Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ৪৭০ – কালবেলা

    কাজী মায়মুর হোসেন এক পাতা গল্প433 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কালবেলা – ১৫ (মাসুদ রানা)

    পনেরো

    সরু পথ গিয়ে উঠেছে টিলার কাঁধে। বামদিকে মস্ত আঙিনার পেছনে আগুনে পোড়া পরিত্যক্ত বিশাল ম্যানশন। ওটার কবাটহীন জানালা গলে আসছে বৃষ্টিভেজা ঝোপের বুনো গন্ধ। সাগর থেকে হু-হু করে বইছে নোনা হাওয়া। আকাশ থেকে কালো মেঘ সরে যাওয়ায় ঝলমল করছে সোনালি সূর্য। এবারডেন হলের পুব উইঙের কাছে গাড়ি রেখে নেমে পড়ল মাসুদ রানা। ছোটবেলায় এ-বাড়িতে পিকনিক করেছে চাচার সঙ্গে। তখন সফেদ দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ বলেন এবারডেন হলের করুণ কাহিনী। কেউ জানে না আঠারো শত একান্ন সালে কেন পুড়ল বাড়ির পশ্চিম উইং। ধসে গেল ছাতের বড় অংশ। অনেকে বলতেন, বদ্ধউন্মাদ হয়ে ম্যানশনে আগুন দেয় স্টার্লিংফোর্ড। আর নিজেই পুড়ে মরে সে নরকে।

    এ-কথা সত্যি হলে নিজের কাজে সম্পূর্ণ সফল হয়নি লোকটা, কারণ পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই নিজে থেকে নিভে যায় আগুন। অনেকে বর্ণনা করেছে, কীভাবে মচমচে রোস্ট হয়ে মরেছে ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর নরপশু সেই জমিদার। তার পোড়া আঙুলে পারিবারিক সোনার আঙটি আর ছাই হওয়া ওয়েস্ট কোটের ভেতরে সোনার ঘড়ি ছাড়া তাকে চেনার কোন উপায় ছিল না। শাসক হিসেবে চরম দুর্নাম ছিল তার। আর সেজন্যেই ম্যানশনে আগুন ধরলেও ওটা নেভাতে গ্রাম থেকে আসেনি কেউ সবার মনে দগদগে ঘায়ের মত ছিল আঠারো শ’ সাতচল্লিশের দুর্ভিক্ষের স্মৃতি। সে-সময় খেতে না পেয়ে মাছির মত পালে পালে মারা গেছে তাদের আত্মীয়স্বজন। জমিদার কোন সাহায্য তো করেইনি, নির্বিচারে খুন করেছে তাদেরকে। কোন দেশে এমন ভয়ঙ্কর মন্বন্তর হলে পরের পাঁচ শ’ বছরেও তা ভুলতে পারে না এলাকার মানুষ।

    বছরের পর বছর আবহাওয়ার নিয়ত অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে ধসে পড়ছে এবারডেন হল। আগের চেয়েও করুণ হাল হয়েছে ওটার। কঙ্কালের মত চারদিকে পাথুরে দেয়াল। মেঝেতে পড়ে চুরমার হয়েছে ছাতের স্লেট। বৃষ্টিতে পচে গেছে দরজা-জানালার কবাট। তুষারপাতে ফাটল ধরা মেঝেতে জন্মেছে বুনো ঝোপঝাড়। এখানে-ওখানে পড়ে আছে মদ ও বিয়ারের খালি বোতল। অবশ্য ওগুলোও বহুকাল আগের। আজ আর কেউ আসে না এবারডেন হলে পিকনিক করতে।

    ভুতুড়ে ম্যানশনে পা রেখে চারপাশে তাকাল রানা। কিছুক্ষণ ভাবল বেলার নোটবুকের কথা। এখন ওর পকেটে থাকলেও জরুরি কোন তথ্য ওটাতে নেই। একটু পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার গাড়িতে উঠল রানা। চলল পশ্চিমে দু’মাইল দূরে গ্লেনফেল শহরের বাজার লক্ষ্য করে।

    লর্ড অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ডের আমলে গ্লেনফেল ছিল দরিদ্র মানুষের বস্তি। পরে ওটা শহর হয়ে গেলেও এখনও সেখানে আছে পাথরের ছোট সব পুরনো ওঅর্কহাউস। দুর্ভিক্ষের সময় এতিম ছেলে-মেয়েদেরকে ওখানে রাখা হতো। খাবার ও চিকিৎসার অভাবে একেক বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে মরত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন শিশু। বিছানায় থাকত সারি সারি লাশ ও মৃতপ্রায় মানুষ। গ্লেনফেলবাসীদের মত একই পরিণতি বরণ করেছিল আয়ারল্যাণ্ডের অসংখ্য শহর ও গ্রামের অসহায় লাখ লাখ মানুষ। দখলদার ইংলিশেরা ছিল সমাজের মাথা। তবে সব জেনেও কোন ধরনের সহায়তা তারা করেনি। এতে গভীর যে ক্ষত তৈরি হয় আয়ারল্যাণ্ডের মানুষের মনে, তাতে অত্যাচারী ইংরেজদেরকে চিরকালের জন্যে চরম ঘৃণা করতে শিখেছে তারা।

    শত বছর পর ওঅর্কহাউসগুলোর বেশিরভাগ হয়ে গেল ধনী খামারিদের শস্যের গুদাম। তেমনই এক গুদামের উঠনে গাড়ি রেখে সেইন্ট ম্যালাচি চার্চ খুঁজতে বেরোল রানা। শহরে আছে মার্বেলের মেমোরিয়াল স্ল্যাব। দুর্ভিক্ষের বিশ বছর পর ওটাতে লেখা হয়েছে হাজার হাজার মৃত মানুষের নাম। ওখানে কিছুক্ষণ থেমে আবার হাঁটতে লাগল রানা।

    বিকেল পাঁচটায় ঢুকল ছায়াঘেরা ম্যালাচি চার্চে। আকারে ওটা বড় বা দেখতে সুন্দর না হলেও যে-কোন ধর্মালয়ের মতই ওখানে আছে নীরবতা ও প্রশান্তির স্বর্গীয় পরিবেশ।

    উঁচু ছাত থেকে ফিরছে রানার জুতোর শব্দের প্রতিধ্বনি। একবার থেমে দেয়ালের কাছে একটা প্লেক দেখল। ওটাতে লেখা: উনিশ শ’ বাইশ সালে গ্রেনফেলের বাইরে গণকবরে পাওয়া গেছে আট হাজার তিন শ’ আটচল্লিশজন নারী-পুরুষ ও শিশুর কঙ্কাল।

    প্লেকের কাছ থেকে সরে যাওয়ার আগেই পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল রানা। ঘুরে দেখল ওর সামনে এসে থেমেছেন দয়ালু চেহারার এক বৃদ্ধ। তাঁর মুখে স্মিত হাসি দেখে বলল রানা, ‘ফাদার ও-সুলিভান?’

    হাসলেন বৃদ্ধ। ‘হ্যাঁ, আমিই সে। আপনার জন্যে কী করতে পারি?’

    ‘একটু সময় দিলে আপনার সঙ্গে কথা বলতাম,’ বলল রানা।

    ‘কোন সমস্যা নেই। কী বলবেন, বলুন?’

    নিজের নাম জানাল রানা। যাজককে বলল, আইরিশ মন্বন্তরের ইতিহাস নিয়ে রিসার্চ করছিল ওর এক কলিগ। কিন্তু হঠাৎ করে সে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আরও তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে নিজে এসেছে ও।

    ‘আমার কলিগ এসেছিল মাত্র কয়েক দিন আগে। আমাকে বলেছে, আপনার সঙ্গে কথা বলেছে ও।’

    রানার মুখে বেলার চেহারার বর্ণনা শুনে মাথা দোলালেন ফাদার ও সুলিভান। ‘হ্যাঁ, মনে আছে। আমাদের চার্চের পুরনো রেজিস্টার খাতা দেখতে চেয়েছিল। খুব যত্নের সঙ্গে নিজের কাজ করে। আমার কাছে জানতে চেয়েছিল আমাদের রেকর্ড নিখুঁত কি না। জবাবে বলেছি: যতটা জানি, কাজে কোন ত্রুটি রাখা হয়নি। তা ছাড়া, রেকর্ডে ভুল হবেই বা কেন?’ রানার চোখে তাকালেন তিনি। ‘আপনি তো বললেন আপনার কলিগ অসুস্থ। আশা করি খারাপ কোন রোগ হয়নি?’

    ‘ওর শারীরিক অবস্থা এখন খুব গুরুতর,’ বলল রানা।

    ‘শুনে দুঃখ পেলাম। মিষ্টি এক মেয়ে। আশা করি স্রষ্টা ওকে নিরোগ করবেন। … এবার, বলুন, আপনি আসলে আমার কাছে কী জানতে চান, মিস্টার রানা?

    ‘আপনার আপত্তি না থাকলে একই রেকর্ড আমিও দেখতে চাই। তাতে হয়তো বুঝব ওর নোটগুলোর অর্থ আসলে কী। নিজে ওকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি…’ চুপ হয়ে গেল রানা।

    ‘বুঝতে পেরেছি, মিস্টার রানা। বেশি অসুস্থ হয়ে গেছে সে। ঠিক আছে, তা হলে আপনি না হয় আরেকবার দেখবেন আমাদের রেকর্ডগুলো। আসুন আমার সঙ্গে।

    নুড়িপাথরে ছাওয়া সরু এক পথে রানাকে চার্চের পেছনে নিয়ে গেলেন ফাদার ও সুলিভান। পকেট থেকে নিলেন বড় একটা চাবি। পুরনো আমলের এক দরজার তালা খুলে রানাকে নিয়ে প্রবেশ করলেন ছোট এক অফিসে। রানার মনে হলো, একপলকে ও পৌঁছে গেছে শত বছর আগে। আসবাবপত্রের ওপরে পুরু ধুলো, বাতাসে ভেজা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ।

    ‘এ-ঘরেই আছে পুরনো সব রেকর্ড,’ ঝুঁকে আসা তাকের ওপরে হলদেটে প্রাচীন রেজিস্টার খাতাগুলো দুঃখ-ভরা চোখে দেখলেন ফাদার ও-সুলিভান। ‘গত এক শ’ বছরে এদিকের মানুষের জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে থেকে শুরু করে দেশত্যাগ পর্যন্ত সবই এসব খাতায় আছে। আজকাল অবশ্য অনেক প্যারিশে রেকর্ড রাখা হয় অনলাইনে। সে-কাজ হয়তো করবে আমার পরবর্তী প্রজন্মের ম্যালাচি চার্চের যাজকেরা। নিজে আমি নতুন টেকনোলজির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারিনি। শুনলে হয়তো অবাক হবেন, আমাদের এখানে কোন টেলিভিশনও নেই।’ মলিন হাসলেন ফাদার। পরক্ষণে চট করে ফিরলেন বর্তমানে। ‘ঠিক আছে, ঘেঁটে দেখুন রেকর্ড। আমার মনে আছে, মেয়েটা আসার আগে বহু বছর কেউ এখানে এসে ওগুলো দেখতে চায়নি। আর তারপর একই সপ্তাহে এলেন আপনারা দু’জন। এটা সত্যি বড় এক রহস্য বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। তাই আপত্তি না থাকলে দয়া করে কি বলবেন, আপনারা আসলে কী খুঁজছেন?’

    ‘আমার কলিগ যে তথ্য দিয়েছে, সেসব এখনও অসম্পূর্ণ,’ বলল রানা। ‘এই প্যারিশের একজনের অতীত ইতিহাস নিয়ে কাজ করছিল ও।

    ‘আমার মনে আছে, এ-কথাই বলেছে মেয়েটা, সাদা দাড়ি চুলকে নিলেন ফাদার ও সুলিভান। ‘যেহেতু আমার কাজ মানুষের জীবন নিয়ে, তাই মৃত্যুর হিসেব ইচ্ছে করেই মনে রাখি না। তবুও বলুন, মানুষটার জন্ম কোন্ সালে হয়েছিল?’

    ‘আঠারো শ’ নয় সাল,’ বলল রানা।

    ‘হুম, সে তো বহুকাল আগের কথা! তার ব্যাপারে তথ্য পেতে হলে আপনাকে ঘাঁটতে হবে অনেক রেজিস্টার খাতা। বলুন তো দেখি কী ছিল মানুষটার নাম?’

    ‘বায়ার্ন,’ বলল রানা।

    অবাক চোখে ওকে দেখলেন ফাদার। ব্যস? তার বংশ- পরিচয় আপনার জানা নেই? বায়ার্ন নামের একলোক, যে কি না জন্ম নিয়েছে আঠারো শ’ নয় সালে? কিন্তু, বাছা, আপনি কি একবার ভেবে দেখেছেন, এই প্যারিশে গত শতাব্দীতে বায়ার্ন নামে কত শত মানুষের জন্ম হয়েছে? আপনার খুঁজে বের করতে হবে বিশেষ একজনকে। কাঁচা ঝাঁকালেন ও- সুলিভান। ‘যা-ই হোক, আপনি চেষ্টা করে দেখুন। ঈশ্বর আপনাকে সহায়তা করুন। সময় যতই লাগুক, এখানে রয়ে যেতে বিব্রত বোধ করবেন না। আপনার কাজ শেষ হলে দরজায় তালা মেরে আমার কাছে দিয়ে যাবেন চাবিটা।’

    ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, ফাদার,’ বলল রানা।

    ‘সবকিছু আরও জটিল করে দেয়ায় আমি দুঃখিত,’ বললেন ফাদার। ‘তবে মনে রাখবেন, বেশকিছু রেকর্ড আছে ল্যাটিন ভাষায়। কেউ একদিন হয়তো ইংরেজিতে ভাষান্তর করবে। আর তখন তার সময়টা কাটবে দুঃস্বপ্নের মত। ঠিক আছে, ঈশ্বর আপনাকে সহায়তা করুন।’

    ঘুপচি ঘরে রানাকে রেখে বিদায় নিলেন ফাদার ও- সুলিভান। চারপাশের পুরনো রেজিস্টার খাতার দিকে ঘুরে তাকাল রানা। দু’চার দিন আগে এখানে এসেছে বেলা। আর ওর মত করেই খুঁজতে হবে জরুরি তথ্য। কিছুক্ষণ এদিক- ওদিক দেখার পর একটু এলোমেলো রেজিস্টার খাতাগুলোর ওপরে চোখ পড়ল রানার। প্রথম রেজিস্টার খাতায় লেখা: Parish birth records 1805 January to 1809 December.

    ধুলোভরা রেজিস্টার খাতাটা হাতে নিয়ে ওটার ওপরে বেলার আঙুলের ছাপ দেখতে পেল রানা। ওর চোখে ভেসে উঠল রক্তাক্ত এক ক্ষত-বিক্ষত মেয়ের মৃতদেহ।

    ঘরের কোণে ছোট্ট টেবিল। ওটার ওপরে রেজিস্টার রেখে প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই বাতাসে ভেসে উঠল মিহি ধুলোর মেঘ। বহুকাল আগের অপূর্ব সুন্দর হাতের লেখায় রচিত হয়েছে প্রতিটি অক্ষর। কালের পরিক্রমা ঝাপসা করে দিয়েছে কিছু শব্দ। দাঁত দিয়ে পুরু কাগজ কেটে নামিয়েছে একদল ইঁদুর। জায়গায় জায়গায় তেলাপোকার বিষ্ঠা। রেজিস্টার খাতার শেষদিকে শুরু হয়েছে আঠারো শ’ নয় সাল। রেজিস্টার খাতা অনুযায়ী তখন গ্লেনফেল আর আশপাশের গ্রামে জন্মেছে শত শত বায়ার্ন নামে শিশু। একের পর এক পৃষ্ঠা ওল্টাতে গিয়ে রানা বুঝল, একফোঁটা মিথ্যা কথা বলেননি ফাদার। সত্যি, বায়ার্নের বংশ-পরিচয় না পেলে কোনভাবেই খুঁজে বের করা যাবে না আসল লোকটাকে।

    আরও কিছুক্ষণ রেজিস্টার খাতা ঘেঁটে হাল ছেড়ে দিল রানা। দরজায় তালা মেরে ফিরে এল চার্চের ভেতরে। খুঁজে নিল ফাদার ও-সুলিভানকে।

    ‘কিছু পেলেন?’ জানতে চাইলেন তিনি।

    ‘হয়তো জানতাম, যদি বুঝতাম আসলে কী খুঁজতে হবে, বলল রানা।

    ‘আপনি যদি দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে আগ্রহী হন, তো একবার ঘুরে আসতে পারেন জাদুঘর থেকে।’

    ‘জাদুঘর?’

    ‘বড় জাদুঘর না হলেও মন্বন্তরের সময় আয়ারল্যাণ্ডের গ্রামের মানুষ কীভাবে মারা গেছে সেটা বুঝতে পারবেন।’

    ‘তা হলে ঘুরে দেখব ওটা,’ বলল রানা, ‘আমাকে সহায়তা করেছেন বলে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ বৃদ্ধ মানুষটার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল রানা।

    ‘স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি, আপনার কলিগ যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন,’ বললেন ফাদার ও-সুলিভান, ‘আপনিও ভাল থাকুন।’

    বুকের ভেতরে কেমন যেন এক চাপ নিয়ে চার্চ থেকে বেরিয়ে এল রানা।

    ষোলো

    টুলসা, ওকলাহোমা।

    ছোট্ট অফিস থেকে বের করে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের বড় এক কামরায় আনা হয়েছে জ্যাকিকে। ওর সঙ্গে আছে পুলিশ চিফ রিপার রিগবি ও ডিটেকটিভ জিম লিয়োনার্ড। প্লাস্টিক চেয়ারে ঘেরা দীর্ঘ এক টেবিলের শেষমাথায় আছে ডিভিডি প্লেয়ার আর বড় একটা স্ক্রিন।

    জ্যাকি ব্যাকপ্যাক থেকে ডিস্ক নিয়ে তার হাতে দেয়ায় জানতে চাইল চিফ রিগবি, ‘এই ডিস্ক কি একমাত্র কপি?’

    ‘জী, একমাত্র,’ মিথ্যা বলল জ্যাকি।

    ‘আর ফোনে যে ভিডিয়ো, সেটা কোথায়?

    ‘আমার কাছেই আছে,’ ব্যাকপ্যাক দেখাল জ্যাকি।

    ‘প্রমাণ হিসেবে ওটাও লাগবে,’ হাতের ইশারা করল চিফ। জ্যাকির কাছ থেকে সংগ্রহ করল ফোন। ইশারায় দেখিয়ে দিল প্লাস্টিকের একটা চেয়ার। ওখানে বসল জ্যাকি, আড়ষ্ট লাগছে ওর ঘাড় ও কাঁধের পেশি। ওর পাশের চেয়ারেই বসল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড।

    ডিভাইসে ডিস্ক ভরল পুলিশ চিফ রিপার রিগবি। স্ট্যাণ্ড থেকে রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে বসে পড়ল একটা চেয়ারে। ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল, ‘এবার নিজের চোখে দেখব।’ ডিভিডি প্লেয়ারের দিকে তাক করে বাটন টিপে দিল রিমোট, কন্ট্রোলের।

    চালু হলো ভিডিয়ো।

    গত দু’দিনে জ্যাকি ভুলে গিয়েছিল, কটেজে কী পরিমাণ ঝাপসা ছবি তুলেছে। দৃশ্যগুলো এখন দেখে হতাশ হয়ে গেল বেচারি। ছবিতে আকাশ থেকে যেন ঝরছে অজস্র বালিকণা। কটেজের আলোয় সবই ছায়াভরা।

    পেরোল দীর্ঘ দুটো মিনিট। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বসে রইল জ্যাকি। লজ্জা লাগছে পুলিশদের দিকে তাকাতে। অস্বস্তি নিয়ে নড়েচড়ে চেয়ারে বসল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড। হয়তো ভাবছে, জ্যাকি মেয়েটা বোধহয় আসলে পাগল।

    আবছায়ায় কটেজের বারান্দায় ঘটল হরর সিনেমার মত ঘটনা। জ্যাকি বুঝে পেল না, কটেজে ওর উপস্থিতি আর বিশ্রী ভিডিয়ো কেমন প্রভাব ফেলেছে দুই পুলিশের মনে। বিশ্রী শব্দ তৈরি করেছে রেকর্ডিং। ফোনের প্রতিক্রিয়াশীল ছোট্ট মাইকে গুলির শব্দ চাপা পড়ল মানুষের বিকৃত গলার নিচে। ভিডিয়ো ক্লিপে খুনের দৃশ্য যেন অবাস্তব ও হাস্যকর। বারান্দায় হাত-পা ছুঁড়ছে ঝাপসা হয়ে যাওয়া লোকটা। পলকের জন্যে দেখা গেল তার খুনি লোকটাকে। দৃশ্য খুব অস্পষ্ট। খুনি গুলি ছুঁড়তেই হঠাৎ করে মেঝেতে স্থির হলো লোকটা। এক সেকেণ্ড আগে রিভলভারের নল থেকে ছিটকে গেছে হলদেটে-কমলা হলকা। একই সময়ে গর্জে উঠেছে অস্ত্র। জ্যাকির হাতে ক্যামেরা নড়ে গেছে বলে আবারও অ্যাডজাস্ট হলো এক্সপোয়ার। কাউবয়দের ভঙ্গিতে চরকির মত ঘুরিয়ে নিয়ে হোলস্টারে রিভলভার রাখল খুনি।

    চাপা কণ্ঠস্বর এল মাইকে:

    ‘যাহ্, আমার জুতোয় হারামজাদার রক্ত লেগেছে।’

    ‘সরি, বস।’

    ‘সমস্যা নেই। ধুয়ে নিলেই হবে।’

    মৃতদেহের ওপর থেকে সরে গেল তিনজন মানুষের ছায়া। তখনই ভয় পেয়ে পিছিয়ে এল জ্যাকি। শেষ হলো ক্লিপ। কালো হয়ে গেছে স্ক্রিন।

    ঘরে নেমেছে থমথমে নীরবতা। টেবিলে রিমোট কন্ট্রোল রেখে জ্যাকির দিকে তাকাল চিফ রিপার রিগবি। ‘ব্যস? আর কিছুই নেই?’

    কাঁধ ঝাঁকাল জ্যাকি। এরপর আর কোন ভিডিয়ো করতে পারিনি।’

    ‘তবে তো বড় বিপদ,’ বলল রিগবি, ভিডিয়োতে কোথাও তো মেয়র কনারকে দেখলাম না।’

    লোকটা বাধা দেয়ার আগেই ছোঁ দিয়ে রিমোট কন্ট্রোল নিল জ্যাকি। বাটন টিপে হাই-স্পিডে পিছিয়ে নিল ভিডিয়ো। বারান্দায় পড়ে আছে মানুষটা। দোতলার বারান্দা থেকে তোলা হয়েছে মেয়রের ভিডিয়ো। বাইরের দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে অ্যারন কনার। তার পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে পেট ঘষ্টে সরে যেতে চাইছে মৃত্যুপথযাত্রী লোকটা। চিৎকার করছে ব্যথায়। স্পিকারে বিকৃতভাবে আসছে সেই শব্দ। প্লে বাটন টিপে ঠিক জায়গায় এনে ইমেজ পয করল জ্যাকি। আঙুল তুলে দেখাল দৃশ্যটা। আপনি কী করে বলছেন যে অ্যারন কনারকে চিনতে পারেননি? ওই যে সে!’

    স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ দেখার পর জ্যাকির দিকে তাকাল চিফ রিগবি। ‘আমি শুধু দেখছি সুট পরা একলোক। চুল সোনালি, বাদামি বা সাদা। আপনি ভাবছেন এই ডিভিয়ো দেখে টুলসার মেয়রকে গ্রেফতার করব আমরা? সেটা করলে উল্টো আমাকেই গ্রেফতার করবে পুলিশ!’ নিজের কথায় হাসল রিগবি। তবে হাসি নেই তার চোখে।

    ‘জানি, ভিডিয়োটা অস্কার পাওয়ার মত নয়, প্রথমবারের মত বলল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড। ‘বেশ হতাশ হয়েছি।’

    ‘কিন্তু নিজের চোখেই তো সব দেখতে পেলেন?’ বলল জ্যাকি। ‘আপনারা মেয়র কনারের চেহারা না দেখলেও ওই কটেজ তো তারই! এটা থেকে তো বহু কিছুই বোঝার কথা!’

    মাথা নাড়ল চিফ রিগবি। ‘ওই কটেজ যে-কারও হতে পারে।’

    ‘তা হলে চাবি কার কাছে ছিল?’ বলল জ্যাকি। ‘কে বন্ধ করল অ্যালার্ম কোড?’

    ‘মিস সিলভেস্টার, প্রতিবছর শত শত কেস নিয়ে কাজ করি আমরা,’ বলল চিফ রিগবি। ‘যে-কেউ বেআইনিভাবে ঢুকতে পারবে কটেজটাতে। টেকনোলজি যত জটিল হচ্ছে ক্রিমিনালরা শিখে নিচ্ছে আরও নানান কায়দা।’

    ‘আপনি তা হলে আমাকে এখন কী করতে বলছেন?’ বলল জ্যাকি। ‘সম্ভবত কোন ব্যবসার কথা বলে কটেজে ডেকে নিয়ে লোকটাকে খুন করেছে মেয়র অ্যারন কনার। সে জানত না যে কটেজে আমি আছি।’

    ডিটেকটিভ লিয়োনার্ডের দিকে তাকাল জ্যাকি

    ‘ফরেনসিক টেকনিশিয়ানরা হয়তো ভিডিয়ো পরিষ্কার করতে পারবে,’ নিচু গলায় বলল অফিসার। ‘সেক্ষেত্রে…

    ‘আপাতত ধরে নেব, আপনার কথা বিশ্বাস করার মত কোন কারণ তৈরি হয়নি, মিস সিলভেস্টার, ́ সহকারীর কথাটা কেড়ে নিয়ে শেষ করল চিফ রিগবি।

    ‘কিন্তু এটা তো মানবেন, ওখানে একজনকে খুন করা হয়েছে! এখন সেই কটেজে গেলে নানান ধরনের প্রমাণ পাবেন!’

    ‘কে জানে এই ফুটেজ আসলে কোন্ জায়গার,’ নির্বিকার সুরে বলল চিফ রিগবি। ‘আপনি আমাদেরকে এমন কোন প্রমাণ দেননি, যেটা পেয়ে আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করব।’

    ‘কিন্তু আমি নিজেই তো খুনের সাক্ষী!’ রেগে গিয়ে টেবিলে ডানহাতের চাপড় দিল জ্যাকি।

    ‘মাথা ঠাণ্ডা রাখুন, মিস,’ বলল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড।

    ‘আপনারা তা হলে মিসেস কনারকে ফোন করে জেনে নিন, ওই কটেজের চাবি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন কি না!’

    জ্যাকির কথা শুনে হাসল পুলিশ চিফ রিগবি। ‘আপনি চাইছেন, আমরা টুলসার ফার্স্ট লেডিকে ফোন করে বলব: আপনার স্বামী মেয়র কনার লেকের ধারে আপনাদের কটেজে একলোককে গুলি করে খুন করেছে-আপনি কি এ-ব্যাপারে কিছু জানেন? বলুন তো, মিস, আমাদের ঘাড়ে কয়টা মাথা?’

    ‘তা হলে আমাকে এখন কী করতে বলেন?’ অসহায় হয়ে বলল জ্যাকি। ‘কিছুই করব না?’

    ‘আমরা অবশ্যই তদন্ত করব,’ বলল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড, ‘সাফ করা হবে ভিডিয়ো। হয়তো জাদু দেখাবে টেকনিশিয়ানরা।’

    ‘নিজে আমি কী করব?’ বলল জ্যাকি। ‘আছি মস্ত বিপদে! যখন-তখন খুন হব প্রমাণিত খুনির হাতে। আপনারা কি আমাকে পুলিশি নিরাপত্তা দেবেন, নাকি দেবেন না?’

    ‘এখনই তার প্রশ্ন উঠছে না, বলল ডিটেকটিভ, ‘আপনার কেস আপাতত আমরা নিচ্ছি না। পরে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হলে সেক্ষেত্রে আমরা আপনাকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেব।’

    ‘অর্থাৎ আপনারা আমার জন্যে কিছুই করবেন না।’

    চেয়ার ছেড়ে জ্যাকির সামনে থামল চিফ রিগবি। কঠোর চোখে দেখল ওকে। বুক পকেট থেকে কার্ড নিয়ে ধরিয়ে দিল ওর হাতে। ‘এখানে আমার ফোন নম্বর আছে। দরকার হলে আমাকে ফোন দেবেন।’

    ‘তার মানে, আমার ব্যাপারে কোন ধরনের দায়িত্ব আপনারা নিচ্ছেন না?’ কার্ড হাতে পুলিশ চিফকে দেখল জ্যাকি। বুঝে গেছে, আগের মতই রয়ে গেছে বিরাট বিপদে।

    ‘আপনি বরং এখন বাড়ি ফিরে যান, মিস,’ বলল চিফ রিগবি। ‘কারও সঙ্গে আলাপ করবেন না। শহর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আমরা পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

    সতেরো

    এখনও গ্লেনফেলে বেলা-হত্যার বিষয়ে কোন ধরনের সূত্র পায়নি রানা। চার্চ থেকে বেরিয়ে ঢুকল ফেমিন মিউযিয়ামে। ফাঁকা পড়ে আছে দর্শকহীন দালান। গ্যালারি বড়জোর গ্রামের পোস্ট অফিস বা বড় কোন দোকানের সমান। চারদেয়ালে কাঁচ দিয়ে ঢাকা কেবিনেটের ভেতরে নানান ধরনের প্রদর্শনী।

    এক এক করে ঘরের ডিসপ্লে দেখতে লাগল রানা। একটা কাঁচের কেবিনেটে আছে জার। ওটার ভেতরে স্বচ্ছ তরলে ডুবে আছে পিটোথোরা সংক্রমণে পচে যাওয়া আলু। আঠারো শ’ ছিচল্লিশ সালে এদিকের মানুষের প্রধান খাবার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গোটা দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল চরম দুর্ভিক্ষ। একটা ডিসপ্লের সামনে থেমে রানা দেখল, কাঁচের ওদিকে পেন্সিল দিয়ে আঁকা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ছবি। এরচেয়েও কষ্টকর ও ভয়াবহ চিত্রকর্ম আগেও দেখেছে রানা। উনিশ শ’ ছিচল্লিশে বাংলার বুকে যে চরম মন্বন্তর হয়েছিল, তখন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সেই দৃশ্য তুলে ধরেন তাঁর আঁকা ছবিতে।

    একটু এগোতেই গ্লাস কেসের ভেতরে সাদা-কালো এক ছবি দেখল রানা। উনিশ শ’ বাইশ সালে মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষের হাড়গোড়। তিক্ত চেহারায় গর্তের ধারে কোদাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে ক’জন। ছোট কিছু ছবিতে আছে ক্লোযআপ দৃশ্য। একটাতে রানা দেখল, মুচড়ে যাওয়া এক শিশু। মৃত্যুর আগে প্রচণ্ড যন্ত্রণা সয়েছে বেচারি।

    ছবির নিচে ক্যাপশনে লেখা: দেশের শত শত গণকবরের মাত্র একটি গ্লেনফেলের এই সমাধি। তখন আয়ারল্যাণ্ডে মারা পড়ে কমপক্ষে উনিশ লাখ মানুষ। স্কিবারিনের গণকবরে একই সঙ্গে মেলে বারো হাজার লাশ। দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে বাড়িয়ে কিছু বলেনি বেলা, নতুন করে আবারও উপলব্ধি করল রানা। সবুজ এই দেশের মাটির নিচে আছে মানুষের হাজারো গণকবর।

    পাশের কেবিনেটে উল্লেখ করা হয়েছে, দুর্ভিক্ষ পরবর্তী কয়েক বছর খাবারের চরম অভাব দেখতে হয়েছে আইরিশদের। ভাড়া দিতে পারেনি বলে ইংরেজ জমিদার তাদের প্রজাদেরকে আর্কটিকের হাড়কাঁপা শীতে ঝাড়ি থেকে উৎখাত করত। যেটা আসলে ছিল মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মত একটি সিদ্ধান্ত। কিছুই করার ছিল না আইরিশদের। বউ-বাচ্চা নিয়ে অসহায় মানুষগুলোকে মরতে হতো প্রচণ্ড শীতে।

    আরেক স্ট্যাণ্ডে আছে প্রাগৈতিহাসিক যন্ত্রপাতি। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ওগুলো দিয়ে চাষ করত আইরিশ কৃষকেরা। কোদালের কাঠের শাফট দেখে রানা বুঝতে পারল, হাতের ত্বকের ঘষায় ক্ষয়ে গেছে ওটা। অসহায় চাষী তাদের পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও ফসলের বড় অংশ চলে যেত ইংরেজ জমিদারদের হাতে।

    পরের ডিসপ্লেতে কাঠের সামুদ্রিক জাহাজের প্রতিকৃতি। আঠারো শ’ চল্লিশের দশকে নতুন দুনিয়ায় পাড়ি দিতে গিয়ে বাড়ি ছেড়েছে হাজার হাজার আইরিশ। অবশ্য তারা ছিল সৌভাগ্যবান। কফিন শিপ বা ইংরেজদের তৈরি জাহাজের ডেকের নিচে গাদাগাদি করে বাস করত। পরিবেশ ছিল নরকের মত। নিয়মিত খুনোখুনি ও বর্ষণ ছিল খুব স্বাভাবিক বিষয়। প্রতিনিয়ত সঙ্গী ছিল ভয়ঙ্কর সব সংক্রামক রোগ। যারা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পৌঁছাবার পথে মরত, তারাও জানত দেশে যে পরিবেশ, তাতে সাগরে মৃত্যু তাদের জন্যে হবে রীতিমত আকর্ষণীয়।

    ফাদার ও-সুলিভান বলেছেন জাদুঘর ছোট, তবে এখানে না এলে রানা বুঝত না কী পরিবেশে মৃত্যুবরণ করেছে মানুষগুলো। জাদুঘর থেকে বেরিয়ে রানা ভাবল, ম্যালাচি চার্চে আসলে কী ধরনের তথ্য আবিষ্কার করেছিল বেলা? কেন সেটার জন্যে মরতে হলো ওকে?

    ছোট এক বাজার পার হওয়ার সময় থমকে দাঁড়াল রানা। ওর চোখ পড়েছে ‘ফি বি’স সারপ্লাস’ লেখা এক সাইনবোর্ডের ওপরে। পেছনে বড় একটা ঘর। জানালায় ঝুলছে ‘ওপেন’ লেখা নোটিশ। দরজার ওদিকে মেঝেতে স্তূপ হয়ে আছে আমেরিকান ও ব্রিটিশ আর্মির রুকস্যাক ও হ্যাভারস্যাক। এ-ছাড়া আছে পশ্চিম জার্মানির আর্মির ব্যবহৃত পঞ্চাশ বা ষাট দশকের নানান ধরনের কিট।

    একটা জানালা দিয়ে পছন্দমত এক ব্যাগ দেখে দোকানে ঢুকল রানা। ঘরে ক্যানভাস, মোম ও তেলের গন্ধ। ফোল্ডিং কোদাল থেকে শুরু করে তাঁবুর খুঁটি—কী নেই দোকানে!

    ‘দোকান বন্ধ করে দিচ্ছি,’ কাউন্টারের পেছন থেকে বলল বয়স্ক একলোক। রানা ধারণা করল, এই ভালুকটাই ফিলবি। চোখে তার বুল ডগের মত সন্দেহের দৃষ্টি। যদিও রানা তার নাকের কাছে দুটো বিশ ইউরোর নোট ধরতেই সহজ হয়ে গেল তার চাহনি।

    ‘আমি এটা কিনতে চাই।’ হাতে নিয়ে কাছ থেকে ‘ব্যাগ দেখল রানা। পুরনো হলেও ওটা বেশ মজবুত। ব্যবহার করা যাবে আরও বহু দিন। দুটো বিশ ইউরো ফিলবির হাতে ধরিয়ে দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল রানা। কাঁধে ঝুলছে পছন্দমত ব্যাগ। একবার দেখে নিল হাতঘড়ি: সন্ধ্যা ছয়টা তেরো মিনিট। ড্রিঙ্ক করার জন্যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর গলা। আর্মির মালামালে ভরা দোকান থেকে কয়েক বাড়ি দূরেই পাব। ওটার ভেতরে গিজগিজ করছে মানুষ।

    বার-এ ঢুকে নানান ব্র্যাণ্ডের আইরিশ উইস্কির বোতলে গিয়ে পড়ল রানার চোখ। একপাশে বিয়ারের কল।

    ‘কী দেব?’ হাসিমুখে জানতে চাইল বারম্যান। ‘মিনারেল ওঅটর,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।

    ওকে হতাশ চোখে দেখল বারম্যান। ‘পানির সঙ্গে বরফের কুচি দেব, নাকি লেবু?’

    ‘শুধু পানি।’

    পানির বোতল হাতে বিয়ার গার্ডেনে ঢুকে কাঠের এক বেঞ্চিতে বসে পড়ল রানা। পানিতে চুমুক দিয়ে ভাবল: এবার? এখন কী করব? হাতে তো কোন সূত্র নেই!

    হতাশ হয়ে চুপ করে বসে থাকল রানা। একটু দূরের টেবিলে বিয়ার হাতে গল্প করছে দুই যুবক আর তাদের দুই বান্ধবী। বয়স হবে বিশ থেকে পঁচিশ। সবার সামনে যে পরিমাণ বিয়ারের খালি বোতল দেখতে পেল রানা, তাতে ওর মনে হলো এরই ভেতরে মাতাল হয়ে গেছে তারা। দুই যুবকের একজনের কাঁধ বেশ চওড়া। দশাসই গর্দান। পাশে সোনালি চুলের তরুণী মেয়েটাকে নিজের ব্যাপারে গর্ব করে গল্প শোনাচ্ছে। মেয়েটার চোখে-মুখে অস্বস্তি।

    এ-ধরনের হামবড়া টাইপের যুবক দেখলে অন্তর থেকে অপছন্দ করে রানা। আনমনে ভাবল, ‘যাক গে, আমার কী! আবার ডুবে গেল ভাবনার গভীরে। একটু পর বের করল বেলার দুই ফোন। প্রিপেইড স্যামসাং দিয়ে রিডায়াল করল লণ্ডনের সেই নম্বরে। আগেরবার কেউ কল না ধরলেও এবার পাঁচবার রিং হওয়ার পর ওদিক থেকে বলল কেউ, ‘গ্রেগ কার্সটি বলছি।’

    পাশের টেবিলের দিকে পিঠ দিয়ে চু স্বরে বলল রানা, ‘মিস্টার কার্সটি, যোগাযোগ করেছি বেলার তরফ থেকে।

    অচেনা কণ্ঠস্বর শুনে সন্দেহের ছাপ পড়ল লোকটার গলায়, ‘ইয়ে… ঠিক আছে। তো কী বলতে চান?’

    ‘আপনি কি বেলাকে চিনতেন?’ জানতে চাইল রানা।

    ‘ইয়ে… হ্যাঁ। ওকে ভাল করেই চিনি। মাফ করবেন, আপনি আসলে কে?’

    ‘আমার নাম পল জ্যাডেন। বেলার বন্ধু ছিলাম।

    ‘ছিলাম মানে?’ বিস্ময়ের সুরে জানতে চাইল লোকটা।

    ‘বেলা মারা গেছে,’ বলল রানা, ‘দয়া করে ফোন রেখে দেবেন না। আমি মজা করছি না। গতকাল গ্যালওয়েতে খুন হয়েছে বেলা। আপনি বোধহয় টিভি-সংবাদ দেখেন না। কার্সটি, অনলাইনে গেলে সবই জানতে পারবেন।’

    ‘হায়, ঈশ্বর!’ আঁৎকে উঠল কার্সটি। ‘আমি তো ভাবতেও পারিনি! মাত্র দু’দিন আগে ওর সঙ্গে…’

    ‘জানি। আপনি তখন ওর সঙ্গে কী আলাপ করেছেন?’

    ‘আপনি নিজের নাম কী যেন বললেন? জ্যাডেন? আপনি কি পুলিশের লোক?’

    ‘না, পুলিশ নই। বেলাকে পছন্দ করতাম। আর সেজন্যে খুঁজে বের করতে চাই ওর খুনিদেরকে। আপনি নিজেও হয়তো আছেন বিপদে। দয়া করে ফোন রেখে দেবেন না।’

    ‘কী ধরনের বিপদ?’ কাঁপা গলায় জানতে চাইল কার্সটি।

    ‘আপনি একই দিনে দুবার কথা বলেন বেলার সঙ্গে। বেলা আপনাকে ফোন করেছিল তিনটে একচল্লিশ মিনিটে। এরপর দু’ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর পাল্টা ফোন করেন আপনি। কথা বলেন তিন মিনিটের কম। আমি জানতে চাই, কেন বেলার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। এ-তথ্য হয়তো রক্ষা করবে আপনাকে।

    ‘তথ্যের জন্যে ফোন করে বেলা,’ ভয় পেয়ে হড়বড় করে বলল কার্সটি। পরে ফোন করেছি জরুরি কিছু খবর দেয়ার জন্যে। আসলে… ওকে বলেছি রিসার্চের বিষয়ে এরবেশি আর কিছুই জানি না। … শপথ করে বলতে পারি।’

    ‘তথ্য দেয়া-নেয়ার ব্যবসা আছে আপনার, তা-ই না?’ বলল রানা, ‘কী ধরনের তথ্য বেলাকে দিয়েছিলেন?’

    ‘বেলা একটা ফোন নম্বর চেয়েছিল। আর কিছু না।’

    ‘কী ধরনের ফোন নম্বর?’

    ‘মোবাইল ফোন নম্বর।’

    ‘ওটা কি আমেরিকার?’

    ‘হ্যাঁ। ওকলাহোমার। টুলসার।’

    ‘বলতে থাকুন, কার্সটি। কিছু গোপন করবেন না। ফোন নম্বরটা কার?’

    সে-কথা আমি বলতে পারব না…’

    ‘এটা তো খুব সহজ একটা প্রশ্ন,’ বলল রানা, ‘ওই ফোন আসলে কার?’

    দ্বিধা কাটিয়ে আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল কার্সটি, ‘অ্যারন কনারের।’

    ‘অ্যারন কনার আসলে কে?’

    ‘টুলসার মেয়র।’

    আবারও টুলসার মেয়র? -ভাবল রানা। ‘তার নম্বর পাওয়ার জন্যে আপনাকে কত দিয়েছিল বেলা?’

    একহাজার পাউণ্ড,’ বলল কার্সটি, ‘নম্বর পাওয়ার জন্যে আমাকে বেশকিছু টাকা খরচ করতে হয়। তাই এত বেশি টাকা লাগে।’

    ‘আপনাকে যোগ্য লোক বলেই মনে হচ্ছে,’ বলল রানা। ‘এবার বলুন, কার্সটি, আপনার মত একজনকে কী কারণে একহাজার পাউণ্ড দিল বেলা? টুলসার মেয়রের ফোন নম্বর পেলে ওর কী লাভ? আমার মনে হচ্ছে বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

    ‘শুনুন, মিস্টার, বেলা আমাকে কিছুই বলেনি। জানি না কেন এত টাকা খরচ করল। তথ্য দেয়ার বদলে আমি পাল্টা প্রশ্ন করি না। আমার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল বেলার।’ বড় করে শ্বাস নিল কার্সটি। ‘হায়, যিশু! শুনুন, এরই ভেতরে অনেক কিছু বলে ফেলেছি। আর কিছু বলার নেই। বেলা যারা গেছে জেনে খারাপ লাগছে। ভাল ক্লায়েন্ট ছিল সে। এবার ফোন রেখে দিচ্ছি। দয়া করে আর কখনও আমাকে ফোন দেবেন না।’

    কার্সটি লাইন কেটে দেয়ার পর কল হিস্ট্রি দেখল রানা। মারা যাওয়ার দু’দিন আগে বিকেলে আমেরিকার এক মোবাইল ফোনে কথা বলেছে বেলা। আয়ারল্যাণ্ড থেকে পুরো ছয়ঘণ্টা পেছনে ওকলাহোমা। কার্সটির কথা সত্যি হলে বেলা বোধহয় তৃতীয় কলের সময় কথা বলে টুলসার মেয়র কনারের সঙ্গে। কিন্তু এত সময় ধরে কী আলাপ করেছিল বেলা?

    ব্যস্ত শহর টুলসা। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মেয়র অ্যারন কনার। শেষ সকালে হঠাৎ ব্যক্তিগত ফোনে কল করল ব্রিটিশ এক সাংবাদিক। সেক্ষেত্রে মেয়র যে পর্যায়ের মানুষ, তার তো দেরি না করে ফোন রেখে দেয়ার কথা। তা হলে অচেনা এক মেয়েকে কী কারণে এতটা সময় দিল সে?

    নানান সম্ভাবনা নিয়ে ভাবছে রানা।

    স্টার্লিংফোর্ড। আয়ারল্যাণ্ড। বায়ার্ন। টুলসা…

    কিন্তু কোন তথ্যের সঙ্গে অন্যটা জোড়া দেয়া যাচ্ছে না।

    এবার কী করবে ভাবতে শুরু করেছে রানা, এমন সময় পাশের টেবিল থেকে এল উঁচু গলার বিতণ্ডা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদিকে তাকাল ও। বান্ধবীর দিকে লালচে চেহারায় চেয়ে আছে গর্দানওয়ালা যুবক। টেবিলে রেখেছে আনারসের মত মস্ত দুই মুঠো। ‘হারামজাদী মাগী!’ হুঙ্কার ছাড়ল সে, ‘আজ তোর আর রেহাই নেই! কুত্তী কোথাকার!’ ধীরগতিতে বান্ধবীর মাথার চুল খামচে ধরতে গেল যুবক।

    তখনই ঘটল দুটো ঘটনা।

    এক: বয়ফ্রেণ্ড মারধর করবে ভেবে মুখ কুঁচকে ফেলল তার বান্ধবী।

    দুই: অনিচ্ছাকৃতভাবে মেয়েটার হাতে লেগে উল্টে গেল গ্লাস। ছলাৎ করে বিয়ার পড়ল বয়ফ্রেণ্ডের আইফোনের ওপরে।

    ‘হারামজাদী মাগী, দেখ, কী করলি তুই!’ বিস্ফারিত চোখে বিয়ারে ভেজা আইফোন দেখছে যুবক। ‘হাতে নে আমার ফোন! গায়ের কাপড় দিয়ে ভাল করে পরিষ্কার কর্! যন্ত্রটা নষ্ট হয়ে থাকলে এক থাবায় মটকে দেব তোর ঘাড়!’

    ‘নিজেই তুলে নাও,’ পাল্টা চেঁচাল মেয়েটা। ‘অমানুষ!’

    মনে মনে তরুণীকে বাহবা দিল রানা।

    ঝট করে ডানহাতের মুঠোয় মেয়েটার মাথার চুল পেঁচিয়ে নিল যুবক। বেচারির মুখটা নামিয়ে আনতে চাইছে টেবিলের ওপরে। ‘এইবার দেখ, মাগী, মজা কেমন লাগে!’

    চুলে টান খেয়ে চিৎকার জুড়েছে তরুণী। যাতে ছেড়ে দেয়া হয় তার সঙ্গিনীকে, সেজন্যে প্রতিবাদ করল দ্বিতীয় মেয়েটা।

    তার বয়ফ্রেণ্ড কড়া গলায় ধমক দিল তাকে, ‘তোমার মুখটা একদম বন্ধ রাখো!’

    দাঁত বের করে হাসতে হাসতে নিজের বান্ধবীর মাথার চুল ধরে আরও জোরে নিচে টান দিল ষাঁড়।

    আরেক ঢোক পানি খেয়ে গ্লাস টেবিলে রেখে পাশের টেবিলের সামনে গেল রানা। নরম সুরে বলল, ‘খুব মজা লাগছে অসহায় এক মেয়েকে শায়েস্তা করতে পেরে?’

    জবাবের অপেক্ষা না করে ডান পা তুলে টেবিলে রাখা আইফোনের ওপরে ঠাস্ করে নামাল রানা। চুরচুর হয়ে ভাঙল ডিভাইসের পুরু কাঁচ। পায়ের পাতা দিয়ে ঠেলে মাটিতে ফেলে দিল আইফোন। পরক্ষণে ধুপ করে ওর বুট নামল ওটার ওপরে। বিধ্বস্ত ডিভাইসের দিকে না চেয়েই বলল রানা, ‘এবার ওকে ছেড়ে দাও। তোমার আইফোন আর নেই যে মাটি থেকে তুলবে।’

    তরুণীর চুল পেঁচিয়ে ধরে বিস্মিত চোখে রানাকে দেখছে যুবক। ‘কেন ভাঙলি আমার আইফোন?’

    ‘মিটিয়ে দিলাম সব ঝগড়া,’ বলল রানা, ‘এবার ছাড়ো মেয়েটাকে। ওকে ব্যথা দিচ্ছ। তৃতীয়বার কিন্তু মুখে কিছু বলব না।’

    বিয়ার গার্ডেনে ক’জন চেয়ে আছে এই টেবিলের দিকে। রানা আরও কিছু বলার আগেই হঠাৎ ওর টেবিলে বাজল বেলার নোকিয়া। অবশ্য এখন কল রিসিভ করতে পারবে না ও।

    ‘তোকে ভর্তা করে দেব, শালা বাদামি কুত্তা!’ হুঙ্কার ছাড়ল যুবক। বান্ধবীর চুল থেকে টেনে নিল মুঠো। বেঞ্চি থেকে ঝট্ করে উঠে দাঁড়াল। দৈর্ঘ্যে সে রানার চেয়ে তিন ইঞ্চি উঁচু।

    মারপিটে যোগ দেবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছে তার বন্ধু

    রক্তলাল চোখে রানাকে দেখছে ষাঁড়।

    বিয়ার গিলে মাতাল হয়ে গেছে এরা, টের পেল রানা। দু’বন্ধুর মধ্যে মারপিটে অভ্যস্ত হচ্ছে ষাঁড়। একমেয়ের ওপরে নির্যাতন করে হয়ে উঠেছে মস্তবড় বীর।

    বিসিআই-এর কয়েকজন মেয়ে এজেন্টের কথা মনে পড়ল রানার। ওরা মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে শুইয়ে দেবে বোকা ষাঁড়টাকে। সে জানেও না যে আজ ফুরিয়ে গেছে ভাগ্যদেবীর সহায়তা।

    মুঠো পাকিয়ে কনুই পেছনে নিল ষাঁড়। রাগে খিঁচিয়ে রেখেছে বড় বড় হলদে দাঁত। শ্বাস নিচ্ছে ঝড়ের হাওয়ার মত। তার ঘুষিটা আসতে দেখে বিস্মিত রানা ভাবল: ব্যাটা কী করে এত ধীর হলো!

    নাক লক্ষ্য করে মন্থরগতি ঘুষি আসতেই সরে গিয়ে খপ করে যুবকের মুঠো ধরে মুচড়ে দিল রানা। কুড়মুড় শব্দে ফেটে গেল কার্টিলেজ। বিকট আর্তনাদ জুড়েছে ষাঁড়। তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে ঘাড় চেপে ধরে মুখটা টেবিলে ঠাস্ করে ফেলল রানা। এত জোরে নয় যে ফেটে যাবে নাকের হাড় ও দাঁত। অবশ্য থ্যাপ করে যে শব্দটা হলো, তাতে রানা বুঝল আগামী দু’সপ্তাহ নাক-মুখের ব্যথায় বিছানায় শুয়ে কাঁদবে ষাঁড়টা।

    পুরো একমিনিট তার মুখ টেবিলে চেপে ধরে রাখল রানা। এরপর বুঝে গেল, ফুরিয়ে গেছে ষাঁড়ের লড়াই করার শখ। হাত সরিয়ে নিতেই টেবিল থেকে কাত হয়ে মাটিতে পড়ল ষাঁড়। তার বন্ধু বিস্মিত চোখে দেখছে রানাকে। একবার দেখল বান্ধবীর দিকে, পরক্ষণে ঘুরেই একদৌড়ে পালিয়ে গেল।

    ‘তুমি ঠিক আছ তো?’ তরুণীর কাছে জিজ্ঞেস করল রানা।

    বিপদ কেটে যাওয়ায় মাথা দোলাল মেয়েটা। মাটিতে শুয়ে ম্যালেরিয়ার জ্বরে আক্রান্ত ভালুকের মত কোঁ-কোঁ করে কাতরাচ্ছে ষাঁড়।

    ‘ভবিষ্যতে ভাল কাউকে খুঁজে নিয়ো,’ মেয়েদুটোকে বলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে হয়তো ঠকতে হবে না।’

    বারকয়েক মাথা দোলাল মেয়েদুটো।

    বিয়ার গার্ডেনে অনেকে চেয়ে আছে এদিকে। হৈ-চৈ শুনে পাব থেকে বের হয়েছে কয়েকজন। সময় নষ্ট না করে নিজের টেবিলে ফিরে এল রানা। বেলার ফোন পকেটে পুরে কাঁধে ব্যাগ তুলে ঢকঢক করে গিলল গ্লাসের শেষ পানিটুকু। তারপর সহজ পায়ে চলল নিজের গাড়ির দিকে। ভিড় করা মানুষগুলো সরে গিয়ে পথ করে দিল।

    গার্ডারা আসার আগেই এলাকা ত্যাগ করবে, ভেবেছে রানা। কেন যেন আগের চেয়ে সুস্থির বোধ করছে।

    আঠারো

    টয়োটা প্রিমিয়োর ড্রাইভিং সিটে বসে দরজা বন্ধ করল রানা। বেলার নোকিয়া স্মার্টফোন চেক করতেই ইন-বক্সে পেল ভয়েস মেসেজ। আইরিশ সমাজের উঁচু পর্যায়ের মানুষদের সুরে ধীরে ধীরে কথা বলছেন তিনি: ‘এই মেসেজ বেলা ওয়েসের জন্যে। আমি সাধাভ ইউ. কেলি। আপনার কয়েক দিন আগে পাঠিয়ে দেয়া প্রশ্নের জবাবে বলছি: জী, আমার কাছেই আছে লেডি হলওয়ের ডায়েরি। দুঃখিত, অসুস্থতার কারণে আগে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি।’

    এই লোক আসলে কে, ভাবছে রানা।

    ‘আপনি রিসার্চের জন্যে ডায়েরি দেখতে চেয়েছেন,’ বলে চলেছেন ভদ্রলোক। ‘এবং আদতেই সেগুলোতে আছে জরুরি কিছু তথ্য। এমন কিছু বিষয়, যা প্রকাশ হোক সেটা আমি চাই না। আপনি যদি কথা দেন সবকিছু গোপন রাখবেন, সেক্ষেত্রে ডায়েরি দেখাতে আমার আপত্তি নেই। এটা জেনেও পড়তে চাইলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ভাল থাকুন।’

    ইনি গোপন রাখতে চান ডায়েরির কথা, ভাবল রানা। কিন্তু সেটা কেন করছেন? পাশের সিটে ফোন রেখে দেখতে পেল, সামনে দিয়ে গেল গার্ডাদের পেট্রল-কার। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে রেডিয়োতে কথা বলছে তাদের একজন।

    ঝামেলা এড়াতে প্রিমিয়ো স্টার্ট করে গ্লেনফেল থেকে বেরিয়ে এল রানা। মনে ঘুরছে গতকাল কটেজে বেলার উচ্চারিত কথাগুলো। আয়ারল্যাণ্ডে একজনের কাছে পাওয়া যাবে লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরি। কিন্তু তাতে এমন কী রয়ে গেছে, যেটা এত বছর পরেও গুরুত্বপূর্ণ? কী জানা আছে যে অতটা সতর্ক হয়ে কথা বলেছেন মি. কেলি?

    সন্ধ্যার পর কটেজে ফিরে নিজের স্মার্টফোনের মাধ্যমে অনলাইনে গেল রানা। সাধাভ ইউ, কেলি সম্পর্কে তেমন কিছু লেখা নেই ওয়েব-এ। দশবছর আগে ছিলেন ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের ইতিহাসের এমিরিটাস প্রফেসর। ছবিতে রানা দেখল শীর্ণ এক লোককে। ধূসর চুল ব্যাকব্রাশ করা। চোখে সোনার তারের ফ্রেমের চশমা। বেলার নোকিয়া থেকে ভদ্রলোকের নম্বর নিয়ে নিজের ফোন ব্যবহার করে কল দিল রানা। ক’বার রিং হওয়ার পর শুনতে পেল ভদ্রলোকের গলা, ‘সাধাভ ইউ, কেলি বলছি।’

    ‘প্রফেসর কেলি, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম মাসুদ রানা। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি বেলা ওয়েসের কারণে।’

    ‘লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরির বিষয়ে?’ জানতে চাইলেন ভদ্রলোক। ‘হ্যাঁ, কিছুদিন আগে বেলা ওয়েস আমার ফোনে মেসেজ দেন। তবে একটা কথা বুঝতে পারছি না, আপনি কেন তাঁর হয়ে কথা বলছেন? উনি কি কোন ঝামেলায় পড়ে গেছেন?

    ‘জী। নিজে থেকে আপনার সঙ্গে আর কখনও কথা বলবে না বেলা। কারণ গতকাল ওকে খুন করা হয়েছে।’

    নীরব থাকল লাইন। তারপর প্রফেসর বললেন, ‘খুন? আর আপনি… বেলা ওয়েসের একজন বন্ধু? অথবা আত্মীয়?’

    ‘বেলা আমার বান্ধবী ছিল না। মাত্র গতকাল পরিচয়। অবশ্য ওকে পছন্দ করতাম। ভাবতেও পারিনি এত নিষ্ঠুরভাবে ওকে খুন করা হবে।’

    ‘দুঃখজনক। এটা জেনে খুব খারাপ লাগছে।’

    ‘প্রফেসর কেলি, আমি বরং সরাসরি মূল বক্তব্যে আসি। আমার ধারণা: লেডি স্টার্লিংফোর্ডের বিষয়ে রিসার্চ করতে গিয়েই খুন হয়েছে বেলা। মেসেজে আপনি বলেছেন ডায়েরির ভেতরে গোপন এবং জরুরি কিছু তথ্য আছে। আর এ-বিষয়ে আপনার কাছ থেকে আরও কিছু জানতে চাই। যাতে খুঁজে বের করতে পারি বেলার খুনিকে।’

    ‘পুলিশ কি নিজেরা খুনের তদন্ত করছে না?’

    ‘তারা তাদের সাধ্যমত করছে,’ বলল রানা। ‘আমি নিজে আলাদাভাবে তদন্ত করব। প্রফেসর, যে-লোক খুন করেছে, সে জবাই করে গেছে বেলাকে। আমি একমাত্র মানুষ যে ওকে শেষবার জীবিত দেখেছি। তাই জানতে চাই, কেন বেলাকে এভাবে খুন করা হলো। সেজন্যে আপনার কাছে সহায়তা চাইছি। আপনি এমন কিছু জানেন, যে-কারণে খুন হয়েছে বেলা।’

    ‘আমি এতটা নিশ্চিত নই,’ বললেন প্রফেসর কেলি, ‘এক শ’ বছরেরও আগে হারিয়ে গিয়েছিল লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরি। বহু বছর পর এবারডেন হলে সেসব খুঁজে পাই। এরপর বারো বছর হলো ওগুলো আমার কাছেই আছে। তখন এ-দেশের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছিলাম। ডায়েরিগুলো এখন আছে আমার বাড়ির সিন্দুকে। আমি একাকী মানুষ, কালেকশন আগে কখনও কাউকে দেখাইনি। এত বছরে আর কেউ কখনও ডায়েরি দেখতেও চায়নি। তাই মনে হচ্ছে, ডায়েরির সঙ্গে মেয়েটার নৃশংস খুনের কোন সম্পর্ক নেই।’

    ‘কেউ একজন জেনে গেছে ইতিহাসের কোন রহস্য ভেদ করেছে বেলা। আর বিষয়টা চাপা দেয়ার জন্যেই খুন করা হয়েছে ওকে। বেলাকে কে খুন করাল, সেটা জানতে হলে ডায়েরি পড়ে দেখা আমার জন্যে জরুরি। আর সেসব আছে আপনার কাছে। প্রফেসর কেলি, আপনি ডায়েরি পড়তে দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারেন। তাতে হয়তো ধরা পড়বে খুনি।’

    চুপ করে আছেন প্রফেসর। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘কী যেন নাম বললেন আপনার?’

    ‘মাসুদ রানা।’

    কেটে গেল পুরো একমিনিট।

    ‘আপনি হয়তো সাহায্য করতে পারবেন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর এক খুনিকে গ্রেফতার করতে,’ বলল রানা, ‘কথা দিচ্ছি, একবার ডায়েরি দেখার পর আর কখনও আপনাকে বিরক্ত করব না। আপনি বললে যে-কোন জায়গায় গিয়ে দেখা করতে আপত্তি নেই। আমার জন্যে আপনার কোন ক্ষতি হবে না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারি।’

    কী যেন ভাবছেন প্রফেসর। শক্ত হাতে কানের সঙ্গে ফোন চেপে ধরে রেখেছে রানা।

    ‘বেশ,’ অবশেষে বললেন প্রফেসর, ‘আপনি আমার সঙ্গে দেখা করলে ডায়েরি পড়তে দেব। অবশ্য সেজন্যে আপনার আসতে হবে আমার বাড়িতে। আমি এখন আর দ্বীপ ছেড়ে কোথাও যাই না।’

    ‘কোন্ দ্বীপে আমাকে আসতে হবে, বলুন?’ জানতে চাইল রানা।

    ‘মেডেইরা।’

    ‘আপনার বাড়ির ঠিকানা দিন,’ বলল রানা।

    .

    বিমানে যেতে হবে মেডেইরার রাজধানী ফুনশাল-এ। ভোরে দু’ঘণ্টা ড্রাইভ করে আয়ারল্যাণ্ডের পুবে ডাবলিন এয়ারপোর্টে পৌছে যাবে, স্থির করেছে রানা। ইন্টারনেট ব্যবহার করে কেটে নিল পরদিন সকাল সাতটায় ফুনশাল যাওয়ার বিমানের টিকেট। রাত দশটার আগেই গুছিয়ে নিল ব্যাগ। পোশাক ছাড়া আর তেমন কিছুই নেয়নি রানা। হালকা ডিনার সেরে শুয়ে পড়ল এগারোটায়।

    কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে ভোরের আগে কটেজ থেকে বেরিয়ে এল। গাড়িতে চেপে যাওয়ার সময় কালো আকাশে ঝলমলে কোটি কোটি রঙিন নক্ষত্র দেখতে পেল রানা।

    দেড়ঘণ্টা পর পৌছে গেল ডাবলিনে। বিমানের জন্যে এয়ারপোর্টের ডিপারচার লাউঞ্জে বসে কফির কাপ হাতে অপেক্ষা করল রানা। গ্রামের বাড়ির ঠিকানা বলার পর কীভাবে ওখানে যাওয়া যাবে, সেটা জানিয়ে দিয়েছেন প্রফেসর কেলি। ফোন রেখে দেয়ার আগে বলেছেন অদ্ভুত এক কথা।

    ‘সন্ধ্যার আঁধার নামার আগে হাজির হবেন না। আমি দিনের আলোয় কোন মানুষের সঙ্গে দেখা করি না।’

    লোকটা কি আসলে ভ্যাম্পায়ার নাকি? আনমনে হেসেছে রানা। জীবনে নানান ধরনের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে ওর। তাদের কেউ কেউ দিনে ঘুমিয়ে জেগে থাকে রাতে। মেডেইরায় সন্ধ্যা হবে দশটায়, সুতরাং তার আগে দেখা মিলবে না প্রফেসরের।

    উনিশ

    মাঝ সকালে বিমানে চেপে ডাবলিন থেকে পাঁচ শ’ মাইল দূরে পৌছে গেল রানা। নিচে দেখতে পেল আয়ারল্যাণ্ডের ঘন সবুজ বনভূমি। এরপর বিমান উড়ে গেল গাঢ় নীল সাগর ও আদিম ছোট সব সৈকতের ওপর দিয়ে। জায়গায় জায়গায় সাগর থেকে হঠাৎ করেই আকাশে নাক তুলেছে কালো রুক্ষ ক্লিফ। সেগুলো ঘিরে নেচে চলেছে সফেদ ঢেউয়ের ফেনা। মেডেইরা দ্বীপের প্রধান বন্দরে গিজগিজ করছে হাজারো বোট। সেগুলোর মাঝে রাজরানির মত সোনালি রোদে ঝলমল করছে সাদা রঙের ক্রু লাইনার।

    বিমানের ডিম্বাকৃতি জানালা দিয়ে কুয়াশাভরা পর্বত ও সেগুলোর মাঝে সবুজ উপত্যকা দেখছে রানা। একদিকে খাড়া কালো ক্লিফ, অন্যদিকে বিস্তৃত নীল সাগর-মাঝে যেন ঘাপটি মেরে বসে আছে মেডেইরা এয়ারপোর্ট। সাগরে প্রকাণ্ড সব কংক্রিটের পিলারে ভর করে সামনে গেছে রানওয়ে। ‘অত্যন্ত দক্ষ পাইলট না হলে কেউ সাহস পাবে না ওখানে নেমে যেতে।

    পৌনে একঘণ্টা পর ছোট্ট এয়ারপোর্ট টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে শুকিয়ে গেল রানার বুক। প্রচণ্ড গরমে দাউ-দাউ করে যেন জ্বলছে চারপাশ। ইউরোকার রেন্টাল থেকে লাল রঙের দু’হাজার একুশ সালের ভিডাব্লিউ অ্যাটলাস ক্রস স্পোর্ট কার ভাড়া নিল রানা। গাড়ির পেছন সিটে ব্যাগ ও লেদার জ্যাকেট রেখে চালু করল এয়ার কণ্ডিশনার। তারপর ঝোড়ো বেগে রওনা হলো উত্তরদিকের পথ ধরে। ফুনশাল শহর এড়িয়ে এগিয়ে চলল দ্বীপের ঘন বনভূমি ও পাহাড়ি এলাকার দিকে। বহু দূরে কোথাও আছে প্রফেসর কেলির ভিলা।

    মেডেইরার প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। যদিও তা দেখার মত মন এখন নেই রানার। অরণ্য ও পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যাওয়া নির্জন পথে আরও গ্রাম্য এলাকার দিকে চলল ও। প্রফেসর কেলি দিনের আলোয় দেখা দেবেন না ভাবতেই একরাশ বিরক্তি জমল রানার মনে। সামনে বড় এক টিলার কোলে রেস্টুরেন্ট দেখে ওখানে থামল। উপত্যকার বহু ওপরে বাগানে বসে সেরে নিল স্থানীয় খাবার এস্পেটাডা দিয়ে। ওটা রোস্ট করা গরুর মাংস ও আলুর চিপ্‌। ওয়াইনের বদলে নিল পাহাড়ি বরফঠাণ্ডা পানি। বেশ কিছুক্ষণ দেখল নিচে সবুজ উপত্যকার অপূর্ব দৃশ্য। বারবার ওর মনে হলো একটা সিগারেট পেলে মন্দ হতো না। তবে বকা দিয়ে নিজের মনটাকে নিয়ন্ত্রণে আনল রানা।

    অ্যাটলাস ক্রস স্পোর্টস্ কারে উঠে আবার রওনা হলো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি নির্জন পথে। মাথার ওপরে থাকল গাছের ঘন পাতার সবুজ ছাউনি। একসময়ে ধীরে ধীরে শীতল হলো উত্তপ্ত দিন। সন্ধ্যার আগে আকাশে দেখা দিল বেগুনি ও নীলের খেলা। রানা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে প্রফেসর কেলির নির্জন ভিলার কাছে।

    ভদ্রলোকের বাড়ির সবচেয়ে কাছের গ্রাম চার মাইল দূরে। ভিলার চারপাশে সাদা রঙ করা উঁচু পাথুরে দেয়াল। ওটা বেয়ে উঠে গেছে নানান ধরনের লতাগুল্ম। চারদিকে ঝোপঝাড়। কিছুটা যাবার পর দুই পিলারের মাঝে বড় এক গেটের সামনে গাড়ি রাখল রানা। প্রকাণ্ড গেট ভেতর থেকে বন্ধ। গাড়ি থেকে নেমে কোন হ্যাণ্ডেল বা হুড়কো দেখতে পেল না রানা। অবশ্য গেটের একদিকের পিলারে ঝুলছে ইন্টারকম বক্স। রানা বাটনে চাপ দিলেও ওদিক থেকে সাড়া দিল না কেউ। ইন্টারকম নষ্ট কি না ভাবতে শুরু করেছে, এমন সময় ক্লিক শব্দ হওয়ার পর রেইলের ওপরে সরসর করে সরে গেল গেট।

    গাড়ি নিয়ে উঠনে ঢুকে পড়ল রানা। ইউনিভার্সিটির বেশিরভাগ রিটায়ার্ড অধ্যাপকদের বাড়ির চেয়ে অনেক বেশি যত্ন নিয়ে নিজের ভিলা তৈরি করেছেন কেলি। তিনি যে শুধু ধনী তা নন, সিকিউরিটির ব্যাপারেও খুব সচেতন। অন্তত নানান ধরনের অ্যালার্ম সিস্টেম সেটাই প্রমাণ করছে। রানার গাড়ি ভেতরে ঢুকতেই পেছনে আটকে গেছে গেট।

    গাড়ি থেকে নেমে রানা বুঝল, আজ সন্ধ্যায় হ্রাস পেয়েছে দিনের তাপমাত্রা। পেছনের সিট থেকে লেদার জ্যাকেট নিয়ে ভিলার দরজার দিকে চলল ও। কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ। ভাল করেই জানে, ঝোপ থেকে ওর ওপরে চোখ রাখছে চারটে ক্যামেরা। ভিলা বেশ লম্বাটে ও নিচু। চারপাশ থেকে ওটাকে ঘিরে রেখেছে লতাগুল্ম ও ফুলের গাছ। সদর দরজা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই দুটো কেনেল। রানাকে আসতে দেখে ওগুলো থেকে বেরোল বিশাল দুই জার্মান শেফার্ড। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে চাপা গর্জন ছাড়ল তারা। সরাসরি ও-দুটোর চোখে চোখ রেখে সহজ পায়ে কেনেল পেরোল রানা। টের পেল, পেছন থেকে কঠোর চোখে ওকে দেখছে কুকুরগুলো। যে-কোন সময়ে পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর ওপরে।

    ভিলার দরজার পাশে আরেকটা ইন্টারকম বক্স। স্পিকারে রানা শুনল আইরিশ সুরে মার্জিত একটি কণ্ঠ: ‘দরজা খোলা। ভেতরে আসুন।’

    দরজা পেরিয়ে বড় এক হলওয়েতে পা রাখল রানা। পাথরের মেঝে মোজাইক করা। উঁচু জানালায় ঝুলছে ভারী সব পর্দা। সেগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকছে চাঁদের রুপালি জ্যোৎস্না। হলওয়ে ফুরিয়ে গেছে চওড়া এক করিডরে। ওটার দু’দিকে একটু পর পর টবে সাজানো আছে পাতাবাহার গাছ। দেয়ালে নানান চিত্রকর্ম। আবছা আলোয় ভালভাবে দেখা গেল না ওগুলো। প্রায়ান্ধকার করিডর বামে বাঁক নিতেই সামনে আধখোলা এক দরজা দেখতে পেল রানা।

    ঘরের ভেতরে জ্বলছে হলদেটে টিমটিমে আলো।

    ইন্টারকমের সেই পরিচিত কণ্ঠ জানালেন, ‘আমি এখানে। ঘরে ঢুকে পেছনে দরজা বন্ধ করে দিন।’

    ঘরে পা রেখে নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করল রানা। মস্ত এক টেবিলের ওপরে জ্বলছে ল্যাম্প। সেই মৃদু আলোয় রানা দেখতে পেল ঘরের চারদেয়ালে উঁচু বুকশেলফ। ওখানে আছে বোধহয় দুমূল্য সব অ্যান্টিক বই। ঘরের আসবাবপত্র বেশ পুরনো হলেও তা খুব দামি। একদিকে প্রায় অন্ধকার ছায়ার ভেতরে বড় এক চামড়ার উইং চেয়ারে রানার দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছেন কেউ। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘খুশি হলাম যে পথ খুঁজে আসতে পেরেছেন।’

    ‘আতিথ্য করার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,’ বলল রানা।

    চেয়ারের হাতলে ভর করে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর কেলি। এখনও রয়ে গেছেন ছায়ার ভেতরে। অস্পষ্ট আলোয় মানুষটার কালচে অবয়ব দেখছে রানা।

    ‘কেউ এলে ভাল লাগে, মিস্টার রানা। আমি নিজে নিঃসঙ্গ এই জীবন বেছে নিইনি। আমার আসলে কোন উপায় ছিল না।’

    প্রফেসর কেন এ-কথা বলেছেন, কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারল রানা। ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। তাঁর মুখ ভয়ঙ্করভাবে বিকৃত। রাতে তাঁকে দেখলে পিশাচ ভেবে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাবে সাধারণ মানুষ

    ‘আশা করি ঘাবড়ে যাননি,’ নরম সুরে বললেন প্রফেসর। ‘বেশ ক’বছর ধরেই আমাকে মেনে নিতে হয়েছে এই পরিণতি। এখন আর আয়নায় নিজেকে দেখি না।’

    তাঁর ফোস্কা ভরা কালচে মুখ জুড়ে নড়ছে রক্তাক্ত মাংসপেশি। এখন নাক বলতে কিছুই নেই। বদলে আছে বড় দুটো গর্ত। খসে পড়ছে চোখের চারপাশের আলগা কালো ত্বক। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কপাল ও করোটির লালচে হাড়। উইং চেয়ারের পিঠে যে হাতটা রেখেছেন, ওটা যেন হিংস্র কোন জন্তুর রক্তে ভরা থাবা।

    ‘স্কিন ক্যান্সার, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রফেসর, ‘এজন্যে এখন আর বাইরে যাই না। আমাকে ফোন করেও কেউ পায় না। আর সেজন্যেই বেলা ওয়েসের মেসেজের জবাব দিতে দেরি হয়েছে। কোন সপ্তাহ একটু ভাল থাকি। আবার কোন সপ্তাহে পড়ে থাকি বিছানায়। আপনার ভাগ্য ভাল যে আপাতত আমি একটু সুস্থ। এখন আর সূর্যের আলোয় বেরোতে পারি না। তাই রাত হয়ে গেছে আমার নিয়ত সঙ্গী। আপনার সঙ্গে দিনে দেখা করতে পারিনি বলে আমাকে ক্ষমা করবেন।’

    ‘আমি সত্যিই দুঃখিত, স্যর,’ বলল রানা। ‘আপনার এই রোগটা কি চিকিৎসাযোগ্য?’

    একসময় দেহের মাংস খসে পড়বে, আর তখন আমাকে কবরে শুইয়ে দেবে কেউ,’ তিক্ত হাসলেন প্রফেসর। ‘বলতে পারেন যে আমাকে চরম শাস্তি দিচ্ছেন ঈশ্বর। যদিও জ্ঞানত কখনও কারও ক্ষতি করিনি। যাই হোক, আপনি যদি আমাকে খুন করতে এসে থাকেন, তো অখুশি হব না। শুধু অনুরোধ করব, আমাকে যেন যন্ত্রণাহীনভাবে মেরে ফেলা হয়। ভাল মানুষ সেটাই করবে।’

    ‘আমি কেন আপনাকে খুন করব, স্যর?’ বলল রানা।

    ‘আমার মনে হয়েছে সেটা আপনি করতে পারেন,’ বললেন প্রফেসর। ‘আমি কিন্তু সেক্ষেত্রে খুশিই হব।’

    চুপ করে থাকল রানা।

    ‘বর্তমান দুনিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বলতে রয়ে গেছে শুধু ইন্টারনেট। আর ওটার মাধ্যমে জেনেছি, আপনি আসলে দুর্ধর্ষ এক অ্যাডভেঞ্চারার। বহু মানুষকে জঙ্গল, পাহাড় আর সাগর থেকে উদ্ধার করে এনেছেন। নামকরা শখের আর্কিওলজিস্ট। এ-ছাড়া খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আপনি ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের সঙ্গে জড়িত। আর তা-ই মনে হয়েছে, আপনি হয়তো আমাকে উদ্ধার করবেন কষ্টকর এই জীবন থেকে।’

    ‘আমি কাউকে খুন করতে আসিনি, স্যর,’ বলল রানা।

    ‘তা হলে বলুন, পুলিশ কি খুঁজে বের করেছে বেলা ওয়েসকে কারা খুন করল?’

    ‘আমার তা মনে হয় না।’

    ‘কী এক বাজে জগতে বাস করি আমরা,’ দুঃখিত সুরে বললেন প্রফেসর। মাথা নাড়লেন। ‘ড্রিঙ্ক কেবিনেট থেকে ড্রিঙ্ক নিতে পারেন। উইস্কি, ব্র্যাণ্ডি, ভোদকা বা…’

    ‘ধন্যবাদ, লাগবে না,’ বলল রানা।

    ‘বেশ, তবে আমাকেই বরং দিন উইস্কি? একদম কানায় কানায় গ্লাস ভরে দেবেন।

    মেঝেতে ব্যাগ রেখে কয়েক পা সরে ড্রিঙ্ক কেবিনেট খুলল রানা। স্বচ্ছ ক্রিস্টালের গ্লাস নিয়ে উইস্কির বোতল থেকে ওটার ভেতরে ঢালল সোনালি তরল। গ্লাস, ধরিয়ে দিল প্রফেসরের রক্তাক্ত ত্বকহীন হাতে। পানপাত্র ঠোঁটে তুললেন প্রফেসর। দু’ঢোকে শেষ করলেন উইস্কি। বড় করে ঢেকুর তুলে বললেন, ‘এখন আগের চেয়ে ভাল লাগছে। অথচ, একসময় এ-জিনিস ছুঁয়েও দেখতাম না। আজ এটা হয়ে গেছে স্বস্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়।’

    ‘ডায়েরির বিষয়ে কিছু বলবেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

    ‘আপনার পেছনে ডেস্কে পাবেন সব,’ বললেন প্রফেসর।

    ঘুরে রানা দেখল, টেবিলের ওপরে ধূসর চামড়া দিয়ে মোড়া কয়েকটা পুরনো খাতা। কুঁচকে গেছে ওগুলো।

    ‘এবারডেন হলের ধ্বংসস্তূপে পেয়েছি সবমিলিয়ে চারটে, ‘ বললেন প্রফেসর কেলি। ‘আজকালকার ডায়েরির মত নয়। বলতে পারেন চিঠি। বেশ কয়েক বছর ধরে লিখেছেন মিসেস স্টার্লিংফোর্ড। প্রথমটার শুরু আঠারো শ’ বেয়াল্লিশ সালে। তখন মাত্র কয়েক মাস হয়েছে বিয়ে করেছেন তাঁরা। বাস করছেন স্বামীর এস্টেটে। তাঁর শেষ ডায়েরি লেখা হয়েছে আয়ারল্যাণ্ডে আঠারো শ’ ঊনপঞ্চাশ সালে। মাঝের তিন বছরের ডায়েরি হারিয়ে গেছে। তবে এসবের ভেতরে পাবেন জরুরি কিছু তথ্য। দয়া করে সাবধানে পড়বেন। পৃষ্ঠা যেন ছিঁড়ে না যায়।’

    ‘বোধহয় নিয়ে গিয়ে আমাকে ওগুলো পড়তে দেবেন না?’ ওপরের হার্ডবাউণ্ড খাতা হাতে নিল রানা।

    ‘ঠিকই ধরেছেন। তবে সময় নিয়ে পড়তে পারবেন। যা জানতে চান, আশা করি সবই ওখানে পাবেন।’

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ৪৭১ : নরকের শহর
    Next Article মাসুদ রানা ৪৬৯ – কিলিং মিশন

    Related Articles

    কাজী মায়মুর হোসেন

    অদৃশ্য ঘাতক – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৬৮ – স্বর্ণলিপ্সা

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    ধাওয়া – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মৃত্যু উপত্যকা – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    খুনে ক্যানিয়ন – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৪৮ – মৃত্যুঘণ্টা

    July 25, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }