Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ৪৭০ – কালবেলা

    কাজী মায়মুর হোসেন এক পাতা গল্প433 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কালবেলা – ৪০ (মাসুদ রানা)

    চল্লিশ

    রাতে সর্বক্ষণ খোলা থাকে এমন এক গ্রিল হাউসের সামনে থামল রানা। মাত্র কয়েক ব্লক দূরেই ওল্ড ইয়েলার ইন। একটু পর খাবার কিনে গাড়ি নিয়ে চলে গেল মোটেলের উঠনে। ইচ্ছে করেই রুম নিয়েছে সদর দরজার কাছে।

    ভাল হোটেলে উঠলে বন্দুক ও হোল্ডঅল দেখে নানান প্রশ্ন তুলত হোটেল কর্তৃপক্ষ। ওল্ড ইয়েলার ইনে সে-ঝামেলা নেই। কারও চোখে না পড়েই জ্যাকিকে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে পড়ল রানা। মেয়েটাকে সোফায় বসতে ইশারা করে বিছানার পাশের মেঝেতে রাখল বন্দুক ও হোল্ডঅল।

    রানা খাবারের প্যাকেট খুলতেই পনির ও মেয়োনেসে ভরা বিশাল বার্গার আর প্রচুর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দেখে চেগিয়ে উঠল জ্যাকির খিদে। এ ছাড়া ওর জন্যে পাঁচ ক্যান বিয়ারও কিনে এনেছে রানা। নিজের জন্যে এক বোতল কোক।

    ‘আসলে মন্দ নয় মোটেলটা,’ বলল জ্যাকি। ‘যদিও স্বস্তি পাবে না কোন মেয়ে। সন্দেহের চোখে দেখল ডাবল বেড। ডেবে গেছে ওটার তোষক। ‘শোয়ার মত লম্বা সোফা তো দেখছি না!’

    ‘নেই, বলল রানা। ‘আমি মেঝেতে ঘুমাব।’

    কী যেন ভাবছে জ্যাকি।

    কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘খেয়ে নাও। খাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

    ছোট্ট টেবিলের দু’পাশের চেয়ারে বসল ওরা। চুপচাপ খেতে লাগল বার্গার ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। মিনিটখানেক পর জ্যাকি বলল, ‘ভাবতেও পারিনি যে এত খিদে লেগেছে।

    ‘বিপদ কেটে গেলে এমনটা হয়,’ বলল রানা।

    বিয়ারের ক্যান বাড়িয়ে দিল জ্যাকি। ‘নেবে না?’

    ‘গুরুর কড়া নিষেধ,’ বলল রানা। ওর মনের পর্দায় ফুটে উঠেছে মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের গম্ভীর মুখ। ‘আমি কোক নিচ্ছি।’

    ‘ঠিক আছে, ‘বলল জ্যাকি।

    ক্যানের মুখ খুলে কোকে চুমুক দিয়ে তিতকুটে হয়ে গেল রানার চেহারা। বিড়বিড় করে বলল, ‘না, এটা আমার জন্যে নয়!’ জ্যাকির হাতে বিয়ারের ক্যান দেখে ওর বুক চিরে এল মস্ত দীর্ঘশ্বাস।

    ‘বিয়ার নেবে না কেন?’ বলল জ্যাকি। ‘তুমি কি তা হলে একজন অ্যালকোহলিক?’

    সরাসরি প্রশ্নে থমকে গেছে রানা। ঘরের হলদে আলোয় সবুজ দেখাচ্ছে জ্যাকির মণি। ‘অ্যালকোহলিক না হলেও বেশ কিছু দিন ধরে ড্রিঙ্ক করেছি,’ বলল ও।

    ‘আমার মা অ্যালকোহলিক ছিল,’ নির্দ্বিধায় বলল জ্যাকি। ‘এ-ধরনের মানুষের সঙ্গে বাস করা কত কঠিন, সেটা জানি মা’র জীবনে সবচেয়ে প্রিয় ছিল টাকিলা আর বুরবন।’

    ‘আমার প্রিয় ছিল মল্ট উইস্কি,’ স্বীকার করল রানা।

    ‘কত দিন হলো ছেড়ে দিয়েছ?’

    ‘মাত্র কয়েক দিন।’

    ‘তোমার সামনে ড্রিঙ্ক করলে পাগল হয়ে উঠবে না তো?’

    ‘না, তা হব না।’

    ‘সারাদিন যা গেল, বিয়ার না পেলে মরেই যেতাম।’ আবার নীরবতা নামল ওদের মাঝে।

    একটু পর বলল রানা, ‘মা অ্যালকোহলিক। ওদিকে মারা গেছেন বাবা। তো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই তোমার?’

    মাথা নাড়ল জ্যাকি।

    খাবার শেষ করে টেবিল গুছিয়ে রাখল ওরা।

    মোটেলের উঠনে গেল রানা। গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে ভাইস নিয়ে ফিরল রুমে। যন্ত্রটা আটকে নিল টেবিলের ধারে। খুলে ফেলল কোমরের বেল্ট।

    ‘কী করছ?’ দ্বিতীয় বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিল জ্যাকি।

    মেঝে থেকে বন্দুক তুলে ব্যারেল খুলে নিল রানা। দৈর্ঘ্যে ওটা দু’ফুটের বেশি। ব্রিচে বেল্ট জড়িয়ে ব্যারেলে পেঁচাল বেল্টের শেষ অংশ। ইস্পাতের নলে এবার কেটে বসবে না ভাইসের দাঁত। ব্যারেল ঠিক জায়গায় রেখে গায়ের জোরে ভাইসে টাইট দিল ও। পরের কাজে মেলা শব্দ হবে, তাই ছেড়ে দিল রেডিয়ো। মিউয়িক চ্যানেলে বাজছে কান্ট্রি মিউযিক। রানা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমরা কি সর্বক্ষণ এসব বাজনাই শোনো?’

    ‘প্রমাণ হলো, তুমি এদিকের মানুষ নও,’ বলল জ্যাকি।

    ভাইসে রাখা ব্যারেলের ওপরে হ্যাকসও চালান রানা। সর্বনাশ হতে লাগল দুর্দান্ত এক স্পোর্টিং শটগানের। অস্ত্রটা দূরে লক্ষ্যভেদ না করলেও হয়ে উঠবে সত্যিকারের রায়ট গান। আইনের দৃষ্টিতে ওটার নল কেটে নেয়া বড় একটি অপরাধ। অবশ্য এসব নিয়ে ভাবছে না রানা।

    ‘আগেও এ-কাজ করেছ,’ কর্কশ শব্দে শিরশির করছে জ্যাকির দু’পাটি দাঁত।

    ‘দু’চারবার,’ স্বীকার করল রানা।

    ‘আজ কী জঘন্য একটা দিন পার করলাম,’ বলল জ্যাকি, ‘দু’জনকে গুলি করেছি। ধাওয়া করেছে আমাকে। কাঁধে গেঁথে দিয়েছে টেইযার। আরেকটু হলে কিডন্যাপ হতাম। আর এখন অদ্ভুত একজনের সঙ্গে বসে আছি, যে আসলে কোন্ দেশের মানুষ সেটাও আমি জানি না। সে আবার কান্ট্রি মিউযিক পছন্দ করে না। বিচ্ছিরি শব্দে কাটছে ভাল একটা বন্দুকের ব্যারেল।’

    ‘জাতে আমি বাঙালি, নাগরিক বাংলাদেশের,’ বলল রানা।

    ‘যদি বাঁচি, হয়তো ঘুরে আসব তোমাদের দেশ থেকে,’ বলল জ্যাকি।

    ‘সবুজ-শ্যামল-মায়াভরা একটা দেশ দেখতে পাবে, যার একটু পর পর বিশাল সব নদী। মুখ তুলে জ্যাকিকে দেখল রানা। তারপর আবারও শুরু করল হ্যাকসও চালানো।

    দশমিনিট পর কাটা পড়ল ব্যারেল। ডানহাত ব্যথা হয়ে গেছে রানার। হ্যাকসও টেবিলে নামিয়ে রাখল। রাঁদা দিয়ে মসৃণ করতে লাগল ব্যারেলের এবড়োখেবড়ো মুখ। কাজ শেষে টেবিলে থাকল পাউডারের মত ধাতব গুঁড়ো। চকচকে কাভারের এক সিনেমা ম্যাগাযিন টেবিল থেকে নিয়ে ওটার ওপরে জড় করে রাখল গুঁড়ো। একটু পর পত্রিকা গেল ওয়েস্ট বাস্কেটের ভেতরে। খাটো ব্যারেলটা বন্দুকে আটকে নিল রানা।

    দ্বিতীয় ক্যান শেষ করে পা থেকে জুতো খুলে বিছানায় আধশোয়া হলো জ্যাকি। হাতে বিয়ারের তৃতীয় ক্যান। ওটার মুখ খুলে চুমুক দিতেই একটা কথা মনে পড়ল ওর। ব্যাগ ঘেঁটে বের করল একটা সিরিঞ্জ। ভুরু কুঁচকে ওটা দেখে নিয়ে রানার কাছে জানতে চাইল, ‘বলো তো, আমার শরীরে কী মিশিয়ে দিতে চেয়েছে শয়তানটা?’

    বন্দুক টেবিলে রেখে বিছানার পাশে গেল রানা। জ্যাকির হাত থেকে নিয়ে সিরিঞ্জের বাঁকা নিড়ল খুলে টেবিলের ওপরে ফেলল দু’ফোঁটা তরল। আঙুলে সামান্য মেখে নিয়ে ওঁকে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘মনে হচ্ছে যোটেপিন। আগেও এই জিনিস দেখেছি।’

    ‘কী কাজ করে ওটা?’ একবার শিউরে উঠল জ্যাকি।

    ‘ফাস্ট-অ্যাক্টিং অ্যান্টিসাইকোটিক ও অ্যান্টিম্যানিক প্রডাক্ট। মার্কেট থেকে সরাবার আগে হাসপাতালে রেগে যাওয়া পাগলদেরকে দিতেন ডাক্তারেরা। একটা ডোয দিলে শান্ত হয়ে যেত উন্মাদেরা। এই যোটেপিন ব্যবহার করে মেয়েদেরকে অবশ করে ধর্ষণ করত নরপশুরা। এর আছে বাজে সাইড এফেক্ট। মাত্র ক’দিন শরীরে গেলে মগজ এমন হবে যে, মানুষটা হয়ে উঠবে জীবন্ত যোম্বির মত

    কুঁচকে গেছে জ্যাকির ভুরু। ‘কিডন্যাপারের কাছ থেকে পেয়ে ভেবেছিলাম প্রমাণ হিসেবে পুলিশকে দেখাব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে টয়লেটে ফেলে ফ্লাশ করে দেয়া উচিত।’

    এটা অন্য কাজেও লাগে,’ বলল রানা।

    ‘ওটা আমার কাছ থেকে দূরে রেখো।’

    ‘বেশ,’ নিডল আটকে টেবিলের ওপরে সিরিঞ্জ রাখল রানা। গিয়ে বসল বিছানার পাশে। জ্যাকিকে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যি করে বলো তো, তোমার এখন কেমন লাগছে?’

    ‘আগের চেয়ে ভাল,’ হাতের ক্যান তুলে দেখাল জ্যাকি। ‘যদিও বিয়ার গিলে এখন ঘুম পাচ্ছে।

    ‘তোমার বসের ব্যাপারে আমাকে জানাও।’

    ‘লিণ্ডা কনার?’

    মৃদু মাথা দোলাল রানা।

    ‘আমাদের মধ্যে বেশ খাতির আছে। তিনি ভাল একজন বস। যারা তাঁর হয়ে কাজ করে, তাদের খেয়াল রাখেন উনি কাজে আন্তরিক। যদিও স্বামীর দুর্ব্যবহারের জন্যে মন খারাপ থাকে তাঁর। আর কী বলব, বলো তো?’

    ‘স্বামী তাকে কতটুকু বিশ্বাস করে?’

    ‘তা জানি না। যদিও শপথ করে বলতে পারি, লিণ্ডার জানা নেই যে গোপনে কী করছে অ্যারন কনার।’

    ‘তুমি কি পুরো নিশ্চিত?’

    মাথা দোলাল জ্যাকি। ‘ওভার শিয়োর।’

    ‘ঠিক আছে।

    ‘আমি নিশ্চিত না হলে কী করতে?’ বলল জ্যাকি।

    ‘ভাবতাম মহিলা বহু কিছুই জানে। সেক্ষেত্রে তার কাছ থেকে জানতাম কোথায় আছে চোরাই অস্ত্রের ওয়্যারহাউস।’

    ‘অ্যারন কনারকে বিয়ে না করলে ভাল করতেন লিণ্ডা,’ বলল জ্যাকি। ‘স্বামী এফবিআই-এর হাতে গ্রেফতার হলে বুক ভেঙে যাবে তাঁর।’

    ‘অর্থাৎ, লি। এসবে জড়িত নয়। এবার বলো, কী জানো অ্যারন কনারের বাবা সম্পর্কে।’

    ‘বিগ রিয়ান?’

    ‘আগে কখনও তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?’

    বিয়ারের প্রভাবে সবুজ চোখ মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে জ্যাকির, হাই তুলল। ‘হ্যাঁ, একবার দেখা হয়েছিল। ছেলের সঙ্গে আমাদের অফিসে এসেছিল। বুড়ো লোকটার আচরণে আমরা সবাই ভয় পেয়েছিলাম।’

    ‘আমি তার ছবি দেখেছি,’ বলল রানা।

    ‘শ্বশুরকে ভয় পান লিণ্ডা। তাই যান না স্পিয়ারহেড র‍্যাঞ্চে। তা ছাড়া, তাঁর অ্যালার্জি আছে ঘোড়ায়। গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল জ্যাকি। ‘আমি অবশ্য ঘোড়া খুব পছন্দ করি।’

    তোমার বাবা নিশ্চয়ই শিখিয়েছেন ঘোড়ায় চড়তে?’

    ‘হুম,’ ঘুম-ঘুম চোখে হাসল জ্যাকি।

    মেয়েটা ঘুমাতে চাইছে বুঝেও জিজ্ঞেস করল রানা, ‘স্পিয়ারহেড নামে অ্যারনের বাবার অয়েল কোম্পানি ছিল।’

    ‘আগে অয়েল ফিল্ড সবই ছিল ইণ্ডিয়ান টেরিটোরিতে। গোটা রাজ্য ছিল তাদের। ইণ্ডিয়ান সংস্কৃতির বহু নাম চলে এসেছে আমাদের সমাজে। সুযোগ পেলেই সেটলারেরা চরম নিষ্ঠুরতা করেছে ইণ্ডিয়ানদের প্রতি।’

    ‘কখনও গেছ সেই র‍্যাঞ্চে?’

    মাথা নাড়ল জ্যাকি। ‘অবশ্য জানি ওটা কোথায়। কে-ই বা না জানে? শহরের পশ্চিমে বিশাল প্রেয়ারিতে।

    ওকলাহোমার সবই বড়, ভাবল রানা। হয়তো সেই র‍্যাঞ্চেই আছে অ্যারনের অস্ত্রের ওয়্যারহাউস। জানতে চাইল ও, ‘বিগ রিয়ান কি সেখানে একাই থাকে?

    ‘তা-ই তো জানি। বহু বছর আগে মারা গেছে তার স্ত্রী। তখন থেকেই একা।’ আবারও হাই তুলল জ্যাকি। নিচু গলায় বলল, ‘তুমি বিয়ে করোনি?’

    মাথা নাড়ল রানা।

    ‘আমিও না,’ বলল জ্যাকি। ‘যাকে ভালবেসেছি, তাকে আর পাইনি।’

    ‘কেন? কী হয়েছিল?’

    ‘বিমান দুর্ঘটনা। পরে কারও সঙ্গে জড়াতে আর মন চায়নি। বলতে পারো ভাল মনের কাউকে পাইনি।’ রানার চোখে তাকাল জ্যাকি। ‘বরং বলো তোমার কথা। পরিবারে কারা আছেন তোমার?’

    ‘আত্মীয়রা মারা গেছেন বহু বছর আগে,’ বলল রানা। ‘তাই পৃথিবীতে নিজের বলে আমার কেউ নেই।’

    ‘কখনও কাউকে পাশে পাওনি?’

    চুপ করে আছে রানা। মনে পড়েছে জেসিকার কথা।

    ‘জনির সঙ্গে তোমার অনেক মিল, বলল জ্যাকি। ‘যাকে আমি ভালবাসতাম।’

    ‘তা-ই?’ বলল রানা।

    ‘হ্যাঁ, বলল জ্যাকি, ‘ওর মণিদুটোও ছিল তোমার চোখের মত রহস্যময় অতল কালো সাগর। আগে জানতাম না, কারও চোখে চেয়ে পার করে দেয়া যায় পুরো একটা জীবন!’

    রানা হঠাৎ করেই বুঝল, জ্যাকি আসলে এখন বলছে ওর চোখের ব্যাপারে!

    খুকখুক করে কাশল জ্যাকি। পাশ ফিরে গায়ে টেনে নিল বেডশিট। ঘুমের ঘোরে বলল, ‘তুমি যেন আবার আমায় ফেলে কোথাও চলে যেয়ো না!’

    জ্যাকির শিথিল হাত থেকে অর্ধেক ভরা বিয়ারের ক্যান নিয়ে টেবিলের ওপরে রাখল রানা। সোফায় বসে ভাবল, এবার কী করা উচিত ওর?

    একচল্লিশ

    জ্যাকিকে বিয়ার গিলতে দেখে মরা কাঠের মত শুকিয়ে গেছে রানার গলা। কয়েকবার ভেবেছে, দু’ঢোক নিলে ক্ষতি কী! যদিও পরক্ষণে নিজেকে নিষেধ করেছে, ‘পা দেব না লোভের ফাঁদে!’ মনে ভেসে উঠেছে বিসিআই চিফের গম্ভীর চেহারা।

    ঘুমিয়ে পড়েছে জ্যাকি। রুমের বাতি নিভিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করল রানা। ভাবতে লাগল সারাদিনের ঘটনাগুলো নিয়ে। ডায়েরি অনুযায়ী আয়ারল্যাণ্ডের দুর্ভিক্ষের জন্যে সম্পূর্ণ দায় অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড আর তার সিনিয়র বন্ধু নরম্যান আর্চিবল্ডের। তারাই ল্যাবোরেটরিতে তৈরি করেছে আলুর গাছের মড়কের ব্যাকটেরিয়া। তাদের কারণে ভয়ঙ্কর করুণভাবে মারা গেছে কমপক্ষে বিশ লাখ মানুষ। এটা ভাবতে গেলে কেমন যেন অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

    একটু পর বাথরুমে ঢুকে বাতি জ্বেলে পকেট থেকে স্মার্টফোন নিল রানা। বসল পুরনো বাথটবের কিনারায়। ইন্টারনেটে সার্চ করল নরম্যান আর্চিবল্ডের জন্যে। এই নামে খুব কম মানুষই আছে দুনিয়ায়।

    ইন্টারনেটে কিছু তথ্য ছাড়া তার সম্পর্কে আর কিছুই নেই। তখনকার নামকরা এক বোটানিস্ট। শিক্ষকতা করত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। আঠারো শ’ ত্রিশ থেকে চল্লিশের দশকে কয়েকটি বই ও সায়েন্টিফিক পেপার প্রকাশ করেছিল। সেগুলোর বিষয়ে আগ্রহী হতে পারল না রানা। কিন্তু এরপর পেল ওয়েব সার্চে অন্যকিছু।

    তখনও পঞ্চাশ বছর হয়নি নরম্যান আর্চিবক্তের। আঠারো শ’ একান্ন সালের সেপ্টেম্বরের ছয় তারিখে ম্যাগডালেন কলেজে মৃত্যুবরণ করে নিজের রুমে। বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষের মত স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে মারা পড়েনি। পেছন থেকে গুলি করে ফুটো করা হয় তার মাথার খুলি। কোন পিস্তল ছিল না তার ঘরে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ঘোষণা করেন: নরম্যান আর্চিবল্ডের মৃত্যু আত্মহত্যা নয়। এবং কোন প্রমাণ রেখে যায়নি তার খুনি।

    বেলার বক্তব্য অনুযায়ী: আঠারো শত একান্ন সালে সেপ্টেম্বরের একুশ তারিখে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড। অর্থাৎ, নরম্যান আর্চিবল্ড খুন হওয়ার মাত্র পনেরো দিন পর মৃত্যু হয় তার।

    অক্সফোর্ড থেকে আয়ারল্যাণ্ডের গ্রামাঞ্চলে খবর যেতে তখন বোধহয় লাগত কমবেশি পনেরো দিন, ভাবল রানা। সেক্ষেত্রে এমনও হতে পারে, মার্চিবল্ড খুন হলে নিজেও খুন হবে সে-ভয়ে আত্মহত্যা করেছিল অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড। যদিও রানার ধারণা, এমন কাজ আসলে করেনি সে। অন্যভাবে হয়েছে তার মৃত্যু। হয়তো মাতাল ছিল। গায়ের ধাক্কা খেয়ে মোমদানী থেকে পড়ে গেছে জ্বলন্ত মোম। তাতে আগুন ধরেছে এবারডেন হলে।

    আর্চিবল্ডের জন্যে আবারও ওয়েবসাইট ঘাঁটতে লাগল রানা। কয়েক মিনিট পর পেল ঝাপসা এক ছবি। সে- আমলের আনুষ্ঠানিক পোশাক লোকটার পরনে। আঠারো শত পঁয়তাল্লিশ সালে ছবিটি তোলা হয়েছে একটি সায়েন্স কনভেনশনে। ছোটখাটো লোক সে। চোখে আইগ্লাস মাথাজুড়ে টাক। গালে নেমেছে চওড়া জুলফি। প্রফেসরকে ঘিরে রেখেছে একদল ছাত্র। সবার পরনে ওয়েস্ট কোটের ওপরে কালো সুট। আর্চিবল্ডের পেছনে দৈত্যের মত এক যুবক। ক্যামেরায় ছবি তুলতে গিয়ে অস্বস্তি বোধ করছিল। নিচের ক্যাপশনে চোখ বোলাল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, বিশাল লোকটাই অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড। আগে তার স্ত্রীর দেয়া বর্ণনা পড়লেও এই প্রথমবার তার ছবি দেখছে রানা। দম্ভ ফুটে বেরোচ্ছে তার চোখ-মুখ থেকে। দৈর্ঘ্যে বোধহয় কমপক্ষে ছয় ফুট সাত ইঞ্চি। শুধু যে দৈত্যের মত, তা নয়, তার ভেতরে আছে ভীষণ অশুভ কী যেন।

    কেন যেন শিরশির করে উঠল রানার মেরুদণ্ড।

    লর্ড অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড, পিকচার, আয়ারল্যাণ্ড লিখে সার্চ দিল ও। পেরোল কয়েক সেকেণ্ড, তারপর হঠাৎ করেই স্ক্রিনে ফুটে উঠল একটা ছবি। ওদিকে চেয়ে চমকে না গিয়ে পারল না রানা। অন্তত কয়েক মিনিট ধরে দেখল ঝাপসা ছবিটা।

    আঠারো শ’ চুয়াল্লিশ সালে এবারডেন হলে একদল অতিথির সঙ্গে ছবি তুলেছে অ্যাঙ্গাস। গম্ভীর সে। যেন গেছে কারও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে। সামনে তার স্ত্রী লেডি স্টার্লিংফোর্ড। রানার মনে হলো, বহুকাল ধরেই চেনে তাঁকে। প্রফেসর কেলি বলেছিলেন, মহিলা অপূর্ব সুন্দরী। যদিও সৌন্দর্যের পূর্ণ বর্ণনা তিনি দিতে পারেননি। ভদ্রমহিলার কাঁধে হাত রেখে অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ডের চেহারায় যেন ফুটে উঠেছে, স্ত্রীকে সম্পদ নয়, সম্পত্তি বলে মনে করে সে। তার কথার ওপরে কথা বলার কোন ধরনের অধিকার ছিল না জেনিফার হলওয়ের।

    ছবিতে পেছনে ইউনিফর্ম পরনে এবারডেন হলের কর্মচারীরা। কারও কারও বয়স তেরো-চোদ্দ। সবাই নার্ভাস। একদিকে টুইড স্যুট পরা ঢ্যাঙা একলোক। তাকে অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ডের কুচক্রী ম্যানসার্ভেন্ট বলে মনে হলো রানার। লেডির অনুরোধে ছবি তোলার জন্যে আস্তাবল থেকে আনা হয়েছে তাঁর ঘোড়াদুটোকে। লাগাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে দৈত্যের মত একজন। চোখে-মুখে কেমন আড়ষ্টতা।

    তাকে দেখে রানা বুঝল, এ-লোকই বায়ার্ন কনার।

    ডায়েরিতে লেডি লিখেছেন, বোকা ও বিশ্বস্ত ছিল পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী লোকটা। ষাঁড়ের মত শক্তিশালী। উচ্চতার দিক থেকে সে ছিল লর্ডের সমান।

    এই লোকই বায়ার্ন কনার, ভাবছে রানা। এর ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল বেলা। গ্লেনফেল গর্জায় গেছে প্যারিশ রেকর্ড ঘাঁটতে। রানার মনে আর কোন সন্দেহ থাকল না, এই একই ছবি দেখেছে মেয়েটা এবং এ-ছবিতেই আছে গূঢ় এক রহস্য।

    আস্তাবল রক্ষকের দিকে চেয়ে রইল রানা। একটু পর ওর চোখ পড়ল অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ডের মুখের ওপরে। রানার মনে বিদ্যুদ্বেগে খেলে গেল একটা দুরূহ চিন্তা। বুঝে গেছে, কী জেনে গিয়েছিল বেলা। একই কারণে এখন ও জানে, ডায়েরি হাতে পাওয়ার জন্যে কেন মরিয়া হয়ে গেছে অ্যারন কনার। এ-ও এখন পরিষ্কার, কেন খুন করা হয়েছে বেলা ওয়েসকে।

    মনে মনে ঝাঁকি খেয়েছে রানা। অন্তর ভরে গেছে ক্রোধ ও ক্ষোভে। সে-আমলে চরম অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও সত্যিটা ছিল আসলেই অকল্পনীয়। অনলাইনে আছে নিউ ইয়র্কের মেয়র অফিসের আর্কাইভে লাখ লাখ জন্ম ও মৃত্যুর সনদ। সাইটে ঢুকে আঠারো শত একান্ন সালে আয়ারল্যাণ্ড থেকে আসা মানুষগুলোর ‘এ’ থেকে ‘যেড’-এর নামের যে ক্রম দেয়া আছে, সেটা অনুযায়ী ‘বি’ অক্ষর দিয়ে সার্চ করল রানা। দশমিনিট পর বড় করে শ্বাস ফেলে ইন্টারনেট থেকে বেরিয়ে এসে পকেটে রেখে দিল ফোন। বাথরুমের বাতি নিভিয়ে চলে এল বেডরুমে।

    ঘুমের চটকা ভেঙে বালিশ থেকে মাথা তুলে ওকে দেখছে জ্যাকি। ‘কী হলো, তুমি ঘুমাবে না? আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ো।’

    ‘বলো তো, কটেজে আসলে সেই রাতে কী ঘটেছিল,’ বলল রানা।

    বেয়াল্লিশ

    এখন বাজে রাত একটা।

    একটু আগে আবারও ঘুমিয়ে গেছে জ্যাকি। ওর সঙ্গে কথা বলার পর তারাভরা রাতে, মোটেল থেকে বেরিয়ে এসেছে রানা। বেশ গরম পড়েছে আজ। ঘামে ভিজে গেছে ওর শার্টের পিঠ। মোটেলের কোন জানালাতেই কোন আলো নেই। থমথম করছে চারপাশ। দূরে টিভি দেখছে কেউ। আবছাভাবে এল প্রবল হাসির আওয়াজ। ছায়ার ভেতরে গার্বেজ ক্যানের কাছে ফোঁস ফোঁস করে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে চাইছে দুই বেড়াল। হাইওয়ে ধরে ঝোড়ো বেগে কোথায় যেন চলে গেল আঠারো চাকার এক ট্রাক।

    আনমনে ভাবল রানা: কবে শেষ হবে আমার এই পথচলা? ওর বুক চিরে এল দীর্ঘশ্বাস। পকেট থেকে স্মার্টফোন নিয়ে ডায়াল করল অ্যারন কনারের মোবাইল ফোনে। বেশ ক’বার বাজার পর কেটে গেল লাইন। কোন মেসেজ না দিয়ে আবারও কল করল রানা। ফলাফল আগের মতই। তৃতীয়বার ডায়াল করলে অবশ্য ওদিক থেকে এবার ধরল কে যেন।

    গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে ফিসফিস করে বলল বিরক্ত অ্যারন কনার, ‘কে তুমি! এত রাতে কী চাই?’

    ‘ভদ্রতার সঙ্গে কথা বলো,’ তাকে সতর্ক করল রানা, ‘নইলে ফোন রেখে দেব। আর সেক্ষেত্রে সকালে কল দেব তোমার স্ত্রীর কাছে। সে বোধহয় শুনতে চাইবে আমার কথা। বিশেষ করে যখন জানবে আইনের বাইরে গিয়ে কী করছ তুমি।’

    এবার মনোযোগ না দিয়ে পারল না অ্যারন কনার। চুপ করে আছে সে। স্পিকারে চাপা শ্বাস শুনছে রানা। ‘তুমি চাও না এত রাতে তোমার স্ত্রীকে ঘুম থেকে তুলি,’ বলল ও। ‘সেক্ষেত্রে অসংখ্য প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তোমাকে। সুতরাং লক্ষ্মী ছেলের মত বিছানা ছেড়ে নিচতলায় নেমে এসো। আরামদায়ক কোন চেয়ারে বসে মন দিয়ে শুনবে আমার কথা। তা হলে আমরা দু’জন ছাড়া আর কেউ কিছু জানবে না। আমার কথা বুঝতে পেরেছ, অ্যারন? আমি কিন্তু তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।’

    চাপা ঘোঁৎ শব্দ শুনল রানা। কাপড়ের খস খস আওয়াজ তুলে বিছানা থেকে নামল টুলসার মেয়র। মিনিট দেড়েক পর বলল, ‘জানি তুমি কে। তোমার ব্যাপারে সবই জেনেছি।’

    ‘তা-ই?’ বলল রানা। ‘আমি হচ্ছি তোমার পথে পড়ে থাকা ক্ষুরধার এক কাঁটা। এরই ভেতরে দোস্ত রিপার রিগবি মিশ্চয়ই তোমাকে বিরক্ত করতে শুরু করেছে? ওই যে, শপিং মলের দুর্ঘটনার জন্যে? তোমার বোধহয় উচিত তার মাসোহারা দ্বিগুণ করে দেয়া।’

    ‘তুমি আসলে কী চাও, রানা?’ রেগে গিয়ে বলল অ্যারন।

    ‘আমি কী চাই তা পরে বলছি,’ বলল রানা। ‘বরং তুমি বলো আসলে কত টাকা দিতে চাও।’

    ‘মাঝরাতে এজন্যে ঘুম ভাঙালে? নির্বোধ কোথাকার!’

    ‘শুনেছি চুক্তি করার সময় তুমি সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নাও,’ বলল রানা। এবারও বোধহয় তাতে ভুল হবে না।’

    ‘কী বলবে সেটা বলো,’ ক্লান্ত স্বরে বলল অ্যারন কনার।

    ‘আমার কাছে আছে তোমার জরুরি কিছু জিনিস। যেমন ধরো ঐতিহাসিক কয়েকটা ডায়েরি। আমি কি আরও বিস্তারিতভাবে খুলে বলব?’

    ‘বুঝতে পেরেছি। আর বলতে হবে না।’

    এই তো চট্ করে বুঝলে। ধুলোভরা ডায়েরি আমার কোন কাজে আসবে না। তাই তোমাকে সব দিয়ে দিতে চাই।’

    ‘বুঝতে পেরেছি। তুমি তা হলে ওগুলো বিক্রি করতে চাও।’

    ‘যে বেশি দেবে, তাকেই দেব। নিলামের প্রথম ডাক শুরু হচ্ছে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দিয়ে।’

    নাক দিয়ে ঘোঁৎ শব্দ করল অ্যারন। ‘তার মানে সবই তোমার জানা হয়ে গেছে?

    ‘আমি সব ফাঁস করে দিলে কী ঘটতে পারে, সেটা একবার ভেবে দেখেছ? শেষ হয়ে যাবে তোমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। অনেকে চাইবে তোমাকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে দিতে। যতই চেষ্টা করো, তোমাকে বাঁচাতে পারবে না তোমার দুই সাইকো চ্যালা লিয়াম বার্ব ও টনি স্ক্যালেস।

    ‘কিন্তু পুরনো ক’টা ডায়েরির জন্যে পাঁচ মিলিয়ন ডলার? নিলামে তুললে বড়জোর তুমি পাবে দশ হাজার।

    চুপ করে থাকল রানা। অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হওয়ার পর বলল, ‘বাজার যে বিক্রেতার, সেটা ভুলে যেয়ো না, অ্যারন। এক্ষেত্রে ক্রেতার কিছু করার নেই।’

    ‘তাতে কী! কেন এত টাকা দেব? আমি তো আড়াই মিলিয়ন ডলার দিয়েও ওগুলো কিনতে রাজি নই।’

    ‘তুমি দেবে, কারণ ভুল লোকের কাছে এসব ডায়েরি চলে গেলে মস্ত ক্ষতি হবে তোমার,’ বলল রানা। ‘তুমি ভাল করেই জানো কী বিষয়ে আমরা কথা বলছি। পাঁচ মিলিয়নের নিচে নিলামে ডাক দিতে পারবে না। আমার ধারণা: এর চেয়ে বেশি চেয়েছিল বেলা ওয়েস। আমি কি ভুল বললাম?’

    চুপ করে থাকল কনার।

    ‘আমি যে আসলে কত ভাল একজন মানুষ, সেটা এবার বুঝিয়ে দিচ্ছি: পাঁচ মিলিয়ন ডলারে বাড়তি পাবে জ্যাকুলিন সিলভেস্টারকে। তার ওপরে কটেজে তোমার, বার্ব আর স্ক্যালেসের যে ভিডিয়ো, সেটাও পাচ্ছ একদম বিনে পয়সায়। কেউ জানবে না যে তোমরাই খুন করেছ হিউবার্ট হ্যারল্ডকে। চুক্তিটা এখন তোমার কাছে কেমন বলে মনে হচ্ছে?’

    হতবাক হয়ে গেছে টুলসার মেয়র।

    হাসল রানা, ‘হ্যালো? আবার জ্ঞান হারালে না তো?’

    ‘আমি শুনছি,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল মেয়র কনার।

    ‘আমি চাই নগদ পাঁচ মিলিয়ন ডলার। আর সেটা দেবে আজ রাতেই। মালামাল বিনিময়ের পর আর কখনও আমাকে দেখতে পাবে না।

    ‘তুমি কি পাগল হলে? ভাল করেই জানো, এত টাকা কেউ কখনও নিজের বাড়িতে রাখে না। পাঁচ মিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে হলে আমার লাগবে অন্তত দু’দিন।’

    ‘বানাইপানাই বাদ দাও, অ্যারন। ক্লায়েন্টের কাছ থেকে কি ব্যাঙ্কের চেক নাও তুমি? সুতরাং আজ রাতেই হয় দেবে নগদ টাকা, অথবা টা-টা দিয়ে দেবে ডায়েরিগুলোকে।

    কিছুক্ষণ ভেবে বলল অ্যারন, ‘ঠিক আছে, রেগে যাওয়ার কিছু নেই। টাকা আমি দেব। তবে এরপর আবারও আমাকে বিরক্ত করতে চাইলে দুনিয়ার যেখানে যাও, খুন হবে আমার লোকের হাতে।’

    ‘তুমি জানো ভাল চুক্তি কীভাবে করতে হয়,’ বলল রানা। ‘এবার মন দিয়ে শোনো লেকের তীরে সেই কটেজে রাত সাড়ে তিনটের একা হাজির হবে। সঙ্গে ডলারে ভরা দুটো হোল্ডঅল। মেয়েটা আর ডায়েরি নিয়ে ঠিক সময়ে দেখা দেব। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’

    ‘একা গেলে মেয়েটাকে কী করে সামলে রাখব? ফিরতি পথে কুত্তী তো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে গোটা শহরের মানুষকে জাগিয়ে দেবে!’

    ওটা মোটেই কোন সমস্যা নয়, বলল রানা, ‘ঘুমিয়ে থাকবে সে। নিজে ওকে তুলে দেব তোমার গাড়ির ট্রাঙ্কে। আমার কথা বুঝতে পেরেছ? তারপর ওকে নিয়ে কী করবে, সেটা স্রেফ তোমার ব্যাপার। খুন করার আগে রেপ করাতে পারো দুই স্যাঙ্গাতকে দিয়ে। কাজ শেষে কুকুর দিয়ে খাইয়ে দিলেই বা আমার কী!’

    ‘তুমি খুব ভাল পযিশনে আছ, তা-ই না, রানা?’

    ‘ঝোপ বুঝে কোপ দিতে হলে বহু কিছু জানতে হয়। তুমি নিজেও আমার মতই বুদ্ধিমান মানুষ।

    ‘আমার হয়ে কাজ করবে? ভাল বেতন দেব। ধরো, প্রতি মাসে দশ হাজার ডলার।

    পকেটে পাঁচ মিলিয়ন ডলার এলে তোমার চাকরি করবে কোন্ শালা?’ চট্ করে হাতঘড়ি দেখল রানা। ‘এবার রওনা হও, মিস্টার মেয়র! হাতে পাবে মাত্র দু’ঘণ্টা। এরপর দেখা হবে কটেজে।’

    তেতাল্লিশ

    উত্তরা হাওয়া এসে দুলিয়ে দিচ্ছে উলোগাহ্ লেকের কালো, জল। রাতের আঁধারে জঙ্গলের ওপর দিয়ে কি-ই-ই-ই শব্দে দূরে চলে গেল এক মর্দা পেঁচা। কটেজের বারান্দায় জ্বলছে দামি লণ্ঠন। হলদেটে বাতি ঘিরে উড়ছে শতখানেক মথ। খুলে রাখা হয়েছে সদর দরজার তালা। আশা করা হচ্ছে একটু পর পৌঁছে যাবে এক বা একাধিক অতিথি। সামনের ঘরে বেজে চলেছে মোয়ার্টের বারো নং কনসার্টো। অ্যারন কনারের বিশাল সিডি কালেকশন দেখে বিস্মিত না হয়ে পারেনি রানা।

    এখন বাজে রাত তিনটে বিশ। একটু পর পৌঁছে যাওয়ার কথা অ্যারন কনারের। অথচ এরই ভেতরে সরু রাস্তা ধরে আসছে দুটো হেডলাইট। যদিও ওটা মেয়রের ব্যক্তিগত ক্যাডিলাক নয়, সাদা জিএমসি কমার্শিয়াল প্যানেল ভ্যান। এবড়োখেবড়ো পথে হোঁচট খেয়ে কটেজের সামনে থামল ওটা। বন্ধ করা হলো না ইঞ্জিন। সরাসারি বারান্দার ওপরে গিয়ে পড়েছে হেডলাইটের জোরালো আলো।

    রানা যা ভেবেছে, ঠিক তা-ই ঘটেছে। ঝুঁকি নিয়ে এ দিকে আসতে যায়নি অ্যারন কনার। ভ্যানের দু’দরজা খুলে নেমে পড়ল লিয়াম বার্ব ও টনি স্ক্যালেস। খোলা হলো পেছনের দরজা। হুড়মুড় করে নামল প্রায় দুই মেজরের ছয় সশস্ত্র স্যাঙাত। নিজেদের ভেতরে কোন কথা হচ্ছে না কারও। চেক করল অটোমেটিক অস্ত্র ক্রিস ভেক্টর। সবার কাছে যে পরিমাণ গুলি, তাতে যুদ্ধে খতম করে দিতে পারবে মাঝারি এক কোম্পানি সৈনিকদেরকে।

    পাশাপাশি থেমে কটেজ লক্ষ্য করে অস্ত্র তাক করল বার্বের লোকেরা। বারান্দার লণ্ঠনের আলো পড়ে তৈরি হয়েছে তাদের দীর্ঘ ছায়া। পরিবেশে চাপা উত্তেজনা। আজ কী করতে হবে, সবাইকে খুলে বলেছে বার্ব ও স্ক্যালেস। তারা লড়বে ভয়ঙ্কর একলোকের বিরুদ্ধে। শপিং মলের পাতাল গ্যারাজে একই লোক তাদের সঙ্গী ফিনির অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে ডজনখানেক গাড়ি। এক বা দু’বার নয়, তিনবার ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে। এজন্যে মাসুদ রানাকে সত্যিকারের কিংবদন্তী বলে ভাবছে বার্বের দলের লোকেরা। অবশ্য এটাও ঠিক, আজ আর কোনভাবেই বাঁচতে পারবে না বাঙালি লোকটা

    সবার মনে কাজ করছে ভয়। বারান্দার দিকে কয়েক পা গিয়ে মেগাফোন মুখে তুলল বার্ব। রাতের নীরবতা চিরে দিল .. তার কণ্ঠ: ‘ঠিক আছে, মাসুদ রানা! ভাল করেই জানো, আমরা কী কারণে এখানে এসেছি! মেয়েটাকে নিয়ে কটেজ থেকে বেরিয়ে এসো! চালাকি করবে না! মাথার ওপরে রাখবে দুই হাত! ডিভিডি আর মেয়েটাকে পেলে তোমাকে ছেড়ে দেব আমরা! কথা বুঝতে পেরেছ? দেরি না করে বেরিয়ে এসো কটেজ থেকে!’

    কটেজের ভেতরে বেজে চলেছে মোযার্টের সঙ্গীত। বাতাসের ধাক্কা খেয়ে আরেকটু খুলে গেল ভেজানো দরজা।

    ঘর থেকে বেরিয়ে এল না কেউ।

    ‘আমার কথা শুনতে পাচ্ছ, রানা?’ মেগাফোনে আবারও বলল বার্ব। ‘কোন ধরনের চালাকি করবে না! বাঁচার জন্যে তোমাকে স্রেফ পাঁচ সেকেণ্ড সময় দিলাম!’

    জবাব দিল না কেউ।

    ‘হারামজাদা কটেজে বসে কী করছে?’ দলের ডানে অস্ত্র হাতে নিচু গলায় বলল ম্যাট কালাহার।

    অস্বস্তি নিয়ে হাসল তার সঙ্গী মর্গ্যান। ‘মনে হয় মেয়েটাকে নিয়ে কটেজের বেডরুমে শুয়ে হাম্পু করছে। এত সুন্দরী মাল সহজে পাওয়া যায় না!’

    ‘যত বড় যোদ্ধা বা প্রেমিকপুরুষ হোক না কেন, আজ মরতেই হবে তাকে,’ বলল আরেকজন।

    কঠোর চোখে তাদেরকে দেখল বার্ব। নীরব হয়ে গেল সবাই। স্ক্যালেসের সঙ্গে চোখাচোখি হলো বার্বের। ‘কুকুরের বাচ্চা নিজে থেকে বেরোবে না,’ ফিসফিস করল স্ক্যালেস।

    কাঁধ ঝাঁকাল বার্র। ‘ঠিক আছে, আমরা আর অপেক্ষা করব না।’ মেগাফোন মাটিতে ফেলে দিল সে। অ্যারন কনারের নির্দেশ পেয়ে সে বিরক্ত। তার ইচ্ছে ছিল মুখোমুখি হয়ে খতম করবে মাসুদ রানাকে। কিন্তু সেটা আর হলো না। এদিকে স্ক্যালেসের বুক ফেটে যাচ্ছে জ্যাকিকে ভোগ করতে না পেরে। আসলে কিছু নির্দেশ পালন করা সবসময় খুব কঠিন হয়!

    আজ রাতে তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সব ধরনের প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করে মাসুদ রানাকে গুম করতে। সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে বার্ব, আবারও যেন হাত থেকে ফস্কে না যায় লোকটা!

    ‘ঠিক আছে, কাঁধে ঝুলন্ত ক্রিস ভেক্টর হাতে নিল বার্ব। ‘এবার কাজ শুরু করো!’

    সেফটি ক্যাচ অফ করে অস্ত্র কাঁধে ঠেকাল সবাই। ট্রিগারে চেপে বসল আঙুল। সঙ্গে সঙ্গে খানখান হয়ে গেল রাতের থমথমে নৈঃশব্দ্য। বিকট আওয়াজ শুনে নীড় ছেড়ে আকাশে ছিটকে গেল ঘুমভাঙা একঝাক ভীত পাখি। গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হচ্ছে ওক কাঠের দেয়াল ও দরজা। প্রতি সেকেণ্ডে কটেজের দিকে যাচ্ছে এক শ’ ত্রিশটির বেশি গুলি। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে গুঁড়ো হলো বারান্দার রেইলিং। ধসে গেল জানালা। ভেঙে চুরচুর হলো হিউস্টন থেকে লিণ্ডা কনারের কেনা বারান্দার দামি কাঁচের লণ্ঠন।

    অস্ত্র রিলোড করে আবার গুলিবর্ষণ শুরু করল তারা। সামনের দেয়াল উড়িয়ে দিল প্রতি মিনিটে ষাট কেজি তামার বুলেট। ঝাঁঝরা হলো কটেজের ভেতরের অংশ। একটা গুলি স্তব্ধ করে দিল সিডি প্লেয়ার। নানাদিকের বা ফেটে যাওয়ায় একে একে নিভে গেল ভেতরের সব বাতি। ভ্যানের হেডলাইটের আলোয় কটেজটাকে এখন দেখাচ্ছে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাড়ির মত। কারও সাধ্য নেই প্রাণে বাঁচবে ওখানে। কাভার নিতে চাইলেও খুন হয়ে গেছে রানা আর মেয়েটা।

    মাথার ওপরে হাত তুলে নির্দেশ দিল বার্ব। হঠাৎ গুলি থেমে যাওয়ায় চারপাশে নেমে এল থমথমে নীরবতা। কটেজের ভেতরে ফিফি শব্দ করছে কী যেন। ওপর থেকে নিচের বারান্দায় ঠং করে পড়ল গুলিতে ভাঙা একটা পাইপ। মেঝের ওখানেই গুলি খেয়ে মারা গিয়েছিল হিউবার্ট হ্যারল্ড।

    একটু পর কটেজ বলতে আর কিছুই থাকবে না। ফেরার আগে সেটা নিশ্চিত করবে বার্ব ও স্ক্যালেস। ভ্যানে আছে চারফুট লম্বা ও দুইফুট চওড়া একটা বাক্স। ওটার ঢাকনি খুলে নিল বার্ব। খাতির আছে বলে ভেতরের জিনিসটা পেয়েছে দুর্নীতিপরায়ণ এক অ্যামুনিশন ডিপো চিফের কাছ থেকে। অস্ত্রটা নতুন লাইটওয়েট ভার্শন এম-৩২ ফোরটি- মিলিমিটার রোটারি গ্রেনেড লঞ্চার। জিনিসটা তৈরি করা হয়েছে ইউএস আর্মি স্পেশাল অপারেশন্স কমাণ্ডের জন্যে। সাধারণ রায়ট থেকে শুরু করে কেমিকেল ও অরফেয়ার বা হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা নিক্ষেপের জন্যে উপযুক্ত। মাত্র চার সেকেণ্ডে ছুঁড়বে ছয় রাউণ্ড গ্রেনেড। অস্ত্রটা হাতে পাওয়ার জন্যে অধৈর্য হয়ে গেছে মেক্সিকান ড্রাগ্‌স্ কার্টেল হার্ডি লোকো।

    লঞ্চারটা ভাল কি না, আজ জেনে নেবে বার্ব। ভ্যানের সামনে ফিরে বারান্দার দিকে গ্রেনেড লঞ্চার তাক করল সে। দ্রুত টিপতে লাগল ট্রিগার। বিধ্বস্ত কটেজে বিদ্যুদ্বেগে ঢুকে পড়ল ছয়টা গ্রেনেড। প্রায় একই সময়ে ফাটল ওগুলো। বোমার বিস্ফোরণে দেয়াল ও ছাত ফেটে আকাশে উঠে গেল। আগুনের বিশাল এক লাল গোলক। নানাদিকে ছিটকাল কাঠের টুকরো। দেয়াল বা আসবাবপত্র বলতে কিছুই থাকল না। বৃষ্টির মত আকাশ থেকে ঝরঝর করে ঝরল ভাঙা জিনিসপত্র। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেছে বার্বের দলের ক’জন লুঠেরা। লেলিহান আগুনের ভেতরে ধসে পড়েছে দোতলা ও প্রথমতলার ছাত।

    নতুন করে আর লঞ্চার রিলোড করল না বার্ব। কটেজের ভেতরের সব কিছুই পুড়ে গেছে গনগনে আগুনে। আজকাল যেখানে দেখা দেয় বার্ব আর স্ক্যালেস, সর্বনাশ হয়ে যায় সেই বাড়ির।

    ‘মজা কাকে বলে!’ হাসল স্ক্যালেস। জ্যাকিকে ভোগ করা গেল না বলে এখন মনে কোন দুঃখ নেই। কটেজে কোথাও চাপা পড়ে ছাই হচ্ছে মেয়েটার লাশ। খতম হয়ে গেছে মাসুদ রানা। আর কখনও বিরক্ত করতে আসবে না সে।

    ‘আমাদের কাজ শেষ, বলল বার্ব। ‘ডিইএ এজেন্টদের কনভয় উড়িয়ে দিতে হলে এই জিনিসই চাই। এবার খুশিতে নাচতে শুরু করবে মেক্সিকান ড্রাগ কার্টেলের ওরা।’ ঠোঁট থেকে মিলিয়ে গেল তার হাসি। ‘তা হলে আজকের মত শেষ হলো আমাদের পার্টি! চলো, এবার বাড়ি ফিরি!’

    স্বস্তি নিয়ে ধসে যাওয়া কটেজের কমলা আগুন দেখছে সবাই। আর একটা গুলিও ছুঁড়তে হবে না। উত্তপ্ত অস্ত্র হাতে উঠে পড়বে নিজেদের ভ্যানে।

    ‘রাতটা ছিল সত্যিই দারুণ!’ বলল মর্গ্যান।

    ‘কালাহার কোথায়?’ হঠাৎ করে বলল দলের একজন। সবার ওপরে চোখ বোলাল বার্ব। গুলি করার সময় ডানে ছিল কালাহার। ভ্যানে চেপে তারা এসেছে আটজন। টনি এবং তাকে বাদ দিলে দলে এখন আছে মাত্র পাঁচজন। তা হলে কোথায় গেছে ম্যাট কালাহার?

    ‘তোমরা ওকে দেখেছ?

    মাথা নাড়ল সবাই।

    ‘একটু আগেও আমার ডানে ছিল,’ জানাল জুন ম্যাস।

    ‘তা হলে গেছে কোথায়?’

    ‘আমি জানি না, বস।’

    ‘বোধহয় প্রস্রাব করতে গেছে,’ জঙ্গলের দিকে তাকাল স্ক্যালেস। ‘অ্যাই, ম্যাট! ফিরে এসো! আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে!’

    কুঁচকে গেছে বার্বের ভুরু। আগুনের কাঁপা কমলা আভায় রহস্যময় দেখাচ্ছে অরণ্যের গাছগুলোকে।

    ‘কালাহার?’ গলা ছেড়ে ডাকল বার্ব, ‘জলদি এসো! নইলে তোমাকে ফেলেই চলে যাব!’

    কিছুক্ষণ পার হয়ে গেলেও কোন জবাব এল না। এরই ভেতরে কটেজ থেকে অন্তত দু’ শ’ গজ দূরে সরে গেছে ম্যাট কালাহার।

    আঁধারে তার অচেতন দেহ কাঁধে তুলে হেঁটে চলেছে মাসুদ রানা!

    চুয়াল্লিশ

    পেছন থেকে মুখ চেপে ধরে ম্যাট কালাহারের ঘাড়ে সুঁই গেঁথে সিরিঞ্জের বেশ অনেকটা তরল ইনজেক্ট করা হয়েছে। ড্রাগসের প্রভাবে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে গেছে লোকটার। দেখার সময় ছিল না যে হামলা করেছে কে। বিসিআই থেকে যে ট্রেনিং দেয়া হয়, তাতে এজেন্টরা সবাই হয়ে ওঠে তুখোড় যোদ্ধা। একই প্রশিক্ষণের গুণে আঁধারে নিঃশব্দে এসে কালাহারকে অচেতন করে গভীর জঙ্গলে ধরে নিয়ে গেছে মাসুদ রানা।

    এখন ড্রাগসের প্রভাব কমে যেতেই অসহায় বোধ করছে ম্যাট কালাহার। এদিক-ওদিক তাকাল ঝাপসা চোখে। তাকে আনা হয়েছে বড় এক ঘরের ভেতরে। তবে সাধারণ ঘর নয়। মাথা কাজ করছে না বলে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কাঠের চেয়ারে বসলেও নাড়াতে পারছে না হাত-পা। একটু পর বুঝে গেল, অবশ নয় তার শরীর। চেয়ারের পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে দু’হাত। একইভাবে চেয়ারের পায়ায় আটকা পড়েছে দু’পায়ের গোড়ালি। জড়ানো দুর্বল কণ্ঠে কথা বলতে গিয়ে টের পেল, রুমাল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে তার মুখ। ব্যথায় দপদপ করছে মাথা, যখন-তখন বমি হবে। চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করতে চাইল সে। আর তখনই বুঝতে পারল, তার মুখের দিকে তাক করা আছে নলকাটা বন্দুকের বৃত্তাকার কালো মাল!

    একদম নড়ছে না ওটা!

    সামনের চেয়ারের পিঠ থেকে তাক করা হয়েছে বন্দুক।

    জ্ঞান ফিরতেই মুখের দিকে বারো গেজের বন্দুক চেয়ে আছে দেখতে পেলে প্যান্ট ভিজিয়ে দেয়া দোষের কিছু নয়। করুণ গোঙানি বেরোল ম্যাটের মুখ থেকে। সরে যেতে চাইল চেয়ার থেকে। অবশ্য বিন্দুমাত্র নড়ল না ভারী আসবার্ব। সামনের চেয়ারে বন্দুক কাঁধে নিয়ে গম্ভীর চেহারায় বসে আছে বাদামি রঙের এক যুবক।

    ‘তা হলে ফিরে এলে জগতে?’ বলল রানা। জঙ্গলের ধারে ক্যারোটিড আর্টারির অক্সিজেন বন্ধ করে কালাহারকে ধরে আনতে পারত। কিন্তু তাতে একটু পর ফিরে আসত তার চেতনা। ফলে বহুক্ষণ তাকে অজ্ঞান রাখতে গিয়ে সিরিঞ্জের তিনভাগের দু’ভাগ ড্রাগ দিয়েছে রানা। লোকটাকে কাঁধে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে গেছে ব্যারাকুডা গাড়ির কাছে। কালাহারকে ভরে দিয়েছে ট্রাঙ্কের ভেতরে। এরপর সরাসরি ফিরে এসেছে ওল্ড ইয়েলার ইনের উঠনে। ঘুম থেকে তুলে জ্যাকিকে সঙ্গে নিয়ে তিনঘণ্টা আগে ফিরেছে গ্যারাজে। ভেতর থেকে শাটার বন্ধ করে চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে দিয়েছে লোকটার হাত-পা। তারপর থেকে অপেক্ষা করছে।

    ‘আমি আসলে কোথায়?’ জানতে চাইল ম্যাট কালাহার। মুখে রুমাল বেঁধে রাখা হয়েছে বলে কোন কথাই বলতে পারল না সে।

    ‘তুমি আছ মস্ত বিপদে,’ বলল রানা। ‘আমার নাম মাসুদ রানা। আর এই মেয়ে জ্যাকি। আগেই আমাদের নাম তুমি জেনে নিয়েছ। তোমার বন্ধুরা তোমাকে ডাকে ম্যাট কালাহার বলে। তাই তোমার নাম আমি জানি। আরও বহু কিছুই জানি বার্ব ও স্ক্যালেসের ব্যাপারে। এ-ও জানতে বাকি নেই, তোমাদের বস হচ্ছে মেয়র অ্যারন কনার। এবার তোমার মুখের বাঁধন খুলে দিলে সব খুলে বলবে আমাকে। নইলে হয়তো আজই শেষ হবে তোমার প্রাণ।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে কালাহারের মুখের বাঁধন খুলল রানা। ঘাড় কাত করে মেঝেতে রক্ত মেশানো থুতু ফেলল লোকটা। ফিতার মত করে রুমাল এঁটে বসেছিল বলে কেটে গেছে ঠোঁটের দু’পাশে।

    ‘এবার কাজের কথায় এসো, চেয়ারে গিয়ে বসল রানা। কাঁধে তুলে নিয়েছে বন্দুকের কুঁদো। ‘তোমার মত বদমাশকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, মিথ্যা বললে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে বারো গেজের শটগানের গুলি কী ধরনের কাজ করে। কাজেই যা জানতে চাইব, সংক্ষেপে তার জবাব দেবে। মিথ্যা এড়িয়ে কথা না বললে তোমার কপালে তৈরি হবে রক্তের বার্না। বুঝতে পেরেছ আমার কথা?’

    ‘মরু, শালা, কুত্তার বাচ্চা!’ গালি দিলেও বন্দুকের ওপর থেকে চোখ সরাতে পারল না গলাহার। চোখে ভয়।

    চেয়ারে ঝুঁকে বসল রা। কী বললে, কালাহার? আবারও বলো তো? তোমার কথা মন দিয়ে শুনতে চাই তবে সেগুলো ভাল না লাগলে কী করব, সেটা তো বুঝতেই পারছ।

    ‘নরকে যা, শুয়োরের বাচ্চা!? কাঁপছে কালাহারের গলা। ‘যা খুশি কর! গুলি কর! আমার মুখ খোলাতে পারবি না!’

    তাকে কঠোর চোখে দেখল রানা। ‘মরার আগে তোমার শেষ কোন খায়েশ আছে, কালাহার?

    ‘কিছু বললে আমাকে খুন করবে বার্ব বা স্ক্যালেস। আমি কষ্ট পেয়ে মরতে চাই না। আমার আর কিছুই বলার নেই, কুত্তার বাচ্চা!’

    ধীরে ধীরে মেঝেতে বন্দুক নামিয়ে রাখল রানা। কালাহারকে খুন করলে কোন তথ্য পাবে না। কর্কশ হাসল রানা। ‘তবে তো আর কিছুই করার নেই! বোকা হাঁদা, তুমি ভুল করে জাগিয়ে দিয়েছ আমার সাইকোপ্যাথ মনটাকে!’

    বিস্ফারিত চোখে ওকে দেখে নিয়ে ঢোক গিলল কালাহার।

    নিচু গলায় বলল রানা, ‘মিনিট বিশেকের জন্যে গ্যারাজ থেকে বেরিয়ে যাও, জ্যাকি। বাইরে থেকে বন্ধ করে দেবে শাটার।’

    ‘আমি বরং এখানেই থাকি?’ আপত্তির সুরে বলল জ্যাকি।

    ‘তা সম্ভব নয়,’ বলল রানা। চোখ সরাচ্ছে না কালাহারের চোখ থেকে। ‘তোমাকে অতটা ভয় দেখাতে চাই না।’

    দ্বিধা করলেও কয়েক সেকেণ্ড পর মাথা দোলাল মেয়েটা। চলে গেল ইস্পাতের শাটারের সামনে। ঝুঁকে হ্যাণ্ডেল ধরে ওপরে তুলে দিল শাটার। ভেতরে এসে পড়েছে ভোরের লালচে রোদ। গ্যারাজের বাইরে পার্ক করা আছে প্লিমাউথ গাড়ি। চওড়া ঢাকা ও আর্চে জঙ্গলের ধুলোবালি। বাইরে বেরিয়ে গেল জ্যাকি। নামিয়ে কংক্রিটের সঙ্গে মিশিয়ে দিল শাটার। গ্যারাজে রয়ে গেছে রানা ও কালাহার।

    গাড়ির দরজা খুলে যাওয়ার আওয়াজ পেল রানা। ওর জন্যে বাইরে অপেক্ষা করছে মেয়েটা।

    গ্যারাজে নেমে এল থমথমে নীরবতা। ভয় নিয়ে রানাকে দেখছে ম্যাট কালাহার। কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

    ‘সবার মনেই থাকে কিছু কালো অশুভ চিন্তা, একটু পর বলল রানা। ‘কিন্তু আমারগুলো এতই কালো, যে এমন কী আমিও কখনও কখনও ভয় পেয়ে যাই।’ ধীরপায়ে ওঅর্কবেঞ্চের কাছে গেল রানা। চোখ বোলাতে লাগল যন্ত্রপাতির ওপরে। ‘একটু পর তুমি খুব ভয় পাবে। কারণ আমি যা করব, সেটা দেখলে তোমার মনে হবে মরে যেতে পারলে বেঁচে যেতে। একবার কাজ শুরু করলে আবার থামতে পারি না। সোনালি রোদের এই ভোরে এমন কিছু করে দেখাব, যেটা এমন কী বার্ব বা তার বন্ধু’ স্ক্যালেসও সারাজীবনে ভাববে না। তুমি বোধহয় জানো না, কালাহার, তুমি আছ আমার টর্চার সেলে। এখান থেকে তোমার লাশ যখন বেরোবে, ততক্ষণে তুমি হবে অদ্ভূত চার টুকরো।’

    ‘আমি কিছুই জানি না, ঈশ্বরের কসম!’ বেসুরো কণ্ঠে বলল কালাহার। ‘যা করতে বলেছে, সেটাই করেছি।’

    চকচক করছে রানার দু’চোখ। ঠোঁটে ফুটে উঠল ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হাসি। ‘আগেও অনেকে এ-কথা বলেছে। তবে কাজ একবার শুরু করলে নিজে থেকেই অনেক কথা বলবে। তোমার মত লোকেরা এই একই ভুল করে। একসময় বাঁচার জন্যে কাঁদে বাচ্চাদের মত। কিন্তু আমি একবার মজা পেয়ে গেলে তখন আর থামতে পারি না।’

    বেঞ্চ থেকে বল-পিন হাতুড়ি নিল রানা। হাঁটুর বাটি, বাহু, দাঁত বা খুলি ফাটাতে ওটা খুব কাজের জিনিস। চিন্তিত চেহারায় হাতুড়িটা দেখল রানা। তারপর বিরক্ত হয়ে ওটা বেঞ্চে রেখে হাতে নিল আরেকটা যন্ত্র। নরম সুরে বলল, ‘আগে কখনও ভেবেছ ত্বক, মাংস কেটে হাড়ের ভেতরে ধীরে ধীরে বোল্ট-ক্রপার গেঁথে বসলে কেমন মজা লাগে! তোমাকে ভাল করে দেখাচ্ছি কীভাবে কাজটা করতে হয়।’

    দেহ মুচড়ে চেয়ার ছেড়ে নেমে যেতে চাইল কালাহার। যদিও সেটা সম্ভব হলো না তার পক্ষে। বোল্ট-ক্রপার হাতে ধীর পায়ে এল রানা। চেয়ারের পেছনে যাওয়ার আগে একবার দেখে নিল হাতের যন্ত্রটা। এবার কী ঘটতে চলেছে সেটা বুঝতে পেরে গলা শুকিয়ে গেছে কালাহারের। বিড়বিড় করে বলল ‘ঈশ্বর! মাফ চাই! আমি মাফ চাই! হায় হায়, ঈশ্বর, মাফ করো তুমি!’

    বোল্ট-ক্রপার চেপে বসল ম্যাট কালাহারের কড়ে আঙুলের মাংসে! লোকটার কানে মধুর কণ্ঠে বলল রানা,

    একদম ভেবো না, এক এক করে সবই কেটে নামাব।’

    ব্যারাকুডা গাড়ির সিটে বসার একটু পর গ্যারাজের ভেতর থেকে করুণ এক আর্তনাদ শুনল জ্যাকি। ভয় পেয়ে বুজে ফেলল দু’চোখ।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমাসুদ রানা ৪৭১ : নরকের শহর
    Next Article মাসুদ রানা ৪৬৯ – কিলিং মিশন

    Related Articles

    কাজী মায়মুর হোসেন

    অদৃশ্য ঘাতক – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৬৮ – স্বর্ণলিপ্সা

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    ধাওয়া – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মৃত্যু উপত্যকা – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    খুনে ক্যানিয়ন – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৪৮ – মৃত্যুঘণ্টা

    July 25, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }