল হয়ে যায় সে। নিজের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে। অবশ্য আর কিছু জানি না। তো তুমি লিখতে চাও লেডি স্টার্লিংফোর্ডের জীবনী?

    ‘তা বলতে পারো,’ কাঁধ ঝাঁকাল বেলা ওয়েস।

    ‘বই নিয়ে তোমাকে অনুৎসাহিত মনে হচ্ছে,’ বলল রানা।

    ওকে দেখল বেলা। ‘তাই বুঝি মনে হচ্ছে? অবশ্য এর কারণও আছে। জানি না বইটা আর লিখতে পারব কি না। গত কয়েক দিনে এমন কিছু জেনেছি, যে কারণে দ্বিধান্বিত হয়ে গেছি…’ মিইয়ে গেল বেলার কণ্ঠস্বর। চট করে দেখল আকাশ। ওদের মাথার ওপরে চলে এসেছে কালো মেঘের সারি।

    এবার যে-কোন সময়ে নামবে বৃষ্টি,’ বলল রানা। ওর কথা শেষ হতে না হতেই ভারী ফোঁটা নিয়ে ঝরঝর করে নামল আস্ত আকাশ। সাগর থেকে এল শোঁ-শোঁ হাওয়া।

    কোমরে ফ্লিসের জ্যাকেট শক্ত করে জড়িয়ে নিল বেলা। বৃষ্টির শব্দের ওপর দিয়ে বলল, ‘হায়, যিশু! আমরা তো ভিজে যাচ্ছি!’

    বহু পেছনে চ্যাপটা পাথরটা দেখল রানা। তারপর বলল, ‘বেলা, গেস্ট-হাউসের চেয়ে আমার কটেজ অনেক কাছে। কী করবে ভাবছ? চাইলে বৃষ্টির সময়টা আমার ওখানে বসতে পারো।’

    ওর দিকে তাকাল বেলা। ‘তো জলদি চলো!’

    সাত

    ছুটে চলেছে রানা ও বেলা। ঝোড়ো হাওয়ায় ভর করে টাস- টাস শব্দে নামছে বৃষ্টির ভারী ফোঁটা। নুড়িভরা সৈকত ও বড় এক পাথরখণ্ডের মাঝের পথ ধরে কটেজের কাছে পৌঁছে গেল ওরা। ছোট্ট বাগান পেরিয়ে থামল সদর দরজায়। তালা খুলে বেলাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল রানা।

    ভিজে গিয়ে শীতে থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা। গা বেয়ে টপটপ করে মেঝেতে পড়ছে পানি। একবার শিউরে উঠে বলল, ‘আমাকে বোধহয় ডুবন্ত ইঁদুরের মত বিশ্রী দেখাচ্ছে?’

    ‘না, তা নয়, ভেজা বেড়ালের মত,’ হাসল রানা।

    ফ্লিসের ভেজা জ্যাকেট খুলল বেলা। ঠাণ্ডায় বেগুনি হয়ে গেছে ওর ফর্সা দুই বাহু।

    ওর দিকে চেয়ার বাড়িয়ে দিল রানা। বেলার হাত থেকে ফ্লিসের জ্যাকেট নিয়ে ঝুলিয়ে রাখল চেয়ারের পিঠে। বলল, ‘আগুন জ্বেলে নিলে চট করে শুকিয়ে যাবে জ্যাকেট।’ কটেজ ভাড়া করার পর চ্যালাকাঠ কেটে রেখেছে ও। ওখান থেকে কয়েকটা নিয়ে গুঁজে দিল ফায়ারপ্লেসে।

    খবরের কাগজ মুড়িয়ে আগুন ধরাবে, এমন সময় দেখল ব্যাগে উঁকি দিচ্ছে বেলা। কয়েক সেকেণ্ড পর স্বস্তির সঙ্গে বলল মেয়েটা, ‘ভাগ্যিস কিছু ভিজে যায়নি!’ চেয়ারের কাঁধে ঝুলিয়ে দিল হাতের ব্যাগ।

    কাঠের সরু সিঁড়ি উঠেছে দোতলায়। ওটা দেখাল রানা। ‘ওপরে ওয়ার্ডোবে তোয়ালে পাবে। বাথরুমে হেয়ার ড্রায়ার।’ সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠল বেলা। এদিকে ফায়ারপ্লেসের দিকে ঝুঁকে লাইটার দিয়ে খবরের কাগজে আগুন দিল রানা।

    মিনিট দশেক পর নেমে এল বেলা। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিয়েছে মাথার চুল। রানার জ্বেলে নেয়া আগুনে উষ্ণ হয়ে উঠেছে কটেজ। খুশি হয়ে বলল বেলা, ‘ছোট হলেও কটেজটা সুন্দর। সত্যিই রুচি আছে তোমার।

    ‘এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় এটা ছিল পরিত্যক্ত, জেলে কুটির। চারদেয়াল ও অর্ধেক ছাত ছাড়া কিছুই ছিল না। বৃষ্টি এলে এখানে ঠাঁই নিতাম। অবশ্য গত কয়েক বছরে সবই বদলে গেছে। জানালার পাশে ওক কাঠের ড্রেসারের সামনে থামল রানা। ওটার ওপর থেকে নিল আধখালি উইস্কির বোতল। ঘুরে তাকাল বেলার দিকে। ‘ড্রিঙ্ক নেবে? এটা ছাড়া আপাতত কটেজে অন্য কোন পানীয় নেই।’

    ‘জনি ওয়াকারের ব্ল্যাক লেবেল, বারো বছর ম্যাচিউর করা,’ হাসল বেলা। ওর চোখ পড়ল ড্রেসারের পাশে খালি কিছু বোতলের ওপর। চট্ করে বলল, ‘তুমি বোধহয়। সত্যিকারের সমঝদার!’

    ‘বদ্ধ মাতাল বলে ধরে নাওনি সেজন্যে ধন্যবাদ,’ তিক্ত হাসল রানা। দুটো ক্রিস্টালের গ্লাসে ঢেলে নিল দু’আউন্স করে উইস্কি।

    ‘আমার বোধহয় নেয়া উচিত হবে না,’ বলল বেলা। ‘উইস্কি এলোমেলো করে দেয় মাথা। অবশ্য এ-ও ঠিক, সামান্য নিলে ক্ষতি কোথায়!’

    ‘উইস্কি উষ্ণ করে মানুষের ঠাণ্ডা হৃদয়,’ বলল রানা।

    ‘ওটা যে মানুষের কোথায় থাকে, আজও বুঝতে পারিনি, ‘ রানার হাত থেকে উইস্কির গ্লাস নিল বেলা। পরেরবার কার্ডিওলজিস্টের সঙ্গে দেখা হলে জেনে নেব। … চিয়ার্স!’

    ‘চিয়ার্স!’ গ্লাসে গ্লাসে টোকা দিল ওরা।

    ফায়ারপ্লেসের দু’পাশের দুই চেয়ারে মুখোমুখি বসল। লালচে আগুনের আভায় রক্তিম দেখাচ্ছে ওদের মুখ।

    গ্লাসে চুমুক দিয়ে আরেকটু হলে মুখ থেকে উইস্কি ফেলে দিত বেলা। বিড়বিড় করে বলল, ‘হায়, যিশু! গলা তো পুড়ে ‘গেছে!’

    ‘খুব বেশি কড়া?’ বলল রানা।

    ‘তুমি তো অভ্যস্ত, তাই বুঝবে না,’ আরেক চুমুক উইস্কি গলায় ঢালল বেলা। ‘মনে হচ্ছে গরম হয়ে গেছে শরীর!’

    বহুদিনের একাকী রানার ভাল লাগছে বেলার সঙ্গ। সৈকতে মেয়েটাকে অভদ্রের মত বিদায় করে দেয়নি বলে নিজের ওপরে খুশি হয়ে উঠল ও।

    ‘তো আসলে কী কাজ করো তুমি, রানা?’

    ‘বলতে পারো আমি আপাতত বেকার।’

    ‘রহস্যময় যুবক! একাকী! কাছে টানলেও কারও সঙ্গে কোন সম্পর্কে জড়ায় না! নেই তার ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনা! আর এখন শুনছি আয়-রোজগার করার মত কোন পেশাও নেই! তো ব্যাপারটা কেমন হলো, রানা?’

    প্রশ্ন এড়াতে গিয়ে বলল রানা, ‘কী ধরনের কাজ করব, আসলে সেটা নিয়েই ভাবতে শুরু করেছি।’

    ‘আগে কী করতে? নাকি বেশি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসেছি?’

    রহস্যমানব হয়ে কাজ নেই, ভাবল রানা। মেয়েটা হয়তো এরপর ভেবে নেবে পড়ে গেছে ভয়ঙ্কর এক সিরিয়াল কিলারের খপ্পরে! আত্মরক্ষা করার জন্যে নিজের সম্পর্কে বলল রানা: ‘আগে ছিলাম মিলিটারিতে। পরে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করেছি।’

    ‘তোমাকে দেখে তো ব্যবসায়ী বলে মনে হয় না,’ হাসল বেলা।

    ‘পেশা ছিল অস্বাভাবিক।’ গ্লাস খালি হতেই উঠে বোতল থেকে নতুন করে সোনালি তরল ঢেলে নিল রানা।

    ড্রিঙ্কে চুমুক দিয়ে বেলা বলল, ‘তুমি তো জানো, আমি কৌতূহলী সাংবাদিক।’ ডানহাতের তর্জনী তাক করল রানার বুকে। ‘মনে রেখো, চাইলে নিরেট পাথরের পেট থেকেও সবই বের করতে পারি।’

    ‘তা-ই?’

    ‘সেজন্যে আমি রীতিমত বিখ্যাত!’

    ‘তবে তো আর মুখ না খুলে উপায় নেই! ঠিক আছে, আগেভাগে বলি: আমি আসলে মানুষকে সহায়তা করি।’

    ‘সহায়তা করো, তার মানে কী?’

    ‘কেউ বিপদে পড়লে তার হয়ে গোয়েন্দাগিরি করি। কখনও খুঁজে বের করি কিডন্যাপ হওয়া মানুষকে।’

    ‘তাই?’ ঢক করে উইস্কি গলায় ঢালল বেলা। অন্তর্ভেদী চোখে দেখল রানাকে। ফায়ার প্লেসে টাস্ করে ফাটল একটা কাঠের টুকরো। চারদিকে ছাল কমলা ফুলকি। ‘তা হলে তো তোমাকে অনেক ধরনের ঝুঁকি নিতে হয়!’

    ‘কখনও কখনও।’

    ‘অবশ্য কিছু পুরুষ আছে, যারা ঝুঁকি না নিয়ে বাঁচতে পারে না।’

    ক্রমে চড়ছে রানার নেশা। নরম সুরে বলল, ‘জেসিকাও একই কথা বলত।

    ‘জেসিকা কি তোমার প্রেমিকা?’

    ‘আগে তা-ই ছিল। কয়েক মাস আগে ভেঙে গেছে বিয়ে।’

    ‘তা-ই? সরি! তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।’

    ‘হয়তো ভালর জন্যেই এমনটা হয়েছে। পরে আফসোস না করে আগেই সরে যাওয়া আসলে ঢের ভাল।’

    ‘আমি জানি মন ভেঙে গেলে কেমন লাগে।’

    ‘তবে কি তোমারও মন ভেঙে গেছে?

    মাথা দোলাল বেলা। ‘তিনবছর একসঙ্গে থাকার পর ভেবেছি বিয়ে করব। কিন্তু তখন ম্যালোরি…’ চুপ হয়ে গেল মেয়েটা।

    ‘সবসময় সব হিসাব মেলে না,’ বলল প্রায় মাতাল রানা। ‘যতই তুমি চাও।’

    ‘তুমি কি মেয়েটাকে এখনও ভালবাস?’

    ‘সত্যি বলতে, আসলে বুঝি না,’ বলল রানা। ‘মেয়েটা কী ধরনের ছিল?’

    কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল রানা, ‘রাগী হলেও কেউ বিপদে পড়লে বাড়িয়ে দিত সাহায্যের হাত। বলত: কখনও সংসারের জালে জড়াবে না। আমিও তা-ই ভাবতাম। কিন্তু পরে নিজেই বিয়ে করতে চাইল। তারিখও স্থির হলো। যেদিন ওর গ্রামে যাব, সে-ভোরে এল ই-মেইল। জানাল: একজনকে ভালবাসে। সেদিনই চার্চে ছিল ওদের বিয়ে।’

    ‘বলো কী!’ উইস্কি গিলতে গিয়ে বিষম খেল বেলা। সামলে নিয়ে বলল, ‘এ আবার কেমন মেয়ে! আমার তো মনে হচ্ছে, তুমি পড়ে গিয়েছিলে আস্ত ডাইনীর খপ্পরে!’

    ‘তুমি নিজে কেমন ধরনের পুরুষকে বিয়ে করতে চাও?’

    ‘সে এমন কেউ, যে আমার ভেতরে ভাল কিছু দেখবে। আর দ্বিধা না করে বলবে সেটা। অন্য কোন মেয়ের জন্যে পাগল হয়ে উঠবে না। তবে, রানা, আসলে জানো, দুনিয়া থেকে বহু আগে বিদায় নিয়েছে সত্যিকারের ভালবাসা। আমি আশপাশে একজনও দেখি না, যে স্বার্থ ছাড়া এক পা এগোয়।’

    হাসল রানা। ‘আমিও আছি তোমার তৈরি কাতারে।

    মাথা নাড়ল বেলা। ‘তোমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তুমি আসলে অন্য ধরনের মানুষ। রানার দিকে গ্লাস বাড়িয়ে দিল, মেয়েটা। ‘দাও দেখি আরেক ঢোক আগুনে পানি।’

    ভাবতে গিয়ে বিস্মিত হলো রানা, কত অনায়াসেই না গড় গড় করে বলে দিয়েছে জেসিকার উপেক্ষণ। আর সেটা করেছে চরম নিঃসঙ্গতা থেকে! বেলার হাতে উইস্কি ভরা গ্লাস দিতে গিয়ে ওর মনে পড়ল, সারা দিন কিছু খায়নি ও। সকালেও নাস্তার বদলে গিলেছে উই স্কি। তারপর মিসেস অ্যাপলউড দিলেন পুরো তিন পাইন্ট বিয়ার। এখন ঘোলা লাগছে ওর মগজ। রানা টের পেল, অনুচিত হবে আর ড্রিঙ্ক করা। তবুও উইস্কিতে ভরে নিল গ্লাস। জানতে চাইল, ‘এমন কী ঘটল যে বইটা আর লিখবে না?’

    কাঁধ ঝাঁকাল বেলা। ‘ভেবেছিলাম বইটা জমবে। কারণ, আগে লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ওপরে বায়োগ্রাফি লেখেনি কেউ। রিসার্চের জন্যে সাতমাস এদিকে ঘুরেছি। এ-কাজে ক’বার ফিরে গেছি ইংল্যাণ্ডে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কাজ শেষ করতে পারব না। তাই আগামীকাল ফিরছি নিজের দেশে।’

    মেয়েটা আকর্ষণীয়া, আন্তরিক ও সহৃদয়। আগামীকাল সে চলে যাবে শুনলে হতাশ হবে পরিচিত যে-কেউ। অবশ্য কারও সঙ্গেই জড়িয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছে রানার নেই। নরম সুরে বলল ও, ‘দীর্ঘ সাতমাস গবেষণা করার পর ভাবছ হাত গুটিয়ে নেবে? বলবে, আসলে কী কারণে হারিয়ে গেল উৎসাহ?’

    ‘উৎসাহ হারিয়ে যায়নি। লেডি স্টার্লিংফোর্ডের জীবনের কাহিনী সত্যিই চমকে দেয়ার মত।’

    ‘আমাকে কি শোনাবে তাঁর অতীত?’

    ‘সত্যিই জানতে চাও?’

    ‘তোমার বলতে আপত্তি না থাকলে শুনব।’

    শ্রাগ করল বেলা। ‘বাথ-এ আঠারো শ’ পঁচিশ সালে জন্ম নেন জেনিফার হলওয়ে। __ ষোলো বছর বয়সে প্রথম দর্শনে তাঁকে পছন্দ করে হবু বর লর্ড অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড। বয়সে তিন বছরের বড় সে। কিন্তু ততদিনে বিখ্যাত হয়ে গেছে উদ্ভিদ-বিজ্ঞানী ও কেমিস্ট হিসেবে। কমবয়সে হাতে এসেছে পরিবারের বিপুল সম্পদ। যেমন ধনী, সাহসী, তৈমনি সুদর্শন এক যুবক। মাত্র ক’দিনে জয় করল সে জেনিফারকে। বলা চলে প্রায় উড়িয়ে আনল এ-দেশে। কিন্তু সুখ হলো না তাদের দাম্পত্য জীবনে। জেনিফার বুঝলেন, চারপাশের মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতে অভ্যস্ত লর্ড স্টার্লিংফোর্ড। কাউকে মানুষ বলেই মনে করে না সে।’

    ‘আমিও সেটাই শুনেছি।’

    ‘এ-কথাই বলে মানুষ নরপশু ছিল লোকটা। জমিদারীর হর্তাকর্তা হিসেবে তার উচিত ছিল আইনের শাসন বজায় রাখা। ছিল একলাখ একরেরও বেশি জমি। উনিশ শতকে নিজের এলাকায় গরীব কৃষকের কাছে সে ছিল সত্যিকারের ঈশ্বর। কিন্তু তার শাসনামলে চলল চরম নির্যাতন। এরপর আঠারো শ’ সাতচল্লিশে মহাদুর্ভিক্ষে দেশটা হলো খিদেভরা ভয়ঙ্কর এক নরক। মর্মান্তিক সে-দুর্যোগে মানুষের করুণ পরিণতি জানলে শিউরে উঠবে যে-কেউ।’

    ইতিহাসবিদ না হয়েও বইয়ে এসব পড়েছে রানা। সাধারণ মানুষের জন্যে আয়ারল্যাণ্ড তখন ছিল হাবিয়া দোজখ। আজও মায়েরা তাদের বাচ্চাদেরকে বলে: কীভাবে খেতে না পেয়ে মরেছে এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ।

    ‘কিছুদিনের ভেতরে মরল দশ লাখ মানুষ,’ বলল রানা। ‘আয়ারল্যাণ্ডের প্রধান খাবার আলু। সে-ফসল নষ্ট হওয়ায় মানুষের বেঁচে থাকার আর কোন অবলম্বন ছিল না।’

    ‘নামকরা ইতিহাসবিদেরা বলেন: দুর্ভিক্ষে মারা গেছে বিশ লাখ মানুষ,’ শুধরে দিল বেলা। ‘এ-দেশে তখন আশি লাখ মানুষ। দু’হাজার তিন সালে ডারফুরের দুর্ভিক্ষে মারা গেছে একলাখ মানুষ। ওই এলাকার জনসংখ্যা দু’কোটি সত্তর লাখ। এ-থেকে বুঝবে, কী মারাত্মক ছিল আয়ারল্যাণ্ডের আকাল। মাছির মত মরেছে মানুষ। গভীর গর্ত খুঁড়ে লাশের ওপরে ঢেলে দিয়েছে নতুন লাশ। এমনও হয়েছে, অতিদুর্বল অনেকে বেঁচে আছে, কিন্তু শরীরে শক্তি নেই যে কবর থেকে প্রতিবাদ করবে। চারপাশে চরম খিদে নিয়ে অসংখ্য মানুষ। একবার এক বর্গাচাষী বাগান থেকে বাচ্চার জন্যে একটা আপেল সংগ্রহ করেছিল বলে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারে লর্ড অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড।’

    ‘ভাল লোককেই বিয়ে করেছিলেন লেডি হলওয়ে।’

    সেজন্যে সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে প্রচণ্ড মানসিক কষ্ট। তখন অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে রেহাই পেত না স্ত্রীরা। প্রতিটা সিদ্ধান্ত নিত পুরুষেরা। আইনগতভাবে যখন খুশি স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে পারত। যা খুশি করার অধিকার ছিল তাদের হাতে। আমার ধারণা: এ-সুযোগ হাতছাড়া করেনি লর্ড স্টার্লিংফোর্ড। অবশ্য লেডির ডায়েরিগুলো হাতে পেলে বহু কিছুই বুঝতাম।’

    ‘ডায়েরি লিখতেন লেডি স্টার্লিংফোর্ড?’

    ‘এ-দেশে এসে নিয়মিত তা-ই করেছেন। ওগুলো পেলে বহু কিছুই পরিষ্কার হতো আমার কাছে।’

    ‘ডায়েরিগুলো কি হারিয়ে গেছে?’ জানতে চাইল রানা। মাথা নাড়ল বেলা। ‘প্রায় সবই আছে এ-দেশের এক প্রফেসরের কাছে। তিনি ইতিহাস সংরক্ষণ করেন। তাঁরই ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে সেসব। আমি যোগাযোগ করেছি তার সঙ্গে, কিন্তু ডায়েরি দেখতে দেবেন কি না, জানাননি এখনও। এখন তাঁর ফোনের জন্যেই অপেক্ষা করছি।’

    ‘বুঝলাম।’

    ‘যাই হোক, পরবর্তী সময়ে লেখা লেডি জেনিফারের কিছু চিঠি পেয়েছি। তাতে আছে দুঃসহ বৈবাহিক জীবনের বর্ণনা।

    ‘স্বামী মারা গেলে আয়ারল্যাণ্ড থেকে চলে যান তিনি?’

    ‘না, ওই লোক মরেছে বেশ পরে। আট বছর নরকে বাস করে এক আত্মীয়ের সাহায্য নিয়ে ইংল্যাণ্ডে চলে যান মহিলা। আর তখন থেকেই বদলে যায় তাঁর জীবন। শুরু করেন মেয়েদের অধিকারের পক্ষে লেখালেখি। বই লেখেন কয়েকটা কবিতা ও উপন্যাসের। দরিদ্র নারী-শিক্ষার জন্যে গড়ে তোলেন একটি স্কুল।’

    ‘অর্থাৎ নাগপাশ থেকে রেহাই পেয়েছিলেন,’ বলল রানা।

    ‘তা আসলে নয়। জীবনে খুব স্বল্পস্থায়ী হয় ভাল সময়। তাঁর এক চিঠি অনুযায়ী: আঠারো শ’ একান্ন সালের গ্রীষ্মে আইনি জটিলতায় পড়েন তিনি। ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়। যা জেনেছি, তাতে মহিলা যোগাযোগ করেন লণ্ডনের নামকরা এক আইনজ্ঞের সঙ্গে। তাঁর নাম ছিল স্যর মার্টিন হাডসন। তিনি নিজেও ছিলেন খুব রহস্যময় মানব।’

    ‘বলতে থাকো, আমি শুনছি।’

    কাঁধ ঝাঁকাল বেলা। সরকারের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ ছিল তাঁর। অনেকে বলত তিনি গুপ্তচর। কেন তাঁর সঙ্গে লেডি স্টার্লিংফোর্ড যোগাযোগ করেন, তা জানা যায়নি অবশ্য সে-সময়ে ক্যাড্রিক ডাফ ঘটনায় … ‘

    ‘সরি? আমি তোমার কথা বুঝতে পারিনি।’

    দোষটা আমার। ক্যাড্রিক ডাফ ছিল একজন শিক্ষক। তাকে স্কুলে চাকরি দিয়েছিলেন লেডি স্টার্লিংফোর্ড। তখন জুলাই মাস। শিক্ষকের বয়স সাতাশ। সুদর্শন। আত্মবিশ্বাসী। দুর্দান্ত সাহসী মানুষ। এরপর জানলাম, লেডি স্টার্লিংফোর্ডের প্রেমে পড়েছে সে। যদিও লেডি তাকে প্রত্যাখ্যান করলে, ডাফ ধরে নেয় জেনিফার অন্য কাউকে ভালবাসেন। তখন প্রচণ্ড রেগে গিয়ে পিস্তল সংগ্রহ করে গুলি করে লেডির বুকে। বুঝতেই তো পারছ… খুন হন জেনিফার স্টার্লিংফোর্ড।’

    ‘অর্থাৎ, আরও রহস্যের জন্ম দিয়ে মারা গেলেন তিনি।’

    তোমাকে বলেছি, নিরেট পাথরের বুক থেকেও তথ্য বের করতে পারি। সেজন্যেই আমি একমাত্র মানুষ, যে ভাল করেই জানে: কোনভাবেই লেডি স্টার্লিংফোর্ডের প্রেমিক ছিল না সেই শিক্ষক। ডাফ ছিল সমকামী। আসলে তাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছিল। খুনি জানত, ক্যাড্রিক ভুলেও চাইবে না সমকামী হিসেবে সমাজে প্রমাণিত হতে। তার ছিল পারিবারিক সম্মান হারাবার ভয়। ফলে উপায় না দেখে মুখ বন্ধ রাখে সে।’

    ‘বুঝলাম। কিন্তু সেক্ষেত্রে কে খুন করল লেডিকে?’

    ‘তার নাম বিলি ক্র্যাকার। পেশাদার খুনি। যদিও কে তাকে কাজটা দিল, সেটা জানার আগেই তো বন্ধ করে দিতে হচ্ছে বই লেখার কাজ।

    ‘আঠারো শ’ একান্ন,’ বলল রানা। ‘একই বছরে নিজের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে স্টার্লিংফোর্ড।’

    ‘শুধু তা-ই নয়, মরে একই মাসে। দুটি মৃত্যুর মাঝে ছিল মাত্র দু’সপ্তাহ। জেনিফার খুন হন সেপ্টেম্বরের সাত তারিখে। আর তাঁর প্রাক্তন স্বামী মারা গেছে একুশ তারিখে।’

    ‘হয়তো স্ত্রীকে হারিয়ে আত্মগ্লানি থেকে আত্মহত্যা করেছে, বলল রানা।

    ওর কথায় নাক কুঁচকাল বেলা। ভাবলে কী করে যে তার মত এক নরপশু মানসিক কষ্টে মরবে!’

    ‘কী জানি!’ বলল রানা, ‘আমি তো আর লেখক নই। তবে মনে হচ্ছে, দারুণ কাহিনী পেয়েও ছেড়ে দিচ্ছ। নাটকীয়তা, খুন, অবিচার, কেলেঙ্কারি, চক্রান্ত-কী নেই প্লটে!

    অনিশ্চয়তায় ভুগছে বেলা। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘তোমাকে আগেই বলেছি, এরপর ঘটেছে আরও কিছু ঘটনা।’

    মেয়েটার মুখে দুশ্চিন্তা ও উত্তেজনার ছাপ দেখছে রানা ‘তুমি বলেছ, রিসার্চ করতে গিয়ে অস্বাভাবিক কিছু জেনেছ,’ বলল ও। তুমি কি সে বিষয়ে কিছু বলতে চাও?’

    মাথা দোলাল বেলা। ‘ক’দিন আগে অন্যকিছু জানলাম।’

    ‘সেটা কী?’

    ‘এমন কিছু, যেজন্যে বদলে গেছে সব। তাই বাধ্য হয়ে বাদ দিচ্ছি বইটি লেখার চিন্তা। আমার ভুল না হলে, এবার বাকি জীবনে বই না লিখলেও আমার ভালভাবেই চলে যাবে।’

    ‘তা হলে তো পেয়ে গেছ সোনার খনি,’ হাসল রানা।

    ‘সত্যিই তা-ই। রিসার্চের সময় স্রেফ কপালের জোরে পেয়েছি এমন এক তথ্য, যেটা পাওয়ার কথা নয়। যেন আমার জন্যেই অপেক্ষায় ছিল ওটা। আপাতত আর কিছু বলব না। তুমি আবার কিছু মনে কোরো না, রানা।’

    ‘যদিও সত্যিই আমি কৌতূহলী হয়ে উঠেছি,’ বলল রানা, ‘একটু আগে বললে গোপন কিছুই বলবে না, সেক্ষেত্রে এত কিছুই বা জানালে কেন?’

    ‘তোমার কথা শুনে,’ বলল বেলা, ‘তুমিই তো বলেছ, মানুষ বিপদে পড়লে তাদেরকে সাহায্য করো।’

    ‘বলেছি আগে এসব করতাম। তার সঙ্গে তোমার এই কাহিনীর কীসের সম্পর্ক?

    ‘তুমি কি এখনও… মানে… সত্যিই সব জানতে চাও?’

    ‘তুমি বলতে চাইলে নিশ্চয়ই শুনব,’ বলল রানা।

    ‘আসলে… এ-ব্যাপারে যা জেনেছি… তা ভয়ঙ্কর। তুমি এসব জানলে যে-কোন সময় বিপদে পড়বে।’

    ‘তা-ই?’

    ‘হ্যাঁ, এসব তথ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করলে খেপে যাবে ক্ষমতাশালী কিছু লোক। তারা আছে গুরুত্বপূর্ণ সব পদে। তাই মনে হচ্ছে এবার বোধহয় যোগ্য কারও সাহায্য লাগবে আমার।’

    ‘এই যোগ্য মানুষটা কী ধরনের হবে?’

    যেমন ধরো তুমি। হয়তো তোমার মত যোগ্য এক বডিগার্ড লাগবে আমার।’

    ‘তুমি কি ঠাট্টা করছ?’ বেলার চোখে তাকাল রানা।

    ‘মোটেই তা নয়। তুমি বলেছ, তোমার হাতে আপাতত কোন কাজ নেই। তাই ভাবছি, তুমি যদি আমার সঙ্গে…’

    ‘সত্যিই তোমার বডিগার্ড লাগবে?’

    ‘তেমনই তো মনে হচ্ছে!’

    ‘কিন্তু তুমি তো আমাকে ভাগ করে চেনোই না!’

    ‘আমি একজন মেয়ে। চোখ দেখে অনেক কিছুই বুঝি। তুমি কখনও কারও সঙ্গে বেইমানি করোনি।’

    ‘আমি পেশাদার বডিগার্ড নই,’ বলল রানা। ‘তা ছাড়া…’

    ‘এ-ও বুঝেছি, তুমি আছ খুব দ্বিধার ভেতরে,’ মাথা দোলাল বেলা। ‘আমার অনুচিত হয়েছে তোমাকে চিন্তিত করে তোলা। সত্যি লজ্জা পাচ্ছি যে, এত কথা বলেছি তোমাকে।’ বারকয়েক মাথা নাড়ল বেলা। চোখ পিটপিট করে তাকাল হাতের গ্লাসের দিকে। তারপর নিচু স্বরে বলল, ‘আমি বোধহয় বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেলেছি। মাথা বনবন করে ঘুরছে। বোতলটা দেখেছ, রানা? আমরা প্রায় খতম করে দিয়েছি ওটা!’

    ‘বেশিরভাগই গেছে আমার পেটে,’ বলল রানা। ‘শোনো, বেলা, তোমার সত্যিই সাহায্য লাগলে উপযুক্ত লোক জোগাড় করে দিতে পারব। ফোন পেলেই হাজির হবে সে।

    ‘সত্যিই কি তা-ই?’

    ‘যদিও প্রথমে সবই খুলে বলতে হবে তোমার, নইলে যাকে কাজ দেব, সে কিছু না জেনে দায়িত্ব নেবে না।’

    ‘ব্যাপারটা লেডির ডায়েরির সঙ্গে সম্পর্কিত।’

    গ্লাসের উইস্কিটুকু গলায় ঢালল রানা। ‘তিনি মারা গেছেন দেড় শ’ বছরেরও আগে। তা হলে এখন কেন তোমার বিপদ হবে? তা হলে কি তোমাকে হুমকি দিয়েছে কেউ?’

    জবাব দেয়ার আগে হাতঘড়ি দেখে চমকে গেল বেলা। বিড়বিড় করে বলল, ‘সর্বনাশ, ভাবিনি এতক্ষণ ধরে গল্প করেছি! এবার যেতে হবে গেস্ট হাউসে। দশটায় কল দেব একজনকে!’

    আজ রবিবার। রানা জানে এ-দেশে এই দিনে কোন কাজ করে না কেউ। ‘এখানে বসেই ফোন করতে পারো,’ বলল ও।

    ‘বলেছ, সেজন্যে ধন্যবাদ।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল বেলা। কখন যেন থেমে গেছে বৃষ্টি। সৈকতে সূর্যাস্তের কমলাটে রোদ। ‘আরও দেরি করলে অন্ধকারে হেঁটে ফিরতে হবে। তা-ই মনে হচ্ছে গেস্ট হাউসে চলে যাওয়াই আমার ভাল। ফোনে কথা বলতে হবে অন্তত আধঘণ্টা। অবশ্য তোমার প্রস্তাবটা আমার মনে থাকল। কথা দিচ্ছি, পরে তোমাকে সবই খুলে বলব। আমাকে তোমার ফোন নম্বর দাও। পরে কল দেব।’

    ‘আগামীকাল সকালে না হয় কথা হবে?’ বলল রানা, ‘আমরা বসতে পারি সেই চ্যাপটা পাথরের ওপরে।

    মাথা নাড়ল বেলা। ‘না, সকাল সাড়ে সাতটায় আমাকে এয়ারপোর্টে নেয়ার জন্যে ট্যাক্সি আসবে।

    ‘মানা করে দাও,’ কটেজের পেছনে আঙুল তাক করল রানা। বাইরে আছে ভাড়া নেয়া টয়োটা প্রিমিয়ো। ‘তোমাকে গাড়িতে করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেব। তখন শুনে নেব সব।’

    ওর কথায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বেলার মুখ। তাতে কোন সমস্যা হবে না তো তোমার? মানে… ঘাড়ে চেপে বসছি না তো?

    ‘মোটেই নয়। কথাগুলো জরুরি হবে বলেই মনে হচ্ছে।’

    তোমার মন মস্ত বড়, রানা,’ চেয়ার ছেড়ে হাতের গ্লাস টেবিলে রাখতে গিয়ে তাল হারাল বেলা। ফ্লিসের জ্যাকেট ও কাপড়ের ব্যাগ যে কাঠের চেয়ারে ঝুলছে, ওটার সঙ্গে হোঁচট খেল ও। কাত হয়ে মেঝেতে ঠাস্ করে পড়ল চেয়ার। বেলা পা পিছলে পড়ছে দেখে হাত বাড়িয়ে ওকে ধরে ফেলল রানা। মেয়েটার হাত থেকে মেঝেতে পড়ে ভাঙল গ্লাস। নানাদিকে ছিটিয়ে গেল ক্রিস্টালের ধারাল টুকরো।

    ‘হায়, যিশু!’ বলল বেলা। ‘সত্যি আমি দুঃখিত!’

    যে-কারও হাত ফস্কে ভাঙতে পারত,’ বলল রানা। ঝুঁকে সিধে করল চেয়ার। ‘আশা করি ক্ষতি হয়নি তোমার ল্যাপটপের।’

    মেঝেতে ছড়িয়ে গেছে মেক-আপ কিট, হেয়ারব্রাশ, পারফিউম। ঝুঁকে ওসব তুলতে লাগল বেলা। তারই ফাঁকে বলল, ‘ডাস্টপ্যান আর ব্রাশ দাও, ভাঙা কাঁচ সরিয়ে ফেলি।’

    ‘লাগবে না,’ বলল রানা। ‘সব গুছিয়ে নাও, তোমার তো গিয়ে ফোন করতে হবে।’ ওর মনে হলো না বেলা পুরো সুস্থ। হাত ধরে ওকে সোজা হতে সাহায্য করল রানা। ‘ঠিক আছ? আমি কি তোমাকে গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিয়ে আসব?

    ‘লাগবে না। লাজুক হাসল বেলা।

    ‘তা হলে সকালে দেখা হবে,’ বলল রানা, ‘গেস্ট- হাউসের সামনে থেকো। যাওয়ার পথে কথা সেরে নেব।’

    ‘সবকিছুর জন্যে তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,’ রানার বাহু স্পর্শ করল বেলা। ‘ঠিক আছে, দেখা হবে সকাল সাড়ে সাতটায়।’ জ্যাকেট পরার পর কাঁধে ব্যাগ তুলে কটেজ ছেড়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটা।

    কিছুক্ষণ বেলার গমনপথে চেয়ে রইল রানা। তারপর দরজা বন্ধ করে ফায়ারপ্লেসের পাশের ড্রেসারের ওপর থেকে বোতল নিয়ে গ্লাসে ঢেলে নিল উইস্কি। ভাবল, ‘দেখি আগামীকাল কী বলে ও!’

    আট

    সৈকত ও বোল্ডারের মাঝের সরু পথে হেঁটে চলেছে বেলা। চট্ করে দেখে নিল হাতঘড়ি। মাত্রাতিরিক্ত উইস্কি গিলে ভোঁতা হয়ে গেছে ওর মগজ। নিজেকে মনে মনে বলল, ‘স্বাভাবিক হও! সামনে জরুরি কাজ! দেরি না করে ফিরতে হবে গেস্ট-হাউসে। বিশ মিনিট পর দিতে হবে ফোন।’

    আজ যে-কথা হবে, তার ওপরে নির্ভর করছে বহু কিছু। দ্রুত না হাঁটলে মন ভরে অপূর্ব এক রঙিন সূর্যাস্ত দেখত বেলা। সৈকত প্রশান্তিময়। ঢেউয়ের আওয়াজ আর সিগালের কিচির-মিচির ছাড়া সবই যেন দারুণ কোন চিত্র। অবশ্য সৈকত সংলগ্ন পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে রুপালি এক জিপগাড়ি।

    হাঁটতে হাঁটতে ভাবল বেলা, রানা আবার ধরে নেয়নি তো যে ফোনকলটি জরুরি নয়? আসলে মস্তবড় এক সুযোগ এসেছে ওর সামনে। একবার সফল হলে জীবনেও আর ভাবতে হবে না টাকার জন্যে।

    বেলার মনে পড়ল রানার মায়াভরা চোখদুটো। আনমনে ভাবল, কাউকে ভালবাসলে সেই মানুষটা হয়তো হবে মাসুদ রানার মতই কেউ। নিজেকে বলল, ক’দিন এখানে রয়ে গেলে বুঝতে পারতাম মানুষটার মনের কথা। কিন্তু সেটা এখন সম্ভব নয়। নিউবারি না ফিরে উপায় নেই ওর। আগে জরুরি ব্যবসা, পরে আর সবকিছু।

    রানার চিন্তা মন থেকে বিদায় করতে চাইল বেলা। ভাবতে লাগল হাজার হাজার মাইল দূরের একলোকের কথা। ঠিক সময়ে তাকে ফোন না দিলে ভেস্তে যাবে সব পরিকল্পনা।

    ছত্রিশ ঘণ্টা আগে ফোন করে চমকে দিয়েছে তাকে। আর সে যখন অত টাকা দিতে রাজি হয়ে গেল, বেলা বুঝল ক’দিনের ভেতরে ডলারে উপচে পড়বে ওর বেডরুম। তখন চাইলে দুনিয়ার সবই কিনতে পারবে।

    কথা বলা এখন জরুরি, কারণ এতক্ষণে হতভম্ব ভাব কাটিয়ে সতর্ক হয়ে উঠেছে লোকটা। টাকা দেয়ার ব্যাপারে সাবধানে কথা বলবে। তা-ই বেলাকেও হতে হবে হুঁশিয়ার। হয়তো এরই মধ্যে ফোনে যোগাযোগ করতে চেয়েও নিজেকে সংবরণ করেছে লোকটা।

    গেস্ট-হাউসে ফিরে ফোন দেবে বেলা। ব্যাগের পকেটে পাউচে আছে স্মার্টফোন নোকিয়া এক্স৩০। ঝুঁকি হ্রাস করতে গিয়ে সঙ্গে রেখেছে বেলা কমদামি এক স্যামসাং মোবাইল ফোন। সরকারি আইনি সংস্থা জানবে না ওটার মালিক আসলে কে। হঠাৎ থেমে ব্যাগে যেখানে পাউচ থাকার কথা, জায়গাটা স্পর্শ করল বেলা। ঢোক গিলতে গিয়ে টের পেল শুকিয়ে গেছে ওর গলা। আরেহ্, ব্যাগে তো নেই পাউচটা!

    ‘হায়, ঈশ্বর!’ বিড়বিড় করল বেলা। ‘ওটা তা হলে কোথায় গেল? পাউচ কি তবে রয়ে গেছে রানার কটেজের মেঝেতে?

    ব্যাগে টুকটাক জিনিস তোলার দৃশ্য মনে পড়ল ওর।

    মেক-আপ, আয়না, হেয়ার ব্রাশ… পার্স…

    তখন কি ব্যাগে তুলতে ভুলে গেছে পাউচটা?

    নিজের ওপরে রেগে গেল বেলা। এজন্যেই কখনও মাতাল হতে নেই! পাউচ বোধহয় ঢুকেছে সোফার নিচে। তখন ওদিকে খেয়াল ছিল না ওর।

    চট্ করে হাতঘড়ি দেখল বেলা। দশমিনিট পর ফোন করতে হবে! এখন ছুট দিলে সময়মত পৌছুতে পারবে রানার কটেজে। যদিও ওখানে বসে আলাপ করা উচিত হবে না। অবশ্য বাথরুমে ঢুকে মিউজিক ছেড়ে কথা বলা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে রানা কিছুই শুনতে পাবে না।

    ঘুরে ফিরতি পথে চলল বেলা। চোখে পড়ল রুপালি সেই মাযদা জিপ। সৈকতের পাশের পথে এগিয়ে চলেছে ওটা। ড্রাইভার বোধহয় দেখছে সূর্যাস্তের চমৎকার দৃশ্য। হয়তো কাউকে খুঁজছে সে।

    কিন্তু বেলা ঘুরে রওনা হতেই ইউ-টার্ন নিয়ে সৈকতের ঘাসে নামল জিপ। রুপালি বডি ও কালো কাঁচে প্রতিফলিত হলো সূর্যের লালচে শেষ আলো।

    হঠাৎ করেই একরাশ সন্দেহ এল বেলার মনে।

    জিপটা কি ওর পিছু নিয়েছে?

    নিজেকে জিজ্ঞেস করল বেলা: আমি কি থমকে দাঁড়াব?

    আমি স্থানীয় নই। ড্রাইভার কিছু জানতে চাইলেও জানাতে পারব না। তা ছাড়া, তাড়া আছে আমার!

    বেলার মনে হলো, কোথায় যেন কী ঠিক নেই!

    ওর এখন উচিত রানার কটেজের দিকে ছুটে যাওয়া!

    বেলার তিরিশ গজ দূরে পৌঁছে গেছে মাযদা জিপ। একটু পর ওকে ধরে ফেলবে ড্রাইভার। ঘাসজমি পার করে নুড়িপাথরের প্রান্তরে নেমে এল জিপ। দুশ্চিন্তা আরও বাড়ল বেলার। শুকিয়ে গেছে বুক।’ মগজ থেকে উধাও হয়েছে নেশা। মনটা বারবার বলছে: কোথাও মস্ত কোন সমস্যা আছে!

    ড্রাইভার চাইছে পথ রুদ্ধ করে দিতে!

    ভয়ে ধড়ফড় করছে বেলার বুক। নিজেকে জিজ্ঞেস করল, ড্রাইভার আসলে কী চায় আমার কাছে? নির্জন এই সৈকতে কি কিডন্যাপ বা রেপ করবে সে? নাকি আরও ভয়ঙ্কর কিছু ভেবেছে লোকটা?

    ভয় লাগতেই দৌড়াতে শুরু করল বেলা। আশা করছে একটু পর পৌঁছে যাবে রানার কটেজে।

    হঠাৎ করেই বেড়ে গেল জিপের গতি। পেছনে ছিটকে দিচ্ছে নুড়িপাথর। ছোট এক বোল্ডারে হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলে পড়ে যেত বেলা। বিড়বিড় করে অভিশাপ দিল নিজেকে। আরও জোরে ছুটল কটেজের দিকে। পেছনে ব্রেক কষে থেমে গেছে জিপ। ঝটাং শব্দে খুলে গেল দুই দরজা। গাড়ি থেকে নেমে, এল দু’জন যুবক। কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল বেলা। ওর দিকে চেয়ে আছে লোকদুটো। গাড়ির দরজা বন্ধ না করে দ্রুত ছুটে এল তারা।

    বেলা বুঝে গেল, এরা এসেছে খারাপ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে। একবার একজন বিরক্ত করতে এলে তার তলপেটে লাথি মেরে পালিয়ে গিয়েছিল বেলা। কিন্তু এখন সেই সুযোগ নেই। দৌড়ে পারবে না দুই যুবকের সঙ্গে।

    একজনের মাথায় হুডি, অন্যজনের মাথায় বেসবল ক্যাপ। গম্ভীর চেহারা জানিয়ে দিচ্ছে, কোনভাবেই হাল ছাড়বে না তারা।

    মস্ত বিপদে পড়ে ছোটার গতি আরও বাড়াল বেলা। ঝুলন্ত ব্যাগের ভেতরে ল্যাপটপ ঠাস্ ঠাস্ বাড়ি মারছে উরুতে। তাতে কমে যাচ্ছে দৌড়ের গতি। কাঁধ থেকে ব্যাগ নিয়ে মাটিতে ফেলে দিল বেলা। ছুটতে ছুটতে পেছনে তাকাল। ফুঁপিয়ে উঠল আতঙ্কে। এখন তীরবেগে আসছে দুই যুবক।

    ঘাড় ফিরিয়ে আবারও পেছনে তাকাল বেলা।

    না থেমেই ব্যাগটা তুলে নিয়েছে ডানদিকের যুবক।

    এরা আমার কাছে কী চায়? দৌড়ের ফাঁকে ভাবল বেলা।

    দু’দিকে চলেছে দুই যুবক। প্রথমজন বেলাকে ধরতে না পারলে বড় বোল্ডারের ওদিকে গিয়ে ওকে ধরবে অন্যজন।

    পালাবার উপায় নেই বেলার!

    এভাবেই খরগোশ শিকার করে শিকারি কুকুরেরা!

    কটেজে যাবার আগেই ধরা পড়বে, বুঝে গেল বেলা। একবার ভাবল ছুটে নেমে পড়বে কি না সাগরে। পরক্ষণে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল, আর একটু, তারপর পৌঁছে যাব রানার কটেজে!

    .

    মেঝে থেকে ক্রিস্টালের টুকরো ডাস্টপ্যানে তুলতে গিয়ে ভাবল রানা, বেলা তো চলে গেছে, এখন বড্ড একা লাগছে। আরও একটু ড্রিঙ্ক করলে হয়তো কাটবে নিঃসঙ্গতার বোধ।

    এটা ওর জন্যে লোভনীয় চিন্তা।

    যদিও মন বলছে: ‘খবরদার! যথেষ্ট! আগামীকাল ঘুম থেকে উঠে দেরি না করে ব্যায়াম শুরু করবে!’

    মনের আরেক অংশ বলছে: ‘আরে, বোকা, আরেকটু গিললে অসুবিধে আসলে কোথায়? খাও না! মানা করেছে কে?’

    মেঝের সমস্ত ভাঙা ক্রিস্টাল তুলে কিচেনের রিসাইকেল বিনে ঢালল রানা। এরই ভেতরে গার্বেজ ক্যানে জমেছে উইস্কির খালি কয়েকটা বোতল। ঝাড় ও ডাস্টপ্যান কিচেনের কোনায় রেখে ফিরে এল রানা লিভিংরুমে। সিদ্ধান্ত নিল, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আধগ্লাস উইস্কি সত্যিই ওর কোন ক্ষতি করবে না।

    টেবিল থেকে প্রায় খালি উইস্কির বোতল হাতে নিল রানা। গ্লাসে সোনালি তরল ঢেলে ঠোঁটে ঠেকাল। আর তখনই শুনতে পেল বাইরের শব্দগুলো।

    আর্তচিৎকার করে উঠেছে এক মেয়ে!

    ঝট করে হাত থেকে বোতল ও গ্লাস ড্রেসারের ওপরে রেখে জানালার দিকে চলল রানা। হাঁটতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ওর কোমর লেগেছে টেবিলের কোণে। গুঁতো খেয়ে ঘুরে গেল প্যাডেস্টাল ল্যাম্প। জানালায় থেমে রানা দেখল, আশি গজ দূরে কটেজ লক্ষ্য করে ছুটে আসছে এক মেয়ে!

    আর সে অন্য কেউ নয়, স্বয়ং বেলা ওয়েস!

    পেছনে তেড়ে আসছে (শ্বতাঙ্গ দুই যুবক। রানার মনে হলো, তাদের বয়স ওর কাছা কাছি হবে। হালকা শরীর হলেও দৌড়ের ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে পুরোপুরি ফিট। একজনের মাথার চুল কালচে, আর্মি ছাঁট। পরনে নেভি ব্লু জ্যাকেট। অন্যজনের পরনে বাদামি হুডি। তীরবেগে আসছে তারা। নীল জ্যাকেটের হাতে এখন বেলার কাপড়ের সেই ব্যাগ।

    ঝাপসা চোখে ক’বার পলক ফেলল রানা। সিদ্ধান্ত নিতে পারল না যে ওর এখন কী করা উচিত।

    ভয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় আর্তচিৎকার ছাড়ল বেলা। রানার নাম ধরে ডাকল: ‘রানা! রানা! বাঁচাও!’

    হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠেছে রানা। ঘুরে দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। বেলা আছে এখন পঞ্চাশ গজ দূরে। ওকে প্রায় ধরে ফেলেছে লোকদু’ জন।

    সামনের গেট খুলে বড় বোল্ডারের দিকে ছুট দিল রানা। ছোট এক পাথরে হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলে পড়ে যেত। কোনমতে সামলে নিল নিজেকে। ভাবছে: ‘একদম বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি নিজের! এখন যা ঘটছে, যেভাবে হোক সেটা সামাল দিতে হবে!’

    বেলাকে ধরে ফেলল দুই যুবক। রানাকে তাদের দিকে ছুটতে দেখেও তোয়াক্কা করছে না তারা। কাঁধ খামচে ধরে বেলাকে হ্যাঁচকা টানে ঘুরিয়ে নিল নীল জ্যাকেট, পরক্ষণে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। ব্যথা পেয়ে কাতরে উঠেছে মেয়েটা।

    প্রাণপণে ছুটছে রানা। বুকের ভেতরে পাগলা ঘোড়ার মত লাফ দিচ্ছে হৃৎপিণ্ড। কানে শোঁ-শোঁ আওয়াজ। ছুটন্ত রানা দেখল, উঠে দাঁড়িয়ে আক্রমণকারীদের কাছ থেকে সরে যেতে চাইছে বেলা। কিন্তু তখনই পেটে লাথি মেরে ওকে মাটিতে ফেলে দিল বাদামি হুডি।

    প্রায় একই সময়ে পৌঁছে গিয়ে হুডিওয়ালার বুকে ডানকাঁধ দিয়ে গুঁতো মারল রানা। ফুসফুস ফাঁকা হতেই খাবি খেল যুবক। তার মুখে পুদিনা পাতার গন্ধ পেল রানা। ব্যথা পেয়ে পিছিয়ে গেলেও মাটিতে পড়ে গেল না যুবক। বেল্টের পেছন থেকে সামনে আনল হাত। এখন মুঠোয় খাটো এক কালো সিলিণ্ডার। ওটার একপ্রান্ত ধরে ঝাঁকি দিল সে। সড়াৎ করে, খুলে গেল পুলিশের ব্যাটন। বেশিরভাগ দেশে ওটা বেআইনি। অস্ত্রটা দিয়ে বেশি জোরে মারলে খুলি ফেটে বেরোবে মগজ।

    বহুবার সশস্ত্র লোকের বিরুদ্ধে লড়ে রানা জানে, ওর প্রথম কাজ হবে ব্যাটন কেড়ে নেয়া। যুবক লোহার ডাণ্ডা তুলে বাড়ি মারার আগেই সামনে বেড়ে তার হাত ধরতে গেল রানা। ট্রেইণ্ড শরীর আগে বিদ্যুদ্বেগে নড়ত, কিন্তু মাসের পর মাস ব্যায়ামে অবহেলা ও অতিরিক্ত মদ্যপান ওকে করে দিয়েছে খুব ধীর। সাধারণ মানুষের চেয়ে দ্রুত হলেও পেশাদার খুনির বিরুদ্ধে জেতা ওর পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

    বিদ্যুদ্বেগে প্রতিক্রিয়া দেখাল দুই যুবক।

    ব্যাটন দখল করতে হলে যত ক্ষিপ্র হওয়া উচিত, তা নয় মাতাল রানা। এক পা সরে গেছে হুডিওয়ালা, পরক্ষণে বাতাস কেটে হুইল শব্দে ব্যাটন নামাল রানার নাকের একইঞ্চি আগে। ঝট করে পিছিয়ে ছে রানা। ওর বুঝতে দেরি হলো না, বেলা আর ও আছে মস্তবড় বিপদে।

    এদিকে নীল জ্যাকেটের ভেতর থেকে ব্যাটন নিল দ্বিতীয় যুবক। কবজির মোচড়ে দীর্ঘ হলো অস্ত্রটা।

    হামলা হবে বুঝে বড় এক বোল্ডারের দিকে পিছিয়ে গেল রানা। কিন্তু তখনই খটাস্ করে ব্যাটন নামল ওর কলারবোনে। আরও দ্রুত পেছাতে গিয়ে পিংপং বলের মত গোল এক পাথরে পিছলে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ল রানা। আগে হলে গড়ান দিয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়াত। কিন্তু এখন সেটা ওর জন্যে অসম্ভব। বুট পরা পা মাথার পাশে লাগতেই চোখে দেখতে পেল সাদা এক ঝিলিক। রানার মনে হলো আগুন ধরে গেছে ওর খুলিতে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠে দাঁড়াল। যে-কোন সময়ে ব্যাটন দিয়ে ওর মাথা ফাটিয়ে দেবে দুই যুবক!

    অবশ্য এবার দয়াবশত রানারই পক্ষ নিলেন ভাগ্যদেবী নীল জ্যাকেট নড়ার আগেই সামনে বেড়ে তার ডান কবজি ধরে ফেলল রানা। ওটা মুচড়ে নিচে নিয়ে বামহাতের তালু দিয়ে ওপরে ঠেলল শত্রুর কনুই। ব্যথা পেয়ে হাত থেকে ব্যাটন ছেড়ে দিয়েছে যুবক। কবজি আটকে রেখে তার পেটে লাথি দিল রানা। যদিও জোর নেই ওর লাথিতে। ধরাশায়ী না হয়ে উল্টে রানার বাহু খপ করে ধরল নীল জ্যাকেট। ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে রাশ বুঝল, শত্রুর শরীরে ষাঁড়ের মত জোর! যদিও বা হাতে ঘুষি মেরে ফাটিয়ে দিল যুবকের গালের ত্বক।

    এদিকে কাছে চলে এসেছে হুডিওয়ালা। তার ব্যাটন ওপর থেকে নামতে দেখেও ঠিক সময়ে সরে যেতে পারল না রানা। স্টিলের ডাঙা ঠাস্ করে পড়ল ওর চোয়ালে। তীব্র ব্যথায় রানার মনে হলো মুখের ভেতরে ফেটে গেছে চল্লিশ এমএম গ্রেনেড।

    নুড়িপাথরে ভরা জমিতে পা পিছলে ধুপ করে পড়ল রানা। দু’চোখে দেখতে পাচ্ছে অসংখ্য রঙিন নক্ষত্র। আর তখনই কপালের একপাশে ঠাস্ করে নামল ব্যাটন। পরের সেকেণ্ডে তৃতীয় বাড়ি মাথায় লাগতেই আঁধার এক অতল কূপে টুপ করে তলিয়ে গেল রানা।

    নয়

    বহু দূরে কোথায় যেন নানাধরনের আওয়াজ। ধীরে ধীরে জেগে উঠছে মাসুদ রানা। মাথার ভেতরে জট পাকিয়ে আছে অর্থহীন কিছু গর্জন ও প্রচণ্ড ব্যথা। বোধহয় যে-কোন সময়ে বিস্ফোরিত হবে ওর খুলি। কিছুক্ষণ পর পিটপিট করে চোখ মেলল রানা। আঙুল দিয়ে ডলে দেখল বাম চোখের ওপরে। জায়গাটা প্রায় অবশ হয়ে গেছে। ঝাপসা দেখছে ডান চোখে। চারদিকে রঙিন রশ্মি। উঠে বসতে চেয়েও ব্যর্থ হলো রানা। ইঞ্জিনের মত ধুপধুপ করছে মাথার ভেতরে।

    খুব ধীরে ধীরে ফিরে এল ওর দৃষ্টিশক্তি। সৈকত ও বোল্ডারে এসে পড়েছে ঘুরন্ত নীল আলো। ফি-ফিয আওয়াজ তুলছে রেডিয়ো। কে যেন উঠিয়ে বসাল রানাকে। প্রচণ্ড শীত লাগছে বলে বারবার কেঁপে উঠছে ওর শরীর। মাথার ভেতরে তীব্র ব্যথা লাগতেই কুঁচকে গেল মুখ। চারপাশে কী যেন করছে কারা যেন। সৈকতের ধারে পুলিশের গাড়ি আর দুটো অ্যাম্বুলেন্স।

    কিন্তু এগুলো এখানে কী করছে?

    ‘আমি একাই বসতে পারব,’ মুখ তুলল রানা। ওকে ধরে রেখেছে মধ্যবয়সী এক মহিলা। পরনে প্যারামেডিকদের পোশাক। শান্ত করতে গিয়ে কী যেন বলছে নরম স্বরে। যদিও একটা কথাও বুঝতে পারছে না রানা। একটু দূরে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে ক’জন। এখানে কী ঘটেছে তাদের কাছ থেকে জেনে নেবে ভেবে উঠে দাঁড়াল রানা, কিন্তু তাতে হঠাৎ করে বেড়ে গেল মাথার ব্যথা। ঝিমঝিম করছে শরীর।

    ওকে ধরে রাখল মহিলা প্যারামেডিক। কয়েক পা নিয়ে বসিয়ে দিল একটা বোল্ডারের ওপরে। যন্ত্রণা-ভরা মাথা নিয়ে অস্থির লাগছে রানার। দু’হাতে চেপে ধরল কপালের দু’দিক। ভিজে গেল হাতের দু’তালু। নীল আলোয় রানা দেখল আঠাল তরলটা আসলে রক্ত। সাবধানে হাত বোলাল মুখে। একটু পর বুঝতে পারল, কোথা থেকে এসেছে রক্ত। ভিজে গেছে ওর টি-শার্ট। কাঁধের ওপরে কম্বল রেখেছে কেউ। রক্তে লাল হয়ে গেছে ওটা। বুজে যাওয়া বাম চোখের ওপরে আঙুল রেখে ওটার কী হয়েছে বুঝতে চাইল রানা।

    ‘চোখে হাত দেবেন না,’ সতর্ক করল প্যারামেডিক I এখন তার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে রানা। ফোলা চোয়ালে আঙুল ছোঁয়াতে গেলেই লাগছে মারাত্মক ব্যথা। চোখের ওপর থেকে রক্ত মুছল রানা। আবার দেখতে পেল। তবে দৃষ্টি খুব ঝাপসা। ওর মনে পড়ল, দু’জন যুবক মিলে পিটিয়ে অজ্ঞান করেছে ওকে। চোখে ভাসল পুলিশের ব্যাটন হাতে তাদের দু’জনের চেহারা।

    ‘বেলা?’ দুর্বল গলায় বলল রানা। ঘুরে তাকাল চারপাশে। ‘বেলা কোথায় গেছে?’

    কোথা থেকে যেন এসে এক পুলিশ অফিসার কথা বলল প্যারামেডিক মহিলার সঙ্গে। রানা শুনল: ‘একে জেরা করতে হবে।’

    জবাবে প্যারামেডিক বলল, ‘আগে ওকে চিকিৎসা দিতে হবে। হাসপাতালের কথা জানাল মহিলা।

    ‘বেলা কোথায়? আবারও জিজ্ঞেস করল রানা। ‘ওকে সাহায্য করতে হবে।’

    ‘আপনি সেটা আর পারবেন না,’ বলল প্যারামেডিক।

    ওর ওপরে হামলা করেছে লোকদুটো, জানাল রানা।

    কেন যেন ওর কথা শুনতে চাইছে না কেউ!

    এদের কি মাথা নষ্ট হয়ে গেল? ভাবল রানা। জড়ানো স্বরে কথা বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। মেলে রাখতে পারল না দু’চোখ। একটু পর ওকে শুইয়ে দেয়া হলো স্ট্রেচারে। রওনা হলো কারা যেন। ধীরে ধীরে পেরোচ্ছে সময়। ধুম শব্দে বন্ধ হলো একটা দরজা। গর্জে উঠল ইঞ্জিন। রানা বুঝল, ও আছে চলন্ত এক গাড়িতে। পাশেই বসে আছে কেউ। হয়তো সেই মৃদুভাষী মহিলা প্যারামেডিক। ওকে নেয়া হচ্ছে বহু দূরে কোথাও। রানার মনে হলো, ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাচ্ছে ও মেঘের ভেলায়। অবশ হয়ে এল ওর শরীর।

    তারপর হঠাৎ অন্য এক পরিবেশে নিজেকে দেখতে পেল রানা। চারপাশে অত্যুজ্জ্বল সাদা আলো। দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে দেয়াল। ওপর থেকে ওর দিকে চেয়ে আছে কারা যেন। রানা বুঝল, গার্নিতে করে ওকে নেয়া হচ্ছে ধবধবে সাদা এক করিডর ধরে। ‘আমি ঠিকই বেলাকে বাঁচাব,’ বলেই জ্ঞান হারাল রানা।

    .

    পরের ক’ঘণ্টা রানার কাটল অদ্ভুত এক ঘোরের ভেতরে। আচ্ছন্ন এক পরিবেশে জানল না, কখন রক্তাক্ত পোশাক খুলে হাসপাতালের রোব পরিয়ে গার্নি থেকে নিয়ে ওকে শুইয়ে দেয়া হয়েছে পর্দাঘেরা কিউবিকলের বেডে। চারপাশে ক’জনকে হাঁটাচলা করতে দেখল। তারা এল আবার বিদায় নিল। ওর মুখে ঝুঁকে কী যেন করল কেউ। মানুষগুলো বোধহয় ধরে নিয়েছে ও ভিনগ্রন্থে কোন জন্তু। একবার বাঁকা সুঁই দিয়ে সেলাই করল সাদা পোশাকে গণ্ডারের মত একলোক। তখন কপালে সুড়সুড়ি লাগল রানার। বুঝে গেল, খুলির ফেটে যাওয়া ত্বক সেলাই করা হচ্ছে। মনে পড়ল অতীতে ক্ষত সেলাইয়ের স্মৃতি। এখন যা হচ্ছে, সেটা আসলে কিছুই নয়। দু’বার রানা বলতে চাইল, আমি ঠিক আছি। কিন্তু এত বেশি দুর্বল যে কথা বলতে পারল না। এরপর ভারী হয়ে গেল ওর চোখের পাতা।

    কনকাশন হয়েছে কি না সেটা জানতে গিয়ে কোনমতেই- ওকে ঘুমাতে দিল না ডাক্তারেরা। তাদের ভেতরে টাইয়ে ফুলের ছোপ দেয়া ডাক্তার পিটার হাম্বল শুকনো রসিকতার রাজা। একটু পর পর টর্চ মেরে ওর চোখ দেখল সে। জানতে চাইল মাথা-ব্যথা বা দুর্বলতা আছে কি না। রানা জানাল, ওর কিছুই হয়নি।

    বমি করছে না রোগী। ফ্যাকাসে হয়নি ত্বক। জড়িয়ে যাচ্ছে না কথা। ফুলে ওঠেনি চোখের পাতা। রোগীর ভেতরে কনকাশনের লক্ষণ না দেখে খুশি হলো ডাক্তার হাম্বল। অবশ্য রোগীর তীব্র মাথা-ব্যথা ও মাথাঘোরা নিয়ে দুশ্চিতা কাটল না তার। হুইল চেয়ারে করে রানাকে নেয়া হলো এক্স- রে রুমে। ওখানে ফাটল ধরা খুলি পরীক্ষা করে আবার ফেরত নিল কিউবিকলে। কোনভাবেই রানাকে ঘুমাতে দিল না হাম্বল। ওর ঘাড়ের নিচে দিল দুটো মোটা বালিশ। যতবারই রানা জিজ্ঞেস করল, কোথায় আছে বেলা, বা কী হয়েছে ওর, একটা কথাও বলল না কেউ। সৈকতে দুটো অ্যাম্বুলেন্স দেখেছে রানা। ওর ধারণা, ওটার একটার ভেতরে ছিল বেলা।

    আধঘণ্টা পর পর নার্স পরখ করে দেখল নিউরো রিঅ্যাকশন।

    ‘মাথায় সামান্য আঘাত,’ তাকে জানাল রানা। ‘মরলে তো আগেই মরে যেতাম।

    রাত তিনটেয় সন্তুষ্ট হলো ডাক্তার হাম্বল। তার ধারণা: কনকাশন হলেও এখন আর কোমা হবে না রানার। কিউবিকল থেকে সরিয়ে ওকে নেয়া হলো এক ওয়ার্ডে। ঘুমাবার অনুমতি পেল রানা। আগেই নানান ওষুধ দিয়ে ভোঁতা করে দেয়া হয়েছে ওর মগজ। বালিশে মাথা রেখে অদ্ভুত ভাসমান এক জগতে সাঁতরাতে লাগল রানা।

    অস্বস্তিকর ঘুমের ভেতরে দেখল বারবার বেলাকে। আলাপ করতে করতে কোথায় যেন চলে গেল মেয়েটা। আচ্ছন্নতার ভেতরে রানা বুঝল, আগামাথা নেই এসব স্বপ্নের। এরপর যে স্বপ্ন এল, সেটা ভয়ঙ্কর। কটেজের জানালা থেকে রানা দেখল সৈকতে বেলাকে তাড়া করছে দুই লোক। তাদের দিকে ছুটে গেল ও। কিন্তু তখনই বাতাস কেটে নেমে এল ব্যাটন…

    চমকে গিয়ে ঘুম ভাঙল রানার। চোখ মেলে দেখল মাথার ওপরে সাদা ছাত। জানালার পর্দা গলে মেঝে ও বেডে পড়েছে সোনালি রোদ। রাত কেটে কখন যেন চলে এসেছে সকাল।

    বালিশে মাথা কাত করে রানা দেখল, ওয়ার্ডের শেষমাথায় আছে ওর বেড। বেশিরভাগ বেডে বয়স্ক সব লোক। একজন ভীষণ হুঁকোরে কাশি দিচ্ছে। মস্ত ঘরে পায়চারি করছে হাতির মত মোটা এক মহিলা মেট্রন। দূর দেয়ালের ঘড়িতে বাজে আটটা সতেরো।

    মাথাঘোরা কমলেও দপ দপ করছে রানার খুলি। ব্যথার পেছনে ব্যাটনের যে অবদান, তার চেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে হ্যাংওভার। মরা কাঠের মত গলা শুকিয়ে গেছে বলে রানার মনে হলো, ভাল হতো কয়েক আউন্স উইস্কি গিলতে পারলে।

    হাত তুলে স্পর্শ করল কপালের ব্যাজে। ক্ষত টিপে দেখতে গিয়ে আঁৎকে উঠল ব্যথায়। খচ খচ করছে ওর মন। আগে কখনও আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে এভাবে ব্যর্থ হতে হয়নি ওকে। অথচ গতকাল অসহায় এক মেয়েকে বিপদের সময়ে সাহায্য করতে পারেনি।

    বিছানায় শুয়ে নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল রানা। বারবার মনে প্রশ্ন জাগল: বেলা এখন কোথায়? সুস্থ আছে তো মেয়েটা? আবার কখন দেখা হবে ওর সঙ্গে?

    ওয়ার্ডের ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজতেই পাকা সিদ্ধান্ত নিল রানা। এবার বেরোতে হবে ওকে এই বন্দিশালা থেকে। এরপর কারও কাছ থেকে জেনে নেবে বেলা এখন কোথায় আছে। বেডকভার সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামবে, এমন সময় নীল পোশাকে খুনখুনে এক বুড়ো আর্দালি থামল ওর বেডের পাশে। ট্রলির ওপরে হাসপাতালের বিস্বাদ নাস্তা। খাবার দেখেই বিদ্রোহী হয়ে উঠল রানার মন। ঘাড় কাত করে মানা করল বুড়োকে। কিন্তু ট্রলি থেকে নিয়ে বেড়ে নাস্তার ট্রে নামিয়ে দিল বুড়ো।

    নাস্তা করার চেয়ে বেলার খোঁজ নেয়া এখন অনেক বেশি জরুরি। বুড়োকে জিজ্ঞেস করল ‘রানা, ‘এখন কোথায় আছে বেলা?’

    জবাবে ট্রে দেখাল আর্দালি। ‘আগে নাস্তা করে নিন।’

    ‘পারলে অন্য কাউকে আপনার আনা খাবার গিলিয়ে দিন,’ প্রতিবাদ করল রানা।

    ওর কথা শেষ হতে না হতেই আজরাইলের মত হাজির হলো হাতিসম মহিলা মেট্রন। বাজখাই গলায় বলল সে, ‘নাস্তা করতে হবে। নইলে পেইন কিলার দিতে পারব না।’

    মহিলা ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বাধ্য হয়ে টোস্ট করা পাউরুটি ও দুধ খেল রানা। তারই ফাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘বেলা এখন কোথায় আছে?’

    পলকের জন্যে মেট্রনের চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টি দেখল রানা। জানতে চাইল, ‘বেলা সুস্থ আছে তো? আমাকে বলুন, ওকে এখন কোথায় পাব?’

    ‘আমি সেটা বলতে পারব না,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল মেট্রন।

    ‘তা হলে যে বলতে পারবে, তেমন কাউকে খুঁজে নেব, গা থেকে চাদর সরিয়ে দিল রানা।

    ‘ভুলেও বেড থেকে নামবেন না,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল মহিলা। দু’হাত কোমরে। রানা লক্ষ্মী ছেলের মত শুয়ে না পড়লে জোর খাটাতে বোধহয় দ্বিধা করবে না সে। কাছ থেকে মেট্রনের বাইসেপ দেখে রানার মনে হলো, এই মহিলা বোধহয় পৃথিবীর সেরা পেশাদার ওজন উত্তোলনকারিণী

    ‘আমার পোশাক কোথায়?’ মহিলার চোখে কঠোর দৃষ্টি ফেলে বেডের ওদিক দিয়ে নেমে পড়ল রানা। এত বেশি রেগে গেছে যে, ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেল মেট্রন।

    ‘আমার রোগী দেখি আজ বেশ সুস্থ,’ বলে উঠল কে যেন। ঘুরে ওয়ার্ডের দরজার দিকে তাকাল রানা।

    এইমাত্র ঘরে ঢুকেছে ডাক্তার হাম্বল। আজকের টাই আরও ফুলেল। ডাক্তারের পেছনে ঘরে পা রেখেছে তিক্ত চেহারার একলোক। সঙ্গে তরুণী এক মেয়ে।

    তাদেরকে হাসপাতালের কর্মী বলে মনে হলো না রানার।

    ‘আপনার কাছে অতিথি এসেছেন,’ বলল ডাক্তার হাম্বল। রানা, এখন আগের চেয়ে সুস্থ কি না, সেটা জেনে নেয়ার জন্যে ওকে বেড়ে বসতে অনুরোধ করল সে।

    বিরক্ত হলেও ডাক্তারের কথা মেনে নিল রানা। চট করে ওর স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করল হাম্বল, তারপর দুই অতিথিকে দেখিয়ে দিল দুটো চেয়ার।

    তিক্ত চেহারার লোকটা তিনদিকের সাদা পর্দা টেনে ওয়ার্ড থেকে আলাদা করে দিল রানার বেড়।

    ডাক্তার বিদায় নিতেই চেয়ার টেনে বসল তারা। তাদের আগমনে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে ওয়ার্ডের বয়স্ক রোগীরা।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ৪৭১ : নরকের শহর
    Next Article মাসুদ রানা ৪৬৯ – কিলিং মিশন

    Related Articles

    কাজী মায়মুর হোসেন

    অদৃশ্য ঘাতক – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৬৮ – স্বর্ণলিপ্সা

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    ধাওয়া – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মৃত্যু উপত্যকা – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    খুনে ক্যানিয়ন – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৪৮ – মৃত্যুঘণ্টা

    July 25, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }